কৰ্ণ – ৫

পাঁচ

বিভোর গলায় ঔর্বকে উদ্দেশ করে দুর্বাসা বললেন, ‘আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে আমি রাজি।’

ঝগড়াটে হোক বা গালাগালিতে দক্ষ হোক, দুর্বাসা কন্দলীর রূপযৌবন দেখেই তাঁকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। এই ব্যাকুলতা থেকেই দুর্বাসা বিয়েতে সম্মত হয়ে গেলেন।

ঔর্ব বললেন, ‘তুমি আগুপিছু ভেবেচিন্তে কথাটা বলছ তো বাবা?’

দুর্বাসা বললেন, ‘কী আর করা যাবে বলুন! আপনার মেয়েও আমার প্রতি আগ্রহী, তাকে দেখে আমারও অনাগ্রহ লাগছে না।’ একটু কৌশলী ভঙ্গিতে নিজের অত্যাগ্রহের কথা বললেন দুর্বাসা।

‘তার পরও ভালো করে একটু ভেবে নিলে হতো না?’

‘তা অবশ্য ভাবা উচিত! কিন্তু আপনি নিজেই বলুন, জগতের কোন নারীটি কোন্দলস্বভাবের নয়! ঝগড়া করার জন্য সর্বদা নারীরা মুখিয়ে থাকে। সুযোগ পাওয়ার দরকার নেই, ঝগড়ার সুযোগটা ওরাই তৈরি করে নেয়। তারপর ঝগড়াযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’ বলতে বলতে কন্দলীর মুখের ওপর চোখ পড়ে দুর্বাসার। দেখলেন, কন্দলীর মুখের রং লালচে হয়ে গেছে। অন্যরা না জানুক, দুর্বাসা যথার্থই জানেন যে ক্রোধের রং লাল। চট করে নিজেকে সংযত করে ফেললেন তিনি।

কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘স্ত্রীলোক মাত্রেই মুক্তির পথে বাধা নয়, সাধনসঙ্গিনীও বটে। আপনার কন্যাটি আমার দাম্পত্যজীবনকে সুখকর করে তুলবে—এ আশা তো করতে পারি আমি? মহাত্মন, আপনি কী বলেন?’

‘তুমি যথার্থ বলেছ বাবা। তবে আমার কন্যাটি যে একটু কোপনস্বভাবা তা বিয়ের আগে পিতা হিসেবে তোমাকে জানানো উচিত বলে আমি মনে করেছি।’

‘আপনি যথার্থ একজন পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন মহর্ষি।’

‘তাহলে তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু ওই যে রাগ! গালাগালি! কোপনস্বভাব! কন্দলীর!’ আমতা আমতা করে বললেন ঔর্ব।

দুর্বাসা নরম গলায় বললেন, ‘আপনার আশঙ্কার উত্তরে আমি এইটুকু বলছি, আপনার মেয়ের ঝগড়াটে স্বভাবকে আমি মেনে নিতে চেষ্টা করব।’  

‘আর গালাগালি?’

‘তাও সহ্য করে যাব।’

‘কিন্তু কত দিন পর্যন্ত? কতটুকু সহ্য করবে তুমি? পুরুষেরও তো সহ্যসীমা বলে একটা কথা আছে!’ ঋষি ঔর্ব কথাচ্ছলে দুর্বাসার কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চাইছেন যে ভবিষ্যতে তাঁর মেয়েটির যেন কোনো দুর্ভাগ্য না উপস্থিত হয়।

দুর্বাসা ঔর্বকে বললেন, ‘বুঝতে পারছি, আপনি কন্দলীর ভবিষ্য-দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার মেয়ের কটুকথা গালাগালি আমি একশবার পর্যন্ত সহ্য করব।’

‘তার পর?’ অস্থির কণ্ঠে জানতে চাইলেন ঔর্ব।

দুর্বাসা বললেন, ‘কিন্তু যদি দেখি, তার পরেও গালাগালি করছে কন্দলী, তাহলে…।’

‘তাহলে! তাহলে কী করবে বাবা? থামলে কেন?’ উৎকণ্ঠিত ঋষি ঔৰ্ব।

দুর্বাসা কিছুটা রুক্ষ গলায় বললেন, ‘তাহলে আর ছাড়ব না আমি। তখন আমার যা করার করব আমি।’

ঔর্ব কাকুতিভরা কণ্ঠে বললেন, ‘আর ছাড়বে না তুমি? কন্দলীকে ক্ষমা করবে না আর?

দুর্বাসা বললেন, ‘নারীরা স্বামীর কাছে একবার ছাড় পেলে মাথায় উঠে যায়। স্বামীদের গ্রাস করে বসে তারা। কিন্তু আমি তো সেরকম মানুষ নই মহর্ষি! আমি কী, তা আপনি ভালো করেই জানেন। আমার আর আপনার কথাগুলো আপনার মেয়ে শুনছে। আশাকরি, এ থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করবে। আমি আবার বলে রাখলাম মহাত্মন, আপনার সম্মানার্থে আমি একশবার কন্দলীর অপমান সহ্য করব। কিন্তু তার বেশি নয়।’ রূঢ় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে মাথা নিচু করলেন দুর্বাসা। মহর্ষি ঔর্ব অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া না-করার উপদেশ দিয়ে কন্দলীকে দুর্বাসার হাতে সম্প্রদান করলেন এবং নিজের তপস্যালয়ে ফিরে গেলেন।

দুর্বাসা মুনির নতুন জীবন আরম্ভ হলো, দাম্পত্যজীবন।

একজন দুঃখী ব্যক্তির জীবনে সুখ শুরু হলে যেমন তার বাসনার নিবৃত্তি হয় না, ওই অবস্থা দুর্বাসারও হলো। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত দুর্বাসা কন্দলীকে কাছে পেয়ে আরও বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলেন। কামাগ্নি তাঁর সমস্ত শরীর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিতে চাইল। ব্যাঘ্র যেমন হরিণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, দুর্বাসাও তেমনি কন্দলীর যৌবনপুষ্ট শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রতিদিন সুরতকার্য করে যেতে লাগলেন দুর্বাসা। নানা রকম শৃঙ্গার এবং নতুন নতুন সঙ্গমে দুর্বাসা-কন্দলীর দিনরাত্রির জ্ঞান রইল না।

এইভাবে বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হলো। সম্ভোগে এতই মগ্ন হয়ে পড়লেন দুর্বাসা, তপশ্চর্যার কথা একেবারে ভুলে গেলেন। মন তখন তাঁর কন্দলীর আঁচলে একেবারে বাঁধা পড়ে গেছে। দেহসুখে দুর্বাসা যখন একেবারে পরিতৃপ্ত, ঠিক ওই সময় কন্দলী পূর্বের মূর্তিতে ফিরে গেলেন। কন্দলীর চোখেমুখে ঝগড়া করার আভাস ফুটে উঠল

একদিন কন্দলীর মুখঝামটা দিয়েই দুর্বাসার সকালটা শুরু হলো। প্রতিশ্রুতি মতো দুর্বাসা চুপ করে থাকেন। কিন্তু কন্দলী থামেন না। বহুদিনের বাধাপ্রাপ্ত জলস্রোত যেমন বাঁধ ভেঙে দুর্বার গতিতে অগ্রসর হতে থাকে, কন্দলীর ঝগুড়েপনাও সেরকম দুর্দমনীয় গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকল। দুর্বাসা যতই বোঝান, কন্দলী ততই রেগে যান। একটা সময়ে তাঁর ঝগড়া থামে। তবে তা সাময়িক। পরদিন আবার জোরালো কণ্ঠে কোন্দল আরম্ভ করেন কন্দলী। গালাগালি করে যাচ্ছেন তো করেই যাচ্ছেন! থামাথামির লক্ষণ নেই। দুর্বাসার দাম্পত্যজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে একসময়। তারপরও তিনি নিজেকে সংযত রাখেন। কিন্তু কন্দলীর ঝগড়াটেপনা শেষ হয়ে যায় না। কন্দলী বারবার ঝগড়া করেন, গালাগাল দেন।

দুর্বাসার মন অভিশাপ দেওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করে ওঠে। কিন্তু নিজের ক্রোধকে কঠোর হস্তে দমন করেন দুর্বাসা। তিনি কেবল কন্দলীর গালাগালি গুনতে থাকেন—এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়…। অপেক্ষা করতে থাকেন কবে একশ হবে।

দিন যেতে থাকে, রাত অতিক্রান্ত হয়। সূর্যদেব ওঠেন, আবার অস্তও যান। কিন্তু দুর্বাসার প্রতি কন্দলীর কটুকাটব্যের অবসান হয় না। উপরন্তু দিন দিন তাঁর গালমন্দ-ঝগড়া আরও বাড়তে থাকে।

কন্দলীর গালাগালের সংখ্যা একশ পূর্ণ হয়। দুর্বাসার প্রতিশ্রুতি মতো কন্দলীর অপরাধের ভাণ্ড পূর্ণ হয়ে যায়। এবার দুর্বাসার ক্রোধপ্রকাশের সময়। কিন্তু দুর্বাসাকে তেমন ক্রোধপরায়ন দেখা গেল না। তিনি যেন তখনো ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। আসল ঘটনা হলো, এতদিন সংসার করার পর কন্দলীর ওপর দুর্বাসার মমতা জমে গেছে। এই মমতা ভালোলাগাতেও রূপান্তরিত হয়েছে একসময়। তাঁর ক্রোধ বারবার এই মমতা-ভালোলাগার কাছে পরাস্ত হয়েছে। তাই একশবার গালাগালি সম্পূর্ণ হওয়ার পরও ধৈর্য ধরে থাকলেন দুর্বাসা। মনকে বোঝালেন, আর একটু সহ্য কর রে মন! হাজার হলেও সে আমার স্ত্রী, আমার সম্ভোগের আধার। এত তাড়াতাড়ি তার ওপর ক্রোধান্বিত হয়ে উঠিস না।

শান্ত কণ্ঠে একদিন কন্দলীকে দুবাসা বললেন, ‘দেখো কন্দলী, ভালোবেসে তুমি আমাকে বিয়ে করেছ। ভালোবাসার মানুষকে গালামন্দ করতে নেই, অপমান করতে নেই।’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কন্দলী বলেন, ‘নিকুচি করি আমি তোমার ভালোবাসার। বুড়া ভামের ভীমরতি হয়েছে! মনসোহাগি কথা!’

‘এসব কী কথা কন্দলী! স্বামীর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই! পাপ হয়, মহাপাপ!’ কাকুতির কণ্ঠে দুর্বাসা বললেন।

‘ওসব পাপপুণ্যের ভয় দেখিও না আমাকে। ভয় দেখিয়ে আমাকে কব্জা করতে চাইছ? সেবাদাসী বানাতে চাইছ? তোমার সে আশা গুড়েবালি।’

স্ত্রীর রূঢ় কথা শুনে যান দুর্বাসা আর তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন অবিরত।

কন্দলীর দিকে দুকদম এগিয়ে একেবারে নরম গলায় বলেন, ‘আমি তোমার অনেক গালিগালাজ সহ্য করেছি কন্দলী। অনেক অপমান করেছ তুমি আমায়। তুমি আমার স্ত্রী, পছন্দের মানুষ—এই ভেবে তোমার কোনো ক্ষতি করিনি আমি এতদিন। আমি আমার ধৈর্য হারাতে বসেছি। আমি তোমাকে শেষবারের মতো ক্ষমা করছি। তবে এটাও বলে রাখছি, তুমি যদি আমাকে আর ভর্ৎসনা করো, তাহলে তোমায় ক্ষমা করব না আমি।’

ক্ষিপ্ত কণ্ঠে কন্দলী বলে উঠলেন, ‘কী করবে তুমি আমার, হ্যাঁ? করবেটা কী তুমি আমার?’ খেপা গলায় এরপর আরও নানা রকম কটুকাটব্য করে গেলেন কন্দলী।

দুর্বাসা নীরবে সেস্থান ত্যাগ করে গেলেন।

দুর্বাসা মনে করেছিলেন, তাঁর সাবধানবাণী শুনে কন্দলী নিজেকে সংশোধন করবেন। তাঁর বিবেক জাগবে। বিবেকের তাড়নায় স্বামীর প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কন্দলীর স্বভাবের কোনোই পরিবর্তন হলো না। উপরন্তু আগের তুলনায় হিংস্রতর হয়ে উঠলেন। রাগের মাত্রা, অসদাচরণের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিলেন কন্দলী।

একদিন ধৈর্য হারালেন ঋষি দুর্বাসা। উন্মত্ত কণ্ঠে বউকে বললেন, ‘তুই দুরাচারী। তোর কথাবার্তা স্ত্রীসুলভ নয়। তোর আচরণে কোমলতা নেই। তুই সুন্দরী বটে, কিন্তু কথায় সৌন্দৰ্য নেই তোর। তুই আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিস কন্দলী। আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি—তুই ভস্ম হয়ে যা।’

ক্ষমা চাওয়ার কোনো সুযোগ পেল না কন্দলী। মুনি দুর্বাসার মুখ থেকে অভিশাপবাক্য নিঃসৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কন্দলী ভস্মীভূত হয়ে গেলেন। তাঁর দাঁড়ানোর স্থানে পড়ে থাকল একমুঠো ছাই। সম্মুখে পড়ে থাকা কন্দলীর দেহভস্ম দেখে সংবিতে ফিরলেন ঋষি দুর্বাসা। প্রথমে স্তব্ধ স্থির, পরে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন তিনি। হায় হায় হায়! এ কী করলেন তিনি! নিজের স্ত্রীকে ক্রোধের আগুনে পুড়িয়ে মারলেন! এখন কাকে নিয়ে সংসার করবেন তিনি? কে তাঁকে রেঁধে খাওয়াবেন? কে তাঁর দেহের পরিচর্যা করবেন? কার কাছ থেকে দেহসান্নিধ্য পাবেন তিনি? কে তাঁর রমণেচ্ছা পূরণ করবেন?

দুর্বাসা ভাবেন আর আর্তনাদ করতে থাকেন। নিজের পর্ণকুটিরের সামনে বসে তিনি নিজের মাথায়-বুকে চাপড় মারতে থাকেন। একটা সময়ে শোকে চৈতন্য হারান দুর্বাসা। বহুক্ষণ অচৈতন্য থাকার পর হুঁশে ফিরেন তিনি। আবার হাহাকারে মগ্ন হয়ে পড়েন। কিছুতেই কন্দলীকে ভুলতে পারছেন না। বারবার অনিবার কন্দলীর লাবণ্যময় শরীরটি, তাঁর উন্নত কুচযুগল, তাঁর পুরুষ্টু নিতম্ব, তাঁর যোনিদেশ দুর্বাসার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল। তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। কন্দলীর ভস্মীভূত হওয়ার সংবাদ পেয়ে মহর্ষি ঔর্ব ছুটে এলেন। আশ্রমেই পেয়ে গেলেন দুর্বাসাকে।

কঠোর কণ্ঠে ঔর্ব বলেন, ‘এ কী করলে তুমি দুর্বাসা? ঋষি হয়ে স্ত্রীঘাতী হলে?’

‘আমি নিরুপায় মহাত্মন। আপনার কন্যা অত্যন্ত কটুভাষী। তার অত্যাচারে প্রতিদিন আমি একবার করে মরেছি।’

‘তাই বলে আমার মেয়েটিকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিলে!’

দুর্বাসা কোনো উত্তর দেন না। শ্বশুরের এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে নেই।

ঔর্ব ক্রুব্ধ কণ্ঠে আবার বলেন, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমার মেয়েটির রাগ বেশি। সে গালমন্দ করে। সব জেনেশুনেই তো তুমি কন্দলীকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে! মানলাম, সে তোমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল, তুমি তাকে তাড়িয়ে দিতে পারতে! তা না করে একেবারে হত্যা করে বসলে কন্দলীকে! দেখো দুর্বাসা, তুমি বিখ্যাত একজন ঋষি, তোমাকে অভিশাপ দেব না আমি, তবে একটা কথা বলে যাচ্ছি, তুমি স্ত্রীহত্যার শাস্তি একদিন না একদিন ভোগ করবেই করবে।’ এই বলে ঔর্ব বিষণ্ন মনে সে স্থান ত্যাগ করে গেলেন।

ছয়

আত্মশোচনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এরপর দুর্বাসা কঠোর তপস্যায় রত হলেন। আত্মহত্যার ইচ্ছা মন থেকে ঝেঁটিয়ে বের করে দিলেন। তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলো। তিনি অনুধাবন করলেন, আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটা ঋষিসুলভ নয়। মন বিচলিত হলে একজন ঋষির উচিত ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন হওয়া। মনশ্চক্ষুকে দুই ভ্রু-র মধ্যিখানে স্থাপন করে জাগতিকতাকে ভুলবার প্রচেষ্টার নামই তো সাধনা! দুর্বাসা কঠোর সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। কিন্তু মন তো ইচ্ছার অধীন নয়! দুর্বাসার সমস্ত মনজুড়ে যে দেহবাসনার রাজত্ব! দুর্বাসা যখনই যোগসাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন, তখনই দেহ কথা বলে ওঠে, কন্দলী কোথায়? তাঁকে যে আমার ভীষণ প্রয়োজন!

দুর্বাসার দেহের সঙ্গে মনের এই ভীষণরকম যুদ্ধটা চলতে থাকল।

দুর্বাসা নিজের মনকে শান্ত করবার সাধনা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

.

একদিন দুর্বাসার তপোবনে এক মুনি এলেন। সেই মুনি কথায় কথায় কুন্তীর কথা দুর্বাসাকে জানালেন। তিনি বললেন, ‘কয়েকদিন আগে আমি কুন্তিভোজের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম মহর্ষি। রাজার কী সে আতিথেয়তা! প্রচুর খাবার! সুখনিদ্রার অবিশ্বাস্য ব্যবস্থা! রাজার বিগলিত বিনয়, দেবদ্বিজে তাঁর শ্রদ্ধা আমাকে মোহিত করেছে মহাত্মন! একদিন রাজার অপ্সরাতুল্য কন্যাটিকেও দেখলাম।’

‘অপ্সরাতুল্য কন্যা!’ গভীর নিন্দ্রামগ্ন মানুষ কারো ডাকে ধড়মড় করে উঠে যে কণ্ঠে কথা বলে, দুর্বাসাও সেই কণ্ঠে রাজকন্যাটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

মুনিটি নির্মোহ গলায় বললেন, ‘প্রাসাদ-উদ্যানে বিকেলের দিকে সহচরীদের নিয়ে হাঁটছিল কন্যাটি। রাজকন্যাটির নাম যেন কী! দাঁড়ান দাঁড়ান মহর্ষি, নামটি মনে করি। উ-হো, মনে পড়েছে, কুন্তী। কুন্তিভোজের কন্যাটির নাম কুন্তী। পূর্ণশশীর মতো রূপ, ভরাবর্ষার নদীর মতো….।’

‘থাক থাক। আর বলার দরকার নেই। একজন মুনির মুখে এর চেয়ে অধিক বাক্য উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়। ও হ্যাঁ, কী বলছিলেন যেন, রাজা কুন্তিভোজ অতিথিপরায়ণ?’ আলতো ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন দুর্বাসা।  

মুনি বললেন, ‘কুন্তিভোজের অতিথিপরায়ণতার কথা এরই মধ্যে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর বিশাল এক অতিথিশালা। দিনরাত সেই অতিথিশালাটি অতিথিদের সমাগমে গমগম করছে। আর একটি কথা মহর্ষি, তেমন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হলে তাঁদের সেবা ও আশীর্বাদের জন্য রাজা নিজকন্যাকে নিয়োজিত করেন শুনেছি।’

‘রাজকন্যাটির কথা আর একটু বিশদে বলবেন’ বলতে গিয়ে কথাটি গিলে ফেললেন দুর্বাসা। তাঁর দেহটি হঠাৎই শিরশির করে উঠল। মস্তিষ্ক থেকে শিশু পর্যন্ত কীসের যেন একটা উষ্ণ প্ৰবাহ অনুভব করলেন তিনি। সেই মুহূর্তেই দুর্বাসা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন, তিনি কুন্তিভোজরাজ্যে যাবেন, রাজার আতিথ্য গ্রহণ করবেন।

কেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন দুর্বাসা? কুন্তিভোজের পরমা সুন্দরী কন্যা কুন্তীই কি এর কারণ? কুন্তী অতিথিসেবায় বিশেষ যত্নশীল বলে, সেই সেবা গ্রহণ করার কামনা তাঁর মধ্যে দগদগ করে উঠেছিল? মুনিটির সঙ্গে কুন্তী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে কি তাঁর কন্দলীর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল? কন্দলীর দেহলাবণ্য, তাঁর সংসর্গ, তাঁর সোহাগ-সান্নিধ্য কি দুর্বাসাকে উতলা করে তুলেছিল কুন্তিভোজের আতিথ্যগ্রহণে? হয়তো তা-ই! নইলে কেন তপস্যায় নতুন করে মনোনিবেশী দুর্বাসা ঈশ্বরচিন্তা বাদ দিয়ে কুন্তিভোজের আতিথ্যগ্রহণে তৎপর হয়ে উঠলেন?

.

সেই অপরাত্নে ত্রস্ত পায়ে রাজতোরণের দিকে এগিয়ে এসেছিলেন মহারাজ কুন্তিভোজ। রক্ষীপ্রধানের সংবাদে তিনি যে ঋষি দুর্বাসাকে চিনে ফেলেছিলেন, এমন নয়। তবে রক্ষীপ্রধানের দেওয়া ঋষির শারীরিক বর্ণনায় অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, নিশ্চয়ই জগদ্বিখ্যাত কোনো তপস্বী হবেন! অনুমানের ওপর নির্ভর করে কুন্তিভোজ রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর গায়ে আলস্য, ঘুম ঘুম চোখ। রাজকার্য সম্পন্ন করে দিবসের আহার শেষে অন্তঃপুরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রাজা। চোখ দুটোও তন্দ্ৰায় জড়িয়ে এসেছিল। ঠিক ওই সময় খাসদাসী সংবাদটা পৌঁছিয়েছিল রাজার কাছে। আপনকক্ষ থেকে বেরিয়ে অলিন্দ পার করলে প্রধানরক্ষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল মহারাজার। তার মুখ থেকে তোরণে দণ্ডায়মান ঋষির বর্ণনা শুনে ত্বরিত পায়ে রাজভবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন কুন্তিভোজ।

কিছুটা এগিয়ে এসে সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করেই আঁতকে উঠেছিলেন কুন্তিভোজ। আরে! ইনি তো ভুবন কাঁপানো মহর্ষি দুর্বাসা! তাঁর ভেতরটা থরথর করে উঠল। দুর্বাসার কোপনস্বভাবের কথা মহারাজ কুন্তিভোজের অজানা নয়। চলার গতি আচমকা বেড়ে গেল রাজার। পড়ি কি মরি করে দ্রুত পায়ে দুর্বাসার দিকে এগিয়ে গেলেন কুন্তিভোজ।

সাষ্টাঙ্গে প্রণাম শেষে দুর্বাসার সামনে করজোড়ে দাঁড়ালেন মহারাজা।

ডান হাত তুলে উদার কণ্ঠে দুর্বাসা বললেন, ‘তোমার কল্যাণ হোক মহারাজ!’

মহারাজ বিগলিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার প্রাসাদে আপনাকে সানন্দে এবং সাগ্রহে আহ্বান জানাচ্ছি মহর্ষি। প্রাসাদাভ্যন্তরে পদার্পণ করে আমাকে কৃতার্থ করুন।’

হৃষ্টচিত্তে দুর্বাসা কুন্তিভোজের আবাহনে সাড়া দিলেন। তিনি রাজতোরণ পেরিয়ে প্রাসাদাভিমুখে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হলেন।

নয়নাভিরাম একটা কক্ষে মনোরম আসনে ঋষি দুর্বাসাকে বসতে দেওয়া হলো। রাজা নিজহাতে তাঁর দিকে পাদ্য-অর্ঘ্য এগিয়ে দিলেন।

রাজার বিনয় আর সুশোভন আচরণ দেখে দুর্বাসা যারপরনাই প্রীত হলেন। পাদ্য-অর্ঘ্য গ্রহণ শেষে প্রশান্ত চোখে কুন্তিভোজের দিকে তাকালেন দুর্বাসা।

বললেন, ‘তোমার এখানে কেন এসেছি জানো কুন্তিভোজ?

কুন্তিভোজ সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এ তো আমার পরম সৌভাগ্য মহর্ষি! আপনার মতো জগদ্বিখ্যাত একজন তপস্বী আমার পর্ণকুটিরে এসেছেন, এর চেয়ে মহানন্দের আর কী হতে পারে!’

দুর্বাসা বললেন, ‘আমি এসেছি তোমার আতিথ্য গ্রহণ করতে। শুনেছি, তুমি বেশ অতিথিপরায়ণ। শুনে আমার খুব লোভ হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমার আতিথ্য গ্রহণ করে দুটো দিন শরীরটাকে একটু আরাম দেব।’

‘এ তো বড় সুখের কথা মহর্ষি! আপনার যে কদিন ইচ্ছে, আমার বাড়িতে থাকুন। এতে রাজা হিসেবে ভারতবর্ষে আমার অহংকার বাড়বে।’

মহর্ষি উদাস ভঙ্গিতে বললেন, ‘তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এখানে আমার একটু কথা বলার আছে।’

‘কথা বলার আছে!’ কাঁচুমাচু হয়ে কুন্তিভোজ বললেন।

‘হ্যাঁ কুন্তিভোজ। আমার কথাটা হলো, দ্বারে দ্বারে আমি ভিক্ষা গ্রহণ করে তোমার গৃহে কিছুদিন থাকব।’

কুন্তিভোজ জানেন, দুর্বাসা একরোখা এবং কোপন-উন্মত্ত। তাঁর কথার বিরোধিতা করা মানে অভিশাপগ্রস্ত হওয়া। ভয়ে প্রথমে তিনি চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘এ-ই যদি আপনার সিদ্ধান্ত হয় মহর্ষি, তবে তা-ই হবে।

‘আরেকটি কথা মহারাজ।’ বলে একটু থামলেন দুর্বাসা। খোলা চোখে কুন্তিভোজের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘আমি যতদিন তোমার গৃহে বাস করব, ততদিন তুমি বা তোমার অন্য কোনো লোক আমার অভিপ্রায়ের বিপরীত কোনো আচরণ করতে পারবে না। এই শর্তে যদি রাজি না হও, তাহলে বলো। আমি অন্য রাজপ্রাসাদে যাই।’ বলে দুর্বাসা আসন থেকে গাত্রোত্থান করতে গেলেন।

কুন্তিভোজ হায় হায় করে উঠলেন, ‘এ কী বলছেন মহাত্মন! আপনার এই সামান্য শর্ত মানতে পারব না আমরা! আপনার যা অভিপ্রায়, তাই পূরিত হবে এখানে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আমার সাদর আতিথ্য গ্রহণ করুন।’

তৃপ্তিময় হাসির চিকন একটা রেখা দুর্বাসার চোখ থেকে জঙ্গুলে শ্মশ্রুতে মিলিয়ে গেল। বললেন, ‘তোমার গৃহে বাস করব আমার ইচ্ছানুসারে। আমি যতদিন থাকব আমার কক্ষের শয্যা, আসন প্রভৃতি ব্যবহার্য দ্রব্য সুশৃঙ্খলভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এর যেন অন্যথা না হয় কখনো।’

‘ঠিক আছে মহাত্মন। আপনার ইচ্ছানুসারে সব কিছু হবে।’

‘আর একটি কথা।’ বলে থেমে গেলেন মহর্ষি।

‘কী কথা মহর্ষি?’ সাগ্রহে জানতে চাইলেন কুন্তিভোজ।

‘না থাক। সেকথা বলার সময় এখনো হয়নি মহারাজ। সময় হলে বলব।’ বললেন দুর্বাসা। দুর্বাসা আসলে বলতে চেয়েছেন, তাঁকে সার্বক্ষণিক দেখভাল করার জন্য কাউকে চাই তাঁর। সে কুন্তিভোজের কন্যা হলে সবচাইতে ভালো হয়। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা নির্লজ্জের মতো বলেন কী করে দুর্বাসা? তাই ঢোক গিলে ফেললেন।  

কুন্তিভোজ দুর্বাসার কথা শুনে মনে মনে ভাবলেন, এই ঋষি অত্যন্ত কোপনস্বভাবী। যথেচ্ছাচারীও। বদরাগী এই মানুষটির সন্তুষ্টি বিধান করা খুব কঠিন। কখন কোন বাসনা প্ৰকাশ করে বসেন কে জানে! তখন সেই বাসনা পূরণ করতে না পারলে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বসবেন। কী করি! কী করব! নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো রাজার। মনের অস্থির ভাব তাঁর মুখাবয়বে ফুটে উঠল।

দেখতে পেলেন দুর্বাসা।

গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘বুঝতে পারছি মহারাজ, তুমি বেশ ফাঁপরে পড়ে গেছ। এই ক্রোধান্বিত ঋষিকে কী করে তৃপ্তি দেবে, আদৌ তৃপ্তি দিতে পারবে কিনা, ভেবে আকুল হচ্ছ তুমি। তাই তো?’

মুনির কথা শুনে কুন্তিভোজের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। দুহাত কচলাতে শুরু করলেন। ‘তুমি এক কাজ করো কুন্তিভোজ, আমার সেবায় তুমি এমন একজনকে নিয়োজিত করো, যার আছে অশেষ সহিষ্ণুতা, সহজে যে ধৈর্য হারায় না এবং তোমার মানমর্যাদা সম্পর্কে যে সর্বাধিক সচেতন। তাকেই তুমি আমার সেবা ও তুষ্টির জন্য নিযুক্ত করো।’ আস্তে আস্তে বলে গেলেন দুর্বাসা।

আগুপিছু না ভেবে কুন্তিভোজ হঠাৎ বলে ফেললেন, ‘মহর্ষি, কুন্তী নামে আমার এক যশস্বিনী কন্যা আছে। কুন্তীর কোনো অহংকার নেই। কপটতা সে পছন্দ করে না। অত্যন্ত ধৈর্যশীল সে। সে কখনো রাগে না। সকল কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করবার শিক্ষা পেয়ে সে বড় হয়েছে। ওই কুন্তীই আপনার সেবাযত্ন করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কুন্তীর শীলবৃত্ত দ্বারা আপনি তুষ্ট হবেন।’

দুর্বাসার চোখ দুটো আচমকা চিকচিক করে উঠল। তাঁর জিভে লালা উপচে পড়ল কিনা বোঝা গেল না। তবে কুন্তিভোজের প্রস্তাবে তিনি যে বেশ খুশি হয়েছেন, দুর্বাসার মুখমণ্ডল দেখে বোঝা গেল।

‘তা বেশ, তা বেশ।’ আনন্দধ্বনি করে উঠলেন দুর্বাসা। বড় একটা শ্বাস ফেললেন। কোনো একটা জটিল কাজে সিদ্ধিলাভ করলে মানুষ যেমন করে শ্বাস ফেলে, দুর্বাসার এই শ্বাসটিও ঠিক তেমনি।

দুর্বাসা বললেন, ‘তা তুমি আমাকে কোথায় থাকতে দেবে মহারাজ? আমার আবাসগৃহটি নির্দেশ করলে সেখানে যাব আমি।’

তারপর হাত দুটো ওপর দিকে তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন ঋষি। বললেন, ‘দীর্ঘ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তোমার এখানে এসে পৌঁছেছি। শরীরটা বড় ক্লান্ত কুন্তিভোজ।’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই মহর্ষি। আমি তার ব্যবস্থা করছি।’ বলে রক্ষীপ্রধানের দিকে তাকালেন কুন্তিভোজ। কী যেন একটা ইঙ্গিত করলেন।

রক্ষীপ্রধান দুহাত বাড়িয়ে প্রণতির ভঙ্গিতে দুর্বাসাকে আহ্বান জানাল। দুর্বাসা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

অতিথিশালার সবচাইতে জৌলুসময় অংশে ঋষি দুর্বাসার থাকার ব্যবস্থা হলো। অতিথিশালার এই অংশের রং দুধসাধা। অশ্বনদীর কূলঘেঁষেই অতিথিশালার এই অংশটি।

এবার কুন্তীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মহারাজ কুন্তিভোজ। বেশ বিচলিত দেখাচ্ছে তাঁকে। এই শীতসন্ধ্যাতেও মহারাজকে ঘামতে দেখা গেল।

রানি তপজাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার আর্য! আপনাকে এরকম অস্থির দেখাচ্ছে কেন! কোনো বিপদ-আপদ?’

‘বড় বিপদে পড়ে গেছি রানি! এই বিপদ থেকে আমাকে একমাত্র কুন্তীই উদ্ধার করতে পারে।’ ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন কুন্তিভোজ।

‘আমি?’ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল কুন্তী।

সাত

‘হ্যাঁ, তুমি। তুমিই কেবল পারো এই কোপনস্বভাবী ঋষির অভিশাপ থেকে আমাকে বাঁচাতে। মানুষ-দানব, দেবতা-যক্ষ, অপ্সরা-গন্ধর্ব কেউই রেহাই পায়নি ওঁর অভিশাপ থেকে। একটু ব্যতিক্রম হয়েছে, কেউ তাঁর কথার বিরোধিতা করেছে, অমনি কমণ্ডলুসমেত ডান হাতটি তুলে অভিসম্পাত দিয়েছেন।’

রাজাকে থামিয়ে দিয়ে মহিষী তপজা বলে উঠলেন, ‘হঠাৎ করে ঋষি দুর্বাসা সম্পর্কে এত কথা বলছেন কেন বুঝতে পারছি না আমি! আর দুর্বাসার সঙ্গে কুন্তীকেই-বা কেন যুক্ত করছেন?

দ্রুত রানির দিকে তাকালেন রাজা। রানি থেকে চোখ সরিয়ে কুন্তীর ওপর রাখলেন। তারপর মরাগলায় দুর্বাসার রাজবাড়িতে আগমন-বৃত্তান্ত বলে গেলেন। ফাঁকে ফাঁকে দুর্বাসা যে দুর্দমনীয় রাগের বশীভূত একজন ঋষি, তাও বললেন। তিনি আরও বললেন, ঋষিটি ইচ্ছে করলে এই সমৃদ্ধ কুন্তিভোজরাজ্যকে অভিশাপের আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারেন।

রানি বললেন, ‘সব তো বুঝলাম, তিনি আমাদের প্রাসাদে এসেছেন, আতিথ্যগ্রহণ করেছেন, আপনি সর্বোত্তম অতিথিকক্ষে তাঁর থাকার সুবন্দোবস্ত করেছেন। এর কোনোটাতেই তাঁর অসন্তুষ্ট হওয়ার কিছুই তো দেখছি না আমি! আপনি তো এ-ও বললেন আর্য, তাঁর আবাসস্থলের সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে রাখারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন! সব তো হলো! এখানে আপনার সন্ত্রস্ত হওয়ার তো কিছুই দেখছি না মহারাজ!’

‘আমি একটা কাজ করে বসেছি রানি।’ সংকুচিত কণ্ঠ রাজার।

‘একটা কাজ করে বসেছেন!’ অবাক কণ্ঠে তপজা জানতে চাইলেন।

‘ঋষি নিজের সেবা ও তুষ্টির জন্য এমন একজনকে চাইলেন, যার অসীম ধৈর্য।’

‘তো!’

‘আমি ধুম করে কুন্তীর নাম বলে ফেলেছি। বলেছি, আপনার সেবা ও তুষ্টি বিধানের জন্য আমার রাজপ্রাসাদে একজনই আছে, যে সর্বোত্তম। আর তার নাম কুন্তী।’

‘কেন বললেন আর্য? আপনার রাজপ্রাসাদে তো অজস্র দাসী! এদের অনেকেই বহু গুণে গুণান্বিত, ধৈর্যশীল, মায়াবতী। রূপবতীও তাদের অনেকে। আপনি তাদের নাম না বলে কুন্তীর নামই-বা বলতে গেলেন কেন? না না, এ আপনি ভালো করেননি। কুন্তী তো আমাদেরই কন্যা!’ বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলেন তপজা। তাঁর চোখেমুখে ক্রোধচিহ্নও দেখা গেল।

রানির কথা শুনে কুন্তিভোজ ভীষণভাবে কুঁচকে গেলেন।

পিতা কুন্তিভোজকে বড় ভালোবাসে কুন্তী। পিতার অসহায় অবস্থা দেখে বড় মায়া হলো তার। মাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘মা, আপনি বাবাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। বাবা ঋষির কাছে কথা দিয়ে এসেছেন, তাঁর সেবার জন্য আমাকে নিয়োজিত করবেন। এই মুহূর্তে আপনার রাগ-ক্ষোভ দেখে বাবা যদি অন্য কাউকে পাঠান, তাহলে মুনি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাছাড়া বাবা তো মিথ্যাচারী হবেন! আমার জন্য বাবা এরকম বেকায়দায় পড়বেন কেন?’

তারপর কুন্তিভোজের দিকে ফিরল কুন্তী। বলল, ‘আপনার প্রতিশ্রুতির খেলাপ হতে দেব না আমি বাবা। মুনির সেবার জন্য আমি যাব অতিথিশালায়।’

এই সময় রানি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘যা ইচ্ছে করো তোমরা। তোমরা যখন ঋষি পরাশরের কুকীর্তির কথা ভুলে গেছ, আমার করার কিছু নেই।’ বলে ধুপধাপ পা ফেলে মহিষী তপজা কক্ষান্তরে গেলেন।

কুন্তীর কথা শুনে রাজা কুন্তিভোজ কৃতার্থ বোধ করলেন। মেয়ের জন্য অহংকারে বক্ষদেশ স্ফীত হয়ে উঠল তাঁর। হঠাৎ করে দাদা শূরসেনের কথা মনে পড়ে গেল কুন্তিভোজের। মনে মনে দাদার উদ্দেশে জোড়হাত তুললেন।

স্বগত কণ্ঠে বললেন, ‘সত্যি দাদা, তুমি এমন এক মেয়ের জন্ম দিয়েছ, যাকে নিয়ে গর্ব করা যায়। কুন্তী মেয়ে নয়, হীরার টুকরা দাদা, সাগরসেঁচা মানিক!’

কুন্তী ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, ঋষি দুর্বাসার আবাসে কখন আমায় যেতে হবে?’

কন্যার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না কুন্তিভোজ। মোলায়েম গলায় বললেন, ‘মহাপ্রতাপশালী তপস্বী এই দুর্বাসা। এই ব্রাহ্মণ ঋষি আমাদের গৃহে আতিথ্যগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এর সঙ্গে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন। শর্তগুলোর কয়েকটা স্পষ্ট। কয়েকটা অস্পষ্ট, রহস্যময়। আমার ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে ওঁর শর্তগুলো অস্বীকার করি! সব কিছু বুঝেও তাঁর শর্তে রাজি হতে বাধ্য হয়েছি মা আমি।’

কুন্তী কিছু না বলে পিতার দিকে তাকিয়ে থাকল।

কুন্তিভোজ বলে যেতে লাগলেন, ‘আমি মা, একমাত্র তোমার ওপর নির্ভর করেই মুনির শেষ শর্তটি মেনে নিয়েছি।’

‘শেষ শর্ত! শেষ শর্ত আবার কী!’ এতক্ষণে কুন্তী কথা বলে উঠল।

‘দুর্বাসা বলেছেন, তাঁর সেবা এবং তুষ্টির জন্য এমন একজনকে নিয়োজিত করতে, যে অশেষ ধৈর্যশীল।’ ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন কুন্তিভোজ।

‘সেবা ও তুষ্টি!’

‘হ্যাঁ মা, হ্যাঁ। এই দুটি শব্দই উচ্চারণ করেছেন ঋষি দুর্বাসা। তিনি আরও বলেছেন, আমার মানমর্যাদা সম্পর্কে যে সর্বাধিক সচেতন, আমি যেন তাঁর সেবা ও তুষ্টির জন্য তাকেই নিয়োগ করি। আমি আচমকা তোমার নামটিই প্রস্তাব করে ফেলেছি মা।’ বলে মাথাটা নিচু করলেন রাজা। ‘ঠিক আছে বাবা। আপনি এখন আমায় খোলাসা করে বলুন, আমাকে কী কী করতে হবে।’

রাজা বললেন, ‘তুমি একাগ্রচিত্তে এই মহর্ষির সেবা করবে। বালিকাবেলা থেকেই তুমি সেবাপরায়ণ। দেবদ্বিজে তোমার অচলাভক্তি। আমার আত্মীয়স্বজন থেকে আরম্ভ করে রাজপ্রাসাদের দাসদাসী পর্যন্ত সবারই ওপর তোমার সানুকম্প দৃষ্টি। কুন্তী, তোমার সততা, সহানুভূতিশীল মনোভাব এবং মধুর স্বভাবের জন্য ভৃত্যরাও তোমার প্রতি আকৃষ্ট—এ আমি যথার্থভাবে জানি।’

‘বাবা, আপনি আসল কথা থেকে সরে গিয়ে শুধু আমার প্রশংসাই করছেন। পিতার মুখে কন্যার প্রশংসা শোভা পায় না বাবা।’ কোমল কণ্ঠে কুন্তী বলল।

রাজা একটু লজ্জা পেলেন বলে মনে হলো। তারপরও তিনি বললেন, ‘জানি মা, প্রকৃত মা-বাবা তাঁর সন্তানের গুণকীর্তন করে না। কিন্তু কুন্তী, তুমি তো যে-সে কন্যা নও! তুমি প্রশংসার্হ। আমি যে প্রশংসা করলাম, তা তো অহেতুক নয়! তুমি যা, বরং তার চেয়ে অনেক কমিয়ে বলেছি আমি।’

স্মিতচোখে কন্যার দিকে একবার তাকালেন কুন্তিভোজ। তারপর উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘হে কল্যাণী, কোপনস্বভাবের এই মহাতপস্বী ব্রাহ্মণকে তুমি সেবা দ্বারা তুষ্ট করতে পারলে আমার অপার শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, আর তোমার মঙ্গল হবে বহুতর।’

এবার অশ্রুতপূর্ব অদ্ভুত এক কণ্ঠে কুন্তী বলে উঠল, ‘আমার কল্যাণের দরকার নেই বাবা, আপনার শ্রীবৃদ্ধি ঘটলেই হলো।’

কুন্তীর কণ্ঠে কি প্রগাঢ় অভিমান?

ধরতে পারলেন না কুন্তিভোজ।

কুন্তিভোজ কিছু বলার আগে কুন্তী আবার বলে উঠল, ‘আমি যখন এই ঋষির সেবায় রত হব, তখন ওঁর সকল অনিয়মই আমি মেনে নেব। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেই তো খাবেন তিনি? যদি ভিক্ষা করতে বেরিয়ে ভোরবেলা বা সন্ধেবেলা অথবা গভীর রাতে—যখনই তিনি ফিরে আসেন, একটুও রাগ করব না আমি। তিনি কোনো নিয়ম না মানলেও আমি কখনো ওঁর সেবাকার্য থেকে বিরত হব না। যা করলে ঋষিবর সন্তুষ্ট হবেন, আমি সর্বদা তা-ই করব। আপনি ব্রাহ্মণকে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব আমি। এখন বলুন, কখন থেকে ওঁর সেবায় নিয়োজিত হব?’

কুন্তিভোজ বললেন, ‘রক্ষীপ্রধানকে নির্দেশ দেওয়া আছে, আজ রাতটা সে সামলে নেবে। আগামীকাল প্রাতে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে মহর্ষির সঙ্গে দেখা করব।’

কুন্তী বলল, ‘ঠিক আছে বাবা।’

.

পরদিন সকালে রাজা কুন্তিভোজ কন্যা কুন্তীকে নিয়ে দুর্বাসার কাছে উপস্থিত হলেন। তার আগেই মহর্ষি দুর্বাসা অশ্বনদীজলে ডুব দিয়ে স্নানকার্য সম্পন্ন করেছেন। প্রাতঃআহ্নিক সমাপনান্তে নিজকক্ষে বেদিমতন একটা জায়গায় যোগাসনে বসেছেন। তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। সেখানে শ্বেতশুভ্র উপবীতটি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। দৃষ্টি তাঁর সামনের দিকে প্রসারিত।

হঠাৎ দরজা অতিক্রম করে মহারাজ কুন্তিভোজকে আসতে দেখলেন তিনি। দুর্বাসা একটু নড়েচড়ে বসলেন। তাঁর অস্থির চোখ দুটো কী যেন খুঁজে ফিরছে! কুন্তিভোজের পেছন পেছন কুন্তীও যে এগিয়ে আসছে, দেখতে পেলেন না দুর্বাসা। তাঁর সেবাযত্নের দায়িত্বভার কুন্তীর নেওয়ার কথা ছিল। আস্ত একটা রাত পেরিয়ে গেল, কুন্তী এলো না! আজ সকালেও এত বেলা হয়ে গেল! কুন্তিভোজ এলো, কই কুন্তী তো এলো না! দুর্বাসার খুব রাগ করতে ইচ্ছা করল। তাঁর মস্তিষ্ক উষ্ণ হতে শুরু করল। উচ্চৈঃস্বরে কিছু একটা বলতে যাবেন, ওই সময় কুন্তিভোজ বাঁ পাশে সরে দাঁড়ালেন।

তীব্র এক উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দুর্বাসার চোখেমুখে এসে লাগল। ঋষির চোখ জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হলো। এ কোনো হুতাশনকণার ঝলকানি নয়, এই তীক্ষ্ণ আলোকছটা কুন্তীর রূপের।

দুর্বাসার ঘোর কাটতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল!

মহারাজার কথায় ঋষি সংবিতে ফিরলেন, ‘মহর্ষি, এই আমার কন্যা। সর্বগুণান্বিত কুন্তী। আজ থেকে সে আপনার সেবায় নিয়োজিত হলো।’

বিস্ফারিত চোখে কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থেকে দুর্বাসা বললেন, ‘উত্তম, উত্তম। তা তোমার কষ্ট হবে না বালিকা?’

ঋষির কথার উত্তর না দিয়ে কুন্তী প্রণিপাতকার্য সম্পন্ন করল। মুচকি একটু হেসে অতি নিম্ন স্বরে বলল, ‘বহু বছর আগে আমি বালিকাবয়স পেরিয়ে এসেছি মহাত্মন। এখন আমি যুবতি।’

দুর্বাসা এতই বিভোর ছিলেন যে কুন্তীর কথাগুলো তাঁর কানে ঢুকল না। কিন্তু কুন্তিভোজ শুনতে পেলেন। ঋষি শুনতে পেয়েছেন ভেবে তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হলেন।

কুন্তীর কথাকে চাপা দেওয়ার জন্য মহারাজ তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ঋষিবর, আমার কন্যাটি চিরকালই সুখে লালিত। একটা কষ্ট ছাড়া কুন্তীকে আমি আর কোনো কষ্ট দিইনি।’ কুন্তীর দিকে তাকিয়েই কথাটি বললেন কুন্তিভোজ।

শিশুকালে প্রকৃত মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের রাজপ্রাসাদে আনবার সময় পৃথার যে চোখমুখ দেখেছিলেন, সে সময়ে বুঝে গিয়েছিলেন, পৃথার মনে অপার কষ্ট দিয়েছেন তিনি। তাঁর রাজপ্রাসাদে আসার পর পূর্বের বালিকাসুলভ চঞ্চলতা, যা শূরসেনের প্রাসাদে পৃথার মধ্যে দেখেছেন, তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাননি কুন্তিভোজ। সেই থেকে কুন্তিভোজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন কুন্তীর কষ্টকে। আজ সুযোগ পেয়ে সেই কথাটিই বলে ফেললেন তিনি।

পিতার কথা শুনে চট করে তাঁর দিকে তাকাল কুন্তী। তার চোখে তখন বহু বছরের জমাটবাঁধা বেদনা। কুন্তী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল। এগিয়ে গিয়ে বাবার হাত ধরল।

কুন্তিভোজ আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার কুন্তী যদি ভুলক্রমে কোনো অপরাধ করে বসে, তাহলে নিজগুণে ওকে ক্ষমা করে দেবেন মুনিবর।

দুর্বাসা সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘তুমি ওভাবে বলছ কেন মহারাজ? তোমার মেয়েকে দেখে আমার এই মনে হচ্ছে, কুন্তী অপরাধ করার মেয়ে নয়। আমার মনে হচ্ছে, কুন্তী অত্যন্ত বিচক্ষণ।

‘তার পরও যদি কোনো অপরাধ…।’

দ্রুত কুন্তিভোজের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দুর্বাসা বললেন, ‘তথাস্তু। আমি কুন্তীর ওপর রাগ করব না।’

আশ্বস্ত হয়ে কুন্তিভোজ রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন।

দুর্বাসার সেবাযত্নের জন্য কুন্তী অতিথিশালায় থেকে গেল।

.

সুধাধবলিত দুর্বাসার আবাসস্থলে কুন্তীর সেবিকাজীবন শুরু হলো। কুন্তী রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই এখানে এসেছে। সে জানে, এখানে তাকে অনেক দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হবে। সে এও জানে, এই দুর্ভোগে সে ভেঙে পড়লে তার পরাজয়, তার পিতার পরাজয়। কিছুতেই পরাজয়কে মেনে নেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে সে এখানে এসেছে।

দুর্বাসা প্রাসাদের বাইরে লোকালয় থেকে মাধুকরীবৃত্তি অবলম্বন করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করবেন এ তথ্য কুন্তীর জানা। তাই তাঁর আহারের জন্য উৎকণ্ঠায় থাকতে হতো না তাকে। তার যত উদ্বেগ ঋষির আসা-যাওয়ার সময়কে নিয়ে। সকালে বেরোবার সময় দুর্বাসা বললেন, তিনি অপরাহের মধ্যে ফিরবেন, কিন্তু ফিরলেন অধিক রাত্রে। আবার যেদিন বলে গেলেন অধিক রাতে ফিরবেন, ফিরে এলেন সকাল সকাল।

ফিরেই দুর্বাসা দেখতেন, অতন্দ্র প্রহরীর মতো গৃহদ্বারে কুন্তী দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি উত্তমরূপে গুছিয়ে রেখেছে কুন্তী।

আট

ঋষি দুর্বাসা যে সবসময় ভিক্ষান্ন খেতেন, তা নয়। মাঝে মাঝে অতিথিশালাতেও খেতেন।

কুন্তীকে বলতেন, ‘আজ মাধুকরীতে যাব না। আজ দ্বিপ্রহরে এই অতিথিশালাতেই খাব। তুমি আমার খাবারের আয়োজন করো।

দুপুরে খেতে বসে প্রচণ্ড রেগে যেতেন দুর্বাসা। মুখের খাবার থু থু করে ফেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কটুকাটব্য শুরু করতেন, ‘ছে ছে ছে! এ কী রান্না করেছ তুমি! এটা কী খাবার? গাধাকে দিলেও তো গাধা এ খাবার ছুঁয়ে দেখবে না! আমাকে মানুষ ভাবলে না তুমি কুন্তী? ‘

কুন্তী মুখ বুজে দুর্বাসার সকল ধিক্কার হজম করে। কুন্তী ভালো রাঁধে–এই কথা কুন্তীর রান্না খেতে খেতে কুন্তিভোজ আর তপজা বহুবার বলেছেন। কুন্তী স্বয়ং জানে, ও খারাপ রাঁধে না। আজও সে খুব যত্ন করে দুর্বাসার জন্য রেঁধেছে। রান্না যে স্বাদযুক্ত হয়েছে, এ ব্যাপারে কুন্তী নিশ্চিত। তাহলে দুর্বাসা ধিক্কার দিয়ে উঠলেন কেন? কুন্তীর বুঝতে বিলম্ব হলো না যে দুর্বাসার এই তিরস্কার ইচ্ছাকৃত। ইচ্ছা করেই তিনি তাকে উত্তেজিত করতে চাইছেন। যাতে রাগের বশে কুন্তী কটূক্তি করে বসে।

বাঁকা একটু হাসল কুন্তী। ঋষিবর, আপনি আমাকে যতই নিন্দামন্দ করে রাগাবার চেষ্টা করুন না কেন, কিছুতেই রাগব না আমি। আপনার ফাঁদে আমি পা দেব না। মনে মনে বলল কুন্তী।

কুন্তী মধুময় কণ্ঠে বলল, ‘আপনি রাগ করবেন না মহর্ষি। আমি আবার খাবার রান্না করে নিয়ে আসছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’ এই বলে কক্ষান্তরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কুন্তী।

দুর্বাসা বলে ওঠেন, ‘হয়েছে হয়েছে! নতুন করে হাত পোড়াতে হবে না তোমায়। এগুলোই আমি খেয়ে নিচ্ছি। তুমি বরং আমাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করো।’

ঠেলে দেওয়া খাবারের থালিকাটা নিজের দিকে টেনে নিলেন দুর্বাসা। গ্রাস মুখ তুলে তৃপ্তিতে দুচোখ বুজলেন।

এইভাবে নানা সময়ে নানা রকম ভর্ৎসনা, নিন্দা, গালাগালি দিতেন দুর্বাসা। কুন্তী নীরবে সব সহ্য করত। একটুও রাগ করত না সে। উপরন্তু সদা হাস্যময় থাকত।

কুন্তিভোজ কন্যাকে প্রত্যহ জিজ্ঞেস করতেন, ‘পুত্রী, ঋষি কি তোমার সেবায় পরিতুষ্ট হচ্ছেন?’  

কুন্তী বুকের তলায় সকল অপমান চেপে রেখে হাসিমুখে বলত, ‘ব্রাহ্মণ যারপরনাই আনন্দিত হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে বাবা। সেবায় কোনো ত্রুটি রাখছি না আমি।’

‘তা বেশ। তবে জানতে ইচ্ছে করছে মা, মহর্ষি কি একবারও তোমার সঙ্গে রাগারাগি করেননি?’

তৎক্ষণাৎ পিতার দিকে তাকাল কুন্তী। পিতাকে কষ্ট দিতে চাইল না সে। তাই একটু ঘুরিয়ে উত্তর দিল, ‘ক্রোধ যে ভালো জিনিস নয়, এটা বুঝে গেছেন ঋষি। রাগ দেখিয়ে সব কিছু হাসিল করা যায় না, এটা আগে না জানলেও এখন জানছেন তিনি।’

কন্যার ঘোরপ্যাচি উত্তরটা ঠিকঠাক মতন অনুধাবন করতে পারলেন না কুন্তিভোজ। সারাংশ যা বুঝলেন, তা হলো—তাঁর মেয়েটি দুর্বাসার রাগের কারণ হয়ে ওঠেনি এখনো।

.

শৈশবের ছোট্ট পৃথা কুন্তিভোজের প্রাসাদে এসে হঠাৎই ধীরস্থির হয়ে গিয়েছিল। নিজের মধ্যে নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করে নিতে শুরু করেছিল সে। তারুণ্যে যথাযথ গুণসম্পন্ন হয়ে উঠল কুন্তী। সহনশীলতা তার চরিত্রের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল। এই সহিষ্ণুতার কারণে দুর্বাসার সমস্ত রকম স্বেচ্ছাচারিতা কুন্তীকে স্পর্শ করতে পারেনি। দুর্বাসার দুর্ব্যবহারের বিপরীতে কুন্তীর রাগের যথেষ্ট কারণ থাকলেও, রাগ করেনি সে।

কুন্তীর অদ্ভুত ধৈর্য দেখে দুর্বাসা বিস্ময়বোধ করতে শুরু করলেন। রাগ থেকে বিস্ময়। বিস্ময় থেকে মধুর ব্যবহার। হ্যাঁ, দুর্বাসা ধীরে ধীরে কুন্তীর সঙ্গে মধুর ব্যবহার শুরু করলেন। দুর্বাসা ভাবতে বসলেন, যে সেবা পাওয়ার লোভে তিনি কুন্তিভোজের রাজপ্রাসাদে এসেছিলেন, সেই সেবা তো তিনি পূর্ণমাত্রায় পেয়ে যাচ্ছেন! তারপরও তাঁর মধ্যে এত অস্থিরতা কেন? কেন হঠাৎ হঠাৎ ক্রোধ তাঁর মাথায় চড়ে বসে? অপ্রাপ্তি থেকেই তো ক্রোধের জন্ম! এই রাজপ্রাসাদে তাহলে তাঁর অপ্রাপ্য জিনিস কী? তৎক্ষণাৎ দুর্বাসার মনে হলো, তিনি এখানে তুষ্টি পাচ্ছেন না। তুষ্টি মানে তৃপ্তি।

কোনো একটা বস্তু এখনো এখানে অপ্রাপ্ত থেকে গেছে বলে তাঁর মনে তৃপ্তির সঞ্চার হচ্ছে না। তৃপ্তিদায়ক সেই বস্তুটি কী?

আচমকা দুর্বাসার চোখমুখ চকচক করে উঠল। তিনি সেই অলভ্য বস্তুটির সন্ধান পেয়ে গেছেন। সেই বস্তুটি আর কেউ নয়, সে কুন্তিভোজপুত্রী কুন্তী।

দুর্বাসা একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপী ঋষি ছিলেন। তাঁর তেজোময় মনে আঁচড় কাটল সাহসিক- তিলোত্তমার রমণদৃশ্য। তারপর তো তিনি নিজেই সাহসিক হয়ে গেলেন। কন্দলী এলেন তাঁর জীবনে। অনাস্বাদিত এক যৌনজীবনের সন্ধান পেলেন দুর্বাসা। কন্দলী তাঁর রূপ ও যৌবন দিয়ে দুর্বাসাকে উন্মাদ করে ছাড়লেন। সেই কন্দলী দুর্বাসার রাগের আগুনে ছাই হয়ে গেলেন একদিন। কন্দলী ভস্মীভূত হলে কী হবে, কন্দলীকে শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে দুর্বাসার মধ্যে যে যৌনলিপ্সার সৃষ্টি হয়েছিল, তার তো অবসান হলো না! তাঁর মধ্যকার লালসা দিন দিন তীব্রতর হয়ে উঠেছে। পঠন-পাঠন-ধ্যান-যজ্ঞের কারণে এতদিন সেই লোভ সুপ্ত ছিল। কুন্তীর সান্নিধ্যে এসে সেই নারীলোলুপতা দুর্বাসার মধ্যে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল

তিনি কুন্তীর মধ্যে কন্দলীকে দেখতে শুরু করলেন।

দুর্বাসার কথার ভঙ্গি বদলে যেতে লাগল। গালাগালির পরিবর্তে মধুর সম্ভাষণ। তাঁর রাগ তিরোহিত হয়ে গেল। যথার্থ তপস্বীর মতো তাঁর মধ্যে শান্ত-সৌম্যভাব। তিনি মাধুকরীবৃত্তি অনেকটা ছেড়েই দিলেন। দিনরাত নিজকক্ষে অবস্থান করা শুরু করলেন।

‘হে দীৰ্ঘনয়না, আমাকে একপাত্র জল দাও। হে কুমারী, আমার বিছানাটা গোছগাছ করে দাও। ওহে মধুরভাষিণী, তুমি কোথায় গেলে, আমার পাশে একটু বসো।’ এরকম কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন দুর্বাসা।

কুন্তী তো অবাক! কোন মন্ত্রবলে ঋষির এমন পরিবর্তন হলো, ধরতে পারল না কুন্তী।

এইভাবে কুন্তিভোজের অতিথিশালায় এক বছর শেষ হতে চলল। এর মধ্যে কুন্তীর প্রতি দুর্বাসা সম্পূর্ণরূপে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন। রমণীয় শয্যায়, আহারে-ব্যসনে দুর্বাসার সেই আকর্ষণ গাঢ়তর হয়েছে। বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে হরিণশোণিত তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। উন্মত্ত হয়ে মনুষ্যরক্ত খুঁজে বেড়াতে থাকে বাঘ। বহুদিনের অনুসন্ধানে কোনো মানুষকে সামনে পেলে বাঘ মৃত্যুর পরোয়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুর্বাসাও তেমনি কন্দলী-সম্ভোগের পর কুন্তীকে নির্জনে পেয়ে মনুষ্যশোণিতলিপ্সু ব্যাঘ্র হয়ে গেলেন।

.

কুন্তীকে এক সাঁঝবেলাতে বলাৎকার করে বসলেন দুর্বাসা।

কুন্তী তখন রজঃস্বলার পরবর্তী দিনগুলো পার করছিল।

বলাৎকারের পর অনিবার কেঁদে গেল কুন্তী।

নির্মোহ চোখে কুন্তীর রোদন দেখে গেলেন দুর্বাসা। দুর্বাসারা এরকমই। তপোতেজে ওঁরা তেজস্বী হয়ে ওঠেন, জনসমাজে প্রচারিত হয়—এসব মহাতেজা ঋষিরা অরিন্দম। ষড়রিপু তাঁদের পদানত। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, ওঁরা প্রথম রিপুর কাছেই নতজানু। শুধু দুর্বাসা কেন, মহর্ষি পরাশরও কি কম যান? জেলেপল্লির অসহায় এক কুমারীকে একা পেয়ে নৌকামধ্যে বলাৎকার করলেন। বিচার হলো না তাঁর। তিনি নাকি আশীর্বাদ করে গেলেন, মাতৃত্বের কোনো চিহ্ন তোমার শরীরে থাকবে না মৎস্যগন্ধা, ভবিষ্যতে তুমি হয়ে উঠবে বিখ্যাত এক রাজার মহিষী। কাকতালীয়ভাবে মৎস্যগন্ধা রাজা শান্তনুর মহিষী হয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু ধর্ষণের আঘাতটি মৎস্যগন্ধা মন থেকে মুছে ফেলতে পেরেছিলেন?

কুন্তীর বেলাতেও দুর্বাসা পরাশরের শঠামিটা করলেন। বললেন, ‘তুমি কেঁদো না কুন্তী। তোমার সঙ্গে যা করেছি, জীবধর্মের তাগিদেই করেছি। দেখো, মানুষের খিদে দুরকমের—পেটের খিদে, আর শরীরের খিদে। শরীরের খিদেকেই কাম বলে। আমিও মানুষ কুন্তী। ধ্যানে-জ্ঞানে যত বড় তপস্বীই হয়ে উঠি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমি রক্ত-মাংস-পুঁজের একজন মানুষ। আমিও কামান্ধ কুন্তী। তারই বশবর্তী হয়ে আজ আমি…।’ বলে মাথা নিচু করলেন দুর্বাসা।

‘তুমি যত পারো আমাকে ধিক্কার দাও কুন্তী। প্রথম রিপুর কাছে আমি অসহায়। কন্দলী আমার ভেতর যে আগুন জ্বালিয়ে রেখে গেছে, তার থেকে মুক্তি পাইনি এখনো আমি। তুমি আমায় মাফ করো কুন্তী।’ বলে কুন্তীর হাত ধরতে গেলেন দুর্বাসা।

কুন্তী ছিটকে দূরে সরে গেল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘ছি!’

অসহায় ভঙ্গিতে দুকদম পিছিয়ে গেলেন দুর্বাসা।

ওই সময় কুন্তীর দলিত-মথিত কণ্ঠস্বর দুর্বাসার কানে এসে ধাক্কা দিল, ‘এখন আমি মা- বাবাকে কী জবাব দেব? যদি আমার গর্ভে সন্তান আসে, তার জনকের কী নাম বলব?’

‘বলবে, তোমার সন্তানের জনক সূর্যদেব। আমার প্রচণ্ড তেজোময়তার জন্য লোকে আমাকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করে। তুমি যখন তোমার সন্তানের জনক হিসেবে সূর্যের নাম করবে, মানুষেরা ভাববে, সূর্যদেবতা বুঝি তোমার গর্ভদান করেছেন। মানুষেরা অলৌকিকতায় অভিভূত হতে পছন্দ করে। কুন্তী তুমি তো জানবে, তোমার এই সন্তানের পিতা আমি দুর্বাসা, লোকে যাকে সূর্য বলে মানে।’ অকম্পিত কণ্ঠে মিথ্যে বলার কৌশলটা কুন্তীকে বলে গেলেন দুর্বাসা।

দুর্বাসার কথা শুনে লজ্জায় ঘৃণায় নিথর হয়ে গেল কুন্তী।

কিন্তু দুর্বাসা থামলেন না। তাঁর মিথ্যে ভাষণকে আরও বেশটুকু প্রসারিত করলেন, ‘তুমি আরও বলবে, আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তোমাকে দেহসম্ভোগের মন্ত্রটি বর হিসেবে শিখিয়ে গেছি। এই মন্ত্র একবার মনে মনে আওড়ে যে দেবতাকে স্মরণ করা হয়, সেই দেবতা এসে উপস্থিত হন। তবে শর্ত এই, উপস্থিত দেবতাকে খালি হাতে ফেরানো যায় না। আর বলবে, যুবতিসুলভ কৌতূহলে তুমি মন্ত্রটা আওড়ে সূর্যদেবকে স্মরণ করেছ। সূর্যদেব উপস্থিত হয়েছেন এবং তুমি তাঁর কামনা নির্বাপণ করেছ।’

‘এত বড় প্রতারণা! এ জঘন্য মিথ্যেটি আমাকে সারাজীবন বলে বেড়াতে হবে! হা ঈশ্বর! তুমি আমার প্রাণ হরণ করে নিয়ে যাও ঈশ্বর! আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না!’ বলে পাশের শিলাখণ্ডে মাথা ঘষতে শুরু করল কুন্তী।

পরদিন অতি প্রত্যুষে কুন্তিভোজের অতিথিশালা ত্যাগ করে গেলেন দুর্বাসা।

কুন্তী রাজপ্রাসাদে ফিরে নিজকক্ষের দরজায় খিল তুলেছে। বিছানায় শুয়ে আদ্যপ্রান্ত ভেবে গেছে কুন্তী। প্রথমে মনে পড়েছে, তার পালকপিতা কুন্তিভোজের কথা। পিতাকে কুন্তী যত অন্তর দিয়ে ভালো বেসেছে, পিতা কিন্তু সেরকমভাবে তাকে ভালো বাসেননি। যদি বাসতেন, তাহলে দুর্বাসার মতো একজন উন্মাদপ্রায় ঋষির সেবায় তাঁকে নিয়োজিত করতেন না। রাজা তো জানতেনই, এসব মুনিঋষির প্রকৃত চারিত্র্য। তাঁরা যে কামের ক্রীতদাস—এটা ভালোভাবেই জানা ছিল মহারাজ কুন্তিভোজের। সব জেনেও পিতা তাকে দুর্বাসার কাছে পাঠিয়েছেন। ভেবেছেন, দুর্বাসা দ্বারা কুন্তীর যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তাঁর নিজের তেমন কিছু আসবে-যাবে না। কুন্তী তো আর তাঁর নিজকন্যা নয়! দত্তককন্যা মাত্র! তাই তো তিনি তার মতামত না নিয়ে দুর্বাসাকে কথা দিয়ে এসেছেন। বলাৎকারের জন্য দুর্বাসা যদি অপরাধী হিসেবে দণ্ডিত হন, তাহলে সেই শাস্তির ভাগীদার রাজা কুন্তিভোজও। সব কিছু জেনেবুঝেই তো তিনি তাকে হিংস্র জানোয়ারের মুখে ঠেলে দিয়েছেন! হ্যাঁ, দুর্বাসা জানোয়ারই তো! জানোয়ারেরই তো কোনো নীতি-নৈতিকতা নেই! দুর্বাসারও তা নেই। বলাৎকারের আগে কত অনুনয়-বিনয় করেছে দুর্বাসাকে, বলেছে, আপনি আমার পিতার মতো, আপনি জগদ্বিখ্যাত তপস্বী, আপনি অধর্ম করবেন না। পৃথিবীতে আপনার কুযশ কীর্তিত হবে।

কুন্তীর কোনো অনুনয়কে কানে তোলেননি দুর্বাসা।

নয়

কুন্তী গর্ভবতী হলো।

এ লজ্জা লুকায় কোথায় কুন্তী!

পিতাকে যদি সত্য কথাটি বলে, বিশ্বাস করবেন না। উলটো এত বড় একজন তপস্বীর বিরুদ্ধে বলায় কুন্তীর ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন কুন্তিভোজ। বলবেন, অন্য কারো সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষ্পাপ ঋষিটির ওপর দোষ চাপাচ্ছ তুমি কুন্তী! আসল কথাটি বলো, কে আসল দুষ্কৃতকারী?

মা তপজা শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন। চিৎকার করে ঘটনাটা রাষ্ট্র করে ছাড়বেন। খুব ভালোবাসেন, এমন পিতা যদি সেবার নামে তথাকথিত মহাতেজা ঋষি দুর্বাসার হাতে তাকে সমৰ্পণ করতে পারেন, ভালোবাসেন না, এমন মা তপজার কানে এই কথাটি গেলে বিশাল এক গণ্ডগোল তৈরি করে ছাড়বেন। নিজের সন্তান হওয়ার পর এমনিতেই তপজার কাছে কুন্তী অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছে।

এছাড়া কুমারী অবস্থায় তার গর্ভবতী হওয়ার কথাটি কোনোভাবে রাজ্যে প্রচার হয়ে গেলে বাবা কুন্তিভোজের অসম্মানের অন্ত থাকবে না। তাঁর সকল যশ-ঐশ্বর্য নিমিষেই ধুলোয় মিশে যাবে। তা হতে দেবে না কুন্তী কিছুতেই। যেকোনো মূল্যে তার গর্ভধারণের কথাটি গোপন রাখবে সে।

কুন্তীর আবাসকক্ষটি প্রাসাদের উত্তরদিক ঘেঁষেই। তরুণী হয়ে ওঠার পর ওই অংশটিকেই বেছে নিয়েছিল সে। প্রাসাদের ওই দিকে প্রকৃতি উদার হস্তে নিজেকে সাজিয়েছে। ওই দিকের ভূ- প্রকৃতি কিছুটা টিলার মতন। সেখানে নানা বৃক্ষের সমাহার। টিলার পাদদেশ ঘেঁষে প্রাসাদের একেবারে গা ছুঁয়ে অশ্বনদী। নদীর কলকল কুন্তীর আবাসকক্ষ পর্যন্ত পৌঁছায়। জলকোলাহল কুন্তীর বড় প্রিয়। কুন্তীর ঘরটির অদূর থেকে টানা অলিন্দের পর নদীজলছোঁয়া সোপান আছে। কখনো কখনো সোপান বেয়ে নদীজল পর্যন্ত নেমে যেত কুন্তী। সোপানতলে পানসি বাঁধা থাকত।

এই কক্ষটিতে নিজেকে বন্দি করে ফেলল কুন্তী। একান্তে নিজঘরটিতে দিনাতিপাত করতে শুরু করল। মা তপজা এমনিতেই তার তেমন খোঁজখবর রাখেন না। দশ দশজন পুত্রসন্তান নিয়ে তিনি এখন মহাব্যস্ত। ফলে মায়ের দিক থেকে কুন্তী অনেকটাই নিরাপদ।

পিতা কুন্তিভোজও এখন ভীষণ ব্যস্ত।  

কুন্তী দাসীর কাছে শুনল, কোনো এক করদরাজা নাকি বিদ্রোহ করে বসেছে! তাকে শায়েস্তা করবার জন্য কুন্তিভোজ এখন যুদ্ধায়োজনে ব্যাপৃত। বেশ কিছুদিনের জন্য পিতাও তার খোঁজখবর নেবেন না।

দাসীদের মধ্যে কুন্তী প্রচার করল, গেল এক বছর ঋষি দুর্বাসার সেবা করতে করতে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। দুর্বাসার যথেচ্ছাচারিতার জন্য নিজের শরীরের যত্ন নিতে পারেনি মোটেই। ঋষির সেবাযত্ন করতে করতেই তার দিন গেছে, রাত গেছে। বিশ্রাম-ঘুম তার জীবন থেকে তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল একটি বছর ধরে। তার পরিশ্রান্ত শরীর আর ক্লান্তবিষণ্ন মন এই মুহূর্তে বিশ্রাম চাইছে।

কুন্তী দাসীদের উদ্দেশে বলল, ‘সামনের বেশ কিছুটা দিন আমি আমার ঘরে একা থাকতে চাই। কেউ আমাকে বিরক্ত করুক, চাই না আমি। আজ থেকে আমি না-বলা পর্যন্ত তোমাদের ছুটি। ক্লান্তি কেটে গেলে আমি তোমাদের আবার ডেকে নেব। এই বিশ্রামের সময় কাউকে না কাউকে তো দরকার আমার! তোমাদের মধ্য থেকে আমি মঞ্জরিকে বেছে নিচ্ছি। আমার খাওয়া-নাওয়া থেকে সকল কিছুর দায়িত্ব আজ থেকে ও-ই নেবে।’

দাসীরা কুন্তীর কথা মেনে নিল। এই এক বছরে তারা তো দুর্বাসা সম্পর্কে কম শোনেনি! এই একটা বছর ওই মুনিটা রাজকুমারীকে যে নানাভাবে অপমান-অপদস্থ করেছে, তা শুনতে-দেখতে বাকি থাকেনি কারো। তাই কুন্তীর কথায় অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পেল না দাসীরা।

দাসীরা ফিরে গেল। থেকে গেল মঞ্জরি!

মঞ্জরি কুন্তীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত দাসী। রাজকুমারীকে মঞ্জরি ভীষণ ভালোবাসে। সেইদিন থেকে রাজকন্যা কুন্তীর দেখাশোনার সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল মঞ্জরি।

সেইদিন থেকেই কুন্তীর একাকী জীবনযাপন শুরু হলো। মঞ্জরি ছাড়া আর কারো সঙ্গে তার সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলল কুন্তী।

দিন যেতে থাকল। এক দুই তিন করে মাসও গড়াতে লাগল। এটা ঠিক যে প্রথমবার গর্ভবতী হওয়া নারীর সন্তানধারণচিহ্ন খুব বেশি প্রকট হয়ে ওঠে না। দ্বিতীয়, তৃতীয়বারের গর্ভবতী নারীদের উদর বেশ স্ফীত হয়ে দৃশ্যমান হয়। কুন্তী যেহেতু প্রথমবার গর্ভধারণ করেছে, সেজন্য তার মাতৃত্বের চিহ্নগুলো তেমনভাবে উৎকট হয়ে উঠল না।

তার পরও মঞ্জরি তো নারী! তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। মঞ্জরি অচিরেই বুঝতে পারল, রাজকুমারী মা হতে চলেছে। সে এও বুঝে গেল, রাজকন্যার বিশ্রামের ব্যাপারটা নির্জনে থাকার অছিলা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবার সাহস করল না মঞ্জরি। আপনমনে রাজকন্যার সেবাযত্ন করে যেতে লাগল।

একদিন মঞ্জরিকে উদ্দেশ করে কুন্তী বলল, ‘তোমার কাছে লুকানোর কিছুই নেই আমার। সন্তান এসেছে আমার পেটে। কোনো অবৈধ কর্মের ফল নয় এটি। এই সন্তানের জনক আছে— তোমাকে এইটুকু শুধু বলব। তবে তোমাকে এর পিতার নাম বলব না। জেনে রাখো, এই সন্তানের জন্মের পেছনে সূর্যদেবের ভূমিকা আছে।’ এইটুকু বলার পর গলা আটকে গেল কুন্তীর। নির্জলা মিথ্যে বলতে গিয়ে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল। দাসী মাথা নিচু করে সব শুনে গেল।

সন্তান প্রসবের দিন ঘনিয়ে এলো। মঞ্জরি অতি গোপনীয়ভাবে সুনিপুণা এক ধাত্রীকে রাজকন্যার কক্ষে ডেকে আনল। একদিন একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। দাসী, ধাত্রী আর কুন্তীর নিখুঁত প্রচেষ্টার কারণে অন্তঃপুরের কেউই এই কথা জানতে পারলেন না।

পুত্রটি সোনার বরণ। গায়ে সুবর্ণ বর্ম, কানে সোনার কুণ্ডল

কুন্তীর মাতৃহৃদয় উতলে উঠল। এই সোনার টুকরাটি তার সন্তান? তারই গর্ভজাত এই পুত্রটি! বিশ্বাস করতে মন চাইছে না কুন্তীর। হায় পুত্র! পুত্র রে! এতদিন পেটে ছিলি, ভালো ছিলি। এখন বাইরে এলি তুই! তোকে দেখে মনকে তো স্থির রাখতে পারছি না রে পুত্র! এখন আমি তোকে কোথায় লুকিয়ে রাখি! তোকে লুকিয়ে রাখার মতো কোনো জায়গা নেই রে পুত্র এই রাজপ্রাসাদে! তুই যে আমার কুমারীপুত্র রে! তোর সন্ধান পেলে রাজবাড়ির সবাই এর পিতা কে জানতে চাইবেন। আমি কী করে বলব, তুই দুর্বাসার বলাৎকারের সন্তান! তখন আমার পিতা কুন্তিভোজের কলঙ্কের যে আর সীমা থাকবে না রে পুত্র! তোকে যে আমি আমার বুকের তলায় রাখতে পারব না রে বাবা!

এইভাবে মনে মনে আর্তনাদ করতে থাকে কুন্তী। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতে থাকে।

ধাত্রী জিজ্ঞেস করে, ‘একে নিয়ে কী করবেন রাজকুমারী?’

কুন্তী হাহাকার করে ওঠে, ‘অ্যা! কী করব? এই সোনার পুতুলকে নিয়ে আমি কী করব ধাত্রী, তুমিই বলে দাও আমায়!’

‘একদিকে আপনার মাতৃহৃদয়, অন্যদিকে আপনার পিতার সামাজিক সম্মান, কোনটা শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে আপনার কাছে?’ ধাত্রী জিজ্ঞেস করল।

কুন্তী অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নত করে থাকল।

ধাত্রী বলল, ‘আমি বলি কি, এই নবজাতককে নদীতে বিসর্জন দিন। তাতে মানুষের কাছে আপনার কুমারীত্বও প্রতিষ্ঠা পাবে, মহারাজার মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকবে।’

‘সন্তান বিসর্জন দেব! নদীতে!’ কান্নায় লুটিয়ে পড়ল কুন্তী।

ধাত্রী বলল, ‘ভেঙে পড়বেন না রাজকুমারী। একটা উপায় বাতলে দিচ্ছি।’

‘কী উপায়?’

‘ওই পথ অবলম্বন করলে নদীজলে আপনার সন্তানটি মরবে না। বরং বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’

‘বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি!’

‘হ্যাঁ রাজকন্যা। একটা কাষ্ঠপেটিকা জোগাড় করতে হবে। তার ছিদ্রগুলো মোম দিয়ে বন্ধ করে দিলে পেটিকায় জল ঢুকবে না। ওই পেটিকার মধ্যে রেখে আপনার সন্তানটিকে নদীতে ভাসিয়ে দিন। আয়ু থাকলে শিশুটি বেঁচেও যেতে পারে। নদীস্রোতে ভাসতে ভাসতে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির হাতে পড়লে আপনার পুত্রটি এ যাত্রা বেঁচে যাবে।’ অনেকক্ষণ কথা বলে প্রবীণা ধাত্রীটি হাঁপিয়ে উঠল।

নিরুপায় কুন্তী ধাত্রীর কথায় সায় দিল।

মঞ্জরির চেষ্টায় পেটিকা সংগৃহীত হলো। মোম দিয়ে ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। শুধু ওপর দিকে শিশুটির শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য একটা রন্ধ্র খোলা রাখা হলো।

অবিরাম কেঁদে চলেছে কুন্তী। উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে পারছে না সে। তাহলে গোপন কথাটি জানাজানি হয়ে যাবে। নিজের আবেগ-আকুলতাকে বুকের তলায় দাবিয়ে রাখতে চাইছে, কিন্তু মাতৃহৃদয়ের ক্রন্দন কিছুতেই রুদ্ধ হচ্ছে না। উপরন্তু হাহাকার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই পেটিকার মধ্যে গরম মোটা কাপড় পেতে দেওয়া হলো। আরামপ্রদ নরম কাপড়ে জড়িয়ে কুন্তী নবজাতকটিকে পেটিকার মধ্যে শুইয়ে দিল। পেটিকার ঢাকনাটি ভালো করে বন্ধ করা হলো। কুন্তী, ধাত্রী, মঞ্জরি— তিনজনে পেটিকাসহ সন্ধ্যার অন্ধকারে কক্ষ থেকে বের হলো। ওরা চলল প্রাসাদ- সংলগ্ন অশ্বনদীর দিকে। সামাজিক দায় আর বাৎসল্য—এই দুটোর টানাপড়েনে কুন্তী তখন বিদীর্ণ- রক্তাক্ত হচ্ছিল।

ধাত্রী আর মঞ্জরি মিলে পেটিকাটিকে নদীজলে ভাসিয়ে দিতে উদ্যোগ নিল।

এই সময় কাতর কণ্ঠে ছেলের উদ্দেশে কুন্তী বলল, ‘বাছা আমার! ভূলোক-দ্যুলোকের কেউ যেন তোমার ক্ষতি না করে। তোমাকে জলে বিসর্জন দিলাম রে পুত্র, জলের কোনো প্রাণী যেন তোমার ক্ষতি না করে। তুই আমার কোলজুড়ে এসেছিলি রে বাপ, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে তোকে নিজের কাছে রাখতে পারলাম না আমি! নদীজলে বিসর্জন দিতে হচ্ছে তোকে! তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস রে বাছা! সর্বত্র বায়ু যাতে তোকে নিশ্বাস দেয় রে বাপ!

কুন্তীর বিলাপ শুনে অন্য দুই নারীও নিজেদের ধরে রাখতে পারল না। তারাও সমস্বরে ক্রন্দন করতে থাকল।

ধাত্রী প্রবীণা বলে, জীবনের অনেক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে বলে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।

কোমল কণ্ঠে বলল, ‘আর কাঁদবেন না রাজকুমারী। দেখবেন, আপনার এই পুত্রটি বেঁচে থাকবে।’

কুন্তী অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘বাছা, বিদেশ-বিভুঁইয়ে যেখানেই বেঁচে থাকো তুমি, তোমার সহজাত বর্ম-কুণ্ডল দেখে আমি ঠিক চিনে নেব তোমাকে। পুত্র, তুমি যখন মাটিতে হামাগুড়ি দেবে, ধুলায় ধূসর হবে তোমার শিশুশরীর, তুমি কথা বলবে কলকল করে, আধো আধো ভাষায়, সেই দিনগুলোতে আমি তোমাকে দেখতে পাব না। দেখতে পাবে অন্য কোনো সৌভাগ্যবতী মা। যখন তুমি বড় হবে, বন্যসিংহের তেজ আসবে তোমার শরীরে, সেদিনও আমি তোমাকে দেখতে পাব না বৎস। দেখবে অন্য কোনো জননী।’

কুন্তীর পাশ ঘেঁষে মঞ্জরি মমতাভরা কণ্ঠে বলল, ‘আপনার পায়ে পড়ি রাজকুমারী, আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না। নিজেকে সংযত করুন। দেখবেন, আপনার গর্ভজাত এই পুত্রটি নিজের গুণে পৃথিবীতে বিখ্যাত হবেন।’

‘মঞ্জরি ঠিক বলেছে রাজকন্যা। আপনি ব্যাকুলতা থামান। রাত অনেক হয়ে গেল। আমাদের প্রাসাদে ফিরে যাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। আপনি অনুমতি দিন—পেটিকাটি নদীজলে বিসর্জন করি আমরা।’ বলল ধাত্রী।

অতঃপর তিনজনে ধরাধরি করে পেটিকাটি অশ্বনদী জলে ভাসিয়ে দিল।

কুন্তী কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলো।

.

নবজাতকটিসহ পেটিকাটি নদীস্রোতে এগিয়ে গেল। অশ্বনদী, চর্মন্বতী নদী, যমুনা, ভাগীরথী স্রোতঃস্বতীতে ভাসতে ভাসতে একসময় পেটিকাটি চম্পানগরীর কূলে উপস্থিত হলো।

চম্পানগরী অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। অঙ্গরাজ্য হস্তিনাপুরের অধীন। হস্তিনাপুর কুরুবংশ শাসিত চম্পানগরীতে বাস করতেন অধিরথ। অধিরথ জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয়। কিন্তু সারথির কাজ করতেন বলে তাঁর সামাজিক অবনমন হয়েছে। সবাই তাঁকে সূত নামে সম্বোধন করে। ধৃতরাষ্ট্রের রথচালক ছিলেন এই অধিরথ। তাঁর স্ত্রীর নাম রাধা। রাধা ব্রাহ্মণকন্যা। অধিরথকে বিয়ে করায় সমাজের সম্মানের আসনটি রাধাও হারিয়ে বসেছেন। তাতে অধিরথ বা রাধার মনে কোনো ক্ষোভ-দুঃখ নেই। এই দম্পতির যত দুঃখ—তাঁরা নিঃসন্তান।

রাধা দারুণ সুন্দরী। যাগ-যজ্ঞ, তীর্থ, কবচ—অনেক সাধ্যসাধনা করেও রাধার কোনো সন্তান হলো না।

সন্তানবুভুক্ষু রাধা একদিন স্বামীসহ গঙ্গাস্নানে এলেন।

হঠাৎ তিনি দেখলেন, একটা পেটিকা ওলটপালট খেতে খেতে ঢেউয়ের টানে ভেসে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *