৪
মুক্তাদীর যখন বিলেত থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন, তখন দৈবক্রমে আফসানার বাবা আসির উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই মুক্তাদীরকে এই বাড়িটা কেনার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। তাই আসির উদ্দিনের সঙ্গে মুক্তাদীরের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারপর আসির উদ্দিন যখন তাকে বিয়ে করার পরামর্শ দেন তখন তিনি অমত প্রকাশ করে নিজের জীবনবৃত্তান্ত বলেন।
আসির উদ্দিন উকিল-মানুষ। তাই কথাপ্রসঙ্গে মুক্তাদীরের গ্রামের ঠিকানা। জেনে নিয়ে লিখে রাখেন।
ক্রমে ক্রমে দুই ফ্যামিলির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সেই সাথে নিগার ও আফসানার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
মুক্তাদীর মারা যাওয়ার পর মেয়ের মুখে নিগারের উচ্ছলতার কথা শুনে আসির উদ্দিন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। হাজার হোক বন্ধুর মেয়ে। তাই একটা ভালো ছেলের খোঁজ পেয়ে মেয়েকে দিয়ে মতামত জানতে চেয়েছিলেন। মেয়ের মুখে তার মতামত শুনে দুঃখ পেলেও কিভাবে তাকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করবেন চিন্তা করতে লাগলেন। কয়েকদিন চিন্তা-ভাবনা করে নিগারের দাদা ইকতিদারকে চিঠি লিখে মুক্তাদীর ও নিগারের সবকিছু জানালেন। আরো জানালেন, তিনি এসে যেন বংশের একমাত্র প্রদ্বীপ নিগারকে দেশের বাড়িতে নিয়ে যান। চিঠির মধ্যে মুক্তাদীরের ও নিজের ঠিকানা দিয়ে দিলেন।
ইকতিদার আলির চুল, দাড়ি, গোঁফ সব শাদা হয়ে গেলেও এখনো জরায় আক্রান্ত হন নি। একমাত্র ছেলে যখন রাগ করে বিদেশে চলে যায় তখন রক্তের গরম ছিল। তাই তিনিও ছেলের খোঁজ-খবর নেওয়ার দরকার মনে করেন নি। কিন্তু এখন চিন্তা করেন, এই বিশাল সম্পত্তি ভোগ-দখল করবে কে? বিলেতে যে ঠিকানায় থেকে ছেলে লেখাপড়া করত, সেখানে কয়েকটা চিঠি দিয়ে ফিরে আসতে বলেছেন। কিন্তু সেই সময় চিঠির কোনো উত্তর না পেয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন এবং ক্রমশ শরীর ও মন ভেঙে পড়ছিল। আজ আসির উদ্দিনের চিঠি পেয়ে যেন নবজন্ম লাভ করলেন। ভাবলেন, আল্লাহ এতদিনে তাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে মনের আশা পূরণ করালেন। কয়েকদিন পর ঢাকায় রওয়ানা হলেন।
হঠাৎ একদিন বাবার রুমের টেবিলের ড্রয়ারে একটা চিঠি দেখে নিগার পড়তে শুরু করল।
মা মেহের নিগার,
তুমি যে পথে চলেছ, তা ধ্বংসের পথ। তাই তোমাকে সেই পথ থেকে ফেরাবার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। সব জিনিসের যেমন দুটো দিক আছে। তেমনি শিক্ষারও দুটো দিক আছে। একটা ভালো অন্যটা মন্দ। বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা ভালো দিকটাকে সেকেলে ভেবে মন্দ দিকটাকে মডার্ন ও প্রগতিশীল মনে করে গ্রহণ করছে। এখন মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে চরম উন্নতি করলেও এবং তার সৎ ব্যবহার করতে জানলেও অসৎ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাই সারা বিশ্বে এত যুদ্ধ-বিগ্রহ, দেখাদ্বেষী, ও মানবতার চরম অবমাননা হচ্ছে।
আমার পরিচয় তোমাকে জানাই নি। জানালে তোমার পিলে চমকে উঠত এবং তুমি হয়ত ধ্বংসের পথে আরো বেশি অগ্রসর হতে। তাই এতদিন তোমাকে জানাই নি। বেশ কিছুদিন আমার মনে হচ্ছে, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। তাই প্রথম স্ট্রোক করার পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে কথাটা আরো বেশি মনে হতে লাগল। তখন তোমাকে আমার পরিচয় জানাবার খুব ইচ্ছা হলেও তোমার ভালোমন্দ চিন্তা করে জানাই নি। একদিন রাতে স্বপ্নে এক মৌলবি ধরনের লোক আমাকে বললেন, মেয়েকে তোমার আসল পরিচয় জানানো উচিত। স্বপ্নটা দেখার পরের দিন এই চিঠি লিখি।
লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জের জমিদার ইফতিদার আলির একমাত্র ছেলে আমি। জমিদারি প্রথা না থাকলেও আমার বাবার জমিদারের থেকে কম কিছু নেই। তারপর শিক্ষাজীবন ও বাবার সঙ্গে তার মনোমালিন্য ও বিলেতে ফিরে গিয়ে কিভাবে জীবন শুরু করলেন এবং দেশে ফেরার পর তার দুশ্চিন্তার কারণ পর্যন্ত পড়ে বাবার কথা মনে পড়তে নিগারের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। চিঠির বাকি অংশ পড়তে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুছে আবার পড়তে শুরু করল, বাবা হয়ে অনুরোধ করছি, আমি মারা যাওয়ার পর তুমি তোমার দাদাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং তিনি তোমাকে পেয়ে যা করবেন, মেনে নেবে। আশা করি মৃত্যুপথযাত্রী বাবার অনুরোধ রাখবে। আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করুক, এই দোয়া চেয়ে শেষ করছি।
ইতি–
তোমার বাবা মুক্তাদীর
চিঠিটা পড়ে নিগার অনেকক্ষণ চুপ কর বসে রইল। হঠাৎ তার মনে হলো, জমিদারের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি। তাই বোধহয় আল্লাহ পাক তাঁর এক নেকবান্দা আফজাল ভাইকে উপলক্ষ করে তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে হেদায়েত দান করেছেন। ভাবল, রেজাল্ট বেরোবার পর দাদাজীকে সবকিছু জানিয়ে চিঠি দিয়ে আসতে বলবে। ততদিন কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও অন্যান্য ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়ে ইসলাম সম্পর্কে আরো জ্ঞান অর্জন করবে।
তারপর কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা যত পড়তে লাগল, তত সবকিছু মেনে চলার প্রেরণা অনুভব করে অনুসরণ করার চেষ্টা করতে লাগল। নাইট ক্লাব যাওয়া তো বন্ধ করেছেই, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
তার পরিবর্তন দেখে আফসানা প্রায় প্রতিদিন তার কাছে আসে। সেও ঐসব পড়ে অনুসরণ করতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে দু’জনে ধর্ম ও বর্তমান মুসলমান সমাজের অবক্ষয়, আধুনিকতা ও নারী-পুরুষের সমান আবিষ্কারের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে।
একদিন আফসানা বলল, আফজাল ভাই তোকে কী যে জাদু করেছেন, তোর মতো মেয়েও হেদায়েত হয়ে গেলি?
নিগার হেসে উঠে বলল, আর তুইও তো তাই হয়েছিস।
আফসানা বলল, তাঁর সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। কই, আমাকে তো তিনি জাদু করলেন না? করলেন তোকে। আর তোর সংস্পর্শে এসে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দান করলেন।
তাঁ, আল্লাহ কখন কার অসিলায় হেদায়েত দান করেন, তা কেউ বলতে পারে না। আমার মনে হয়, আফজাল ভাইয়ের মধ্যে এমন কিছু জিনিস আছে, যে কেউ তার সংস্পর্শে আসবে, সেই হেদায়েত হয়ে যাবে। তা হ্যাঁরে, উনি আর তোদের বাসায় আসেন না?
না। তোকে যেদিন জাদু করে গেলেন, তারপর থেকে আর আসেন না। বাবাই আজ বলছিল, কেসের দিন এগিয়ে আসছে, অথচ আফজালের কোনো খবর নেই। আমি বললাম, তাকে খবর দিয়ে ডেকে পাঠালেই হয়। বাবা বললেন, ঢাকায় থাকলে তো ডেকে পাঠাব। কখন কোথায় থাকে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সুদূর উত্তরবঙ্গের গ্রামের ছেলে। সেখানেও সবসময় থাকে না। চিঠি দিলে দশ-পনেরো দিন পর পায়।
বললাম, ওঁর কেস তো অনেকদিন থেকে চালাচ্ছ, এতদিনেও ঢাকার ঠিকানা জেনে নাও নি?
বাবা বললেন, জানতে চেয়েছিলাম। বলল, ঢাকায় তার কোনো ঠিকানা নেই। গ্রামেই থাকে। ঢাকায় এলে হোটেলে থাকে।
জিজ্ঞেস করলাম, আগের কেসের দিনগুলোতে ঠিকমতো এসেছে?
হ্যাঁ, বরং চার-পাঁচদিন আগেই এসে দেখা করেছে।
এবারে কেসের দিন কবে?
বাবা বললেন পরশু।
বললাম, তা হলে নিশ্চয় আজ-কালের মধ্যে এসে যাবে।
নিগার বলল, এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি।
আফসানা হেসে উঠে বলল, কেন রে, প্রেমে পড়ে গেছিস না কি?
নিগারও হেসে উঠে বলল, তুই-ই তো বললি, আফজাল ভাই আমাকে জাদু করেছেন?
ভেবেছিলাম, তোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাদু করেছেন। প্রেমের জাদু করেছেন, ভাবি নি?
প্রেমের জাদু করেছেন কি না জানি না। তবে তাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। যিনি আমাকে অনেক বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করলেন, তাকে দেখতে ইচ্ছা করে কি না তুই-ই বল?
তোর কথা অবশ্য ঠিক; তবে কারো প্রেমে পড়লে তাকেও দেখতে ইচ্ছা করে।
তোর কথাও ঠিক, তবে তুই তো আমাকে খুব ভালোভাবে চিনিস, আমার মতো মেয়ে যার-তার প্রেমে পড়বে না।
তা আর চিনি না। এমনি ইয়ার্কি করে কথাটা বললাম। সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন?
এমন সময় কাজের বুয়া আসিয়া চা-নাস্তা নিয়ে এসে নিগারকে বলল, মেম সাহেব, খুড়ী, আপামনি, একজন বুড়োলোক আপনার কাছে এসেছেন।
আগে বাসার সবাই নিগারকে মেম সাহেব বলত। সেই রাতের পর থেকে নিগার তাদেরকে মেম সাহেবের বদলে আপামনি বলতে শিখিয়েছে।
আসিয়ার কথা শুনে নিগার বলল, কোনো ফকিরটকির নয় তো?
না আপামনি, উনি ফকির নন। চকচকে গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমি উনাকে ড্রইংরুমে বসিয়েছি।
তাই নাকি বলে নিগার আফসানাকে বলল, কে হতে পারে বলতে পারিস?
আফসানা বলল, না দেখে বলব কী করে?
নিগার আসিয়াকে বলল, তুই ওঁকে চা-বিস্কুট দে, আমরা আসছি।
চা-নাস্তা খেয়ে নিগার ও আফসানা ড্রইংরুমে এসে একজন সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধকে দেখে সালাম দিল।
ইকতিদার আলি সালামের উত্তর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দু’জনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি মেহের নিগারের কাছে এসেছি। তোমাদের দু’জনের মধ্যে নিশ্চয় কেউ একজন?
নিগার বলল, আমি মেহের নিগার। তারপর আফসানাকে দেখিয়ে বলল, আমার বান্ধবী আফসানা। পাশের বাড়িটাই ওদের। ওর বাবা আসির উদ্দিন একজন নামকরা উকিল।
ইকতিদার আলি একদৃষ্টে কিছুক্ষণ নাতনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। চশমা খুলে চোখ মুছে বললেন, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।
তাঁকে চোখ মুছতে দেখে দু’জনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল।
নিগার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার কাছে কেন এসেছেন বলুন।
ইকতিদার আলি বুকপকেট থেকে একটা ফটো বের করে বললেন, একে চেনো?
নিগার ফটোটা হাতে নিয়ে দেখেই চিনতে পেরে অবাককণ্ঠে বলল, অনেক আগের হলেও এ ফটো তো আমার বাবার। আপনি পেলেন কোথায়? তারপর আফসানার পাশে বসে ফটোটা দেখিয়ে বলল, তুইও নিশ্চয় চিনতে পারছিস?
আফসানা বলল, হ্যাঁ পারছি।
ইকতিদার আলি মৃদু হেসে বললেন, কোথায় পেলাম সে-কথা পরে বলছি। তোমরা যে ফটোটা চিনতে পেরেছ, তাতেই আমি খুশি। তারপর আবার চশমা খুলে চোখ মুছলেন।
তাই দেখে নিগারের মন বলে উঠল, ইনিই তোমার দাদাজী নয় তো? জিজ্ঞেস করল, আপনি বারবার চোখ মুছছেন কেন?
দেখছ-না বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছে?
সেই কারণটাই তো জানতে চাচ্ছি।
তোমার বাবার নাম মুক্তাদীর, তাই না?
জি।
যদি বলি মুক্তাদীর আমার একমাত্র সন্তান?
কথাটা শুনে দু’জনেই চমকে উঠলেও নিগারের মনে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। মনেমনে আল্লাহর শুকরিয়া জানাতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আফসানা বলল, শুধু ফটো দেখালে তো হবে, আপনি যে মুক্তাদীর চাচার বাবা, প্রমাণ করতে পারবেন?
ছেলের বাবা যখন হয়েছি, তখন আর প্রমাণ করতে পারব না? বল কী প্রমাণ চাও?
আমরা চাইব কেন? আপনি প্রমাণ করবেন।
আমি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জের জমিদার ইকতিদার আলি। আমার একমাত্র সন্তান মুক্তাদীর। বিলেতে উচ্চশিক্ষা নিতে পাঠিয়েছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যায়। এরপরের ঘটনা জানতে হলে তোমার বাবাকে ডেকে নিয়ে এস।
আফসানা অবাক হয়ে বলল, বাবা আপনাকে চেনেন?
ইকতিদার আলি ঢাকায় এসে প্রথমে আসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে নিগারের কাছে এসেছেন। বললেন, উকিল সাহেবকে ডেকে নিয়ে এলেই জানতে পারবে।
আসির উদ্দিন ইকতিদার আলিকে পাঠিয়ে কিছুক্ষণ পরে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু শুনছিলেন। এবার ভিতরে ঢুকে বললেন, হ্যাঁ মা, উনি যা বলেছেন, সব কিছু সত্য।
কেউ কিছু বলার আগে, নিগার ছুটে এসে দাদাজী বলে ইকতিদার আলিকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদল। তারপর পাশে বসে চোখ মুছতে মুছতে বলল, মা বা বাবা কেউই আপনার কথা আমাকে জানায় নি। কিছুদিন আগে বাবার ড্রয়ারে একটা চিঠি পাই। তাতে আপনার পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছেন। কিন্তু আপনি আমার কথা জানলেন কীভাবে? আমার ঠিকানাই-বা পেলেন কীভাবে?
ইকতিদার আলি মৃদু হেসে বললেন, আল্লাহর ঈশারাতেই ভূ-মণ্ডল ও আকাশ মণ্ডলীর সবকিছু চলছে। তারপর আসির উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই উকিল সাহেব মুক্তাদীরের ও তোমার সবকিছু পত্রের দ্বারা জানিয়েছেন।
নিগার প্রথমে দাদাজীকে ও পরে আসির উদ্দিনকে কদমবুসি করে বলল, চাচা, আপনার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। অনেক বেয়াদবি আপনার সঙ্গে করেছি, মাফ করে দিন।
আসির উদ্দিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক মা। তোমার ভালোমন্দ চিন্তা করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তাতে তুমি রাজি না হতে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিঠিতে সবকিছু জানিয়ে ওঁকে আসতে বলেছিলাম। কয়েকদিন আগে আফসানার মুখে তোমার পরিবর্তনের কথা শুনে খুব খুশি হয়েছি। আশা করব, তোমার দাদাজীর কথামতো চলবে।
ইকতিদার আলি বললেন, নিগার শুধু আমার একটা কথা মেনে নেবে। তারপর আমি ওর সব কথা মেনে চলব।
নিগার দাদাজীর দুটো হাত ধরে কাদাঁদ গলায় বলল, শুধু একটা কথা মেনে নেওয়ার কথা বলছেন কেন? আর আমার সব কথাই-বা মেনে চলবেন বলছেন কেন? বরং আমিই আপনার সব আদেশ-নির্দেশ মেনে চলব।
ইকতিদার আলি এবার আফসানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী দাদু, আরো প্রমাণ চাও না কি?
আফসানা ইকতিদার আলি ও বাবাকে কদমবুসি করে লজ্জিতকণ্ঠে বলল, আমি অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি, আমাকে আপনি মাফ করে দিন।
ইকতিদার আলি বললেন, তুমি কোনো বেয়াদবি করো নি, বরং যা কিছু বলেছ, তা বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। দোয়া করি, “আল্লাহ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন। সুখের করুক, শান্তির করুক।”
নিগার কাজের বুয়া আসিয়াকে ডেকে সবাইকে চা-নাস্তা দিতে বলল।
.
পরের দিন ইকতিদার আলি গ্রামে ফিরতে চাইলে নিগার রাজি হলো না। বলল, একসপ্তাহ অন্তত থাকুন, এর মধ্যে এই বাড়িটা কী করবেন না-করবেন ঠিক করুন।
ইকতিদার আলি বললেন, সে ব্যবস্থা এসেই করে ফেলেছি।
নিগার খুব অবাক হয়ে বলল, এসেই করে ফেলেছেন মানে?
মানে কাল এসে যখন তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তোমার আসির উদ্দিন চাচার সঙ্গে আলাপ করছিলাম তখনই বাড়িটার সব দায়-দায়িত্ব তার উপর চাপিয়ে দিয়েছি। মুক্তাদীরের বন্ধু নিশ্চয় বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে বেইমানি করবে না?
নিগার উঠুকণ্ঠে বলল, ওহ দাদাজী, এই বুড়ো বয়সেও আপনার এত বুদ্ধি? যুবক বয়সে না-জানি কত বুদ্ধি ছিল?
ইকতিদার আলি হেসে উঠে বললেন, বুদ্ধি না থাকলে কি জমিদারি চালান যায়? এবার আর যাওয়ার পথে নিশ্চয় বাধা নেই?
নিগারের ইচ্ছা আফজালের সঙ্গে দেখা করে যাবে। তাই বলল, বাধা না থাকলেও সবকিছু গোছগাছ করতে দু’তিন দিন সময় লাগবে।
ঠিক আছে, দুদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে যা করার করে নাও। তিন দিনের দিন আমরা রওয়ানা দেব।
কেসের দিন আফজাল কোর্টে এসে আসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে কাজ শেষ হওয়ার পর চলে গেছে।
আফসানার মুখে সেকথা শোনার পর নিগারের মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
চার দিন থেকে ইকতিদার আলি নাতনি নিগারকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেলেন।
যাওয়ার আগে নিগার আফসানাকে বলল, আমি চিঠি দেব, উত্তর দিস। আর আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে আমার সালাম দিয়ে বলবি, একদিনের জন্য হলেও তিনি যেন আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তার পথ চেয়ে থাকব।
আফসানা মৃদু হেসে বলল, কতদিন পথ চেয়ে থাকার কথা বলব?
নিগারও মৃদু হেসে বলল, আজীবন।
তুই তোর দাদুর জমিদারির একমাত্র উত্তরাধিকারী। জমিদারি পাওয়ার পর আফজাল ভাইকে তোর মনে থাকবে? আমার তো মনে হয়, তাকে ভুলেই যাবি? আফজাল ভাই গেলে হয়ত চিনতেই পারবি না।
এ ব্যাপার নিয়ে কোনো তর্ক তোর সঙ্গে করব না। শুধু এতটুকু বলব, জমিদারি পাওয়া রূপার মতো হলে, আফজাল ভাইকে পাওয়া হীরের মতো।
ওরে বাব্বা! এ যে দেখছি, আফজাল ভাইয়ের প্রেমে তুই হাবুডুবু খাচ্ছিস।
হ্যাঁ, হাবুডুবু খেতে খেতে তার প্রেম-সাগরে তলিয়ে যেতে চাই।
কিন্তু এত বাড়াবাড়ি কি তোর উচিত হচ্ছে? তিনি যদি তোর প্রেমকে অস্বীকার করেন অথবা তারও যদি অন্য কোনো প্রেমিকা থাকেন?
এত কথা বলবি না তো। যদি সেরকম কিছু হয়, জানার পর কী করব তোকে জানাব। আফজাল ভাইকে যা বলতে বললাম, বলবি কি না বল?
কথা দিচ্ছি বলব। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তোর মতো বন্ধু আমার আর কেউ নেই। তোকে আর দেখতে পাব না মনে পড়লে, শুধু কান্না পায়। খুব কষ্ট অনুভব করি।
নিগারও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তোর মতো আমারও হয়। তুই দেখিস, বছরে অন্তত দু’তিনবার আসবই।