৫
পরের দিন নাহিদ নিজের কাজে ব্যস্ত রইল। লাঞ্চের পর এক ফাঁকে ফোন করে নাহিদাকে বলল, আমি চারটের সময় আসছি। তুমি রেডি থেকো, তোমাকে নিয়ে রাজবাড়ি দেখতে যাব।
নাহিদা বলল, ঠিক আছে, তাই হবে; তবে তুমি আমাদের বাড়িতে এলে আন্টির সামনে তোমার সঙ্গে বেরোতে আমার লজ্জা লাগবে। তাছাড়া আঙ্কেল যা ঠোঁটকাটা, আমাকে যা তা করে বলে ইয়ার্কি করবে। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে যা করে; আন্টির কাছে মাথা তুলতে পারি না।
নাহিদ হেসে উঠে বলল, তাই নাকি? আঙ্কেল হয়ে ভাইঝির সঙ্গে ইয়ার্কি করেন কেমন করে?
: আঙ্কেল খুব মজার লোক, কার সঙ্গে কী সম্পর্ক, কথা বলার সময় সেসব তার খেয়াল থাকে না। এজন্যে আন্টির কাছে প্রায়ই বকা খায়।
: তোমার কথাই ঠিক। এখন আমার আব্বার কথা মনে পড়ছে; উনি আমাকে প্রায়ই বলেন জানিস নাহিদ, আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু আবুল হোসেন সাহেব দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলের ডাইরেক্টর। সে খুব সাদাসিধে ও আমুদে লোক। ছোট-বড়, আত্মীয়-অনাত্মীয় ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, কথা বলার সময় সম্পর্কের কোনো ধার ধারে না। তাদের সাথে হাস্যরস করে কথা বলবেই।
নাহিদা বলল, তোমার বাবা তার বন্ধুকে ঠিকই চিনেন। তুমি এক কাজ কর, আমাদের বাড়িতে আসবার সময় কিছুটা দূরে রাস্তার মোড়ে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওখানে চা খাবে। আমি ঠিক চারটের সময় পৌঁছে যাব।
নাহিদ বলল, ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোন ছেড়ে দিল।
নাহিদা তিনটে থেকে পৌনে চারটে পর্যন্ত ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে সাজাল। তারপর আন্টির কাছে গিয়ে বলল, আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।
জোহরা বেগম দেওরের এই মেয়েটিকে আজও চিনতে পারেন নি। নিজের কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। তাই হয়তো নাহিদাকে মানুষ করলেও তার মন বুঝতে পারেন নি। ভাবেন, মেয়েটা বিলেতে মানুষ হয়েছে বলে হয়তো এর স্বভাব আলাদা। আজ তাকে সেজেগুজে বেরোতে দেখে বললেন, কোথায় যাবি? তোর আঙ্কেলকে গাড়ি পাঠাতে বলেছিস?
নাহিদা বলল, না বলি নি, যার সঙ্গে বেড়াতে যাব তার গাড়ি আছে।
: কার সঙ্গে বেড়াতে যাবি?
ফিরে এসে বলব বলে নাহিদা সেখান থেকে চলে এল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে একটা রিকশা নিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে এল।
রিকশা থেকে নেমেছে এমন সময় নাহিদের গাড়ি তার পাশে এসে থামল।
নাহিদ খুব অবাক হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে আজ ঘিয়ে কালারের সালওয়ার কামিজ ও ওড়না পরেছে। ভাবল, আমার পছন্দের সঙ্গে ওর পছন্দের হুবহু মিল রয়েছে।
নাহিদা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নাহিদের দিকে চেয়ে তারও ঐ একই অবস্থা এবং সেও একই কথা ভাবল। কারণ নাহিদও আজ ঘিয়ে কালারের পাজামা পাঞ্জাবি পরে এসেছে। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, এভাবে আমার দিকে চেয়ে কী দেখছ?
নাহিদ সালামের প্রতিউত্তর দিয়ে পাশের দরজা খুলে বসতে বলল।
নাহিদা বসে দরজা বন্ধ করে বলল, কী দেখছিলেন বললে না যে?
নাহিদ বলল, গতকাল ও আজ যা দেখলাম, তাতে খুব অবাক হচ্ছি আমার পছন্দের সঙ্গে তোমার মিল দেখে। তার চেয়ে আরও আশ্চর্য হচ্ছি, দু’জনে একই সঙ্গে একই কালারের পোশাক পরেছি বলে।
নাহিদা মৃদু হেসে বলল, আমিও তাই ভেবে খুব অবাক হচ্ছি। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল, এটা হয়তো আল্লাহপাকের ইশারা। জ্ঞানমতো জানি যাদের মন-মানসিকতা একই ধরনের হয়, তারা ভবিষ্যৎ জীবনে সুখী হয়।
: তুমি খুব খাঁটি কথা বলেছ। আল্লাহপাক যেন আমাদের ইহজীবন ও পরজীবন সুখের করেন, শন্তির করেন।
নাহিদা বলল, আমিন।
সুবহান আল্লাহ বলে নাহিদ বলল, এই কয়েক মাসে তুমি অনেক বদলে গেছ। তোমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তোমার পরিবর্তনে আমি যে কত আনন্দিত হয়েছি, তা আল্লাহপাক ছাড়া কেউ জানেন না।
নাহিদা বলল, আমার এই পরিবর্তনের মূলে তুমি। আল্লাহপাক মেহেরবানী করে তোমাকে জানার ও তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ করে আমাকে ধন্য করেছেন, সে জন্যে তাঁর পাক দরবারে জানাই অসংখ্যবার শুকরিয়া।
ততক্ষণে তারা রাজবাড়িতে পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমে দু’জনে ঘুরে ঘুরে রাজবাড়ি দেখতে লাগল। রাজবাড়ির সামনে বেশ অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সেখানে নানা রকম গাছ। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা বড় দেবদারু গাছের তলায় এসে বসল।
নাহিদ পকেট থেকে নামায পড়ার কাপড় বের করে বলল, আমার অযু আছে, আসরের নামায পড়ব।
নাহিদা বলল, আমারও অজু আছে। তোমার পড়া হয়ে গেলে আমিও পড়ব।
নামায পড়ে গল্প করতে করতে নাহিদা জিজ্ঞেস করল, কাল রাতে ঘুম হয়েছিল?
: না, তোমার?
: আমারও হয় নি।
: আজ হবে?
: জানি না।
: ঘুম না আসলে আজও ফোন করব।
: আমি জেগে থাকব। তারপর জিজ্ঞেস করল, সিলেটে কি একা থাক?
: দোকা যে নেই, তা তো তুমি জান?
: তাহলে রান্নাবান্না করে কে?
: কাদুর বাপ।
নাহিদা হেসে উঠে বলল, কাদুর বাপ আবার কে?
: একজন বুড়োমতো লোক। তার কাদু নামে এক ছেলে ছাড়া কেউ নেই। সেই ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। বুড়োটা আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রিতে বদলিতে কুলির কাজ করত। মাসের মধে বিশ-পঁচিশ দিন কাজ পেত না। তবে সারাদিন গেটের পাশে বসে থাকত। খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। আমি জানতে পেরে নিজের কাজে লাগিয়েছি। পাহাড়ি এলাকার খুব সহজ সরল লোক। তবে খুব ভালো রান্না করে। আর ঘরদোর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। কোনো লম্বা ছুটিতে সিলেটে বেড়াতে এসো না। দাওয়াত দিয়ে একদিন কাদুর বাপের মজাদার রান্না খাওয়াব। সে সময় আমারও ছুটি থাকবে। তোমাকে নিয়ে পাহাড়ি গ্রাম ঘুরে বেড়াব, মাধবকুণ্ডে জলপ্রপাত দেখাতে নিয়ে যাব। জাফলংয়ে তুমি তো একবার গিয়েছ, আবার নিয়ে যাব। ওখানকার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য দু’বার দেখেছি, তবু বার বার দেখতে ইচ্ছে করে।
নাহিদা আনন্দে উল্লসিত হয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় যাব। তবে….বলে চুপ করে মলিন মুখে নাহিদের দিকে চেয়ে রইল।
তাই দেখে বিমর্ষ মুখে নাহিদ বলল, কি হলো তোমার?
নাহিদা ম্লান মুখে বলল, এখন আমরা যা করছি এবং যা করার প্রোগ্রাম করলাম তা কি শরীয়ত সঙ্গত?
নাহিদ ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে ধার্মিক জেনে এসেছে। বাবাকে ধার্মিক ও আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে তার সুনামের কথাও জেনেছে। তারা নাহিদকে নিজেদের মতো করে গড়েছেন। অন্যান্য ছেলে-মেয়েদেরও সেইভাবে গড়ছেন। তাই নাহিদ কলেজ, ভার্সিটি ও ফরেন থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এলেও ধর্মের পথ থেকে এতটুকু সরে যায় নি। মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করা গোনাহ্ জেনে ঐ পথে পা বাড়ায় নি। মা-বাবা তার বিয়ে দেবার জন্য অনেক মেয়ে দেখেছেন, কিন্তু গোপনে তাদের বায়োডাটা জেনে সব নাচক করে দিয়েছে। ভেবে রেখেছে, মনের মতো যদি কোনো মেয়ে পাই, তাহলে বিয়ে করবে নচেৎ করবে না। সাহেবের বাসায় যখন নাহিদার সঙ্গে তার পরিচয় হয়, তখন নাহিদাকে দেখে নাহিদের ঘুমন্ত মন হঠাৎ জেগে উঠে তাকে বলে, ভালো করে দেখ, এই তোমার মানসী কিনা? সেজন্যে অপলক নয়নে নাহিদার দিকে চেয়ে ছিল। কিন্তু তার পরিচয় শুনে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মনকে শক্ত করে নেয়। তারপর জাফলং থেকে নাহিদাকে নিয়ে কক্সবাজার যাওয়া এবং সেখান থেকে ঢাকা আসা পর্যন্ত তাকে নিয়ে কিছুই ভাবে নি। ঢাকার হোটেলে তার আচরণের পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক হলেও মনকে সংযত রাখে। কিন্তু দিনাজপুর যাবার পথে সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতের পর নাহিদার মনের খবর পেয়ে নিজেকে সংযত রাখতে পারে নি। তখন থেকে ভেবেছে, বিয়ে যদি করতেই হয় তবে নাহিদাকেই করবে। তারপর তাকে যত জেনেছে তার প্রতি তত দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিয়ের আগে এভাবে দু’জন যুবক-যুবতির মেলামেশা যে ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ, সে কথা তার মনে হয় নি। এতদিন সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। এখন নাহিদার কথা শুনে সেই ঘোর কেটে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সবকিছু জেনেও আমি বিরাট ভুল করে চলছিলাম। আল্লাহ্পাকের লাখ লাখ শুকরিয়া, তিনি আমাকে তার এক নেক বান্দীর মারফত অন্যায় ধরিয়ে দিলেন। বিশ্বাস কর নাহিদা, আমি কোনোদিন কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবি নি। বিনা প্রয়োজনে কোনো মেয়ের মুখের দিকে চেয়েও দেখি নি। প্রথম পরিচয়ের সময় তোমাকে দেখে দুর্বলতা অনুভব করেলেও ধর্মীয় কারণে নিজেকে সংযত রেখেছি। তারপর যখন আমরা একে অপরের মনের খবর পেয়ে এগোতে লাগলাম তখন ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কথা ভুলে যাই। এখন আমাদের কী করা উচিত তুমি বল।
নাহিদা ছলছল চোখে বলল, আমি কী ছিলাম, তা আমি জানি। তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার পর সাধারণ ছেলে ভেবে পাত্তা দিই নি। তোমাকে নিয়ে কখনো ভাবি নি। তোমাকে জানার পর ভালোবসে নিজেকে চিনেছি, আল্লাহকে ও রসুল (দঃ)-কে চিনেছি। আর আমি কী রত্ন লাভ করেছি, তা আমি ও আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন। আমি মেয়ে, কী বুদ্ধি দেব? যা কিছু করার তোমাকে করতে হবে।
: তোমার আঙ্কেলের সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব। আব্বা প্রস্তাব দিলে নিশ্চয় উনি মেনে নেবেন।
: আমারও তাই মনে হয়। আঙ্কেল তোমার ও তোমার বাবার প্রশংসা আমার কাছে প্রায় করেন। তোমাকে নিয়ে আমার সঙ্গে ফাজলামিও করেন। তাছাড়া তোমার বস ও তার স্ত্রী, মানে আমার বড় খালা ও খালু তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। ওঁরাও শুনে খুশি হবেন।
আলহামদুলিল্লাহ বলে নাহিদ বলল, তাহলে চল, আজই তোমার আঙ্কেলকে প্রস্তাবটা দিয়ে দিই। আর সেই সঙ্গে তোমাকে সিলেটে বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তেমন তেমন বুঝলে সেখানেই বিয়েটা সেরে ফেলব।
নাহিদা বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেলেও হাসি চাপতে পারল না। হাসতে হাসতে বলল, তেমন তেমন কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম না।
: এই বোকা, সামান্য কথাটা বুঝতে পারলে না? কথাটার অর্থ হলো-আমরা যদি একে অন্যকে ছেড়ে থাকতে না পারি অথবা শরীয়তের কথা ভেবে এক সঙ্গে বেড়াতে যেতে না পারি, তা ইমারজেন্সি হিসেবে গোপনে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলব। তার ফলে গার্জেনরা আমাদের মেলামেশা দেখে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি শুভস্য শিঘ্রমের ব্যবস্থা করবেন।
নাহিদা আরও বেশি লজ্জা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, তুমি মুখে যা বললে, কাজে তা দেখাতে পারবে?
: কেন পারব না? তুমি চাইলে এক্ষুনি কাজী অফিসে যেতে পারি।
নাহিদা হাসতে হাসতে বলল, কোনো কাজ তাড়াতাড়ি করতে নেই। এটা হাদিসের কথা। সিলেটে গিয়ে তেমন তেমন বুঝলে দেখা যাবে।
নাহিদও হেসে উঠে বলল, আল্লাহপাক যেন সে সময় তোমাকে তেমন তেমন বুঝবার ক্ষমতা দেন।
এই কথায় দু’জনে আবার হেসে উঠল।
এমন সময় একজোড়া যুবক-যুবতিকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে নাহিদ বলল, দেখ দেখ, আমাদের মতো ওরাও রাজবাড়ি দেখতে এসেছে।
নাহিদা তাদের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, ওরা আমাদের অফিস স্টাফ। ছেলেটা ম্যানেজার, আর মেয়েটা আঙ্কেলের পি.এ.। চল এবার ফেরা যাক, নচেৎ বাড়িতে গিয়ে মাগরিবের নামায পড়তে পারব না। কাজা হয়ে যাবে।
: আরও কিছুক্ষণ বস। এখানে নামায পড়ব। তারপর শহরের কোনো ভালো হোটেলে খেয়ে তোমাকে পৌঁছে দেব।
: সন্ধ্যার পর এখানে থাকলে পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে যাবে।
: তা হলে তো ভালোই হবে। দারোগাকে বলব, আমরা স্বামী-স্ত্রী, দয়া করে আমাদেরকে এক কামরায় রাখবেন।
নাহিদা হেসে উঠে বলল, আবার কিন্তু বোকার মতো কথা বলছ।
: আরে বাবা, প্রেমে পড়লে চালাকরাও বোকা বনে যায়। দেখলে না, একটা টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার হয়ে সামান্য একটা পি.এ.র সঙ্গে প্রেম করে অভিসারে বেরিয়েছে।
: হয়েছে হয়েছে, অত আর সাফাই গাইতে হবে না। ওদের কেসটা একটু অন্যরকম।
: তাই নাকি? তাহলে কেসটা বর্ণনা কর।
: কেসটার সঙ্গে আমিও কিন্তু জড়িত।
: তাহলে তো কেসটা দারুণ ফ্যান্টাস্টিক, তাড়াতাড়ি বল।
নাহিদা হেসে উঠে বলল, শুনলে তোমার জেলাস হবে।
: আমাকে অত ছোট ভাবলে দুঃখ পাব।
: সরি, এমনি কথা প্রসঙ্গে বলেছি, তুমি দুঃখ পাবে জানলে বলতাম না। তবু ক্ষমা চাইছি।
: ক্ষমা চাওয়ার মতো অপরাধ তুমি কর নি। এবার বল।
: ম্যানেজারের অফিসিয়াল রেকর্ড খুব ভালো। আমিও তার কোনো দোষ দেখি নি। কয়েক মাস আগে তার স্ত্রী মারা গেছে। আমি অফিসে জয়েন করার পর আমার দিকে এগোবার চেষ্টা করেন। বুঝতে পেরে একদিন আমি ভদ্রভাবে কিছু কথাবার্তা বলে দু’জনের মাঝখানে প্রাচীর তুলে দুই। তারপর থেকে আঙ্কেলের পি, এর পিছনে লেগেছেন। আঙ্কেল বলেছিল, ওদের বিয়ে নাকি খুব শিগগির হবে।
নাহিদ একটা মেকী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, সবার সব কিছু তাড়াতাড়ি হচ্ছে, শুধু আমার বেলায় ব্যতিক্রম।
নাহিদা তার চালাকি বুঝতে পেরে হেসে উঠে বলল, সবরের গাছ খুব তিতা হলেও ফল বড় মিষ্টি।
: কথাটা আমিও জানি। তুমি সবর করতে পারলে, আমি পারব না কেন? এখন বল, সিলেটে কবে আসছ?
: চিঠি দিয়ে জানাব।
: একটু তাড়াতাড়ি দিও।
হঠাৎ নাহিদার শর্মিলার কথা মনে পড়ল। বলল, তুমি শর্মিলা নামে কোনো মেয়েকে চেন নাকি? অত্যন্ত সুন্দরী ও লাস্যময়ী মেয়ে। ওকে একবার দেখলে কেউ ভুলতে পারবে না। ময়মনসিংহের মেয়ে। এখন রাজশাহীতে চাকরি করছে। কথাটা বলে তার মুখের দিকে নাহিদা তাকিয়ে রইল, কোনো ভাবান্তর হয় কিনা দেখার জন্য। তা হল না দেখে খুশি হল।
নাহিদ অল্পক্ষণ চিন্তা করে বলল, তুমি ছাড়া নাম মনে রাখার মতো এমন কোনো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। তবে তোমার কথা শুনে একটা মেয়ের কথা একটু একটু যেন মনে পড়ছে। আমার বন্ধুর বোন। নাম মনে নেই। একবার কী একটা কাজে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। সে সময় বন্ধুর বাড়িতে একদিন-একরাত ছিলাম। বন্ধুই তার বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মেয়েটা দেখতে ভালোই। তবে তুমি যতটা সুন্দরী বললে, ততটা নয়। কী জানি, আমার হয়তো তেমন সৌন্দর্যবোধ নেই।
নাহিদা বলল, সৌন্দর্যবোধ সবারই আছে। তবে তার প্রকারভেদ থাকতে পারে। আমি যে শর্মিলার কথা বলছি, তার সাথে আমার লন্ডনে পরিচয়। আমরা অক্সফোর্ডের ছাত্রী ছিলাম। কয়েক মাস আগে ফিরেছে। তার সাথে হঠাৎ একদিন দেখা। কথায় কথায় এক সময় তোমার দুটো ফটো দেখিয়ে বলল, একে সে ভীষণ ভালোবাসে। তার কথা শুনে মনে হলো, তোমার জন্যে সে প্রাণও দিতে পারে। সে সময় বলেছিল, ছুটি নিয়ে সিলেটে তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তারপর মাসখানেক আগেও চিঠি দিয়ে সেকথা জানিয়েছিল। গিয়েছিল না কি?
কথাটা বলে ফেলে নাহিদা বুঝতে পারল, কথাটা বলা ঠিক হয় নি। নাহিদ নিশ্চয় তাকে মীনমাইন্ডেড মনে করছে।
নাহিদ অবাক কণ্ঠে বলল, স্ট্রেঞ্জ! তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর, আমি কিন্তু তার কথা এই প্রথম তোমার কাছে শুনলাম। তাদের বাড়িতে ফর্মাল আলাপ ছাড়া কোনো আলাপই হয় নি। ফটো দু’টো হয়তো তার ভাইয়ার কাছ থেকে পেয়েছে। কিছুদিন আগে অফিসে একটা মেয়ে কয়েকবার ফোন করে আমার খোঁজ করেছিল। আমি তখন কয়েকদিন সিলেটের বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে সে খবর জানতে পারি। এখন মনে হচ্ছে, ঐ মেয়েটাই তাহলে ফোন করেছিল। টেবিলে যে মেসেজটা লেখা ছিল, তাতে মেয়েটার বাড়ি ময়মনসিংহ ছিল।
নাহিদা ভাবল, শর্মিলার কথাটা না তুললেই ভালো হতো। প্রসঙ্গটা এড়াবার জন্য বলল, সত্যিই কি এখানে নামায পড়বে, না এবার উঠবে?
: তুমি যখন পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে তখন চলে যাওয়াই ভালো। নচেৎ সত্যিসত্যি যদি হাজতে যেতে হয়, তাহলে কেলেঙ্কারীর শেষ থাকবে না। এই কথা বলে উঠে দাঁড়াল। তারপর তাকে তাদের বাড়ির গেটের অনতিদূরে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল।