খুনে ক্যানিয়ন – ১

এক

এতগুলো দিন সে পেছনে লেগে আছে যে, দিনক্ষণ হিসেব করে বলতে পারবে না। ট্রেইল নেই কোন, একাকী পথ চলছে সে, রুক্ষ বন্ধুর বিরান জমিতে নিরবধি এগিয়ে চলেছে। এখন মনে হচ্ছে এই পথ চলা কোনদিনও শেষ হবে না। এমন মরীচিকার পেছনে সে ছুটছে যে মরীচিকার কথা ভাবে মাতাল ভ্যাকুয়েরো অথবা হুইস্কিতে ডুবে যাওয়া নিয়মিত সেলুন খদ্দের।

ধূসর ধুলোয় ছাওয়া রাইডারকে প্রায় রুগ্‌ণই বলা যায়। তার ঘোড়াটার অবস্থাও ভাল নয়। চলে ফিরে বেড়াচ্ছে এটাই একটা বিস্ময়। ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আলো ক্যানিয়নের দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে রাইডারের চোখে এসে লাগছে। তার বুকে ধূসর শার্টের বুক পকেটের ওপর সাঁটা ইউ এস মার্শালের ব্যাজটা চকচক করছে সে আলোয়।

সমস্যা হচ্ছে কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না সত্যিই খুনে ক্যানিয়নের অস্তিত্ব আছে কিনা। লোকে বলে ওখানে গেলে পাওয়া যাবে বেন স্টার্ক আর তার দলবলের দেখা। দুর্ধর্ষ একদল ডাকাত তারা। সান্টা ফে থেকে শুরু করে সিলভার সিটি পর্যন্ত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে দলটা। ব্যাঙ্ক লুট, খনি আক্রমণ, স্টেজ ডাকাতি ইত্যাদি থেকে শুরু করে হেন কুকর্ম নেই যা তারা করে না। প্রতি ডাকাতির পর দলটা স্রেফ বাতাসে মিশে যায়, যেন মাটি ফাঁক হয়ে তাদের লুকানোর জায়গা করে দিয়েছে। আবার দেখা দেয় তারা হিংস্র র‍্যাটল স্নেকের মত, হানা দেয় অতর্কিতে।

আগন্তুক জানে বেন স্টার্কের ভাল কোন লুকানোর জায়গা আছে। কিন্তু এল পাসো থেকে প্যানহ্যাণ্ডেল পর্যন্ত সমস্ত এলাকা চষে বেড়িয়েও স্টার্কের হাইডআউটের কোন খোঁজ বের করতে পারেনি আইনের লোকরা। কোনমতেই ধ্বংস করা যাচ্ছে না দলটা। কর্তব্যের পাশাপাশি লাভেরও ব্যাপার তাদের ধরতে পারা। পাঁচ হাজার ডলার বাউন্টি মানি নির্ধারিত করা হয়েছে বেন স্টার্কের মাথার ওপর। তার স্যাঙাতদের জন্যে পুরস্কার আছে এক হাজার ডলার করে। এছাড়া যে আধ মিলিয়ন ডলার তারা লুট করেছে তার খোঁজ বের করতে পারলে শতকরা বিশ ভাগ পাবে উদ্ধারকারী।

আগন্তুক এল পাসো ডিস্ট্রিক্টের ইউ এস মার্শালদের মধ্যে ট্র্যাকিঙে সবচেয়ে বেশি দক্ষ। ছেলেবেলাটা শান্তিপূর্ণ ইণ্ডিয়ানদের মাঝে কাটিয়েছে সে, অর্জন করেছে নিঃশব্দে অনুসরণ করার দক্ষতা। সে শপথ করেছে বেন স্টার্কের গোপন আস্তানার খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বে না, পুরস্কারের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না। ট্রেইলে নামার আগেই সে জেনেছে যে বাউন্টি হান্টার আর আইনের লোকরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারা ধরে নিয়েছে খুনে ক্যানিয়ন আসলে গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।

রুক্ষ ডায়াবলো রেঞ্জ পার হবার সময় এক মেক্সিকান মেষপালককে ধরে জেরা করেছে সে। লোকটা কাদের কাছে যেন ওর আগমন বার্তা জানাচ্ছিল ধোঁয়ার সঙ্কেত দিয়ে। অস্ত্রের মুখে তাকে বন্দি করে আগন্তুক। ভীত লোকটা স্বীকার করেছে যে খুনে ক্যানিয়নের অস্তিত্ব সত্যি আছে। জিলা নদীর কোথাও আছে ক্যানিয়নটা, এছাড়া সে আর কিছু জানে না। বলেছে, ‘সেনিয়র, সন্তদের শপথ করে বলছি, খুনে ক্যানিয়ন জিলা নদীর কোথাও, এর বেশি আমি কিছু জানি না।’

লোকটাকে আচ্ছামত পিটিয়ে আধমরা করে বেঁধে রেখে আবার এগিয়েছে দীর্ঘদেহী আগন্তুক, জানে দু’একদিনের মধ্যে লোকটার কাছে কেউ না কেউ আসবে, উদ্ধার করবে তাকে।

এরপর সোজা এগিয়েছে সে জিলা নদীর দিকে।

নিউ মেক্সিকো আর অ্যারিজোনার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে পাঁচশো মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে জিলা নদী। এত বড় একটা পাহাড়ী এলাকায় কোথায় খুনিদের ক্যানিয়ন তা জানা রীতিমত অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু হাল ছাড়েনি সে। অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং নাছোড়বান্দা লোক সে। জিলা নদীর উৎস থেকে খুঁজতে খুঁজতে ভাটির দিকে এগোচ্ছে। পার হয়ে এসেছে অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যের মনোমুগ্ধকর পিনোস অ্যালটোস। আজ এক সপ্তাহ হলো নদীর পাশে পাশে এগিয়ে চলেছে। একের পর এক ক্যানিয়ন আর গাশ্ খুঁজে ধীরে ধীরে সামনে বাড়ছে।

রক্তের মত লাল টকটকে সূর্যটা এখন ডুবছে। পশ্চিম দিগন্ত লাল হয়ে গেছে। কমলা আভায় উদ্ভাসিত হলো পাহাড়গুলো। ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এল তার ঘোড়া। ক্যাম্প করার জন্যে জায়গা খুঁজল সে। সামনেই এক পাশে দেখা যাচ্ছে জিলা নদী, রুপোলি একটা রেখা ধূসর পাথর আর ঝোপের মাঝ দিয়ে পথ করে এগিয়ে চলেছে অজানায়। হঠাৎ করেই থামল আগন্তুক। নদীর উজানে নড়াচড়া চোখে পড়েছে। নদী ওখানে সরু, তীব্র স্রোত, দু’পাশে মসৃণ জেড পাথরের দেয়াল।

খরস্রোতা নদীর ওপর একটা বিশাল মোটা কটনউড গাছ ফেলে ব্রিজ বানানো হয়েছে। তার ওপারে সরু একটা টিলা। ফাঁক আছে তার গায়ে। বেশ কয়েকটা ফাঁক। প্রকৃতি তার অদ্ভুত খেয়ালে পাহাড়ের মাঝে সমতল ভূমি তৈরি করেছে। ক্লিফের সামনে প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুয়েবলোটা। এখন স্রেফ ধ্বংসাবশেষ বললেই চলে পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলা বসতিটা। একটা পর একটা টেরেস উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। ওগুলোর মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছে একটা প্রাচীন এবড়োখেবড়ো ভাঙাচোরা সিঁড়ি।

এ দৃশ্য তার কাছে নতুন নয়। প্রাচীন ইণ্ডিয়ানদের এমন পাহাড়ী আবাস আগেও দেখেছে সে। গত কয়েক শতক ধরে এগুলো পরিত্যক্ত পড়ে আছে। বাসিন্দা যারা ছিল তারা রহস্যজনক ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। জনশ্রুতি আছে, ভিন্ন জগতে চলে গেছে তারা গোপন কোন দরজা পেরিয়ে। সেখান থেকে আর ফিরতে পারেনি বা চায়নি।

কিন্তু এই পুয়েবলোটা পরিত্যক্ত নয়! বেশ কয়েকটা ঘোড়া দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পাদভূমিতে। পাথর আর অ্যাডোবির দেয়ালে যে ফুটোগুলো জানালা হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলোতে ঝুলছে নানা বর্ণের কাপড়। একজন রাইডারকেও দেখা গেল। একটা দরজার সামনে আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করছে দুই মেক্সিকান যুবতী।

হঠাৎ করেই আগন্তুক অনুভব করল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন যে কেউ ওই পুয়েবলো থেকে তাকে দেখতে পাবে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করল সে। পেছনের কোন বোল্ডারের আড়ালে গিয়ে জায়গাটা ভাল করে দেখার ইচ্ছে। গর্জে উঠল একটা রাইফেল। গরম বাতাসের কারণে তীক্ষ্ণ শোনাল আওয়াজটা, মনে হলো বাতাসে সজোরে চাবুক ফুটিয়েছে কেউ। সোজা হয়ে বসল ডেপুটি মার্শাল, চেহারা ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল। অদৃশ্য আততায়ীর রাইফেল থেকে আরও দুটো বুলেট ছুটে এল। বড় করে শ্বাস ফেলল আইনরক্ষী, তারপর স্যাডলে কাত হতে শুরু করল তার দেহ। থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা। অতি ধীরে কাত হচ্ছে ডেপুটির দেহ। স্যাডল থেকে খসে পড়ল। ধপ করে মাটিতে পড়তেই একরাশ ধুলো উড়ল। মৃত ডেপুটি বিশপ জানল না সত্যিই খুনিদের ক্যানিয়নের খোঁজ পেয়েছিল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *