১
জমিদার ইকতিদার আলি কাছারিবাড়ির উঁচু বারান্দায় চেয়ারে বসে একমাত্র বংশধর নাতনি নিগারের সঙ্গে আজকের ঘটনার ব্যাপারে কথা বলছিলেন।
এমন সময় লাঠিয়ালবাহিনী রক্তাক্ত সোহরাব আলিকে পিছমোড়া করে বেঁধে সামনের উঠোনে নিয়ে এল। তাদের সঙ্গে গ্রামের অনেক লোকজনও এসেছে।
সেদিকে তাকিয়ে ইকতিদার আলির ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। নাতনিকে বললেন, যে লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে এনেছে, ওর কথাই তোমাকে বলছিলাম। ও হলো পাশের গ্রামের সোহরাব আলি। বেটা আমার সঙ্গে টেক্কা দিতে চায়। এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল।
দাদাজীর কোনো কথাই নিগারের কানে গেল না। সে তখন সোহরাব আলির পাশে দাঁড়ানো আফজালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
আজ একবছর হতে চলল নিগার ঢাকা ছেড়ে দাদাজীর সঙ্গে কালীগঞ্জে চলে এসেছে। এর মধ্যে দু’বার ম্যানেজারের সঙ্গে ঢাকা গিয়েছিল। দ্বিতীয়বার যখন যায় তখন আফসানার কাছে শুনেছে, আফজাল ভাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য কালীগঞ্জে গেছেন। ফিরে এসে দাদাজীকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কি না?
ইকতিদার আলি বললেন, হ্যাঁ, একদিন একটা পাগল ছেলে এসে তোমার খোঁজ করেছিল। আমি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।
দাদাজীর কথা শুনে নিগারের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। বলল, কাজটা আপনি ঠিক করেন নি। আমিই তাঁকে আসতে বলেছিলাম।
ইকতিদার আলি অবাককণ্ঠে বললেন, ঐ পাগল ছেলেটাকে তুমি আসতে বলেছিলে?
হ্যাঁ বলেছিলাম। ছেলেটাকে পাগল বলছেন কেন?
হো হো হেসে উঠে ইকতিদার আলি বললেন, পাগলকে পাগল বলব না তো কী বলব?
তিনি এমন কী পাগলামি করেছিলেন যে, তাঁকে পাগল বলছেন?
তা হলে শোন, এবারে যখন তুমি ম্যানেজারের সঙ্গে ঢাকা গিয়েছিলে, সেই সময় একদিন কাঁচারিবাড়িতে এসে হানিফকে বলে, “ইকতিদার আলির নাতনি মেহের নিগারকে ডেকে দিন। বলবেন আফজাল এসেছে।” জানো তো, হানিফ আমার খাস চাকর। সে চাকর হলে কী হবে, যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি চালাক চতুর। সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আমার সঙ্গে থেকে রুচিজ্ঞানও হয়েছে। আফজালের গায়ে ছোটলোকদের মতো পোশাক দেখে বলল, জমিদারের নাতনি তোদের মতো ছোটলোকদের সঙ্গে দেখা করেন না। যা ভাগ। তখন আমি কাঁচারিবাড়িতে আসছিলাম। কাছে এসে হানিফের কথা শুনে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমারও তাই মনে হলো। হানিফকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
হানিফ বলল, এই ছেলেটা আপনার নাতনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
আমাকে দেখে ছেলেটা সালামবিনিময় করে বলল, “আপনার নাতনি মেহের নিগার আমাকে ভালোবাসে। আমিও তাকে পছন্দ করি। কথাটা বিশ্বাস না হলে তাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসুন।”
তার কথা শুনে খুব রেগে গেলেও পাগল ভেবে রাগ সংযত করে বললাম, “সে নেই, ঢাকা গেছে।”
ছেলেটা বলল, ঢাকা থেকে ফিরে এলে তাকে বলবেন, “আফজাল এসেছিল। আবার আসবে।
বললাম, তুমি আর কখনো এখানে এসো না।
ছেলেটা হো হো করে হেসে উঠে বলল, আসতে নিষেধ করছেন কেন? না এলে তো আপনার নাতনি পাগল হয়ে যাবেন।
এবার রাগ সামলাতে পারলাম না। হানিফকে বললাম, ওর ঘাড় ধরে এখান থেকে বের করে দে।
ছেলেটা বলল, থাক, ওকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই চলে যাচ্ছি। তবে আমার কথাগুলো আপনার নাতনিকে বলতে ভুলবেন না যেন। তারপর চলে গেল।
এখন তুমিই বল দাদু, পাগল ভেবে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া কি ভুল হয়েছে?
নিগার বলল, হ্যাঁ হয়েছে। কারণ ছেলেটা পাগল নন। আর তিনি যা বলছেন তা সত্য।
ইকতিদার আলি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললেন, কী বলছ তুমি দাদুভাই? একটা ছোটলোক পাগল ছেলেকে…।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে নিগার বলে উঠল, বললাম-না, ছেলেটা পাগল নন? আর তিনি যা কিছু বলেছেন, তা সত্য?
নাতনির কথা শুনে ইকতিদার আলি খুব রেগে গেলেন; কিন্তু তা প্রকাশ না করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, ছেলেটার পরিচয় বলতো দাদু?
ওঁর সম্পূর্ণ পরিচয় জানি না। তবে এতটুকু জানি, তিনি ছোটলোক বা পাগল তো ননই, বরং খুব ইন্টেলিজেন্ট ও ধর্মীয় জ্ঞানে গুণী। মাত্র দু’বার আলাপ হওয়ার কয়েকদিন পর আপনি আমাকে নিয়ে চলে এলেন। তাই আসবার সময় উকিলচাচার মেয়ে আফসানাকে বলেছিলাম, “উনি এলে বলবি, এখানে আমার সঙ্গে যেন দেখা করতে আসেন।” আমার মনে হয় উকিল চাচা ওঁর সম্পূর্ণ পরিচয় জানেন।
ইকতিদার আলি অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বললেন, এবার তোমার সঙ্গে যখন ঢাকা যাব তখন উকিলকে জিজ্ঞেস করব।
এখন সোহরাব আলির পাশে সেই ছেলেটাকে দেখে অবাক হলেও পাত্তা দিলেন না। শুধু নাতনির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে গর্জে উঠলেন, সোহরাব আলি, মাফ চাইবে, না জুতোপেটা খেয়ে নাকখত দেবে?
.
সোহরাব আলির লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ শরীর। তিনিও ভালো লাঠিখেলা জানেন। কিন্তু সত্তর আশিজন লাঠিয়ালের সঙ্গে একা আর কতক্ষণ লড়বেন? বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পাশের গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। ছেলে নেই। সাত মেয়ে। অল্প শিক্ষিত হলেও খুব বুদ্ধিমান। তিনি লোকজনদের প্রায় বলেন, “বাজার করবে ঘুরে, আর মেয়ের বিয়ে দেবে দূরে।” কথাটা আর কেউ না মানলেও নিজে মেনেছেন। পাঁচ মেয়ের বিয়ে দূর দূর গ্রামে দিয়েছেন। এখনো চৌদ্দ ও ষোলো বছরের দু’টো মেয়ে অবিবাহিত আছে। এ বছর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি না হওয়ায় চাষিরা পানি তুলে চাষ করছে। তাই যখন শুনলেন, ইকতিদার আলি খাল বেঁধে নিজের মাঠে পানি তুলেছেন তখন একদিন গ্রামের অনেককে নিয়ে ইকতিদার আলির কাছে এসে প্রতিবাদ করে বললেন, এটা কি উচিত হচ্ছে? দিনে-রাতে দু’বার খালে জোয়ারের পানি আসে। বাঁধ না দিয়ে টিন দিয়ে ঘিরে যে-কোনো একসময়ের জোয়ারের পানি নিতে পারতেন। তা না করে বাঁধ দিয়েছেন। আমাদের মাঠে একছটাক পানি আসছে না। আমরা চাষাবাদ করব না?
ইকতিদার আলি রাগের সঙ্গে বললেন, আমার মাঠের চাষাবাদ শেষ হওয়ার পর বাঁধ কেটে দেওয়া হবে। তখন তোমরা পানি পাবে।
সোহরাব আলি বললেন, তখন তো চাষাবাদ নাবি হয়ে যাবে। ফসল কম। হবে।
ফসল কম হলে আমি কী করব? আমার মাঠের চাষাবাদ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত বাঁধ থাকবে।
আমরা এই কথা মানব না। বাঁধ কেটে দিয়ে দিনে-রাতের যে-কোনো একটা জোয়ারের পানি ছাড় দিতে হবে।
যদি না দিই?
গ্রামের চাষিরা এর বিহিত করবে।
বেশ তো বিহিত কর দেখি, তোমাদের কত হিম্মত।
সেদিন সোহরাব আলি ফিরে এসে গ্রামের সবাইকে নিয়ে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, রাতে বাঁধ কেটে তাদের মাঠে জোয়ারের পানি তুলবে।
ঐ দিন রাতে এগারোটার সময় গ্রামবাসী খালের বাঁধ কাটতে গিয়ে দেখল, পঁচিশ-ত্রিশজন লাঠিয়াল বাঁধ পাহারা দিচ্ছে। রাতে হাঙ্গামা না করে সোহরাব আলি সবাইকে নিয়ে ফিরে এসে আবার পরামর্শ করে ঠিক করলেন, কাল দিনের বেলায় সবাই লাঠিসোটা নিয়ে লাঠিয়ালদের হটিয়ে দিয়ে বাঁধ কাটবে।
পরের দিন পরামর্শমতো গ্রামবাসী বাঁধ কাটার জন্য লাঠিয়ালদের উপর হামলা করল। অগণিত গ্রামবাসীর সঙ্গে পঁচিশ-ত্রিশজন লাঠিয়াল টিকতে পারল না। লাঠিয়ালদের সর্দার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একজনকে ইকতিদার আলির কাছে পাঠিয়ে আরো লাঠিয়াল পাঠাতে বলল।
খবর পেয়ে ইকতিদার আলি আরো পঞ্চাশ-ষাটজন লাঠিয়াল পাঠিয়ে দিলেন।
ততক্ষণ সোহরাব আলি গ্রামবাসীদের প্রথম লাঠিয়াল দলকে ভাগিয়ে দিয়ে বাঁধ কাটতে শুরু করেছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে লাঠিয়ালদের দ্বিতীয় দল এসে পড়ায় প্রথম দল তাদের সঙ্গে মিশে একসঙ্গে গ্রাসবাসীর উপর হামলা করল। অনেকে তখন বাঁধ কাটা নিয়ে ব্যস্ত। অন্যরা প্রতিরোধ করল, কিন্তু অতগুলো লাঠিয়ালদের সাথে পেরে উঠল না। আহত হয়ে পালাতে লাগল। সোহরাব আলি একা আর কত লড়বেন? লাঠিয়ালরা তাকে ঘায়েল করে রক্তাক্ত অবস্থায় যখন বেঁধে নিয়ে আসছিল তখন আফজাল সেই রাস্তা দিয়ে নিগারের সঙ্গে দেখা করতে আসছিল। একজনের কাছ থেকে ব্যাপারটা জেনে ইকতিদার আলির অমানবিক কার্যকলাপে যেমন রেগে গেল, তেমনি সোহবের অবস্থা দেখে দুঃখ পেল। শেষমেস কী হয় দেখার জন্য তাদের সঙ্গে এসেছে।
জমিদারি না থাকলেও ইকতিদার আলির মাঠকে-মাঠ ধানী জমি, আগান বাগান ও পুকুর-ডোবা যা আছে, তা আগেকার জমিদারের চেয়ে কোনো অংশে কম না। তাই এই এলাকায় তিনি জমিদার নামে পরিচিত। বয়স প্রায় পঁচাত্তরের মতো হলেও সুঠাম দেহের অধিকারী। আশপাশের কয়েকটা গ্রামের লোকজন তার ভয়ে কম্পমান। বাপ-দাদাদের আমলে ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। তাঁরা ঘোড়ায় চেপে জমিদারি দেখাশুনা করতেন। ইকতিদার আলিও যুবক বয়সে ঘোড়ায় চেপে যাতায়াত করতেন। ইদানীং রাস্তাঘাটের উন্নতি হতে গাড়ি ব্যবহার করেন। বাড়িতে চাকর-চাকরানি, চাষ-বাস দেখাশোনা ও প্রজাদের কাছ থেকে বর্গা দেওয়া জমির ফসল আদায়ের জন্য চৌদ্দ-পনেরোজন লোক সবসময় কাছারিবাড়িতে থাকে। এদের সবার বেতন ও খাওয়ানো ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাগানবাড়িতে জলসাঘর ছিল। সেখানে পূর্বপুরুষরা শহর থেকে বাইজি আনিয়ে রাতকে-রাত নাচ-গান হতো। সেই সাথে বিদেশী মদের ফোয়ারা ছুটত। ইকতিদার আলি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তিনিও যুবক বয়স থেকে পূর্বপুরুষদের রেওয়াজ চালু রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তান মুক্তাদীর একটু বড় হওয়ার পর এসবের প্রতিবাদ করেন। তাই ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করার পর ফরেনে পাঠিয়ে দেন উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য। এর কিছুদিন পর মুক্তাদীরের মা মারা যান। ইকতিদার আলি তাকে সে-খবর জানান নি। আর বিয়ে না করে মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতেন। লেখাপড়া শেষ করে মুক্তাদীর ফিরে এসে মায়ের মৃত্যুসংবাদ জেনে এবং বাবাকে সেই আগের মতো দেখে খুব দুঃখ পান। বাবাকে ওসব ছেড়ে দেওয়ার ও আবার বিয়ে করতে এবং দেশের জন্য জনহিতকর কাজ করার কথা বলেন। সবকিছু তওবা করে হজ করার কথাও বলেন।
ইকতিদার আলি ছেলের কথা মেনে নিতে পারলেন না।
মুক্তাদীর অনেক চেষ্টা করেও যখন বাবাকে ফেরাতে পারলেন না তখন একদিন আবার বিদেশে চলে যান। যাওয়ার সময় বাবাকে বলেছিলেন, আপনার মতিগতি না ভালো হলে আমি আর দেশে ফিরব না।
ইকতিদার আলি বিষয়-সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে ছেলেকে বাধা দিয়েছিলেন।
কিন্তু মুক্তাদীর বাবার বাধা ঠেলে চলে গিয়েছিলেন। সেসব প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের কথা। এতদিন তিনি বাবাকে একটাও চিঠিপত্র দেন নি।
ফরেনে লেখাপড়া করার সময় শাবানা নামে এক বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে-সময় মুক্তাদীর খুব ধনী-ঘরের ছেলে জেনে শাবানা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তাদীর রাজি হন নি। মুক্তাদীর ফরেনে ফিরে এলে শাবানা আবার তার পিছু নেন এবং তাকে সবরকমের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব মেনে নিয়ে মুক্তাদীর তাকে বিয়ে করেন।
শাবানার বাবা গাফফার সাহেব বাংলাদেশের একজন শিল্পপতি। শাবানা তাঁর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জেনে তিনি স্ত্রীসহ গিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন এবং জামাইয়ের চাকরির ব্যবস্থা করে ফিরে আসেন।
শাবানা শিল্পপতি বাবার আদুরে ও উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির মেয়ে। ধনীলোকের ছেলেদের সঙ্গে ডেটিং, করে বেড়াতেন। মুক্তাদীর উচ্চধনী ঘরের ছেলে জেনে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর যখন জানতে পারলেন, সে বাবার সবকিছু ত্যাগ করে থেকে যাওয়ার জন্য এখানে এসেছে তখন হতাশ হন এবং স্বামীর উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। প্রথম দিকে স্বামীকে দেশে ফেরার জন্য অনেক বোঝান; কিন্তু যখন মুক্তাদীর কিছুতেই রাজি হলেন না তখন থেকে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয়। ইতিমধ্যে তাদের একটা মেয়ে হয়। মেয়েটিকে দেখতে চাঁদের আলোর মতো ফুটফুটে বলে মুক্তাদীর তার নাম রাখেন মেহের নিগার। তবে নিগার বলে ডাকেন। নিগার যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চরম বিরোধ হয় এবং কোর্টের মাধ্যমে শাবানা তালাক নিয়ে অন্য একজন বিদেশীকে বিয়ে করে লন্ডন থেকে আমেরিকা চলে যান। মুক্তাদীর অনেক দিন থেকে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগলেও স্ত্রী ত্যাগ করার কথা কখনো চিন্তা করেন নি। কোর্টের মাধ্যমে তালাকের কাগজপত্র পেয়েও অন্য একজন বিদেশীকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা শুনে খুব মুষড়ে পড়েন। মেয়ে নিগারের ভালোমন্দ চিন্তা করে সবকিছু সামলে নেন। কিন্তু মানসিক দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পেলেন না।
নিগার তখন তরুণী। মায়ের এরূপ কাজে মনে ভীষণ আঘাত পায়। বাবার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে একদিন বলল, বাবা, আমাকে নানুর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি আবার বিয়ে কর।
মুক্তাদীর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, তা হয় না মা। তোর নানা-নানু মারা গেছেন। তোকে যেমন তোর মামাদের কাছে পাঠাতে পারব না, তেমনি আমিও আবার বিয়ে করতে পারব না।
নিগার বলল, আমার যে কিছু ভালো লাগে না। তুমি বিয়ে কর বাবা, আমি তাকে মা বলে ডাকব।
মেয়ের কথা শুনে মুক্তাদীরের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে বললেন, ও কথা বলিস না মা। আমি আর বিয়ে করব না, তোকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।
আমার যে এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শুধু মায়ের কথা মনে পড়ে।
মুক্তাদীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে, আমরা দেশে ফিরে যাব। তবে তোর মামাদের কাছে নয়।
মেহের নিগার খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা, এটা তুমি ঠিক কথা বলেছ। দেশে গেলে তোমারও মন ভালো হয়ে যাবে।
তারপর বছর খানেকের মধ্যে সেখানকার পাট চুকিয়ে মুক্তাদীর দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকায় একটা চারতলা বাড়ি কিনে নিজেরা বাস করতে থাকেন, আর ভাড়ার টাকায় সংসার চালাতে লাগলেন। কোনো চাকরি বা ব্যবসা করার চেষ্টা করলেন না। সবসময় বাসায় ধর্মীয় বইপুস্তক পড়তেন। মাঝে মাঝে আলেমদের বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াতেন। তাদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। মুসলমান সমাজের এত অবক্ষয়ের কারণ সম্পর্কেও নানান আলোচনা করতেন।
প্রথম দিকে নিগার এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাত না। ভাবত, বাবা যদি এসব করে শান্তি পায়, পাক। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, বাবাকে তত গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে তার মনে হলো, বাবা যেন কোনো ব্যাপার নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে। তাই একদিন সময়-সুযোগ পেয়ে বলল, দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তুমি বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে, অথচ সবসময় দুশ্চিন্তায় থাক। কী এত দুশ্চিন্তা কর আমাকে বলবে বাবা? কিছু একটা চাকরি বা ব্যবসা-ট্যাবসা করতে পার? তা না করে সবসময় কী যেন চিন্তা কর। আচ্ছা বাবা, তুমি কি মায়ের ব্যাপারটা আজও ভুলতে পার নি?
মুক্তাদীর মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, সারাজীবন চাকরি করেছি। ব্যবসার কিছু বুঝি না। তা ছাড়া যা টাকা-পয়সা এনেছিলাম, বাড়িটা কিনতে সব শেষ হয়ে গেছে। আর তোর মায়ের কথা যা বললি তা ঠিক নয়। তোর মায়ের ঘটনা আমাকে তেমন ভাবায় না। তোকে নিয়েই আমার যত চিন্তা।
কেন বাবা? আমাকে নিয়ে চিন্তা করার কী আছে?
তুই বললে তো হবে না? এই যেমন তুই সবসময় মায়ের অভাব অনুভব করিস। মা যতটা তোর দিকে লক্ষ্য করত, আমি কি তা করতে পারছি?
তাই যদি হয়, তা হলে বিয়ে করছ না কেন? যাকে বিয়ে করে আনবে, তাকে আমি মা বলে মেনে নেব।
আর সে যদি তোকে মেয়ের মতো করে মেনে নিতে না পারে?
তুমি দেখে নিও বাবা, আমি তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করব, আমাকে মেয়ের মতো মনে করতে বাধ্য হবেন।
তুই যে তা করবি সে-কথা আমিও জানি। কিন্তু কি জানিস মা, যদি সেই মেয়ে তোকে মেনে নিতে পারে, তা হলে আমার থেকে কেউ বেশি খুশি হবে না। আর যদি তোকে মেনে নিতে না পারে, তখন যে দুঃখ পাব, তা আমি সহ্য করতে পারব না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর বিয়ে করব না। তোকে উচ্চশিক্ষা দিয়ে মানুষ করে কোনো ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব।
নিগার জানে, মা বাবাকে যতটা-না ভালোবাসত, বাবা তার থেকে অনেক বেশি ভালোবাসে। এখন বাবার কথা শুনে চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে গাল ভার করে আদুরে গলায় বলল, আমি বিয়ে করব না। চিরকাল তোমার কাছে থাকব। তা না হলে তোমার দেখাশুনা করবে কে?
মুক্তাদীর মৃদু হেসে বললেন, পাগলি মেয়ে, দুনিয়াতে অনেকেরই একমাত্র মেয়ে থাকে, তারা কি বিয়ে না করে চিরকাল বাবার কাছে থাকে?
গাল ভার করেই নিগার বলল, অনেকের কথা বাদ দাও, বললাম, তা আমি করবই।
মুক্তাদীর হেসে উঠে বললেন, ঠিক আছে, এখন যা, ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
ঢাকায় এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর মুক্তাদীর মেয়ের অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। দিন দিন যেন মায়ের মতো স্বভাব তার চরিত্রে ফুটে উঠছে। বয়ফ্রেন্ডদের বাসায় নিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যায়। অবশ্য বেড়াতে যাওয়ার আগে তাকে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমাবার কথা বলে যায়। দু’জন আয়া আছে, তাদেরকেও তার দিকে লক্ষ রাখতে বলে। তবু যেন মুক্তাদীরের মনে হয় মেয়েটা ক্রমশ মায়ের মতো হয়ে উঠছে। এ কথাটাই তাকে সবসময় ভাবায়। তাই তিনি সবসময় দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
নিগার ভার্সিটিতে চলে যাওয়ার পর চিন্তা করতে লাগলেন, মেয়েকে নিজের পরিচয় জানাবেন কি না। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ে দেবেন। তারপর পরিচয় জানাবেন।