কৰ্ণ – ২৫

পঁচিশ

কিন্তু অর্জুন রঙ্গভূমিতে অস্ত্রের যে কায়দাকৌশলগুলো দেখিয়েছে, কর্ণ তাদের সব কিছুই করে দেখাল অনায়াসে।

কর্ণের অস্ত্রনিপুণতা দেখে গোটা রঙ্গভূমি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ল। সবাই বেশ কিছুক্ষণ বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে থাকলেন। কথা বলতে বা হর্ষধ্বনি করতেও তাঁরা যেন ভুলে গেলেন। এই অবস্থায় কৌরবভাইদের সবাই একযোগে করতালি দিয়ে উঠল। তাদের দেখাদেখি উপস্থিত সবাই করতালিতে যোগ দিলেন। বিরত থাকলেন পাঁচজন—ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অর্জুন এবং বিদুর।

কর্ণের বাণমুখর জবাব দেখে দুর্যোধন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। নিরানব্বই ভাইয়ের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কর্ণের সামনে এগিয়ে এলো

সবার সামনে কর্ণকে জড়িয়ে ধরে দুর্যোধন বলল, ‘উচিত শিক্ষা দিয়েছ তুমি কর্ণ। অর্জুনকে জানিয়ে দিলে, এই হস্তিনাপুরে সে প্রতিপক্ষহীন নয়। তার সমকক্ষও একজন এই রাজ্যে আছে।’

তারপর কণ্ঠস্বরকে খাটো করে বলল, ‘আর দ্রোণাচার্যের অহংকারের দুর্গ ভেঙেচুরে একাকার করে দিলে আজ তুমি! তুমি আমার অভিবাদন গ্রহণ করো বন্ধু।’

এরপর গলা উঁচিয়ে সবাই শুনতে পায় মতো করে দুর্যোধন বলল, ‘বলো, কী চাই তোমার কর্ণ? কী পেলে তুমি খুশি হবে বন্ধু? যা চাইবে, তা-ই দিতে প্রস্তুতি আমি।’

কর্ণ শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি অন্য কিছু চাই না দুর্যোধন, শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই। আর চাই…।’ বলে থেমে গেল কৰ্ণ।

দুর্যোধন উদ্‌গ্রীব হয়ে বলল, ‘থেমে গেলে কেন? বলো, আর কী চাও তুমি?’

‘আর চাই ওই অর্জুনটার সঙ্গে যুদ্ধ করতে।’ ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে অর্জুনকে দেখাল কর্ণ।

তারপর প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘আমি অর্জুনের সঙ্গে সোজাসুজি লড়তে চাই এবং তা এখনই।’

দুর্যোধন তাড়াতাড়ি বলল, ‘তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তুমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করলে আমার মুখ উজ্জ্বল হবে।’

অদূরে দাঁড়ানো অর্জুন কর্ণ-দুর্যোধনের সকল কথা শুনতে পেল। খুব অপমানবোধ করতে থাকল সে। তার লজ্জা ও রাগ হলো।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অর্জুন কর্ণকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তুমি এই রঙ্গভূমিতে আমন্ত্রিত হওনি কর্ণ। তুমি রবাহূত। তাছাড়া তুমি বাচাল ধরনের। যে বাচাল এবং রবাহূত তার কথার জবাব দিতে রাজি নই আমি।’

কর্ণ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘এটা একটা রঙ্গভূমি। রঙ্গস্থলে সবার আসার অধিকার আছে। আমিও এসেছি তাই। আমার আসা নিয়ে মাথা খারাপ না করে শুধু এইটুকু বলো, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে তুমি সম্মত কিনা?

অর্জুনের ইতস্তততা দেখে কর্ণ আবার গর্জন করে উঠল, ‘এত ভয় পাচ্ছিস কেন অর্জুন? বড় বড় কথা বাদ দিয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হ তুই। তোর গুরুর সামনেই তোর মাথা কেটে মাটিতে নামাব আমি।’

অর্জুন কর্ণের এই অপমান আর সহ্য করতে পারল না। কাতর কণ্ঠে দ্রোণাচার্যের কাছে যুদ্ধ করার অনুমতি চাইল।

দ্রোণাচার্যও কর্ণের দুর্ব্যবহারে জর্জরিত হচ্ছিলেন তখন। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘যুদ্ধ করো বস, ওই দুর্বিনীত কর্ণের অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দাও। অনুমতি নয়, আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি—কর্ণকে ধূলিসাৎ করে দাও।’

দ্রোণাচার্যের কথা শুনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো অর্জুন।

কর্ণও প্রস্তুত।

ওদিকে দর্শকমহলে দুধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। রাজবাড়ির লোকেরা আর্তনাদ করতে শুরু করলেন। তাঁরা বুঝলেন, কর্ণ-অর্জুনে যুদ্ধ হলে তার পরিণতি রক্তারক্তিতে গড়াবে। যেরকম মারমুখী দেখা যাচ্ছে দুই যোদ্ধাকে, মৃত্যুতে গিয়ে না এই যুদ্ধ শেষ হয়!

সাধারণ দর্শকদের কেউ অর্জুনের পক্ষে, কেউ কর্ণের পক্ষে সমর্থন দিতে থাকল। গোটা রঙ্গভূমি কলরোল-হট্টগোলে উন্মত্ত হয়ে উঠল।

এদিকে রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত রাজপ্রাসাদের মানুষেরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। একদিকে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা, অন্যদিকে ভীষ্ম-বিদুর। রমণীরাও দুই বীরের সমর্থনে দুই ভাগ হয়ে গেলেন। রমণীদের মাঝখানে বসা কুন্তী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের পাশ থেকে দ্রুত কুন্তীর দিকে ছুটে গেল। দাসীদের ডেকে বলল, কুন্তীর চোখেমুখে চন্দনজলের ছিটা দিতে। দাসীদের সেবায় অল্পক্ষণের মধ্যে কুন্তীর জ্ঞান ফিরে এলো। তাকিয়ে দেখলেন, তাঁরই গর্ভজ দুই পুত্র অস্ত্রহাতে পরস্পরের মুখোমুখি। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না কুন্তী।

তাঁর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ওরে অর্জুন, কর্ণও আমার ছেলে, আমার গর্ভজ সন্তান সে! সম্পর্কে কর্ণ তোর সহোদর রে অর্জুন! দাদা তোর! নিজের দাদার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াস না পুত্র! আর কর্ণ রে, আজ তুমি ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যার সামনে দাঁড়িয়েছ, সে আর কেউ নয়! সে তোমার অনুজ। তা তুমি জানো না বলে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে যাচ্ছ। অর্জুন যে তোমার সহোদর, জানো না তুমি কর্ণ। আজ আমি জনসমক্ষে বলছি—তুমি আমার সন্তান, প্রথম পার্থ তুমি। তোমাদের দুজনের প্রতি আমার মাথার দিব্যি রইল রে বাপ, তোমরা এই মরণঘাতী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ো না!

কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কিছুই বললেন না কুন্তী। শুধু নিস্পন্দ হয়ে অপলক চোখে কর্ণ-অর্জুনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

হঠাৎ দ্রোণাচার্য আর কৃপাচার্য কানে কানে কিছু একটা বলাবলি করলেন। কৃপাচার্যের চোখ জ্বলে উঠতে দেখা গেল। দুই ব্রাহ্মণ কানে কানে যে কথাটি আদান-প্রদান করলেন, তা অত্যন্ত মারাত্মক। দুই ব্রাহ্মণ একজোট হলেন বর্ণেতর কর্ণকে দলিত মথিত লাঞ্ছিত করবার উদ্দেশ্যে। দ্রোণাচার্য এই হীনতায় সরাসরি অংশগ্রহণ করলেন না, শ্যালক কৃপাচার্যকে প্রণোদিত করলেন কর্ণকে বিধ্বস্ত করতে।

যুদ্ধোন্মুখ কর্ণকে লক্ষ্য করে কৃপাচার্য বললেন, ‘যার সঙ্গে তুমি যুদ্ধ করতে চাইছ কর্ণ, সে অর্জুন, পাণ্ডুপুত্র অর্জুন। তার আরেকটা পরিচয় আছে, সে পার্থ, পৃথা তথা প্রাক্তন মহিষী কুন্তীর সন্তান সে। আমি অর্জুনের পরিচয় সবিস্তারে দিলাম তোমায়। হ্যাঁ, অর্জুন তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে ঠিক, কিন্তু তার আগে তুমি তোমার পরিচয় দাও। কোন বংশে তোমার জন্ম, তোমার মাতৃকুল, পিতৃকুল—এসবের পরিচয় দাও। আমাদের রাজপুত্র অর্জুন তো আর কুলমানহীন সাধারণ কারো সঙ্গে যুদ্ধ করবে না!’

কৃপাচার্য দ্রোণাচার্যের প্ররোচনায় ইচ্ছে করে কর্ণের প্রতি চরম অপমানবাচক শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন। এমন কোনো নিয়ম নেই যে নিজের গোত্রপরিচয় জানিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে! যোদ্ধারা সকল বর্ণ-গোত্র থেকে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে। এমন কোনো শাস্ত্রবাক্য বা শাস্ত্রনির্দেশও নেই, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণের সঙ্গে, ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে, রাজা রাজার সঙ্গে, রাজপুত্র রাজপুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে। অন্য কোনো গোত্র বা বর্ণের মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না।

তবুও কৃপাচার্য বংশপরিচয়ের কথা তুললেন। তুললেন এইজন্য যে কৃপ-দ্রোণ বামুন জাতির মানুষ। বর্ণেতর সম্প্রদায়ের কর্ণকে অপদস্থ করার সুযোগ হারাবেন কেন? তাছাড়া অর্জুন দ্রোণের প্রিয় পাত্র, প্রিয় ছাত্র। সূতপুত্র কর্ণের হাতে অর্জুনের পরাজয় ঘটা তো দ্রোণেরই পরাজয় ঘটা! তাই শ্যালক-ভগ্নিপতি একজোট হয়ে কর্ণ-অপদস্থতায় অবতীর্ণ হলেন। কর্ণকে তার জন্মযন্ত্ৰণা নিয়ে আঘাত করবেন বলে স্থির করলেন কৃপাচার্য।

কৃপাচার্যের কথা শুনে কর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল। এত বড় বীর যে কর্ণ, মুহূর্তেই চুপসে গেল। কৃপের অপমানজনক কথায় কর্ণের মুখটি লজ্জায় অবনত হলো। বড় করুণ, বড় কাহিল, বড় অপ্রস্তুত কর্ণ তখন। তার মুখ দিয়ে একটিও শব্দ বেরোল না। মাথা নিচু করে নিজেকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগল কৰ্ণ।

নিকটেই দাঁড়িয়ে ছিল দুর্যোধন। কর্ণের অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সে। দ্রুত পদক্ষেপে কৃপের কাছে এগিয়ে এলো দুর্যোধন।

যথার্থ বন্ধুর মতন কর্ণের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে কৃপাচার্যকে দুর্যোধন বলল, ‘আপনি বলছেন, কর্ণ রাজা বা রাজপুত্র অথবা ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয় নয় বলে পাণ্ডুপুত্র অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না।’

কৃপাচার্য বিজ্ঞের মস্তকটি নেড়ে বললেন, ‘ঠিক তাই।’

‘আপনার কথামতো কর্ণ রাজা বা রাজপুত্র হলে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারত?

‘যথার্থ বলেছ তুমি দুর্যোধন।’

দুর্যোধন কণ্ঠে ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আচার্য, বলুন তো রাজা কয় প্রকারের হন?

কৃপাচার্য থতমত ভঙ্গিতে বললেন, ‘মানে! তোমার কথা বুঝতে পারছি না দুর্যোধন!

উভয়ের মধ্যে নিম্ন স্বরে কথা হচ্ছিল। কোলাহলের মধ্যে তাঁদের কথোপকথন রঙ্গমঞ্চে উপবিষ্টদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কাছে বারবার জানতে চাইছিলেন ঘটনার গতি-প্রকৃতি। বিদুরও ব্যাপারটা যথাযথভাবে বুঝতে পারছিল না। দর্শকসারিতে বিপুল এক ব্যাকুলতা আর ব্যগ্রতার সৃষ্টি হলো। ঠিক এই সময় দুর্যোধন তার ডান হাতটি দর্শকদের উদ্দেশে উত্তোলন করল। ভঙ্গিতে বোঝাল, আপনারা চুপ করুন। আমাদের কথা শুনুন।

দুর্যোধনের এক ইঙ্গিতে রঙ্গভূমি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

এবার কণ্ঠস্বরকে উঁচুতে তুলে দুর্যোধন বলল, ‘আমি বলছি আচার্য, রাজা কত রকমের হয়!’ একপলক দ্রোণাচার্যকে দেখে নিল দুর্যোধন। কর্ণকে নিয়ে অপমানের যে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছেন কৃপাচার্য, তার পেছনে যে দ্রোণাচার্যই কলকাঠি নেড়েছেন বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি দুর্যোধনের। কৃপাচার্যের প্রতি তার এই যে উত্তর, সেটার উদ্দিষ্ট যে আসলে দ্রোণাচার্য, একপলক চাহনিতে দুর্যোধন বুঝিয়ে দিল।

খাঁকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিল দুর্যোধন। তার পর উদাত্ত কণ্ঠে বলল, ‘তিন রকমের রাজা হয়—যিনি সৎকুলে জাত, যিনি বীর এবং যিনি সৈন্যপরিচালনা করতে পারেন। কর্ণের জন্ম পরিচয়ের কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই না। কারণ তখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে। আপনাদের মতো অনেকেরই জন্ম-ঘটনার সঙ্গে খুব বেশি কৌলীন্যবৃত্তান্ত জড়িয়ে নেই। যাক ওসব কথা। আমি যেটা বলতে চাই, তা হলো—কর্ণ বীরযোদ্ধা। বীরযোদ্ধা রাজার মতো মর্যাদাশীল। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে কর্ণের বাধা কোথায়?’

দুর্যোধনের এত কথার পরও কৃপাচার্যের মধ্যে তেমন ভাবান্তর হলো না। তিনি তো চক্রান্তই করছেন, কর্ণকে কিছুতেই আজ যুদ্ধ করতে দেবেন না। তাই দুর্যোধনের কথা আমলে নিলেন না কৃপাচার্য।

উপরন্তু কৃপাচার্য বললেন, ‘তুমি যা-ই বলো দুর্যোধন, এটা তো সত্য যে কর্ণ রাজা বা রাজপুত্র নয়! তাই তার অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করার অধিকারও নেই।’

দুর্যোধন এবার রোষান্বিত চোখে বললেন, ‘অধিকার নেই, না? দাঁড়ান আমি কর্ণকে সেই অধিকার পাইয়ে দিচ্ছি এই মুহূর্তে।’

দুর্যোধন নিজ কণ্ঠে এবার বন্ধুপ্রেম আর তেজ মেশাল। উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘এই মুহূর্তে কর্ণকে আমি অঙ্গরাজ্যের রাজা বলে ঘোষণা করছি। আজ থেকে কর্ণ কুরুসাম্রাজ্যের অন্তর্গত অঙ্গরাজ্যের রাজা হিসেবে মাননীয় হবে।’

দুর্যোধনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে অকুস্থলে খই, মুকুট, সোনার পিঁড়ি—সব এসে গেল। ব্রাহ্মণরাও যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। মন্ত্রবিদ ব্রাহ্মণরা কর্ণ সমীপে উপস্থিত হলেন। অভিষেকমন্ত্র উচ্চারণ করে কর্ণের মস্তকে রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন তাঁরা।

কৌরবরা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল—জয় মহারাজ কর্ণের জয়।

অতি দ্রুত কর্ণের রাজা হওয়ার ঘটনাটি ঘটে গেল। দর্শকসারিতে বসা ভীষ্ম, বিদুর, গান্ধারী, কুন্তীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা একেবারেই বোবা বনে গেলেন। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন তাঁরা।

কর্ণ ভীষণ অভিভূত হয়ে গেল। দুর্যোধনের হাত দুটো ধরে কৃতজ্ঞতাভরে বলল, ‘রাজ্য দিয়েছ তুমি আমায়, রাজা করেছ! এর বিনিময়ে আমি তোমাকে কী দিতে পারি বন্ধু?’

দুর্যোধন বলল, ‘বিনিময়ে কিছু চাই না আমি। শুধু তোমার বন্ধুত্বটুকু চাই। সারাজীবন বন্ধু হয়ে আমার পাশে পাশে থাকবে তুমি—এই কথাটি দাও শুধু তুমি আমাকে!’

‘তাই হবে বন্ধু। কোনো সংকটে বা প্রলোভনে কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাব না আমি। আজ থেকে আমার এই জীবনটা তোমারই জন্য।’

রঙ্গভূমির মাঝখানে সবার সমক্ষে কর্ণ আর দুর্যোধন পরস্পরকে আলিঙ্গন করল।

ছাব্বিশ

কর্ণ রাজপদে অভিষিক্ত হওয়ার ফলে কর্ণ-অর্জুনে যুদ্ধ হওয়ার আর বাধা রইল না। যুদ্ধ না-করার যে চাল দ্রোণ-কৃপাচার্য মিলে চেলেছিলেন, দুর্যোধনের একসিদ্ধান্তে তা বানচাল হয়ে গেল।

যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো দুজনে। নিশ্বাস বন্ধ করে সবাই এই দুই যোদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই যুদ্ধ অবশ্যই প্রাণঘাতী হবে—ভেবে নিলেন সবাই।

কর্ণ ধনুকে টঙ্কার দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধপ্রায় এক মানুষ। ধুলিধূসরিত দেহ। পথক্লেশে ন্যুব্জ। উত্তরীয় মাটিতে লুটাচ্ছে। ঘেমে-নেয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে কর্ণের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। তিনি আর কেউ নন, কর্ণপিতা অধিরথ

অর্ধপথ অতিক্রম করার পর রথচক্র ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। চাকা ঠিক করতে গেলে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। অত সময় তাঁর হাতে নেই। শুনেছেন—কর্ণ হস্তিনাপুরে। দ্রোণাচার্যের সঙ্গে মতবিরোধের কথা তিনি জানেন; শুনেছেন অর্জুনের সঙ্গেও তার রেষারেষি। তাঁর মন বলছে, কোনো একটা অঘটন ঘটবে আজ রঙ্গভূমিতে। তাই অধিরথ হেঁটে হস্তিনাপুরের দিকে এগোতে শুরু করেছিলেন।

রঙ্গদ্বারে পৌঁছেই শুনলেন—কর্ণ-অর্জুন দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। দ্বাররক্ষীরা বিলক্ষণ চিনত অধিরথকে। সসম্মানে রঙ্গভূমিতে অধিরথকে প্রবেশ করতে দিল তারা। দ্বার অতিক্রম করে মাথা উঁচিয়ে দেখলেন, কর্ণ-অর্জুন মুখোমুখি। উভয়ের হাতে ধনুক। যত দ্রুত সম্ভব শরীরটাকে টানতে টানতে কর্ণের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

পিতা অধিরথকে দেখামাত্র হাতের ধনুকটি ত্যাগ করল কর্ণ। অভিষেকের জলধোয়া মাথাটি অধিরথের পায়ে লুটিয়ে দিল।

রঙ্গভূমিভর্তি এতগুলো মাননীয় মানুষের সামনে পুত্রের সগর্ব প্রণাম পেয়ে অধিরথ হঠাৎ সংকোচ বোধ করতে লাগলেন। তাঁর কেমন যেন লজ্জা করতে লাগল! আচমকা তিনি নিজের পা দুখানি নিজের কাপড়ের খুঁট দিয়ে ঢেকে দিলেন

অধিরথ বলে উঠলেন, ‘থাক বাবা! থাক, থাক!’ বলে বুকের একেবারে নিকটে টেনে নিলেন পুত্রকে। অধিরথের চোখ দিয়ে তখন আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।  

কোণঠাসা হয়ে এতক্ষণ পাণ্ডুপুত্ররা চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কর্ণ-অধিরথের ঘটনাটি দেখে মধ্যম পাণ্ডব ভীম আর চুপ থাকতে পারল না।

ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওরে সারথির বেটা কর্ণ, তুই না রাজপুত্র অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবি বলছিলি? এখন দেখছি, যুদ্ধ করা তো তোর কাজ নয়! তোর কাজ তো দেখছি রথচালনা! তোর বাপও তো তা-ই করে! তুই বরং এক কাজ কর, ধনুক ফেলে তাড়াতাড়ি ঘোড়ার লাগাম ধর গিয়ে।

এই ধরনের অশ্রাব্য কথা কর্ণ বা অধিরথ আগে কখনো শোনেননি। বিশেষ করে পাণ্ডুপুত্রদের মুখ থেকে! আজ ভীমের মুখে এরকম কটুকথা শুনে অধিরথ বোবা হয়ে গেলেন একেবারে। কর্ণ খেই হারিয়ে বসল।

অতটুকু বলে ভীম কিন্তু থেমে যায়নি। সে আরও বলল, ‘এ আবার অঙ্গরাজ্যের রাজা হয়েছে! তোর কি রাজা হওয়ার যোগ্যতা আছে রে কর্ণ? কুত্তা খেতে চায় যজ্ঞের ঘি!’

কর্ণ-অধিরথ চুপ করে থাকলেও দুর্যোধন কিন্তু চুপ করে থাকল না। রোষে-ক্রোধে জ্বলে উঠল।

চোখ পাকিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে উচ্চ কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘এসব বাজে কথা বলো না ভীম। ক্ষত্রিয়ের প্রধান শক্তি তার দেহবল আর মনোবল। চোখ খুলে দেখো, আমাদের কর্ণের মধ্যে এই দুটো সম্পূর্ণরূপে বর্তমান। বলবান পুরুষ এবং নদীর উৎস খুঁজতে যেয়ো না ভীম। তাহলে বিপদে পড়বে।’

ভীম অট্টহাস্য দিয়ে উঠল। বলল, ‘বি-প-দ! কীসের বিপদে পড়ব রে দুর্যোধন? খুলে বলবে একটু!’

দুর্যোধন এতক্ষণ রেখেঢেকে কথা বলতে চাইছিল। ভীমের কথা শুনে রাগ তার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত পৌঁছল। বলল, ‘কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করো না। তাহলে অনেক গুপ্তকাহিনি বেরিয়ে পড়বে। তখন মুখ লুকাবার জায়গা পাবে না তুমি। এই যে দাঁড়িয়ে আছেন আচার্য দ্রোণ আর কৃপ আর ওই যে জগদ্বিখ্যাত বিশ্বামিত্র—এঁদের জন্মবৃত্তান্তে রহস্য আছে। যেমন আছে তোমাদের জন্মবৃত্তান্তে। তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের জন্ম কেমন করে হয়েছে, ভালো করেই জানি আমি। চুপ থাকো ভীম। নিজেদের বগলের নিচটা আগে শুঁকে দেখো। তারপর না হয়, কর্ণ সম্পর্কে জানতে এসো।’

এত কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না ভীম। ভেবেছিল, তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং কটুকথায় কর্ণকে বিব্ৰত করে তুলতে পারলে হতোদ্যম হয়ে পড়বে সে। তাতে সে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াবে। ভাবেনি, মারমুখী ভঙ্গি নিয়ে দুর্যোধন কর্ণের পাশে এসে দাঁড়াবে। দুর্যোধন যে জ্ঞাতিত্ব ভুলে তাদের জন্মকাহিনি নিয়ে এমন কু-ইঙ্গিত করবে, তাও ভাবেনি ভীম। দুর্যোধনের কথা শুনে একেবারে ভেবাচেকা খেয়ে গেল সে!

আর ওদিকে এত কথা বলার পরও দুর্যোধনের দম ফুরাল না, ক্রোধ কমল না।

সক্রোধে দুর্যোধন আবার বলল, ‘চেয়ে দেখো ভীম, কর্ণের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখো— এই রকম সূর্যের আলোককণামাখা যার চেহারা, সোনার বর্ম আর সোনার কুণ্ডল যার জন্ম থেকে গায়ে আঁটা, তার জন্ম কি নীচকুলে হতে পারে? হরিণীর পেটে কি বাঘ জন্মায়? জন্মায় না তো!’

দুর্যোধনের হিংস্র দেহভঙ্গি আর নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে যুধিষ্ঠির দ্রুত ভীমের কাছে এগিয়ে এলো। ভীমের বাহু স্পর্শ করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘আর কথা বাড়িয়ো না ভীম। চলো আমার সঙ্গে।’ বলে নিজের দিকে ভীমকে আকর্ষণ করল যুধিষ্ঠির।

ভীম পেছন ফিরতে যাবে, ওই সময় দুর্যোধন আবার বলে উঠল, ‘শোনো ভীম, শুধু অঙ্গরাজ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীর রাজা হওয়ার যোগ্যতা রাখে কর্ণ।’

তারপর হিসানো কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘অত কথা না বলে এসো না যুদ্ধ করতে। ও হো! তুমি তো কর্ণের সামনে ছুঁচো ছাড়া কিছুই নও। তোমার ভাই অর্জুনকে বলো—তার সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে কর্ণের মোকাবিলা করতে।’

দুর্যোধনের কথা শুনে সমগ্র রঙ্গভূমি যুদ্ধের জন্য পুনরায় উন্মুখ হয়ে উঠল।

ধনুক বাগিয়ে অর্জুন সামনের দিকে অগ্রসর হলো।

কর্ণকে সংযত করার জন্য অধিরথ আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। রঙ্গস্থলে লোকেরা শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকলেন। নারীদর্শকদের মধ্য থেকে হাহাকার ধ্বনি উঠল।

এই হট্টগোলের মধ্যে কেউ খেয়াল করলেন না যে দিনের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দূরদিগন্তে আঁধারের ছোঁয়া লেগে গেছে।

কর্ণ-অর্জুন যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ঠিক ওই সময়ে সূর্যদেব অস্ত গেলেন। রঙ্গভূমিতে আলো ক্ষীণ হয়ে এলো। ক্ষীণ আলো যুদ্ধোপযোগী নয়।

দর্শকসারি থেকে পিতামহ ভীষ্ম ঘোষণা দিলেন, ‘এই যুদ্ধ আর হবে না। দ্বৈতযুদ্ধের জন্য চাই সূর্যের স্পষ্ট আলো। এখন সূর্যদেব অস্ত গিয়েছেন। পৃথিবীর আলো ফুরিয়ে গেছে। তাই এই যুদ্ধ বন্ধ ঘোষণা করছি আমি।’

পিতামহের কথার বিরোধিতা করলেন না কেউ।

এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় লাভ হলো দুর্যোধনের। কর্ণেরও কম লাভ হলো না। সারথিপুত্র থেকে নিমিষেই সে রাজা বনে গেল।

দুর্যোধনের আনন্দের অন্ত থাকল না। কর্ণের হাত ধরে আগে আগে চলতে শুরু করল দুর্যোধন। তাদের পেছনে নিরানব্বইজন কৌরবভ্রাতা। সবার হাতে জ্বলন্ত মশাল, মুখে কর্ণের জয়ধ্বনি।

পাণ্ডবরাও দ্রোণ-কৃপের সঙ্গে রঙ্গালয় থেকে বেরিয়ে নিজের নিজের আলয়ে চলে গেল।

.

হস্তিনাপুরের লোকেদের কেউ অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগল, কেউ-বা কর্ণের। এমনকি কেউ কেউ দুর্যোধনেরও প্রশংসা করতে শুরু করল—দুর্যোধনের মতো বন্ধু জীবনে একজন থাকলেই হয়! দুর্যোধনের মতো অকৃত্রিম এক সুহৃদকে দেখলাম আজ!

আজকের ঘটনায় যুধিষ্ঠিরের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হলো যে কর্ণের মতো বীর বুঝি এই পৃথিবীতে নেই।

এসব কিছুকে অতিক্রম করে অতি অদ্ভুত এক চাপা আনন্দ রঙ্গস্থলে বসেথাকা এক রমণীকে আপ্লুত করল। তিনি কর্ণজননী কুন্তী। নানা কথাবার্তা বলতে বলতেই রাজপ্রাসাদে ফিরছিলেন কুলবতীরা। তাঁদেরই মধ্যে এক কুমারীজননীহৃদয় চাপা আবেগে ভেসে যাচ্ছিল। যাকে নাম ধরে ডাকতে পারেননি, লোকলজ্জার ভয়ে যাকে মাতৃবাৎসল্য থেকে বঞ্চিত করেছেন, তাঁর সেই ছেলে আজ রাজা হয়েছে! বুকের তলায় উত্তুঙ্গ গর্ব আর নিবিড় এক আনন্দ নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন কুন্তী।

কৌরব-পাণ্ডবদের প্রথাগত ছাত্রজীবন শেষ হলো।

ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা প্রাসাদীয় কার্যে জড়িয়ে পড়ল। দুর্যোধন-দুঃশাসন রাজকার্যে মাথা ঘামাতে শুরু করল।

পাণ্ডুপুত্ররাও থেমে থাকল না। বিদুর-ভীষ্মের প্রশ্রয়ে আর সহায়তায় রাজসভা এবং রাজনীতির নানা কর্মকাণ্ডে তারাও অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করল।

রাজা হয়ে কর্ণ পিতা অধিরথকে নিয়ে অঙ্গরাজ্যের সিংহাসনে আরোহণের জন্য ফিরে গেল না। দুর্যোধনের অসামান্য বন্ধুত্বের পরিচয় দেওয়ার জন্য হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে থেকে গেল। বন্ধুর কাছে বিশ্বস্ততা প্রমাণই তখনকার একমাত্র কাজ বলে মনে হলো কর্ণের।

.

এর মধ্যে একদিন দ্রোণাচার্য তাঁর ছাত্রদের কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসলেন। পাঠশালায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন কৌরব-পাণ্ডর সব ছাত্রকে।

তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘প্রিয় শিষ্যরা, তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বিদ্যারম্ভের প্রথমদিন আমি তোমাদের গুরুদক্ষিণার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, বিদ্যাগ্রহণ সমাপ্ত হলে তোমাদের কাছে গুরুদক্ষিণা চাইব।’ অর্জুনের ওপর চোখ রেখে শেষবাক্য বললেন দ্রোণ।

অর্জুন সোৎসাহে বলল, ‘মনে আছে আচার্য।’

‘তোমাদের মনে আছে?’ কৌরবদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন দ্রোণাচার্য।

দুর্যোধনভাইয়েরা সমস্বরে বলল, ‘আমাদের মনে আছে আপনার গুরুদক্ষিণা চাওয়ার কথা।’

‘বেশ। আজ সেই দক্ষিণা চাওয়ার দিন এসে গেছে বৎসরা!’

‘কী সেই গুরুদক্ষিণা? কী দক্ষিণা পেলে আপনি প্রীতিলাভ করবেন গুরুদেব?’ দুর্যোধন জিজ্ঞেস করল।

দ্রোণাচার্য দুই চক্ষু বুজলেন, হয়তো ক্রোধকে আড়াল করবার জন্যই চোখ বুজলেন তিনি, তারপর প্রতিটি শব্দের ওপর জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘পঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দি করে আমার পায়ের কাছে এনে ফেলতে হবে।’

কৌরব-পাণ্ডব নির্বিশেষে সবার মুখ থেকে সম্মতির ধ্বনি উচ্চারিত হলো। সবাই একযোগে বলল, এক্ষুনি রওনা হচ্ছি আমরা। আজকের মধ্যেই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করব।

সবার কণ্ঠকে ছাপিয়ে গেল দুর্যোধনের কণ্ঠস্বর, ‘আমি আমার ভাইদের নিয়ে এখনই পঞ্চালের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি। আমাদের হাতে দ্রুপদের পরাজয় আজ নিশ্চিত।’

ভাইদের নিয়ে অস্ত্রপাঠশালা থেকে বেরিয়ে গেল দুর্যোধন। যে অর্জুন, গুরুদক্ষিণা ঢুকাবে বলে প্রথমদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে অর্জুন আজ একেবারে চুপচাপ থাকল। কৌরবরা বেরিয়ে গেলে পাঁচ ভাই দ্রোণের নিকটে এগিয়ে গেল।

ভক্তিসহকারে প্রণাম করে অর্জুন বলল, ‘আমাকে আশীর্বাদ করুন গুরুদেব, আমরা যেন আপনার বাসনা পূরণ করতে পারি।’

ডান হাতে পৈতে জড়িয়ে দ্রোণাচার্য উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার প্রতি আমার অশেষ আশীর্বাদ রইল বৎস।’

এরপর পাণ্ডবরাও দ্রুপদজয়ে অগ্রসর হলো।

যুদ্ধযাত্রা করবার আগমুহূর্তে দুর্যোধনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কর্ণ।

বলল, ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাব দুর্যোধন।’

‘তুমিও যাবে!’ কিছুটা অবাক হয়ে বলল দুর্যোধন।

এবার দৃঢ় কণ্ঠে কর্ণ বলল, ‘তুমি আমার সুহৃদ দুর্যোধন। যুদ্ধে তোমার পাশে পাশে না থাকলে বন্ধুত্বের মান থাকে বলো!’

‘বলছিলাম কী, তুমি তো আর দ্রোণাচার্যের শিষ্য নও! তোমার তো গুরুদক্ষিণা দেওয়ার দায় নেই! তুমি কেন শুধু শুধু পঞ্চালযুদ্ধে যাবে? দ্রুপদকে আমরাই বন্দি করে আনতে পারব।

‘তা জানি দুর্যোধন। কিন্তু বন্ধুকৃত্য বলে একটা কথা আছে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার প্রতি বন্ধুঋণ শোধ করার সুযোগ দাও দুর্যোধন।’

দুর্যোধন আর না করল না।

পঞ্চালযুদ্ধযাত্রায় কর্ণকেও সঙ্গে নিল।

সাতাশ

পঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দি করে আনার যুদ্ধযাত্রায় কর্ণের অংশগ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। গুরু হিসেবে দ্রোণকে ত্যাগ করেছিল কর্ণ স্বয়ং। ফলে গুরুদক্ষিণা শোধ করবার দায় কর্ণের ছিল না। তারপরও কর্ণ পঞ্চাল-অভিযানে অংশগ্রহণ করল। কারণ দুর্যোধন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কিন্তু এই যুদ্ধযাত্রা কর্ণের জন্য সুখকর হয়নি।

আক্রমণের কথা অনুমান করে দ্রুপদ বহু আগেই সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।

দ্রুপদরাজসভায় অপমানিত হয়ে দ্রোণাচার্য যে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়েছেন এবং কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন—জানতেন রাজা দ্রুপদ। বিদ্যাদান শুরু করবার আগেই যে দ্রোণ ছাত্রদের কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসেছেন, ওই সংবাদও রাজার কানে এসে পৌঁছেছিল। অস্ত্রপরীক্ষার দিনে আমন্ত্রিত হয়ে রঙ্গভূমিতে তাঁর মহামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। মহামন্ত্রী হস্তিনাপুর ত্যাগ করার সময় দুজন গুপ্তচরকে রাজধানীতে রেখে এসেছিলেন। ওরা দ্রোণকে চোখে চোখে রেখেছিল। গুপ্তচরের কাছেই রাজা দ্রুপদ জানতে পারলেন— দ্রোণের গুরুদক্ষিণা চাওয়াটা কী?

সংবাদ পেয়েই দ্রুপদ তাঁর সামরিক বাহিনীকে সতর্ক করলেন।

ওদিকে কৌরবরা বাহবা পাওয়ার লোভে সামান্যসংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করল। উদ্দেশ্য—পাণ্ডবদের আগে গিয়ে রাজা দ্রুপদকে বন্দি করা। কর্ণও কৌরবদের সমভিব্যাহারে চলল।

পঞ্চালরাজ্য আক্রমণ করেই দুর্যোধন বুঝল, মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। দ্রুপদকে সে যত দুর্বল ভেবেছে, দ্রুপদ কিন্তু সামরিকশক্তিতে তত কমজোরি নন। তার উচিত ছিল আরও বহুসংখ্যক কুরুসৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করা। কিন্তু কৌরবরা এখন নিরুপায়। প্রবল বিক্রমে পাঞ্চালদের আক্রমণ করেও তাদের সঙ্গে পেরে উঠল না। কর্ণও আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল। কিন্তু পঞ্চালসৈন্যদের সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারল না তারা।

পরাজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে পাণ্ডবরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে উপস্থিত হলো। অর্জুনের বাণাঘাতে, ভীমের গদার ঘূর্ণিতে এবং নকুল-সহদেবের তুখোড় অসিচালনায় পঞ্চালসৈন্য পিছু হটতে বাধ্য হলো।

অবশেষে পাণ্ডবদের হাতে বন্দি হলেন রাজা দ্রুপদ।

বন্দি দ্রুপদকে দ্রোণাচার্যের পায়ের কাছে এনে ফেলল অর্জুন। অনেক তিরস্কারের পর অর্ধেক রাজ্য দ্রুপদের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন দ্ৰোণ।

বন্ধুকে প্রাণভিক্ষা দিয়ে রাজধানীতে পাঠিয়ে দিলেন।

হস্তিনাপুরের চারদিকে অর্জুনের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল।

প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে অর্জুনের কাছে প্রথম হার হলো কর্ণের। এই হার কর্ণকে আরও পাণ্ডববিরোধী করে তুলল। পাণ্ডববিরোধিতার কারণেই কর্ণ হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির দৈনন্দিন রাজনীতির সঙ্গে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ল।

দুর্যোধন প্রতিনিয়ত চিন্তা করে যাচ্ছে কী করে জ্ঞাতিভাই পাণ্ডবদের শায়েস্তা করা যায়? কর্ণ ও দুর্যোধনের সঙ্গে থাকতে থাকতে দুর্যোধনভাবনায় প্রভাবিত হতে থাকল। দুর্যোধনের মতো একটা সময়ে তারও চিন্তার একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়াল পাণ্ডবদের দলিত-মথিত করা।

অস্ত্রপরীক্ষার এক বছর পরে হস্তিনাপুরের যুবরাজ সম্পর্কে কথা উঠল।

রাজসভায় এই প্রসঙ্গের অবতারণা করল বিদুর।

বলল, ‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কুরুসাম্রাজ্যের অধিপতি। ভারপ্রাপ্ত হলেও তিনি আজ এই রাজ্যের নৃপতি—এ বিষয়ে কারো মতপার্থক্য নেই। আমার কথা মহারাজের রাজ্যশাসন ক্ষমতা নিয়ে নয়। আমি অন্য একটি প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই আজ।’

ধৃতরাষ্ট্র উৎকর্ণ হলেন। দাসীপুত্র হলেও এই ভাইটিকে বড় ভালোবাসেন মহারাজ। রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। রাজকীয় সিদ্ধান্তে বিদুরের কথাকে বেশ দাম দেন তিনি। ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিও বিদুরের অচলা ভক্তি—বিশ্বাস করেন ধৃতরাষ্ট্র।

কিন্তু বিদুরের বর্তমানের কিছু কর্মকাণ্ডে মহারাজার সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। পাণ্ডবদের প্রতি বিদুরের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব ধৃতরাষ্ট্রের চোখ এড়াচ্ছে না। ইদানীং পাণ্ডবদের স্বার্থ নিয়েই বিদুর রাজসভায় কথা বলতে শুরু করেছে। বিদুরের আজকের প্রসঙ্গটাও ওই রকমের কিছু কি? উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকলেন মহারাজ।

বিদুর আবার বলতে শুরু করল, ‘আমার কথা যুবরাজ পদটি নিয়ে। মহারাজ পাণ্ডু পরলোকে গেছেন, জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য চালাচ্ছেন—ঠিক আছে। কিন্তু এই হস্তিনাপুরে দীর্ঘদিন যুবরাজের পদটি খালি পড়ে আছে। আমাদের রাজকুমাররা বড় হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে একজনকে যুবরাজ হিসেবে বেছে নেওয়ার সময় হয়েছে মহারাজ।’

‘তা তুমি কার নাম প্রস্তাব করছ?’ ধৃতরাষ্ট্র ভেবে নিয়েছেন, তিনি যেহেতু হস্তিনাপুরের রাজা, যুবরাজ হিসেবে বিদুর অবশ্যই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনের নাম প্রস্তাব করবে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হলো না।

ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে অনতিদূরে বসা পিতামহ ভীষ্ম বলে উঠলেন, ‘আমি প্রস্তাব করছি যুবরাজের নাম। যুধিষ্ঠিরই হোক কুরুরাজ্যের যুবরাজ। তার পিতা হস্তিনাধিপতি ছিল, উত্তরাধিকারের সূত্রে যুধিষ্ঠিরেরই যুবরাজ হওয়ার অধিকার।’

ধৃতরাষ্ট্রের অক্ষিগোলক বেরিয়ে আসবার উপক্রম হলো। দুই হাত দিয়ে সিংহাসনের হাতল চেপে ধরে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন মহারাজ।

তিনি কিছু বলবার আগেই রাজসভার অধিকাংশ মন্ত্রী-অমাত্য-উপদেষ্টা ভীষ্মের প্রস্তাবকে উচ্চ কণ্ঠে সমর্থন জানিয়ে বসলেন।

শেষ পর্যন্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করলেন।

এই নিয়ে রাজপ্রাসাদে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠল। দুর্যোধন যুবরাজ হিসেবে যুধিষ্ঠিরকে মানতে নারাজ। কর্ণ আর শকুনি দুর্যোধনকে ইন্ধন দিয়ে যেতে লাগল। অনেকদিন আগেই গান্ধারীভ্রাতা শকুনি রাজপ্রাসাদে এসেছিল। ভাগ্নেরা বড় হয়ে ওঠার পর শকুনিমামা দুর্যোধনের দোসর হয়ে উঠল।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাজপ্রাসাদে দুটো ভাগ স্পষ্ট হয়ে উঠল—পাণ্ডবপক্ষ এবং দুর্যোধনপক্ষ।

যুধিষ্ঠির যুবরাজ হওয়ার পর দ্রোণাচার্যকে রাজসভায় উচ্চাসন দেওয়া হলো। ভীষ্ম নিজের পাশের আসনটা দ্রোণাচার্যের জন্য নির্ধারণ করে দিলেন। দ্রোণ গদগদ হয়ে অর্জুনকে মারাত্মক ব্রহ্মশির অস্ত্র দিয়ে দিলেন। এতে কৌরবরা আরও ক্রুব্ধ হয়ে উঠল। ইত্যবসরে যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতিনিধি হয়ে অর্জুন দেশজয়ে বেরোল। অর্জুন এমন কতকগুলো রাজ্য জয় করে হস্তিনাপুরে ফিরে এলো, যে দেশগুলো তার পিতা পাণ্ডুও জয় করতে পারেননি। সবাই ধন্য ধন্য করতে আরম্ভ করল। দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে কঠিন এক চক্রান্ত শুরু করল। জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল দুর্যোধন। পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করিয়ে কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডবকে বারণাবতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করে ফেলল। ওখানেই দাহ্য পদার্থ দিয়ে ‘জতুগৃহ’ নামের আবাসস্থলটি তৈরি করা হয়েছে।

দুর্যোধনের এসব হীন চক্রান্ত কর্ণের মোটেই পছন্দ নয়। কিন্তু বন্ধুত্বের এক দায় হলো যে বন্ধুর অপকর্মেও সমর্থন দেওয়া! কর্ণও তা-ই করল। দুর্যোধনের কূটচক্রান্তগুলোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিল কর্ণ।

বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চক্রান্তটি বিদুরের বিচক্ষণতায় ব্যর্থ হয়ে গেল। পাণ্ডবদের গায়ে আগুনের আঁচ লাগল না, কিন্তু উলটো জতুগৃহের আগুনের হলকা হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে এসে লাগল। এতে দুর্যোধনরা যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো কৰ্ণ।

জতুগৃহের আগুন থেকে রক্ষা পেয়ে পাণ্ডবরা কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো ছদ্মবেশ ধারণ করে এ-গ্রামে ও-গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। তাঁদের ভীষণ কষ্টের জীবন তখন।

এদিকে দুর্যোধনদের ধারণা, পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে পুড়ে মরেছে। তাদের জীবনে স্বস্তি ফিরে এলো। ঠিক এই সময়ে একটি স্বয়ংম্বরসভার কথা দুর্যোধনের কানে এলো।

কলিঙ্গদেশের রাজা চিত্রাঙ্গদ। তাঁর যুবতিকন্যা ভানুমতী অত্যন্ত রূপসী। তার রূপলাবণ্যের কথা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যান্যের মতো দুর্যোধনও শুনতে পেয়েছিল ভানুমতীর রূপযৌবনের কথা। পাণ্ডুপুত্রদের নিয়ে দুর্যোধন মহাব্যস্ত তখন। প্রাসাদীয় জটিলতা কমে এলে দুর্যোধন ভানুমতীর স্বয়ংবরসভার কথা জানতে পারল। ভানুমতীকে পাওয়ার জন্য দুর্যোধন আগ্রহী হয়ে উঠল। কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ংবরসভায় যোগ দিল দুর্যোধন।

কলিঙ্গের রাজধানী রাজপুর তখন নানা সাজে সজ্জিত। স্বয়ংবরসভার চাকচিক্য সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। নানা দেশের রাজা এবং রাজপুত্ররা স্বয়ংবরসভায় সমবেত হয়েছে। সবাই ভানুমতীকে পেতে চায়। কিন্তু বর নির্বাচনের অধিকার একমাত্র ভানুমতীর হাতে।

নির্ধারিত সময়ে কলিঙ্গরাজকন্যা অনিন্দ্যসুন্দরী ভানুমতী স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হলো। রাজকন্যার সঙ্গে ধাত্রী। হাতে বরণমালা নিয়ে ভানুমতী ধীর পায়ে অগ্রসর হতে লাগল। ধাত্রী একে একে উপস্থিত রাজা আর রাজপুত্রদের পরিচয় রাজকন্যার সামনে তুলে ধরতে লাগল।

কাউকে রাজকন্যার মনে ধরছে না। একে একে সবাইকে অতিক্রম করে যেতে লাগল ভানুমতী।

তৃতীয় সারির মধ্যিখানের দুটি আসনে পাশাপাশি বসে আছে দুর্যোধন এবং কর্ণ। ভানুমতীকে প্রথম দর্শনেই খুব পছন্দ হয়েছিল দুর্যোধনের। তার বিশ্বাস, কাছ থেকে দেখে অবশ্যই তাকে পছন্দ করে বসবে ভানুমতী। দুর্যোধনের চোখমুখ দেখে কর্ণের বুঝতে বাকি নেই, দুর্যোধন ভানুমতীকে স্ত্রী হিসেবে পেতে চায়।

কিন্তু বিধি বাম। দুর্যোধন ভানুমতীর চোখে লাগল না। অন্য রাজা-রাজকুমারদের মতো দুর্যোধনকেও অতিক্রম করে গেল ভানুমতী।

অসহনীয় মনোব্যথায় কঁকিয়ে উঠল দুর্যোধন। দীর্ঘ একটা শ্বাস তার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো। বন্ধুর হাহাকারময় দীর্ঘশ্বাস কর্ণকে বিচলিত করে তুলল। সে তখন তখনই সিদ্ধান্ত নিল—ভানুমতীকে দুর্যোধনকে পাইয়ে দিতে হবে।

কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা কণ্ঠে দুর্যোধনকে কর্ণ বলল, ‘তুমি ভানুমতীর হাত পাকড়ে রথের দিকে এগিয়ে যাও। এদিকটা আমি দেখছি।’

ইতস্তত কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘স্বয়ংবরসভায় বড় বড় যোদ্ধা, রাজা আর রাজপুত্ররা উপস্থিত। আমি ভানুমতীর ওপর জোর খাটাতে গেলে ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে একযোগে আক্রমণ করে বসবে। সবাইকে তুমি একা সামাল দিতে পারবে?’

তার শক্তি সম্পর্কে দুর্যোধনের ধারণা দেখে কর্ণ মর্মাহত হলো। কিন্তু দুর্যোধনকে দেখাল না তা। শুধু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘যা বলছি, তা-ই করো। এবং তা এখনই। পরের ব্যাপারটা আমি দেখছি। ও হ্যাঁ, ভানুমতীকে নিয়ে সরাসরি রথে চড়ে বসবে। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে অপেক্ষা করবে। আমার জন্য মোটেই ভাববে না তুমি।’

তারপর অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা এখনো স্পষ্ট হয়নি দুর্যোধন! আমি যে কী, তা আজ তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’

দুর্যোধন আর বিলম্ব করল না। ঝট করে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ভানুমতীর হাত আঁকড়ে ধরল। হাত থেকে বরণমালাটি পড়ে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করল না দুর্যোধন। ভানুমতীকে হরণ করে নিজরথে নিয়ে তুলল। সারথিকে নির্দেশ দিল, রথকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাও।

উপস্থিত রাজা-রাজপুত্ররা দুর্যোধনকে পেল না। কিন্তু কর্ণকে পেয়ে গেল। ওরা আগেই খেয়াল করেছে—কর্ণ দুর্যোধনের সঙ্গে এসেছে। ওরা জোটবদ্ধ হয়ে কর্ণকে আক্রমণ করে বসল। কিন্তু ওরা তো কর্ণের অস্ত্রপারঙ্গমতার কথা জানে না! ধরে নিয়েছে, দুর্যোধনের মোসাহেব ধরনের কিছু একটা হবে এই যুবকটি!

কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে কর্ণ প্রমাণ করে দিল, সে অস্ত্রবিশারদ মহাবীর। বাণে বাণে সবাইকে ছারখার করে দিল কর্ণ। কিছুক্ষণের মধ্যে পেছন হটতে বাধ্য হলো ভানুমতী-আকাঙ্ক্ষী রাজা- রাজপুত্ররা।

দুর্যোধন ভানুমতীকে নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরল। রাজপ্রাসাদে সাদরে গৃহীত হলো ভানুমতী। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সাড়ম্বরে দুর্যোধনের বিবাহকার্য সম্পন্ন করলেন।

কলিঙ্গরাজকন্যার স্বয়ংবরসভায় কর্ণের পরাক্রমের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল।

মগধরাজ জরাসন্ধের কানে কর্ণের বিক্রমের কথা পৌঁছলে তিনি উত্তেজিত হলেন। তিনি মনে করেন, তাঁর মতো যোদ্ধা ভূ-ভারতে নেই। তিনি কর্ণকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন।

দীর্ঘ দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর কর্ণের কাছে পরাজিত হলেন জরাসন্ধ। এতে কর্ণের বীরত্বের কথা হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে দূরের রাজ্যগুলোতে বিস্তৃত হলো।

ক্ষত্রিয়সমাজে যোদ্ধা হিসেবে কর্ণের গুরুত্ব ও সমাদর অনেকখানি বেড়ে গেল।

আটাশ

কর্ণ জীবনে কখনো ছলনাকে প্রশ্রয় দেয়নি। তার ভাবনা স্পষ্ট, সিদ্ধান্ত দৃঢ়।

জন্মমুহূর্তে মায়ের বঞ্চনা, তারুণ্যে অস্ত্রগুরুর হীনম্ম্যতা আর অভিশাপ এবং যৌবনে ভীষ্ম- দ্রোণ-কৃপ-বিদুরের মতো কুরু-উপদেষ্টাদের প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে কর্ণের জীবন অতিবাহিত হয়েছে। ইন্দ্রের মতো দেবতা তাকে বঞ্চনা করছেন জেনেও সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকেছে কর্ণ। এই সত্যনিষ্ঠার কারণেই কর্ণ নিজেকে সূতপুত্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। সগর্বে উচ্চারণ করেছে—আমি অধিরথপুত্র রাধেয়। অধিরথপত্নী রাধা জলে-বিসর্জিত কর্ণকে নিজের সন্তানের মর্যাদা দিয়েছেন। এই ভালোবাসার সম্মান কর্ণ সারাজীবন দিয়ে গেছে। অস্ত্রপরীক্ষার রঙ্গমঙ্গে অধিরথের ধুলিমাখা পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পিতা অধিথকে প্রণাম করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি কর্ণ। নিজেকে সর্বদা ‘রাধেয়’ বলে পরিচয় দিয়ে মাতৃমর্যাদাকে সর্বোচ্চে তুলে ধরেছে।

কর্ণ নামের এই বীরযোদ্ধা শুধু সারথির ঘরে লালিতপালিত হওয়ার অপরাধে বর্ণেতর বলে পদে পদে লাঞ্ছিত হয়েছে। তার পৌরুষ, তার আত্মসম্মান বারবার দলিত হয়েছে। এই বঞ্চনা- লাঞ্ছনা-দলন শুধু হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে সীমাবদ্ধ থাকেনি। হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের নানা দেশে বিস্তৃত হয়েছে। নইলে কেন স্বয়ংবরসভায় দাঁড়িয়ে দ্রৌপদী উচ্চারণ করে—নাহং বরয়ামি সূতম্। আমি কিন্তু সূতপুত্রকে বরণ করব না।

.

অনেকটাই অজ্ঞাতবাসের জীবন চলছে তখন পাণ্ডবদের। মাকে নিয়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণবেশে দ্রুপদরাজ্যেরই একটা গ্রামে বসবাস করছে যুধিষ্ঠিররা। ভিক্ষান্নে জীবন চলে। সকালে পাঁচ ভাই বেরিয়ে পড়ে, ভিক্ষা করে যা পায়, তা নিয়ে অপরাহ্ণের দিকে বাড়ি ফেরে। মা কুন্তী রান্না করে অন্ন-ব্যঞ্জন পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেন, নিজে খান।

এই-ই জীবন যখন পাণ্ডবদের, যুধিষ্ঠির একদিন শুনতে পেলেন, দ্রুপদপ্রাসাদে স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হয়েছে। ওই স্বয়ংবরসভায় দ্রুপদকন্যা দ্রৌপদী তার পছন্দমতো স্বামী বেছে নেবে। যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত নিল—ভাইদের নিয়ে ওই স্বয়ংবরসভায় যাবে।

রাজা দ্রুপদের গোপন ইচ্ছা—তাঁর মেয়ে অর্জুনকেই বর হিসেবে বরণ করুক। যদিও তিনি শুনেছেন, বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবরা পুড়ে মরেছে। তার পরও দ্রুপদের মনে কেন জানি একটা সংশয় ছিল। তাঁর মন বারবার বলত—পাণ্ডুপুত্রদের পুড়ে মরার ঘটনাটি সত্য নয়। পাণ্ডবরা মরেনি। অর্জুনরা কোথাও না কোথাও বেঁচে আছে।

ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের পারদর্শিতার কথা তিনি শুনেছেন এবং দেখেছেনও। তাঁকে বন্দি করে দ্রোণাচার্যের পায়ের কাছে ছুড়ে ফেলার অপমানের কথা দ্রুপদ তো ভুলে যাননি! দ্রোণের সামনে হাঁটুগেড়ে বসা অবস্থাতেই দ্রুপদ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবেন তিনি। ভবিষ্যতে কোনোদিন যদি হাতে সুযোগ আসে, তাহলে এই অর্জুনকে দিয়েই মূলোৎপাটন করবেন দ্রোণের। সেই প্রতিজ্ঞা দীর্ঘদিন মনের মধ্যে পোষণ করে যাচ্ছেন দ্রুপদ।

এইদিকে মেয়ে দ্রৌপদী বিবাহ-উপযুক্ত হয়ে উঠল। প্রথা মেনে স্বয়ংবরসভারও আয়োজন করলেন দ্রুপদ। মনে মনে আশা করে থাকলেন, এই বরণসভায় অর্জুন দ্রৌপদীপ্রার্থী হয়ে আসবে, দ্রৌপদী তার গলায় বরণমালা পরাবে। অর্জুন তাঁর জামাতা হবে এবং এই অর্জুনকে দিয়ে দ্রোণের অপমানের প্রতিশোধ নেবেন।

দ্রুপদ জানতেন, অর্জুন মহাধনুর্ধর। সকল প্রকার ধনুকবিদ্যা তার করতলগত। তীর-ধনুক সম্পর্কিত সমস্ত জটিলতা সে নিমিষেই অতিক্রম করতে সক্ষম। এই কথা মাথায় রেখে দ্রুপদ একটা কৌশল অবলম্বন করলেন।

একটি বেদি তৈরি করালেন। বেদির বেশ ওপরে যন্ত্রের মধ্যে একটি মৎস্য সংরক্ষণ করলেন। যন্ত্রে এমন একটা ছিদ্র রাখলেন, যেটার মধ্য দিয়ে একটা তীর কোনোরকমে অতিক্রম করতে পারবে। খুব পারঙ্গম তীরন্দাজ না হলে ওই ছিদ্রপথ দিয়ে মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করতে পারবে না কেউ।

রাজা ঘোষণা করলেন, বেদিতে দাঁড়িয়ে যে ওই যন্ত্রস্থিত মৎস্যচক্ষু তীরবিদ্ধ করতে পারবে, তাকেই আমার কন্যা স্বামী হিসেবে বরণ করবে। রাজা দ্রুপদের বদ্ধমূল ধারণা—যদি কেউ এই কাজ করতে পারে, তাহলে অর্জুনই পারবে শুধু। আরও একটা কাজ করেছিলেন দ্রুপদ, যে ধনুকটি দিয়ে মৎস্যচক্ষু তীরবিদ্ধ করতে হবে, সেই ধনুকটি এমন ভারী করে নির্মাণ করালেন, যাতে সাধারণমানের রাজা-যুবরাজরা তুলতেও না পারে।

দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় নানা দেশ থেকে বড় বড় রাজা-রাজপুত্ররা এলো। নিরানব্বইজন ভাইকে নিয়ে দুর্যোধনও উপস্থিত হলো। কর্ণও গেল। ব্রাহ্মণবেশে সাধারণের মধ্যে পাণ্ডবরা বসে থাকল।

ওই স্বয়ংবরসভায় আরেকজন এসেছিল। সে কৃষ্ণ। কুন্তীভ্রাতা বসুদেবের পুত্র কৃষ্ণ। না, দ্রৌপদীর পাণিপ্রার্থী হয়ে কৃষ্ণ ওখানে উপস্থিত হয়নি। উপস্থিত থেকেছে দ্রুপদের কাছ থেকে সম্মানিত অতিথির নিমন্ত্রণ পেয়ে।

স্বয়ংবরা দ্রৌপদ বরণমাল্য নিয়ে সভার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তিনভুবনের সেরা সুন্দরী দ্রৌপদী। গায়ের রং কালো বটে, কিন্তু সেই কালোরও যে একটা বিশেষ রূপ আর লাবণ্য আছে, দ্রৌপদীকে দেখেই অনুধাবন করা যায়। বিদগ্ধতায় আর ব্যক্তিত্বে দ্রৌপদী সব রমণীর ওপরে।

বোনের পাশে পঞ্চালরাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন।

সে মহারাজ দ্রুপদের কথাই সর্বসমক্ষে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করল, ‘যে ওই বেদিতে রাখা ধনুক দিয়ে যন্ত্রের মধ্যকার মাছের চোখ বিদ্ধ করতে পারবে, সে হবে আমার বোন দ্রৌপদীর স্বামী। আমার বোন তার গলাতে বরণমালা পরাবে।’

ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা শুনে উপস্থিত সবাই নড়েচড়ে বসল। যারা কমজোরি ধনুর্ধর, তারা ঢোক গিলল। ধৃষ্টদ্যুম্ন আবার বলল, ‘আগের কথায় একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। তা হলো প্রতিদ্বন্দ্বীকে অবশ্যই কুলীন, রূপবান এবং বীর্যবান হতে হবে।’

ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা শুনে কর্ণ বিচলিত হলো। দ্রৌপদীকে দেখে তার খুব ভালো লেগে গেছে। মনে মনে বাসনা করে আছে দ্রৌপদীকে সে বিয়ে করবে। রাজা দ্রুপদ যে-যন্ত্রকৌশল তৈরি করেছেন, তা সে হেলায় অতিক্রম করতে পারবে। তার দ্রৌপদীকে পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। হঠাৎ ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘোষণা কর্ণের কানে এসে ধাক্কা দিল। এখানেও জন্মকুলীনতার কথা! মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরের অস্থিরতা বের করে দিল কর্ণ। এই সময় তার ভাবতে ভালো লাগল—ধৃষ্টদ্যুম্নের সাজানো বক্তৃতার মধ্যে কুলের কথাটা অভ্যাসবশেই এসেছে নিশ্চয়।

বড়-ছোট রাজাদের পরিচয় দিতে গিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন উপস্থিত সবার নাম উচ্চারণ করল। কিন্তু কর্ণের নাম উচ্চারণ করল না। কর্ণ অঙ্গরাজ্যের রাজা জেনেও কর্ণের প্রতি অবহেলা দেখাল ধৃষ্টদ্যুম্ন। এরপর রাজকুমারদের নাম বলতে গিয়ে দুর্যোধন, দুঃশাসন এমনকি বিকর্ণ, দুর্বিষহ, দুর্মুখ নামে ধৃতরাষ্ট্রের গৌণপুত্রদের নামও বলল।

শেষের দিকে ধৃষ্টদ্যুম্ন শুধু বলল, ‘ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের সঙ্গে কর্ণও এসেছে।’

ধৃষ্টদ্যুম্নের আচরণ কর্ণকে অবাক করে ছাড়ল। সে ভেবে কূল পেল না, ধৃষ্টদ্যুম্নের এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কী? সে কি ইচ্ছে করেই তাকে অবহেলা দেখাচ্ছে?

ভেতরে ভেতরে বেশ উষ্ণ হয়ে উঠল কর্ণ। আপনমনে গর্জে উঠল, ‘তীর ছোড়ার সময় উপস্থিত বীরদের মুরোদ বোঝা যাবে।’

ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা শেষ হওয়ার পর রূপে, ক্ষমতায়, কুলগর্বে এবং যৌবনে যারা বলীয়ান, তারা সবাই একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু নিয়মানুসারে একের পর এক প্রার্থীকে মৎস্যবেদিতে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমে গেলও সবাই। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই লক্ষ্যভেদ তো দূরের কথা, ধনুকটি তুলতে গিয়ে বেদিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। যে দু-চারজন ধনুক তুলতে পারল, ধনুকে তীর যোজনা করতে ব্যর্থ হলো। এক-দুই জন তীর ছুড়লেও সেই তীর যন্ত্রের দিক না গিয়ে ভিন্ন দিকে চলে গেল।

দ্রৌপদী-প্রার্থীদের কাণ্ড দেখে না হেসে পারল না কর্ণ। বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বেদির দিকে বীরদর্পে কর্ণ এগিয়ে গেল। বাঁ হাতে দ্রুপদের তৈরি করা ভীষণভারী ধনুকটি তুলে নিল। না, অন্যান্য বীরের মতো ধনুকটি তুলতে কর্ণের গলার হারটি খসে পড়ল না, শিথিল হলো না কাঁকন।

কর্ণ ধনুক তুলল এক মুহূর্তে, উদ্যত ধনুকে গুণ পরাল সঙ্গে সঙ্গে এবং তাতে লক্ষ্যভেদী বাণ জুড়ল নিমিষে।

কর্ণের এই তৎপরতা দেখে ব্যর্থ রাজা-রাজকুমাররা ভাবল–কর্ণের দৌড় ওই পর্যন্তই! আর যা-ই করতে পারুক কর্ণ, মৎস্যচক্ষু বিঁধতে পারবে না।

সাধারণের মধ্যে দরিদ্র ব্রাহ্মণবেশে বসে থাকা জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ল। কর্ণকে চিনেছে সে। এবং সে জানে, যন্ত্রের মধ্য দিয়ে মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করা কর্ণের জন্য সামান্য একটা ব্যাপার। এখনই চোখের পলকে কাজটি করে দেখাবে কর্ণ। তার বুঝি আর দ্রৌপদীকে পাওয়া হলো না!

কর্ণের পারঙ্গমতা দেখে দ্রৌপদী দ্রুত ভেবে গেল—আগুনে জন্মনেওয়া তার মতো তেজি নারীটিকে শেষ পর্যন্ত কুলমানহীন সূতপুত্রকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিতে হবে? নীচজাতের কর্ণের গলায় মালা পরিয়ে সে কি সমাজে অবনমিত হবে?

‘না, কিছুতেই না।’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল দ্রৌপদী।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ধৃষ্টদ্যুম্ন ভেবাচেকা মুখে দ্রৌপদীর দিকে তাকাল।

চাপা গলায় বলল, ‘কী হয়েছে দ্রৌপদী! তুমি এরকম করে উঠলে কেন?

দ্রৌপদী দাদার প্রশ্নের উত্তর দিল না। গলা ফাটিয়ে সে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আমি সূতপুত্ৰ কর্ণকে কিছুতেই স্বামী হিসেবে বরণ করব না।’

চকিত চমকে দ্রৌপদীর দিকে ফিরে তাকাল কর্ণ। ক্রোধে তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। অপমানে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ক্রোধকে ছাপিয়ে তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। এ হাসি নিয়তির বিরুদ্ধে, এ হাসি দ্রৌপদীর বর্ণগরিমার বিরুদ্ধে।

তারপর সূর্যের দিকে পূর্ণ চোখে তাকাল কর্ণ। এর পর হাতের ধনুকটি দূরে ছুড়ে ফেলে দিল।

মাথা নিচু করে দ্রৌপদী-প্রত্যাখ্যাত কর্ণ উঁচু বেদিটি থেকে নেমে এলো।

কর্ণের জীবনে যে বিকার এবং আচরণে যে পরস্পরবিরোধিতা তার মূলে আছে দুটি নারীর প্রত্যাখ্যান-তাচ্ছিল্য। সেই দুটি নারীর প্রথমজন কুন্তী, দ্বিতীয়জন দ্রৌপদী। কুন্তী জন্মলগ্নেই কর্ণের সঙ্গে তাঁর পুত্রসম্বন্ধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্রৌপদী কর্ণের পুরুষযোগ্যতা প্রত্যাখ্যান করেছে।

কুন্তীর পুত্রত্ব-অস্বীকারের জ্বালা সূতজননীর স্নেহপ্রলেপে কর্ণ কিছুটা ভুলেছিল, কিন্তু দ্রৌপদীর অবহেলা কর্ণ কিছুতেই ভুলতে পারেনি কোনোদিন। দ্রৌপদীর কুলমানজনিত অপমান কর্ণের মনে সারাজীবন ক্রোধ উদ্‌গিরণ করে গেছে।

দ্রৌপদীর এই অস্বীকারে স্বয়ংবরসভা ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলো।

ধৃষ্টদ্যুম্ন পিতার সঙ্গে পরামর্শ করে ঘোষণা করল, ‘যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমার বোন কর্ণকে অস্বীকার করল। অস্বীকার না করেই-বা কী করবে দ্রৌপদী? একজন ক্ষত্রিয়রাজকন্যা হয়ে তো আর সারথিপুত্রকে বিয়ে করতে পারে না! যাক সেকথা, এখন আমি নতুন করে একটি ঘোষণা দিতে যাচ্ছি। তা হলো—ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, ব্রাহ্মণরাও দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে অংশ নিতে পারবেন। উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মধ্য থেকেও কেউ যদি মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করতে পারে, তাহলে দ্রৌপদী তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেবে।’

উপস্থিত সাধারণের মধ্যে বড় একটা কোলাহল তৈরি হয়ে গেল।

এই হট্টগোলের মধ্যে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বলল, ‘যাও অর্জুন, দ্রৌপদীকে জিতে নাও।’

অর্জুন চাপা কণ্ঠে বলল, ‘তা কী করে হয় দাদা! দেখছেন না, দুর্যোধন তার ভাইদের নিয়ে উপস্থিত, কর্ণ তার পাশে বসা? আমাদের পরিচয় পেলে ছারখার করে ছাড়বে!’

যুধিষ্ঠির নির্দেশের সুরে বলল, ‘যা বলছি, তাই করো অর্জুন। বাগবিতণ্ডা করার সময় এটা নয়। আগে মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ কর। পরেরটা আমি দেখব।’

অর্জুন আর দ্বিরুক্তি করল না। সামনে এগিয়ে গেল ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন।

অনায়াসে মৎস্যচক্ষু তীরবিদ্ধ করল।

দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় মালা পরাতে যাবে, ঠিক ওই সময় ধুন্ধমার যুদ্ধ লেগে গেল। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনের সঙ্গে কর্ণেরও যুদ্ধ হলো। অর্জুন চিনলেও কর্ণ কিন্তু শ্মশ্রুমণ্ডিত অর্জুনকে চিনতে পারল না।

অর্জুনকে লক্ষ্য করে কর্ণ বলল, ‘ব্রাহ্মণ, যুদ্ধে তোমার নৈপুণ্য দেখে আমি মুগ্ধ। দেবরাজ ইন্দ্ৰ আর অর্জুনই শুধু তোমার মতো যুদ্ধ করার সক্ষমতা রাখেন। তুমি কে হে বাপু! পরশুরাম নয়তো?’

অর্জুন বলে উঠেছিল, ‘আমি পরশুরামও নই বা অন্য কেউই নই। আমি সাধারণ একজন ব্রাহ্মণ। আজ তুমি ক্ষান্ত হও বীর। যুদ্ধ থামাও।’

কর্ণ বীরের মর্যাদা দিতে জানে। অর্জুনের অনুরোধের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়েছে কর্ণ।

ঊনত্রিশ

দেখার পর থেকে দ্রৌপদীর ওপর ভীষণ লালসা জমে গিয়েছিল যুধিষ্ঠিরের। দ্রৌপদীকে পাওয়ার লোভ যুধিষ্ঠিরের মন চঞ্চল করে তুলেছিল। কিন্তু সে নিজের ধনুপারঙ্গমতা সম্পর্কে ভালো করেই জানে। দ্রুপদের তৈরি যন্ত্রের ভেতর দিয়ে মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করার মতো দক্ষতা যে শুধু তার ভাই অর্জুনেরই আছে, অবগত সে। যুধিষ্ঠির ভেবে রেখেছে, অর্জুনলব্ধ দ্রৌপদীকে সে-ই বিয়ে করবে। অর্জুন যেভাবেই দ্রৌপদীকে অর্জন করুক না কেন, বড় ভাই বিয়ে করার আগে তো সে আর বিয়ে করবে না! অতি অবশ্যই অর্জুন তাকে প্রস্তাব দেবে দ্রৌপদীকে বিয়ে করার জন্য। সাধলে সে না করবে না—মনে মনে স্থির করে রেখেছে যুধিষ্ঠির।

হঠাৎ কর্ণের আবির্ভাবে যুধিষ্ঠিরের বাসনা লণ্ডভণ্ড হতে বসেছিল। কর্ণ তো দ্রৌপদীকে জিতেই নিত, যদি না দ্রৌপদী মাঝখানে বাগড়া দিত! ভাগ্যিস দ্রৌপদী হীনজাতের কর্ণকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল! নইলে যে কী হতো কে জানে! কর্ণবিপত্তিটা কাটল বটে, ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন দ্রৌপদীকে জিতেও নিল। তাতে যুধিষ্ঠিরের মনটা মুহূর্তেই ভালোলাগায় ভরে উঠেছিল।

কিন্তু পরমুহূর্তেই যুধিষ্ঠিরের প্রাণটা আনচান করে উঠেছিল—নিয়ম অনুসারে দ্রৌপদী তো এখনি অর্জুনের গলায় বরণমালা পরাবে! তাহলে কি দ্রৌপদীকে তার পাওয়া হবে না!

কিন্তু নিয়তির কী অপার লীলা! দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় মালা পরাতে যাবে, ঠিক ওই সময় কর্ণ এবং অন্যান্য রাজা-রাজকুমার অর্জুনকে আক্রমণ করে বসল। তাই তো মালা পরানোর ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ থেকে গেল! অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়েটা হলো না!

যুদ্ধটা একসময়ে থামল। অর্জুনের রণদক্ষতায় বিদেশি রাজা-কুমাররা হতোদ্যম হয়ে পিছু হটল।

ততক্ষণে দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের চিনে ফেলেছেন।

কৃষ্ণ এসে পাঁচ ভাইকে সাদর সম্ভাষণ জানাল।

দ্রুপদ বিবাহকার্যটা রাজপ্রাসাদেই সম্পন্ন করতে চাইলেন।

যুধিষ্ঠির বলল, ‘মা আছে ঘরে। মায়ের অনুমতি ছাড়া অর্জুন বিয়েটা করে কী করে! দ্রৌপদীকে বরং আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যাই। মায়ের অনুমতিক্রমে দ্রৌপদীর বিয়েটা সুসম্পন্ন করব আমরা।’

‘অর্জুনের সঙ্গেই বিয়েটা সুসম্পন্ন করব আমরা’ বলল না যুধিষ্ঠির, শুধু বলল, ‘দ্রৌপদীর বিয়েটা সুসম্পন্ন করব আমরা।’  

যুধিষ্ঠিরের ওপরচালাকিটা দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন বা অন্য চার ভাইয়ের কেউই ধরতে পারলেন না। যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাবে সবাই সহজেই রাজি হয়ে গেলেন।

দ্রৌপদী ও অন্য ভাইদের নিয়ে নিজেদের কুটিরের সামনে উপস্থিত হয়েছিল যুধিষ্ঠির। মা কুন্তী তখন গৃহাভ্যন্তরে দৈনন্দিন ঘরকন্নায় ব্যস্ত।

উঠানে দাঁড়িয়ে মাকে লক্ষ্য করে উঁচু গলায় যুধিষ্ঠির বলেছিল, ‘মা, আজ আমরা একটা বস্তু এনেছি আমাদের সঙ্গে। বাইরে এসো মা, দেখো।’

কুন্তী তখন ঘরের ভেতর মহাব্যস্ত। হাতের কাজ ফেলে তাঁর তখন বাইরে বেরিয়ে আসার উপায় নেই।

ওই অবস্থাতেই কুন্তী বললেন, ‘তোমরা এক কাজ করো বাছা, ওই বস্তুটা তোমরা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নাও।’

অন্য ভাইয়েরা মায়ের কথা শুনে উদ্ভ্রান্ত হলো। যুধিষ্ঠির কিন্তু স্থির থাকল। তার চালাকি যে সার্থক হয়েছে!

এরপর কুন্তী বাইরে এসেছিলেন। দ্রৌপদীকে দেখে হতভম্ব হয়েছিলেন। এ কী বলেছেন তিনি! পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নাও!

মায়ের মুখনিঃসৃত বচন বলে কথা! মায়ের কথাকে কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না—দৃঢ় কণ্ঠে বলল যুধিষ্ঠির। বড় দাদার কথা শুনে অন্য ভাইদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। অর্জুন একেবারেই নির্বাক হয়ে যায়।

দ্রৌপদীকে মায়ের সামনে বছরওয়ারি ভাগ করে নেওয়া হয়। সেদিন থেকে দ্রৌপদী এক এক বছরের জন্য এক এক ভাইয়ের সঙ্গে স্ত্রী হিসেবে থাকবে। অন্য ভাইদের কাছে দ্রৌপদী থাকবে তখন অস্পর্শিত। এই নিয়ম সব ভাই মেনে নিতে বাধ্য হলো। যুধিষ্ঠির যেহেতু বড় ভাই, তাকে দিয়েই দ্রৌপদীর সহবাসজীবন শুরু হলো।

দ্রৌপদী সারাজীবন পঞ্চস্বামীনিষ্ঠ হয়ে কাটিয়ে দিল।

যুধিষ্ঠিররা কিন্তু একপত্নীনিষ্ঠ হয়ে থাকেনি। থাকেই-বা কী করে! এক বছর দ্রৌপদীকে ভোগ করার পর অন্য ভাইদের হাত ঘুরে আসতে আসতে চার বছর লেগে যায়। কোনো ভোগী পুরুষের পক্ষে কি নারীবিহীন চার-চারটা বছর কাটানো সম্ভব? তাই তো পঞ্চপাণ্ডব নিজেদের পছন্দমতো আরও অনেক নারীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেছে। নতুন স্বামী গ্রহণ করতে পারেনি শুধু দ্রৌপদী। পারবে কী করে? প্রতিটি রাতে যে তাকে সম্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়! দ্রৌপদীর জীবন ঘিরে শুধু পঞ্চপতির উপাখ্যান আর পঞ্চপতিকে ঘিরে বহু নারীভোগের বৃত্তান্ত।

শিবি দেশের রাজা গোবাসন শৈব্য তাঁর মেয়ে দেবিকার স্বয়ংবরসভার আয়োজন করেছেন। যুধিষ্ঠির সেই স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হয়েছে। দেবিকা যুধিষ্ঠিরের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছে।

মধ্যম পাণ্ডব ভীম সব ব্যাপারেই একটু অগ্রসর। বিয়ের ব্যাপারেও সে অন্য ভাইদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল না। যুধিষ্ঠিরের অনেক আগেই সে নারীদেহের স্বাদ পেয়ে গিয়েছিল।

প্রাণ হাতে করে জতুগৃহ থেকে পালিয়েছিল পাণ্ডবরা। সুড়ঙ্গপথে এক অরণ্যে এসে থেমেছিল। বড় শ্রান্ত-ক্লান্ত ছিল তাদের দেহ। আর এগোতে পারছিল না। এক বৃক্ষতলে শুয়ে পড়েছিল। ভীম ছাড়া সবাই নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ভীম পাহারায় থাকল। রাক্ষস হিড়িম্ব ছিল সেই অরণ্যের অধিকর্তা। পাণ্ডবদের দেখে হিড়িম্বর নরমাংস খাওয়ার লোভ হলো।

বোন হিড়িম্বাকে বলল, ‘যাও, ওদের বধ করো। আজ আমি নরমাংস খাব।’

দাদার নির্দেশ পেয়ে হিড়িম্বা পাণ্ডবদের দিকে এগিয়ে গেল। নরহত্যায় বোনকে সাহায্য করার জন্য হিড়িম্বও অগ্রসর হলো। কিন্তু ভীমের হাতে অচিরেই হিড়িম্ব নিহত হলো। ভীম হিড়িম্বাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে যুধিষ্ঠির বাধা দিল। এদিকে আচমকা ভীমের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ল হিড়িম্বা। ওরা তো মায়াবিনী! মায়ার ছলনায় নিজেকে সুন্দরী সজ্জিতা নারীতে রূপান্তরিত করল এবং ভীমকে স্বামী হিসেবে প্রার্থনা করে বসল। যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার বাসনাকে অস্বীকার করল না। সেই দুর্যোগময় দিনে চালচুলাহীন সময়ের ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার বিয়ে দিয়ে দিল যুধিষ্ঠির।

হিড়িম্বা ছাড়া ভীম আরও দুই নারীকে বিয়ে করেছিল। তাদের একজন বলন্ধরা। বলন্ধরা কাশীরাজকন্যা। ভীমের তৃতীয় স্ত্রীর নাম কালী। কালী সুন্দরীশ্রেষ্ঠা।

তবে বিয়ের ক্ষেত্রে সব ভাইয়ের মধ্যে এগিয়ে ছিল অর্জুন। অর্জুনের যেমন ছিল বীরত্ব, তেমনি ছিল দেহলাবণ্য। স্বভাবতই নারীরা তার জন্য ব্যাকুল হতো।

কয়েকজন ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র আনতে গিয়ে দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠিরের ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয় অর্জুন। ওরা তখন লীলামগ্ন ছিল। শর্তানুসারে অর্জুনকে বারো বছরের জন্য অন্যত্র চলে যেতে হয়। ওই সময়ে একদিন অর্জুন স্নানের উদ্দেশ্যে গঙ্গায় নামলে উলূপী নামের এক নাগকন্যা তাকে দেখে কামাতুরা হয়ে পড়ে এবং অর্জনের দেহসান্নিধ্য প্রার্থনা করে। অর্জুন তাকে ফেরায় না।

এরপর অর্জুন মণিপুরিকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করে। রাজা চিত্রভানুকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখামাত্র প্রেমে পড়ে অর্জুন। রাজার কাছে চিত্রাঙ্গদার পাণিপ্রার্থনা করলে অর্জুনের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার বিয়ে দেন রাজা চিত্রভানু।

ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন প্রভাসে এলে কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। কৃষ্ণ অর্জুনকে রৈবতক পর্বতে নিয়ে যায়। ওই সময় ওখানে উৎসব চলছিল। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা সেই উৎসবে যোগ দিয়েছিল অর্জুনকে দেখেই প্রেমমুগ্ধ হয় সুভদ্রা। কৃষ্ণের সহায়তায় অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করে। হরণ করেই মামাতো বোন সুভদ্রাকে বিয়ে করে ফেলে অর্জুন।

নকুল ছিল পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচাইতে রূপবান। এই রূপবান নকুলও দ্রৌপদী ছাড়া আরেক নারীকে বিয়ে করে। তার নাম করেণুমতী। করেণুমতী ছিল চেদিরাজ শিশুপালের কন্যা।

সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা সহদেব। এই সহদেবও দ্রৌপদী ছাড়া আরও দুটি বিয়ে করে। প্রথমজনের নাম বিজয়া। সহদেবের অপর স্ত্রীর নাম জানা যায় না। তবে সে ছিল রাজা জরাসন্ধের কন্যা।

অন্যান্য রাজা-রাজকুমারের মতো দুর্যোধন-কর্ণও দ্রুপদরাজ্য থেকে ফিরে এসেছিল। দুর্যোধনের মনে দ্রৌপদীর কথা তেমন করে মনে থাকল না। দেশে দেশে রাজকন্যাদের স্বয়ংবরসভা হয়। রাজা-রাজপুত্ররা সেই সভায় পাণিপ্রার্থী হয়ে উপস্থিত থাকে। একজনের বাসনাই পূরণ হয়। অন্যরা ব্যর্থকাম হয়ে স্বদেশে ফিরে যায়। সামনের কোনো এক স্বয়ংবরসভার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে তারা। পেছনেরটাকে ভুলে যায়। দুর্যোধনও ভুলে গেছে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভার কথা।

কর্ণ কিন্তু ভোলে না। আপ্রাণ চেষ্টা করেও দ্রৌপদীর অপমান ভুলতে পারছে না সে। তার বুকের তলায় রক্তক্ষরণ চলতে থাকল। উন্মুক্ত সভায় দ্রৌপদীর ওই অপমান কর্ণকে দিনে দিনে ম্রিয়মাণ করে তুলল। একধরনের অবসন্নতা তাকে গ্রাস করা শুরু করল।

তার বিষণ্নতা দেখে দুর্যোধন শঙ্কিত হয়ে পড়ল। দুর্যোধন বুঝে গেল, কর্ণের এই হতমানতা আর বিষণ্ণতা দ্রৌপদীর কারণে। সে তো দেখেছে, দ্রৌপদীকে দেখামাত্র কর্ণের চোখমুখ কী অসাধারণ আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল! কাঁপা হাতে আসনের হাতল দুটো চেপে ধরেছিল কর্ণ—চোখ এড়ায়নি দুর্যোধনের। সে বিবাহিত বলে বুঝতে অসুবিধা হয়নি কর্ণের এ কাঁপন সাধারণ কোনো কাঁপন নয়। এ যে রোমাঞ্চ! দ্রৌপদীলাভের বাসনার শিহরণ!

বন্ধু কর্ণকে যেকোনো মূল্যে অবসাদগ্রস্ততা থেকে বের করে আনতে হবে—দ্রুত ভেবে গেল দুর্যোধন। কিন্তু কী করে কর্ণকে বিষণ্ণতামুক্ত করা যাবে, ভেবে কূল পেল না। দুঃশাসনের সঙ্গে আলাপ করল দুর্যোধন।

দুঃশাসন বলল, ‘একটা উপায় আছে দাদা।’

‘উপায় আছে! বলো, বলো সেই উপায়টা কী!’ উদ্‌গ্রীব হয়ে জানতে চাইল দুর্যোধন।

দুঃশাসন বলল, ‘তুমি কর্ণের বিয়ের ব্যবস্থা করো। স্ত্রীসান্নিধ্যে তার সকল বিষাদ কেটে যাবে। নতুন জীবন তাকে উজ্জীবিত করে তুলবে।’

ছোট ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দুর্যোধন বলল, ‘তুমি ঠিক পরামর্শ দিয়েছ দুঃশাসন। ওটাই একমাত্র পথ, যা দিয়ে কর্ণকে আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারব। আমি আজই পিতার সঙ্গে কথা বলছি। তাঁর সঙ্গে তো কর্ণপিতা অধিরথের বন্ধুত্বের সম্পর্ক!’

দুর্যোধন কালবিলম্ব না করে একান্তে পিতা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করেছিল। কর্ণ-দ্রৌপদী বিষয়ক সকল কথা পিতাকে খুলে বলেছিল।

শেষে বলেছিল, ‘পিতা, কর্ণ আমার প্রিয় সুহৃদ। তার বিষণ্ণতা আমি সহ্য করতে পারছি না। আপনি অধিরথের সঙ্গে কথা বলে কর্ণের বিয়ের উদ্যোগ নিন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—বিয়ের পর কর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।’

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের কথাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অধিরথ আর রাধার সঙ্গে কর্ণের বিয়ে নিয়ে আলাপ করেছিলেন।

অধিরথ বলেছিলেন, ‘আমাদের কর্ণ তো বীর! মহাযোদ্ধা সে! সে কি স্বয়ংবরসভা থেকে কোনো রাজকন্যাকে জিতে নিতে পারে না?’

অধিরথ জানেন না, সম্প্রতি তার পুত্রটি শুধু জাতকুলমানের হীনতার কারণে দ্রৌপদী দ্বারা অপমানিত হয়েছে।

ধৃতরাষ্ট্র তা অধিরথ-রাধাকে জানাতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ‘সূতজাতীয় কন্যার সঙ্গে কর্ণের বিয়ে দিলে সর্বার্থে ভালো হয় অধিরথ।’

অধিরথ বা রাধা—কেউ ধৃতরাষ্ট্রের প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন না আর। কর্ণের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তাঁরা।

অচিরেই কর্ণের সঙ্গে সূতজাতের তিনজন সুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেল। ওরা তিনজন সহোদরা। ওদের নাম মঞ্জুলা, ঋজুলা, তটিনী।

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরে সাড়ম্বরে কর্ণের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন।

ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল কৰ্ণ।

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখকরজীবনেও হঠাৎ দ্রৌপদীর অপমানের কথা মনে পড়লে বড় চঞ্চল হয়ে উঠত কৰ্ণ।

যতদিন অপমানের প্রতিশোধ নিতে না পারছে কর্ণ, ততদিন পর্যন্ত কর্ণের ভেতরের প্রতিশোধস্পৃহা জাগরূক থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *