কামিনী কাঞ্চন – ৭

নাহিদ দিনাজপুর থেকে ফেরার পথে বাড়িতে এক দিন ছিল। সে সময় আব্বাকে তার বন্ধুর কথা বলে এসেছে।

কয়েকদিন পরে মাল আমদানি ও রপ্তানির ব্যাপারে নাহিদকে মাস তিনেকের জন্য লন্ডন ও আমেরিকা যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে নাহিদার একটা চিঠি পেল। চিঠিটা গতকাল এসেছে। খুলে পড়তে লাগল–

চির কাক্ষিত নাহিদ,

প্রথমে আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিও। পরে জানাই যে, এখান থেকে যাবার সপ্তাহখানেক পর ফোন করে জানতে পারলাম, তুমি দেশের বাইরে গেছ, ফিরতে দু’তিন মাস দেরি হবে। জেনে আল্লাহ পাকের দরবারে ফরিয়াদ করেছি, যে কাজের জন্য গেছ, তা ভালোভাবে সমাধা করে সুস্থ শরীরে যেন ফিরে আসতে পার। আমাকে না জানিয়ে যাওয়ার কৈফিয়ৎ চাইব না। শুধু জানতে চাই, আমার কথা তোমার মনে আছে কিনা? এতদিনে ফিরেছ কিনা জানি না; তবু মনের তাগিদে এই চিঠি লিখলাম। কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের মিল পনেরো দিন বন্ধ থাকবে। আঙ্কেল ওখানে বড় খালার বাসায় বেড়াতে যাবার জন্য বলছে। বড় খালাও যাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে। আর আমি তো যেতেই চাই; কিন্তু তুমি নেই। তাই যেতে মন চাচ্ছে না। ভেবেছি, তোমার চিঠি পেলে ডিসিশান নেব। জোর করে চিঠির উত্তর চাওয়ার অধিকার নেই। ইচ্ছে করলে দিও। লেখায় ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা করো। আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ

ইতি তোমার, শুধু তোমারই
নাহিদা।

চিঠি পড়ে নাহিদ খুব অনুতপ্ত হলো। ভাবল, নাহিদাকে না জানিয়ে বিদেশ গিয়ে খুব অন্যায় করেছি। বেচারি খুব দুঃখ পেয়েছে। যা রাগি মেয়ে, চিঠিতে বা ফোনে কাজ হবে না। কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে সশরীরে যেতে হবে।

একটা প্রবাদ বাক্য আছে, “ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস”, নাহিদের বেলাতে তাই হলো। অফিসের কাজের চাপে শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছুটি নিতে পারল না।

কয়েকদিন পর একদিন লাঞ্চ খেয়ে এসে ফাইলে হাত দিয়েছে, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, ম্যানেজার নাহিদ বলছি।

ওপাশ থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে ফাইলে চোখ বোলাতে লাগল। এমন সময় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।

নাহিদ বিরক্ত হয়ে ফোন ধরে আগের কথাগুলো রিপিট করল।

এবারে ওপাশ থেকে একটা মেয়ে ভিজে গলায় সালামের উত্তর দিয়ে বলল, দিনাজপুর থেকে নাহিদা বলছি। আমি কাল ঢাকা রওয়ানা হচ্ছি। পরশুদিন তিনটের ফ্লাইটে আসছি। তুমি এয়ারপোর্টে থাকবে। তারপর ফোন রেখে দেবার

শব্দ পেল।  

নাহিদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন রেখে দিয়ে চিন্তা করল এত তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিল কেন? গলার স্বর ভিজে মনে হলো। তাহলে কি কান্না শুনতে পাব বলে ছেড়ে দিল?

কামিনী কাঞ্চন,

brs

ঐদিন বিকেলে অফিস থেকে বেরোবার সময় পিয়ন এসে বলল, একজন ভদ্র মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

কথাটা শুনে নাহিদের বুকটা ধক করে উঠল। ভাবল, নাহিদা নয় তো? আবার ভাবল, তা কী করে হয়? দুপুরে তো তার ফোন পেলাম। পিয়নকে বলল, কোথা থেকে এসেছেন জিজ্ঞেস করেছ?

: জি। ময়মনসিংহ থেকে।

নাহিদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, কোথায় তিনি?

: রিসিপশন রুমে।

: ঠিক আছে নিয়ে এস।

একটু পরে একজন পর্দানশীন মেয়েকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

মেয়েটি ঢুকেই সালাম দিল।

নাহিদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না? তবে কোথাও যেন এক আধবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।

মেয়েটি স্মিত হাস্যে বলল, আপনি একবার ময়মনসিংহ গিয়ে যে বন্ধুর বাড়িতে একরাত ছিলেন, আমি, তার ছোট বোন শর্মিলা।

নাহিদ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, বসুন বসুন,-এবার মনে পড়ছে। কেমন আছেন বলুন? আপনার ভাইয়া কেমন আছে?

শর্মিলা বসে হাসিমুখে বলল, আমরা সবাই ভালো। আপনি কেমন আছেন?

: আল্লাহ পাকের রহমতে ভালো।

: উঠেছেন কোথায়? এখানে কি কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন?

: না, এখানে আমার কোনো আত্মীয় নেই। ……. হোটেলে উঠেছি। বেড়াতে এলাম। ভাইয়ার কাছে শুনেছি আপনি এখানে অনেকদিন আছেন। এখানকার সবকিছু আপনার নখদর্পণে। তাই আপনার কম্প্যানির আশায় একাই চলে এলাম, এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্যে।

তখন নাহিদের নাহিদার কথা মনে পড়ল, “শর্মিলা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। আপনার ফটো সবসময় বুকে নিয়ে বেড়ায়। আপনার জন্য সে প্রাণও দিতে পারে।”

নাহিদ নিজেকে সংযত রেখে বলল, যতটুকু সম্ভব দেব, এখন আমার বাসায় চলুন।

বাসায় এসে নাহিদ কাদুর বাপকে ডেকে বলল, মেহমান এসেছে নাস্তার ব্যবস্থা কর।

নাস্তা খেয়ে চা খাওয়ার সময় নাহিদ জিজ্ঞেস করল, দিনাজপুরের নাহিদাকে কতটা চেনেন?

নাহিদর নাম শুনে শর্মিলা চমকে উঠল। সামলে নিয়ে বলল, তার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে নাকি?

: আছে, সেকথা পরে বলছি, প্রথমে আপনি বলুন।

: ও আমার বান্ধবী। আমরা অক্সফোর্ডে পড়তাম। এবার বলুন ওর সঙ্গে আপনার পরিচয় হলো কী করে?

শর্মিলা কেন এসেছে নাহিদের বুঝতে বাকি রইল না। চিন্তা করল, নাহিদা পরশু আসছে, ওদের দুজনের মুখোমুখি হবার আগেই শর্মিলাকে সবকিছু জানান দরকার। শুনে হয়তো ও দুঃখ পাবে; তবু বলতেই হবে। বলল, নাহিদা আমার বাবার বন্ধুর ভাইঝি। তারপর তাদের দুজনের সম্পর্কের কথা বলে বলল, নাহিদা পরশু বিকেলের ফ্লাইটে আসছে। ভাবছি, এখানেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব।

নাহিদের কথা শুনে শর্মিলার মনে হলো, কেউ যেন তাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। জীবনে কোনোদিন কোনো বিষয়ে সে হার স্বীকার করে নি। এই প্রথম নাহিদা তাকে হারিয়ে দিল। শর্মিলা জানত, দুনিয়ার এমন কোনো পুরুষের সাধ্য নেই যে তাকে ডিনাই করে। এ বিষয়ে তার বরাবর গর্ব ছিল। কিন্তু আজ তা চূর্ণ হতে দেখে এবং নাহিদকে পাওয়া অসম্ভব জেনে তার মন ক্ষত-বিক্ষত হলো। এক সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠতে মাথা নিচু করে রইল। লজ্জায় ও ক্ষোভে তার মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করল।

তার অবস্থা বুঝতে পেরে নাহিদ মনে ব্যথা অনুভব করে সমবেদনার সুরে বলল, এই পরিস্থিতির জন্য আমি খুব দুঃখিত। মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দী। ভাগ্যকে মেনে নেওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। তারপর বলল, বেড়াতে যখন এসেছেন তখন কয়েকদিন থাকুন। এখানে বেড়াবার মতো অনেক জায়গা আছে। নাহিদার সঙ্গে আপনাকে নিয়েও সেই সব জায়গায় বেড়াতে যাব।

শর্মিলা প্রথমে নাহিদার কথা শুনে হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। পরে চিন্তা করল, এতে নাহিদারই বা দোষ কোথায়? নাহিদও তো তাকে ভালোবাসে। শুধু তাই নয়, খুব শিগগির তাকে বিয়েও করবে। তাছাড়া নাহিদা তার প্রিয় বান্ধবী। প্রিয় বান্ধবীর জন্য স্বার্থ ত্যাগ করাই উচিত।

শর্মিলাকে চুপ করে থাকতে দেখে নাহিদ আবার বলল, আপনি আমার বন্ধুর বোন, আমিও আপনাকে বোনের মতো মনে করি। আশা করি আপনিও আমাকে বড় ভাই বলে মনে করবেন।

শর্মিলা ততক্ষণ সামলে নিয়েছে, চোখ মুখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কখনো কখনো মানুষের জীবনে ভাগ্য বড় নিষ্ঠুরের মতো কাজ করে।

নাহিদ বলল, কথাটা সত্য হলেও ভাগ্যকে দোষ দেওয়া কঠিন গোনাহ্। কারণ ভাগ্য আল্লাহ পাক লিখেছেন। ভাগ্যকে কিছু বলা মানে আল্লাহকে বলা। “আল্লাহ পাক ন্যায়বিচারক।” এটা কুরআন পাকের কথা। তাই কোনো মুসলমানেরই উচিত না ভাগ্যকে দোষ দেয়া।

শর্মিলা বলল, আপনার কথাই ঠিক। তারপর উঠে এসে নাহিদকে কদমবুসি করে বলল, তুমি যে ভাই-বোনের সম্পর্কের কথা বললে তা পাকাপাকি করে নিলাম। আশা করব এবার তুমিও আমার সঙ্গে ছোট বোনের মতো ব্যবহার করবে।

নাহিদ তার মাথায় হাত ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলল, তাই হবে। আল্লাহ পাক তোকে সুখী করুক, তোর মনে শান্তি দিক।

শর্মিলা বলল, আমার একটা আব্দার আছে। আমিও তোমার সাথে এয়ারপোর্ট যাব। তারপর এমন কিছু কথা বলল, যা শুনে নাহিদ হেসে উঠে বলল, নাহিদা যদি রাজি না হয়?

: হবে না মানে? নিশ্চয় হবে, আমি তোমাকে যেভাবে যা কিছু করতে বললাম, তা করলে ও বাধা দেবার কোনো সুযোগই পাবে না।

 : ঠিক আছে, তাই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *