আম্রপালী – ৬

০৬.

আরও সাতটা দিন কেটে গেছে। তারপর।

আবছা মনে পড়ে অভিজ্ঞতাটা। ঘোর-ঘোর বিস্মৃতির একটা কুয়াশা জড়ানো। এল. এস. ডি, বা মারিজুয়ানা সেবনের স্বর্গসুখস্মৃতি যেন! মনে পড়ে, আচমকা ডোর-বেলটা আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন ওঁরা দুজনেই আদম-ঈভ! ঘরে সর্বক্ষণ একটা জোরালো বাতি জ্বলছিল। এত প্রখর আলো ওঁর ভাল লাগছিল না। মেয়েটি শোনেনি। বলেছিল, ‘আমরা কি চুরি করছি’? ডোর-বেলটা আচমকা বেজে উঠতেই মেয়েটি হাত বাড়িয়ে চট করে নিবিয়ে দিল বাতিটা। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, পালাও। ও এসে গেছে!

–ও? ও কে?

–ডোন্ট আস্ক কোশ্চেনস্। নাও, পরে নাও।

অন্ধকারে ওঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ড্রয়ার, গেঞ্জি, প্যান্ট, শার্ট!

আবছা অন্ধকারে খানিকটা নিজে নিজে পরলেন, খানিকটা ও পরিয়ে দিল। ‘জিন’-এর প্রভাব ততক্ষণে জম-জমাট!

–এস, আমার সঙ্গে এস। কোথায়, তা জানতে চাননি। বেডরুমের সংলগ্ন টয়লেটে একটা ছোট একপাল্লার দরজা। বাইরের করিডোর থেকে জমাদারের আসার পথ। সেই দরজাটা খুলে ও বলল, বাঁ দিকে লিফট।

–আর তুমি?

–আমার জন্যে ভাবতে হবে না। আই নো হ্যোয়ার আই স্ট্যান্ড!

তা বটে! এটা ফ্রিনের নিজস্ব সাম্রাজ্য!

কিন্তু ‘ও’ কে? সোন্ধী? তার সঙ্গে তো ওর ডির্ভোস হয়ে গেছে। ও তো নিজেই বলেছে, ও মিসেস সোন্ধী নয়!

ঠিক তখনই লিটা এসে দাঁড়ালো আট নম্বর ফ্লোরে। স্বয়ংক্রিয় লিফটে দ্বিতীয় যাত্রী ছিল না। ফলে কেউ জানতে পারল না, ওঁর জামার বোতামগুলো ভুল ঘরে লাগানো।

অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই দাঁড়িয়েছিল একটা ট্যাক্সি। সৌভাগ্যই বলতে হবে। তখন ওঁর শারীরিক অবস্থা খুব জুতের নয়। যোধপুর পার্কে নিজস্ব বাড়ির নম্বরটা তা বলে ভুলে যাননি। ট্যাক্সি থেকে নেমে মানিব্যাগ খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে দিয়েছিলেন সে কথা মনে আছে। কিন্তু লোকটা ভাঙানি ফেরত দিয়েছিল কিনা সেটা মনে পড়ে না।

দিন-সাতেক পরে সাহসে ভর করে ফোন করলেন ওকে। রামু তখন বাজারে। প্রণতি অঘোরে নিদ্রায় অভিভূত। বারদুয়েক রিঙিং টোনের পর ও-প্রান্তে সাড়া জাগল : ইয়েস, সোন্ধী স্পিকিং।

ইংরেজিতে বললেন, মালিনী আছে? একটু ডেকে দেবেন?

–হু?

–ডিয়ার মি! ওর নাম কি তাহলে মালিনী নয়? এটা এইট বাই টোয়েন্টি মেঘচুম্বিত অ্যাপার্টমেন্টস’ তো?

–দ্যাটস রাইট। কী নাম বললেন? মালিনী?

–নামটা ভুলও হতে পারে। আমি লিখে রাখিনি। বয়স প্রায় ত্রিশ।

–আ-ইয়েস! মালিনী। তাই বলুন। ও বাথরুমে আছে। একটু লাইনটা ধরুন। কী নাম বলব? কে নে করছেন?

–মিত্র, সলিল মিত্র।

ওঁর স্পষ্ট মনে হল টেলিফোনের ‘কথামুখে’ হাত-চাপা দিয়ে ও-প্রান্তবাসী ইংরেজিতে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘মালিনী তোমাকে টেলিফোনে সাম মিস্টার মিত্র খুঁজছেন। তোমার কি বাথরুম থেকে বার হতে দেরি হবে?

তারপর একটু নীরবতা। বাথরুম থেকে কেউ কিছু বলল কি না বোঝা গেল না। অন্তত টেলিফোনে কোনো শব্দ ভেসে এল না। তারপর ভদ্রলোক টেলিফোনে বললেন, মালিনীর দেরী হবে বাথরুম থেকে বের হতে। ও রিং-ব্যাক করবে বলল! আপনার নম্বরটা কাইন্ডলি…

তালুকদার সর্তক হয়ে উঠেছেন ইতিমধ্যে।

বলেন, আমার বাড়িতে ফোন নেই। পোস্টঅফিস থেকে ফোন করছি।

–আই সি! ধরুন!

আবার ‘কথামুখে’ হাত চাপা দিয়ে ভদ্রলোক উচ্চকণ্ঠে কাকে যেন ইংরেজিতে বললেন, ওঁর ফোন নেই। কী বললে? অ্যাড্রেস? ও আচ্ছা…ঠিক আছে লিখে রাখছি…

এই কথাগুলি মাউথপিসে ফাঁকা-আঙুলে হাত চাপা দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলা হল। তারপর ও-প্রান্তবাসী বেশ সহজকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, এক্সকিউজ মি, মিস্টার মিত্র, ও ‘সলিল মিত্রকে ঠিক প্লেস করতে পারছে না। আপনি কি বালিগঞ্জ থেকে বলছেন? আপনার অ্যাড্রেসটা কাইন্ডলি…।

অধ্যাপক তালুকদার নিঃশব্দে ধারক-অঙ্গে টেলিফোন যন্ত্রটা নামিয়ে রাখলেন। সাবধানী বুদ্ধিমান মানুষটির মনে হল সোন্ধী মায়াজাল বিস্তার করতে চাইছে। মালিনী মেয়েটির নাম নয়, হতে পারে না। কবি কালিদাসের প্রসঙ্গে কাব্য করে ও ছদ্মনাম নিয়েছিল : মালিনী। আর সেই জন্যই প্রথমবার ও-প্রান্তবাসী নাম শুনে চিনতে পারেনি। প্রতিপ্রশ্ন করেছিল : হু?

খুব সম্ভবত সোন্ধীর বাথরুমে কেউ ছিল না।

সে শূন্যে কথাগুলি ছেড়ে দিয়ে ওঁর বিশ্বাস উৎপাদনের চেষ্টা করছিল। কায়দা করে ওঁর টেলিফোন নাম্বার অথবা ঠিকানাটা জানতে চাইছিল।

উপায় নেই। মেয়েটি নিজ থেকে যোগাযোগ না করলে এ রহস্যজাল ছিন্ন করা যাবে না।

কিন্তু ওঁর গরজটাই বা কী? একটা দুঃস্বপ্ন–আচ্ছা, না হয় ‘সুখস্বপ্নই’ হল—‘স্বপ্ন’ বলে অভিজ্ঞতাটাকে গ্রহণ করলে ক্ষতি কার?

Leave a Reply to Soumyen Maitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *