৭
আফজাল সোহরাব আলিকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়িতে গেল। সোহরাব আলি তাকে সদর ঘরে বসালেন।
পাড়ার লোকেদের কাছে তার বাড়ির সবাই জেনেছে সোহরাব আলিকে লাঠিয়ালরা ধরে জমিদার বাড়িতে নিয়ে গেছে। তারা জমিদারের অত্যাচারের কথা জানত, “যাকে ধরে নিয়ে যায়, তাকে মেরে আধমরা করে ফেলেন। পাটায় করে তুলে আনতে হয়।” তাই তাকে অচেনা এক যুবকের সঙ্গে হেঁটে আসতে দেখে সোহরাব আলির স্ত্রী, দুই মেয়ে ও পাড়ার সবাই অবাক হলো।
রক্তাক্ত অবস্থা দেখে দুই মেয়ে আব্বা বলে জড়িয়ে ধরল। আর তার স্ত্রী মাকসুদা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল। আফজাল ও পাড়ার লোকেরা রয়েছে বলে কাছে যেতে পারলেন না।
সোহরাব আলি মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিয়ে বললেন, জমিদার আমার কিছু করতে পারে নি। লাঠিয়ালদের সঙ্গে লড়াই করে রক্তাক্ত হয়েছি। তারপর পাড়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে আফজালকে দেখিয়ে বললেন, এই ছেলেটা জমিদারের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছে। আজ থেকে এ আমার ছেলে। আল্লাহ একে মিলিয়েছে। তোমরা সবাই চলে যাও। আমি এর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করব।
পাড়ার লোকেরা এতক্ষণ আফজালকেই দেখতে ছিল। এত সুন্দর ছেলে তারা কখনো দেখে নি। সোহরাব আলির কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, এই ছেলেটা কী করে আপনাকে জমিদারের অত্যাচার থেকে বাঁচাল, না শোনা পর্যন্ত আমরা যাচ্ছি না।
সোহরাব আলি বলার আগে আফজাল বলল, সেকথা পরে শুনবেন। এখন আপনারা চলে যান। দেখছেন না, উনি আহত? শুশ্রূষা দরকার?
আফজালের কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল, পাড়ার লোকেরা আর কোনো কথা না বলে চলে গেল।
আফজাল সোহরাব আলিকে বলল, চাচা, আপনি ভিতরে যান। আপনার এখন সেবা-যত্ন দরকার। আর শুনুন, আজ থেকে প্রতিরাতে গ্রামবাসীদের নিয়ে খালের বাঁধ কেটে মাঠে জোয়ারের পানি তুলবেন। জমিদার আর বাধা দিতে লাঠিয়ালবাহিনী পাঠাবেন না। তিনি দিনে মাঠে জোয়ারের পানি তোলার ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহ আপনাদেরকে হেফাজত করুন বলে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার আসি চাচা।
সে কী? এক্ষুনি চলে যাবেন? আল্লাহ আপনাকে দিয়ে আমাকে শুধু জমিদারের অত্যাচার থেকে রক্ষা করান নাই, আমার ইজ্জতও বাঁচিয়েছেন। আমি তো ভেবেছি, আপনাকে কয়েকদিন ছেলের মতো রেখে দেব।
মাফ করবেন চাচা, আমি থাকতে পারব না।
কিছু অন্তত মুখে দিয়ে যান।
তা হলে আমাকে তুমি করে বলুন। আমি তো আপনার ছেলের বয়সী।
ঠিক আছে বাবা, তুমি বস। আমি তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
নাস্তা খাইয়ে সোহরাব আলি বললেন, আসার সময় অত করে তোমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম, বললে না। বললে তো তোমার খোঁজ-খবর নিতে পারতাম।
আফজাল বলল, আমার খোঁজ আপনাকে নিতে হবে না, আমি মাঝে মাঝে আপনাদের খোঁজ নিতে আসব। তারপর সালামবিনিময় করে চলে গেল।
সোহরাব আলি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিল। এমন সময় চাচাতো ভাই ইলিয়াস এসে বললেন, ছেলেটাকে যে চলে যেতে দেখলাম?
সোহরাব আলি বললেন, হ্যাঁ, দু’চারদিন থাকতে বললাম, থাকল না। বলল, “মাফ করুন চাচা, থাকতে পারব না।” তখনই চলে যাচ্ছিল। অনেক করে বলে নাস্তা খাইয়েছি।
ছেলেটার পরিচয় নিয়েছ?
অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিছুতেই বলে নি। শুধু বলল, “পরিচয়ের কী দরকার? আপনাদের মতো আমিও মানুষ। আর সব মানুষই বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) এর বংশধর।”
গ্রামের মানুষজন যারা কিছুক্ষণ আগে আফজালের কথায় চলে গিয়েছিল, কী করে জমিদারের অত্যাচর থেকে সোহরাব আলিকে ছেলেটা রক্ষা করল, তা
জানার জন্য তারা আবার হাজির হলো।
সকলের হয়ে ইলিয়াস ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করল।
সোহরাব আলি ঘটনাটা বলে বললেন, ছেলেটার কথার মধ্যে যেন জাদু ছিল। প্রথম দিকে জমিদার মেজাজ দেখালেও শেষের দিকে টুসাড়া করতে পারেন নি। আর পঞ্চাশ-ষাটজন লাঠিয়াল রুস্তমের অবস্থা দেখে মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। আমি তো হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি।
ইলিয়াস বলল, সত্যিই খুব আশ্চর্য ব্যাপার। মনে হয় ছেলেটা মানুষ নয়, জিন। তা না হলে তার পরিচয় দিল না কেন?
সোহরাব আলি বললেন, দূর, জিন হতে যাবে কেন? মায়ের মুখে শুনেছি, জিনেরা মানুষের চুর ধরতে পারলেও পা ঘোড়ার খুরের মতো হয়। কিন্তু ছেলেটার পা-তো আমাদের মতই। পরিচয় না দেওয়ার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। ছেলেটা যাওয়ার আগে বলেছে, আজ থেকেই রাতে খালের বাঁধ কেটে মাঠে জোয়ারের পানি তুলতে। জমিদার নাকি আর বাধা দেওয়ার জন্য লাঠিয়ালবাহিনী পাঠাবেন না। তিনি দিনে জোয়ারের পানি মাঠে তুলবেন। তোমরা সব তৈরি থাকবে, খালে জোয়ারের সময় বাঁধ কাটতে যাব।
পাড়ার একজন বলল, জমিদার যদি লাঠিযালবাহিনী পাঠায়, তা হলে কী হবে?
সোহরাব আলি বললেন, পাঠালে আমরা সবাই ফিরে আসব। তবে আমার মনে হয়, ছেলেটার কথা সত্য। জমিদার বাধা দিতে কাউকে পাঠাবেন না। তোমরা যে যেতে চাও যাবে কাউকে জোর করব না। যারা যাবে তারা খাওয়া দাওয়ার পর এখানে আসবে। সবাই একসঙ্গে বেরব।
সোহরাব আলি রাত্রে খাওয়ার পর পাড়ার লোকজনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মাত্র দশ-বারোজন লোক কোদাল হাতে নিয়ে এল। আরো ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করেও যখন দু’একজন ছাড়া আর কেউ এল না তখন তাদের নিয়ে বাঁধ কাটতে গেলেন।
গিয়ে দেখল, বাঁধের কাছে কোনো পোপক্ষী নেই। বাঁধ কাটা শেষ হয়েছে, এমন সময় আকাশে মেঘের ডাক শোনা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি নামল।
সোহরাব আলি বললেন, আল্লাহর কী কুদরত, বাঁধ কাটার সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হলো। চল আমরা সবাই ফিরি।
একটানা তিনদিন প্রচুর বৃষ্টি হলো। খালের জোয়ারের পানি আর বৃষ্টির পানিতে মাঠ ভরে গেল। চাষিরা মনের আনন্দে চাষ শুরু করল।
.
ম্যানেজার সামসুদ্দিন দাদাজীর মতো সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ হলেও তার মতো ততটা ধার্মীক নয়। তার উপর যুবক। ইকতিদার আলির মুখে তাকে নাতজামাই করার কথা শুনে রাজকন্যার সাথে রাজত্ব পাওয়ার লোভ সামলাতে পারল না। তাই আফজালকে যেমন করে তোক খুঁজে বের করার ও সে যাতে তার পথের কাঁটা হতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করার প্রতিজ্ঞা করল। ভাবল, সোহরাব আলিকে যখন জমিদারের কাছ থেকে নিয়ে গেছে তখন তিনি নিশ্চয় তাকে চেনেন অথবা তার কোনো আত্মীয়ও হতে পারে। তাই পরেরদিন সোহরাব আলির বাড়িতে নিজে গিয়ে খোঁজ করার মনস্থ করলেও বৃষ্টির কারণে তিন দিন যেতে পারল না। চার দিন পর দালাগ্রামে গিয়ে তার খোঁজ করল।
সোহরাব আলি বাড়িতে ছিলেন না। তার ছোট মেয়ে রোশনী বলল, আব্বা বাড়ি নাই। কামলা নিয়ে মাঠে গেছে।
সামসুদ্দিন বলল, তোমার আব্বার কাছে একটা জরুরি কাজে এসেছি। আমাকে তার কাছে নিয়ে চল।
রোশনী তাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে আব্বার কাছে গিয়ে বলল, এই লোকটা বাড়িতে এসে তোমার খোঁজ করছিল।
সালামবিনিময় করে সোহরাব আলি বললেন, কে আপনি? কোথায় থেকে এসেছেন? আপনাকে যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।
সামসুদ্দিন বলল, আমি জমিদার ইকতিদার আলির ম্যানেজার। জমিদারের কাঁচারিবাড়িতে দেখেছেন।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে। তা কী মনে করে এসেছেন?
আফজাল, মানে যে ছেলেটা আপনার বাঁধন খুলে নিয়ে এল, তিনি কোথায়।
সে তো ঐ দিনই চলে গেছে।
তিনি আপনার কেউ হন না?
না তো।
কোথায় গেছেন?
তা জানি না। হয়ত তার বাড়িতে গেছে।
বাড়ি কোথায় জানেন?
না।
তার সম্পকে আর কী জানেন?
আমি কিছুই জানি না।
তা হলে আপনার জন্য এতকিছু করল কেন?
তাও জানি না।
প্রথম থেকে, মানে খালের বাঁধ কাটার সময় তিনি আপনাদের সঙ্গে ছিলেন না?
আমাদের সঙ্গে থাকবে কেন? তার বাড়ি তো আমাদের গ্রামে না।
আশ্চর্য?
হ্যাঁ, আমিও তখন খুব আশ্চর্য হয়েছি যখন জমিদারের সঙ্গে তর্ক করছিল এবং আমার বাঁধন খুলে নিয়ে এল। তার আগে আমি তাকে কখনো দেখি নি।
তিনি আপনাদের বাড়িতে এসেছিলেন?
হ্যাঁ, এসেছিল। নাস্তা খেয়ে চলে গেছে।
তাঁর পরিচয় জানতে চাননি?
অনেকবার চেয়েছি, বলেনি।
আপনার জন্য এত কিছু করল, কেন বলতে চান নি, জিজ্ঞেস করেননি?
তাও করেছি, বলল, মানুষ হয়ে অন্য মানুষের বিপদে সাহায্য করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য, তাই করেছি। এবার আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো, তার খোঁজ নিতে এসেছেন কেন?
সামসুদ্দিন অল্পক্ষণ চিন্তা করে মিথ্যে বলল, উনি কাল মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। জমিদার তার মহত্বে মুগ্ধ হয়ে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছেন।
সোহরাব আলি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলেছেন। তার মতো মহৎ ছেলে আমি জীবনে দেখি নি।
সামসুদ্দিন হতাশ গলায় বলল, কিন্তু অমন মহৎ ছেলের খোঁজ পেলাম না বলে খুব দুঃখ হচ্ছে। তার সাথে যদি কখনো দেখা হয়, তা হলে বলবেন, জমিদার দেখা করতে বলেছেন।
ঠিক আছে বলব।
এবার আসি বলে সামসুদ্দিন সালামবিনিময় করে সেখান থেকে চলে এল।
তারপর একদিন রুস্তমকে জিজ্ঞেস করল, সেদিন আফজালকে জুতো মারতে গিয়ে কি এমন হলো যে, কাঁদতে কাঁদতে পা ধরে মাফ চাইলে?
রুস্তম ঘটনাটা বলে বলল, ঐ কথা মনে পড়লে ভয়ে আজও কলজে শুকিয়ে যায়।
সামসুদ্দিন তাকে বিদায় করে চিন্তা করল, তা হলে জমিদারের কথাই ঠিক। আফজাল জাদুকর অথবা ম্যাসমেরিজিয়ান। যদি তাই হয়, তার বিরুদ্ধে কিছু করে সে কি সাকসেসফুল হতে পারবে? অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, নিজে কিছু না করে একজন লোকের দ্বারা আফজালের বায়োডাটা যোগাড় করার ব্যবস্থা করবে।
আসির উদ্দিন উকিলের কাছ থেকে এর মধ্যে ইকতিদার আলি আফসানার বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পেলেন। সেই সাথে নিগারও আফসানার একটি চিঠি পেল।
নিগার নিজের রুমে এসে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
সুপ্রিয় বন্ধু নিগার,
আসোলামু আলাইকুম, আশা করি, আল্লাহর অশেষ রহমতে দাদা-দাদিসহ ভালো আছিস এবং জমিদারি চালাবার কায়দা-কানুন শিখে নিচ্ছিস। আমি ও আমাদের বাসার সংবাদ আল্লাহর রহমতে ভালো জানবি। পরে জানাই যে, বাবা তোর দাদুকে আমার বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পাঠিয়েছেন। আর আমি এই চিঠি দিয়ে তোকে নিমন্ত্রণ করলাম। বিয়ের তারিখের একসপ্তাহ আগে দাদা-দাদিসহ আসবি। না এলে চিরতরে বন্ধুত্ব হারাবি।
এবার পাত্রের কথা বলি, বাবার পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে। তোর জন্য বাবা যে ইঞ্জিনিয়ার ছেলে দেখেছিলেন। সেই ছেলেটাই আমার হবু বর। কথাবার্তা পাকা করার আগে পাত্র, তার মা-বাবা ও অন্যান্য নিকটআত্মীয় এসেছিলেন। সে-সময় পাত্রকে ও আমাকে আলাদা রুমে আধঘণ্টা আলাপ করার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি বাবাকে বলেছিলাম, তুমি ও মা যখন পাত্র নির্বাচন করেছ তখন আর এ রকম ব্যবস্থা করার কোনো দরকার নেই। বাবা বললেন, ইসলামে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ থাকলেও বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী একে অপরকে দেখার পারমিশান দিয়েছে। আমি আর আপত্তি করি নি। আধঘণ্টা আলাপের মধ্যে পাত্রকে যতটুকু জানতে পেরেছি, মনে হয় ভালোই হবে। বাকি আল্লাহর মর্জি। আর শোন, আফজাল ভাই কয়েকদিন আগে এসেছিলেন। তাকেও নিমন্ত্রণ করেছি, আসবেন বলেছেন। তোর সঙ্গে আবার দেখা করতে গিয়েছিলেন কিনা জিজ্ঞেস করতে বললেন, “দেখা হয়েছে, কিন্তু দুভাগ্যবশত আলাপ করার সুযোগ হয় নি।” তুই যে চিঠিতে লিখেছিলি তাঁকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবি না; কিন্তু আজও তার সম্পূর্ণ পরিচয় জানিস না। প্রথম বার দেখা করতে গিয়ে শুধু তোর দাদাজীকে যে সব কথা আফজাল ভাই বলেছিলেন, সেই কথার উপর সিদ্ধান্ত নেওয়া কি তোর ঠিক হয়েছে? আমার বিয়েতে এসে তাঁর সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিবি। তা ছাড়া আরো লিখেছিস, তোর দাদিআম্মা রাজি থাকলেও তোর দাদাজী আফজাল ভাইকে জাদুকর ভেবে রাজি নন। যা কিছু করবি ভেবেচিন্তে করবি। তোর জন্য আমার খুব চিন্তা হয়। আর বেশি কিছু লিখে বিরক্ত করব না। সাক্ষাতে আলাপ করব। তোর দাদি ও দাদাজীকে আমার সালাম দিবি। আল্লাহর কাছে তোর সহিসালামত কামনা করে বিদায় নিচ্ছি, আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোর প্রিয় বন্ধু আফসানা।
চিঠি পড়া শেষ করে নিগার দাদাজীর কাছে এসে বলল, আফসানা বিয়ের একসপ্তাহ আগে যেতে বলেছে।
বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পাওয়ার আগেই ইকতিদার আলি ভেবেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে উকিলের কাছ থেকে আফজালের বিস্তারিত সবকিছু জানবেন এবং কয়েকদিন থেকে কোনো হুজুরের কাছে গিয়ে জানবেন, নিগারের প্রতি কোনো জিন আকৃষ্ট কি না। আরো জানবেন, আফজাল জিন অথবা জাদুকর বা
ম্যাসমেরিজিয়ান কি না। এখন নাতির কথা শুনে বললেন, একসপ্তাহ আগে যেতে না পারলেও দু’দিন আগে যাবই এবং বেশ কয়েকদিন থাকবও। আমার কিছু কাজ আছে।
নিগার উঞ্ছন্নকণ্ঠে বলল, আমিও সে কথা আপনাকে বলব ভেবেছিলাম। এবার দাদিআম্মাকেও নিতে হবে কিন্তু। ওঁকে তো আপনি কখনো ঢাকা নিয়ে যান নি।
এমন সময় সালমা বেগম এসে নিগারের শেষের কথাটা শুনে বললেন, কার কথা বলছিস?
নিগার বলল, আপনার কথা। আমার বন্ধু আফসানার কথা আপনাকে একদিন বলেছিলাম না? তার বিয়ে। সে তো উকিল-চাচার মেয়ে। উকিল-চাচা সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ কার্ড পাঠিয়েছেন। তাই আপনাকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য দাদাজীকে বললাম।
সালমা বেগম আড় চোখে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বেদনামিশ্রিতস্বরে বললেন, আজ ষোলো-সতেরো বছর আগে বৌ হয়ে এ বাড়িতে ঢুকছি। তারপর একদিনের জন্যও তোর দাদাজী কোথাও নিয়ে যায় নি। আমার কি এত সৌভাগ্য হবে যে, ঢাকা যাব? কথা শেষ করে ফিরে যেতে লাগলেন।
নিগার তাড়াতাড়ি গিয়ে দাদিআম্মার একটা হাত ধরে ফিরিয়ে এনে বসিয়ে বলল, এ ব্যাপারে দাদাজীর কাছে কৈফিয়ত চেয়ে বেয়াদবি করব না। তবু বলব, দাদাজী যে ভুল করেছেন, কুরআন হাদিসের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে করেছেন। এখন আর তাকে কোনো ভুল করতে দেব না। তারপর দাদাজীকে বললেন, দাদিআম্মাকে ঢাকায় নিয়ে যাবেন কি না বলুন? যদি না নিয়ে যান, আমিও যাব না।
ইকতিদার আলি বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। আমি অনেক ভুল করেছি। তবে তুমি না বললেও তোমার দাদিআম্মাকে এবারে ঢাকা নিয়ে যেতাম।
নিগার মনেমনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, মনীষীরা বলেছেন, “যারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধনের চেষ্টা করেন, তারা মহৎ।” আশা করি, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন না করে এতদিন যে ভুল করেছেন, এখন থেকে তা অর্জন করে সেই ভুলেরও সংশোধন করবেন।
ইকতিদার আলি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
দাদাজী, আপনি কিছু বলছেন না কেন?
এখন কি আর শেখার বয়স আছে ভাই?
দাদাজী কী যে বলেন। শিক্ষার বুঝি বয়স থাকে? যে-কোনো বয়সেই শিক্ষালাভ করা যায়। আমাদের নবি (দ.) বলিয়াছেন, “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার বয়স।” আমার কাছে বাবার বাংলায় ধর্মীয় অনেক বই আছে। সেগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমার কথা ঠিক কি না। যারা মনে করে বাল্যকাল থেকে যুবক বয়স পর্যন্ত শিক্ষার বয়স তারা খুব ভুল করে। তবে বাল্যকাল থেকে শিক্ষা শুরু করা উচিত। আর শিক্ষা বলতে শুধু স্কুল-কলেজের শিক্ষাটাই শিক্ষা নয়, সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা ও তার অনুসরণ অনুশীলনই হলো আসল শিক্ষা। ছোটবেলা থেকে যদি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ ও অনুসরণ না করে, তা হলে যেমন শিক্ষা বা জ্ঞান পূর্ণ হয় না, তেমনি চরিত্র গঠনও হয় না।
ইকতিদার আলি বললেন, তুমি তো ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন কর নি এবং সে সব অনুসরণও করনি, তা হলে কী তুমি চরিত্রহীন?
নিগার বলল, ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা না পেলেও ধার্মীক ও চরিত্রবান বাবার আন্ডারে মানুষ হয়েছি। তবু কিন্তু বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে উদ্ধৃঙ্খল পথে পা বাড়িয়েছিলাম। সেটা আরো বেড়ে গিয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর। আল্লাহর অপার করুণায় তাঁর এক নেক বান্দা আমাকে ঐ পথ থেকে ফিরিয়ে ধর্মের পথে নিয়ে আসেন।
ইকতিদার আলি বললেন, আল্লাহর সেই নেক বান্দা কে?
যাকে আপনি পাগল ও জাদুকর ভাবেন, সেই আফজাল।
যদি বলি তোমার রূপে মুগ্ধ হয়ে এবং তুমি বাবার একমাত্র সন্তান জেনে সম্পত্তির লোভে তোমাকে জাদু করেছে?
আপনার ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমার রূপে মুগ্ধ হলেও বাবার একমাত্র সন্তান জেনে সম্পত্তির লোভে জাদু করেছে তা ঠিক নয়। তা ছাড়া কুরআনে জাদুর কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে পৃথিবীতে জাদু আছে কি না সন্দেহ। আপনি হয়ত মনে করেছেন, আমি ও আফজাল অনেকদিন মেলামেশা করেছি। যার ফলে একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি তাও ঠিক নয়। বরং উকিল-চাচার মেয়ে আফসানার সঙ্গে তিনি অনেকদিন মেলামেশা করেছেন। আর আমার সঙ্গে
মাত্র দু’দিন শুধু আলাপ হয়েছে। আফসানাকে তো আপনি দেখেছেন। সেও আমার চেয়ে কম রূপসী নয়?
তুমি লেখাপড়া করলেও তোমার বুদ্ধি বা জ্ঞান পাকা হয় নি। আফসানা রূপসী হলেও মা-বাবার একমাত্র সন্তান নয়। তার তিন ভাই আছে। তাই প্রথম আলাপ হওয়ার পর আফসানা ও তার বাবার কাছে তোমার সম্পর্কে সবকিছু জেনে দ্বিতীয়বার আলাপ করার সময় তোমাকে জাদু করেছে।
নিগার একটু রাগের সঙ্গে বলল, আপনি শুধু জাদু জাদুকরছেন কেন? বললাম না, বর্তমানে পৃথিবীতে জাদু আছে কি না সন্দেহ।
আরে ভাই তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? জাদু না থাকলেও ম্যাসমেরিজামবিদ্যা তো আছে? আফজাল জাদুকর না হলেও ম্যাসমেরিজিয়ান। সে তোমাকে ম্যাসমেরিজাম করে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছে।
রাগের চোটে নিগারের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, ঠিক আছে, ঢাকায় গিয়ে প্রমাণ করাব, তিনি জাদুকর, ম্যাসমেরিজিয়ান, অন্য কিছু।
ইকতিদার আলি বললেন, আফজালকে পাবে কোথায় যে, প্রমাণ করাবে?
তিনিও আফসানার বিয়েতে আসবেন।
এলেও আমি এসেছি শুনে সে পালিয়ে যাবে।
না, পালাবেন না। তিনি যে কাপুরুষ নন, তা আপনি কয়েকদিন আগেই জেনেছেন।
ইকতিদার আলি মনেমনে বললেন, বেটার একবার দেখা পাই, তারপর দেখব কাপুরুষ না মহাপুরুষ। মুখে বললেন, ঠিক আছে, ঢাকায় পেলেই বোঝ যাবে সে কতবড় মহাপুরুষ।
আপনি তাকে মহাপুরুষ বলছেন কেন? আমি তো তাঁকে তা বলি নি। তবে তিনি যে একজন মহৎ, তার প্রমাণও আপনি আগেই পেয়েছেন। তারপর নিগার চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।
সালমা বেগম এতক্ষণ চুপ করে তাদের কথা শুনছিলেন। নিগার চলে যাওয়ার পর বললেন, ঢাকায় গিয়ে যদি সত্য প্রমাণ পাও আফজাল মহৎ, তা হলে কী তার হাতে নিগারকে দেবে?
না। ম্যানেজার সামসুদ্দিনের সঙ্গেই তার বিয়ে আমি দেবই। দু’একটা গুণ থাকলে কেউ মহৎ হয় না। তা ছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস আফজাল ম্যাসমেরিজাম বিদ্যা জানে। ওটার দ্বারা কিছু ভালো কাজ করে মানুষের চোখে মহৎগিরি দেখায়। তোমাকেও তো আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, সে কত মহৎ না অন্য কিছু, তুমিও তা জানতে পারবে।
সালমা বেগম খুব চতুর মহিলা। বিয়ের সময় জহিরউদ্দিন মেয়েকে ইকতিদার আলির সবকিছু বললেও বয়সের কথা বলেন নি। তিনি জানতেন, বয়সের কথা বললে সালমা কিছুতেই রাজি হবে না। তাই শুধু বলেছিলেন, বয়স একটু বেশি। বাসর রাতে স্বামীকে দেখে যেমন দুঃখ পেয়েছিলেন, তেমনি আব্বার উপর প্রচণ্ড ক্ষোভ হয়েছিল। তখন বিষ খেয়ে অথবা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। হয়ত তাই করেই ফেলতেন; কিন্তু তার মধ্যে দ্বীনের এলেম ছিল। হঠাৎ তাঁর দু’টো হাদিস মনে পড়ল। “যে পর্বত হইতে নিজেকে নিক্ষেপ করিয়া আত্মহত্যা করে, সে নিজেকে দোজোখের অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। যে বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করে, সে বিষ হাতে লইয়া দোজোখের ভিতরে তাহার স্বাদ গ্রহণ করিবে। যে বন্দুক দ্ধারা আত্মহত্যা করে, সে বন্দুক হাতে লইয়া দোজোখের ভিতর নিজের উদরে নিক্ষেপ করিবে এবং চিরকাল তথায় অবস্থান করিবে।” [বর্ণনায় : হজরত আবু হোরায়রা (রা.)- তিরমিজী ইবনেমাজা] “যে শ্বাসরোধ করিয়া আত্মহত্যা করে, সে দোযখের আগুনে নিজ আত্মার শ্বাসরোধ করিবে। এবং যে গুলির দ্ধারা আত্মহত্যা করে, সে দোযখের আগুনে নিজের প্রতি গুলি করিবে।” [বর্ণনায় : হজরত আবু হোরায়রা (রা.)- বুখারী]
হাদিস দু’টো মনে পড়তে সালমা বেগম ভয়ে শিউরে উঠলেন। তারপর আল্লাহ তার তকদিরে বুড়ো স্বামীর সংসার করা লিখেছেন ভেবে সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন। আর মনেমনে একটা স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন।
পনেরো-ষোলো বছর পর স্বামীর মুখে ভাইপোকে নাতজামাই করার কথা শুনে, সেই স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে দেখে মনেমনে খুব আনন্দিত হলেও তা প্রকাশ করেন নি। ভাবলেন, এই কথা বলে স্বামী হয়ত তাকে পরীক্ষা করছেন। তাই এতদিন নিগারের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু আজ আবার স্বামী যখন ভাইপোকেই নাতজামাই করার দৃঢ়তা প্রকাশ করল তখন নিজের মতামত প্রকাশ করার জন্য বললেন, আমিও চাই আফজালের সঙ্গে নিগারের বিয়ে হোক। নিগার আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে ভেবে এতদিন তার পক্ষে কথা বলেছে।
ইকতিদার আলি মৃদু হেসে বললেন, জানতাম একথা একদিন তুমি বলবেই। প্রথম যেদিন নিগার আফজালের কথা বলে ম্যানেজারের হাতে নিগারকে দেওয়ার কথা বলি, সেদিন তুমি অমত করলেও আমি তোমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলাম।
স্বামীর কথা শুনে, সালমা বেগম অবাক দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ইকতিদার আলি হেসে উঠে বললেন, আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছ,? এতে অবাক হওয়ার কী আছে? বেশিরভাগ মেয়ে, যারা প্রথমে কোনো ব্যাপারে রাজি থাকলেও তা প্রকাশ না করে অমত প্রকাশ করে, তুমি হচ্ছ তাদের দলে।
সালমা বেগম হেসে উঠে বললেন, এত বছর যাকে নিয়ে ঘর করছ, তার মনের খবর বুঝতে যদি না পারবে, তা হলে পুরুষ কিসের?
ইকদিতার আলিও আবার হেসে উঠে বললেন, শোন, আফজাল যতই মহৎ হোক, আর তার ধন-সম্পদ যতই থাকুক-না কেন কিছুতেই তার সঙ্গে নিগারের বিয়ে দেব না। কারণ আমাদের ও বিষয়সম্পত্তির প্রতি সামমুদ্দিনের যতটা মায়া-মমতা থাকবে, আফজালের ততটা থাকবে না। তা ছাড়া সামসুদ্দিন তোমার ভাইপো। যখন সে জানবে আমরা তার ফুফা-ফুফি তখন সে মনেপ্রাণে সব কিছু লক্ষ রাখবে। এখন তোমার কাজ হলো, নিগারের কাছে সবসময় সামসুদ্দিনের গুণগান করে তাকে বিয়ে করার জন্য রাজি করান।