কে ডাকে তোমায় – ৪

চার

পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে আমজাদ সনদপত্র নেওয়ার জন্য ইউনিভার্সিটিতে রওয়ানা দিল। সবকিছু নিয়ে যখন ফিরছিল তখন দুপুর একটা। আন্দরকিল্লা রোডের উত্তর পাশে কালুরঘাট বাস স্ট্যাণ্ডে যখন এল তখন অস্ত্র হাতে চারজন সন্ত্রাসীকে একটা আঠার বিশ বছরের মেয়ে আরোহীর রিকশার গতিরোধ করতে দেখে ড্রাইভারকে বলল, স্কুটার থামান। স্কুটার থামার পর দেখল, সন্ত্রাসীরা মেয়েটির গলার হার ছিনতাই করে কানের দুল খোলার চেষ্টা করছে।

মেয়েটা বাঁচাও! বাঁচাও! বলে চিৎকার করছে আর দুহাতে কান দুটো ঢেকে রেখেছে। সন্ত্রাসীদের দু’জন মেয়েটির দুটো হাত ধরে কান থেকে সরিয়ে নিল। অন্য একজন কানের দুল টান দিয়ে ছিঁড়তে গেলে মেয়েটি লাথি মেরে তাকে রিকশা থেকে ফেলে দিল। সন্ত্রাসীটা উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির পিঠে ও কাঁধে চাকু দিয়ে আঘাত করল। মেয়েটি বাবাগো বলে লুটিয়ে রিক্সা থেকে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেল।

রাস্তায় নোকজন যাতায়াত করছে। অনেকে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছে; কিন্তু সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র থাকায় কেউ সাহস করে মেয়েটিকে রক্ষা করতে এগোচ্ছে না। যখন সন্ত্রাসীরা মেয়েটাকে ধরাধরি করে একটা স্কুটারে তোলার চেষ্টা করল তখন আমজাদ আর স্থির থাকতে পারল না। স্কুটার থেকে নেমে লোকজনদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, মেয়েটি যদি আপনাদের কারো বোন বা মেয়ে হত, তা হলে কী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন? সন্ত্রাসীরা মাত্র চারজন, আর আমরা প্রায় সত্তর আশিজন,আসুন আমরা ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। কথা শেষ করে আমজাদ রাস্তার পাশে পড়ে থাকা দু’টো আধলা ইট নিয়ে ছুটে এগিয়ে গিয়ে ডান হাতের ইটটা একজন সন্ত্রাসীর মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। তারপর বাম হাতের ইটটা ডান হাতে নিয়ে অন্য একজনের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। ঐ দু’জন মেয়েটিকে ধরে স্কুটারে তোলার চেষ্টা করছিল। মাথায় ইটের বাড়ি খেয়ে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল। তখন তাদের মাথা কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। তাই দেখে রাস্তার সব লোকজন তাদের দিকে মারমুখী হয়ে এগিয়ে এল।

সন্ত্রাসীরা বেগতিক দেখে মেয়েটিকে রাস্তায় ফেলে রেখে স্কুটারে উঠে কয়েকটা বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে গেল। আমজাদ লোকজনের সাহায্যে মেয়েটিকে নিজের স্কুটারে তুলে জেনারেল হাসপাতালে ইমারজেন্সীতে নিয়ে গেল।

ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বললেন, যা কিছু করার আমরা করছি। কিন্তু পেসেন্টের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, রক্তের দরকার। আমাদের কাছে রক্ত নেই। আপনি রক্তের ব্যবস্থা করুন।  

আমজাদ বলল, আমি কুমিল্লার লোক, কাল এসেছি। এখানকার কিছুই জানি, চিনি না। রক্ত কোথায় পাওয়া যাবে তাও জানি না। আপনারা বরং আমার রক্ত পরীক্ষা করে দেখুন, যদি একই গ্রুপ হয়, তা হলে আমার রক্ত নিন।

ডাক্তাররা মেয়েটির ও আমজাদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখল, দু’জনের একই গ্রুপ। সে কথা জেনে আমজাদ রক্ত দিল। প্রায় ঘন্টা তিনেক পর মেয়েটির জ্ঞান ফিরল। এর মধ্যে আমজাদ হোটেল থেকে খেয়ে এসেছে। ডাক্তারের কাছে রুগীর জ্ঞান ফেরার কথা শুনে মেয়েটির কাছে গিয়ে দেখল, চোখ বন্ধ।

ডাক্তার মেয়েটির কপালে হাত রেখে বললেন, যিনি আপনাকে এখানে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন, উনি এসেছেন।  

মেয়েটি চোখ খুলে ডাক্তারের পাশে দাঁড়ান আমজাদের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। একসময় তার চোখ দুটো থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।  

মেয়েটির সারা শরীর চাদরে ঢাকা। শুধু মুখটা ভোলা। আমজাদ তার ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ দেখে মুগ্ধ হল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে এসে নিজের রূমালে চোখ মুছে দিয়ে বলল, ঠিকানা বলুন। আপনার মা বাবাকে খবরটা দেওয়া খুব জরুরী।  

মেয়েটি ভিজে গলায় বলল, আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তা আপনজনের জন্যও কেউ করেছে কিনা জানি না। আল্লাহ আপনাকে উপলক্ষ করে আমাকে বাঁচিয়েছেন। আপনার ঋণ আমি……….।

আমজাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনার এখন বেশি কথা বলা উচিত নয়। শুধু ঠিকানাটা বলুন।  

মেয়েটি বলল, আপনি লিখে নিন, বলছি।

আমজাদ বুক পকেট থেকে কলম নিয়ে হাতের ফাইল খুলে বলল, বলুন।

শারমিন আক্তার, ডটার অফ আবদুল জব্বার সওদাগর, টেরী বাজার, বাড়ি নং…….।

আমজাদ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা রিকশায় উঠে ঠিকানা বলল।

রিকশাওয়ালা টেরী বাজারে এসে বলল, কোন দিকে যাব?

আমজাদ রিকশা থামাতে বলল। থামার পর ভাড়া মিটিয়ে বাসার নাম্বার দেখে দেখে শারমিনদের বাসার কাছে এসে একটা পনের ষোল বছরের ছেলেকে দখে বলল, জব্বার সওদাগরের বাসা কোনটা বলতে পার?

ছেলেটা জব্বার সওদাগরের বড় ছেলে রফিক। ক্লাস টেনে পড়ে। বলল, কেন বলুন তো? আমি ওনার ছেলে।

আমজাদ বলল, শারমিন আপনার বড় বোন?

অচেনা একটা ছেলের মুখে আপার নাম শুনে রফিক বেশ অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।

আমার নাম আমজাদ। এখন এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। বললেও আপনি চিনবেন না। আপনার আপা সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন। আমি খবরটা দিতে এসেছি।

রফিক আতঙ্কিত হয়ে বলল, তাই না কি? আপা এখন কেমন আছে?

প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা অজ্ঞান ছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এসেছি।

রফিক বলল, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর তাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে গিয়ে মাকে আপার কথা জানাল।

রফিকের বাবা অফিস থেকে এখনো ফেরেন নি। মা ফজিলা বেগম আসরের নামায পড়ে তসবীহ পড়ছিলেন। মেয়ের খবর শুনে চমকে উঠে বললেন, কে খবর নিয়ে এল?

আমজাদ নামে এক ভদ্রলোক। তাকে ড্রইংরুমে বসিয়েছি।

ফজিলা বেগম পর্দানশীন মহিলা। তবু মেয়ের খবর শুনে গায়ে মাথায় ভালো করে কাপড় জড়িয়ে ড্রইংরুমের দরজার কাছে এসে বললেন, শারমিনের কী হয়েছে ঘটনাটা বলুন তো বাবা?

আমজাদ সালাম বিনিময় করে সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে বলল, আমি একটা বিশেষ কাজে কুমিল্লা থেকে কাল এসেছি। আগামী কাল চলে যেতে হবে। যাদের বাসায় উঠেছি, দুপুরে ফিরব বলে তাদের বাসা থেকে সকালে বেরিয়েছি। এখন প্রায় পাঁচটা বাজে, তারা খুব চিন্তা করছে। আমি এবার আসি। আপনারা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যান।

ফজিলা বেগম বললেন, সে কী বাবা, আপনি এক্ষুনি চলে যাবেন? আপনি আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছেন। শারমিনের আব্বার সঙ্গে দেখা করে তারপর যাবেন।  

মাফ করবেন, আর দেরি করতে পারছি না। যদি সম্ভব হয় কাল সকালে একবার হাসপাতালে যাব। তারপর সালাম বিনিময় করে আমজাদ সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

রফিক ততক্ষণ আব্বাকে ফোন করে আপার কথা জানিয়ে হাসপাতালে আসার জন্য বলে মায়ের কাছে এল।

ফজিলা বেগম তাকে দেখে বললেন, তোর আব্বাকে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বল। তারপর একটা রিকশা নিয়ে আয়।

রফিক বলল, তুমি বলার আগেই ফোন করেছি। তৈরি হয়ে নাও, আমি রিকশা নিয়ে আসছি বলে বেরিয়ে গেল।

জব্বার সওদাগরের দেশের বাড়ি কুমিল্লা জেলার গৌরীপুর । তিনি চট্টগ্রাম বক্সি বাজারে এক্সপোট ইম্পোটের ব্যবসা করেন। দেশের অবস্থা খুব ভালো। টেরীবাজারে একটা চারতলা বাড়ি করেছেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সবার বড় শারমিন নন্দন কানন সরকারী মহিলা কলেজে এইচ.এস.সি’তে পড়ে। বাকি অন্যান্য ভাই বোনেরা স্কুলে পড়ে। শারমিনের গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা-স্বাস্থ্য দোহারা-চোখ দুটো ডাগর ডাগর-খাড়া নাক-চিকন ঠোঁটে সব সময় হাসি লেগে থাকে। পাশের বাড়ির মেয়ে সুমী তার ক্লাসমেট ও বান্ধবি। দু’জনে এক রিকশায় কলেজে যাতায়াত করে।

রফিক মাকে নিয়ে হাসপাতালে আসার কিছুক্ষণ পর জব্বার সওদাগরও এলেন। তিনি মেয়ের কাছে না গিয়ে প্রথমে ডাক্তারের রুমে গেলেন। ডাক্তারের কাছে সব কিছু শুনে ভাবলেন, ছেলেটা নিশ্চয় শিক্ষিত ও দ্রঘরের। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি কি চলে গেছে?  

ডাক্তার বললেন, আপনার মেয়ের জ্ঞান ফেরার পর তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আপনাদের বাসায় খবর দিতে গিয়েছিলেন। আপনার সঙ্গে দেখা হয় নি?

না, আমি অফিসে ছিলাম। ফোনে খবর পেয়ে এসেছি। তারপর মেয়ের বেডের কাছে এলেন।

মাও রফিককে দেখে শারমিন চোখের পানি রোধ করতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাঁর উদ্ধারকর্তাকে খুঁজতে লাগল।  

ফজিলা বেগম তা বুঝতে পেরে মেয়ের চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন, ছেলেটা আসেনি। সকালে বেরিয়েছিল, বাসার সবাই চিন্তা করবে, তাই আমাদেরকে তোর খবরটা দিয়ে চলে গেল।

মায়ের কথা শুনে শারমিনের মলিন মুখটা আরো মলিন হয়ে গেল। ভাবল, ফেরেস্তার মতো উদ্ধারকর্তাকে জীবনে আর বোধ হয় কোনোদিন দেখতে পাবে না। এক সময় তার চোখ দুটো আবার পানিতে ভরে উঠল।

মেয়ের মনের অবস্থা ফজিলা বেগমের চোখে ধরা পড়ল। প্রবোধ দেওয়ার জন্য বললেন, ছেলেটা যাওয়ার সময় বলল, সম্ভব হলে কাল সকালে তোকে দেখতে আসবে।

এমন সময় জব্বার সওদাগর সেখানে এসে মেয়ের মাথার কাছে বসে বললেন, আমি ডাক্তারের কাছে সবকিছু শুনেছি। এখন কেমন বোধ করছিস?

শারমিন ভিজে গলায় বলল, একটু ভালো।

ওদের কাউকে তুই চিনিস?

পরিচয় জানি না, তবে দেখলে চিনতে পারব।

ঘটনাটা বলতে শুনি।

ওরা কিছুদিন থেকে আমাকে ও সুমীকে ফলো করত। দু’জন এক রিকসায় থাকতাম বলে হয়তো এতদিন কিছু করেনি। আজ সুমীর জ্বর বলে আমি একা কলেজে গিয়েছিলাম। ছুটির পর একাই একটা রিকশায় ফিরছিলাম। লক্ষ্য করলাম, ঐ ছেলেগুলো একটা স্কুটারে আমার রিকশাকে ফলো করছে। রিকশা যখন কালুরঘাট বাস স্ট্রাণ্ডে আসে তখন ছেলেগুলো সামনে এসে রিকশার গতিরোধ করে। তারপর স্কুটার থেকে নেমে আমার উপর হামলা চালায়। তারপর জ্ঞান হারাবার আগে পর্যন্ত যা ঘটেছে বলল।

ঠিক আছে, তুই সুস্থ্য হয়ে নে, তারপর যা করার করব। জানিস মা, ডাক্তার বললেন, যে ছেলেটা তোকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে নিজের রক্ত দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছে। দুঃখের ব্যাপার কী জানিস, ছেলেটার পরিচয় পর্যন্ত আমরা জানতে পারলাম না।

ফজিলা বেগম বললেন, আমি তাকে তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে বলেছিলাম। তারপর তার অপারগতার কথা জানিয়ে বললো, ছেলেটা কুমিল্লা থেকে কি একটা কাজে এসেছে। কাল চলে যাবে। অবশ্য সময় পেলে যাওয়ার আগে একবার এখানে আসবে বলেছে।

কুমিল্লা কোথায় বাড়ি জিজ্ঞেস করনি?

জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম না, তাড়াতাড়ি চলে গেল।

রফিক বলল,আমি বাসার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছেলেটা তোমার নাম বলে বাসাটা দেখিয়ে দিতে বলে। বললাম, আমি ওনার ছেলে। ছেলেটা আপার নাম বলে দুর্ঘটনার কথা বললেন। আমি পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, আমি আমজাদ, এখন আর বেশি কিছু বলতে পারছি না।

জব্বার সওদাগর বললেন, ঠিক আছে, কাল যদি আসে পরিচয় জেনে নেওয়া যাবে।

.

আয়শা প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে রান্না করে নিজে খেয়ে স্বামীর জন্য রেখে যায়। জাভেদ দেড়টার সময় এসে খেয়ে দুটোর সময় আবার অফিসে যায়। আজ সকালে অফিসে বেরোবার সময় জাভেদ তাকে বলেছিল, দেড়টা থেকে দু’টোর মধ্যে ফিরবি। একসঙ্গে খাব। আর যদি আগে বা পরে ফিরিস, তা হলে অফিসে গিয়ে আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাসায় আসবি।

জাভেদ দুপুরে বাসায় এসে আমজাদের জন্য দু’টো পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতে বসল। তারপর আড়াইটা পর্যন্ত বাসায় থেকে অফিসে চলে গেল।

পাঁচটার কিছু আগে জাভেদ ও আয়শা ফিরল। আয়শা আগে ফিরেছে। তাই জাভেদ আসার পর জিজ্ঞেস করল, আমজাদ ভাই দুপুরে ফিরে খেয়েছে?

জাভেদ বলল, আমি ওর জন্য আড়াইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর অফিসে গেছি। ফিরতে দেরি হলে অফিসে গিয়ে চাবি নিতে বলেছিলাম, তাও যায়নি।

আয়শা বলল, খুব চিন্তার কথা। এর আগে আর কখনো চট্টগ্রাম আসেনি বলল। কোনো বিপদে পড়ল নাতো?

জাভেদ বলল, তোমার কথা যুক্তিসংগত হলেও আমার সে রকম মনে হচ্ছে না। ও খুব এক্সপার্ট ছেলে। বিপদে পড়লে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল জানে।  

তুমি কী বলতে চাচ্ছ, সে এখনো ভার্সিটিতেই রয়েছে?

তা ঠিক বলছি না, আমার মনে হয় পরিচিত কারো সঙ্গে হয়তো দেখা হয়ে গেছে। সে ছাড়ে নি।

ওরা ড্রইংরুমে বসে কথা বলছিল। এমন সময় জাভেদ জানালা দিয়ে আমজাদকে আসতে দেখে বলল, ঐ তো এসে গেছে। তারপর দরজা খুলে দিল।

আমজাদ রুমে ডুকে সালাম দিয়ে জাভেদের পাশে বসল।

জাভেদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কীরে, এই বুঝি তোর দু’টোর মধ্যে ফেরা?

আয়শা আমজাদের চেহারা দেখে বুঝতে পারল,তার উপর ছোট খাট ঝড় বয়ে গেছে। স্বামীর কথা শুনে বলল, তুমি থামতো, দেখছ না আমজাদ ভাইকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে?

জাভেদও তা লক্ষ্য করে বলল, কী ব্যাপার বলতো, তোকে অত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?

আমজাদ আসার সময় চিন্তা করেছে ফিরতে দেরি দেখে বন্ধু ও বন্ধুপত্নী কারণ জিজ্ঞেস করবেই। যদি সত্য ঘটনা বলি, তাহলে দুজনেই শারমিনকে নিয়ে নানান কথা বলে ঠাট্টা ইয়ার্কি করবে। তাই কি বলবে ভেবে রেখেছিল। বলল, হাইজাকারদের পাল্লায় পড়েছিলাম। তারা আমাকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে মনমতো টাকা পয়সা না পেয়ে আটকে রেখে মুক্তি পণ চাওয়ার কথা যখন বলাবলি করছিল তখন তাদেরকে পরিচয় দিয়ে বললাম, আমার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। আমি লোকের বাড়িতে লজিং থেকে অনেক কষ্টে বি.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। চাকরির জন্য সনদপত্র তুলতে ভার্সিটিতে এসেছিলাম। বিশ্বাস না হয়। আমার সনদপত্র দেখুন। হাইজাকার ছেলেগুলো শিক্ষিত। সনদপত্র দেখে তাদের লীডার ছেড়ে দিল। তাই ফিরতে দেরি হল।

জাভেদ ও আয়শা একসঙ্গে বলে উঠল, তা হলে তো খাওয়া দাওয়া হয় নি?

আমজাদ বলল, সে জন্য তোদের কিছু ভাবতে হবে না। সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। এখন আর ভাত-টাত খাব না। চা নাস্তা খাব।

আয়শা তার কাপড়ে রক্তের দাগ দেখতে পেয়ে বলল, তোমার কাপড়ে রক্তের দাগ কেন? মারধর করেছিল না কী?  

আমজাদ বলল, ও কিছু নয়, প্রথমে হাইজাকারদের সঙ্গে খানিকটা মারামারী করেছিলাম। সে সময় ওদের কারো রক্ত কাপড়ে লেগেছে। আমার গায়ে আঁচড় পর্যন্ত দিতে পারে নি। ওদের একজনের কাছে পিস্তল ছিল। তাই ধরা দিয়েছিলাম, নচেৎ আমাকে কাবু করতে পারত না।

জাভেদ জানে দু’চারটা হাইজাকারকে আমজাদ খোঁড়াই কেয়ার করে। তাই ঐ ব্যাপারে আর কিছু না বলে বলল, ঠিক আছে, কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নে। তারপর স্ত্রীকে বলল, যাও চা নাস্তার ব্যবস্থা কর।  

ঐদিন বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে আমজাদ ঘুমাতে গেল। কিন্তু চোখে ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করলে কেবলই শারমিনের বড় বড় মায়াবী চোখ ও অনিন্দ সুন্দর মুখের ছবি মনে পড়তে লাগল। তার মনে হল, এই রকম মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে জীবনে সুখী হওয়া যায়। হঠাৎ তাদের বাসার। পরিবেশের কথা মনে পড়তে ভাবল, ওরা নিশ্চয় খুব বড় লোক। ওর বাবা কী আমার মতো গরিব ছেলের হাতে মেয়েকে দেবেন। চিন্তাটা মন থেকে দুর করার চেষ্টা করে ও সফল হল না। শেষে ভেবে রাখল, কাল ঢাকা যাওয়ার আগে মেয়েটিকে একবার দেখে তারপর যাবে।

পরের দিন আমজাদ আটটার বাস ধরার কথা বলে নাস্তা খেয়ে বন্ধু ও বন্ধু পত্নীর কাছে আবার আসার ওয়াদা করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে একটা খালি রিকসা দেখতে পেয়ে উঠে বসে রিকশাওয়ালাকে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে যেতে বলল।

হাসপাতালটা পাহাড়ের উপর। তাই গেটে রিকশা থেকে নেমে হেঁটে হাসপাতলে শারমিনের বেড়ের কাছে গিয়ে দেখল, সে ঘুমাচ্ছে।

তাকে দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল, উনি সারা রাত-ব্যথায় ঘুমাতে পারেন নি। ছটার দিকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ান হয়েছে। তাই ঘুমাচ্ছেন, জাগাবেন। । গতকাল এই নার্সই ডিউটিতে ছিল। তাই সে আমজাদকে চিনতে পেরেছে।

আমজাদ জিজ্ঞেস করল, রাত্রে পেসেন্টের কাছে কেউ ছিল না?

ওঁর মা ছিলেন। ঘুমিয়ে পড়ার পর বাসায় গেছেন।

উনি এলে বলবেন, আমি এসেছিলাম। তারপর শারমিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমজাদ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে রিকশা নিয়ে বাস ধরার জন্য রওয়ানা দিল। তারপর আজ একবছর হয়ে গেল চাকরির চেষ্টায় ঢাকায় রয়েছে। এর মধ্যে দুতিনবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। প্রত্যেক বারে জাভেদের চিঠি পেয়েছে। চিঠিতে ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে যেতে বলেছে। আমজাদের ইচ্ছা থাকা সত্বেও লজিং ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে যেতে পারে নি। ভেবেছিল, চাকরি পেলে যাবে। তাই আপাতত অপারগতার কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে চিঠির উত্তর দিয়েছে। এই চিন্তা করতে করতে কখন যে রাত শেষ হয়ে গেছে আমজাদ বুঝতে পারল না। সারারাত সে যেন স্বপ্ন দেখছিল। ফজরের আজান শুনে বাস্তবে ফিরে এল। বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের কাজ সেরে নামায পড়ার জন্য মসজিদে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *