৩
নাহিদাদের বাড়ি সদরপুর গ্রামে। এখানে যে টেক্সটাইল মিল আছে, তার মালিক নাহিদার বাবা মোজাম্মেল সাহেব। তিনি স্ত্রী আজরা সুলতানাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। মোজাম্মেল সাহেব যেমন অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন, আজরা সুলতানাও তেমনি অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। আজরা সুলতানাও স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তাদের বিয়ের দিন ঠিক হয়ে যাবার পর মোজাম্মেল সাহেব পক্সে আক্রান্ত হন। বাঁচার কোনো আশা ছিল না। পক্স থেকে আরোগ্য লাভ করলেও মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। মুখের দিকে তাকালে সবাই ভয় পেত। এই খবর আজরা সুলতানার–বাবা জানতে পেরে বিয়ে ভেঙে দিতে চাইলেন। কিন্তু আজরা সুলতানা মা-বাবাকে জানালেন, তাকেই বিয়ে করবেন। মা-বাবা মেয়েকে অনেক বুঝিয়েও বশে আনতে পারলেন না। আজরা সুলতানা তাদেরকে বললেন, বিয়ের পর যদি এরকম হতো, তা হলে কী করতে? তাছাড়া আমার যদি এরকম হতো, তা হলেই বা কী করতে?
মোজাম্মেল সাহেব হবু শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্ত্রীর কথা জানতে পেরে গোপনে আজরা সুলতানার সঙ্গে দেখা করে তার মা-বাবার কথা মেনে নিতে বলেন। আরও বলেন, এই কুৎসিত মুখ নিয়ে অন্য কোনো মেয়েকেও বিয়ে করবেন না। যে মুখ আয়নাতে দেখে আমি নিজেই ভয় পাই, সেই মুখ অন্য কোনো মেয়েকে দেখাব কী করে?
আজরা সুলতানা পাশের গ্রামের সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। অপূর্ব সুন্দরী হওয়ার কারণে স্কুল ও কলেজের অনেক ছেলে প্রেম নিবেদন করে চিঠি দিত। কেউ কেউ বিয়ের প্রস্তাবও দিত। তিনি তাদের কাউকেই পাত্তা দেন নি। কারণ তিনি মনে মনে মোজাম্মেল সাহেবকে ভালোবাসতেন। আর মোজাম্মেল সাহেবও যে আজরা সুলতানাকে মনে মনে ভালোবাসতেন, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। মোজাম্মেল সাহেবের চেয়ে আজরা সুলতানা দু’বছরের জুনিয়ার ছিলেন। রাস্তা ঘাটে ও স্কুল-কলেজে প্রায় তাদের দেখা হয়েছে, কিন্তু কেউ কোনোদিন কারো সঙ্গে কথা বলেন নি। কখনো কখনো সামনা-সামনি পড়ে গেলে, একে অপরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক নয়নে চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চলে যেতেন। তাতেই যেন একে অপরের মনের কথা জানতে পারেন। কিন্তু কোনোদিন কেউ তা প্রকাশ করেন নি। পড়াশুনা শেষ হবার পর তাদের মধ্যে আর দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি। তারপর গার্জেনরা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করছেন জেনে, উভয়েই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন।
মোজাম্মেল সাহেবের কথা শুনে আজরা সুলতানা তার মুখের দিকে চেয়ে আঁশুভরা চোখে বললেন, ছাত্রজীবনে অনেকে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এবং তাদের আমি ফিরিয়ে দিয়েছি, সে সব কথা হয়তো আপনি জানেন, কিন্তু কেন ফিরিয়ে দিয়েছি শুনবেন? আপনাকে ভালোবাসতাম। আপনার সঙ্গে আমার কোনোদিন আলাপ হয় নি বটে। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকে মন-প্রাণ উজাড় করে আপনাকে ভালোবেসেছি, আজো বাসি এবং আমরণ বেসে যাব। আর আপনিও যে আমাকে ভালোবাসেন, তাও আমি জানি।
মোজাম্মেল সাহেব কী বলবেন ভেবে না পেয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন।
: কী হলো কিছু বরছেন না কেন?
: কী বলব বলুন, আমি এখন পরিস্থিতির শিকার।
: কীসের পরিস্থিতি? সারা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে কুৎসিত দেখলেও আমার চোখে আপনি তা নন। আপনি পুরুষ, পুরুষের চরিত্র এবং কর্মজীবনই তাকে পৃথিবীতে অমর করে রাখে। আমার প্রথম ও শেষ কথা আপনি যদি আমাকে বিয়ে না করেন, তাহলে আমার ভবিষ্যতের জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।
সেদিন মোজাম্মেল সাহেব আজরা সুলতানার দুটো হাত ধরে বলেছিলেন, তোমার কথাই ঠিক। আমিও তোমাকে জ্ঞান হবার পর থেকে ভালোবেসে এসেছি। তারপর আমার এই অবস্থার কারণে বিদেশে কোথাও পালিয়ে যাব ভেবেছিলাম; কিন্তু তার আগেই তোমার মতামত জানতে পেরে দেখা করতে এসেছি।
আজরা সুলতানা এগিয়ে এসে কদমবুছি করে ভিজে গলায় বললেন, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, আমাকে গ্রহণ করে ধন্য কর।
মোজাম্মেল সাহেব তার কপালে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তোমার কথা আমি রাখব। তারপর তারা দুজনে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
এরপর অনেক বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে মোজাম্মেল সাহেব আজরা সুলতানাকে। নির্দিষ্ট দিনেই বিয়ে করেন।
বিয়ের চার বছর পর নাহিদার জন্ম। নাহিদার বয়স যখন চার বছর তখন আজরা সুলতানা মারা যান। মোজাম্মেল সাহেব স্ত্রী বিয়োগে খুব ভেঙে পড়েন। মাস তিনেক পর কাউকে কিছু না বলে লন্ডন চলে যান। চাকরি পাবার পর বড় ভাইকে সবকিছু জানিয়ে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর পর দেশে ফিরে নাহিদাকে নিয়ে চলে যান। তারপর প্রতি বছর নাহিদাকে নিয়ে দেশে আসতেন এবং বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এক টেক্সটাইল মিল প্রতিষ্ঠা করেন।
বড় ভাই আবুল হোসেন সাহেবের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। নাহিদাকে উনি ও উনার স্ত্রী জোহরা বেগম নিজেদের মেয়ে মনে করতেন। তার বাবা যখন তাকে নিয়ে চলে যেতে চাইলেন তখন তাদের মনে ব্যথা লাগলেও বাধা দেন নি। আবু হোসেন সাহেব মিলের ডাইরেক্টর। শেষবারে এসে যখন মোজাম্মেল সাহেব মৃত্যুশয্যায় ছিলেন তখন বড় ভাইয়ের দুটো হাত ধরে বলেছিলেন, আমি মারা যাবার পর আপনারাই ওর গার্জেন। নাহিদা খুব জেদী মেয়ে। যদি আপাততঃ বিয়ে না করে চাকরি করতে চায়, তাহলে মিলেই একটা ভালো পদে চাকরি দিবেন। তারপর আপনি যা ভালো বুঝবেন করবেন।
মোজাম্মেল সাহেব মারা যাবার পর আবুল হোসেন সাহেব ভাইঝির বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন; কিন্তু নাহিদা কিছুতেই রাজি হয় নি। লন্ডনে লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে, বাংলাদেশের ছেলেদের মধ্যে কাউকে তার মনের মতো পাচ্ছে না। একবার চাচাকে বলেওছিল, এখানে থাকতে তার মন চায় না, লন্ডনে গিয়ে আরও পড়াশুনা করবে। এখানকার ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষা নিলেও কেমন যেন আনকালচার্ড আনকালচার্ড মনে হয়।
আবুল হোসেন সাহেব ভাইঝির মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, তুই আমাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ। চলে গেলে এখানকার বিষয় সম্পত্তি কে ভোগ করবে? আর আমাদেরকেই বা কে দেখাশুনা করবে? আরও কিছুদিন থাক, দেখবি ভালো লাগছে। লেখাপড়া করতে চাইলে এখানেই কর। অথবা তুই যদি চাকরি-বাকরি কিছু করতে চাস, তাহলে আমি তার ব্যবস্থা করব।
তারপর থেকে তাকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ দিলেন। সেই সাথে প্রতিমাসে বেশকিছু টাকা হাত খরচ বাবদ দিচ্ছেন।
নাহিদার চাচি জোহরা বেগম খুব সাদাসিধে মহিলা। তিনি বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। নাহিদার বিয়ে দেবার জন্য স্বামীকে মাঝে মাঝে তাগিদ দেন।
আবুল হোসেন সাহেব স্ত্রীকে বলেন, তুমি এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা করো না। যা করার আমিই করব।
এভাবে প্রায় এক বছর কেটে যাবার পর এবারে যখন নাহিদা সিলেটে বড় খালার বাড়ি বেড়াতে যাবার কথা বলল, তখন পারমিশন দিয়ে চিন্তা করলেন, এবার ওকে আমার অ্যাসিস্টেন্ট পদে চাকরি দিলে কেমন হয়? কিন্তু ও চাকরি করবে কিনা জানা দরকার। তাই সিলেট যাবার আগে একদিন নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কি চাকরি করার ইচ্ছা আছে, না আরও পড়াশুনা করবি?
নাহিদা বলল, পড়াশুনা করতে ইচ্ছা করছে না। তবে একটা ভালো চাকরি পেলে করব।
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, আমার অ্যাসিস্টেন পদে লোক দরকার। তুই ইচ্ছা করলে অ্যাপ্লিকেশন করতে পারিস।
নাহিদা পদের কথা শুনে খুশি হয়ে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে সিলেটে এসেছিল। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে দিনাজপুর ফিরছে।
বাড়িতে পৌঁছে নাহিদা করিডোরে গাড়ি পার্ক করার পর একজন চাকর এসে গাড়ির দুদিকের দরজা খুলে দিল।
নাহিদ গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি দেখে অবাক।
প্রায় দুই একর জমির মাঝখানে তিনতলা বাড়ি। পিছনের দিকে নানা রকম ফলের গাছ থাকলেও সামনের সবটুকু জায়গা ফুল গাছে ভর্তি।
নাহিদা গাড়ি থেকে নেমে চাকরকে মালপত্র তুলতে বলে নাহিদকে বলল, আসুন।
নাহিদ চাকরকে পিছনের সিট থেকে নাহিদার সুটকেস ও অন্যান্য জামাকাপড় নামিয়ে নিতে বলে নাহিদাকে বলল, মাফ করবেন, এখন আসতে পারব না। অফিসের একটা রিপোর্ট আছে, সেটা দুপুরের আগে পৌঁছাতে হবে। বাসা তো চিনেই গেলাম, অন্য একদিন আসব।
নাহিদা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, কিন্তু আপনি তো অসুস্থ, ড্রাইভিং করবেন কী করে?
নাহিদ মৃদু হেসে বলল, অসুস্থ আগে ছিলাম কিন্তু আপনার চিকিৎসায় এখন সুস্থ।
: যে কোনো সময় জ্বর আবার আসতে পারে।
: তা পারে, তবে এলেও অনেক পারে আসবে। তার আগেই অফিসে পৌঁছে যাব।
: অন্তত সামান্য কিছু মুখে দিয়ে যান।
: ধন্যবাদ, আসি, আল্লাহ হাফেজ। তারপর নাহিদ গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিল। নাহিদা তার উপর রেগে গেল। ভাবল, সত্যিই কি অফিসের কাজটা
জরুরি? না অন্য কিছু?
হাবিব সাহেব নাহিদাকে নাহিদের সাথে পাঠিয়ে দেবার পর ফোন করে নাহিদার চাচাকে সে কথা জানিয়ে বললেন, নাহিদ আমার ইন্ডাস্ট্রির অল ইন অল। যেমন সৎ তেমনি কর্মঠ ও দায়িত্বশীল।
আবুল হোসেন সাহেব নাহিদের নাম শুনে বললেন, আপনি ছেলেটার বায়োডাটা বলুন তো?
হাবিব সাহেব নাহিদের বায়োডাটা বললেন।
আবুল হোসেন সাহেব হেসে উঠে বললেন, তাই নাকি? তাকে তো আমিও ভালোভাবে চিনি। সে আমার বন্ধু নিয়াজের ছেলে। আমরা ভার্সিটিতে এক সঙ্গে পড়েছি। অত্যন্ত সৎ। ডবল এম, এ, হয়েও সৎ নাগরিক তৈরি করার ব্রত নিয়ে নিজের গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করছে।
: তাহলে তো ভালোই হলো। আমি তো মনে করেছিলাম, অপরিচিত একজন ছেলের সঙ্গে এতটা পথ যাবে শুনে আপনি অসন্তুষ্ট হবেন।
: আরে না না, কী যে বলেন। নাহিদের মতো ছেলে আজকাল চোখে পড়ে। আমি তো ওর সঙ্গে নাহিদার বিয়ে দিব বলে ভেবেছিলাম; কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বলে কিনা এখানকার ছেলেরা সব আনকালচার্ড। আমি কিন্তু এখনও হাল ছাড়ি নি।
: পাত্র হিসেবে নাহিদ যে রত্ন, সে কথা আমার চেয়ে আপনি বেশি জানেন। তবে একটা বিষয়ে যা একটু চিন্তা, নাহিদ খুব ধার্মিক। নাহিদা লন্ডনে মানুষ হয়েছে। সে ধার্মিক ছেলে পছন্দ করবে কিনা সন্দেহ। তবে নাহিদ ধার্মিক হলেও গোঁড়া নয়। সবকিছু মানিয়ে নেবার জ্ঞান তার আছে এবং সেই তাই করেও থাকে।
: আমি নিয়াজকে তো জানি। নাহিদ তার বাবার মতো হয়েছে। আমি তার সম্বন্ধে কিছু কিছু খোঁজ-খবর নিয়েছি। তবে আপনার কাছে যে কাজ করছে। জানতাম না। দেখা যাক না, তিন চার দিন তো দু’জনে এক সঙ্গে থাকছে, এখানে এলেই ওদের ফিলিংস বুঝতে পারব। যাক, পরে এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলব, এখন রাখি, তারপর সালাম বিনিময় করে আবুল হোসেন সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
নাহিদ চলে যাবার পর নাহিদা আঙ্কেলকে ফোন করল। নাহিদা চাচা-চাচিকে আঙ্কেল ও আন্টি বলে ডাকে।
আবুল হোসেন সাহেব ফোন ধরে নাহিদার গলা বুঝতে পেরে বললেন, আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর ফোন রেখে দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি রওয়ানা দিলেন।
বাড়িতে এসে নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলেন, নাহিদকে দেখছি না কেন?
নাহিদা বেশ অবাক হয়ে বলল, তুমি নাহিদ সাহেবের কথা জানলে কেমন করে?
: তোর বড় খালু ফোন করে জানিয়েছেন। সে কোথায় বলবি তো?
: নেই।
: নেই মানে।
: নেই মানে নেই। আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছেন। তার এখানকার অফিসে কী একটা রিপোর্ট নাকি দুপুরের মধ্যে পৌঁছাতে হবে।
: রিপোর্টটা সাবমিট করে তাকে আসতে বলিস নি?
: কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, সময় করে একদিন আসবেন।
: কিন্তু তোদের তো গত কাল আসার কথা?
নাহিদা গত কালের দুর্যোগের কথা ও নাহিদের জ্বরের কথা বলল।
: ওকে যেতে দিয়ে তুই খুব ভুল করেছিস মা।
: ফোন করলে অফিসের লোক বাপ বাপ করতে করতে এসে রিপোর্টটা নিয়ে যেত। তোর বড় খালু নামেমাত্র ইন্ডাস্ট্রির মালিক, যা কিছু সব নাহিদের কথায় চলে। ওকে সব অফিসের স্টাফরা যেমন ভয় করে তেমনি সম্মান করে। ওর মতো ছেলে এই জামানায় দ্বিতীয় আছে কিনা জানি না। সে যে তোকে এই কয়েকদিন কম্পেনিয়ান দিয়ে নিয়ে এল, সেটা তোর সৌভাগ্য।
নাহিদা আরও অবাক হয়ে বলল, তুমি ওর সম্বন্ধে এতকিছু জানলে কী করে?
: আমি জানব না তো কে জানবে? ও আমার বন্ধুর ছেলে। দাঁড়া ওর অফিসে ফোন করি।
ওপারে ফোন ধরতে আবুল হোসেন সাহেব বললেন, নাহিদ সাহেবকে দিন।
: উনি তো এই পাঁচ মিনিট আগে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন।
: মানে?
: জি, উনি অফিসে আসার পর পর সিলেট থেকে বড় সাহেব ফোন করেছিলেন। তিনি কী বললেন আমাদের বলেন নি। ফোন রেখে রিপোর্টটা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, জরুরি দরকারে আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হচ্ছে। আজ ঢাকায় পৌঁছাতেই হবে। ওখানকার কাজ সেরে কাল সিলেট যাবেন।
আবুল হোসেন সাহেব ফোন রেখে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নাহিদাকে ফোনের আলাপের কথা বলে বললেন, শুনলি তো মা, ছেলেটা কত কর্তব্যপরায়ণ, কোম্পানির জন্য নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করল না।
নাহিদা চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু তিনি খুব অসুস্থ। সেই অবস্থায় এতটা পথ জার্নি করে এসে আবার এত পথ জার্নি করবেন কী করে?
: সেকথা এখন আর ভেবে কী হবে? চল আমরা খেয়ে নিই।
নাহিদার মন খারাপ হয়ে গেল। নাহিদের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে একদিকে যেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, অপরদিকে আঙ্কেলের মুখে তার গুণগান শুনে আনন্দে ও অনুশোচনায় তার গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। কোনো রকমে ঢোক গিলে বলল, তুমি খেয়ে নাও। আমার এখন খিদে নেই, পরে খাব।
আবুল হোসেন সাহেব ভাইঝির মুখের অবস্থা দেখে যা বুঝার বুঝে গেলেন। মনে মনে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা নাহিদকে তোর কেমন লাগল।
: কেমন আবার? ভালোই, তবে আনকালচার্ড।
জোহরা বেগম নাহিদাকে ছোটবেলায় মেয়ের মতো মানুষ করলেও এখন তার বেলেল্লিপনার জন্য এব বিয়ে না করে চাকরি করবে শুনে তার উপর বেশ অসন্তুষ্ট। তিনি একটু আগে এসে নাহিদার শেষের কথা শুনে তাকে উদ্দেশ করে বললেন, তুই বুঝি নাহিদকে খুব চোটপাট দেখিয়েছিস?
: আন্টি, তুমি আমাকে কী মনে কর? শুধু শুধু চোটপাট দেখাতে যাব কেন?
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, তোর আন্টির কথা বাদ দে। নাহিদ তোকে কেমন কম্পোনিয়ান দিল বল!
নাহিদা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, মোটামুটি।
: যাক ছেলেটাকে তাহলে তোর মোটামুটি পছন্দ, কি বলিস?
: আঙ্কেল, তুমি কিন্তু বেলাইনে চলে যাচ্ছ।
আবুল হোসেন সাহেব স্ত্রীর দিকে একবার চেয়ে নিয়ে হেসে উঠে বললেন, বেলাইনে যাবার বয়স এখন আর কি আছ? তুই না চলে যাস সেই চিন্তাই করছি।
নাহিদা লজ্জা পেয়ে বলল, আঙ্কেল কী হচ্ছে? আন্টি রয়েছে না?
জোহরা বেগম চুপ করে থাকতে পারলেন না। বললেন, তোর আঙ্কেল বরাবর ঐ রকম। কাকে কী বলতে হয় জানে না। চল সবাই খাবে চল।
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, ওর এখন খিদে নেই। অসুস্থ নাহিদ আজই ফিরে গেছে শুনে মন খারাপ দেখতে পাচ্ছ না? আমাকে খেতে দেবে চল।
নাহিদা আঙ্কেলের দিকে একবার কটাক্ষ হেনে বলল, উনি অসুস্থ তাই। নচেৎ আমার মন খারাপ হতে বয়েই গেছে। তারপর নিজের রুমে যেতে যেতে বলল, দু’দিন গোসল করি নি, গোসল করে তারপর খাব।
নাহিদা বাথরুমে ঢুকে প্রথমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে ধিক্কার দিয়ে বলল, এই রূপ ও ফিগার নিয়ে বড়াই করিস? তারপর শর্মিলাকে পাশে কল্পনা করে নিজেকে একটা নগণ্য মেয়ে বলে মনে হলো। শর্মিলাকে দেখার পর কোনো ছেলেই তার দিকে চেয়েও দেখবে না। তখন তার মনে হলো, মেয়েদের যতই গুণ থাক না কেন, সেই সাথে রূপ ও ফিগার যদি না থাকে, তা হলে সে মেয়ের দিকে কোনো সুপুরুষের চোখ পড়বে না।
আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নাহিদা জীবনে এই প্রথম আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করল, এই মুটকিকে কি কোনো সুন্দর ছেলে পছন্দ করবে?
নাহিদা হ্যাংলা গোবেচারা ধরনের ছেলেদের মোটেই পছন্দ করে না। যুবতি হবার পর বান্ধবীদের প্রেমিকদের দেখে সে হতাশ হয়েছে। যে পুরুষের মধ্যে পৌরুষের বলিষ্ঠতা নেই, তাকে জীবনসঙ্গী করতে তার একদম মন চায় নি। লন্ডনে শর্মিলা ও অন্যান্য বান্ধবীদেরকে ঐরকম ছেলেদের সঙ্গে ডেটিং করতে দেখে নাহিদার মন বিরক্তিতে ভরে যেত। তাই মনের মতো পুরুষ পায় নি বলে কোনোদিন কারো সঙ্গে ডেটিং করে নি। নাহিদের সঙ্গে পরিচয় হলেও তার ঢিলে-ঢালা পোশাকের মধ্যে তার মনের মতো বলিষ্ঠ পুরুষ যে লুকিয়ে থাকতে পারে, তা ঢাকায় শর্মিলার কাছে নাহিদকে সুইমিং ড্রেসে না দেখলে জানতেই পারত না। শর্মিলার কথা মনে পড়তে ভাবল, তার মতো সুন্দরী মেয়ের ভালোবাসা অফার পাবার পরও কি নাহিদ আমার কথা মনে রাখবে? তা হলে আমি কি শর্মিলার মতো একটা বাজে মেয়ের কাছে হেরে যাব?
নাহিদ ঢাকার অফিসের কাজ সেরে পরের দিন যখন সিলেটে নিজের বাসায় পৌঁছল তখন রাত আটটা। আজ কয়েক দিন তার শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। তার উপর অসুস্থ। বাসায় পৌঁছে প্রথমে ডাক্তারের কাছে গেল। তারপর ফিরে এসে এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করতে করতে দশটা বেজে গেল। ভাবল, আজ আর সাহেবকে ফোন করার দরকার নেই; কাল অফিসে গিয়ে দেখা করলেই চলবে। এই ভেবে ঘুমোতে গিয়ে বালিশে মাথা রেখেছে, এমন সময় ফোন বেজে উঠল।
ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সালমা বেগমের গলা শোনা গেল, নাহিদ, কখন ফিরলে তুমি?
: আটটার সময়।
: তোমরা নাকি ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় আটকা পড়ে গাড়িতেই রাত কাটিয়েছ? কী সাংঘাতিক বিপদে না পড়েছিলে? গাড়িতে তোমার জ্বরও হয়েছিল? সেই অবস্থাতেই আবার এত পথ জার্নি করে ফিরে আসতে গেলে কেন? সাহেবকে অসুখের কথা জানিয়ে দু’চার দিন রেস্ট নিয়ে আসতে পারতে। শরীরের প্রতি এত অবিচার করা তোমার উচিত হয় নি। এখন কেমন আছ?
নাহিদ বেশ অবাক হয়ে বলল, ভালো। কিন্তু এসব খবর এরই মধ্যে আপনি জানলেন কেমন করে?
নাহিদার চাচা কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলেন। ঐ দস্যি মেয়েটা তোমার সঙ্গে মনে হয় ভালো ব্যবহার করে নি?
নাহিদ কিছু বলার আগে সাহেবের গলা শুনতে পেল, আমায় দাও।
সালমা বেগম নাহিদকে বললেন, নাও, এবার তোমার সাহেবের সঙ্গে কথা বল।
হাবিব সাহেব ফোন নিয়ে বললেন, নাহিদ, তুমি নিশ্চয় খুব টায়ার্ড? তাই এখন তোমার উচিত, খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়া। কাল অফিসে কথা হবে। তারপর ফোন রেখে দিলেন।
নাহিদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, সাহেব ফোন না ধরলে বেগম সাহেব আর যে কতক্ষণ বক্তৃতা করতেন, তার হিসাব নেই।