খুনে ক্যানিয়ন – ১১

এগারো

সুরের ঝঙ্কারে শীঘ্রি একদল শ্রোতা জুটে গেল ওর ঘরের সামনে। নিঃশব্দে এল তারা, ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকল নীরবে। গান গাইতে ইচ্ছে করছিল বেননের কিন্তু শ্রোতারা ওর গলা আর সুর শুনে দিগ্বিদিকে ছিটকে যাবে জানা থাকায় সেটা আর হয়ে উঠল না।

আধঘণ্টা পর গিটার নামিয়ে রেখে দিল ও পাশে। এতক্ষণে ঘরে প্রবেশ করল কয়েকজন আউট-ল। তাদের অনুরোধে সেলুনে যেতে হলো বেননকে।

মাঝরাত পার হবার পরও বেশ খানিকক্ষণ সবার মন রক্ষা করতে গিয়ে মদ্যপান করতে হলো ওকে। শেষ পর্যন্ত হয়তো বেহুঁশ হতে হত, কিন্তু হাউণ্ডি ম্যাগপাই তার চিকন গলায় ঘোষণা দিল যে আজকের মত সে সেলুন বন্ধ করে দেবে, আর কাউকে মদ দেয়া হবে না।

সবার সঙ্গে সেলুন থেকে বেরিয়ে এল বেনন। ভাল নেশা হয়েছে ওর। প্রায় মাতাল বললেই চলে। পুরুষ আর মহিলারা যে যার মত চলে যাওয়ার পর পুয়েবলোর নিচের পাথরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ও, উপভোগ করল শীতল বাতাসের স্পর্শ। গভীর করে শ্বাস নিল। মাথা থেকে ভোঁতা ভাবটা দূর করার চেষ্টা করল। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না পুয়েবলোর গুহায়। বাইরে রাত কাটাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওর গুহা থেকে কম্বল আর স্যাডল নিয়ে নেমে এল আবার। নদীর পাড়ে ঘন ঝোপের মাঝখানে ফাঁকা একটা জায়গা পেয়ে ওখানেই কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল।

মাথার ওপর রাতের কালো আকাশের গায়ে ঝিকিমিকি করছে হাজারো কোটি নক্ষত্র। কাছেই মৃদু ছলাৎ ছল ধ্বনি তুলে বয়ে চলেছে নদীটা। বাতাসে ফুলের সুবাস। অনেকক্ষণ আকাশ দেখল বেনন, নদীর কলতান শুনল, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়।

মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে ঘুম ভাঙল ওর। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকল বেনন। আকাশটা ধূসর হয়ে আসছে, ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্ররাজি। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। মনে পড়ল গিটার বাজানোর কথা, সেলুনের পার্টির কথা, তারপর ঝোপের মধ্যে এসে ঘুমানোর কথা। গোলাগুলির কারণ ওর মাথায় ঢুকল না। ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে এক নাগাড়ে গুলির বিকট আওয়াজ, শেষ রাতের পবিত্রতা নষ্ট করছে যেন।

অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে ওর। কেমন যেন চাপচাপ ব্যথা। চুপ করে শুয়ে থেকে সম্পূর্ণ সচেতন হতে চেষ্টা করল ও। চারপাশের ঝোপের ভেতর ডাকাডাকি শুরু করেছে পাখির দল। ধূসর আলোয় ক্যানিয়নটা আবছা দেখা যাচ্ছে। পাশ থেকে মেসকিটের একটা ডাল সরিয়ে উঠে বসল বেনন। ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নদীর ওপার। সেখান থেকে ঝিলিক দিচ্ছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। অন্তত বারোটা অস্ত্র হুঙ্কার ছাড়ছে এক নাগাড়ে। পুয়েবলোর দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ, তবুও দেখতে পেল ওদিক থেকেও আগুনের ঝিলিক। আক্রমণকারীদের গুলির জবাবে পাল্টা গুলি করতে শুরু করেছে আউট-লরা।

ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের আওয়াজে পাশ ফিরে তাকাল বেনন। দীর্ঘদেহী এক লালচুলো অশ্বারোহী তীরবেগে কটনউড গাছের তৈরি সেতুটার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। কম আলোতেই রেড কেলটনকে চিনতে পারল। স্যাডলের ওপর ঝুঁকে প্রায় মিশে আছে সে। স্পারের খোঁচায় গতি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

হঠাৎ স্যাডল থেকে ছিটকে পড়ে গেল লোকটা। পানিতে পড়ার আগে তার, গলা দিয়ে বের হলো অস্ফুট একটা চিৎকার। আহত হয়েছে। হাত ঝাপটানো দেখে বুঝতে পারল বেনন, রেড সাঁতার জানে না। কয়েকবার ভেসে উঠল, তারপর টুপ করে ডুবে গেল পাহাড়ী নদীতে।

ঘটনা কী ঘটছে এতক্ষণে আন্দাজ করতে পারল বেনন। ক্রল করে পিছিয়ে ঝোপের আরও ভেতরে ঢুকল ও। খুনে ক্যানিয়ন আক্রান্ত হয়েছে। ফ্ল্যানারি আইনের লোক নিয়ে ফিরে এসে বেন স্টার্কের আস্তানার হদিস বের করে ফেলেছে। আইরিশ লোকটা ওকে একেবারে হদ্দ বোকা বানিয়ে দিয়েছে, তিক্ত মনে ভাবল বেনন। রিয়ো ঠিকই ধরেছিল, ফ্ল্যানারি আসলে বাউন্টি হান্টার।

আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে-কমছে গোলাগুলি বিনিময়। ঝোপের ভেতর থেকে সারধানে উঁকি দিয়ে নদীর অপর পাড়টা দেখল বেনন, আক্রমণকারীদের কোন চিহ্ন ওর চোখে পড়ল না। বড় বড় বোল্ডার আর গ্রিসউডের পেছন থেকে শুধু মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে বারুদের ধোঁয়া। রাগী ভোমরার মত পাল্টা বুলেট ছুটছে আউট-লদের তরফ থেকে। তাদের রাইফেলের নল থেকে ছিটকে বের হচ্ছে আগুন। নদীর অপর পাড় লক্ষ্য করে গুলি করছে সবাই।

মদের প্রভাব কেটে যাওয়ায় এখন পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে বেনন। বুঝতে পারল আক্রমণকারীরা যদি হাল ছেড়ে না দিয়ে হামলা বজায় রাখে তা হলে আউট-লদের জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। আত্মসমর্পণ না করলে মরতে হবে তাদের। হয় বুলেটের আঘাতে, নয়তো রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় না খেয়ে। বক্স ক্যানিয়নে কোণঠাসা ইঁদুরের মতই অসহায় হয়ে গেছে তারা।

কটনউডের সেতু ছাড়া ক্যানিয়ন থেকে বের হবার আর কোন পথ নেই। যত কঠোর শৃঙ্খলা আর দৃঢ় সংকল্প নিয়েই বেন স্টার্কের দল লডুক, শেষ বুলেটটাও যদি খরচ করে ফেলে তবু তাদের মুক্তি নেই। মুক্তি নেই ওরও। ঘাম জমল বেননের কপালে।

সূর্য আকাশের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে তাপ। ক্যানিয়নের দেয়ালে বাধা পেয়ে আরও বেশি তাপ ছড়াচ্ছে সূর্যালোক। পুয়েবলোর ভেতরে পুরু অ্যাডোবির দেয়াল থাকায় বেনন আগে ধারণাই করতে পারেনি যে ক্যানিয়নটা দিনের বেলায় একটা উত্তপ্ত কড়াই হয়ে উঠতে পারে। ক্রস ফায়ারের মাঝখানে ঝোপের ভেতর শুয়ে দরদর করে ঘামতে শুরু করল ও।

মুখের ভেতরটা এমন হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে শুকনো ছাই চিবিয়ে খেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। জিভটাকে মনে হচ্ছে রবারের একটা টুকরো। জীবনে যা কিছু অর্জন করেছে সমস্ত এখন বেনন দিয়ে দিতে পারে এক গ্লাস শীতল জলের বিনিময়ে। জিলার কলধ্বনি কানে আসছে, তীর বড়জোর বিশ ফুট দূরে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ওই দূরত্ব চাঁদের পিঠের সমান অগম্য।

অলস একটা কচ্ছপের চেয়েও মন্থর গতিতে কাটছে সময়। ক্রমেই মাঝ আকাশে উঠছে সূর্য-আগুনের একটা গোলা। ক্রমেই আরও বাড়ছে উত্তাপ। কেমন যেন অবসন্ন করে দিতে চায় দেহমন। পেটের ভেতর খিদে মোচড় মারছে। অসুস্থ লাগছে বেননের। বুঝতে পারছে সন্ধ্যোর আঁধার নামলেই পালানোর চেষ্টা করতে হবে ওকে। আজ যদি না পারে তা হলে আর কোনদিন ওর উদ্দেশ্য পূরণ হবে না, ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাবে বেন স্টার্ক। বলা যায় না, নিজের সত্যিকার পরিচয় জানানোর আগেই হয়তো আইনের লোক বা আউট-লদের কারও গুলিতে বেঘোরে মরতে হবে।

চুপচাপ শুয়ে শুয়ে পালানোর সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছে বেনন। দীর্ঘ লেজওয়ালা একটা গিরগিটি ঝোপের ভেতর দিয়ে এসে ছোট এক খণ্ড পাথরের ওপর উঠে থমকে দাঁড়াল। বেননকে চোখে পড়েছে তার। বেমানান এই অনুপ্রবেশকারীকে উজ্জ্বল ছোট ছোট চোখে কৌতূহল নিয়ে দেখল সে, তারপর বিরক্ত হয়ে চলে গেল ঝোপের আরেকদিকে।

সন্ধ্যার পর কুয়োর কাছে ফিরে গিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারবে ও, ভাবল বেনন। তারপর আউট-লদের সঙ্গে পুয়েবলোতে আশ্রয় নিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করতে পারবে। কিন্তু তাতে আখেরে কোন লাভ হবে না। ক্যানিয়নের প্রত্যেকে খুন হবে অথবা গ্রেফতার হবে—এটা ঠেকানোর কোন রাস্তা নেই। গ্রেফতার হওয়ার মানে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝোলা। আইনের লোকও এই এলাকায় পারতপক্ষে আইনী দীর্ঘসূত্রতাকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। বুঝতে পারছে বেনন, পালাতে হবে ওকে। নদীর কথা ভাবল ও। ওটাই পালানোর পক্ষে একমাত্র বড় বাধা। একবার ওটা পার হতে পারলে বিরান দুর্গম এই অঞ্চলে আইনের লোকদের ফাঁকি দিয়ে সরে পড়ার সম্ভাবনা একেবারে কম নয়। দরকার শুধু ট্র্যাক গোপন করার দক্ষতা। সেটা ওর আছে।

কিন্তু জিলা নদী ভাটির দিকের পাহাড়ী সরু খাদের ভেতর দিয়ে গেছে। সে জায়গাটা অত্যন্ত খরস্রোতা। তবু স্রোতের সঙ্গে ভেসে না গিয়ে উদ্ধারের আর কোন পথ ওর মাথায় এল না। আইনরক্ষকদের আওতার বাইরে চলে যেতে হবে, তারপর স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে উঠতে হবে পাড়ে। এটাই বাঁচার একমাত্র পথ। কিন্তু তাতে ঝুঁকি আছে অনেক। ভাটির দিকটা বেনন চেনে না। হয়তো খরস্রোতা নদীর বুকে জেগে আছে পাথর, হয়তো আছে জলপ্রপাত-যদিও ভাল সাঁতারু ও, তারপরও একবার তীব্র স্রোতে ভেসে গেলে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।

কিন্তু তবু নদীতে নেমে ভাটির দিকে গিয়ে আইনরক্ষকদের ঘেরাওয়ের বাইরে চলে যাওয়াটাই মুক্তির একমাত্র পথ। বেন স্টার্ককে ধরতে পারার আগে পর্যন্ত নিজের পরিচয় প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর, তাতে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি হবার সম্ভাবনা।

দিনটা যেন কখনও শেষ হবে না। কিন্তু এক সময় সূর্য পশ্চিমে হেলে দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল শেষ পর্যন্ত। টিলার ছায়া ক্যানিয়নের ভেতর আঁধার ঘনিয়ে আনতে শুরু করল। যত আঁধার নামছে, নদীর ওই পাড় থেকে গোলাগুলির পরিমাণও সেই সঙ্গে বাড়ছে। এখন আর গোলাগুলিতে বিন্দুমাত্র বিরাম নেই। নদীর ঢালে বারবার দেখা যাচ্ছে আগুনের ঝিলিক। বাতাসে শিস কেটে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য বুলেট। কোন কোনটা পাথরে পিছলে তীক্ষ্ণ আওয়াজ করছে।

নদীর তীর লক্ষ্য করে ক্রল করতে শুরু করল বেনন। মনে মনে বুলেটের আঘাতের জন্যে তৈরি হয়ে আছে। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। সামনের ঝোপ আগের তুলনায় অনেক বেশি ঘন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালুময় তীরে পৌঁছে গেল ও, মুখ ডুবিয়ে পান করল জিলা নদীর কাদা মেশানো ঘোলাটে পানি। ওটাই মনে হলো অমৃত। মুখ-হাত ধুয়ে নিল, পানি ঢালল ঘাড়ে, মাথায়। প্রাণ ভরে উপভোগ করল শীতলতাটুকু।

অন্ধকার আরও গাঢ় হলো। ক্যানিয়নের ওপর নামল কালো একটা চাদর। দু’দিক থেকে মাঝে মাঝেই ঝিলিক দিচ্ছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। অন্ধকারে ওকে দেখা যাবে না নিশ্চিত হয়ে কাপড়চোপড় খুলে ফেলল বেনন, গানবেল্ট, প্যান্ট, বুট জড়িয়ে পেঁচিয়ে ছোট একটা বাণ্ডিল বানালো, তারপর বেল্ট আর রুমাল দিয়ে পিঠের সঙ্গে বাঁধল ওটা। এবার পাথর টপকে নেমে পড়ল শীতল জিলা নদীতে।

পাড়ের কাছ থেকেই দুই মানুষ সমান গভীরতা পেয়েছে পাহাড়ী জিলা। পানিতে নামতেই তলিয়ে গেল বিস্মিত বেনন, মুখে পানি ঢুকে গেল। দ্রুত হাত- পা নেড়ে ভেসে উঠল ও, নদীর মাঝখানে চলে এল। প্রবল একটা টান অনুভব করল সঙ্গে সঙ্গে। ভাটির দিকে দ্রুত গতিতে ওকে টেনে নিয়ে চলল তীব্র স্রোত।

মাথার ওপর একটা ছায়া পার হয়ে যেতে দেখে বুঝতে পারল সাঁকোটা পার হয়ে এসেছে ও। বরফের মত শীতল পানিতে ভেসে চলল চিৎ হয়ে। একটু একটু হাত-পা নাড়ছে। মাঝে মাঝে কানে পানি ঢুকে যাচ্ছে, চেহারার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে দুয়েকটা ঢেউ।

হঠাৎই বেনন উপলব্ধি করল যে অস্ত্রের গর্জন আর কানে আসছে না। স্রোতের কলধ্বনি ছাড়া চারপাশে আর কোন আওয়াজ নেই। বুঝতে পারল মুক্তি মিলে গেছে ওর। একথা সত্যি যে হাঁটতে হবে ওকে, কিন্তু সেটা বড় কোন ব্যাপার নয়, ওর পরিকল্পনা যে বিঘ্নিত হয়নি সেটাই আসল কথা। ওর সত্যিকার পরিচয় বেন স্টার্কের কানে যাওয়ার কোন উপায় নেই আর।

টের পেল, স্রোতের টান বেড়ে গেছে অনেক। পাহাড় এখানে দু’পাশ থেকে চেপে এসেছে। ক্রমেই ওকে দ্রুত টেনে নিয়ে চলেছে স্রোত। একটা বাঁক নিল নদী। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় চারপাশ ভেসে গেল। নদীর পানি ঝিকমিক করছে। সুউচ্চ পাহাড়গুলো রুপোলি দেখাচ্ছে।

দূর থেকে মৃদু কিন্তু আতঙ্কজনক একটা আওয়াজ কানে ভেসে এল ওর। মুহূর্তের মধ্যে নিজের বিপদ বুঝে ফেলল বেনন। সামনে আছে জলপ্রপাত! কাছের তীরের দিকে এগোনোর চেষ্টা করল বেনন, টের পেল ভেসে থাকা খুব বেশি কষ্টকর না হলেও স্রোত ঠেলে তীরের দিকে এগোনো দুরূহ কাজ-প্রায় অসম্ভব। ব্যাঙ যেমন আড়াআড়ি ভাবে স্রোত পার হয় তেমনি করে চেষ্টা করল ও। প্রচণ্ড পরিশ্রমে ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে হাত-পা। ভেসে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠল। মনে হলো পানিতে ডুবে যাবে ও। মাথা ডুবে গেল পানিতে। দ্রুত হাত- পা নেড়ে ভেসে উঠল। ততক্ষণে মুখে কিছুটা পানি ঢুকে গেছে। জলপ্রপাতের আওয়াজে কোন বিরতি নেই। বাড়ছে আওয়াজটা। নিঃশব্দে মসৃণ ভাবে বয়ে চলেছে খরস্রোতা বুনো জিলা নদী।

চাঁদের আলোয় সামনে নদীর স্রোতের মাথাগুলো সাদা দেখাচ্ছে। সে আলোয় বেশ কয়েকটা পাথর দেখা গেল নদীর মাঝে-একটা দেয়াল মত তৈরি করেছে। ওগুলোর পাশ দিয়ে তীরবেগে ছুটছে স্রোত, তারপরই জলপ্রপাতের শুরু। কত ফুট নিচে ওটা গিয়ে পড়েছে তা জানা নেই। নিচে পাথরও থাকতে পারে। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করল বেনন। ওর সামনে দুটো পরিণতি অপেক্ষা করছে। যেকোন একটা ঘটতে পারে। হয় পাথরগুলোতে গিয়ে ধাক্কা খাবে ও, হাড়গোড় ভেঙে যাবে; নয়তো ওগুলোকে পাশ কাটিয়ে পানির সঙ্গে নিচে গিয়ে পড়বে। সেখানে হয়তো অপেক্ষা করছে পাথর খণ্ড। সেক্ষেত্রে মৃত্যু নিশ্চিত। কোন সম্ভাবনাই ওর পছন্দ হলো না। বজ্রপাতের মত আওয়াজ করছে জলপ্রপাত, ক্রমেই কাছিয়ে আসছে।

তীব্র স্রোতের কাছে হার মেনে তীরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিল বেনন। বুঝতে পারছে ভাগ্যে যা আছে তা মেনে না নিয়ে আর কোন উপায় নেই। সামনে কালো দেখাচ্ছে নদীর বুকে মাথা জাগানো পাথরের খণ্ডগুলো। ওগুলোর মাঝ দিয়ে এবং পাশ কাটিয়ে সাদা ফেনা তুলে ছুটে চলেছে মৃত্যুশীতল জলরাশি।

বাঁচার সম্ভাবনা কতখানি সেটা ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করে দেখল বেনন। প্রপাতের একটু আগে নদীর দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে আছে পাথর খণ্ড। পানি যেদিক দিয়ে যাচ্ছে সেখানে স্রোত তীব্র হলেও পাথরের সামনের পানি একেবারে শান্ত। নতুন করে বাঁচার আশা জেগে উঠল ওর মনে। আবার সাঁতরাতে শুরু করল নতুন উদ্যমে। এক নাগাড়ে হাত-পা নাড়ছে, এগিয়ে চলেছে স্রোতের সঙ্গে, চেষ্টা করছে একটু একটু করে পাথরগুলোর দিকে সরে যাওয়ার। স্রোত ওকে বিশ ফুট নিয়ে যাচ্ছে ও এক ফুট সরে আসতে পারার আগেই। দ্রুত কাছে চলে আসছে পতনের মুহূর্ত। তবু সাহস হারাল না বেনন, আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে খরস্রোত ঠেলে শান্ত পানিতে পৌঁছানোর, এগোতেও পারছে অল্প অল্প।

পাথরগুলোর কাছে চলে আসছে, দেখে মনে হচ্ছে পানির ওপর দিয়ে থাবা বাড়িয়ে রেখেছে। নদীর শেষ অংশে পানির কণা বাতাসে ভাসছে। নদী ওখানে অনেকটা ফুলে উঠেছে, ফেনা তুলে পাথরের পাশ দিয়ে হিসহিস আওয়াজ তুলে পার হয়ে যাচ্ছে। হাত-পা ঝিমঝিম করছে বেননের, ভারী লাগছে, মনে হচ্ছে ওগুলো পাথর দিয়ে তৈরি। মনের জোরে শুধু টিকে আছে ও, নইলে এতক্ষণে ভেসে যেত মূল স্রোতে।

আস্তে আস্তে কমছে স্রোতের টান। কিছুক্ষণ পর শান্ত পানির ধারে পৌঁছে গেল বেনন। তারপর একেবারে শান্ত পানিতে চলে আসতে আর কোন অসুবিধে হলো না। পিঠ দিয়ে পাথরের সঙ্গে ঠেস দিয়ে ভাসল ও। পিঠে বাঁধা পুটুলিটা ভিজে গিয়ে অসম্ভব ভারী হয়ে আছে। ঘুরে নিয়ে পিছলা পাথরের ওপরে ওঠার চেষ্টা করল ও হাতের জোরে। পিছলে গেল হাত। ঝপাস করে আবার পানিতে পড়ল বেনন। আবার চেষ্টা করল। এবার পাথরের ফাটলে হাত ভরে ওপরে উঠছে। একটু চেষ্টা করতেই একটা খাঁজে হাঁটু ভরতে পারল। বাকিটা উঠতে আর বিশেষ কষ্ট করতে হলো না। পাথরের মাথাটা সমতল। শুকনো। পিঠের বাণ্ডিলটা পাশে রেখে শুয়ে পড়ল ও, হাঁপাচ্ছে হাপরের মত। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।

বেশ অনেকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর আস্তে করে উঠে বসল ও, ধীরেসুস্থে পোঁটলাটা খুলল। ভেজা শার্ট-প্যান্ট পরতে গিয়ে বেশ কসরত করতে হলো ওকে। টেনেটুনে পরে নিল বুট জোড়া। ক্লান্তিতে ঝাপসা দেখছে চোখে। রুক্ষ পাথরের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল তীরের দিকে।

তীরে পৌঁছে একটা সিডারের নিচে ধপ করে বসল ও, তারপর শুয়ে পড়ল। গায়ের ভেজা কাপড় সত্ত্বেও মুহূর্ত মাত্র লাগল না গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে।

সূর্যের তাপে ঘুম ভাঙল ওর। এখনও একটা ঘোরের ভেতর আছে। উঠে বসে চারদিকে তাকাল। একটা গালিতে আছে ও। বহু নিচে বিপুল জলরাশি পড়ার বজ্রসম আওয়াজে মনে পড়ল গত রাতের কথা। মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠল ও। গা থেকে ভেজা শার্ট-প্যান্ট খুলে রোদে দিয়ে সিডার গাছের নিচে বসে থাকল দিগম্বর হয়ে। শার্টের পকেট থেকে সিগার বের করে নিয়ে দেখল গুগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। বিরক্ত চেহারা করল জন্মদিনের পোশাক পরা বেনন।

এবার ও অস্ত্রটা বের করল হোলস্টার থেকে। পরিষ্কার করে আবার রেখে দিল খাপে। পরে সময় সুযোগ মত হোলস্টারে বেশ করে তেল মাখাতে হবে। ভাগ্যের সহায়তার কথা যতই ওর মনে আসতে লাগল ততই মেজাজ ভাল হতে লাগল। আন্দাজ করল, সম্ভবত ও-ই ক্যানিয়নে অবস্থানরত একমাত্র মানুষ যে সটকে পড়তে পেরেছে। যারা জানে যে নদীতে এরকম বড় একটা জলপ্রপাত আছে তারা ভুলেও এপথে পালাবার চিন্তা মাথায় ঠাঁই দেবে না।

বেসুরো শিস দিতে দিতে উঠে দাঁড়াল ও, পরমুহূর্তে চমকে গেল কড়া গলার নির্দেশ কানে যেতে।

‘হাত তোলো! খবরদার! কোন নড়াচড়া না!’

গালির অপর প্রান্তের পাথরের খণ্ডগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন লোক। দু’জনের হাতে দুটো উইনচেস্টার। নলগুলো বেননের দিকে তাক করা। উলঙ্গ অবস্থায় মাথার ওপর দু’হাত তুলে দাঁড়ানোর পর ওকে কেমন লাগছে দেখতে সেটা মনে করে অত্যন্ত বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে মাথার ওপর হাত তুলল বেনন, কেমন যেন বোকা বোকা আর অসহায় লাগছে নিজেকে।

সাবধানে ওর দিকে এগিয়ে এল লোক দু’জন। সূর্যের আলোয় তাদের ধূসর শার্টের বুক পকেটের ওপর আটকানো রুপোলি তারা ঝিলিক দিয়ে উঠছে।

ব্যাজ ছাড়াও এদের চিনতে বেননের কোন অসুবিধে হত না। এরা দু’জনই এল পাসোর ডেপুটি ইউ. এস. মার্শাল-ওভারহোলসারের স্যাঙাত।

ফুট পাঁচেক দূরত্বে থামল তারা, চোখে কৌতূহল নিয়ে বেননকে দেখল।

‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল একজন। ‘স্বয়ং আদম মনে হচ্ছে!’

‘আদম না,’ বলল গম্ভীর বেনন। ‘সামান্য এক কাউবয় আমি। নদীটা পার হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জঘন্য স্রোতে আমার ঘোড়াটা ভেসে গেছে। মনে হয় ডুবে মারাই গেছে বেচারা।’

‘শালা মিথ্যে বলছে, টিম,’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেননের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে সঙ্গীকে বলল দ্বিতীয় ডেপুটি। ‘চিনেছি আমি! এ শালা ওই রন জনসন! ওই যে কাপুরুষটা-জেল থেকে যে পালিয়েছিল। বাজি ধরে বলতে পারি এ ক্যানিয়ন থেকে পালিয়ে নদীতে নেমে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে হাজির হয়েছে।’

‘আরেহ্, তাই তো!’ চোখ বড় বড় হলো প্রথম ডেপুটির। ‘শালার গানবেল্টটা নিয়ে নাও, জেম্‌স্।’ বেননের উদ্দেশে টিটকারির সুরে বলল, ‘কাপড় পরো, রন জনসন। মার্শাল ওভারহোলসার আইসিসি র‍্যাঞ্চে আছে। তোমাকে পেলে ফাঁসি দেয়ার আগে সে কী করবে ভেবে আমারই গায়ে কাঁপ উঠে যেতে চাইছে।’

.

সূর্য ডোবার সামান্য আগে ওরা আইসিসি র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছল। একজন ডেপুটির পেছনে স্যাডলে বসে আসতে হয়েছে বেননকে। ঠেলা ধাক্কা দিয়ে শীঘ্রি ওকে ফ্ল্যানারিকে যে দুর্গন্ধযুক্ত অ্যাডোবির ঘরে বন্দি করা হয়েছিল সেখানে নিয়ে ঢোকানো হলো। ওর পিঠের ওপর বন্ধ করে দেয়া হলো দরজাটা।

জানালাহীন ঘরটার এক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে তিক্ত মনে পরবর্তী পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করল বেনন। নিজের পরিচয় গোপন রেখে কীভাবে এই নরক থেকে বের হওয়া যায় সেটা ওর প্রথম চিন্তা। সহজ হবে না কাজটা। নিজের কাজে কোন খুঁত রাখে না ওভারহোলসার। এটা নিশ্চিত যে ক্যানিয়নে যে আউট-লরা ছিল তারা হয় ধরা পড়েছে নয়তো লড়াইতে মারা গেছে।

একই সঙ্গে দু’দিকে লোক পাঠিয়ে দু’কাজ সেরেছে ওভারহোলসার। ক্যানিয়নে আক্রমণের পাশাপাশি আইসিসি রেঞ্জও ফ্রস্টিদের কবল থেকে উদ্ধার করেছে লোকটা। তা করুক, সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা হলো পালাতে হবে ওকে নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে। নইলে হয়তো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে বেন স্টার্ক। কীভাবে সেটা সম্ভব?

ভাবনা চিন্তা করে কোন পথ না পেয়ে মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা দূর করে দিল বেনন। এমন খিদে লেগেছে যে স্যাডলের ওপরে পাতার খসখসে কম্বল পেলেও চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে ও। সিগারের তৃষ্ণা নিবারণেরও কোন উপায় নেই। বিশ্রী একটা পরিস্থিতি।

দরজার পাল্লা দুটোর মাঝ দিয়ে সামান্য আলোর একটা সরু রেখা আসছে ভেতরে। উঠে দাঁড়িয়ে দরজাটা পরখ করে দেখল ও। বাইরে থেকে আড়া দিয়ে বন্ধ করা। সরু ফাঁকে চোখ রাখল। বাইরে একজন পাহারা দিচ্ছে রাইফেল হাতে। ওভারহোলসার কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

আবার পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল ও। দরজা খুলে গেল। লণ্ঠনের হলুদ আলোয় ভরে উঠল ঘরটা।

‘সত্যি বড় করুণ অবস্থায় তোমাকে পেলাম,’ বলল পরিচিত একটা গলা।

উঠে দাঁড়াল বিস্মিত বেনন। ‘ফ্ল্যানারি!’ মনে আশা জেগে উঠল ওর।

লণ্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে রাখল ফ্ল্যানারি। বেনন দেখল তার হাতে একটা প্লেট। সেটাতে উঁচু স্তূপ হয়ে আছে মাংস, আলু আর টিনের ভেতর ভরা টমেটো।

বন্দির হাতে প্লেটটা ধরিয়ে দিল সে, যেন কিছুই হয়নি বেননের এমন গলায় বলল, ‘একটু পর আমি কফি নিয়ে আসব। তিনজনের সমান বুদ্ধি দিলেও ঈশ্বর আমাকে তিনটে হাত দেননি।’

চলে গেল ফ্ল্যানারি। প্রহরী এসে দরজায় দাঁড়াল। রাইফেল উঁচিয়ে নীরবে বন্দির দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

আইরিশম্যান ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ফিরে আসার পর তার পেছনে দরজা বন্ধ করে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।

মাংসের শেষ কণাটুকুও মুখে পুরে নিয়ে বেনন বলল, ‘আগের তুলনায় এখন অনেক ভাল বোধ হচ্ছে।’ ফ্যানারির হাতের সিগারেটের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না ও। নীরবে ওর হাতে সিগারেটের তামাক আর কাগজ তুলে দিল ফ্ল্যানারি।

‘রাখো এটা। আমার মনে আছে এঘরে আমাকে তামাক ছাড়া বেশ কষ্টে থাকতে হয়েছিল।’

সিগারেট বানিয়ে কষে কয়েকটা টান দিয়ে ফ্ল্যানারির দিকে তাকাল বেনন, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘এখানে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ঈশ্বর আমার কাছে দেবদূত পাঠিয়েছেন। ব্যাপার কী, এখানে তুমি ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াতে পারছ দেখছি। তোমার আসল পরিচয়টা জানতে পারি?’

‘পরে বলছি সে-কথা,’ বলল ফ্ল্যানারি। ‘আগে বলো তোমার নামে যা শুনছি তা কি সত্যি? তুমি নাকি একটা কাপুরুষ? ওদের কথা বিশ্বাস করতে পারছি না আমি মন থেকে। তোমাকে যতটা চিনেছি তাতে খোদ শয়তানের তাড়া খেলেও বিচলিত হবার লোক বলে তোমাকে মনে হয়নি আমার।’

কিছুক্ষণ চুপ করে সিগারেট টানল বেনন, তারপর প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি যদি বাউন্টি হান্টারই হও, তা হলে আইনের লোকের সঙ্গে কী করছ?’

‘কীসের বাউন্টি হান্টার!’ নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে আওয়াজ করল ফ্ল্যানারি। হ্যাট খুলে ছোট একটা ধাতব ব্যাজ ভেতর থেকে বের করে দেখাল। ‘পিঙ্কারটন। নাম্বার চারশো এক।’

‘তা হলে তুমিও বেন স্টার্কের পেছনে লেগেছ?’ পিঙ্কারটনের সঙ্গে কাজ করেছে সেটা উল্লেখ করল না বেনন। বুড়ো মালিকটা যে ওকে ভীষণ পছন্দ করে সেটাও জানাল না। কারও কাছেই পরিচয় দিয়ে স্টার্ককে সতর্ক করে দেবার ঝুঁকি নেবে না ও।

‘জাহান্নামে যাক বেন স্টার্ক, ঘড়ঘড়ে গলায় বিরক্তির সঙ্গে বলল ফ্ল্যানারি। ‘আইন তার কাজ করুক, আমরা আমাদের কাজ করব। আমাদের কাজ লুটের মালের হদিস বের করা। শুধু সোনার বাঁটই আছে সিকি মিলিয়ন ডলারের। কৌতূহলী দৃষ্টিতে বেননকে দেখল সে। ‘তুমি যে ধাঁচের লোক তাতে স্বল্প পরিচয়ে তোমাকে চিনে ওঠা কঠিন। আইনরক্ষীর দায়িত্ব নিয়ে আসল কাজের সময় পিছিয়ে গেলে কেন?’

শ্রাগ করল বেনন। ‘এমনও হতে পারে যে আমিও আসলে ওই লুটের টাকার পেছনে ছুটছি। উদ্ধার করতে পারলে অনেক টাকা পুরস্কার পাওয়া যাবে তা তো জানোই।’

‘হতে পারে তুমি বেন স্টার্কের দলের সঙ্গে গিয়ে জুটে পড়তে চেয়েছিলে, পরে ধোঁকা দিয়ে ওদের ধরিয়ে দিতে।’

‘হতে পারে তোমার কথাই সত্যি,’ সায় দিল বেনন অলস সুরে। চিন্তিত চেহারায় সিগারেটে টান দিল ও। ‘যাই বলো, ব্যাপারটা ছিল জুয়ার মতন। আমি যদি ওভারহোলসারের কথা মত স্টার্কের খোঁজে বের হতাম তা হলে বেশির ভাগ সম্ভাবনা ছিল অন্যদের মত এক গুলিতে আমাকেও মরতে হত। আমি যেভাবে এগিয়েছি তাতে সফল হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল।’

‘সত্যি লোভ মানুষকে দিয়ে ভুল কাজ করায়,’ কিছুটা দুঃখিত শোনাল ফ্যানারির কণ্ঠ। পরমুহূর্তে সুর পাল্টে গেল। এখন সে সম্পূর্ণ পেশাদার গোয়েন্দা। ‘তা ক্যানিয়নে লুটের সন্ধান পেলে তুমি?’

‘যদি পেয়ে থাকি তা হলে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল বেনন।

হাসল ফ্ল্যানারি। ‘কী লাভ হবে তোমার সোনার হদিস পেয়ে, যদি জীবনের বেশিরভাগটাই তোমাকে জেলের ভেতর কাটাতে হয়? ওভারহোলসার ঠিক করেছে অবাধ্যতার পাশাপাশি আউট-লদের সঙ্গে যোগ দেয়ার অভিযোগও আনবে সে তোমার বিরুদ্ধে। আমার ধারণা অভিযোগ সে প্রমাণও করতে পারবে। কিন্তু ধরো আমার কথা। ওই সোনা উদ্ধার করে পুরস্কারটা পেলে আমার অনেক কাজে আসবে।’

‘কথা ঠিক,’ হাসল বেননও। ‘কিন্তু একটা কথা কি জানো, আমার হাতে এখনও দুয়েকটা ভাল তাস আছে। এখনই আমি হাল ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নই।’

নীরবতা নামল দু’জনের মাঝে। মনে মনে হতাশ বোধ করছে বেনন। ও ভেবেছিল ফ্ল্যানারির কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সে শুধু বেন স্টার্কের লুটের সোনার ব্যাপারে উৎসাহী।

শুধু কথার কথা হিসেবে বলল ও, ‘ওভারহোলসার যখন রেঞ্জ দখল করল তখন ক্রুদের ধরেছে?’

‘একটা লোকও ছিল না,’ বলল ফ্ল্যানারি। ‘খাঁখাঁ করছিল চারপাশ। আগেই তারা কোন ভাবে টের পেয়ে গিয়েছিল যে আইনের লোকদের বড় একটা দল এদিকে আসছে। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। তাদের কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’

‘মেয়েটার কী হলো? রিয়া? মৃত র‍্যাঞ্চ মালিকের বোন?’

‘ধরে নিয়ে গেছে। ওভারহোলসার বেশ চিন্তিত। হাজার হলেও মেয়েটা ব্রিটিশ নাগরিক। তাকে উদ্ধার করতে না পারলে ওয়াশিংটন থেকে অপ্রীতিকর প্রশ্ন আসতে পারে।’

‘তারমানে বেন স্টার্কের হাতেও একটা ভাল তাস আছে।’

‘না। ক্যানিয়নের ভেতর কোণঠাসা ইঁদুরের মত সমস্ত স্যাঙাত নিয়ে আটকা পড়ে আছে সে।’

‘আমার তা মনে হয় না।’

দরজাটা খুলে গেল। প্রহরী শুকনো গলায় বলল, ‘মাইক, তোমার মতলব কী, ওর সঙ্গেই রাতে ঘুমাবে নাকি?’

এর চেয়েও খারাপ মানুষের সঙ্গ সহ্য করতে হয়েছে আমাকে জীবনে,’ বলে উঠে দাঁড়াল ফ্ল্যানারি, প্লেট আর লণ্ঠন নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। থামল সে দরজার কাছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আবার দেখা হবে।’

প্রহরীকে জিজ্ঞেস করল বেনন, ‘আমার কি হবে, মাটিতে শোবো?’

‘ওভারহোলসার পারলে মেঝেতে পাথরের টুকরো বিছিয়ে রাখত,’ বলে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল লোকটা। খটাস করে দরজার আড়া পড়ল জায়গামত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *