আবার যদি ইচ্ছা কর – ১০

১০.

এই সময়ে, বুঝলে নরেন, নিতান্ত ঘটনাচক্রে একদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চন্দ্রভানের। শ্যামবাজারের দিকে একটি রোগী দেখতে গিয়েছিলাম। রোগী দেখে কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীট ধরে মেডিক্যাল কলেজে ফিরছি, হঠাৎ নজর হল হেদোর ধারে একটা প্যাকিং বাক্সের উপর বসে আছে আমারই বয়সী একজন লোক। দেখেই চেনা চেনা লাগল, পরমুহূর্তেই চিনে ফেললাম তাকে। প্রায় বিশ বছর পরে তাকে দেখছি, কিন্তু চিনতে আমার ভুল হয়নি। এ নিশ্চিত সেই চন্দ্রভান। গাড়ি থামিয়ে নেমে এলাম। লোকটা চুপ করে বসে আছে কী ভাবছে। গায়ে একটা হাফ-সার্ট, তার উপর আলোয়ান, নিম্নাঙ্গে একটা পাৎলুন–পায়জামার মত ক্রীজহীন। পায়ে ছেঁড়া চটি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ; চুলে বহুদিন তেল চিরুনি পড়েনি। বয়সে বেড়েছে, বেশ রোগাও হয়ে গেছে সে। জমিদার বাড়ির আলালের ঘরের সেই দুলালটির চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। ওকে চিনতে পারলাম ওর সেই অদ্ভুত চোখ দুটো দেখে। আর কান দুটো। চন্দ্রভানের কান দুটো যেন ওর বিদ্রোহী আত্মার বিজয় কেতন। সহজে ভুল হবার নয়!

-কি রে, চিনতে পারিস?

ও কি যেন ভাবছিল আপন মনে। চমকে ওঠে আমার ডাক শুনে। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় প্যাকিং বাক্সটা ছেড়ে। বলে, আরে! তুই দীপু না?

জড়িয়ে ধরল একেবারে। ম্যাট্রিক পাস করার পর পাক্কা উনিশ বছর কেটে গেছে। আমার কোন সংবাদই সে রাখত না। ওর সম্বন্ধে আমিও তখন বিশেষ কিছু জানতাম না। লোকমুখে শুনেছিলাম, সে সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। আর শুনেছিলাম সে নাকি ধর্মত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়ে গেছে। আর কিছু জানতাম না।

-তুই যে একেবারে সাহেব হয়ে গেছিস রে, অ্যাঁ? মটোর গাড়ি? তোর? কিনেছিস?

আমার নিখুঁত স্যুট আর গাড়িটা সে দেখছিল। ঈর্ষার কণামাত্র লক্ষ্য হল না ওর বিস্মিত দৃষ্টিতে। সে যেন খুব খুশি হয়েছে আমার এ উন্নতিতে। বললে, তুই আজকাল কি করছিস রে দীপু? তোর খবর বন্?

ডাক্তার হয়েছি আমি। মেডিক্যাল কলেজে অ্যাটাচ আছি। প্রাইভেট প্র্যাকটিও করি।

বাঃ! বাঃ! তুই তা হলে জীবনে সফল হয়েছিস! ভারি ভাল লাগছে শুনে।

–তুই এখানে বসে কি করছিলি?

চন্দ্রভান হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল হেদোর রেলিঙে টাঙানো একগাদা ছবি। রেলিঙের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে দড়ি খাটানো। তাতে ক্লিপ দিয়ে আটকানো খান দশ বারো ছবি। ফ্রেম নেই, বাঁধানো নয়। কিছু পেনসিল স্কেচ, কিছু ক্রেয়নে, খান তিনেক জলরঙে। এছাড়া রেলিঙের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা আছে খান চার-পাঁচ তেলরঙের ক্যানভাস। হায় ঈশ্বর! শেষে চন্দ্রভানও ছবি আঁকতে শুরু করল? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখলাম। কয়েকটি নিসর্গ দৃশ্য। একটা ভাঙা গীর্জা, পশ্চাৎপটে কি একটা ফ্রেম-স্ট্রাকচার, তাতে গোল গোল দুটো চাকা। দেবদারু গাছের সারির মাঝখান দিয়ে রাঙা মাটির আঁকাবাঁকা পথ। কতকগুলি কুলি রমণীর ছবি। জনা-কতক সাঁওতাল গোল হয়ে বসে বোধকরি হাঁড়িয়া খাচ্ছে। সাঁওতালী নাচের পালা–মাদল বাজাচ্ছে, বাঁশি বাজাচ্ছে, মেয়েরা নাচছে। একটা কাঠের সাঁকো নিচেকার জলে সাঁকোটা প্রতিবিম্বিত, একটা নৌকা, কজন জলে কাপড় ধুচ্ছে, সাঁকোর উপর একটা এক-ঘোড়ার গাড়ি। আর একটা তেল রঙের ছবি–মাঝখানে জ্বলছে কেরোসিনের টেমি, তিনটি কুলি রমণী ও একজন পুরুষ গোল গোল ডিমের মত কি যেন খাচ্ছে; চিত্রকরের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে একটি বছর আষ্টেকের মেয়ে, চিত্রের কেন্দ্রস্থলে।

নেহাৎ মামুলি ছবি সব। বিষয়বস্তুতে আকর্ষণীয় কিছু নেই। তবে রঙের ব্যবহারটাতে সাহসের পরিচয় আছে। কখনও কখনও তুলির সোজা টান না দিয়ে সে পাশাপাশি বিন্দু বিন্দু রঙের ফুটকি বসিয়েছে। কখনও বা বিশেষ করে অয়েল কালারে, রঙ লাগিয়েছে রীতিমত ধ্যাবড়া করে লিনসিড অয়েল-তৃষিত কাঁচা রঙ বোধহয় আঙুলে করে থুপ থুপ করে বসিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের রঙের ব্যভিচার আমি ইতিপূর্বে কখনও দেখিনি।

-কেমন লাগছে?

 সেই চিরন্তন সমস্যা! নবীন সাহিত্যিক, নবীন শিল্পীর বন্ধুদলের এ এক সর্বকালের সমস্যা। মুখ ফুটে বলাও যায় না যে, মোটেই ভাল লাগছে না! একটু ঘুরিয়ে বলি, স্টাইলটা নতুন, কিন্তু এ কি পাবলিকে নেবে?

–পাবলিকের জন্য তো আঁকিনি আমি!

 –তাহলে হেদোর ধারে সাজিয়ে বসেছিস কেন?

চন্দ্রভান ম্লান হাসে। বুঝতে পারি তার সমস্যা। সাধারণ মানুষে ছবি কেনে না, কেনে রাজা মহারাজা জমিদার এবং বিলাতি কোম্পানির ধনকুবেররা। তাদের নাগাল কেমন করে পাবে চন্দ্রভান? তাছাড়া তারা এ জাতীয় ছবি পচ্ছন্দই করবে না।

–ছবির কথা থাক। তোর খবর বল্। কোথায় আছিস?

 চন্দ্রভান বললে, সে কাছেই থাকে। ঠিকানা জানাল না।

বিয়ে করেছিস?

 এবার সে হাসল। বললে, করেছি। তুই তো ডাক্তার হয়েছিস দীপু, একটা উপকার করবি?

-কি বল্?

–ওকে একবার ডাক্তার দিয়ে দেখাতে চাই।

–বেশ তো, নিয়ে যাস একদিন। হাসপাতালে কিংবা আমার বাড়িতে

— ছাপানো কার্ড বার করে দিলাম। সেটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মুখ নিচু করেই বললে, –তোকে দিয়ে দেখানো চলবে না, কোন লেডি ডাক্তার তোর জানাশোনা আছে?

আমি হেসে উঠি। বলি, –তোর বউ পর্দানশীন নাকি? তুই না খ্রীষ্টান হয়েছিস? তোর বউও তো আলোকপ্রাপ্তা? না কি?

না রে! ও কিছুতেই পুরুষমানুষের সামনে বের হতে চায় না। সে অনেক ব্যাপার। তোকে পরে সব বলব একদিন। কোন মেয়ে ডাক্তার হলে

-কি হয়েছে তোর বউয়ের? অসুখটা কি?

–না, অসুখ কিছু নয়। ওর…ছেলেপুলে হবে।

–আচ্ছা! কংগ্রাচুলেশন্স! এই কি ফার্স্ট কনফাইনমেন্ট? প্রথম সন্তান সম্ভবনা?

না। এর আগেও একটি ছেলে হয়েছিল। সেটি মারা গেছে।

 জন্মাবার সময়?

–না না। অনেক বড় হয়ে প্রায় আট বছর বয়সে।

–ওঃ! অনেকদিন বিয়ে করেছিস তাহলে। তা এত বছর আর বাচ্চা হয়নি?

না।

-বুঝলাম। তা তুই কালই ওকে হাসপাতালে নিয়ে আয়। আমি ব্যবস্থা করে দেব। ভয় নেই, আমি ঘোমটা দিয়ে থাকব। মেডিক্যাল কলেজে একজন লেডি ডাক্তার। আছেন। ডক্টর মিসেস স্মিথ। কাল তার ভিসিটিং ডে। তুই সোজা আমার ঘরে চলে আসিস।

পরদিনই চন্দ্রভান সস্ত্রীক মেডিক্যাল কলেজে এসে হাজির। স্লিপ দেখে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। চন্দ্রভানকে নিয়ে এলাম। মিসেস স্মিথের ঘরে। আমার চেম্বারের বাইরে বেঞ্চিতে যারা সারি সারি বসেছিল তাদের মধ্যে একজনকে চন্দ্রভান ইঙ্গিতে আহ্বান করল। উঠে এলেন একজন মহিলা। মুখের উপর এত প্রকাণ্ড ঘোমটা তিনি দিয়েছেন যে, চন্দ্রভানের বউ দেখা আমার হল না, তবে হাত-পাগুলি অনাবৃত ছিল। তাতে মালুম হল, চন্দ্রভান যদি কখনও বটুকেশ্বরের মত তার বউয়ের ছবি আঁকতে বসে তাহলে তার প্রয়োজন হবে একটি মাত্র রঙ-চাইনিস ইংক। বলিষ্ঠগঠনা। দীর্ঘাঙ্গী। নিঃসন্দেহে তার ফিগারটি অনিন্দ্যনীয়, যদিও বর্তমানে তাকে মধ্যে-ক্ষামা বলার উপায় নেই।

মিসেস স্মিথের কাছে ওকে জিন্মা করে আসার আগে বলি, কাল আবার আসিস। ইতিমধ্যে মিসেস স্মিথের কাছ থেকে প্রাথমিক রিপোর্টটা আমি শুনে নেব।

প্রাথমিক রিপোর্টটা আমাকে গরজ করে শুনতে যেতে হল না। ভিসিটিং আওয়ার শেষ হলে ডক্টর মিসেস স্মিথ নিজেই চলে এলেন আমার ঘরে। আমারও রোগী দেখার পর্ব শেষ হয়েছিল। উঠব উঠব করছি, হঠাৎ উনি আসায় আবার বসে পড়ি। উনি বলেন, ডক্টর লাহিড়ী মিস্টার গর্গ কি আপনার বিশিষ্ট বন্ধু?

-হ্যাঁ, আমার সহপাঠী। আমরা একসঙ্গে আর্য মিশন স্কুলে পড়তাম।

–তারপর? তারপর আপনাদের বন্ধুত্বটা কি পর্যায়ে আছে?

-কেন বলুন তো? ম্যাট্রিক পাস করার পর আর ওর খবর কিছু জানতাম না। গতকাল মাত্র দেখা হয়েছে। একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?

মিসেস স্মিথ একটু ইতস্ততঃ করে বলেন, না, কিছু নয়। ওঁর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, নয়?

-হ্যাঁ। অথচ ও জমিদারের ছেলে। সব ছেড়ে-ছুঁড়ে ও বিবাগী হয়ে যায়।

জমিদারের ছেলে! ও, তাই বলুন!

 কেমন যেন অসংলগ্ন কথাবার্তা ওর। মনে হল কি একটা কথা উনি বলি বলি করেও বলতে পারছেন না। অমন একটা লোফারের সঙ্গে আমার মত ডাক্তার মানুষের বন্ধুত্বটা ঠিকমত বরদাস্ত করতে পারছিলেন না বোধ হয়।

মিসেস গর্গকে কেমন দেখলেন বলুন? কোন কমপ্লিকেশান আছে?

এতক্ষণে মুখ তুলে মিসেস স্মিথ চাইলেন আমার দিকে। বললেন, –আছে! কিন্তু চিকিৎসাটা আপনাকে করতে হবে, আমার দ্বারা সম্ভবপর নয়!

এ আবার কি হেঁয়ালি? আমাকে প্রশ্ন করতে হল না। উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, চিকিৎসার প্রয়োজন ওর স্ত্রীর নয়, মিস্টার গর্গের। আর সে ওষুধটা আপনার পক্ষে প্রয়োগ করাই বাঞ্ছনীয়।

-কি ওষুধ?

–শঙ্কর মাছের চাবুক!

আমি স্তম্ভিত। কি বলছেন উনি? কী বলতে চাইছেন?

 মিসেস স্মিথ নিঃশব্দে একটি রিপোর্ট আমার সামনে বাড়িয়ে ধরেন। দেখলাম লেখা আছে-রোগিণী মিসেস গর্গ, বয়স ছত্রিশ, ওজন একশ বারো পাউণ্ড, গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স পঁচিশ সপ্তাহ, এবং আসন্ন জননী উপদংশ রোগে আক্রান্ত!

–ওঁর স্ত্রী নিতান্ত গ্রাম্য মহিলা। কথায় জড়তা আছে। লজ্জায় জড়সড়। বোধকরি আপনার বন্ধু তাকে নিয়ে কোনদিন থিয়েটার্স দেখতেও যান না, পর্দানশীন যে! আর এদিকে নিজে প্রস্ কোয়ার্টার থেকে নিয়ে এসেছেন এ রোগ–চাপিয়ে দিয়েছেন নির্বিচারে একটা অসহায় মেয়ের দেহে। মাপ করবেন ডক্টর লাহিড়ী-আপনার বন্ধু বলে আমি রেয়াৎ করব না। হান্টার পেটা করা ছাড়া ও রোগের চিকিৎসা নেই!

আমি জবাব দিতে পারিনি। জবাব ছিলও না কিছু। সেই চন্দ্রভান এত নিচে নেমে গেছে?

পরদিন আবার চন্দ্রভান এল হাসপাতালে। ঘরে ঢোকবার মুখেই দেখি বেঞ্চির কোণ দখল করে বসে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে কিছু একটা কথা বলতে চায়। আমি দেখেও দেখি না। সোজা ঢুকে পড়ি চেম্বারে।

একটু পরে আর্দালি খানকতক স্লিপ রেখে গেল টেবিলে। সবার উপরে চন্দ্রভানের চিরকুট। আমি সেটা বাঁ-হাতে সরিয়ে রাখি। থাক বসে। অন্যান্য দর্শনপ্রার্থীদের একে একে বিদায় করতে থাকি। একটি বেলা ওকে বসিয়ে রেখে উঠবার উপক্রম করছি, আর্দালি পুনরায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল স্লিপ কাগজটার দিকে।

-এর আউটডোর টিকিট কোথায়? এখানে কি চায়?

–না স্যার, উনি এমনিই দেখা করতে চান। বললেন, আপনার বন্ধু।

বন্ধু! নাঃ! এ অধ্যায়ের শেষ করতে হয়। না হলে সকাল-সন্ধ্যা নোকটা বিরক্ত করবে, যেখানে-সেখানে পরিচয় দেবে ডাক্তার দ্বৈপায়ন লাহিড়ী ওর বন্ধু। ঐ চরিত্রহীন, ইন্দ্রিয়াসক্ত লম্পট লোকটা–যে বেশ্যাপল্লী থেকে কুৎসিত ব্যাধি বয়ে নিয়ে এসে সেটা ধর্মপত্নীর দেহে পাচার করেছে তার সঙ্গে সব সম্পর্ক এখনই চুকিয়ে নেওয়া দরকার।

–ডেকে দাও।

চন্দ্রভান পর্দা সরিয়ে ঢুকল। সে নিশ্চয় কিছু আন্দাজ করেছে। বিনা অনুমতিতে বসল আমার ভিসিটার্স চেয়ারে। কেমন যেন গোরু চোরের মত আতঙ্কিত দৃষ্টি। কান দুটো খরগোশের মত খাড়া হয়ে আছে। একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

-কি চাই?

একেবারে থতমত খেয়ে গেল চন্দ্রভান। ঢোক গিলে বললে, না, মানে কাল তুই আসতে বলেছিলি কিনা? ইয়ে মিসেস স্মিথ কি বললেন? কোন কমপ্লিকেশান নেই তো?

আমি ওকে বসতে বললাম না। বরং নিজেই উঠে পড়ি। হ্যাঙার থেকে কোটটা পেড়ে গায়ে দিতে দিতে বলি, কপ্লিকেশান যে আছে তা তুমি জান না?

ও বোকার মত তাকিয়ে থাকে। অস্ফুটে বলে, না! কী?

-তোমার স্ত্রী একটি কুৎসিত ব্যাধিতে ভুগছেন, এ কথা তোমার জানা নেই বলতে চাও?

বিশ্বাস কর দীপু, আমি কিছুই জানি না!

ও আমাকে বিশ্বাস করতে বলছে! স্ত্রীর উপদংশ রোগ হয়েছে, তা স্বামী জানে না! ঘুরে দাঁড়িয়ে বলি, –তোর লজ্জা হয় না স্কাউণ্ড্রেল? সমাজে মুখ দেখাস কি করে?

ওর মুখটা একেবারে ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলে, কী বলছিস?

ন্যাকা! কতদিন ধরে প্রস্ কোয়াটার্সে যাচ্ছিস?

মাথাটা নিচু হয়ে গেল ওর।

-কই, তুই তো বললি না–প্রস্ কোয়ার্টার্সে আমি জীবনে যাইনি দীপু!

মুখটা তুলল না। মাথা নিচু করেই বলল, -মিছে কথা আমি বলি না। আমি শুধু ভাবছি তুই কেমন করে জানতে পারলি!

–রোগ চাপা থাকে না। ও-রোগের চিকিৎসা হচ্ছে চাবুক। চাবকে শায়েস্তা করলে তবে ও রোগ ছাড়বে। তবে আমার ওসব ভাল লাগে না। আমার সময়ও নেই, ধৈর্যও নেই। অন্য কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাস।

একটি কথাও বলল না চন্দ্রভান। মুখ তুলে চাইল না পর্যন্ত।

আর একটা কথা। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও আজ এখানে শেষ হল।

 –আর কোনদিন এখানে আসব না, এই কথা বলতে চাস?

না। এটা সরকারী হাসপাতালও কথা বলার অধিকার আমার নেই। তবে ডাক্তার দ্বৈপায়ন লাহিড়ীর বন্ধুর পরিচয়ে এখানে আর এস না।

এতক্ষণে চন্দ্রভান হাসল। পাণ্ডুর ম্লান হাসি। বললে, ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি।

বলল বটে, কিন্তু চলে গেল না। জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর আপন মনে বললে, আজব এ দুনিয়া! ক্রিশ্চান ফাদারদের দেখলাম–পাপের সঙ্গে দিব্যি আপস করেছেন তারা, যত আক্রোশ পাপীর উপর, আর কে পাপী তাও চিনতে পারছেন না! আজ আবার মেডিক্যাল কলেজের পাস করা ডাক্তারদের দেখলাম রোগের বিরুদ্ধে তাদের কোন জেহাদ নেই, যত আক্রোশ রোগীর উপর, আর কে রোগী তাও চিনতে পারছেন না তারা।

–তার মানে? তুই নিরোগ? ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বল্ দেখি তোর রতিজ রোগ নেই?

–তা আমি বলব না দীপু। কারণ ঈশ্বরকে আমি মানি না! ঈশ্বরের নামে শপথ নিই না আমি!

-না, মিস্টার ভিন্সেন্ট ভান গর্গ! আমি কালী-দুর্গা-মা শীতলার দিব্যি দিতে বলছি না তোমাকে। তোমাদের গড-দি-ফাদারের নামে ওথ নিতে বলছি।

-হ্যাঁ, আমি ও তাঁর কথা বলছি! ঈশ্বর মানি না আমি! আমি নাস্তিক!

-খুব আনন্দের কথা! সমাজ মানো না, ধর্ম মানো না, ঈশ্বরও মানো না! বাঃ! বেশ কথা, তবে দয়া করে ঐ সঙ্গে আরও একটি জিনিস অস্বীকার কর–আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা!

চন্দ্রভান জবাব দেওয়ার সুযোগ পায়নি। পরক্ষণে আমি নিজেই ঘর ছেড়ে চলে যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *