কৰ্ণ – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুরুরাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসার সময় সভাকক্ষের সামনের চত্বরে কর্ণের দেখা পেয়ে গেল কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কিন্তু মনে মনে চাইছিল—হস্তিনাপুর ত্যাগ করার আগে কর্ণের সঙ্গে তার একবার সাক্ষাৎ হোক। ঘটনাক্রমে অথবা কাকতালীয়ভাবে কর্ণ-কৃষ্ণ মোলাকাত হয়ে গেল।

রাজসভা ভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। মহারাজ ফিরে গেছেন তাঁর অন্তঃপুরে, কুরু- উপদেষ্টারা যাঁর যাঁর আলয়ে। একান্তে বসে কর্ণ-দুর্যোধন নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করল। আলোচনা শেষ করে কর্ণ নিজভবনে ফিরে যাচ্ছিল। চত্বরটি অতিক্রম করার সময় কৃষ্ণ-কর্ণ মুখোমুখি হলো।

কোনো ভূমিকা না করে কৃষ্ণ বলল, ‘চলো।’

কর্ণ বলল, ‘চলব! কোথায়?’

‘আমার সঙ্গে।’

‘তোমার সঙ্গে! শত্রুপক্ষের লোকের সঙ্গে আমি যাব!’

‘হ্যাঁ, যাবে।’

‘কেন যাব? দুর্যোধন শুনলে কী ভাববে!’

‘দুর্যোধনকে ভয় পাও নাকি তুমি?’

কর্ণ থতমত খেল।

কৃষ্ণ বলে উঠল, ‘আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। তুমি শুধু আমার সঙ্গে এসো। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না।’

না হেসে পারল না কর্ণ, ‘তুমি আবার আমার কী ক্ষতি করবে! আমার ক্ষতি করার ক্ষমতা তোমার আছে নাকি?’

‘তা-ই যদি তুমি বিশ্বাস করো, তাহলে আমার সঙ্গে এসো। তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

চট করে কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকাল কর্ণ, ‘গুরুত্বপূর্ণ কথা! তোমার সঙ্গে আমার এমন কী গোপন কথা আছে, যা শোনবার জন্য আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে হবে?’  

‘এসোই না তুমি আমার সঙ্গে! ধরে নাও এ আমার অনুরোধ।’

কৃষ্ণের কথায় সম্মোহিত হলো কর্ণ। ভাবল—কৃষ্ণ তার সঙ্গে কী কথা বলতে চায়, জানলে ক্ষতি কী?

কর্ণ বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি এগোও। আমি আমার রথে করে আসছি।’

কৃষ্ণ বলল, ‘তোমার রথে করে আসার দরকার নেই। তুমি আমার রথেই চড়ো। দুজনে একসঙ্গে যাব।’

‘একসঙ্গে যাব!’ কর্ণের বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

কৃষ্ণ প্রকাশ্যে বলল, ‘অত অবাক হচ্ছ কেন কর্ণ?’ স্বগত বলল, ‘ভাইয়ে ভাইয়ে এক রথে চড়লে অসুবিধা কোথায়? তুমি আমার সঙ্গে চলই না! আরও কত বিস্ময় তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে!

দুজনে গিয়ে কৃষ্ণের রথে চড়ল। নগরের বাইরে নির্জন স্থানে এসে রথ থামাল কৃষ্ণ। অনুগামী যদুসেনারা দূরে কৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

কর্ণ-কৃষ্ণ সামনাসামনি দাঁড়াল।

কর্ণের চোখমুখ থেকে বিস্ময় তখনো কাটেনি।

কৃষ্ণের মুখে আবছা কুটিল হাসি।

কর্ণ জিজ্ঞেস করল, ‘এবার বলো, তুমি কেন আমায় এই নির্জন ভূমিতে নিয়ে এসেছ?’

আসতে আসতে কৃষ্ণ মনে মনে স্থির করে নিয়েছে, সে কর্ণের সঙ্গে কথা বলবে নরমে, গরমে, স্তুতিবাক্যে, টোপ ফেলে। তার উদ্দেশ্য হবে যেকোনোভাবে কর্ণকে দুর্যোধন থেকে বিযুক্ত করা।

কৃষ্ণ বলল, ‘কর্ণ, তুমি বিদ্বান এবং বিচক্ষণ মানুষ। সনাতন ধর্ম, বেদবাদ, ধর্মশাস্ত্র—সবই তুমি জানো।

কর্ণ কৃষ্ণকুটিলতা সম্পর্কে আগে থেকেই জানত। এখন তার কথা শুনে সতর্ক হলো। বলল, ‘হস্তিনাপুর থেকে এত দূরে এই কথাটি বলবার জন্যই কি নিয়ে এসেছ আমায়?’ থতমত খেল কৃষ্ণ। তবে তা সামান্য সময়ের জন্য। দ্রুত নিজের ভেতরটা গুছিয়ে নিল। ‘শোনো কর্ণ, তোমাকে একটি শাস্ত্রের কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এই কথাটি নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবে তুমি।’

একটু থেমে কর্ণের দিকে নিবিড় চোখে একবার দেখে নিল কৃষ্ণ। তারপর আবার বলল, ‘পুরুষ যে মেয়েকে বিয়ে করে, সেই মেয়ের যদি অবিবাহিত অবস্থার কোনো সন্তান থেকে থাকে, তাহলে বিবাহিত পুরুষটি ওই কুমারী অবস্থার সন্তানটিরও পিতা হয়।’ ভূমিকাটা একটু জটিল করল কৃষ্ণ।

কর্ণ বলল, ‘তো? এই শাস্ত্রবাক্য আমাকে শোনাচ্ছ কেন?’

‘কারণ তুমিও এই নিয়মের মধ্যে পড়ো।’

‘মানে! কী বলতে চাও তুমি কৃষ্ণ?’

‘তুমি মহারাজ পাণ্ডুর ছেলে কর্ণ।’

‘কী আবোলতাবোল বলছ তুমি!’

‘হ্যাঁ কর্ণ, তুমি কুন্তীর কুমারীকালের সন্তান। পাণ্ডবজননী কুন্তী তোমার জননী। তুমিই প্রথম পাৰ্থ কৰ্ণ।’

এরপর কৃষ্ণ কুন্তীর গর্ভধারণ থেকে নদীজলে পুত্রবিসর্জন, রাধার লালনপালন থেকে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে আগমন—সবই গড়গড় করে বলে গেল কর্ণকে।

হঠাৎ নিথর হয়ে গেল কর্ণ। পাথর যেন! কিন্তু কী অদ্ভুত! একটুও চমকাল না কর্ণ। সারাটা জীবন সূতপুত্রের কলঙ্ক বইতে বইতে বহু আগেই তার সকল অনুভূতি মরে গেছে। আজ নিজের জন্মরহস্য উন্মোচিত হওয়ার পর সেই মৃত অনুভূতিতে কোনোরূপ স্পন্দন জাগল না। কেবল পাথর প্রতিমার মতো স্থির হয়ে কৃষ্ণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল কর্ণ।

কৃষ্ণ বলতে থাকল, ‘নিয়ম অনুসারে তোমারই কিন্তু আজ রাজা হওয়ার কথা কর্ণ। তোমার পিতৃকুলে আছে পাণ্ডবরা, মাতৃকুলে আমি, বলরাম বৃষ্ণিবংশের পুরুষেরা। কুন্তী আমার পিসি কর্ণ, তুমি আমার দাদা। তুমি আমার সঙ্গে বিরাটরাজ্যে চলো ভাই। পঞ্চপাণ্ডব জানুক—তাদের একজন বড় দাদা আছে, কর্ণ তার নাম, মহাধনুর্ধর সে।’

আচমকা হা হা হো হো অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল কর্ণ। এই হাসি আর থামতেই চায় না।

ভড়কে যাওয়ার লোক নয় কৃষ্ণ। কিন্তু এখন একটু ভড়কে গেল। তারপরও নিজের ওপর আস্থা হারাল না।

বলল, ‘যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন—সবাই তোমার পায়ে পড়ে থাকবে। এমনকি আমিও তোমার পাদবন্দনা করব কর্ণ। চলো তুমি আমার সঙ্গে, পাণ্ডবরা তোমার অভিষেকের আয়োজন করবে।’

একটিও কথা বলছে না কর্ণ। শুধু নির্নিমেষ নয়নে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন যে কূটচারী, মানব-অভিজ্ঞ কৃষ্ণ, সেই কৃষ্ণও কর্ণের চাহনির ভাষা বুঝে উঠতে পারছে না। পারছে না বলেই একের পর এক টোপ দিয়ে যাচ্ছে কর্ণকে।

কৃষ্ণ এবার আরও একটু গভীরে নামল, ‘আর দিনের ষষ্ঠভাগে যখন পৃথিবীতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, তখন…।’ বলে কর্ণকে মাপবার জন্য কৃষ্ণ থেমে গেল।

কিন্তু কর্ণকে মাপার মতো অত সূক্ষ্ম চোখ কৃষ্ণের নেই। যেই নির্বিকার, সেই নির্বিকারই থাকল কৰ্ণ।

কৃষ্ণ কণ্ঠে জোছনা মেখে মন্থর কণ্ঠে বলল, ‘ত্রিভুবনের সেরা সুন্দরী দ্রৌপদী এসে তোমার সঙ্গে দেখা করবে তখন।’

কৃষ্ণের বিশ্বাস—মানুষ আর যা কিছুর লোভ ত্যাগ করতে পারুক, সুন্দরী নারীর লালসা ত্যাগ করতে পারে না। কর্ণও মানুষ। সেও দ্রৌপদীলোভ এড়িয়ে যেতে পারবে না। কৃষ্ণ জানে— সেই প্রথম থেকেই দ্রৌপদীর ওপর কর্ণের লোভ। আজ সেই দ্রৌপদীলোভের টোপে কৰ্ণ টলে যাবে।

কিন্তু কর্ণ টলল না। দ্রৌপদীকথা শুনে একটুও বিচলিত হলো না কৰ্ণ।

বুঝতে পেরে কৃষ্ণ তার কথার ধরন পাল্টাল, দ্রৌপদী থেকে সরে এলো কৃষ্ণ। আরও প্রবল, আরও শক্তিশালী প্রলোভন কর্ণের কাছে উপস্থাপন করল কৃষ্ণ, ‘তাহলে বলো কর্ণ, ধৌম্য পুরোহিত তোমার অভিষেকের মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করুন, আমরা সবাই অভিষেকের প্রস্তুতি নিই। তোমার যুবরাজ হবে যুধিষ্ঠির, তোমার মাথার চামর দোলাবে সে। তোমার মাথার ওপর রাজছত্র ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে ভীমসেন। তোমার সাদা ঘোড়ার রথ চালাবে অর্জুন।’

কর্ণ শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে। এই হাসিতে অসম্মতির আভাস নেই, সম্মতির ইঙ্গিতও নেই। অনেক চেষ্টার পরও কর্ণের মনোভাব আন্দাজ করতে পারছে না কৃষ্ণ।

এবার মরিয়া হয়ে শেষ প্রস্তাব দিল কৃষ্ণ, ‘তুমি রাজা হও কর্ণ, নিজের রাজ্যপাট বুঝে নাও। ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা দূর হোক। জননী কুন্তীর পুত্রস্নেহাতুর হৃদয়খানি প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলো কৌন্তেয়।

‘কৌন্তেয়’ শব্দটি খট করে কর্ণের কানে বাজল। কৌন্তেয় মানে কুন্তীর সন্তান। সে কুন্তীর সন্তান! এতদিন তো কেউ তাকে কৌন্তেয় বলে ডাকেনি, ডেকেছে রাধেয় বলে! রাধারই তো ছেলে সে, সূত অধিরথপুত্র! সারাজীবন জাতপাতের এত এত লাঞ্ছনা সহ্য করার পর, আজ আচমকা সে হয়ে গেল কুন্তীর পুত্র! নিজের প্রতি এ কত বড় উপহাস কৃষ্ণ বুঝবে না। কৃষ্ণের কাছে সম্ভ্রমের চেয়ে স্বার্থ বড়। আজ কেন কৃষ্ণ তাকে নিয়ে এই নির্জন স্থানে এসেছে, এতক্ষণে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাকে পটাতে চায় কৃষ্ণ, তাকে প্রলোভনের ফাঁদে পেলে কৌরবশক্তিকে খর্ব করার কূটকৌশলে অবতীর্ণ হয়েছে কৃষ্ণ। ভাই, জননী, রাজ্য, দ্রৌপদী—এসবের লোভ দেখিয়ে কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়।

মনে মনে ক্রুর একটু হেসে নিল কর্ণ।

বলল, ‘আজকে তুমি ভালোবেসে, আপন সখার মতো আমার ভালো চেয়ে যা কিছু বললে, সেসব তো আমার মঙ্গলের জন্যই বললে! তুমি বললে—আমি জননী কুন্তীর কুমারীকালের সন্তান, সমাজভয়ে নদীজলে বিসর্জন দিয়েছিলেন আমায়। সেদিন যদি তাঁর লোকভয় হয়, তাহলে আজ তাঁর সেই লোকলজ্জা যাবে কোথায়? আমার জন্য জননী কুন্তী আরও গহিনতর অপমানে নিমজ্জিত হবে না? আর আমিও-বা এমন কোন নির্লজ্জ হলাম যে স্বার্থের জন্য মা মা করে কুন্তীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ব?’

দুজন নারী কর্ণজীবনকে তছনছ করে দিয়েছেন। একজন দ্রৌপদী, অন্যজন জননী কুন্তী। দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ কর্ণ তিলতিল করে নিয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তো নেবে। কিন্তু কুন্তীর ওপর শোধ নেয় কী করে কর্ণ? কুন্তী তো শুধু পাণ্ডবমাতা নন, তারও জননী! যে মা নিজের সন্তানকে জলে বিসর্জন দেন, তাঁকে তো কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। আর গর্ভধারিণী বলে তাঁকে অপমানও করা যায় না।

বেশ কিছুক্ষণ মৌন থাকল কর্ণ। ভেতরের লালসা-ক্রোধকে ঝেঁটিয়ে বের করে দিল। প্ৰশান্ত দৃষ্টিতে একবার দূরদিগন্তে দেখে নিল।

তারপর কৃষ্ণের দিকে চোখ ঘোরাল, ‘পিতা অধিরথ আমাকে মা রাধার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মা রাধা তখন-তখনই বুকের কাছে টেনে নিয়েছিলেন আমায়। সূতজননীর বুক থেকে স্নেহধারা অমৃত হয়ে ঝরে পড়েছিল। শিশুকালে আমার মূত্র পুরীষ সাফ করেছেন এই রাধা মা। এসব জেনে-বুঝে আজ হঠাৎ করে তাঁর ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে যাব আমি! তাছাড়া শিশুকাল থেকে অধিরথকে পিতা বলে জেনে এসেছি আমি। আজ তোমার কথায় আচমকা পাণ্ডুপুত্র হয়ে যাব আমি! তিনি পিতার মতো জাতকর্ম, অন্নপ্রাশন সব করিয়েছেন, যৌবনে মেয়ে খুঁজে আমাকে বিয়ে করিয়েছেন। সেই স্ত্রীদের গর্ভে আমার ছেলেমেয়ে জন্মেছে। আমার স্ত্রীদের আমি ভালোবাসি কৃষ্ণ, সন্তানদের প্রাণের অধিক স্নেহ করি আমি।’ বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে এলো কর্ণের। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করল। এই অশ্রু বেদনার না আনন্দের ধরতে পারল না কৃষ্ণ। ফ্যালফ্যালে চোখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কৃষ্ণের আর কোনো উপায় থাকল না।

এই মুহূর্তটা কর্ণের জীবনে বিপুলায়তন সংকটে জড়ানোর, আবার সংকটমুক্তিরও। কৃষ্ণকথা মানলে তার জীবনে আর কোনো সংকট থাকবে না।

কিন্তু কর্ণ বিকটাকার সংকটকেই নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিল।

ছেচল্লিশ

কর্ণ যে কত বড় হৃদয়ের মানুষ, কত মহান আর কৃতজ্ঞচিত্তের—ওই এক সিদ্ধান্তেই বোঝা গেল।

অস্বীকার করবার উপায় নেই—কর্ণ হিংসা-প্রতিহিংসা মোড়ানো একজন রক্তমাংসের মানুষ। তার মধ্যে লালসা আছে, যশলোভ আছে। কিন্তু একথাও সত্য যে সে একনিষ্ঠ বন্ধুবৎসল। দানবীর সে—একথা বাদ দিলেও আর অন্য যে গুণটি তার চরিত্রকে উদ্ভাসিত করে, তাহলো কৃতজ্ঞতাবোধ। সে তার মা রাধাকে ভোলে কী করে, পিতা অধিরথের বাৎসল্যকে অস্বীকার করে কীভাবে? আর ওই যে প্রেমপ্রীতিতে ভরা সুখের গৃহকোণটি, তাকে বিস্মৃত হয় কেমনে? কৃষ্ণ তাকে চিনতে পারেনি। ভেবেছে, সে তারই মতো নারীলোভী, ক্ষমতাপ্রত্যাশী, ক্রূরতাপরায়ণ রক্তপুঁজের মানুষ। কর্ণ যে অন্য ধাতুতে গড়া, জানে না কৃষ্ণ।

অনেক কথার মাঝে কৃষ্ণ বারবার বলছিল, ‘তোমাকে আমরা সবাই মিলে রাজার আসনে বসাব। যুধিষ্ঠির হবে তোমার যুবরাজ।’

কৃষ্ণের বারবার প্রলোভনের প্রস্তাব শুনে কর্ণের রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু কী হলো কে জানে, রাগতে ইচ্ছে করল না কর্ণের। ভেতরে কীসের যেন এক পরিবর্তন অনুভব করতে লাগল সে। ক্রোধের পরিবর্তে সহনশীলতা, অধৈর্যের পরিবর্তে স্থিরতা, হিংসার পরিবর্তে ভালোবাসা কর্ণকে আবৃত করতে শুরু করল।

কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে কর্ণ বলল, ‘ছোট্ট সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে পাণ্ডবদের কাছে চলে যাওয়ার উপায় নেই আমার কৃষ্ণ। আমি দুর্যোধনের, আমি অধিরথের, আমি রাধা মায়ের। আমি তিন সূতরমণীরও। আর যারা আমাকে পিতার গরিমা দিয়েছে, তাদেরও।’

কৃষ্ণ দ্রুত কিছু বলতে চাইল কর্ণকে। ফ্যাকাশে চোখ দুটো তুলে কৃষ্ণকে থামিয়ে দিল কৰ্ণ।

বলল, ‘তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ কৃষ্ণ—তুমি আমার জন্মরহস্য যুধিষ্ঠিরের সামনে প্রকাশ করো না। যুধিষ্ঠিরকে ভালো করেই জানি আমি। আমিই কুন্তীর বড় ছেলে—জানতে পারলে কিছুতেই রাজা হবে না যুধিষ্ঠির। আর যুধিষ্ঠির রাজা না-হোক—কিছুতেই চাই না আমি। আমাকে যদি জোর করে তোমরা রাজা করই-বা, বন্ধুত্বের খাতিরে সমস্ত রাজ্য আমি দুর্যোধনের হাতে তুলে দেব।’  

আঁতকে উঠল কৃষ্ণ, ‘দুর্যোধনের হাতে রাজ্য তুলে দেবে!’

‘হ্যাঁ কৃষ্ণ। ও আমার বন্ধু, প্রাণের বন্ধু। আমার জয় মানে দুর্যোধনের প্রাপ্তি।’

‘সে কী!’

কর্ণ বলল, ‘আমার আজকের যা কিছু পরিচয়-প্রতিপত্তি, সব তো দুর্যোধনের জন্যই! ও যদি আমাকে রাজা না করত, যদি বন্ধু বলে কাছে টেনে না নিত, তাহলে আমি সেই সূতপুত্ৰই তো থেকে যেতাম! তাই বলছি—আমি যা কিছু অর্জন করব, তা সবই বন্ধু দুর্যোধনের হবে।’

‘তোমার নিজের বলে কিছু নেই তাহলে?’

‘না নেই। শুধু প্রাপ্তির কথা বলছ কেন, আমি এতকাল পাণ্ডবদের যে জঘন্য কথাগুলো শুনিয়েছি, তা সবই দুর্যোধনের তুষ্টির জন্য।’

‘তাতে তোমার অনুতাপ হয়নি?’ জিজ্ঞেস না-করে পারল না কৃষ্ণ!

‘আজ বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, ওই জন্য আমার অনুতাপ ছিল এবং আজও আছে।’ কৃষ্ণ এবার সুযোগ নিল, ‘সেজন্যই তো বলছি, ওই অনুতাপের ঘূর্ণি থেকে তুমি বেরিয়ে এসো কর্ণ, পাণ্ডবদলে যোগ দাও।’

ম্লান বিষণ্ণ একটুকরা হাসিতে কর্ণের সারামুখ ছেয়ে গেল।

ধীর কণ্ঠে বলল, ‘যে যুদ্ধ হতে যাচ্ছে, সে যুদ্ধ হবেই। এই যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারলে আমি আনন্দ পাব। তুমি যাও কৃষ্ণ, পাণ্ডবদের কাছে ফিরে যাও। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলো ওদের।’

একটা ঢোক গিলল কর্ণ। আকাশের দিকে তাকাল। তারপর কণ্ঠে একরাশ বেদনা জড়াল, ‘আবার অনুরোধ করছি তোমাকে কৃষ্ণ—সমস্ত রহস্য যা তুমি জানো, চেপে রেখো নিজের মধ্যে।’ কৃষ্ণ এবার তার কথাকে রূঢ় করল, ‘আসন্ন যুদ্ধে পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকে এক একজন যমদূত হয়ে উঠবে। তাদের অস্ত্রাঘাত তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হবে। সেই অস্ত্রাঘাত থেকে রেহাই পাবে না তুমি কর্ণ। কৌরবদেরও কারো রক্ষা নেই।’

একটুও ভয় পেল না কর্ণ। বলল, ‘অযথা ত্রাস ছড়িয়ো না তুমি। কে যমদূত, আর কে বজ্রধারী ইন্দ্র, যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রমাণ হবে। আর শোনো, আবার বলছি—যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে আমি আনন্দ পাব।’

এতকাল কর্ণ দুর্যোধন-দুঃশাসনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে পাণ্ডবদের টিটকারি দিয়েছে, দ্রৌপদীকে উলঙ্গ করার আদেশ দিয়েছে, সেই পাণ্ডবপরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার যে প্রস্তাব কৃষ্ণ আজ তাকে দিল, তা অত্যন্ত অবাস্তব। কর্ণ কোন মুখে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? গদগদ হয়ে বলবে—আমি তোমাদের দাদা! কুন্তীর প্রথম পুত্র আমি! লজ্জা! কী লজ্জা! এর চেয়ে মরণ শ্রেয়। তাই কর্ণ মরতে চেয়েছে।

কুরুসভায় কৃষ্ণের দূতক্রীড়া ব্যর্থ হয়েছে, কর্ণের সঙ্গে কূটকৌশলটাও অসফল হলো। নিজের ওপর কৃষ্ণের অপার আস্থা ছিল। কুন্তীর কাছে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত শোনার পর সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—কর্ণের সামনে পাশার এই ঘুঁটিটি এমনভাবে চালবে, এক চালেই ধরাশায়ী হবে কৰ্ণ। কিন্তু কর্ণের মনের জোর আর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না কৃষ্ণের। কর্ণের দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় পেয়ে একেবারেই স্তম্ভিত হয়ে গেল কৃষ্ণ।

ব্যর্থ মনোরথ হয়ে কৃষ্ণ বিরাটরাজ্যে পাণ্ডবদের কাছে ফিরে গেল।

.

কুরুসভার সমাপ্তি হলে কুরু-উপদেষ্টারা নিজ নিজ আবাসনে ফিরে গিয়েছিলেন। অন্য সবাই গেলেও বিদুর কিন্তু নিজগৃহে ফিরে যায়নি। সে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল কুন্তীর ঘরে। বিদুর এলে কুন্তী বড় তৃপ্তি পান। অধীর আগ্রহে বিদুরের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তিনি। বিদুরের প্রশান্ত চেহারা দেখে আর মিষ্ট কথা শুনে কুন্তীর মন আনন্দে ভরে ওঠে।

এই আনন্দ একতরফা নয়। সমান আনন্দ আর তৃপ্তি বিদুরেরও। আজ বিদুরের চেহারায় তৃপ্তির কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলেন না কুন্তী। কী রকম বিমর্ষ, ক্রোধান্বিত যেন বিদুর! কৃষ্ণের কাছে কুরুসভার বিবরণ যে কুন্তী শোনেনি, তা নয়। কিন্তু কৃষ্ণ বিচলিত থাকার কারণে সব কিছুর অনুপুঙ্খ ভালো করে জানতে পারেননি কুন্তী। আশা করে ছিলেন, বিদুর এলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু জেনে নেবেন। কিন্তু তা বুঝি আর হলো না! বিদুরকে যা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে, কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস করছেন না কুন্তী!

বিদুর জিজ্ঞাসার পথটা সুগম করে দিল, ‘আর কী! করার আর কিছুই থাকল না! যুদ্ধ লেগে গেল বলে!’

‘কী হয়েছে ঠাকুরপো? আমাকে খুলে বলো! আমি বড় উচাটনে আছি!’ কুন্তীর কথায় অস্থিরতা।

বিদুর বলল, ‘কী আর বলব বউঠান, ওই দুর্যোধনটা কারো কথা শোনে না।’

‘কেন শোনে না! তার বাবার কথা, পিতামহ ভীষ্মের কথা, আচার্য দ্রোণের কথা…।’

‘না না, কারো কথা শোনে না ওই কুলাঙ্গারটা! শুনবে কী করে? সারা দিনরাত যদি কেউ কানের কাছে কুমন্ত্রণা দিয়ে যায়, তাহলে শুভবুদ্ধি তো বিদায় নিতে বাধ্য!

‘কে কুমন্ত্রণা দেয়? ভালো উপদেশ দেওয়ার কি কেউ নেই দুর্যোধনের পাশে?

‘না নেই। যারা আছে, সবাই অত্যন্ত খারাপ লোক। কুবুদ্ধিতে তাদের মস্তিষ্ক ঠাসা।’

‘কারা তারা?’ কাতর হয়ে জানতে চান কুন্তী।

‘কারা আবার! ওই জয়দ্রথ, দুঃশাসন, শকুনি আর কর্ণ।’ বিদুরের কণ্ঠস্বর উষ্ণ।

নিস্তেজ কণ্ঠে কুন্তী বললেন, ‘দুঃশাসন কুমন্ত্রণা দিতে পারে, কারণ সে দুর্যোধনের ভাই। শকুনি দুর্যোধনের মাথা গুলিয়ে দিতে পারে, কারণ শকুনির মনে পিতৃহত্যা আর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধস্পৃহা জাগরূক। জয়দ্রথের কুপরামর্শে আমি অবাক হচ্ছি না, কারণ সে দুর্যোধনের বোন দুঃশলার স্বামী। কিন্তু একজনের ব্যাপারে আমি বিস্মিত হচ্ছি!’

‘সেজন কর্ণ তো?’ ত্বরিত জিজ্ঞেস করল বিদুর।

চমকে বিদুরের দিকে তাকালেন কুন্তী। আস্তে করে সম্মতির মাথা নাড়লেন।

‘বউঠান, দুর্যোধনের সবচাইতে বড় কুপরামর্শদাতা তো ওই কর্ণই! কর্ণই তো দুর্যোধনের মাথাটি বিগড়ে দিয়েছে! ওরই কুমন্ত্রণায় দুর্যোধন আজ পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম পর্যন্ত দিতে রাজি হলো না!’

কুন্তী কথা বলার শক্তি হারালেন। তাঁর ছেলেটি এতই নিচে নেমে গেছে! তার শুভবুদ্ধিটা লোপ পেল নাকি? তার কি কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই? কীসের লোভে কৰ্ণ দুর্যোধনকে উসকাচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতে কুন্তীর নিশ্বাস গাঢ়তর হলো, দুঃখ গভীরতর হলো। কুন্তী মনে মনে বলতে লাগলেন—দুর্যোধনের সঙ্গে থেকে থেকে ছেলেটা আমার একেবারে নষ্ট হয়ে গেল! তার রক্তের মধ্যে তো নষ্টামি থাকার কথা নয়! না-হয় সে জোরজবরদস্তির সন্তান, তাই বলে পিতা তো তার এলনা-ফেলনা কেউ নন! একজন ঋষির সন্তান উচ্ছন্নে গেল কী করে! সঙ্গদোষ! ওই সঙ্গদোষই কর্ণের মাথাটা গুলিয়ে দিয়েছে! হায় হায়! এখন আমি কী করব? সব কথা তো আর বিদুরকে বলা যাবে না! যদি বলা যেত, তাহলে তার কাছে একটা পরামর্শ পাওয়া যেত। হায় কৰ্ণ, তুই একেবারে বখে গেলি পুত্র? দুর্যোধনের সঙ্গে মিশে তারই ক্ষমতার মোহে প্রলুব্ধ হয়ে নিজ ভাইদের বিরুদ্ধে বিবাদ করে যাচ্ছিস তুই!

এতদিন যা করেছ, করেছ। আর এধরনের কাজ করতে দেব না আমি তোমাকে কর্ণ—মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন কুন্তী।

সিদ্ধান্ত নিলেন—কর্ণের সঙ্গে একান্তে দেখা করবেন তিনি।

কিন্তু কর্ণের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন? কাকে দিয়ে কর্ণের কাছে খবর পাঠাবেন যে কুন্তী তার সঙ্গে কথা বলতে চান?

এই প্রাসাদেই কর্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়। কর্ণের বাসস্থান তো কুরুপ্রাসাদের চৌহদ্দির বাইরে নয়। প্রাসাদসংলগ্নই তো কর্ণের বাসভবন! সামান্য পথটুকু হেঁটে গেলেই কর্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব। কিন্তু এই সাক্ষাতের কথা জানাজানি হয়ে গেলে কুরুপ্রাসাদে একটা লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। কুন্তী তো কুরুবিরোধীপক্ষ পাণ্ডবদেরই জননী! প্রাসাদের মানুষেরা এই সাক্ষাৎকে সহজভাবে নেবে না। এর মধ্যে কুটিলতা খুঁজে ফিরবে।

দূরে কোথাও কর্ণের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা তো একা তাঁর পক্ষে সংঘটিত করা সম্ভব নয়। একজনের সাহায্য যে নিতেই হবে!

হঠাৎ বিদুরের দিকে ফিরে কুন্তী বললেন, ‘তুমি একটি কাজ করতে পারবে ঠাকুরপো?’

বিদুর ইতস্তত করে বলল, ‘কী কাজ?’

‘কৃষ্ণকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলতে পারবে?’

‘পারব। কিন্তু কৃষ্ণ যদি আবার এই হস্তিনাপুরে আসে, সন্দেহের কী ভয়াবহ আগুন জ্বলে উঠবে, ভেবে দেখেছেন বউঠান?’

‘তোমার কথা সত্যি। কিন্তু কৃষ্ণকে একবার আমার দরকার ভাই।’

‘কী করি বলুন তো বউঠান?’

‘তুমি কৃষ্ণকে ছদ্মবেশে আসবার জন্য সংবাদ দাও। বলো—আমার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে। এই মুহূর্তে তাকে আমার খুব দরকার ভাই।’

‘ঠিক আছে বউঠান, আমি গুপ্তচর পাঠাচ্ছি কৃষ্ণের কাছে।’

বিদুর বিরাটরাজ্যে কৃষ্ণের কাছে নিজস্ব গুপ্তচর পাঠাল।

.

সংবাদ পেয়ে ছদ্মবেশে কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেছে কৃষ্ণ।

এবং ঠিক পরদিন কুন্তীকে নিয়ে ভাগীরথীর অদূরের অরণ্যময় টিলামতন স্থানটিতে পৌঁছে গিয়েছিল কৃষ্ণ।

সাতচল্লিশ

‘এত এত বর থাকতে মুনি দুর্বাসা আপনাকে দেহসম্ভোগের বর দিলেন কেন?’ কর্ণের এই প্রশ্নের সামনে কুন্তী একেবারেই বোবা হয়ে গেলেন।

কুঁকড়ে গেলেন সম্পূর্ণ। কর্ণের এই প্রশ্নের উত্তর কুন্তীর কাছে আছে, কিন্তু দিতে পারবেন না। এই প্রশ্নের উত্তর দিলে কুন্তীর জীবনের ভূগোল-ইতিহাস পালটে যাবে। কর্ণ যদি জানতে পারে সূর্যর্য কেউ তার জনক নন, সে দুর্বাসার বলাৎকারের সন্তান, জারজ সে; তাহলে কর্ণের সুস্থির জীবনটা যে একেবারে তছনছ হয়ে যাবে! মা হয়ে পুত্রের জীবন এলোমেলো করে দিতে পারেন না তিনি! তারচেয়ে এই-ই ভালো, চুপচাপ থাকাই উত্তম।

কুন্তীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে পিতৃপরিচয়ের দিকে আর গেল না কর্ণ। যা বোঝার বুঝে নেওয়ার চেষ্টায় রত হলো। সে বিচক্ষণ। দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান।

এই সময় কুন্তী বললেন, তাঁর কণ্ঠস্বর আবদারে-অভিমানে মাখামাখি, ‘তুমি আমারই পুত্র কর্ণ। বড় ছেলে হয়ে তুমি আজ ছোট ভাইদের চিনছ না। ভাইদের ছেড়ে যে-মোহে তুমি দুর্যোধনের সেবা করছ, তা মোটেই ঠিক হচ্ছে না বাছা। মা-বাবাকে সন্তুষ্ট করা পুত্রের কাজ। তুমি আমাকে সন্তুষ্ট করো কর্ণ। তুমি পাণ্ডবদের কাছে ফিরে এলেই আমি সন্তুষ্ট হব।’

একটু থেমে কর্ণের দিকে করুণ চোখে তাকালেন কুন্তী। বললেন, ‘যে বিপুল সম্পদ একদিন দিগ্বিজয় করে অর্জুন জিতে এনেছিল, সেই সম্পদ দুর্যোধন ছলনা করে গ্রাস করে নিয়েছে। ওই সম্পদ তুমি ফিরিয়ে আনো পুত্র। ফিরিয়ে এনে ভাইদের নিয়ে ভোগ করো। পৃথিবীর দুই শ্রেষ্ঠ বীর আজ এক জায়গায়—দেখতে চাই আমি। কর্ণ আর অর্জুন—আমার দুই পুত্র একজোট হয়ে কৌরবদের ধ্বংসে মেতেছে দেখলে মরেও আমার আত্মা শান্তি পাবে।’

এতক্ষণ অসীম ধৈর্য নিয়ে কুন্তীর কথাগুলো শুনে গেছে কর্ণ। মনের ক্রোধ-বিরক্তিকে কুন্তীর সামনে প্রকাশ করেনি। এখন কুন্তীর কথার উত্তরে একেবারে শুষ্ক স্বরে কর্ণ বলল, ‘আপনার এসব কথা আমার কাছে অমূলক। এই কথাগুলোর একটিও গ্রহণ করতে পারছি না আমি।’

এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কর্ণ। চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। চোখ খুলে বলল, কণ্ঠস্বরে ক্রোধ আর রুক্ষতার মিশাল, ‘আপনার কথামতো কাজ করলে ধর্ম তো হবেই না, উলটো অধর্ম হবে আমার। আপনি জন্মলগ্নে আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। ফলে আমি নিজেকে ক্ষত্রিয় বলে  পরিচয় দিতে পারিনি। আমাকে জলে বিসর্জন দিয়ে আপনি দুর্নামমুক্ত হয়েছেন, কিন্তু সারাজীবনের জন্য বদনামের ভাগী করেছেন আমাকে। আপনার নিষ্ঠুরতার কারণে আমি ক্ষত্রিয়সংস্কার লাভ করতে পারিনি। কোনো বড় শত্রুও এত বড় ক্ষতি করত না আমার, যা আপনি করেছেন।’ বলতে বলতে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল কর্ণ। নিজেকে সংযত রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগল। হঠাৎ দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল।

এর পর কাতর গলায় বলল, ‘যে সময়ে সত্যিই আমার আপনাকে প্রয়োজন ছিল, সে সময়ে আপনি আমাকে ত্যাগ করেছেন। এখন আপনি এসেছেন আমার কাছে। কেন? নিজের স্বার্থে। শুধু নিজের প্রয়োজনে আপনি আজ আমার প্রতি অপত্য স্নেহ দেখাচ্ছেন। এই মুহূর্তে আপনাকে আমি কী ভাবতে পারি, বলুন তো!’

কুন্তী এতটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ভাবেননি, এতটাই ফিরে পাবেন তিনি, কর্ণের কাছ থেকে। তিনি ভেবেছিলেন, কর্ণকে বুঝিয়ে বললে, একটু করুণ কণ্ঠে মায়ের প্রতি পুত্রের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেই পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে কর্ণ! কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। তিনি তো জানেন না, জন্মবৃত্তান্ত না-জানা পুত্রের কী গভীর বেদনা! এ বেদনা যে কত হৃদয়বিদারক, কুন্তীর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না!

কর্ণের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারলেন না কুন্তী। বিস্বাদ আর বিব্রত মুখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

মায়ের বেদনাক্লিষ্ট চেহারার দিকে ভ্রুক্ষেপ করল না কর্ণ, ‘কর্ণ-অর্জুন একজোট হয়ে যুদ্ধে নামলে কে ভয় পাবে না বলুন? কিন্তু আজ যদি আমি অর্জুন-কৃষ্ণের দলে গিয়ে যোগ দিই, তাহলে আমাকে লোকে কী ভাববে? ভাববে—আমি ভীতু, স্বার্থপর এবং বিশ্বাসঘাতক। সারা পৃথিবীর মানুষ যুগ যুগ ধরে আমার নামে থুতু ছিটাক—এই-ই চান আপনি?’

কুন্তী মরা কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি পাণ্ডবদলে গেলে আমার আনন্দ লাগত আর তোমার লাভ হতো।’

‘আপনার আনন্দের কোনোই মূল্য নেই আমার কাছে। আর আমার লাভের কথা বললেন তো? পাণ্ডবপক্ষে গেলে আজ আর নতুন করে কী লাভ হবে আমার? মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে। আমার কোনো ইচ্ছাই অপূরিত রাখেনি তারা। সেই দুর্যোধন- দুঃশাসনরা আজ আমার ওপর ভরসা করে যুদ্ধে নেমেছে, আপনি কি বলেন, আমি তাদের অকূল সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে পাণ্ডবকুলে ভিড়ে যাই?’

কুন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘বড় আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম পুত্ৰ।’

কর্ণ হাসল, বলল, ‘ওসব আবেগের কথা বলে আমাকে বশীভূত করতে পারবেন না। আপনি যা বলছেন, তা কিছুতেই করব না আমি।’

কৃষ্ণও কর্ণকে একই কথা বলেছিল, কিন্তু কৃষ্ণের বলার ভঙ্গির জন্য হয়তো-বা কর্ণ তার সঙ্গে মধুর ব্যবহার করেছিল। কিন্তু মায়ের সঙ্গে সেই রকম সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার করতে পারল না কৰ্ণ। উপরন্তু এতদিন পরে কুন্তীকে সামনে পেয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল সে। কর্ণের বুঝতে বাকি থাকল না—কুন্তী তার সামনে উপস্থিত হয়েছেন বাৎসল্যে আপ্লুত হয়ে নয়, স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত হয়ে। সন্তানত্যাগী জননীর প্রতি কোনোই মমতা অনুভব করল না কর্ণ।

ক্রোধে ফেটে পড়ে কর্ণ বলল, ‘আসলে আপনি আমার কাছে কী জন্য এসেছেন, বলুন তো! আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যে আপনি আসেননি, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু আসলেই কী জন্য এসেছেন, বুঝতে পারছি না।’

কর্ণের কথা শুনে কুন্তীর চক্ষু স্থির হয়ে গেল। নিজেকে আর লুকাতে ইচ্ছে করল না তাঁর, ‘দেখো কর্ণ, আসন্ন যুদ্ধে ভীম আর অর্জুনকে তিনজন ধনুর্ধর মারতে পারবেন। পিতামহ ভীষ্ম পারবেন, দ্রোণাচার্য পারবেন। ওঁদের দুজনেরই ভীমার্জুনকে বধ করার অস্ত্রদক্ষতা আছে।’

‘একথা আমিও মানি। কিন্তু ওঁরা…।’

কর্ণের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কুন্তী বললেন, ‘ওঁরা কখনো ভীমার্জুনকে হত্যা করবেন না। প্রাণাধিক ভালোবাসেন তাঁরা ওদের।’

‘আপনি এখনো তৃতীয় জনের নাম বলেননি।’ কর্ণের কথায় কৌতূহল মিশানো।

কুন্তী মাথা নেড়ে বললেন, ‘তৃতীয় জন তুমি। ভীমার্জুনকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমার আছে কৰ্ণ।’

হাসি কর্ণের চোখেমুখে ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল, ‘আমার কী এমন অস্ত্রবিদ্যা যে দ্রোণের শিষ্যকে আমি হত্যা করতে পারি!’

‘অর্জুনের সঙ্গে তোমার আজন্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তুমি আর কাউকে সহ্য করতে পারলেও অর্জুনকে সহ্য করতে পারো না। যুদ্ধে প্রথম সুযোগেই তুমি অর্জুনের ক্ষতি করে বসবে।’

খুব মনোযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনে গেল কর্ণ। বলল, ‘বলুন, আমি কী করতে পারি।’

‘তুমি অর্জুনকে মারবে না—কথা দাও আমায়।’ কুন্তীর কথায় ব্যাখ্যাতীত এক আকুতি।

‘খালি হাতে আমি আপনাকে ফিরাব না। আমি কথা দিচ্ছি—অর্জুন ছাড়া যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব—এদের কাউকে আমি মারব না।’

‘অর্জুন ছাড়া! অর্জুনকে মারবে কেন তুমি!’ বিপুল বিস্ময় আর ত্রাসে কণ্ঠস্বর বুজে আসতে চাইল কুন্তীর।

কুন্তীর কথা কানে তুলল না কর্ণ। বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে হয় অর্জুনকে আমি মারব, না হয় অর্জুন আমাকে মারবে। অর্জুনের মতো বীরের হাতে মরলে বিরাট যশের ভাগী হব আমি। তবে হ্যাঁ…।’ আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল কর্ণ।

কুন্তী কর্ণের পরের কথা শোনবার জন্য অপেক্ষা করে থাকলেন।

এবার কর্ণ কথায় ব্যঙ্গ মিশাল, ‘তবে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার যে পাঁচ ছেলে, সেই পাঁচ ছেলেই থাকবে। হয় অর্জুন থাকবে না, আমি থাকব। নয়তো আমি থাকব না, অর্জুন থাকবে। ফলে পাঁচজন ছেলে তো থাকলই আপনার?’

ভ্রু কুঁচকে গেল কুন্তীর। কপালে ভাঁজ পড়ল।

এই সময় একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল টিলাজুড়ে। হাওয়ায় হঠাৎ কুন্তীর মাথা থেকে রাজকীয় শুভ্র পট্টবস্ত্রখানি সরে গেল। তাঁর রূপের ঔজ্জ্বল্যে গোটা ভূমি ঝকমক করে উঠল।

কুন্তী মস্তকাবরণটি সামলে কর্ণের দিকে বিমূঢ় চোখে তাকালেন। তিনি দ্রুত ভাবতে থাকলেন—তিনি যে-কর্ণের কথা ভেবে এখানে এসেছেন, এ কর্ণ সেই কৰ্ণ নয়। এই কর্ণ দৃঢ়চেতা, স্বার্থবুদ্ধিমুক্ত এবং সর্বোপরি অতি বিশ্বস্ত এক বন্ধুবৎসল মানুষ। এ সেই কর্ণ, যে বন্ধুর জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এই কর্ণের চিন্তাকে আবেগে বিভ্রান্ত করে জননিত্বের প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব নয়।

হঠাৎ কুন্তীর বুক ভেঙে কান্না এলো। কর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল খুব। কিন্তু এরই মধ্যে কুন্তী বুঝে গেছেন, আহ্বান জানালে এ কর্ণ জননীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানুষ নয়। কর্ণের মধ্যে এতটি বছর ধরে অপমানের, লাঞ্ছনার যে আগুন জ্বলে গেছে, তা তাঁর একটি আহ্বানে নির্বাপিত হওয়ার নয়।

ব্যাকুল কণ্ঠে কুন্তী বললেন, ‘চার ভাইয়ের জীবন সম্পর্কে অভয় দিলে তুমি কর্ণ। কিন্তু অর্জুনের জীবনসংশয়টা থেকেই গেল। তুমি আর অর্জুন—আমার প্রিয়তম সন্তান। দুজনের কাউকেই হারাতে চাই না আমি। কিন্তু বিধি আমার কপালে কী লিখে রেখেছেন, জানি না। তোদের দুজনের মধ্যে কে থাকবে, কে জানে! তোর ভালো হোক বাপ, তোর মঙ্গল হোক।’ শেষের দিকে কুন্তী চূর্ণবিচূর্ণ হতে থাকলেন।

কুন্তী মুখে যা-ই বলুন, কর্ণের কাছে এসেছিলেন পাঁচ পুত্রকে বিপদমুক্ত করতে। কুন্তী প্রথম থেকে চেষ্টা করে গেছেন, যাতে তাঁর মনোভাবটি কর্ণের কাছে স্পষ্ট না হয়। কিন্তু কর্ণ তো সাধারণ মানুষ নয়! মনুষ্যচরিত্র তার স্পষ্ট জানা। কথাবার্তা কিছুদূর এগোনোর পর কর্ণ বুঝে ফেলেছে— জননী কুন্তী বিশেষ এক স্বার্থের তাড়নায় তার সঙ্গে প্রতারণা করতে এসেছেন। সব কিছু বুঝতে পেরেও কর্ণ মায়ের প্রতি কণামাত্র অশ্রদ্ধা দেখায়নি। উপরন্তু মাকে কথা দিয়েছে—তাঁর চার সন্তানকে হত্যা করবে না।

.

কুন্তী পিছন ফিরেছেন। নিজের মনস্কামনা অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে তাঁর। মনের কোনায় সামান্য খোঁচা থাকলেও হৃদয়টাতে বিপুল পরিতৃপ্তি।

নিচের দিকে তাকিয়ে পথ চলছেন তিনি। রোদের জ্বালা থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য মাথার ওপর পট্টবস্ত্রটি টেনে দিয়েছেন।

মায়ের যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কর্ণ। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন মা। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে এতদিনের জমানো পাপবোধ থেকে মুক্তির স্বস্তি।

কর্ণ তার বুকের মধ্যে এ যাবৎ যাপিতজীবনের রুধির পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।

কর্ণ যখনই কোনো অপমানে জর্জরিত হয়েছে বা বঞ্চনায় ম্রিয়মাণ হয়েছে অথবা হয়েছে বিষাদে হতোদ্যম, নিজের অজান্তে সূর্যদেবের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে। করুণ চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়েছে।

আজও কর্ণের অভ্যাসের ব্যত্যয় হলো না। সূর্যের অভিমুখে বেদনাক্লিষ্ট চোখ দুটো তুলে ধরল সে।

আটচল্লিশ

কৌরব-পাণ্ডব—উভয় শিবিরে যুদ্ধের সাজসাজ রব উঠল।

উভয়পক্ষ নানা দেশের রাজাকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা শুরু করল। অনেক রাজা তাদের বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে উভয় দলে যোগদান করতে শুরু করল। কালক্রমে ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রায় সকল রাজা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল। কেউ যোগ দিল কৌরব দলে, কেউ পাণ্ডবপক্ষে।

দ্বারকার কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিল। দাদা বলরাম জ্ঞাতিবিরোধে না জড়িয়ে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে পেয়ে আনন্দিত হলো। কৃষ্ণের নারায়ণীসেনা পেয়ে দুর্যোধনেরও তৃপ্তির সীমা থাকল না।

মহাবীর সাত্যকি অশ্বারোহী-গজারোহী-রথারোহী-পদাতিকের বিশাল এক বাহিনী নিয়ে পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করল। চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, জরাসন্ধের পুত্র জয়ৎসেন তাদের বিপুল সৈন্যদল নিয়ে পাণ্ডবপক্ষকে শক্তিসম্পন্ন করে তুলল। মহাবীর দ্রুপদ ও তাঁর পুত্ররা আর মৎস্যরাজ বিরাট তো পাণ্ডবদলে ছিলেনই। ধীরে ধীরে পাণ্ডববাহিনী স্ফীত হলো। তাদের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল সাত অক্ষৌহিণী।

অপরদিকে কৌরবদলে যোগ দিল রাজা ভগদত্ত, মহাবীর ভূরিশ্রবা, হার্দিক্য, কৃতবর্মা, সিন্ধুসৌবীর দেশের জয়দ্রথ, কম্বোজ দেশের রাজা সুদক্ষিণ, মাহিষ্মতী নগরীর নৃপতি নীল, অবন্তীদেশের রাজাদ্বয় বিন্দ ও অনুবিন্দ, কৈকেয়দেশের রাজা পঞ্চসহোদর। সকলেই বিশাল বিশাল বাহিনী নিয়ে দুর্যোধনপক্ষকে দুর্জয় করে তুলল। এইভাবে কৌরবপক্ষের সৈন্যসংখ্যা হলো এগারো অক্ষৌহিণী। দুই লাখ আঠারো হাজার সাতশ সৈন্য নিয়ে এক অক্ষৌহিণী। সে হিসাবে পাণ্ডবপক্ষের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল পনেরো লাখ ত্রিশ হাজার নয়শ আর কৌরবদের সৈন্যসংখ্যা চব্বিশ লাখ পাঁচ হাজার সাতশ।

একদিন প্রাণঘাতী যুদ্ধ করবার উদ্দেশ্যে এই ঊনচল্লিশ লাখ ছত্রিশ হাজার ছয়শ সৈন্য বিপুলায়তনের কুরুক্ষেত্রে সমবেত হলো।

পাণ্ডবদল দাঁড়াল পূর্বমুখী হয়ে, কৌরবপক্ষ পশ্চিমমুখী হয়ে।

কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে যুদ্ধোদ্যোগের কথা মদ্ররাজ শল্যের কানেও পৌঁছেছিল। অল্পদিনের মধ্যে পাণ্ডবদের অনুরোধ পেলেন তিনি। এই যুদ্ধসংকটে তিনি যেন পাণ্ডবপক্ষে সসৈন্যে যোগদান করেন।  

মদ্ররাজ শল্য পাণ্ডুপত্নী মাদ্রীর সহোদর। সেই সুবাদে নকুল-সহদেবের আপন মাতুল এই শল্য। আহ্বান পেয়ে পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ পাণ্ডবদলে যোগদানের জন্য রওনা দিল শল্য। সৈন্যরা যাতে খুব ক্লান্ত হয়ে না পড়ে, সেজন্য ধীরগতিতে কুরুক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল মদ্ররাজ।

সংবাদটা অতিগোপনে দুর্যোধনের কাছে পৌঁছে গেল। দুর্যোধন জানে—শল্যের গন্তব্য পাণ্ডবশিবির। গুপ্তচর তার কাছে আরেকটি তথ্য দিল—এই শল্য অত্যন্ত ভোজনবিলাসী এবং নৃত্যগীতিপিয়াসী।

দুর্যোধন একটা কূটবুদ্ধির খেলা খেলল। শল্যের যাত্রাপথে প্রচুর আহারাদির ব্যবস্থা করল। বিলাসব্যসনে ভরিয়ে তুলল মদ্ররাজের অগ্রগমনের পথটি। দক্ষ গায়িকা আর চটুল কটাক্ষের রূপসী নর্তকীদের দ্বারা শল্যের যুদ্ধযাত্রার কালটি আকর্ষণীয় ও মধুময় করে তুলল দুর্যোধন। দুর্যোধন নিজে অগ্রসর হয়ে মদ্ররাজ শল্যকে স্বাগত সম্ভাষণ করল।

ভাগনেদের কথা বিস্মৃত হলো শল্য। সসৈন্যে কৌরবদলে যোগদান করে বসল।

এতে পাণ্ডবরা প্রথম দিকে ভেঙে পড়লেও কৃষ্ণের পরামর্শে চাঙ্গা হয়ে উঠল। কৃষ্ণের কথামতো যুধিষ্ঠির যুদ্ধদিনের শুরুতে মাতুল শল্যের সঙ্গে দেখা করল এবং এই সম্মতি আদায় করে নিল যে কর্ণ আর অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে যখন পরস্পর মুখোমুখি হবে, তখন শল্য কর্ণের রথের সারথি হবে এবং অহেতুক কথা বলে যুদ্ধমগ্ন কর্ণের মনঃসংযোগ বিনষ্ট করবে।

যুধিষ্ঠির সাত অক্ষৌহিণীর সেনাদলকে সাতভাগে বিভক্ত করল। প্রত্যেক অক্ষৌহিণীর সেনাধ্যক্ষ নির্বাচিত হলেন—দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, চেকিতান, সাত্যকি এবং ভীম। কৃষ্ণের পরামর্শে ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রধান সেনাপতি পদে বৃত করা হলো। সবার ওপরে থাকল যুধিষ্ঠির।

.

কৌরবদলে প্রধান সেনাপতি নির্বাচনের সময় ঝঞ্ঝাটটা তৈরি হলো।

দুর্যোধনের বিপুল বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র, নানা যুদ্ধসামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য নিয়ে কুরুক্ষেত্রে পৌঁছে গিয়েছিল। কুরুক্ষেত্রে পৌঁছে দুর্যোধন কর্ণের সঙ্গে পরামর্শ করে বিশাল সমতলভূমিজুড়ে সৈন্যশিবির স্থাপন করল। দুর্যোধনের যুদ্ধায়োজন সুসম্পন্ন হলো, সুশৃঙ্খল হলো না।

ভীষ্ম আর কর্ণের পূর্বতন বিবাদ চাগিয়ে উঠল।

পিতামহ ভীষ্ম কৌরবপক্ষের প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হলেন। তাঁকে সেনাপতি করার সবচাইতে বড় সমর্থক ছিল কর্ণ। কিন্তু ভীষ্ম তার এই সমর্থনকে মর্যাদা দিলেন না। উপরন্তু কর্ণের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।

যুদ্ধ শুরুর আগে পিতামহ দুর্যোধনের মহাক্ষতিকারক একটি শর্ত আরোপ করে বসলেন, ‘আসন্ন যুদ্ধে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমি রাজি নই। হয় কর্ণ আগে যুদ্ধ করুক, নয় আগে আমি করি। প্রথমজনের মৃত্যু হলে দ্বিতীয়জন যুদ্ধ করবে।’

ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধন তো একেবারে হাঁ-হয়ে গেল! বলেন কী পিতামহ! ভীষ্ম আর কর্ণ যে-ধরনের মহারথী, দুজনে এক সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে কুরুপক্ষকে পরাজিত করা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু পিতামহ এ কী বলছেন!

হতাশা জড়ানো কণ্ঠে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘এ কী রকম কথা পিতামহ আপনার! কর্ণ যুদ্ধ করলে আপনি করবেন না! এ তো কৌরবদলের জন্য অতি দুর্ভাগ্যজনক শর্ত।’

কর্ণ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, ‘তুমি বুঝে উঠতে পারছ না দুর্যোধন, কেন তিনি এ শর্ত দিলেন? আরে! তিনি তো চানই না কৌরবদের জয় হোক! যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন তোমাদের হয়ে, কিন্তু মনে মনে তিনি তো কামনা করেন, পাণ্ডবদেরই জয় হোক! তিনি তো পাণ্ডবদেরই বশংবদ!’

কর্ণের এরকম মন্তব্যের পরও কোনো কথা বললেন না ভীষ্ম

দুর্যোধন বলল, ‘কিছু বলছেন না যে পিতামহ? কর্ণের সঙ্গে আপনার মতপার্থক্য আছে, মানি। কিন্তু যুদ্ধসময়ে সেই মতান্তরকে এত বড় করে তুলছেন কেন?’

ভীষ্ম কোনো ব্যাখ্যায় গেলেন না। শুধু বললেন, ‘আমার ওই এককথা। হয় কর্ণ যুদ্ধ করবে, নয় আমি। ওর সঙ্গে যুদ্ধ করব না আমি।’

‘কিন্তু কেন করবেন না, তার তো একটা ব্যাখ্যা দেবেন!’ অধৈর্য দুর্যোধন।

‘দুদিন আগেরই তো কথা। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে দুর্যোধন? রাজবাড়ির কৌরবসভায় কর্ণের অপমানটা এত সহজেই ভুলে যাব আমি?’ বললেন ভীষ্ম।

দিনকয়েক আগে কুরুরাজবাড়িতে কৌরবকুলের প্রধান যোদ্ধাদের বলাবল নির্ধারণীসভা বসেছে। প্রধান সেনাপতি হিসেবে এক্ষেত্রে ভীষ্মেরই মতামত চাওয়া হলো। কে প্রতিপক্ষের কতজন সৈন্য হত্যা করতে সক্ষম—এর নিরিখে পিতামহ কাউকে ‘রথ’, কাউকে ‘অতিরথ’, কাউকে ‘মহারথ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ক্রমানুসারে ভীষ্ম দুর্যোধনের দুজন নাম-না-জানা ভাইকেও ‘রথ’ আখ্যা দিলেন।

কক্ষের একপাশে চুপচাপ বসে ছিল কর্ণ। তার ওপর চোখ পড়তেই দুর্যোধন পিতামহকে জিজ্ঞেস করল, ‘সবার কথা বললেন, কর্ণের কথা বললেন না যে?’

এই প্রশ্নটার জন্য ভীষ্ম বোধহয় তৈরি হয়েই ছিলেন, ‘তোমার যে প্রাণের বন্ধু কর্ণ, সে ‘রথ’ও নয়, ‘অতিরথ’ও নয়।’

দুর্যোধন কিছু বলবার আগে আচমকা কথা ঘোরালেন ভীষ্ম। কর্ণকে বীরসভায় অপদস্থ করার জন্যই কথায় অবহেলা আর ঘৃণা মেশালেন, ‘আসলে এই কর্ণটা স্বভাবে অত্যন্ত নীচপ্রকৃতির। সে তোমাকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে সর্বদা উসকাচ্ছে। ও তো কথার রাজা ছাড়া আর কিছু নয়। সে তোমার বুদ্ধিদাতা মন্ত্রী হতে পারে, আমার কাছে ওর কোনো গুরুত্বই নেই।

দুর্যোধন ভীষ্মের কথা শুনে একেবারে থ মেরে গেল।

অনেক পরে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘কর্ণের কোনো গুরুত্ব নেই!’

কর্ণের কাছে দ্রোণ আগেই অপমানিত হয়েছিলেন। মওকা হাতে এসে যাওয়ায় দ্রোণ চুপ থাকলেন না। ভীষ্মের কথাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে বলে উঠলেন, ‘মহামতি ভীষ্ম যা বলেছেন, যথার্থই বলেছেন। ও প্রকৃতই কিছু না। সবাইকে শেষ করে দেবে, অর্জুনকে হত্যা করবে— -এই রকম তর্জন-গর্জনই করে গেল শুধু! কার্যক্ষেত্রে কর্ণ যে কী, সবাই জানেন।’

ঘোড়ার পিঠে সহিস যেমন করে চাবুক মারে, ভীষ্ম-দ্রোণ দুজনে মিলে কর্ণের পিঠে তেমন করে চাবুক চালালেন যেন!

কড়া চোখে ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে কর্ণ বলল, ‘যথেষ্ট হয়েছে পিতামহ, যথেষ্ট! আমি নিজের মধ্যে ডুবে আছি। আপনি কিন্তু অবিরাম আমাকে খুঁচিয়ে যাচ্ছেন। আর ওই বামুনটা আপনাকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। আপনি আমাকে ইচ্ছে করে পদে পদে অপমান করছেন। দুর্যোধনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু আর নয়।’

ক্রোধ তার চোখমুখ ফেটে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। সংযত হওয়ার কোনো চেষ্টাই কর্ণের মধ্যে দেখা গেল না।

ওই অবস্থাতেই কর্ণ বলল, ‘আরে, আপনি আমাকে কাপুরুষ, খারাপ লোক—কত কিছুই না বলছেন, চুপচাপ ছিলাম আমি। এখন আমি বলছি, আপনি শুনুন—আপনি কোন মহারথ? আমার বিবেচনায় আপনি অর্ধরথ ছাড়া আর কিছুই নন।’

কর্ণের কথা শুনে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভীষ্ম। তেড়ে কর্ণের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলেন। দ্রোণাচার্য তাঁকে আটকালেন।

ততক্ষণে কর্ণও তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তর্জনী পাকিয়ে ভীষ্মকে লক্ষ্য করে বলেছে, ‘সবাই বলে, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মিথ্যে বলেন না, আমি বলি, তাঁর প্রতিটি কথাতেই মিথ্যাচার। কৌরবদের ছত্রছায়ায় থেকে আপনি সবসময় কুরুকুলের বিরোধিতা করে গেছেন। আর এখন যে অপকৌশলটা অবলম্বন করেছেন আপনি, মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত বুঝতে পারছেন না। ‘রথ’, ‘অতিরথ’, ‘মহারথে’র মাধ্যমে আপনি যুদ্ধের আগেই কুরুদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। শুনুন পিতামহ, বয়সের ভার আর পাকা চুল দেখে ‘রথ’, ‘মহারথ’ নির্ণিত হয় না, ওসব ঠিক হয় রণদক্ষতায়।’

এরপর দুর্যোধনের দিকে মুখ ফেরাল কর্ণ, ‘দেখো দুর্যোধন, এখনো সময় আছে, এই ঘরের শত্রু বিভীষণ পিতামহটাকে ত্যাগ করো তুমি। নইলে ভবিষ্যতে তোমাকে অনেক মূল্য দিতে হবে।’ দুর্যোধন হতভম্ব! এই দুইজনের ঝগড়া কীভাবে মিটাবে বুঝে উঠতে পারল না! থতমত খেয়ে বোবাচাহনি নিয়ে সভামাঝে দাঁড়িয়ে থাকল দুর্যোধন।

ক্রুদ্ধ কর্ণ শেষ পর্যন্ত বলে বসল, ‘আমি বলে দিচ্ছি দুর্যোধন, আমি ভীষ্মের সেনাপতিত্বে যুদ্ধ করব না। এই ভীষ্ম বেঁচে থাকতে যুদ্ধই করব না আমি, মরলে যুদ্ধে নামব।’

দুর্যোধন কোনোভাবেই ভীষ্ম আর কর্ণের ঝগড়া থামাতে পারল না। তাতে কুরুপক্ষেরই মস্তবড় ক্ষতি হয়ে গেল।

ভীষ্ম যদি পাণ্ডবদের গায়ে হাত না দিয়েও শুধু অসংখ্য সৈন্য হত্যা করে যেতেন, তাহলে সেই অবসরে কর্ণ পঞ্চপাণ্ডবের ভরাডুবি ঘটাতে পারত।

কিন্তু ভীষ্মের দূরদৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী।

তা কর্ণ বুঝলেও দুর্যোধন বুঝতে পারেনি।

ঊনপঞ্চাশ

ভীষণ বিষণ্ন মন নিয়ে দুর্যোধন তার এগারো অক্ষৌহিণীর বাহিনীকে এগারো ভাগে বিভক্ত করল। প্রতিটি ভাগে এক অক্ষৌহিণী সেনা। কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য, শল্য, জয়দ্রথ, কর্ণ, সুদক্ষিণ, কৃতবর্মা, অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, শকুনি ও বাহ্লীক—এই এগারো জন বীরকে এক এক অক্ষৌহিণীর সেনাপতি করল দুর্যোধন।

ভীষ্মের শর্ত মতে কর্ণ নিজেকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখল। কুরুক্ষেত্রে সে উপস্থিত থাকল বটে, কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল না।

যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে কুরুবাহিনীপ্রধান ভীষ্ম আচমকা আরও দুটি শর্ত দিয়ে বসলেন—তিনি পাণ্ডুপুত্রদের বধ করবেন না। তবে প্রতিদিনের যুদ্ধে দশ হাজার পাণ্ডবসেনা হত্যা করবেন। পরের শর্তটি আরও ভয়াবহ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দ্বিতীয় শর্ত হলো—তিনি দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডীর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না বা তাকে হত্যা করবেন না। তাঁর আজন্ম শপথ ছিল—তিনি কোনো নারী বা আগে যে নারী ছিল, সে ব্যক্তিকে কখনো বধ করবেন না। শিখণ্ডী পূর্বজন্মে নারী তো ছিলই, এ জন্মেও কন্যারূপে জন্ম নিয়ে পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে।

অবশেষে রাত্রি প্রভাত হলো।

ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হলো।

মৃত্যু প্রলয়ের অন্ধকার হয়ে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলো সেই সকালে।

দুই পক্ষের সেনানায়কেরা কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দ্বিধাগ্রস্ত অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের ভগবদ্‌গীতার উপদেশ ও বিশ্বরূপ দেখানোর ব্যাপারটিও সাঙ্গ হলো। যুদ্ধ আরম্ভ হয় হয় সময়ে যুধিষ্ঠির রথ থেকে নেমে কুরুবৃদ্ধদের কাছে আশীর্বাদ চাইতে গেল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ—একে একে যুদ্ধজয়ের আশীর্বাদ দিলেন যুধিষ্ঠিরকে।

এদিকে ভীষ্মের অধিনায়কত্বে কর্ণ যে যুদ্ধ করবে না এবং আজ যে যুদ্ধোন্মুখ উন্মুখ কৌরবসৈন্যদের মধ্যে কর্ণ নেই, খবরটি কৃষ্ণের কানে পৌঁছে গেছে। যুদ্ধারম্ভের ডামাডোলের একফাকে অর্জুনের রথ থেকে নেমে গেল কৃষ্ণ।  

অতি সাবধানে কর্ণশিবিরে গিয়ে উপস্থিত হলো কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবশিবিরে যোগদানের জন্য কর্ণকে পুনরায় সবিনয়ে অনুরোধ জানাল।

কর্ণ কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘তা হয় না কৃষ্ণ। বেঁচে থাকতে দুর্যোধনের অনিষ্ট করা আমার দ্বারা হবে না। তোমাকে আগে একবার বলেছি কথাটা। তারপরও যে কেন এলে আমার কাছে, বুঝতে পারছি না!’

কূটচাল চালল কৃষ্ণ, ‘ঠিক আছে। তুমি অন্য একটা কাজ করো দাদা—ভীষ্মের পতন পর্যন্ত তুমি পাণ্ডবদের হয়ে যুদ্ধ করো। পরে না হয় কৌরবশিবিরে যোগ দেবে। দুর্যোধনের বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করবে তখন।’

ম্লান হেসে কর্ণ বলল, ‘তোমার মধ্য থেকে ধান্ধাবাজিটা আর গেল না কৃষ্ণ! ধুরন্ধর তুমি। কূটচালে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধটা বাধিয়েই ছাড়লে। তার পরও তুমি ক্ষান্ত হচ্ছ না। আমাকে ভোলাতে এলে। বিভ্রান্ত করে আমাকে পাণ্ডবদলে ভিড়াতে চাইছ? আমি দ্রোণ বা ভীষ্ম নই, যাঁদের তোমরা বিভ্রান্ত করতে পেরেছ। তুমি দ্রুত ফিরে যাও কৃষ্ণ। প্রহরীরা দেখে ফেললে অনর্থ ঘটবে।’

কৃষ্ণ দেখল—এ কর্ণ বিভ্রান্ত হওয়ার লোক নয়। আর যাকেই বিভোর করা যাক না কেন, কর্ণকে নয়!

যেমন সংগোপনে এসেছিল, তেমনি করে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গেল কৃষ্ণ।

.

প্রথমদিনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

সেনাদের গর্জন, তুরি-ভেরি ইত্যাদি রণবাদ্যের ধ্বনি, হস্তির বৃংহণ, অশ্বের হ্রেষায় সমস্ত কুরুক্ষেত্র উতরোল হয়ে উঠল।

ভীম সসৈন্যে কুরুসেনাদের দিকে এগিয়ে গেল। কুরুরা বাণে বাণে ভীমকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

দুর্যোধন, দুর্মুখ, দুঃসহ, দুঃশাসন, দুমর্ষণ, চিত্রসেন, বিবর্ণ, ভোজ প্রমুখরা অভিমন্যু, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অর্জুন ভীষ্মের মুখোমুখি হলো। ভয়ঙ্কর গাণ্ডীব নিয়ে ভীষ্মের ওপর আক্রমণ চালাল অর্জুন। ভীষ্মও ছাড় দিলেন না। ভীষণদর্শন ধনু দিয়ে অর্জুনের বাণাঘাতের জবাব দিলেন ভীষ্ম।

মহাযোদ্ধা সাত্যকির সঙ্গে কৌরবযোদ্ধা কৃতবর্মার যুদ্ধ বেধে গেল। প্রথম দিনের যুদ্ধে ভীমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল দুর্যোধন। উভয়ের প্রধান অস্ত্র গদা হলেও প্রথমদিন তারা তীর-ধনুক নিয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। দুঃশাসনের সঙ্গে নকুল যুদ্ধে রত হলো। দুর্মুখের সঙ্গে লড়াই বাধল সহদেবের। মদ্ররাজ শল্যের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের, দ্রোণাচার্যের সঙ্গে দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘোরতর সংগ্রাম চলতে লাগল। এইভাবে অলম্বুষের সঙ্গে ভীমপুত্র ঘটোৎকচের, কৃপাচার্যের সঙ্গে কৈকেয়রাজ বৃহৎক্ষত্রের, জয়দ্রথের সঙ্গে দ্রুপদের যুদ্ধ চলতে লাগল।

প্রথমদিনের যুদ্ধে বিরাটপুত্র উত্তর মদ্ররাজ শল্যের তীক্ষ্ণমুখ শক্তির আঘাতে প্রাণ হারাল। এরপর নিহত হলো বিরাটের অন্য এক পুত্র শ্বেত। শল্যই তাকে হত্যা করল।

প্রথমদিনের যুদ্ধশেষে দেখা গেল—পাণ্ডবপক্ষেরই ক্ষতি হয়েছে বেশি। দুর্যোধন আনন্দিত হলো।

যুধিষ্ঠির বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ল।

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলল, ‘এত হতাশ হয়ে পড়ছ কেন দাদা? প্রথমদিনের যুদ্ধেই কি সমস্ত যুদ্ধের ফলাফল নির্ণীত হয়ে গেছে?’

‘না। তারপরও বলছি—আমাদের পক্ষের এত এত বীর মারা গেল! সহস্র সহস্র পাণ্ডবসেনার রক্তে কুরুক্ষেত্র ভিজে গেছে! উত্তরকে হত্যা করলেন মামা শল্য!’

যুধিষ্ঠিরকে থামিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ বলে উঠল, ‘তুমি অল্পতেই ভেঙে পড়ছ দাদা। উত্তর, শ্বেত মরেছে তো কী হয়েছে? ধর্মযুদ্ধের জন্যই তো প্রাণ দিয়েছে তারা!’

উদাস চোখে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কৃষ্ণ তাকে উজ্জীবিত করবার জন্য আবার বলল, ‘দেখো দাদা, তোমাদের পক্ষে সাত্যকি আছেন, রাজা বিরাট আছেন, দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যুম্ন আছেন। মহাবীর চার পাণ্ডব তো আছেই! আর শিখণ্ডী তো আমাদের পাশাখেলার ঘুঁটি। তাকে দিয়েই তো আমি পিতামহ ভীষ্মের ভবলীলা সাঙ্গ করাব।’ কৃষ্ণের এরকম উৎসাহমূলক কথায় যুধিষ্ঠির উদ্দীপিত হয়ে উঠল। পরদিনের যুদ্ধে ক্রৌঞ্চারুণ ব্যূহ রচনা করবার নির্দেশ দিল ধৃষ্টদ্যুম্নকে।

প্রধান সেনানায়ক হিসেবে ভীষ্ম যুদ্ধ করলেন পুরো দশদিন। এই যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের অজস্র সৈন্য আর বড় বড় যোদ্ধা নিহত হয়েছে ঠিক, কিন্তু পাণ্ডবকুলের কোনো প্রথিতযশা বীরকে হত্যা করতে পারেননি ভীষ্ম। এই সময় দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য—এঁরাও যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য পাণ্ডববীরকে যমালয়ে পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরা।

শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের কুটিল বুদ্ধিতে শিখণ্ডীকে সামনে রেখে বাণে বাণে অর্জুন ভীষ্মকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এবং দিনশেষে অর্জুনের বাণাঘাতে শয্যাশায়ী হলেন ভীষ্ম।

কোন অর্জুন ভীষ্মকে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে দিল? যে অর্জুনের প্রতি ভীষ্মের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব ছিল, যে অর্জুনকে কর্ণের বাড়া মনে করতেন, সেই অর্জুনই তাঁকে শরশয্যায় শুইয়ে দিল।

কর্ণ এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল। ভীষ্মের জন্যই তো বিগত দশদিন সে যুদ্ধ করতে পারেনি! আর যুদ্ধ করতে না পারলে কর্ণের জীবন যে বৃথা, সেটা অন্যরা না জানলেও কর্ণ ভালো করেই জানে। তারপরও ভীষ্মের পতনের সংবাদ পেয়ে কর্ণ যারপরনাই ব্যথিত হলো।

গভীর রাতে কুরুক্ষেত্রে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলো কৰ্ণ।

ভীষ্মের তখন চক্ষু মুদিত। অদূরে মশালরা আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে ভীষ্মের মুখচ্ছবি স্পষ্ট।

কর্ণ দুহাত দিয়ে ভীষ্মের পা স্পর্শ করে বলল, ‘পিতামহ আমি রাধেয় কর্ণ। আপনার দুচোখের বিষ, চিরজীবনের শত্রু।’

কর্ণের কথা শোনামাত্রই পক্ককেশের বৃদ্ধ ভীষ্ম তাঁর বলিরেখায় আবৃত চোখ দুটো খুললেন। মাথাটা সামান্য উঁচু করে কর্ণকে দেখলেন। তারপর কাঁপা ডান হাতখানা দিয়ে কর্ণকে কাছে টেনে নিলেন।

বললেন, ‘এসো কর্ণ, এসো। তুমি যতই নিজেকে রাধার ছেলে বলে পরিচয় দাও না কেন, আমি জানি—তুমি কুন্তীর ছেলে। তোমার জন্মবৃত্তান্ত আমার অজানা নয় বাবা।’

তারপর গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন ভীষ্ম। কোমল স্বরে বললেন, ‘বিশ্বাস করো তুমি, আমি কোনোদিন তোমার ওপর বিদ্বেষ পোষণ করিনি।’

হেসে উঠতে গিয়ে নিজেকে সংযত করল কর্ণ। মরতে মরতেও কী অবলীলায় মিথ্যে কথা বলছেন ভীষ্ম! গা রি রি করে উঠল কর্ণের।

তার পরও স্বগত কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘তাই নাকি!’

শুনে ফেললেন পিতামহ, ‘তুমি আমাকে উপহাস করতেই পারো। সেই অধিকার তোমার আছে বৎস। এটা ঠিক যে আমি সবসময় তোমার মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তার কারণ তুমি সর্বদা পাণ্ডবদের নিন্দা করতে। পাণ্ডবনিন্দা আমার মোটেই সহ্য হয় না। আর তুমি কুরুবৃদ্ধদের নিন্দা করে গেছ অবিরাম। বয়স্ক মানুষদের শ্রদ্ধা করতে শেখোনি তুমি। এটার পেছনেও একটা কারণ আছে, আমি জানি। জীবনের প্রথম থেকে হীনজাতের দোহাই দিয়ে মানুষেরা তোমাকে যথাযথ শ্রদ্ধা দেখায়নি। সেই থেকে ওই উঁচুবর্ণের মানুষদের প্রতি প্রচণ্ড একটা ঘৃণা তোমার মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই তুমি আমাকে, দ্রোণাচার্যকে পদে পদে অপমান-অপদস্থ করতে।’ বলতে বলতে হাঁপাতে শুরু করলেন ভীষ্ম।

তা দেখে কর্ণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘থামুন পিতামহ, আর কথা বলবেন না। আপনি কাহিল হয়ে পড়বেন।’

মৃদু একটু হাসলেন ভীষ্ম। বললেন, ‘আর কাহিল হওয়া! এই কারণে কুরুসভায় তোমাকে নানা বাজে কথা বলেছি।’

কর্ণ কিছু না বলে শরশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।

ভীষ্ম কথা বলার শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় বললেন, ‘আমার পরপারে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে কর্ণ। যাওয়ার আগে আমি তোমাকে আমার একান্ত বিশ্বাসের কথা বলে যাই—তুমি অসীম শক্তিশালী একজন বীরযোদ্ধা। তোমার সমকক্ষ শক্তিমান পুরুষ দেবলোকেও নেই। অস্ত্রচালনায় তুমি অর্জুনের সমান। এই স্বল্পপরিসর জীবনে তুমি কতগুলো যুদ্ধ জিতেছ, ভেবে দেখো! তবে একটি কথা বাবা, তোমাকে একটি অনুরোধ করতে চাই আমি।’

ভীষ্মের চোখে চোখ রেখে কর্ণ বলল, ‘কী অনুরোধ?’

ভীষ্ম বললেন, ‘আমার মরার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাতিঘাতী এই যুদ্ধ শেষ হোক কর্ণ। আপন ভাইদের সঙ্গে আর বিসংবাদে জড়িয়ো না। তুমি আপন ভাইদের কাছে পাণ্ডবশিবিরে ফিরে যাও বাবা।’

যাকে চিরশত্রু মনে করতেন, সেই ভীষ্মের মুখে নিজের অস্ত্রনৈপুণ্যের জয়ঘোষণা শুনে কর্ণ ভীষণ খুশি হলো। আবার ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল ভীষ্মের শেষ অনুরোধ শুনে।

এখন তার কি সেই উপায় আছে পাণ্ডবশিবিরে ফিরে যাওয়ার? সদ্যোজাত পুত্রকে কুন্তীমাতার জলে বিসর্জন দেওয়ার কথা, সূত পিতামাতার স্নেহমমতার কথা, দুর্যোধনের বন্ধুত্বের কথা ভীষ্মের এক অনুরোধেই ভুলে যাওয়া যায়? যায় না তো!

কর্ণ বলল, ‘এখন আর সেই পথ খোলা নেই আমার সামনে। আমার গন্তব্য মৃত্যু—জানি আমি। আপনার কথার মর্যাদা দেওয়ার জন্য বিগত দশদিন আমি যুদ্ধ করিনি। এখন কাল থেকে যুদ্ধ করার অনুমতি দিন পিতামহ আমায়।’

ভীষ্ম বুঝলেন, মৃত্যু কর্ণের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। শত অনুরোধেও সে ফিরবে না।

ক্লান্ত বিষণ্ণ কণ্ঠে পিতামহ বললেন, ‘তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হোক বৎস।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *