আম্রপালী – ১৪

১৪.

শনিবার রাত সাড়ে আটটায় যথারীতি টেলিফোন করল লোকটা।

প্রশ্ন মাত্র বিস্তারিত নির্দেশ দিয়ে গেল।

টাকাটা হস্তান্তরিত করতে হবে ভবানীপুরে। নর্দার্ন পার্কে। রবিবার দুপুরে কাঁটায়-কাঁটায় বেলা আড়াইটায়। নর্দান পার্কটা কোথায়? শুনুন বলি : শরৎ বসু রোড ধরে উত্তরমুখো আসছেন দেশপ্রিয় পার্ক থেকে। কেমন তো? পদ্মপুকুরের পরের স্টপেজ চক্রবেড়িয়া। সেখান থেকে জাস্টিস্ চন্দ্ৰমাধব রোড ধরে পশ্চিমমুখো চলতে হবে। বাঁ-হাতি গুজরাতীদের মেটার্নিটি হোম পার হলেন। তার পরেই নর্দার্ন পার্ক। তার উত্তর-পূর্ব কোণের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ধুতি পাঞ্জাবি পর দণ্ডায়মান মূর্তি। তাঁর পাদমূলে–একটু দূরে–একটি বেঞ্চি পাতা। উপরে ছাউনি। ভরদুপুরে সেখানে জনমানব থাকবে না। সেখানেই ও প্রতীক্ষা করবে। নেহাৎ ঘটনাচক্রে তখন যদি ওখানে কোনো বেগানা লোক কেউ থাকে তাহলে ও বসে থাকবে আশেপাশের কোনও ফাঁকা বেঞ্চিতে। পরিধানে জীনস্-এর জীর্ণ প্যান্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে পাকা টোম্যাটো রঙের স্পোর্টস গেঞ্জি, পায়ে হান্টিং শু, মাথায় ইলাসটিক ব্যান্ডে বাঁধা পীজবোর্ডের হুড–ক্রিকেট-মরশুমে যা ইডেন-গার্ডেন্সে-এ হাজারে হাজারে দেখতে পাওয়া যায়।

এমন বিচিত্র সাজ-পোশাকে ঐ ভরদুপুরে ঐ পার্কের বেঞ্চিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকার সম্ভাবনা নেই। ভুল হতেই পারে না। তবু সাবধানের মান নেই। ছেলেটি প্রফেসর তালুকদারকে চেনে। ওঁকে দেখতে পেলেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করবে, ‘কটা বাজে, স্যার? আমার হাত-ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে।’

উনি লক্ষ্য করে দেখে নেবেন ওর হাতে শুধু ব্যান্ডই আছে, ঘড়ি নেই। তখন আদান-প্রদান হবে। ছেলেটি ওঁকে প্রথমে দেবে খোলা খামে এক সেট ছবি। সেটা যাচাই করে নিয়ে উনি বার করে দেবেন রসিদ আর স্ট্যাম্প প্যাড। টিপছাপ দেওয়া শেষ হলে উনি ওঁর কাঁধের ঝোলা-ব্যাগটা থেকে টাকার বান্ডিলটা বার করে দেবেন। সেটা যেন কাগজে ভাল করে জড়ানো ও দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে।

তালুকদার জানতে চান, তুমি বারে বারে, ‘ছেলেটি ছেলেটি বলছ, তার মানে কি বলতে চাও তুমি নিজে আসবে না?

–আজ্ঞে না স্যার। এত বড় মূর্খামি আমি করব না। নিজেই আসব।

–মূর্খামি কেন বলছ?

–ধরুন, আমি রাম-শ্যাম-যদুকে পাঠালাম, আর শালা ফিরে এসে বললে, ‘প্যাকেট তো নিয়ে এসেছি গুরু, কিন্তু তাতে একখানা নোটও নেই। শুধুই পুরনো কাগজ ঠাসা!’ তখন? কী করে বুঝব, কোন শালা তঞ্চকতা করল, আপনি না আমার চ্যালা?

–তার মানে তুমি টাকাটা গুনে নেবে না?

–কেমন করে নেব, স্যার? ভরদুপুরে স্বয়ং নেতাজীর পায়ের তলায় বসে ওখানে ব্ল্যাকমেলিঙের নোট আমি গুনতে পারি? গোনা শেষ হতে হতে তো দেখব স্টেনগানধারী পুলিসে নর্দার্ন পার্ক ছেয়ে ফেলেছে।

–আই সী! কিন্তু আমি যদি তোমাকে পঁচিশের বদলে বিশ দিই?

–বিষ যখন দিতে পারছেন না তখন বিশও দিতে পারেন না। নেগেটিভের হাইড্রোজেন বোমা যে আমার হেপাজতেই রয়ে গেল। বুঝেছেন?

অধ্যাপক তালুকদার নীরবে কী যেন ভাবতে থাকেন।

–কী হল? জবাব দিলেন না যে? আপনি লাইনে আছেন তো?

বৃদ্ধ গম্ভীরভাবে বললেন, আছি। মন খুলে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, মস্তান। হয়তো তুমি আমার ছেলের বয়সী। তাই কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। তুমি আমাকে এই নোংরা কাজটা করতে বাধ্য কর না, মস্তান। এতে তোমার ভাল হবে না!

টেলিফোনে ভেসে এল উদ্ধত যুবকের অট্টহাস্য। বললে, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার নরকযন্ত্রণার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু নিজের ভালমন্দর কথা চিন্তা করুন। আপনাকে বরং একটা শেষ কথা বলে নিই, স্যার;

পুলিসে খবর দিলে কিন্তু খেল খতম! কলেজে কেমিস্ট্রি লেকচার থিয়েটার ক্লাসের মধ্যেই আপনার লাশ ফেলে দেব। আমার সঙ্গে বেইমানি করে কেউ কখনো পার পায়নি, স্যার। তিনটে ডাকাতি, পাঁচটা রেপ-কেস আর দু-দুটো খুনের মামলা আমার মাথায় ঝুলছে, বুয়েছেন? তার ভিতর একটা আবার পুলিস–এক শালা পুলিস। কেদ্দানি দেখাতে গিয়ে আনফরচুনেটলি আমার গুলিতেই ফৌত হয়েছিল। তবু দেখুন, আমি জামিনে ছাড়া! পুলিস আজও কোনও ‘আই-উইটনেস্’ যোগাড় করতে পারেনি। পারবে কোথা থেকে? সাক্ষী দিতে রাজি হলেই সে শালা হাফিজ! তাই পুলিস ডিপার্টমেন্টে আমি-শালা অচ্ছুৎ! বুয়েছেন?

বৃদ্ধ অধ্যাপক গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ মস্তান?

–আজ্ঞে না! কলেজে আপনার খুব সুনাম শুনি কিনা। সবাই বলে আর. কে. টি. খুব সৎ আর প্রচণ্ড সাহসী। তাঁর নাকি দারুণ বুদ্ধি! তাই আপনাকে একটু সাবধান করে দিচ্ছি, এই আর কি। ও-সব থানা-পুলিসের ন্যাকড়াবাজিতে যাবেন না। জানে মারা যাবেন? আর যদি ‘পোলিটিকাল দাদা-টাদা’ থাকেন–ঐ যাঁরা হাতে মাথা কেটে থাকেন, তাঁদের কাছেও নয়। জানেনই তো, পাঁচটি বছর হাতে মাথা কাটার পর ওঁরা ভিক্ষাপাত্র হাতে পথে নামেন–দেশসেবা করবার আর্জি নিয়ে –আপনার ভোটটা আমাকে কাইভলি দেবেন, স্যার?’ সেই দেশসেবকদের টিকি বাঁধা থাকে আমাদের কাছে।

নিঃশব্দে রিসিভারে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

বুঝতে পারেন : ও মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না। মৃত্যু ওকে টানছে! তাই সগর্বে ও ঘোষণা করেছে ওর কীর্তিকাহিনী! এটাই এখন স্বাধীন ভারতবর্ষের ট্র্যাজেডি।

ইংরেজের অপশাসনের হাত থেকে দেশটাকে স্বাধীন করতে যারা প্রাণপাত করেছিলেন, কালের ধর্মে তাঁরা ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছেন ইতিহাসের নেপথ্যে। এখন এগিয়ে আসছে আর এক জাতের অপশাসক। স্বার্থান্ধ, স্বজনপোষক, মিথ্যাচারী! দেশশাসনের নামে দেশশোষণ করতে তারা হিটলারী পদ্ধতিতে পোষে নিজ নিজ দলের গেস্টাপো বাহিনী : গুণ্ডা, মস্তান, মাসম্যান, প্রফেশনাল খুনী! পলিটিকস্ আজকের দিনে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে ইচ্ছে করে এমন দেশসেবক আজও ক্কচিৎ দেখা যায়–তাঁরা অব্যতিক্রম দেশের নির্বাচনে প্রার্থী হন না। হয় গান্ধীবাদী, নয় সুভাষবাদী অথবা অগ্নিযুগের শেষ অবশেষ। তারা ক্লান্ত! তাঁরা বিভ্রান্ত। তাঁরা খবরের কাগজও পড়েন না। ভোট দিতেও যান না। কাকে দেবেন?

দেশের ভালমন্দ নির্ধারণ করেন, দেশশাসন তথা দেশশোষণ করেন, আপনার আমার নির্বাচিত প্রতিনিধির দল।

পাছে আমরা নির্বাচনে ভুল করে বসি, তাই দেশসেবক জনপ্রতিনিধিরা নানান ব্যবস্থা করে রেখেছেন। শাসকদলের মতাদর্শের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে ওঁরা সে কণ্ঠকে নীরব করিয়ে দেন। লেলিয়ে দেন পোষা গুণ্ডা। গৌরবে তাদের বলা হয়– পার্টি ক্যাডার।

দিল্লী শহরের পথে-ঘাটে নাটক করে বেড়াতে একটি প্রাণবন্ত তরুণ। সস্ত্রীক। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স তার। জন্মসূত্রে মুসলমান। মুশকিল এই : আহাম্মকটা সাম্যবাদী। বোঝ বখেড়া। কী দরকার তোর এই চূড়ান্ত অ-সাম্যের দেশে সাম্যবাদ নিয়ে আমড়াগাছি করার? মিলমালিক কী-কায়দায় মজদুরকে শোষণ করে, বড় জোতদার কীভাবে বর্গাদারকে ভূমিহীন মজুর চাষীতে রূপান্তরিত করে, ডাইনাস্টিক রুলে দেশশাসক কীভাবে দেশশোষক হয়ে যায়, তা নেচে-কুঁদে দেখালে কি তোর চারটে হাত গজাবে? পার্টি-মস্তান গোপনে হুমকি দিলেন : ‘বন্ধ কর য়্যে নটুঙ্গীখেল’! মূর্খটা শুনলো না। পড়িলিখি ইনসান! ‘Right to Perform’ নামে একখানা কিতাব লিখেছে অংরেজিতে-–পড়ে দেখ–কী দারুণ বিদ্যে! পোষ মানলে বকরি নোকরি-ছুকরি সবই পার্টি থেকে দেওয়া হতো। লেকিন, শুনল না। অগত্যা! একদিন পথ-নাটকের মাঝখানে ট্রাকে চেপে হামলা করল গেস্টাপো বাহিনী। ঝাঁপিয়ে পড়ল নাটকের কুশীলবদের উপর। ওর ঔরৎটা জানে বেঁচে গেল, ও জান বাঁচাতে সেকলো না! ক্যা আপসোস্ কি বাত! শত শত দর্শকের সামনে লুটিয়ে পড়ল নাট্যকার! কলিজার খুনে ভেসে গেল দিল্লীর রাজপথ!

আদালতে মামলা উঠল! পার্টি-পেপার ব্যতীত সমগ্র ভারতের সংবাদপত্র এই নৃশংস বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানালো। মায়, সারা-ভারত টি. ভি. স্ক্রীনে দেখল চলচ্চিত্র উৎসবে শাবানা আজমি প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল–শাসকদলের বেইজ্জতির চূড়ান্ত। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রকাশ্যে স্টেটমেন্ট দিলেন, ‘হামে কদম উঠানা চাহিয়ে কি য়্যে গুণ্ডোলোগোঁ কি বদমাসি বন্ধ কিয়া যায়…’

‘কদম’ কতটা উঠেছিল প্রফেসর তালুকদার জানেন না, তবে ‘কর্দম’ উঠেছিল। অনেকটাই। আদালতে যখন মামলা উঠল তখন সহস্র দর্শকের ভিতর একটিও প্রতক্ষ্যদর্শীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রায় সমান্তরাল ঘটনা ঘটে গেল ওঁর নিজের শহরে–এই তো সেদিন। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন পদস্থ মধ্যবয়সী মহিলা অফিসারকে রেডক্রস-ছাপমারা গাড়ি থেকে টেনে নামানো হল। একহাট লোকের সামনে মস্তান-পার্টি ঐ মহিলাকে বিবস্ত্র ও হত্যা করল। এ ভদ্রমহিলা কিন্তু দিল্লীর সেই তরুণ নটুয়ার মতো কোনো একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করতে রাস্তায় নামেননি। সমাজকল্যাণ দপ্তরের তিনি এক সম্মানীয় অফিসার। সরকারী কাজে ট্যুরে বেরিয়েছিলেন। রাজনীতির ধারে কাছে নেই। তবে হ্যাঁ, দুর্জনে বলে, তিনি নাকি একটি তদন্তও করছিলেন : এক আন্তর্জাতিক সংস্থার বিনামূল্যে প্রেরিত ঔষধপত্র কীভাবে চোরাবাজারে বিক্রয় হচ্ছে সে বিষয়ে তদন্ত!

এবারেও হাটের কেন্দ্রবিন্দুতে অনুষ্ঠিত ঐ নাটকের–দুঃশাসনকর্তৃক দ্রৌপদীবস্ত্রহরণ পালার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই! হত্যার সময়ে হাজার হাটুরে যে চোখ খুলে ছিল এমন প্রমাণ নেই, তবে কমিশনের সামনে কেউ যে মুখ খুলবার সাহস পায়নি তার প্রমাণ আছে।

আমরা শুনলাম–আদালতে নয়, বাইরে : ‘এমন তো হয়েই থাকে!’

ফলে, ঐ অজ্ঞাতপরিচয় মস্তান যা দাবী করেছে, তা মিথ্যা আস্ফালন নয়। সত্যই জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ার আড়ালে ও যথেচ্ছাচার করে যাচ্ছে। ‘যুগ-যুগ জিও’ আইনে করে যাবেও। ছেলেটা কথাপ্রসঙ্গে ওঁকে ‘আর. কে. টি.’ নামে অভিহিত করেছে। অর্থাৎ ছাত্রমহলে ওর যাতায়াত আছে।

এ কথা নিশ্চিত : ও যদি ‘কেমিক্যাল ল্যাব’-এর ভিতর অথবা লেকচার থিয়েটারে ঢুকে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ওঁকে গুলি করে মেরে ফেলে, তারপর শিস দিতে দিতে কলেজ থেকে বেরিয়ে যায়, মোটর বাইকে চেপে হাওয়া হয়ে যায়–তাহলে, পরে পুলিস রোল-কলের খাতা মিলিয়ে একচল্লিশটি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একটিও প্রত্যক্ষদর্শী উদ্ধার করতে পারবে না।

এই আজকের সমাজ-ব্যবস্থা।

আর্দশের জন্য মরতে উনি ভয় পান না! কিন্তু প্রণতি! তার কী হবে? যদি এ অসম যুদ্ধে সাহসিকতা দেখাতে গিয়ে…।

নাঃ। উপায় নেই! ছোকরার প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া!

পঁচিশ হাজার টাকার জন্য দুঃখ করছেন না। ওঁর কোনো ওয়ারিশ নেই। প্রণতির আজীবন ভরণ-পোষণ-সেবাযত্নের জন্য টাকা জমা দেওয়া আছে ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে–যদি দৈবাৎ ওঁর ডাক আগে এসে যায়। বাকি অর্থের কিছুটা পাবে তোতন। বাকিটা শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন। পঁচিশ হাজার টাকার অঙ্কটা সেদিক থেকে কিছুই নয়।

বেদনা দু-তরফা।

এক : ঐ নরকের কীটের কাছে হার মানা। এদিকে মাস্তান ওঁকে দোহন করছে। আর ওদিকে লালমোহন কৃষ্ণার বডি নামিয়ে দিচ্ছে তার বাপের দাওয়ায়! উনি প্রতিবাদ করতে পারছেন না।

দুই : নিজের ভ্রান্তি! উনি সঠিক কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করতে পারলেন না! ক্যালসিয়াম, সিলিকা আর সোডা অ্যাশ-এর মিশ্রণকে আইডেন্টিফাই করলেন ‘ক্রিস্টালাইজড রেগুলার অক্টাহেড্রনাস স্ফটিক’ বলে। সোজা কথায় বেলোয়ারী কাঁচকে হীরকখণ্ড বলে ভুল করলেন আজন্ম অদ্বিতীয় কেমিস্ট্রির অধ্যাপক! ভুলটা হল কখন? ঠিক কোথায়? হ্যাঁ, মনে পড়েছে! ও যখন বললে, ‘তোমাকে তোমারি অস্ত্রে বধ করব এবার! বলতো, অধ্যাপক, বুদ্ধযুগে, একজন অযোনিসম্ভবা জনপদকল্যাণী সে-কালীন শ্রেষ্ঠ ভেষগাচার্যকে গর্ভে ধারণ করে…’

তখনি, ঠিক তখনি, ওঁর সব ভুল হয়ে গেল। উনি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে ফেলেছিলেন অর্ধ-অনাবৃতার বাহুমূল! না, না, কামপরবশ হয়ে নয়, তবে হ্যাঁ, উত্তেজনায়.! ওঁর মনে পড়ে গেছিল মাতা আম্রপালীর কথা!

হ্যাঁ! রূপোপজীবিনী রাজনটী আম্রপালী নয়, বৌদ্ধ ভিক্ষুণী : ‘মাতা’ আম্রপালী!

.

আম্রপালী! তাঁর জন্ম নিয়ে নানান কিংবদন্তী। বিনয় পিটক অনুসারে তিনি স্বয়ম্ভু, অযোনিসম্ভবা! বৈশালী নগরী তখন লিচ্ছবীদের রাজধানী। সেই নগরীপ্রান্তে এক আম্রকাননে পূর্ণযৌবনারূপে আম্রপালীর আবির্ভাব। সকলকলাপারঙ্গমা এই উর্বশীবিনিন্দিতাকে মহিষী করার জন্য একযোগে লিচ্ছবীরাজের কাছে আবেদন করলেন প্রতিবেশী রাজন্যবর্গ। সকলেই মহাক্ষত্রপ : ক্রৌঞ্চ, শাক্য, মগধ, পাঞ্চাল। অযুত পাণিপ্রার্থীর ভিতর মাত্র একজনকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব–মগধ ব্যতিরেকে, কারণ মগধরাজ বিম্বিসার লিচ্ছবিদের শত্রু–কিন্তু বাদবাকি সবাই যে তাহলে অসন্তুষ্ট হয়ে যাবে। লিচ্ছবি মহারাজ তখন ‘গণ’-এর শরণ নিলেন। গণ হচ্ছে ‘সিটি কাউন্সেল’–নগর প্রধানদের পঞ্চায়েত।

গণ নির্দেশ দিলেন : আম্রপালী হবে জনপদকল্যাণী, শত্রু ভিন্ন সর্বজনভোগ্যা!

আম্রপালী হল স্বৈরিণী, রাজনটী।

নগরীর রাজপুরুষ, শ্রেষ্ঠী তো বটেই বিদেশী ক্রৌঞ্চ, শাক্য, পাঞ্চালের সওদাগরেরাও অর্থমূল্যে এই নাগরীর শয্যাসঙ্গী হবার সৌভাগ্যলাভ করল। এমনকি লিচ্ছবি প্রহরীদের চোখে ধূলো দিয়ে ছদ্মবেশে স্বয়ং মগধরাজ বিম্বিসারও গঙ্গা পার হয়ে রাত্রিবাস করে যেতেন ঐ পণ্যাঙ্গনার প্রমোদভবনে।

ভাগ্যের এমনই বিড়ম্বনা–ঐ শত্রুরাজ বিম্বিসারের ঔরসেই গর্ভবতী হল আম্রপালী!

পুত্রের নাম জীবক। কিন্তু লিচ্ছবীরাজের আদেশে তার চূড়াকরণ হল না, বিদ্যারম্ভ হল না। মাতার কাছে সর্ববিদ্যা অধ্যয়ন করতে থাকে জীবক, পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ ভেষগাচার্য!

আমাদের কাহিনীর কালে আর্যাবতের শ্রেষ্ঠ মানুষ শাক্যসিংহ। তিনি তখন পরিব্রাজক। কিন্তু রাজচক্রবর্তী মগধাধিপতি বিম্বিসার। জাহ্নবীর দক্ষিণপাড়ে পাটলীপুত্র, উত্তরে বৈশালী।

দিন যায়! আম্রপালী এখন তার বিশাল প্রমোদভবনে অন্তরীণ। কেউ তার সন্দর্শনে যেতে পারে না। রাজাদেশে। কারণ আম্রপালী শত্ৰুপুত্রকে গর্ভে ধারণ। করেছে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তাই স্বগৃহে অন্তরীণ।

তারপর একদিন।

বৈশালীতে এলো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ভগবান বুদ্ধ চলেছেন কুশীনগর : বৈশালীর উপর দিয়ে। এক রাত্রি তিনি বাস করে যাবেন মহানগরীতে। মহাপরিব্রাজক তখন অতি বৃদ্ধ, সঙ্গে আছেন মহা মৌদগল্ল্যায়ন, সারিপুও এবং আনন্দ। লিচ্ছবিরাজ ধন্য হয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদ, সুসজ্জিত করা হল এই আশায় যে, শাক্যসিংহ সপার্ষদ সেখানেই রাত্রিবাস করবেন।

নগরপ্রান্তে আম্রকাননে উন্মুক্ত আকাশের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন সপার্ষদ তথাগত। সমস্ত নগরীর নরনারী সে-সন্ধ্যায় সমবেত হয়েছে ঐ আম্রকাননে, পরমকারুণিকের দর্শনে। এমনকি–কী দুঃসাহস–সেই জনারণ্যে অবগুণ্ঠনে মুখ আবৃত করে উপস্থিত হয়েছে ঐ পাপিষ্ঠা! কী অপরিসীম দুঃসাহস! কানীন পুত্রটিকেও নিয়ে গেছে সঙ্গে করে।

দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলে লোকুত্তমের ধ্যানভঙ্গ হল। জনতার প্রথম সারি থেকে একযোগে দণ্ডায়মান হলেন লিচ্ছবীরাজ মহানাম, নগরশ্রেষ্ঠী এবং গণপ্রধান। সকলেই চাইছেন সপার্ষদ বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ করতে। কিন্তু তাঁরা কিছু নিবেদন করার পূর্বেই জনতার লক্ষ্য হল–মহাকারুণিকের করুণাঘন দৃষ্টি নিপতিত হয়েছে জনারণ্যের শেষপ্রান্তে এক অন্তেবাসিনীর উপর।

শাক্যসিংহ সহাস্যে বললেন, আম্রপালিকে! বৈশালী নগরীতে অদ্য রাত্রি অতিবাহিত করতে চাই। তোমার সর্বতোভদ্রে আমাদের ভিক্ষু কয়জনের ঠাঁই হবে?

পরিবর্তে সভাস্থলে বজ্রপাত হলেও জনতা এমন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হত না।

‘সর্বতোভদ্র’! সর্বশ্রেষ্ঠ ভদ্রাসন! ঘৃণিত দেহোপজীবিনীর গণিকালয়!

আম্রপালী উঠে দাঁড়াল। কয়েকপদ অগ্রসর হয়ে এল। কী যেন বলতে গেল। পারল না। ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল তার। নতজানু হয়ে বসে পড়ল মহামানবের পদপ্রান্তে।

মহাভিক্ষু সারিপুত্ত বললেন, জীবমাতা! ভগবান বুদ্ধ তোমার আতিথ্য ভিক্ষা করেছেন। তুমি তাকে আমন্ত্রণ করবে না?

না! পারবে না! কিছুতেই পারবে না! সেই পতিতালয়ে গণিকা আম্রপালী কেমন করে আহ্বান জানাবে ‘লোকুত্তম’কে? হতভাগিনী তার অনিন্দ্য-আননটি নীরবে নামিয়ে আনে সহস্রদল পদ্মের মতো যুগলচরণে–আযৌবনের অযুত পরুষ-পুরুষস্পর্শের পুরীষ অশ্রুর বন্যায় ধৌত হয়ে গেল।

লিচ্ছবীরাজ ও গণ-এর পরাজয় ঘটল।

সেই ঘৃণিতা দুর্বিনীতা রাজনটী–যে আশ্রয় দিয়েছিল লিচ্ছবীদের চিরশত্রুকে আপন শয়নকক্ষে, যে সেই মহাপাষণ্ডের বীর্যকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করে পাপের পশরা পূর্ণ করেছে–সেই কলঙ্কিনীর হল জয়!

ভগবান বুদ্ধ সশিষ্য অতিথি হলেন নটীর প্রমোদভবনে।

পিটককার বলেননি –আহা, কেন বলেননি– সেই অবাক-রাত্রিতে মহাকারুণিক কী উপদেশ দিয়েছিলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে–ঐ হতভাগিনী কানীনপুত্রের জননীকে! বস্তুত আদৌ কোন উপদেশ যে তিনি দিয়েছিলেন তারও উল্লেখ নেই, ইঙ্গিত নেই। বোধকরি সেরাত্রে আম্রপালীর অন্তরে মুক্তির জন্য এমন একটি ঐকান্তিক আকুতি তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যার জন্য মৌখিক উপদেশ ছিল বাহুল্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *