কে ডাকে তোমায় – ৬

ছয়

কয়েকদিন পর বাবার চিঠি পেয়ে আমজাদ বাড়ি যাওয়ার চিন্তা করে রাজু ও চম্পাকে সে কথা জানাল। পরের দিন আমজাদ বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতী নিচ্ছিল।

এমন সময় চম্পা এসে একটা চিঠি দিয়ে বলল, বাড়িতে গিয়ে পড়বেন।

আমজাদ বাসে উঠে চিঠিটা পড়ল,

প্রিয়তম,

প্রেমের কসম দিয়ে বলছি, তোমার মা-বাবাকে হয় নিয়ে আসবে; নচেৎ তাদের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করে মতামত আদায় করে আনবে। আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা থাকলেও তুমি বিরক্ত হবে ভেবে লিখলাম না। তুমি করে লিখতে নিষেধ করা সত্বেও লিখলাম। কারণ যাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসি, তাকে আপনি করে লিখতে মন সায় দেয়নি। তবু ক্ষমা চাইছি। আশা করি, আমার কথামতো কাজ করবেন।

ইতি–

তোমার একান্ত চম্পা

পড়া শেষ হতে চিঠিটা কুটিকুটি করে জানালা দিয়ে ফেলে দিল।

এক সপ্তাহ বাড়িতে থেকে আমজাদ ঢাকা ফিরে এল। রুমে এসে কাপড় পাল্টাচ্ছে, এমন সময় চম্পা পাগলের মতো ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার মা বাবা এলেন না? আমজাদ সালাম বিনিময় করে বলল, তোমাকে কতবার বলেছি, কারো সঙ্গে দেখা করতে এলে প্রথমে সালাম দিতে হয়; কিন্তু কখনও দাওনি।

ঠিক আছে, এবার থেকে দেব। আপনার মা-বাবা এলেন না কেন বলুন।

এখন চাষ আবাদের সময়, আসবেন কেমন করে?

আলাপ করে মতামত নিয়ে এসছেন?

আলাপ করেছি, আমার চাকরি হওয়ার পর আসবেন বলেছেন।

কবে আপনার চাকরি হবে না হবে, তার কোনো ঠিক আছে? অতদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আপনাকে ছাড়া আমি আর এক রাতও একা থাকতে পারব না। তাই বলি কী, আমরা আজই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি চলুন।

তার কথা শুনে আমজাদ খুব রেগে গেল। রাগের সঙ্গেই বলল, না, এটা কখনই সম্ভব নয়। মাস্টার হিসাবে যে খাতির ও সম্মান পাই, তোমার কথামতো কাজ করলে সেসব ধূলোয় মিশে যাবে। আর চার পাশের লোকজন আমার নামে দূর্নাম তো করবেই, তার উপর অত্যাচারও করবে। দয়া করে তুমি এখন চলে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।  

তার কথা শুনে চম্পাও ভীষণ রেগে গেল। চোখ দুটো লাল করে আমজাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। এক সময় চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে বুকের কাপড় ভিজে যেতে লাগল।

আমজাদ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, এত অধৈর্য হচ্ছ কেন? তাড়াহুড়োর কোনো কাজ ভালো নয়। মনিষিরা বলেছেন, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” আর হাদিসে আছে, “তাড়াহুড়ো শয়তানের কাজ, আর ধীরে সুস্থে ফেরেস্তার কাজ।” তাড়াহুড়ো করে যে কাজ করা হয়, তা যেমন সুন্দর হয়, তেমনি দীর্ঘস্থায়ীও হয় না। যে কাজ ধীরে সুস্তে করা হয়, তা যেমন সুন্দর হয়, তেমনি দীর্ঘস্থায়ীও হয়। জেনে রেখ, সব পূণ্যের সীমা আছে, কিন্তু ধৈর্য এমন একটা পূণ্য, যার কোনো সীমা নেই।

তার কথা শুনে চম্পা আরো রেগে গিয়ে বলল, মানুষ কী নিজের পছন্দমতো বিয়ে করে না? না নিজের পছন্দমতো বিয়ে করে কেউ সুখী হয় না? আপনি এত লেখাপড়া করেছেন, নিজের পছন্দ বা মতামত বলতে কী আপনার কিছুই নেই? দুনিয়াতে কত ছেলে-মেয়ে নিজের পছন্দ মত বিয়ে করছে। অনেকে মা-বাবার অমতেও করছে। আমি আপনার কোনো অজুহাত শুনব না। আপনি প্রস্তুত থাকবেন, এ সপ্তাহের মধ্যে আমাদের বিয়ে হবেই। কথা শেষ করে হন হন করে চলে গেল।

আমজাদ তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল, নিশ্চয় ওর মা ও ভাই এই রকম কিছু সলা-পরামর্শ করেছেন। ওদের নীচ মনের পরিচয় পেয়ে তাদের প্রতি ঘৃনায় আমজাদের মন ভরে গেল। এক্ষুনি এই লজিং ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করল। মাস শেষ হতে পনের-ষোল দিন বাকি। এই কটাদিন যাতে এখানে থাকতে পারে, সেজন্যে চম্পাকে একটা চিঠি লিখতে বসল।

চম্পা,

অনেক ভেবে চিন্তে জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়েকে চিঠি লিখছি। আমার কথা না বুজে তুমি রাগ ও অভিমান করে যাওয়ার সময় যে কথা বলে গেলে, তা যদি সত্য হয়, তাহলে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হব। তোমরা, মানে মেয়েরা যত তাড়াতাড়ি রং বদলাতে পার ও সিদ্ধান্ত নিতে পার, আমরা, মানে ছেলেরা তা পারি না। তাই তো মেয়েরা বিয়ের আগে কাঁদে, আর ছেলেরা কাঁদে বিয়ের পরে। তুমি বোধ হয়, জান না, হাতী পুষতে হলে আগে কলা গাছের চাষ করতে হয়? নতুবা পরে খুব বিপদ হয়। হাতী পোষা এবং বউ পোষা সমান। তাই তোমাকে বিয়ে করার আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সেই জন্য বলছি, আমাকে অন্ততঃ দুই বছর সময় দাও। ইনশাআল্লাহ এর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব। এবার তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি, আমাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে। সেই বাড়ির বৌ হতে হলে তোমাকে ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে। যেমন, শালীনতা বজায় রেখে কাপড় পরতে হবে। অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ মন থেকে দূর করতে হবে। নিয়মিত নামায-রোযা করতে হবে। কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। ধর্মীয় বই পুস্তক পড়াশোনা করে প্রকৃত মুসলীম রমনী ও আদর্শ নারী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আদব-কায়দা ও লেহাজ-তামিজের জ্ঞান অর্জন করে, সেই মত সবার সঙ্গে আচার-ব্যবহার করতে হবে। সিনেমা বা ভি.সি. আর দেখা বর্জন করতে হবে। ঘরের বাইরে যেখানেই যাওনা কেন বোরখা পরে যেতে হবে। এই দুই বছরের মধ্যে যদি এসব পালন করে দেখাতে পার, তা হলে তোমার স্বপ্ন সফল হবে। আর বেশি কিছু লেখার দরকার আছে বলে মনে করি না। তাই এখানেই শেষ করলাম।

ইতি

তোমার প্রেমাস্পদ

লেখা শেষ করে চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দিল।

রাত্রে পড়ানর শেষে রাজু চলে যাওয়ার পর বালিশের নিচ থেকে চিঠিটা নিয়ে চম্পার হাতে দিয়ে বলল, আমার মতামত লিখে জানালাম। ভেবে চিন্তে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিও।

চম্পা চিঠিটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। তারপর বই খাতা নিয়ে চলে গেল।

রুমে এসে চিঠি পড়ে মুখ ভার করে বসে রইল।

রাহেলা খাতুন ভাত খাওয়ার জন্য মেয়ের নাম ধরে কয়েক বার ডাকলেন। এল না দেখে মাস্টারকে খাইয়ে দিলেন। তারপর রুমে এসে তাকে চুপ চাপ বসে থাকতে দেখে ভাবলেন, নিশ্চয় মাস্টারের সাথে কিছু হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, কীরে? এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? মাস্টার কিছু বলেছে না কী?

চম্পা দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বলল, কিছু বলেন নি, তবে চিঠি দিয়েছেন। তারপর চিঠিটা পড়ে মাকে শোনাল।

রাহেলা খাতুন মাষ্টারের প্রতি খুব রেগে গেলেন। বললেন, বেটার মৌলবীগিরী যদি ছাড়াতে না পারি, তবে আমি বাপের বেটি নই। তারপর মেয়েকে সান্তনা দিয়ে বললেন, তুই চিন্তা করিস না। সোজা আঙ্গুলে ঘী না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করতে হয়। এখন খাবি চল।

রাহেলা খাতুন চিঠির কথা সত্য-মিথ্যা বাড়িয়ে আত্মীয় স্বজনের কাছে বলে বেড়াতে লাগলেন। ফলে আমজাদের নামে চতুর্দিকে দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ল। লজিং বাড়ির সবাই বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করল। আগের মতো খাতির যত্নও বন্ধ করে দিল।

আমজাদ তাদের ব্যবাহরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, ক্রমশঃ এমন আরম্ভ করল, যাতে তার পক্ষে সেখানে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।এর মধ্যে একদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় রাহেলা খাতুন আমজাদকে বললেন, ইদানিং চম্পার বুক ব্যাথা করছে। পড়াশোনা করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। তাই তার মন খুব খারাপ। তুমি বাবা তাকে আজ একজন ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে নিয়ে এস। রাজুকে নিয়ে যেতে বলেছিলাম, সে বলল, স্কুল খোলা, সে যেতে পারবে না। ওকে নিয়ে যাওয়ার মত আর কেউ নেই বলে তোমাকে বললাম।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমজাদ চম্পাকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে রওয়ানা। হল।

বাসা থেকে বেরিয়ে চম্পা বলল, হেঁটে যাব নাকি? রিকশা নিন।

দু’জন যুবক-যুবতী এক রিকশায় যাওয়া কঠিন গোনাহ বলতে গিয়েও আমজাদ সামলে নিল। বলল, বড় রাস্তা থেকে বাসে করে যাব, রিকশায় যেতে অনেক সময় লাগবে।

বড় রাস্তায় এসে পর পর কয়েকটি বাসে প্রচণ্ড ভীড় দেখে বাধ্য হয়ে একটা স্কুটার ভাড়া করে চম্পাকে নিয়ে উঠল। স্কুটার যখন ফার্মগেট পার হয়ে চন্দ্রিমা পার্কের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন চম্পা ড্রাইভারকে থামাতে বলল। ড্রাইভার ফুটপাত ঘেঁষে স্কুটার থামাল।

আমজাদ চম্পাকে বলল, এখানে থামাতে বললে কেন?

চম্পা স্কুটার থেকে নেমে বলল, আগে স্কুটার ড্রাইভারকে বিদায় করুন, তারপর বলছি।

আমজাদ বিরক্ত হয়ে স্কুটার থেকে নেমে ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করল। তারপর বলল, এখানে কিছু দরকার থাকলে হাসপাতালের কাজ সেরে ফেরার সময় করতে পারতে।

চম্পা হেসে ফেলে বলল, আমার বুকে কিছু হয়নি। মাকে মিথ্যে করে বলে আপনাকে নিয়ে বেড়াতে এলাম আপনার সঙ্গে নিরিবিলিতে খোলামেলা আলাপ করার জন্য। চলুন পার্কে গিয়ে বসি।

আমজাদ চম্পার কথা শুনে যতটা না অবাক হল, মিথ্যা ও ছলনার জন্য তার প্রতি তার চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা জন্মাল। সেই সাথে রেগেও গেল। গম্ভীরস্বরে বলল, বাসায় গিয়ে চাচি আম্মাকে কী বলবে?  

যা বলার আমি বলব। সে সব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আসুন পার্কে যাই বলে চম্পা হাঁটতে লাগল।

আমজাদ কি আর করবে? বাধ্য হয়ে তার পিছু নিল। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে একটা গাছের নিচে ঘাসের উপর বসে চম্পা আমজাদকেও বসতে বলল।

আমজাদ দূরত্ব বজায় রেখে বসল।

চম্পা সরে এসে গায়ে গা ঘেঁসে বসে বলল, আপনি কী আমাকে ঘৃণা করেন?

আমজাদ মনে মনে বলল, শুধু ঘৃনা করি না, তোমাকে নরকের কীট মনে করি। মুখে বলল, ঘৃনা করলে এতদিন তোমাকে পড়াতাম না। আর তোমার সঙ্গে কোথাও যেতামও না।

তা হলে দূরত্ব বজায় রেখে বসলেন যে?

ঘেঁসাঘেসী বসা ইসলামে নিষেধ বলে আমজাদ একটু সরে বসল।

আপনি মা-বাবার মতামত ছাড়া-বিয়ে করতে চাচ্ছেন না কেন?

সে কথা আগে অনেকবার বলেছি। আবার বলছি, এটাও ইসলামের নিতী বিরুদ্ধ।

কিন্তু আজকাল তো অনেকেই করছে এবং তাদের মা-বাবা দুদিন আগে পরে মেনেও নিচ্ছেন।

আমি তাদের দলের নই।

আপনার নিজস্ব মতামত বলে কী কিছু নেই?

আছে। তবে নিজের মতামতের চেয়ে মা-বাবার মতামতকে আমি বেশি অগ্রাধিকার দিই। আর এটা করা সন্তানদের উচিতও। আমি কি চাই, তা তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, আমি উচ্ছল, বেহায়াপনা, হিংসুটে, অহঙ্কারী ও পরপুরুষে আসক্ত নারীকে একদম পছন্দ করি না। তাদেরকে সর্বান্তকরণে ঘৃনা করি।

চম্পা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমার জীবনে প্রথম পুরুষ আপনি। আপনাকে আমি নিজের জীবনের চেয়ে লক্ষগুন বেশি ভালবাসি এবং আমি আপনাকেই…….।

আমজাদ আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলে উঠল, চুপ কর, চুপ কর চম্পা। তোমার এই মিথ্যা ও ছলনা শুনতে চাই না। তুমি যে নষ্টা, তা তোমাদের বাড়িতে লজিং আসার কিছু দিনের মধ্যে জেনেছি। পরে তোমার কার্যকলাপ ও আচরণ দেখে তা বিশ্বাস করেছি। কিন্তু তবুও চেয়েছিলাম, কুরআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে তোমার মনে অনুশোচনার আগুন জ্বালাতে, সেই আগুনে তোমাকে পবিত্র করতে। কিন্তু তোমার কোনো পরিবর্তন হল না। বরং তুমি আমাকে পাপের পথে টানার জন্য অনেক ছলা-কলা দেখিয়েছ ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছ। আল্লাহর লাখো কোটী-শুকরিয়া, তিনি আমাকে পাপ থেকে রক্ষা করেছেন।

চম্পা কাঁদা অবস্থায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, এ আপনি কী বলছেন? আমি নষ্টা, কে আপনাকে বলেছে?

চেঁচাচ্ছ কেন? আস্তে বল। লোকজন শুনতে পেলে দু’জনেরই বিপদ হবে। একটা কথা মনে রেখ, “সাগর ও শুকায় না, আর পাপও লুকায় না।” এটা প্রবাদ বাক্য হলেও ইউনিভার্সাল টুথ। আজ এখানে এসে ভালই হল। একটু আগে তোমাকে ঘৃনা করি কিনা জিজ্ঞেস করলে না? তখন উত্তরে যা বলেছি, তা সত্য নয়। এখন সত্য বলছি, তোমাকে আমি পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট জিনিসের মতো ঘৃনা করি। একদিকে ভালবাসার কথা বলে বিয়ে করার কথা বল, অন্যদিকে যৌবন দেখিয়ে পাপের পথে আকর্ষণ করার চেষ্টা কর। কোনো সতী-নারীর এক সঙ্গে দুই রূপ হয় না। অসতী নারীকে কোনো সৎ ছেলে বিয়ে করে না, তারাই করে যারা নাকি অন্য নারীর সতীত্ব হরণ করে।

চম্পা ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো ফোঁস করে উঠল, আজকাল সতী নারী হাজারে একটা আছে কিনা সন্দেহ। আপনি তা হলে বিয়ে করবেন কাকে?  

তোমাদের সমাজে হয়তো হাজারে একটা সতী নারী আছে; কিন্তু দেশটা শুধু তোমাদের এই ধোলাইপাড় নয় যে, সারা দেশে সতী নারী নেই।

সতী নারীদের মধ্যে অনেকে কিন্তু কুশ্রী, হিংসুটে, বদমেজাজী ও অহঙ্কারী হয়।

অস্বীকার করব না। তবে তাদের মধ্যে দেখে শুনে হাসিনা মেয়েকে বিয়ে করব।  

হাসিনা মেয়ে? সে আবার কী?

যে মেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত ঠিকমতো নামায পড়ে, রমযানের রোযা রাখে, নিজের গুপ্তাঙ্গের হেফাজত করে, স্বামীর বা পাড়া-প্রতিবেশীর মনে কষ্ট দেয় না এবং মিথ্যা বলে না, তাকে হাসিনা মেয়ে বলে। হাদিসে আছে, “হাসিনা মেয়েদের জন্য বেহেস্তের সব দরজা খোলা থাকবে। তারা যেটা দিয়ে ইচ্ছা বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারবে।”

চম্পা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তেকে বলল, আমার সম্পর্কে আপনি যা জেনেছেন তা মিথ্যে।

আমজাদ ধমকের সুরে বলল, চুপ কর, মিথ্যা বলতে তোমার লজ্জা করল না। এখনও সময় আছে কৃতকর্মের জন্য তওবা করে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে কান্নাকাটি কর। তিনি অসীম দয়ালু, কোনো বান্দা যত বড় গোনাহ করুক না কেন? তওবা করে অনুশোচনার সঙ্গে কেঁদে কেঁদে মাফ চাইলে মাফ করে দেন। এটাও হাদিসের কথা।

আমি আজ থেকে আপনার সব কথা শুনব, যা কিছু করতে বললেন করব। আপনি বলুন আমাকে বিয়ে করবেন?

যা বললে তা করে দেখাও আগে, তারপর বিয়ের কথা।

আমাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য যে কথাটা বললেন, তা বুঝতে পেরেছি। তবে একটা কথা জেনে রাখুন, আপনি আমাকে যতই ঘৃনা করেন না কেন আমাকে যদি বিয়ে না করেন, তা হলে আত্মহত্যা করব। আর এর জন্য আপনিই দায়ী হবেন।

চম্পার মতো মেয়ে আত্মহত্যা করবে আমজাদ বিশ্বাস করতে পারল না। এটা যে তার একটা ছলনা তাও বুঝতে পারল। বলল, আত্মহত্যা মহাপাপ। যে পাপের কোনো ক্ষমা নেই। তা ছাড়া এই সুন্দর পৃথিবীতে কত আনন্দ ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ, আত্মহত্যা করতে যাবে কোন দুঃখে? আত্মহত্যা করে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। বরং তার পরিবারের সমস্যা আরো বাড়ে।

আমি মরলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আমজাদ বলল, ঠিক আছে, আমাকে ভাববার সময় দাও। এবার চল ফেরা যাক। তারপর দু’জনে পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে একটা স্কুটার নিয়ে বাসায় ফিরল।

এরপর কয়েকদিন চম্পা বেশ সংযত হয়ে চলল। তারপর আগের মতো আচরণ শুরু করল। একদিন সকালে ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে আমজাদ নাস্তা খাচ্ছিল। এমন সময় চম্পা এসে বলল, স্যার আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন।

আমজাদ বলল, কেন?

বিশেষ দরকার আছে।

দরকারটা এখনই বল। দু’জায়গায় টিউসনী করে ফিরতে দেরি হবে।

আজ টিউসনীতে কী না গেলেই নয়?

যেতেই হবে, ছাত্রদের পরীক্ষা চলছে।

তা হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরবেন। তারপর আমজাদকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চম্পা চলে গেল।

আমজাদও টিউসনীতে চলে গেল।

এক জায়গায় পড়িয়ে আমজাদ চিন্তা করল, আর এক জায়গায় পড়াতে গেলে একটা দেড়টার আগে ফিরতে পারবে না। একে ওরা যা ব্যবাহর করছে, তা অসহ্য। চম্পার কথামতো যদি তাড়াতাড়ি না ফিরি, তা হলে কি যে হবে ভেবে পেল না, তাই পড়াতে না গিয়ে বাসায় যখন ফিরল তখন প্রায় বারটা বাজে।

চম্পা সেজেগুজে স্যারের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে ফিরতে দেখে কাছে। এসে বলল, এই বুঝি আপনার তাড়াতাড়ি ফেরা? আসুন আমার সঙ্গে।

চম্পা সুন্দরী। তার উপর সাজগোজ করাতে আরো সুন্দরী দেখাচ্ছে। আমজাদ তার আপাদমস্তক একবার দেখে চিন্তা করল, আজ আবার কোন ফাঁদ পেতেছে আল্লাহই জানে? তার কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। বলল, কোথায় যাব?

তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে চম্পা মৃদু হেসে বলল, ভয় পওয়ার কিছু নেই, কোনো বিপদে ফেলব না।

আমজাদ বলল, কোথায় যাবে না বললে যাব না।

আজ আমরা কোর্টে বিয়ে করব। তারপর কাজী অফিসে গিয়ে ইসলামী মতে যা করার করে আসব।

আমজাদ খুব রেগে গেল। রাগের সঙ্গে বলল, তোমার মা ও ভাইয়াকে ডাক।

ভাইয়াতো সকালে দোকানে চলে গেছে। আম্মা নাস্তা খেয়ে আপাদের বাসায় গেছে। আসুন না দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?

বিয়ে কি ছেলেখেলা না কী? তুমি বললে আর মেনে নিলাম। শোন, তুমি যা করতে চাচ্ছ, তা কখনই সম্ভব নয়।  

কেন সম্ভব নয়? আমি আপনার কোনো কথাই শুনব না। যদি আপনি ভালই ভালই না যান, তাহলে সাড়ি ব্লউজ খুলে চিৎকার করে লোক ডাকব। তাদেরকে বলব, আপনি আমার উজ্জতের উপর হামলা করেছেন।  

আমজাদ রাগ সামলাতে পারল না। তার গালে খুব জোরে একটা চড় মেরে। ধাক্কা দিয়ে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে বলল, তুমি একটা ইতর শ্রেণীর মেয়ে। যে ছেলে ইতর, সে-ই তোমাকে বিয়ে করবে। এতদিন ধরে ভালো করার জন্য তোমাকে অনেক কুরআন-হাদিসের বাণী শুনিয়েছি, তবু তোমার এতটুকু পরিবর্তন। হল না। সাধে কি আর লোকে বলে “চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।” তারপর হন হন করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

চম্পা কল্পনাই করতে পারে নি, স্যার তাকে মারবে। চড়ের আঘাতে গালটা জ্বালা করছিল। স্যারের কথার একবর্ণও তার কানে যাইনি। সে রাগে ফুলছিল আর ভাবছিল, স্যার কত বড় সাধু দেখে ছাড়বে।

বিকেলে রাহেলা খাতুন বড় মেয়ে শিউলীকে নিয়ে ফিরলেন।

চম্পা মা ও আপাকে বলল, স্যার দুপুরে খেতে এসে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি রাজি না হতে আমার গালে চড় মেরেছে।

রাহেলা খাতুন রেগে আগুন হয়ে বললেন, কী এতবড় সাহস মাষ্টারের পোলা মাষ্টারের? তোর বড় ভাই আসুক, এর বিহিত করে তবে ছাড়ব।  

শিউলি ছোট বোনের স্বভাব জানে। আর মাষ্টার যে খুব চরিত্রবান ছেলে তাও জানে। তাই তার কথা বিশ্বাস করল না। ভাবল, চম্পাই হয়তো কুপ্রস্তাব দিয়েছিল, তাই মাস্টার তাকে মেরেছে। মায়ের কথা শুনে বলল, এত চেঁচিয়ে কথা বলছ কেন? লোক শুনলে শুধু মাষ্টারের দুর্নাম হবে না, সেই সাতে চম্পারও হবে। আর ভাইয়াকেও এখন কিছু বলার দরকার নেই। বরং চেষ্টা কর ওদের বিয়ে দেওয়ার । তারপর চম্পাকে বলল, তুই যে মাষ্টারের দোষ দিচ্ছিস, তাকে তো তুই ভালবাসিস, তাকে বিয়েও করতে চাস। যা হয়েছে চুপ চাপ থাক।

চম্পা কিছু বলতে যাচ্ছিল, রাহেলা খাতুন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুই চুপ থাক। শিউলি ঠিক কথা বলেছে। তুই মাষ্টারের সাথে এমন ব্যবহার করবি যেন কিছুই হয়নি। মাষ্টারকে কিছু করতে গেলে তার সাথে তোরও দুর্নাম রটবে। মাষ্টার বেটা বিয়ে না করে যাবে কোথায়?

আমজাদ বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, এখানে থাকা আর মোটেই নিরাপদ নয়। চম্পা তার মাকে মিথ্যে কিছু বলে আমার বিরুদ্ধে লাগবে। বিয়ে করতে রাজি হয়নি বলে এমই রেগে আছেন, মেয়ের কথা শুনে কী করবেন কি জানি। যাত্রাবাড়িতে এসে হোটেলে ভাত খেল। তারপর লজিং খুজতে বের হল। আজ মাসের উনত্রিশ তারিখ, তাই প্রথমে কমলাপুরে অগ্রিম ভাড়া দেওয়া মেসে গেল। গিয়ে শুনল, ঐ লোক আরো একমাস পরে সিট ছাড়বে। আমজাদের মন আরো খারাপ হয়ে গেল। ভাবল, কি আর করা যাবে, একটা মাস যেমন করে হোক চম্পাদের বাসা থাকতে হবে।

মাগরিবের নামায পড়ে আমজাদ খুব চিন্তিত মনে বাসায় ফিরল। কিছুক্ষণ পরে রাজু পড়তে এল। সে এসব ব্যাপার কিছু জানে না। রাজু আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে চম্পাও পড়তে এল। আমজাদ ভেবেছিল, বাসায় ফিরে রাহেলা খাতুনের অনেক তিরস্কার শুনতে হবে। এমন কি লজিং ছেড়ে চলে যেতে বলবেন। ওদেরকে পড়তে আসতে দেখে কিছুটা স্বত্বি পেলেও চিন্তাটা একেবারে দূর হল না।

দশটা পর্যন্ত পড়ে রাজু চলে যাওয়ার পর চম্পা বলল, স্যার, দুপুরে খেতে এলেন না কেন? আজকের ঘটনার জন্য যে আমিই দায়ী তা বুঝতে পেরেছি। তাই আমিও না খেয়ে আছি। যাই ভাত নিয়ে আসি বলে চম্পা বই খাতা নিয়ে চলে গেল।

আমজাদ খুব অবাক হয়ে চিন্তা করল, চম্পা কী তা হলে দুপুরের ঘটনাটা ওর মাকে জানায় নি? না এর মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র আছে?

পাঁচ ছ’দিন বেশ ভালই কাটল। চম্পার বড় বোন শিউলী স্বামীর বাসায় চলে যাওয়ার পর একদিন রাত বারটার সময় আমজাদ ঘুমাতে যাবে, এমন সময় চম্পা এসে বলল, ঘুম আসছিল না বলে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। এই কথা বলে দরজা ভিড়িয়ে চৌকিতে পা তুলে বসল।

আমজাদ বিপদের গন্ধ পেল। একটু রাগের সঙ্গে বলল, এত রাতে আসা তোমার উচিত হয়নি। এক্ষুনি চলে যাও। আমার মন ভালো নেই, আমি ঘুমাব। তা ছাড়া কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারীর শেষ থাকবে না। কতবার বলেছি, বেশি রাতে তুমি এখানে আসবে না।

চম্পা বলল, আপনি রাগ করছেন কেন? বললাম তো, ঘুম আসছিল না বলে গল্প করতে এলাম। আর কেউ দেখে ফেলার কথা যে বললেন, আমিও তো আপনাকে কতবার বলেছি, বাইরের কেউ এত রাতে দেখতে আসবে না, দেখলে বাসার কেউ দেখবে। তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। সবাই জানে আমরা একে অপরকে ভালবাসি এবং বিয়েও করব। কথা শেষ করে ওড়নাটা খুলে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর বলল, ভীষণ গরম পড়েছে, ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দেন না স্যার।

কোনো পুরুষেরই এই পরিস্থিতিতে সংযত থাকা সম্ভব নয়। তার উপর আমজাদ একজন পুর্ণবয়স্ক যুবক। তার সমস্ত শরীরে কামনার আগুন জ্বলে উঠল। হঠাৎ তার মনে হল, এটা কোনো ফাঁদ নয়তো? কথাটা মনে হতেই কঠোর ভাবে পশুশক্তিটাকে সংযত করে রাগের সঙ্গে বলল, এক্ষুনি চলে যাও বলছি। নচেৎ সেদিনের মতো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।

চম্পার কোনো পরিবর্তন হল না। বলল, দেন না বের করে। আমিও চিৎকার করে লোক ডাকব। এখন বাসায় সবাই আছে।

তবু আমি তোমাকে বের করে দেব বলে আমজাদ তার একটা হাত ধরে টান দিল।  

চম্পা তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি এত নিষ্ঠুর কেন? আপনার মনে কী……কথাটা শেষ করতে পারল না। ঠিক সেই মুহঁতে রাহেলা খাতুন দরজা ঠেলে ভিতরে এসে দাঁড়ালেন। চম্পা দেখেও না দেখার ভান করে ঐ অবস্থায়ই রইল।

দরজাটা বন্ধ করার সময় কোনো শব্দ না হলেও ভোলার সময় একটু শব্দ হয়। আমজাদের পিছনের দিকে দরজা, তাই রাহেলা খাতুনের আগমন টের না পেলেও দরজা খোলার শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকাল। তার মাকে দেখে চম্পাকে ঠেলে বিছানায় ফেলে দিল। জেঁকের মুখে নুন পড়ার মতো তখন তার অবস্থা হল। কি করবে বা কি বলবে ভেবে না পেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

চম্পা উঠে বসে ওড়নাটা পরে নিল।

রাহেলা খাতুন একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আমজাদকে বললেন, তোমার মনে যদি এই ছিল, তা হলে দুই বছর সময় চাওয়ার কী দরকার ছিল। তুমি নামায-রোযা কর,আর এটা জান না, বিয়ের আগে এসব হারাম? আমি কালই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।  

আমজাদ ততক্ষণে সামলে উঠেছে। বলল, চাচি আম্মা, আপনি ভূল বুঝছেন। আমি ওকে……।

রাহেলা খাতুন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বয়স তো কম হলনা বাবা, তা ছাড়া তোমার চেয়ে বড় আমার দুটো ছেলে মেয়ে আছে। আমাকে কোনো কথা আর বুঝাতে হবে না। যা বুঝার তা স্বচক্ষে দেখেই বুঝেছি। কাল তোমাদের বিয়ে দেবই।

আমজাদ রেগে উঠে বলল, তা কখনই সম্ভব নয়। আপনি আগে আমার কথা শুনুন, তারপর যা করতে চান করবেন।  

রাহেলা খাতুনও রেগে উঠে মেয়েকে বললেন, তুই এখনও রয়েছিস কেন? যা রুমে যা।

চম্পা চৌকি থেকে নেমে সুড় সুড় করে বেরিয়ে এল; কিন্তু রুমে না গিয়ে কবাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।

মেয়ে চলে যাওয়ার পর রাহেলা খাতুন আমজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মেয়ের ইজ্জৎ তুমি নষ্ট করেছ। যদি জাত ঘরের ছেলে হও, তা হলে কালই আমার মেয়েকে বিয়ে করবে।

রাগে দুঃখে আমজাদের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আপনি আমার কোনো কথা না শুনে আমার উপর কলঙ্ক দিচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, আমি ওকে বের করে দেওয়ার জন্য ওর হাত ধরে টেনেছিলাম। ঐ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেই দৃশ্য আপনি দেখেছেন।

সে যাই হোক না কেন? আমি যা বললাম তা করবই।

আমজাদ বুঝতে পারল, যাতে আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে রাজি হই, সেই জন্য মা-মেয়ে মিলে আজ এই ফাঁদ পেতেছিল। দৃঢ় স্বরে বলল, তা কখনই সম্ভব নয়। আমি আপনার মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করব না।

তা করবে কেন? আমার মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে ফুর্তি করতে লজ্জা করে না? যাও এক্ষুনি বেরিয়ে যাও, নচেৎ লোকজন ডেকে বের করে দেব। কথা শেষ করে আমজাদের বিছানা চৌকি থেকে টেনে মেঝেয় ফেলে দিতে লাগলেন।

আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না বলে আমজাদ সবকিছু বাধা-ছাদা করতে লাগল।

তুমি কী মনে করেছ, তোমাকে এত সহজে ছেড়ে দেব? যেখানেই থাক না কেন এর বিহীত করে ছাড়ব। তারপর চলে যেতে যেতে দরজার বাইরে থেকে। আবার ফিরে এসে বললেন, এখন সবকিছু বেঁধে ছেদে রাখ, সকালে যাবে। এত রাতে গেছ শুনলে লোকজন আমাদের দুর্নাম করবে। কথা শেষ করে হন হন করে চলে গেলেন।  

সারারাত আমজাদ ঘুমাল না। সবকিছু গোছ-গাছ করে বসে রাত কাটিয়ে দিল। ফজরের আজান হতে মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসার সময় বড় রাস্তা থেকে একটা ভ্যান গাড়ি নিয়ে এল। তারপর মালপত্র তাতে তুলল। তখনও চম্পারা কেউ ঘুম থেকে উঠে নি। তাদেরকে না বলে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে ভ্যানওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বলে রুমে ফিরে এল।

চম্পা রাত্রে দরজার আড়াল থেকে মা ও স্যারের কথা শুনেছে। মা বেরিয়ে আসার আগে নিজের রুমে চলে আসে। তারপর স্যারকে একটা চিঠি লিখে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে সে অনেক আগে উঠেছে। জানালা দিয়ে স্যারকে সব মালপত্র নিয়ে যেতে দেখেছে। মাল তুলে স্যারকে ফিরে এসে রুমে ঢুকতে দেখে চিঠিটা নিয়ে সেখানে এসে তার হাতে দিয়ে বলল, কাজটা ভালো করলেন না। তারপর ফিরে যেতে লাগল।

আমজাদ বলল, চম্পা চাচি আম্মাকে একটু ডেকে দাও। তারপর চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।

আমার ঘৃনিত ভালবাসা নিও। পরে জানাই যে, তোমার দেওয়া চিঠি মা ও ভাইয়া পড়েছে। তারা দু’বছর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তাই আজ তারা আমাকে বড় আপার দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তুমি যে নপুংসক তা জানতাম না। নপুংসক বললাম বলে রাগ করলে না তো? আসলে সত্যিই তুমি নপুংসক। তা না হলে একটা যুবতী মেয়ে কত রকম ভাবে মিলনের আহব্বান জানাল, আর তুমি সাড়া দিলে না। আগে জানলে তোমার কাছেও যেতাম না। তোমার কথাই ঠিক। এ পর্যন্ত আমি অনেক ছেলের সঙ্গে ফুর্তি করেছি। তারা তোমার মতো নপুংসক নয়। তোমার সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে কাছে পেতে চেয়েছি দেহের চাহিদা মেটাবার জন্য। তুমি কাপুরুষ ও নপুংসক। তাই ধর্মের কথা বলে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ। যাই হোক, বড় আপার দেশের বাড়িতে আমার প্রেমিকের অভাব হবে না। পুরুষদের সঙ্গে ভালবাসার ছলনা করে ফুর্তি করে আমি আনন্দ পাই। তোমার সঙ্গে ছলনা করে এতদিন কি ভুলইনা করেছি। এবার সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছি। দুঃখ করো না, কেমন?

ইতি–

তোমার ঘৃনার পাত্রী চম্পা।

চিঠিটা পড়াশেষ করে ছিঁড়ে টেবিলের উপর রেখে চম্পার মায়ের জন্য দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে আসতে দেখে আমজাদ বেরিয়ে এসে বলল, চাচি আম্মা, অনেকদিন আপনাদের এখানে থাকলাম, হয়তো অনেক দোষ-ত্রুটি করেছি, ছেলে মনে করে মাফ করে দেবেন। তারপর, আসি আল্লাহ হাফেজ বলে আমজাদ সেখান থেকে চলে এসে ভ্যান গাড়ীতে বসে ড্রাইভারকে চালাতে বলল।

বড় রাস্তায় এসে ভ্যানওয়ালা জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যাব?

আমজাদ সেই কথাই ভাবছিল, হঠাৎ তার দেশের কাইয়ুম নামে এক টেলারিং দোকানের মালিকের কথা মনে পড়ল। দয়াগঞ্জে লজিং খুঁজতে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছিল। ভ্যানওালার কথা শুনে বলল, দয়াগঞ্জ বাজারে চল।  

দয়াগঞ্জ বাজারে কাইয়ুমের টেলারিং দোকানটা বেশ বড়। চার-পাঁচ জন কারিগর সেলাই করে। সে শুধু কাপড় কেটে দেয়।

তার দোকানের সামনে ভ্যান রেখে আমজাদ কাইয়ুমের সঙ্গে দেখা করে মালপত্র গুলো কয়েকদিনের জন্য রাখার অনুরোধ করল।

কাইয়ুম আমজাদের গ্রামের খুব গরিব ঘরের এতিম ছেলে। ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসে। তার মা এক বাড়িতে কাজ করত আর কাইয়ুমকে একটা টেলারিং দোকানে পেট ভাতে কাজ শিখতে দেয়। তখন তার বয়স দশ বছর। দোকানের মালিক কাইয়ুমের ভালো আচরণ ও সততা দেখে নিজে তাকে সবকিছু শেখায়। প্রায় চৌদ্দ পনের বছর কাইয়ুম ঐ দোকানে কাজ করে, খুব সুনাম অর্জন করে। মালিক খুশী হয়ে তাকে একটা ছোটখাট ঘর ভাড়া করে দিয়ে আলাদা টেলারিং দোকান করে দেন। সেই ছোট দোকান থেকে কর্মদক্ষতায় আজ এই পর্যন্ত পৌঁছেছে।

আমজাদের কথা শুনে কাইয়ুম বলল, ঠিক আছে রাখুন। মালপত্র রাখা হয়ে যাওয়ার পর বলল, বসুন, চা খেয়ে যাবেন। তারপর একজন কারিগরকে চা-বিস্কুট আনতে দিয়ে বলল, আপনি সেই কবে একদিন লজিং খুঁজতে এসেছিলেন আরতো এলেন না। দেশের ভাই হিসাবে আমি আপনার জন্য দু’তিনটে লজিং ঠিক করেছিলাম। এই কয়েকদিন আগেও মীরহাজীবাগের আমার এক কাষ্টমার লজিং মাষ্টারের খোঁজ করছিল। মাষ্টার রেখে ফেলেছে কিনা আমি খোঁজ নেব। দু’একদিন পরে এলে জানতে পারবেন।

চা-খাওয়ার পর আমজাদ বলল, ওখানে লজিং পাওয়া না গেলেও অন্য জায়গায় চেষ্টা করবেন। আমি দু’দিন পর এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব। তারপর সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় লজিং এর খোঁজে ঘুরল এবং দু’জায়গায় টিউসনী পড়িয়ে কোনো মসজিদে রাত কাটাবে ভেবে শহরের দুতিনট মসজিদে গিয়ে থাকার সুযোগ পেল না। কারণ শহরের মসজিদে কাউকে রাত্রে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় না। শেষে স্বামী বাগ শাহি মসজিদে গিয়ে মোয়াজ্জেম সাহেবকে অনুরোধ করে মসজিদে থাকার অনুমতি পেল। ফজরের আজানের আগে মোয়াজ্জেম এসে জাগিয়ে বলল, এবার উঠে পড়ুন। কেউ দেখে ফেললে আমার চাকরি থাকবে না। এভাবে আরো দু’দিন মসজিদে রাত কাঠিয়ে পরের দিন সন্ধ্যের পর দয়াগঞ্জে কাইয়ুমের কাছে গেল।

কাইয়ুম বলল, আমি ওঁর কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম। আজ বিকালে আসবে বলেছিলেন, এখনও আসেন নি। আপনি বরং কাল একবার আসুন।  

ঠিক আছে, তাই আসব বলে আমজাদ সালাম বিনিময় করে দোকান থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময় কাইয়ুমের গলা শুনতে পেল, এই যে আমজাদ ভাই শুনে যান।  

আমজাদ ফিরে এলে কাউয়ুম একজন ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল, ইনার কথাই আপনাকে বলেছিলাম। এখনও মাষ্টার পান নাই শুনে আপনাকে ডাকলাম। যাক, ভালই হল। তারপর দুজনের পরিচয় করিয়ে দিল।

ভদ্রলোক সাতক্ষীরার। নিউ মার্কেটে একটা কাপড়ের দোকানের সেলস্ ম্যানেজার। নাম হক সাহেব।

আমজাদকে হক সাহেবের পছন্দ হল। বললেন, আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তারা ফাইভ, সিক্স, সেভেন ও এইটে পড়ে। তাদেরকে সকালে ও রাত্রে পড়াবেন। তিন বেলা খাবেন। কিন্তু বাসায় থাকতে দিতে পারব না। আমাদের বাসার কাছাকাছি কয়েকটা মেস আছে। মেসে থাকবেন, ভাড়া আমিই দেব।

হক সাহেবের কথা শুনে আমজাদ অকুল সাগরে যেন কূল দেখতে পেল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমি রাজি।

হক সাহেব বললেন, আমার দেশের অনেকে ঐ সব মেসে থেকে চাকরি করে। কোন মেসে সিট আছে, খোঁজ নেব। আপনি কাল সন্ধ্যের পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর কাইয়ুমের কাছ থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বললেন, এই নিন আমার বাসার ঠিকানা।

আমজাদ আর একবার মনে মেন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে দোকান থেকে বেরিয়ে এল।

আল্লাহ তার নেক বান্দাদের বিপদে সাহায্য করেন। পরের দিন আমজাদ সন্ধ্যের পর হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, সিট একটা আছে। চলুন আপনাকে নিয়ে যায়। তারপর মেসে নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ঐ রাতেই আমজাদ কাইয়ুমের দোকান থেকে মালপত্র নিয়ে মেসে চলে এল।

পরের দিন হক সাহেবের ছেলেমেয়েদের পড়াতে গিয়ে আমজাদ বুঝতে পারল, সবাই ভলো ছাত্র-ছাত্রী। তাদের আদব-কায়দা ও চাল-চলনও খুব ভালো। বাসার পরিবেশও খুব সুন্দর। হক সাহেব যেমন ধর্মপরায়ন ছেলে মেয়েদেরকেও সেই ভাবে মানুষ করেছেন। ‘আমজাদ আজ আড়াই বছর ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসায় লজিং ছিল, বিভিন্ন বাসায় ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়েছে। এই বাসার মতো সুন্দর পরিবেশ ও এই সব ছাত্র-ছাত্রীদের মতো সুন্দর আচরণ আর কোথাও দেখে নি। হক সাহেবের মতো ভালো মানুষও দেখে নি।

কিছুদিন পর একবার আমজাদের খুব জ্বর হল। খবর পেয়ে হক সাহেব নিজে ছেলেদের সঙ্গে করে নিয়ে এসে মাথায় পানি ঢাললেন। ডাক্তার এনে দেখিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে এলেন। যে কয়েকদিন আমজাদ অসুস্থ ছিল, ছেলেরা বাসা থেকে তিন বেলা খাবার মেসে দিয়ে গেল। হক সাহেব রাত্রে ফেরার সময় মাস্টারের খোঁজ খবর নিয়ে বাসায় ফেরেন।

আমজাদ চলে আসার দিন বড় ছেলে বশির ঘুম থেকে উঠার পর রাহেলা খাতুন তাকে বললেন, মাষ্টারকে ভালো ছেলে ভেবে জামাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে যে লম্পট-চরিত্রহীন তা জানতাম না। সে চম্পাকে বিয়ে করার জন্য দু’বছরের সময় চেয়ে তার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল। তারপর গত রাত্রের ঘটনার সঙ্গে মিথ্যে অনেক কিছু বাড়িয়ে বলে বললেন, আমি ঠিক সময় মতো সেখানে গিয়েছিলাম, নচেৎ কি যে হত, তা আল্লাহই জানে। আমি তাকে সকালে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি।

বশির রেগে লাল হয়ে বলল, তাই নাকি? শালা শুয়রের বাচ্চার এতবড় সাহস, আমাদের বংশের মুখে চুনকালি দিতে চেয়েছিল? তাড়াবার আগে আমাকে ঘুম থেকে জাগালে না কেন? শালাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ছাড়তাম। জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে?

হ্যাঁ, আমি তার জিনিসপত্র ঘর থেকে বাইরে, ফেলে দিয়েছিলাম। চম্পা তখনও ঘুমিয়ে ছিল। ভাইয়ের চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যেতে উঠে সেখানে এসে মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারল, মা গত রাতের কথা বলছে। মা থেমে যেতে কেঁদে ফেলে বলল, ভাইয়া, তুমি ওকে ছেড়ে কথা বলো না। আমার ইজ্জতের উপর হামলা করেছিল। খোঁজ করে এমন শাস্তি দিও, তা যেন চিরকাল মনে থাকে।

বশির বলল, সে কথা তোকে বলে দিতে হবে না। আগে খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় থাকে, তারপর বাছাধনকে দেখে নেব।

মাস দুয়েক পরে বশির একদিন একটা লোকের সঙ্গে দয়াগঞ্জ বাজারে দেখা করতে গেল। দেখা করে ফেরার সময় একটা মুদি দোকানে মাস্টারকে সদাই করতে দেখে আড়াল থেকে লক্ষ রাখল। তারপর তাকে ফলো করে কোথায় থাকে দেখে বাসায় ফিরে মাকে কথাটা বলে বলল, আমাদের পাড়ার মাস্তানদেরকে কিছু টাকা দিয়ে মাস্টারকে এমন ধোলাই দেওয়াব, যা তার চিরকাল মনে থাকবে।  

রাহেলা খাতুন বললেন, ধোলাই দেওয়ার আগে মাষ্টারকে বাসায় নিয়ে আসতে বলবি। আনার পর চম্পার সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবি। কারণ সে আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে। আর যদি বিয়ে করতে রাজি না হয়, তখন না হয় ধোলাই দিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে চিরকারের জন্য পঙ্গু করে দিবি।

বশির বলল, তুমি খুব ভালো কথা বলেছ মা, তাই করব।

রাজু এ বছর এস.এস.সি. পরীক্ষা দেবে। মোটামুটি সাবালক। সে অন্য ভাই বোনদের চেয়ে একটু আলাদা। স্যারের সঙ্গে ছোট আপার বেহায়াপনা তার ভালো লাগত না। স্যারের সঙ্গে বিয়ে হবে জেনে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। স্যার যে খুব ভালো ছেলে রাজু তা জানে এবং বিশ্বাসও করে। যে কারণে স্যারকে মা তাড়িয়ে দিয়েছে, তা জেনেছে; কিন্তু বিশ্বাস করে নি। ছোট আপা যখন তখন স্যারের রুমে গিয়ে গল্প করে দেখেও মা কিছু বলত না বলে বরং মায়ের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। আর স্যার চাকরি পাওয়ার পর ছোট আপাকে বিয়ে করবে, তার আগে নয়, একথা শুনে স্যারের প্রতি তার ভক্তি আরও বেড়ে গিয়েছিল। বেকার অবস্তায় স্যার বিয়ে করুক, সে তা চায় না। স্যারকে সে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তাই আজ যখন ভাইয়া মাস্টারকে ধোলাই দেওয়ার কথা বলল এবং তারপর মা যা বলল তা শুনে রাজুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। স্যারের হয়ে মা ও ভাইয়ার বিরদ্ধে কিছু বলার তার সাহস হল না। স্যারকে মা ও ভাইয়ার ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে সাবধান করার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।  

বশির যখন মাকে বলল, স্যার দয়াগঞ্জ বাজারের দক্ষিন পাশে যে খাল রয়েছে, সেই খালের দক্ষিণ পাড়ে মীরহাজীবাগের এক মেসে থাকে তখন রাজু তা শুনেছিল। পরের দিন সকালে দয়াগঞ্জ বাজার হয়ে রেল লাইনের উপর দিয়ে খাল পার হয়ে দেখল, স্যার রেল লাইনের পাশ ধরে হাঁটছে। দ্রুত হেঁটে কিছুটা কাছে এসে ডাকল, স্যার শুনুন।

রাজুর গলা আমজাদ বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকে দেখতে গেল।

রাজু কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন স্যার?

ভালো। তুমি কেমন আছ? বাসার সবাই ভালো আছে?

হ্যাঁ, স্যার, সবাই ভালো। তবে আপনি চলে আসার পর ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারছি না। আপনার কথা মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে।

রাজুকে বাসার সবার থেকে ব্যতিক্রম দেখে আমজাদ তাকে খুব ভালবাসত। বলল, সে কী? সামনে তোমার ফাইন্যাল পরীক্ষা। যা-যা প্রয়োজন আমি সব দেখিয়ে দিয়েছি। যা নোট করার করে দিয়েছি। তুমিও সে সব তৈরীও করেছ। এখন শুধু মন দিয়ে রিভাইজ দাও। আশা করি, ইনশাআল্লাহ ভালো রেজাল্ট করতে পারবে। তা হঠাৎ এত সকালে কী মনে করে?

কেমন আছেন দেখতে এলাম। সেই সাথে একটা জরুরী খবরও দিতে এলাম।

বল কী জরুরী খবর?

আপনি আমাকে ও ছোট আপাকে অনেক সৎ উপদেশ দিয়েছেন, কুরআন হাদিসের বাণীও অনেক শুনিয়েছেন। আপনার আদর্শে আমি মানুষের মতো মানুষ হওয়ার চেস্টা করছি। আপনি মা-বাবা ও বড় ভাই বোনেদের দোষ ধরতে নিষেধও করেছেন। কিন্তু মা ও ভাইয়া যা করতে চাচ্ছে, তা আমার কাছে খুব অন্যায় বলে মনে হয়েছে। তাই বেয়াদবি হবে ভেবে কোনো প্রতিবাদ করতে না পেরে আপনাকে জানাতে এসেছি।  

বেশ তো কী জানাতে এসেছ বল।

বলতে খুব খারাপ লাগছে, তবু বলছি স্যার। তারপর মা ও ভাইয়ার ষড়যন্ত্রের কথা সব খুলে বলল।

আমজাদ বলল, তোমার কাছে আমি এই রকমই আশা করেছিলাম। শোন রাজু, মানুষ সৎ পথে থাকলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। আমি যদি অন্যায় কিছু করে থাকি, তা হলে ইহকালে ও পরকালে তার শাস্তি পেতেই হবে। আর যদি সৎ পথে থাকি, তবে আল্লাহকে আমি সব থেকে বড় সাহায্যকারী জানি। এবার তুমি যাও, আমার জন্য কোনো চিন্তা করো না। খবরটা জানিয়ে তুমি তোমার কর্তব্য পালন করেছ। দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সুখের করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *