কৰ্ণ – ১

এক

আমি রব নিম্ফলের হতাশের দলে!
জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে
নামহীন গৃহহীন। আজিও তেমনি
আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো, জননী,
দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব—’পরে।
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে,
জয়লোভে যশোলোভে, রাজ্যলোভে,
অয়ি, বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই ॥

—কর্ণকুন্তীসংবাদ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিনদিকে দিগন্তবিস্তৃত অরণ্যভূমি। পশ্চিমে ভাগীরথী।

অরণ্যজুড়ে নানা বৃক্ষ। শালবৃক্ষই অধিক। শালপত্রের ছায়া নিবিড়। নিবিড় ছায়া সুশীতল। এ ছাড়া আম-কাঁঠাল, শিরীষ, কদম্ব, তমাল, বট, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল গাছের ছড়াছড়ি গোটা বনভূমিতে। মৃদুমন্দ সমীরণে বৃক্ষের শাখা-পল্লব তরঙ্গায়িত। আশ্চর্য মনোহর এক সুগন্ধ অরণ্যভূমির বাতাসে। হয়তো পুষ্পগন্ধ, নয়তো ধূপবৃক্ষের দেহনিঃসৃত সুবাস বাতাসে জড়ানো-ছড়ানো। দুইয়ের সম্মিলিত সুরভি হওয়াও বিচিত্র নয়।

অদূরে ভাগীরথী। জলভরা। এই অগ্রহায়ণেও ভাগীরথী খলখল। এই অঞ্চলে সে কণ্ঠহারের মতো বাঁকানো। শিলাময় দুটো পাড়ে ঘা খেয়ে খেয়ে এর স্রোত অগ্রসরমাণ। তাতে এক সাংগীতিক মূর্ছনা তৈরি হয়ে চলেছে। এখানকার বাতাস ঈষৎ জলীয়। এই সুখভোগ বাতাস অরণ্যভূমি পর্যন্ত, শুধু অরণ্যভূমি কেন, অরণ্যভূমি ছাড়িয়ে হস্তিনাপুর পর্যন্ত ব্যাপ্ত।

অরণ্যভূমির মাঝখানটায় বেশ উঁচু। টিলামতন। টিলার চারদিকের পাদদেশে নানা রকম বৃক্ষ থাকলেও এর শীর্ষদেশ বৃক্ষশূন্য। তবে একেবারে বৃক্ষবিরল নয় টিলাচূড়াটি। বহু শতাব্দী প্রাচীন এক তেঁতুলতরু নিজের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে টিলাশীর্ষে। অনেকটা অংশজুড়ে টিলাচূড়াটি সমতল। উত্তর এবং পূর্বদিক থেকে দুটো পথরেখা সমতলটির অনতিদূরে এসে ঠেকে গেছে। উত্তরের পথরেখাটি বহু ব্যবহৃত। রথচক্রের অজস্র চিহ্ন উত্তরের পথজুড়ে। সদ্য চক্ররেখাও দেখা যাচ্ছে ও-পথে। পুবের পথটি কদাচিৎ ব্যবহৃত। এই পথের দুধারে ঘন ঘাস। ঘাসের ডগা পথের ওপর নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। ওরা সতেজ। ওদের দেখে মনে হয়, বহু বহুদিন কোনো পথচারী এপথ মাড়ায়নি। অথবা কোনো রথচক্র এই পথ দিয়ে অগ্রসর হয়নি।

আজ সেই অব্যবহৃত পুবের রাস্তাটি দিয়ে একটি রথকে ধীরলয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সেই রথের আরোহী এক নারী—রাজমাতা কুন্তী। রথের সারথি—কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কুন্তীর ভ্রাতুষ্পুত্র। বসুদেবের অষ্টম সন্তান এই কৃষ্ণ। বসুদেব যাদববংশীয়। কুন্তীও। কৃষ্ণ আজ কুন্তীকে এই অরণ্যমধ্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়েছে। তাঁদের আজকের এই যাত্রা অত্যন্ত গোপনীয়। লোকচক্ষু এড়িয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে এঁরা দুজন এখানে এসেছেন। বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে তাঁদের আজকের এই অভিযাত্রা। এ অভিযাত্রা নয়, এ যেন এক অভিযান। বাসনাপূরণের অভিযান। তাঁদের এই আগমনের পেছনে দুটো অভিপ্রায়। বাৎসল্যের পরিপূরণ এবং স্বার্থসিদ্ধি।

ওই পথরেখার শেষ প্রান্তে এসে রথটি থেমে গেল। রথটির আর সামনে এগোবার উপায় নেই। সামনের পথ এবড়োখেবড়ো। এ পথ রথচক্রের জন্য অনুকূল নয়। জোর করে এগোতে চাইলে রথচাকা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা। আরোহীরও দৈহিক কষ্টের সীমা থাকবে না। ওই এবড়োখেবড়ো রাস্তাও একটা পর্যায়ে শেষ হয়ে গেছে। এরপর শিলাখণ্ডের ধাপ। ওই ধাপ বেয়েই টিলাচূড়ায় উঠতে হবে। কুন্তী ওই টিলাশীর্ষে উঠবার জন্যই আজ এখানে এসেছেন। ওখানেই যে কুন্তীর ঈপ্সিত মানুষটি!

উত্তরের পথটি বেয়ে অনেক আগে আরেকটি রথ এসেছিল। সূর্যদেব তখন পূর্বগগনে। এই রথটি প্রায়ই এখানে আসে। টিলাশীর্ষের কাছাকাছি গিয়ে থামে। আরোহী রথ থেকে নামে। দৃঢ়পদক্ষেপে সোপানের দিকে এগিয়ে যায়। সারথি ওইখানেই রথ নিয়ে অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর সারথির কর্ণে মন্দ্রিত মন্ত্রধ্বনি ভেসে আসে।

আজ ওই রথটি প্রভাতের একটু পরে উত্তরের পথটি বেয়ে এগিয়ে এসেছিল।

রাজমাতা কুন্তীর রথটি চার চাকাবিশিষ্ট। আটটি ঘোড়ায় টানা। রথটির চূড়া থেকে আরম্ভ করে চাকা পর্যন্ত ঐশ্বর্যে ঝলকিত। আর উত্তরের পথ বেয়ে আসা রথটিতে ঐশ্বর্যের তেমন কোনো উপস্থিতি নেই। এই রথের আরোহীও সাধারণ কেউ নয়। রাজা সে। অঙ্গরাজ্যের অধিপতি। নৃপতি হওয়া সত্ত্বেও রাজৈশ্বর্যের কণামাত্র চিহ্ন তার রথের কোথাও নেই। সাধারণ্য এই নৃপতিচরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই রথটি দ্বিচক্রের। রাজাদের অনেকে তাদের রথে চারটি ঘোড়া ব্যবহার করলেও অঙ্গরাজ্যের রাজার রথের ঘোড়া দুটি। ঘোড়া দুটোর রং ধবল। ঘোড়াগুলো অনতি-উচ্চ। দেহগঠন অত্যন্ত সবল। ক্ষিপ্রগতি এদের। চার ঘোড়ার রথও দৌড়ে এদের সঙ্গে পেড়ে ওঠে না।

আজও রথটি অসমতল পথপ্রান্তে এসে থেমে গিয়েছিল। রাজকীয় পদবিক্ষেপে নেমে এসেছিল নৃপতি। উত্তরীয়টি যথাস্থানে আছে কিনা ডান হাত দিয়ে একবার পরখ করে নিয়েছিল। সামনে পা বাড়াবার আগে সারথির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলেছিল, ‘কঙ্ক, তুমি এখানেই অপেক্ষা করো।’

কঙ্ক মাথা নুইয়ে তার সম্মতি জ্ঞাপন করেছিল।

রাজা পাথুরে সোপানে ডান পা-টি রেখেছিল। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে টিলাশীর্ষের সমতল ভূমিটিতে পৌঁছে গিয়েছিল রাজা। পছন্দের স্থানটিতে দাঁড়িয়ে চোখ বুজেছিল। দুহাত জড়ো করে পূর্বমুখী হয়ে মাথায় ঠেকিয়েছিল। তারপর বুকের কাছাকাছি বদ্ধাঞ্জলি হয়ে উচ্চারণ করেছিল — ওঁ জবা কুসুম…। নৃপতি সূর্যভক্ত। দিনমণির প্রণাম সম্পন্ন করেই সে দিনের আহার্য গ্রহণ করে। আজও মন্ত্রমন্দ্রিত কণ্ঠে রাজা সূর্যমন্ত্রটি আওড়ে যাচ্ছিল।

পেছন থেকে কৃষ্ণ বলে উঠেছিল, ‘এই বন্ধুর পথ আপনি পায়ে দলে যেতে পারবেন না রাজমাতা।’ কুন্তী সম্পর্কে কৃষ্ণের পিতৃসা হলেও সম্বোধনে তা উচ্চারণ করে না কৃষ্ণ। বলে, রাজমাতা। কুন্তী রাজা যুধিষ্ঠিরের মা যে!

রাজমাতা কুন্তী রথ থেকে নেমে দুকদম এগিয়ে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণের কথা শুনে থমকে গেলেন। পেছন ফিরে ঈষদুচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘কষ্ট হলেও এই পথটি আমাকে একলাই হেঁটে যেতে হবে কৃষ্ণ। ওখানে তোমার যাওয়ার যে উপায় নেই!’

রাজমাতার কথা শুনে কৃষ্ণ দ্রুত এগিয়ে গেল। সসম্ভ্রমে রাজমাতার বাঁ হাতটি ধরে বলল, ‘সোপান পর্যন্ত আমি আপনাকে এগিয়ে দিই রাজমাতা।’

‘তুমি হাত ছাড়ো কৃষ্ণ। আমি একা যেতে পারব।’ বললেন কুন্তী।

‘না, আপনি সোপান পর্যন্ত একা একা যেতে পারবেন না। উঁচু-নিচু এই পথটি অতিক্রম করতে আপনার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তার পর তো আরও কষ্টকর সোপানপথ! না না রাজমাতা, আপনি যা-ই বলুন, আমি আপনার হাতটি ছাড়ছি না।’

মৃদু হেসে কুন্তী স্বগত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি একটা উন্মাদ ছাড়া আর কিছু নও কৃষ্ণ।’

কুন্তীর বলাটা আত্মগত হলেও কৃষ্ণ স্পষ্ট শুনতে পেল। কোমল গলায় কুন্তীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘এই মুহূর্তে আপনার বুকের ভেতর কী প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে অন্য কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি রাজমাতা। আজ যে আপনার পরীক্ষার দিন! সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষার দিন!’

অকস্মাৎ হাঁটা থামিয়ে দিলেন কুন্তী। তাঁর বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তারপর মৃতপ্রায় কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ কর্ণ। আজ থেকে বহু শত বছর আগে সীতাকে স্বামী রামের সামনে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাঁর সতীত্ব প্রমাণের জন্য। আজ আমি পরীক্ষা দিতে চলেছি আমারই…।’ কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো কুন্তীর।

কৃষ্ণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে কি চলবে রাজমাতা?’

রাজমাতা নিজেকে সংবরণ করতে চাইলেন।

ইত্যবসরে কৃষ্ণ বলল, ‘মনে রাখবেন, আজকের সাক্ষাতের সঙ্গে আপনার বেদনাময় অতীত যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি জড়িয়ে আছে গভীর এক সামরিক কূটকৌশল। মনে রাখবেন, আপনার আজকের সার্থকতার সঙ্গে আপনার পুত্রদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জড়িত। আপনি আজ ব্যর্থ হলে নিরেট অন্ধকারে নিক্ষেপিত হবে পঞ্চপাণ্ডব। যুদ্ধজয় সূদূর পরাহত হবে।’

‘যুদ্ধজয় পরাহত হবে!’ অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের মাখামাখি রাজমাতার চোখেমুখে।

‘আমি একটি শব্দও মিথ্যে বলছি না রাজমাতা।’ বলে একটু থামল কৃষ্ণ। কী যেন একটু ভাবল! তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘বিচক্ষণ হিসেবে আপনি সর্বদা আমাকে বাহবা দেন। আপনি মনে করেন, আমার দূরদৃষ্টি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। মিথ্যে বলছি না তো রাজমাতা?’

‘না, তুমি বানিয়ে বলছ না কৃষ্ণ। আমি বিশ্বাস করি, তোমার মতো কূটকৌশলী ও বিশদদর্শী বর্তমানের ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়জন নেই।’

‘আপনার বিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে আস্থার সঙ্গে বলছি, যে করেই হোক ওকে পাণ্ডবদলে টেনে আনবেন। সে আপনার বাৎসল্যের দোহাই দিয়ে হোক বা চতুরতা দিয়ে হোক। যে কোনো মূল্যে তাকে আমাদের দলে ভিড়াতেই হবে।’

‘আমার খুব ভয় করছে কৃষ্ণ।’

ভয়ের কিছু নেই। এ হলো আপনার ধৈর্যের পরীক্ষা। অনেকটা অভিনয়েরও।’

‘অভিনয়ের! এ কী বলছ তুমি!’

‘আমি যথার্থই বলছি রাজমাতা।’

স্তম্ভিত গলায় কুন্তী বললেন, ‘যথার্থ বলছ! তোমার কথার কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি!’

‘বুঝিয়ে বলছি। যার কাছে যাচ্ছেন, সে মহাধনুর্ধর। তার রণকুশলতার সঙ্গে একমাত্র অর্জুনেরই প্রতিতুলনা চলে। দুর্ভাগ্যক্রমে সে আজ কৌরবদলে যোগ দিয়েছে। তাকে যদি একবার আমাদের দলে নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে পাণ্ডবপক্ষের শৌর্যবীর্য বহুগুণে বেড়ে যাবে। আর ভেঙে পড়বে দুর্যোধন। ফলে অল্প আয়াসেই পাণ্ডবদের বিজয় সাধিত হবে।’ পথ ফুরাতে ফুরাতে বলে গেল কৃষ্ণ।

‘তাহলে আমার বাৎসল্য, আমার মমতা, আমার হ্রদয়নিঙড়ানো স্নেহ—এসবের কী হবে কৃষ্ণ! এসবকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বার্থপরতাকেই প্রধান করে তুলব আমি!’ ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে গেলেন রাজমাতা।

এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারল না কৃষ্ণ। ভেবাচেকা চোখে কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকল।

পাথুরে সোপানের নিকটে এসে পৌঁছে গেছেন দুজনে। হেমন্তের নরম সূর্যকিরণ কুন্তীর সর্বাঙ্গজুড়ে। তাঁর চোখে, অধরে, নাসিকায়, গণ্ডে, দুবাহুতে সূর্যালোক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। রাজমাতা কুন্তী এই বয়সেও কম সুন্দরী নন। শরীরে সামান্য মেদ জমেছে ঠিকই, কিন্তু সেই মেদ কুন্তীর দেহসৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। নবীন বয়সে কুন্তী ছিলেন অত্যন্ত রূপময়ী। কালক্রমে হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর সঙ্গে বিয়ে হলো তাঁর। তাঁর মনোমোহিনী রূপ দেখে পাণ্ডু মুগ্ধ হয়েছিলেন। যতক্ষণ কাছে থাকতেন, বিভোর চোখে কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। পরবর্তীকালে মদ্ররাজকন্যা মাদ্রীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পাণ্ডু। এ বিয়ে ছিল রাজনৈতিক। পিতামহ ভীষ্মের উদ্যোগে দ্বিতীয় বিয়েটি হয়েছিল। দুই স্ত্রীর মধ্যে কুন্তী ছিলেন পরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন। মাদ্রী ছিলেন সরল ও তরলমতি। কিছুটা প্রগলভও। রূপ আর যৌবন সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন মাদ্রী। অপর পক্ষে কুন্তীর সুশ্রীতা ছিল সহজাত। বিচক্ষণতা তাঁর সৌন্দর্যকে আরও উচ্চকোটিতে নিয়ে গেছে। ঘটনাক্রমে অরণ্যমাঝে পাণ্ডুর মৃত্যু হলো। মাদ্রী সহমরণে গেলেন। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—পাঁচ পুত্রের দায় কুন্তীর ওপর এসে পড়ল। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন তাঁর নিজের গর্ভজাত। পরের দুজনের জননী মাদ্রী।

এই কুন্তী আজ ভাগীরথী তীরের এই অরণ্যে এসেছেন বিশেষ একজনের সঙ্গে দেখা করতে। লোকটির সঙ্গে এটি তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হতে চলেছে। প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মানুষটির জন্মমুহূর্তে। মধ্যিখানের সময়টাতে দূর থেকে বেশ কয়েকবার দেখেছেন তাকে কুন্তী। কথা হয়নি কখনো। আজ জীবনে প্রথমবার যুবকটির সঙ্গে কথা হবে তাঁর।

ভেতরটায় ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়েছে কুন্তীর। ঘোর ঘোর লাগছে তাঁর। স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে আসছে। জিভও জড়িয়ে যাচ্ছে যেন!

বিভোর কণ্ঠে কুন্তী বললেন, ‘পারব তো আমি কৃষ্ণ?

‘পারতে আপনাকে হবেই রাজমাতা। আপনার পারার মধ্যে পাণ্ডবপক্ষের ধ্বংস অথবা জয় নির্ভর করে আছে।’ উৎসাহী কণ্ঠে বলে উঠল কৃষ্ণ।

কুন্তী প্রথম সোপানে তাঁর বাঁ পা-টি তুলে দিলেন।

দুই

ওঁ জবা কুসমসঙ্কাশং
কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং
প্রণতোহষ্মি দিবাকরম্ ॥

সূর্যপ্রার্থনার প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা ব্যঞ্জনা নিয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রোচ্চারণ একবার হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার শুরু করছে প্রার্থনামগ্ন মানুষটি। এরপর তৃতীয়বার, চতুর্থবার এবং বারবার, শত সহস্রবার। এখানে আসার পর থেকে করজোড়ে সূর্যমন্ত্রটি উচ্চারণ করে যাচ্ছে অঙ্গরাজ্যের মহারাজা। কোন সকালে এসেছে রাজা, এখন দুপুরপ্রায়! সকাল থেকেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিমীলিত চোখে একমনে সূর্যধ্যান করে যাচ্ছে সে।

সূর্যদেব এখন মাথার ওপর স্থির। নৃপতির দেহছায়া কায়ার সঙ্গে মিশে আছে। সূর্যের তাপ আজ বড় প্রখর। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রাজার। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলতে শুরু করেছে। রাজার দেহ থেকে ছায়া বেরিয়ে সামনের দিকে দীর্ঘ হতে শুরু করেছে। অপরাহ্ণ হয়ে আসছে। নৃপতি তখনো সূর্যদেবকে স্তুতি করে যাচ্ছে।

কুন্তী ক্লান্ত পায়ে রাজার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। সমতল হলেও এই পথটি হেঁটে আসতে তিনি দম হারিয়ে ফেলেছেন। যা কিছু মনোবল আর দৈহিক শক্তি নিয়ে সোপান অতিক্রম করতে শুরু করেছিলেন, কিছু ধাপ পেরোনোর পর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেললেন। দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ল। ধপাস করে সিঁড়িতে বসে পড়লেন তিনি। একবার ত্বরিত নিচের দিকে তাকালেন। দেখলেন, কৃষ্ণ উঁচু-নিচু পথটি মাড়িয়ে রথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনফেরা বলে কৃষ্ণ তাঁর ক্লান্তিদশাটা দেখতে পেল না। মনে জোর ফিরিয়ে আনলেন রাজমাতা। উঠে দাঁড়ালেন। টিলাচূড়ার সমতলে পৌছে জোরে শ্বাস টেনে বুকটা বাতাসে ভরে নিলেন পাণ্ডবমাতা। তারপর সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন। দূরে দাঁড়ানো নৃপতির পশ্চাৎ অংশটি দেখতে পেলেন। তাঁর বুকটা ধক করে উঠল। এ কী! তাঁর বুকটা এরকম করে কম্পিত হচ্ছে কেন? কেন তাঁর সামনের দিকে পা বাড়াতে কষ্ট হচ্ছে? এই মুহূর্তে তাঁর তো উৎফুল্ল হয়ে উঠার কথা! তা না হয়ে বারবার তাঁর চোখের কোনা ভিজে উঠছে কেন? তিনি তো তাঁর প্রার্থিত মানুষটির সন্নিধানে যাচ্ছেন! প্রার্থিতজনের সান্নিধ্য তো মানুষকে সুখী করে! তাহলে এই মুহূর্তে তিনি দুঃখ অনুভব করছেন কেন?

মন থেকে সব ক্লান্তি-বিষণ্নতা ঝেড়ে ফেললেন রাজমাতা। এক পা দুইপা করে রাজার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দাঁড়ানোর পর বুঝতে পারলেন, তাঁর ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। সূর্যের দিকে তাকালেন তিনি একবার। মনে মনে কিছু একটা ভাবলেন তিনি। শ্বেতশুভ্র আঁচলখানি দিয়ে নিজের মাথাটি আড়াল করলেন। যেন সূর্যকিরণ তাঁর দেহে পড়তে না পারে। শুষ্ক পদ্মমালার মতো চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছিল তাঁর।

মধ্যাহ্ন কেটে গিয়ে সূর্যকিরণ নৃপতির পিঠে পড়লে রাজার সূর্যপ্রার্থনা শেষ হলো।

কুন্তী মোলায়েম কণ্ঠে ডাকলেন, ‘কর্ণ।’

এই নির্জনস্থানে অকস্মাৎ নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনে মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল কর্ণ। দ্রুত ভেবে গেল, কে ডাকল তাকে এই জনহীন টিলাশীর্ষে? এখানে তো কারো আসার কথা নয়! গুপ্তঘাতক? পাণ্ডবপক্ষের কোনো হত্যাকারী তাকে হত্যা করবার জন্য এই অরণ্যভূমিতে পৌঁছে গেছে? নিজের অজান্তে কোমরে ঝোলানো তরবারিতে হাত চলে গেল তার। নিজের বোকামির জন্য ফিক করে হেসে দিল কর্ণ। ধুর, নারী আবার গুপ্তঘাতক হয় কী করে! নারীকণ্ঠই তো শুনল সে! তরুণীকণ্ঠ নয়। বেশ ভারী বয়সি স্নেহমাখা নারীকণ্ঠই তো শুনল! তাহলে…!

এই সময় মমতাময় নারীকণ্ঠস্বরটি আবার শুনতে পেল কর্ণ, ‘বৎস, পেছন ফিরো। তোমার সঙ্গে দেখা করতেই দীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এসেছি আমি।’

‘আমার সঙ্গে দেখা করতে?’ বলতে বলতে দ্রুত পেছন ফিরল কর্ণ।

‘হ্যাঁ পুত্র, তোমার সঙ্গে দেখা করতে।’

‘পুত্র! রাজমাতা! আপনি এখানে!’ সামনে কুন্তীকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে কর্ণের বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

কুন্তী আবেগায়িত কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ পুত্র, আমি। সমস্ত হস্তিনাপুর এবং ইন্দ্রপ্রস্থের মানুষেরা যাকে রাজমাতা বলে সম্বোধন করে, সেই কুন্তী আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

কর্ণ বিস্ময় কাটিয়ে বলল, ‘ভদ্রে, আমার প্রণিপাত গ্রহণ করুন।’

কুন্তী ভেবেছিলেন, কর্ণ তাঁর পা স্পর্শ করে প্রণাম করবে। আবেগে গদগদ হয়ে বলবে, এতটা পথ আসতে তোমার কষ্ট হয়নি? ভেবেছিলেন, কর্ণ বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাবে।

কিন্তু তার ধারেকাছেও গেল না কর্ণ। তার সামনে দণ্ডায়মান এই নারীটির প্রকৃত পরিচয় সে জানে। না না, কুন্তী যে রাজা পাণ্ডুর প্রথমা মহিষী, সে পরিচয় নয়। কুন্তী যে যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুন— এই তিন পাণ্ডবের জননী, সে পরিচয়ও নয়। কুন্তী যে তার গর্ভধারিণী, সে পরিচয় কর্ণ আগে থেকেই জানত। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই গোপন কথাটি তাকে জানিয়েছে। এই জানাটা বজ্রাঘাতের মতো মনে হলেও কর্ণ নিজেকে সামলে নিয়েছিল সেদিন। কৃষ্ণের প্রলোভনে বিন্দুমাত্র টলেনি। খালি হাতে কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তবে সেদিন নিজের প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে বুকের মধ্যে প্রচণ্ড এক ঘূর্ণি তৈরি হয়েছিল কর্ণের। সেই ঘূর্ণি ক্রোধের, সেই ঘূর্ণি ঘৃণার। কুন্তীর বিরুদ্ধে কর্ণের মনে ঘৃণা আর ক্রোধের প্রবল এক আবর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। মায়ের প্রতি সেই ঘৃণা আর ক্রোধ এখনো কর্ণকে ছেড়ে যায়নি। মায়ের জন্য হৃদয়ে কোনোরূপ অভিমানের সৃষ্টি হয়েছিল কিনা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখেছিল কর্ণ। অভিমানের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পায়নি সে বুকের তলায়। শুধু রোষ, শুধু তীব্র বিতৃষ্ণা তার স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল—কোনোদিন কোনো অবস্থাতে সে ওই নারীটির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না। তাঁর কাছে করুণা বা বাৎসল্য চাইবে না কোনোদিন। কোনোদিন জননী নামের ওই নারীটির পাদস্পর্শ করবে না। যদি আসতে হয়, তিনিই আসবেন তার কাছে। সেই দিন তাঁর পরিচয় জানা সত্ত্বেও আবেগে বিহ্বল হবে না। ব্যাকুল গলায় কথাও বলবে না।

আজ সেই মোক্ষম দিনটি এলো কর্ণের জীবনে। মা এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। আজ শোধ নেওয়ার দিন। প্রতিজ্ঞামতো কর্ণ মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণতি জানাল না। কেজো ভঙ্গিতে দুহাত জড়ো করে প্রণিপাত জানাল শুধু।

রাজমাতা কর্ণের মনের অবস্থা অনুধাবন করলেন। ব্যথা যে পেলেন না, তা নয়। তবে মনোবেদনা মুখচোখের রেখায় আর চাহনিতে পষ্ট হতে দিলেন না।

কুন্তীর পূর্বের সম্বোধনের রেশ ধরে কর্ণ বলল, ‘প্রথম থেকেই রাজমাতা আপনি পুত্র পুত্র করছেন। আমি তো আপনার পুত্র নই ভদ্রে! আমি তো রাধা মায়ের পুত্র! অধিরথের ছেলে আমি। অধিরথের পুত্র হিসেবে রাধা মায়ের সন্তান হিসেবে আমি আপনাকে পুনরায় অভিবাদন জানাচ্ছি পাণ্ডবজননী।’

কর্ণের কথা শুনে কুন্তী ভাঙাচোরা কণ্ঠে বললেন, ‘না পুত্র, না! তুমি ওরকম করে বলো না! আমি শুধু পাণ্ডবজননী নই, আমি তোমারও জননী বৎস।’

‘এ মিথ্যে। আমি রাধেয়।’

‘না, তুমি রাধেয় নও কর্ণ। তুমি কৌন্তেয়।’

‘ওসব মিথ্যাচার দিয়ে আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করবেন না রাজমাতা। আমি বিশ্বাস করি, আমি সূতপুত্র ছাড়া আর কিছুই নই।’

কুন্তী আক্ষেপের সুরে বলে চললেন, ‘না বাবা, না। তুমি রাধার ছেলে নও, অধিরথের ছেলে নও। তুমি কুন্তীর ছেলে, আমার ছেলে। অধিরথ তোমার আসল বাবা নয়, সারথিঘরের ছেলে নও তুমি। ছোটজাতের ছেলে নও তুমি। তুমি ক্ষত্রিয়।’

তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে হেসে উঠল কর্ণ। তার হাসি আর থামে না।

কুন্তী ভয় পেয়ে গেলেন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘থামো তুমি পুত্র, থামো। ওরকম করে হেসে যেয়ো না।’

যেমন করে হঠাৎ হেসে উঠেছিল কর্ণ, ঠিক তেমন করে থেমে গেল।

কর্ণের হাসি থেমে যেতে না-যেতে কুন্তী আকুল কণ্ঠে আবার বলে উঠলেন, ‘তুমি আমারই পুত্র কর্ণ, আমার সাগরসেঁচা ধন।’

‘তা না হয় বুঝলাম, আপনি আমার জননী! তাহলে আমার জনক কে?’

কর্ণের মুখ থেকে এ প্রশ্ন উচ্চারিত হবে, প্রস্তুত ছিলেন না রাজমাতা। থতমত খেলেন। নিজেকে সংহত করলেন।

বললেন, ‘আমার বিয়ে হয়নি তখন। আমি তখন কুন্তিভোজরাজা, মানে আমার বাবার রাজপ্রাসাদে। সেখানে একজনের আশীর্বাদে তুই জন্মেছিলি কর্ণ। ওই যে সূর্যদেব, আকাশে যিনি জ্বলজ্বল করছেন, সব কিছু প্রকাশ করাই যাঁর কাজ, তিনিই তুই হয়ে আমার পেটে এসেছিলেন পুত্র। সহজাত কবচ-কুণ্ডল ধারণ করেই তুই আমার কোলে এসেছিলি রে বৎস।’ বলে মাথা নিচু করলেন কুন্তী।

হঠাৎ ক্রোধে ফেটে পড়ল কর্ণ, ‘মিথ্যে, মিথ্যে। সবটাই আগাগোড়া অলীক। ছলনার মোড়কে সত্যকে ঢাকতে চাইছেন আপনি রাজমাতা।’

‘মিথ্যে! ছলনা! এসব কী বলছিস তুই বাবা।’ দ্বিধাজড়িত গলায় কর্ণের কথার প্রতিবাদ করতে চাইলেন কুন্তী।

‘ছলনা নয় তো কী? সূর্যদেবের বুঝি আর কাজ নেই? কোথায় কোন রাজপ্রাসাদে কোন সুন্দরী অনূঢ়া রাজকন্যা আছে, তাদের খুঁজে খুঁজে বের করাই বুঝি সূর্যদেবের কাজ? আসলে এই জগতে নিজেদের দুষ্কর্মগুলো ঢাকবার জন্য মর্ত্যের মানুষেরা দেবতাদের দোহাই দিয়ে এসেছে। তথাকথিত দেবতারা তো আর স্বর্গ থেকে নেমে এসে মানুষের এই অন্যায় কথনের প্রতিবাদ করতে পারেন না! মুচকি একটু হাসেন হয়তো! ওই দেবতাদের দোহাই দিয়ে বহু মানুষ নিজেদের অপকর্ম থেকে রেহাই পেয়ে যায়।’ এখানে এসে কর্ণ খেই হারিয়ে ফেলল। এর পরে যা বলতে চাইল, মুখ দিয়ে বের হলো না। নাকমুখ দিয়ে শুধু উষ্ণ বাষ্প বেরিয়ে আসতে লাগল।

কর্ণের কথা শুনে রাজমাতা কুন্তী দিশে হারালেন। তাঁর নাড়ি-স্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকল।

বহুক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘বাপের বাড়িতে আমি সুখ পাইনি কর্ণ। শ্বশুরবাড়িতেও আমার লাঞ্ছনার সীমা ছিল না। কুরুরাজ পাণ্ডুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার শারীরিক কোনো খুঁত না থাকা সত্ত্বেও পিতামহ ভীষ্ম পৌত্র পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করিয়ে দিলেন। তিনি প্রচার করলেন, এ বিয়ে রাজনৈতিক। মদ্ররাজ অত্যন্ত শক্তিশালী নরপতি। তাঁর পরিবারের সঙ্গে কুরুপরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে কৌরবদের সামরিক শক্তি অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এই অজুহাতে পিতামহ ভীষ্ম আর্য পাণ্ডুর সঙ্গে মদ্ররাজকন্যা মাদ্রীর বিয়ে দিলেন।’ দম নেওয়ার জন্য থামলেন কুন্তী।

তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘আসলে এই বিয়ে রাজনৈতিক কোনো কৌশলের জন্য নয়। এই বিয়ের পশ্চাতে অন্য একটা গূঢ় কারণ ছিল।’

‘গূঢ় কারণ!’ এতক্ষণে কর্ণের মুখ দিয়ে কথা বেরিয়ে এলো।

‘হ্যাঁ পুত্র, অন্য একটা গুহ্য কারণ ছিল এই দ্বিতীয় বিয়ের পেছনে।

‘কী সেটা?’

‘রাজা পাণ্ডু আর আমার বিয়ে হওয়ার পর বেশ কয়েকটি বছর কেটে গেল। সন্তান হলো না আমাদের। একদা রাজমাতা সত্যবতী বংশধারা অব্যাহত রাখবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন। নিজের কুমারীপুত্র ব্যাসদেবকে দিয়ে ছোট ভাইদের স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করিয়েছিলেন। আমার ব্যাপারে পিতামহ সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন।’

‘সন্দেহপ্রবণ!’

‘পিতামহ ভেবেছেন, আমি বুঝি বন্ধ্যা! কিন্তু তাঁর বংশধারা তো অব্যাহত রাখা চাই! উত্তরাধিকারীর জন্য তিনি মাদ্রীকে রাজা পাণ্ডুর স্ত্রী করে ঘরে আনলেন। মাদ্রীরও কোনো সন্তান হলো না। দোষ আমাদের ছিল না। দোষ ছিল রাজা পাণ্ডুর। তিনি নপুংশক ছিলেন।

কর্ণ কিছু না বলে হাঁ-করে কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকল।

নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আমার পিতা, আমার জনক কে?’

কুন্তী নত চোখে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে বললেন, ‘সূর্যদেব। দুর্বাসা মুনির দেহসম্ভোগের আশীর্বাদে তুই জন্মেছিলি পুত্র।’

কর্ণের মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে এলো, ‘এত এত বর থাকতে দুর্বাসা মুনি আপনাকে দেহসম্ভোগের বর দিলেন কেন?’

তিন

যাদবদের রাজ্য মথুরানগর। এর রাজধানী মথুরাপুরী। এই রাজ্যের রাজা শূরসেন। শূরসেনের শাসনকালে মথুরানগর সুখৈশ্বর্যে পরিপূর্ণ ছিল। প্রজাদের দুঃখ-দারিদ্র্যের অনেকটাই রাজা শূরসেন লাঘব করতে পেরেছিলেন। প্রজারা রাজার গুণগানে মুখর ছিল। প্রজার সুখে রাজার স্বস্তি। প্রজার শান্তিতে রাজার সুখ্যাতি। শূরসেনের সুনাম তাঁর রাজ্য ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

মথুরাপুরীর রাজপ্রাসাদটি দেখার মতো। শুভ্রতার প্রতি রাজার আগ্রহ ছিল প্রবল। তাঁর রাজদরবারের সব কিছুই সাদা ছিল। এমনকি তিনি নিজেও শ্বেতশুভ্র পরিধেয় পরিধান করতেন। মহারাজ শূরসেনের রাজপ্রাসাদটি ছিল ধবল। রাজার বিশ্বাস- শুভ্র রং মানুষের মনের কালিমা দূর করে।

নৃপতি শূরসেনের প্রধান মহিষীর নাম সুদেষ্ণা। কালক্রমে সুদেষ্ণার গর্ভে শূরসেনের দুজন সন্তান জন্মাল। একজন পুত্র, অন্যজন কন্যা। পুত্রের নাম বসুদেব, কন্যার নাম পৃথা।

বসুদেব আর পৃথা মাতা-পিতার অপার ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগল। পৃথার যখন পুতুলখেলার বয়স, ঠিক তখনই যদুরাজ শূরসেন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন।

শূরসেনের পিসতুতো ভাইয়ের নাম কুন্তিভোজ। তিনিও নরপতি।

অশ্বনদীর তীর ঘেঁষেই কুন্তিভোজরাজ্যের অবস্থান। দুজন যে পরস্পরের নিকট-আত্মীয় তা-ই নয় শুধু, তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বও ছিল নিবিড়। বালকবেলা থেকেই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যুবরাজ থাকাকালীন উভয়ের মধ্যে সেই সম্পর্ক গাঢ়তর হয়। রাজা হওয়ার পরও দুজনের মধ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অথবা অন্য কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মতান্তর হয়নি। উপরন্তু উভয়ে পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের সমৃদ্ধি ঘটাতে চেয়েছেন। একসময় দুজনেরই বিয়ে হলো।

বহুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও কুন্তিভোজের মহিষী তপজার কোনো সন্তান হলো না। কুন্তিভোজ আর তপজার মনোবেদনার অন্ত থাকল না। সন্তানহীনতার হাহাকার দুজনকে গ্রাস করে বসল।  

একদিন রাজা শূরসেনের রাজপ্রাসাদে মহিষীসহ বেড়াতে এলেন কুন্তিভোজ। পিসতুতো ভাইকে সাদরে নিজের রাজপ্রাসাদে স্বাগত জানালেন শূরসেন। আনন্দ-আহ্লাদে বেশ কয়েকটা দিন অতিবাহিত হলো। ওঁদের সামনে বসুদেব আর পৃথা চঞ্চল পায়ে এঘর-ওঘর করতে লাগল। বিশেষ করে পৃথার চপলতা ও কমনীয়তা কুন্তিভোজ-তপজার দৃষ্টি কেড়ে নিল। ও যত লাফায়-ঝাঁপায়, ওঁদের হৃদয়ও তত লাফায়-ঝাঁপায়। পৃথার আধ-আধ কথা ওঁদের বুকের তলায় ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। একটা সময়ে তাঁরা বাৎসল্যে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন

এক রাতের ভোজে কুন্তিভোজ বললেন, ‘দাদা, তোমার কাছে আমার একটা জিনিস চাওয়ার আছে।’

মুখে খাবার না পুরে কিছুটা অবাক কণ্ঠে শূরসেন বললেন, ‘চাওয়ার আছে! কী চাওয়ার আছে কুন্তিভোজ?’ তার পর কণ্ঠে ঠাট্টা মিশিয়ে বললেন, ‘তোমার রাজ্য আমার চেয়ে অনেক বেশি ধনশালী, তোমার ঐশ্বর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তোমার সামরিক শক্তির কথা শুনে যে কোনো রাজা ত্রস্ত হয়, তোমার প্রাসাদের জৌলুসের কথা সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়ানো। সেই তুমি কুন্তিভোজ আমার কাছে একটা জিনিস প্রার্থনা করছ!’

মুখ কাঁচুমাচু করে কুন্তিভোজ বললেন, ‘আমার প্রার্থনাটা তুমি ঠাট্টাচ্ছলে উড়িয়ে দিয়ো না দাদা।’ তপজার দিকে একটুখানি তাকালেন কুন্তিভোজ।

কুন্তিভোজের তাকানোটা শূরসেনের চোখ এড়াল না। তিনিও পাশে বসা সুদেষ্ণার দিকে একপলক তাকালেন। মহিষী সুদেষ্ণার চোখেমুখে তখন এক অজানা আশঙ্কার আভা।

কুন্তিভোজের কথা শুনে স্থির কণ্ঠে শূরসেন বললেন, ‘তা তোমার সেই প্রার্থনীয় বস্তুটা কী?’

‘তার আগে বলো, তুমি আমাকে ফিরাবে না। বলো, আমার আবেদন তুমি গ্রাহ্য করবে।’

সুদেষ্ণার হৃদয় কেন জানি হঠাৎ থরথর করে উঠল। কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘আগে ব্যাপারটা কী, খুলে বলুন। তারপর না হয় আপনার দাদা কথা দেবেন!’

‘না না বউঠান, আপনার ভয় পাওয়ার মতো কিছু চাইব না আমি।’

রাজা শূরসেন আগুপিছু না ভেবে আচমকা বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে কথা দিচ্ছি, তোমার প্রার্থনা আমি ফিরাব না।’

মহিষী সুদেষ্ণা বললেন, ‘কথা দেওয়ার আগে প্রার্থনীয় বস্তুটা কী, জানলে ভালো হতো না?’

শূরসেন অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘আরে! তুমি অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? কুন্তিভোজ তো আর আমার রাজ্যটা চেয়ে বসবে না!’

কুন্তিভোজ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘আমি তোমার কাছে তোমার মেয়েটিকে ভিক্ষে চাইছি দাদা।’

‘মেয়েটি মানে পৃথাকে! ভিক্ষে!’ হতভম্ব কণ্ঠে বললেন সুদেষ্ণা।

পাশে বসা তপজা সুদেষ্ণার দুহাত চেপে ধরে অনুনয়ের গলায় বললেন, ‘দিদি, আমরা নিঃসন্তান আপনারা জানেন। সন্তানহীনতার যে কী দুঃখ! আমাদের সব কিছু আছে, কিন্তু সন্তান নেই। আমাদের চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই দিদি। একমাত্র পৃথাই আমাদের জীবন থেকে অন্ধকার দূর করতে পারে। আপনার পায়ে পড়ি দিদি, আপনাদের কন্যাটিকে আমাদের কাছে দত্তক দিন। আমরা পৃথাকে বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে রাখব।’

খাবার অসমাপ্ত রেখে মহিষী সুদেষ্ণা উঠে গিয়েছিলেন সেরাতে।

অন্তঃপুরে রাজা শূরসেন আর মহিষী সুদেষ্ণার মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল, কেউ জানে না। শুধু পরদিন শূরসেন কুন্তিভোজকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান পৃথাকে তোমার হাতে তুলে দেব কুন্তিভোজ।

.

পৃথাকে সঙ্গে নিয়ে রাজা কুন্তিভোজ নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন।

পৃথার মনের সেদিনের তোলপাড়টা কেউ খেয়াল করেননি।

শূরসেনের কন্যাটিকে নিজ রাজ্যে এনে কুন্তিভোজ তার নামটি পাল্টে দিলেন। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে কন্যাটির নাম রাখলেন—কুন্তী।

সেই বালিকা বয়সেই পিতা শূরসেনের ওপর কুন্তীর প্রচণ্ড এক ক্ষোভ তৈরি হয়ে গেল। নিজের বাবা তাকে অন্যের হাতে তুলে দিল! দানবীর সাজবার জন্য! পারল কী করে বাবা এ কাজ করতে! তার ঘরে, এমন তো নয় যে অনেকগুলো সন্তান কিলবিল করছে! তারা মাত্র দুই ভাইবোন! মায়ের অপত্য স্নেহছায়ায় বড় হচ্ছিল তারা! বুকের তলা থেকে একটি শাবককে কেড়ে নিলে হরিণী যেমন করে, চলে আসবার সময় মা সুদেষ্ণাকে সেরকম করতে দেখে এসেছে কুন্তী। যুগ যুগ ধরে পুরুষেরা নারীদের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছে, বাকস্বাধীনতা হরণ করেছে। এখানেও পিতা শূরসেন তা-ই করেছে। মাকে কথা বলতে দেয়নি। চোখ রাঙিয়ে মাকে থামিয়ে দিয়েছে। তাই তো চিরবিদায়ের সময় মা তার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে গেছে শুধু। মুখে কিছু বলতে পারেনি। না না, এই পিতাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না পৃথা। যে পিতা কন্দুকক্রীড়ারত কন্যাকে শুধুমাত্র দানবীর সাজবার জন্য অন্যকে দান করে দেয়, সেই পিতাকে আর যা কিছু করা যায়, ক্ষমা করা যায় না!

কুন্তী সারাজীবন ক্ষমা করেনওনি পিতা শূরসেনকে। কেউ পিতার প্রসঙ্গ তুললে তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কুন্তী।

এদিকে যথেষ্ট আদরে-ভালোবাসায় প্রতিপালন করতে লাগলেন কুন্তিভোজ, কুন্তীকে। কুন্তী যে তাঁর সন্তানহীনতার হাহাকার মিটিয়েছে! ওই বালিকাবয়সেই কুন্তী অনুধাবন করতে পেরেছিল, তার পালকপিতাটি অত্যন্ত সরল এবং বাৎসল্যপরায়ণ। এই মানুষটির পিতৃত্বের সাধনায় কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি কুন্তী। কিন্তু পালকমাতা তপজাকে ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনি কুন্তী। তাঁর ভালোবাসায় ঘাটতি লক্ষ করেছে সে।

কুন্তীকে দত্তক হিসেবে নিজরাজ্যে আনার পর কুন্তিভোজ-তপজা আর অনপত্য থাকেননি। মহিষী তপজার গর্ভে অনেকগুলো সন্তান জন্ম নিয়েছিল। সেকারণে তপজার কুন্তীস্নেহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এটা অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়নি কুন্তীর পক্ষে। সন্তান জন্মানোর পর তপজার বাৎসল্যে যে পক্ষপাতিত্ব দেখা দিয়েছিল, রাজা কুন্তিভোজও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কুন্তীকে বাৎসল্যের বন্ধনে আরও বেশি করে জড়িয়েছেন কুন্তিভোজ। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই কন্যাটি তাঁর রাজভবনে পদার্পণ করেছে বলেই তিনি প্রথম পুত্রসন্তান লাভ করতে পেরেছেন। কুন্তিভোজ মনে করতেন, কুন্তী নামের এই কন্যাটি বড় সৌভাগ্যবতী। তাই মহারাজা কুন্তীকে বাড়তি ভালোবাসা দিতেন।

কুন্তিভোজের রাজপ্রাসাদে কুন্তী ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগল। বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে যুবতি হয়ে উঠল কুন্তী। এখন সে অপরূপ সুন্দরী। দীর্ঘনয়না। রূপযৌবনশালিনী এখন কুন্তী নারীসুলভ সকল গুণের অধিকারী। গম্ভীর স্বভাব এবং তেজস্বিনী।

যুবতি হয়ে ওঠার পর কুন্তীর মধ্যে একটি ব্যাপার খুব করে লক্ষ করা গেল। অন্তর্মুখী মনমরা স্বভাবের হয়ে গেল কুন্তী। জনকের বাড়ির বালিকাবয়সের চঞ্চলতা কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার! ধীরস্থির প্রায়-নির্বাক কুন্তীর মধ্যে চঞ্চল-অস্থির পৃথা সমাহিত হয়ে গেল। বালিকাবয়সে জনকজননীর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ধকলটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কুন্তী। তবে এটা ঠিক যে, সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিল। মনের দুঃখকথা কখনো কুন্তিভোজ পরিবারের কাউকে বুঝতে দেয়নি কুন্তী।

রাজপরিবারে কুন্তীর চারদিকে প্রচুর দাসী-সহচরীর সমাগম। কিন্তু কারো সঙ্গে তার তেমন সখীভাব গড়ে ওঠেনি। পিতৃমাতৃস্নেহ বঞ্চিত এই মেয়েটি সর্বদা নিজেকে পৃথক করে রাখতে পছন্দ করত। ফলে স্বাভাবিক নারীর মতো কুন্তী গড়ে ওঠেনি। একধরনের হীনমন্যতা এবং জটিল মনস্ক্রিয়া তার মধ্যে সর্বদা কাজ করত। শৈশবে জনকজননীর স্নেহবঞ্চনা তাকে জটিল করে তুলেছিল। পালকপিতার রাজপ্রাসাদে পালকমাতা তপজার পক্ষপাতমূলক আচরণ কুন্তীর ভেতরের একাকিত্বকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কুন্তিভোজের বিপুল স্নেহ-আদরেও নিজের বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে চলে আসার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা কুন্তীর মন থেকে মুছে যায়নি

কুন্তী যুবতি হয়ে উঠলে রাজ-অন্তঃপুরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব কুন্তীর ওপর এসে পড়ল। কুন্তীর অন্যতম দায়িত্বের একটি হলো অতিথি-আপ্যায়ন করা।

রাজা কুন্তিভোজ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তাঁর আতিথ্যের কথা কুন্তিভোজরাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি অতিথিদের শুধু পাদ্য-অর্ঘ্য-চব্য-চোষ্য- পানীয় দিয়ে তৃপ্ত করতেন না, যাওয়ার সময় নানা রকম মূল্যবান সামগ্রী, যেমন গোধন, স্বর্ণখণ্ড, যব ইত্যাদি দিয়ে অতিথিদের মন তুষ্ট করতেন। আচণ্ডালদ্বিজ তাঁর দান থেকে বঞ্চিত হতো না। প্রত্যেকের সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান অনুসারে রাজা কুন্তিভোজ অতিথিদের দান করতেন। প্রাসাদ-অনুপম এক অতিথিশালা নির্মাণ করেছিলেন কুন্তিভোজ। সেখানে অতিথিরা যত দিন ইচ্ছে, থাকতে পারত। অতিথিদের দেখভালের জন্য সর্বদা সেবক-সেবিকা, পাচক-পাচিকা নিয়োজিত থাকত।

মাঝেমধ্যে রাজা কুন্তিভোজের কাছে মুনিঋষিরাও আসতেন। তখন রাজা নিজে তাঁদের অভ্যর্থনা করতেন। সেই ঋষিদের সেবার জন্য তখন রাজ-অন্তঃপুরের সুন্দরী দাসীদের পাঠানো হতো। দাসীদের সেবাযত্নে অতিথি ঋষিরা বড়ই তৃপ্তি পেতেন। তাঁদের ইচ্ছা পূরিত হওয়ার পর মুনিঋষিরা কুন্তিভোজের কাছে বিদায় নিয়ে দেশান্তরে যেতেন।

এসব মুনিঋষি রাজপ্রাসাদে বা অশ্বনদীর তীরের রাজকাননে নতুবা রাজবাড়ির উদ্যানে কোনো না কোনো সময় রাজকন্যা কুন্তীকে দেখে থাকবেন। যাযাবর এসব মুনিঋষির মুখে মুখে কুন্তীর রূপময়তার কথা চারদিকে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। এঁদের মাধ্যমে কুন্তীর সৌন্দর্য-ব্যাখ্যান নানা দেশের রাজা-যুবরাজরা যেমন জানতে পেরেছেন, তেমনি শুনেছেন খ্যাত-অখ্যাত মুনিঋষিরাও। তপস্বীরা শুধুই ঈশ্বরানুরাগী নন, সৌন্দর্যপিয়াসীও। তাঁদের ভেতরও যে রক্ত-মাংস-পুঁজের অবস্থান! তাঁদের সবাই অরিন্দম নন। ষড়রিপু তাঁদের কব্জায় থাকে না সবসময়। প্রথম রিপুর কাছে অধিকাংশ ঋষি নতজানু।

একদিন প্রবলপ্রতাপী ঋষি দুর্বাসা কুন্তীর রূপের কথা শুনলেন। তাঁর বুকের তলায় কীসের যেন একটা ঘূর্ণি উঠল!

চার

এক অপরাহ্ণে ঋষি দুর্বাসা কুন্তিভোজের রাজপ্রাসাদের সিংহতোরণের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

দুর্বাসা যে-সে ঋষি নন, ক্রোধ-উন্মত্ত, প্রতিপত্তিশালী, ভয়জাগানিয়া, সম্ভ্রম আদায়কারী যে কজন তপস্বী সেই সময়ের ভারতবর্ষে ছিলেন, তাঁদের একজন তিনি।

যেনতেন চেহারা নয় দুর্বাসার। তাঁর গায়ের রং গাঢ় মধুর মতো কালচে লাল। শরীরটা সুদর্শন। মুখে দাড়ি, মাথায় জটা। হাতে সন্ন্যাসীর দণ্ড। চোখমুখ এমন যে দেখে মনে হয়, গোটা শরীরটাই যেন সূর্যদেবের মতো জ্বলছে। তীব্র তেজস্বী, দীর্ঘকায়, জটাজুটধারী, তপস্যাতেজে প্রজ্বলিত একজন মুনিকে দেখে তোরণরক্ষীরা ভয় পেয়ে গেল। রক্ষীপ্রধান রাজাকে সংবাদটা জানাবার জন্য দ্রুত পায়ে প্রাসাদ-অভ্যন্তরের দিকে এগিয়ে গেল।

মহর্ষি অত্রির ঔরসে অনসূয়ার গর্ভে জন্ম নেন দুর্বাসা। কালে কালে তিনি জগদ্বিখ্যাত ঋষি হয়ে ওঠেন। দুর্বাসার খ্যাতি তপস্বী হিসেবে যেমন, তার চেয়ে বেশি পরিচিতি তাঁর রাগের জন্য। ক্রোধজাত সন্তান তিনি। ক্রুদ্ধ দুর্বাসার অভিশাপ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র হতে স্বয়ং কৃষ্ণ পর্যন্ত কেউই রক্ষা পাননি।

দুর্বাসার জন্মবৃত্তান্তের মধ্যেই তাঁর অতিকোপন স্বভাবের রহস্য লুকিয়ে আছে। একসময় শিব আর ব্রহ্মার মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া বাধে। এই ঝগড়া থেকে দুই দেবতার হাতাহাতি, মারামারি। প্রবল ক্ষমতাশালী দুই দেবতার মধ্যে তাণ্ডব দেখে সকল দেবতা ভয় পেয়ে যান। পার্বতীর মাধ্যমে স্বামী শিবকে থামানোর উদ্যোগ নেন দেবতারা।

পার্বতী স্বামীকে গিয়ে বললেন, ‘এ কী শুরু করেছ তুমি?’

শিব বললেন, ‘আমি আবার কী করলাম!’

পার্বতী বললেন, ‘হিংসাপরায়ণ দুই বাচ্চার মতো ঝগড়া শুরু করেছ তোমরা!’

‘আমার দোষ দেখলে, ওই ব্রহ্মা বেটার দোষ দেখতে পাচ্ছ না?’

‘আ হা হা! কথার কী শ্রী! একজন মাননীয় দেবতা সম্পর্কে কী ভাষায় কথা বলছে তোমরা দেখে যাও গো!’ গলা উঁচিয়ে বললেন পার্বতী।

পার্বতীর কথা শুনে শিব কিছুটা নরম হলেন বলে মনে হলো। নিচু কণ্ঠে বললেন, ‘তা আমায় কী করতে হবে?’  

স্বামীর কথা কানে না তুলে পার্বতী বললেন, ‘এরকম করলে আমার এ বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।’

পার্বতীর বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার ভয় দেখানোতে শিবঠাকুর একেবারে নরম হয়ে গেলেন। গলানো গলায় বললেন, ‘আহা! অত রাগ করছ কেন? আমায় কী করতে হবে বলো না!’

পার্বতী কৃত্রিম রাগী কণ্ঠে বললেন, ‘ঝগড়া থামিয়ে দিতে হবে।

‘তা না হয় মানলাম। কিন্তু আমার মনে জন্মানো ক্রোধ আমি কোথায় রাখব? এই রাগ জমা রাখার জন্য একটা স্থান তো দরকার!’

‘তা আমি কী করে বলব তোমার রাগটা কোথায় রাখবে! রাগবার সময় খেয়াল ছিল না সে কথা?’

বউয়ের ঝামটা খেয়ে শিবের হঠাৎ একজনের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি অনসূয়া—মহর্ষি অত্রির স্ত্রী। একদিন অনসূয়া তাঁর কাছে পুত্রের বর চেয়েছিলেন। শিব বলেছিলেন, সময়মতো তোমার বাসনা পূরণ করব আমি অনসূয়া। আজ সেই সময়টা এসে গেছে। অনসূয়াই তাঁর ক্রোধ নির্বাপণের একমাত্র উপায়। শিব তাঁর ক্রোধকে মহর্ষি অত্রির বীর্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। সেই ক্রোধবীর্য থেকেই দুর্বাসার জন্ম হলো। এতে ব্রহ্মা আর শিবের কলহ মিটল বটে, কিন্তু সেই কলহের ফলশ্রুতিতে ক্রোধপরায়ণ দুর্বাসার জন্ম হলো এই পৃথিবীতে। জন্ম তো হলো তাঁর, যৌবনপ্রাপ্ত হলেন। প্রৌঢ়ত্বেও পৌঁছে গেলেন একদা। শৈশব ছাড়ল তাঁকে, যৌবনও ছেড়ে গেল একসময়। কিন্তু ক্রোধ দুর্বাসাকে ছেড়ে গেল না। স্বভাবগত কারণে দুর্বাসা সর্বদাই ক্রোধ প্রকাশ করেন। যখন- তখন অভিশাপ উচ্চারণেও তিনি পিছপা হন না। অন্যদিকে তিনি এক পরম জ্ঞানী এবং কঠোর তপস্যাসিদ্ধ পুরুষও। কিন্তু জ্ঞান ও বৈরাগ্যের চরম ভূমিতে অবস্থান করেও দুর্বাসা কিছুতেই ক্রোধকে দমন করতে পারেন না। তাঁর ক্রোধের শিকার হন ইন্দ্র, স্বর্গরূপসী রম্ভা-উর্বশী-মেনকারা। স্বর্গের প্রভাবশালী অন্যান্য দেবতাও তাঁর ক্রোধজনিত অভিশাপ থেকে রেহাই পান না। এইভাবেই জীবন অতিবাহিত হতে থাকে ঋষি দুর্বাসার।

দুর্বাসা একবার গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করলেন। বটবৃক্ষতলের একটা জায়গায় স্থিত হয়ে অনেক বছর ধরে তপস্যা চালিয়ে গেলেন তিনি। তপস্যামগ্নতার কারণে বাহ্যজ্ঞান তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর।

এদিকে দৈত্যরাজ বলীর ছেলে সাহসিক গন্ধমাদন পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দীর্ঘদেহী সাহসিক অত্যন্ত রূপবান ছিল। স্বর্গসুন্দরী তিলোত্তমাও গন্ধমাদন পর্বতে বিহার করতে এসেছিল। দুজনের দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। তিলোত্তমা তো অতুলনীয় রূপময়ী! তার ওপর তিনি ছিলেন স্বল্পবসনা। তিলোত্তমার সেদিনকার সাজপোশাক এমন ছিল যে উতল হাওয়ার ইন্ধনে সাহসিক উন্মত্ত হয়ে উঠল। অরণ্যমধ্যে আচমকা এমন একজন দৃষ্টিনন্দন সুপুরুষকে দেখতে পেয়ে তিলোত্তমার মনও বিচলিত হয়ে উঠল। বলীপুত্র সাহসিক তিলোত্তমাকে যাচনা করে বসল। তিলোত্তমার শরীরজুড়ে কামের ঢেউ মুখর হয়ে উঠল। সাহসিকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল সে। গন্ধমাদনের নির্জনতার স্বাদ নিতে তাদের দেরি হলো না। দুজনেই উন্মত্তের মতো শৃঙ্গারে প্রবৃত্ত হলো। তারা জানত না, অনতিদূরে ঋষি দুর্বাসা তপস্যারত। বৃক্ষলতার অন্তরালের কারণে তারা ঋষিকে দেখতে পায়নি।

দুই কামার্ত পুরুষ-রমণীর শৃঙ্গার-শীৎকার, কিঙ্কণী-কঙ্কণ আর চুম্বনের বিচিত্র শব্দে মহামুনি দুর্বাসার ধ্যান ভেঙে গেল। দুর্বাসা দেখলেন, বেশ কিছুক্ষণ দেখেই গেলেন সাহসিক-তিলোত্তমার রতিক্রীড়াটি। দুই নরনারীর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। রতিক্রীড়ায় ভীষণ রকম মগ্ন থাকল তারা।

কিছুক্ষণ পর হুঁশে ফিরলেন দুর্বাসা। একে তো ঈশ্বর-সাধনায় বাধা, তার ওপর দুজনের বাধাবন্ধনহীন অবিশ্রান্ত শৃঙ্গার! কাঁহাতক সহ্য করা যায় এই অনাচার! রাগে ফেটে পড়লেন দুর্বাসা।

সাহসিককে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ওরে নির্লজ্জ বেহায়া গাধা! তুই বলীরাজার কুপুত্র। জগতে মানুষ মাত্রেরই লজ্জা আছে, পশুদের তা নেই। কিন্তু পশুদের সময়-অসময় জ্ঞান আছে, শুধু গাধার তা নেই। তুই গাধা ছাড়া আর কিছু নস। তোর শৃঙ্গার-লোলুপতা যখন এতই প্রবল, তখন তুই গাধা হ।’ বলে দুর্বাসা তিলোত্তমার দিকে তাকালেন।

বললেন, ‘আর এই যে তিলোত্তমা, তুই একজন স্বর্গসুন্দরী। ইন্দ্র আর অন্যান্য দেবতার তুষ্টির জন্য তোকে সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বর্গকন্যা হয়ে তোর এত রুচিবিকৃতি ঘটল! ছি ছি ছি! আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি তোর নিম্নরুচি দেখে! একজন দৈত্যপুত্রকে দেহ দিতে তোর রুচিতে বাধল না?’ একটু থামলেন দুর্বাসা।

দম নিয়ে আবার বললেন, ‘দৈত্য-দানবের সঙ্গে শৃঙ্গারে তোর যদি এত উল্লাস, সেই উল্লাসের দফারফা করে ছাড়ছি আমি দেখ। তোকেও শাপ দিচ্ছি আমি, তুই দানবী হ।’ এই বলে ক্রোধে গরগর করে কাঁপতে লাগলেন দুর্বাসা।

অভিশাপ শুনে সাহসিক আর তিলোত্তমা দুর্বাসার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। আকুল হয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল দুজনে। ঋষির মন শান্ত হয়ে এলো। অবশেষে তাদের শাপগ্রস্ত জীবন থেকে মুক্তির উপায় বলে দিলেন। উভয়ে সেখান থেকে বিদায় নিল। কিন্তু দুর্বাসার বুকের তলায় রেখে গেল প্রবল এক রিরংসা।

তিলোত্তমা-সাহসিকের সঙ্গমরত দৃশ্য দেখার পর থেকে তপস্যায় আর কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারলেন না দুর্বাসা। যোগাসনে বসে যেই-না চোখ বোজেন, অমনি রতিক্রীড়ার দৃশ্যটি চোখে ভেসে ওঠে তাঁর, রমণকালের সাহসিক-তিলোত্তমার মুখনিঃসৃত নানা কাম-উত্তেজিত ধ্বনি তাঁর মনঃসংযোগ তছনছ করে দেয়। শরীরের তন্ত্রে-রন্ধ্রে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করতে থাকেন দুর্বাসা। তিনি বুঝতে পারেন, প্রথম রিপু তাঁকে পরিপূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছে।

জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরও অসৎ-সংসর্গে সাংসর্গিক দোষ দেখা দেয়। নারীসঙ্গমের পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা দুর্বাসার না থাকলেও সাহসিক-তিলোত্তমার শৃঙ্গার-বিহার তাঁকে উতলা করে তুলল। তাঁর দেহে ও মনে রমণস্পৃহা তীব্রভাবে জেগে উঠল। তিনি ঋষির ধর্ম তপস্যা ত্যাগ করলেন। নিজের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধে বারবার তাঁর ঈশ্বরচিন্তা পরাভূত হলো। শেষপর্যন্ত তিনি কামিনী চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়লেন।

দুর্বাসা মনস্থির করলেন—তিনি বিয়ে করবেন। কারণ একমাত্র স্ত্রীই তাঁর রমণেচ্ছা পূরণ করতে পারবে।

কিন্তু তাঁর মতো ক্রোধোন্মত্ত ঋষিকে কে তাঁর কন্যাটিকে সম্প্রদান করবেন—ভাবলেন দুর্বাসা। দূর-অতীতের দিকে চোখ ফেরালেন তিনি। সেখানে শুধু ক্রোধের আস্ফালন আর অভিশাপের ছড়াছড়ি দেখতে পেলেন। তিনি অনুভব করলেন, মানুষেরা তাঁকে ভয় করে বটে, কিন্তু শ্রদ্ধা করে না। দুমুখ ঋষিকে কে-ই-বা পছন্দ করে? আত্মবিশ্লেষণের পরও দুর্বাসার সঙ্গমেচ্ছা স্তিমিত হয় না। উপরন্তু যত দিন যায়, তত তাঁর নারীসঙ্গলিপ্সা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি তপাশ্রম ছেড়ে পাত্রীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। দেশ-দেশান্তর, বন-বনান্তরে ঘুরেও কোনো পাত্রীর সন্ধান পেলেন না দুর্বাসা।

একদিন তাঁর কানে এলো কন্দলীর কথা।

সেসময় ঔর্ব নামে মহাতপা এক ঋষি ছিলেন। ঋষি ঔর্বের কন্যার নাম কন্দলী। কন্দলীর একটু বয়স হয়ে গেলেও দেখতে সুরূপা। এই কন্দলী আবার দুর্বাসার অসাধারণ ব্রহ্মতেজের কথা জানতেন। ফলে তাঁর মধ্যে শ্রবণানুরাগ জন্মায়। দুর্বাসাকে নিজের স্বামী হিসেবে মনে মনে ভেবে নেন কন্দলী। কন্দলীকে সঙ্গে নিয়ে ঔর্ব পাত্রের সন্ধানে বের হন। একটা সময়ে দুর্বাসার সঙ্গে ওঁদের দেখা হয়ে যায়। কন্দলীকে দেখেই দুর্বাসা কামজ্বরে আক্রান্ত হন। দুর্বাসা সসম্ভ্রমে ঔর্বকে প্রণাম জানান। ঋষি ঔর্বের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দুর্বাসার এই অতিভক্তি কন্যা কন্দলীর কারণে।

ঔর্ব দুর্বাসাকে প্রতিপ্রণাম করে বললেন, ‘এ আমার কন্যা কন্দলী। ওর বয়স একটু বেশি বটে, তবে আপনার রূপ আর গুণের কথা শুনে ও আপনাকেই ভালোবেসে ফেলেছে।’

দুর্বাসা আর কী বলবেন! পারলে এখনই শয্যায় নিয়ে যান কন্দলীকে! ঔর্বের কথা শুনে কন্দলী দিকে তাকান দুর্বাসা। দেখেন, কন্দলীর চোখেমুখে মুগ্ধতার গাঢ় উপস্থিতি। এই সময় ঋষি ঔৰ্ব আবার বলে উঠলেন, ‘আমার মেয়ের রূপগুণ কোনোটারই ঘাটতি নেই। পূর্ণযৌবনা সে। মনোলোভাও কন্দলী। তবে…।’ বলে থেমে গেলেন মুনি ঔর্ব।

দুর্বাসা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘কথা অসমাপ্ত রাখলেন কেন মহাত্মন?’

‘তবে তার চরিত্র সম্পর্কে একটা কথা বলার ছিল বাবা।’

‘কী কথা, বলুন না।’ সাগ্রহে বললেন দুর্বাসা।

বেশ বড় একটা শ্বাস ত্যাগ করে ঋষি ঔর্ব বললেন, ‘কন্দলী একটু ঝগড়াটে স্বভাবের। সত্যি কথা বলতে কী, সে ঝগড়া করতে পছন্দই করে।’

‘ঝগড়া করতে পছন্দ করে!’ ভেবাচেকা কণ্ঠে বলেন দুর্বাসা।

ঔর্ব ইতস্তত কণ্ঠে বললেন, ‘শুধু তা-ই নয়, রেগে গেলে কন্দলী যাচ্ছেতাই বলে গালাগালিও দেয়।’

ঋষি ঔর্ব জানতেন, দুর্বাসা অত্যন্ত ক্রোধন স্বভাবের। রাগী মানুষদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ক্রোধী মানুষেরা প্রতিপক্ষের তর্ককে মোটেই পছন্দ করে না। দুর্বাসার প্রকৃতিও সেরকম। এখন দুর্বাসাকে যতই নরমশরম মনে হোক না কেন, তাঁর আসল পরিচয় তো তিনি ক্রোধী একজন ঋষি! কন্দলীকে বিয়ে করলে একসময় না একসময় দাম্পত্যকলহ হবেই। তখন দুর্বাসা তাঁকে দোষারোপ করবেন। তাই কন্যার কোপনস্বভাবের কথা ঔর্ব দুর্বাসাকে আগেভাগে জানিয়ে দিলেন। কন্দলীকে বিয়ে করবেন কি করবেন না, সে সিদ্ধান্ত নেবেন দুর্বাসাই।

ঔর্বের কথা শুনে দুর্বাসার আনন্দ আর দুঃখ দুই-ই হলো। এতদিন পরে যে একজন কন্যার সন্ধান পাওয়া গেল, যে তাঁকে বিয়ে করতে উৎসুক, সে নাকি কোন্দলপরায়ণ। কোন্দলপরায়ণ বলেই কি তাঁর নাম কন্দলী?

দুর্বাসার দোনোমনা দেখে ঔর্ব এবার পাশার মোক্ষম ঘুঁটিটি চাললেন। কন্দলী এতক্ষণ পিতার পেছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতটি ধরে কন্দলীকে দুর্বাসার একেবারে সামনে এনে দাঁড় করালেন ঔর্ব।

দুর্বাসা এবার পূর্ণ চোখে কন্দলীর দিকে তাকালেন। দেখলেন, কন্দলীর বয়স সত্যি একটু বেশি। তবে বয়স হওয়ার ফলে কন্দলী অত্যন্ত গাঢ় যৌবনবতী। প্রসন্ন হাস্যোজ্জ্বল মুখ, পদ্মপাতার মতো চোখ। নিতম্ব পয়োধর ভীষণ আকর্ষণীয়। আগুন রঙের শাড়ি পরেছেন কন্দলী। গায়ে বিবিধ অলঙ্কার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কন্দলী কামুক কটাক্ষে দুর্বাসাকে ঘায়েল করতে চাইছেন।

মোহিত হলেন ঋষি দুর্বাসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *