০৮.
শনিবার সওয়া আটটা নাগাদ উনি ওঁর স্টাডি-রুমে এসে বসলেন। ঐ নাছোড়বান্দা ছিনেজোঁকটির সঙ্গে একাই মোকাবিলা করতে হবে। দ্বৈরথ সমরে। তার অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্র, শিষ্য, পাঠক-পাঠিকা। কিন্তু কারও কাছে সাহায্য চাইবার কোনো উপায় নেই। একদিকে ঐ মাস্তান, উদ্ধত যুবক, তার সঙ্গীসাথী, তার আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি-ক্ষুর অ্যাসিড বাল্ব, পেটোয়া পুলিস, অন্য দিকে প্রৌঢ় একজন পণ্ডিত। ল্যাবরেটরি আর লাইব্রেরির চৌহদ্দিতে জীবনটা যিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন নির্বিবাদে। তাঁর হাতিয়ার তাঁর শিক্ষা, তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর সারাজীবনে হার-না-মানার স্ট্যামিনা! ভয় পেলে চলবে না, ভয় তিনি পাননি। দ্বৈরথ সমরে অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত বৃদ্ধ মানুষটি।
স্টাডিরুম ভিতর থেকে বন্ধ। পাশের ঘরে ধর্মেন্দ্র না শশী কাপুর কে যেন ভিলেনকে ক্রমাগত টিশম্-টিশম্ কিলিয়ে চলেছে। টি. ভি.-তে। প্রফেসর তালুকদারও ঐভাবে মাস্তানকে ঠ্যাঙাতে পারেন, যদি ভিলেনের ঘুসিগুলো ওঁর হয়ে খায় ওঁর ডামি। না হলেও পারেন, যদি নেপথ্য নাট্যকারের তাই নির্দেশ থাকে। বৃদ্ধ বলে তিনি লড়তে ভয় পাবেন না। ও-ঘরে প্রণতি আর রামু সেই লড়াই দেখতে বুঁদ। ওরা জানে না, ঠিক পাশের ঘরে এই নিরস্ত্র বৃদ্ধ এক রিভলভারধারীর সঙ্গে একইভাবে মোকাবিলার তাল ভাঁজছেন। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় রিঙিং টোন শুরু হতেই তুলে নিয়ে তার কথামুখে’ বললেন : তালুকদার।
–নমস্তে! রোপেয়ার ইন্তেজাম হইয়েসে স্যার?–কী বিনীত মোলায়েম কাকুতি!
–না!
–না! কেনো! তিন-সেট পিকচার আর নিগেটিভ আপনি খরিদ করবেন না?
–করব। কিন্তু…
–আ! সমঝলম! ভাও লিয়ে দরাদরি করবার হিঞ্ছা হইয়াসে?
–না! দরাদরি নয়। আমি জানতে চাইছি কেন তুমি প্রিন্সিপাল-সাহেবকে ফোন করেছিলে? জগদীশকে কেন বলেছ…
–আহাহা! দিমাগ খারাপ করছেন কেন প্রফেসর-সাব? আসল কথা তো কিছু বলি নাই প্রফেসর-স্যার? আমি কি ওঁদের বলেছি প্রফেসর তালুকদার-সাহাব এক ছুকরির সঙ্গে লেংটা-খেলা খেলিয়েসেন? আপন গড! সি-কথা কুছু বলি নাই। বেহুদ্দো দিমাগ কেনো খারাপ করছেন, স্যার? ছবি আর নেগেটিভ কিনে লিন, ব্যস্। লেঠা চুকিয়ে যাক। ই-সব নোংরা ঝামেলা হমার বুঢ়া লাগে।
–তার আগে ঐ মেয়েটির সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। টাকার প্যাকেটটা আমি শুধু তার হাতেই দেব। অন্য কাউকে নয়।
–তা তো হবে না, স্যার। সি ইখানে না আছে। তাকে কী দরকার?
–একমাত্র তাকেই আমি দেখলে চিনতে পারব।
–লেকিন সি তো কলকাত্তামে না-আছে। পাকিট হামাকেই দিতে হবে। আমি আইডেন্টিটি দেখিয়ে তবে লিব।
–কী আইডেন্টিটি?
–তিন সেট পিকচার ঔর নিগেটিভ।
–সে সব আমি চাই না।
-–চান না, ওয়াপস লিবেন না। লেকিন কেন?
–তুমি তো দশ কপি করে প্রিন্ট বানিয়ে রেখে ওগুলো আমাকে ফেরত দিতে পার। আমি তোমাকে টাকাটা দিলেই তুমি আবার নতুন করে টাকা চাইতে পার। ঠেকাচ্ছে কে?
–‘আপন গড’ স্যার! সিরেফ তিন সেট বানিয়েসি। আপন মাই অনার!
প্রফেসর তালুকদার নীরবে অপেক্ষা করেন।
–কী হল স্যার? কুছু তো বোলেন?
–আমি কী বলব, মাস্তান? তুমি বলছ ‘আপন গড’, ‘আপন মাই অনার’-এ ক্ষেত্রে আমি কী বলতে পারি? তোমার মতো অনারেবল…
–অ! তা আপনি কী চাইছেন?
–সেই মেয়েটি যদি টাকা নিতে না পারে তবে তোমাকেই আমি প্যাকেটটা দেব, তবে স্ট্যাম্পড রসিদ নিয়ে।
–কী নিয়ে? রিসিট?
–হ্যাঁ, তাই। রসিদ। রিসিট!
–আপনি কি দিল্লাগি শুরু করলেন স্যার? ব্ল্যাকমেলিং-এর রুপেয় কেউ কখনো রসিদ দিয়ে নেয়?
–তা তো আমি জানি না। আমার জানার কথা নয়। এই জীবনে কখনো ব্ল্যাকমেলিঙের টাকা নিইওনি, দিইওনি। তবে ঐ আমার শর্ত। আমি একটা কাগজে লিখে নিয়ে যাব—”পত্রবাহকের কাছে ব্ল্যাকমেলিং বাবদ পঁচিশ হাজার টাকা খুচরো নোটে বুঝিয়া পাইলাম।” স্ট্যাম্প প্যাডও নিয়ে যাব। তুমি তার নিচে তোমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের টিপছাপ দিয়ে টাকাটা আমার কাছ থেকে নেবে!
–আপনি পাগল হইয়ে গেসেন, স্যার। তাই কি হামি পারি?
–না পার টিপছাপ দিও না। রসিদ দিও না। আমিও টাকাটা দিতে পারব না।
–ও. কে.। তাইলে কালই তিন সেট পিচার ডাকে ডেলে দিই।
–ক্ষমতা থাকে দাও!
–ক্ষেমতা! কেঁও? হমার হিম্মতে কুলাবে না?
–তাই তো আমার ধারণা!
–তিনঠো লেফাফা ডাক-বাক্সে গিরাতে সেকব না আমি?
–সেই কথাই তো বলছি আমি। বারে বারে বলছি।
–লেকিন কেঁও?
–কারণ তোমার এক্তিয়ারে ঐ একটিই একাঘ্নী বাণ আছে, মাস্তান! ও দিয়ে তুমি ঘটোৎকচকে বধ করতে পার–আলবৎ পার–কিন্তু অর্জুন তাহলে জীবিত থাকবে। তোমার কভিকশন তো অৰ্জুনই করবে, তাই নয়? আই. পি. সি.-তে ব্ল্যাকমেলিঙের জন্য ম্যাক্সিমাম কত বছর সশ্রম কারাদণ্ডের প্রভিসন্স আছে তা ভোলনি নিশ্চয়। অর্জুনই সে ব্রহ্মাস্ত্রটা ছাড়বে, তাই নয়? ঘটোৎকচ তো বেফাজুল? ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে এলেবেলে-চরিত্র!
–কী উল্টাসিধা বকছেন প্রফেসার-সাহাব!
–মহাভারত যে পড়নি তা জানি, কিন্তু চোপড়া-সাহেবের সিরিয়ালটাও দেখনি রোব্বারে?
–হামি সচমুছ কুছু সমঝাতে পারছি না, স্যার!
–অলরাইট! মহাভারত তুমি পড়নি! কিন্তু তাস খেল নিশ্চয়। শোন! তোমার হাতে আছে রঙের টেক্কাখানা! ম্যায়নে মান্লি! একটা পিঠ তুমি তুলবেই। কোন শুয়ারের বাচ্চা রুখতে পারবে না! তাই না মাস্তান? কিন্তু তারপর! টেক্কাখানা তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবার পর? মানছি, আমার নানান অসুবিধা হবে, নানা বেইজ্জতি। হয়তো চাকরি ছেড়ে দেব। কিন্তু তুমি? শুধু পঁচিশ হাজার টাকাই খোয়াবে –উপরন্তু আমার মতো একটা শত্রুকে লাভ করবে। বদলা না নিয়ে যে আমি থামব তা তুমি নিশ্চয় বুঝছ! বয়স হয়েছে, তবু শত্রু হিসাবে আমি লোকটা যে সাঘাতিক তা তোমার ভালরকম জানা। তাছাড়া তুমি জান নিশ্চয়, সোন্ধী ইতিমধ্যে পুলিসে ডায়েরি করেছে…
–সোন্ধী! সৌন্ধী কৌন আছে?
–ন্যাকা সাজবার চেষ্টা কর না মাস্তান! য়ু আর অলরেডি হাফ-এক্সপোজড! তুমি জান যে, পুলিসে এইট বাই টোয়েন্টি অ্যাপার্টমেন্টে সাত-সাতটা লেটেন্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়েছে। একটা মেয়ের, আর একটা ছেলের। য়ু নো ড্যাম ওয়েল, হোয়াটস আ লেটেন্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট। তুমি জান, পুলিস রেকর্ডে তোমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে কি না। যদি জীবনে কখনো কনভিকশন হয়ে থাকে, যদি কখনো কোনো হাজতে রাত্রিবাস করে থাক, তাহলে য়োর ফিঙ্গারপ্রিন্ট উড ট্যালি…
–হামি কুছু সমঝাতে…
–লেকিন হামি সব কুছ সমঝেছি মাস্তান! ডু হোয়াটএভার য়ু থিংক বেস্ট! আই নো অ্যান্ড দ্য পুলিস নো দ্যাট য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ পার্ফেক্টলি! গুড নাইট!
–শুনুন স্যার, প্লীজ…
তালুকদার লাইনটা কেটে দিলেন।
‘ফিয়ার ইজ দ্য কী!’
তীক্ষ্ণধী মানুষটি ইতিমধ্যে ‘দুইয়ে-দুইয়ে চার’ করেছেন।
সদ্যসমাপ্ত অ্যাপার্টমেন্ট। প্রকাণ্ড বড় ফ্ল্যাট, অথচ আসবাবপত্রবিহীন! তার একটাই অর্থ হতে পারে : মালিক ফ্ল্যাটের দখল নিয়েছে, নেমপ্লেট বসিয়েছে, নগদ টাকার জোরে টেলিফোন কানেকশান পর্যন্ত পেয়েছে, কিন্তু সপরিবারে ফ্ল্যাটটা দখল করেনি। এটা বোঝা যায়। একটা ফ্রিজ, একটা ডবল-বেড খাট আর একটা সিলিঙ ফ্যান। ব্যস! কেন? সম্ভবত পূর্ববর্তী এক-কামরার ফ্ল্যাট থেকে এগুলি স্থানান্তরিত করে সোন্ধী অপেক্ষা করছিল। হয়তো ওর স্ত্রী-পুত্র-পরিবার দিল্লীতে, বোম্বাইয়ে বা ব্যাঙ্গালোরে। দু-চার মাস পরে, বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হলে হয়তো ওরা সবাই আসবে। এই সুযোগটা নিয়েছে ঐ মাস্তান-পার্টি। যে কোনোভাবেই হোক ঐ সদর দরজার একটা ডুপ্লিকেট চাবি যোগাড় করেছে।
সেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওরা কারবার ফেঁদে বসেছিল। হয়তো এতদিনে সোন্ধী আচমকা সপরিবারে ফিরে এসেছে। হয়তো বিগত সপ্তাহে সে পাঁচ সাতটা বিচিত্র টেলিফোন কল পেয়েছে। কেউ খুঁজছে সরযূকে, কেউ নমিতাকে, কেউ মালিনীকে। অথচ প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিচয় সযত্নে গোপন রাখতে চায়। নাম জানতে চাইলেই লাইন কেটে দিয়েছে। কেন? সোন্ধী সন্দিগ্ধ হয়েছে–খোঁজ নিতে গিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে জেনেছে ‘কে বা কাহারা’ তার ফ্ল্যাটে বাস করে গেছে। পুরুষ এবং স্ত্রীলোক। প্রতিবেশীরা ধরে নিয়েছিল তাঁরা সোন্ধীর রিস্তেদার। হয়তো তাই মায়াজাল বিস্তার করে সোন্ধী জানবার চেষ্টা করেছিল প্রফেসর তালুকদারের পরিচয়। নিদেন তাঁর টেলিফোন নাম্বার। মাস্তান এ বিষয়ে কতটা কী জানে তা জানা নেই কিন্তু সোন্ধী যে সন্দিগ্ধ, অ্যাপার্টমেন্টটা হাতছাড়া হবার পরেই তা বুঝেছে। হয়তো আচমকা পালাতে গিয়ে ফ্রিজে ফেলে আসতে হয়েছে অর্ধসমাপ্ত বিয়ার অথবা জীন-এর বোতল!
‘ফিয়ার ইজ দ্য কী!’–আতঙ্কের বলটা উনি ও-কোর্টে ফিরিয়ে দিলেন।
রবিবার রাত সাড়ে-আটটায় টেলিফোন রিসিভারের পাশে চুপচাপ বসে ছিলেন। ওঁর টেবিলের উপর একটা ইংরেজি পেপারব্যাক গল্পের বই, পাতা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে : ফ্রেডেরিক ফরসাইথ-এর ‘নো কামব্যাকস্’! একটা পাতাও পড়তে পারছেন না। আশা ছিল, আতঙ্কগ্রস্ত ব্ল্যাকমেলার একই সময়ে ফোন করবে। সে সময়ে অন্য কেউ ফোনটা তুলুক তা উনি চান না।
ঠিক তাই সাড়ে আটটায় বেজে উঠল টেলিফোনটা।
–তালুকদার স্পিকিং।
–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই বলছি। আপনি অহেতুক দরাদরি করছেন, স্যার। আপনি আমাকে চেনেন না। এসব ব্যাপারে আমি অত্যন্ত নিষ্ঠুর, জানে মারা পড়বেন কিন্তু।
পরিষ্কার সহজ সরল বাঙলা উচ্চারণ। কাবুলিওয়ালার সেই ‘খোঁকী তোমি সসুরবাড়ি যাবিস্’-গোছের বিকৃতির চিহ্নমাত্র নেই।
তালুকদার বললেন, লুক হিয়ার, মাস্তান! আয়াম নট আফটার এনি বারগেন!…অর ডু য়ু স্টিল প্রিটেন্ড দ্যাট য়ু ডোন্ট ফলো মি?
–না স্যার! আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি।
–তাহলে? আমি তো একটা নয়া পয়সা কমাবার কথা বলিনি। পুরো পঁচিশ হাজারই দেব। সমস্তই দশ বা বিশ টাকার নোটে। বিনিময়ে আমার ঐ শর্তটা তোমাকে মানতে হবে।
–ঐ রসিদে সই দিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের টাকা নেওয়া?
–হ্যাঁ, কিন্তু শুধু সই নয়, বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলের টিপছাপ।
–আপনাকে একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবেন স্যার?
–ইতস্তত করছ কেন?
–ঐ যে কাল আপনি বললেন, ‘তোমার মতো অনারেবল…’, কিন্তু এখন যেটা বলছি তা আপনি যাচাই করে জেনে নিতে পারেন…
–কী কথা?
–ঐ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে আপনি কিসসু করতে পারবেন না। অ্যাসুমিং আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট পুলিসের কাছে আছে, অ্যাসুমিং সেই টিপছাপের সঙ্গে সোন্ধীর বাড়িতে ওরা যে টিপছাপ পেয়েছে তা মিলে গেল। তাহলে কী হবে?
–তুমিই বল?
–মাকড় মারলে যা হয় : ধোকড়! খুঁটির জোরে ম্যাড়া লড়ে শোনিননি? কোন শালা পুলিসের বড়সাহেবের হিম্মৎ হবে না…
–তাহলে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন?
–এটাই আপনার ভুল। ‘ভয়’ আমি আদৌ পাইনি। কিন্তু তাই বলে বেহুদ্দো পঁচিশ হাজার টাকা খোয়াতেও আমি রাজি নই।
–বুঝলাম! তা এতই যদি বেপরোয়া তাহলে টিপছাপ দিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের টাকা নিতেই বা তোমার আপত্তি কিসের?
–কিন্ত ঐ টিপছাপ নিয়ে আপনি কী করবেন? পুলিসে যাবেন? আপনার ছাত্র সেই দিল্লীতে-পোস্টেড কল্যাণ সেনগুপ্ত, আই. পি. এস.?
তালুকদার বুঝতে পারেন লোকটা কতদূর খবর রাখে।
বলেন, না, মাস্তান। আমি পুলিসে যাব না আদৌ। রসিদটা ব্যাঙ্ক ভল্টে রেখে দেব।
–বাট হোয়াই? কেন?
–দেখ মাস্তান, আমি খোলা কথার মানুষ। হ্যাঁ, ভুল আমি একটা করেছি। তোমরা আমাকে বোকা বানিয়েছ। আমার অবশ্য এখনো দৃঢ় বিশ্বাস–সেই মেয়েটি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে কোনও তঞ্চকতা করেনি। কেন এমন অদ্ভুত ধারণা হয়েছে, ওয়েল, তা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। ইন ফ্যাক্ট, তুমি যে স্তরের মানুষ, তাতে তোমার পক্ষে ওসব বোঝা সম্ভবপরও নয়। বাদ দাও সেকথা! ‘অ্যাভেইলেবল ডাটা’ অনুসারে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মেয়েটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তোমাকে ব্ল্যাকমেলিঙের সুযোগ করে দিতে। স্বীকার করতেই হবে, তোমরা আমাকে বোকা বানিয়েছ। ওয়েল, তার মূল্য আমি দেব। কড়ায় গণ্ডায়। যা তুমি চেয়েছ-গোনাগুন্তি পঁচিশ হাজারই। কিন্তু দুবার নয়। একবার! আমার মৃত্যুবাণ যেমন তোমার কাছে থাকবে, তেমনি তোমার মৃতুবাণও থাকবে আমার কাছে। দু-পক্ষের আর্সেনেলে হাইড্রোজেন বোমা থাকলে, কোন পক্ষই সেটা ফাটাতে পারে না। ফলো?
–আজ্ঞে না। যতক্ষণ না আমি মেনে নিতে পারছি যে, ঐ টিপছাপ দেওয়া রসিদটা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে।
–তাহলে তা দিতেই বা তোমার এত আপত্তি কেন?
–যেহেতু এটা একটা অ্যাবসার্ড প্রপোজিশান! পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কোনদিন রসিদ দিয়ে ব্ল্যাকমানি নেয়নি।
–তার কারণটা কী তা জান?
–না। আপনিই বলুন?
–অলরাইট! কারণটা আমিই বলছি। কেন তুমি ভয় পাচ্ছ টিপছাপ দিতে।
–ভয় আমি পাচ্ছি না।
–পাচ্ছ! আলবৎ পাচ্ছ! একশবার পাচ্ছ! কেন পাচ্ছ, তা তুমিও জান, আমিও জানি।
–কী,বলুন?
–তুমি জান, ভারতবর্ষে আজ যারা ক্ষমতার চূড়ায় কাল তারা অপজিশন বেঞ্চে গিয়ে বসতে পারে। আজ যাদের প্রভাবে তুমি হাতে মাথা কাটছ তারাই তখন পথে পথে মিছিল করে ঘুরে মরতে পারে : আমাদের দাবী মানতে হবে। সেই দুর্দিনে ঐ টিপছাপ, ঐ রসিদ তোমার কাছে হাইড্রোজেন বোমারই সামিল! তাই না তোমার এত আপত্তি? কী? মাস্তান-সাহেব?
ওপক্ষ তবু জবাব দিল না।
–হ্যালো, মাস্তান? তুমি লাইনে আছ?
–আছি স্যার! আপনি একটি পাক্কা হারামজাদা ব্যক্তি আছেন! অলরাইট, ঐ শর্তেই আমি টাকাটা নেব।
–রসিদ দিয়ে? টিপছাপ দিয়ে?
–উপায় কি? টাকাটার বড় জরুরি দরকার। আই এগ্রি! কোনপক্ষই বোমা ফাটাতে পারবে না কোনদিনই। আজকে যারা পার্টি-ইন-পাওয়ার তারা অপজিশানে গেলেও আপনি ঐ রসিদটা দাখিল করতে পারবেন না। কারণ তাহলে ঐ ফটোগুলোও আমি দাখিল করব। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস যেদিকেই মোড় নিক আপনাকে ইজ্জত বাঁচাতে হবেই।
–তাহলে টিপছাপ দিয়ে টাকাটা নেবে?
–বলছি তো তাই নেব।
–কিন্তু ঐ মেয়েটারও টিপছাপ যে আমার চাই?
–দ্যাটস্ ইম্পসিবল। বিশ্বাস করুন, ও এখানে নেই।
–অলরাইট। কোথায় কীভাবে টাকাটা তোমাকে দেব তা এবার বল। সাতটা দিন সময় আমাকে দাও। টাকাটা জোগাড় করতে, আর দশ-বিশটাকার খুচরো নোটে তা ভাঙাতে। আজ রবিবার। আগামী রবিবার টাকাটা তোমাকে আমি দেব। বল, কখন কোথায়?
–রবিবার দেবেন? ওয়েল, তাহলে শনিবার বলব, এই সময়ই।
–আজ বলতে পার না?
–ছেলেমানুষী করবেন না, স্যার!
লাইন কেটে দিল লো্কটা।