কে ডাকে তোমায় – ২

দুই

চম্পাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। চম্পার ভালো নাম সাবিনা ইয়াসমিন। তার গায়ের রং চাপা ফুলের মতো বলে তার মা রাহেলা খাতুন মেয়ের ডাক নাম রাখেন। চম্পা। চম্পারা দুই ভাই ও দুই বোন। তাদেরকে ছোট রেখে তাদের বাবা আব্দুল মারা যান। আব্দুল নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক ছিলেন। জমি জায়গা তেমন ছিল না। যতটুকু ছিল, অভাবের তাড়নায় তাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। মারা যাওয়ার সময় তাদের শুধু বাস্তুভিটে ছিল!

চম্পার বড় ভাই বশির প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে আর পড়েনি। বাবার সঙ্গে অন্যের ক্ষেতে খামারে কাজ করত। বাবা মারা যাওয়ার পর একা খেটে সংসার চালাতে না পেরে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বাস্তুভিটে বেঁচে ঢাকার অদুরে ধোলাই পাড়ে দু’কাঠা জমি কিনে পাঁচ ছটা বেড়ার রুম করে। দুটো রুমে নিজেরা থাকে, বাকি গুলো ভাড়া দেয়। আর গুলিস্তানের বঙ্গবাজারে একটা দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে রেডিম্যাট কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে। তারপর ভাইবোনদের স্কুলে ভর্তি করে দেয়। বশিরের পরের বোন শিউলি। এস.এস.সি পড়ার সময় একই ক্লাসের করিম নামে একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। শিউলির পরে চম্পা। সে এখন এইচ. এস.সি, পড়ে। সবার ছোট ভাই রাজু নাইনে পড়ে। তাদের মা রাহেলা খাতুন গ্রামের অশিক্ষিত মহিলা। বিধবা হলেও তার চাল চলনে তা বোঝা যায় না। গ্রামে অভাব অনটনে দিন কাটিয়েছেন। ঢাকায় এসে বাড়ি ভাড়া ও দোকানের আয়ে এখন সাংসারিক অবস্থা একটু স্বচ্ছল। তাই দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। ছেলে মেয়েরাও বেশ অহঙ্কার দেখায়। সামান্য ব্যাপার নিয়ে রাহেলা খাতুন পাড়া প্রতিবেশির সাথে ঝগড়া করেন। সে সময় মুখ খারাপ করে গালাগালিও করেন। এরা শিক্ষিত লোকের কদর বুঝে না। এরা যে, ছোট লোক শ্রেণীর মানুষ আমজাদ এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই তা বুঝতে পারে। অনেক চেষ্টা করেও অন্য কোথাও লজিং এর ব্যবস্থা করতে না পেরে একরকম বাধ্য হয়েই এখানে রয়েছে।

চম্পা চলে যাওয়ার পর আমজাদ ঘুমাতে গেল; কিন্তু চোখে একফোঁটা ঘুম এল না। চম্পার কথা ভাবতে ভাবতে তার বিগত জীবনের কথা মনের পাতায়। ভেসে উঠল।

আমজাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার কান্দিরপাড় গ্রামে। গ্রামটা তেমন বড় না হলেও পরিবেশ খুব সুন্দর। গ্রামের চতুর্দিকে খোলা মেলা মাঠ। বর্ষা মওসুমে যখন মাঠ পানিতে থৈ থৈ করে তখন গ্রামটাকে একটা দ্বীপের মতো মনে হয়। আর মাঠ যখন ফসলে ভরা থাকে তখন মনে হয় গ্রামটি শষ্য শ্যামলে ভরা মাঠকে উঁকি মেরে দেখছে। গ্রামের ঘরগুলোর দরজা জানালা খুবই সুন্দর। এখানকার মানুষগুলোও একেবারে সহজ সরল। তাদের মধ্যে কোনো কুটিলতা, হিংসা বা বিদ্বেষ নাই। প্রত্যেকের কিছু না কিছু জায়গা জমিও ব্যবসা বানিজ্য আছে। তাই তাদের কোনো অভাব নেই। এখানে একটা মসজিদ ও মক্তব আছে।  

এই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে আমজাদ। তার বাবা মোঃ লিয়াকত আলি। তিনি আদর্শ কৃষক। তাঁর দাদা জসিমউদ্দিন ছিলেন একজন সমাজ সেবক। তিনি নলুয়া গ্রামের প্রভাব-প্রতাপশালী সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন। জসিমউদ্দিনের চার ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলেরা কেউ চাকরি এবং কেউ চাষবাসের কাজ করতেন। সবার বড় লিয়াকত আলি। তিনি বিয়ে করেন খলারপাড় মুনসী বাড়িতে। আমজাদের নানা মহিউদ্দিন বিরাট অর্থ সম্পদের মালিক এবং অত্র এলাকার গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। আঠাশ সদস্যের বিরাট সংসার খুব নিয়ম শৃঙ্খলার সঙ্গে চালাতেন। ধর্মের বিধি বিধান নিজে যেমন মেনে চলতেন, তেমনি পরিবারের সবাইকেও মেনে চালাতেন। এক কথায় বৃহৎ একটা মুসলিম পরিবার। আমজাদের মামারা তিনজন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও চাকরি জীবী। তার মা-খালারা তিনজন। সবার বড় কামরুন্নেশা। মহিউদ্দিন বড় মেয়ে কামরুন্নেশার বিয়ে দেন কান্দিরপাড় গ্রামের লিয়াকত আলির নিকট। লিয়াকত আলির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে নুরুন্নেশাকে নাইনে পড়ার সময় চান্দিনার এক চাকুরিজীবি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে জেবুন্নেশাকে টেনে পড়ার সময় বিয়ে দেন চট্টগ্রামের মীরসরাই এর চৌধুরী বাড়িতে। জামাই কুয়েতে চাকরি করে। সবার ছোট আমজাদ। সে বোনেদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত । শুধু ঐ পরিবারের মধ্যে নয় কান্দিরপাড় গ্রামের মধ্যে সে প্রথম ও একমাত্র গ্রাজুয়েট। আমজাদ পাড়ার বা গ্রামের কোনো আজে-বাজে ছেলের সঙ্গে কখনও মেলামেশা করে নি। তবে তার ফুটবল খেলার খুব নেশা ছিল। তার একমাত্র আশা ছিল, মন দিয়ে লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষা নিবে এবং উপার্জন করে মা-বাবার খিদমত করে তারেদকে সুখী করবে।  

তার বয়স যখন চার কি পাঁচ তখন দাদা জসিমউদ্দিন মারা যান। উনি মারা যাওয়ার পর ছেলে মেয়েদের মধ্যে জমি জায়গা ভাগ বাটোয়ারা করে আলাদা করা হয়। ফলে লিয়াকত আলি পৈত্রিক সম্পত্তি তেমন বেশি পান নাই। ছয় সাত সদস্যের সংসার খুব কষ্টের সঙ্গে চালাতেন। গ্রামের মধ্যে একমাত্র তাদেরই অবস্থা খারাপ। অন্যান্যদের প্রচুর জমি-জায়গা ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকায় তাদের ছেলেরা লেখাপড়া না করে এসব নিয়ে ব্যস্থ থাকত। তাই ঐ গ্রামে লেখাপড়ার পরিবেশ গড়ে উঠেনি। আমজাদ জ্ঞান হওয়ার পর গ্রামের পরিবেশ ও নিজেদের আর্থিক দুরবস্তা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। ছোট বেলায় একটু দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। যখন সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে তখন একদিন পাড়ার সাথিদের সঙ্গে চাচাঁদের গাছ থেকে নারিকেল ও শুপারি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। চাচা তেমন কিছু না বললেও বাবার হাতে মার খেয়েছিল বেদম।

সেই রাগে কয়েক দিন পর এক গভীর রাতে ঐ সব সাথিদের নিয়ে পাশের বাড়ির মুরগীর খোঁয়াড় থেকে পাঁচ ছয়টা মোরগ চুরি করে মাঠে গিয়ে পিকনিক করে। পরের দিন কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এই খবর জানতে পেরে তার নানা মেজ ছেলে জহির উদ্দিনকে পাঠান। তিনি একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইহজগতে নেই। তিনি এসে বুবু ও দুলাভাইকে বললেন, এখানে থাকলে আমজাদের লেখাপড়া হবে না। আমাদের দু’জন গৃহ শিক্ষক আছেন। ওকে আমি নিয়ে যাই। সেখানে ভালোভাবে লেখাপড়া করে মানুষ হবে।

লিয়াকত আলি ও কামরুন্নেশা আমজাদকে তার মেজ মামার সঙ্গে পাঠিয়ে দেন।

আমজাদ নানার বাড়ির ভালো পরিবেশে ও তাদের আর্থিক সহযোগীতায় ভালোভাবে লেখাপড়া করতে লাগল। এখানেই ধর্মীয় পরিবেশে থেকে ধর্মের সব কিছু মেনে চলতে শুরু করে এবং নানার ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ে দ্বীনি এলেম হাসিল করে। আড্ডা উমেদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু বৃত্তি পায়নি। তবে স্কুল পরীক্ষায় ফাষ্ট হয়েছিল। পরবর্তিতে ঝুলম উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়। এক বছর নানার বাড়ি থেকে স্কুলে যাতায়াত করে। টেনে উঠার পর স্কুলের কাছাকাছি একটি বাড়িতে লজিং নেয়। লজিং এ দু’তিনজন ছাত্র ছাত্রী পড়াতে হত। ফলে এস.এস.সি’তে আশানুরূপ ফল হল না। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। তারপর বরুড়া শহীদ স্মৃতি সরকারী কলেজে ভর্তি হয় এবং এইচ. এস.সি. পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে পাশ করে। তারপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজে ম্যানেজমেন্টে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। মাস খানেক ক্লাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও তার আণ্ডারে যত কলেজ আছে সবগুলোতে একটানা নয় মাস শিক্ষক ধর্মঘট চলে। তিন মাস অপেক্ষা করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চৌমুহনী সরকারী কলেজে বি.এস.সি. পাস কোর্সে ভর্তি হয়। কলেজের পরিবেশ যেমন মনোরম তেমনি লেখাপড়ার পরিবেশও খুব সুন্দর। লাকসাম নোয়াখালি রেললাইন থেকে তিন মাইল দূরে মহেশপুর গ্রামে ছিমছাম ও পরিপাটী একটা বাড়িতে লজিং পেল। এই বাড়ির লোকজন ছিল উঁচু মনের মানুষ এবং বিত্তবান।

চৌমুহনী বাজারে তাদের কয়েকটি দোকান ও হোটেল আছে। তা ছাড়া বিষয় সম্পত্তি প্রচুর। লেখাপড়ার ব্যাপারে তারা আমজাদকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিতেন। যাদেরকে পড়াত তাদের এক দাদি ছিলেন। তিনি সব সময় মাস্টারের খোঁজ খবর নিতেন। এবং লেখাপড়া ভালোভাবে করার জন্য উৎসাহিত করতেন। মাষ্টারের কোনো বিষয়ে কোনো রকম অসুবিধা যাতে না হয়, সেজন্য ছেলে বৌদের সাথে প্রায়ই চিল্লাচিল্লি করতেন। খাওয়ার সময় হওয়ার সাথে সাথে টেবিলে খাওয়ার দেওয়ার ব্যবস্থা করে মাষ্টারকে ডেকে পাঠাতেন।

একবার আমজাদ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে তিন দিনের কথা বলে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াবার পর টেকনাফে বার্মা সীমান্ত নাফ নদী পর্যন্ত দেখতে গিয়েছিল। তাই ফিরে আসতে ছয় দিন সময় লাগে। এদিকে লজিং বাড়ির লোকেরা মাষ্টারের খোঁজ নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে খবর পাঠিয়েছিলেন।

লজিং বাড়ির বড় কর্তা একদিন আমজাদকে বললেন, “বাউরে, আঁই আঁন্নেরে এককান কহথা কই। আন্নে যহন হড়ার লাই আঁনগো বাইত আইছেন তহন আনে আন্নের হড়া বাত দিয়া আঁর হুলাহান গো বেশি হড়ান লাগতো ন। কারণ অন্নের মা বাপ ছাইড়া আঁর বাইত আইছেন হড়ার জন্য। আঁনে অহন থাইক্যা আঁনের হড়া ঠিক রাইহেন বুঝঝেননি? আঁর হুলাহান ছোড। এদের হড়ার অনেক সময় আছে। কিন্তু বাজি, এককান কতা মনে রাইনে, আঁর বাইত থ্যাইক্যা যদি আঁন্নে পরীক্ষায় ভালা করতেন হারেন, তা অইলে আর এককান নাম অইব। আন্নের মা-বাবার মনডা খুশীতে ভইরা হুডবো। তবে বাউরে, মোরা ডাল-ভাত, হানি যা খাই আঁনেও আঁংগোলগে তা খাইবেন।” বড় কর্তার কথা শুনে আমজাদ খুশী হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। তাঁর অনুমতিক্রমে আমজাদ ভালভাবে পড়া শোনা করে টিউটোরিয়াল পরীক্ষাগুলোতে খুব ভালো রেজাল্ট করল। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষও খুশী হয়ে তার বেতন ফ্রি করে দেয়।

একদিন প্রিন্সিপাল তাকে ডেকে বললেন, “তোমাকে দিয়ে আমি এই কলেজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই। আশা করি, তুমি বি.এস.সি. (পাশ) শ্রেনীতে ফাষ্ট হয়ে আমার ও কলেজের সুনাম বাড়াবে।”

প্রিন্সিপালের কথা শুনে আমজাদ ভক্তিগদগদ কণ্ঠে বলল, আপনি দোয়া করুন স্যার, আল্লাহ যেন আমাকে আপনার আশা পূরণ করার তওফিক দেন।

প্রিন্সিপাল বললেন, তাতো নিশ্চয় করব।

এরপর আমজাদ কঠোর পরিশ্রম করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে লাগল। ফলে টেষ্ট পরীক্ষায় ফাষ্টক্লাস ফাষ্ট হল।

প্রিন্সিপাল খুশী হয়ে ফরম পূরণের সময় যত টাকা চার্জ সব কলেজ ফাণ্ড থেকে পরিশোধ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন আমজাদের ভীষণ জ্বর হল। সেই অবস্থায় অতিকষ্টে পরীক্ষা দিল। ফলে সামান্য কয়েকটা নাম্বারের জন্য ফাষ্ট ক্লাস পেল না। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোন পর্যন্ত আমজাদ ঐ লজিংএ ছিল।

তারপর বাড়িতে এসে কয়েক মাস পেরপেটি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। এম.এস.সি. পড়ার জন্য চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা আসে। ঢাকা আসার পর ভার্সিটিতে এম.এস.সি’তে ভর্তি হল। কিন্তু থাকার কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে খুব অসুবিধায় পড়ে গেল। তার এক চাচাত ভাই বেলী রোডে একটা প্রেসে চাকরি করত। তার কাছে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। আর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় চাকরি করত মালিবাগে এক অফিসে। অফিসেই সে থাকত। আমজাদ তাকে অনেক অনুরোধ করে রাত্রে তার সঙ্গে ঐ অফিসের টেবিলের উপর অথবা ফ্লোরে শোয়ার ব্যবস্থা করল। বিকেলে স্বামীবাগে একটা টিউশনি করত। দিনে বিশ্রাম নেওয়ার মতো তার কোনো জায়গা ছিল না। অফিস টাইমে চাকরির সন্ধান করত এবং বাকী সময় লজিং খুঁজে বেড়াত। চাকরি ও লজিং ঢাকা শহরে সোনার হরিণের মতো বলে আমজাদের মনে হল। তার বড় দুলাভাই বগুড়ায় চাকুরি করে। ফ্যামিলী নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকে। একদিন ঐ বোনের চিঠি গেল। লিখেছে “তোর দুলাভাই এক আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার পোস্টে চাকরি ঠিক করেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়।” চিঠি পাওয়ার পরের দিন বগুড়ায় গিয়ে দুলাভাইকে নিয়ে হোটেলের মালিকের সঙ্গে দেখা করল।

মালিক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়?

আমজাদ বলল, কুমিল্লা।

কোয়ালিফিকেশন কী?

বি.এস.সি. সেকেণ্ড ক্লাস।

এখানে থাকবেন কোথায়?

দুলাভাইকে দেখিয়ে বলল, ইনাদের বাসায়।

শুনুন, আগের ম্যানেজার খুব ভালো ছিল। কিন্তু কয়েকদিন আগে-ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাই আপনাকে দশ হাজার টাকা জামানত দিতে হবে। এখানেই থাকবেন খাবেন আর ছশ টাকা বেতন পাবেন। মাঝে মাঝে বাসার বাজার করে দেবেন। আর আমাকে না বলে কোথাও যেতে পারবেন না।  

আমজাদের চাকরি পছন্দ হল না। মালিককেও পছন্দ হল না। তা ছাড়া দশ হাজার টাকা জামানত দেওয়ার তার ক্ষমতাও নেই। তাই লেখাপড়া করার অজুহাত দেখিয়ে পরের দিন ঢাকা ফিরে এল।

আমজাদ যে আত্মীয়ের অফিসে রাতে থাকত, সেটা অফিসের সাহেবের বাসার নিচতলা। সেই বাসায় এসে শুনল, সাহেবের ছয় বছরের মেয়ে মিতুর হাত ঘড়ি চুরি হয়ে গেছে। বেগম সাহেব আমজাদকে চার্জ করলেন, আমার মেয়ের ঘড়ি কোথায়?

শুনে আমজাদের মাথায় বাজ পড়ার মতো হল। কোনো রকমে বলল, এ আপনি কী বলছেন? আমি গতকাল বগুড়া গিয়েছিলাম। এখনই ফিরলাম। আপনার মেয়ের ঘড়ি কোথায় আমি বলব কি করে?

আপনি মিথ্যা বলছেন। গতকাল ঘড়ি চুরি করে বগুড়া গিয়েছিলেন। এক্ষুনি ঘড়ি বের করুন, নচেৎ অসুবিধা হবে।

আপনি শুধু শুধু আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। আমি আপনার মেয়ের ঘড়ি নিইনি।

বেগম সাহেব রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, হয় ঘড়ি বের করুন, নচেৎ এক্ষুনি এখান থেকে বিদায় হন। তারপর আমজাদের ঐ আত্মীয়কে অনেক রাগারাগি করে বললেন, চাচাতো ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে একজন চোরকে এখানে

আশ্রয় দিয়েছেন। আর এক মুহূর্ত যেন ঐ চোর এখানে না থাকে।

তখনই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে আমজাদ সেখান থেকে চলে এল। তারপরও রক্ষা পেল না। যে প্রেসে খাওয়া দাওয়া করত, সেই প্রেসের মালিকের কাছেও তারা ঘড়ি চুরির ব্যাপারটা জানিয়ে সাবধান করে দিল। ফলে প্রেসের মালিক ঐ দিন থেকেই সেখানে খাওয়া নিষেধ করে দিলেন।

আমজাদ খুব মুষড়ে পড়ল। ভারাক্রান্ত মনে সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে লাগল, এখন সে কি করবে? কোথায় থাকবে? কোথায় খাবে? হঠাৎ তার কুরআন পাকের একটা আয়াত মনে পড়ল, “ইন্নালাহা মায়াস সাবেরিন” নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন”। [সূরা বাক্কারা ১৫০ আয়াতের শেষ অংশ পারা-২]

আরো মনে পড়ল, আল্লাহ মুমীন বান্দাদের বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। আমজাদ ঢাকা আসার আগেই শুনেছিল, তাদের দেশের দূর সম্পর্কের এক চাচাত ভাই শ্যামলীতে থাকে। সে নাকি লজিং ও টিউসনির ব্যবস্থা করে দিতে পারে। সেকথা মনে পড়তে ফার্মগেটে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে সব ঘটনা খুলে বলল। চাচাত ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার এখানে থাকার ব্যবস্থা নেই। আর এই মুহূর্তে লজিং বা টিউসনির ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। তোমার ঢাকায় থাকার দরকার কী? আমি বাস ভাড়া দিচ্ছি, তুমি বাড়ি চলে যাও। পরে এক সময় টাকা ফেরৎ দিয়ে দিও। যখন কোনো ব্যবস্থা করতে পারব তখন খবর দেব।”

আমজাদের এই চাচাত ভাইয়েদের পূর্ব পুরুষরা যে তাদের ভালো কামনা করে না, তা জানত। তাই আর কিছু না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গুলিস্তানে এক হোটেলে কম টাকায় কয়েকদিনের খাওয়ার ব্যবস্থা করল। আর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটায়। সপ্তাহ খানেক পরে এক দোকানদারের সহায়তায় গোপীবাগে এক বাসায় লজিংএর সন্ধান পেল। দুজন ছাত্রীকে পড়াতে হবে। একজন এইটে অন্যজন টেনে পড়ে। স্কুলে পড়লেও তাদেরকে কলেজ ছাত্রী মনে হয়। অবশ্য আমজাদ তখন সে কথা জানত না।

আমজাদ দোকানদারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ঐ বাসায় গেল। গৃহকর্তা নানা রকম প্রশ্ন করে সদউত্তর পেয়ে বললেন, আপনাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। যে দোকানদার আপনাকে পাঠিয়েছে কাল তার সঙ্গে দেখা করবেন।

আমজাদ সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে চলে আসার সময় মনে মনে আল্লাহকে জানাল, “আল্লাহ তুমি রহমানুর রাহিম, আমার উপর রহম কর। এখানে যেন লজিংটা পাই।”

ঐ দিন ছাত্রীদের মা-বাবা দোকানদারকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, মাষ্টারকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। তবে কথা হল, আপনিতো জানেন, আমার মেয়ে দুটো বিয়ের উপযুক্ত। তাই মাস্টারের চরিত্র কেমন, তা পরীক্ষা করব। আপাততঃ আমাদের প্লাস্টিক কারখানায় কয়েক দিন রাত্রে থাকবে। বাসায় মেয়ে দুটোকে পড়াবে আর খাওয়া দাওয়া করবে। এতে যদি মাষ্টার রাজি থাকে, তাহলে তাকে পাঠিয়ে দেবেন।

পরের দিন আমজাদ দোকানদারের কাছে সব কিছু শুনে রাজি হয়ে গেল। তাঁদের কথামতো কারখানায় গিয়ে উঠল। কিন্তু কারখানার পরিবেশ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। সেখানে থাকার বা বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন লোকজন আসা যাওয়া করে। কর্মচারীরা রাত বারটা একটা পর্যন্ত কাজ করে। কারখানা আগুনের মতো গরম হয়ে থাকে। সারাদিন চাকরির চেস্টায় ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় ছাত্রীদের পড়িয়ে খাওয়া দাওয়া করে কারখানায় ঘুমাতে আসে। কিন্তু ঘুমাবার পরিবেশ নেই। একটা টেবিল সরিয়ে বিছানা করতে হয়। তখনও কর্মচারীরা কাজ করে। ফলে গোটা কারখানা আগুনের মতো গরম থাকে। তার উপর ঐ রূমে ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। গরমের জন্য আমজাদ ঘুমাতে পারত না। অধিকাংশ রাত্রে কারখানার গলি পথে পায়চারী করে রাত কাটাতে লাগল।

কয়েক দিনের মধ্যে ছাত্রীদের মা-বাবা বুঝতে পারলেন, সত্যিই মাস্টার খুব ভালো ছেলে। তাদের ফ্যামিলীর সবাই-ই সিনেমা দেখতে অভ্যস্থ। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও সিনেমা দেখতে যেত। ছাত্রীরা মাষ্টারকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলত। কিন্তু আমজাদ যেত না। বরং সিনেমা দেখা যে উচিত নয় এবং ইসলামের দৃস্টিতে নিষেধ তা বোঝাত। বড় ছাত্রীর নাম মিতু, আর ঘোটর নাম জিবু। এই কয়েক দিনেই মিতু যে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তা আমজাদ বুঝতে পেরে সাবধান। হয়ে গেল। যেদিন সবাই সিনেমা দেখতে যাবে তার আগের দিন মিতু আমজাদকে। বলে স্যার, আপনি কাল আমাদের সঙ্গে হলে ছবি দেখতে যাবেন।

তখন আমজাদ হা-না কিছু না বলে পড়াতে থাকে। পরের দিন তাদের বাসায় দুপুরে খেতে আসে না।  

একদিন বাসার সবাই সিনেমা দেখতে গেছে; কিন্তু মিতু শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে যাইনি। ঐ দিন আমজাদের খেতে আসতে দেরি হল। তিনটের দিকে খেতে এলে মিতু খাবার নিয়ে এলে বলল, বাসায় আর কেউ নেই নাকী? একদম চুপ চাপ যে?

মিতু বলল, আমি ছাড়া সবাই সিনেমা দেখতে গেছে। তারপর তার পাশে বসে বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে আমার একটা জরুরী কথা আছে, খাওয়ার পর আজ এখানেই রেষ্ট নেবেন। তা ছাড়া বাসায় একা একা থাকতে ভয় লাগছে। সবাই ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনি থাকবেন।

তার কথা শুনে আমজাদ খাওয়া বন্ধ করে চিন্তা করল, এর মধ্যে নিশ্চয় মিতুর কোনো ষড়যন্ত্র আছে।

মিতু বলল, কী হল স্যার? খাওয়া বন্ধ করে কী ভাবছেন?

আমজাদ সামলে নিয়ে খেতে শুরু করে বলল, না তেমন কিছু না। তোমার জরুরী কথাটা এখন বল।

কেন? খাওয়ার পর বললে কী আপনার আপত্তি আছে?

না, তা নয়। আমার কাজ আছে, এক্ষুনি যেতে হবে। তাই বলছি; যা বলার এখনই বল।

আপনার কষ্ট দেখে আমি আম্মাকে বলেছি, বাসাতে থাকার ব্যবস্থা করতে। আম্মা রাজি হয়েছে। আর একটি কথা খাওয়ার পর বলব, আপনি খান, আমি আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেব।

তার কথা শুনে আমজাদ যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, বললাম না, আজ জরুরী কাজে এক জায়গায় এক্ষুনি যেতে হবে? অন্য দিন তোমার কথা শুনব।

মিতু উত্তেজিত স্বরে বলল, না, আজই আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে। আমজাদ আর কিছু না বলে খেতে লাগল।

খাওয়া শেষ হওয়ার পর মিতু যখন থালা বাটি নিয়ে অন্য রুমে রাখতে গেল তখন আমজাদ সেখান থেকে চলে এল।  

সন্ধ্যার পর আমজাদ তাদের পড়াতে গেল। কিন্তু ছাত্রীরা পড়তে এল না। বাসাটা নিস্তব্ধ মনে হল। কি করবে না করবে ভাবছে এমন সময় মিতুর আম্মা এলেন।

আমজাদ দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

মিতুর মা গম্ভীর স্বরে সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, দুপুরে মিতুকে কী বলেছেন? সে খুব কান্না কাটি করছে।  

মিতু কান্নাকাটি করছে শুনে আমজাদ বেশ অবাক হয়ে কি বলবে না বলবে ঠিক করতে না পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল

মিতুর মা বললেন, যাক বাবা, কি বলেছেন না বলেছেন বাদ দেন। আপনার কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনি আমার সন্তানের মতো, আজই কারখানা থেকে আপনার সব কিছু নিয়ে বাসায় চলে আসুন।

যারা জেনে শুনে একজন মাষ্টারকে কারখানায় অযোগ্য ও কষ্টকর পরিবেশে রাখতে পারেন, তারা আজ হঠাৎ বাসায় রাখতে চাচ্ছেন শুনে আমজাদ বুঝতে পারল, মিতু নিশ্চয় তার মনের কথা মা-বাবাকে জানিয়েছে এবং তারাও মেয়ের মতের সঙ্গে একমত। তাই মনে মনে এখান থেকে কেটে পড়ার চিন্তা করে মিথ্যে করে বলল, চাচি আম্মা, আমি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এসসি’তে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, আজই খবর পেলাম, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। দু’একদিনের মধ্যে আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে।

তার কথা শুনে মিতুর মায়ের মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ ভার করে বললেন, ঢাকাতে ভর্তি হওয়া যায় না?

জ্বি না।

মিতুর মা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের কোনো ছেলে সন্তান নেই। আপনাকে নিজের ছেলেরমতো ভেবেছি, তাই আপনি চলে যাবেন শুনে দুঃখ পেলাম। যাক বাবা, আপনি যখন লেখাপড়া করার জন্য চলে যেতে চাচ্ছেন তখন তো আর বাধা দিতে পারি না। তবে বাবা, যেখানেই থাকেন না কেন চিঠি পত্র দেবেন। ঢাকায় এলে আমাদের বাসায় উঠবেন।

পরের দিন আমজাদ তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আবার আসার আশ্বাস দিয়ে চলে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *