আবার যদি ইচ্ছা কর – ৬

০৬.

নতুন করে জীবনের সালতামামি করতে বসেছে ভিন্সেন্ট। সব কিছুই শূন্য হয়ে গেছে হঠাৎ। উনিশ বছরের জীবনেই সব কিছু ফুরিয়ে গেল যেন। বাপ মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল শৈশবে-দুরন্ত অভিমানে সব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল; জীবনের নূতন অর্থ খুঁজে পেয়েছিল ফাদার শারদাঁর আশীর্বাদে। ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতে শিখেছিল। দৃঢ় বিশ্বাসের সম্বলটুকু নিয়ে এখানে এসেছিল সেবা করতে, ঈশ্বরের জয়গান গাইতে। বাধা পেল দুদিক থেকেই। চার্চ থেকে বিতাড়িত হল, গীর্জায় তার প্রবেশ মানা। মুখ ফিরিয়ে নিল কুলি-ধাওড়ার মানুষগুলো–যাদের সেবা করতে, যাদের ভালবাসতে সবকিছু ছেড়ে সে ছুটে এসেছিল এখানে। সে আঘাতটাই বেশি করে বেজেছে ওর।

দুর্ঘটনায় ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তিল তিল করে ওদের স্বাভাবিক করে তুলবার চেষ্টা করছিল ভিন্সেন্ট! যোসেফ মুর্মু নেই, এককড়ি সরখেল মারা গেছে– ওরা ওদের ফাদারদাকেই দলপতি ঠাওরালে। ভিন্সেন্ট শ্রমিক আন্দোলনের কিছুই জানে না; সাধারণ বুদ্ধিতে ওর মনে হয়েছিল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে কব্জা করতে হলে এদের দলবেঁধে প্রতিবাদ করতে হবে। বেশি কিছু চায়নি তারা কিছু নিরাপত্তার ব্যবস্থা, ভরপেট খাওয়ার মত মজুরি, আর দুর্ঘটনায় মৃত মালকাটাদের অসহায় পরিবারবর্গের জন্য কিছু সাহায্য। কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করল না। ভিন্সেন্ট ওদের ঘরে ঘরে গিয়ে পরামর্শ দিয়েছিল, কেউ কাজে যাবি না, দেখি ওরা কতদিন কয়লাকুঠি বন্ধ করে রাখতে পারে?

নিদারুণ অভিমানে ওরা সায় দিয়েছিল, হঁ! ই কি মঘের মুলুক বটে? মোরা কেউ যাবক নাই!

ফলে যা হয়ে থাকে। তিল তিল করে অনশনের মুখে এগিয়ে যায় মানুষগুলো। অর্ধাহার, অনাহার–পেট বড় অবুঝ! জমানো পুঁজি কারও নেই। ধার মেলে না। ওরা মরিয়া হয়ে ওঠে।

ভিন্সেন্ট বলে, –তোরা ধাওড়া ছেড়ে নিজের নিজের দেশঘরে ফিরে যা!

দেশঘর? সেটা আবার কি? ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এই ধাওড়াই তো তাদের দেশঘর। এখানেই জন্মেছে, এখানেই মরতে দেখেছে বাপ-জ্যাঠাদের। জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারির বাইরে যে দুনিয়া আছে এটা ওরা জানেই না। মাঝে মাঝে গেছে রাণীগঞ্জ, বরাকর, আসানসোল; কিন্তু সেখানে কে ওদের খেতে দেবে? থাকতে দেবে?

শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতে হল। মাথা নিচু করে বারোদিন অনশনের পরে ওরা গুটি গুটি এসে হাজির হল কয়লাকুঠির ফটকের সামনে।

পাঁচু হালদারের দল হেসে বলে, –সেই তো পানি খেলি, তবে কেন জল ঘোলালি?

সবচেয়ে করুণ অধ্যায়–এ নিদারুণ পরাজয়, এ অপমানের জন্য ঐ মালকাটার দল ঈশ্বরকে অভিশাপ দিল না, কর্তৃপক্ষকে গাল পাড়ল না, উল্টে দায়ী করল তাদের ফাদারদাকে। সেই তো কাজ বন্ধ করার পরামর্শটা দিয়েছিল প্রথমে! ওরা তাকে এড়িয়ে যায়। পাঁচু হালদারের দলও তাই চায়, বলে, –ঐ ফাদারদার সাথে যে বাৎ করবে তারে ছাঁটাই করব কিন্তু!

গীর্জা থেকে বিতাড়িত হয়ে ভিন্সেন্ট এসে উঠেছে তেঁতুলডাঙার মাঠে, সন্ন্যাসীর পরিত্যক্ত কুটিরে। হেরে গেছে সে। সব দিকে। কোলিয়ারিতে সে অবাঞ্ছিত। কর্তৃপক্ষ, চার্চ-সম্প্রদায়, মায় মালকাটারাও তাকে পরিহার করে চলে। এ-পাশে তেঁতুলডাঙার কোলিয়ারি। মাঝখানে সিঙারণ নদী। ভিন্সেন্ট আজ অন্তেবাসী। একা।

তার চেয়েও করুণ অধ্যায় ওর বিশ্বাসের ভিতটা গেছে নড়ে। কোথায় তার দীনের বন্ধু পরম করুণাময় ঈশ্বর? কোথায় সেই শিষ্টপালন দুষ্টদমন ন্যায়াধীশ? সব মিথ্যা! সব ভুল! ঈশ্বর নেই! থাকলেও তিনি হয় মূক, নয় বধিরনাহলে উদাসীন! ধরা যাক যোসেফ মুর্মুর মৃত্যুর কথাটা। লোকটা মৃত্যুর উল্লেখ সইতে পারত না। কয়লাখনির আগুনের বেড়াজাল ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল ঠিক–অথচ বাঁচল না। কী প্রয়োজন ছিল ঈশ্বরের ঐ ধর্মভীরু মানুষটাকে বাইরে টেনে এনে ওভাবে দশ দিন। বাঁচিয়ে রাখার? সর্বাঙ্গে দগদগে ঘা নিয়ে লোকটা ক্রমাগত কাতরেছে আর মৃত্যু কামনা করেছে। জ্ঞান ছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল তার। ভিন্সেন্ট বসেছিল ওর মৃত্যুশয্যার পাশে। ও শুধু দেখছিল ঐ অসহায় মানুষটাকে–যার একমাত্র কামনা ছিল, যন্ত্রণার অবসান-মৃত্যু! এই কি করুণাময় ঈশ্বরের লীলা? দশ দিন লোকটাকে ঐভাবে জিইয়ে রাখায়?

এরই মধ্যে ওর কাছে একটা হাতচিঠি পাঠিয়েছিল চিত্রলেখা। মালকাটাদের একটা বাচ্চার হাতে। প্রেমপত্র পড়ে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল ভিন্সেন্টের। এরা কি মানুষ? কোলিয়ারির এতবড় সর্বনাশের সময় চিত্রলেখা গৃহত্যাগের স্বপ্ন দেখেছে! ঐ ছেলেটার হাতেই কড়াসুরে জবাব পাঠিয়েছিল ভিন্সেন্ট। লিখেছিল, এভাবে যেন ভবিষ্যতে চিত্রলেখা তাকে আর বিরক্ত না করে!

ফাদার শারদাঁকে কোন চিঠি দেয়নি এখানে আসার পর। এবার লিখেছে। সব লিখেছে। সব কথা জানিয়ে। নির্দেশ চেয়েছে এবার সে কি করবে। ফিরে যাবে? উত্তরের প্রতীক্ষায় দিন গুনছে ভিন্সেন্ট। কলাকুঠির জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কেউ ওর সঙ্গে কথা বলে না। একমাত্র ব্যতিক্রম ঐ নষ্ট মেয়েমানুষটাবাসী। রোজ সকালে এসে একঘটি দুধ সে আজও খাইয়ে যায় তাকে। নানকু নেইদুধের পরিমাণটা বেড়েছে। কমেছে প্রগম্ভতাটা। কৌতুকময়ী দেহোপজীবিনী যেন সে নয়, সন্তানহারা অভাগিনী আজ।

হাতে কাজ নেই, মনটা ফাঁকা, প্রতীক্ষা করছে ফাদার শারদাঁর নির্দেশের। অলস ভঙ্গিতে দিন কেটে যায়। একদিন হঠাৎ কি খেয়াল হল, এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে সামনের ঐ সেতুটা আঁকতে বসল। আর কিছু নয়, সময়টা তো কাটবে। এ-পারে তেঁতুলডাঙার ঊষর বন্ধ্যা মাঠ, ও-পাশে জোড়-জাঙ্গাল কেলিয়ারির নিষিদ্ধ জীবনছন্দ–মাঝখানে ক্ষীণ একটা কাঠের সেতু। কতকগুলি মালকাটা স্নান করছে। কাপড় কাঁচছে। একটা ছোট ডিঙি নৌকাও বাঁধা আছে। সাঁকোর উপর দিয়ে মাঝে মাঝে পার হয়ে যাচ্ছে এক ঘোড়ার গাড়ি, গো-যান।

সারাটা দিনমান ভিন্সেন্ট ঐ সাঁকোটার ছবি আঁকল বসে বসে।

আশ্চর্য একটা অনুভূতি। দিনটা কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পায়নি। ও বিশেষ কিছু মনে করে আঁকতে বসেনি, চেয়েছিল শুধু সময়টা কাটাতে কিন্তু ছবিখানা শেষ করে ওর মনে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি এল।

কাগজের চতুঃসীমায় আবদ্ধ ঐ ছোট্ট ভূখণ্ডে ঈশ্বরের সৃষ্ট দুনিয়া নয়–এ তার নিজের সৃষ্ট জগৎ! এখানে তার হুকুমে সব কিছু চলবে। এখানকার মালকাটারা নেমকহারাম নয়, এখানকার যোসেফ মুর্মু আগুনে পুড়ে মরে না, এখানকার নানকুকে সে তার বারাঙ্গনা মায়ের কোল খালি করে পালাতে দেবে না! এ রাজ্যের একছত্র মালিক ভিন্সেন্ট ভান গর্গ–কোনও খেয়ালী, উদাসীন বিশ্বনিয়ন্তা নন!

আশ্চর্য! আশ্চর্য! এ এক অদ্ভুত অনুভূতি!

ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ছবিটা ভাল হয়নি। চোখের সামনে যা দেখেছে তা ফুটে ওঠেনি কাগজের বুকে। পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে ওর ধারণা নেই। দৃশ্যপটের বিলীয়মান বিন্দু কাকে বলে জানে না। দেবনারায়ণবাবুর ক্লাসে যদি আর একটু মন দিয়ে ছবি আঁকা শিখত, তাহলে আরও ভাল করে আঁকতে পারত। তা হোক, ও তো ঐ সাঁকোটার হুবহু ছবি আঁকতে চায়নি। ও চেয়েছিল ওর মনগড়া একটা মিলন-সেতু রচনা করতে। ওর সেতু তেঁতুলডাঙার ঊষর বন্ধ্যা মাটির সঙ্গে জোড় জাঙ্গালের কোলিয়ারিকে যুক্ত করেনি করেছে ওর নিরীশ্বর নিরানন্দ উষর জীবনের সঙ্গে শিল্প-জগতের নূতন আনন্দলোকের। এ তার মনোময় সাঁকো, তার অন্তর্লোকের একটি ভাবরূপ সে মূর্ত করেছে ঐ কাঁচা হাতের ছবিখানায়।

একটা নূতন অনুভূতি, নূতন চেতনা। না, ভিন্সেন্টের সবকিছু শূন্য হয়ে যায়নি। সে নূতন মনোময় জগৎ সৃষ্টি করবে-কাগজের বুকে, ক্যানভাসের উপর! ফাদার শারদাঁ ওকে উপনিষদ থেকে পড়িয়েছিলেন-ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা! আজ অপরিসীম বেদনার মধ্যে দিয়ে ভিন্সেন্ট উপলব্ধি করল আর একটা নূতন সত্য ব্ৰহ্ম মিথ্যা, জগৎ সত্য!!

এ জগৎকে সে নূতন করে সৃষ্টি করবে। সে শিল্পী হবে, চিত্রকর হবে। এই তার জীবনের নূতন দীক্ষা!

মনে পড়ল সিস্টিন চ্যাপেলে আঁকা মিকেলাঞ্জেলোর শেষবিচারের সেই অনবদ্য চিত্রটির কথা। ঈশ্বর অলীক, ঈশ্বর মায়া–কিন্তু যীসাস বাস্তব সত্য! তার দুঃখ ভোগ কোন ধর্মযাজকের কল্পনাবিলাস নয়! মিকেলাঞ্জেলো সেই যীসাস ক্রাইষ্টকে চিরাচরিত পদ্ধতিতে আঁকেননি–অনশনক্লিষ্ট, শীর্ণকায়, নতশির প্রৌঢ় মানুষটি নন, তাঁর হাতেপায়ে পেরেকের দাগ আর আনত মস্তকে মৃত্যু-যন্ত্রণার ব্যঞ্জনা নয়–মিকেলাঞ্জেলো যীসাসকে এঁকেছেন উনিশ বছরের তরুণের রূপে। শালপ্রাংশু মহাভুজ তিনি, পেশীবহুল দীর্ঘ অবয়ব, গ্রীক দেবতা অ্যাপোলোর মত, গোলিয়াহ্ম ন ডেভিডের মত, নিমীয়া সিংহদলন হারকিউলিসের মত! এমন যীসাসকে ঈশ্বর গড়তে পারেননি, পেরেছেন। মিকেলাঞ্জেলো বুয়োনারতি! ঈশ্বর যা পারেন না, শিল্পী তাই পারে!

ভিন্সেন্টও এমন অবাক দুনিয়া সৃজন করবে!

ওর ব্যাগে ছিল কিছু কাগজ আর একটা পেন্সিল। ভিন্সেন্ট সাঁকো পার হয়ে জোড় জাঙ্গালে প্রবেশ করল গুটিগুটি। কেউ তাকে কিছু বলে না। সে আপন মনে বসে পড়ে পথের ধারে, কয়লা স্কুপের উপর, কখনও বা কারও দাওয়ায়। যা দেখে তাই আঁকে। শুধু যা দেখে তাই নয়, যা দেখলে সে খুশি হত তাও। মালকাটার দল সার বেঁধে চলেছে, টেবিল থেকে কয়লার টুকরো বেছে তুলছে, মালবোঝাই টব ঠেলে নিয়ে চলেছে। দ্রুত হাতে স্কেচ এঁকে যায় ভিন্সেন্ট। আঁকে আর দেখে। পছন্দ হয় না। ছিঁড়ে ফেলে। আবার আঁকে। মনের মত হয় না। আবার ছেড়ে।

হঠাৎ খেয়াল হল, আচ্ছা অবসর নেবার পর দেবনারায়ণবাবু তো আসানসোলেই থাকেন। ঠিকানাটা ঠিক জানা নেই, কিন্তু খুঁজে নিতে পারবে না? আসানসোল এখান থেকে পঁচিশ ক্রোশ, মানে পঞ্চাশ মাইল। ট্রেন ভাড়ার সম্বল নেই কিন্তু এটুকু পথ হেঁটে যেতে আর কতক্ষণ লাগবে? বড় জোর দুদিন। সকাল সকাল রওনা হলে পরদিন সন্ধ্যের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। পরদিন প্রত্যুষেই সে বার হয়ে পড়ল খানকতক স্কেচ হাতে নিয়ে। তখনও সূর্যোদয় হয়নি।

খালি গা, খালি পা, কদিন অনাহারে শরীরও বেশ দুর্বল। তা হোক। ছবির বাণ্ডিলটা নিয়ে সে চলল আসানসোল মুখো।

.

ভিন্সেন্ট ফিরে এল প্রায় তিন মাস পরে। এবার তার গায়ে জামা, পায়ে জুতো, — হাতে রঙ, তুলি, ক্যানভাস, কাগজ। দেবনারায়ণবাবু ওকে নূতন মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছেন। ভান গর্গ জীবনের নূতন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। অধরাকে ধরবার কৌশল শিখে এসেছে। সে শিল্পী হতে চায়। নূতন পৃথিবী সৃজন করবে সে এই। চাক্ষুষ বাস্তব। জগতের মত ক্লেদাক্ত, পঙ্কিল, অন্ধকার, দুনিয়া নয়–তার মনোমত নূতন ত্রিভুবন! ঈশ্বর-বিশ্বাসী ঈভানজেলিস্ট ভিন্সেন্ট গর্গ আজ স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী! দাউ শ্যাল ক্রিয়েট দ্য ক্রিয়েটার।

দেবনারায়ণবাবু প্রথমটা ওকে চিনতে পারেননি। তার দোষ নেই। খালি গা, খালি পা, একমাথা রুক্ষ চুল, একমুখ খোঁচা খোঁচা গোঁফ-দাড়ি-ভিখারী ভেবেছিলেন তাকে। পথশ্রমে ক্লান্ত ধূলি-ধূসরিত মানুষটা যে সেই জমিদার বাড়ির আলালের ঘরের দুলাল এ কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ওর কাছে সব কথা শুনেছিলেন। দেবানারায়ণবাবু নিজেও একদিন সংসার ছেড়ে এভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন। গোঁড়া কায়স্থ পরিবারের সন্তান তিনি-দীক্ষা নিয়েছিলেন ব্রাহ্মধর্মে। শিবনাথ শাস্ত্রীর সাক্ষাৎ শিষ্য। ছবি আঁকার সখ ছিল দেবনারায়ণবাবুর। শিখেছিলেন আর্ট স্কুলে। শিক্ষকতা করেছেন আর্য মিশনে, সংসার করেছেন, উপাসনা করেছেন, উপার্জন করেছেন–আজ অবসরপ্রাপ্ত জীবনে আশ্রয় নিয়েছেন ছেলের সংসারে। ছেলে রেলের মালবাবু–রেলের কোয়ার্টার্স পেয়েছে। ছাত্রকে চিনতে পারার পর তাকে কোলে টেনে নিয়েছিলেন দেবনারায়ণবাবু। ওর আগ্রহ দেখে প্রাণ ঢেলে শিখিয়েছেন এ কদিন। পরিপ্রেক্ষিতে মূল সূত্র, টেম্পারা আর ওয়াশ পদ্ধতির পার্থক্য, ট্রান্সফারিং, তেলরঙের কাজ। অসীম উৎসাহ তাঁর ছাত্রের। দিনের মধ্যে আঠারো ঘন্টা কাজ করত সে। ছোট্ট রেলের কোয়ার্টার্স। দু কামরার বাড়ি। একটিতে থাকে পুত্র পুত্রবধূ, দ্বিতীয়টায় থাকতেন বিপত্নীক বৃদ্ধ। চন্দ্রভানকে থাকতে দিয়েছিলেন সেখানেই।

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটা ভিন্সেন্ট কোনদিন ভুলবে না।

চন্দ্রভান যে ক্রমাগত ওঁর ড্রইংক্লাসে ফাঁকি দিত একথা দেবনারায়ণবাবু ভোলেননি। পরীক্ষায় নম্বরও সে কোনদিন বেশি পায়নি। ওদের ক্লাসে ফার্স্ট হত বটুকেশ্বর, কখনও বা দ্বৈপায়ন। ফঁকিবাজ চন্দরটা আজ ছবি আঁকা শিখবার জন্য তার কাছে এভাবে ছুটে এসেছে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ। বলেছিলেন, কতদিন হল এ ভূত ঘাড়ে চেপেছে?

–দিন পনের হল, স্যার।

— হঠাৎ ছবি আঁকার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠলি কেন রে?

-ঐ যে বললাম স্যার। কোলিয়ারির মালকাটাদের লড়াইয়ে মাথা গলিয়েছিলাম। হেরে গিয়ে মনটা একেবারে ভেঙে পড়ল। সময় কাটাবার জন্য একদিন ছবি আঁকতে বসেছিলাম। অদ্ভুত ভাল লাগল। তারপর ক্রমাগত অনেকগুলো ছবি এঁকেছি। কিন্তু ঠিক মনোমত হয়নি। আঁকতে ভীষণ ভাল লাগে, অথচ, আঁকতে পারছি না। কোথায় ভুল হচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। তখন আপনার কথা মনে হল

আর অমনি পঞ্চাশ মাইল পথ হেঁটে চলে এলি? পাগল কোথাকার!

ভিন্সেন্ট একটি স্কেচ বের করে দেখায়। টেবিলের স্তূপ থেকে একটি মেয়ে কয়লার টুকরো বেছে ঝুড়িতে ভরছে, ছবিখানা দেখে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন অভিজ্ঞ আর্টিস্ট। বলেন, –চন্দ্র! কিছু মনে করিস নে বাবা! তোর দ্বারা হবে না! এ কিছুই হয়নি।

ছবিটা যে ঠিকমত আঁকা হয়নি এ বোধ ভিন্সেন্টের নিজেরই ছিল। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। দেবনারায়ণবাবু তার দৃঢ় ভাষণে বোধহয় ঈষৎ লজ্জিত হয়ে পড়েন, সামলে নিয়ে বলেন, মানে, অনেক দিন মকসো করতে হবে। এ ছবি কিছু হয়নি। ফিগর অব এইট হেডস্ কাকে বলে জানিস?

ভিন্সেন্ট মাথা নাড়ে।

একটি প্রামাণিক বিলাতি বই বার করে দেবনারায়ণবাবু ওকে দেখাতে থাকেন হিউম্যান ফিগার আঁকার মূলসূত্রগুলি। একটা মানুষের মুখটা যত বড় তার গোটা দেহের উচ্চতা তার আটগুণ। কেন্দ্রবিন্দু তার যৌনমণ্ডলউপর দিকে চার ভাগ, নিচের দিকে চার ভাগ। ফিমার-বোন দু-ভাগ। হাঁটু থেকে গোড়ালি দু-ভাগ। তেমনি উপর দিকে যৌনমণ্ডল থেকে নাভি, নাভি থেকে স্তনবৃন্তের সংযোজন-রেখা, সেখান থেকে চিবুক, এবং চিবুক থেকে ব্রহ্মতালু এরা প্রত্যেকে দৈর্ঘ্যে সমান একভাগ। এই হল পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে মানবদেহের অক্টেভ। এই সারেগামা-পাধানিসার ছন্দে গ্রীক ভাস্কর্য থেকে রেনেসাঁ, সেখান থেকে মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগে নানান সঙ্গীত গেয়েছেন চিত্রকরের দল। এই প্রপোর্সান হচ্ছে মানবদেহ অঙ্কনের মূলসূত্র। আবার দেখ প্রাচ্য পণ্ডিতদের হিসাব। প্রাচীন হিন্দু শিল্পশাস্ত্রকারেরা বললেন, সব মূর্তি এক রকম হবে না। প্রথমে দেখতে হবে কী ভাবের ব্যঞ্জনা করতে চাইছ। সাধারণ নরমূর্তি হবে দশতল; ক্রূর মূর্তি দ্বাদশতাল; আসুর মূর্তি–যোড়শতাল। আবার যদি স্নিগ্ধভাব ফোটাতে চাও, তাল কমাও। কুমার মূর্তি ষট্‌তাল, বালামূর্তি পঞ্চতাল। তাল কি? তাল হচ্ছে একটা মাপ। শিল্পীর নিজমুষ্টির এক-চতুর্থাংশকে বলে এক আঙুল। এই রকম দ্বাদশ আঙুলে, বা তিন মুষ্টিতে হয় এক তাল। দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে শেষে বলেন, তাহলে বুঝে দেখ চন্দর, তোর এই কুলি রমণীটি না পাশ্চাত্য আদশে না ভারতীয় আর্দশে কোনভাবেই কোন তাল-লয়-মান মেনে আঁকা হয়নি!

ভিন্সেন্ট বলে, তাইতো হবে স্যার।

তা আঁকবার চেষ্টা করেছিস মাত্র। যা দেখেছিস তা আঁকতে পারিসনি।

তা হবে। আচ্ছা আপনি হলে ঐ মেয়েটিকে কিভাবে আঁকতেন?

আমি? আচ্ছা দেখাই তোকে। দেখ।

দেবনারায়ণবাবু এক টুকরো কাগজে ঐ কুলি রমণীকে পুনরায় আঁকতে শুরু করেন। মেয়েটির ভঙ্গি ভিন্সেন্টের চিত্রের অনুকরণে নিচু হয়ে কয়লার টুকরো বাচছে। প্রথমেই স্কেল ফেলে প্রপোর্সান ঠিক করে নিলেন। প্রায় আধ-ঘন্টা সময় লাগল ভিন্সেন্টের কুলি রমণীটিকে পুনরায় আঁকতে। ভিন্সেন্ট তীব্র আগ্রহ নিয়ে পেনসিলের প্রতিটি টান লক্ষ্য করতে থাকে। আঁকা শেষ করে দেবনারায়ণবাবু খুশি হয়ে বলেন, এবার লক্ষ্য করে দেখ, প্রপোর্সান নিখুঁত হয়েছে।

ভিন্সেন্ট মুখে কিছু বলল না। তার নিজের আঁকা ছবিটা আর মাস্টার মশায়ের সদ্যসমাপ্ত স্কেচটা ঈসেলের উপর বসিয়ে দেয়। একটু পিছনে সরে এসে দেখতে থাকে। কি যেন বলতে চায়, কিন্তু বলে না। দেবনারায়ণবাবু একদৃষ্টে দেখছিলেন পাশাপাশি রাখা ছবি দুটো। হঠাৎ বলে ওঠেন, বুঝেছি, কী বলতে চাইছি! আমি ঐ কুলি-মেয়েটিকে ঠিকমত প্রপোর্সান দিয়েছি বটে, কিন্তু ওর ক্যারেকটারটা কেড়ে নিয়েছি!

ভিন্সেন্ট এবারও কিছু বললে না।

মাস্টার মশাই আরও কয়েক মিনিট চুপ করে ছবি দুটো দেখলেন। তারপর বলে ওঠেন, না রে চন্দর, তোর ছবিখানা খুব খারাপ হয়নি, বুঝেছিস! ওর সারাটা শরীরই বেটপ, মুখটা তো একেবারেই যাচ্ছেতাই–তা হোক, তবু ঐ কদাকার মেয়েটাকে আমার কি জানি কেন ভাল লাগছে। কেন এমন হচ্ছে বল তো চন্দর? মনে হচ্ছে ওকে যেন কোথাও দেখেছি

–কোন কয়লাকুঠিতে অমন মেয়ে দেখে থাকবেন স্যার। ওরা আসানসোলেও আসে–

–হুঁ! আসলে কি জানিস, তোর ছবিটা টিপিক্যাল কয়লাকুঠির মালকাটা-মেয়ের। আমার আঁকা মেয়েটার হাতে একটা হাতা বা খুন্তি ধরিয়ে দিলে মনে হবে রান্না করছে। এমনকি সুদৃশ্য টি-টপ এঁকে দিলে মনে হবে ও চা ঢালছে; মানে আমার আঁকা মেয়েটি একটা সুন্দরী মেয়ে, সে যে কোন পরিবেশে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে নিজেকে। কিন্তু তোর ঐ কদাকার মেয়েছেলেটা তা নয়। ও টিপিক্যাল কুলির মেয়ে! ও জীবনভর কয়লা ঘেঁটেছে, কয়লা ঘাঁটবে! ওর হাতে হাতা-খুন্তি বই-টি-পট কিছুই ধরানো চলবে না!…হেত্তরি! আমার স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে চন্দর, কিন্তু…কি বলব…তোর ছবিখানা সত্যিই ভালরকম উৎরেছে।

চন্দ্রভান বলে, –স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে কেন স্যার?

হবে না? বলিস কি তুই! এ একখানা ছবি হয়েছে? কিছু হয়নি! ছবি আঁকার সব আইন কানুন তুই যে চুলোর-দোরে পাঠিয়েছিস! পার্সপেকটিভ ভুল, প্রপোর্সান ভুল–ড্রইং পরীক্ষায় এমন একখানা ছবি কেউ দাখিল করলে আমি স্রেফ গোল্লা দিতাম! কিন্তু..মানে…না রে চন্দর! আমি স্বীকার না করে পারছি না–তোর ছবিখানা অপূর্ব হয়েছে।

প্রাণ ঢেলে এ কদিন শিখিয়েছেন ওকে। জামা-জুতো কিনে দিয়েছেন, রঙ-তুলি ক্যানভাস কিনে দিয়েছেন। গুরুগৃহে এককালে যেভাবে শিষ্যরা ব্রহ্মবিদ্যা শিখত তেমনি যত্ন করেই শেখাতে চেয়েছিলেন ওকে। ভিন্সেন্ট কিন্তু ওখানে আর বাঁধা পড়তে চায়নি। সে শুধু হালধরা, পাল-খাটানোটুকুই শিখতে চেয়েছিল–কোন্ দরিয়ায় নাও ভাসাবে তা শুধু সেই স্থির করবে। ভিন্সেন্ট বোধকরি আশঙ্কা করেছিল আরও দীর্ঘদিন দেবনারায়ণবাবুর স্নেহচ্ছায়ায় থাকলে তার স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যাবে, অথবা ফাদার শারদাঁর চিঠি এল কিনা জানবার জন্য মনটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল কিম্বা হয়তো কয়লাকুঠির আকর্ষণটা সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মোটকথা মাস তিনেক পরে আবার সেই তেঁতুলডাঙার পর্ণকুটিরে ফিরে এল চন্দ্রভান।

ফিরে এসেই প্রচণ্ড একটা আঘাত পেল। বাওয়ালী থেকে ইতিমধ্যে একটা পোস্টকার্ড এসেছে ওর নামে। ফাদার শারদাঁ লেখেননি; লিখেছে ওর সর্দার পোড়ো রাখাল রুহিদাস। আঁকাবাঁকা হরফে সে নিবেদন করেছে কয়েকটি মর্মন্তুদ দুসংবাদ। ফাদার শারদাঁ ইতিমধ্যে দেহ রেখেছেন। হঠাৎ সন্ন্যাস রোগে মারা গেছেন। ওখানেই কবর দেওয়া হয়েছে তাকে। ওদের পাঠশালাটি উঠে গেছে, অনাথ আশ্রমটাও। ন’পিসি কোথায় চলে গেছে রাখাল তা জানে না। সে নিজে এখন মণ্ডল মশায়ের ক্ষেতে কাজ করে। জনমজুর। সাহেবের টালির ঘর, জমি বাড়ি বাগান সব বিক্রি হয়ে গেছে। সাহেবের ভাইঝি ঊর্মিলা ঐ সম্পত্তিটা পেয়েছিল। রাখেনি। অমন অজ পাড়াগাঁয়ে ঐ সম্পত্তি রাখার কোন অর্থ খুঁজে পাননি ডেভিডসন সাহেব। মানে ঊর্মিলার স্বামী!

ছোট্ট চিঠি। ছোট খবর। রাখাল রুহিদাসের প্রথম পত্র। কিন্তু ভিন্সেন্টের বুকে সেটা শেল হানল। ঊর্মিলার স্বামী ডেভিডসনকে আর কেমন করে দোষ দেওয়া যায়? তিনি তো ফাদার শারদাঁর স্বপ্নের কথা কিছুই জানেন না। কিন্তু ঊর্মিলা কেমন করে রাজী হল? সে যে আবাল্য ঐ পরিবেশে মানুষ হয়েছে। একটু মায়া হল না? কিম্বা। কি জানি, এই বোধহয় জগতের নিয়ম। সেও তো আবাল্য মানুষ হয়েছে। পাগলাচণ্ডীতে। সেখানকার রাধাকান্তজীর মন্দির, দয়ের ছবি, দিগন্ত অনুসারী ধানের। ক্ষেতের কথা কি এখন দিনান্তে একবারও মনে করে? যাক, ফাদার শারদাঁ তাহলে শান্তি পেয়েছেন! ঈশ্বরের করুণায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি–তার ক্রোড়েই ফিরে গেছেন। হয়তে। ভিন্সেন্ট নতজানু হয়ে মনে মনে বলল, -ফাদার! তোমার আত্মার শান্তি কামনায় আমি তোমার পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে পারছি না কারণ আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছি। আজ জানি না, ঈশ্বর আদৌ আছে কি না। আর থাকলেও তিনি কারও প্রার্থনায় আদৌ কর্ণপাত করেন কি না। কিন্তু তোমার দেওয়া পতাকাকে আমি ধূলায় লুটাতে দেব না, ফাদার! তুমিই আমাকে প্রথম দেখিয়েছিলে কীভাবে রঙে আর রেখায় একটা নূতন জগৎ গড়ে তোলা যায়। তুমিই আমার আদি গুরু। তোমার সে পতাকা আমি কাঁধে তুলে নিয়েছি।

রোজ ভোরবেলা উঠে চন্দ্রভান বেরিয়ে পড়ে তার রঙ-তুলি নিয়ে। কয়লা কুঠির জীবনছন্দকে আবদ্ধ করে ক্যানভাস অথবা কাগজের চতুঃসীমায়। মালকাটাদের জীবনের ছবি রূপায়িত করে নূতন করে। ওরা কয়লা ঢোলাই করছে, টব ঠেলে নিয়ে। যাচ্ছে, গাঁইতা চালাচ্ছে; টেবিলের স্তূপ থেকে কয়লা বাচছে বাচ্চা ছেলে-মেয়ের দল। মালাকাটার বস্তীতে গিয়েও এঁকেছে ওদের নানান জীবনযাত্রার ছবি। ওরা কুয়ো থেকে জল তুলছে, গল্প করছে, ঝগড়া করছে, বিশ্রাম করছে। ঈশাকের ছাপরায় সেদিন এঁকেছে একটা অনবদ্য ছবি–পোটাটো ইটাস বা আলুর ভোজ!

বিষয়বস্তুটা করুণ। ভিন্সেন্ট সেদিন সন্ধ্যায় ঈশাকের ছাপরায় গিয়ে দেখে ওরা সপরিবারে নৈশ-আহারে বসতে যাচ্ছে। ভিন্সেন্ট অনেকদিন পরে এসেছে ওদের বাড়িতে। ঈশাক ওকে বলল, কি ফাদারদা, মোদের সাথে টুক্ খায়ে লিবেন নাকি?

আসেন, বসেন!

ভিন্সেন্ট দেখে ওদের গোল হয়ে বসার বিচিত্র ভঙ্গিটা। বলে, না ভাই ঈশাক। তোমরা সকলে বরং খেতে থাক। আমি তোমাদের একটা ছবি আঁকি।

-আরে, পেরথমে খায়ে লেন টুক!

ঈশাক-মালাকাটার ভাঁড়ারে সেদিন মা লক্ষ্মী বাড়ন্ত। আটা-ময়দার জোগাড় নেই যে রুটি বানাবে। ঈশাকের বউ এক কড়াই আলু সিদ্ধ করেছে। ওরা সবাই মিলে দাওয়ায় গোল হয়ে বসেছেনুন দিয়ে আলু সিদ্ধ খাচ্ছে। এই আজ ওদের নৈশভোজের আয়োজন! মাঝখানে জ্বলছে একটা কেরোসিনের টেমি। এপাশে ঈশাক, ওপাশে তার বউ। ঈশাকের মা আর দিদিও আছে। আর আছে যোসেফ মুর্মুর অনাথ মেয়েটি মেরী! বাপ-মা মরা আবাগীটাকে ঈশাকই আশ্রয় দিয়েছিল। সে এখন এ পরিবারভুক্ত। ঈশাকের মা দুটি খোসা ছাড়ানো আলু অতিথির দিকে বাড়িয়ে ধরে। বিনা বাক্যব্যয়ে ভিন্সেন্ট সে দুটি মুখে পোরে। ঐ সঙ্গে সে বসে যায় ওদের নৈশ-ভোজের এই বিচিত্র দৃশ্যটা তেলরঙে আঁকতে।

ঈশাক হাসে। ফাদারদা যে নতুন খেয়ালে মেতেছে দিবারাত্র কয়লাকুঠির ছবি এঁকে বেড়াচ্ছে সবাই তা জানে। ঈশাকের তা অজানা নয়। এতদিনে আবার ফাদারদা তিল তিল করে ফিরে পাচ্ছে কুলি-ধাওড়ায় তার হারানো সম্মানের আসর। আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ঈশাক বলে, –মেরীটা যে আপনকার দিকে পিছন ফিরে বসিছে ফাদারদা। অরে ইবাগে লয়্যা আসি? নইলে অর মুখটা যে আঁধারে পড়ি যাবেক!

যোসেফ মুর্মুর সাত বছরের মেয়ে, মেরী। মেয়েটি বসেছিল দৃশ্যপটের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে–আলোর নিচেই; অথচ তার দেহের যে অংশ চিত্রকরের গোচর সে অংশে আলো পড়েনি। সে আছে অন্ধকারে। ভিন্সেন্টের মনে হল এর গূঢ় ব্যঞ্জনা আছে। ঈশাক তার হা-ভাত সংসারের কেন্দ্রবিন্দুতে এনে বসাতে চেয়েছে প্রতিবেশীর ঐ বাপ-মা মরা আবাগীটাকে! বসিয়েছে আলোর নিচেই। কিন্তু ঈশ্বরের বিধানে মেয়েটিকে ঘিরে আছে শুধুই অন্ধকার। জীবনের দিকে পিছন ফিরিয়ে ঈশ্বর তাকে বসিয়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত ঘটনাচক্র। আপনমনেই হেসে ওঠে ভিন্সেন্ট। বলে, না ঈশাকভাই, মেরী যেখানে আছে ওখানেই থাক। ওর পিছন-ফেরা ছবিই আঁকব আমি।

ওরা আপনমনে আলুর ভোজে আত্মনিমগ্ন হয়ে পড়ে। ঈশাক তার কোলিয়ারির পোশাকটি ছাড়েনি। মায় মাথার টুপিটাও খোলেনি। ঈশাক আর তার বউ দৃশ্যপটের দুপ্রান্তে দুজন বসেছে মুখোমুখি–যেন গতরে খেটে মাঝের ক-জনকে ওরা এ আলুর ভোজে ডেকে এনেছে। মেরী কেন্দ্রস্থলে, ঘন অন্ধকারে। কিন্তু না! খোদার উপর খোদগিরি করবে ভিন্সেন্ট। মেরীর মাথায় আর দুধের উপর, ঘাড়ের কাছে বাঁ দিকে কয়েকটি ক্ষীণ আলোর রেখা এঁকে দিল সে। এই তার বিদ্রোহ! এই তার ফরিয়াদ! প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ। ও মনে মনে বললে, তুমি যতই ওকে অন্ধকারে টেনে আন না কেন, আমি আমার শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখছি, ওর মাথায় আর কাঁধে লেগেছে আলোর ছোঁওয়া। এ আলোকপাত তোমার কোন কীর্তি নয়! তুমি ওর মাকে মেরে ফেলেছ খাদের অন্ধকূপে, বাপকে পুড়িয়ে মেরেছ দশদিনের যন্ত্রণা ভোগের। পর! ঐ সাত বছরের মেয়েটিকে পেড়ে ফেলেছ নীরন্ধ্র অন্ধকারে! এই তোমার কীর্তি। কিন্তু সেখানেই তো মেরীর ইতিহাস শেষ নয়–ওকে ঐ ঈশাকের বউ বুকে টেনে নিয়েছে–ঈশাক ওকে এনে বসিয়েছে তার অর্ধাহারের আলুর ভোজে! ওর মাথায় ঐ যে আলোকবিন্দু তা ঐ ঈশাক পরিবারের আশীর্বাদ!

আলুর ভোজ ভিন্সেন্টের এক অমর কীর্তি!

কিন্তু ওর প্রতিদ্বন্দ্বীও অত সহজে হার মানার পাত্র নন! কঠিনতর আঘাত হানলেন তিনি ভিন্সেন্টের মস্তক লক্ষ্য করে। আঘাতে আঘাতে উন্মাদ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত যেন করুণাময় ঈশ্বরের ক্লান্তি নেই!

এ তিন মাসে এই জোড়-জাঙাল কয়লাকুঠির জীবনযাত্রায় আরও পরিবর্তন হয়েছে। বাইরে থেকে তা ঠিকমত ঠাওর হয় না। ক্রমে ক্রমে সব কথা সে জানতে পারে। এককড়ি সরখেলের শূন্যপদে উন্নীত হয়েছে পাঁচু হালদার। মেটমুন্সি থেকে ওভারম্যান। বিরাট উন্নতি। এ খবরটা শুনে ভিন্সেন্ট ভেবেছিল মালকাটাদের বিদ্রোহের সময় পাঁচু হালদার যে প্রভুভক্ত কুকুরের ভূমিকাটা নিয়েছিল এই রুটির টুকরোটা বুঝি তারই পুরস্কার। কিন্তু কানাঘুষায় শুনতে পেল, ওর ওই বিরাট উন্নতির মূলে আরও গূঢ় কিছু রহস্য আছে। পাঁচুবাবু কি এক বিচিত্র কায়দায় খোদ নাথানিয়াল সাহেবকে একেবারে খুশি করে দিয়েছে। কী করে? তা ওরা বলেনি–মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছে শুধু!

ব্যাপারটা খোলাখুলি জানা গেল বাতাসীর কথায়। তার কোন ঢাক ঢাক্ গুন্ গুর নেই। স্পষ্টবাদিনী সে-ভালকে ভাল বলতে জানে, মন্দকে নির্ভেজাল গাল পাড়তেও তার কসুর নেই। বললে, –ঈ বাবা গ! তু জানিস নাই ফাদারদা? তা তখন আর শুনায়ে কী হবে? অমন সোন্দর সম্বন্ধটো করলম, তুর মন মানলেক নাই। সোনার কোসম লাগলেক ঐ চামারের ভোগে! চামার! চামার! উটা মানুষ লয় বটে!

-কী পাগলের মত বকছিস বাতাসী! কে চামার?

–হুই নাথানেল সাহেব গ!

–সে তো জানি। কিন্তু সোনার কুসুমটা কে?

 –তু শুনিস নাই? পাঁচু মিতিরি কেমনে সাহেব হৈ গেল?

না। কেমন করে?

বুইনঝিটারে জবাই করলেক! হুই চামারটার ছামুতে

উত্তেজনায় রুখে ওঠে ভিন্সেন্ট, কী! কী বললি?

–ঈঃ! অখন কুলোপানা চক্কর দেখাইলে কী হবেক রে? মাইয়াটা তুর পায়ে আছাড়ি-পিছাড়ি পড়লেক, তুর দয়া হল নাই! হাত-চিঠি দিলেক, তু ফিরায়ে দিলি! সব জানে রে ই বাতাসী! অখন পাঁচু মাইয়াটারে বেচে দিলেক আর তু কুলোপানা চক্কর দেখাইছি–কী! কী বুললি! তু মরদ, না কী বটেরে! থুঃ!

পর্ণকুটিরের সামনে পথের উপর থুতু ফেলে চলে গিয়েছিল বাতাসী। সাঁওতালি মেয়েটার কাছে মরদের এ জাতীয় কাপুরুষতার বুঝি ক্ষমা নেই। চন্দ্রভান বজ্রাহত হয়ে যায়! চুপ করে বসে থাকে সে তার পর্ণকুটিরের দাওয়ায়!

ক্লান্ত সূরয ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। চৈত্রের শেষ। শীত গেছে, এসেছে বসন্ত। এই কয়লা কালো জোড়-জাঙালেও দখিনা বাতাস আসে। দূরে দূরে পলাশ গাছের মাথায় মাথায় লেগেছে অস্তরবির ফাগ-আবীর। ভার্মিলিয়ান টিনট! উদাস হয়ে বসে থাকে ভিন্সেন্ট। সমস্ত ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে এই ন্যক্কারজনক দুর্ঘটনাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে পেল এতক্ষণে!

চিত্রলেখার প্রগলভতায় সে রাত্রে ভিন্সেন্ট বিব্রত হয়েছিল। তার প্রেমপত্র পড়ে ক্ষেপে উঠেছিল আর একদিন; কিন্তু ভিন্সেন্ট একবারও ভেবে দেখেনি–কী মর্মান্তিক প্রয়োজনে এভাবে চিত্রলেখা ওর সাহায্য চাইতে ছুটে এসেছিল বারে বারে! চিত্রলেখা তার মামার চোখে দেখেছিল তার নিজের সর্বনাশের ছায়া। উদ্ভিন্নযৌবনা বোনঝিটাকে পাঁচু হালদার টৌপ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, ভেট হিসেবে উপহার দিতে চেয়েছিল নাথানিয়ালকে। মেয়েমানুষের স্বাভাবিক বৃত্তিবশে সে এ সত্যটা বুঝতে পেরেছিল অনেকদিন আগে থেকেই। তাই আকারে-ইঙ্গিতে এবং শেষের দিকে নিলজ্জের মত সাহায্য চেয়েছে চন্দ্রভানের কাছে। অথচ চন্দ্রভান নিপ্রাণ পাথরের মত বারে বারে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে! কেন? মনের অগোচরে পাপ নেই। ভিন্সেন্ট নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হল–সে সময় তার মনে ঊর্মিলার স্বপ্নের রেশ লেগেছিল। ঊর্মিলার গায়ের রঙ মেমসাহেবের মত ফর্সা, সে বারে বারে চন্দ্রভানকে নাকাল করেছে, তাই কি সে দুর্লভ; আর কালো-কোলো বাঙালী-ঘরের অনাথা মেয়েটি যেচে এসে ধরা দিতে চেয়েছিল বলেই সে সুলভ? চকমকির স্ফুলিঙ্গই শধু চোখে ধাঁধা লাগায়, নিবাত, নিষ্কম্প ঘৃতপ্রদীপের দীপ্তিটা নজরে পড়ে না? ঊর্মিলার আশায় অন্ধ ছিল বলেই চিত্রলেখার নীরব আত্মদানের মহিমাটা ওর নজরে পড়েনি। না; পাপ একা পাঁচু হালদার করেনি, করেছে চন্দ্রভানও।

তখনই উঠে পড়ে। ভুল-ভুলই। তাকে শোধরাতে হবে। এখনই, আজ রাত্রেই সে উদ্ধার করবে চিত্রলেখাকে ঐ কামুক পাষণ্ডটার কবল থেকে। বেরিয়ে পড়বে নিরুদ্দেশ যাত্রায়। নাথানিয়াল চিত্রলেখার ধর্ম নষ্ট করেছে? তাতে ভ্রূক্ষেপ করে না ভিন্সেন্ট। ধর্ম কি? বাইবেল-কোরান-উপনিষদ সব বুজরুকি! সতীত্ব ধর্মটাও তাই। ভিন্সেন্টের ধর্ম তার বিবেক! সেই বিবেকের নির্দেশেই সে গ্রহণ করবে চিত্রলেখাকে– দেবে সহধর্মিণীর মর্যাদা!

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। হনহন করে সাঁকো পার হয়ে ভিন্সেন্ট এসে প্রবেশ করে কয়লাকুঠিতে। কুলি-ধাওড়াকে বাঁ-হাতে রেখে এগিয়ে যায় টিলার দিকে। সাহেব কুঠির দিকে। বাধা পেল লোহার ফটকটায়। গুখ সেপাই হটিয়ে দিল তাকে। ঢুকতেই দিল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সাহেব কুঠির চৌহদ্দিতে।

অগত্যা মাথা নিচু করে ফিরে আসছিল। কেমন করে চিত্ৰলেখার দেখা পাওয়া। যায়? কেমন করে ঐ পাঁচিল-দিয়ে-ঘেরা দুর্গের ভিত্র বন্দিনী নারীর কাছে সংবাদ পাঠানো যায়? বাতাসী কি পারবে ওর ভিতর ঢুকতে? আপনমনে পথ চলছিল, হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। টিলার নিচের দিক থেকে ধীর গতিতে উঠে আসছে চিত্রলেখা। একা। আশ্চর্য! সে তাহলে বন্দিনী নয়। প্রতি সন্ধ্যায় কি তাকে আসতে হয় এমনি করে বাবু কোয়ার্টার্স থেকে ঐ টিলার উপর! চিত্রলেখাও আপনমনে পথ চলছিল; খেয়াল করেনি উপর থেকে আর একজন নেমে আসছে। হঠাৎ ওকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

–লেখা! কোথায় চলেছে এমন একা একা?

 মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যায় মেয়েটির। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে। কয়েক মিনিট সময় লাগে তার নিজেকে সামলে নিতে। তারপর বলে, -সে খোঁজে আপনার কি প্রয়োজন?

প্রয়োজন আছে বলেই ছুটে এসেছি লেখা। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। চল, আজ রাত্রেই আমরা পালিয়ে যাই এখান থেকে।

হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল চিত্রলেখা। দু-হাতে মুখটা ঢাকা। ভিন্সেন্ট এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে। বলে, –আমাকে ক্ষমা করেছ?

যেন অনেক দূর থেকে জবাব দেয় চিত্রলেখা, এখন আর তা সম্ভব নয়।

আলবাৎ সম্ভব! কে বাধা দেবে? আমার অবশ্য কোন রোজগার নেই। আমি বেকার। তা হোক, যা পাব দুজনে ভাগ করে খাব। ঐ কামুক পাষণ্ডটার–

আবার একই কথা বললে চিত্রলেখা, বললাম তো! আজ আর তা হবার নয়!

-কেন অসম্ভব?

–সেকথা মুখ ফুটে বলতে পারব না আমি!

বুঝেছি। বলতে তোমাকে কিছুই হবে না লেখা। আমি ওসব মানি না। তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে এভাবে মরতে দেব না আমি।

চিত্রলেখা তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বলে, -মরার আর কিছু বাকি নেই আমার।

কী আশ্চর্য! বুঝছ না কেন তুমি? ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না আমি।

 –আমি করি! আজ আর আমি রাজী নই!

ভিন্সেন্ট আরও কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। দেখতে পায় আরও কজন পথচলতি লোক এদিকে আসছে। চিত্রলেখা ধীর পদে পাকদণ্ডী বেয়ে টিলার মাথায় উঠে যায়। চন্দ্রভান চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে আসে তার। কুঁড়েঘরে।

পরের কটা দিন কোথা দিয়ে কেটে গেছে খেয়াল নেই ভিন্সেন্টের। ছবি আঁকাতেও মন দিতে পারছে না। জিনিসটা নিয়ে যতই ভেবেছে ততই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়েছে। ও বুঝতে পেরেছে চিত্রলেখাকে ঐ নরক থেকে উদ্ধার করতে না পারলে তার মনের শান্তি কোনদিনই ফিরে আসবে না। চিত্রলেখাকে সব কথা বুঝিয়ে বলা দরকার। যেটাকে সে দূরতিক্রম্য বাধা বলে মনে করেছে সেটাকে ভিন্সেন্ট আদৌ আমল দিতে চায় না। একথাটা ওকে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। ভিন্সেন্ট সুযোগ খুঁজতে থাকে। পর পর তিনদিন ঐ সাহেববাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করেছে কিন্তু চিত্রলেখাকে দেখতে পায়নি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে ওখানে আসে না। বরং ঐ বাড়িতেই থাকে আজকাল। না হলে এ তিনদিনের মধ্যে একবার সে তাকে পথের ভিতর ধরতে পারত।

অবশেষে মরিয়া হয়ে ভিন্সেন্ট একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসে। প্রাচীরবেষ্টিত সাহেব কুঠির ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে না পেরে সে শেষ পর্যন্ত একদিন পাঁচিল টপকালো। সন্ধ্যার অন্ধকারে সে লাফিয়ে নামল পাঁচিল থেকে। কিন্তু যা ভেবেছিল তা। হল না। ধরা পড়ে গেল। গুখ সেপাইদের হাতে নির্মম প্রহারে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। চিৎকার চেঁচামেচিতে সাহেবের সান্ধ্য-অবকাশ বিঘ্নিত হয়। দ্বিতলে বসে মদ্যপান করছিলেন সাহেব, নেমে এলেন বাধ্য হয়ে। পরনে তার সৌখিন সিল্কের গাউন, মুখে পাইপ, হাতে টর্চ, ভূযুগলে বিরক্তির আভাস।

-ক্যা হুয়া হ্যায় ব্রীজ সিং, এৎনা হল্লা কেঁউ মচাতা?

ব্রীজ সিং এগিয়ে এসে লম্বা সেলাম করে। সবিনয়ে নিবেদন করে একটা চৌট্টা কুঠিতে খুঁসেছিল এবং ব্রীজ সিং-এর অতন্দ্র পাহারায় লোকটা ধরা পড়েছে। সাহেব হুকুম করলেন চোরকে আলোর সামনে নিয়ে আসতে। দুজন সেপাই দু-দিকে ধরে নিয়ে এল প্রহারজর্জর মানুষটাকে আলোর সামনে। বছর উনিশ কুড়ি বয়স, একমাথা রুক্ষ চুল, হাফ-সার্টটা ছিঁড়ে ফালা ফালা, ঠোঁটের কষ বেয়ে নেমেছে রক্তের একটা ধারা। সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েক পেগ বিলাইতি ওঁর পাকস্থলীতে আশ্রয়লাভ করেছিল, তবু চিনতে অসুবিধা হল না নাথানিয়াল সাহেবের। এক চিলতে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে তার ওষ্ঠপ্রান্তে। বলেন, হ্যাল্লো! ওয়েলকাম সেন্ট টমাস বেকেট!

ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না। তার দু-চোখে আগুন। স্থির দৃষ্টে সে তাকিয়ে থাকে।

ব্রীজ সিং পুনরায় সেলাম করে বলে, -সাব?

অর্থাৎ নূতন করে প্রহার শুরু করার অনুমতি চায়।

সাহেব কিন্তু অনুমতি দিলেন না। বোধকরি দৈহিক পীড়নের চেয়ে অন্যভাবে পীড়ন করার একটা বাসনা জাগল তাঁর। সান্ধ্য কৌতুকটা লোভনীয় মনে হল বুঝি। নাথানিয়াল পাকা ঘুঘু কলয়াকুঠির সব সংবাদ তাঁর নখদর্পণে; এমন কি ঐ বাউণ্ডুলে ছেলেটা যে তার গৃহবন্দিনীর সঙ্গে প্রেম করত সে খবরও তার অজানা নয়। তাই ব্রীজ সিংকে সাহেব হুকুম দিলেন, ওকে তার ড্রইংরুমে পৌঁছে দিতে।

বাইরের ঘরে আরাম কেদারায় আরাম করে বসল নাথানিয়াল। এ সেই ঘর– পিছনে ফায়ার প্লেসে এখন অবশ্য আগুন নিভে গেছে; পড়ে আছে কিছু যীশুমূর্তির উপর ভারতসম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের ফ্রেমে বাঁধানো সেই সদম্ভ ভঙ্গিমা। নাথানিয়ালের খাস কামরা কুঠি সংলগ্ন। এখানে বসেই সে কয়লাকুঠির কলকাঠি নেড়ে থাকে।

নাথানিয়ালের নির্দেশে ব্রীজ সিং বিদ্রোহী বন্দীকে এ ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাইরে চলে যায়। নাথানিয়াল ওয়াইন-গবলেটে হলুদ রঙের কিছুটা পানীয় ঢেলে হাসি হাসি মুখে তার বিচিত্র ভাষায় যে প্রশ্নটা করে তার নির্গলিতাৰ্থ—তুমি তো আইনের অনেক কেতাব। পড়েছ হে। অনধিকার প্রবেশের দায়ে পিনাল কোডের ধারায় কত বছরের মেয়াদের ব্যবস্থা আছে সেটা জান?

ভিন্সেন্ট কোন জবাব দিল না। ঠোঁটটা মুছে নেয়। হাফ-সার্টের বাঁ-হাতে কাঁধের কাছটা লালে লাল হয়ে ওঠে। রক্তক্ষরণটা বন্ধ হয়নি। নাথানিয়াল গম্ভীর স্বরে বলে, জবাব দিচ্ছ না কেন? পাঁচিল টপকিয়ে আমার কুঠিতে ঢুকেছ কেন?

সদর দরজা দিয়ে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে।

বাঃ! বেশ যুক্তি তত তোমার? তোমাকে পুলিস ডেকে ধরিয়ে দিতে পারি, তা জান?

না, পারেন না। পুলিস ডাকলে আপনিও ধরা পড়ে যাবেন! –হোয়াট ডু য়ু মীন?

-ইণ্ডিয়ান পিনাল কোডে অনধিকার প্রবেশের জন্য যেমন সাজার ব্যবস্থা আছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে আটকে রাখলেও তেমনি সাজার ব্যবস্থা আছে।

-তুমি পাঁচিল টপকে ঢুকেছ, তাই তোমাকে আটকে রেখেছি—

–আমি আমার কথা বলছি না। আমি বলছি পাঁচু হালদারের বাড়ির মেয়েটির কথা।

–আই সী! ও, আজ বুঝি তুমি টমাস বেকেটের চরিত্র অভিনয় করছ না? নাইটহুড শিভ্যালরি, এ? এ লেডি ইন ডিস্ট্রেস! বন্দিনীকে উদ্ধার করতে এসেছ?

ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না।

নাথানিয়াল আর এক পাত্র গলাধঃকরণ করে। পাইপটা নিভে গিয়েছিল–টেবিলের উপর থেকে প্রকাণ্ড মোমবাতিটা টেনে নিয়ে পাইপটা ধরায় ফের। রূপার সৌখীন মোমদানে রক্ষিত হাতখানেক লম্বা মোটা মোমবাতি এ-ঘরে একমাত্র আলোর উৎস। নীলাভ ধোঁয়ায় নাথানিয়াল ভাসিয়ে দেয় তার পরবর্তী বক্তব্য, -পাঁচুবাবুর বোনঝি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে।

–আপনি তাকে ডাকুন। আমি তার কাছ থেকে স্বকর্ণে শুনে যেতে চাই।

–তুমি কি তার গার্জেন?

এ প্রশ্ন অবান্তর।

–অবান্তর মোটেই নয়। এ কৈফিয়ত তুমি দাবী করছ কোন্ অধিকারে?

–সে আমার বাগদত্তা। আমি তাকে বিবাহ করব বলে প্রতিশ্রুত। এই অধিকারে।

নাথানিয়াল একটু থমকে যায়। সামলে নিয়ে বলে, প্রতিশ্রুত ছিলে! এখন এ অবস্থায় নিশ্চয় তুমি তাকে বিবাহ করতে চাও না?

–একথা জেনেও সে আজ তিন মাস ধরে আমার রক্ষিতা?

রক্ষিতা! কী অবলীলাক্রমে ঐ কুৎসিত শব্দটা উচ্চারণ করল নাথানিয়াল। ভিন্সেন্টের চোখ দুটি জ্বলে ওঠে। তবু শান্তভাবে বলে, –তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছেন! এজন্যে তার কী অপরাধ? ওকে ডেকে দিন। আমি নিয়ে যাব।

এবার স্পষ্টই বিচলিত হয়ে পড়ে নাথানিয়াল। এতটা বোধকরি সে আশঙ্কা করেনি। একবার পিছন ফিরে ওদিকে পর্দাটার দিকে তাকায়। হয়তো পর্দার ও-প্রান্তে উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছিল সেই মেয়েটি, যার ভাগ্য নিয়ে এরা দুজন ছিনিমিনি খেলছে! একটু নড়েচড়ে বসে নাথানিয়াল। বলে, তুমি ভুল করছ হে ছোকরা। মেয়েটাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি এখানে আটকে রাখিনি। তুমি নিজে খেতে পাও না, ওকে কি খাওয়াবে, অ্যাঁ? আমি তাকে রাণীর হালে রেখেছি। শাড়ি, গহনা

-চুপ করুন। আমি বিশ্বাস করি না। আপনি তাকে এখানে ডেকে আনুন।  সে আমাকে বলুক যে, সে এখানেই থাকতে চায়; আমি স্বকর্ণে শুনে চলে যাব।

হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে নাথানিয়াল, –গো, গো! গেট আউট, য়ু ভ্যাগাবণ্ড!

ভিন্সেন্ট নিশ্চল পাথরের মূর্তি।

নাথানিয়ালের হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, -তোমাকে খুন করব আমি! য়ু আর ইনকরিজিব্ল!

ভিন্সেন্ট অবিচলিতভাবে বলে, তাতে লাভ হবে না মিস্টার নাথানিয়াল। আপনি ভুলে গেছেন, পর্দার ও পাশে একজন সাক্ষী আছেন। শাড়ি-গহনা দিয়ে ওর মুখ আপনি বন্ধ করতে পারবেন না। ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার চার্জ! ফাঁসীর দড়িতে ঝুলতে হবে আপনাকে!

নাথানিয়ালের দৃষ্টি আবার ফিরে যায় পিছনের পর্দাটার দিকে। হাওয়ায় সেটা দুলছে। উঠে পড়ে চেয়ার ছেড়ে। ঘরময় পায়চারি করে বার কতক।

ভিন্সেন্ট বলে ওঠে, তার চেয়ে ওকে ডেকে দিন। আমি ওর সঙ্গে কথা বলি।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে নাথানিয়াল। ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, কিন্তু তুমি তো ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে। তুমি ওকে চিঠি লিখে সেকথা জানাওনি?

ভিন্সেন্ট অবাক হয়ে যায়। ও লোকটা কি কয়লাকুঠির চৌহদ্দির ভিত্র যেখানে যা। কিছু ঘটছে তার খবর রাখে? সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না সে, বলো লিখেছিলাম। সেটা ভুল হয়েছিল আমার। আমার ডান হাতখানা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আমার মনের কথা সে লেখেনি।

ডান হাতখানা সে আলোর সামনে বাড়িয়ে ধরে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে হাতটার দিকে।

হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে মাতালটা। বলে, বটে! বেশ মেলোড্রামাটিক কথা বলতে পার তো হে ছোকরা! ডান হাতখানা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, অ্যাঁ? তা সেই বিশ্বাসহন্তার কী শাস্তির ব্যবস্থা রেছ?

ভিন্সেন্ট কেমন যেন বদলে যায়। হাতখানা আলোর সামনে বাড়িয়ে ধরে কী যেন দেখতে থাকে। জবাব দেয় না। কী দেখছে সে হাতের দিকে তাকিয়ে। তার চোখে। উন্মাদের দৃষ্টি!

নাথানিয়াল এতক্ষণে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। ভিন্সেন্টের ছিদ্রটা তার নজরে পড়েছে। তাহলে শুধু নাথানিয়ালের একারই নয় ঐ আদর্শবাদীটার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিশ্বাসঘাতকতা করে? তবে আর ও লোকটাকে সমীহ করে চলার কি আছে? এতক্ষণে খোশ মেজাজে সে আবার গিয়ে বসে তার আরাম কেদারায়। এক পাত্র পানীয় ঢেলে নিয়ে তার আক্রমণের পদ্ধতিটা পালটে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে, বাবু! আমার সঙ্গে চালাকি কর না। ও মেয়েটাকে যে আর বিয়ে করা চলে না তা আমিও জানি, মেয়েটাও জানে, আর তুমিও জান! কেন মিছে কথা বলছ?

–আমি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি

 –ঈশ্বর! সেটা আবার কে? শুনেছি তুমি নাকি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না আজকাল!

 –আই টেক মাই ওথ অব অনার– চিত্রলেখাকে আমি বিবাহ করতে চাই।

 হঠাৎ আবার হেসে ওঠে মাতালটা। বলে, বাজে কথা। সেদিন তোমার হাত-খানা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, আজ জিহ্বাটা করছে। সোজা কথা বল না বাবু, মেয়েটাকে নিয়ে দুদিন ফুর্তি করতে চাও! তা আমার সখ মিটে যাক–উচ্ছিষ্ট যা থাকবে–

-সাট আপ!–গর্জে ওঠে ভিন্সেন্ট।

 নাথানিয়াল কিন্তু রাগ করে না। চোখ তুলে একবার শুধু তাকায়।

–আপনি ওকে ডেকে দিন। বেশি সময় আমি নেব না! কতটা সময় তুমি নেবে বাবু?

হঠাৎ কি হল ভিন্সেন্টের। ডান হাতখানাকে আর সহ্য করতে পারল না। বিশ্বাসঘাতক হাতখানাকে তখনই শাস্তি না দিলে যেন ওর তৃপ্তি নেই। ধীরপদে এগিয়ে আসে সে। ডান হাতখানা বাড়িয়ে ধরে। বলে, –এই বিশ্বাসঘাতক হাতখানা যতক্ষণ তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে তার বেশি সময় আমি নেব না নাথানিয়াল!

হাতখানা সে হঠাৎ বাড়িয়ে ধরে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখার উপর!

ঘরের আলো স্তিমিত হয়ে আসে। মোমবাতির শিখা ডানহাতের তালুতে প্রায়শ্চিত্তের একটা কালো দাগা বুলিয়ে দিল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই সেই কলঙ্কের কালো চিহ্নটা অনুশোচনায় লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে ওঠে। ভিন্সেন্ট যেন পাথরে গড়া একটা ভাস্কর্যের নিদর্শন। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মত সে অচঞ্চল! তার মর্মভেদী দৃষ্টি নাথানিয়ালের ভূ-মধ্যে সন্নিবিষ্ট! দু-সেকেণ্ড, তিন সেকেণ্ড, পাঁচ সেকেণ্ড! চামড়ার রক্তিম অংশটা স্ফীতকায় হয়ে ওঠে। জলভরা কাজলকালো চোখের মত টলটল করতে থাকে কার্বনের বেড়া দেওয়া প্রকাণ্ড একটা ফোস্কা! নাথানিয়ালের নেশা ছুটে যায়! চোখ দুটো তার ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আপ্রাণ চেষ্টায় সে কিছু বলতে যায়–পারে না। কণ্ঠে তার স্বর ফোটে না। নাথানিয়াল বজ্রাহত। দশ সেকেণ্ড, পনের সেকেণ্ড! স্ফীতকায় ফোস্কাটা আর সহ্য করতে পারে না উত্তাপ—ফেটে গেল সেটা সশব্দে! নৈঃশব্দের মাঝখানে একটা ছোট্ট শব্দের তরঙ্গ রুদ্ধদ্বার কক্ষের বাতাসে ভাসতে থাকে। আর তখনই ঘরের পিছনের পর্দাটা বিদীর্ণ করে ভেসে এল একটা জান্তব আর্তনাদ!

সম্বিৎ ফিরে পেল নাথানিয়াল। এ কী হচ্ছে কি? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত লাফ দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। অগ্নির উৎসটা সবলে আঁকড়ে ধরে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় মোমবাতিটা ঘরের ও-প্রান্তে।

নীরন্ধ্র অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মাঝখানে শোনা যায় আতঙ্কতাড়িত নাথানিয়ালের গর্জন, যু ক্রেসি ম্যান! য়ু ইনসেন ফুল!

কিন্তু সে শব্দকে খান্ খান্ করে জেগে ওঠে আর একটি আর্ত কণ্ঠস্বর। অন্ধকার ঘরের ও-প্রান্তে পর্দাটা ঠেলে কেউ প্রবেশ করেছে পূর্বমুহূর্তে। কায়াহীন একটা নারীকণ্ঠ চিৎকার করে ওঠে, –ওকে যেতে বল! ও পাগল! ও বদ্ধ উন্মাদ!

.

আরও পনেরটা দিন সে ছিল ঐ জোড়-জাঙালে, তেঁতুলডাঙা মাঠের মাঝখানে তার পাতায় ছাওয়া কুটিরখানিতে। এমন দুরন্ত অবসাদে আর কোনদিন তার দেহমন ভেঙে পড়েনি। আঘাত তো সে জীবনে কম পায়নি। মায়ের মৃত্যু, খুড়িমার অনাদর, কাকার কাছে অপমান। দুঃখ কী, তা ছেলেবয়স থেকেই বুঝতে শিখেছে। তারপর যত বয়স বেড়েছে ক্রমাগত আঘাত সইতে হয়েছে তাকে। ঊর্মিলার কৌতুক আর প্রত্যাখ্যান, গীর্জা থেকে বিতাড়ন, মালকাটাদের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াও সয়েছিল। শারদাঁ ওকে দিয়েছিলেন দুঃখকে জয় করবার এক নূতন মন্ত্র–ঈশ্বরে বিশ্বাস। তাও ধোপে টিকল না। ঈশ্বরে বিশ্বাস হারালো। তবু ভেঙে পড়েনি ভিন্সেন্ট। নূতন তন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল দেবনারায়ণবাবুর কাছে। নূতন জগৎ সৃষ্টি করবার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এসেছিল জোড় জাঙালে। কিন্তু নিয়তি আজও ওর পিছন ছাড়েনি। বিদায় নিলেন ফাদার শারদাঁ, সরে গেল ওর জীবন থেকে ঊর্মিলা। আর বিসর্জন দিয়ে এল চিত্রলেখাকেও। সে নাকি পাগল! সে নাকি বদ্ধ উন্মাদ!

ডানহাতের তালুতে দগদগে ঘা। ছবি আঁকার প্রশ্নই ওঠে না। তুলি ধরা বন্ধ থাকবে কতদিন কে জানে? সাঁকো পার হয়ে ইদানিং মালকাটার দল আর তেঁতুলডাঙার মাঠে আসে না ওর সন্ধান নিতে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বাতাসী। সেও আর আসে না। ভিন্সেন্ট জানতে পারেনি শীতের অন্তে ধাওড়ায় বসন্ত এসেছে তার ভীষণ রূপে। নিদারুণ মারী রোগে বাতাসী শয্যাগতা।

তিল তিল করে অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষটা দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। কোনমতে বয়ে নিয়ে আসে খাবার জলটুকু। সারাদিন ঐ তার সম্বল। চুপচাপ শুয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। এখন সে কি করবে? কলকাতায় ফিরে যাবে? ট্রেনভাড়া পাবে কোথায়? সূরযকে চিঠি লিখবে? কিন্তু সূরয কোথায় থাকে এখন? কি করছে সে?

ভিন্সেন্টের মনে হল, বিশ বছর বয়সেই সে ফুরিয়ে গেছে। আর তার কিছু করণীয় নেই। আজকাল সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেও পারে না। মাথার মধ্যে টলে ওঠে। অন্তত বাতাসীটাও যদি আসত! মনে পড়ে বার বার যোসেফ মুর্মুর কথা। যোসেফ মরতে চায়নি; তবু শেষ সময়ে মৃত্যুই তার একমাত্র কাম্য ছিল। ভিন্সেন্টও মরতে চায় নানা, আজও সে বাঁচতেই চায়। মনে পড়ে ফাদার শারদাঁর ঘরে টাঙানো সেই শেষ বিচারের ছবিখানা। মিকেলাঞ্জেলোর অনবদ্য সৃষ্টি-সিস্টিন চ্যাপেলে আঁকা শেষ বিচারের দৃশ্য। ঈশ্বর অলীক; কিন্তু যীসাস তো ঐতিহাসিক সত্য। মিকেলাঞ্জেলোর স্বপ্ন কি সার্থক হবে না কোনদিন! আঠারো বছরের ন্যায়াধীশ তরুণের বেশে সাধুদের পরিত্রাণ করতে, আর দুষ্কৃতদের নয়কে পাঠাতে যীসাস কি সত্যিই একদিন ফিরে আসবেন না? আর মনে পড়ে কোম্পানির বাগানে দেখা সেই সন্ন্যাসীকে। তিনি বলেছিলেন, পূর্বজন্মে ভিন্সেন্ট নাকি বৈকুণ্ঠবাসের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছিল এই দুনিয়াদারির পঙ্কিল পরিবেশে। এবারকার খেলাও তো শেষ হয়ে এল। এবার যখন যমদূত এসে প্রশ্ন করবে তাকে, সে কী জবাব দেবে? আবার কি নতুন করে শুরু করতে চাইবে ঐ একই খেলা?

সেদিন সন্ধ্যায় নিজেকে এত দুর্বল লাগল যে, বিছানা থেকে মাথাটা আর তুলতে পারল না। ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিল; কিন্তু উঠে গিয়ে জল গড়িয়ে খাবার মত সামর্থ্য আর বাকি নেই। হঠাৎ ভিন্সেন্টের মনে হল খোলা দরজায় কার যেন ছায়া পড়ল। চোখ তুলে দেখবার চেষ্টা করে। উন্মুক্ত দ্বারপথে একমুঠো আকাশের পশ্চাৎপটে মনে হল কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যু কি আসন্ন? ঐ কি মৃত্যুর রূপ? কিন্তু তা কেমন করে হবে–যে এসেছে সে তো যমদূতের মত ভয়াবহ নয়? সে যে আঠারো বছরের তরুণ। বলিষ্ঠ দীর্ঘকায় সুপুরুষ একজন।

–কে? কে তুমি?–আর্তকণ্ঠে বলতে গেল ভিন্সেন্ট। কথা ফুটল না।

আগন্তুক এগিয়ে এল। নিচু হয়ে দেখল একবার। তারপর হাঁটু গেড়ে বসল ওর সামনে। তুলে নিল ওর মাথাটা নিজের কোলে। হাত বুলিয়ে দিল ওর জ্বরতপ্ত কপালে।

যীসাস ক্রাইস্ট! হ্যাঁ; কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ শীর্ণকায় দুর্বল প্রৌঢ় মানুষটা নন মিকেলাঞ্জেলোর স্বপ্নে দেখা বৃষস্কন্ধ মহাকায় যীসাস! অ্যাপালোর মত, ডেভিডের মত আঠারো বছরের তারুণ্যে ভরপুর!

জল!-অস্ফুটে বলল ভিন্সেন্ট।

লোকটা ওর মুখের কাছে ধরল জলের পাত্র!

যীসাস! তুমি এসেছ? এতদিনে সময় হয়েছে তোমার?

লোকটা ঝরঝব করে কেঁদে ফেললে। বললে, দাদা! আমাকে চিনতে পারছ না? আমি সূরয!

মৃত্যু আপাতত হার স্বীকার করল। মরা হল না ভিন্সেন্টের। সূরয ওকে মরতে দিল না, দিতে পারে না। সাত রাজ্য ঘুরে সে এসে পৌচেছে ঠিক সময়ে। চন্দ্রভান। গর্গের লক্ষ্মণভাই সূরযভান গর্গ!

জোড়-জাঙালের জীবন শেষ হয়ে গেল ভিন্সেন্টের। সূরয ইতিমধ্যে চাকরিতে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে ওদের কাকার মৃত্যু হয়েছে। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে শুধু খ্রীষ্টান ভিন্সেন্ট একাই নয়, তার ভাইও বঞ্চিত হয়েছে। তাতে দুঃখ নেই সুরযের। সেও সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এসেছে। কলকাতায় একটি মেস বাড়িতে থাকে। নর্মান অ্যাণ্ড হ্যারিস কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। অল্প আয়, তা হোক, দাদার দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা সে রাখে। দাদাকে সে নিয়ে গিয়েছিল তার কলকাতার মেসে। ভিন্সেন্টের জীবনে শুরু হল আবার এক নূতন অধ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *