কামিনী কাঞ্চন – ১

নাহিদ ফরেন থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে ফেরার পর সিলেটে একটা ইন্ডাস্ট্রিতে দু’বছর হলো চাকরি করছে। এখানে একটা বাংলো টাইপের বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছে। দুই বেড, একটা বাথ ও কিচেন রুম এবং বেশ খানিকটা উঠোনসহ পাঁচিলঘেরা ছিমছাম বাড়ি। কাদুর বাপ নামে একজন আধা বয়সী লোককে রান্নাবান্না, বাজার-হাট ও ঘর-দোর পরিষ্কার করার জন্য রেখেছে। কাদুর বাপ সিলেটেরই লোক। ইন্ডাস্ট্রিতে বদলিতে কুলির কাজ করত। মাসের মধ্যে পনেরো-ষোলো দিন কাজ না পেলেও প্রতিদিন গেটের কাছে অপেক্ষা করত। তার একটাই ছেলে, নাম কাদু। তাই তাকে সবাই কাদুর বাপ বলে ডাকে। কাদু বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। কাদুর বাপের কষ্ট দেখে নাহিদ তাকে নিজের কাছে রেখেছে। লোকটা খুব সৎ ও কর্মঠ। নাহিদের বাসার সব কাজকর্ম করার সাথে সাথে গার্জেনের মতো তার ভালো মন্দও লক্ষ্য রাখে।  

আজ নাহিদ কোম্পানির কাজে মাধবকুণ্ড গিয়েছিল। মাধবকুণ্ড পাখারিয়া পরগনার অন্তর্গত বড় লেখা স্টেশন থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। আদম আইল পাহাড়ে মাধব ছড়ার জলধারা থেকে এই প্রপাতের সৃষ্টি। কম করে হলেও ৪৫ মিটার উঁচু থেকে জলধারা নিচে পড়ে আনুমানিক ৪৬৪ বর্গমিটার আয়তনের যে বিশাল কুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই মাধবকুণ্ড। বারুনী স্নানের সময় এখানে বিরাট মেলা হয়ে থাকে। কাজ সারার পর জলপ্রপাত দেখে যখন নাহিদ বাসায় ফিরল তখন বেলা প্রায় আড়াইটা। জোহরের নামায পড়ে ভাত খেয়ে বারান্দায় একটা চেয়োরে বসে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল।

এমন সময় কাদুর বাপ প্লেটে আনারস নিয়ে এসে বলল, আমি খেয়ে দেখেছি, খুব মিষ্টি।

তখন আষাঢ় মাস। সিলেটে এ সময়ে আনারস খুব সস্তা হয়।

নাহিদ টক জাতীয় কোনোকিছু খেতে পারে না। তাই কাদুর বাপের কথা শুনে বলল, তবু চিনি মিশিয়ে দাও।

কাদুর বাপ চিনি এনে আনারসের উপর ছিটিয়ে দেবার পর নাহিদ খেতে শুরু করল। এমন সময় ফোন বেজে উঠতে নাহিদ তাকে ধরতে বলল।

কাদুর বাপ ফোন ধরে বলল, কে একটা মেয়ে আপনাকে চাচ্ছে।

নাহিদ হাতটা তোয়ালেতে মুছে এসে ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, আমি নাহিদ বলছি।

ওপাশের মেয়েটি বলল, আমি জাফলং থেকে সালমা বেগম বলছি। শোন, তোমার সাহেব বলছিল, তুমি নাকি দু’চার দিনের মধ্যে দিনাজপুর যাচ্ছ?

নাহিদ, সাহেবের স্ত্রী ফোন করেছে বুঝতে পেরে বলল, জি।

সালমা বেগম বললেন, এদিকে একটা ঘটনা হয়েছে। আমার মেজ বোনের মেয়ে নাহিদাকে তো তুমি আমাদের বাসায় দেখেছ। ওর শনিবার দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলে জয়েন করার ডেট। তিন চার দিন আগে ওর চাচা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে কথা আমাদের ও নাহিদার মনে ছিল না। গতকাল নাহিদা আমাদের সঙ্গে বেড়াতে চলে এসেছে। তুমি যদি কাল সকালে এখানে এসে ওকে সঙ্গে করে দিনাজপুর নিয়ে যেতে, তা হলে…বলে থেমে গেলেন।

নাহিদ চিন্তা করল, সাহেব ও তার স্ত্রী তাকে ছেলের মতো দেখেন। তাছাড়া চাকরির উত্থান-পতনও ওঁদের হাতে। যতই ব্যক্তিগত অসুবিধা থাক না কেন, ওঁদের কথামতো কাজ করাই উচিত।

উনি থেমে যেতে নাহিদ বলল, আমার কোনো অসুবিধা নেই। আপনি ফোনটা সাহেবকে একটু দিন।

সালমা বেগম বললেন, ধর, দিচ্ছি।

হাবিব সাহেব ফোন ধরে বললেন, আমার ওয়াইফের কাছে ঘটনাটা তো শুনলে, তোমার কোনো অসুবিধা আছে কিনা বল।

: জ্বি না, অসুবিধা কীসের।

হাবিব সাহেব বললেন, এর মধ্যে তোমাকে আর একটু ঝামেলা পোহাতে হবে। নাহিদার দুদিন পরে গেলেও চলত; কিন্তু ও জিদ ধরেছে, কক্সবাজার যাবে। সেখানে ওর ছোট খালা আছে। তাদের বাড়িতে দু’দিন বেড়াবে। মেয়েটা লন্ডনে মানুষ হয়েছে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে কতবার যাতায়াত করেছে। এখন বলছে, বঙ্গোপসাগর দেখবে।

নাহিদ বলল, এটাকে ঝামেলা বলছেন কেন? আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই।

 : তাহলে তুমি আজই অফিসের কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে কাল সকালে এখানে চলে এস।

১০।

ও জি আসব। তারপর হাবিব সাহেব ফোন রাখার পর নাহিদও রেখে দিল।

সন্ধ্যার দিকে বেশ গুমোট ছিল। রাত দশটার দিকে ভারী একপশলা বৃষ্টি হলো। ঠাণ্ডা লাগতে নাহিদ চাদর গায়ে দিয়ে শুয়েছিল। ফজরের আজানের সময় উঠে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ব্রিফকেসে ভরে নিল। তারপর নামায পড়ে কাদুর বাপকে হাঁক দিয়ে বলল, চাচা নাস্তা হয়েছে?

নাহিদ ঘুমোবার আগে কাদুর বাপকে তার ট্যুরের কথা বলে ভোরে নাস্তা তৈরি রাখতে বলেছিল। সেইজন্য সেও নাস্তা তৈরি করে নামায পড়ে অপেক্ষা করছিল। ডাক শুনে নিয়ে এল।

নাহিদ খেতে বসল।

কাদুর বাপ ব্রিফকেসটা গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে বলল, আজকাল রাস্তায় খুব বেশি অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, সাবধানে গাড়ি চালাবেন।

নাহিদ কিছু না বলে খেতে লাগল। কাদুর বাপের কাছে এই কথা আজ দু’বছর যাবৎ শুনে আসছে। মাঝে মাঝে তার প্রতি নাহিদের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। সত্যিই লোকটা আপনজনের মতো সবদিকে লক্ষ্য রাখে।

কাল বিকেলেই গাড়ি চেকআপ করিয়ে তেল ভরে রেখেছিল। গাড়িতে উঠে কাদুর বাপের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে স্টার্ট দিয়ে যখন রওয়ানা দিল তখনও সূর্য উঠতে আধঘণ্টা দেরি।  

হেড লাইট জ্বেলে নাহিদ গাড়ি চালাতে লাগল। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে স্পিডে চালাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, গাড়িটা বেশ পুরোনো। তার উপর চাকার অবস্থাও ততটা ভালো নয়। হঠাৎ যদি পাংচার হয়ে যায় অথবা ইঞ্জিন বিগড়ে যায়, তাহলে বিপদের সীমা থাকবে না। চাকা একটা অবশ্য আছে, পাল্টানো যাবে; কিন্তু ইঞ্জিন বিগড়ালেই বিপদ। এতখানি পথ একজন যুবতি মেয়েকে নিয়ে এরকম গাড়িতে যেতে হবে ভেবে বেশ নার্ভাস ফিল করল।

বছর খানেক আগের থেকে সাহেব তাকে একটা নতুন গাড়ি কেনার জন্য বলছেন। গাড়িটা পুরোনো হলেও কন্ডিশান ভালো আছে বলে নাহিদ এখনও কিনে নি।

নাহিদ জলপ্রপাত দেখতে এর আগে দু’বার জাফলং এসেছে। পথ-ঘাট চেনা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে তরতর করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে একটা চিন্তা তার মনে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল, নাহিদাকে একবার মাত্র দেখলেও মনে হয়েছে খুব আধুনিকা ও চৌকস মেয়ে। এত দীর্ঘ পথ গাড়িতে কী রকম ব্যবহার করবে কি জানি।

হাবিব সাহেব বাংলোর বারান্দায় বসে সবাইকে নিয়ে নাস্তা খাচ্ছিলেন। একটা গাড়ি এসে থামতে সকলে সেদিকে তাকাল।

নাহিদকে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসতে দেখে হাবিব সাহেব বললেন, তুমি এত সকালে এসে পড়বে ভাবতেই পারছি না। এস বস, আমাদের সঙ্গে নাস্তা খেয়ে নাও।

ওঁরা নাস্তা খাচ্ছিলেন বলে নাহিদ সালাম দিল না। নাস্তার পর হাবিব সাহেব নাহিদাকে বললেন, যাও মা, তৈরি হয়ে এস।

নাহিদা সব কিছু আগেই সুটকেসে গুছিয়ে রেখেছিল, শুধু পরনের কাপড়টা পাল্টে নেবার জন্য ভিতরে গেল।

কেয়ার টেকার আজিজ নাহিদার সুটকেস নিয়ে এলে নাহিদ গাড়ির বুট খুলে দিল।

একটু পরে নাহিদা এসে খালা-খালুকে কদমবুছি করে নিজেই গাড়ির সামনের দরজা খুলে উঠে বসল।

সালমা বেগম নাহিদকে বললেন, একটু সাবধানে চালিও বাবা, বাপ-মা মরা মেয়ে। তারপর নাহিদার কাছে এগিয়ে এসে তার মাথায় ও মুখে হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, তুই যা দুষ্ট মেয়ে, পথে নাহিদের সঙ্গে দুষ্টুমি করবি না কিন্তু।

নাহিদা কিছু না বলে দরজা বন্ধ করে ঠিকঠাক হয়ে বসল।

নাহিদা ড্রাইভিং সিটে বসার পর হাবিব সাহেব তাকে উদ্দেশ করে বললেন, দিনাজপুর যাওয়ার পথে তোমরা ঢাকায় এক রাত থেকে পরের দিন রওয়ানা দিও।

নাহিদ সালাম বিনিময় করে গাড়ি ছেড়ে দিল। বাংলোর গেট পার হয়ে রাস্তায় এসে স্পিড বাড়িয়ে দিল।

রাতে এদিকেও বৃষ্টি হয়েছে। তবে সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার। চারদিকের গাছপালা সোনালি রোদে ঝলমল করছে। এদিকটা শুধু পাহাড় আর। পাহাড়। পাহাড়ের নয়ন ভুলানো দৃশ্য দেখার মতো। গাড়ির জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস তাদের চোখে মুখে লাগছে। কয়েকদিন খুব গরম পড়েছিল। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় কেমন সোঁদা সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে। নাহিদ আড়চোখে দেখল, সঙ্গিনীর চুল বাতাসে গালে ও কপালে ওড়াউড়ি করছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে।  

দেখতে দেখতে তারা শ্রীমঙ্গল এসে পড়ল। এদিকে রাস্তার দু’পাশে বড় বড় চা-বাগান। চা-বাগানে উপজাতীয় মেয়েদের চা-পাতা সংগ্রহের দৃশ্যও কম মনোরম নয়।

এতক্ষণ কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে নি। গাড়ি যখন দু’পাশের পাহাড় জঙ্গলের ভিতর থেকে যাচ্ছিল তখন নাহিদা বলল, এসব জায়গায় বাঘ বা অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী নেই?

নাহিদ বলল, জানি না। তবে মনে হয় নেই। থাকলে সে রকম কিছু শুনতাম।

: আচ্ছা, এসব জায়গায় তো ডাকাতদের উপদ্রব হবার কথা, সে রকম কিছু হয় নাকি?

: না, তাও শুনি নি। বরং লোকালয়ের কাছাকাছি বাস ডাকাতি হতে শুনেছি। এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না।  

কুমিল্লা টাউন পার হয়ে চৌদ্দগ্রামে ডলফিন বাস স্ট্যান্ডে হোটেলের সামনে গাড়ি পার্ক করে নাহিদ বলল, এখানে লাঞ্চ সেরে নিই আসুন। চিটাগাং পৌঁছাতে লাঞ্চের সময় থাকবে না। পথে আর কোনো ভালো হোটেলও নেই। তারপর গাড়ি থেকে নেমে বলল, আমি মসজিদ থেকে যোহরের নামায পড়ে আসি। আপনি ততক্ষণ ভিতরে গিয়ে খেয়ে নিন।

: আপনি খাবেন না?

: নামাজ পড়ে এসে খাব। তারপর গাড়ির দরজা জানালা লক করে মসজিদের দিকে চলে গেল।

নাহিদার সঙ্গে নাহিদের আগে তেমন কোনো আলাপ হয় নি। কী একটা ফেস্টিভালে সাহেব নাহিদকে দাওয়াত করেছিলেন। সেদিন সালমা বেগম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নাহিদ কয়েক সেকেন্ড তার আপাদমস্তক দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল। চেহারা দেখবার মতো কিছু নয়। শরীরটা বেশ মোটা। চোখ মুখ যে খুব একটা সুন্দর, তাও নয়। রং ফর্সা-কালোর মাঝামাঝি। তবে দেখতে একেবারে খারাপ না। অতিথিদের অনেকের সঙ্গে সাহেবী টোনে ইংরেজিতে কথা বলতে শুনে নাহিদের মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই বিদেশে লেখাপড়া করেছে। এক ফাঁকে নাহিদা বলেছিল, খালা-খালুর কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি, একদিন আসবেন গল্প করা যাবে। নাহিদও সাহেবের কাছে নহিদার অনেক গুণাগুণ শুনেছিল। নিজের অস্তিত্বের কথা এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার সঙ্গে দেখা করে নি।

নাহিদ নামাজ পড়তে চলে যাবার পর নাহিদা হোটেলে না ঢুকে রাস্তার ধারে একটা আম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে ভাবল, ঐ ঢিলে প্যান্ট ও লম্বাঝুল পাঞ্জাবি পরা গোবেচারা ছেলেটার নাম নাহিদ, আর আমার নাম নাহিদা, দারুণ ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার। কথাটা ভেবে তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। খালা খালুর মুখে শুনছি, ছেলেটা খুব সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ। নামাযও পড়ে দেখছি। যাই হোক, ওকে ওর নামের অর্থ জিজ্ঞেস করতে হবে।

নাহিদ ফিরে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আপনি খেয়েছেন?

: না, চলুন এক সঙ্গে খাব।

খাওয়ার পর গাড়িতে উঠে নাহিদ পকেট থেকে মসলার ডিবে বের করে নিজে খেয়ে নাহিদার দিকে বড়িয়ে বলল, খাবেন?

নাহিদা মসলা গালে দিয়ে ডিবেটা ফেরত দেবার সময় বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনার নামের অর্থটা বলবেন?

নাহিদ বলল, আমার পুরো নাম মোহাম্মদ নাহিদ তকী। যার অর্থ হলো প্রশংসিত উন্নত ধার্মিক।

তারপর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় উঠে স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনার নামের আগেপিছে কিছু নিশ্চয় আছে?  

ও আমার মা নাম রেখেছিলেন, নাহিদা গওহর। এরকম নাম যে মা কেন রেখেছিলেন, আজও বুঝতে পারি নি।

: অর্থটা জানলে ঠিকই বুঝতে পারতেন।

: তাই নাকি? তাহলে অর্থটা বলুন তো।

: উন্নত মুক্তা। অর্থটা বলে নাহিদ তার মুখের দিকে তাকাতে গেলে চোখে চোখ পড়ে গেল। দেখল, চোখে বেশ রাগের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

নাহিদ দৃষ্টি রাস্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমি মিথ্যাকে ঘৃণা করি।

নাহিদা রাগ সামলে নিয়ে সংযতস্বরে বলল, কক্সবাজার এখনও কতদূর?

: অনেক দূর। আমরা সবেমাত্র চট্টগ্রামে ঢুকলাম। এই জায়গার নাম কর্নেলহাট। এরপর বরইহাট, মীরসরাই, সীতাকুণ্ডু, নিজামপুর, বারো আউলিয়া, ফৌজদারহাট, পাহাড়তলী, তারপর চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম টাউন থেকে কক্সবাজার প্রায় দেড়শো কিলোমিটার।

: আমরা কখন কক্সবাজার পৌঁছাতে পারব বলে মনে করেন?

: গাড়ি যদি ডিস্টার্ব না করে, তাহলে ইনশাআল্লাহ সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে পারব।

সীতাকুণ্ডুর উপর থেকে আসার সময় নাহিদা পূর্ব দিকের পাহাড় দেখিয়ে বলল, পাহাড়ের মাথায় মন্দিরের মতো যেন দেখা যাচ্ছে।

: ঐ পাহাড়টার নাম সীতাকুণ্ডু। লোক মুখে শোনা যায় রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে এখানে কিছুদিন বনবাস যাপন করেছিলেন। এটা হিন্দুদের তীর্থস্থান।

: এসব আপনি বিশ্বাস করেন?

: একই প্রশ্ন আমি যদি আপনাকে করি?

নাহিদা একটু রেগে উঠে বলল, কেউ কোনো প্রশ্ন করলে, তাকেই সেই প্রশ্ন করা অভদ্রতা।

: তা হয়তো ঠিক, তবে আমি মনে করি ভিন্ন ধর্মের কোনো অজানা ব্যাপার নিয়ে এরকম প্রশ্ন কাউকে করা বোধহয় উচিত নয়।

নাহিদা আর কোনো কথা না বলে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইল।

নিজামপুর আসার পর গাড়ির পিছনের একটা চাকা ভীষণ শব্দ করে ব্রাস্ট হলো।

নাহিদা চমকে উঠে গাড়ির জানালা ধরে টাল সামলাল।

নাহিদ রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে বলল, প্রথম থেকে এরকম কিছু একটা আশা করছিলাম। আপনি নেমে একটু দাঁড়ান, আমি চাকাটা পাল্টে নিই। চাকা পাল্টানো হয়ে যাবার পর নাহিদ বলল, চলুন চা খাওয়া যাক।

নাহিদার চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল। কোনো কথা না বলে তাকে অনুস্বরণ করল।

চা খেয়ে গাড়িতে উঠার পর আর কেউ কোনো কথা বলল না। একেবারে লোহাগাড়ায় এসে মসজিদের সামনে গাড়ি থামিয়ে নাহিদ বলল, আপনি বসুন, আমি আসরের নামাযটা পড়ে নিই।

নামায পড়ে নাহিদ গাড়িতে উঠে স্পিড বাড়িয়ে দিল।

নাহিদা বলল, এত স্পিডে যে গাড়ি চালাচ্ছেন, ভয় করছে না? কিছু একটা হলে তখন কি হবে?

: ভাগ্যে থাকলে আস্তে চালালেও হবে। আপনি কি স্পিডকে ভয় পান?

: না। আপনার গাড়ির কন্ডিশান দেখে বললাম।

চকরিয়ার সামান্য উত্তরে মাতামুহুরী নদীর ব্রিজের উপর হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে গাড়িটা আস্তে আস্তে যেতে যেতে এক সময় দাঁড়িয়ে পড়ল।

নাহিদা রেগে গেলেও হেসে ফেলে বলল, কি হল?

: মনে হচ্ছে ইঞ্জিন বিগড়েছে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে ইঞ্জিন পরীক্ষা করে কোনো দোষ ধরতে পারল না।

নাহিদা তা বুঝতে পেরে বলল, গাড়ি চালান অথচ ইঞ্জিনের দোষ ধরতে পারেন না, এ কেমন কথা।

 : আপনি পারেন?

: আমি তো আর সব সময় গাড়ি চালাই না।

: আপনি স্টিয়ারিং- এ বসুন। সামনেই চকরিয়া টাউন। ঠেলে নিয়ে যেতে হবে।

নাহিদ গাড়িটা ঠেলে চকরিয়ায় একটা গ্যারেজের সামনে নিয়ে এসে তাদেরকে সারাতে বলল। সেই সঙ্গে চাকাটাও সারাতে বলে নাহিদাকে বলল, আপনি গাড়িতেই বসে থাকুন। আমি মাগরিবের নামাযটা পড়ে আসি। তারপর কিছু নাস্তা খাওয়া যাবে। কথা শেষ করে নামায পড়তে চলে গেল।

ফিরে এসে নাহিদাকে বলল, চলুন নাস্তা খেয়ে আসি।

নাস্তা খেয়ে এসে দু’জন মেকানিক্সকে ইঞ্জিনে কাজ করতে দেখে নাহিদ জিজ্ঞেস করল, আর কতক্ষণ সময় লাগবে?

তাদের একজন বলল, কোনো দোষ ধরতে পারছি না, আরও সময় লাগবে।

: কিন্ত আমরা তো কক্সবাজার যাব।

: আজ এখানে থেকে যান। কাল ভোরে যাবেন। গাড়ি কখন ঠিক হবে তার নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া বেশি রাতে যাওয়া ঠিক হবে না।

নাহিদ নাহিদার দিকে চেয়ে বলল, শুনলেন তো মেকানিক্সের কথা? রাতটা এখানে কাটানো যাক, কি বলেন?

নাহিদা জিজ্ঞেস করল, কক্সবাজার এখান থেকে কত দূর?

: প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার।

: ছোট খালাকে একটা ফোন করা দরকার। বড় খালা তাকে ফোন করে জানিয়েছে, আমরা আসছি।

: আগে হোটেলে চলুন, তারপর ফোন করবেন?

চকরিয়ায় যে দুতিনটে আবাসিক হোটেল আছে, তার মধ্যে “হোটেল কাশফা” সব থেকে ভালো। ওরা পাশাপাশি দু’টো রুম নিল।

নাহিদ যখন রুম বুক করছিল তখন নাহিদা ম্যানেজারকে বলে ছোট খালাকে ফোন করে ঘটনাটা জানাল।  

রাতে হোটেল বয়েরা তাদের জন্য যে ভাত তরকারি নিয়ে এল, তা তারা মোটেই খেতে পারল না। একে নিম্নমানের আতপ চালের ভাত, তার উপর তরকারিতে ভীষণ ঝাল। নাহিদা দু’এক লোকমা গালে দিয়ে শু শু করতে করতে পানি খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফেলল। নাহিদ অল্পকিছু খেয়ে উঠে পড়ল। তারপর নিচে গিয়ে ভালো দেখে ছানার সন্দেশ নিয়ে এসে দু’জনে খেল।

রাতের মধ্যে মেকানিক্সরা গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল। সকালে নাস্তা খেয়ে তারা রওয়ানা দিল।

নাহিদার ছোট খালু রহমান সাহেব কক্সবাজার সোনালি ব্যাংকের ম্যানেজার। ওখানে বাড়ি করেছেন। তাদের দু’ছেলে ও এক মেয়ে। সবাই স্কুলে পড়ে।

ওরা সাড়ে নটার সময় কক্সবাজার পৌঁছে প্রথমে ব্যাংকে গেল। রহমান সাহেব আলাপ পরিচয়ের পর একজন পিয়নকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।

নাহিদার ছোট খালা সাহেদা বেগম। নাহিদাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোকে সেই কত আগে দেখেছিলাম। বড় আপা ফোন করে যখন বলল, তুই আসছিস তখন যা খুশি লাগছিল না। তারপর নাহিদকে বললেন, তোমার কথাও বড় আপা জানিয়েছে। তুমি আমাদের এখানেই থাকবে।

নাহিদ বলল, না-না, আমি হোটেলে থাকব। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি?

সাহেদা বেগম বললেন, ওমা সে কী? ছেলের মতো দুটো দিন থাকবে, তাতে আবার ঝামেলার কী আছে। তোমাকে ছেলে মনে করেই তুমি করে বলছি। তাছাড়া তুমি নাহিদার জন্য এত কষ্ট করছ, আর আমরা তোমাকে হোটেলে থাকতে দেব, একথা ভাবলে কী করে?

নাহিদা বলল, হ্যাঁ খালা, তুমি ঠিক কথাই বলেছ।

নাহিদ আর আপত্তি করতে পারল না।

সাহেদা বেগম কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, মেহমানকে গেস্টরুমে নিয়ে যাও।

দু’দিন কক্সবাজারে থেকে নাহিদা খালাতো ভাইবোনদের নিয়ে সমুদ্র সৈকতে গোসল করল, সাঁতার কাটল, সূর্যাস্ত দেখল, বৌদ্ধমঠ দেখল। একদিন হিমছড়ি গিয়ে ঝর্না দেখে এল।

তিন দিনের দিন তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দিনাজপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।

টেকনাফ যাবার রাস্তার মোড়ে এসে সাইনবোর্ড দেখে নাহিদা বলল, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, সময়ের অভাবে দেখা হলো না।

নাহিদ বলল, আমারও দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ঐ একই কারণে হয়ে ওঠে নি। কোনো এক লম্বা ছুটিতে সিলেটে আসবেন। ওখানের অনেক কিছু দেখার আছে। সেসব দেখে তারপর টেকনাফে ও সেন্টমার্টিনে বেড়াতে যাওয়া যাবে।  

নাহিদা এই কদিন নাহিদকে খুব মার্ক করেছে। একটি যুবতি মেয়ে যে তার সঙ্গে সব সময় রয়েছে, সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রয়োজন ছাড়া তার সাথে কোনো কথা বলে না। কথা প্রসঙ্গে সে কতবার হেসেছে; কিন্তু তাকে একবারও হাসতে দেখে নি। নাহিদা ভেবেছে, ছেলেটা যেন কেমন? দু’জন যুবক যুবতি এক সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে তাদের মধ্যে যে সখ্যতা গড়ে ওঠে, সেরকম কিছু হয় নি। কাছাকাছি থাকলেও নাহিদার মনে হয়েছে, তাকে এড়িয়ে থাকছে। তাই ভেবেছিল, ছেলেটা হয়তো সংস্কারমুক্ত নয়। বড় খালা বলেছিল, ছেলেটা শিক্ষিত ও খুব ভদ্র ঘরের। কিন্তু কতটা শিক্ষিত বলে নি।

এখন তার মুখে বেড়াতে যাবার কথা শুনে বলল, কিন্তু আপনি যা গম্ভীর ছেলে, আপনার সঙ্গে বেড়িয়ে আনন্দ পাওয়া যাবে না।

নাহিদ একবার তার মুখের দিকে চেয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি প্রগলভতা বুঝি পছন্দ করেন?

: করি, তবে বেশি নয়।

: আমি না হয় গম্ভীর ধরনের ছেলে, কিন্তু আপনি তো তা নন, তাহলে আপনি চুপ করে থাকেন কেন?

: ভেবেছি আপনি হয়তো বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না।

: বেশি কোনো জিনিসটাই ভালো নয়। সব জিনিসের মধ্যম ভালো। এটা হাদিসের কথা।

: আপনি বুঝি হাদিস কালাম অনেক জানেন?

: অনেক না জানলেও কিছু কিছু জানি।

: আপনার কে কে আছেন?

: বাবা-মা, দু’ভাই ও একবোন। আমিই বড়, আপনার?

: আমার বাবা, মা, ভাই বোন কেউ নেই। আমাকে ছোট রেখে মা মারা যান। মা মারা যাবার পর বাবা কাউকে কিছু না বলে লন্ডন চলে যান। সেখানে চাকরি করতেন। আমি চাচা-চাচির কাছে মানুষ হয়েছি। দশ বছর বয়সের সময় বাবা আমাকে নিয়ে লন্ডন চলে যান। সেইখানেই আমি লেখাপড়া করি। বাবা আর বিয়ে করেন নি। দু’এক বছর পর পর আমাকে নিয়ে দেশে বেড়াতে আসতেন। গত বছর বাবা বেড়াতে এসে মারা গেছেন। সেই থেকে চাচা-চাচির কাছে আছি।

: চাকরি করতে চাচ্ছেন কেন? আপনার চাচা-চাচি আপত্তি করেন নি?

: করেন নি আবার, ওঁরা তো আমার বিয়ে দেবার জন্য খুব চেষ্টা করেছেন।

: সেটাই তো ভালো হতো।

: তা হয়তো হতো, কিন্তু… বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, বাদ দিন ওসব কথা।

নাহিদ আর কিছু না বলে গাড়ি চালাতে লাগল, ঘনঘন স্পিড ব্রেকার থাকায় স্পিড বাড়ানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম আসার পর বলল, চা খেতে ইচ্ছে করছে।

নাহিদা বলল, আমারও। একটা টি স্টলে চা খেয়ে তারা গাড়িতে উঠল।

চৌদ্দগ্রামে এসে নাহিদ বলল, লাঞ্চ এখানে খাবেন, না ঢাকায় খাবেন?

: ঢাকায়।

ওরা যখন যাত্রাবাড়ি এসে পৌঁছল তাখন বেলা দু’টো, নাহিদ বলল, প্রথমে একটা হোটেলে উঠব, তারপর লাঞ্চ করব।

: নাহিদা কিছু বলল না।

নাহিদ অভিসার সিনেমা হল পার হয়ে বাঁ দিকে অল্প একটু দূরে হোটেল ইন্টারন্যাশনালের গেট দিয়ে ঢুকে গাড়ি পার্ক করল, তারপর দু’টো রুম ভাড়া নিয়ে নাহিদাকে বলল, আপনি গোসল করে নিন, আমিও তাই।

লাঞ্চের পর নাহিদ বলল, আপনি বিশ্রাম নিন, আমি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাব। ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করবেন না।

নাহিদ চারটের সময় হেঁটেল থেকে বেরিয়ে গেল।

নাহিদার অনেক দিনের অভ্যাস কি দিনে, কি রাতে ঘুমোবার আগে কিছুক্ষণ ম্যাগাজিন পড়া। আজ লাঞ্চের পর ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, নাহিদের সঙ্গে সে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেছে। একসময় নাহিদা ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে বেশ একটু দূরে চলে গিয়েছিল। ফেরার সময় দেখতে পেল একটা অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে নাহিদের সাথে সাথে হেসে কথা বলছে, কাছে এসে দেখল, মেয়েটা নেই। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। মেয়েটির কথা নাহিদকে জিজ্ঞেস করতে যাবে। এমন সময় কারো কলকলানির শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। তখনও শব্দটা বারান্দায় হচ্ছে শুনে দরজা খুলে কয়েকজনের সঙ্গে মাথায় রুমাল বাঁধা ও গায়ে ওড়না জড়ানো শর্মিলাকে দেখে অবাক হলেও উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, আরে শর্মিলা তুই?

শর্মিলাও নাহিদাকে দেখে একই কণ্ঠে বলল, আরে নাহিদা তুই? তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস বল?

: ভালো, কিন্তু তুই ঢাকায় এলি কবে?

শর্মিলা সঙ্গীদের বলল, তোরা রুমে যা, আমি আসছি। তারপর নাহিদাকে ঠেলে তার রুমে ঢুকে বলল, লন্ডন থেকে ফিরেছি মাস ছয়েক আগে। এখানে একটা চাকরির অফার পেয়ে চলে এলাম। তাছাড়া বাবা ও ভাইয়েরা সবাই চলে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল।

: তুই চাকরি করবি কেন? বিয়েটিয়ে করবি না? না সারাজীবন ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খেয়ে বেড়াবি?

শর্মিলা হেসে উঠে বলল, ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খেয়ে কী যে মজা, তা যদি তুই বুঝতিস, তাহলে এই কথা বলতিস না।

 : সত্যি তুই যে কী, ভেবে পাই নি। তোর চেহারা বোম্বের ফিল্ম হিরোইন শর্মিলা ঠাকুরের মতো। তোকে না পেয়ে সুমন সুইসাইড করল, লন্ডনে কত ছেলে যে তোকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিল, সে কথা আমার চেয়ে তুই নিজেই বেশি জানিস। তা কোথায় চাকরি করছিস?  

ও রাজশাহীতে একটা বিদেশি ফার্মে। কয়েকদিনের ছুটিতে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে এসেছিলাম। কাল সকালের ট্রেনে চলে যাব। এখন আমরা এক বান্ধবীর চাচার বাসায় যাব। সেখান থেকে স্টেশনে এসে ট্রেনে উঠব। তা তুই এখানে একা, না আর কেউ আছেন?

: আছেন। তিনি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন।

: তিনিটা কে বলবি তো?

: বড় খালুর অফিসের একটা ছেলে।

: তার সঙ্গে তুই এখানে কেন? কিরে কিছু ইয়ে টিয়ে চলছে না কি?

: নাহিদা হেসে উঠে বলল, আরে নারে না। তোর মতো তো আমি রূপসী নই। এই মোটা ধুমসির দিকে কে নজর দিবে বল। দিনাজপুরে আমাদের বাড়ির কাছেই টেক্সটাইল মিলে আমি একটা চাকরি পেয়েছি। শনিবার জয়েনিং ডেট। ভদ্রলোক অফিসের কাজে ওখানে যাচ্ছিলেন। তাই বড় খালুর কথামতো আমাকে লিফট দিচ্ছেন।

: তুই চাকরি করবি শুনে খুশি হলাম। তা বিয়ের কথা ভাবিস নি?

: তোর কথার উত্তর দিচ্ছি, তার আগে বল কী খাবি?

: কিছু না। তবে চা আনাতে পারিস।

নাহিদা কলিং বেল বাজাতে একটা হোটেল বয় এল। তাকে দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে শর্মিলাকে বলল, তোর পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, তুই শর্মিলা ঠাকুরের রূপ নিয়ে মনের মানুষ পেয়েছিস। মুনমুনের মতো ধুমসি মেয়ের দিকে কে তাকাবে বল। আমার কথা বাদ দে। সত্যি করে বল তো বিয়ে করেছিস নাকি?

শর্মিলা হেসে উঠে বলল, না, তবে এবার মনের মানুষ পেয়েছি। জানিস ছেলেটা না সবদিক থেকে জিনিয়াস, গাজীপুরে বাড়ি। উচ্চ শিক্ষিত। সিলেটে একটা ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো পোস্টে আছে। ফুটবল ও ক্রিকেট দুটোতেই নাম করা প্লেয়ার। জুডো ক্যারাতে অদ্বিতীয়। আর খুব ধার্মিক। সাহিত্যের উপরও বেশ ঝোঁক। মাঝে মাঝে কাগজে লেখা দেয়। আমার চাচা তার একমাত্র মেয়ের জন্য তাকে জামাই করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি মেয়ে জামাইয়ের নামে তার সমস্ত সম্পত্তি ও ব্যবসাপত্র লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাচার মেয়েকে দেখে সবার সামনেই ছেলেটা বলে ফেলল, আমি ধন সম্পত্তির প্রত্যাশী নই, ধার্মিক স্ত্রীর প্রত্যাশী। আপনারা মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন ঠিক, কিন্তু ধর্মীয় অনুশীলনে যেমন মানুষ করেন নি, তেমনি সেই সব শিক্ষাও দেন নি। ধন সম্পত্তি মানুষকে কিছুটা সুখ দিতে পারলেও কখনো শান্তি দিতে পারে না। আমি সুখের চেয়ে শান্তির প্রত্যাশী। তাছাড়া আপনার মেয়েকে আমি ধর্মীয় অনুশীলনে চালাতে চাইলে, আমাদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে। আমরা জীবনে কেউ কখনো শান্তির মুখ দেখতে পাব না। ওকে চাচার খুব পছন্দ ছিল। তারপরও অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চাচি ও তার মেয়ে ওকে গোঁড়া ও আনকালচার্ড বলে অমত করল। কিছুদিন আগে কী কাজে যেন ময়মনসিংহ এসেছিল। সে সময় আমাদের বাড়িতে দু’দিন ছিল। ভাইয়া তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, বলে আজকের পৃথিবীতে এত ভালো ও ব্রিলিয়ান্ট ছেলে হয় না। অত্যন্ত ধার্মিক কিন্তু গোড়া নন। ভাবছি সিলেটে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করব। সিলেটের চা বাগান ও প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর। ওর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সেইসব দেখব। জাফলং এর জলপ্রপাত দেখতেও যাব। কিন্তু একদিনের স্বল্প আলাপী লোকের কাছে যেতে ভীষণ লজ্জা করে, তাই এতদিন যাই নি। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। সে কথা আমি জানতাম না। লন্ডন থেকে আসার পর হঠাৎ দেখি আমাদের লনে দাঁড়িয়ে দু’বন্ধুতে একে অপরের ফটো তুলছে। আমাকে আসতে দেখে বড় ভাইয়া বলল, এই শর্মিলা এদিকে আয়, আমার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সেই একদিনই যা ওর সঙ্গে অল্প দু’চারটে কথা হয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর দেখা হয় নি। চাচাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের কথা লন্ডনে থাকতেই বড় ভাইয়া জানিয়েছিল। দেশে ফিরার পর বড় ভাইয়া যখন ওর সঙ্গে পরিচয় করাল তখন বড় ভাইয়ার মনের ইচ্ছা বুঝতে পারলাম। সেইদিন অল্প একটু আলাপ হয়েছিল। তাতেই আমার মন বলে উঠল, এই লোকই তোর মনের মানুষ। তারপর একদিন বড় ভাইয়া বন্ধুর গুণগান করে আমার হাতে দুটো ছবি দিয়ে বলল, তোর পছন্দ হলে আমাকে জানাবি। সেই থেকে আমি ওর জন্য পাগল হয়ে আছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *