কে ডাকে তোমায় – ৫

পাঁচ

তিনমাস পর এস.এস.সি’র রেজাল্ট বেরোল। চম্পার রেজাল্ট জানার জন্য আমজাদকেই সেন্টারে যেতে হল। চম্পা দুটো লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিসানে পাশ করেছে। রেজাল্টের খবর জেনে ওদের বাসার সবাই মহাখুশী। পাড়ায় মিষ্টি বিলান হল। চম্পা প্লেট ভরে মিষ্টি নিয়ে মাষ্টারের রুমে এসে বলল, আমার এত ভালো রেজাল্টের জন্য আপনার অবদান অনেক। কদমবুসি করতে খুব ইচ্ছা করছে, আপনি নিষেধ করেছেন তাই করলাম না। তবে আজ আমি আপনাকে নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়াব।  

আমজাদ চেয়ারে বসেছিল। বলল, না, তুমি খাওয়াবে না। টেবিলে রাখ, আমি নিজেই খাব।

চম্পা প্লেটটা টেবিলে রেখে বলল, আজ এই খুশীর দিনে কোনো কিছু নিষেধ করবেন না, মানতে পারব না। তারপর একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে বলল, নিন হ্যাঁ করুন।

আমজাদ রেগে গেলেও সংযতকণ্ঠে বলল, একী পাগলামী করছ? কেউ দেখে ফেললে কী হবে ভেবেছ?

বাইরের কেউ তো দেখবে না; দেখলে আমাদের বাসার কেউ দেখবে। তাতে কোনো দোষ হবে না। এই কথা বলে বাঁ হাতে স্যারের গাল টিপে ধরে বলল, নিন হা করুন।

আমজাদ আরো বেশি রেগে গেল। কিন্তু চম্পা এমন জোরে গাল টিপে ধরেছে যে, হ্যাঁ না করে পারল না।

চম্পা হাতের মিষ্টিটা তার মুখে দিয়ে প্লেট থেকে আর একটা মিষ্টি নিতে গেলে আমজাদ কঠিন গলায় বলল, ওটা রেখে দাও, আমি নিজের হাতে খাব।

স্যারের কঠিন গলা শুনে চম্পা মিষ্টিটা প্লেটে রেখে আহত স্বরে বলল, এই আনন্দের দিনে আপনি আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দেবেন না? আমজাদ তখনও রেগে ছিল। রাগের সঙ্গেই বলল, না।

চম্পা কিছুক্ষণ স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মুখ নিচু করে নিল।

আমজাদ দেখল, তার দু’চোখ থেকে পানি টপটপ করে পড়ছে। বলল, তুমি জান, আমি ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলি। তবু এরকম করছ কেন? বিয়ের আগে ‘গায়ের মহররাম’ ছেলে মেয়ে এভাবে খাওয়া ও খাইয়ে দেওয়া ইসলামে নিষেধ। তাই তুমি ওভাবে খাওয়াতে রেগে গেছি। আর একই কারণে তোমাকে খাওয়াতে পারছি না। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তুমি মনে কষ্ট নিও না।

চম্পা চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আসলে আপনি আমাকে ঘৃনা করেন, তাই আমার হাতে কিছু যেমন খেতে চান না, তেমনি আমাকে খাইয়ে দিতেও চান না।

আমজাদ মনে মনে বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। তোমার বেহায়াপনার জন্য সত্যিই তোমাকে ঘৃণা করি। মুখে বলল, তোমাকে যদি ঘৃনাই করতাম, তা হলে ভালো রেজাল্ট করার জন্য তোমার পিছনে এত পরিশ্রম করতাম না। আর এতদিন তোমাদের বাসায়ও থাকতাম না।

চম্পা আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে গেল। আমজাদকে রাহেলা খাতুনের খুব পছন্দ। মেয়ের উচ্ছলতা তিনি জানেন। তাই আমজাদের মতো ধার্মীক ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান। বড় ছেলে রশিদকে সে কথা জানিয়ে আমজাদদের বাড়ির খোঁজ খবর নিতে বলেছিলেন। রশিদেরও আমজাদকে খুব পছন্দ এবং সেও তার সঙ্গে বোনের বিয়ে দিতে চায়। তাই তোক মারফত আমজাদদের বাড়ির খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে তাদের সবকিছু ভালো । ঐবাড়িতে সম্পর্ক হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সে কথা মাকেও জানায়।  

মেয়ে যে মাষ্টারকে ভালবাসে এবং তাকে বিয়ে করতে চায় তা রাহেলা খাতুন মেয়েকে ফলো করে অনেক আগেই বুঝেছেন। তাই মাষ্টার যাতে হাত ছাড়া না হয়ে যায়, সেজন্য মাষ্টারের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ দিয়েছেন। দিনে অথবা রাত্রে চম্পা যখন একাকী মাষ্টারের রুমে যায় তখন মাঝে মধ্যে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাদের দিকে লক্ষ্য রাখেন এবং কি কথা বার্তা হয় তাও শোনেন।

মা ও ভাইয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে চম্পা আরো বেশি সাহসী হয়েছে এবং স্যারকে ক্যাপচার করার জন্য নির্লজ্জার মতো নিজের মনের কামনা বাসনা প্রকাশ করেছে।

আজ যখন চম্পা মাষ্টারের জন্য প্লেট ভরে মিষ্টি নিয়ে গেল তখন রাহেলা খাতুন বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে সব কিছু দেখছিলেন। মেয়েকে ফিরে আসতে দেখে বললেন, কীরে, মাস্টারকে মিষ্টি খেতে দিয়ে ফিরে এলি যে?

চম্পার তখন রাগে ও মনের কষ্টে কান্না পাচ্ছিল। তাই চুপ করে রইল।

রাহেলা খাতুন বললেন, মাষ্টার বুঝি কিছু বলেছে? তারপর তার একটা হাত। ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, চলতো দেখি, মাষ্টারের ব্যাটা কী বলেছে দেখি।

চম্পার যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও মা কি করে বা বলে জানার জন্য গেল।

রুমে ঢুকে রাহেলা খাতুন বললেন, চম্পাকে মিষ্টির প্লেট হাতে তোমার রুমে ঢুকতে দেখলাম। তুমি কী এমন কথা বলেছ যে, ও কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাচ্ছিল?  

আমজাদ কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।

রাহেলা খাতুন না জানার ভান করে বললেন, চম্পা তোমাকে ভীষণ ভালবাসে। সব সময় তোমার গুনগান করে। তোমার কারণেই নাকি ও পরীক্ষায় এত ভালো করেছে। তুমিও ওকে যে খুব ভালবাস, তাও বলে। তবু যে কেন তুমি ওকে মাঝে মাঝে কাঁদাও বুঝতে পারি না। আজ খুশীর দিনে ওকে কাদান তোমার ঠিক হয়নি। যাকগে, যা হওয়ার হয়েছে। তোমাকে আমি পেটের ছেলের মতো মনে করি। এস তোমাদের দুজনকে আমি মিষ্টি খাইয়ে দিই। কথা শেষ করে একটা মিষ্টি নিয়ে আমজাদের সামনে গিয়ে বলল, নাও খাওতো বাবা।  

আমজাদ বুঝতে পেরেছিল মা ও বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে চম্পা এত অশালীন ব্যবহার তার সঙ্গে করে। কিন্তু কোনো মা মেয়ের হয়ে এরকম প্রকাশ্যে ওকালতী করবে, তা সে কল্পনাও করেনি। মিষ্টি খাবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাহেলা খাতুন অধৈৰ্য্য গলায় বললেন, কই বাবা খাও। আমি তো তোমার মায়ের মতো। তোমর মা খাইয়ে দিলে খেতে না?

অগত্যা আমজাদ না খেয়ে পারল না।

রাহেলা খাতুন একবার মাষ্টারকে আর একবার চম্পাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলে প্রানটা জুড়িয়ে যায়। চম্পার কী সে ভাগ্য ……।

আমজাদ আর সহ্য করতে পারল না। তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলল, চাচি আম্মা, আমি মিষ্টি খেতে ভালবাসি না, আপনি মনে কষ্ট পাবেন তাই খেলাম। আর খেতে পারব না। তারপর জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কিছুটা খেয়ে মুখ ধোয়ার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে এল।

চম্পা মাকে বলল, আমিও আর খাব না, তুমি প্লেট নিয়ে যাও।

রাহেলা খাতুন ফিস ফিস করে বললেন, মাস্টারকে বেশি জ্বালাতন করবি না, তারপর চলে গেলেন।

আমজাদ রুমে ফিরে এলে চম্পা বলল, আমার হাতে খেলেন না, অথচ আমার মায়ের হাতে খেলেন।

আমজাদ রেগে ছিল। তাই কিছু না বলে চুপ চাপ প্যান্ট সার্ট পরতে লাগল।

দুপুর হয়ে গেছে এখন আবার কোথায় যাবেন?

এক জায়গায় একটা জরুরী কাজ আছে যেতেই হবে।

তাড়াতাড়ি ফিরবেন, আজ আমরা সবাই একসঙ্গে খাব। বিরিয়ানী ও মোরগের মাংস রান্না হয়েছে।

আমজাদের এখানে থাকতে অসহ্য লাগছে। তাই মিথ্যে কাজের অজুহাত দেখিয়ে লজিং খোঁজার জন্য বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে। প্যান্ট সার্ট পরা হয়ে যেতে কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর সারাদিন লজিং এর জন্য সারা শহর চষে বেড়াল। কিন্তু সফল হল না। দুপুরে হোটেলে সামান্য কিছু খেয়েছিল। রাত দশটায় রুমে ফিরে এল। সারাদিন অনেক হেঁটেছে তাই খুব ক্লান্ত লাগছিল। প্যান্ট সার্ট পাল্টে লুংগী পরে কলতলা থেকে অজু করে এসে এশার নামায পড়ল। তারপর বিছানা পেতে গা এলিয়ে দিল। পেটে প্রচণ্ড শীদে থাকা সত্বেও কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করল না। চিন্তা করতে লাগল, দুপুরে খেতে আসিনি, সেজন্যে চম্পা ছেড়ে কথা বলবে না। ক্লান্তিতে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল, কারো স্যার ডাক শুনে। তন্দ্রা ছুটে গেল। তাকিয়ে দেখল, রাজু দাঁড়িয়ে আছে।

স্যারকে তাকাতে দেখে রাজু বলল, আম্মা আপনাকে খেতে ডাকছে। আসুন আমার সঙ্গে।  

আমজাদের রুমে কেউ না কেউ খাবার দিয়ে যায়। আজ ভিতরে খেতে যাওয়ার কথা শুনে বেশ অবাক হলেও তার সঙ্গে গেল। যে রুমটায় গিয়ে বসল, সেটা বেশ বড়। একপাশে একটা খাট। অন্য পাশে একটা লম্বা টেবিল, তার দু’পাশে ছটা চেয়ার। মাঝখানে আলনা ও মিটসেল্ফ দিয়ে পাটিশান দেওয়া। রাজু। তাকে বসতে বলে বেরিয়ে গেল। একটু পরে রাহেলা খাতুন চম্পাকে সাথে করে এনে আমজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দুপুরে খেতে এলে না কেন? তুমি খেতে। আসনি বলে চম্পাও খায়নি। তারপর চম্পাকে বললেন, বস, আমি তোদের খাবার নিয়ে আসি। কথা শেষ করে চলে গেলেন।

চম্পা আমজাদের পাশের চেয়ারে বসে ভিজে গলায় বলল, আমাকে কাঁদিয়ে, কষ্ট দিয়ে আপনি বুঝি খুব সুখ পান?

আমজাদ অল্পক্ষন চুপ করে থেকে বলল, আমি জরুরী কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। তাই আসতে পারি নি। এতে তোমার কাঁদার বা কষ্ট পাওয়ার কী আছে? তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছ। তোমার আম্মা কি মনে করছেন?

আমি বাড়াবাড়ি করছি, না আপনি করছেন? আমাকে খুব বোকা পেয়েছেন না? রাত দশটা পর্যন্ত কারো জরুরী কাজ থাকে বুঝি?

আমজাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার মাকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল।

রাহেলা খাতুন জামাই খাতির করে আমজাদকে খাওয়ালেন। খাওয়ার সময় চম্পা কোনো কথা বলল না।

খাওয়ার পর আমজাদ নিজের রুমে এসে ঘুমাবার সময় চিন্তা করল, মা-মেয়ে যা শুরু করেছে এখানে আর বেশি দিন থাকা যাবে না। কিছু দিনের মধ্যে অন্য কোথাও লজিং না পেলে কোনো মেসে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

চম্পাকে কলেজে ভর্তি করার ব্যাপারে তার মায়ের কথামত আমজাদকেই ছোটাছুটি করতে হল। শেষে মাস দেড়েকের মধ্যে গোপিবাগ সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজে ভর্তি করে দিল।

আমজাদ সারারাত ধরে নিজের বিগত জীবনের স্মৃতিচারণ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানতে পারল না। মসজিদ থেকে মাইকে আযান হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসে গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়তে ভাবল, তার মাও যেভাবে মেয়েকে আমার পিছু লেলিয়ে দিয়েছেন, তাতে করে কোন দিন কিছু অঘটন না ঘটে যায়? হয়তো মেয়ের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করাতে পারেন। কথাটা ভাবতেই আমজাদের। সারা শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এখন তার কি করা উচিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভেবে শেষে সিদ্ধান্ত নিল দু’চার দিনের মধ্যে দুরের কোনো মেসেই চলে যাবে।  

সে গোপীবাগ ও হাটখোলায়ও দু’টো টিউসনি করে। সেদিকেই মেসে সিট নেওয়ার জন্য পরের দিন অনেক খোঁজ করল। কিন্তু কোনো মেসেই সিট পেল না। দু’তিন দিন খোঁজাখুঁজির পর কমলাপুরে সর্দার বাড়ির একটা মেসে যদিও একটা চান্স পেল, তাও একমাস পর ঐ সিটের লোক চলে যাবে। সিটটা নিতে হলে দু’এক দিনের মধ্যে অগ্রিম ভাড়া দিতে হবে। আমজাদের কাছে তখন ভাড়ার সব টাকা ছিল না। একশ টাকা ছিল। তাই দিয়ে বলল, কাল পরশু এসে বাকি টাকা দিয়ে যাব।

ঐরাতের পর থেকে চম্পা দিনে যখনই সুযোগ পেত তখনই আমজাদের কাছে বিভিন্ন অজুহাতে এসে প্রেম ভালবাসার ব্যাপারে আলাপ করতে লাগল। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে আমজাদ তাকে বলল, মানুষ যা আশা করে তা সব পুরণ হয় না। তুমি বিয়ের আগে যা পেতে চাচ্ছ, তা জঘন্যতম পাপ। এই পাপের পাঁকে যারা একবার নিমজ্জিত হয়, তারা সারাজীবনেও উদ্ধার পায় না। দুনিয়াতে যেমন জীবন। কলঙ্কময় হয়, তেমনি আখেরাতেও জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হয়। তুমি ধৈৰ্য্য। ধর; আমাকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দাও। আমি আমার মা বাবার এক ছেলে, আমার উপর তাদের অনেক আশা ভরসা। আমি তাদের সেই আশা ভরসায় কুঠারাঘাত করতে চাই না।

চম্পা মুখ ভার করে বলল আপনার মা-বাবার আশা ভরসায় কুঠারাঘাত করার কী আছে? বলেছিতো তাদেরকে আমাদের বাসায় একবার নিয়ে আসুন। তার। পরের ব্যবস্থা আম্মা ও ভাইয়া করবে। সেদিন তো বললাম, বিয়ে হয়ে গেলেও আমি এখানে থেকে পড়াশোনা করব। আপনি চাকরি পাওয়ার পর যা করার করবেন।

আমজাদ বুঝতে পারল, ওকে বেশি দিন রুখতে পারবে না। তাই প্রবোধ। দেওয়ার জন্য বলল, ঠিক আছে, এবারে বাড়ি গেলে নিয়ে আসব।

চম্পা আনন্দে আটখানা হয়ে বলল, সত্যি বলছেন স্যার?

আমজাদ তার আনন্দ দেখে মনে মনে বলল, সত্য না মিথ্যে কিছু দিনের মধ্যে জানতে পারবে। মুখে বলল, হ্যাঁ সত্য।

যাই আম্মাকে কথাটা বলে আসি বলে চম্পা এক রকম দৌড়ে ছুটে চলে গেল।

আমজাদ ভাবল, কথাটা বলে কি ভুল করলাম? ওর মাতো কথাটা বিশ্বাস করে ফেলবেন।

ঐ দিন রাতে ঘুমাবার সময় মশারী খুঁসতে গিয়ে বালিসের তলায় একটা চিঠি পেল। খুলে পড়তে শুরু করল।

প্রিয় সাথি,

তুমি আমার কাছে বসন্তের বকুল, রাতের রজনীগন্ধা, বেহেস্তের সওগাত। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অচল। তোমাকে শৰ্য্যা পাশে পাওয়ার জন্য দু’আড়াই বছর হল চাতক পাখীর মতো হয়ে আছি। সারাক্ষণ তোমার ছবি আমার মনের পাতায় ভেসে বেড়ায়। বেশিক্ষণ তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না। তাই তো নানান ছুতোয় তোমার কাছে যাই। রাত্রে একবিন্দু ঘুমাতে পারি না। সারারাত এপাশ ওপাশ করি। ভালোভাবে পড়াশোনাও করতে পারি না। কবে তোমাকে একান্ত করে পাব, বল না প্রিয়তম? তোমাকে পেলে আমার জীবন সার্থক হবে। কথা দাও, তুমি সারাজীবন আমারই থাকবে। তোমাকে আমার সব কিছু উজাড় করে দেব। আমার মাথার মুকুট করে রাখব। মেয়ে বলে সবকিছু মুখ ফুটে বলতে পারি না। তাই এই চিঠি দিলাম। উত্তরের জন্য প্রহর গুনব।

ইতি

তোমার চম্পা।

যে মেয়ে কথা বার্তায় আচার ব্যবহারে দৈহিক মিলনের ইঙ্গিত দেয়, তার এই চিঠি পড়ে আমজাদ অবাক হল না। তবে তুমি করে সম্বোধন করায় অবাক না হয়ে পারল না। ভাবল, এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত যেমন করে হোক ওকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।  

পরের দিন চম্পা একা পড়তে এল। আমজাদ জিজ্ঞেস করল, রাজু এল না যে?

ও বন্ধুদের সাথে কোথায় যেন ক্রিকেট খেলতে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে ফিরতে রাত হবে।

পড়ানো হয়ে যাওয়ার পর চম্পা বলল, চিঠিতে অপনাকে তুমি করে লিখেছি কিছু মনে করেন নি তো?

আমজাদ সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল; যতদিন মাস্টার ও ছাত্রী সম্পর্ক থাকবে, ততদিন আপনি করে বলবে। তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি শোন, তুমি এখন যে সমস্ত চিন্তা ভাবনা কর; তা আমি পছন্দ করি না। আর বিয়ে করাও এখন একেবারেই সম্ভব নয়। মা-বাবাকে সাহায্য করার জন্য সর্বপ্রথম আমার একটা চাকরির দরকার। তারপর অন্য চিন্তা।  

চাকরি আপনার একদিন হবেই। তখন হয়তো আপনি আমাকে পাবেন না। আর আমিও অতদিন ধৈর্য ধরতে পারব না।

তার কথায় আমজাদ খুব আনন্দিত হল। মনে মনে বলল, আল্লাহ যেন তাই করেন। মুখে বলল, তক্বদীরে থাকলে পাব, না থাকলে পাব কী করে? তকদীরকে তো আর বদলাতে পারব না।

চম্পা কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করল, তারপর বই খাতা নিয়ে চলে গেল।

এরপর থেকে চম্পার মা রাহেলা খাতুন আমজাদকে ভিতর বাড়িতে নিজে ভালো ভালো খাবার তৈরি করে খাওয়াতে লাগলেন।

অন্য যে কোনো ছেলে হলে হয় চরিত্র হারাত, নচেৎ বিয়ে করে ফেলত। আমজাদেরও এক এক সময় মনের অবস্থা যে সেরকম হয় নি, তা নয়। অনেক সময় পশুবৃত্তিটা উত্তেজীত হলে সমস্ত শরীরের রক্ত গরম পানির মতো টগবগ করে। ফুটে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর মুমীন বান্দাকে হেফাযত করেন। তাই আমজাদ উত্তেজিত হয়ে যখন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না তখন হঠাৎ করে কুরআন শরীফের একটা আয়াত মনে পড়ে যায়, “আর তোমরা অবৈধ যৌন-সংযোগের নিকটবর্তী হইও না; নিশ্চয় উহা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।” [সূরা-বানী ইসরাইল, আয়াত নং- ৩২, পারা-১৫]

আর তখনই পশুবৃত্তিটা নিস্তেজ হয়ে যায়। পরক্ষণে চম্পার মুখের উপর শারমিনের প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে তার মন। শান্তিতে ভরে উঠে।

একদিন রাত সাড়ে দশটার সময় খেয়ে এসে রুমে ঢুকে দেখল, চম্পা বিছানা ঠিক-ঠাক করে মশারী খাটাচ্ছে। আমজাদ যখন খেতে ভিতর বাড়িতে যায়, প্রতিদিন সে সময় চম্পা এই কাজটা করে দিয়ে চলে যায়। আজ তাকে দেখে প্রথমে কিছু মনে করেনি। কিন্তু পরক্ষণে তার শরীরে পাতলা ফিনফিনে ম্যাক্সী দেখে বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। স্বামী ছাড়া কো্নো কুমারী মেয়ে যে এই পোশাক পরে তার মাস্টারের রুমে এত রাতে আসতে পারে, তা কল্পনাও করেনি।

মশারী খাটানো হয়ে যেতে চম্পা চৌকী থেকে নেমে আমজাদকে দেখে মধুর হাসি উপহার দিয়ে ডিমলাইট জেলে বড় লাইট অফ করে দিল। তারপর চৌকির কাছে এসে বলল, ঘুমাবেন আসুন।  

চম্পা সুন্দরী যুবতী। তার উপর মেক আপ করায় আরো সুন্দরী দেখাচ্ছিল। বড় লাইট অফ করে লাল ডিম রাইটের আলোতে তাকে এত সুন্দরী দেখাচ্ছে যে, যা দেখে আমজাদের পঁচিশ বছরের বলিস্ট শরীরে আগুন ধরে গেল। যার তাপ সহ্য করতে না পেরে যখন চম্পার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করল ঠিক তখনই কুরআন শরীফের উক্ত আয়াতটা মনে পড়তে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে সে নিজেই বুঝতে পারল না। যখন কিছুটা শান্ত হল তখন দেখল, সে মসজিদের বারান্দায় বসে আছে। আল্লাহ তাকে মস্তবড় গোনাহ থেকে রক্ষা করেছেন ভেবে মসজিদের কল থেকে অজু করে এসে দু’রাকাত শোকরানা নামায পড়ল।

তারপর মশার কামড় সহ্য করে সেখানেই রাত কাটাল। ভোরে ফজরের নামায পড়ে রুমে ফিরে এল।

পরের দিন সারাদিন বাইরে কাটিয়ে আমজাদ মাগরিবের নামায পড়ে ফিরে এসে দেখল, দু’ভাই বোন পড়ছে। চম্পার মুখটা বেশ ভার ভার। আমজাদ মনে করেছিল, রাগে হয়তো চম্পা মায়ের কাছে তার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করবে এবং আজ পড়তেও আসবে না। এসেছে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল।

রাজু জানে ছোট আপার সাথে স্যারের বিয়ে হবে। তাই পড়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে বই খাতা নিয়ে চলে যায়। আজও তাই করল।

রাজু চলে যাওয়ার পর চম্পা ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, সারা রাত কোথায় ছিলেন? আমি আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ রাত চারটের সময় ঘুম ভেঙে যেতে দেখি আপনি তখনও ফেরেননি। দরজার দুই কপাট দু’দিকে। ভয় পেয়ে আমি দরজায় শেকল দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমায়।

আমজাদ বলল, যেখানেই থাকি না কেন, তা তোমার জানার দরকার নেই। যা বলছি শোন, ভালবাসার কথা বলে যেভাবে তুমি আমাকে পেতে চাচ্ছ, তা কোনো কালেই সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়া বা আমার মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করা কোনোটাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ইসলামে দু’টোই হারাম এবং জাহান্নামের পথ। তা ছাড়া আমাদের সমাজ আছে। যা কিছু করি না কেন সমাজকে নিয়ে করতে হবে। আমার ইচ্ছার কথা এর আগে অনেকবার বলেছি। আবার বলছি চাকরি পাওয়ার পর মা-বাবার পছন্দ মতো সমাজের দশজন ও আত্মীয়-স্বজনকে সাথে নিয়ে মাথা উঁচু করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করব। তাতে সবাইয়ের সঙ্গে মা-বাবাও খুশী হবেন। তখন সবাই খুশী মনে দোয়া করবেন। তাদের দোয়ায় আমাদের দাম্পত্ত জীবন সুখের হবে। প্রেম করে গোপনে বিয়ে করলে যেমন সবাই অসন্তষ্ট হয় এবং কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি সবাইয়ের দোয়ার বদলে অভিশাপ কুড়াতে হয়।

চম্পা বলল, ঠিক আছে, আমি তো বলেছি, একদিন বাড়ি গিয়ে আপনার মা বাবাকে নিয়ে আসুন। যদি তাদের আসতে এখন অসুবিধা থাকে, তবে তাদের মতামত নিয়ে আসুন। আমাদের সবাই এ ব্যাপারে সম্মত আছে।

আমজাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, এতকিছু বলার পরেও সেই একই কথা বলছ? তা হলে কী তোমরা আমাকে ঘরজামাই করে রাখার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ? তাই যদি ভেবে থাক, তা হলে মস্ত বড় ভূল করেছ। লেখাপড়া করে বেকার থাকার কি যে যন্ত্রনা, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। তার উপর বেকার অবস্থায় যদি ঘর-জামাই থাকি, তা হলে নির্ঘাৎ আত্মহত্যা করতে হবে। তুমি এখন যাও, আমার খুব অস্বস্থি লাগছে।

চম্পা আর কিছু না বলে বই খাতা নিয়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *