ঘটনার ঘনঘটা – ৩

—তুমি শান্তিনিকেতনে আগে কখনো আসনি?

–না।

–সেকি? এমন কোনো শিক্ষিত বাঙালি ছেলেমেয়ে থাকতে পারে, যে একবারও শান্তিনিকেতন দেখেনি? এ তো আমি ভাবতেই পারি না!

– আমার আসা হয়নি, মানে অনেকবারই ভেবেছি। চেনাশুনো কারুকে পেলে তার বাড়িতে থেকে ভালো করে দেখব। কিন্তু চেনাশুনো তো কেউ ছিল না এতদিন।

—নীলু, তুমি এখানে এক সপ্তাহ থেকে যাও। উজ্জয়িনী ভালো আলু–পোস্ত রান্না করে আর বিউলির ডাল। সঙ্গে বেগুনভাজা কিংবা পেঁয়াজের বড়া। মাছ–মাংস বিশেষ পাবে না। বড্ড দাম। তবে দু’ একদিন রাত্তিরে ডিমের ঝোল পেতে পার। খাও–দাও ঘুরে বেড়াও, আর উজ্জয়িনীর সঙ্গে বাউল গান নিয়ে যত ইচ্ছে আলোচনা করো।

কথা বলতে বলতে চন্দনদা উঠে দাঁড়িয়ে এক সাইকেল আরোহিণী যুবতীকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। এই হাসি, হাসি, এদিকে শুনে যা!

শরীরে বিদ্যুৎ–তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে যাবার ব্যাপারটা যে কী, তা এই প্ৰথম টের পেলুম। আমার চোখের পলক পড়তে ভুলে গেল। বুকের মধ্যে লাবডুপ লাবডুপ শব্দটাও বুঝি থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

আমার জীবনে কোনো যুক্তি নেই। কোনো কার্যকারণ নেই। কোনো নির্দিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে ওঠা–নামা নেই। সবই যেন এক আকস্মিকতার মালা।

শেকসপীয়ার সরণির মোড়ে এক বৃষ্টি–পড়া সন্ধেবেলা আমি দাঁড়িয়ে না

•থাকলে কিংবা দু’এক মিনিট আগে সেখান থেকে চলে গেলে চলন্ত বাসের জানলা থেকে রাহুলদা আমায় দেখতে পেতেন না। তা হলে তিনি চ্যারিটি শো–এর টিকিট গছাতে পারতেন না আমাকে। তা হলে সেই সন্ধ্যায় রাজকুমারী–বেশিনী এক যুবতী নর্তকীকে দেখে আমার বুক কাঁপত না।

সে না হয় হলো। ছোটমামার রেকর্ড প্লেয়ারটা তপনের কেনার কি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল? সে আমাকেই সেটা পৌঁছে দিতে বলল রাজার বাঁধে, সেখানে দৈবাৎ দেখা চন্দনদা ও উজ্জয়িনীর সঙ্গে। চায়ের আসরে এমন আলাপ হয়ে গেল যে ওরা আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে এলো শান্তিনিকেতনে। এর মধ্যে যে–কোনো একটা কিছু তো এদিক ওদিক হয়ে যেতে পারত।

এই ঘটনাচক্রের যে–কোনো একটা পেরেক আলগা হয়ে গেলে রাজকুমারীর সঙ্গে আমার আর দেখা হতো না!

হাসি হাত তুলে বলল, আসছি, চন্দনদা, একটু পরেই আসছি।

সাইকেলটা একটা বাঁক নিয়ে চলে গেল ডানদিকের রাস্তায়। একটা যেন গোলাপি রঙের ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ এসে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল আমার চোখের সামনে থেকে।

রাজকুমারীকে এখানে আচমকা দেখতে পেয়ে আমার তো খুশি হবার কথা, কিন্তু আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কেন! বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। একটু বাদে হাসি এখানে এলে তার সঙ্গে আমি কী কথা বলব? আমি কে, কেউ না!

সে আসবার আগেই কেটে পড়লে হয়। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, চন্দনদা, আমি একটু শ্রীনিকেতনের দিক থেকে ঘুরে আসি!

ডান হাতের তর্জনী নাচিয়ে চন্দনদা বললেন, বসো, বসো। উজ্জয়িনী আসুক আগে। তুমি একলা একলা কী যাবে। কিছুই দেখতে পাবে না। একজন কারুকে সঙ্গে দেব, তখন যেও!

–আমার একলা একলা ঘুরতেই বেশি ভালো লাগে।

—ঘুরবে। একলা একলা ঘোরার অনেক সময় পাবে। আচ্ছা বলো তো নীলু, গুরুদেবের শেষ দশ বৎসরের লেখা তোমার কেমন লাগে?

–গুরুদেব কে?

—তুমি জানো না গুরুদেব কে? তুমি কি বাঙালির ছেলে? শান্তিনিকেতনে গুরুদেব বলতে একজনকেই বোঝায়।

—রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান, তখন আপনার জন্মই হয়নি। তা হলে উনি কী করে আপনার গুরুদেব হলেন?

–ওসব কথা বাদ দাও! ঐ কবিতাগুলো কেমন লাগে তাই বলো।

— আমি গুরুদেবের কোনো লেখাই পড়িনি। রবীন্দ্রনাথের সব লেখাই আমার ভালো লাগে। মানে যতটা বুঝতে পারি, সব তো আর বুঝি না!

–শেষের দিকে, তোমার মনে হয় না, কবির ওপর দার্শনিক সত্তা বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে!

–ওসব শক্ত শক্ত প্রশ্ন আমায় কেন জিজ্ঞেস করছেন, চন্দনদা?

—এই বিষয়ে আমি একটা পেপার লিখেছি, বুঝলে, বেশি বড় নয়। পঞ্চাশ– ষাট পাতা হবে। সেটা শুনলে সব ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আমি একটা ঢোক গিলে বললুম, হ্যাঁ, শুনব। মানে, সন্ধের পর বেশ নিরিবিলিতে।

চন্দনদা মুখ কুঁচকে বললেন, সন্ধের পর প্রায় প্রত্যেকদিন লোডশেডিং। লেখাপড়া করার কি উপায় আছে? দাঁড়াও, খাতাটা নিয়ে আসছি!

পূর্বপল্লীর একপ্রান্তে এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে চন্দনদা। বেশ বড় বাড়ি, সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা। এক সময় সেখানে একটা বাগান করার চেষ্টা হয়েছিল। তার সামান্য চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝেই যাচ্ছে সাইকেল। দুপুর থেকেই ঝেঁকে ঝেঁকে আসছে বৃষ্টি, খুব প্রবল নয়। হালকা হালকা। যেন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সোজা নামছে না। উড়তে উড়তে আসছে।

কাকিমার কাছে অতিকষ্টে রেকর্ড প্লেয়ারটা রেখে আসা গেছে। পরে কোনো এক সময় আমি ফেরত নিয়ে যাব, এই কড়ারে। সকালবেলা চন্দন–উজ্জয়িনীর বাড়িতে গিয়ে এমন ভাব জমে গেল যে ওদের সঙ্গেই আসতে হলো শান্তিনিকেতনে। চন্দন হয়ে গেল চন্দনদা আর উজ্জয়িনীর সঙ্গে তুমি–তুমি সম্পর্ক।

চন্দনদার মধ্যে একটা পিঠ চাপড়ানির ভাব আছে। উনি ধরেই নিয়েছেন আমি একটি পথভ্রষ্ট ছোকরা। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। ঠিক লাইনে পড়াশুনো করিনি। এই ধরনের উটকো ছেলেদের উপদেশ দিয়ে, নিজের জীবনদর্শন দিয়ে অনুপ্রাণিত করে উনি ঠিক পথে চালাতে চান। চন্দনদা আমার ট্রেনের টিকিট কেটেছেন জোর করে, কিন্তু তারপর থেকে উনি আমাকে অনবরত জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন। উজ্জয়িনী অবশ্য থামাবার চেষ্টা করছে মাঝে মাঝে।

রাজকুমারীর ডাকনাম তা হলে হাসি। ভালো নাম নিশ্চয়ই রাজকুমারী নয়। সে কি এখানকার ছাত্রী, না এখানকার কারুর আত্মীয়া? তার সাইকেল চালানোর মধ্যে এমন একটা সাবলীলতা আছে যে মনে হয়, সে এখানে অনেক দিন আছে। কলকাতার মেয়েরা এমন সাইকেল চালাতে পারে না। রাজকুমারীকে এখানেই মানায়।

চন্দনদা হাতে একটা মোটা ফাইল নিয়ে ফিরে এলো। মুখে জ্বলন্ত চুরুট। আমি লক্ষ্য করেছি, অনেকেরই চুরুট টানতে গেলে ভুরু দুটো উঁচু হয়ে যায়, তাতে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব আসে।

তা হলে এই বৃষ্টির বিকেলে আমাকে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ শুনতে হবে? এখন হঠাৎ দাঁত–মুখ খিঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে কেমন হয়? পরে বলব, আমার মৃগীরোগ আছে!

এই সময়ে একটা সাইকেল রিক্সা থামল গেটের সামনে। উজ্জয়িনী ফিরে এসেছে। যাক বাঁচা গেল।

লাল টুকটুকে শাড়ি পরা উজ্জয়িনী ঝলমলে হাসি দিয়ে বলল, নীলু, কাত্যায়নদাকে এইমাত্র তোমার কথা বললুম। উনি তোমাকে একবার দেখা করতে বলেছেন। তোমার সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড।

চাণক্য নাটকের বাইরে আমি কাত্যায়ন নামটি এই প্রথম শুনলুম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সে আবার কে? তার বদলে বললুম, ও তাই নাকি?

কাত্যায়নদা রেডিওতে দু’বার বাউল গান বিষয়ে টক দিয়েছেন। বাউলদের সম্পর্কে অথরিটি।

—ওঁর বাড়িটা কোথায়! তা হলে যাই, ঘুরে আসি!

চন্দনদা বললেন, না–না, এখন না! উনি রাত্তির সাড়ে আটটার আগে কারুর সঙ্গে বাড়িতে দেখা করেন না। আটটার সময় ডিনার খেয়ে নেন তো।

উজ্জয়িনী বলল, হ্যাঁ, সাড়ে আটটার পরই যেও, আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

তারপর চন্দনদার দিকে সকৌতুকে বলল, আমি ছিলুম না, এই ফাঁকে তুমি তোমার ঐ অখাদ্য প্রবন্ধটা বুঝি নীললোহিতকে শুনিয়ে দিয়েছ?

চুরুটের ছাই ঝেড়ে গম্ভীরভাবে চন্দনদা বললেন, তুমি সহজিয়া তত্ত্ব নিয়ে মেতে আছ, তাই এসব গভীর ব্যাপার তোমার মাথায় ঢোকে না। সব জিনিস সকলের খাদ্য নয়!

ভৎসনাটুকু একদম গায়ে না মেখে উজ্জয়িনী বলল, জানো, আজ রাজাকে দেখলুম। রতনকুঠির দিকে গেল। ও এখন প্রত্যেক উইক এণ্ডে আসতে শুরু করেছে। আর তর সইছে না!

চন্দনদা ‘তাই নাকি’ বলে হা হা করে হাসতে শুরু করলেন। উজ্জয়িনীরও হেসে গড়াগড়ি যাবার মতন অবস্থা।

এটা ওদের প্রাইভেট জোক, এর মধ্যে আমার মাথা গলানোর কোনো মানে হয় না। আমি আকাশ দেখতে লাগলুম। এক ঝাঁক বক দিনের শেষে কুলায় ফিরছে। অন্ধকার হয়ে এলো প্রায়।

উজ্জয়িনী হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা চা খেয়েছ?

চন্দনদা বললেন, না, মানে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম।

—তুমি নীললোহিত বেচারাকে এককাপ চা–ও খাওয়াও নি? ছি ছি ছি ছি। আমি এক্ষুনি চা করে আনছি!

—শোনো, বিস্কুট কেনা হয়নি। চায়ের সঙ্গে যদি একটু নিমকি–টিমকি ভেজে দিতে পারো…

উজ্জয়িনী রান্নাঘরে চলে যেতেই আলোটা জ্বেলে দিলেন। তারপর আমার দিকে ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে এবারে শুরু করা যাক? আমি সামান্য ঘাড় হেলিয়ে মিনমিন করে বললুম, হ্যাঁ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে…

চন্দনদা ফাইলটা খুলে একবার গলা খাঁকারি দিলেন। তারপর সবেমাত্র পড়তে শুরু করলেন, জীবন জিজ্ঞাসা যখন জীবন দেবতার কাছে এসে পৌঁছোয়, পথের অনুসন্ধান যখন হৃদয়ের আবিষ্কারে পরিণত হয়…তার পরেই আলো নিভে গেল। শুধু এ বাড়িতে নয়, গোটা শান্তিনিকেতন অন্ধকার।

স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডকে অনেক ধন্যবাদ। ওঁরা জানেন, ঠিক ঠিক কখন লোডশেডিং করতে হয়। আমার মতন আরো কত মানুষের উপকার করবার জন্য কোথায়, কোন সময় লোডশেডিং করতে হবে। সেই হিসেব রাখতেই ওঁরা হিমসিম খেয়ে যান।

চন্দনদা বললেন, যাচ্ছেতাই! এই জন্য মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কলকাতায় চলে যাই।

—কলকাতায় সন্ধেবেলা অন্ধকারে বসে গরমে ঘামতে হয়। এখানে তো তবু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আপনার লেখার বিগিনিংটা কিন্তু দারুণ চন্দনদা! জীবন জিজ্ঞাসা থেকে জীবন দেবতা…অপূর্ব। জীবন দেবতা কথাটা অন্তত এক হাজার বার পড়েছি আর শুনেছি, কিন্তু আপনার মতন এমন ঠিক ঠিক ভাবে আগে কেউ ব্যবহার করতে পারেনি।

–আর একটু শুনলে বুঝতে পারতে, গুরুদেবের কবিতার একটা নতুন ইন্টারপ্রিটেশান…

গেট ঠেলে একটা সাইকেল ঢুকল চত্বরে। একটি সুরেলা গলা চেঁচিয়ে বলল, চন্দনদা, বাড়িতে আছেন তো!

চন্দনদা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসো হাসি। উজ্জয়িনী, এককাপ চা বেশি করে….

হাসির সাইকেল এসে বারান্দার সামনে থামতেই আমি উঠে পড়ে বললুম, একটু আসছি!

অন্ধকারে হাসি আমাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু প্রথমেই আমি তার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই না। চন্দনদা আমার কী পরিচয় দেবে?

ভেতরে এসে দেখলুম, উজ্জয়িনী রান্নাঘরে একটা মোম জ্বেলে চা ছাঁকছে। আমাকে দেখেই সে বলল, বাথরুমে যাবে? নাও, এই মোমটা নাও! বাড়িতে আর মোম নেই।

–না, বাথরুমে যাব না। তোমার কোনো সাহায্যের দরকার কি না দেখতে এলুম।

–বাবা, তুমি তো দেখছি খুব কাজের ছেলে। আমার কিছু সাহায্য লাগবে না। তুমি গিয়ে বাইরে বসো না, আমি এক্ষুনি চা নিয়ে যাচ্ছি।

–চার কাপ চা তুমি একলা নিয়ে যাবে কী করে?

—এই তো ট্রে রয়েছে। হাসি এসেছে, তাই না। ওর সঙ্গে আলাপ করলে তোমার ভালো লাগবে। খুব মজার মেয়েটা।

—শান্তিনিকেতনে পড়ে বুঝি?

–না, ওরা আগে ছিল এলাহাবাদে। সেখানেই পড়াশুনো করেছে। ওর বাবা এই কিছুদিন হলো সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে এসেছেন। হাসি এখন সঙ্গীত ভবনে গান শিখছে।

উজ্জয়িনী চায়ের ট্রে–টা নিল, আমি পেঁয়াজির প্লেট দু’খানা হাতে নিয়ে চললুম ওর পেছন পেছন।

হাসি এখনো বসেনি, সাইকেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের মধ্যে যেন এক ফালি জ্যোৎস্না। আমি কখনো এত দুর্বল বোধ করিনি কোনো মেয়ের সামনে। আমার ভয় করছে, খুব ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। হাসির সঙ্গে যেন আমার আলাপ না হয়! আলাপ হলেই যদি ও সাধারণ হয়ে যায়?

আমার বুক কেঁপেছিল মঞ্চের ওপর এক রাজকুমারীকে দেখে। সঙ্গীত ভবনের কোনো ছাত্রীর জন্য নয়।

হাসি বলল, চিনিদি, আমার খুব খিদে পেয়েছে। শুধু চা খাব না, আর কী আছে দাও।

–ঐ তো পেঁয়াজি রয়েছে, খা না!

হাসি ঝুঁকে এসে আমার হাতের প্লেট থেকে দু’তিনটে পেঁয়াজি একসঙ্গে তুলে উঃ বড্ড গরম বলে লাফাতে লাগল, তার সাইকেলটা পড়ে গেল ঝন ঝনাৎ করে।

উজ্জয়িনী বলল, বেশ হয়েছে। সাইকেলটা রেখে ভালো করে বসতে পারিস না? সব সময় পায়ে চর্কি বেঁধে ঘুরবি!

হাসি সাইকেলটা তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল। তারপর আড়চোখে তাকাল আমার দিকে। যেন এই ক্ষুদ্র দুর্ঘটনার জন্য আমিই দায়ী।

উজ্জয়িনী বলল, এই হচ্ছে নীললোহিত, আমাদের নতুন বন্ধু। আয় হাসি, এই চেয়ারটায় বোস। তোকে এক্ষুনি একটা ভালো খবর দেব।

হাসি বলল, জানি! টি ভি প্রোগ্রাম তো?

–কিসের টিভি প্রোগ্রাম? সেটা তো আমি শুনিনি।

—দিল্লি টিভি থেকে ‘শ্যামা’ করবে, তাতে আমাকে নিতে চায়। আমি অবশ্য এখনও হ্যাঁ কিংবা না কিছু বলিনি। ক’দিন ভেবে দেখি। আচ্ছা, চিনিদি, তুমি বলো তো—আমার কি নেওয়া উচিত?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ, কেন নেবে না। দিল্লি থেকে করছে? এ তো দারুণ অফার! তোর চেনা কেউ আছে বুঝি দিল্লি টি ভি–তে?

–ভ্যাট, চেনা কে থাকবে? ওরা নতুন মুখ খুঁজছে। শান্তিনিকেতনে এসেছিল…মোহরদির কাছে…

–তোকে কোন রোলটা দিতে চাইছে?

—শ্যামা।

—মেইন রোল। এ রকম চান্স ছাড়ার তো কোনো কোশ্চেনই ওঠে না।

—শ্যামা আমাকে মানাবে? আমার ইচ্ছে করছে না।

–তোকে এমন ভাবে সাজিয়ে দেবে দেখবি …

এমন টি ভি–র আলোচনায় ওরা মগ্ন হয়ে গেল, আমি যে একটা বাইরের মানুষ উপস্থিত রয়েছি তা ওরা ভুলেই গেল। আমি চুপচাপ চা খেতে লাগলুম। হাসি আমার মতামত চাইলে আমি বলতুম, শ্যামার ভূমিকায় তাকে মানাবে না, ঐ টি ভি প্রোগ্রামটা হাসির নেওয়া ঠিক হবে না।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল।

টি ভি–র কথা থামিয়ে হাসি বলল, এই রে, এখন আমি ফিরব কী করে?

উজ্জয়িনী বলল, কেন, তোর এত যাওয়ার তাড়া কিসের রে?

চন্দনদা বলল, নিশ্চয়ই রতন কুঠিতে একবার খোঁজ নিতে যাবে। এই হাসি, সন্ধের পর তোর রতনকুঠিতে না যাওয়াই ভালো।

–রতনকুঠিতে? সেখানে আমি কেন যাব?

–আহা–হা, আমাদের কাছে আর লুকোতে হবে না।

উজ্জয়িনী বলল, না, ও লুকোচ্ছে না। ও জানে না। শোন হাসি, তোর রতনকুঠি একটু বাদেই এখানে আসবে।

হাসি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি বাড়ি যাব, আটটা পনেরোর সময় একটা রেডিও প্রোগ্রাম শুনব।

–তার অনেক দেরি আছে। তুই আমাদের একটা গান শুনিয়ে যা।

—চিনিদি, রোজ–রোজ লোডশেডিং হচ্ছে আর অন্ধকারের গান গেয়ে গেয়ে সব রবীন্দ্রসঙ্গীত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

চন্দনদা বলল, অন্ধকারের গান শুনতেও চাই না। ‘ও আমার আঁধার ভালো’, এই গানটি শুনলেই এখন আমার রাগে গা জ্বলে যায়।

উজ্জয়িনী বলল, রবীন্দ্রনাথ ইলেকট্রিসিটির বন্দনা করে কোনো গান লেখেননি, সে রকম গান থাকলে লোডশেডিং হলেই আমরা সেই গানটা কোরাস গেয়ে প্রার্থনা জানাতুম।

চন্দনদা বলল, অন্ধকারের মধ্যে আরো কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে। হাসি তুই একটা মন–ভালো করার গান শুনিয়ে যা। নীলু, তোমার কোনো বিশেষ পছন্দের গান আছে?

আমি বললুম, হ্যাঁ। “এখনো তারে চোখে দেখিনি, শুধু বাঁশি শুনেছি … এটা অনেক দিন শোনা হয়নি।

সঙ্গে–সঙ্গে আলো জ্বলে উঠল। প্রথমটা চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

এই প্রথম হাসি আমাকে দেখল। কয়েক পলক, স্থিরভাবে। তারপর, লাজুক, বিনীত গলায় বলল, ঐ গানটা আমি ভালো জানি না। আমি তো বেশি গান শিখিনি। রাজকুমারীর সজ্জার বদলে একটা সাধারণ গোলাপি শাড়িতেও হাসিকে বেশ মানিয়েছে। তার লম্বা শরীরটিতে একটা তরঙ্গ আছে। সে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। চোখদুটি যেন উড়ে যেতে চাইছে।

শান্তিনিকেতনে সুশ্রী মেয়ে অনেক আছে, হাসিকে তাদের তুলনায় অসাধারণ কিছু বলা যায় না। তবে তার অবাক–অবাক চোখ দুটির মধ্যে রয়েছে আমাদের ভুলে যাওয়া সারল্য।

আমি হাসির দিকে বোধহয় একটু বেশি সময়ই চেয়ে আছি, কোনো কথা বলছি না, এটা নিশ্চয়ই খারাপ দেখাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিলুম।

হাসি আবার বলল, আজ আলো এসে গেছে, আজ আমি যাই। আর একদিন এসে গান শোনাব।

উজ্জয়িনী বলল, ও কবে চলে যাবে তার ঠিক নেই।

—আপনি এখানে থাকেন না বুঝি?

আমি নিঃশব্দে দু’দিকে মাথা নাড়লুম। চন্দনদা বলল, এই ছেলেটা গ্রামে– গ্রামে ঘুরে–ঘুরে বেড়ায়। দারুণ সব ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে এর জীবনে। রিসেন্টলি একটা গ্রামে চোর হিসেবে ধরা পড়েছিল। এই নীলু, সেইটা বলো না হাসিকে!

সত্যি ঘটনা বারবার বলা যায়। কিন্তু বানানো গল্প হুবহু একভাবে দ্বিতীয়বার বর্ণনা করা মুশকিল। ট্রেনে আসবার সময় উজ্জয়িনী–চন্দনদাকে আনন্দ দেবার জন্য আমি ঠিক কী বলেছিলুম মনে নেই।

আমি হাসিকে বললুম, ওটা একটা বানানো গল্প। আপনি ভালো নাচতে পারেন, তাই না?

—আপনি কী করে জানলেন?

—আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়!

—মোটেই তা নয়। নিশ্চয়ই কারুর কাছে শুনেছেন। আমি গানের চেয়ে নাচতেই বেশি ভালোবাসি।

চন্দনদা বলল, এখন এই বারান্দায় তো তোকে নাচ দেখাতে বলতে পারি না, সেইজন্যই একটা গান শোনাতে বলেছিলুম।

–বাইরে বৃষ্টির মধ্যে নাচব?

উজ্জয়িনী বলল, এই হাসি, পাগলামি করিস না।

হাসি তার চোখ, নাক, ঠোঁট কান, কপাল, চিবুক এমন কি চুলে পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে বলল, আমার এক–একসময় কী ইচ্ছে করে জানো, চিনিদি? কলকাতায় যখন যাই, তখন একদিন বাস থেকে নেমে পড়ে চৌরঙ্গির মাঝখানে সব বাস আর গাড়ি–টাড়ি থামিয়ে সেইখানে সবাইকে নাচ দেখাই। আমার সঙ্গে একজন তবলচি থাকবে, সে–ও রাস্তার ওপর বসে পড়বে…এ রকম করা যায় না?

চন্দনদা–উজ্জয়িনী একসঙ্গে হাসতে লাগল। চন্দনদা উঠে এসে হাসির মাথায় একটা চাপড় দিয়ে বলল, এই মেয়েটা দেখছি সত্যি পাগল! তোর এই প্রস্তাবটা রাজাকে দিয়ে দেখিস তো। শুনব, সেকি বলে?

উজ্জয়িনী বলল, রাজা এখনো এলো না কেন? বৃষ্টিতে বোধহয় আটকে গেছে।

হাসি চমকে গিয়ে বলল, রাজা কোথায়?

—রতনকুঠিতে এসে উঠেছে। তুই জানিস না?

—না তো! কখন এলো? তা হলে যাই, রাজাকে ডেকে আনি… তখুনি গেটের বাইরে ডাক শোনা গেল, চন্দনদা! চন্দনদা!

চন্দনদা বলল, ঐ তো হিরো হাজির হয়ে গেছে। এসো, ভেতরে চলে এসো!

সবাই গেটের দিকে ফিরল। আমি হাসিকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি যে চৌরঙ্গির মাঝখানে নাচবার কথা ভেবেছেন, কোন্ পোশাকে নাচবেন, রাজকুমারী না ভিখারিণী সেজে?

—এই যেমন পোশাকে এখন আছি।

হাসি গেটের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক, তাই আমার প্রশ্নটা তার মনে ঠিক রেজিস্টার করল না।

আমি বললুম, আইডিয়াটা কিন্তু আমার চমৎকার লাগছে।

হাসি আমার এ–কথাটা বোধহয় শুনতেই পেল না। চেঁচিয়ে বলল, এই, তুমি কখন এসেছ? এসেই আমায় খবর দাওনি কেন?

দৌড়ে এসে একজন যুবক বারান্দায় উঠল। রুমাল দিয়ে মুখের জল মুছতে– মুছতে বলল, খবর দেব কী! যেমন অন্ধকার তেমন বৃষ্টি! এখানে তোমরা থাক কী করে?

উজ্জয়িনী একটা তোয়ালে এনে বলল, ভালো করে মাথাটা মুছে নে। এই বৃষ্টিতে ভিজলেই নির্ঘাত জ্বর।

হাসি তোয়ালেটা কেড়ে নিয়ে বলল, না, মুছতে হবে না। চলো, বৃষ্টিতে ভিজতে–ভিজতে আমার খোয়াই–এর ধারে যাই। চলো, চলো, এক্ষুনি চলো।

রাজা নামের যুবকটির বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, মনে হয় নিয়মিত ব্যায়াম করে কিংবা টেনিস খেলে। প্যান্টের ওপর চৌখুপি কাটা হাওয়াই শার্ট পরা, মাথায় অনেক চুল। জুলপি দুটো লম্বা।

সে তার চোখ দুটি গোল করে বলল, এই বৃষ্টির মধ্যে খোয়াই–এর ধারে যাব, কেন?

হাসি বলল, কেন আবার কী, এমনি! যেতে ইচ্ছে করছে আমার।

চন্দনদা বলল, এই বৃষ্টির মধ্যে কেউ খোয়াই যায়? অন্ধকার হয়ে গেছে, কিছু দেখা যাবে না। হাসি তাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, বৃষ্টির মধ্যে খোয়াই যাওয়ার কোনো নিষেধ আছে নাকি! টর্চ নিয়ে যাব?

রাজা এবারে তার চোখ দুটি স্বাভাবিক করে, হাসির কথা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ভ্যাট! খোয়াই–ফোয়াই বাদ দাও তো, এখানে জমিয়ে আড্ডা দিতে এসেছি।

হাসি তবু অনুনয় করে বলল, আমরা সবাই মিলে যাব তো বলছি, ওখানে আড্ডা দেব! চলো না, তোমরা চলো না!

উজ্জয়িনী বলল, আমাদের অত শখ নেই ভাই। তোদেরও এখন বৃষ্টিতে ভেজা মোটেই উচিত নয়। আর তো মোটে কুড়ি–বাইশ দিন বাকি!

হাসি বলল, বাইশ দিন না, পঁচিশ দিন। সে তো অনেক দেরি।

চন্দনদা হো–হো করে হেসে উঠে বলল, আর বুঝি ধৈর্য রাখতে পারছিস না! প্রত্যেকটা দিন গুনছিস। আর রাজা, তুই প্রত্যেক উইক এণ্ডে ছুটে আসছিস, তোর লজ্জা করে না?

উজ্জয়িনী বলল, আমরাও ভাই প্রেম করে বিয়ে করেছি। কিন্তু তোদের মতন এমন আদেখলেপনা আমাদের ছিল না।

রাজা বলল, বাঃ, বিয়ের আগে কোর্টশিপ চলবে না? সেটা বাদ যাবে কেন? তারপর রাজা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইনি কে? এঁকে তো চিনলাম না। একেবারে চুপচাপ বসে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *