কৰ্ণ – ৪০

চল্লিশ

মুখমণ্ডল ব্যথায় ছেয়ে গেল সূর্যদেবের।

গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি এতক্ষণ ধরে তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তুমি অন্যের কথা মানতে শেখোনি। তোমার মধ্যে একরোখা একটা ভাব আছে, যা তোমার বুদ্ধিবিবেচনা লুপ্ত করে দেয়। তুমি যে ইন্দ্রের ছলনার কাছে কবচ-কুণ্ডল হারিয়ে বসবে, বুঝতে পারছি। তার পরও তুমি একটা কাজ করো কর্ণ।’

কর্ণ ভাবলেশহীন চোখে ছদ্মবেশী সূর্যের দিকে তাকাল।

সূর্যদেব বললেন, ‘কবচ-কুণ্ডল ইন্দ্রকে দেওয়ার সময় একটা শর্ত আরোপ করবে তুমি। বলবে—আমি আপনাকে কবচ-কুণ্ডল দিচ্ছি, বিনিময়ে আপনি আমাকে আপনার অমোঘ শক্তিশেলটি দিন। তুমি জানো কিনা জানি না, এই শক্তিশেল যার ওপর নিক্ষেপ করা হয়, তার মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী।’

বলে আর দাঁড়ালেন না ব্রাহ্মণবেশী সূর্যদেব। শ্লথ পায়ে কর্ণের শয্যাকক্ষ ত্যাগ করে গেলেন।

.

তার পর বেশ কিছুদিন পর সেই দিনটি এলো।

সজ্জিত দানকক্ষ। প্রশস্ত। উঁচু ছাদ। সারি সারি বসার আসন। দাঁড়ানোরও সুব্যবস্থা। কক্ষের পশ্চিম প্রান্তে সাধারণ মানের একটি আসনে বসে আছে কর্ণ। পরনের পোশাক রাজকীয় নয়। সাধারণ দুটো বস্ত্রখণ্ড দিয়ে কর্ণ ঊর্ধ্বাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ আবৃত করেছে। মুকুটহীন মস্তক। পাদুকাহীন পা। দানভূমিতে যখন আসে কর্ণ, এ বেশেই আসে। তাকে দেখে কোনোক্রমেই মনে হয় না, সে একটা দেশের রাজা। মনে হয় না দোর্দণ্ডপ্রতাপী ধনুর্বিদ সে, মনে হয় না হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদের ক্ষমতাশালী মানুষদের একজন সে। বরং দেখে মনে হয়—গাঁ-গেরামের সাধারণ নিরীহ মানুষদের একজন। বিনীত চোখমুখ, নিরহংকারী অঙ্গভঙ্গি। কণ্ঠস্বর মৃদু।

দানার্থীদের প্রত্যেকের কথা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছে কর্ণ। প্রত্যেকের প্রার্থনা পূরণ করছে। কেউ ভূমি, কেউ গোধন, কেউ অর্থ, কেউ ভরণপোষণের দ্রব্যাদি, কেউ-বা সোনাদানা ধনদৌলত, হাতি-ঘোড়া, রথ চাইছে। কর্ণ কাউকে ফিরাচ্ছে না। সবার বাসনা মঞ্জুর করছে। সবাই প্রাপ্ত দ্রব্যাদি নিয়ে কর্ণের জয়গান গাইতে গাইতে নিষ্ক্রমণ করছে।  

সেদিনের দানকার্য প্রায় শেষের দিকে। সামনে দণ্ডায়মান দুজন দরিদ্রের প্রার্থনা পূরণ করলেই কর্ণের দানকার্য সেদিনের মতো সমাপ্ত হবে। ওই দুইজনকে তাদের প্রার্থিত সামগ্রী দান করে আসন থেকে উঠতে যাবে কর্ণ, ঠিক তখনই দরজায় এক গম্ভীর কণ্ঠধ্বনি শোনা গেল—ভিক্ষাং দেহি।

এই কণ্ঠস্বর কোনো রুক্ষ-জীর্ণ উপবাসক্লিষ্ট ব্রাহ্মণের নয়, এই স্বর বিশেষ কারো। চকিতে দরজার দিকে তাকাল কর্ণ। দেখল—দীর্ঘদেহী এক ব্রাহ্মণ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। তাঁর গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা, সুদৃঢ় পেশি, জ্যোতির্ময় চক্ষু, দীর্ঘ বাহু, কাঁধছোঁয়া কেশদাম।

দেখেই কর্ণ বুঝল—এই ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণ নন। ব্রাহ্মণের দেহগঠন এরূপ নয়, বাচনভঙ্গি এত স্পষ্ট, গম্ভীর ও অকম্প নয়। দেখেই কর্ণ চিনে ফেলল—এই ভিক্ষার্থী দিবাকরকথিত ছদ্মবেশী দেবরাজ ইন্দ্র।

চিনে ফেলার ব্যাপারটি কর্ণ ইন্দ্রকে আপাতত বুঝতে দিল না।

কর্ণ ব্রাহ্মণবেশীকে বলল, ‘স্বাগত দ্বিজরাজ, আপনাকে প্রণাম।

এতক্ষণ দিবাকর অজস্রধারায় আলোক বিতরণ করে যাচ্ছিলেন। কর্ণের দ্বারে ইন্দ্রের উপস্থিতি দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন তিনি। সূর্যের রথচাকা যেন থমকে গেল! দলে দলে মেঘ এসে সূর্যের সদাজাগ্রত সহস্ৰ চক্ষু ঢেকে দিল। ভক্ত স্নেহভাজন কর্ণের ধ্বংস তিনি যেন দেখতে চান না!

কেউ নত হয়ে প্রণাম জানালে সম্মানিত ব্যক্তি ‘আয়ুষ্মান ভব’ বলে আশীর্বাদ করেন। এ কথার অর্থ তুমি দীর্ঘায়ু হও। কিন্তু ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্র তো এসেছেন কর্ণের আয়ু হরণ করতে! সেই তিনি কী করে কর্ণকে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ করেন? তাহলে তো তাঁর ইষ্টসিদ্ধি হয় না! কিন্তু কর্ণের প্রণামের জবাবে ইন্দ্ৰকে তো কিছু একটা বলতেই হবে! কী বলবেন? স্থির করতে একটু সময় নিলেন ইন্দ্ৰ।

তারপর বললেন, ‘হে বৎস, আমি তোমাকে উদাত্ত কণ্ঠে আশীর্বাদ করছি, সূর্যের মতো, সমুদ্রের মতো, পর্বতরাজ হিমালয়ের মতো তোমার যশ অক্ষয় হোক।’

ইন্দ্রের মুখে সূর্যের নাম শুনেই সূর্যের কথা মনে পড়ে গেল কর্ণের। ইন্দ্রের আশীর্বাণী শুনে পুরোপুরি বুঝে গেল যে ইনি ইন্দ্রই। সূর্যের উপদেশ ওই মুহূর্তে স্মরণে এলো কর্ণের। দেবরাজকে নিয়ে একটু খেলতে ইচ্ছে হলো তার।

কৌতুকী গলায় বলল, ‘বলুন ব্রাহ্মণ, কী চাই আপনার? কীই-বা দিতে পারি আমি আপনাকে? সোনায় মুড়ে দেওয়া যুবতি রমণী নেবেন?’

ইন্দ্র ত্বরিত বললেন, ‘না না! ওসব মেয়েছেলে নিয়ে আমি কী করব!’

‘তাহলে গ্রাম দিতে পারি, জনপদ দিতে পারি।’

‘গ্রাম-জনপদ আমার কোনো কাজে আসবে না।’

‘তাহলে গোধন নিন। ঘোড়াও নিতে পারেন।’

‘ওসব গরুঘোড়া লালনপালনে অনেক দিকদারি বাপু।’

কর্ণ বলল, ‘আমার গোটা রাজ্যটাই আপনি নিয়ে নিন ব্রাহ্মণ। দেখবেন, ব্রাহ্মণ থেকে রাজা হয়ে যাওয়া বড় সুখের।’

ব্রাহ্মণবেশী বললেন, ‘ওসব তুমি অন্য কোনো লোভী বামুনকে দিয়ো বাছা।’

এরপর কর্ণ হাতির কথা বলে, ব্রাহ্মণ বলেন, ও তো চড়লেই সুখ শেষ। তাহলে যজ্ঞের ফলাদি নিন, ছদ্মবেশী দেবরাজ বলেন, চাই না বাপু।

কর্ণ যা-ই বলে, ব্রাহ্মণের মুখ থেকে উত্তর আসে, ‘ওসব চাই না আমি।’

ধৈর্যচ্যুতি ঘটল কর্ণের। ধুম করে বলে ফেলল, ‘তাহলে আমার মাথাটা কেটে দিই? নিয়ে যান!’

ইন্দ্র হাহা করে ওঠেন, ‘বলো কী বৎস, বলো কী বাছা! এরকম করে বলছ কেন!’

‘তাহলে বলুন, কী চান আপনি দ্বিজরাজ?’ বলে কৰ্ণ।

ইন্দ্র আসল কথাটি বলতে পারেন না। তাঁর কেবলই লজ্জা করে। লালসার কথা বলেন কী করে তিনি? আচমকা দুদিকে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকান ইন্দ্র। ঝাঁকিয়ে মাথা থেকে লজ্জা-দ্বিধা বের করে দেন।

বলেন, ‘কবচ-কুণ্ডল চাই আমি। নিজের দেহ থেকে কেটে ও দুটো তুমি আমায় দিয়ে দাও কর্ণ।’

কর্ণ মৃদু হেসে বলে, ‘ওগুলো তো আপনার কোনো কাজে লাগবে না ব্রাহ্মণ। আমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই কবচ-কুণ্ডল তাদের কার্যকারিতা হারাবে।’

‘ওসব আমি বুঝি না। ওগুলো আমাকে দান করবে কিনা বলো।’ বলেই শঙ্কিত হয়ে উঠল ইন্দ্ৰ। যদি কর্ণ কবচ-কুণ্ডল দিতে অস্বীকার করে, যদি বলে ওগুলোর পরিবর্তে যা চান, তা-ই দেব!

তাই ত্রস্ত কণ্ঠে ইন্দ্ৰ আবার বলেন, ‘মনে রেখো, তুমি দানের ব্রত নিয়েছ। এই ব্রতধারীরা কখনো কাউকে ফেরায় না।’

ইন্দ্রের কথা শুনে কর্ণ হেসে দিল। এই হাসি ধিক্কারের। এই ধিক্কার ছদ্মবেশী ইন্দ্রের জন্য।

ওই হাসি মুখে রেখেই কর্ণ বলল, ‘আমি সবই জানি। দেবরাজ ইন্দ্র, কেনই-বা আপনার এই ব্রাহ্মণবেশ আর কেনই-বা আপনার এই প্রার্থনা—এর সবটুকুই আমার জানা দেবরাজ।’

কর্ণের কথায় ইন্দ্রকে বেশ বিচলিত দেখাল। এত ছদ্মবেশের পরও কর্ণ তাঁকে চিনে ফেলেছে। শুধু চিনে ফেলা তো নয়, তাঁর প্রার্থনার গূঢ়রহস্যও কর্ণের অজ্ঞাত নয়! নিজের ছলচাতুরী কর্ণের কাছে ধরা পড়ে গেছে বলে বেশ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন ইন্দ্ৰ।

কর্ণের কথা কানে এলো, ‘আপনি স্বর্গের রাজা ইন্দ্র। দান করা আপনার স্বভাব। সেই ইন্দ্ৰ এসেছেন আজ দান নিতে! বড় অবাক হচ্ছি আমি! ব্রাহ্মণবেশে ভিক্ষুকের মতো দান গ্রহণ করতে এসেছেন দেবরাজ ইন্দ্র, আমার কাছে! আমার বিস্ময় আর বিহ্বলতা কোথায় রাখব বুঝতে পারছি না!’

ততক্ষণে ইন্দ্র তার ব্যাকুলতা কাটিয়ে উঠেছেন। বললেন, ‘দাতা তুমি। দাতার কাছে ভিক্ষুক আর দেবরাজে কোনো পার্থক্য নেই।’ আরও কিছু বলতে চাইলেন ইন্দ্ৰ।

কর্ণ বলে উঠল, ‘না না, আপনি ভয় পাবেন না দেবরাজ! আমি আপনাকে খালি হাতে ফেরাব না। আপনার প্রার্থিত বস্তু আপনাকে আমি দেব। ওই ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন।’

বেশ হৃষ্টচিত্ত দেখাল দেবরাজকে।

‘আমার মৃত্যুবাণ আমি আপনার হাতে তুলে দেব, আর অর্জুনকে নিরাপদ করে স্বচ্ছন্দে আপনি এখান থেকে চলে যাবেন, তা হবে না। আপনার সঙ্গে আমি বিনিময়ের খেলা খেলব।’ অনেকটা রূঢ় শোনাল কর্ণকে।

চমকে ইন্দ্ৰ বললেন, ‘বিনিময়ের খেলা!’

‘হ্যাঁ, বিনিময়ের খেলা। আপনি আমার কাছ থেকে দুটো জিনিস নেবেন, বিনিময়ে একটা জিনিস দেবেন।’

‘একটা জিনিস দেব!’ কী জিনিস চাইছে কর্ণ, ধরতে পারছেন না ইন্দ্র।  

‘আমি এখানে আসবার পরেই বুঝেছি, সূর্যদেব তোমার সঙ্গে দেখা করে সব বলে গেছেন তা ঠিক আছে বাপু, তুমি আমাকে তোমার কবচ-কুণ্ডল দাও, বিনিময়ে আমার বজ্রটা তুমি নাও।

কটকট করে হেসে উঠল কর্ণ। হাসতে হাসতে বলল, ‘তা হবে না দেবরাজ। এত সামান্য দিয়ে ভোলাবেন আমায়? আপনার হাতের ওই বজ্র দিয়ে আমি কী করব? দেবেন যখন, তখন ওই একবীরঘাতিনী অমোঘ শক্তিশেলটি আমায় দিন।’

গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন ইন্দ্ৰ

তারপর ইতস্তত কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, চাইছ যখন তোমাকে শক্তিশেলটি দিচ্ছি আমি। কিন্তু মনে রাখবে—এটি দিয়ে একজন বীরকেই শুধু বধ করা যায়। তোমার ঈপ্সিত একজনকে বধ করামাত্রই অমোঘ অস্ত্রটি আমার কাছে ফিরে যাবে। দ্বিতীয়বার এটি ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না তুমি।’

কর্ণ বলল, ‘আমি একজনকেই মারতে চাই। দ্বিতীয়বার ব্যবহারের প্রয়োজন নেই আমার।’

‘একজনকেই মারতে চাও?’ যেন কর্ণের লক্ষ্যবস্তুর কথা তিনি জানেন না, তেমন করে জিজ্ঞেস করলেন ইন্দ্র।

কর্ণ দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল, ‘অর্জুন, অর্জুনকেই বধ করতে চাই আমি।’

অস্থির হয়ে উঠলেন ইন্দ্ৰ। ‘অর্জুনকেই বধ করতে চাও! কিন্তু কর্ণ, তুমি যে-অর্জুনকে মারতে চাইছ, তাকে রক্ষা করে চলেছেন স্বয়ং কৃষ্ণ। তাঁর কারণেই অর্জুন তোমার অবধ্য থাকবে।’

কর্ণ ইন্দ্রের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘অর্জুনকে যে-ই রক্ষা করবে করুক। ও নিয়ে আমার ভাবনা নেই। এখন আপনি বলুন, কবচ-কুণ্ডলের বিনিময়ে আপনি শক্তিশেলটি দেবেন কিনা?’

ইন্দ্ৰ আমতা আমতা করে বললেন, ‘দেব না কেন, দেব। তুমি তাহলে তোমার কবচ-কুণ্ডল আমাকে কেটে দাও।’

এই সময় একটি কথা মনে পড়ে গেল কর্ণের। কান আর গা থেকে কবচ-কুণ্ডল কেটে দিলে তার মুখ ও দেহ কুৎসিত হয়ে যাবে। কিন্তু তাহলে তো চলবে না! কুৎসিতকে বড় ঘৃণা করে কর্ণ

ইন্দ্রকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আমি গা থেকে কবচ-কুণ্ডল কেটে দেব আপনাকে, তাতে আমার শরীরে বীভৎসতা আসবে। ওই বীভৎসতা চা-ই না আমি।’

ইন্দ্র তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘তুমি চিন্তা করো না কর্ণ, ওগুলো কেটে নেওয়ার পর তোমার শরীরে কোনো কুশ্রীতা থাকবে না। তুমি যেমন সুন্দর আছ, তেমন সুন্দর থাকবে।’

কর্ণ নির্বিকারে তরবারিটি হাতে তুলে নিল।

নিজের দেহ থেকে দৈববর্মটি কেটে ইন্দ্রের হাতে দিল। কানের লতি থেকে কুণ্ডল দুটো কর্তিত করে ইন্দ্রকে দিতে দিতে বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত হলেন তো দেবরাজ, অর্জুনকে বিপন্মুক্ত করে?’

ইন্দ্ৰ কোনো জবাব না দিয়ে অঘোম শক্তিশেলটি কর্ণের হাতে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

কর্ণের জীবনরক্ষার কবচ-কুণ্ডল দেবরাজ হরণ করেছেন—এই সংবাদ পেয়ে বনবাসী পাণ্ডবরা পুলকিত হলো। আর কৌরবরা একেবারেই ভেঙে পড়ল।

একচল্লিশ

বারো বছর বনবাসের পর পাণ্ডবদের এক বছরের অজ্ঞাতবাস শুরু হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে।

সেই অজ্ঞাতবাসও শেষ হতে চলল।

এদিকে দুর্যোধনও বসে নেই। শত শত গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সময়ে যদি পাণ্ডবদের খুঁজে বের করা যায়, তাহলে পরবর্তী তেরো বছরের নিশ্চিত নিরাপদ জীবন। কিন্তু বারো বছরের বনবাস শেষে দ্বৈতবন থেকে পাণ্ডবরা টুপ করে যে কোথায় মিলিয়ে গেল, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও বের করতে পারেনি দুর্যোধন!

অজ্ঞাতবাস সমাপ্তির এই সময়টাতে দুর্যোধন ভীষণ উতলা হয়ে উঠল

গুপ্তচরদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বলল, ‘যে করেই হোক, পাণ্ডবদের খুঁজে বের করো।’

গুপ্তচররা এ-বন, সে-বন তন্নতন্ন করে খুঁজে এসে খবর দিল—কোথাও পাণ্ডবদের পাওয়া যায়নি।

দুর্যোধন বলল, ‘নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ো। প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভালো করে অনুসন্ধান চালাবে। কুঁড়ে থেকে রাজপ্রাসাদ কোনোটাই বাদ দেবে না। পাণ্ডবদের যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করা চাই-ই চাই।’

গুপ্তচররা দিকে দিকে ছুটে গেল।

কর্ণ বলল, ‘পাণ্ডবদের ভালো করে খোঁজা দরকার দুর্যোধন। অজ্ঞাতবাস শেষে ওরা ফিরে এলে কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ? রাজ্য চাইবে তারা। দিতে বাধ্যও তুমি। খেলার শর্ত তা-ই ছিল। তখন তোমার ক্ষমতা, কর্তৃত্ব কোথায় যাবে, ভাবো একবার।’ রাজ্য হারানোর দুশ্চিন্তা যেন কর্ণেরই বেশি!

দুর্যোধন বলল, ‘নানা স্থানে গুপ্তচর পাঠিয়েছি। তারা পাণ্ডবদের অনুসন্ধান করে যাচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না। কী যে করব, বুঝে উঠতে পারছি না!

কর্ণ বলল, ‘আরও আরও ভালো করে খুঁজতে হবে পাণ্ডবদের। ধূর্ত, চৌকস, পরিশ্রমী গুপ্তচর পাঠিয়ে অনুসন্ধান আরও জোরদার করো। নদীর তীর থেকে পর্বতের গুহা—সর্বত্র চষে ফেলতে বলো ওদের।’

কর্ণের পরামর্শে দুর্যোধন তার গুপ্তচরবাহিনীকে আরও কড়া নির্দেশ দিল।  

গুপ্তচররা অনেক অনুসন্ধান করেও পাণ্ডবদের টিকির সংবাদটিও এনে দিতে পারল না দুর্যোধনকে।

একদিন একটি অগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আনল গুপ্তচররা—বিরাটরাজার প্রবল পরাক্রান্ত সেনাপতি কীচক কোনো এক অজ্ঞাত গন্ধর্বের হাতে নিহত হয়েছে।

এই সংবাদকে কোনো গুরুত্ব দিল না দুর্যোধন। দুর্যোধন বিচক্ষণ নয় বলে এই সংবাদটিকে কোনো মূল্য দিল না। যদি বিচক্ষণ হতো, তাহলে বুঝে নিতে পারত এই সংবাদটির সঙ্গে তার কত বড় স্বার্থ জড়িত আছে! অজ্ঞাত গন্ধর্বটি যে ভীম ছাড়া অন্য কেউ নয়, ভালো করে বিচার-বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসত তা। দুর্যোধন কীচকহত্যাকে নিছক প্রাসাদীয় ষড়যন্ত্র বলে মনে করল। তাই অজ্ঞাতবাসের সময়ে পাণ্ডবদের চিনে ফেলার সুবর্ণসুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেল দুর্যোধনের।

অজ্ঞাতবাস শুরু হওয়ার আগে আগে পাঁচ ভাই এবং দ্রৌপদী বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল— অজ্ঞাতবাসের বছরটি তারা অরণ্যে-পাহাড়ে কাটাবে না। তাহলে ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তারা ওই সময়টা কাটাবে কোনো রাজার জনবহুল জাঁকজমকপূর্ণ রাজপ্রাসাদে। জনাকীর্ণতার মধ্যে কেউ কারো দিকে তেমন করে খেয়াল করে না। তবে স্বনামে আর স্বপরিচয়ে নয়। ছদ্মবেশে এবং ছদ্মনামে।

বিরাটরাজার রাজপ্রাসাদকেই নিরাপদ মনে করল তারা। ওই রাজপ্রাসাদে যুধিষ্ঠির কঙ্ক নামে, ভীম বল্লভ নামে, অর্জুন বৃহন্নলা নামে, নকুল গ্রন্থিক নামে, সহদেব তন্তিপাল নামে এবং দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রীরূপে আশ্রয় নেয়। তারা এমন সতর্কতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে থাকে যে বাইরের লোক তো দূরের কথা, খোদ রাজা বিরাট বা রাজমহিষীও পাণ্ডবদের চিনতে পারলেন না।

কীচক বিরাটরাজ্যের সেনাপতি। উপরন্তু মহারানির সহোদর। সেই সুবাদে অন্দরমহলে অবাধে যাতায়াত তার। দিদির কেশবিন্যাসকারী পরিচারিকা দ্রৌপদীর ওপর লালসার নজর পড়ে কীচকের। একা পেয়ে দ্রৌপদীকে বক্ষলগ্ন করতে গেলে ধাক্কা দিয়ে কোনোরকমে কীচকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে দ্রৌপদী। ওখানেই কীচক ক্ষান্ত হয় না। প্রকাশ্য রাজসভায় দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে তাকে পদাঘাত করে বসে কীচক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গভীর রাতে নাট্যশালায় কীচককে হত্যা করে ভীম। রটিয়ে দেয়—কোনো এক গন্ধর্ব কীচককে বধ করেছে।

শেষ সংবাদটিই এসে পৌঁছেছিল দুর্যোধনের কাছে। পূর্বাপর সমস্ত ঘটনার বিবরণ গুপ্তচররা দিলে অনায়াসেই পাণ্ডবরা ধরা পড়ে যেত। আগের ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেয়নি গুপ্তচররা। ভেবেছে—শেষের ঘটনাটিই দুর্যোধনকে জানানো দরকার।

বিরাটরাজ্যের প্রতিবেশী ত্রিগতরাজ্য। উভয় দেশের সম্পর্ক শত্রুতার। ত্রিগর্তদেশের রাজা আবার দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিরাটসেনাপতি কীচক নিহত হলে ত্রিগর্তরাজ খুশি হলো। নানা সময়ে তাকে বিরাটরাজ যুদ্ধে নাকাল করেছে।

মনে মনে বলল—এখনই প্রতিশোধ নেওয়ার সময়। কিন্তু বিরাটরাজার সঙ্গে একা পেরে উঠবে না সে। এই সময় আক্রমণসহযোগী দরকার তার।

বন্ধু দুর্যোধনকেই বেছে নিল ত্রিগর্তরাজ।

দ্রুতগামী রথে চড়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলো সে।

দুর্যোধনকে বলল, ‘সামরিকশক্তিতে বিরাটরাজ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে। এমন দুর্দমনীয় যে তোমাদের সামরিকশক্তিকে টেক্কা দেওয়ার মতো। আমার তো আশঙ্কা, কখন হস্তিনাপুর আক্রমণ করে বসে! সুখবর এটা যে বিরাটরাজ্যের সেনাপতি কীচক কোনো এক গন্ধর্বের হাতে নিহত হয়েছে। কীচক হত্যায় বিরাটরাজ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সেনাবাহিনীতেও এখন বিশৃঙ্খল অবস্থা।’

লম্বা ভূমিকা ধৈর্য ধরে শুনল দুর্যোধন। বলল, ‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার হস্তিনাপুর আসার আসল উদ্দেশ্যটা কী?’

একটু ভেবাচেকা খেয়ে গেল ত্রিগর্তরাজ।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘এই মুহূর্তে তোমার বিরাটরাজ্য আক্রমণ করা উচিত। কুরুবাহিনীর সামনে অর্ধেকবেলাও টিকতে পারবে না বিরাটবাহিনী। এই যুদ্ধে জিতলে তোমার যে কী পরিমাণ লাভ হবে, ভাবতে পারবে না তুমি!’

‘কী লাভ?’ জানতে চাইল দুর্যোধন।

ত্রিগর্তরাজ বলল, ‘বিরাটরাজার অপরিমেয় ধন-রত্ন, অশ্ব-গজ, গোধন। যুদ্ধজয়ে ওগুলো সব তোমার হবে।’

দুর্যোধন একা সিদ্ধান্ত নিল না। ভাইদের এবং কর্ণের মতামত জানতে চাই।

দুঃশাসনরা কিছু বলার আগে কর্ণ তার মনোভাব ব্যক্ত করল।

দানক্রিয়া তাকে মহৎ করেছে বটে, কিন্তু যুদ্ধের কথা শুনে দিগ্বিজয়ী কর্ণের রক্তে রণোন্মত্ততার ঢেউ উঠল

কর্ণ বলল, ‘ত্রিগর্তরাজের প্রস্তাবটা উত্তম বলে মনে হচ্ছে আমার। পাণ্ডবদের তো অনেক খুঁজলে দুর্যোধন, পেলে না। এখন ওই শক্তিহীন অর্থহীন অসহায় পাণ্ডবদের না খুঁজে বরং তুমি বিরাটরাজ্য আক্রমণ করো। তাতে কুরুরাজকোষে প্রচুর ধন-রত্ন যুক্ত হবে।’

কর্ণের প্রস্তাব দুর্যোধনের মনে লেগে গেল। কুরুবাহিনীকে বিরাটরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার নির্দেশ দিয়ে বসল দুর্যোধন।

এই যুদ্ধযাত্রায় ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরের কাছ থেকে কোনো বাধা এলো না। কারণ এই সমরাভিযান তো পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে নয়! উপরন্তু ভীষ্ম-দ্রোণ, কৃপ-অশ্বত্থামা এই অভিযানে অংশ নিলেন।

কুরুসৈন্যরা আক্রমণ করার আগেই ত্রিগর্তরাজ বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে বসল। কিন্তু এই যুদ্ধে বিরাটরাজার পক্ষে ভীম-অর্জুন-নকুল-সহদেব ছদ্মবেশে এমন যুদ্ধ করল যে ত্রিগর্তবাহিনী মুহূর্তেই ছত্রখান হয়ে গেল।

এদিকে কৌরবরা সবাই মিলে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে বিরাটসীমান্তে উপস্থিত হলো। বিরাটরাজার অজ্ঞাতেই বিরাটপুত্র উত্তরের সঙ্গে রণক্ষেত্রে চলে গেল বৃহন্নলাবেশী অর্জুন। অর্জুনকে দেখেই দ্রোণাচার্য চিনে ফেললেন এবং উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘অর্জুন, অর্জুন।’

রেগে গেল কর্ণ। বলল, ‘অর্জুনের ওপর আপনার যত সোহাগ যে যাকে দেখেন, তাকেই অর্জুন বলে মনে হয় আপনার। আরে, ও অর্জুন হোক, যাই হোক আমার সামনে কিংবা দুর্যোধনের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না।’

কর্ণের কথা দুর্যোধন লুফে নিল, ‘এ যদি অর্জুন হয়, তাহলে আমাদের তো পরম সৌভাগ্য! অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার আগেই ধরা পড়ে গেছে অর্জুন! তাহলে আবার বারো বছরের বনবাস।’

কর্ণ দ্রোণকে উপহাস করে দুর্যোধনের উদ্দেশে বলল, ‘বন্ধু, যুদ্ধের কৌশল আমাদের আচার্যকে বাদ দিয়েই করো। তুমি পিতামহ ভীষ্ম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য—এঁদের মনোভাব সম্যক জান। এঁদের পাণ্ডবদের দিকে টান, অর্জুনের জন্য অপার ভালোবাসা। দেখলে তো যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই তোমাদের গুরু দ্রোণ অর্জুনের ভয় দেখাতে শুরু করলেন আমাদের! অর্জুনের নাম এমন চিৎকার করে উচ্চারণ করলেন, যাতে আমাদের সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়।

দ্রোণ বললেন, ‘যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা তোমার বালকের মতো বলে তুমি আমাকে উপহাস করছ। যথেষ্ট অভিজ্ঞ তুমি যদি হতে, তাহলে একথা বলতে না তুমি কর্ণ। যে ঘোড়ার ডাক শুনে রথারোহীকে চেনে না, সে আবার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা!’ কর্ণের উপহাস কর্ণকেই ফিরিয়ে দিলেন আচার্য।

কর্ণও থামবার পাত্র নয়, ‘এঁরা সবাই, বিশেষত এই আচার্য দ্রোণ, চিরটা কাল পাণ্ডবদের হয়ে গান গেয়ে গেলেন। কৌরবদের শৌর্যবীর্য কিছুই নজরে পড়ল না তাঁর! এই আচার্যের কাছে আপন বলতে ওই পাণ্ডবরাই। আমাদের ওপর জন্মের রাগ তাঁর।’

রাগ ব্রহ্মতালু ছুঁয়েছে কর্ণের। ক্রোধে ফুঁসে উঠে কর্ণ আবার বলল, ‘এই আচার্যের মায়ার শরীর। তার মধ্যে হিংসাবৃত্তি বলে কিচ্ছুটি নেই। অথচ তুমি জানো দুর্যোধন, হিংসা ছাড়া যুদ্ধ হয় না।’

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন বেশ মজা পেল।

কর্ণের ঔদ্ধত্য দেখে আরও সম্মান হারানোর ভয়ে দ্রোণাচার্য চুপ করে থাকলেন।

কিন্তু কর্ণ ওখানে থেমে গেল না।

চোখেমুখে হিংস্রতা, ঘৃণা, অবহেলা ছড়িয়ে কর্ণ আরও বলে গেল—দ্রোণাচার্যের মতো লোকদের পণ্ডিতি কথা কোথায় মানায় জানো দুর্যোধন? বড় বড় লোকদের বাড়িতে, যেখানে অলস আড্ডায় জীবন প্রবাহিত হয়। আর মানায় রাজসভায়, যেখানে পণ্ডিতদের মধ্যে কূটতর্ক চলে। কিন্তু তাঁর পণ্ডিতি উপদেশ যে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে না, বোঝেন না আচার্য দ্রোণ। বামুন মানুষ তিনি। ভুলক্রমে যুদ্ধবিদ্যায় ঢুকে পড়েছেন। ব্রাহ্মণদের আসল জায়গা তো যজ্ঞ, শাস্ত্রপাঠ, ছাত্র পড়ানো। এসব ব্যাপারে দ্রোণের মতো বামুন পণ্ডিতরা খুবই উপযুক্ত। ও—, আরেকটা ব্যাপারে ওঁরা বেশ দক্ষ। পরের দোষ বের করতে দাও, মনুষ্যচরিত্রে কোথায় স্খলন ঘটল, বের করতে দাও, কোন ব্ৰাহ্মণ কার বাড়িতে ভাত খেয়ে অন্নদোষ ঘটাল, বের করতে দাও—এই সব বামুনপণ্ডিত তা খুব পারবে।

তারপর সমবেত কুরুবাহিনীর দিকে চোখ ফেরাল কর্ণ। দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আরে, আমাদের সেনারা আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন? তুমি ওদের বলো—অর্জুন আসুক আর রাজা বিরাট আসুক, এই কর্ণ তাদের গুঁড়িয়ে দেবে। তীরভূমিতে যেমন সমুদ্রঢেউ আটকে যায়, ঠিক তেমন করে আমার সামনে থমকে যাবে ওরা।’

এতক্ষণ সামান্য তফাতে অবস্থান নিয়ে কর্ণ-দ্রোণের কথোপকথন শুনে যাচ্ছিলেন কৃপাচার্য। কর্ণের আস্ফালন তাঁর আর সহ্য হলো না।

বললেন, ‘দেখো কর্ণ, তুমি বেশি সাহস দেখিয়ো না। একটু চিন্তা করে দেখলে বুঝতে পারবে, আমরা সবাই একত্রে অর্জুনের সঙ্গে লড়ে কুলিয়ে উঠতে পারব না। ভুলে যাচ্ছ কেন—এই অর্জুনই একসময় একাই কুরুদেশ রক্ষা করেছে, একাই খাণ্ডববন পুড়িয়েছে, সুভদ্রাকে হরণ করে কৃষ্ণকে দ্বৈরথে আহ্বান জানিয়েছে।’

কৃপাচার্য এবার তার কণ্ঠকে চিকন করে উপহাস মেশালেন, ‘গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে যুদ্ধে কে পালিয়েছিল, তুমিই তো! বন্দি দুর্যোধনদের কে মুক্ত করেছিল, অৰ্জুনই তো!’

বিয়াল্লিশ

কর্ণ গর্জন করে উঠল, ‘থামুন আপনি কৃপাচার্য। আর একটি শব্দও বলবেন না।’

‘কেন, আরেকটি শব্দ বললে কী করবে তুমি? আমার কথায় আঁতে ঘা লাগছে? তুমি যখন অন্যকে অপমান করো, একথা মনে থাকে না তোমার?’ কৃপের নির্বিঘ্ন কণ্ঠ।

দুর্যোধন বলল, ‘আপনি থামুন আচার্য। এটা রণক্ষেত্র। এখানে তর্কে জড়ালে যুদ্ধটাই ভেসে যাবে!’

দুর্যোধনের কথা কানে তুললেন না কৃপাচার্য। কর্ণকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘মনে রেখো কর্ণ, তোমার শরীরে পাণ্ডবদের অপমান আর ক্রোধের ঘি মাখা রয়েছে। কাজেই তোমার অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে গায়ে চপচপে ঘি মেখে সূক্ষ্ম কাপড় পরে অর্জুন নামের জ্বলন্ত আগুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। তুমি আর বেশি সাহস দেখিয়ো না কৰ্ণ।’

‘আরে রাখুন আপনার বাগাড়ম্বর। আপনি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখুন—আমি একা কী করে অর্জুনকে চূর্ণবিচূর্ণ করি।’ সরোষে কর্ণ বলল।

কৃপাচার্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘আরে না না! ও-কাজ একা করতে যেয়ো না তুমি! অর্জুনের হাতে শুধু শুধু অপদস্থ হয়ে লোক হাসানোর দরকার নেই। আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করব, দ্রোণ- ভীষ্ম-অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, আমি, তুমি সবাই। দেখো অর্জুনকে সবাই মিলে জব্দ করতে পারো কিনা।’

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘থামুন আপনি। বিরাটরাজার সব গোধন নিয়ে কৌরবরা হস্তিনাপুর চলে যাক, আর আপনি দূরে দাঁড়িয়ে আমার একার যুদ্ধ দেখে যান।’

দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মামা কূপের কথাও শুনল, কর্ণের কথাও শুনল। তার আগে শুনেছে দ্রোণাচার্যকে নিয়ে কর্ণের উপহাসমূলক সংলাপ। অশ্বত্থামা মূলত দুর্যোধনদলের। দুঃশাসন-কর্ণদের সঙ্গে তার যত সখ্য। কিন্তু দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দিনটিকে কোনোক্রমে মেনে নিতে পারেনি অশ্বত্থামা। ওইদিনই ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল তার। কিন্তু মুখ বুজে ছিল অশ্বত্থামা।

আজ পিতা দ্রোণের প্রতি কর্ণের অপমানজনক কথাবার্তা অশ্বত্থামার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। অশ্বত্থামা এলনা-ফেলনা কেউ নয়, কর্ণের মতোই বীর সে। সেও তো যোদ্ধা! যোদ্ধার শৌর্যবীর্য তার মধ্যেও তো আছে! সর্বজনবন্দিত দ্রোণাচার্যের অপমানে অশ্বত্থামা আর নীরব থাকল না।  

কর্ণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো অশ্বত্থামা, ‘লজ্জা জিনিসটা বড় কম কর্ণ তোমার। প্রকৃত বীররা অনেক যুদ্ধ জেতার পরও তোমার মতো এত বকবক করে না। তুমি প্রকৃত বীর কিনা তারও তো প্রমাণ দাওনি এখনো! এখনো তুমি বিরাটরাজার গোধনগুলো জিতে আনোনি। ও হো! জিতে আনবে কী করে, এখনো তো বিরাটরাজ্যের সীমানাও পেরোওনি তুমি!’

আপন মনে কিছু একটা ভেবে নিল অশ্বত্থামা। তারপর অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘প্রকৃত বীররা হামবড়াইটা দেখায় না। আগুনের কথাই ভাবো না, নীরবে পুড়িয়ে দেয়। আর তোমার এত কীসের বড়াই কর্ণ! কৌরবদের জন্য এমন কী করেছ তুমি? পাশাখেলার আয়োজন করে পাণ্ডবদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার আয়োজন করেছ, এই তো?’

দুর্যোধন বলে উঠল, ‘তুমি চুপ করো অশ্বত্থামা।’

অশ্বত্থামা দুর্যোধনের খবরদারি কানেই তুলল না। উপরন্তু নির্ভীক গলায় বলল, ‘আর তোমরা ধৃতরাষ্ট্রের নির্লজ্জ পুত্রগুলো, তোমরা কী করেছ? ব্যাধের মতো শঠতার ফাঁদ পেতে বসে আছ তোমরা। কখন পাণ্ডবদের সেই ফাঁদে আটকাবে এই ফন্দি করে যাচ্ছ।’

সদর্পে কর্ণের দিকে ঘাড় ফেরাল অশ্বত্থামা। যুদ্ধাভিযান ভেস্তে যায় যাক, আজ কর্ণকে ছাড় দেওয়া যাবে না—মনে মনে স্থির করল অশ্বত্থামা।

আজ কর্ণের সকল অহংকার চুরমার করে তারপর যেন ক্ষান্ত হবে অশ্বত্থামা, ‘একটা, মাত্র একটা যুদ্ধের কথা বলো তুমি কর্ণ, যেখানে অর্জুনকে তুমি একা জয় করেছ! ওই যে নকুল-সহদেব, যাদের তুমি এক রত্তিও মূল্য দাও না, সেই তাদেরই-বা তুমি কী করতে পেরেছ? কী করতে পেরেছ ভীমকে? যুধিষ্ঠিরের কেশাগ্র নাড়াতে পেরেছ তুমি? কই অর্জুনরা থাকতে ইন্দ্রপ্রস্থ জয় করার সাহস তো করোনি তুমি! দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় যখন গেলে, সেখানে যে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল তোমার, জিতেছ সেই যুদ্ধ? জেতোনি তো! মাঝখানে কুলবধূ দ্রৌপদীকে এককাপড়ে রাজসভায় টেনে এনে যে জঘন্য অপমানটা করলে! ছি ছি! ছি।’

অশ্বত্থামা জানে, পিতা দ্রোণাচার্য পুত্রাধিক ভালোবাসেন যাকে, তার নাম অর্জুন। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পিতা যে ‘অর্জুন অর্জুন’ করলেন, তা ভয়ের জন্য নয়। অর্জুনকে স্নেহ করেন বলে। বহু বছর পর প্রাণাধিক শিষ্যকে দেখতে পেয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি দ্রোণাচার্য।

পিতার বাৎসল্যের অপমান দেখে অশ্বত্থামা চুপ থাকতে পারেনি। কর্ণের প্রতি প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়েছে।

কর্ণের কাছে এই প্রশ্নগুলোর একটিরও উত্তর নেই। তাই সে চুপ করে থাকল।

অশ্বত্থামা শেষ ঘোষণা দিল, ‘এই যুদ্ধে যিনিই যুদ্ধ করতে চান, করুন। আমি কিন্তু যুদ্ধ করব না। আমি অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না—বলে দিলাম।’

অশ্বত্থামার আচমকা এই ঘোষণায় কুরুজোটে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিল। মনোবল ভেঙে গেলে যুদ্ধজয় অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেকোনোভাবে কুরুজোট টিকিয়ে রাখতে হবে—দ্রুত ভেবে গেলেন পিতামহ ভীষ্ম। তিনি বুঝে গেছেন, এই অভিযানে অশ্বত্থামার চেয়ে কর্ণের গুরুত্ব বেশি।

তাই ভীষ্ম মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন, ‘কর্ণ যা বলেছে, তা হয়তো সকলের মনোবল বাড়াবার জন্য বলেছে। তবে এটাও সত্য যে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে কর্ণের কটূক্তি করা ঠিক হয়নি।’

এরপর দ্রোণের দিকে ফিরলেন পিতামহ। বললেন, ‘আচার্য, আপনি কর্ণের অপরাধ ক্ষমা করে দিন। কৃপাচার্য, আপনাকেও বলছি, ক্ষমা করুন। অশ্বত্থামা, তুমিও ক্ষান্ত হও। দেখো, গাণ্ডীব হাতে অর্জুন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।’

ভীষ্মের কথা শুনে কর্ণ কুঁকড়ে গেল।

কুরুবাহিনী সজ্জিত করবার দায়িত্ব ছিল পিতামহের ওপর। যুদ্ধকে বাঁচানোর জন্য কর্ণের পক্ষে পিতামহ কথা বললেন বটে, কিন্তু সৈন্য সাজাবার সময় এমন একটা প্যাচ কষলেন, যাতে কর্ণকেই বেশির ভাগ অর্জুনের মুখোমুখি হতে হয়।

ভীষ্ম বললেন, ‘দ্রোণাচার্য থাকুন সেনাবাহিনীর মধ্যভাগে, অশ্বত্থামা বাঁ দিকে আর কৃপাচার্য ডান দিকে। সবার সামনে থাকবে ধনুর্ধর কর্ণ। আর আমি সবার শেষে থেকে চারদিক রক্ষা করব।’ ভীষ্মের নির্দেশে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বলে রেখেছিলেন, যুদ্ধ শুরু হলে তুমি বিরাটরাজার গোধন হরণ করে হস্তিনার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে।

নির্দেশমতো তা-ই করল দুর্যোধন। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারল না। অর্জুন দুর্যোধনের পিছু ধাওয়া করল। কৌরববাহিনী ঘিরে ধরলে অর্জুন তাদের কাউকে হটিয়ে দিল, অধিকাংশকে হত্যা করল।

এরপর কর্ণ আর অর্জুন মুখোমুখি হলো।

কর্ণ-অর্জুনে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তাদের যুদ্ধ সমানে সমানে। কেউ কম যায় না। দুজনেই মহাবল। দুজনেই শত্রুর জন্য বিপজ্জনক। কৌরবরা নিজেদের যুদ্ধ ভুলে এই দুই ধনুর্ধরের যুদ্ধ দেখে যেতে লাগলেন। যুদ্ধ দেখতে দেখতে কেউ বলল, কর্ণ উত্তম; কেউ বলল, অর্জুন উত্তম।

কর্ণ যতবার অর্জুনের তীর বানচাল করে দিচ্ছিল, ততবারই কৌরবদের অজস্র হাততালি পড়ছিল। তারপরও সেদিনের যুদ্ধে কর্ণ, অর্জুন—দুজনেই ভাস্বর। বাণে বাণে দুজনে দুজনকে আবৃত করে ফেলেছিল। দুর্ভাগ্যবশত অর্জুনের চেয়ে কর্ণ আঘাত পেয়েছিল বেশি। কর্ণ হাতে, গলায়, ঊরুতে, মাথায় বিভিন্ন রকমের চোট পেয়েছিল। কর্ণের অবস্থা এমন হলো যে যুদ্ধক্ষেত্রে আর কিছুক্ষণ থাকলেই মৃত্যুর আশঙ্কা নিশ্চিত হয়ে যাবে।

কর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাল।

কিছুক্ষণ পর কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার ফিরে এসেছিল কর্ণ। কিন্তু ততক্ষণে ভীষ্ম-দ্রোণ-দুর্যোধন সবাই অর্জুনের হাতে প্রায়-পর্যুদস্ত।

হঠাৎ অর্জুনের দুটো তীর এসে কর্ণের দুই কানে লাগল। অর্জুনের পরাক্রমে কর্ণের রথ ভাঙল, অশ্ব মরল, সারথি নিহত হলো। কর্ণ নতুন রথের দিকে দৌড়ে গেল। নতুন সজ্জিত রথে চড়ে অর্জুনের মুখোমুখি হলো আবার কর্ণ।

বিরাটবাহিনীর বিরুদ্ধে যতক্ষণ যুদ্ধ হয়েছে, অধিকাংশ সময়ই যুদ্ধ করতে হয়েছে কর্ণকে। কারণ কর্ণ কুরুবাহিনীর অগ্রভাগে ছিল। ফলে অধিকাংশ অস্ত্রাঘাত তার ওপরই পড়েছে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছে তাকে। স্বাভাবিকভাবেই কর্ণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত অর্জুনের বাণাঘাতে রথোপরি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল কর্ণ। সারথি অচেতন কর্ণকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে বাধ্য হলো।

তেরো বছর পর কর্ণজয়ের আনন্দ অর্জুনের চোখেমুখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

.

তেরো বছর অতিক্রান্ত হলো। কৌরব আর পাণ্ডব—উভয় শিবিরে গোপনে যুদ্ধ-প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। বাইরে পাণ্ডবরা অবশ্য সন্ধির চেষ্টা করল।

পাণ্ডবরা বিরাটরাজার কুলপুরোহিতকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে কুরুরাজসভায় পাঠাল। প্রস্তাবে হৃতরাজ্য পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ ছিল। কিন্তু সেই কুলপুরোহিত ছিলেন অহংকারী, কিছুটা উদ্ধতও। তাঁর ভাষার মধ্যে পাণ্ডবদের অপমানের গ্লানি আর শক্তিমত্তার কথা মিশে ছিল!

ব্রাহ্মণের দুর্বিনীত কথা শুনে খোদ পিতামহ ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তবে মনের ক্রোধকে মনেই গোপন করে রাখলেন তিনি।

কটাক্ষ করে বললেন, ‘পুরোহিত, আপনি পাণ্ডবদের দূত হয়ে এসেছেন, আপত্তি নেই আমাদের। আমাদের আপত্তি আপনার ভাষা নিয়ে। আপনি পুরোহিত বটে, কিন্তু এখনো প্রকৃত ব্রাহ্মণ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রকৃত ব্রাহ্মণের ভাষা এত কড়া ও কর্কশ হতে পারে না।

এই কথা বলার পর পিতামহের ভাষা কিছুটা নমনীয় হয়ে এলো। পিতামহের শান্ত মেজাজ আর নমনীয় চোখমুখ দেখে কর্ণ ভয় পেয়ে গেল। ভীষ্ম এমনিতেই পাণ্ডবদলের, তাঁর সহানুভূতি সর্বদা পাঁচ ভাইদের অনুকূলে। শান্ত মেজাজ সেই আনুকূল্যকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, হঠাৎ তিনি বলেও ফেলতে পারেন—আচ্ছা ঠিক আছে, পাণ্ডবদের তেরো বছরের বনবাস ও অজ্ঞাতবাস জীবন শেষ হয়েছে যখন, আমাদের আপত্তি নেই পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে। আর পিতামহ একবার কথা দিয়ে দিলে দুর্যোধনের ভাগ্য ওলট-পালট হয়ে যাবে। এই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠল কর্ণ। সেই আতঙ্কে কর্ণ ভীষ্মকে আর কিছু বলতে দিল না।

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কিছু বলার আগে, এমনকি দুর্যোধনও মুখ খোলার আগে কর্ণ বলে উঠল, ‘বারবার এক কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না আমরা।’

তারপর সরোষে পুরোহিতের দিকে মুখ ফেরাল কর্ণ, ‘শোনেন পুরোহিত, আপনার ভাষা ব্রাহ্মণের নয়, চণ্ডালের। আপনার মতো একজন কটুভাষীকে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ভুল করেছে পাণ্ডবরা। যাক গে, আসল কথায় আসি। পাশাখেলার শর্ত ছিল অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা ধরা পড়লে আবার বারো বছরের বনবাসে যেতে হবে। বিরাটরাজার যুদ্ধে আমরা অর্জুনকে চিনে ফেলেছি। অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার আগে সে বিরাটের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছে। ওদের গিয়ে বলুন, আবার বারো বছরের জন্য বনে যেতে। এইটেই আমাদের শেষ কথা।’

পুরোহিত জানেন, এই দূতক্রীড়ার শেষ পরিণতি কী? তাঁকে সেভাবে বুঝিয়েও দেওয়া হয়েছে—দুর্যোধনরা রাজ্য দেবে না। তাই বলে আপনি ভাষাকে নমনীয় করবেন না কিছুতেই।

কণ্ঠকে কর্কশতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলেন পুরোহিত, ‘সদ্য পরাজিত হয়েও পরাজয়ের কোনো লজ্জা আপনার চোখেমুখে দেখছি না অঙ্গরাজ। আপনি কি বিরাটবাহিনীর শক্তির কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? পাণ্ডবদের কথা নাই-বা বললাম এখানে। ওঁদের শ্বশুর যে দ্রুপদরাজা, ভুলে যাননি নিশ্চয়ই।’

হুঙ্কার দিয়ে উঠল কর্ণ, ‘বিরাট আর দ্রুপদরাজার ভয় দেখাচ্ছ তুমি আমাদের পুরোহিত। তুমি কি কুরুশক্তির কথা ভুলে গেলে? ভুলে গেলে দুর্যোধনের গদাদক্ষতার কথা? আর আমার অস্ত্রশক্তিকে অবহেলা করছ কোন সাহসে?’

তেতাল্লিশ

খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল বিরাটরাজার কুলপুরোহিত। এই হাসির প্রতিটি ধ্বনিতে বিরাটযুদ্ধে অর্জুনের হাতে কর্ণের বারবার হারার বিদ্রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল।

কর্ণ তা গায়ে মাখল না। নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ‘শোনো পুরোহিত, ভয় দেখালে দুর্যোধন একের চার ভাগ কেন, এক পা জমিও ছাড়বে না। আর যদি ন্যায়ের কথা বলো, অতি বড় শত্রুকেও সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দেওয়ার মতো হৃদয় আমাদের দুর্যোধনের আছে। তুমি পাণ্ডবদের ন্যায়ের পথে আসতে বলো। পুনরায় বনবাসে গিয়ে শর্ত পূরণ করে আসতে বলো। তারপর অনায়াসে তারা তাদের রাজ্য ফিরে পাবে। আরও শুনে রাখো পুরোহিত, এটা না করে যদি অন্য কিছু করে পাণ্ডবরা, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে আমার কথা যেন স্মরণে থাকে পাণ্ডবদের।’

কর্ণের এই মিথ্যে দাম্ভিকতা আর সহ্য করতে পারলেন না ভীষ্ম।

ক্রুদ্ধ ভীষ্ম বলে উঠলেন, ‘তোমার এই অলীক অহমিকা কি কখনো বন্ধ হবে না কর্ণ? গলগল করে মিথ্যেগুলো উগরে যাচ্ছ কেন তুমি? বিগত যুদ্ধগুলোতে তোমার শক্তিমত্তার কথা একটু স্মরণ করে দেখো, সেখানে কতটুকু কৃতিত্ব তোমার! এই গত-যুদ্ধের কথা মনে করে দেখো তো কর্ণ, বিরাটরাজার গোধন হরণের কথা বলছি আমি, অর্জুন কী গরুহারাই না হারাল তোমাকে! শুধু তোমাকে বলছি কেন, কুরুপক্ষের ছয়জন মহারথীকেই তো অর্জুন হেলায় পরাজিত করল!’

এত যে তর্ক-বিতর্ক, কথা কাটাকাটি হচ্ছে, সব শুনেও ধৃতরাষ্ট্র একেবারে নিশ্চুপ। দুর্যোধনও কোনো কথা বলছে না। তাঁদের নিশ্চুপতা কর্ণকেই সমর্থন জানাচ্ছে—ধরে নিলেন ভীষ্ম।

এবার দুর্যোধনকে লক্ষ্য করে ভীষ্ম বললেন, ‘শোনো দুর্যোধন, কর্ণের দাম্ভিকতায় ভুল না। ও সুবিধাবাদী। সংকটসময়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচে। ওর শৌর্যে বিশ্বাস রেখো না তুমি। পাণ্ডবদের সন্ধির প্রস্তাব যদি তুমি মেনে না নাও, তাহলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। যদি যুদ্ধ বাধে, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে শুয়ে শুয়ে আমাদের মাটি খেতে হবে।’

ভীষ্মের রাগ দেখে ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে গেলেন।

প্রকাশ্যে কর্ণকে তিরস্কার করে বললেন, ‘তুমি সংযত হও কর্ণ। এত দম্ভ ভালো নয়।’

পাশে বসা তাঁর ব্যক্তিগত ধারাভাষ্যকার সঞ্জয়কে বললেন, ‘আমাদের পক্ষে এই কর্ণ আর দুর্যোধন ছাড়া আর কেউ নেই।’  

ভীষ্মের কথা তখনো শেষ হয়নি, ‘তোমাকে বলছি দুর্যোধন, ধৃতরাষ্ট্র রাজা হলেও আজ গোটা ভারতবর্ষ জেনে গেছে—হস্তিনাপুরের মূল চালক তুমি। তোমার দিকে চেয়ে আছি আমরা। তুমি নিজে সিদ্ধান্ত নাও। পরশুরাম দ্বারা অভিশপ্ত কর্ণকে দিয়ে পরিচালিত হয়ো না তুমি। কৌরবদের বিপদ ডেকে এনো না। ও একটা বেজাতে জন্মানো সূতপুত্ৰই তো!’

শেষ বাক্যটা যে কর্ণের জন্য, বুঝল সবাই।

ভীষ্মের কথা শুনে কর্ণের রাগ আরও বেড়ে গেল। বলল, ‘যা বলেছেন, বলেছেন। দ্বিতীয়বার আর এমন গর্হিত কথা বলবেন না আপনি। আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করি। সেই ধর্ম থেকে একচুলও নড়ি না। আপনি আমার মধ্যে কোন খারাপটি দেখেছেন যে নীচজাতের লোকের মতো এমন গালাগালটা করলেন আমায়?’

এবার কণ্ঠে ঔদ্ধত্য মেশালো কর্ণ, ‘কই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা তো আমার মধ্যে কোনো অন্যায় আচরণ দেখতে পায় না! আর হ্যাঁ, আমি যা বলেছি, ভুল তো বলিনি! মহারাজ তো বলছেন না, আমি অন্যায় বলেছি! দুর্যোধনদের যা প্রিয়, তা-ই বলেছি আমি। থামালে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র থামাবেন আমায়, দুর্যোধন বারণ করবে। আপনি কে আমাকে থামিয়ে দেওয়ার?’

কর্ণের এই কথাগুলো ভীষ্মের বড় গায়ে লাগল। যে কুরুরাজ্যকে তিনি এতদিন ধরে রক্ষা করে এসেছেন, যে ধৃতরাষ্ট্রকে লালনপালন করে বড় করে তুলেছেন, সেই কুরুরাজসভায় দাঁড়িয়ে সেই ধৃতরাষ্ট্রের সামনে কর্ণ এরকম অপমানজনক কথা বলবার সাহস পেল কোত্থেকে?

গা জ্বলে যেতে লাগল ভীষ্মের। ফোঁসানো গলায় বললেন, ‘এই কর্ণটার অহঙ্কারের শেষ নেই। প্রতিদিনই সে একবার করে পাণ্ডবদের শেষ করছে। কার্যক্ষেত্রে ও যে একটা মাকাল ফল বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না।’

দ্রোণাচার্য সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্মকে সমর্থন করলেন, ‘মিথ্যা বাগাড়ম্বর অনেক শুনেছি। ওসব ফালতু কথার মূল্য নেই।

ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ফিরলেন দ্রোণাচার্য, ‘মহারাজ, আমি আপনাকে সাবধান করছি, এই অর্বাচীনের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন না।’

দ্রোণের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের চেহারা মলিন হয়ে গেল।

লক্ষ করল দুর্যোধন।

সরোষে বলল, ‘আপনারা সবাই মিলে কর্ণের শৌর্যকে খাটো করে দেখানোর ফন্দি করেছেন। বলছেন, কর্ণের তর্জন-গর্জনই সার, প্রকৃত শক্তিমত্তা কর্ণের নেই। ইন্দ্রের ছলনায় কর্ণ কবচ-কুণ্ডল হারিয়েছে বলেই বোধহয় আপনারা একথা বলছেন। কিন্তু আপনারা ভুলে যাচ্ছেন কী করে যে ইন্দ্রের একবীরঘাতিনী শক্তিশেলটি কর্ণের হাতে আছে?’

দুর্যোধনের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের মন চাঙ্গা হয়ে উঠল

বললেন, ‘তাই তো! কর্ণের এই অস্ত্রটির কথা আপনারা ভুলে গেলেন কেন? আর কর্ণের শক্তিকে এত খর্ব করে দেখারও তো কোনো কারণ দেখছি না আমি!’

দুর্যোধন বলল, ‘আপনি একটুও চিন্তা করবেন না মহারাজ। পাকা ফলের মতো জয় আমাদের হাতের মুঠোয়।’

বিদুর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, ‘দুর্যোধনের এই হঠকারিতা হস্তিনাপুরে মস্তবড় অমঙ্গল ডেকে আনবে মহারাজ। আপনি এসব থামান, যুদ্ধের কথা বন্ধ করুন।’

ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল দুর্যোধন, ‘পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা—কারো ওপর ভরসা করি না আমি। আমার একমাত্র ভরসা কর্ণ। কর্ণ আর আমি—দুজনে মিলে যুদ্ধ করব। যুদ্ধটা যদি যজ্ঞের মতো চেহারা নেয়, তাহলে সেই রণযজ্ঞের পশুবলি হবে যুধিষ্ঠির আর যজ্ঞের পুরোহিত হবে আমাদের কৰ্ণ।

উল্লাসে ফেটে পড়ে কর্ণ বলল, ‘পাণ্ডবদের শায়েস্তা করবার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও কর্ণ। পরশুরাম থেকে শিখে আসা অস্ত্র দিয়ে আমি প্রতিটি পাণ্ডবকে ঘায়েল করে ছাড়ব।’

ওখানে না থেমে কুরুবৃদ্ধদের খোঁচা মারার ইচ্ছেটা কর্ণের মনে প্রবল হয়ে উঠল।

ওঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পিতামহ ভীষ্ম আর আচার্য দ্রোণ, এই বুড়ো বয়সে আপনাদের যুদ্ধ করার দরকার নেই। আপনারা খোশমেজাজে মহারাজার পাশে বসে থাকবেন আর দেখে যাবেন আমার রণনিপুণতা।’

এত অপমান! আর কত সহ্য করেন ভীষ্ম! জ্বলন্ত চোখে বললেন, ‘তোমার সময় শেষ হয়ে এসেছে বাছা। যথেষ্ট বড় বড় কথা শুনিয়েছ, আর নয়। যে শক্তিশেলের কথা বলছে দুর্যোধন, তা যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবে। মনে রাখবে, অর্জুনের সহায় শ্রীকৃষ্ণ। তোমার মতো তথাকথিত বীর যোদ্ধাকে ওপারে পাঠাতে অর্জুনের বেশি সময় লাগবে না।’

ভীষ্মের কথা থামতেই চায় না। কিন্তু কর্ণ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুনুন পিতামহ, এই আমি অস্ত্র ফেলে দিলাম, আপনি বেঁচে থাকতে এই সভাতে আমি আর আসব না। এবং যে যুদ্ধে আপনি আছেন, সেই যুদ্ধেও আমি অংশগ্রহণ করব না। আমি কী করতে পারি, তা আপনি না দেখলেও অন্যরা দেখতে পাবেন।’

এই বলে ফুঁসতে ফুঁসতে রাজসভা ত্যাগ করে গেল কর্ণ।

কর্ণ কুরুসভা ত্যাগ করে গেলে দুর্যোধন ভীষণ অসন্তুষ্ট হলো। বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে ভারী গলায় ভীষ্মকে বলল, ‘পিতামহ, আপনি কিংবা অস্ত্রগুরু দ্রোণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আমি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। আমার আস্থা কর্ণের ওপর। শুনে রাখুন, পাণ্ডবদের নির্মূল করতে আমি, কর্ণ আর দুঃশাসনই যথেষ্ট।’

ভীষ্ম চুপ থাকলেন না, ‘বারবার কর্ণের কথাটাই বলে যাচ্ছ কেন দুর্যোধন? ওর ক্ষমতা কতটুকু, তা তো বিরাটযুদ্ধেই নিজচক্ষে দেখেছ তুমি! তার পরও ওর বাগাড়ম্বরে বিশ্বাস করে যাচ্ছ তুমি! যুদ্ধ যদি বাধে, দেখে নিয়ো, ওই কর্ণই তোমাদের ভরাডুবি ঘটাবে।’

‘আপনার এই কথা আমার মোটেই ভালো লাগল না। আপনার আর গুরুদেব দ্রোণের পক্ষপাতিত্ব এই রাজসভায় আর গোপন নেই। আপনারা এমন নির্লজ্জ যে পাণ্ডবদের পক্ষে কথা বলতে এখন আর রাখঢাকও করেন না। তারপরও আমি এবং আমার পিতা আপনাদের সহ্য করে যাচ্ছি।’ দুর্যোধন বলল।

ভীষ্ম বললেন, ‘আমরা কোনো পক্ষপাতী কথা বলছি না। যা সত্য, তা-ই বলছি।’

‘আপনাদের এই সত্যকথনে মিথ্যাচার আছে।’

‘তুমি বাহুবলে অন্ধ বলে এ কথা বলছ। তোমার যদি সত্য দেখার দৃষ্টি থাকত, তাহলে এভাবে বলতে না।’

দুর্যোধন বলল, ‘অস্ত্রে, ক্ষমতায়, সৈন্যবলে আমরা পাণ্ডবদের থেকে কম কীসে বলুন তো পিতামহ! আপনারা দুজনে, শুধু দুজনে কেন, কৃপাচার্য আর পিতৃব্য বিদুরের কথা বলছি না কেন, সবাই মিলে শুধু পাণ্ডবদেরই জয় দেখতে পান। কৌরবদের জয় দেখতে পান না কেন? ওদের অর্জুন থাকলে আমাদের কর্ণ আছে, ওদের ভীম থাকলে কৌরবদের দুর্যোধন আছে, ওদের যুধিষ্ঠির থাকলে কুরুদের দুঃশাসন আছে, ওদের…।’

‘থামো থামো তুমি দুর্যোধন।’ মুখের কথা কেড়ে নিলেন ভীষ্ম। ‘কর্ণ একটা অপরীক্ষিত শক্তি। কথার রাজা সে। তার কথায় আস্থা রেখো না তুমি।’

‘সেই প্রথম থেকেই আপনি কর্ণবিরোধী পিতামহ। ইচ্ছে করেই আপনি কর্ণকে হীনচোখে দেখেন। আপনার মতো একজন বীরের এ আচরণ সাজে না।’

ধৃতরাষ্ট্র দেখলেন দুর্যোধন-ভীষ্মের কথোপকথন ধীরে ধীরে সৌজন্য অতিক্রম করে যাচ্ছে। কিছুটা উঁচু গলায় তিনি বললেন, ‘তুমি থামো দুর্যোধন। এই বিতর্ক শেষ হওয়ার নয়। যদি হয়, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রেই হবে।

এরপর মহারাজা পুরোহিতের দিকে ফিরলেন। রাজকীয় কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি ফিরে যান ব্ৰাহ্মণ।’

আচমকা কঠোর কণ্ঠে দুর্যোধন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ফিরে যান আপনি। গিয়ে পাণ্ডুপুত্রদের বলুন, ওদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে রাজি নই আমরা। যদি শক্তি থাকে, যুদ্ধ করে রাজ্য উদ্ধার করতে বলুন।’

ভীষ্ম দুর্যোধনের কথা শুনে বড় কাতর হয়ে পড়লেন। তাঁরই সামনে মহারাজ শান্তনুর দুই বংশধারা আত্মঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে! রাজমাতা সত্যবতী কী মর্মান্তিক সংকটের মধ্যেও এই বংশের প্রবাহকে অব্যাহত রেখেছিলেন! তিনি নিজেও কি কম ত্যাগ করেছেন? রাজ্যলোভ, ক্ষমতালোভ, নারীবাসনা—সব কিছু পরিত্যাগ করে কুরুবংশটিকে ভারতবর্ষে টিকিয়ে রেখেছেন। আজ ভূমিলোভে আর নারীলালসায় এই বংশের অবলুপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। আজ পাণ্ডুপুত্ররা নিজেদের কুরু বলে পরিচয় দেয় না, দেয় পাণ্ডব বলে। আর কৌরবরা পাণ্ডবদের কুরুবংশের কেউ বলে স্বীকার করে না। বলে—এই হস্তিনাপুরে ওরা বহিরাগত। এখন, এই মুহূর্তে কী করবেন, দিশা পাচ্ছেন না ভীষ্ম।

দুর্যোধনের কথা শুনে হাহাকার করে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধনকে থামাও তুমি। অর্বাচীন সিদ্ধান্ত নিতে দিয়ো না তুমি ওকে। স্বজনঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ো না তুমি ধৃতরাষ্ট্র।’

কণ্ঠ বুজে এলো ভীষ্মের

দুর্যোধনের মতের বিপক্ষে কিছু বলবার সাহস করলেন না মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। অসহায় ভঙ্গিতে সিংহাসনে বসে থাকলেন।

বিরাটরাজার কুলপুরোহিত ফিরে গেলেন।

পাণ্ডবদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল। ভেবেছিল, তেরো বছরের জন্য ওদের বনবাসে পাঠিয়ে কৌরবদের ক্রোধ স্তিমিত হয়েছে। তাদের বোধোদয় হয়েছে। অহংকার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে এখন বিবেক দ্বারা পরিচালিত হবে তারা।

কিন্তু পাণ্ডবরা বাস্তবে দেখল—এই তেরো বছরে দুর্যোধনের বিবেকের কোনোই পরিবর্তন হয়নি।

চুয়াল্লিশ

কৃষ্ণ পাণ্ডবদের বলল, ‘তোমরা ভেঙে পড়ো না। মনে সাহস রাখো, ধৈর্য ধর।’

ভীম ক্রুদ্ধ চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আর কত ধৈর্য ধরতে বলো তুমি আমাদের!’

কৃষ্ণ বলল, ‘ধৈর্য শুভতা বয়ে আনে।’

যুধিষ্ঠির হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘আর শুভতা! তেরো বছরেও যাদের মনের পরিবর্তন হলো না, তাদের কাছ থেকে কী শুভতা আশা করো তুমি কৃষ্ণ?’

‘তুমি পাণ্ডবচতুষ্টয়ের বিশ্বাসের স্তম্ভ, আস্থার জায়গা। তুমি যদি ভেঙে পড়ো দাদা, তাহলে ভীম-অর্জুনরা কোথায় যাবে?’

কৃষ্ণের কথায় যুধিষ্ঠিরের মধ্যে স্থিরতা এলো, ‘তুমি কী করতে বলো? তোমার পরামর্শ কী?’

‘আমাকে একবার সুযোগ দাও।’

‘সুযোগ! কীসের সুযোগের কথা বলছ তুমি কৃষ্ণ?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল যুধিষ্ঠির।

কৃষ্ণ হাসল, মধুর হাসি। বলল, ‘আমি একবার হস্তিনাপুরে যাই। শান্তিদূত হয়ে। কুলপুরোহিতের চেষ্টা ব্যর্থ হলো, ধৃতরাষ্ট্রের দূত হয়ে সঞ্জয় এসেছিল, তাকেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হলো। শেষ চেষ্টাটা আমাকে করতে দাও দাদা। আমি সার্থক হতেও তো পারি!’

অর্জুন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘যতদিন কুরুসভায় দুর্যোধন আছে, তার পাশে কর্ণ আছে, সেখানে তোমার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে দাদা।’

‘তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন অর্জুন, ওই রাজসভায় পিতামহ আছেন, দ্রোণাচার্য আছেন, কৃপাচার্য আছেন, আছেন বিদুরও। তাঁদের কথারও তো গুরুত্ব আছে!’ আস্থার সঙ্গে বলল কৃষ্ণ।

‘আমি আগে একবার বললাম, আবার বলছি—জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের হাতের পুতুল হয়ে গেছেন। দুর্যোধনকে থামানোর ক্ষমতা এখন মহারাজের নেই। ওই কর্ণটা দুর্যোধনের মগজ ধোলাই করে দিয়েছে। এখন দুর্যোধনের মাথায় সৎবুদ্ধি নেই, সৎচিন্তা নেই। কর্ণ যা বোঝায়, তা-ই বলে দুর্যোধন। দুর্যোধন তোমার প্রস্তাব এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে দাদা। তুমি দুর্যোধনের হাতে অপমানিত হতে হস্তিনাপুরে যেয়ো না।’ অর্জুনের কথায় মিনতি।  

নরম একটু হাসল কৃষ্ণ, ‘একবার, ধরে নাও এটাই শেষবার। চেষ্টা করতে দাও না আমায়! যদি দুর্যোধনের হাতে লাঞ্ছিত হই, তোমাদের জন্যই হলাম না হয়!’

গম্ভীর হয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘কৃষ্ণকে আর বাধা দিয়ো না অর্জুন। চাইছে যখন, যাক। শান্তির শেষচেষ্টাটি না-হয় কৃষ্ণ করে দেখুক!

দাদার কথা শুনে অর্জুন চুপ করে থাকল।

.

কৃষ্ণ শান্তির প্রস্তাব নিয়ে কুরুসভায় এসেছিল।

সবাই ছিলেন সেদিন—ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, দুঃশাসন, দুর্যোধন, কর্ণ—সবাই। মন্ত্রী-অমাত্য সমাহারে রাজসভা তখন গমগম করছে।

সুসজ্জিত একটি আসনে কৃষ্ণকে বসতে দেওয়া হয়েছে। দূত সর্বকালে সর্বদেশে অতীব সম্মানের। কৃষ্ণও আজ কুরুরাজসভায় একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি। পরপর দুজন দূত ব্যর্থ হওয়ার পর কৃষ্ণের আগমন ধৃতরাষ্ট্রসভায়। আগের দূতের একজন বিরাটরাজার কুলপুরোহিত ব্রাহ্মণ। কিন্তু দূতের ভাষা তাঁর জানা ছিল না। তিনি ছিলেন দাম্ভিক এবং কর্কশভাষী। এই দুটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সেই দূতক্রীড়া বিফল হয়েছে। তাঁর দুর্ব্যবহার কুরুসভার সবার মনে আঘাত দিয়েছে। সঞ্জয় ছিল দ্বিতীয় বার্তাবাহক। জাতিতে সূত ছিল সে। ধৃতরাষ্ট্রের বার্তা নিয়ে বিরাটরাজ্যে পাণ্ডবদের কাছে গিয়েছিল। নরম প্রকৃতির লোক সঞ্জয়—বিনয়ী, মিষ্টভাষী। ভীম এবং অন্যান্যের অসহযোগিতায় সঞ্জয়ও ব্যর্থ হয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছে।

শেষচেষ্টায় অবতীর্ণ হয়েছে কৃষ্ণ। কর্ণ-দুর্যোধন ছাড়া কুরুসভার অন্যরা কৃষ্ণকে স্বাগত জানিয়েছেন। কর্ণ-দুর্যোধন মনে করেছে, দূতক্রীড়ায় কৃষ্ণ সফল হলে বিশাল কুরুরাজ্য এককভাবে ভোগ করার ক্ষমতা ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে কৌরবরা। তাই তারা প্রথম থেকেই কৃষ্ণের আগমনকে সুনজরে দেখেনি।

কৃষ্ণের আসনের একেবারে নিকটে বসেছিল দুর্যোধন। তার আসন ঘেঁষে কর্ণের আসন। ইচ্ছে করেই কর্ণ-দুর্যোধন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে। প্রয়োজনে নিম্ন কণ্ঠে যাতে গোপন কথাটি সারতে পারে। আর ওদের দুজনের কৃষ্ণের পাশ ঘেঁষে বসারও একটা কারণ আছে। কৃষ্ণকে মানসিক চাপে রাখা কিন্তু কৃষ্ণকে ওরা ভালো করে চেনে না। কৃষ্ণ মানসিক চাপে বিপর্যস্ত হওয়ার লোক নয়, বরং বিরুদ্ধপক্ষকে মানসিকভাবে কুপোকাত করার মানুষ। কৃষ্ণের মানসিক শক্তি আর রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই কর্ণ-দুর্যোধনের।

কুরুসভায় কৃষ্ণ মধুরভাষী, যুক্তিবাদী, অনেকটাই বিনয়ী। প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণ চায়নি তার এই দূতকার্য সফল হোক। তাহলে তার উদ্দেশ্যই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে! তার পিসতুতো ভাই, যারা ব্রাহ্মণ্যবাদিতার ধারক-বাহক, এই শান্তিপ্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না। কৃষ্ণের আসল উদ্দেশ্য—পাণ্ডবদের গোটা কুরুসাম্রাজ্যের একক অধিকারী করে তোলা। এই দূতক্রীড়া ব্যর্থ হলে কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। এবং যেভাবেই হোক পাণ্ডবদের ওই যুদ্ধে জিতিয়ে ছাড়বে কৃষ্ণ।

এই চক্রান্তের পরও কৃষ্ণ কুরুরাজসভায় এসেছে, সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। কারণ সমস্ত ভারতবর্ষের মানুষজনকে তো দেখাতে হবে পাণ্ডবরা শান্তির পক্ষে! কৃষ্ণ তাই তার সকল চাল-চক্রান্তকে গোপন করে একজন শান্ত বিনীত মানুষ হয়ে নিজ আসনে বসেছে। কৃষ্ণ অনুধাবন করতে পারল—তার শান্তিপ্রস্তাব সফল হবে না। কৃষ্ণ মানুষ চেনে। সেই শৈশব থেকে কংসকে দেখেছে সে, যৌবনবেলায় জরাসন্ধ-শিশুপালকে মোকাবিলা করেছে। এসব কঠিন-অহংকারী মানুষদের দেখে দেখে মানুষচেনার চোখ পেকে গেছে কৃষ্ণের।

কৃষ্ণ চোখ চিকন করে দেখে নিয়েছে—কর্ণ-দুর্যোধনের চোখমুখ অহংকারে দপদপ করছে। শান্তি-সন্ধির কথা শোনবার মতো মানসিক অবস্থা তাদের নেই। ক্রোধ নামক একটা রিপুকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের আসনে গুম হয়ে বসে আছে তারা। তাদের দেখে কৃষ্ণের মনে হলো—বিবেকহীন স্বার্থপরায়ণ দুটি মানুষ কৃষ্ণের প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করার জন্যই বুঝি এরকম করে বসে আছে।

এরপর কৃষ্ণ কুরুবৃদ্ধদের সামনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে একের পর এক শান্তি-সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে গেছে। প্রতিটি প্রস্তাবকে ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুররা সমর্থন করেছেন এবং প্রস্তাবগুলো মেনে নেওয়ার জন্য দুর্যোধনকে উপদেশ-অনুরোধ করে গেছেন। কিন্তু দুর্যোধন কৃষ্ণের কোনো প্রস্তাবকেই গ্ৰাহ্য করেনি। বারবার কর্ণের মুখের দিকে তাকিয়েছে সে। চন্দ্র যেমন সূর্য থেকে আলো ধার নিয়ে নিজেকে আলোকিত করে, দুর্যোধনও তেমনি কর্ণ থেকে আত্মবিশ্বাস আর অহংকার ধার নিয়ে কৃষ্ণের প্রতিটি প্রস্তাবকে সদম্ভ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। কুরুবৃদ্ধরা যতই হাহাকার করে উঠেছেন, ধৃতরাষ্ট্র নীরব থেকে আরও অধিক নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন। পুত্রের ওপর কোনো খবরদারি করেননি তিনি। ভিতরে ভিতরে বরং খুশি হয়ে উঠেছেন। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধনের এই দুর্বিনীত অগ্রাহ্যতার মধ্যে কৌরবদের, বিশেষ করে দুর্যোধনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছেন। তাই কৃষ্ণের শত উপরোধেও মুখ খোলেননি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। কৃষ্ণকে তাই বাধ্য হয়ে দুর্যোধনের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে।

কৃষ্ণ বলেছে, ‘অহংকারে অন্ধ হয়ো না তুমি দুর্যোধন। পাণ্ডবদের তুমি শুধু ইন্দ্রপ্রস্থটাই ফিরিয়ে দাও, তাতেই ওরা রাজি হবে। আমি ওদের রাজি করাব।’

‘ওরা রাজি হওয়ার কে? রাজ্য তো আমাদের!’ দুর্যোধন বলে উঠেছে। ‘দেওয়া না দেওয়ার অধিকার তো আমাদেরই!’

‘বনবাস থেকে ফেরার পর ওদের রাজ্য ওদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল দুর্যোধন।’

‘কী কথা ছিল, এখন তা আমার মনে নেই। মনে থাকলেও যুদ্ধ ছাড়া ভূমি ফিরে পাবে না পাণ্ডবরা।’

‘যুদ্ধলোভী হয়ো না দুর্যোধন। শক্তির অহংকার করো না।’

‘আমাকে উপদেশ দেওয়ার তুমি কে হে কৃষ্ণ? তুমি তো পাণ্ডুপুত্রদের বশংবদ। ওদেরই তল্পিবাহক হয়ে কুরুসভায় এসেছ তুমি। আমাদের কুমন্ত্রণা দিতে।’

দুর্যোধনের অপমান গায়ে মাখল না কৃষ্ণ। নরম সুরে বলল, ‘ঠিক আছে, পাণ্ডবদের হৃতরাজ্য ফিরিয়ে না দাও, তাতেও আপত্তি নেই। তুমি এক কাজ করো দুর্যোধন, যুধিষ্ঠিররা পাঁচ ভাই, পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটি গ্রাম দাও তুমি। দিলেই আসন্ন যুদ্ধ থেকে বিরত হবে ওরা।

চট করে কর্ণের দিকে তাকাল দুর্যোধন। কর্ণ তখন ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে যাচ্ছে।

দুর্যোধন সরোষে বলে উঠল, ‘পাঁচটি গ্রাম তো দূরের কথা, সুচের আগা যতটুকু ভূমি অধিকার করে, বিনাযুদ্ধে অতটুকু স্থানও পাণ্ডবদের দিতে রাজি নই আমি।’

এক কুটিল হাসি কৃষ্ণের চোখেমুখে ছলকে উঠে ত্বরিত মিলিয়ে গেল।

আহত কণ্ঠে কৃষ্ণ বলল, ‘ভুল করছ তুমি দুর্যোধন, অন্যের ইন্ধনে মস্তবড় অন্যায় করছ তুমি।’

ইঙ্গিতটা যে কর্ণকে লক্ষ্য করে, বুঝতে অসুবিধা হলো না কর্ণের। কিন্তু কর্ণ একটি শব্দও করল না।

সংবাদ পেয়ে রাজমহিষী গান্ধারী কুরুরাজসভায় উপস্থিত হয়েছেন। বুদ্ধিমতী তিনি। ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্যোধনের মন জুগিয়ে কথা বলার মানুষ তিনি নন। তিনি স্পষ্টভাষী এবং নির্ভীক।

অনুচ্চ অথচ সুদৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘তোমার বন্ধু ওই সূতপুত্র কর্ণ কিংবা দুঃশাসন জীবনেও পাণ্ডবদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তুমি পাণ্ডুপুত্রদের রাজ্য ফিরিয়ে দাও। কৌরবদের ধ্বংস অনিবার্য করে তুলো না দুর্যোধন।

কিন্তু দুর্যোধনের তখন এমন আত্মম্ভরী মানসিকতা যে মায়ের কথা শুনতেও রাজি নয়।

কৃষ্ণ স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠেছে, ‘তোমার পিতা-মাতার সামনে বলে যাচ্ছি দুর্যোধন, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও তুমি। ওই যুদ্ধে ভীম তোমার ঊরু ভাঙবে, দুঃশাসনের রক্ত পান করবে।’

‘কী বললে!’ বলে তেড়ে উঠল দুর্যোধন। চিৎকার করে বলল, ‘প্রহরী, প্রহরী। কৃষ্ণকে বন্দি করো।’

এতক্ষণে কথা বললেন ধৃতরাষ্ট্র। কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘অনেক হয়েছে দুর্যোধন। আর না। কৃষ্ণকে সসম্মানে যেতে দাও।’

মাথা উঁচু করে কুরুরাজসভা থেকে বেরিয়ে এসেছিল কৃষ্ণ। এবং প্রাসাদ-অভ্যন্তরে গিয়ে পাণ্ডবজননী কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেছিল।

আপন পিসি কুন্তীকে দুর্যোধনের সিদ্ধান্তের কথা কৃষ্ণ বলেছে, কৃষ্ণ এও বলেছে—কর্ণের ইন্ধনে এই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল পিসি।

কুন্তী কৃষ্ণকে দ্রৌপদীলাঞ্ছনার কথা মনে করিয়ে দিলেন, পুত্রদের দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন

বললেন, ‘আমার পুত্রদের বলো, তারা যেন এই অপমান-লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেয়।’

কৌরবদের কারো নাম মুখে না এনে কুন্তী এই কথাটি বললেন।

কী করে মুখে আনবেন তিনি? কৌরবদের কথা বলতে গেলে যে গর্ভজাত জ্যেষ্ঠপুত্র কর্ণের নাম এসে পড়বে!

.

এরপর অত্যন্ত ম্রিয়মাণ হয়ে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত কৃষ্ণকে শুনিয়ে গিয়েছিলেন কুন্তী।

কুন্তীর কথা শুনতে শুনতে বুদ্ধিটা কৃষ্ণের মস্তিষ্কে ঝলমল করে উঠেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *