কৰ্ণ – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

মহিষী গান্ধারীর তিরস্কারে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের মুক্তি দিয়েছিলেন, তাদের সর্বস্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং সসম্মানে পাণ্ডব পরিবারকে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দেশে রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন।

পাণ্ডবরা সভাগৃহ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল দুঃশাসন।

দুর্যোধনকে লক্ষ্য করে ত্রস্ত কণ্ঠে বলেছিল, ‘ভুল হয়ে গেল দাদা! মানুষের জীবনে মস্তবড় ভুল বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে পাণ্ডবদের ছেড়ে দেওয়াটা আমাদের জীবনে মস্তবড় ভুল।’

দুর্যোধনের মনে তখন পেয়ে হারানোর বেদনা। এক এক করে বাজি জেতার পর তার মনে যে আনন্দভাণ্ড তৈরি হয়েছিল, পিতার এক সিদ্ধান্তে সেই ভাণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ওই ব্যথাদীর্ণ ঘোরের মধ্যে দুঃশাসনের কথা দুর্যোধনের কানে ঢুকল না। ফ্যালফ্যাল করে দুঃশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকল দুর্যোধন।

দুঃশাসন তা বুঝতে পারল। দাদার হাতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘আমাদের এখনই একান্তে বসা দরকার দাদা।’

দুর্যোধনের ঘোর কাটল। ছোট্ট করে বলল, ‘ঠিক আছে।’

ওরা দুর্যোধনের ঘরে জরুরি সভায় বসেছিল। এই সভায় দুঃশাসন-শকুনি তো ছিলই, কর্ণও ছিল! প্রথমবারের চক্রান্তের প্রাথমিক আলোচনায় শকুনি অংশ নেয়নি, কিন্তু দ্বিতীয়বারের ষড়যন্ত্রে সক্রিয় অংশ নিল কৰ্ণ।

আলোচনা শেষে চারজনই বুঝল—এবারে পাণ্ডবরা ছাড়বে না। তারা এমন একটা কিছু করবে, যাতে কৌরবদের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে। কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু কী করবে?

শকুনি বুদ্ধি দিল, ‘দ্বিতীয়বার পাশাখেলায় বসাও।’

‘তাতে লাভ?’

‘এবারে ধনসম্পত্তির বাজি নয়। অন্য কিছুর বাজি।’

অবাক হয়ে দুর্যোধন বলে, ‘অন্য কিছুর বাজি!’  

‘হ্যাঁ, এবার বনবাসের বাজি। বারো বছরের বনবাস। বারো বছরে হস্তিনাপুরের রাজ্যপাট গুছিয়ে নিতে পারবে না ভাগনে?’

কর্ণ বলে, ‘পারবে না মানে! নিশ্চয়ই পারবে। আমি আছি না?’

প্রস্তাবটা সবার মনে ধরল।

কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করাবে কে? পাণ্ডবদের কেউ যদি ফিরিয়ে এনে পুনরায় পাশাখেলায় বসাতে পারেন, তা কেবল মহারাজই পারবেন।

শকুনি বলল, ‘মহারাজকে বোঝানোর দায়িত্ব আমি নিলাম। তোমরা আমার সঙ্গে চলো।’

ওরা চারজন মহারাজার সঙ্গে দেখা করল। ধৃতরাষ্ট্র তখন রাজসভার পাশে নিজস্বকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

শকুনি বলল, ‘বিশেষ বিপদের কথা চিন্তা করে এই অসময়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম মহারাজ।

‘বিশেষ বিপদ!’ শয্যা থেকে উঠে বসলেন ধৃতরাষ্ট্র।

মহারাজের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শকুনি বলল, ‘আমি একা নই। আমার সঙ্গে দুর্যোধন-দুঃশাসন আছে, কর্ণও আছে।’

একটা ঢোক গিলল শকুনি। তারপর বলল, ‘আপনি যদি দেখতে পেতেন মহারাজ, তাহলে দুর্যোধনের ভেঙেপড়া চেহারা দেখে আপনি আঁতকে উঠতেন।’

‘কী হয়েছে আমার পুত্র দুর্যোধনের!’ উদ্গ্রীব ধৃতরাষ্ট্র।

কর্ণ বলল, ‘আপনার সিদ্ধান্তে তো পাণ্ডবরা পার পেয়ে গেল! দ্রৌপদীও ফিরে গেল নিজ রাজ্যে। কিন্তু ওরা কি আজকের অপমান হজম করবে মহারাজ?’

বিহ্বল চেহারা ধৃতরাষ্ট্রের। মুখের কথা ফুরিয়ে গেছে যেন তাঁর!

এই সুযোগে শকুনি বলল, ‘পাণ্ডবরা কিছুতেই দুর্যোধনকে ছাড়বে না। আজ সভায় অর্জুন যেভাবে গাণ্ডীব তুলে নিচ্ছিল হাতে, ভীম যেভাবে এমনি এমনি গদা ঘোরাচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছে, এরা এবার কোনো একটা আঘাত করবেই, যে আঘাতে দুর্যোধনের হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তাছাড়া দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ তো ওরা নেবেই!’

শকুনির কথা শুনে একেবারেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন ধৃতরাষ্ট্র।

শুকনো গলায় বললেন, ‘তাহলে উপায়?’

‘উপায় একটা আছে মহারাজ।’ ছলনা মেশানো গলায় বলল শকুনি। ‘আপনি যদি পাণ্ডুপুত্রদের ফিরিয়ে এনে পুনরায় পাশাখেলায় বসাতে পারেন, তাহলে দুর্যোধনকে সম্পূর্ণভাবে বিপন্মুক্ত করতে পারব আমি।’

ধৃতরাষ্ট্রের সবচাইতে কোমল জায়গা দুর্যোধন। দুর্যোধনের জন্য যেকোনো কাজ করতে পারেন তিনি। এটাও করলেন।

পাণ্ডুপুত্রদের অর্ধপথ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। কুরুবৃদ্ধদের জোর-প্রতিবাদ সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরকে পুনরায় পাশাখেলায় বসালেন। এবার কুরুবৃদ্ধরা একজোট হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বাধা দিয়েছেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র ওঁদের কোনো যুক্তি মানেননি। দ্বিতীয়বার পাশাখেলার পক্ষে নিজে কোনো যুক্তিও দেখাননি। কিন্তু গান্ধারী যখন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেন, ধৃতরাষ্ট্র একটি কথাই বললেন, ‘আমি কুরুকুলের সর্বনাশ কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।’

এবারের বাজি ছিল একটাই, চালে হারলে বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, বারো বছর পর এক বছর অজ্ঞাতবাস করতে হবে। এই শর্তের সঙ্গে আরও একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছিল সৌবল শকুনি, ‘এই এক বছর অজ্ঞাতবাসের সময় যদি কাউকে চিনে ফেলা যায়, তাহলে পুনরায় বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে।’

যুধিষ্ঠির পূর্বের মতো এবারও কিছু বলল না। আগের মতো জুয়া খেলতে বসে গেল এবং শকুনির কূটচালে হেরে বসল।

পাণ্ডবরা মা কুন্তীকে রাজপ্রাসাদে রেখে দ্রৌপদীকে নিয়ে বনবাসে গেল।

ওরা বনবাসে চলে গেলে ধর্মদর্শিনী গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন, ‘আপনি বলেছিলেন, কুরুকুলের সর্বনাশ ঠেকাতে পারবেন না আপনি। আপনি কি একবারও ভেবেছেন, এই সর্বনাশের পেছনে কার হাত? কুরুকুলের সর্বনাশের মূল কারণ অবশ্যই দুর্যোধন। কিন্তু কর্ণের দোষ তার চেয়ে কি কম? দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে বলেছে কে? তাকে দাসী বলে অপমানিত করেছে কে? ওই কর্ণই তো? মূল অপরাধ দুর্যোধন করলেও শকুনি আর কর্ণ তাকে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে। মানছি, দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে আসার হুকুম দিয়েছে দুর্যোধন, কিন্তু নিয়ে আসার পর তাকে নিয়ে যে নোংরামিটা হলো, তার কারিগর কে? ওই দুষ্ট কৰ্ণটাই তো? আমি ধিক্কার দিচ্ছি কৰ্ণকে, ধিক্কার দিচ্ছি দুর্যোধন-দুঃশাসনকে। আপনি যদি আমার স্বামী না হতেন, আমার নিন্দার হাত থেকে আপনিও রেহাই পেতেন না রাজা।’

গান্ধারীর সকল অভিযোগ চুপ করে শুনে গিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র।

পাণ্ডবরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল। দ্যূতসভায় পাণ্ডবদের যেভাবে জয় করা হয়েছে, যেভাবে কুলবধূ দ্রৌপদীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, তাতে প্রজাদের মনে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ব্রাহ্মণরা এই প্রজাদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিল।

এই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছিল দুর্যোধন। এতে হস্তিনাপুরের ব্রাহ্মণদের একাংশ কাম্যক বনে অবস্থানরত পাণ্ডবদের কাছে চলে গিয়েছিল।

এই ঘটনার পর প্রজারা বুঝে গিয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্র নামে রাজা, শাসনক্ষমতার পুরোটাই এখন দুর্যোধনের হাতে। আর তার ডান হাত হলো কর্ণ। শকুনি তার মন্ত্রণাদাতা।

দুর্যোধনের দমনপীড়নের ফলে বৈশ্য এবং অন্য সাধারণ প্রজারাও কাম্যক বনে চলে গিয়েছিল। সেখানে রীতিমতো বিশাল এক জনসমাগম তৈরি করে ফেলেছিল তারা। তারা ধৃতরাষ্ট্রকে দোষ দিচ্ছিল না।

তারা আওয়াজ তুলছিল, ‘দুর্যোধন নিপাত যাক। শকুনি আর কর্ণের অশুভ আঁতাত ধ্বংস হোক।’

রাজসভায় বিদুরও বসে থাকল না। ধৃতরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি আর চোখ বুজে থাকবেন না মহারাজ। আপনি যথার্থ রাজার ভূমিকা পালন করুন। আপনি আপনার পুত্র দুর্যোধনকে সাবধান করুন। শ্যালক শকুনি এবং সারথির বেটা কর্ণকে বলুন, যাতে ওরা পাণ্ডবদের বিরোধিতা না করে।

বিদুরের এত কথাতেও ধৃতরাষ্ট্রের দুর্যোধনী-সম্মোহন কাটল না।

ধৃতরাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা দেখে বিদুরও একদিন পাণ্ডবদের কাছে চলে গেল।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দুর্যোধন।

কিন্তু পাণ্ডবসন্নিধানে বিদুর বেশিদিন থাকল না। রাজপ্রাসাদে ফিরে এলো। তাতে দুর্যোধন একেবারেই মুষড়ে পড়ল। কারণ বিদুরকে সে কৌরবহিতাকাঙ্ক্ষী বলে মনে করে না।

বলে, ‘এই বিদুরটা পাণ্ডবদের বন্ধু। পাণ্ডবদেরই মঙ্গল চায় সে সর্বদা।’

দুর্যোধনের এই তাচ্ছিল্য দেখে কর্ণেরও সাহস বেড়ে গিয়েছিল। দুর্যোধনের চোখেই সে কুরুবৃদ্ধদের দেখতে শুরু করল।

দুর্যোধনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সে বলল, ‘তুমি শুধু বিদুরকে সন্দেহ করছ কেন? অন্যরাও কি কম? এই যে তোমাদের পিতামহ ভীষ্ম আর ওই যে সাম্প্রদায়িক বুড়ো বামুন দ্রোণাচার্যটা, মেদামারা কৃপটা—এদের কেউই তোমার কল্যাণ চান না বন্ধু। এঁরা খান মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের, মঙ্গল চান ওই অর্জুনদের।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ কর্ণ, রাজপ্রাসাদে আমি নিরাপদ নই। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘শত্রু আর আগুন—এ দুটোর অবশেষ রাখতে নেই।’

‘তোমার কথা বুঝলাম না কৰ্ণ!’

‘শত্রুকে সমূলে উৎপাটন করো।’

‘কাদের কথা বলছ?’

‘পাণ্ডবদের কথা বলছি। আক্রমণ করে ওদের ধ্বংস করে দাও। ওরা মরলে প্রাসাদের এই বুড়োরা চুপসে যাবে একেবারে।’

‘পাণ্ডবদের আক্রমণ করব?’

‘এই তো সময়। নিরস্ত্র তারা। বনবাসী এবং অসহায়। তাছাড়া খাদ্যাভাবেও আছে। বনে- অরণ্যে অত খাবারদাবার কোথায়?’ পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠিয়েও কর্ণের মনে প্রতিশোধের ধিকিধিকি জ্বালা।

‘কিন্তু পিতার অনুমতি ছাড়া তো পাণ্ডবদের আক্রমণ করা যাবে না!’

‘মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি আদায় করো। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। তোমার প্রার্থনা ফেলবেন না।’

কিন্তু দুর্যোধন পাণ্ডব-আক্রমণের অনুমতি চাইতে গেলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অনুমতি দিলেন না। উপরন্তু বললেন, ‘এখন তুমি কণ্টকমুক্ত। নিজের মতো করে রাজ্যটাকে গুছিয়ে নাও। আমি আর কতদিন! কুরুরাজ্য তো তোমাকেই চালাতে হবে!’

পিতার কথায় আপাতত থেমে গিয়েছিল দুর্যোধন।

কিন্তু কর্ণ তাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। সর্বদা দুর্যোধনের মনে পাণ্ডবভীতি চাগিয়ে রেখেছে। এবং পাণ্ডবদের ধ্বংস করার নতুন কোনো সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে।

একদিন সেই সুযোগটা এসে উপস্থিত হলো।

সেদিন রাজসভায় সিংহাসনে বসেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। সেদিন দুর্যোধন বা কর্ণ—কেউই ছিল না রাজদরবারে। শকুনি ছিল।

হঠাৎ এক ব্রাহ্মণ প্রবেশ করল রাজসভায়।

ধৃতরাষ্ট্রকে সম্মান জানিয়ে বলল, ‘মহারাজ, আমি বনে বনে ঘুরে বেড়ানো ব্রাহ্মণ। ঘুরতে ঘুরতে আমি একদিন দ্বৈতবনে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেখানে পাণ্ডবরা এখন নিদারুণ কষ্টে আছে মহারাজ। আপনি দয়াবান নৃপতি। আপনি ওঁদের ফিরিয়ে আনুন। কষ্ট থেকে উদ্ধার করুন ওঁদের।’

ব্রাহ্মণের আকুতিতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানালেন না ধৃতরাষ্ট্র।

শকুনি অচিরেই তথ্যটি দুর্যোধন-কর্ণের কাছে সরবরাহ করল।

এতে দুর্যোধনের চেয়ে কর্ণই বেশি খুশি হলো। তৎক্ষণাৎ তার মাথায় নতুন একটি পরিকল্পনার উদয় হলো।

পরিকল্পনাটি হলো দুর্যোধনকে অহংকারী করে তোলা।

ছত্রিশ

কর্ণ বলল, ‘বহুদিন হলো তোমার সঙ্গে বেড়াতে বের হইনি দুর্যোধন। আজ যাবে আমার সঙ্গে? বেড়াতে?

দুর্যোধন একটু অবাক হয়ে কর্ণের দিকে তাকাল। কর্ণ তো শুধু শুধু বেড়ানোর লোক নয়! তার প্রতিটি পদক্ষেপের একটা উদ্দেশ্য থাকে। আজও এই প্রস্তাবের পেছনে নিশ্চয়ই একটা উদ্দেশ্য আছে। দুর্যোধন বুদ্ধিমান। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। দুর্যোধন ঠিক করল, তার বুঝতে পারার ব্যাপারটা কর্ণকে বুঝতে দেবে না।

‘বেড়াতে যাবে! কোথায় যাবে?’ মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল দুর্যোধন।

‘আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানেই চলো আজ। কী, আমার সঙ্গে যেতে ভরসা পাচ্ছ তো?’

‘কী যে বলো না বন্ধু! তোমার সঙ্গে যেতে আমি ভরসা পাব না!’

‘তাহলে চলো। ঘোড়ায় ওঠো। আজ রথে চড়ে নয়। ঘোড়ার পিঠেই দুজনে বেড়াতে বেরোব আজ।

সেই অপরাহ্ণে রাজপ্রাসাদ থেকে দুটো ঘোড়া বেরিয়েছিল। একটি শ্বেতশুভ্র, অন্যটি মিশমিশে কালো। সাদা ঘোড়ায় চড়েছিল দুর্যোধন, কালোটার পিঠে কর্ণ। দুটো ঘোড়াই সবল, তেজি। ভাগীরথীর তীরের দিকেই ঘোড়া দুটো ছুটতে শুরু করেছিল, পাশাপাশি। রাজপথ ফুরিয়ে এসেছিল একসময়। তারপর মেটে পথ। এরপর নদীপাড়। ওরা দুজনের কেউই জানল না, ছোট্ট একটা সৈন্যদল তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে এসেছে। দলনেতা দুঃশাসন। দুর্যোধনকে একা ছাড়তে নারাজ দুঃশাসন। প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসে সে দাদাকে।

একটা জায়গায় এসে ঘোড়া থামাল কর্ণ। তার দেখাদেখি দুর্যোধনও। নামল দুজনে। নদীতীর প্রশস্ত এখানে। জায়গাটা বৃক্ষবহুল। সামনে বিশালাকার ভাগীরথী বুকে অগাধ জল নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

সূর্যের তেজ আজ সহনীয়। অপরাহ্ণ বলে তেজে তীব্রতা নেই। নদীকে সামনে রেখে বিরাট এক বৃক্ষশিকড়ে বসল দুজনে। মুখোমুখি।

কর্ণের কথা শুনবে বলে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল দুর্যোধন। ঠিক ওই সময় কর্ণ বলল, ‘মহারাজ দুর্যোধন।

চমকে কর্ণের চোখে চোখ রাখল দুর্যোধন। তার চোখেমুখে বিরাট জিজ্ঞাসাচিহ্ন—মহারাজ!

কর্ণ বলল, ‘তুমি অবাক হচ্ছ কেন বন্ধু? তুমি তো এই কুরুরাজ্যের মহারাজই! তোমার পিতার বয়স হয়ে গেছে। তুমি উপযুক্ত হয়ে উঠেছ। তোমার এই হস্তিনাপুরের রাজা হওয়া তো শুধু সময়ের ব্যাপার! তুমি তো রাজা! মহারাজাই তো তুমি! তোমাকে মহারাজ সম্বোধন করে মোটেই ভুল করিনি আমি।’

কর্ণের এমন কথা শুনে বিভোর হলো দুর্যোধন। এই ‘মহারাজ’ সম্বোধনটি শুনতে বেশ ভালো লাগল তার।

‘এই সমস্ত বসুন্ধরা এখন তোমার হাতের মুঠোয়।’ ডান হাতকে যতটুকু উঁচু করা যায়, ততটুকু উঁচু করে বলল কর্ণ। ‘সামন্তরাজারা তোমার আদেশের প্রতীক্ষা করে সবসময়। তোমার এই ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্য-প্রতিপত্তি দেখে যদি পাণ্ডবদের কষ্টই না লাগল, তাহলে ওই সবের মানে থাকে না বন্ধু।’

‘তুমি যা বলেছ, সব ঠিক আছে। কিন্তু এসব কথার প্রকৃত মানেটা আমি ধরতে পারছি না কর্ণ।’ ইতস্তত কণ্ঠে বলল দুর্যোধন।

কর্ণ বলল, ‘তোমার অফুরান সম্পত্তি আছে, পাণ্ডবদের কানাকড়ি নেই—তোমার এই বাড়বাড়ন্ত পাণ্ডবদের দেখানো দরকার। সত্যি এটা যে দুর্যোধন, তোমার ধনসম্পত্তি-রাজ্যপাট যদি বনবাসী দুর্বিপাকগ্রস্ত পাণ্ডুপুত্রদের দেখিয়ে তাদের ব্যাকুল করে তুলতে না পারো, তাহলে সুখ কোথায়?’

দুর্যোধন চকচকে চোখে বলল, ‘আমাকে কী করতে বলো তুমি?’

‘তুমি এক কাজ করো। পাণ্ডবরা এখন দ্বৈতবনে কুটির বেঁধে বাস করছে। চলো, আমরা সকলে মিলে ওখানে যাই। তুমি যাবে রাজার সাজে। তোমার সঙ্গে থাকবে অগণন দাসদাসী। তোমাকে দেখে বাকলপরা অর্জুনের মনের কী হাল হবে ভেবে দেখো।’

কর্ণের প্রস্তাবটা দুর্যোধনের বেশ মনে ধরে গেল। অহংকারে তার বুক ফুলে উঠল। কর্ণ বেশ বলেছে! পাণ্ডুপুত্রদের শোকাতুর করে তোলার এটাই সুবর্ণসুযোগ।

দুর্যোধন বলল, ‘পিতার কাছ থেকে কৌশলে অনুমতি আদায় করে নিচ্ছি আমি।’

কর্ণ বলল, ‘তা তুমি নিতে পারবে, আমি জানি। ও হ্যাঁ, কুরুবাড়ির বউদেরও সঙ্গে নেবে। তারা সেজেগুজে জীর্ণবস্ত্রপরা দ্রৌপদীর সামনে ঘুরে বেড়াবে। দ্রৌপদী তখন ভাববে, পাণ্ডবদের বিয়ে করে কী ভুলটাই না করেছে সে!’

দুর্যোধন আগে কখনো এভাবে ভাবেনি। কর্ণ বলায়, তার মনে হলো—আরে, তাই তো! এভাবে তো পাণ্ডবদের বেশটুকু হেনস্তা করা যায়! এরকম করে কর্ণের আগে কেন ভাবেনি সে?

দুর্যোধন নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা ঢেকে বলল, ‘বন্ধু কর্ণ, তুমি যা বললে তা আমার মনেও ছিল। কিন্তু পিতার অনুমতি মিলবে না বলে এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিলাম আমি। আর চুপচাপ থাকব না। পিতার সঙ্গে দেখা করে কিছু একটা করব এবার।’

হৃষ্টচিত্তে দুজনেই ভাগীরথীতীর থেকে রাজপ্রাসাদে ফিরে এসেছিল।

পরদিন সকালবেলাতেই দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা করে কর্ণ বলল, ‘দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের কুটিরের কাছাকাছি হস্তিনাপুরের খাসপ্রজা গয়লাদের বাড়ি। যেখানে রাজবাড়ির গোধন লালিতপালিত হয়। ওই গোয়ালাদের আমন্ত্রণ পেয়েছ তুমি। সেখানে যাবে। গোধনের হিসাব-সংখ্যা দেখেশুনে আসবে তুমি। এই কথাগুলো মহারাজকে গিয়ে বলো। দেখবে—সানন্দে রাজি হয়ে যাবেন তিনি।’

শুনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। বলেছিলেন, ‘গরুবাছুরদের গণনাশেষে মৃগয়াটাও করে এসো বাছা।’

কর্ণ, দুঃশাসন এবং শকুনিকে নিয়ে দুর্যোধন দ্বৈতবনের উদ্দেশে যাত্রা করল। সঙ্গে থাকল সৈন্যসামন্ত, রথ, হস্তী। আর থাকল ঐশ্বর্যময়ী সালঙ্কারা কুলবধূরা।

আগেই এক গোয়ালাকে দিয়ে দ্বৈতবনের ঘোষপল্লিতে খবর পাঠানো হয়েছিল—ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধন সপরিবারে যাচ্ছেন সেখানে। গরুশুমারি করবেন তিনি। সবাই প্রস্তুত থাকে যেন। সংবাদ পেয়ে ঘোষপল্লিতে সাজসাজ রব উঠল

রাজ-উদ্যোগে দ্বৈতবনের চেহারার অনেকটাই পালটে গেল। থাকার বিশাল ব্যবস্থা, খাওয়ার এলাহি আয়োজন। আর নাচ-গানের বিপুল উচ্ছ্বাসে সমস্ত অরণ্য ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলো।

ঘোষপল্লিতে গরুগণনার কাজ শেষ করে সপারিষদ মৃগয়ায় গেল দুর্যোধন। মৃগয়ায় যাওয়ার পথে সরোবরটা দেখল সে। জানল—এই সরোবরের পশ্চিমপাড়ে পাণ্ডুপুত্ররা পর্ণকুটির বানিয়ে দ্রৌপদীকে নিয়ে বাস করছে।

মৃগয়া থেকে ফিরেই ওই সরোবরের পূর্বধারে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন বাড়ি বানাতে কারিগরদের নির্দেশ দিল দুর্যোধন। এধার থেকে ওধারের পাণ্ডবদের বিষণ্ণ করে তুলতে সুবিধা হবে খুব।

কিন্তু পূর্বধারে বাড়ি বানাতে গিয়ে বিপত্তিটা ঘটল।

অনেক আগে থেকেই গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন সরোবরের পূর্বধার দখল করে ছিল। কারিগররা দুর্যোধনের দেমাক নিয়ে বাড়ি বানাতে গেল। চিত্রসেনের সৈন্যদের সঙ্গে প্রথমে তর্কাতর্কি। তারপর তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধে চিত্রসেন আর দুর্যোধনরাও জড়িয়ে পড়ল। ওপারে পাণ্ডবরা—তাদের সামনে চিত্রসেনকে গুঁড়িয়ে দিতে পারলে কৌরব-অহংকার বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং এই যুদ্ধে জেতা চাই। কিন্তু দুর্যোধনের সঙ্গে তো তেমন চৌকস সেনাবাহিনী ছিল না! সাধারণ একটা সৈন্যদল নিয়ে ঘোষপল্লিতে এসেছিল সে। ওই সৈন্যদল গান্ধর্বসৈন্যদের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। প্রধান প্রধান কুরুসেনা হেরে গেলে কর্ণ যুদ্ধে নামল। প্রচণ্ড যুদ্ধে অনেক গান্ধর্বসেনাকে হত্যা করল কৰ্ণ। কিন্তু চিত্রসেনকে কাবু করতে পারল না। চিত্রসেন মায়াযুদ্ধ জানে। একসময় কর্ণ দেখল, তার আশেপাশে দুর্যোধন-দুঃশাসন কেউই নেই। এবং চিত্রসেন গান্ধর্বসৈন্য দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধের একপর্যায়ে গান্ধর্বসেনাদের কেউ কর্ণের রথ ভাঙে, কেউ ধ্বজা কেটে দেয়, কেউ রথের চাকা নিয়ে পালায়, কেউ-বা রথের ঘোড়া মারে। শেষে চিত্রসেন কর্ণকে বাণাঘাতে এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলল যে অন্য একটা রথে চড়ে যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ করে যেতে বাধ্য হলো কৰ্ণ।

কুরুসেনারা রণে ভঙ্গ দিলে দুর্যোধন সস্ত্রীক বন্দি হলো চিত্রসেনের হাতে। দুঃশাসনরাও বাদ গেল না।

এই সংবাদটা পাণ্ডবদের কাছে পৌঁছলে ভীমার্জুন খুব খুশি হলো। কিন্তু যুধিষ্ঠির দুর্যোধনদের বন্দিদশা আর কুরুসেনাদের পরাজয় মেনে নিতে পারল না। ভীমার্জুনকে নির্দেশ দিল চিত্রসেনকে পরাস্ত করে দুর্যোধনদের এবং তাদের স্ত্রীদের মুক্ত করতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদার আদেশ পালন করল ওরা।

দুর্যোধন লজ্জায় মাথা নত করে হস্তিনাপুরের দিকে রওনা দিল। নিজের ওপর অশ্রদ্ধায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করল তার। এই সময় কর্ণ এসে উপস্থিত হলো কোত্থেকে। কর্ণ একজন তেজি পুরুষ, ধনুর্বিদ সে। যুদ্ধদক্ষ হিসেবে সমস্ত ভারতবর্ষে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। এরকম একজন মানুষের নির্লজ্জতা মানায় না। কিন্তু কেন জানি কর্ণ আজ তার সকল সুদৃঢ় চারিত্র্য বিসর্জন দিল। যেন কিছুই হয়নি এমনভাব করে দুর্যোধনকে বলল, ‘বাঃ বাঃ! তোমরা তাহলে চিত্রসেনকে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করতে পেরেছ? এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’

দুর্যোধনের সেই মুহূর্তে কর্ণের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, আবার কর্ণের মনেও ব্যথা দিতে রাজি নয় সে।

কষ্টের একচিলতে হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে কর্ণ?’

আজ যেন কর্ণ সকল লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছে, যেন আজ সে চিত্রসেনের হাতে বিধ্বস্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচেনি! একেবারেই স্বাভাবিক কণ্ঠে কৰ্ণ বলল, ‘তোমরা তো দেখেছই গন্ধর্বরা আমাকে কীভাবে ঘিরে ধরেছে? তারপরও কি আমি ছেড়েছি? চিত্রসেনকে লেজেগোবরে করে ছেড়েছি আমি…।’

মাঝপথে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘থাক, থাক আর বলতে হবে না।’ কর্ণের মিথ্যেবলা ওই মুহূর্তে মোটেই ভালো লাগছিল না দুর্যোধনের।

দুর্যোধনের কথাকে সরিয়ে রেখে কর্ণ তবু বলল, ‘আমার খুব গৌরব হচ্ছে তুমি চিত্রসেনকে পরাজিত করতে পেরেছ।

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন বুঝল—তার সস্ত্রীক বন্দি হওয়া, পাণ্ডবদের বীরত্বে তাদের মুক্তি পাওয়ার কোনো সংবাদই কর্ণ জানে না। একবার ভাবল—কর্ণকে এসবের কিছুই বলবে না। আবার ভাবল—না, কিছুই লুকাবে না কর্ণের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গম্ভীর হতমান কণ্ঠে আদ্যপ্রান্ত খুলে বলল। এবং সবশেষে বলল, ‘এই অপমানের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই না আমি। আমি আত্মহত্যা করব। আমার পরিবর্তে দুঃশাসন যুবরাজ হবে।’

দুর্যোধনের বিলাপে কর্ণ তার আত্মধিক্কার আর হতাশার গভীরতা অনুধাবন করতে পারল। এতকালের বন্ধু দুর্যোধনকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না।

হাবেভাবে উদাসীনতা ঢেলে কর্ণ বলল, ‘আচ্ছা বন্ধু, বোকার মতো এত কষ্ট পাচ্ছ কেন তুমি?’

‘বোকার মতো!’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল দুর্যোধন।

‘নয়তো কী? এই বন কুরুশাসনের অধীনে। এখানে যারা বাস করে তারা সবাই তোমার প্রজা। পাণ্ডবরাও এখানে বাস করে বলে ওরাও তোমার প্রজা। রাজার সংকটে প্রজার সাহায্য করা কর্তব্য। চিত্রসেনের হাত থেকে পাণ্ডবরা তোমাকে মুক্ত করে প্রজার কর্তব্য করেছে। তাতে এত মুষড়ে পড়ার কী আছে, হ্যাঁ?’

কর্ণের কথায় দুর্যোধনের মন কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠল।

তার মনের সকল আবিলতা কেটে গেল যখন শকুনি বলল, ‘কর্ণ যথার্থই বলেছে ভাগনে। পাণ্ডবরা শুধু তো তোমার প্রজা নয়, দাসও। সুতরাং দাসদের সাহায্যের ব্যাপারটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন তুমি? চলো চলো, হস্তিনাপুরে ফিরে চলো।’

মাতুলের কথা শুনে দুর্যোধনের হতাশা কেটে গেল।

সবাইকে নিয়ে হস্তিনায় ফিরে এলো দুর্যোধন।

সাঁইত্রিশ

দুর্যোধন ভেবে নিয়েছিল—দ্বৈতবনে তার পরাজয়বৃত্তান্ত এবং পাণ্ডবসহায়তার কথা গোপন থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। দুর্যোধনের দল হস্তিনাপুরে পৌঁছার আগেই দ্বৈতবনকাহিনি পিতামহ ভীষ্মের কানে পৌঁছে গিয়েছিল।

কুরু-অধিপতি শান্তনুর আমল থেকে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম হস্তিনাপুরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। প্রাসাদীয় অভিজ্ঞতা তাঁর অগাধ। ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুরা তাঁর চোখের সামনেই জন্মাল। দুর্যোধন-যুধিষ্ঠির-কর্ণরা তো তাঁর কাছে দুধের শিশু! রাজ-অন্তঃপুরে এবং রাজসভায় পিতামহ ভীষ্মের বিপুল প্রতিপত্তি। যদিও ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি কখনো স্নেহবশত, কখনো-বা দুর্মদ দুর্যোধনের দুর্ব্যবহারের ভয়ে ভীষ্ম তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শন করেননি মাঝেমধ্যে। কিন্তু যথাসময়ে যথোপযুক্ত স্থানে প্রতিবাদ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না ভীষ্ম। রাজসিংহাসনে আরোহণ করেননি বটে, কুরুরাজনীতি থেকে নিজেকে কখনো বিযুক্তও করেননি। তার নিজস্ব একটা গুপ্তচরবাহিনী আছে। সেই বাহিনী তাঁকে রাজ্যের সকল তথ্য সরবরাহ করে। এই বাহিনীপ্রধান পিতামহের কাছে দ্বৈতবনে দুর্যোধনলাঞ্ছনার বৃত্তান্ত আগেভাগে পৌঁছে দিয়েছে।

বহু আগে, যখন হিমালয় থেকে আগত পাণ্ডুপুত্রদের গ্রহণ-অগ্রহণের প্রশ্ন উঠেছে, যখন হস্তিনাপুরের যুবরাজ কে হবে—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, পাণ্ডবদের কুরুরাজ্য ভাগ করে দেওয়া উচিত নাকি উচিত নয়—এ নিয়ে কথা উঠেছে, তখন কুরুরাজসভা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। কৌরবপক্ষ আর পাণ্ডবপক্ষ। কৌরবপক্ষ বাহুবলকে সম্বল করেছে, পাণ্ডবপক্ষ বুদ্ধিবলকে মূলধন করেছে। ভীষ্ম- দ্রোণ-কৃপ—সবসময় পাণ্ডবজয়গানে মুখর থেকেছেন। এঁরা সর্বদা পাণ্ডবপক্ষের হয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন—এই প্রাসাদীয়দ্বন্দ্বে অবশ্যই ধর্মের জয় হবে। তাঁরা পাণ্ডবপক্ষকে ধর্মপক্ষ ভেবেছেন আর কৌরবদলকে ভেবেছেন অধর্মের ধ্বজাধারী। বিদুরও এইসব কুরুবৃদ্ধের অনুবর্তী হয়ে চলেছে। যদিও সে ধৃতরাষ্ট্রের ভাই, ধৃতরাষ্ট্রই বিদুর এবং বিদুরপরিবারের ভরণপোষণের সকল দায়ভার বহন করেন, তারপরও বিদুর পাণ্ডুপুত্রদেরই বেশি পছন্দ করে। কারণ পাণ্ডুপত্নী কুন্তীর প্রতি তার বিশেষ টান। কুন্তী বিদুরের সবচাইতে প্রিয় নাম। এজন্য বিদুরের কাছে কৌরবরা জঘন্য, পাণ্ডুর কানীনপুত্ররা বড় আপন। সেজন্য কৌরবদের নিন্দার সুযোগ যখন আসে অথবা পাণ্ডুপুত্রদের জয়গানের সুযোগ, দুটোই জোরেশোরে করে।

দ্বৈতবন থেকে দুর্যোধন ফিরেছে যখন, বেশ হৃষ্টচিত্ত। কর্ণ আর শকুনির প্রণোদনামূলক কথায় দ্বৈতবনের অপমান-লাঞ্ছনার কথা ভুলে গিয়েছে তখন দুর্যোধন। বেশ প্রফুল্ল মেজাজ নিয়ে প্রাসাদে ফিরল সে।

কর্ণ-দুর্যোধন—দুজনকে একসঙ্গে পেয়ে গেলেন ভীষ্ম। কথায় ভূমিকা পছন্দ করেন না পিতামহ। সরাসরিই বললেন, ‘তা বাছা দুর্যোধন, তোমাকে আগেই দ্বৈতবনে যেতে বারণ করেছিলাম। শোনোনি। দুষ্ট লোকের খপ্পরে পড়ে আমার কথাকে তেতো মনে হয়েছিল তখন। এখন জিজ্ঞেস করি, মুখটা কি এখন তোমার তেতোতে ভরা, না মিষ্টিতে?’

দুর্যোধন পিতামহের কথা ধরতে পারছে, আবার পারছেও না। দ্বৈতবনের কথা তো পিতামহের জানার কথা নয়! তাহলে? তিনি বললেন তো দ্বৈতবনের নাম!

ইতস্তত চোখে ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে থাকল দুর্যোধন।

ভীষ্ম বললেন, ‘বুঝতে পারছ না বোধহয় আমার কথা?’

দুর্যোধন ওপরে-নিচে মাথা নাড়তে গিয়ে ডানে-বাঁয়ে নেড়ে ফেলল।

ক্রূর হাসি হেসে পিতামহ বললেন, ‘সামান্য একজন গন্ধর্ব চিত্রসেন। ও বেটার হাতে বন্দি হতে কেমন লাগল? যে পাণ্ডুপুত্রদের চক্রান্ত করে রাজ্যচ্যুত করলে, বনবাসী করলে, সেই পাণ্ডুপুত্ররাই তো বাঁচাল তোমায়! শুধু তোমায় বলছি কেন, যে কুলনারীরা এই কুরুরাজপ্রাসাদের ইজ্জত, সেই ইজ্জতকেই তো বেইজ্জতির হাত থেকে রক্ষা করল ভীম আর অর্জুনে! ওদের সাহায্য নিতে লজ্জা করল না তোমার? ছি ছি!’

ঘৃণায় ভীষ্মের কণ্ঠ বুজে আসতে চাইল।

তখনই কর্ণের ওপর চোখ পড়ল পিতামহের।

আবার জ্বলে উঠলেন তিনি, ‘আর এই যে সারথির পো কর্ণ, সে তো প্রাণের ভয়ে পালিয়েই গেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে! গন্ধর্বদের আঘাতে তোমরা যখন ছারখার হচ্ছিলে, বেশ তো কর্ণ কর্ণ বলে ডাক ছাড়ছিলে, তখন তোমার এই কর্ণ কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করো। আরে, জিজ্ঞেস করবে কী? জিজ্ঞেস করলে সে তো উত্তর দিতে পারবে না। আমি বলছি শোনো, ওই সূতপুত্রটি তখন লেজ গুটিয়ে সরে পড়েছিল তোমাদের বিপদের মধ্যে রেখে।’

এত কড়া কথা সহ্য করার লোক নয় কর্ণ। কিন্তু আজ ভীষ্মের সত্যকথার সামনে পড়ে একেবারে কুঁকড়ে গেল। দুর্যোধনও এত রূঢ় কথা শুনতে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু পিতামহের কথার উত্তরে কিছু বলার শক্তি হারিয়ে বসল দুর্যোধন।

আজ যে পিতামহেরই কথা বলার দিন, ‘কর্ণের ক্ষমতা দেখলে তো আজ? অর্জুনেরও ক্ষমতা দেখে এলে। এখন বলো, কার শক্তি বেশি? কর্ণের, না অর্জুনের? জানি, সত্যকথাটি তোমার মুখ দিয়ে বের হবে না দুর্যোধন। আমি বলছি—কর্ণ অর্জুনের পায়ের নখের যুগ্যিও নয়।’ বলে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে লাগলেন ভীষ্ম।

রুক্ষ চোখে কর্ণ ভীষ্মের দিকে তাকাল। দুর্যোধন কী একটা বলতে চাইল।

তর্জনী উঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন পিতামহ, ‘সার কথাটা বলি শোনো দুর্যোধন, পাণ্ডবদের সঙ্গে তুমি সন্ধি করো। সেটাই হবে তোমার জন্য চরম মঙ্গলের।’

ভীষ্মের কথা শুনে গরগর করতে শুরু করল দুর্যোধন। পিতামহের কথার উত্তর দেওয়ার সৌজন্যটুকু দেখাল না। পিতামহের মুখের ওপর অবজ্ঞার এক হাসি হেসে কর্ণের হাত ধরে প্রাসাদাভ্যন্তরে চলে গেল।  

যেতে যেতে কর্ণ বলল, ‘তোমাদের পিতামহটা আমাদের একদম পছন্দ করেন না। সবসময় ওঁর মুখে শুধু পাণ্ডবদের প্রশংসাই শুনবে। তোমার ভালো কাজটা চোখে পড়ে না বুড়োর। তোমাকে দেখতে পারেন না বলে আমাকেও দেখতে পারেন না।’ দুর্যোধনকে জড়িয়ে নিয়ে কর্ণ নিজের কথাই বলল। কর্ণ পিতামহের বিরুদ্ধে বলছে, তিনি তাকে অপমান করে গেলেন বলে নয়, দুর্যোধনকে অপমান করে গেলেন বলে—এরকম করেই বোঝাতে চাইল কর্ণ দুর্যোধনকে।

‘আর যা-ই সহ্য করি বন্ধু, তোমার নিন্দা সহ্য করতে পারি না।’ কর্ণের চোখে ক্রোধ।

কর্ণের কথা শুনে মনটা আনন্দে ভরে উঠল দুর্যোধনের।

দুর্যোধনের আনন্দ দেখে কর্ণ উৎসাহ পেল। বুঝল—তার সৌহার্দপনা দুর্যোধনের মন ছুঁয়েছে। জীবনের প্রথম থেকেই কর্ণ লক্ষ করে আসছে, পিতামহ ভীষ্ম তাকে পছন্দ করেন না। তার অপরাধটা কী—তা অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারেনি। সেটা কি সে সূতপুত্র বলে? নিম্নকুলে লালিত বলে কি তিনি কর্ণকে সহ্য করতে পারেন না? তিনি কি উচ্চবর্ণীয় জননীর গর্ভে জন্মেছেন? তাঁর মা ব্রাহ্মণী? তা তো নয়! তিনি জন্মেছেন তো শূদ্রাণী মৎস্যগন্ধার গর্ভে! পিতা পরাশর না হয় ব্রাহ্মণ! কিন্তু দুরাচারী ব্রাহ্মণই তো পরাশর! জেলেকন্যাকে ধর্ষণ করে যে, সে দুরাচারী নয় তো কী? এই ভীষ্ম যখন তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকান, তখন ক্রোধে ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে কর্ণের।

হ্যাঁ, পরবর্তীকালে তাকে ঘৃণা করার কারণ খুঁজে পেয়েছে কর্ণ। বহিরাগত পাণ্ডুপুত্রদের মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসতে শুরু করলেন ভীষ্ম আর বিদুর। পাণ্ডবপ্রীতির প্রতিযোগিতায় ওঁরা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী! সমানমাত্রায় এই দুজন দুর্যোধনদের অবহেলা-ঘৃণা করেন। কেন করেন, তার উত্তর জানা নেই কর্ণের। ওঁরা, ওঁদের দেখাদেখি দ্রোণ-কৃপরাও বলেন, পাণ্ডবরা নাকি ন্যায়বান, আর কৌরবরা অধর্ম যার অন্যায়ের প্রতিভূ। এই তথাকথিত অধর্মের দোহাই দিয়ে ভীষ্মরা কৌরবদের ভালোবাসেন না। কৌরবরা তো নির্বোধ নয়! ভীষ্মদের ঘৃণা বুঝতে দুঃশাসনদের তো বেগ পেতে হয় না! ওরা যদিও ভালোবাসার কাঙাল, কিন্তু যাঁরা তাদের ভালোবাসেন না, তাঁদের শ্রদ্ধা করে কী করে কৌরবরা? তাই তো দুর্যোধন-দুঃশাসনরা ভীষ্ম-কৃপ-দ্রোণ-বিদুরের সঙ্গে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে কথা বলে না! তাতে কর্ণের দোষ কী? কর্ণের অপরাধ হলো সে দুর্যোধনের বন্ধু। শত্রুর বন্ধুও শত্রু—এই কথাটি মনে রেখেই ভীষ্ম সর্বদা তার সঙ্গে অসদাচরণ করেন। আরেকটা কারণ তো আছেই! কর্ণ অর্জুনকে পছন্দ করে না, ধনুর্বিদ্যায় নিজের প্রতিপক্ষ মনে করে অর্জুনকে। একজন ধনুর্বিদ আরেকজন ধনুর্বিদকে প্রতিপক্ষ মনে করা তো স্বাভাবিক! অর্জুনও তো কর্ণকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে! এতে যদি শত্রুতা বা ঘৃণা তৈরি হয়, তা হওয়া উচিত প্রতিদ্বন্দ্বী দুজনের মধ্যে! ভীষ্ম বা দ্রোণ বা বিদুরের মধ্যে তো তা তৈরি হওয়ার কথা নয়! কিন্তু সত্য এটা যে, ভীষ্ম- দ্রোণ-বিদুররা পক্ষপাতহীন নন। অর্জুনের শত্রু বলে তাঁরা দলবেঁধে কর্ণকে ঘৃণা করেন, সুযোগ পেলে অপদস্থ করেন। যেমন আজকে ভীষ্ম করে গেলেন।

এসব ঘৃণা-অবহেলা পেতে পেতে কর্ণের মনও বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছে। তার ভেতর থেকে কুরুবৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উবে গেছে। এখন আর ভীষ্ম-দ্রোণকে ছেড়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না কর্ণের। সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যেমন আজকে পিতামহের তাচ্ছিল্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সে। এই ক্ষিপ্ততার সঙ্গে দুর্যোধনের অবজ্ঞা মিলিত হয়ে কর্ণকে আরও ক্ষুভিত করে তুলল।

সেই অবস্থাতেই কর্ণ বলল, ‘তোমাদের পিতামহ ভীষ্ম সবসময় তোমার সামনে আমাকে খাটো করেন। এই অপমান আমার আর ভালো লাগে না বন্ধু! সবসময় পাণ্ডবদের প্রশংসা আর তোমার নিন্দা—এ আমার মোটেই সহ্য হয় না দুর্যোধন।’ কর্ণের গলা বুজে আসতে চাইল। ‘তুমি যদি চাও এখনই আমি পৃথিবী জয় করে এনে দিতে পারি তোমায়। যে সমস্ত সামন্তরাজ্য একসময় পাণ্ডবরা জিতেছিল, যদি বলো ওসব রাজ্য একাই জিতে এনে দিতে পারি আমি। কুরুকুলের ওই দুষ্টবুদ্ধি বুড়োটা দেখুন, আমার ক্ষমতা কত! তুমি আমাকে অনুমতি দাও বন্ধু, আমি দিগ্বিজয় করতে বের হতে চাই। বেটা, সর্বদা অর্জুনের প্রশংসা করে, কর্ণকে চোখে দেখে না! শেষবাক্যটি যে ভীষ্মের প্রতি, দুর্যোধনের বুঝতে অসুবিধা হয় না।

দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের রক্তের সম্পর্ক নয়। রক্তের সম্পর্ক পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে। পিতামহ কুরুকুলের সবচাইতে সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। ধৃতরাষ্ট্র থেকে সাধারণ প্রহরী পর্যন্ত সবাই ভীষ্মকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন। শুধু শ্রদ্ধা করে না কর্ণ। দুর্যোধনও। কিন্তু বাহ্যিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সময় দুর্যোধন কখনো ভীষ্মকে অবহেলা দেখায় না। তার সামনে কর্ণ যখন ভীষ্মের প্রতি অবহেলার বাক্য বর্ষণ করে যাচ্ছে, কুরুবংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে দুর্যোধনের ভীষ্মের পক্ষ নেওয়া উচিত। কর্ণকে বলা উচিত ‘পিতামহ তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করেছেন, মানি। নানা সময়ে তোমাকে অপদস্থ করেন, তাও অস্বীকার করছি না। কিন্তু পিতামহের প্রতি কটূক্তি করার সময় বন্ধু কর্ণ তোমার মনে রাখা কর্তব্য, তিনি আমার পূর্বপুরুষ। তাঁর নাম শুনলে গোটা হস্তিনাপুর শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। সেই তাঁকে তোমার অশ্রদ্ধা দেখানো উচিত নয় কৰ্ণ।’

কিন্তু এসবের কিছুই বলে না দুর্যোধন। উপরন্তু রাজ্যজয়ের কথা শুনে সপ্রশংস দৃষ্টিতে কর্ণের দিকে তাকায়।

উজ্জ্বল চোখে বলে, ‘তোমার কথা শুনে আমি ধন্য হলাম বন্ধু। তোমার মতো সুহৃদ মানুষের জীবনে একজন থাকলেই হয়। তোমার মতো একজন মহাপরাক্রমশালী সবসময় আমার মঙ্গল চিন্তা করে যাচ্ছ, ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি আমি।’

তারপর কণ্ঠে আনন্দাবেগ মিশিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে দুর্যোধন বলে উঠল, ‘যাও বীর, তুমি বিশ্বভুবন জয় করে ফিরে এসো।’

পাণ্ডবরা একদিন দিগ্বিজয় করতে বেরিয়েছিল, সেদিন গর্ববোধ হয়নি দুর্যোধনের। কারণ ওই বিজয়ের সঙ্গে তার নাম জড়িত ছিল না। আজ দুর্যোধনের ভীষণ অহংকারবোধ হচ্ছে, কারণ কর্ণের এই দিগ্বিজয়ের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে থাকবে।

পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে কর্ণকে নিয়ে গেল দুর্যোধন। সব শুনে ধৃতরাষ্ট্র উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন

বললেন, ‘বিশাল কুরুবাহিনী থেকে তোমার পছন্দমতো সৈন্য বেছে নাও। চতুরঙ্গ সেনাদল নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। দিগ্বিজয়ী কর্ণকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আমি উদ্‌দ্গ্রীব হয়ে থাকব।

কর্ণ সসৈন্যে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়েছিল।

আটত্রিশ

হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়ে কর্ণের প্রথম লক্ষ্য হলো দ্রুপদের দেশ পঞ্চাল।

হস্তিনাপুরের পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে ছড়ানো-ছিটানো এত এত রাজ্য! সেগুলোর ওপর নজর না দিয়ে কর্ণ প্রথমেই নজর দিল দ্রুপদরাজ্য পঞ্চালের দিকে।

কেন?

কারণ এই দেশটির সঙ্গে তার জীবনের অনেক কালো অধ্যায় জড়িয়ে আছে। এই দেশটির কথা মনে হলেই কর্ণের মনে পড়ে যায় পরাজয়ের কথা। যুদ্ধের পরাজয় আর মর্যাদার পরাজয়। পরাজয়ের ক্ষতচিহ্ন এখনো তার বুকজুড়ে। এই সেই দ্রুপদ, যাকে দুর্যোধনদের সঙ্গে যুবাবয়সে জয় করতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল কর্ণ। অথচ তারই যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুন অনায়াসে দ্রুপদকে বন্দি করে নিয়ে এসেছিল। এই সেই পঞ্চালরাজ্য, রাজ্যের রাজকন্যা দ্রৌপদী হীনজাতের দোহাই দিয়ে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই সেই রাজা দ্রুপদ, যিনি কন্যাদান করেছেন কর্ণেরই চিরশত্রু পাণ্ডবদের। তাই দ্রুপদের প্রতি বিদ্বেষের আঁচ কর্ণের মন থেকে কমেনি। পূর্বের পরাজয় আর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কর্ণ তাই প্ৰথমে সসৈন্যে পঞ্চালরাজ্যের দিকে রওনা দিল।

বীরবিক্রমে পঞ্চালকে তছনছ করে দিল কর্ণ। কর্ণ তখন অপ্রতিরোধ্য। তার সঙ্গে পরাক্রমী কুরুবাহিনী। কর্ণের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না দ্রুপদ। নতজানু হলেন। এটা তাঁর দ্বিতীয়বার হাঁটু গেড়ে বসা। প্রথমবার বসেছিলেন দ্রোণাচার্যের সামনে।

পঞ্চাল জয় করে দ্রুপদের কাছ থেকে রীতিমতো কর আদায় করে নিল কর্ণ।

দ্রুপদ আর তার মিত্র রাজাদের পরাজিত করে কর্ণের বাহিনী ছুটল উত্তর দিকে। তার চিরবৈরী অর্জুন দুই-দুইবার উত্তর দিকের রাজ্যগুলো জয় করেছিল। অর্জুন যদি পারে, সে নয় কেন—এই মনোভাব নিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেল কর্ণ। উত্তরের প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্ত, হিমালয়ের পার্বত্য বীর জনজাতিগুলো, নেপাল প্রভৃতি জয় করে কর্ণ পূর্বদিকে অগ্রসর হলো!

কলিঙ্গ-মিথিলা জয় করে মগধ ও কর্কটদেশে কৌরবদের বিজয়পতাকা উড়িয়ে কর্ণ বৎসদেশে উপস্থিত হলো!

এবার লক্ষ্য দক্ষিণ দিক। সেখানে মার্তিকাবতরাজ্য জয় করল। কেরলকে পদানত করল। বিদর্ভদেশে রুক্মীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করল কর্ণ। তারপর দাক্ষিণাত্যের জনপদগুলো পরাজিত করে কুরুদের অধীনে নিয়ে এলো। এরপর বিজয়দর্পে উপস্থিত হলো অবন্তীদেশে। চেদিরাজ্য এবং অবন্তীনগর কর্ণের বশ্যতা স্বীকার করে নিল।

কর্ণের এর পরের অভিযান পশ্চিম দিকে। পশ্চিমে বর্বর ম্লেচ্ছদের দেশ। হিংস্রও তেমনি ওরা। কর্ণকে প্রতিহত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল তারা। কিন্তু কর্ণকে প্রতিহত করা তো আর পুতুলখেলা নয়! কর্ণবাহিনী ওদের ছত্রখান করে ছাড়ল। রাজারা পালিয়ে বাঁচল, প্রজারা নতজানু হলো।

উল্লেখের যে কর্ণকে অবন্তীদেশে যুদ্ধ করতে হয়নি। অবন্তীর রাজারা জরাসন্ধপন্থি। ওরা দুর্যোধনের মিত্রপক্ষ। সেখানে কর্ণের যুদ্ধহীন জয় সাধিত হয়েছিল। দ্বারকার বৃঞ্চিদেরও আক্রমণ করেনি কর্ণ। এই বৃষ্ণিরা পাণ্ডবদের মিত্রপক্ষ। কর্ণ জানত না ওই দেশটি তার আপন মাতুলদের। জানত না, বসুদেব তার আপন মাতুল। ওই দেশের সীমান্তে পৌঁছে কর্ণের কেন জানি মনে হলো এদেশ আক্রমণ না করলে ক্ষতি কী? দ্বারকা না হয় তার অজেয়ই থাক! দ্বারকার সীমান্ত থেকে সসৈন্যে পেছন ফিরেছিল কর্ণ।

কর্ণ দিগ্বিজয় করে রাশি রাশি ধন-সম্পদ নিয়ে হস্তিনায় ফিরে এলো। গদগদ হয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কর্ণকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানানোর ব্যবস্থা করেন। কর্ণের সাফল্যে দুর্যোধনের বুক গর্বে স্ফীত হয়ে উঠল। বাদ্যবাজনা বাজিয়ে ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে জয়রথ থেকে কর্ণকে সাদরে নামিয়ে আনল। কর্ণকে মাথায় তুলে নিতে ইচ্ছে করল দুর্যোধনের।

কর্ণকে উদ্দেশ করে বলল, ‘যে সুখ আমাকে পিতামহ ভীষ্ম দিতে পারেননি, যে আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, সেই সুখ আর আনন্দ তুমি আজ আমাকে এনে দিলে বন্ধু! তোমার জন্য আমার অহংকারের সীমা নেই কর্ণ!’

কর্ণ দুর্যোধনের আবেগ বুঝতে পারল। চিত্রসেনের কাছে পরাজিত-লাঞ্ছিত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল দুর্যোধন। মনে বড় একটা দুঃখ জমা হয়ে গিয়েছিল তার। আজ কর্ণের দিগ্বিজয়ে দুর্যোধনের সেই দুঃখব্যথার অনেকটাই অপনোদিত হতে দেখে কর্ণের বেশ ভালো লাগল। কৰ্ণ অনুধাবন করল—দুর্যোধনের কাছে আজ সে ভীষ্মের চেয়েও বীরপুরুষ।

‘আমার নিজের শক্তির সঙ্গে তোমার উৎসাহ মিশে আমাকে দুর্দমনীয় করে তুলেছে। তুমিই আমার সকল শক্তির উৎস। তুমি আছ বলে আমি নিজেকে কখনো অনাথ ভাবি না। মনে রেখো বন্ধু, তোমার শক্তির তুলনায় পাণ্ডবদের শক্তি কিছুই নয়।’

কর্ণের এই কথায় দুর্যোধন বিশ্বাস করল যে কর্ণই শুধু পাণ্ডবদের জয় করতে পারবে।

কর্ণের চোখে চোখ রেখে দুর্যোধন বলল, ‘কর্ণ, আজ যাও তুমি, পিতা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করো। জননী গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করো। যেমন করে, যুদ্ধজয় শেষে ইন্দ্ৰ দেবমাতা অদিতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন।’

কর্ণ দুর্যোধনাদি সমভিব্যাহারে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল। পাদবন্দনা করে তাঁদের আশীর্বাদ নিয়েছিল

এই দিগ্বিজয়ের পর কর্ণ আর বাইরের লোক থাকল না, কৌরবকুলের ঘরের ছেলে হয়ে গেল। দুর্যোধন আর শকুনি ভাবল, কর্ণ বুঝি পাণ্ডবদের জয় করেই ফেলেছে।

দিগ্বিজয় হলো। অপার ধনদৌলতে রাজকোষ পূর্ণ হয়ে গেল। দুর্যোধনের সুখের সীমা থাকল না। মাত্রাতিরিক্ত তৃপ্তির উচ্ছ্বাসে দুর্যোধন সিদ্ধান্ত নিল—যুধিষ্ঠিরের মতো একটা রাজসূয় যজ্ঞ করবে সে। কারণ একটা রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারলেই তার ভাবমূর্তি আকাশ ছোঁবে।

একদিন তার বাসনার কথা কর্ণকে জানাল দুর্যোধন, ‘আমার বহু বছরের আকাঙ্ক্ষা কৰ্ণ, আমি রাজসূয় যজ্ঞ করব। মূলত যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে দেখেই এই বাসনা আমার মনে জেগেছে। তুমি আমার এই বাসনাটা পূরণ করো বন্ধু।’

কর্ণ হেসে বলল, ‘আরে, তুমি ওরকম করে বলছ কেন! সমস্ত ধরণী তো তোমার অধিগত হয়েই আছে! এখন তোমার কাজ হলো মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে গিয়ে বলা যাতে তিনি ব্রাহ্মণদের ডেকে রাজসূয় যজ্ঞের ব্যবস্থা করেন।’

ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে কথাটা পাড়ল দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রও উজ্জীবিত হলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন ব্রাহ্মণপণ্ডিতরা।

তাঁরা বললেন, ‘একই বংশের দুই জ্ঞাতিপুরুষের রাজসূয় যজ্ঞ করার বিধান নেই শাস্ত্রে। যুধিষ্ঠির যেহেতু আগে রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেছে, সেজন্য দুর্যোধন ওই যজ্ঞ করলে তা অশুদ্ধ হবে। পণ্ডিতসমাজ এই যজ্ঞকে সমর্থন করবে না।’

ধৃতরাষ্ট্র হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে!’

‘হ্যাঁ, করতে পারতেন, যদি যুধিষ্ঠির মারা যেতেন। পূর্বে যজ্ঞসম্পন্নকারীর জীবিতাবস্থায় দুর্যোধন এই যজ্ঞ করতে পারবেন না।’ প্রধান ব্রাহ্মণপণ্ডিত মাথা নেড়ে বললেন।

ধৈর্য হারালেন ধৃতরাষ্ট্র, ‘তা তো আগেও একবার বলেছেন! এখন বলুন, ভিন্ন কোনো উপায় আছে কিনা?

‘আছে।’ পণ্ডিত বললেন। একটু থেমে পৈতেটা ঠিক করে আবার বললেন, ‘যুবরাজ দুর্যোধন রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না ঠিক, কিন্তু বৈষ্ণব যজ্ঞ করতে পারবেন।

‘বৈষ্ণব যজ্ঞ!’ অবাক কণ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের।

পণ্ডিত বললেন, ‘হ্যাঁ মহারাজ, রাজসূয়র পরিবর্তে বৈষ্ণব যজ্ঞ করতে পারবেন যুবরাজ। বৈষ্ণব যজ্ঞ রাজসূয় যজ্ঞের সমতুল্য।’

দুর্যোধন ভাবল—যদি সমতুল্যই হয়, তাহলে বৈষ্ণব যজ্ঞ করতে অসুবিধা কোথায়?

পিতা কিছু বলবার আগেই দুর্যোধন বলে উঠল, ‘তাতেই সই। বৈষ্ণব যজ্ঞে আমার আপত্তি নেই। শুধু জনগণ আমার নামে ধন্য ধন্য করলেই হলো।’

ব্রাহ্মণসমাজ সম্মতি দিলে হস্তিনাপুরে বৈষ্ণব যজ্ঞ শুরু হলো। ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুর—সবাই এই যজ্ঞকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। তাঁরা ভাবলেন, দুর্যোধনের বুঝি সুমতি হয়েছে! তাই তো ধর্ম-কর্মে তার ভক্তি ফিরেছে!

বৈষ্ণব যজ্ঞের আড়ম্বরতা দেখে জনগণ ধন্য ধন্য শুরু করল।

যজ্ঞসমাপ্তির দিন ঘনিয়ে এলো। সেদিন দুর্যোধনের পক্ষে মনের আনন্দ ধরে রাখা মুশকিল হলো। বহুদিন পর একটা ব্যাপারে যুধিষ্ঠিরের সমকক্ষ হওয়া গেল! যুধিষ্ঠির করেছে রাজসূয় যজ্ঞ, সে করল বৈষ্ণব যজ্ঞ। পণ্ডিতদের বিধানে দুটো যজ্ঞই সমমর্যাদার। সমমর্যাদার যজ্ঞ যে দুজন সম্পন্ন করেছে, তারাও সমান মর্যাদার। সুতরাং দুর্যোধনের মান আজ যুধিষ্ঠিরের মানের সমপর্যায়ে পৌঁছে গেল।

রাজকীয় সজ্জায় সজ্জিত হয়ে স্তুতি-চন্দনের চূর্ণ গায়ে মেখে দুর্যোধন আহ্লাদিত চিত্তে আপনগোষ্ঠীর মাঝখানে এসে বসল। ব্রাহ্মণরা তখন যজ্ঞকুণ্ডে শেষ আহুতি প্রদান করছেন। তাঁদের মন্দ্রমন্ত্রিত কণ্ঠে বেদমন্ত্র। যজ্ঞবেদির চারদিকে কুরুবৃদ্ধরা, অমাত্যরা, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, বিজিত রাষ্ট্র আর মিত্ররাষ্ট্রের নৃপতি-যুবরাজরা ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে বসে আছেন।

একসময় ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

উঠে দাঁড়াল কর্ণ। ‘বৈষ্ণব যজ্ঞ শেষ হলো। দেখে মনে হচ্ছে তুমি তৃপ্ত। কিন্তু আমি জানি দুর্যোধন, পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি যাকে বলে, তা তুমি পাওনি। কারণ তুমি যুধিষ্ঠিরের মতো রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারোনি।’

কর্ণের কথা দুর্যোধনের ভেতরটা আবার ওলটপালট করে দিল। অদ্ভুত এক বিষণ্ন চোখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকল দুর্যোধন।

কর্ণ বলল, ‘কেন পারোনি? পারোনি যুধিষ্ঠিরের জন্য। ওই যুধিষ্ঠিরটা তোমার আগেই রাজসূয় যজ্ঞ করে ফেলেছে। শাস্ত্রীয় বিধানের কথাও শুনলে তুমি—ও বেঁচে থাকতে তুমি আর রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবে না। আমি যেদিন সব পাণ্ডবকে হত্যা করব, সেদিনই তুমি রাজসূয় যজ্ঞ করবে।’

তারপর একটু থামল কর্ণ। আবার বলল, ‘আমি আজ তোমাকে হৃদয় থেকে সম্মান জানাতে পারছি না বন্ধু। আমি তোমাকে সেইদিনই সাদর সম্ভাষণ জানাব, যেদিন তুমি রাজসূয় যজ্ঞ করবে।’ আবেগের আতিশয্যে দুর্যোধন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ে কর্ণকে একেবারে বুকের গভীরে টেনে নিল।

এমন শক্ত মানুষ যে কর্ণ, যার মধ্যে আবেগের চেয়ে ক্রোধ বেশি, সেই কর্ণ ব্যাকুল হয়ে উঠল। সমস্ত উত্তেজনা একসঙ্গে জড়ো করে কর্ণ বলে উঠল, ‘আজ আমি এই যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত মাননীয়দের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি—যতদিন আমি অর্জুনকে নিধন করতে না পারছি, ততদিন নিজের পা নিজে ধোব না। মাংস খাব না। আর আজ থেকে আমি ‘অসুরব্রত’ পালন করব। ‘অসুরব্রতে’র নিয়ম হলো—দানপ্রত্যাশী কাউকে খালি হাতে না ফেরানো। আমি শপথ করছি, আজ থেকে কেউ যদি এসে আমার কাছে কিছু চায়, আমি ফেরাব না।’

কর্ণের এই প্রতিজ্ঞাবাক্য শুনে অনুষ্ঠানস্থল একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।

কর্ণের অর্জুনবধের দৃঢ়সংকল্প দুর্যোধনকে বিভোর করে ছাড়ল। তার বিশ্বাস জন্মাল যে কর্ণের হাতে পাণ্ডবদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

.

এরপর কর্ণের অন্যরকম একটা জীবন শুরু হলো। তার নাম দানের জীবন। কর্ণের জীবনের এই অংশটা চাতুরী, ছলনা আর কারুণ্যে ভরা। এই অধ্যায়কে করুণ অধ্যায়ও বলা যায়।

সেদিনের পর থেকে কর্ণের দানের মাত্রা এত বেড়ে গেল যে, সাধারণ মানুষেরা তাকে দাতাকর্ণ বলে সম্বোধন করতে শুরু করল। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কর্ণ তার দানের ব্রত অব্যাহত রেখেছিল।

দুর্যোধনসান্নিধ্যে থেকে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদীয় ঘূর্ণিতে পড়ে এতদিন ধরে কর্ণের যে অখ্যাতি হয়েছিল, দানের মাহাত্ম্যে কর্ণের সেই অখ্যাতি চাপা পড়ে গেল।

এখন অমাত্য থেকে আরম্ভ করে প্রজাসাধারণ পর্যন্ত—সকলের কাছে কর্ণ একজন দানবীর সজ্জন ব্যক্তি।

ঊনচল্লিশ

কর্ণকে দানের নেশায় পেয়ে বসেছে। পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা, কুরুপ্রাসাদের ষড়যন্ত্র, দ্রৌপদী- অপমানের যন্ত্রণা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে কর্ণ। দানকার্যই এখন তার ধ্যান-জ্ঞান।

খুব দান করে চলেছে কর্ণ। তার দানের পুণ্য দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে আশপাশের রাজ্যে, আশপাশের রাজ্য ছাড়িয়ে গোটা ভারতবর্ষে, ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে দেবলোকেও কর্ণের দানের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। কর্ণ এখন বীরপুরুষ। এই বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ জড়িয়ে নেই, জড়িয়ে আছে উদারতার মাহাত্ম্য।

ওদিকে পাণ্ডবদের বনবাসের বারো বছর শেষ হতে চলেছে। এরপর শুরু হবে এক বছরের অজ্ঞাতবাস। বনবাসের দিন যত শেষ হয়ে আসছে কৌরব ও পাণ্ডব—উভয়পক্ষ যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে।

স্বর্গে হোক কি পাতালে বা মর্ত্যে, যেখানেই যুদ্ধের আঁচ বুঝতে পারেন, উতলা হয়ে ওঠেন দেবরাজ ইন্দ্র। তাঁর স্বভাবই হলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধপ্রস্তুতিও তাঁকে উন্মাতাল করে তুলল। বহু বছর আগে থেকেই অর্জুনের পক্ষপাতী ইন্দ্র। অর্জুনকে সাহায্য করতে পারলে ইন্দ্রের তৃপ্তির সীমা থাকে না। ভবিষ্যৎ-যুদ্ধে অর্জুনকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করবার জন্য হীন এক চক্রান্তে অবতীর্ণ হলেন ইন্দ্ৰ।

অন্যদিকে সূর্যদেবের পক্ষপাতিত্ব আবার কর্ণের দিকে। তাকে সাহায্য করতে পারলে সূর্যদেব পিতৃত্বের স্বাদ পান।

সূর্যদেবের সঙ্গে ইন্দ্রের টানাপড়েনের সম্পর্ক। ইন্দ্রের নারীপ্রীতি, ষড়যন্ত্রপরায়ণতা, পররাজ্যের প্রতি লোভ—এসব মোটেই পছন্দ নয় সূর্যদেবের। কর্ণার্জুনকে কেন্দ্র করে ইন্দ্রের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে যান দিবাকর। তিনি বুঝে যান, কর্ণের দাব্রতের সুযোগটাই নেবেন ইন্দ্র। কর্ণের কাছে সহজাত কবচ এবং কুণ্ডল আছে। এই দুটো জিনিস যতদিন কর্ণের অঙ্গজুড়ে থাকবে, ততদিন কর্ণ অমর। অর্জুন কখনো কর্ণকে পরাজিত করতে পারবে না।

দেবরাজ ইন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ছলনার আশ্রয় নিয়ে কবচ আর কুণ্ডল কর্ণের কাছ থেকে হরণ করবেন। এই দুটো দ্রব্য হরিত হলে অর্জুনের পরম প্রাপ্তি হবে। আর এই প্রাপ্তিতে ইন্দ্র পরম তৃপ্তি পাবেন।

ইন্দ্রের এই চক্রান্তের কথা টের পেয়ে সূর্যদেব ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন। যেকোনো মূল্যে ইন্দ্রের এই ষড়যন্ত্র বানচাল করতেই হবে। ইন্দ্রের মতো নিজেও একটা সিদ্ধান্ত নিলেন সূর্যদেব।

সূর্য ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। উপস্থিত হলেন কর্ণের শয়নকক্ষে। ঘুমে আচ্ছন্ন তখন কর্ণ। মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল কৰ্ণ।

‘কে, কে আপনি? এত রাতে আমার শয়নকক্ষে এলেন কী করে?’ প্রায়-চিৎকার করে উঠল কর্ণ।

একেবারে শান্ত গলায় সূর্য বলল, ‘আমার পরিচয় জানতে চেয়ো না। শুধু এইটুকু জেনে রাখো —আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।’

‘শুভাকাঙ্ক্ষী! কিন্তু এত রাতে এরকম দুর্ভেদ্য কক্ষে আপনি ঢুকলেন কী করে!’

‘ধরে নাও—আমার সে ক্ষমতা আছে। যাক ও-কথা। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘ক্ষতি করতে আসেননি! তাহলে কী করতে এসেছেন?’

‘উপকার করতে এসেছি।’ দিবাকর বললেন।

বিস্মিত কর্ণের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, আপনি ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অন্য কেউ।’

কর্ণের মুখের কথা কেড়ে নিলেন সূর্য, ‘এর চেয়ে বেশি জানার দরকার নেই তোমার। শুধু জেনে রাখো, তুমি মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছ বৎস।’

করুণ হেসে কর্ণ বলল, ‘বিপদে পড়তে যাচ্ছি! আমার আবার কী বিপদ!

‘শোনো কর্ণ, এর মধ্যে ত্রিভুবনে প্রচার হয়ে গেছে যে দানপ্রার্থী কাউকে তুমি খালি হাতে ফিরাও না। তোমার এই দুর্বলতার সুযোগটাই নিতে আসবেন।’

‘দুর্বলতা! সুযোগ নিতে আসবেন! কে?’ টুকরো টুকরো কথাগুলো কর্ণের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।

দুর্বলতার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন সূর্যদেব। শুধু বললেন, ‘ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তোমার কাছে দানপ্রার্থী হয়ে আসবেন।’

‘দানপ্রার্থী হয়ে আসবেন! দেবরাজ ইন্দ্র!’ কর্ণ অবাক হয়ে বলে।

সূর্যদেব বললেন, ‘ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ইন্দ্র তোমার কাছে আসবেন তোমার কবচ ও কুণ্ডল যাচনা করার জন্য। তিনি জানেন, তুমি কাউকে ফেরাও না। তাঁকেও ফেরাবে না।’

‘তাই তো। দেবরাজ ইন্দ্রকেও ফেরাব কেন?’

‘শোনো বাছা, তোমার মঙ্গলের জন্য বলছি, যেকোনোভাবে ইন্দ্রকে ফেরাবে তুমি। কোনোক্রমেই তুমি ইন্দ্রকে কবচ-কুণ্ডল দেবে না।’

কর্ণ কষ্টের একটু হাসি হেসে চুপ করে থাকল।

কিন্তু সূর্য চুপ থাকলেন না, ‘তুমি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে যাতে ইন্দ্ৰ কবচ-কুণ্ডল চাওয়া থেকে বিরত থাকেন। ও দুটি জিনিস ইন্দ্র যখন তোমার কাছে ভিক্ষা চাইবেন, তুমি তখন হিরে- জহরতের লোভ দেখাবে। মদমত্ত যুবতি কামিনীর লোভ দেখাবে। তাঁর মধ্যে প্রবল নারীদেহ- লালসা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—যৌবনবতী রমণীর লোভ দেখালে কবচ-কুণ্ডল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন ইন্দ্ৰ।’

কর্ণের কেন জানি একটু রঙ্গ করতে ইচ্ছে জাগল। বলল, ‘যদি দেবরাজ নারীলোভে কাতর না হন?’

‘তাহলে গরু-ঘোড়ার লোভ দেখাবে। গোধনের প্রতি তাঁর লোভের সীমা নেই।

‘আপনার সব কথা মানলাম আমি। আপনি যে আমার শুভার্থী, তাও বুঝতে পারছি। কিন্তু যদি ধরেন দেবরাজ এসবে, মানে যেগুলোর নাম করলেন আপনি, লোভী নন তিনি ওই মুহূর্তে, তিনি তখন শুধু আমার কবচ-কুণ্ডলই পেতে চাইছেন, তখন কী করব আমি?’

সূর্যদেব শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ওইসব আমি বুঝিটুঝি না বাছা। আমার মূলকথা—তুমি কিছুতেই তোমার রক্ষাকবচ আর কুণ্ডল ইন্দ্রকে দেবে না।’

‘যদি দিই?’ নির্বিকার কর্ণ।

উত্তেজিত হয়ে দিবাকর বললেন, ‘তোমার কবচ আর কুণ্ডল যদি একবার দিয়ে দাও, তাহলেই তোমার পরমায়ু শেষ। যতদিন ওই দুটো তোমার সঙ্গে আছে, ততদিন তুমিও আছ। কবচ-কুণ্ডল হারালে যুদ্ধক্ষেত্রে আর তুমি শত্রুর অবধ্য থাকবে না।’

করুণ একটা দীর্ঘশ্বাস সূর্যের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো। বললেন, ‘যদি বাঁচতে চাও কৰ্ণ, তাহলে অমৃতভাণ্ড থেকে উঠে আসা কবচ-কুণ্ডল দুটি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।’

‘আচ্ছা বলুন তো, কে আপনি?’ ব্রাহ্মণবেশীকে জিজ্ঞেস করে বসল কৰ্ণ।

‘আমি আর নিজেকে লুকাব না কর্ণ। আমি দিবাকর, আমি সহস্রাংশু সূর্য।’

‘আপনি আমার মঙ্গল চিন্তায় এত ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন কেন?’

‘ভালোবেসে বৎস। কে কখন কাকে ভালোবেসে ফেলে, তার তো কোনো ব্যাখ্যা-বৃত্তান্ত নেই! তোমার প্রতি আমার স্নেহেরও কোনো যুক্তি, ধরে নাও আমার কাছে নেই। শুধু তোমাকে ভালোবেসেই ইন্দ্রের কুহক থেকে তোমাকে বাঁচাতে চাইছি আমি।’

কিন্তু আজ কর্ণ যশপ্রার্থী। যশখ্যাতি এই ভূমণ্ডলে তাকে অমর করে রাখবে—একান্তভাবে বিশ্বাস করে কর্ণ। শৈশব থেকে সূতপুত্র বলে সর্বত্র লাঞ্ছিত হয়েছে। সবাই নিন্দার চোখে তার দিকে তাকিয়েছে। আজ সে দানের বদৌলতে যশস্বী হয়েছে। তার কাছে যশখ্যাতি মরণের চেয়েও অধিক কাম্য। শক্তি ও প্রতিভার গুণে কুরুরাজবাড়িতেও খ্যাতি পেয়েছিল সে। কিন্তু সেই খ্যাতি পাণ্ডবপক্ষীয়রা স্বীকার করতেন না। কিন্তু তার দানধ্যানের যশ এখন সবার মুখে মুখে। বিরুদ্ধপক্ষও মুখ বুজে স্বীকার করে যে কর্ণ অতুলনীয় দাতা। এই যশ তাকে জন্মের গ্লানি ভুলিয়ে দিয়েছে, জীবনের সমস্ত লাঞ্ছনা ধুয়েমুছে দিয়েছে। এখন এই কর্ণের কাছে মরণের ভয় তুচ্ছ।

কর্ণ বলল, ‘আপনি আমার ভালোর জন্য যা বলেছেন, তা বুঝি আমি। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ মার্তণ্ডদেব, সত্যিই যদি আপনি আমাকে ভালোবাসেন, তাহলে আমার দাননিষ্ঠায় বাধা দেবেন না।’ থেমে গেল কৰ্ণ।

ব্যথাতুর মুখে শূন্যের দিকে তাকাল। তারপর সেই বিষণ্ন মুখে অদ্ভুত এক হাসির রেখা ঝিলিক দিয়ে উঠে মিলিয়ে গেল। হঠাৎ তার মুখ থেকে ব্যথাভাব কেটে গেল। সেখানে জলভরা বর্ষার পূর্ণতা।

বলল, ‘পাণ্ডবদের জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণবেশে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন! কী এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, ভেবে দেখেছেন দিবাকর! আমার তৃপ্তির কথাটা একবার চিন্তা করুন। স্বয়ং দেবরাজ! আমার দুয়ারে! দান পাওয়ার আশায়! না না, আমি ইন্দ্রকে খালি হাতে ফেরাতে পারব না। কবচ-কুণ্ডল তাঁকে আমি অবশ্যই দিয়ে দেব। আমাকে যে দিতেই হবে! হা হা হা! ভিক্ষা! স্বর্গরাজ ইন্দ্র!’ আত্মতৃপ্তিতে বিভোর হয়ে পড়ল কর্ণ।

মার্তণ্ডদেবের বোবা চাহনি তখন। এ কোন কর্ণকে দেখছেন তিনি! যার অপযশে গোটা ভারতবর্ষ মুখর। দেবলোকের অনেকেই তাকে পছন্দ করে না। ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুর-কৃপ—সবাই অধর্ম আচরণের জন্য কর্ণকে নিন্দামন্দ করে অবিরাম, তাঁর সামনে দাঁড়ানো এই কর্ণ কি সেই কৰ্ণ? কিছুতেই মিলাতে পারছেন না তিনি।

বিস্ময়বোধ কমে এলে সূর্য বললেন, ‘নিজের মৃত্যুবাণ শত্রুর হাতে তুলে দিয়ো না কর্ণ। এ আমার অনুরোধ।’

মৃত্যুর কথা শুনে কর্ণ মোটেই ভীত হলো না। বরং বিপুল এক আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ওই অবস্থাতেই কর্ণ বলে উঠল, ‘সহস্ৰ বৈদিক যজ্ঞে যে দেবতাকে তুষ্ট করতে হয়, হাজার হাজার দৈত্যদানবকে যিনি নিহত করেছেন, দেবহস্তী ঐরাবতে যিনি নিত্য আরোহণ করেন, সেই দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমি কর্ণের সামনে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন! অর্জুনের প্রাণের জন্য আমার কাছে ভিক্ষা! আপনার পায়ে পড়ি মার্তণ্ডদেব, এই আনন্দ উপভোগ করার তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে বলবেন না আপনি। মরণ তো একদিন না একদিন হবেই আমার! মরণ যদি আমাকে যশ এনে দেয়, সেই মরণ আমার কাছে পরম বাঞ্ছনীয়। এই ভিক্ষাদান আমার কীর্তিকে অক্ষয় করে তুলবে।’

পরশুরামের কাছে শিক্ষার শুরু থেকে দিগ্বিজয় পর্যন্ত কর্ণ যা কিছু করেছে, কীর্তির জন্যই করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সেই পথে কীর্তি আসেনি, বরং অপযশ এসেছে। আজ সব শুধরে নেওয়ার দিন। ক্ষমতায়, বুদ্ধিতে, সম্মানে অর্জুন তার চেয়ে খাটো হোক—এই-ই চেয়েছে কৰ্ণ, সারাজীবন। তার সামনে সেই দিনটি উপস্থিত হবে, যেদিন অর্জুনেরই প্রাণরক্ষার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র তার দরজায় ভিক্ষুক হয়ে এসে দাঁড়াবেন! ইন্দ্রকে নিজ হাতে ভিক্ষে দিচ্ছে—ভাবতেই শিহরণ বোধ করল কর্ণ।

এতক্ষণ ধরে চুপ থেকে কর্ণের সকল কথা শুনে গেলেন সূর্যদেব। তিনি ভেবে দিশা পান না—এ কোন কর্ণ, যে বাঁচার কৌশলকে মরণের ফাঁদে রূপান্তরিত করে! আশঙ্কায় সূর্যের বুক কেঁপে ওঠে।

বললেন, ‘না বাছা, না। নিজের প্রতি অবিচার করো না তুমি! দেখো কর্ণ, তোমার বন্ধুজন আছে, তোমার স্ত্রীরা আছে, পুত্ররা আছে। সর্বোপরি তোমার মা-বাবা আছে। তাদের কথা একবার ভাবো। তুমি মরে গেলে তাদের জীবন কী হবে, একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো তুমি।’

কিছু একটা বলতে চাইল কর্ণ। ব্রাহ্মণবেশী সূর্য তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি যশ চাইছ, বেশ কথা। কিন্তু সেই যশ জীবনের বিনিময়ে পেতে চাইছ কেন? তুমি তো সামাজিক সম্পর্কহীন কেউ নও! তুমি কারো পুত্র, কারো পিতা, কারো স্বামী, কারো সুহৃদ। এই ভালোবাসার সম্পর্ক ততদিন, যতদিন তুমি বেঁচে আছ। তোমার মরণ হলে সব সম্পর্ক চুকে যাবে। এত যে যশখ্যাতি পেতে চাইছ তুমি, মরে গেলে সেই যশের স্বাদ কি তুমি পাবে? ভস্মীভূত ব্যক্তি কি যশের খবর শুনতে পায়?’

‘আমি মরলে আপনার কী?’ বড় নিষ্ঠুর আর নির্মোহ শোনাল কর্ণের কণ্ঠস্বর।

সূর্যদেব আমতা আমতা করে বললেন, ‘না না, আমার আর কী! এতদিন ধরে তুমি সূর্যোপাসনা করে যাচ্ছ। ভক্ত তুমি আমার। ভক্তের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই তোমাকে কথাটা বলতে এসেছিলাম। তুমি ইন্দ্রের বলি হও, চাই না আমি।’

কর্ণ বলল, ‘কবচ-কুণ্ডলের শক্তি সম্পর্কে আপনি যা বলেছেন, মানি আমি। কিন্তু আমার কাছে অস্ত্রবলের কমতি নেই। পরমগুরু পরশুরাম আমাকে সকল অস্ত্রবিদ্যা দান করেছেন। ওগুলো দিয়ে আমি অর্জুনকে কব্জা করবই। হে তিমিরবিনাশী দিবাকর, আমি কিছুতেই ইন্দ্রকে ফেরাব না। যদি জীবন দিতে হয়, তাও না।’

সূর্য বুঝলেন, কর্ণ উপদেশ শোনার লোক নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *