খুনে ক্যানিয়ন – ৮

আট

একচুলও নড়ল না দীর্ঘদেহী ফোরম্যান। সরাসরি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সে রিয়ার দিকে। বেননের মনে হলো ছোট্ট একটা মুরগির বাচ্চার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে একটা আক্রমণোদ্যত ধেড়ে শকুন। পরমুহূর্তে বিস্মিত হতে হলো ওকে। ঝট করে হোলস্টার থেকে রিভলভারটা টেনে বের করেছে রিয়া। হ্যামার উঠিয়ে কেলটনের বুকে তাক করল অস্ত্রটা।

শান্ত নিচু গলায় বলল, ‘আমাদের ঠেকানোর চেষ্টা করলে গুলি করতে বাধ্য হবো।’

মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বেনন স্পষ্ট টের পেল এ মেয়ে মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না, যা বলছে তা করবে প্রয়োজন পড়লে। বুঝতে পারল সেটা রেড কেলটনেরও জানা। গম্ভীর চেহারায় দু’পা সরে দাঁড়াল রেড কেলটন।

‘সামনে বাড়ো,’ কাঁধের ওপর দিয়ে বেননকে বলল রিয়া। অস্ত্র এখনও কেলটনের বুকে তাক করে রেখেছে। ‘কাউকে আমি বিশ্বাস করি না।’

কেলটনের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল বেনন, তারপর রিয়াকে পাশ কাটিয়ে এগোল সামনে, র‍্যাঞ্চ হাউসের খোলা দরজার দিকে। প্রায় পৌঁছে গেছে এমন সময়ে ওর পাশে চলে এল রিয়া। দরজা দিয়ে বেনন ঢোকার পর ওটা দড়াম করে বন্ধ করল মেয়েটা, একটা বোল্ট টেনে আটকে দিল যাতে হঠাৎ করে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। শান্ত গলায় বলল, ‘আমার উচিত ছিল কেলটনকে গুলি করা।’

বিশ্বাস করতে বেননের কষ্ট হলো যে এত সুন্দরী একটা মেয়ে এত বিপজ্জনক হতে পারে। হোলস্টারে রাখা ছোট্ট রিভলভারের বাঁটের দিকে তাকিয়ে নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করল ও, ‘গুলি আছে তোমার অস্ত্রে?’

জবাবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেননকে কিছুক্ষণ দেখল রিয়া, তারপর আস্তে করে মাথা দুলিয়ে অ্যাডোবির মাটি দিয়ে লেপা একটা চৌকোনা প্যাশিয়োর দিকে এগোতে ইঙ্গিত করল। বাড়ির মাঝখানে জায়গাটা, খোলা আকাশের নিচে। দিনের খরতাপের পর এখন জায়গাটাকে বেহেস্ত বলে মনে হচ্ছে। শীতল, রংচঙে, আরামদায়ক। উঠানের মাঝে একটা কুয়ো। সেটা থেকে ওক কাঠের বালতিতে করে পানি তুলছে এক মেক্সিকান মহিলা, অ্যাডোবি ভিজিয়ে শীতল করছে। টবে শোভা পাচ্ছে লাল হলুদ আর সাদা ফুলের গাছ। ফুল ফুটে আছে। একটা ঝোপের পেছনে কয়েকটা রকিং চেয়ার আর একটা টেবিল দেখা গেল। মাথার ওপর ছাউনি বলে জায়গাটা ছায়া ছায়া। পাশ থেকে ওখানে বসতে ইঙ্গিত করল রিয়া। তারপর আজব একটা কাণ্ড করল। ‘দেখো,’ বলেই রিভলভার ড্র করে গুলি করে বসল। ছাদ থেকে ঝুলন্ত খাঁচার ভেতর একটা জে পাখি ছিল, বুকে গুলি খেয়ে খাঁচার ভেতর লুটিয়ে পড়ল পাখিটা।

‘ঠিক তোমার মতই ভুল ভেবে বসেছিল র‍্যাঞ্চের এক গানম্যান,’ বলল রিয়া রিভলভারটা হোলস্টারে রাখতে রাখতে। ‘ভুল ধারণা ভেঙে গেছে তার। দ্বিতীয়বার একই ভুল সে আর করবে না। তুমিও কথাটা মনে রেখো। দরকার পড়লে নিখুঁত লক্ষ্যে গুলি করতে দ্বিধা করি না আমি।’

অসন্তুষ্ট বোধ করলেও কোন কথা বলল না বেনন। বুঝতে পারছে, রিয়ো ঠিকই বলেছে, গোলাপের মত সুন্দর হলেও চোলার মতই কাঁটাময় এই রিয়া মেয়েটি। খামোকা খাঁচার পাখিটাকে মেরে কোন দুঃখ বোধ করছে না সে।

দরজায় টোকার আওয়াজ হলো। ‘রন, গুলি করেছে তোমাকে?’ জানতে চাইল একটা কণ্ঠ।

‘না, এখনও বেঁচেবর্তেই আছি,’ জবাবে বলল বেনন।

আস্তে করে একটা রকিং চেয়ারে বসল ও। সামনেই টেবিল। তার ওপর স্কচ হুইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস রাখা।

উল্টো পাশের একটা চেয়ারে বসল রিয়া। গ্লাসে মদ ঢালল। বলল, ‘আমেরিকান হুইস্কি আমি খেতে পারি না। বড় বেশি ধক। তরল আগুন!’

রিয়ার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিল বেনন, তারপর মন্তব্য করল, ‘আমার কিন্তু ওই ধকই পছন্দ। স্কচ হুইস্কিতে সেই ধাক্কাটা নেই।’

কোলের ওপর গিটার তুলে নিল ও, বাজাতে শুরু করল মৃদু টোকায়। প্লাক করছে আঁধারে।

চুপ করে শুনছে রিয়া, মাঝে মাঝে গ্লাসে হুইস্কি ভরতে সামনে ঝুঁকছে। আধ ঘণ্টা পর বোতলটা খালি হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল রিয়া, সামান্য টলছে। ‘চমৎকার গিটার বাজাও তুমি,’ প্রশংসা করে বলল।

‘যাই তা হলে,’ উঠে দাঁড়াল বেননও।

‘না, দাঁড়াও,’ বলে উঠল রিয়া। গলায় জরুরী সুর চিনতে ভুল হলো না বেননের। কাছে সরে এল মেয়েটি। ‘রন, রেড কেলটনের হয়ে কেন কাজ করো তুমি?’

শ্রাগ করল বেনন। ‘বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, রেড কেলটন আমাকে কাজে নিয়েছে। বেতন ভাল। রয়ে গিয়েছি। জানতাম না আসলে র‍্যাঞ্চটার মালিক তুমি।’

‘মালিক!’ তিক্ত শোনাল রিয়ার কণ্ঠ। তিক্ত হাসল। ‘বন্দি আমি। স্রেফ বন্দি। আটকে রাখা হয়েছে আমাকে।’

‘নিজের ইচ্ছেয় চলতে পারছ না তুমি?’

‘না। চিঠি লিখতে পারি না আত্মীয়দের কাছে। কোথাও যেতে পারি না। আমার ভাইকে খুনে ক্যানিয়নে মেরে ফেলেছে ওরা। আটকে রাখা হয়েছে আমাকে। রেড লেটন তার বসের নির্দেশে ইচ্ছে মত চালাচ্ছে র‍্যাঞ্চটা।’

‘খুনে ক্যানিয়ন,’ সতর্ক সুরে উচ্চারণ করল বেনন। ‘তোমার ভাই সেখানে মারা গেছে?’

‘হ্যাঁ। ওকে খুন করা হয়েছে। খুন করেছে বেন স্টার্ক।’

‘ক্যানিয়নটা কোথায়?’

’আমাদের রেঞ্জের ওপর দিয়ে যে নদীটা গেছে তার উজানে। ঠিক কোথায় তা বলতে পারব না। …কেন?’

জবাব না দিয়ে মেয়েটার কাছ থেকে আরও তথ্য আদায় করতে চেষ্টা করল বেনন। ‘আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। তোমার ভাই কার দলে ছিল? কেন তাকে খুন করা হলো? তুমিই বা বন্দি কেন? তাছাড়া রেড কেলটন র‍্যাঞ্চটা দখল করল কীভাবে? একটু খুলে বলো।’

‘একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছ তুমি,’ বলল রিয়া। ‘সাধ্যমত জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। শুনে তুমি অবাক হবে। তার আগে বলি কেন তোমার সঙ্গে এসব আলাপ করছি। এখানে আমি একেবারেই একা। কাউকে না কাউকে মনের কথা বলতে হবে, নইলে পাগল হয়ে যাব আমি। তোমাকে পছন্দ হওয়ায় স্থির করেছি কথা বলে মনটা হালকা করব।’

বেননকে আবার বসতে ইঙ্গিত করল রিয়া। নিজেও বসল। ‘আমার ভাই ছিল ব্রিটিশ আর্মির ক্যাপ্টেন। অবসর নিয়ে পশ্চিমে আসে ও র‍্যাঞ্চ করার ইচ্ছে নিয়ে। এই র‍্যাঞ্চটা কেনে। তখন ও জানত না আউট-লরা ওকে টিকতে দেবে না। একদিন একদল বদমাশ ওকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। পরে রেড কেলটনের কাছে শুনেছি খুন করা হয়েছে ওকে। বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ ছয় মাস হলো ওর কোন খোঁজ নেই। আমাকে একা বিপদে ফেলে চলে যাবার কথা নয় ওর। র‍্যাঞ্চেও ফেরেনি। এখন বুঝি কেলটনের কথাই সত্যি।’

ঝোপের মধ্যে নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়ে তাকাল বেনন। সেই মেক্সিকান মহিলা, ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। জাগির কথা মনে পড়ে গেল বেননের। সতর্ক হয়ে উঠল ও। তারপর ওকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখবে না সেটা মনে মনে নিশ্চিত হয়ে আবার রিয়ার দিকে মনোযোগ দিল।

‘আমরা যখন এই র‍্যাঞ্চটা কিনে এখানে এলাম তখন রেড কেলটন ছিল র‍্যাঞ্চে। তার দলবলও ছিল। এদিকে কাজের লোক পাওয়া দুঃসাধ্য বলে তাকে কাজে রাখল আমার ভাই। গরু কেনার সুযোগ হয়নি ওর। কয়েকদিন পরেই বুঝল সে অন্য কারও নির্দেশে কাজ করছে রেড কেলটন। তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। একদিন রাগারাগি করল কেলটনের সঙ্গে। তার পরদিনই একদল লোক ওকে ধরে নিয়ে যায়।’

কিছুক্ষণ নীরবতার পর প্রশ্ন করল বেনন, ‘আমি কি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারি?’

আঠা দিয়ে বন্ধ করা একটা সাদা এনভেলপ বেননের হাতে দিল রিয়া। ‘ভাল লোক বলে তোমাকে মনে হয়েছে আমার। সেজন্যেই তোমাকে ডেকেছি। এই চিঠিটা সবচেয়ে কাছের জাজের ঠিকানায় পোস্ট করে দিয়ো, তা হলেই আমার বিরাট উপকার করা হবে। এমন হতে পারে না যে এই বিরাট দেশে কোন আইন নেই। নিশ্চয়ই পুলিশ আছে। আইন আছে। কোর্ট আছে। অসহায় একটা মেয়ের স্বার্থ নিশ্চয়ই তারা দেখবে।’ ব্লাউজের পকেট থেকে কয়েকটা কয়েন বের করল রিয়া। ওগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বিনা পয়সায় তোমার সাহায্য চাইছি না আমি। এখানে পাঁচটা বিশ ডলারের কয়েন আছে। পুলিশ এই র‍্যাঞ্চে আসার পর তোমাকে আরও একশো ডলার দেব আমি।’

উঠে দাঁড়াল বেনন, কয়েনের দিকে হাত না বাড়িয়ে বলল, ‘আমি আমার সাধ্যমত করার চেষ্টা করব। …না, পয়সা লাগবে না সেজন্যে।’

মেক্সিকান মহিলা এখনও গাছে পানি দিচ্ছে।

‘আমার চিঠিটা তুমি পাঠাবার ব্যবস্থা করবে তো?’ উদ্‌গ্রীব স্বরে জানতে চাইল রিয়া।

‘নিশ্চয়ই,’ আশ্বস্ত করল বেনন। পকেটে খামটা রেখে দিল।

দরজার কাছ পর্যন্ত এসে বেননকে এগিয়ে দিল রিয়া। পেছনে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পেল বেনন। অন্ধকার উঠান পার হয়ে বাঙ্ক হাউসের দিকে চলল ও। বাঙ্ক হাউসে এখন আর কোন আলো জ্বলছে না। চারপাশ নীরব।

এখন বেনন জানে কেন এই র‍্যাঞ্চে কোন গরু নেই। আইসিসির রেঞ্জেই বেন স্টার্কের আস্তানা। তার দলবল রিয়ার ভাইকে খুন করে আপদ দূর করেছে। রিয়াকে বন্দি করে রেখে রেঞ্জ টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে তার লোক। বহিরাগতরা খুনে ক্যানিয়নের ধারেকাছেও ঘেঁষার সুযোগ পাবে না, তার আগেই ঠেকানো হবে তাদের।

ভাগ্যের সহায়তায় অবাক লাগছে বেননের। যখন খুনে ক্যানিয়ন খোঁজা বাদ দিয়েছে তখনই সন্ধান পাওয়া গেল ওটার।

বাঙ্ক হাউসের দরজার পাশে বসে ছিল রেড কেলটন, বেননকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, ‘বাজি ধরে বলতে পারি মেয়েটা তোমার কান পচিয়ে ছেড়েছে।’

‘আস্ত পাগল ওই মেয়ে,’ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে এমন সুরে বলল বেনন। ‘আইনের লোক নিয়ে আসতে পারলে আমাকে তিনশো ডলার দেবে বলেছে।’ হাসল বেনন। ‘আর আমাকে, চিন্তা করে দেখো, আইন যাকে খুঁজছে!’ পকেট থেকে সাদা এনভেলপটা বের করে বাড়িয়ে দিল ও। ‘বলছিল এটা যাতে আমি পোস্ট করি।’

এনভেলপটা নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখল কেলটন। ‘এবার নিয়ে পাঁচবার চিঠি পাচারের চেষ্টা করল। বলতেই হয় যে হাল ছাড়া মেয়েটার ধাতে নেই।’

‘অস্ত্র ব্যবহারেও দক্ষ,’ মন্তব্য করল বেনন। জে পাখিটার পরিণতি বলল।

ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল কেলটন। বাহুতে একটা লম্বা ক্ষত চিহ্ন। ‘হ্যালো বলার আগেই আমাকে গুলি করেছিল মেয়েটা। বুনো বিড়ালের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয় ও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *