খুনে ক্যানিয়ন – ৬

ছয়

নড়াচড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল বেননের। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকল বেনন। তারপর চোখের পাতা সামান্য একটু ফাঁক করল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কোন আওয়াজ না পেয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে কিছুটা উঁচু করল শরীর।

প্রথম ভোরের হালকা ধূসর আলোয় বেসিনটাকে ভিন্ন পৃথিবীর অংশ বলে মনে হচ্ছে। রাতের আকাশে এখনও জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্ররাজি, ম্লান হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। পুবের দিগন্তে সরু একটা বাঁকা রেখা দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আগমনী বার্তা প্রচার করছে ওটা।

শীত পড়েছে বেশ। পাশ ফিরল বেনন। ছোট একটা আগুন জ্বেলেছে ফ্ল্যানারি। ফ্ল্যাপজ্যাক গরম করছে। একটা প্লেটে কয়েকটা ফ্ল্যাপজ্যাক দিয়ে বেননের হাতে ধরিয়ে দিল সে। পটের ভেতর ফুটছে কড়া কালো কফি।

কোন কথা হলো না, নিজের নিজের চিন্তায় ডুবে কফি আর ফ্ল্যাপজ্যাক দিয়ে নাস্তা সারল ওরা নিঃশব্দে।

নাস্তা সেরে ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে যখন যাত্রার জন্যে ওরা তৈরি হয়ে গেল তখনও বেসিন থেকে ছায়াময়তা দূর হয়নি। এখনও মনের মাঝে প্রশ্নটা খচখচ করছে বেননের। সেই স্টেজ স্টেশন থেকে। মাইক ফ্ল্যানারির আসল পরিচয় কী?

বেননের উদ্দেশ্য বেন স্টার্কের সঙ্গে দেখা করা। ও নিশ্চিত নয় যে এ মুহূর্তে বেন স্টার্ক ওর ঠিক ছ’ফুট দূরে আছে কিনা। এটা সত্যি যে হাতে কোন প্রমাণ নেই, তাছাড়া জিজ্ঞেস করলে বেন স্টার্ক নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে। তার সফলতার মূল কারণই হচ্ছে পরিচয় গোপন করা। যদি জানাও থাকে তবু কেউ বলবে না যে এ-ই বেন স্টার্ক।

আইন মেনে চলে পশ্চিমের এমন একজন লোকও বলতে পারবে না বেন স্টার্ক দীর্ঘদেহী কি বেঁটে, চুলের রং কালো কি ন্যাড়া মাথা। মোটা নাকি চিকন। তবে এটা এখন নিশ্চিত যে এই ফ্ল্যানারি লোকটা খুনে ক্যানিয়নের ঠিকানা জানে। লোকটার নীল চোখে একটা তীব্র দ্যুতি আছে। বোঝা যায় সে আইন মেনে চলা লোক না-ও হতে পারে।

সিদ্ধান্তে পৌঁছল বেনন, এ যদি বেন স্টার্ক না-ও হয় তবু এমন সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি যে সে স্টার্কের দলের লোক। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিজের পরিচয় গোপন রেখেছে সে। সৎ মানুষ হলে তার লুকানোর কিছু থাকত না। হয়তো ফ্ল্যানারির সঙ্গে লেগে থাকলে লোকটা মুখ খুলতে পারে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে লেগে থাকতে হলে একটা অজুহাত দরকার। সেটা কী হতে পারে?

আচম্বিতে ওর সমস্যার সমাধান ফ্ল্যানারিই করে দিল। সিঞ্চের স্ট্র্যাপ ঠিক করতে করতে সে বলল, ‘তা হলে তুমি জিলা নদীর দিকে চলেছ? প্রাণের মায়া আছে এমন কেউ ওদিকে সজ্ঞানে যায় না। ধরতে পারলে অ্যাপাচিরা মাথার ছাল খুলে নেবে। তাছাড়া মন্দ লোকের অভাব নেই ওই দুর্গম ট্রেইলে।’

‘তুমি যেমন টাম্বলউইডের মত ভবঘুরে মানুষ তাতে তো সব ট্রেইলই তোমার কাছে সমান,’ বলল বেনন। ‘এক কাজ করো না, আমার সঙ্গে চলো বরং। কথা দিতে পারি, উত্তেজনার খোরাক পাবে।’

স্যাডলে সোজা হয়ে বসে বেননের দিকে তাকাল ফ্ল্যানারি, চোখ দুটো নীরবে হাসছে। ‘ঠিক একই কথা আমিও ভাবছিলাম,’ বলল সে। ‘গুজব আছে যে এলডোরাডোর রাস্তা নাকি সোনায় মোড়া। খাবার বাসনও নাকি সোনার তৈরি। ধার্মিকরা বলে জায়গাটা গোনাগারদের নরক, সেলুন আর নাচের আসরের আড্ডা। ওখানে নাকি নদীর স্রোতের মত মদের নহর বয়ে যায়। বাতাসে নাকি টাকা ওড়ে। ওখানে গেলে হয়তো নিজের জন্যে সামান্য কিছু সোনা আমি সংগ্রহ করতে পারব।’

সূর্য উঠছে পুবের আকাশ লাল করে। উত্তরদিকে এগিয়ে চলেছে বেনন আর ফ্ল্যানারি। ওদিকে দূরে দেখা যাচ্ছে ছায়ায় মোড়া পর্বতশৃঙ্গ-আকাশের গায়ে মাথা উঁচু করে আছে, দেখলে মনে হয় দাঁতভাঙা করাত। ভালুক ঘাস আর সেজব্রাশে ছাওয়া নিচু বালির ঢিবি পার হয়ে দুলকি চালে এগোচ্ছে ওদের ঘোড়া। বেশ কিছুক্ষণ পর ওগুলো পার হয়ে এল ওরা। সামনে শুধুই সমতল মরুপ্রান্তর সেই সুদূর পাহাড়শ্রেণী পর্যন্ত চলে গিয়েছে-ঊষর, পানিশূন্য, রুক্ষ, বন্য। জন্মেছে সবুজ-ধূসর সেজ আর ঝোপ, হলুদ ফুলে সেজে আছে। দূরে তাকালে দেখা যায় শুধুই উজ্জ্বল হলুদ আর লাল রঙের মেলা।

রাতে ওরা যখন ড্রাই ক্যাম্প করল, ততক্ষণে মরুভূমির বেশ ভেতরে চলে এসেছে ওরা। চারপাশে পাথর খণ্ড পড়ে আছে। রাতের খাওয়া শেষ হতে হতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। আগুন নিভিয়ে দিল ওরা, ওজায়গা থেকে সরে এল বেশ অনেকদূর, তারপর বিছানা পাতল ওদের ঘোড়াগুলোর পাশে। বাম হাতে ঘোড়ার রাশ বেঁধে নিয়েছে, যাতে সামান্য নড়াচড়াতেই ঘুম ভেঙে যায়। সতর্কতার প্রয়োজন আছে। অ্যাপাচিদের এই বিচরণ ভূমিতে মানুষ তার জীবনে মাত্র একটাই ভুল করার সুযোগ পায়। সেটা হয় তার জীবনের শেষ ভুল।

পথ চলার দ্বিতীয় দিনে ওরা মিমব্রেস নদীর তীরে পৌঁছল। উজানের দিকে রওনা হলো ওরা, পার হলো একের পর এক ক্যানিয়ন আর গ্র্যানাইটের খাদ। আস্তে আস্তে সরু হলো নদী, দু’পাশ থেকে চেপে এল ক্লিফ। পাথুরে ভাঙাচোরা এলাকায় প্রবেশ করল ওরা। পানি নেই এখানে, শুষ্ক উত্তপ্ত অঞ্চল। কষ্টসাধ্য পথচলা, কিন্তু এগিয়ে চলল ওরা পাইমা অ্যালটোস পাহাড়শ্রেণীর রুক্ষ চুড়োগুলোর দিকে। ওগুলো ঘিরে আছে কুয়াশার আবরণ। সূর্যের আলোয় সাতরঙা দেখাচ্ছে। সূর্যটা ডুবতে দেখল ওরা। আকাশ ছোঁয়া ক্যানিয়নের দেয়ালে বিদায়ী চুম্বন দিল গোধূলির আলো। অপূর্ব একটা দৃশ্য। কিন্তু সে দৃশ্য উপভোগ করা গেল না পুরোপুরি। দূরে প্রথমবারের মত দেখতে পেল ওরা অ্যাপাচিদের ধোঁয়ার সঙ্কেত।

আচরণের স্বাভাবিকতায় প্রমাণ হয়ে গেল যে সহজে বিচলিত হবার বান্দা নয় ফ্ল্যানারি। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে জানে সে। দ্বিতীয় রাতের মত ক্যাম্প করল ওরা ছোট একটা বক্স ক্যানিয়নে। ঘোড়াগুলো হারাবার ভয় না থাকায় ছেড়ে দিল ওগুলোকে চরে খাওয়ার জন্যে। সামান্য ঘাসই আছে ক্যানিয়নে, কিন্তু দুটো জন্তুর চাহিদা মেটানোর জন্যে যথেষ্ট। বেননের পরামর্শে বক্স ক্যানিয়নের সরু মুখের কাছে কয়েকটা বোল্ডারের পেছনে ব্ল্যাঙ্কেট পাতা হলো। স্থির হলো সারারাত পালা করে পাহারা দেবে দু’জন।

একটু পরই ফিসফিস করল বেনন, ‘অ্যাপাচিরা কাছে চলে আসছে। আওয়াজ পেয়েছি আমি।’

বোল্ডারের পেছনে অবস্থান নিল ওরা, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে, পূর্ণ সতর্ক হয়ে উঠেছে। টানটান হয়ে আছে বেননের স্নায়ু, তাকিয়ে থাকল ও সামনের দিকে।

সন্ধ্যার ধূসর আলোয় দেখা গেল লোকগুলোকে। বেশ কয়েকজন ব্রেভ, ঘোড়ায় চড়ে ক্যানিয়নের মুখের বিশ ফুট দূর দিয়ে পার হয়ে গেল। মোট পাঁচজন তারা। অর্ধনগ্ন। কোমরে নোংরা নেংটি। দীর্ঘ চুলগুলো মাথার পেছনে ব্যাণ্ড দিয়ে বাঁধা। দু’জনের হাতে রাইফেল আছে, অন্যদের সম্বল শুধুই তীর ধনুক।

‘ওরা শিকার খুঁজতে বেরিয়েছে,’ ফিসফিস করল বেনন। ‘প্রসপেক্টরদের সন্ধান করছে। ধরতে পারলেই খুন করে সব কেড়ে নেবে।’

হঠাৎ করেই ইণ্ডিয়ানদের দলের নেতা ঘোড়া থামিয়ে সামনের জমিনের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল। অন্য চার অ্যাপাচি তাদের ঘোড়ায় নিথর বসে থাকল মূর্তির মত। ‘ওরা আমাদের ট্র্যাক দেখেছে,’ জানাল বেনন। ‘এবার ওরা হামলার প্রস্তুতি নেবে।’

আস্তে করে মাথা দোলাল ফ্ল্যানারি, রাইফেল কক্ করল। বুঝে গেছে এধরনের পরিস্থিতি রন জনসনের জীবনে নতুন নয়। তার কথা মত কাজ করলেই ফলাফল ভাল হবার সম্ভাবনা বেশি।

‘আমি বলার আগে গুলি কোরো না,’ সতর্ক করল বেনন। ‘হামলা এলে নেতাটাকে আমি গুলি করব। ওর কাছে রাইফেল আছে। শেষের লোকটাকে তুমি গুলি করবে। অন্যদের কাছে তীর ধনুক ছাড়া আর কিছু নেই, ওরা এমনিতেই পালাবে।’

উইনচেস্টারের বাঁটে গাল ঠেকিয়ে ব্ৰীচে একটা বুলেট পাঠাল বেনন বোল্ট টেনে। সরাসরি ইণ্ডিয়ান চীফের বুক লক্ষ্য করে তাক করেছে ও রাইফেল।

একবার শুধু মাথা ঝাঁকাল ইণ্ডিয়ান চীফ, তারপর হাতের ইশারা করল। বিদ্যুদ্বেগে পনিগুলোকে ঘুরিয়ে নিল ইণ্ডিয়ান যোদ্ধারা, তারপর তীক্ষ্ণ রণহুঙ্কার ছেড়ে তেড়ে এল ক্যানিয়নের প্রবেশ পথের দিকে।

গর্জে উঠল বেননের রাইফেল। ছিটকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল সর্দার। বুকে তাক করেছিল বেনন, কিন্তু লোকটা কুঁজো হয়ে স্যাডলে বসায় মাথায় লাগল গুলি। খুলির অর্ধেকটা উড়ে গেল চারপাশে মগজ ছিটিয়ে।

প্রায় একই সময়ে আগুন ঝরাল ফ্ল্যানারির রাইফেল। ক্যাভালরি কারবাইন কাঁধে তুলে ছুটে আসছিল বিশালদেহী আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত ইণ্ডিয়ান যোদ্ধা। ভারী বুলেটের আঘাতে ঘোড়ার পিঠ থেকে শূন্যে উঠে পেছনে আছড়ে পড়ল। বুকে গুলি খেয়েছে, মাটিতে পড়ার পর একবার পায়ে খিঁচুনি দিয়েই স্থির হয়ে গেল।

সুবিধে হবে না বুঝে গেছে অ্যাপাচিরা। অন্য তিনজন ঘোড়ার পিঠে কাত হয়ে এক পাশে ঝুলে পড়ল। শুধু তাদের একটা বাদামী পা দেখতে পাচ্ছে বেনন আর ফ্ল্যানারি। ঘোড়া ছুটিয়ে চোখের পলকে পাথরের আড়ালে চলে গেল যোদ্ধারা।

‘ঘোড়ায় স্যাডল চাপাও,’ চাপা স্বরে বলল বেনন, ‘আমি পাহারায় থাকছি। অন্ধকারে হামলা করলে আমরা ওদের ঠেকাতে পারব না। আক্রমণ ওরা করবেই। তার আগেই এখান থেকে সরে যেতে হবে।’

নিচু হয়ে দৌড়ে ক্যানিয়নের পেছনে গেল ফ্ল্যানারি, দ্রুত হাতে ঘোড়াগুলোয় জিন চাপিয়ে ফেরত এল ক্যানিয়নের মুখের কাছে, যেখানে বেনন অবস্থান করছে।

ওরা যখন ক্যানিয়ন থেকে বের হলো তখন অ্যাপাচিদের কোন চিহ্নও দেখতে পেল না। শুধু মাটিতে পড়ে আছে মৃত দুই যোদ্ধার লাশ।

একটা খাদের ভেতর দিয়ে সামনে বাড়ল ওরা। ক্রমেই সরু হচ্ছে খাদ। দু’পাশ থেকে উঁচু দেয়াল চেপে আসছে। এখানে ওখানে পড়ে আছে বড় বড় বোল্ডার। ওগুলোকে পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে যেতে হচ্ছে। আগে যাচ্ছে বেনন। ওরকম একটা বোল্ডার পাশ কাটানোর সময় নিঃশব্দে ওর পেছনে লাফ দিয়ে পড়ল এক অ্যাপাচি যোদ্ধা। এক হাতে বেননের গলা পেঁচিয়ে ধরল সে, শ্বাস আটকে শত্রুকে কাবু করতে চাইছে। মাথা কাত করে বেনন দেখল লোকটার অপর হাতে ধারাল একটা ছোরা। হাতটা উঁচু করছে সে, ছোরা চালাবে ওর পিঠে।

কনুই দিয়ে গুঁতো মারল বেনন অ্যাপাচি যোদ্ধার পেটে। গলার ওপর হাতের চাপ কমে গেল অনেকটা। অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াল বেনন। কিন্তু ওকে গুলি করতে হলো না। পেছন থেকে গর্জে উঠল একটা সিক্সগান। আলগোছে ঘোড়ার পিঠ থেকে খসে পড়ে গেল অ্যাপাচি লোকটা।

সোজা হয়ে বসে গলায় হাত বুলাল বেনন। ফ্ল্যানারি তার ধোঁয়া বের হওয়া অস্ত্রটা খাপে পুরে রাখল।

‘ধন্যবাদ, মাইক,’ বলল বেনন। ‘আরেকটু হলেই আমার মাথার ছাল ছাড়াত অ্যাপাচি ব্যাটা।’

‘বলা যায় না, হয়তো আমাদের দু’জনের ছালই ছাড়াবে ওরা শেষ পর্যন্ত, ‘ গম্ভীর চেহারায় মন্তব্য করল ফ্ল্যানারি।

সতর্ক হয়ে সামনে বাড়ছে ওরা। আর কোন অ্যাপাচির দেখা পেল না। সুবিধে হবে না বুঝে বোধহয় সরে গেছে জীবিতরা।

তৃতীয় দিনে সন্ধ্যার সময় এলডোরাডো শহরে পৌছাল ওরা। এলডোরাডো বূম টাউন। ব্যস্ত শহর। রূপার খনির কারণে প্রসপেক্টর, মাইনার, ভাগ্যান্বেষী-নানারকমের মানুষের ভিড়ে সরগরম। এখানে এসে জুটেছে সব ধরনের মানব শকুনের দল। সেলুন, ড্যান্স হল, বেশ্যাপাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা শহরের সর্বত্র।

পাহাড়ের প্রশান্ত নীরব পবিত্রতার পর এলডোরাডোকে ওদের মনে হলো দুনিয়ার সবচেয়ে জনবহুল শহর। রাস্তার মাটিতে গভীর দাগ কেটে একের পর এক যাচ্ছে বারো থেকে চোদ্দ ঘোড়ায় টানা খনিজবাহী ভারী ওয়্যাগন। বোর্ডওয়াকে হাই হিল পরা পাঞ্চাররা আলাপ করছে চওড়া সমব্রেরো হ্যাট পরা মেক্সিকানদের সঙ্গে। আলাপে অংশ নিচ্ছে দাড়িওয়ালা প্রসপেক্টর আর শক্ত গড়নের মাইনাররা। সেলুনগুলোর বাইরের ছাউনির নিচে দেখা যাচ্ছে বাকস্কিনের শার্ট পরা শৌখিন পিস্তল ঝোলানো কাউবয়দের। চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। পথ চলতে গিয়ে ঠেলাধাক্কা দিচ্ছে তারা, চিৎকার করছে। পিঁপড়ের বাসা ভাঙা হলে যেমন চারপাশে গিজগিজ করে পিঁপড়ে, তেমন লাগছে তাদের দেখতে। সেলুন আর জুয়োর আড্ডাগুলোর সামনেই ভিড়টা বেশি। চারপাশে নানা রকমের শব্দ, রং আর উত্তেজনার ছড়াছড়ি।

একটা বার্নে ঘোড়া রেখে বোর্ডওয়াক ধরে এগোল ওরা ভিড়ের মাঝ দিয়ে। একটা দোকানের সামনে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াল ফ্ল্যানারি। দোকানটা ক্ল্যাপবোর্ডের তৈরি। দেয়ালের বাইরে ঘরের জানালার চেয়েও উঁচু করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রুপোর বড় বড় বাঁট। ওগুলো কোথাও পাঠানো হবে। কোথাও কাউকে ওগুলোর পাহারায় দেখা গেল না।

বিড়বিড় করে বেননকে বলল ফ্ল্যানারি,’কী করে কেউ বিশ্বাস করবে রুপো এভাবে পড়ে থাকে বিনা পাহারায়! নিজের চোখে দেখেও তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’

একদল প্রসপেক্টরের মাঝ দিয়ে কাঁধের গুঁতোয় পথ করে নিয়ে সামনে এগোল ওরা আবার, ঢুকল একটা সেলুনে। লম্বা ঘরটার পেছনের পুরোটা জুড়ে মেহগনি কাঠের বার কাউন্টার। সেই কাউন্টারের সামনে তিন সারিতে লাইন দিয়ে মদের জন্যে অপেক্ষা করছে একগাদা অধৈর্য খদ্দের।

‘আমার ধারণা আমরা বেহেস্তে হাজির হয়ে গেছি, বিড়বিড় করে বলল ফ্ল্যানারি। সেলুনের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেঝেতে গেঁথে রাখা হয়েছে অসংখ্য রুপোর ডলার। মানুষের জুতোর ঘষায় মসৃণ হয়ে গেছে ওগুলো, ওপর থেকে ঝুলন্ত লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে।

বারের পেছনে গোটা দেয়াল জুড়ে আছে মস্ত একটা আয়না। সাদা কোট পরা বারকীপের দল ব্যস্ত হয়ে মদ পরিবেশন করছে। একটা দরজার ফাঁক দিয়ে অন্য একটা ঘরে নজর গেল বেননের। মানুষের বেশ ভিড় ভেতরে। সিল্কের খাটো স্কার্ট পরা মেয়েরা তাদের মাঝ দিয়ে ঘোরাফেরা করছে। সবুজ টেবিলের ওপর ঝুঁকে আছে পোকার খেলোয়াড়রা। যারা পেশাদার জুয়াড়ী তাদের পরনে কালো ফ্রক কোট, ক্র্যাভেটে সাতরং ছড়ানো ঝলমলে হীরে; গম্ভীর প্রত্যেকের চেহারা, সর্বক্ষণ হিসেব নিকেশে ব্যস্ত।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বেনন আর ফ্ল্যানারি দু’জন দুটো বীয়ার কিনতে পারল। এক কোনার একটা টেবিলে বসার সুযোগও মিলল সেই সঙ্গে। চারপাশে নানা ধরনের কথা আর বোতল গ্লাসের টুংটাং শব্দ। একটা সিগার ধরিয়ে উদাস ভঙ্গিতে টানতে শুরু করল বেনন। কান খাড়া। সাধারণত ব্যস্ত সেলুনে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। খুনে ক্যানিয়নের ব্যাপারে হয়তো কিছু জানা যাবে সচেতন থাকলে।

‘এবার?’ অনেকক্ষণ পর বলল বেনন। ‘তুমি তো এলডোরাডো পৌঁছেছ। এখন কী করবে ভাবছ?’

‘এটা একটা বোকার মত কথা হলো,’ বলল ফ্ল্যানারি। মেঝেতে গাঁথা রুপোর ডলারে বুট জুতো দিয়ে ঘষা দিল সে। ‘যে শহরে রুপোর কয়েনের ওপর দিয়ে মানুষ হাঁটে, যে শহরে রুপোর ইঁট সাজিয়ে রাখা হয় বিনা পাহারায়, সে জায়গা ছেড়ে কেউ নড়তে চাইবে কেন! আমি এখানেই থাকছি।’

‘আমি জিলা নদীর দিকে যাব,’ জানাল বেনন।

‘জিলায় আছেটা কী! র‍্যা স্নেক আর ইণ্ডিয়ান।’

‘তুমি ভাল করেই জানো আমি কেন যাব।’

নীল চোখ ফিরিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বেননের চোখে তাকাল ফ্ল্যানারি, মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘জানার বা জানতে চাওয়ার কোন কারণ আছে আমার?’

‘আমি হাতের তাস মেলে ধরেছি,’ বলল বেনন। ‘স্টার্কের দলে যোগ দিতে চাই সেটা তোমাকে আগেও জানিয়েছি। আমি জানি ওর আস্তানা জিলা নদী এলাকায়। আর আমার ধারণা ইচ্ছে করলেই তুমি আমাকে সঠিক জায়গায় দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দিতে পারবে।’

বীয়ারে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে আস্তে করে মাথা নাড়ল ফ্ল্যানারি, বলল, ‘ধারণা ভুল তোমার। স্টার্কের আস্তানার খবর আমার জানা নেই। এটুকু জানি, বেন স্টার্কের ব্যাপারে তার নিজের দলের নেতৃত্বস্থানীয় কয়েকজন লোক ছাড়া বাকিরা অন্ধকারে বাস করে। নির্দেশ পালন করতেই অভ্যস্ত তারা। এসবই অবশ্য আমার আন্দাজ। কারণ অত্যন্ত সতর্ক লোক বলেই বেন স্টার্ককে মনে করি আমি। তা নাহলে অনেক আগেই সে ধরা পড়ে যেত।’ চারপাশের টেবিলের ওপর একবার নজর ফিরিয়ে বেননের দিকে তাকাল ফ্যানারি। ‘এখন এই মুহূর্তে বেন স্টার্ক যদি এই সেলুনেও থেকে থাকে তা হলেও আমি অবাক হবো না।’

‘হয়তো সে এই টেবিলেই আছে,’ শুষ্ক গলায় বলল বেনন।

‘ঠিক বলেছ,’ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল ফ্ল্যানারি। ‘সে এই টেবিলেও থাকতে পারে। কেউ চেনে না তাকে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা যদি জানতে চাও তো বলব বেন স্টার্ক চতুর স্বল্পভাষী লোকদের নিজের দলে নেয়। তুমি যেমন লড়াইয়ের জন্যে মুখিয়ে আছো তাতে তোমাকে তার পছন্দ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘খুনে ক্যানিয়ন আমি ঠিকই খুঁজে বের করতে পারব। তুমি সাহায্য না করলেও।’

ড্রিঙ্ক শেষ করে উঠে দাঁড়াল ফ্যানারি। সরাসরি বেননের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘সেক্ষেত্রে আমার উপদেশ হচ্ছে সাবধানে থেকো। জিলা থেকে এ পর্যন্ত অনেক ঘোড়া খালি স্যাডল নিয়ে ফিরেছে। আমি যাচ্ছি, পরে হয়তো দেখা হবে।’

‘যাচ্ছ কোথায়?’

‘রুপোর বাঁট দেখতে। ইঁটের মত দোকানের বাইরে রুপো পড়ে থাকবে এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না।’ কথা শেষ করে স্পারের আওয়াজ তুলে ঘুরে দাঁড়াল সে, কাউন্টারে গিয়ে বিল মিটিয়ে দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে গেল সেলুন ছেড়ে।

পকেট থেকে আরেকটা সিগার বের করে ধরাল বেনন। বুঝতে পারছে ওকে একাই যেতে হবে খুনে ক্যানিয়নের খোঁজে। কিছুটা হতাশ লাগল ফ্ল্যানারির সঙ্গ পাবে না ভাবতে। লোকটাকে ওর পছন্দ হতে শুরু করেছিল। একবার ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে লোকটা। তবে ওর সঙ্গ যে ফ্ল্যানারির পছন্দ নয় সেটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে এখন। হতে পারে মাইক ফ্ল্যানারিই আসলে বেন স্টার্ক। হয়তো দলে নিতে উৎসাহী নয় বলেই ওর সঙ্গ এড়িয়ে গেছে। হতে পারে সে দলে নতুন লোক নিতে চাইছে না আপাতত। লোকের কোন অভাব নেই তার। বেন স্টার্কের দলে যোগ দিতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে এমন আউট-লর সংখ্যা কম নয়।

সিগারটা শেষ করে আবার জনবহুল ব্যস্ত সড়কে বেরিয়ে এল বেনন। রাত নামছে, আকাশে হাজারো নক্ষত্রের মেলা। একের পর এক অনেকগুলো সেলুন। সেগুলোর সামনে জ্বলছে উজ্জ্বল বাতি। আশু রাতের কারণে শহরের ব্যস্ততা যেন বেড়েছে আরও। বাতাসে সর্বক্ষণ ভাসছে ভারী একটা মিশ্র গুঞ্জন। কান পাতলে আলাদা করে শোনা যায় স্ট্যাম্প মিল চলছে, আছে বুটের আওয়াজ, ব্রথেলের বাইরে চিৎকার করছে অসন্তুষ্ট খদ্দেরের দল। উঁচু স্বরে কথা বলছে অনেক মানুষ।

গুঞ্জনের ঢেউ ছাপিয়ে উঠল এক মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের গালি। কাছেই কোথাও কাঁচ ভাঙল ঝনঝন করে। একটা সিক্সগান গর্জে উঠল। পাহাড়ের দিক থেকে শোনা গেল ভারী একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ। মনে হলো বাজ পড়েছে দূরে।

বুনো একটা শহর এটা, সিদ্ধান্তে এল বেনন। এখানে থেকে বেন স্টার্কের খোঁজ পাবার চেষ্টা করার চেয়ে উচিত হবে জিলা নদীর দিকে গিয়ে খুনে ক্যানিয়নের অনুসন্ধান করা।

লিভারি বার্নের দিকে পা বাড়াল। নোংরা গান গাইছে এক গায়ক। তাকে ঘিরে বেশ ভিড় জমেছে বোর্ডওয়াকে। লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগোতে হলো ওকে।

সেলুনের সারি শেষ হতে রাস্তার ভিড়ও কমে গেল। বোর্ডওয়াক শেষ হয়ে যেতে রাস্তায় নামল বেনন। বন্ধ দোকান আর কুটির পাশ কাটিয়ে বার্নের দিকে চলল। বার্নটা একা দাঁড়িয়ে আছে শহরের প্রান্তে। আবছা অন্ধকারে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ঘোড়ার গায়ের গন্ধ পেল ও। ধারে কাছে কেউ আছে বলে মনে হলো না। একটা পেরেকে ঝুলছে লণ্ঠন, সলতে কমিয়ে দেয়ায় মৃদু আলো বিলাচ্ছে। লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে স্টলগুলো দেখতে দেখতে চলল ও। ওর ঘোড়াটা শেষের একটা স্টলে রাখা আছে। পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হয়েছে ওটার সামনের বালতিতে

আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল ফ্ল্যানারির ঘোড়াটা ওটার স্টলে নেই। সম্ভবত শহর ছেড়ে চলে গেছে আইরিশ লোকটা। সেলুন থেকে বেরিয়ে আর দেরি করেনি। ভ্রূ কুঁচকাল বেনন। কেন? কীসের এত তাড়া লোকটার?

চিন্তাটা আপাতত মাথা থেকে দূর করে দিল। বার্নের দ্বিতীয় তলায় খড় রাখার গুদাম। একটা মই বেয়ে উঠতে হয়। স্যাডল রোলটা কাঁধে তুলে মই বেয়ে দোতলায় উঠে এল ও। অর্ধেক গুদাম খালি পড়ে আছে। এক কোনায় স্যাডলটা রেখে কিছু খড় বিছাল সমান করে। তারপর খড়ের ওপর কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল রাত কাটাতে। একটুও দেরি হলো না ওর ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়তে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *