আম্রপালী – ৭

০৭.

আরও দিন-তিনেক পরে ডাকবাক্স থেকে উদ্ধার করলেন একটা মোটা খাম। সলিল মিত্রের নামে। বেশ ভারী খাম। বাড়তি ডাকটিকিট দিতে হয়েছে। ও বোধহয় অনেক কিছু লিখেছে। স্টাডিরুমে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে সযত্নে পেন-নাইফ দিয়ে খামটা খুলে ফেললেন।

ভিতর থেকে বার হয়ে এল খান-ছয়েক পোস্টকার্ড-সাইজ রঙিন হট-শট ফটোগ্রাফ।

বজ্রাহত হয়ে গেলেন অধ্যাপক তালুকদার!

ঐ ছয়খানি রঙিন আলোকচিত্র ব্যতিরেকে লেফাফার ভিতর আর কিছু ছিল না। প্রতিটিই চূড়ান্ত পর্নোগ্রাফিক আলোকচিত্র। নরনারীর নিরাবরণ যৌনমিলনের দৃশ্য। তিনখানি ছবিতে পুরুষটির পিছন দিক দেখা যাচ্ছে, সে তিনটিতে মালিনীকে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না। দু-খানি ছবিতে অধ্যাপক তালুকদারের সম্মুখদৃশ্য। চশমাটা খোলা আছে, তবু চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না, সে তিনটিতে রতিরঙ্গসঙ্গিনীর পশ্চাদ্দেশ দেখা যাচ্ছে। বাকি একখানি পাশ থেকে তোলা। প্রোফাইল। নায়ক নায়িকা দু-জনকেই স্পষ্ট সনাক্ত করা যায়।

যা ছিল মধুর স্বপ্নময় আধোস্মরণে তা পুরীষক্লিন্নকদর্যতায় উপস্থিত হল চাক্ষুষভাবে। ভয় তো পেয়েছেন বটেই, ঐ সঙ্গে নিদারুণ একটা বেদনার অনুভব!

মেয়েটি এই! মানুষ চিনতে পারলেন না। সে তো একটা পয়সাও হাত পেতে নেয়নি। বলেছিল, তার দক্ষিণা ওঁর তৃপ্তির পরিমাণ-নির্ভর। পরে, হ্যাঁ শেষ পর্যায়ে যা বলেছিল তা অন্য দৃষ্টিভঙ্গির। ফ্রিনে তার নারীত্বের মর্যাদা দাবী করেছিল প্র্যাক্সিটেলেস্-এর কাছে। তাকে উপেক্ষা করে উনি ফিরে এলে নাকি ফ্রিনের শাশ্বত নারীত্বের অপমান! কী সব বড় বড় কথা!

বাস্তবে–ছি, ছি, ছি! ভারী পর্দার পেছনে হটশট ক্যামেরা হাতে প্রতীক্ষায় ছিল ওর পাপের সঙ্গী। তাই ঘরে অত জোরালো আলোর আয়োজন। হয়তো ফ্লাশবালবে ঝিলিকও দিয়েছে–তখন নেশাগ্রস্ত প্রৌঢ় মানুষটি ছিলেন দীর্ঘ তিন দশকের তৃষ্ণায় কাতর। জৈবক্ষুধায় হতভাগ্য তখন তুরীয়ানন্দে অন্য জগতে। এসব জাগতিক কাণ্ডকারখানার ঊর্ধ্বে, বহু ঊর্ধ্বে।

ছি-ছি-ছি! এ কী হয়ে গেল!

জীবনে যিনি কখনো হার মানেননি–স্কুল-কলেজ জীবনে কখনো সেকেন্ড হননি, তিনি এভাবে চূড়ান্তভাবে হেরে গেলেন একটা বেশ্যা আর তার নাগরের ছলনায়! জীবনে এত বড় সমস্যার সম্মুখীন হননি কখনো। প্রণতির অ্যাকসিডেন্টের সময়েও এতটা বিচলিত হয়ে পড়েননি। সেবার মাথা খাড়া রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফারটা ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার? ওরা তো অনতিবিলম্বেই ব্ল্যাকমেলিং শুরু করে দেবে!

পরদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে শুনলেন, সারা দিন কে-একটা বেগানা লোক ওঁকে বারে বারে ফোন করেছে। নামটা জানায়নি, কিন্তু রামুকে বলেছে–তার সাহেব ফিরে এলে যেন জানানো হয়, রাত সাড়ে আটটায় সে আবার ফোন করবে। ব্যাপারটা নাকি খুবই জরুরী। সাহেব যেন রাত সাড়ে আটটায় বাড়িতে থাকেন।

প্রণতি বিরক্ত হয়ে বলেন, কে বল তো লোকটা? কী চায়? ভারি উদ্ধত মেজাজের। অসভ্য।

বুঝলেন সবই। মুখে বলতে হল, আমি কী করে জানব?

কাঁটায়-কাঁটায় আটটা উনত্রিশে টেলিফোনটা বেজে উঠল।

উনি প্রস্তুত হয়ে বসেছিলেন। পড়ার টেবিলে। বাঁ-হাতটা টেলিফোন রিসিভারে রেখে। ঘর ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ। একবার মাত্র রিঙিং টোন হতেই তুলে নিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, ইয়েস! তালুকদার বলছি…

–আপনি কি প্রফেসর রঞ্জন তালুকদার আছেন?

পুরুষকণ্ঠ। বিকৃত কণ্ঠস্বর। উচ্চারণও বিকৃত। পশ্চিমা ঢঙে। হয়তো ইচ্ছাকৃত।

উনি ওর খাজা বাঙলার জবাবে বললেন, আছি।

–অ! আছেন! বাই মিসটেক প্রফেসর সলিল মিত্র আছেন না তো?

দাঁতে-দাঁত চেপে নীরব রইলেন। বঁড়শিতে মাছটা নিশ্চিত গেঁথেছে বুঝতে পেরে ও লোকটা ওঁকে একটু খেলিয়ে তুলতে চায়।

–কী হল, প্রফেসর-সাহেব? গুম খেয়ে যাচ্ছেন কেন? সুতো ছাড়লুম, অখন ঘাই মারুন। আর কুছু না পারেন তো শালা-বাহানচোৎ করুন।

–কী চাও তুমি?

–আপনাকে এক সেট পেরিস্‌ পিকচার প্রেজেন্ট পাঠিয়েসি। পাইয়েসেন তো?

–কী নাম তোমার?

–প্রফেসর-সাহাব। আপনাকে একঠো প্রশ্‌ন করা হইয়েসে, জবাবটা পহিলে দিন! এতটা উমর হল, ই-কথা জানেন না কি, আসামী সির্‌ফ জবাব দিয়ে যায়, সওয়াল করে না? প্রফেসর তালুকদার, আপনি আপনার ল্যাংটো ছবি পাইয়েসেন?

উপায় নেই। সংক্ষেপে সারতে না পারলে ও ক্রমেই অশ্লীলতর আলাপচারি শুরু করবে। বললেন, পেয়েছি।

–বহুৎ সুক্রিয়া! অব শুনেন, স্যার। ছয়খানা ছবির তিন-তিন সেট প্রিন্ট করা হইয়েসে। একসেট আপনার প্রিন্সিপাল-সাহেবের খাতির, দুসরা-সেট মিসেস তালুকদারের খাতির। সমঝলেন? অখন থার্ড সেট কুথায় যাবে আন্‌জাদ করতে পারেন?…কোই বাত নেই, থিংক করেন…

প্রফেসার তালুকদার অসীম ধৈর্যে নীরব রইলেন। লোকটা ওঁকে ভয় দেখাতে চাইছে। ভয় যে পাননি তা নয়, কিন্তু ভয়ে বুদ্ধিভ্রংশ হতে দেবেন না কিছুতেই! হার মেনে নেওয়া ওঁর ধাতে নেই।

অবশ্য এমন নরকের কীটের সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে নামবার দুর্ভাগ্য ওঁর আগে কখনো হয়নি জীবনে।

–টাইম খতম হইয়ে গেলো। আন্‌জাদ করতে সেকলেন না। আপনার কলেজে ঘুস্‌তে একঠো বড়কা লুটি বোর্ড আছে না? ঐ বোর্ড-এ ছয়খানি ফটো রাতারাতি লটকে দিয়ে আসব। প্রফেসররা সবাই দেখবে, ছেলেরা দেখবে, ঔর ছুকরিগুলান ভি দেখবে। এখন বলুন স্যার, এ বে-ইজ্জতি রুখতে চান? ইয়েস্ অর নো?

–কত টাকা চাইছ?

স্পষ্ট উচ্চারণে বললে, নাউ য়ু আর টকিং প্রফেসর! সিধা হিসাব! ইচ সেট ছবির দাম পাঁচ পাঁচ হাজার, ঔর নেগেটিভ দস হাজার। অব হিসাব জুড়িয়ে লিন : তে-পাঁচা পন্দের ঔর দস–পঁচিস হাজার! লেকিন সবটা দস-বিস টাকার য়ুজ্‌ট্‌ নোটে! সমঝলেন?

লোকটা নিজেকে অবাঙালি, অশিক্ষিত উত্তরভারতের লোক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। বাস্তবে ও বাঙালী এবং শিক্ষিত। উনি টাকার অঙ্কটা জানতে চাওয়া মাত্র আনন্দে ওর ছদ্মবেশটা খণ্ডমুহূর্তের জন্য গা থেকে খুলে গেছিল। ‘আন্দাজ’কে যে ‘আন্‌জাদ’ উচ্চারণ করে সে হঠাৎ-খুশিতে ঐ ইংরেজি লব্‌জ্‌টা কিছুতেই বলতে পারে না ‘নাউ য়ু আর টকিং, প্রফেসর!’ ইংরেজিতে অনেক ক্রাইম থ্রিলার ওর পড়া।

–কী হল প্রফেসর-সাব? ফিন গুম খেয়ে গেলেন নাকি?

–অত টাকা আমি কোথায় পাব?

–ই একটা কোথা হল? রাজারা মানিক পায় কুথায়?

আবার–আবার একটা ক্লু। ‘কথা’ কে ‘কোথা’, ‘কোথায়’কে ‘কুথায়’ যার বাংলা জ্ঞান, তার সঞ্চয়ে থাকা সম্ভবপর নয় ঐ বাঙলা ঘরোয়া রসিকতা ‘রাজারা মানিক পায় কোথায়’? লোকটা এক নিশ্বাসে বলেই চলেছে, ক্যাশ-সার্টিফিটি তোড়াতে পারেন, ইউনিট-ট্রাস্ট, এন. এস. সি. নিদেন প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন। ভাবীজীর দু-চারখান অর্নামেন্টস্ ঝেড়ে দিলেই বা কে ঠেকাচ্ছে? ভাবীজীর তো মালুম পড়বে না। ব্যাঙ্ক-ভল্ট তো আপনিই ট্রানস্যাক্ট করেন।

পাকা ক্রিমিনাল সন্দেহ নেই; কিন্তু সূক্ষ্ম কারিগরী এখনো আয়ত্ত করতে পারেনি। মিসেস্ তালুকদার যে পঙ্গু,এ সংবাদ পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে অথচ বুঝতে পারে না যে, একটা অর্ধশিক্ষিত মানুষ, যে ‘সার্টিফিকেট’কে ‘সার্টিফিটি’ বলে, সে ‘ব্যাঙ্ক-ভল্ট ট্রানস্যাক্ট’ করার কথা বলতে পারে না! সে দিলখুশ হলে ফস্ করে বলে বসতে পারে না : নাউ য়ু আর টকিং, প্রফেসর!

কাঁচা কাজ!

–কী হল? কুছ তো বলেন?

বুঝতে পারেন, এর সঙ্গে দরদাম চলবে না।

বললেন, একটা শর্তে আমি টাকাটা দেব।

–কী শর্ত?

–টাকাটা আমি ঐ ঠিকানায় দেব। তোমার পার্টনার-ইন-ক্রাইম সেই মেয়েটির সামনে, সেই এইট বাই টোয়েন্টি…

–থামুন, থামুন! টেলিফোনে ই-সব বাৎ বোলতে নেই। সে অ্যাপার্টমেন্ট অখন বেহাৎ! তিন রোজ টাইম দিচ্ছি। আজ বুধবার আছে, শনিচর রাত সাড়ে-আট বাজে ফিন টেলিফোন করে জানাব কোথায়, কীভাবে প্যাকেটটা আপনি দিবেন। সমঝলেন?

–শোন…

ও-প্রান্তবাসী শুনল না। রিসিভারে ফোনটা নামিয়ে রাখল। সম্ভবত ওর একটা আশঙ্কা আছে পুলিস ওকে খুঁজছে। ও কোথা থেকে ফোন করছে তা ধরবার চেষ্টা করতে পারে পুলিস। দীর্ঘসময় টেলিফোন-লাইনে থাকলে ‘গোস্ট-কল’ খুঁজে বার করা যায়–এ তত্ত্বটা ওর জানা। যতই অশিক্ষিত বলে নিজেকে জাহির করতে চাক ও বেশ ভালই শিক্ষিত। ‘ব্ল্যাকমেলিং’ যদি একটি অপরা-বিদ্যা হয় তাহলে সে সে বিদ্যা ভালভাবেই আয়ত্তে এনেছে। শুধু আলাপচারিতায় অভ্যস্ত হয়নি। তাছাড়া ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি নেই। প্রফেসর তালুকদারের মতো মানুষকেও সে ফাঁদে ফেলতে পেরেছে।

অবশ্য সে কৃতিত্বের বৃকোদর-ভাগ সেই মেয়েটির প্রাপ্য! যাঁকে ওর মনে হয়েছিল শুধু রতিরঙ্গরসেই নয়, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, কৃষ্টিতে সে Phryne! অমন একটি মেয়েকে কী করে পার্টনার-ইন-ক্রাইম করতে সক্ষম হল এ লোকটা? তা সে যাই হোক, ও নিশ্চয় এতক্ষণ কোনো পাবলিক টেলিফোন-বুথ থেকে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছে। জানে, পুলিস সেই উৎসমুখের সন্ধান পেলেও ওকে ধরা-ছোঁওয়ার মধ্যে পাবে না। তাতেই একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা চালাতে ও গররাজি।

পুলিসে খবর দেবার প্রশ্নই ওঠে না। কেউ ওঁকে ব্ল্যাকমেলিঙ করবার চেষ্টা করছে। এ-জাতীয় এজাহার দেবার সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে–কী নিয়ে ‘ব্ল্যাকমেলিং’। এভিডেন্স হিসাবে ঐ ছয়খানি ছবি তাঁকে দাখিল করতে হবে। লোকটা ধরা পড়লে মামলা আদালতে উঠবে। আসামী পক্ষের উকিল ছবিগুলি প্রকাশ্য আদালতে…

নাঃ। সে অসম্ভব। বস্তুত এটাই হচ্ছে ‘ব্লাকমেলিং বিজনেসের’ বিউটি টাচ্‌! সারা বিশ্বে ব্ল্যাকমেলারদের হাতে অনিবার্যভাবে থাকে রঙের টেক্কাখানা। যতক্ষণ না সেটা টেবিলে নামানো হচ্ছে ততক্ষণ তাকে কেউ ছুঁতে পারে না। না ভিকটিম, না পুলিস। সম্মান বাঁচাতে গিয়ে, অপরাধটা গোপন করতে গিয়ে, কেলেঙ্কারিটা রুখতে গিয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। দশ-বিশ বছর আধপেটা খেয়ে, না-খেয়ে, হতভাগ্যের দল ব্ল্যাকমেলারকে টাকার যোগান দিয়ে চলে। উপায় নেই। ঐ রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে একবার পড়লে আমৃত্যু নিষ্কৃতি নেই! এটাই এ খেলার একপেশে নিষ্ঠুর নিয়ম!

কিন্তু প্রফেসর রঞ্জন তালুকদার যে জীবনে কখনো কারও কাছে হার মানেননি। মর-মানুষের কাছে। প্রণতির দুর্ভাগ্যটা নিতান্ত নিয়তি। তবু সেবার মাথা খাড়া রেখেই ঈশ্বর-নিক্ষিপ্ত–ঈশ্বর বলে যদি আদৌ কোনো সত্তা থাকে–বজ্রটা বুক পেতে গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু এবার?

.

রাত্রে আহারের অবকাশে তালুকদার জানতে চাইলেন আজ টি. ভি. তে ‘চিত্রহার’ ছিল না?

প্রণতি জানেন, এসব নিতান্ত ‘খেজুরে-আলাপ’। অধ্যাপক মশায়ের ওসবে আদৌ কোনো আকর্ষণ নেই। এ শুধু আলাপ-জমানোর অহৈতুকী প্রয়াস। বললেন, সেই অভদ্র লোকটা ফোন করেছিল? সাড়ে আটটায়?

–করেছিল! অভদ্র শুধু নয়, অসভ্য!

উনি মনগড়া এক দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন। বিপদ কখন কীভাবে আসবে জানা নেই। লোকটা নানাভাবে ওঁর গৃহের শান্তি বিনষ্ট করবার চেষ্টা করতে পারে। ভয় দেখাতে। সেক্ষেত্রে প্রণতিকে একটু-একটু করে তৈরি করতে হবে। আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে কিছুটা প্রস্তুতি থাকলে অজ্ঞাত আঘাতের আকস্মিকতার ধার কিছুটা ভোঁতা হয়ে যাবে। বড় জাতের শক ভাল নয় প্রণতির দুর্বল হৃদয়ের পক্ষে।

উনি যে গল্পটা ফাঁদলেন তাতে আছে এক ভিলেন। নানান পাপ কাজে সে হাত পাকিয়েছে। ওয়াগন ব্রেকার। ইলেকশনের সময় বুথ দখল করার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের প্রিয়পাত্র হয়ে পড়েছে। পুলিস তাকে ছুঁতে সাহস পায় না। ভয় পায়, তাহলে তাকে পাণ্ডববর্জিত স্টেশানে বদলি করে দেওয়া হবে। এ হেন মন্ত্রীমহলের প্রিয়পাত্র যে গুণ্ডা, তার একটি মাসতুত ভগিন আছে। চোরে-চোরে সম্পর্ক অথবা সত্যিই মাসির মেয়ে, জানা নেই, তবে মেয়েটি পড়াশুনায় ভাল। নাম মালিনী। এবার সে নাকি ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় পাস করেনি। ফেল করেছে তালুকদার-সাহেবের পেপারেই। তাই ঐ মস্তান ওঁকে টেলিফোনে শাসাচ্ছে। বলছে, মেয়েটাকে পাস করিয়ে না দিলে…

ভয়ে নীল হয়ে যান প্রণতি, তুমি…তুমি কী করবে?

–আরে, অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? এটা কলকাতা শহর!

–কলকাতা শহরে খুন-জখম হয় না? বিশেষ যদি প্রভাবশালী মন্ত্রী-টন্ত্রীর পোষা গুণ্ডা হয়?

–তুমি ভেব না। যা ব্যবস্থা নেবার আমি নেব। পুলিসের টপ-লিস্টে কল্যাণ আছে। কল্যাণ সেনগুপ্ত। তুমি তো চেনই। আমার প্রিয় ছাত্র। ওকে একটা ফোন করে দেব। ও মস্তান পার্টিকে কড়কে দেবে।

.

পরদিন এল জগদীশের ফোন : জামাইবাবু, তোমার সেই ছাত্রটি লোক সুবিধের নয় কিন্তু….

–কোন ছাত্রটি?

–ঐ যে সুবল মিত্তির না সলিল মিত্তির। ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে থাকে বলে যে তোমার অ্যাড্রেসটার সুযোগ নেয়।

–তাই নাকি? তুমি কী করে জানলে?

–কাল একটা মিস্টিরিয়াস টেলিফোন পেয়েছি। বুঝলে? প্রথমে আমার নামটা জেনে নিয়ে লোকটা জানতে চাইল তুমি আমার ভগিনীপতি কি না। স্বীকার করায় বললে, তোমার এক ছাত্র কিংবা ‘কোলীগ’ সলিল মিত্র একটা মেয়ের সঙ্গে লটঘট করছে। মানে, ‘ইল্‌লিসিট কানেকশন’। মেয়েটার নাম মালিনী। ওর মামাতো বোন। ও আমাকে বলেছে তোমাকে অনুরোধ করতে, যেন সলিল মিত্র মালিনীর সঙ্গে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়।

–‘ব্যাপারটা’ মানে?

–পরিষ্কার করে বলেনি। হয় ‘মানি-সেটলমেন্ট’ অথবা বিয়ে করা। ঠিক বোঝা গেল না।

–আই সী! কথা শুনে তোমার কি মনে হল ও লোকটা লেখাপড়া জানা বাঙালী…

–আদৌ নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও পশ্চিমা মুসলমান। লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা। ভাঙা-ভাঙা বাঙলা বলতে পারে মাত্র…

–বুঝলাম। তুমি আমাকে দুটো শব্দ শুনিয়ে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। একটা ‘লটঘট’ একটা ‘ইল্‌লিসিট কনেকশন’। ও নিজে কোনটা ব্যবহার করেছিল, জগু? ঐ মিস্টিরিয়াস লোকটা?

–কেন বল তো, রঞ্জনদা?

–তোমার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী লোকটা ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতে পারে। ফলে ‘লটঘট’ শব্দটা সে ব্যবহার করবে না। কথিত বাংলায় যার যথেষ্ট দখল তার পক্ষেই শব্দটা ব্যবহার্য। আবার পড়াশুনায় যে অষ্টরম্ভা তার পক্ষে ‘ইস্‌লিসিট কনেকশন’ শব্দের প্রয়োগ…

–তাই তো। আমার যতদূর মনে পড়ে ও ‘ইস্‌লিসিট কনেকশন’ শব্দটাই ব্যবহার করেছে।

–তাহলে পড়াশুনায় সে অষ্টরম্ভা নয়। কেমন? কী নাম বলেছে?

–বললে তো ‘মাস্তান’। আমার বিশ্বাস হয় না। বাবা-মা কোনো সদ্যোজাত সন্তানের নাম ‘মাস্তান’ রাখতে পারে?

–পারে, যদি ‘মাস্তানির’ সহজাত কবচ-কুন্ডল নিয়ে সে মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে। যা হোক, তুমি চিন্তা কর না, আমি সলিলকে জিগ্যেস করে যথোচিত ব্যবস্থা করব।

.

সেদিন কলেজেও এক কাণ্ড হল।

প্রিন্সিপাল-সাহেব তাঁর চেম্বারে ওঁকে ডেকে পাঠালেন। কলেজ সংক্রান্ত এ-কথা সে-কথার আলাপ আলোচনা হল কিছুটা। ইউ. জি. সি-র গ্রান্ট, কেমিস্ট্রি ল্যাবের এক্সপ্যানশন ইত্যাদি। তারপর সৌজন্যবোধে মিসেস তালুকদারের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কিছু তত্ত্বতলাশ নিলেন। অতঃপর তাঁর ঝুলি থেকে বার করলেন বেড়ালছানাটিকে : আপনাকে একটি ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করছি প্রফেসর তালুকদার, কিছু মনে করবেন না। ‘সলিল মিত্র’ নামে আপনার কোনো নিকট আত্মীয় আছে?

ক্ষুরধার বুদ্ধির মানুষটি তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেন ব্যাপারটা। ওঁর মনে পড়ে যায় অ্যালিস্টার ম্যাকলিন-এর একটি ক্রাইম থ্রিলার-এর কথা : ‘ফিয়ার ইজ দ্য কী!’ ভয়! আতঙ্ক! তিল-তিল করে প্রয়োগ করতে হয়। মাস্তান নামে ঐ যে ছেলেটি ওঁর সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে নেমেছে সে চায় চারিদিক থেকে ওঁকে ঘিরে ধরতে। প্রকারান্তরে সে বুঝিয়ে দিতে চায়–ওঁর আত্মীয়-স্বজন, ওঁর কর্মস্থলের উপরওয়ালার সব সন্ধান সে যোগাড় করেছে। চতুর্দিকেই সে বোমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সব বিস্ফোরকই এক সূত্রে আবদ্ধ। ওঁর প্রত্যাখ্যানমাত্র ‘ফিউজ’-এ অগ্নিসংযোগ করা হবে। মুহূর্তমধ্যে কলকাতা শহরের সবচেয়ে নামকরা কলেজের অতি সম্মানীয় কেমিস্ট্রির অধ্যাপক রঞ্জন তালুকদার পি. আর. এস. ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন! ‘ফিয়ার ইজ দ্য কী?’ তিনটি দিন সময় সে দিয়েছে ওঁকে। শুধু টাকা সংগ্রহের জন্য নয়, পঁচিশ হাজার টাকাকে ছোট ছোট ব্যবহৃত নোটে রূপান্তরিত করতেই শুধু নয়–ঐ বাহাত্তর ঘণ্টা ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে থাকতে!

তালুকদার বললেন, আমার উপাধি শুনে ঠিক বোঝা যায় না স্যার যে, ‘তালুকদার’ একটা নবাবী খেতাব। আমার পূর্বপুরুষরা পেয়েছিলেন। বাস্তবে আমরা বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। ‘মিত্র’ কীভাবে আমার নিকট আত্মীয় হবে?

–না, মানে, আজকাল তো অসবর্ণ বিবাহ ঘরে-ঘরে। তাই বলছি। ব্যাপারটা কী জানেন?…

একই কাহিনী। অজ্ঞাতনামা একটি অবাঙালী লোক ভাঙা-ভাঙা বাংলায় প্রিন্সিপাল-সাহেবকে টেলিফোনে একটি অনুরোধ করেছে। তার অভিযোগ : প্রফেসর তালুকদারের এক নিকট আত্মীয় সলিল মিত্র আবেদনকারীর পিসতুতো ভগিনীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। বিস্তারিত কিছু সে বলেনি। শুধু আর্জি পেশ করেছে যাতে প্রফেসর তালুকদার মধ্যস্থতা করে ঐ সলিল মিত্র আর তার ভগিনী মালিনীর ‘মানি-সেটলমেন্ট’ কেসটা তাড়াতাড়ি ফয়শালা করে দেন।

তালুকদার সরাসরি জানিয়ে দেন, আজ্ঞে না। লোকটা কোথাও কিছু ভুল করেছে। সলিল মিত্র নামে আমি কাউকে চিনি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *