আমিও মানুষ – ৫

প্রায় একবছর পর আজ আফজালকে আহত সোহরাব আলির পাশে দেখে নিগার যেমন খুব অবাক হলো, তেমনি মনের মধ্যে আনন্দের ফোয়ারা ছুটল। তখন তার দাদাজীর কথা মনে পড়ল, “পাগল না হলে কেউ বলে, আপনার নাতনি আমাকে ভালোবাসে, আমিও তাকে ভালোবাসি?” কথাটা মনে পড়তে মনের মধ্যে আনন্দের ফোয়ারা আরো দ্রুত বইতে লাগল। কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিল তার খেয়াল নেই। যখন ইকতিদার আলি আবার গর্জন করে উঠে বললেন, ম্যানেজার, ওকে জুতোপেটা করে নাকখত দেওয়ার ব্যবস্থা কর তখন নিগার বাস্তবে ফিরে এল।

ম্যানেজার সোহরাবকে জুতোপেটা করার জন্য রুস্তমকে হুকুম করল।

রুস্তম ষণ্ডামার্কা খুব শক্তিশালী লোক। জমিদারবাড়িতেই লালিত-পালিত। জমিদারবাড়িতে যত লোককে শাস্তি দেওয়া হয়, সব শাস্তি সে-ই দেয়।

পায়ের জুতো খুলে রুস্তম এগিয়ে এলে আফজাল তার পথ আগলে বলল, থামুন। তারপর ইকতিদার আলিকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই লোকটার প্রতি কেন এরকম শাস্তি দিচ্ছেন জানতে পারি?

এবার সকলের দৃষ্টি আফজালের উপর পড়ল, তারা অবাক হয়ে ভাবল, কে এই অচেনা যুবক? দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো সাধারণ ঘরের ছেলে। কিন্তু জমিদার ও তার এতগুলো লাঠিয়ালের সামনে কথা বলার সাহস পেল কী করে?

অনেকে আবার ভাবল, পাগলটাগল হবে হয়ত?

ইকতিদার আলি অগ্নিদৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড আফজালের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কে তুই? তোর এত বড় সাহস? আমার হুকুমে বাধা দিস?

আফজাল মৃদু হেসে বলল, এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলেন? না, না চেনার ভান করছেন?

ইকতিদার আলি কর্কশকণ্ঠে বললেন, আমার প্রশ্নের উত্তর দে।

আফজাল ভার রাগকে পাত্তা না দিয়ে নরমস্বরে বলল, যেই হই-না কেন, আমিও মানুষ। ভদ্রভাবে কথা বলুন।

ইকতিদার আলি রাগ সামলাতে পারলেন না। উচ্চস্বরে বললেন, সোহরাবের আগে এই পাগলটাকে জুতো মারতে মারতে এখান থেকে বের করে দাও।

কথাটা শুনে নিগার দাদাজীর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বলল, না দাদাজী না, আপনার আদেশ ফিরিয়ে নিন। উনি পাগল নন। আপনি বোধহয় চিনতে পারছেন না। উনিই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

নাতনি যে এরকম কথা বলবে, ইকতিদার আলি আগেই জানতেন। তিনি চান না, এই ঘোটলোক পাগল ছেলেটার সঙ্গে নাতনি সম্পর্ক রাখুক। বললেন, আশ্চর্য? এই ঘোটলোক পাগলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক?

দাদাজী আপনি বারবার ওকে ছোটলোকের ছেলে বলবেন না, আর উনি পাগলও নন। আপনি আদেশ ফিরিয়ে নিন।

ইকতিদার আলি বললেন, এখানকার সবাই জানে তোমার দাদাজী কোনো আদেশ দিলে, তা ফিরিয়ে নেয় না। ছেলেটা সত্যি ছোটলোকের কি না অথবা পাগল কি না তার প্রমাণ এক্ষুনি হয়ে যাবে। তুমি চুপ করে থাক।

মালিকের হুকুম পেয়ে রুস্তম আফজালকে মারার জন্য জুতো ওঠাল। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখল যে রুস্তমের হাতে জুতোপেটা খেয়ে কেউ কখনো হেঁটে ফিরে যেতে পারে নি। বাঁশের পাটায় করে নিয়ে যেতে হয়, সেই রুস্তমের হাতটা উপরে উঠেই থেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়ে তার মুখটা বিবর্ণ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জুতো ফেলে দিয়ে আফজালের দুটো পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছে, আর অস্ফুটস্বরে কী যেন বলছে।

বিনামেঘে বজ্রপাত হলেও সবাই এত অবাক হতো না। কিন্তু নিগার এতটুকু অবাক হয় নি। সে এই রকম কিছু আশা করছিল। হাসি মুখে আফজালের দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলতে পারল না।

একসময় ইকতিদার আলি রাগের সঙ্গে বললেন, রুস্তম জানিস তো, আমার হুকুম অমান্য করলে কী শাস্তি পেতে হয়?

রুস্তম এবার আফজালের পা ছেড়ে দিয়ে ইকতিদার আলির কাছে এসে দু’পা জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল, আর মাথা নাড়াতে লাগল। ইকতিদার আলি তাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে বল।

রুস্তুম জুতো মারতে গিয়ে আফজালের চোখে এমন কিছু জিনিস দেখেছে, যা দেখে সে ভীষণ ভয় পেয়েছে এবং তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাই কথা বলতে না পেরে চোখের পানিতে বুক ভেজাতে ভেজাতে মাথা নেড়েই বলল।

ইকতিদার আলি আরো রেগে গিয়ে হুকুম দিলেন, এই কুত্তার বাচ্চাকে হাত পা বেঁধে বন্দিখানায় রেখে আয়।

তিন চারজন লোক রুস্তমের দিকে এগিয়ে এলে আফজাল কঠিনস্বরে বলল, খবরদার, শুধু এখন নয়, ভবিষ্যতেও কেউ ওর গায়ে হাত দেবেন না। তারপর ইকতিদার আলির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি মানুষ নামের অযোগ্য। এত বয়স হলো, তবু মরণের ভয় আপনার দিলে এল না। আপনি কি মনে করেছেন, ফেরাউন ও শাদ্দাদের মতো আয়ু পাবেন? তারা হাজার বছর আয়ু পেয়ে নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিল। আপনিও কি তাদের দলভুক্ত হতে চান? তা যদি না চান, তা হলে শুনুন, শুধু নামাজ, রোযা, হজ ও যাকাত আদায় করলেই মুসলমান হয় না। যারা নিজের কামনা-বাসনা ত্যাগ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দ.) এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে তাদেরকেই মুসলমান বলে। আর তাদেরকেই ইহকালে উত্তম রেযেক ও পরকালে বেহেস্ত দিবেন বলে আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন। আপনি জমিদার বংশে জন্মেছেন। জীবন-যৌবন ভোগ-বিলাসে কাটিয়েছেন। মুসলমান হয়েও কুরআন-হাদিস পড়েন না। সেসবে কী বিধিনিষেধ আছে তাও জানেন না। কুরআনে আছে, “আর তোমরা আল্লাহ তায়ালারই ইবাদত কর, এবং তাহার সহিত কাহাকেও শরীক করিও না। এবং পিতা-মাতার সহিত সদ্ব্যবহার কর, এবং আত্মীয়স্বজনের সহিত ও এবং এতিমদের সহিতও এবং দরিদ্রগণের সহিতও, এবং নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের সহিতও এবং দূরবর্তী প্রতিবেশীদের সহিতও এবং সহচরদের সহিতও এবং পথিকদের সহিতও এবং উহাদের সহিতও যারা তোমাদের মালিকাধীন আছে। নিশ্চয় আল্লাহ এরূপ লোকদিগকে ভালবাসেন না, যাহারা নিজেকে বড় মনে করে ও আত্মগর্ব করে।” [সুরা-নিসা, আয়াত-৩৬, পারা-৫]

আরেকটা কথা জেনে রাখুন, মেহের নিগার আপনার মতো লোকের নাতনি জানলে তাকে পছন্দ করতাম না। তারপর নিগারকে উদ্দেশ্য করে বলল, দুঃখিত, আজ আপনার সঙ্গে দেখা হলেও কোনো আলাপ করতে পারলাম না। আল্লাহ রাজি থাকলে ঢাকায় আলাপ হবে। তারপর সোহরাব আলির কাছে এসে তার বাঁধন খুলে দিতে দিতে বলল, এই লোকটা মাঠে খালের পানি ওঠানোর ব্যাপারে গ্রামসুদ্ধ লোক নিয়ে আপনার কাছে এসে উত্তম প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু আপনি জমিদার, সেই অহঙ্কারে তাদের প্রস্তাব মেনে না নিয়ে অন্যায়ভাবে পানি থেকে বঞ্চিত করছিলেন। তাই হয়ত তারা আপনার দেওয়া খালের বাঁধ কাটতে গিয়েছিলেন। এটা ন্যায় না অন্যায় ভেবে দেখুন। আপনার কাছে অনুরোধ করছি, ওঁদের রাতের জোয়ারের পানি মাঠে ওঠাতে দিন, আর আপনি দিনের বেলা তোলার ব্যবস্থা করুন। যদি আমার অনুরোধ না রেখে ওদেরকে বাধা দিতে যান, তা হলে যারা বাধা দিতে যাবে রুস্তমের মতো অবস্থা তাদের হবে। আর শুনুন, ক্ষমতাবান হয়ে যদি দুর্বলদের প্রতি দয়া দেখান এবং ইনসাফমতো বিচার করেন, তা হলে আল্লাহ আপনাকে ইহকালে যেমন ধন-দৌলত ও মান-ইজ্জত বাড়িয়ে দেবেন, পরকালেও তেমনি বেহেস্ত নসিব করবেন। তারপর সোহরাবের বাঁধন খোলা হয়ে যেতে তার হাত ধরে আপনি আমার সঙ্গে আসুন বলে হাঁটতে লাগল। লাঠিয়ালবাহিনী, জমিদারের লোজন ও গ্রামবাসী বোবা দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, বরং সরে গিয়ে তাদের পথ করে দিতে লাগল।

ইকতিদার আলি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কে যেন তাঁর জিব ভিতরের দিকে টেনে রেখেছে। খুব অসস্তিবোধ করে নাতনির দিকে বারবার তাকাতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ নিরবতা বিরাজ করতে লাগল। সবাই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সকলের কাছে ঘটনাটা ভোজবাজি বলে মনে হতে লাগল।

দাদাজীর অবস্থা কিছুটা যেন নিগার আন্দাজ করতে পারল। একটু উচ্চস্বরে বলল, দাদাজীর শরীর খারাপ লাগছে, আপনারা এখন সবাই চলে যান।

তার কথা শুনে ম্যানেজার ইকতিদার আলির কাছে এসে বললেন, ডাক্তার আনতে পাঠাব?

ইকতিদার আলি কথা না বলে হাতের ইশারায় না করে সবাইকে চলে যেতে বললেন।

নিগারের কথা শুনে গ্রামবাসীরা চলে যেতে লাগলেও লাঠিয়ালবাহিনী দাঁড়িয়েছিল।

ম্যানেজার তাদেরকেও চলে যেতে বললেন।

নিগার দাদাজীর হাত ধরে বলল, আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ভিতরে চলুন আরাম করবেন।

ইকতিদার আলি প্রতিবাদ না করে নাতনির সঙ্গে রুমে এলেন।

ইকতিদার আলির বয়স যখন ষাট বছর এবং অনেক চেষ্টা করেও মুক্তাদীরের কোনো খোঁজ-খবর পেলেন না তখন বংশরক্ষা ও বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করার কথা চিন্তা করে পঁচিশ বছরের সালমা বেগমকে বিয়ে করেন। আল্লাহর কী কুদরত, যে-জন্য তিনি বিয়ে করলেন, সে আশা তাঁর পূরণ হলো না। আজও সালমা বেগমের পেটে সন্তানাদি হয় নি। সালমা বেগমের বয়স এখন চল্লিশের উপর। তিনি নিগারকে খুব ভালোবাসেন।

নিগার দাদাজীকে ঘরে নিয়ে এলে সালমা বেগম নিগারকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বুবু, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে? বিচার হয়ে গেল?

নিগার ইশারায় দাদিকে চুপ করে থাকতে বলে দাদাজীকে খাটে শুইয়ে দিল। তারপর ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বলল, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন, ভালো লাগবে।

সালমা বেগম আতঙ্কিতস্বরে বললেন, তোর দাদিজীর শরীর খারাপ? নিগার তার একটা হাত ধরে বারান্দায় এনে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও অন্য একটা চেয়ারে বসে ঘটনাটা বলে বলল, ঐ আফজালের কথাই আপনাকে একদিন বলেছিলাম। সালমা বেগম বললেন, ঘটনাটা শুনে মনে হচ্ছে, ছেলেটার মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে।

আমারও তাই মনে হয়। ঢাকায় বাবার বন্ধু উকিল চাচাও তাই বলেন।

তোর উকিল চাচা তা হলে আফজালকে চেনেন?

হ্যাঁ চেনেন, কী একটা কেসের ব্যাপারে আফজাল উকিল-চাচার কাছে মাঝে মাঝে যান।

আফজালের কথা তোর দাদাজীকে বলেছিস?

কিছুদিন আগে আমি যখন ঢাকা গিয়েছিলাম তখন আফজাল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। দাদাজী তাকে পাগল ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজও তাই ভেবে রুস্তুমকে দিয়ে জুতো মেরে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার ফল কী হলো, তা তো বললাম।

তুই যে আফজালকে ভালোবাসিস, তোর দাদাজী জানে?

হ্যাঁ, জানেন।

আমার যতদূর বিশ্বাস, সে আফজালের হাতে তোকে দেবে না।

তা আমিও জানি। তবে আমারও এক কথা, ওঁর সঙ্গে বিয়ে না দিলে আমি সারাজীবন বিয়েই করব না।

সালমা বেগম বললেন, আজকের ঘটনার পর আফজালের ব্যাপারে তোর দাদাজীর মতামত পাল্টাতে পারে।

নিগার বলল, আমারও তাই মনে হয়। দাদাজীর কথা বাদ দিন। আপনার মতামত বলুন।

সালমা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, জমিদারি আমলে যেমন এ বাড়ির বৌয়েদের মতামতের এক কানাকড়িও দাম ছিল না, তেমনি আজও নেই।

জমিদারি আমালের কথা ছেড়ে দিন। এখন সভ্যযুগ। নারী-পুরুষের সমান অধিকার। তা ছাড়া ইসলামও নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। যদিও আলেমরা মেয়েদেরকে তা জানায় নি।

এমন সময় ইকতিদার আলি এসে তাদের পাশে চেয়ারে বসে বললেন, দাদি-নাতনিতে কী এত আলাপ হচ্ছে?

নিগার বলল, এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন? আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ভালো হতো না?

তা অবশ্য হতো; কিন্তু আফজাল নিতে দিল না। আচ্ছা, তুই ওর ঠিকানা জানিস না?

জি না দাদাজী, জানি না।

আমার তো মনে হচ্ছে আশেপাশের কোনো গ্রামেই ওর বাড়ি।

তাই যদি হয়, তা হলে আপনি লোকের দ্বারা খোঁজ নিতে পারেন।

হ্যাঁ, তাই নেব। একবার যদি বাছাধনকে পাই, তা হলে খালপোশ করে গায়ে লবণ ও মরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দেব। তখন তার বাহাদুরি দেখা যাবে। তারপর নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ওকে ভুলে যাও। তোমার বাপের মতো একগুঁয়েমি করো না। নচেৎ তোমার পরিণাম ভালো হবে না। এতবড় সাহস? শত শত মানুষের সামনে আমাকে যা-তা বলে অপমান করল?

নিগার মনে করেছিল, আফজালের ও কুরআন হাদিসের কথা শুনে তার মতো দাদাজীরও দিব্যচোখ খুলে যাবে। কিন্তু এখন তার কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল। মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেল।

সালমা বেগম নাতনির মুখের অবস্থা একবার দেখে নিয়ে বললেন, আজ তো তোমার লাঠিয়ালবাহিনীর সামনে তাকে পেয়েছিলে, যা বললে তা করলে না কেন?

স্ত্রীর কথায় উত্তর দিতে না পেরে ইকতিদার আলি অগ্নিদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, হ্যাঁ তাই করতাম। কিন্তু ওর স্পর্ধা দেখে রাগে সে-কথা মাথায় আসেনি। মনে হয় ছেলেটা ম্যাসমেরিজাম অথবা জাদু-টাদু জানে। সবাইয়ের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে সোহরাব আলিকে নিয়ে চলে গেল।

সালমা বেগম বললেন, তাই যদি মনে কর, তা হলে তাকে ধরে এনে কিছু করার আগেই তো ঐসব করে আবার ধাঁধা লাগিয়ে চলে যাবে?

স্ত্রীর এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আফজাল তোমাকে জাদু করেছে। রুস্তমকেও জাদুর দ্বারা ভয় দেখিয়েছে। আমার নাম ইকতিদার আলি, আমিও দেখে নেব, কতবড় জাদুকর।

সালমা বেগম বললেন, নিগারের মুখে শুনলাম, আফজাল ধার্মীক। ধর্মীয় জ্ঞানও তার অনেক। ধার্মিক লোকেরা আবার জাদুকর হয় কী করে?

ইকতিদার আলি বারবার স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন। রাগের সঙ্গে বললেন, তুমি যে দেখছি ঐ বদমাইশটার হয়ে কথা বলছ। মনে হয় নিগার তোমাকে তার ভালোবাসার কথা বলেছে?

নিগার দাদাজীর রাগ দেখে আরো ভয় পেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেখান থেকে চলে গেল।

সালমা বেগম বললেন, হ্যাঁ বলেছে। ‘দাদাকে বলতে পারলে দাদিকে বলবে কেন?

তা হলে তুমিও জেনে রাখ, আমি বেঁচে থাকতে ওর হাতে নিগারকে তুলে দেব না। আমার কথার নড়চড় যে হয় না, তা তুমি ভালো করেই জান। আর নিগারকেও কথাটা জানিয়ে দিও।

আর আফজাল যদি জাদুর দ্বারা নিগারকে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, তা হলে কী করবে?

তা হলে ওর থেকে বড় জাদুকরের দ্বারা ওদেরকে খুঁজে বের করে দু’জনকে একসঙ্গে জ্যান্ত কবর দেব।

তাই দিও বলে সালমা বেগমও সেখান থেকে চলে গেলেন।

স্ত্রী চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ইকতিদার আলি ভাবলেন, সালমা তো কখনো তার মুখের উপর তর্ক করে না, কিন্তু আজ করল কেন? তা হলে কি বদমাইশটা ওকেও জাদু করেছে? হঠাৎরুস্তমের কথা মনে পড়তে কাছারিবাড়িতে এসে রুস্তমকে ডেকে পাঠালেন।

কিছুক্ষণ পর রুস্তুম চোখ মুছতে মুছতে এসে মাথা নিচু করে একপাশে দাঁড়াল।  

ইকতিদার আলি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কীরে বেটা, এখনো কাঁদছিলি? আফজালকে জুতো মারতে গিয়ে কী এমন হলো যে, তুই তার পা ধরে মাফ চাইলি? তখন জিজ্ঞেস করতে কিছু বলতেও পারলি না?

রুস্তম তখনো পুরোপুরি ধাতস্থ হয় নি। তোতলাতে তোতলাতে বলল, হুজুর, সে-কথা মনে পড়লে আমার কলজে শুকিয়ে যায়। জুতো তুলে মারার সময় ওনার চোখে চোখ পড়তে দেখতে পেলাম, একজন দৈত্যের মতো লোক বড় বড় আগুনের মতো চোখ বের করে, দুহাতে দুটো ছোরা নিয়ে মারার জন্য আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তখন ভয়ে আমার শরীর ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল। তারপর কী করেছি কিছুই মনে নেই।

ইকতিদার আলির দৃঢ় ধারণা হলো, আফজাল জাদু জানে। বললেন তুই এখন যা।

রুস্তুম চলে যাওয়ার পর ম্যানেজার সামসুদ্দিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জাদু বিশ্বাস কর?

জি করি।

কেন কর? কোনো প্রমাণ পেয়েছ?

জি না প্রমাণ পাই নি। তবে কুরআনে জাদুর কথা উল্লেখ আছে।

মৌলবিদের মুখে শুনেছ? না নিজে কুরআনের ব্যাখ্যা পড়ে জেনেছ?

কুরআনের ব্যাখ্যা পড়ে জেনেছি।

তোমার কী মনে হয়, আজ আফজাল, মানে ঐ যে ছেলেটা সোহরাব আলির বাঁধন খুলে নিয়ে চলে গেল, সে জাদু জানে?

জাদু সত্য হলেও বর্তমান দুনিয়ায় আছে বলে মনে হয় না। তবে ম্যাসমেরিজাম বলে একটা বিদ্যা আছে, যে এই বিদ্যায় পারদর্শী, সে অনেক অবাস্তব ঘটনা ঘটাতে পারে। আমার বিশ্বাস, আফজাল ম্যাসমেরিজামবিদ্যায় পারদর্শী।

তোমার কথা অস্বীকার করব না। এখন যা বলছি মন দিয়ে শোনো, আমার ইচ্ছা, নিগারের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আফজাল। আফজাল জাদু করে হোক আর ম্যাসমেরিজাম করেই হোক, নিগারের মন জয় করেছে। নিগারও তাকে ভালোবাসে। বিয়েও করতে চায়। আমিও বলে দিয়েছি, একটা জাদুকর ছেলের হাতে তোমাকে দেব না। এখন তোমার পথের কাঁটা তোমাকেই দূর করতে হবে। তুমি লোক লাগিয়ে আফজালের খোঁজ নাও। কোথায় বাড়ি? কার ছেলে? কী করে? এককথায় তার পুরো বায়োডাটা নিয়ে আমাকে জানাবে। তারপর আমি দেখে নেব, সে কতবড় জাদুকর অথবা ম্যাসমেরিজিয়ান। সেই সাথে আরো খোঁজ নেবে দেশে বা বিদেশে কোনো বড় জাদুকর অথবা ম্যাসমেরিজিয়ান আছে কি না। যদি থাকে, তার ঠিকানাও জেনে আমাকে বলবে। আর এর জন্য যত টাকা-পয়সা লাগে আমি দেব।

নিগারকে প্রথম দিন দেখেই ম্যানেজার সামসুদ্দিন মুগ্ধ হলেও তাকে পাওয়ার স্বপ্ন কোনদিন দেখে নি। এখন তার সঙ্গে মালিক বিয়ে দেবেন শুনে তার হার্টবিট হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে সামলে নিয়ে বলল, জি, আপনার কথামতো কাজ করার ব্যবস্থা এখন থেকেই শুরু করব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। তারপর বলল, মাঠে খালের পানি তোলার ব্যাপারে কিছু বলবেন না?

ইকতিদার আলির তখন রুস্তমের অবস্থার কথা মনে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। যা বললাম, তাই তুমি কর?

জি আচ্ছা বলে সামসুদ্দিন সেখান থেকে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *