৪
আজ এক সপ্তাহ হলো নাহিদা চাকরিতে জয়েন করেছে। এই কয়েকদিন আবুল হোসেন সাহেব তাকে অফিসের ফাইলপত্রের সঙ্গে পরিচয় না করিয়ে মিলের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন।
এক সময় নাহিদা জিজ্ঞেস করেছিল, এই মিলের মালিক কে?
উত্তরে আবুল হোসেন সাহেব বলেছেন, এত তাড়া করছিস কেন? আস্তে আস্তে সবকিছু জানতে পারবি। তোর প্রথম কাজ হলো, সমস্ত অফিস স্টাফদের সম্বন্ধে জানা। তা না হলে তোকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। আমার ইচ্ছা আমি রিটায়ার্ড করার আগে আমার পোস্টে তোকে বসাব। চিন্তা করিস না। তার আগেই তোকে তৈরি করে নেব।
এই মিলের ম্যানেজার কায়সার। কায়সার উচ্চশিক্ষিত, মিষ্টভাষি সুদর্শন যুবক। বয়স পয়ত্রিশের মতো। খুব সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ। সেইজন্য ডাইরেক্টর সাহেব তাকে যেমন বিশ্বাস করেন, তেমনি স্নেহও করেন। কায়সারের মা ছাড়া কেউ নেই। বছর খানেক হলো তার স্ত্রী মারা গেছেন।
ডাইরেক্টর সাহেব তাকে আবার বিয়ে করতে বলেছেন। উত্তরে জানিয়েছেন, সে রকম মেয়ে পেলে করবেন।
নাহিদা জয়েন করার পর তাকে দেখে কায়সারের মনে হলো, এই রকম মেয়েকেই তিনি খুঁজছেন। ডাইরেক্টর সাহেবের ভাইঝি জেনে মনের ইচ্ছা চেপে রেখেছেন। কিন্তু প্রায়ই তার কথা মনে পড়ে। কীভাবে তাকে পেতে পারে ভেবে না পেয়ে ঠিক করলেন, যেমন করে তোক নাহিদাকে তার প্রতি দুর্বল করতে হবে। তা যদি পারি, তাহলে এব্যাপারে নাহিদাই অগ্রভূমিকা নেবে। এইসব চিন্তা করে সময় সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন।
ডাইরেক্টর সাহেবের অনুপস্থিতিতে কায়সার ফাইলপত্র সই করাবার জন্য নাহিদার কাছে এসে দক্ষ ম্যানেজারের মতো নিজেকে জাহির করেন।
নাহিদা ম্যানেজারের কথা আঙ্কেলের কাছে শুনেছে। তার কাজকর্মে বেশ সন্তুষ্ট। কিন্তু মাঝে মধ্যে কথা বলার সময় তার দিকে তাকাতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ে গেলে বুঝতে পারে, যুবকরা যুবতিদের কাছে যা পেতে চায়, তা তিনিও চান। প্রথম দিকে অতটা গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু পরে যখন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখল তখন তার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিল।
ব্যাপারটা ম্যানেজার বুঝতে পেরে একদিন সুযোগ মতো নাহিদাকে বললেন, ম্যাডাম যদি অনুমতি দেন, তাহলে একটা কথা বলতে চাই।
নাহিদা বলল, বলুন।
: আপনি কি কোনো কারণে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন?
: সে রকম কি কোনো প্রমাণ পেয়েছেন?
: না, মানে আমার যেন সে রকম মনে হয়।
: প্রমাণ ছাড়া আমি আপনার কথার উত্তর দেব না। আপনি ডাইরেক্টর সাহেবের বিশ্বাসী ও স্নেহের পাত্র। নথিপত্রে আপনার রেকর্ডও ভালো। শুধু শুধু অসন্তুষ্ট হতে যাব কেন? মন থেকে সন্দেহের শিকড় দূর করে দিয়ে কাজ করে যান। ভবিষ্যতে আপনার আরও উন্নতি হোক, সেই কামনা করি।
এরপর ম্যানেজার আর কিছু বলতে পারল না।
বেশ কিছুদিন পর এক বিকেলে বাড়ির সামনের লনে, গাছের ছায়ায় আঙ্কেল ও আন্টির সঙ্গে নাহিদা চা খাচ্ছিল।
এক সময় নাহিদা বলল, আমাদের ম্যানেজার তোমার খুব প্রিয় তাই না আঙ্কেল?
আবুল হোসেন সাহেব হেসে উঠে বললেন, হঠাৎ তার কথা বলছিস কেন রে?
: সে কথা পরে, যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও।
: হ্যাঁ তাই, তোর কাছে কেমন মনে হয়?
: আমার কাছেও তাই। তবে কয়েকদিন থেকে লক্ষ করছি, তিনি যেন আরও প্রিয় হতে চাচ্ছেন।
: বুঝতে পারলাম না, একটু খুলে বল।
: আঙ্কেল, তুমি যদি সত্যিই বুঝতে না পার তাহলে বলব। আর যদি ….
আবুল হোসেন সাহেব তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হেসে উঠে বললেন, পেরেছি পেরেছি। তোর মতো মেয়েকে যে দেখবে সেই পছন্দ করবে। এতে ম্যানেজারের দোষ দেখলি কোথায়?
: আহ্ আঙ্কেল, তুমি না একটা যাচ্ছে তাই লোক। আন্টির সামনেই এরকম কথা বলা তোমার উচিত হয় নি। যাকগে, যা বলছি শোনো। এব্যাপারে তিনি তোমাকে কোনো রকম হিন্টস দেবার আগেই তুমি তাকে হিন্টস দিয়ে দিবে, তিনি যেন বেশি প্রিয় হবার চেষ্টা না করেন।
আবুল হোসেন সাহেব আবার হেসে উঠে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, শুনলে তাঁদড় মেয়ের কথা।
জোহরা বেগম রেগে গিয়ে বললেন, এতে হাসির কী হলো? ম্যানেজার তার পদের যোগ্য হলেও নাহিদার যোগ্য নয়। নাহিদা যা বলল, তাকে তা বলে দিও।
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, তা না হয় বলবো, কিন্তু নাহিদ বা নাহিদের বাবা যদি কিছু হিন্টস দেয়, তাহলে তাদেরও কি সাবধান করে দিব?
নাহিদা লজ্জায় লাল হয়ে কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর দাঁড়িয়ে আঙ্কেল ইজ এ ভেরি ওয়ার্থলেস বয়-বলে ছুটে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
আবুল হোসেন সাহেব হাসতে হাসতে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটার মনের খবর কিছু জানতে পারলে?
জোহরা বেগম বললেন, মেয়েদের মনের খবর মেয়েরাই বেশি জানে।
মাস দুই পরে নাহিদা শর্মিলার চিঠি পেয়ে জানতে পারল, সে মা-বাবার সঙ্গে সামনে মাসের পনেরো তারিখে সিলেটে হজরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার জিয়ারত করতে যাবে। সেই সময় নাহিদের সঙ্গে দেখা করবে।
চিঠি পড়ে নাহিদার মন বেশ খারাপ হয়ে গেল। চিন্তা করতে লাগল, খালা খালু, শর্মিলা ও আঙ্কেলের কাছে নাহিদের গুণাগুণ শুনে তাকে ভালো লেগেছিল অথবা তার প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল। তখন ভেবেছিল, বেশিদিন চোখের আড়াল থাকলে, মনেরও আড়াল হয়ে যাবে। তাছাড়া নাহিদ তো প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারে বধিরের ভূমিকা পালন করেছে। তারপর নাহিদ ধার্মিক। আমি ধর্মের কিছুই জানি না, মানি না। তাকে ভালবাসলেও তার সঙ্গে আমার মনের মিল হবে না। এত কিছু সত্ত্বেও তাকে মন থেকে সরাতে পারছি না কেন? যত তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি ততই মনে পড়ে কেন? শর্মিলা যাবার আগেই আমার যেতে মন চাইছে কেন? আর শর্মিলার উপরই বা ঈর্ষা হচ্ছে কেন? তা হলে কি আমি তাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি? আচ্ছা, নাহিদ কি আমাকে নিয়ে ভাবে? সে কি আমাকে ভালোবাসে? তার সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক হয়েছে, তাকে কি প্রেম-ভালোবাসা বলা যায়? আমি যদি তাকে প্রেম নিবেদন করি, আর সে ডিনাই করে অথবা আমাকে ভালো না বাসলেও আমার কথা শুনে অনুগ্রহ দেখায়, তা হলে আমি কি সুখী হতে পারব? একবার ভাবল, প্রেম ভালোবাসার কথা না জানিয়ে প্লেন একটা চিঠি লিখে উত্তর চাইলে তার মনের ভাব জানা যেত। আবার ভাবল, সে আমাকে ভালোবাসে, এ কথা না জানা পর্যন্ত চিঠি দেয়া ঠিক হবে না। হঠাৎ তার মনে হলো, শর্মিলা তাকে প্রেম নিবেদন করলে, নাহিদ কি তাকে ডিনাই করবে? করলেও সে যে ধরনের মেয়ে, ছলে বলে কৌশলে হলেও তাকে প্রেমের জালে জড়াতে চেষ্টা করবে।
সেদিন সন্ধ্যার পর নিজের রুমে একটা সোফায় হেলান দিয়ে বসে এইসব চিন্তা করছিল। এমন সময় একটা কাজের মেয়ে এসে বলল, বেগম সাহেব আপনাকে খেতে ডাকছেন।
নাহিদা ডাইনিং রুমে এসে আঙ্কেলের পাশে যে চেয়ারে প্রতিদিন বসে, সেটাতে বসল।
প্রতিদিন রাতের খাওয়া দাওয়ার পর তারা বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ অফিসিয়াল আলোচনা করেন। জোহরা বেগম এসব ব্যাপার বোঝেন না। তাই তিনি তাদের কাছে থাকেন না। আজ আলোচনার শেষ পর্যায়ে আবুল হোসেন সাহেব নাহিদাকে বললেন, তোকে একটা সুখবর দেব, কী খাওয়াবি বল।
নাহিদা একটুও অবাক না হয়ে বলল, আগে সুখবরটা শুনি, তারপর বিবেচনা করে বলব।
: নাহিদ অফিসের কাজে নভেম্বরের দশ তারিখে দিনাজপুর আসছে। দুতিন দিন থাকবে। অবশ্য তারিখটার এখনও দেড় মাস দেরি।
কথাটা শুনে নাহিদার মনে ফল্পধারার মতো আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। আঙ্কেল যেন তার মনের ভাব বুঝতে না পারে, সেজন্যে অবজ্ঞাস্বরে বলল, তার দরকারে তিনি আসছেন, তাতে আমার কী? অবশ্য বন্ধুর ছেলে হিসেবে তুমি আনন্দিত হতে পার।
আবুল হোসেন সাহেব ভাইঝির মনের ভাব ঠিকই বুঝতে পারলেন। তাই অবাক হবার ভান করে বললেন, সে কী রে, যে লোকটা ড্রাইভার ‘কাম’ বডিগার্ড হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ তোকে কম্পেনিয়ান দিল, তাকে ইনভাইট করে খাওয়াবি না?
: তুমি আমার গার্জেন, সেটা তোমার দায়িত্ব।
: আমাকে যদি গার্জেন বলে মনে করিস, তাহলে আমার অনুমতি ছাড়া নাহিদের দিকে একটু অগ্রসর হয়েছিস কি, অমনি তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব।
নাহিদা ঠোঁট উল্টে বলল, তার দিকে অগ্রসর হতে বয়েই গেছে।
: ঠিক আছে আমিও ওঁত পেতে থাকবো। তাই থেকো বলে নাহিদা হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে গেল।
দিনাজপুর থেকে ফিরে নাহিদ বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভুগল। তার প্রায় নাহিদার কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতের কথা। যখন কাঁপুনি থামাবার জন্য নাহিদা তাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। নাহিদ সবসময় স্বভাবসুলভ মতো তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। নাহিদাও তাকে তেমন গ্রাহ্য করে নি। তাতে নাহিদ অসন্তুষ্ট হয় নি বরং সন্তুষ্টই ছিল। ঢাকার হোটেলে নাহিদার পরিবর্তন নাহিদের চোখে পড়লেও কারণ খুঁজে না পেয়ে সে কথা নিয়ে কোনো চিন্তা করে নি। কিন্তু দুর্যোগের রাতের ঘটনাটা এই কয়েক মাস খুব ভাবাচ্ছে। কেবলই তার মনে হয়, আমি কি নাহিদাকে ভালোবেসে ফেললাম?
নাহিদা আঙ্কেলের মুখে নাহিদের আসার কথা শুনে মনে মনে একটা সংকল্প করল। পরের দিন দিনাজপুর টাউনে গিয়ে একটা বইয়ের দোকান থেকে কানাই লাল সাহার “মেয়েদের স্বাস্থ্য ও মেয়েদের ব্যায়াম” বই কিনে নিয়ে এল। বইটা প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার শ্রীভূতি পাবলিশিং কোম্পানি থেকে। রাতে বইটা স্টাডি করে স্বাস্থ্য কমানোর জন্য যে যে ব্যায়ামের নির্দেশ আছে, সেইগুলো পরের দিন ভোর থেকে প্র্যাকটিস শুরু করল। সেই সঙ্গে ডায়েড কন্ট্রোল করতে লাগল।
ব্যায়াম করার কথা কেউ জানতে না পারলেও কয়েকদিন নাহিদাকে কম কম খেতে দেখে এবং চর্বিজাতীয় কোনো খাবার খাচ্ছে না দেখে জোহরা বেগম একদিন খাবার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কি পেটের ট্রাবল হয়েছে?
নাহিদা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে বলল, কই না তো?
: তাহলে কয়েকদিন থেকে তুই সব সময় কম খাচ্ছিস, মাছ-মাংসও খাচ্ছিস, দুধ তো একদম ঠুস না। এরকম খেলে তো রোগা হয়ে যাবি।
নাহিদা হেসে উঠে বলল, দেখছ না দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছি? তাই একটু কম খাচ্ছি।
: তুই মোটা হচ্ছিস কে বললে? একই রকম তো রয়েছিস। তোর স্বাস্থ্য ভালো, এটাকে মুটিয়ে যাওয়া বলে না।
আবুল হোসেন সাহেব স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, এর মধ্যে একটা রহস্য আছে, যেটা তুমি বুঝতে পার নি।
জোহরা বেগম অবাক হয়ে বললেন, ওমা, খাওয়ার মধ্যে আবার রহস্য থাকে না-কি?
: থাকে থাকে, তুমি তো সেকালের মেয়ে, আজকালের মেয়েদের রহস্য তোমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না।
জোহরা বেগম মৃদু হেসে বললেন, তুমি যদি একালের মেয়েদের রহস্য বুঝেই থাক, তবে বলছ না কেন?
: কিছুদিনের মধ্যে নাহিদ আসছে, তাই নাহিদা স্লিম হওয়ার চেষ্ট করছে।
নাহিদা ধরা পড়ে ভীষণ লজ্জা পেল, তার খাওয়া শেষ হয়েছিল। বেসিনে হাত ধুতে যাবার সময় কপট রাগের সঙ্গে বলল, আঙ্কেলের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমনসেন্স কমে যাচ্ছে।
নাহিদা চলে যাবার পর জোহরা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা চাচা-ভাইঝি একেক সময় যা কর, দেখলে রাগ হয়।
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, বোকারাই একটুতে রেগে যায়।
: আর চালাকরা বুঝি ভাইঝির সঙ্গে ইয়ার্কি করে?
: তা করে না, তবে কি জান …
: থাক, সে কথা আর জানাতে হবে না।
বোকা বলতে স্ত্রী রেগে গেছে বুঝতে পেরে আবুল হোসেন সাহেব হেসে উঠে বললেন, এই জন্যেই লোকে বলে, “বোকাদের বোকা বললে তারা রেগে যায়, পাগলদের পাগল বললে তারা ক্ষেপে যায়।”
: বোকা মেয়েকে বিয়ে করেছিল বলে সারাজীবন শান্তিতে কাটাচ্ছ। চালাক মেয়ে হলে টের পেতে।
আবুল হোসেন সাহেব এই কথার কোনো উত্তর দিতে পারল না। স্ত্রী যে খাঁটি কথা বলেছে তা জানেন।
জোহরা বেগমের মতো সাদা-সিধে মেয়ে খুব কম আছে। কোনো দিন নিজে থেকে কোনো কিছু স্বামীর কাছে চান নি। স্বামী যখন যা দিয়েছে, তা খুশি মনে গ্রহণ করেছেন।
হাত মুখ ধুয়ে এসে আবুল হোসেন সাহেব স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বোকা বলেছি বলে রাগ করছ কেন? বিশ্বাস কর, তোমার মতো স্ত্রী পেয়ে সত্যিই আমি সুখী।
জোহরা বেগম বললেন, রাগ করলেই বা কি? এখন তো আর আগের মতো রাগ মানাতে হবে না।
: হবে হবে, একশবার হবে। কেন দুদিন আগেও কী কথা নিয়ে তুমি যখন রাগ করলে, তখন মানাই নি?
জোহরা বেগম হেসে ফেলে বললেন, হয়েছে হয়েছে অত আর তোয়াজ করতে হবে না, ছাড়। কেউ এসে পড়তে পারে। নাহিদা ঠিকই বলেছে, সত্যিই তোমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমনসেন্স কমে যাচ্ছে।
নাহিদা প্রতিদিন ভোরে উঠে প্রায় এক ঘণ্টা ব্যায়াম করে। ব্যায়াম শেষে পনেরো বিশ মিনিট রেস্ট নিয়ে গোসল করে। তারপর যখন নাস্তা খেতে আসে তখন তার শরীর ও মন বেশ ফ্রেস লাগে। নিয়মিত ব্যায়াম ও ডায়েড কন্ট্রোল করার ফলে মাসখানেকের মধ্যে নাহিদার ওজন সাত কেজি কমে গেল। এখন নিজের কাছে নিজের শরীর বেশ হালকা লাগে।
নাহিদার দিনগুলো যে কীভাবে কেটে যাচ্ছে তা সে নিজেই জানে না। জানে শুধু নভেম্বরের দশ তারিখের কথা। ঐ দিনটার জন্য সে উন্মুখ হয়ে প্রতিদিন চেয়ে দেখে ক্যালেন্ডারের দিকে। অফিসের ক্যালেন্ডারে ঐ তারিখটা লাল কালিতে গোল দাগ দিয়ে রেখেছে। রাতে ঘুমোবার সময় ভাবে চঞ্চলা স্বভাবের নাহিদা কেমন যেন বোকা হয়ে গেছে। যে নাকি ধর্ম কী জিনিস জানত, কখনো জানার ইচ্ছাও যার হয় নি, সে কিনা নানা ধর্মীয় বই কিনে পড়তে শুরু করেছে। পোশাক-পরিচ্ছদ বদলিয়েছে। আঙ্কেল ও আন্টির কাছ থেকে লজ্জা পাবার ভয়ে গোপনে নামাযও পড়ছে। আচ্ছা, আমার পরিবর্তন দেখে নাহিদ কি ভাববে, অমি তার প্রেমে পড়েছি? যদি আমাকে সেরকম কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে কী বলব? তার মনের ভেতর থেকে প্রায়ই কে যেন বলে উঠে, এত ভালো ছেলে থাকতে শেষকালে তুই একটা কেবলা মার্কা ছেলের প্রেমে পড়ে গেলি? তার উপর ছেলেটা ধার্মিক, ধার্মিক ছেলেরা মেয়েদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। খাঁচার পাখির মতো তাকে বন্দী জীবন কাটাতে হবে। এইসব ভেবে নাহিদা খুব ভয় পায়। নাহিদের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা করে। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু পরের দিন আবার নাহিদের বলিষ্ঠ ও শান্ত চেহারার কথা মনে পড়লে প্রতিজ্ঞা ভুলে যায়। তার জন্য নিজেকে তৈরি করার চেষ্টায় মেতে উঠে।
আবুল হোসেন সাহেব ভাইঝির পরিবর্তন লক্ষ করে খুশি হন, মনে শান্তি অনুভব করেন। ভাবেন, এবার মেয়েটার বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। নাহিদও নিশ্চয় ওকে ভালোবাসে। তা না হলে নাহিদা এতটা এগোবার পাত্রী নয়। স্ত্রীর সামনে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করেন না। একদিন সুযোগ পেয়ে বললেন, শুনেছি মানুষ আল্লাহকে পাবার জন্য সাধনা করে; কিন্তু কোনো ছেলেকে পাবার জন্য কোনো মেয়ে যে সাধনা করে, তা শুনি নি।
নাহিদা ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে বলল, আঙ্কেল মাঝে মাঝে এমনি কথা বলে, যার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝা যায় না।
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, কেউ যদি বুঝেও না বোঝার ভান করে, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। তবে লন্ডন ফেরত চৌকস মেয়ে, অনুন্নত বাংলাদেশের লোকের কথা বুঝতে পারবে না-এটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না।
তোমাকে বিশ্বাস করতে কে বলেছে, এই কথা বলে নাহিদা চলে যেতে উদ্যত হলে আবুল হোসেন সাহেব বললেন, দাঁড়া, চলে যাচ্ছিস কেন? তারপর এগিয়ে এসে তার মাথায় একটা হাত রেখে ভিজে গলায় বললেন, নাহিদকে যে তুই পছন্দ করেছিস, তাতে আমি তোর চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি। আমি বোধহয় নিজের থেকে তোকে বেশি ভালোবাসি। তাই তোর বিয়ের অনীহা দেখে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এতদিনে আল্লাহ আমাকে সেই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলেন। দোওয়া করি মা, আল্লাহ তোর মনের ইচ্ছা পূরণ করুক। তোর মা-বাবা নেই। মা-বাবার স্নেহ আমরা কতটা দিতে পেরেছি তা উপরের মালিকই জানেন। বিয়ে করে তুই সুখী হ, এটা আমাদের আন্তরিক কামনা।
জোহরা বেগম বারান্দা দিয়ে যাবার সময় স্বামীর গলা পেয়ে সেদিকে এগিয়ে এলেন। উনি আসার আগেই নাহিদা আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, মা কেমন জিনিস জানি না। ছোটবেলা থেকে আন্টিকেই মা বলে জানি। আর বাবার মৃত্যুর পর তুমি স্নেহ দিয়ে বাবার কথা ভুলিয়ে দিয়েছ, বিয়ের পর যেন তোমরা আমাকে ভুলে যেও না।
জোহরা বেগমের আগমন আবুল হোসেন সাহেব টের পেলেও নাহিদা পায় নি। তিনি স্ত্রীকে বললেন, শুনেছ ডাকাত মেয়ের কথা? বিয়ের পর ওকে নাকি আমরা ভুলে যাব। বরং আমিই ভাবছি, বিয়ের পর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িদের পেয়ে ঐ না আমাদেরকে ভুলে যায়।
আঙ্কেলের কথা শুনে নাহিদা বুঝতে পারল, আন্টি এসেছে। তাড়াতাড়ি আঙ্কেলকে ছেড়ে দিয়ে আন্টিকে জড়িয়ে ধরল।
জোহরা বেগম নাহিদার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বললেন, মেয়েরা যেমন স্বামীর ঘরে গিয়ে মা-বাবাকে ভুলতে পারে না, তেমনি মা-বাবাও মেয়েকে স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে ভুলতে পারে না। তুই তো আমাদেরই মেয়ে। তোকে আমরা ভুলে যাব একথা বলতে পারলি?
আন্টির শেষের দিকের কথাগুলো নাহিদার কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, আমি ঐ কথা বলে ভুল করেছি, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও।
জোহরা বেগম তার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, পাগলি মেয়ে, ক্ষমা চাইছিস কেন? মা-বাবা কোনোদিন ছেলেমেয়ের দোষ মনে রাখে না। তারা যতই অন্যায় করুক না কেন, মা-বাবা সব সময় তাদের জন্য দোওয়া করে।
এর কয়েকদিন পর নাহিদা বড় খালার চিঠি পেল।
লিখেছেন:
স্নেহের নাহিদা,
প্রথমে আমার আন্তরিক দোওয়া ও স্নেহাশীষ নিস, তোর চাচা-চাচিকে আমার সালাম জানাবি। খোদার ফজলে আমারা ভালো আছি, আশা করি তোরাও সকলে ভালো আছিস। শোন, নাহিদ নভেম্বরের দশ তারিখে অফিসের কাজে দিনাজপুর যাচ্ছে। ওকে একদিন দাওয়াত দিয়ে খাওয়াস। তোর জন্য এত কিছু করেছে। তুইও তো তাকে কম জ্বালাস নি। চিঠি দিস না কেন? কাছে এলে তো খালার আঁচল ছাড়িস না। মনে হয় খালাকে না দেখলে একদণ্ড বাঁচবি। আর সেই যে কত মাস হয়ে গেল গেলি, একটা চিঠি দিয়েও খোঁজ নিলি। এই জন্যেই বোধহয় লোকে বলে, “চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়ে যায়।”
ইতি
তোর বড় খালা।
চিঠি পড়ে নাহিদা মনে মনে লজ্জিত হলো। এটা ওর একটা বড় দোষ, কাউকে চিঠি লিখতে হলে মাথায় যেন আশিমণ পাথর চেপে যায়।
দেখতে দেখতে নভেম্বর মাস এসে গেল। নাহিদা এক তারিখেই এগারো থেকে তেরো তারিখ পর্যন্ত তিন দিনের জন্য ছুটির দরখাস্ত দিল। তার মন বলেছে এই কয়েকদিন ছুটি নিয়ে নাহিদকে সঙ্গ দেয়া উচিত। সেই সময় ছুটি নিলে আঙ্কেল লজ্জা দিবে, তাই আগে থেকে ছুটির ব্যবস্থা করল।
আজ দশ তারিখ, সকাল থেকেই নাহিদার মনে অজানা একটা আনন্দ বইতে শুরু করল। অফিসের কাজে তেমন মন দিতে পারল না।
ছুটির পর বাড়িতে ফিরতেই জোহরা বেগম বললেন, নাহিদ ফোন করেছিল। আমি তাকে এখানে উঠতে বলেছিলাম। বলল, মাফ করবেন, তা সম্ভব নয়। আমি অফিসের কাজে এসেছি, অফিস কোয়ার্টারে থাকব। যখন বেড়াতে আসব তখন উঠব। আমি বললাম, তাহলে একবার এসে অন্তত আমাদের সঙ্গে দেখা করে যাও। বলল, আজ ও কাল খুব ব্যস্ত থাকব। ইনশাআল্লাহ পরশু দিন রাতে শুধু দেখা করতে যাব না, সেই সঙ্গে খেয়ে আসব। তারপর তুই কেমন আছিস জিজ্ঞেস করল। ফোন নাম্বার দিয়ে বলল, তুই যেন অফিস থেকে ফিরে ওকে ফোন করিস।
আন্টির কথা শুনে আনন্দে নাহিদার হার্টবিট বেড়ে গেল। এক্ষুনি ফোন করতে ইচ্ছে করল; কিন্তু আন্টির সামনে ফোন করলে ভালো করে কথা বলা যাবে না। ভাবল, একটু পরে নিরিবিলি দেখে ফোন করা যাবে। তাই বলল, এখন ফোন করতে আমার বইয়ে গেছে। আগে গোসল করি, খাওয়া-দাওয়া করি, তারপর দেখা যাবে। অতই যদি তার ব্যস্ততা, তাহলে ফোন না করলেই পারতেন।
জোহরা বেগম বললেন, সে কথা আমাকে বলছিস কেন? এলে তাকেই বলিস।
: হ্যাঁ, বলব তো, নাহিদা কাউকে ভয়-টয় করে না। তা ফোন নাম্বারটা কোথায়?
: টেলিফোনের সামনে প্যাডে লিখে রেখেছি।
নাহিদা আর কিছু না বলে নিজের রুমে গিয়ে পোশাক পাল্টে বাথরুমে ঢুকল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েছে এমন সময় জোহরা বেগম দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, নাহিদ আবার ফোন করেছে, তোকে চাইছে।
নাহিদার সমস্ত তনুমন আনন্দে থরথর করে কেঁপে উঠল। সামলে নিয়ে কোনোরকমে বলল, বলে দাও আমি এখন গোসল করছি বেরেতে দেরি হবে।
আন্টি বিরক্ত কণ্ঠে কী বলে চেলে গেলেন, শাওয়ারের পানি পড়ার শব্দে নাহিদা শুনতে পেল না।
নাহিদা গান শুনতে ভালোবাসলেও কোনোদিন গান গায় নি। এমনকি গানের দু’এক কলি আবৃত্তিও করে নি। কিন্তু এখন গায়ে সাবার মাখতে মাখতে আনন্দের আবেগে নিজের ভাষাতেই গুনগুনিয়ে গাইতে লাগল–
“এতদিন পথ চেয়ে শুধু ভেবেছি আমি তোমারই,
ওলিরা কানে কানে বলে গেছে তুমি আমারই, তুমি আমারই।”
গোসল সেরে জামা-কাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়েছে, এমন সময় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
জোহরা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন, ফোনের আওয়াজ শুনতে পেলেন না।
নাহিদা ফোন ধরার আগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আন্টিকে দেখতে না পেয়ে ভাবল, আন্টি নিশ্চয় রান্না ঘরে। একটা কাজের মেয়েকে আসতে দেখে বলল, আন্টিকে খাবার রেডি করতে বল, আমি আসছি। তারপর ফোন ধরল, ওপাশ থেকে নাহিদ নাম্বার জিজ্ঞেস করল।
নাহিদা নাম্বার বলল।
নাহিদ বলল, দয়া করে নাহিদাকে একটু দিন।
নাহিদার বুক তখন আনন্দ মিশ্রিত ভয়ে টিপ টিপ করছে। ভাবল, বুকের শব্দ নাহিদ কি শুনতে পাচ্ছে? সামলে নিয়ে গলার স্বর ঠিক রেখে বলল, আপনার নামটা জানতে পারি?
: আপনি কে বলছেন?
: মনে করেছিলাম আমার গলার স্বর শুনেই চিনবেন। তা যখন পারলেন না তখন আপনার নামের শেষে একটা আকার দিয়ে নিন। আমি কিন্তু আপনাকে ঠিকই চিনেছি।
নাহিদ হেসে উঠে বলল, আমিও চিনেছি, তবে আপনার মন মেজাজ কেমন আছে না আছে জানার জন্য অচেনার ভান করেছি।
নাহিদা স্বভাবগত কারণে রেগে উঠল। বলল, আমাকে যদি সেই রকম মেয়ে ভাবেন, তবে এতবার ফোন করা কেন?
নাহিদ আবার হেসে উঠে বলল, আপনি হলেন আমার বসের জেঠাষের মেয়ে। আপনার খোঁজ-খবর নেয়া কি কর্তব্য নয়? আপনার খালা আপনার জন্য আনারসের আচার পাঠিয়েছেন। এখন গেলে কি অসন্তুষ্ট হবেন?
: অসন্তুষ্ট হব কেন? কিন্তু শুনলাম আজ এবং কাল আপনার একদণ্ড অবসর নেই। সে জন্যে পরশুদিন আসবেন বলেছেন।
: তা বলেছিলাম, তবে আপনার সাক্ষাৎ লাভের জন্য অবসর আছে।
: তাই নাকি?
: হ্যাঁ তাই, পরীক্ষা করে দেখুন না।
: মনে হচ্ছে আমার জন্য এই কয়েক মাস ঘুমোতে পারেন নি?
: সত্যি বললে কিছু মাইন্ড করবেন না তো?
: না।
: কথাটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক না হলেও নব্বই পার্সেন্ট ঠিক।
: বেশ কথা বলতে শিখেছেন দেখছি। কয়েক মাস আগে কিন্তু এরকম গুছিয়ে কথা বলেন নি।
নাহিদ একটু চুপ করে থেকে বলল, তখন আপনাকে জানার মতো জানতাম না, চেনার মতো চিনতাম না, পথে দুর্যোগের রাতে চিনলাম ও জানলাম। কিন্তু তখন শরীরের অসুস্থতার জন্য এবং আপনাকে জেনে ও চিনে মনের যে অবস্থা হয়েছিল তাতে করে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর নাহিদার রিপ্লাই শোনার জন্য অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
নাহিদের কথা শুনতে শুনতে নাহিদা আনন্দে বেসামাল হয়ে পড়ল। ভাবল, আমি তাহলে একজন স্কলার ছেলের মনে আসন পেয়েছি। এতদিনে কারো চোখের ঘুম কাড়তে পেরেছি।
নাহিদার কাছ থেকে রিপ্লাই না পেয়ে নাহিদ বলল, কিছু একটা শুনবো আশা করেছিলাম। এখানে আসা অবধি আপনাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে করছিল। কেন যে এত দেখার তীব্র ইচ্ছা তা নিজেই জানি না। কিছু বলছেন না যখন তখন আর বিরক্ত করব না। ফোন রাখার আগে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে আপনি কেমন আছেন। আর বদলে গেছেন কিনা? আচ্ছা, আপনার কি কিছু জানতে ইচ্ছা করছে না?
নাহিদা তার স্বভাবসুলভবশত ওকে একটু নার্ভাস করে দিতে চাইল, বলল, না।
না শব্দটা নাহিদের মনে প্রচণ্ড আঘাত করল। তাই নাহিদা না বলার সাথে সাথে ফোন ছেড়ে দিল। চিন্তা করল যে নাহিদা বুকের তাপ দিয়ে জ্বরের কাঁপুনি বন্ধ করেছিল তার কাছ থেকে এরকম কথা শুনবে তা কল্পনা করতে পারে নি। আল্লাহ পাকের দরবারে মনে মনে ফরিয়াদ করল, আল্লাহ পাক তুমি আমাকে সব রকমের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা দাও। তারপর ভারাক্রান্ত মনে রুম থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। নাহিদ ফোন ধরে বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে করুণ স্বরে নাহিদা সালাম দিল।
নাহিদ মনে করল, কোনো মেয়ে হয়তো ভুল করে এই নাম্বারে ফোন করেছে অথবা ক্রস কানেকশন হয়েছে। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি বোধহয় রং নাম্বারে ফোন করেছেন।
: আমি নাহিদ সাহবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
: বলুন, আমিই নাহিদ।
: আপনি এত জিনিয়াস হয়েও সামান্য না শব্দ শুনে মাইন্ড করবেন তা আমি ভাবতেই পারি নি। জানেন না বুঝি, মেয়েরা হ্যাঁকেই না-এর মধ্যে প্রকাশ করে।
নাহিদা নাহিদাকে সালাম দিতে শুনে যেমন অবাক হলো তেমন আনন্দিতও হলো। কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
: কী হল চুপ করে থাকবেন, না কিছু বলবেন?
: আমি তো মেয়ে নই যে মেয়েদের ব্যাপার-স্যাপার জানব।
: তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু যে পুরুষ কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে তার জানা উচিত।
: এর আগে তো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ি নি জানব কী করে?
: এখন যখন পড়েছেন তখন জানা উচিত ছিল।
: কিন্তু সেই মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে কিনা জানতাম না। অনুমানের উপর ভরসা করে আলাপের মধ্য দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি তো না করে দিলেন।
নাহিদা এই কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
: চুপ করে আছেন কেন? কিছু বলুন।
: বললে শুনবেন?
: বলেই দেখুন।
: এক্ষুনি এই মুহূর্তে চলে আসুন। সামনাসামনি বলবো। কই ফোন রাখুন।
: হুকুম না অনুরোধ?
: কোনোটাই নয়, ফরিয়াদির আপিল।
নাহিদ ফোন রেখে দিয়ে রওয়ানা দিল। এখন তার মনে কোনো ব্যথা নেই। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করল।
নাহিদা রিসিভার রেখেছে এমন সময় আঙ্কেলকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আঙ্কেল?
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, আমাদের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট সালাম সাহেবের মেয়ের আজ বিয়ে। আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, সে কথা আমার মনেই ছিল না। কিন্তু সে কথা তুইও তো জানিস। এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তোর আন্টি কোথায়? কথা শেষ করে এই যে শুনছ, কোথায় তুমি বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
নাহিদা বারান্দায় এসে বসে রইল।
কয়েক মিনিট পরে জোহরা বেগম তৈরি হয়ে স্বামীর সঙ্গে এসে নাহিদাকে বসে থাকতে দেখে বললেন, কিরে তুই যাবি না?
নাহিদা কখনো মিথ্যে বলে না। আজ নাহিদের জন্য বলল, আমার কোথাও যেতে ভালো লাগছে না, তোমরা যাও। আমি যাব না।
ওঁরা নাহিদার স্বভাব জানেন, তাই জিদাজিদি না করে জোহরা বেগম বললেন, তাহলে মাজেদাকে বলিস, মুরগির মাংস রান্না করতে। আমাদের ফিরতে দেরি হলে তুই খেয়ে শুয়ে পড়িস।
আঙ্কেল ও আন্টি বেরিয়ে যেতে নাহিদা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভাবল, যাক নাহিদের সাথে নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। আঙ্কেল ও আন্টির সামনে লজ্জা পেতে হবে না।
নাহিদা একটা সাদা-কালো প্রিন্টের শাড়ি পরে ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, নাহিদ হয়তো সালোয়ার-কামিজ ভালোবাসে। কথাটা মনে হতে রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে শাড়িটা খুলে নিজেকে দেখল, আগের থেকে শরীরের মেদ অনেক কমে গেছে, বেশ রোগাও মনে হচ্ছে। তাই এখন তাকে যেন সুন্দরী দেখাচ্ছে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তে সময় বেশি নেই বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি সাদা সিল্কের সালোয়ার-কামিজ ও গায়ে জর্জেটের সাদা ওড়না পরল। মাথাটা কালো রুমাল দিয়ে বেঁধে নিল। আগে সে দামি দামি সেন্ট ব্যবহার করত। যখন সে হাদিসে পড়ে জানতে পারল, সেন্ট মাখলে নামায হয় না তখন থেকে সেসব আর মাখে না, আতর ব্যবহার করে। আতরের মধ্যে গোলাপ সে বেশি পছন্দ করে। বেশ হালকা সুবাস। অন্যান্যগুলোর তীব্রতা নাহিদা সহ্য করতে পারে না। দিনাজপুর টাউনে ধর্মীয় বই কিনতে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে গোলাপ আতর কিনে এনেছে। সেন্ট ও আতরের মধ্যে পার্থক্য নাহিদা বুঝতে পেরেছে। সেন্ট মাখলে দেহে ও মনে কী এক রকমের ঘুমন্ত সত্তা যেন জেগে ওঠে। আর আতর মাখলে মনের মধ্যে একরকম প্রশান্তি অনুভব হয়। আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) এর কথা মনে পড়ে।
নাহিদা আতর মাখার সময় আয়নায় নিজেকে দেখে বেশ অবাক হলো। আজকের নাহিদা যেন দেড়মাস আগের নাহিদা নয়। এ যেন অন্য তন্বী মেয়ে। তার বয়স যেন দশ বছর কমে গেছে। ঘড়ির দিকে আর একবার তাকিয়ে বারান্দায় এসেছে এমন সময় নাহিদের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল। যখন নিচের বারান্দার দরজার কাছে এল, ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।
নাহিদা দরজা খুলে সালাম দিয়ে সাধা ধবধবে কাবলী সুট পরা নাহিদকে দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
আর নাহিদও সালামের প্রতিউত্তর দিয়ে নাহিদাকে দেখে সুবহান আল্লাহ বলে বিস্ময়ে থ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। আজকের নাহিদা যেন তার পরিচিত নাহিদা নয়, মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। দু’হাতে চোখ রগড়ে আবার তাকিয়ে রইল।
কতক্ষণ যে ঐভাবে ছিল, তা কেউ টের পেল না। এমন সময় যদি মসজিদ থেকে মাইকে মাগরিবের আজান ভেসে না আসত, তাহলে হয়তো সারারাত ঐভাবেই দাঁড়িয়ে থাকত।
আজান শুনে প্রথমে নাহিদার হুঁশ হল। বলল, কথা পরে হবে, আগে নামায পড়ে নিই চলুন।
নাহিদ শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, হ্যাঁ তাই চলুন।
উপরে ড্রইংরুমে এসে নাহিদা বলল, আমি নামাযের পাটি এনে দিচ্ছি; অযু না থাকলে ঐ যে এটাচ বাথ।
নাহিদ বলল, আমার অযু আছে, আর নামাযপাটি আমার সাথেই আছে। তারপর পকেট থেকে কাপড়ের নামাযপাটি বের করে বলল, এটা সব সময় আমার সাথেই থাকে।
তাহলে আপনি নামায পড়ুন, আমিও পড়ে আসছি বলে নাহিদা চলে গেল। নামাযের পর দু’জনের বারান্দায় এসে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে একে অপরের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল।
এক সময় নাহিদা বলল, ফোনে দুর্ব্যবহার করার জন্য ক্ষমা চাইছি, বলুন ক্ষমা করেছেন।
নহিদাকে যত দেখছে, যত জানছে, নাহিদ তত অবাক হচ্ছে। সেই সঙ্গে তার মনে আনন্দের তুফান বইতে শুরু করেছে।
নাহিদার অবস্থাও তাই। বলল, বিশ্বাস করুন, ঐ কথা বলে আপনাকে একটু নার্ভাস করতে চেয়েছিলাম। ফোন রেখে না দিয়ে পরের কথাগুলো শুনলে আমার কথার সততা বুঝতে পারতেন।
নাহিদ বলল, পরে আপনার ফোন পেয়ে তা বুঝতে পেরেছি। আর এখানে আসার পর থেকে সমস্ত ব্যপারটাই আমার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। আল্লাহপাক আজ আপনাকে যেভাবে দেখালেন, তা আমার চিরজীবনের কামনা। সেইজন্য তাঁর পাক দরবারে বার বার জানাই শতকোটি শুকরিয়া। শুধু ভয় হচ্ছে, এ স্বপ্ন যেন ভেঙে না যায়। আপনার ডান হাতটা একটু বাড়ান তো।
নাহিদা হাত বাড়িয়ে বলল, আমি কিন্তু এখনও ক্ষমা পাই নি।
নাহিদ পকেট থেকে একটা গোলাপ ফুল বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, মুখের কথার চেয়ে এটাই উত্তম। তারপর আবার বলল, ‘আল্লাহপাক আপনাকে তাঁর প্রিয় বান্দিদের মধ্যে সামিল করুক, আপনার মনের সমস্ত নেক বাসনা পূরণ করুক, আপনার ইহ ও পরজীবন সুখের ও শান্তির করুক, এই দোয়া করছি।
নাহিদের দোয়া শুনে নাহিদার অন্তর জুড়িয়ে গেল। আনন্দে চোখে পানি চলে এল। বলল, আমিও আপনাকে যত দেখছি, যত জানছি, তত নিজেকে আপনার মধ্যে হারিয়ে ফেলছি। আল্লাহপাক আপনারও ইহকাল ও পরকালের জীবন সুখের করুক, শান্তির করুক, মনের সমস্ত নেক বাসনা পূরণ করুক, সেই কামনা করি। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আবার অন্যায় করে ফেললাম, একটু বসুন নাস্তার কথা বলে আসি।
নাহিদ বলল, এখানে খেতে আসি নি, একজনকে প্রাণভরে দেখতে এসেছি। ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চুপ করে বসুন।
নাহিদা মৃদু হেসে বলল, আপনি আসছেন জেনে তিন দিনের ছুটি নিয়েছি।
নাহিদ খুশি হয়ে বলল, তাই নাকি? তাহলে তো আপনার সঙ্গে এখানকার দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে বেড়ানো যাবে। তারপর বলল, কাউকে দেখছি না কেন?
: আঙ্কেল ও আন্টি আমাদের অফিসের চিফ একাউন্টেন্টের মেয়ের বিয়ে খেতে গেছেন। আপনার জন্য আমি যাই নি। সত্যিই কি কিছু খাবেন না?
: না। এক্ষুনি বললাম না, শুধু আপনাকে দেখতে এসেছি? এবার বলুন, সারাজীবন চাকরি করবেন, না অন্য কিছু চিন্তা ভাবনা করেছেন?
: চাকরি যতদিন ভালো লাগবে করব, ভালো না লাগলে ছেড়ে দব। নারী স্বাধীনতাকে আপনি কতটা স্বীকার করেন? আপনি কি মনে করেন, মেয়েরা চাকরি-বাকরি করে উপার্জন করলেই তারা স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারবে?
নাহিদ বেশ অবকা হয়ে বলল, এসব আমার থেকে আপনারই বেশি জানা উচিত। কোনো পুরুষের মতামতের উপর কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই তার স্বাধীনতার চেতনা উপলব্ধি করবে না অথবা মেনে নেবে না। তবে যে সব মেয়েরা উপার্জন। করবে, তাদের যে কিছু স্বাধীনতা থাকবেই তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
নাহিদা বলল, আমি লন্ডনে পড়াশুনা করলেও সেখানকার ভাবধারা আমার মনকে আকৃষ্ট করতে পারে নি। আর এখানে মেয়েদের স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের কথা যেসব শুনি, সেসবও আমি মেনে নিতে পারি নি। মঞ্চে বক্তৃতা দেয়া, শ্লোগান দিয়ে মিছিল করা অথবা মাসিক কিছু রোজগার করাকে নারী-স্বাীনতা বলে না। ফরেনের মেয়েদের মতো এই দেশের মেয়েরা যদি আজ একজনের সঙ্গে, কাল অন্যজনের সঙ্গে, পরশু আর একজনের সঙ্গে লিভ টুগেদার করত, তা হলে না হয় বুঝতাম। যারা এইসব বিশ্বাস করে অথবা পছন্দ করে, তাদের দলের আমি নই। এগুলোকে আমি ঘৃণা করি। জ্ঞান হবার পর থেকে আমার স্বপ্ন, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর-জা ও ননদদের নিয়ে হাসি খুশির সংসার। আর স্বামী হবে এমন একজন পুরুষ, যার চরিত্র হবে নির্মল। আচরণে থাকবে মাধুর্য, আর থাকবে বলিষ্ঠ পুরুষত্ব যাকে সম্মান করতে আমার এতটুকু বাধবে না। স্বামীও নিশ্চয় আমাকে স্ত্রীর সম্মান দিবে এবং আমাদের মধ্যে থাকবে গভীর ভালোবাসা।
নাহিদ তার কথায় আনন্দে বিভোর হয়ে কোনো কথা বলতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
নাহিদা হেসে উঠে বলল, কি, আমার বক্তৃতা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন না কি?
: না ভাবছি।
: কী ভাবছেন?
: আপনার কথা শুনে দুটো জিনিস মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার একটা হলো, আপনার মনের মতো ছেলে আছে কি না। আর অন্যটা হলো, সে রকম ছেলে পাওয়া গেলে, এতবড় পদের চাকরিও ছেড়ে দিতে রাজি আছেন।
নাহিদা বলল, আপনার ভাবনাটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট। আমি মনে করি, একজন নারী পরিবারের সর্বময়ী কত্রী। পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে তাদের ন্যায্যমতো স্নেহ-ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং ধৈর্য ও সহনশীলতার দ্বারা গোটা পরিবারের কর্তৃত্ব করবেন। তিনি পরিবারের উন্নতি-অবনতি ও সুখ-শান্তির দিকে লক্ষ্য রাখবেন। অবশ্য স্বামীর সহযোগিতা না পেলে তা সম্ভব নয়। আমি আরও মনে করি, স্বামী ও স্ত্রী যদি পারিবারিক জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জ্ঞান অর্জন করে একে অপরকে ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে সাহায্য করে, তা হলে পরিবারের অভাব অনটন থাকলেও দুঃখ বা অশান্তি ঢুকতে পারবে না এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার ফাটলও ধরতে পারবে না। কোনো নারী যদি ন্যায় ও ধর্মীয় আইন সংগত কর্তৃত্ব করতে পারে, তবে তার চেয়ে নারীদের স্বাধীনতা আর কী হতে পারে? যে সব নারী সভা-সমিতি, ক্লাব ও নাচ-গান এবং চরিত্রহীন পুরুষদের মতো স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের বুলি আওড়াচ্ছে, তারা সমগ্র নারী জাতির কঙ্ক। আমি তাদের ঘোর বিরোধী। আমি বিশ্বাস করি, একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে দেশের সমগ্র মানবগোষ্ঠী একটা বৃহৎ পরিবার এবং সেই পরিবারের উন্নতি-অবনতি, ভালো-মন্দ ও সুখ-দুঃখ যেমন রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে, তেমনি একটা ছোট পরিবারের সবকিছু সেই পরিবারের কর্তীর উপর নির্ভর করে। তিনি যদি সভা-সমিতি, নাচ-গান ও ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে তার পক্ষে পরিবারের সব দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা একেবারেই অসম্ভব। নারীত্বই নারীর গৌরব। নারীত্ব কী জিনিস তা ঐসব নারীরা জানে না। আমি চাই, নারীত্ব বজায় রেখে, যে সব পুরুষ নারীদের উপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার করছে, তার প্রতিকার করা। দুধ বা ঘিয়ের মধ্যে যে সমস্ত গুণ থাকার কথা, তাতে যদি তা না থাকে, তবে সেই দুধ ও ঘিয়ের মূল্য যেমন থাকে না, তেমনি নারীর মধ্যে নারীত্ব না থাকলে সেই নারীরও কোনো মূল্য থাকে না। জানতাম পুরুষেরা কামিনী-কাঞ্চনের জন্য এমন কোনো গর্হিত কাজ নেই, যা তারা করতে পারে না। কিন্তু আজকাল কতিপয় নারী কামনা ও কাঞ্চনের জন্য সেই সব গর্হিত কাজ করবেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে।
নাহিদ বলল, এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমার মনে হয়, ঐ ধরনের নারীরা ক্লিওপেট্রার মতো খ্যাতি অর্জন করার জন্য এবং যৌনলিপ্সা ও অর্থলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য এইসব করছেন। আর তাদেরকে নাচাচ্ছে নাস্তিকরা ও বিধর্মীরা এবং মুসলমান নামধারী মুনাফেকরা। নাস্তিকরা সব যুগে ছিল, এই যুগে আছে এবং পরের যুগেও থাকবে। তাদেরকে নিয়ে আস্তিক লোকদের কোনো যুগেই মাথাব্যথা ছিল না, এবং এখনও নেই। অবশ্য আগের যুগে তাদের মধ্যে যারা ধর্মগ্রন্থকে নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করেছেন, তাদেরকে সেজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আর বর্তমান যুগে যারা ঐরূপ দুঃসাহস দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন, তাদেরকেও চরম মূল্য দিতে হয়েছে এবং হবে। একটা কথা সমস্ত মুসলমানদের তথা সারা বিশ্বের মানুষের জেনে রাখা উচিত, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের বড় বড় পণ্ডিতবর্গ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, “কুরআন একটা নির্ভুল ঐশীগ্রন্থ এবং আজও অপরিবর্তনীয় রয়েছে।” আর কুরআন পাককে কেয়ামত পর্যন্ত কেউ যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন অথবা বিলুপ্ত করতে পারবে না, সে কথা আল্লাহপাক নিজেই কোরআনে বর্ণনা করেছেন, “আমিই কোরআন নাযিল করিয়াছি এবং আমিই উহার রক্ষক।” [সূরা হিজর-আয়াত নং ৯, পারা ১৩।]
আল্লাহ পাক কুরআনে অন্যত্র আরও বর্ণনা করেছেন,–“আমার বাণীসমূহ কেহই পরিবর্তন করিতে পরিবে না।” [সূরা কাহাফের ২৭ নং আয়াতের মাঝখানের অংশবিশেষ, পারা-১৫।]
এই সমস্ত জানার পর যারা নিজেদের কুয়ার ব্যাঙের মতো জ্ঞানের পরিধি নিয়ে কুরআনের ভুল ধরেন বা পরিবর্তনের কথা বলেন, তা হলে তাদেরকে মহামূর্খ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
তবে তারা যদি সমাজের ক্ষতগুলো কুরআন হাদিসের আলোকে প্রতিকারের এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক নারীদেরকে কতটা অধিকার দিয়েছেন, সেই জ্ঞান অর্জন করে সেইসব আদায়ের আন্দোলন করতেন, তাহলে তারা সারাবিশ্বের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন। শুধু তাদেরকে উদ্দেশ করেই নয়, বরং পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানদের তথা বিশ্বমানবদের উদ্দেশ করে কুরআন পাকে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন-”যাহারা আল্লাহর সহিত এবং তাহার রসুলগণের সহিত কুফরি করে এবং এইরূপ ইচ্ছা রাখে যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে (ঈমান আনয়নের ব্যাপারে) পার্থক্য করে এবং বলে আমরা (পয়গম্বরদের) কতিপয়ের উপর ঈমান রাখি এবং কতিপয়কে অবিশ্বাস করি, আর এইরূপ ইচ্ছা রাখে যে, ইহার মাঝামাঝি একটি পথ উদ্ভাবন করে। এইরূপ লোকেরা সুনিশ্চিত কাফের, আর কাফেরদের জন্য আমি অপমানজনক শাস্তি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছি”। [সূরা নিসা ১৫০-১৫১ আয়াত, ৬ পারা।] কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নাহিদ আবার বলল, যখন কেউ কুরআনের বিরুদ্ধে কিছু বলে তখন কুরআন পাকে বর্ণিত আল্লাহর ঘোষণা আরও কিছু মনে পড়ে “এই কিতাব এমন-যাহার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই, (ইহা) খোদাভীরুগণের জন্য পথ প্রদর্শক। ঐ খোদাভীরুগণ এমন যে, বিশ্বাস স্থাপন করে অদৃশ্য বস্তুসমূহের প্রতি এবং নামায কায়েম রাখে আর আমি তাহাদিগকে যাহা প্রদান করিয়াছি উহা হইতে ব্যয় করে এবং তাহারা এমন যে, বিশ্বাস স্থাপন করে এই কিতাবের প্রতিও যাহা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে। আর ঐ সমস্ত কিতাবের প্রতিও যাহা আপনার পূর্বে অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং আখেরাতের প্রতিও তাহারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। ইহারাই রহিয়াছে তাহাদের প্রভু হইতে প্রাপ্ত হেদায়েতের উপর এবং ইহারাই সফলকাম। নিশ্চয় যাহারা কাফের হইয়া গিয়াছে, তাহাদের জন্য উভয়ই সমান-আপনি তাহাদিগকে ভয় দেখান বা না দেখান, তাহারা ঈমান অনিবে না। আল্লাহতায়ালা মোহর মারিয়া দিয়াছেন। তাহাদের অন্তরসমূহের উপর ও তাহাদের কর্ণসমূহের উপর এবং তাহাদের চক্ষুসমূহের উপর পর্দা রহিয়াছে আর তাহাদের জন্য রহিয়াছে গুরুতর শাস্তি”। [সূরা বাকারা ১/২/৩/৪/৫/৬ ও ৭ নং আয়াত-পারা-১।]
নাহিদা বলল, আমি যে ধর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না, সে কথা আগে একদিন আপনাকে বলেছিলাম। শুধু তাই নয়, ইসলাম ও ইসলাম ধর্মের সম্বন্ধে এবং কুরআন সম্বন্ধেও কিছু জানতাম না। লন্ডনে পড়াশুনা করার সময় এক বাঙালি মুসলমান মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু পোশাক-পরিচ্ছদে ও চাল চলনে কেউ তাকে বাঙালি মেয়ে বলে বুঝতে পারত না। সে দেখতেও খুব সুন্দরী। সে তো ধর্মের নামে নাক সিটকাত। কয়েক মাস আগে হঠাৎ তার সঙ্গে একদিন দেখা। প্রথমে তাকে দেখে আমি মনে বেশ হোঁচট খাই। সেই মেম সাহেব বান্ধবী মুসলিম গার্লে পরিণত হয়েছে। ব্যাপার জানতে চাইলে বলল, সে একজন প্রকৃত মুসলমান যুবককে ভালোবেসেছে। জিজ্ঞেস করলাম, প্রকৃত মুসলমান আবার কী? বলল, যারা ইসলামের আইন মেনে চলেন তাদেরকে প্রকৃত মুসলমান বলে। তার পরিবর্তন দেখে ও তার কথা শুনে ভাবলাম, ইসলাম এমন কী জিনিস যে জন্য অমন মেম সাহেব বান্ধবী ইসলামভক্ত হয়ে গেল। তখন থেকে আমিও ইসলামকে জানার জন্য প্রেরণা অনুভব করিল। তারপর একদিন টাউনে গিয়ে হজরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শাফী (রঃ) এর মা আরেফুল কুরআনের বাংলা তফসির কিনে এনে পড়তে শুরু করি। সেই সঙ্গে কয়েকটি ধর্মীয় বই কিনি। সেগুলোর মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত আফীফ আবদুল ফাত্তাহ্ তাবরার মাওলানা রেজাউল করিম ইসলামাবাদী অনূদিত “ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ” বইটি পড়ার সময় যখন পড়লাম “তোমরা আল্লাহর আদেশ মান্য কর এবং রসূলের (দঃ) আদেশ মান্য কর” (১) তখন রাসুলুল্লাহ (দঃ)-এর জীবনী পড়তে শুরু করি। আল্লাহপাকের শুকরিয়া জানাই যে, তিনি আমাকে হেদায়েত দান করেছেন।
নাহিদ বলল, আপনাকে দেখে আজ আমি যেমন অবাক হয়েছি তেমনি আনন্দিতও হয়েছি। আল্লাহপাক কাকে কখন হেদায়েত দেন তা মানুষের বোঝার অসাধ্য। আপনি কিন্তু আগের চেয়ে বেশ একটু রোগা হয়ে গেছেন। অবশ্য তাতে আপনাকে আরও বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে।
নাহিদা লজ্জা পেলেও হেসে ফেলে বলল, বাজে কথা।
আমি কখনো বাজে কথা বলি না। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে নাহিদ দাঁড়িয়ে বলল, আজ আসি তা হলে।
নাহিদাও দাঁড়িয়ে মিনতি স্বরে বলল, কিছু না খেয়ে গেলে আমি মনে… কথাটা শেষ না করে মাথাটা নিচু করে নিল।
নাহিদ এগিয়ে এসে তার চিবুক ধরে কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে নরম সুরে বলল, আপনাকে দেখতে এসেছিলাম। দেখে মন ও পেট দুটোই এত বেশি ভরে গেছে যে, কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া একবার যা না করেছি তা হ্যাঁ করতে পারি না। এটাই আমার স্বভাব। তাই ক্ষমাপ্রার্থী। আবার যখন আসব তখন তুমি সরি, আপনি যা খাওয়াবেন তাই খাব।
নাহিদা বারান্দা থেকে তার চলে যাওয়া দেখল। গাড়ি চোখের আড়াল হয়ে যেতে এশার নামায পড়ার জন্য অযু করতে বাথরুমে গেল।
সে রাতে নাহিদের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। শুধু নাহিদার কথা মনে পড়ছে। এপাশ-ওপাশ করতে করতে যখন কিছুতেই সফল হলো না তখন বালিশের তলা থেকে রেডিয়াম দেওয়া হাত ঘড়ি বার করে দেখল, বারোটা। ভাবল, একবার ফোন করলে কেমন হয়? আবার ভাবল, ওকি ঘুমিয়ে পড়েছে। অথবা ফোনটা যদি ওর আঙ্কেলের ঘরে থাকে তা হলে কী হবে? কিছুক্ষণ সাত পাঁচ ভেবে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে ডায়েল করল।
আবুল হোসেন সাহেব স্ত্রীসহ ফিরে এসে এগারোটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাহিদার ঘর অন্ধকার দেখে ভেবেছেন, সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
নাহিদা নটার দিকে খাওয়া-দাওয়া করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে শুয়ে নাহিদের কথা চিন্তা করছিল। আঙ্কেল ও আন্টির ফেরার শব্দ পেয়েছে। সে খেয়েছে কিনা কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করতেও শুনেছে। এখন রাত প্রায় বারোটা তবু তার চোখে ঘুম নেই। নাহিদ যেন চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বাথরুমের কাজ সেরে অযু করে এসে টেবিললেম্পের আলোতে কুরআনের তফসির পড়ছিল। এমন সময় টেলিফোন বাজার ক্ষীণ শব্দ তার কানে এল। ঘুমোবার সময় অন্যদিকের জানালা বন্ধ রাখলেও বারান্দার দিকের জানালা খোলা রাখে। তবে পর্দা ফেলা থাকে। তফসিরের বইটা বালিশের উপর রেখে তাড়াতাড়ি শালটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে ভীরু পায়ে বেরিয়ে এল।
টেলিফোন সেটটা আঙ্কেলের ঘরের দরজার পাশে বারান্দায় থাকে। নাহিদা দুরুদুরু বুকে রিসিভার তুলে অনুচ্চস্বরে বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে কেউ যেন কাঁপা গলায় বলল, কে আপনি?
নাহিদা নাহিদের গলা চিনতে পেরে বলল, আপনি কে আগে বলুন?
কথা বলার ধরন দেখে নাহিদ বুঝতে পারল, নাহিদাই ফোন ধরেছে। কিন্তু সে আমার গলা চিনতে পারে নি। তখন তার দুষ্টুমি করার খেয়াল চাপল। বলল, এটা কি আবুল হোসেন সাহেবের নাম্বার?
নাহিদা বিরক্ত হয়ে বলল, জ্বি, কিন্তু আপনি কে, কথা বলছেন না কেন?
: আমি খুব বিপদে পড়ে ওঁর কাছে ফোন করেছি। ওঁকে ফোনটা একটু দিতে পারেন?
এবার নাহিদা রেগে উঠে বলল, বার বার আপনার পরিচয় জানতে চাচ্ছি। আপনি সে কথা না বলে নানান পেঁচাল পাড়ছেন। আপনার পরিচয় বলুন, নচেৎ ফোন রেখে দিব।
: আমার পরিচয় শুনলে আপনি এখন যতটা রেগে আছেন তার চেয়ে অনেক বেশি রেগে যাবেন।
নাহিদার এবার মনে হলো, কোনো বাজে লোক তার সঙ্গে ফাজলামি করছে। রাগ সংযত করে গম্ভীর গলায় বলল, রেগে গেলেও আপনাকে তো আর হাতের কাছে পাচ্ছি না যে কিছু করব। এবার বলে ফেলুন। তা না হলে কালকে এক্সচেঞ্জ থেকে ইনকয়েরি করে আপনার নাম ঠিকানা জেনে যা করব, তা তখন টের পাবেন।
নাহিদ কপটতার আশ্রয় নিয়ে ভয়ার্ত স্বরে বলল, বলছি বলছি, অমন কাজ করবেন না, তা হলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। আপনার গলা শুনে বুঝতে পারছি, আপনি আবুল হোসেন সাহেবের আদরের ভাইঝি নাহিদা। আপনার নামের শেষ অক্ষরের আকারটা বাদ দিলে যা হয়, সেটাই আমার নাম।
নাহিদা লজ্জা পেয়ে বলল, আপনি কী বলুন তো? ছি, ছি আপনাকে কত কী বলে ফেললাম। আপনি যে দুষ্টুমিতেও জিনিয়াস তা জানতাম না। তারপর চুপ করে গেল।
নাহিদ তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে সেও চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ নাহিদার সাড়া না পেয়ে কাচুমাচু স্বরে বলল, আমার কি দোষ বলুন, আমি আপনার গলা চিনতে পারলাম, আপনি আমারটা পারলেন না, তাই দুষ্টুমি করার খেয়াল চেপে গেল। তাছাড়া প্রায় দু’ঘণ্ট ধরে ঘুমোবার চেষ্টা করছি; কিন্তু আপনি আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছেন না, তাই একটু শাস্তি দিলাম। সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
তার কথা শুনে নাহিদা লজ্জার কথা ভুলে হেসে উঠল।
: হাসছেন যে, ক্ষমা করবেন না?
: আঙ্কেল আন্টির ঘুম যাতে ভেঙে না যায় সেজন্য নাহিদা মুখে আঁচল খুঁজে হাসতেই লাগল।
: কী হলো এত হাসছেন কেন? বেশি হাসতে আমাদের নবী (দঃ) নিষেধ করেছেন।
নাহিদা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, আপনার মতো আমারও কিছুতেই ঘুম আসছিল না। চোখ বন্ধ করলেই আপনার ছবি ভেসে ওঠে। শেষে এই কিছুক্ষণ আগে অযু করে এসে কোরআনের তফসির পড়ছিলাম। তোমার কথা শুনে নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হচ্ছে। নিজের বোকামির কথা জানতে পেরে হাসি চেপে রাখতে পারছিলাম না।
নহিদ বলল, বোকারাই বেশি হাসে।
: আর চালাকরা?
: চুপ করে তাদের হাসি শোনে।
: কথাটা ঠিক নয়। চালাকেরা তা করে না। তারা বোকাদের বোকামি ধরিয়ে দিয়ে হাসি থামায়। বরং বোকারাই চুপ করে থেকে বোকাদের হাসবার সুযোগ দেয়।
: বাহ! কী দারুণ বুদ্ধি তোমার! আমার কথা দিয়েই আমাকে বোকা বানিয়ে ফেললে। তাহলে আমরা দুজনেই কি বোকা, না চালাক?
: আসলে আমার বোকাও নই, চালাকও নই।
: তাহলে আমরা কী?
: নাহিদা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, বললে মাইন্ড করবে না তো?
: না করব না।
: আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা।
নাহিদ হেসে উঠে বলল, সত্যি না মিথ্যা? মিথ্যাকে আমি কিন্তু ভীষণ ঘৃণা করি।
: জি হুজুর, সত্যি বললাম। আমিও তোমার মতো মিথ্যাকে ঘৃণা করি।
: এবার রাখি তাহলে?
: তোমার, সরি আপনার মর্জি।
নাহিদ হেসে ফেলে বলল, আবার আপনি কেন? বেশ তো তুমি করেই চালাচ্ছিলে? অবশ্য আমিও তাই।
নাহিদা লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ওমা তাই নাকি?
: হ্যাঁ তাই। তবে লজ্জা পাবার কিছু নেই। এটাইতো স্বাভাবিক। এবার রাখি, রাত অনেক হয়েছে শুয়ে পড়। তারপর সালাম দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলল।
নাহিদা সালামের প্রতিউত্তর দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে বলল, আপনিও শুয়ে পড়ুন, নচেৎ শরীর খারাপ করবে। তারপর নাহিদের ফোন রাখার শব্দ শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফোন রেখে দিল।