১৩.
মঙ্গলবার সকালের দিকে ওঁর তিনটে ক্লাস থাকে। বিকালটা অফ। দুপুর নাগাদ ফিরতে পারবেন। কলেজে এসে খবর পেয়েছেন, মেডিকেল কলেজে তিনটি রুগীই ভালোর দিকে। কৃষ্ণা সেনের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। আর গতকাল যে তিনটি ছেলে গ্রেপ্তার হয়েছিল তারা সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে। পুলিস কেস চালাবে না।
ছাত্র ইউনিয়নের কিছু একটা হয়েছে। থমথমে ভাব। ধর্মঘট ঘোষণা করেনি কোন পক্ষই, কিন্তু সব বিভাগেই উপস্থিতির হার খুবই কম।
বেলা তিনটে নাগাদ ডেকে পাঠালেন তাপসকে। জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার বল তো? কলেজে এমন থমথমে ভাব কেন? একটা ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে।
–আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই আন্দাজ করেছেন। উপরওয়ালাদের ইন্টারপ্রিটেশন জোয়াদ্দার মেনে নিতে পারছে না। একটা বিস্ফোরণ আশঙ্কা করছি।
-–কিসের ইন্টারপ্রিটেশন?
–পার্টি লাইনের বক্তব্য, কৃষ্ণা সেন একটা সাজানো অ্যাবডাকশনের নাটকে অভিনয় করে আত্মগোপন করেছে। পার্টির একজন দক্ষ ক্যাডারকে ফাঁসানোর জন্য। জোয়াদ্দার কেন, তার দলের অনেকেই এই থিয়োরিটা মেনে নিতে পারছে না। সাজানো অ্যাবডাকশন কেস-এ অমনভাবে কেউ কারও তলপেটে ছুরি মারে না। ওভাবে বোমা ছেড়ে না! ফলে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের একটা মতপার্থক্য হয়েছে। জোয়াদ্দার আর তার দলের কয়েকটি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ছাত্রনেতা এখন ‘বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীভুক্ত’!
–যা হোক। তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি একটা জরুরি কথা জানাতে। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র তিনটে দিন আমি ছুটি নিয়েছি
–কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন, স্যার?
–না, বাড়িতেই থাকব। তুমি টেলিফোনে আমাকে পোস্টেড রেখ। শনিবার আমার সাপ্তাহিক ছুটি। একেবারে পরের সোমবার আবার কলেজে আসছি।
-–ঠিক আছে, স্যার।
.
ওকে বিদায় করে উনি বেড়িয়ে পড়লেন মার্কেটিঙে।
সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এভাবেই কলেজ-ফের্তা তিনি কিনে নিয়ে যান। ধর্মতলায় ওঁর একটি ছাত্রের দোকান আছে। সেই দোকানের সামনে গাড়ি রেখে, তাকে সজাগ করে চাঁদনি-বাজারে ঢুকলেন। প্রথমেই খরিদ করলেন একটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। তারপর নানান টুকিটাকি জিনিস কিনে ঐ ব্যাগে ভরতে থাকেন : হেয়ার-অয়েল, টুথপেস্ট, শেভিং-ক্রীম, ভিম পাউডার, ন্যাপথলিন। মাঝারি-সাইজ একটা স্টীলের ক্যাশবাক্সও কিনলেন। সাবধানী মানুষ –দশ বা বিশ টাকার নোটে পঁচিশ হাজার টাকা বড় কম জায়গা নেবে না। কাগজের প্যাকেটে বেঁধে নিয়ে যেতে চান না উনি। আরও কিনলেন টর্চের এক-জোড়া ব্যাটারি, কিছু ফিউজ তার। খোদায় মালুম-কী মনে করে ঝালাই-কাজের কিছুটা সলডারিং লোহা। তাছাড়া একটা স্প্রিং দেওয়া মজবুত ইঁদুর-মারা-কল। কেন? ওঁর বাড়িতে তো ইঁদুরের উপদ্রব নেই?
সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এলেন বাড়িতে।
বুধ-বৃহস্পতি-শুক্র তিন-তিনটে দিন ছুটি নিয়ে এসেছেন। রুদ্ধদ্বার কক্ষে এ ক’দিন কী করলেন তা উনিই জানেন।
.
শুক্রবার সন্ধ্যায় দেখা করতে এল তাপস। অনেক খবর সে এনেছে। দেবু ছাড়া বাকি দুজন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। দেবুর অবস্থা অনেক ভাল। পরের সপ্তাহে সে বাড়ি যাবে। তবে এখনো দু-এক সপ্তাহ তাকে শুয়েই থাকতে হবে। দেবুর কাছ থেকে গোপন করার চেষ্টা হয়েছিল– কৃষ্ণার খবরটা। কিন্তু সে জেনে ফেলেছে। উপায় নেই। আর একটা বড় খবর হচ্ছে জোয়াদ্দার রিজাইন দিয়েছে। সে সদলবলে এখন বিক্ষুব্ধের দলে। সতীশকে বোধহয় এবার ওরা ইউনিয়নের সেক্রেটারি করতে পারে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে : কৃষ্ণা সেন বাড়ি ফিরে এসেছে।
–এসেছে? কখন? কীভাবে?
কাল রাত তিনটেয়। একটা কালো অ্যামবাসাডারে। বিচিত্র ঘটনাচক্র। রাত আড়াইটে নাগাদ একটা অ্যামবাসাড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ায় ডক্টর অপরেশ সেনের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আসে দু-তিনটি ছেলে। কল-বেল বাজায়। ওঁদের ঘুম ভেঙেছিল ঠিকই, কিন্তু সাড়া দিতে চাননি। কিন্তু এ পক্ষ বেপরোয়া। চিৎকার-চেঁচামেচিতে পাড়ার আশেপাশের বাড়িতে আলো জ্বলে ওঠে। ডাক্তার সেন দ্বিতলের ঝোলা বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে পড়ে জানতে চান : এত রাত্রে কে তোমরা হল্লা করছ?
–রুগী নিয়ে এসেছি, স্যার। দোর খুলুন।
–হাসপাতালে নিয়ে যাও। এত রাত্রে আমি রুগী দেখি না।
–রুগি যে আপনার সোনার চাঁদ মেয়ে গো ডাক্তার সা’ব। তার বডি নেবেন না?
–বডি?
–জিন্দা কি মূর্দা নেমে এসে স্বচক্ষে দেখুন—
লোকটার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। হয় অত্যধিক মদ্যপান করেছে, অথবা মদ্যপের অভিনয় করছে। আধো-অন্ধকারে দেখা যায় অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ষণ্ডামার্কা একজন তরুণ। কালো-রঙের চোঙা প্যান্ট তার পরিধানে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আর একজন। সে ঊর্ধ্বমুখে আকাশকে সম্বোধন করে বললে, এ-পাড়ার কোনো সুয়োরের বাচ্চা যদি এখন টেলিফোন ছোঁয় তবে কাল সুর্যিডোবার আগেই তার লাস ফেলে দেব মাইরি। …অ্যাই, অ্যাই, তোরা খড়খড়ি তুলে কী দেখছিস্ বে? সার্কাস?
গলির উল্টোদিকে একটা বাড়ির ভেনিশিয়ান খড়খড়ি পাল্লা তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ির ভিতর থেকে কে একজন মুরুব্বি ভারি গলায় হুকুম দিল : কেন বেহদ্দা ঝুট-ঝামেলা করছিস্ বে? বডিটা রোয়াকে নামিয়ে দে, যে পয়দা করেছে সে সালা সমঝে নেবে জিন্দা না মুর্দা। ডাক্তার-মানুস্ এটুকু বুঝবে না?
দু-তিনজন ধরাধরি করে একটা অচেতন নারী-দেহ রোয়াকে নামিয়ে দিল। তারপর ওরা ঐ গাড়ি চেপে চলে যায়।
ডক্টর সেন নেমে এসে মেয়েকে ঘরে তুলে নেন। না, মৃতদেহ নয়। অজ্ঞান হয়েছিল জোরালো ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোতে। বেলা দশটা নাগাদ তার ঘুম ভেঙেছে। তার আগেই একজন পরিচিত লেডি ডাক্তারকে দিয়ে ডক্টর সেন কৃষ্ণাকে পরীক্ষা করিয়ে ছিলেন। তার ঘুমন্ত অবস্থাতেই।
যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল! স্টিচ দিতে হয়েছে।
জ্ঞান ফিরে আসার পর কৃষ্ণা কারও সঙ্গে একটা কথাও বলেনি।
কিছু খায়নি পর্যন্ত।
তালুকদার নতনেত্রে শুনছিলেন এতক্ষণ। তাপস থামতেই চোখ তুলে তাকান, বলেন, তারপর? ডক্টর সেন পুলিসকে জানিয়েছেন?
–না, স্যার। তবে পুলিস খবর পেয়ে গেছে।
–সারাদিন সারারাত সে অভুক্ত আছে?
–হ্যাঁ, স্যার। শুধু তাই নয়, মৌনও। এখনো পর্যন্ত সে কোন কথা বলেনি। কোন প্রশ্নের জবাব দেয়নি। ও বোধহয় নির্বাক অনশনে মৃত্যুবরণ করতে চায়!
তালুকদার নীরব রইলেন।
–আপনি স্যার, একবার চেষ্টা করে দেখবেন?
–আমি? আমি কী চেষ্টা করে দেখব? ওর অনশন ভাঙাতে? আমাকে সে কোনভাবে চেনেই না। তার বাবা, ছোট বোন, ভাই যেখানে ওকে রাজি করাতে পারেনি…
–তা বটে।
তালুকদার সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন।
তাপসও নীরবতা ভঙ্গ করে না।
যেন অনেক-অনেক দূর থেকে তালুকদার হঠাৎ প্রশ্ন করেন, তাপস! গত বছর আমাদের সোস্যালে কৃষ্ণা কোন্ রবীন্দ্রসঙ্গীতটা গেয়েছিল তোমার মনে আছে?
তাপস জবাব দিল না। বাহুল্যবোধে। এ-কথা কি কারও মনে থাকতে পারে?
তালুকদার বললেন : “দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে, যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করে ধরিব হে!”