ঘটনার ঘনঘটা – ২

তপন বলল, হ্যাঁ, আমি তোর রেকর্ড প্লেয়ারটা কিনতে পারি, যদি তুই ওটা অন্য এক জায়গায় ডেলিভারি দিয়ে আসতে পারিস।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, হ্যাঁ, রাজি আছি। কোথায় পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে, বল!

তপন মিটিমিটি হেসে বলল, ঠিক দিয়ে আসবি তো?

এর আগে আমি ছোটমামার এই রেকর্ড প্লেয়ারটা অন্তত সাতাশজনকে গছাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। কয়েকজন তো পাত্তাই দিতে চায়নি। কয়েকজন ঠাট্টা করে বলেছে, এই জাংটা কোথা থেকে তুলে আনলি? নিলয়দা বলেছিলেন, আমার বাড়িতে ওরকম একটা পড়ে আছে, তুই নিয়ে যেতে পারিস। ফ্রি।

এদিকে ওটাকে উপলক্ষ করে আমার ছোটমামার সংসারে গৃহশান্তি নষ্ট হবার উপক্রম। নতুন মামিমা চান একটা টু–ইন–ওয়ান কিনতে। কিন্তু ছোটমামা খুব স্ট্রিক্ট প্রিন্সিপালের মানুষ। পুরোনোটা বিক্রি না করে নতুন কিছু কিনবেন না। টাকার প্রশ্ন নয়, নীতির প্রশ্ন। ফলে ও বাড়িতে গানের বদলে সর্বক্ষণ ঝগড়া শুনতে পাওয়া যায়।

ছোটমামা আবার নিজের মুখে কারুকে ওটা বিক্রির কথা বলতে পারবেন না, তাতে তাঁর সম্মানে লাগে। ফলে, আমিই তাঁর একমাত্র সেলসম্যান। এর মধ্যে আমি কিছু কিছু সেল্সটক্ রপ্ত করে ফেলেছি। প্রথমেই ক্যাসেটের নিন্দে করতে শুরু করি। বাজারে অধিকাংশ ক্যাসেটই ভেজাল। প্রি–রেকর্ডেড যেসব গানের ক্যাসেট সস্তায় কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলো শুনলে মানুষ দিন দিন অসুর হয়ে ওঠে। আর যেহেতু ব্যাড কয়েনস ড্রাইভ আউট গুড কয়েন্‌স, সেই রকমই ভেজাল ক্যাসেটের অত্যাচারে খাঁটি ক্যাসেট বাজারে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। রেকর্ড হচ্ছে খানদানি জিনিস। খাঁটি মিউজিক, সূক্ষ্ম সুরের কাজ শুনতে হলে এখনো রেকর্ড ছাড়া উপায় নেই…

তপনের ওপর আমি বিশেষ ভরসা করিনি। তপন আমার চেয়ে বছর চারেক মাত্র বড়। কিন্তু ছেলেবেলায় একসঙ্গে ফুটবল খেলেছি বলে ওকে আমি নাম ধরেই ডাকি। যদিও আমার তুলনায় তপন অনেক উঁচুতলার মানুষ। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই, ভালো চাকরি পেয়েছে। এর মধ্যে জাপান ঘুরে এলো একবার। তাছাড়া প্রায়ই দিল্লি–বোম্বাই যায় অফিসের কাজে। গত বছর বিয়ে করেছে, শ্বশুরের কাছ থেকে গাড়ি পেয়েছে। সে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কোনো জিনিস কেনার খদ্দের নয়। এমনিই এ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম বলে তপনকে একবার বাজিয়ে দিতে চেয়েছিলাম!

তপন এখনো রেকর্ড প্লেয়ারটা চোখেই দেখেনি। তবু রাজি হয়ে গেল? দামও জানতে চায়নি।

তপন একটা প্যাড টেনে নিয়ে বলল, তাহলে তোকে আমি ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। যাওয়া আসার খরচও আমি দেব। তোকে শুধু পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।

—যাওয়া–আসার খরচ দিতে হবে না। কিন্তু তুই জিনিসটা আগে দেখবি না?

–তোর মুখের কথা আমি অবিশ্বাস করব? তুই তো বলছিস যন্তরটা চালু অবস্থায় আছে!

–হ্যাঁ। চালু তো আছেই, খুব ভালো কোম্পানির জিনিস। অ্যাজ গুড অ্যাজ নিউ। সঙ্গে চারখানা রেকর্ড ফ্রি।

—তবে তো আর কোনো কথাই নেই। কত যেন দাম বললি?

—জিনিসটা তো আমার নিজের নয়, ছোটমামার। উনি সাড়ে সাত শো চাইছেন। অবশ্য বলে–কয়ে…

—ঠিক আছে। আমি চেক লিখে দিচ্ছি। কার নামে লিখব, তোর নামে?

–না–না, আমার নামে না। আমার কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। ছোটমামার নামে লিখতে হবে।

–তোর নামে চেক নিবি না? তা হলে তুই তোর কমিশান পাবি?

— কমিশান? আমার ছোটমামার কাছ থেকে আমি কমিশান নেব নাকি? যাঃ!

আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে তপন বলল, নীলু, তুই আর মানুষ হলি না! এই জন্য তোর কিছু হবে না। আজকালকার দিনে ছোটমামা–বড়মামা, কাকা–জ্যাঠা যেই–ই হোক, তুই কারুর হয়ে একটা কাজ করে দিলে তার পারিশ্রমিক নিবি না? তুই যে এতটা সময় নষ্ট করছিস, তার কোনো দাম নেই?

আমিও হাসলুম। খুব বড়লোকদের মতন আমি একটা জিনিসই যত ইচ্ছে খরচ করতে পারি, সেটা হচ্ছে সময়। সুস্থ অবস্থায় গোটা একটা দিন বিছানায় শুয়ে পা নাড়ালেও কেউ আমায় কিছু বলবে না। কটা বড়লোক এই আরাম উপভোগ করতে পারে!

তপনকে বললুম, চেকটা তুই আমার ছোটমামার নামেই লিখে দে। কারুকে খুশি করতে পারাও তো অনেক কিছু পাওয়া। তাছাড়া, এরপর যখন তখন নতুন মামিমার কাছে খিচুড়ি খেতে চাইলেও মনের মধ্যে কোনো গ্লানি হবে না।

তপন প্রথমে চেকটা লিখল, তারপর একটা কাগজে একটা ঠিকানা লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কবে যেতে পারবি, বল?

ঠিকানাটা দেখে আমি থঃ—

অনুপমা সেন
রাজার বাঁধ
ভায়া ইব্রাহিমপুর
জেলা : বীরভূম।

চোখ কপালে তুলে আমি জিজ্ঞেস করলুম, রেকর্ড প্লেয়ারটা বীরভূমে পৌঁছে দিতে হবে?

তপন একগাল হেসে বলল, তুই কথা দিয়েছিস, নীলু। সেই অনুযায়ী ডিল হয়েছে। চেক লিখে ফেলেছি। এখন ব্যাক আউট করতে পারবি না!

অত দূরে যেতে হবে! বলিসনি তো আগে?

—সেই জন্যই তো তোকে ভাড়া অফার করেছি। এটার জন্য যখন তুই কোনো কমিশান পাবি না, তোর আমি ক্ষতি করতে চাই না। ভাড়া–টাড়া সব দিয়ে দেব। যা না ঘুরে আয়। তোর ভালো লাগবে।

–এই অনুপমা সেন কে?

–আমার প্রথম প্রেমিকা। বিবাহিতা মহিলা…আমার নাম করে তোকে চুপি চুপি দিয়ে আসতে হবে। দেখিস, অন্য কেউ যেন টের না পায়।

–ভাই তপন, আমি ওসব ঝঞ্ঝাটে যেতে চাই না!

তপন এমন হাসতে লাগল যেন খুব একটা মজা পেয়েছে। আমার প্রায় সব কথাতেই হাসছে—আমি কি চার্লি চ্যাপলিন নাকি?

–দ্যাখ নীলু। তোর কাছ থেকে সাড়ে সাত শো টাকা দিয়ে আমি যেটা কিনলুম, সেটা কোনো রেকর্ড প্লেয়ার নয়। সেটা একটা আইডিয়া। তোর কথা শোনা মাত্র আমার মাথায় আইডিয়াটা এলো। সেজন্য তোকে ধন্যবাদ। এখন তুই যদি এই জিনিসটা বীরভূম পৌঁছে দিয়ে আসতে পারিস, তা হলে আমি যথার্থ খুশি হবো। তুই তোর মামা–মামিমাকে খুশি করার জন্য এত পরিশ্রম করছিস, তুই আমার জন্য এইটুকু করবি না?

—ভাই তপন। তোকে খুশি করার জন্য আমাকে বীরভূমের এক গ্রামে মার খেতে পাঠাবি। এটা কি ঠিক? শুনেছি বীরভূমের লোকেরা লাঠির বদলে লোহার শাবল–টাবল দিয়ে মারে!

তপন আর একগাল অট্টহাসি চালাল। ও যেন আজ হাসি দিয়ে গলা সাধছে।

সিগারেটের প্যাকেট বার করে আমাকে একটা দিয়ে খানিকটা শান্ত হয়ে বলল, নীলু, তোর জীবনের প্রথম প্রেমিকা কে ছিল আমি জানি না। কিন্তু আমার জীবনের প্রথম প্রেমিকা আমার মা। মাকে আমি পাগলের মতন এখনো ভালোবাসি অনুপমা নামটা শুনলে ঠিক মা মা মনে হয়। তাই না? কিন্তু আমাদের মায়েরাও এক সময় আধুনিকা ছিল। মাত্র বারো–চোদ্দ বছর আগেও আমার মা সেজেগুজে বাবার সঙ্গে পার্টিতে যেতেন। আমার মাকে তো তুই দেখেছিস?

আমি মাথা নাড়লুম। তপনের মাকে আমি কাকিমা বলে ডেকে এসেছি। কোনোদিন তার নাম জানার প্রয়োজন হয়নি।

তপন আবার বলল, বাবা মারা যাবার পর মা নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে। আমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে জানিস তো? আমি বিয়ে করার পর মা হঠাৎ ঠিক করল আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। তা বলে ভাবিস না আমার বউয়ের সঙ্গে মায়ের ঝগড়া হয়েছে। টুনটুনির সঙ্গে আমার মায়ের খুব ভাব। কিন্তু মায়ের ধারণা শাশুড়ি–বৌয়ের অনেকদিন ভাব রাখতে গেলে একটু দূরে দূরে থাকা দরকার। আমি আর টুনটুনি মাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি। মা তবু জেদ করে গ্রামে চলে গেল। সে বাড়ি ভাঙাচুরো অবস্থায় পড়েছিল, সারিয়ে– টারিয়ে নেওয়া হয়েছে বটে। কিন্তু মা সেখানে একলা একলা থাকবে, এটা ভাবলে আমাদের ভালো লাগে?

আমি বললুম, সেইজন্যই কাকিমাকে অনেকদিন দেখিনি।

— মা বছরে একবার কলকাতায় থাকবে ঠিক করেছে। তার ফলে আমাদেরই এখন গ্রামে যেতে হয়।

–তুই মাঝে মাঝে যাস?

—হ্যাঁ, যাই, কিন্তু অফিসের কাজকর্ম থাকে, কত আর ঘন ঘন যাওয়া যায় বল্। আমাদের কাজে শনি–রবিবারেও ছুটি নেই। আমি আর টুনটুনি গত মাসেই গিয়েছিলুম।

–তুই আবার যখন যাবি, তখন নিয়ে যাস রেকর্ড প্লেয়ারটা।

–আমার কথাটা শোন, নীলু। গত মাসে যখন গেলুম, তখন একটা জিনিস দেখে আমার খটকা লেগেছিল। না সব সময় রেডিও চালিয়ে রাখে। এমনকি রান্নাঘরে রান্না করার সময়েও পাশে রেডিও চলে। আগে কোনোদিন মায়ের রেডিও শোনার এত শখ দেখিনি। এখন একা একা থাকেন তো, কথা বলারও কোনো সঙ্গী নেই। তাই রেডিওর শব্দটাই…কিন্তু সারাদিন ধরে রেডিও প্রোগ্রাম শোনা কী কষ্টকর ভেবে দ্যাখ! যা সব অসহ্য প্রোগ্রাম হয়…।

—গ্রামে থাকলেই সবাই রেডিও বেশি শোনে।

—কিন্তু আমার মা তো গ্রামের মেয়ে নয়। আমার বাবার দেশ বীরভূমে কিন্তু মামাবাড়ি ভবানীপুরে। তুই যখন এ রেকর্ড প্লেয়ারটার কথা তুললি, অমনি চট করে মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেল। মাকে যদি ঐটা পাঠানো যায়, আর কিছু কিছু রেকর্ড, তা হলে মা ইচ্ছে মতন গান–বাজনা শুনতে পারে। মা অতুলপ্রসাদের গান খুব ভালোবাসে। রেডিওর গান–বাজনা তো বেশির ভাগ সময়েই—

—কিন্তু জিনিসটা তুই নিজে গিয়ে দিয়ে এলে ভালো হতো না?

—শোন, আমার বাড়িতে একটা প্রায় নতুন রেকর্ড প্লেয়ার আছে। সেটাই তো মাকে দিতে পারতুম, পারতুম না? কিন্তু আমার মা–টা যে দারুণ জেদি আর অহংকারী। এটা দিতে গেলে মা কিছুতেই নিত না। মা ভাবত আমরা নিজেদের অসুবিধে করে স্যাক্রিফাইস করছি। দ্বিতীয় কথা, আমি যদি আর একটা রেকর্ড প্লেয়ার হাতে করে নিয়ে যাই, মা বলত, আমি টাকা বাজে খরচ করছি, ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু তুই নিয়ে গেলে ফিরিয়ে দেবে না। তৃতীয়ত, আমাকে বোম্বেতে একটা ট্রেনিং–এর জন্য যেতে হচ্ছে, দু’ মাসের মধ্যে ফিরতে পারব না। দু’ মাস গ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়। আইডিয়াটা যখন মাথায় এসেছে, তখন দু’ মাস অপেক্ষা করা কি ঠিক? তুই–ই বল!

তপনের প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত আছে। আমার সেরকম একটাও যুক্তি নেই। পট করে একটা মিথ্যে অজুহাতও মনে পড়ল না। তার ফলে আমার চোখ দুটো ফ্যালফেলে হয়ে গেল।

তপন বলল, দা সুনার দা বেটার। তুই কালকেই বেরিয়ে পড়। আমাদের গ্রামটা প্রায় পশ্চিমবাংলা আর বিহারের বর্ডারে। আমরা হাফ–বিহারী বুঝলি, তোকে রুটটা বুঝিয়ে দিচ্ছি…

ছোটমামার বাড়িতে চেকটা পৌঁছে দিতে গিয়ে শুনলাম, ওঁরা দুজনেই রবিশঙ্করের বাজনা শুনতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে। বাইরে বেশ বৃষ্টি পড়ছে জমিয়ে, আমার একটু একটু খিচুড়ি খাওয়ার শখ হয়েছিল।

মামাতো ভাই পিন্টুকে সব বুঝিয়ে বলে, কয়েকটা রেকর্ড বেছে নিয়ে, রেকর্ড প্লেয়ারটি ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়লুম। ট্যাক্সি নিতে অসুবিধে নেই। তপন আমাকে পঁয়ষট্টি টাকা দিয়েছে।

হঠাৎ মনে হলো, আমি কলকাতায় কয়েকদিন থাকব না। আমি রাজকুমারীর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তার নামটা এখনো জানি না। কিন্তু আবার তাকে অন্তত একবার না দেখলে চলবেই না। সমস্ত নাচের আসরে ঘুরে ঘুরে ওকে খুঁজে বার করতেই হবে। শুধু শুধু আমার বুক কাঁপিয়ে চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবে! এ কি ছেলেখেলা নাকি?

রামপুরহাট থেকে ইব্রাহিমপুর, সেখান থেকে সাইকেল রিক্সা। রাজার বাঁধ তিন মাইলের মতন রাস্তা। একটা জিনিস তপনেরও মাথায় আসেনি। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। রাজার বাঁধে ইলেকট্রিসিটি আছে তো? এই রেকর্ড প্লেয়ারটা তো ব্যাটারিতে চলবে না। তা হলে এতখানি আসাটাই পণ্ডশ্রম।

রিক্সাওয়ালার সঙ্গে গল্প জমাতে গিয়ে প্রথম প্রশ্নটাতেই গণ্ডগোল করে ফেললুম। যে–কোনো আলাপে প্রথম বাক্যটিই আসল। কোনো কারণ নেই, বেমক্কা জিজ্ঞেস করলুম, ভাই, এখানে কি খুব বৃষ্টি চলছে এখন?

লোকটি গড়গড়িয়ে উত্তর দিল, কেন, আপনার খুব বৃষ্টি দরকার নাকি? বৃষ্টির জ্বালায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তার ওপরেও আপনার বৃষ্টি চাই?

লোকটির নাম দেওকীনন্দন। বাংলা বলে জলের মতন, কিন্তু, বৃষ্টি পছন্দ করে না। বৃষ্টিতে ওর জীবিকার ক্ষতি হয়। কলকাতা শহরে বৃষ্টির সময় রিক্সাওয়ালাদের পোয়াবারো। কিন্তু এখানে বৃষ্টির সময় লোকে সহজে ‘রাস্তায় বেরোয় না।

এর পরেই বিদ্যুতের কথা কী করে জিজ্ঞেস করি! যদি আবার বকুনি দেয়। আমি ভাবছিলুম, রাজার বাঁধে বিদ্যুৎ না থাকলে পত্রপাঠ এই রিক্সাতেই ফিরে যাব। ছেলের কাছ থেকে একটা অকেজো কলের গান উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছি, এটা দেখলে কাকিমা নিশ্চয়ই খুশি হবেন না।

রিক্সাওয়ালা নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করল, কলকেতায় জোর বৃষ্টি হচ্ছে বুঝি?

–খুব। সকালে স্টেশনে আসতে গিয়ে ভিজে গেছি।

—আপনারাই তো বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসেন!

—এদেশে তো জল জমে না। আমাদের কলকাতার সব রাস্তায় জল জমে যায়। বৃষ্টিতে আমাদেরই অসুবিধে বেশি হয়।

—এখানে ধান রোওয়ার সময় বৃষ্টির দেখা নেই। এখন অসময়ে দৈনিক ঝমঝমানি। আপনি রাজার বাঁধে কোন্ বাড়িতে যাবেন?

–সেন বাড়ি।

–কোন্ সেন। তিনজন আছে। কবিরাজ বাড়ি?

—না। একজন ভদ্রমহিলা একা থাকেন। কলকাতা থেকে এসেছেন।

–অ, বুঝিচি, নাড়ু গিন্নির বাড়ি।

—নাড়ু গিন্নি মানে?

ওনার বাড়িতে অতিথি গেলেই উনি দু’খানা করে নাড়ু আর জল খেতে দ্যান। আমি দু’ তিনবার সওয়ারি নিয়ে গেছি। আমাকেও দিয়েছেন। মানুষটা ভালো। কোনো দেমাক নেই।

লাল ধুলোর রাস্তা, দু’পাশে উদাত্ত মাঠ, মাঝে মাঝে জঙ্গলের মতন। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মাটির রঙে একটা নয়নবিমোহন আভা এসেছে। এখানকার প্রকৃতি অনেকটা সাঁওতাল পরগনার মতন, আমার বড় প্রিয়। এই প্রথম ঠিক করলুম, এসেছি যখন, দু’তিন দিন থেকে যেতে হবে। পিওনের মতন জিনিসটা পৌঁছেই ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।

তপনের কথা শুনে মনে হয়েছিল, ওর মা কোনো দূর এঁদো পাড়াগাঁয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেরকম কিছু তো নয়। কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। গ্রামে যাওয়ার রাস্তাটিও বেশ চওড়া, মোটরগাড়ি যেতে পারে, বিদ্যুতের পোস্টও চোখে পড়ল। এ তো বেড়াবার মতন জায়গা।

বাড়িটার দু’ ধারে বাঁশবন ও আমবাগান, অনেকখানি জমি। আমাদের রিক্সা একটা সরু নদীর ধার দিয়ে দিয়ে গিয়ে, আমবাগানের মধ্য দিয়ে ঢুকে সেই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়াল।

বাড়িটি পুরোনো, বাগানের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে, একটু দূরে একটা আলাদা ঘর ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপের মতন ছাদহীন অবস্থায় পড়ে আছে। এই রকম পুরোনো বাড়িই আমার ভালো লাগে। রেকর্ড প্লেয়ারের ঝঞ্ঝাট না থাকলে, এই বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকাই উচিত ছিল।

পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা মানুষের মুখ বেশি মনে রাখে। আমি দু’ বার ডাকতেই কাকিমা বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে অবাক হলেন ঠিকই, কিন্তু চিনতে ভুল হলো না, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, নীলু তুই?

আমাকে দেখলেন প্রায় সাত–আট বছর বাদে, তার আগেও আমি তপনের বাড়িতে মাত্র দু’ তিনবারই গেছি। এই সাত–আট বছরে আমার চেহারার কিছু পরিবর্তন হয়েছে আশা করি!

–কাকিমা, আমি রামপুরহাটে একটা কাজে এসেছিলুম। আসবার আগে কলকাতায় তপনের সঙ্গে দেখা হলো, ওর কাছে শুনলুম, আপনি এখানে থাকেন।

–আয়, আয়, ভেতরে আয়!

–কাকিমা, আমি কিন্তু আজ রাত্তিরটা এখানে থাকবো।

—শুধু আজ রাত কেন, তোর যতদিন খুশি থাকবি।

রিক্সা থেকে আমার বোঝা, রেকর্ড প্লেয়ারের বাক্সটা নামালুম। কাকিমা সেটা দেখে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, নিশ্চয়ই ভাবলেন ওতে আমার কিছু মালপত্র আছে। ওটার কথা পরে বললেই হবে।

ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে শহুরে পোশাকের এক দম্পতি বসে আছে। ভদ্রলোকের বয়েস পঁয়তিরিশ ছত্রিশ হবে। মহিলাটি তিরিশের কাছাকাছি। কাকিমা এঁদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। হাতে চায়ের কাপ। কাকিমা পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভদ্রলোকের নাম চন্দন ব্যানার্জি, তাঁর স্ত্রীর নাম উজ্জয়িনী, স্বামীটি শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রীও ওখানকার লাইব্রেরিতে কাজ করেন। এঁরা কাকিমার প্রতিবেশী, মাসে একবার শান্তিনিকেতন থেকে এখানে চলে আসেন। কাকিমা আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই হচ্ছে নীলু, আমার ছেলের বন্ধু। খেলাধুলো করতে খুব ভালোবাসে।

খেলোয়াড় হিসেবে যে আমার কোনো রকম সুনাম আছে, তা এই প্রথম জানলুম। ছোটবেলায় ওদের বাড়ির সামনে মাঠটায় প্রত্যেক বিকেলেই খুব ফুটবল পিটতুম তো, কাকিমার সেই কথাই মনে আছে।

আমি জানি, এখন ওদের তিনজনের মনেই কোন্ প্রশ্নটি ঘুরছে। আমার বয়েসী একজন মানুষের পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না জানা যায় যে তার জীবিকা কী। বাঙালির ছেলে চাকরিই করবে, কোন্ চাকরি, কোথায় চাকরি, সেই অনুযায়ী আমাকে মাপা হবে।

ওঁদের কৌতূহল নিরসন করার জন্য আমি নিজে থেকেই বললুম, আমি বীরভূমের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাউল গান সংগ্রহ করছি। অল ইণ্ডিয়া রেডিও থেকে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে।

এটা একটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের ব্যাপার হলো। এটাকে ঠিক চাকরি বলা যায় না, আবার রেডিও–র গান সংগ্রাহকদের নামও প্রচার করা হয় না নিশ্চয়ই। বস্তুত, অল ইণ্ডিয়া রেডিও–র এরকম কোনো ব্যবস্থা আছে কি না তাই–ই বা কে জানে!

আমার কথা শুনেই চন্দন চমকে তার স্ত্রীর দিকে তাকাল।

উজ্জয়িনী ফিক করে হেসে বলল, আমিও তো এখন ঐ কাজই করছি। আপনি কতগুলো কালেক্‌ট করেছেন?

বিনা দ্বিধায় উত্তর দিলুম, সতেরোটা!

—অনেকগুলো কমন হয়ে যায়নি? একই গান একটু–আধটু পাল্টে আলাদা আলাদা বাউলরা গায়।

—হ্যাঁ। কমন তো থাকেই।

– তারপর দেখবেন, কোনো গান নতুন বলে মনে হবে। যে গাইছে সে তার নিজের লেখা বলে দাবি করবে। কিন্তু আসলে হয়তো অনেক আগে ছাপা হয়ে গেছে। পূর্ণ দাস বাউল এরকম একটা কালেকশান ছাপিয়েছে, সেটা দেখেছেন?

—পূর্ণ দাস বাউলের বই, হ্যাঁ। দেখেছি তো বটেই, আমি নতুন যেগুলো সংগ্রহ করি, ঐ কালেকশানের সঙ্গে মিলিয়ে নিই।

—আপনি কী কী পেয়েছেন, আমাকে একটু দেখাবেন? আপনি আমার সংগ্রহগুলোও দেখতে পারেন। যদি আপনার কাজে লাগে…

—আপনারটা দেখতে পেলে তো আমার অনেক উপকার হবে।

—কিন্তু সে তো এখানে নেই। শান্তিনিকেতনে আছে। অবশ্য প্রথম লাইনগুলো আমি মুখস্থ বলতে পারি।

চন্দন অস্থিরভাবে বলল, আঃ থামো তো। বাউল গানের কথা উঠলে তোমার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ভদ্রলোক সবে এসেছেন, একটু বসতে দাও!

কাকিমা বললেন, বোস নীলু, আমি তোর জন্য চা করে আনছি।

–না, কাকিমা। এক্ষুনি চায়ের দরকার নেই। আপনি বসুন। তপনরা সবাই ভালো আছে। ওরা তো গত মাসেই এসেছিল।

অন্য কোনো একটি ঘরে রেডিও বেজে চলেছে। তপন ঠিকই বলেছিল। রেডিওতে সেতার বাজছে।

চন্দন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জানেন, আপনাদের কাকিমা যে এখানে একা থাকেন, সেটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এখানে আজকাল বড্ড ডাকাতি হচ্ছে, গত সপ্তাহেই একটা ডাকাতি হয়ে গেছে আমাদের বাড়িতে। বাড়িতে দু’জন লোক ছিল, একজনকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছে, আর একজনের ঘাড়ে টাঙ্গির কোপ মেরেছে, একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে।

কাকিমা বললেন, ডাকাতরা এ বাড়ি থেকে কী নেবে? কিছুই তো নেই। আমাকে ওরা বিরক্ত করতে আসবে না।

চন্দন বলল, আপনি জানেন না, কাকিমা, আজকাল কী অবস্থা। চোররাও সব ডাকাত হয়ে গেছে। ঘটি–বাটি সাইকেল এই সব নেবার জন্যও দল বেঁধে ডাকাত আসে।

কাকিমা হেসে বললেন, আসুক না। আমি কোনোদিন নিজের চোখে জলজ্যান্ত ডাকাত দেখিনি। ওরা কি গায়ে রং মেখে আসে?

–কাকিমা, আপনি কথাটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। কিন্তু আমার মনে হয়, আপনার একজন দারোয়ান–টারোয়ান রাখা উচিত।

–আরে বলছি তো, আমার বাড়িতে দামী কোনো জিনিস নেই। ডাকাতরাও তা জেনে গেছে। থাকার মধ্যে আছে একটা ছোট রেডিও। সেটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড হিসেবে বিক্রি করলে পঞ্চাশ টাকাও পাবে না।

আমি রেকর্ড প্লেয়ারের বাক্সটির দিকে একবার তাকালুম।

কাকিমা একটা লালপাড় শাড়ি পরে আছেন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন। এখনও সে সৌন্দর্য মুছে যায়নি। শরীরে বার্ধক্যও প্রকট নয়। আসবার পথে রিক্সাওয়ালার মুখে কাকিমার প্রশংসা শুনেছি। এরকম মানুষের কাছে ডাকাতরা কখনো আসে না। এলেও দিনের বেলা আসবে, অন্য রকম পোশাকে।

একটু বাদে চন্দন আর উজ্জয়িনী বিদায় নিল। কাল সকালে ওদের বাড়িতে আমার চায়ের নেমন্তন্ন, বিকেলে ওরা ফিরে যাবে শান্তিনিকেতনে।

কাকিমা বললেন, আয় নীলু, তোর ঘর দেখিয়ে দিই। ট্রেন–জার্নি করে এসেছিস খুব ভিড় ছিল নিশ্চয়ই? বসার জায়গা পেয়েছিলি?

–না, দারুণ ভিড় ছিল।

—তা হলে একটু শুয়ে নিতে পারিস। বিকেলবেলা নদীর ধারটা ঘুরে আয়, খুব সুন্দর। দুপুরে খেয়েছিস তো?

—হ্যাঁ খেয়েছি। এখন এককাপ চা খেতে পারি।

কাকিমা আমাকে পাশের একটা ঘরে নিয়ে এলেন। সেখানে খাট–বিছানা পাতা আছে। তপনরা এলে নিশ্চয়ই এই ঘরে থাকে। একটা টেবিলের ওপর কয়েকখানা বই, পত্র–পত্রিকা আর তপনের কোম্পানির একটা প্যাড।

আমার শোওয়ার দরকার নেই, দরকার একটা সিগারেট টানার। আর খান কয়েক বাউল গান এক্ষুনি লিখে ফেলতে হবে। উজ্জয়িনী সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না।

আধঘণ্টা কাগজ–কলম নিয়ে ধস্তাধস্তি করেও বিশেষ সুবিধে হলো না। কিছু লিখতে গেলেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতন হয়ে যায়। এখনও অনেক লোক রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখে চলেছে শুনেছি। কিন্তু আমি সেরকম কিছু চালাতে গেলে উজ্জয়িনী ধরে ফেলবে, ও শান্তিনিকেতনের মেয়ে!

কী কুক্ষণে যে ঐ কথাটা বলে ফেলেছিলুম! কিংবা, ঐ সময় এ বাড়িতে চন্দন আর উজ্জয়িনীর উপস্থিত থাকার দরকার কী ছিল?

তিনটে সিগারেট পুড়িয়ে ও তপনের কোম্পানির প্যাডের পাঁচটা পাতা নষ্ট করে আমি ক্ষান্ত দিলুম। কবিতা কি সকলের হাতে আসে! গণ্ডার দিয়ে কি হাল– চাষ করানো যায়? নাঃ, এ উপমাটা ভালো নয়। ভিমরুলকে দিয়ে কি গান গাওয়ানো সম্ভব? এ উপমাটাও ভালো হলো না। যাক গে, আমার দরকার কী উপমা–টুপমা নিয়ে মাথা ঘামানোর?

রেকর্ড প্লেয়ারের বাক্সটি খুলে, সব কিছু ঠিকঠাক করে একটা অতুলপ্রসাদের রেকর্ড চালিয়ে দিলুম। এবাড়িতে বিদ্যুৎ আছে, ছোটমামার মেশিনটাতেও খুঁত নেই, আওয়াজ বেশ ভালো।

কাকিমা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। মুখখানাতে সরল বিস্ময়। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে বললেন, এ তো বাউল গান নয়, তুই এই গানও সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিস? আমার বাপু বাউল গান বেশি সহ্য হয় না।

—কাকিমা, আমার কাছে আরো বেশ কয়েকটা রেকর্ড আছে। দেখুন তো, এই গানগুলো আপনার পছন্দ?

রেকর্ডগুচ্ছ হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কাকিমা বললেন, বাঃ, এ তো সব ভালো ভালো গান রয়েছে রে! কতদিন এই সব গান শুনিনি! তুই এই সব নিয়ে ঘুরছিস কেন রে, নীলু? তোর কাজের জন্য দরকার তো একটা টেপ রেকর্ডার! –কাকিমা, এগুলো নিয়ে আমি ঘুরছি না। আপনার জন্য এনেছি।

–আমার জন্য? তুই এগুলো আমার জন্য এনেছিস?

—হ্যাঁ। তপন আপনাকে এই মেশিনটা পাঠিয়েছে। আমি এদিকে আসছি শুনে ও বলল আপনাকে পৌঁছে দিতে। কয়েকটা রেকর্ড এনেছি আমার ছোটমামার কাছ থেকে, এমনি পড়েছিল।

—খোকা আমাকে হঠাৎ এটা পাঠাল কেন?

–আপনি গান শুনবেন বলে।

— গান তো আমি রেডিওতে সর্বক্ষণ শুনছি। আমার আবার এত দামী জিনিসে দরকার কী?

—এটা এমন কিছু দামী নয়।

—রেকর্ড প্লেয়ারের কত দাম হয় আমি জানি না? একটু আগে শুনলি না, এখানে কী রকম ডাকাতি হয়? এই সব দেখলে ডাকাতদের লোভ পড়বে এ বাড়ির দিকে। না–না, ওটা আমার দরকার নেই। তুই ফিরিয়ে নিয়ে যাবি।

–না–না, কাকিমা, এটাতে আপনি গান শুনবেন। আপনার ভালো লাগবে।

—আমার অত গান শোনার দরকার নেই। তুই চাস এ বাড়িতে ডাকাতের হামলা হোক?

—ডাকাতরা জানবে কী করে? ভাববে রেডিও বাজছে।

— আজকালকার ডাকাতরা সব চেনে। তাছাড়া, তুই যে সাইকেল রিক্সায় এলি, ঐ লোকটাই বলে দেবে। ফেরার সময় তুই ঐ রিক্সাতেই যাবি, এটা সঙ্গে নিয়ে যাবি।

—কিন্তু কাকিমা, আমি তো সোজা কলকাতায় ফিরব না, আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। এরকম একটা ভারি জিনিস সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ঘোরা…

–সে আমি জানি না। তুই এনেছিস যখন, তোকেই ফেরত নিয়ে যেতে হবে। খোকাকে বলবি, এরকম হুটহাট করে যেন কোনো জিনিসপত্র না পাঠায়।

ওদের এখন বাচ্চা–কাচ্চা হয়েছে, অনেক খরচপত্র আছে। আমার জন্য এখন কিছু পাঠাতে হবে না। যাকগে, রেকর্ডগুলো যখন এনেছিস, শুনে নি।

কাকিমা বসে পড়লেন মেঝেতে, মঞ্জু গুপ্তর একখানা গান শুনতে শুনতে হঠাৎ নিজেও গেয়ে উঠলেন সেই গানটা। বেশ সুন্দর গলা! কাকিমা পিসিমাদের মুখে গান শোনার তো অভ্যেস নেই, তাই চমকে গেলাম প্রথমে। তারপরেই মনে হলো, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়–সুচিত্রা মিত্রও তো এই বয়েসীই হবেন। মঞ্জু গুপ্ত বেঁচে থাকলে আমার দিদিমার সমান হতেন।

সেই রাত্রে আমি একটা খুব গোলমেলে স্বপ্ন দেখলুম। তিনটে ডাকাত এসেছে, তার মধ্যে একজন হচ্ছে আমার রিক্সাওয়ালা দেওকীনন্দন, যে বৃষ্টি অপছন্দ করে। সে চোখ পাকিয়ে বলল, খুব যে কলকাতা থেকে বৃষ্টি নিয়ে এসেছ, এখন দাও, সব কিছু দাও! কাকিমা বললেন, এই নীলু, ওদের সঙ্গে তর্ক করিস না, রেকর্ড প্লেয়ারটা দিয়ে দে শিগগির…আমি তখন ভাবতে লাগলুম, রেকর্ড প্লেয়ারটা কার গেল, তপনের না আমার? কাকিমা ওটা ফেরত দিয়ে দিয়েছেন, তারপর ডাকাতে নিয়ে গেল…তপন বলবে, ডেলিভারি কমপ্লিট হয়নি, তুই দাম ফেরত দে! ছোটমামা বলবেন, তুই আমার জিনিসটা নিয়ে গেলি, আর ফেরত আনলি না, এখন বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছিস…। ঘামে আমার সারা গা ভিজে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *