১৬.
এরপর দীর্ঘ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ব্যবধান দিয়ে শুরু করি–
আমি দ্বৈপায়নদাদুকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, আপনার গল্প কি এখনও শেষ হয়নি?
তুমি কি ভেবেছিলে, শেষ হয়ে গেল সব কথা?
-তাই তো ভেবেছিলাম। বটুকেশ্বর দেবনাথ বরিশালে ফিরে গেলেন, গগন পাল দেশত্যাগী হলেন আর ভান গর্গ উন্মাদ অবস্থায় আত্মহত্যা করলেন–এরপর আর বাকি থাকল কে?
বাকি থাকল দ্বৈপায়ন লাহিড়ী। ভূষণ্ডী কাকের মত আশী বছর বয়সে সে আজও টিকে আছে।
আমি লজ্জা পাই।
দ্বৈপায়নদাদু কিন্তু থামলেন না, বলে চলেন, শিল্পীর শেষ আছে, শিল্পের শেষ নেই। গল্প আমার শেষ হয়নি। বটুকেশ্বরের সঙ্গে তার শেষদিন পর্যন্ত আমার পত্রালাপ অব্যাহত ছিল। বরিশাল থেকে মাঝে মাঝৈ তার চিঠি পেতাম। তার পরিবারে ফিরে গিয়েছিল সে। বাপ-মা তাকে গ্রহণ করেছিলেন। সে আর বিবাহ করেনি কোনদিন। সুলেখাকে সে ভুলতে পারেনি সারাজীবন। মহাজনী কারবারে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল। ছবি আর কখনও আঁকেনি সে। দেশ স্বাধীন হবার আগেই সে মারা যায়। বরিশালেই।
গগ্যার খবরও আর পাইনি। একটি বিদেশী জাহাজে খালাসীর কাজ নিয়ে সে কোন্ সুদূরে পাড়ি জমায় এটুকু জেনেছিলাম। তারপর আর বিশ-ত্রিশ বছর তার খবর রাখিনি। তবু অদ্ভুতভাবে গগনের শেষজীবনের কাহিনীটা আমার গোচরে এল। অনেক অনেক দিন পরে। সেটা বোধহয় উনিশশো তিপ্পান্ন সাল। হঠাৎ বিলাতি ডাকটিকিট দেওয়া একটা খাম এল আমার নামে। অভাবনীয় ব্যাপার! চিঠিখানা লিখেছেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একজন মার্কিন ভদ্রলোক-প্রফেসর রবার্ট ম্যাকগ্রেগরী। একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিস। সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। মার্কিন মুলুকের একজন বিশ্ববিশ্রুত কলারসিক–আর্ট-কনৌসার। লিখেছেন–নিতান্ত ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছি আপনার সঙ্গে মিস্টার গগন পাল আর্টিস্টের পরিচয় ছিল। গগনবাবুর পুত্র, বর্তমানে ঢাকা-নিবাসী মিস্টার আর. জি. পাল অ্যাডভোকেট আমাকে জানিয়েছেন যে, আপনি তার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এ কথা যদি সত্য হয় তাহলে অনুগ্রহ করে শিল্পীর বাল্যজীবন সম্বন্ধে আপনার যেটুকু জানা আছে তা আমাকে জানাবেন কি? তাঁর শিল্পকর্ম কোথায় দেখতে পাওয়া যেতে পারে তাও জানাবেন। আপনার উত্তর পেলে কলকাতাস্থিত আমেরিকান কনস্যুলেটকে আমি অনুরোধ করব আপনার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে।
আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। গগন পালের বাল্যজীবন সম্বন্ধে ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্প-বিশারদ আগ্রহী! গগ্যার খবর তিনি কোথায় পেলেন? গগ্যার ছেলের সন্ধানই বা। তিনি জানলেন কেমন করে? বাবলু তাহলে অ্যাডভোকেট হয়েছে? সেই হাফ-প্যাডেল করা বাবলু! যাই হোক জবাবে আমি লিখলাম, -গগন পাল আমার সতীর্থ ও বন্ধু। তার জীবনের অনেক কিছুই আমি জানি। উনিশশো চব্বিশ সালে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি। তারপর সে কোথায় আছে আমি জানি না। তার শিল্পকর্মও কোথায় আছে তা আমার অজ্ঞাত। তবে তার আঁকা একটি অয়েলকালার আমার কাছে আছে। সেটা আমি নিলামে কিনেছিলাম।
ম্যাকগ্রেগরী পত্রপাঠ জবাব দিলেন, –আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার বন্ধু জীবিত নেই। তাঁর ছবিখানি আপনি কোনক্রমেই হস্তান্তরিত করবেন না। ঘটনাচক্রে আগামী মাসে এখান থেকে ওঙ্কারভাট, বরভুদর যেতে হবে আমাকে। সেই সময় ভারতবর্ষে যাবারও চেষ্টা করব। সম্ভব হলে আপনার সঙ্গে দেখা করব।
মাসছয়েক পরে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বছর পঞ্চাশ বয়স। বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারা। ইতিপূর্বে আরও দুবার ভারতবর্ষে এসেছেন! অজন্তা খাজুরাহো সাঁচি-মহাবলিপুরম চষে বেড়িয়েছেন। সৌজন্য-বিনিময়ের পরে বলেন, কই, নিয়ে আসুন আপনার বন্ধুর ছবিটা!
যখন আমি ছবিখানা দ্বিতলের ঘর থেকে নামিয়ে আনলাম তখন উনি সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত। আমি ছবিটা জানালার সিলের উপর রাখি; ভদ্রলোক কয়েক পা পিছু হটে এলেন। একদৃষ্টে ছবিখানা দেখতে থাকেন। নির্বাক নিস্পন্দ। না টানলে একটা সিগারেট আদ্যন্ত পুড়তে কতক্ষণ লাগে? অতটা সময় ছবিখানা দেখেছিলেন। যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন আঙুলে আগুনের ছেঁকা লাগায়।
য়ায়াম সরি! ইতিমধ্যে সিগারেটের লম্বা ছাই ঝরে পড়েছে মেঝের কার্পেটে। স্টাম্পটা অ্যাসট্রেতে ফেলে দিয়ে উনি দ্বিতীয় একটি সিগারেট ধরান। আমার দিকে ফিরে বলেন, আপনি কি এই ছবিটা বিক্রি করতে সম্মত? আপনি চিঠিতে লিখেছিলেন এটি আপনি নিলামে কিনেছেন–এ কোন উপহার নয়; তাই প্রশ্ন করছি।
–এ ছবি নিয়ে আপনি কি করবেন?
–কোন একটি সংগ্রহশালায় রাখব।
আমি বলি, প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী, আমার বন্ধু এ দেশে তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। এ ছবিটি অতি অল্প দামে কিনেছিলাম আমি। আপনি যদি একে কোন বিখ্যাত সংগ্রহশালায় রাখতে চান আমি বাধা দেব না। আপনি এখানা নিয়ে যান।
কত দাম দিতে হবে?
আমি হেসে বলি, –আমি ছবির কি বুঝি? আপনি আর্ট কনৌসার। এ ছবির ন্যায্য দাম যা হওয়া উচিত তাই দেবেন।
কৌতুক উপচে পড়ে অধ্যাপকের চোখ দুটিতে। বলেন, বর্তমানে আমি আর্ট কনৌসার নই, সামান্য খরিদ্দার মাত্র। আপনি ছবিটি নিলামে কিনেছেন, তাই ন্যায্য দর না জানলেও ওর বাজার-দরটা আপনি জানেন!
শিল্পীরা আত্মভোলা হয়। শিল্প-বিশারদরা সে জাতের নয় তাহলে।
তবে একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রাখা উচিত। আমি আপনাকে ঠকিয়ে নিয়ে গেছি একথা যেন আমাকে শুনতে না হয়। তাই প্রথমেই বলে রাখছি—ছবিটি মূল্যবান। আপনি বুঝেসুঝে দর দিন ডক্টর লাহিড়ী।
আমি ফস্ করে বলে বসি, –পাঁচশ টাকা দামটা কি খুব বেশি হবে?
প্রফেসর আমার কথার জবাব দিলেন না। তিনি তৈরী হয়েই এসেছিলেন। হাতব্যাগ খুলে পঞ্চাশখানি একশো টাকার নোট টেবিলের উপর রেখে বলেন, এক হাজার ডলার এর মিনিমাম্ প্রাইস্!
আমি স্তম্ভিত।
একটি পোর্টেবল টেপ-রেকর্ডার আমার টেবিলের উপর রাখেন। মাউথ-পীসটা আমার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরে বলেন, –আর্টিস্ট গগন পাল সম্বন্ধে আপনি যা জানেন এবার বলে যান।
আমি বলি, আগে আপনি বলুন গগন পালকে কেমন করে চিনলেন আপনি! কেনই বা ওর বিষয়ে এত উৎসাহ আপনার!
প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী বলেন, ডক্টর লাহিড়ী, আমিও আপনাকে একটি চমকপ্রদ কাহিনী শোনাব; কিন্তু সেটা পরে। আমি চাই সেকথা না জেনে খোলা মনে আপনি আপনার বন্ধুর সম্বন্ধে যা জানেন তা বলে যান। তার শেষ জীবনের কথা জানা হয়ে গেলে তার জীবনের প্রথম অধ্যায়টা ঠিকমত বলতে পারবেন না আপনি।
অগত্যা গগন পাল সম্বন্ধে আমার স্মৃতির ঝাপি খুলে ধরলাম। স্কুলজীবনের নানান। খুঁটিনাটি। পড়াশুনায় সে ভাল ছেলে ছিল না। ক্লাসে সেই ছিল বয়ঃজ্যেষ্ঠ। তারপর আমরা একসঙ্গে এনট্রান্স পরীক্ষা দিলাম। গগন এর আগেও দুবার ঐ পরীক্ষা দিয়েছিল, পাস করতে পারেনি। এবার পরীক্ষার পর আমরা ক বন্ধু কোম্পানির বাগানে কেমন করে সেই সন্ন্যাসী দর্শন করতে গিয়েছিলাম তাও বললাম। সন্ন্যাসী তুলসীদাসজীর একটি দোঁহা শুনিয়েছিলেন–তেরা বনৎ বনৎ বনি যাই; তেরা বিগড়ি বনৎ বনি যাই। চন্দ্রভানকে বলেছিলেন, -যবন কাহাকা!
বাধা দিয়ে ম্যাকগ্রেগরী বলেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার এই বন্ধু চন্দ্রভান গর্গ কি পরে খ্রীষ্টান হয়ে যান!
-হ্যাঁ। সেও পরবর্তী জীবনে চিত্রকর হতে চেয়েছিল। তার নাম হয়েছিল ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। বেচারীর ছবি কোন সমাদর পায়নি।
প্রফেসর বললেন, আপনি খবর রাখেন না ডক্টর লাহিড়ী। আপনার বন্ধু ভিন্সেন্ট ভান গর্গ অতি সম্প্রতি পশ্চিম-জগতে একজন স্বীকৃত মহাশিল্পী। আমার কাছে তার এ পর্যন্ত উদ্ধার-পাওয়া আটচল্লিশখানি ছবির হিসাব আছে। সাতটি অরিজিনাল এ পর্যন্ত আমি নিজে দেখেছি। বাকিগুলি য়ুরোপে ও আমেরিকায় আছে।
আমি অবাক হয়ে বলি, কী বলছেন আপনি! চন্দ্রভানের কোন্ ছবি আপনি দেখেছেন? তার ছবি য়ুরোপে আছে মানে? কেমন করে গেল সেখানে? নিশ্চয় আপনার ভুল হচ্ছে। সে আমার বন্ধু চন্দ্রভান নয়।
-আমি দেখেছি-আলুর ভোজ, সিঙারণের সেতু, সূরযমুখী, ইলিশমাছের ঝুড়ি, একটি গীর্জা, খান দুই সেলফ-পোর্ট্রেট।
কী আশ্চর্য! ওর এসব ছবি কোথায় আছে?
–পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত সংগ্রহশালায়। আমস্টার্ডাম, জুরিখ, ওটেলো, মস্কো, লণ্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারী, প্যারীর লুভার সংলগ্ন ইম্প্রেশনিস্ট মিউজিয়ামে।
আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করতেও ভুলে যাই। অধ্যাপক বলেন, আর্টিস্ট ভান গর্গের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী আমি পড়েছি। লিখেছেন মিসেস ডেভিডসন; তিনি ছিলেন ওঁর চিকিৎসকের স্ত্রী। লেখাটা আমেরিকান আর্ট-জার্নালে ছাপা হয়েছিল। অদ্ভুত জীবনী! ভদ্রলোক সমস্ত জীবন অর্থকষ্টে কাটিয়েছেন; অথচ তার যে-কোন একখানি ছবির আজ যা বাজার-দর তাতে সারাজীবন তিনি পায়ের উপর পা দিয়ে কাটাতে পারতেন।
আমি তখনও কথা বলতে পারছি না। মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা! বিশেষ করে ভিন্সেন্টের সেই উক্তিটি, –তুমি কি আমাকে করুণা করতে এসেছ ঊর্মি? সহানুভূতি জানাতে এসেছ?
শুধু ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রী একাই নন, ভিন্সেন্টও ছিল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। সে বলে গিয়েছিল –একদিন পৃথিবী নতমস্তকে স্বীকার করবে তার সৃষ্টিকে।
তারপর বলুন?
আবার শুরু করি আমার কাহিনী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গগনের সেই উদাত্ত কণ্ঠের গান, বাঙলার মাটি বাঙলার জল। তারপর সে ফেল করল। গগ্যা মুছে গেল আমার জানা দুনিয়া থেকে। এরপর কী ভাবে ঢাকার পল্টনবাজারে তার সন্ধান পাই, কী ভাবে সে স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে ত্যাগ করে চলে আসে বরানগরের বস্তীতে, রঙলালের স্ত্রীর স্কেচ করার অপরাধে তার মাথা ফেটে যাওয়া
তারপর আমি সঙ্কোচে থেমে যাই। বলি, -প্রফেসর, এরপর গগন পালের জীবনে এমন একটি অধ্যায়ের কথা আমি জানি যার সঙ্গে অন্যের জীবন যুক্ত। সেটা প্রকাশ করা বোধ হয় সঙ্গত হবে না!
যন্ত্রটা বন্ধ করে দিয়ে অধ্যাপক জানতে চান ব্যাপারটা কি। গগন তার বন্ধুর স্ত্রীকে ইলোপ করেছিল শুনে উনি জানতে চান সেই মেয়েটি, তার স্বামী অথবা সন্তান কে কে বেঁচে আছে। কেউ নেই শুনে বললেন, তাহলে আর সঙ্কোচ করবেন না। ইতিহাসকে অস্বীকার করবেন না।
যা জানি অকপটে সব বলে গেলাম।
অধ্যাপক বলেন, এবার আমি কেমন করে ওর সন্ধান পেলাম শুনুন।
বাধা দিয়ে বলি, না, এবার ইন্টারমিশন। একটু জলযোগ করে নিতে হবে।
প্রফেসর বলেন, –সে কি! আমি ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছি!
–তা হোক। এই হচ্ছে ভারতীয় শিষ্টাচার। আপনি কিছু না খেয়ে গেলে আমার স্ত্রী অত্যন্ত মর্মাহত হবেন।
প্রফেসর শ্রাগ করেন। হেসে বলেন, -ওরিয়েন্টাল কালচার সম্বন্ধে এখনও অনেক কিছু শিখতে বাকি আছে দেখছি!
আহারের অবকাশে বলি, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে দিন তো। ঐ ছবিখানা আপনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনলেন; কিন্তু ওতে আছেটা কি? আমি যে ওটা দশ টাকায় নিলামে কিনেছিলাম!
প্রফেসর অনভ্যস্ত হাতে ফুলকো লুচি ভাঙতে ভাঙতে বলেন, –এ একটি অনবদ্য ছবি! একেবারে নতুন স্টাইল। মৃত বেড়ালছানাটা হচ্ছে ঐ বস্তী-জীবনের অতীত। এভাবেই ঐ বস্তীর মানুষ যুগে যুগে মরেছে; আর ওদের মৃতদেহ মিল-মালিকের দল অবজ্ঞায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আঁস্তাকুড়ে। উপরের ঐ নিঃসঙ্গ চিলটা হচ্ছে বর্তমান শিল্পী স্বয়ং। বার্ডস্ আই ভিয়ুতে তিনি ঐ অবক্ষয়ী বস্তী-জীবনকে দেখছেন। তিনি ঐ জীবনের ভাগীদার নন, আছেন অনেক অনেক উঁচুতে; কিন্তু এ জীবনের সামগ্রিক অবক্ষয়ীরূপে গরুড়াবলোকনে প্রত্যক্ষ করছেন তিনি। শিল্পী হতাশ হননি। রক্তের মত জমাট কাদার দটাই এ বীর শেষ কথা নয় তিনি দেখেছেন ঐ নগ্ন শিশু ভোলানাথকেও! আবহমান কালের লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের নির্মোকও টান মেরে খুলে ফেলেছে–তাই ও উলঙ্গ। ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দুর্বল, ও শিশু, কিন্তু ওর মধ্যেই আছে বটগাছের বীজ! ওর প্রাণে তারুণ্যের সবুজাভা–ও নগ্ন বিদ্রোহী। ঐ শিশু ভোলানাথই কালে হবে রুদ্র ভৈরব! ইটস্ এ মাস্টার পীস্! ভরে রাখার উপযুক্ত।
কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! কালোহয়ং নিরবধি, বিপুলা পৃথ্বী। উপেক্ষিত নগণ্য গেয়ো যোগী মদের ঝেকে যে কথা বলেছিল বটুককে–যে কথা আমরা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম তারই অনুরণন আজ ত্রিশ বছর পরে শুনলাম সাগরপারের এক আর্ট কনৌসারের মুখে।
অধ্যাপক প্রশ্ন করেন, এ ছবিটি কোথায় বসে শিল্পী এঁকেছিলেন ধারণা করতে পারেন?
ধারণা কেন? জায়গাটা আমি চিনি। বরানগরের একটা কুলিবস্তী।
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী তৎক্ষণাৎ উঠে পড়েন। বলেন, তাহলে আর দেরী নয়। চলুন, এখনই সেখান থেকে ঘুরে আসি।
–সে কি? আপনার গল্পটা যে শোনা হয়নি।
-সেটা ফিরে এসে বলব। সকালের আলোতে ঐ বস্তীর কয়েকটা ফটো নিতে চাই। বেলা বেড়ে গেলে এফেক্টটা থাকবে না।
অগত্যা পাগল অধ্যাপককে নিয়ে এলাম সেই বরানগরের বস্তীতে। বিশ-ত্রিশ বছর পরে এলাম সেখানে। আশপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে। নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। রাস্তা পাকা হয়েছে। উদ্বাস্তু কলোনি জেগে উঠছে এখানে-ওখানে। কিন্তু কী আশ্চর্যভারতবর্ষের সেই ট্রাডিশান তবু সমানতালে চলেছে। বস্তীর জীবন আছে অপরিবর্তিত। রাস্তার উপর জমে আছে তেমনি ঘোলা জল, আঁস্তাকুড়ে উপচীয়মান আবর্জনার স্তূপ, পথের উপর বেওয়ারিশ উলঙ্গ শিশুর দল গাড়ির চাকার তলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ভাজিওয়ালার সেই চিনেবাদামগুলো এই ত্রিশ বছরেও ভাজা শেষ হয়নি । রাস্তার কলে সেদিন যে যুবতী মেয়েটিকে স্নান করতে দেখেছিলাম এ পঁচিশ ত্রিশ বছরেও তার স্নান শেষ হয়নি, তার পীনোদ্ধত যৌবন একটুও টলেনি।
গগন পালের সেই তের নম্বর ছাপরাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। এখন সেটা নাকি একটা তীর্থ।
সাহেব দেখে ওরা থতমত খেয়ে যায়। মেয়েরা গায়ের কাপড় সামলায়। বাচ্চাগুলো মায়ের পিছনে আড়াল খোঁজে। সাহেব অনেকগুলি ফটো নিলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিল। স্বদেশের এই নিরতিশয় দারিদ্র্যের ছবি মার্কিন দেশের আইভরি ফিনিশ আর্ট পেপারে ছাপা হবে। কিন্তু বাধাও দিতে পারলাম না।
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীর কাছে শুনেছিলাম গগন পালের শেষ জীবনের ইতিকথা :
বছর তিনেক আগের কথা। একজন চিত্র ব্যবসায়ী ওঁকে খানকতক ছবি এনে দেখায়। বলে, এগুলি সে নামমাত্র মূল্যে কিনেছে একজন স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান নাবিকের কাছে। ছবিগুলো দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন ম্যাকগ্রেগরী। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নাবিক সেগুলি সংগ্রহ করেছিল প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপে। চিত্রকরের নাম পল গগ্যা। সে তাহিতির লোক নয়, বিদেশী। ছবি আঁকত ঐ একান্ত দ্বীপে। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী চিত্রকর সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছিলেন তার ভাষ্য দিয়ে ঐ ছবি কখানি ছাপালেন আমেরিকার একটি বিখ্যাত আর্ট-ম্যাগাজিনে। হৈ-হৈ পড়ে গেল তাতে। পত্র পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখালেখি শুরু হয়ে গেল। কে এই আর্টিস্ট? তার আর কি ছবি আছে? যে কখানি ছবি সংগৃহীত হয়েছিল সেগুলি আশাতীত মূল্যে বিক্রয় হয়ে গেল। ম্যাকগ্রেগরী সেবার দূর প্রাচ্যে আসবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইউরোপ ঘুরে না এসে উনি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এলেন। উদ্দেশ্য ঐ তাহিতি দ্বীপের রাজধানী পাপীত্তিতে নেমে অজ্ঞাত চিত্রকরের সম্বন্ধে সন্ধান করা।
প্রথম দু-চারদিন কোন সংবাদ পান না। পল গগ্যা নামে কোন বিদেশীর খবর কেউ দিতে পারে না। শেষে একটি হোটেলের একজন বার-মেড বললে, –গগ্যা? সেই দৈত্যের মত লোকটা? একমুখ দাড়ি আর একমাথা চুল?
অধ্যাপক বলেন, –তা জানি না, কিন্তু লোকটা ছবি আঁকে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, ছবি আঁকে আর বাঁশী বাজায়। তবে সে-ই হবে। সে তো এখানে থাকে । বিয়ে করার পর সে মারকুয়েশাস দ্বীপে চলে গেছে।
বিয়ে করেছে? এখানে? কাকে?
–য়ামায়াকে। সে ছিল আত্তাই-এর মেয়ে। আত্তাই এখনও বেঁছে আছে! সে জানে।
মায়ের সন্ধান পেলেন অধ্যাপক। হ্যাঁ, সে পল গগ্যাকে চেনে। বিদেশী। কোন্ দেশের মানুষ জানে না। একদিন জাহাজে চেপে এসেছিল। খালাসীর পোশাকে। জাহাজে সে নাকি ইঞ্জিন-ঘরে কয়লা ঢালত। জাহাজটা এ বন্দরে দিন তিনেক ছিল। লোকটা পালায়। সে নাকি প্রথম দর্শনেই এই দ্বীপের প্রেমে পড়ে যায়। জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাবার দিনে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড জোয়ান। বছর পঞ্চাশ বয়স, কিন্তু খাটতে পারত ভূতের মত। লোকটা ছবি আঁকত আর বাঁশী বাজাত। দিনের বেলা ডকে কুলি-মজদুরের কাজ করত। গগ্যার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা দিল আত্তাই?
গ্রেট তাহিতির পূর্ব-উপকূলে তখন আত্তাই-এর বাস। একদিন সন্ধ্যাবেলা ঘোড়ায় চেপে একজন বিদেশী তার কুটিরে এসে উপস্থিত। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড চেহারা, একমাথা লম্বা লম্বা চুল, একমুখ দাড়ি, সর্বাঙ্গ ধূলায় ভরা। ঘোড়ার মুখে সাদা ফেনা। অনেকটা দৌড়ে এসেছে বোধহয়। দাড়িওয়ালা লোকটা বললে, সুন্দরী, আজ রাতটা তোমার বাসায় থাকতে দেবে?
আত্তাই-এর বয়স তখন চল্লিশের উপর। সুন্দরী সম্বোধনে সে গলে গেল। বললে, একটা রাত বই তো নয়। তা বেশ, থাক। তা তুমি কে? কোথা থেকে আসছ?
লোকটা বললে, আমি বিদেশী। জাহাজের খালাসী ছিলাম। তোমাদের দেশটা ভাল লেগে গেল। তাই এখানেই রয়ে গেছি।
-কি কর তুমি?
ছবি আঁকি আর বাঁশী বাজাই।
আত্তাই অবাক হয়ে যায়। লোকটা তার ঘোড়ার পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখে।
–তা এখন ঘোড়ায় চেপে কোথায় চলেছ?
লোকটা হাসতে হাসতে বলে, রাজপুত্রেরা ঘোড়ায় চেপে কোথায় যায়? রাজকন্যার সন্ধানে। অনেক বয়স হয়ে গেছে তো। তাই আমি বউ খুঁজতে বেরিয়েছি।
আত্তাই বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। লোকটা নিঃসন্দেহে বিদেশী। চেহারাটাই তার প্রমাণ। তাছাড়া কথা বলছে ভাঙা ভাঙা তাহিতিতে। আহা বেচারি। এত বয়সেও বউ যোগাড় করতে পারেনি। বললে, –তা বউ খুঁজতে এত ঘুরে মরছ কেন? আমার একটা মেয়ে আছে। তাকেই বিয়ে কর না।
লোকটা হা-হা করে হেসে উঠল। খড়ের বিছানায় সে তার কম্বলটা বিছিয়ে শোবার উপক্রম করছিল। বললে, –তোমার মেয়ে? আমার বয়স কত জান? তুমি বিয়ে করতে রাজী হলে না হয় ভেবে দেখা যেত। তুমি সুন্দর দেখতে
আত্তাই লজ্জা পেল না। বললে, না গো, আমার মরদ আছে। তা আমার মেয়েও বেশ সুন্দরী।
বটে বটে! কই, ডাক দেখি তোমার মেয়েকে!
আত্তাই তার মেয়েকে নিয়ে এল। বছর চোদ্দ বয়স। ডাগর দুটি চোখ মেলে সে অদ্ভুতদর্শন আগন্তুককে দেখতে থাকে। চোদ্দ বছর বয়স হলে কি হবে, মেয়েটি বাড়ন্ত গড়নের। বিষুব অঞ্চলের প্রখর রৌদ্রে চৌদ্দটি বসন্তেই কিশোরী মেয়েকে এনে দেয়। নারীত্বের মহিমা। লোকটা আপনমনে নিজের ভাষায় কি যেন বললে। ভাষাটা অজানা। আত্তাই বলে, কি বলছ?
বলছি তোমার মেয়েটি খাসা। তোমার নাম কি গো মেয়ে?
–য়ামায়া।
লোকটা য়ামায়াকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখল। তাহিতি দ্বীপের যাবতীয় পলিনেশিয়ান মেয়ের মতই নাকটি চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু, গভীর কালো দুটি ব্যঞ্জনাময় চোখে অবাক চাহনি। কটিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত পিঙ্গল চুল, মসৃণ কোমল গাত্রচর্ম, সুশ্রোণী। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ, যৌবনের যুগ্ম পূর্ণকুম্ভ প্রমাণ দেয় মেয়েটি কিশোরী নয়। বন্যমার্জারির মত এস্তা।
লোকটা বললে, আমাকে ভয় করছে?
মাথা নেড়ে মেয়েটি বলে, না!
আমাকে বিয়ে করবে?
য়ামায়া মাথা নেড়ে সায় দেয়।
-আমাকে ফেলে পালাবে না তো?
না।
লোকটা আত্তাইকে বললে, কনে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ও কি এই বুড়ো বরকে বরাবর বরদাস্ত করতে পারবে? জোয়ান তাহিতির ছেলে ইশারায় ওকে ডাক দিলেই আমাকে ছেড়ে পালাবে।
আত্তাই বলে, –আমার মেয়ে তেমন নয় গো। আর তোমাকে ও সহ্য করতে পারবে কিনা সেটা আজ রাতেই পরখ করে দেখতে পার। যদি তোমার ওকে পছন্দ না হয়, অথবা ও তোমাকে সইতে না পারে তবে বিয়ে কর না।
লোকটা বোধহয় তাহিতিতে নতুন এসেছে। এমন সহজ হিসাবটা বুঝতে তার বেশ সময় লাগল। শেষমেষ সে রাজী হয়ে যায়। আত্তাই বলে, –তোমার নাম কি গো? কি বলে ডাকব?
–আমার নাম পল গগ্যা।
রাত্রে ওরা তিনজনে একসঙ্গে খেল। আত্তাই-এর মরদ কোথায় যেন গেছে। সে বেচারি পাশের ঘরে একাই শুতে গেল। য়ামায়া কাজকর্ম সেরে যখন শুতে এল লোকটা তখন বিছানা পেতে বসে বাঁশী বাজাচ্ছে। য়ামায়া অবাক হয়ে গেল সে বাঁশী শুনে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকটা বললে, বউ তার পছন্দ হয়েছে। য়ামায়াও বললে, বর তার মনমতো হয়েছে। ব্যস! পরদিনই বউ নিয়ে লোকটা মারকুয়েশা দ্বীপের দিকে চলে গেছে। তারপর আত্তাই আর জানে না।
মারকুয়েশাস্ একটি দ্বীপ নয়, দ্বীপাবলী; কিন্তু প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী অত সহজে হতাশ হবার পাত্র নন। একটি জেলে-ডিঙি ভাড়া করে তিনি চলে এলেন ঐ দ্বীপে। প্রফেসর প্রথমেই এসেছিলেন ডমেনিক দ্বীপে। এবার আর খোঁজ পেতে অত দেরী হল না। শুনলেন, ঐ দ্বীপের বৃহত্তম গ্রাম আটুয়ানাতে গগ্যা একটা পাতায় ছাওয়া কুটির তৈরী করে তার বউ নিয়ে বাস করত, কিন্তু বছর ছয়েকের মধ্যেই একবার প্রবল সাইক্লোনে ওর বাড়িটি ভেঙে যায়। ঐ সময় তার উপর পুলিসের অত্যাচার হয়। তিন মাসের জন্য জেল খাটতে হয় তাকে। অপরাধ–তাহিতির Le Sourire নামে একটি স্থানীয় পত্রিকায় সে একটি প্রবন্ধ লিখেছিল ঔপনিবেশিক শাসকের দল স্থানীয় তাহিতি দ্বীপবাসীর উপর যে অত্যাচার করে তার প্রতিবাদ করে। জেল থেকে বেরিয়ে গগ্যা দেখে প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ুতে তার বাড়ি ভেঙে গেছে, অথচ গাছতলায় অপেক্ষা করে বসে আছে তার বিয়ে না করা বউ য়ামায়া। গগ্যা নাকি ঐ অরণ্যচারিণীর হাত ধরে আরও গভীর অরণ্যে চলে যায়। কোথায়, তা কেউ জানে না।
চারিদিকে বিষুব-অঞ্চলের ঘন জঙ্গল। সমুদ্র-খাড়ি, পাহাড় আর অরণ্যদূরে দূরে গ্রাম্য জনপদ। সেখানে যারা বাস করে তারা কেউ ইংরাজি জানে না। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী এমন বিজন অরণ্যে কেমন করে খুঁজে বার করবেন সেই বিদেশীকে–যার নামটুকু মাত্র জানা আছে! সে কোন্ দেশের মানুষ তা পর্যন্ত জানা নেই। তবু তীক্ষ্ণবুদ্ধি পণ্ডিত মানুষ। দু-দিক থেকে অনুসন্ধান চালালেন। গগ্যার একটা দৈহিক বর্ণনা পাওয়া গেছে তার শাশুড়ীর কাছ থেকে দৈত্যের মত প্রকাণ্ড শরীর, একমাথা কাঁচাপাকা চুল, একবুক দাড়ি। প্রফেসর প্রথমেই বাজারে গিয়ে রঙ-তুলি ক্যানভাসের খোঁজ করলেন। তাহিতিতে বসে কারও ছবি আঁকবার বাসনা হলে সে কোথায় তা সংগ্রহ করতে পারে? নিজেই বের হলেন তার খোঁজে। মাতালকে যদি খুঁজে বার করতে চাওসব কটা শুড়িখানায় তালাস কর। এদিক থেকে সহজেই সন্ধান পাওয়া গেল। শহরে একটি মাত্র দোকান আছে যেখানে রঙ-তুলি পাওয়া যেতে পারে। দোকানদার স্বীকার করলা, পল গগ্যা নামে একজন বিদেশী লোক তার কাছ থেকে আঁকার সরঞ্জাম এককালে কিনত বটে। সাত-আট বছদ্র আগে। লোকটার সঙ্গে তার আলাপও হয়েছিল। কী একটা প্রবন্ধ লেখার অপরাধে তার জেল হয়ে যায়। জেল থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যেন চলে যায়। এর বেশি সে কিছু জানে না।
–লোকটাকে শেষ কবে দেখেছিলেন?
-ঐ যে বললাম, বছর সাত-আট আগে। সে যখন আটুয়ানা ছেড়ে চলে যায় লোকটা আমার দোকানে এসেছিল কিছু রঙ-তুলি কিনতে। আর কাগজ। ক্যানভাসও চেয়েছিল, তা আমার কাছে ছিল না। মনে আছে, লোকটা আমাকে বলেছিলাম নগদে দিতে পারছি না, খানকতক ছবি রেখে যাচ্ছি। তা আমি রাজী হয়ে যাই।
কই কই, দেখি সেই ছবি?
না, ছবিগুলি আমার কাছে নেই। লোকটা রঙের দাম যখন মিটিয়ে দিতে এল না তখন আমি সেগুলি বিক্রি করে দিয়েছিলাম–
কাকে?
কাকে তা কি আর মনে আছে?
প্রফেসর তার অ্যাটাচি-কেস খুলে একটি মার্কিন আর্ট-ম্যাগাজিন বার করে বলেন, — দেখুন তো, এই ছবিগুলি কি?
দোকানদার অবাক হয়ে যায়। বলে, কী আশ্চর্য! হ্যাঁ, এই ছবিগুলিই তো বটে!
ম্যাকগ্রেগরী বলেন, আমি ঐ লোকটার সন্ধানে আমেরিকা থেকে এসেছি। আপনি কি আর কিছুই মনে করতে পারেন না তার সম্বন্ধে? আর কোন ক্লর সন্ধান দিতে পারেন না?
দোকানদার ভদ্রলোক শিক্ষিত। দ্রুতগতিতে সে প্রবন্ধের পাতা উল্টে যায়। বলে, — আশ্চর্য! উনি যে এমন প্রতিভাধর শিল্পী তা আদৌ ভাবতে পারিনি আমি! আচ্ছা, দাঁড়ান।
অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলেন, হ্যাঁ, তার সম্বন্ধে আর একটি কথা আমার মনে পড়ছে।
কী? ..
যাবার দিনে উনি বলেছিলেন, মাস কয়েক পরে এসে খবর নিয়ে যাব ছবিগুলো বিক্রি হল কিনা।
কিন্তু তা তিনি আসেননি?
না আসেননি; কিন্তু আমার মনে পড়ছে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম–আপনি কি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছেন। উনি জবাবে বলেন, হ্যাঁ, আরও গভীর অরণ্যে। আর কিছু মনে পড়ছে না।
দ্বিতীয়ত উনি খোঁজ করলেন স্থানীয় ডাকঘরে। পোস্টমাস্টার মশাই নামটা শুনে, বলেন, না, পল গগ্যা নামের কোন লোক এ দ্বীপের ত্রিসীমানায় বাস করে না। অন্তত ঐ নামে কোন চিঠি তাঁর ডাকঘরে পনের বিশ বছরের ভিতরে আসেনি। তারপর হঠাৎ কি খেয়াল হওয়াতে বলেন, দাঁড়ান প্রফেসার! কী নাম বললেন? পল গগ্যা? গগন পল নয় তো?
-কেন, গগন পল নামে কাউকে চেনেন?
পোস্টমাস্টার মশাই তার বাক্স থেকে একটি জীর্ণ পোস্টকার্ড বার করে বলেন, দেখুন তো এই লোক কিনা?
প্রফেসর গভীর মনোযোগ দিয়ে পোস্টকার্ডখানা লক্ষ্য করে দেখেন। পেনসিলে লেখা চিঠিকিছুই পড়া যায় না। অন্ততঃ ভাষাটা যে ইংরাজি নয় এটুকু বোঝা যায়। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী প্রাচ্যশিল্পী-বিশারদাঁ। সংস্কৃত ও পালি ভাষা জানেন, ব্রাহ্মী ও মাগধী হরফ চিনতে পারেন। তিনি এটুকু বুঝতে পারেন ভাষাটা ভারতীয়। সংস্কৃত অথবা পালির অপভ্রংশ–অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের নয়, আর্যাবর্তের ভাষা। ঠিকানাটা অবশ্য ইংরাজি ভাষায় লেখা। সেটা কালিতে লেখা এবং স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। পত্রলেখকের নাম গগন পাল, প্রাপকের নাম শান্তিরাণী পাল। ঠিকানা–পল্টন বাজার, ঢাকা, ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের অনেকগুলি ডাকঘরের ছাপের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে পোস্টকার্ডখানি আবার প্রেরকের কাছে ফেরত এসেছিল। ঠিকানা ভুল, প্রাপককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহিতি ডাকঘরে পোস্টমাস্টার মশাই আবার এদিকে প্রেরককে খুঁজে পাননি। ফলে দীর্ঘদিন সেটি পড়ে আছে ঐ বাক্সে।
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী অনেকক্ষণ সেই পোস্টকার্ডখানি হাতে নিয়ে নির্বাক বসে থাকেন। কে এই পল গগ্যা অথবা গগন পাল? কোন্ দেশের লোক? ভারতীয়? কী সম্পর্ক ছিল ঐ লোকটার অজ্ঞাত শান্তি পালের সঙ্গে? দুজনেরই উপাধি পাল-ওরা। স্বামী-স্ত্রীও হতে পারে। প্রফেসর জানতেন ঢাকা একটি শহরের নাম। পূর্ব-পাকিস্তানের। রাজধানী। সেটা ভারতবর্ষে নয়। সে খবরটা জানে না এই গগন পাল। হয়তো ভারতবর্ষে অথবা পাকিস্তানে সে কখনও যায়নি। ঢাকা আগে ছিল ভারতবর্ষে, বর্তমানে পাকিস্তানে। এমনও হতে পারে ঐ লোকটা এই অরণ্যে বাস করতে করতে সংবাদই পায়নি যে, ভারতবর্ষ ইতিমধ্যে স্বাধীন হয়েছে। সে খবর রাখে না–ঢাকা বর্তমানে ভারতবর্ষে নয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ধরে নিতে হবে গগন পাল আর শান্তি পাল স্বামী-স্ত্রী নয়। গগন পাল ভারতীয়ই নয়। কারণ লোকটা শিক্ষিত, সংবাদপত্রে ফরাসী ভাষায় প্রবন্ধ লিখবার মত ক্ষমতা তার আছে। এমন একজন শিক্ষিত মানুষ খবরই রাখবে না যে, তার মাতৃভূমি দুশো বছর পরাধীনতার পর স্বাধীন হয়ে গেছে? বিশেষ যদি তার স্ত্রী। সেখানেই থাকে? গোয়েন্দা কাহিনীর মত কোন সমাধানই মনঃপুত হচ্ছিল না। আর আশ্চর্য বুদ্ধি ভারতীয় ডাকঘরের কর্মকর্তাদের। তারা চিঠিখানি দূর তাহিতিতে প্রেরকের কাছে ফেরত না পাঠিয়ে পাশের বাড়ি ঢাকায় পাঠালে প্রাপক হয়তো সময়ে চিঠিখানি পেতেন। অন্ততঃ তখনও চিঠির পাঠোদ্ধার করা চলত।
মোট কথা লোকটা শিক্ষিত। ফ্রেঞ্চ জানত। Le Sourire পত্রিকার প্রবন্ধটাই তার প্রমাণ। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে কলম ধরে জেল খেটেছিল শিল্পী মানুষটা। প্রবন্ধটা সংগ্রহ করে পড়লেন। বেশ জোরালো ভাষা। প্রবন্ধ লেখক ফ্রেঞ্চ ভাষাটা ভালই। জানেন। আদালতে খোঁজ নিতে গিয়ে আবার কতগুলো অদ্ভুত সংবাদ পাওয়া গেল। আদালতের নথী বলছে, লোকটা নিজেকে নির্দোষ বলেছিল, এবং বলেছিল সে ফরাসী ভাষা আদৌ জানে না! তার তরফে কোন উকিল ছিল না, সে নিজেই সওয়াল করে। স্থানীয় বার অ্যাসোসিয়েশনের একজন নবীন উকিল-কামিল দমিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে আসামীর তরফে মামলা পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আসামী তাঁকে। ওকালতনামা দিতে অস্বীকার করেন। বিচারে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে যায়।
অধ্যাপক অতঃপর কামিল দমিয়ে, অ্যাডভোকেটের সঙ্গে দেখা করলেন।
কামিল দমিয়ে জাতে ফরাসী। উদারনৈতিক তরুণ উকিল। বললেন, হ্যাঁ, পল গগ্যাকে আমি চিনতাম। সাত-আট বছর আগে। সত্যি কথা, তিনি ফরাসী জানেন না। তিনি কোন্ দেশের লোক তা জানা নেই। Le Sourireতে প্রকাশিত প্রবন্ধটা গগ্যারই লেখা, তবে তিনি ইংরাজিতে লিখেছিলেন। অন্য কেউ সেটা অনুবাদ করে দেন। কে যে। অনুবাদ করেন তা গগ্যা স্বীকার করেননি। গগ্যা ছিলেন ডাকাবুকো ধরনের দুঃসাহসী লোক। আদালতে তিনি বলেছিলেন তিনি ফরাসী ভাষা জানেন না–সেকথা বিচারক বিশ্বাসও করেছিলেন। কিন্তু গগ্যা বলেন প্রবন্ধের বক্তব্য তারই, তিনি ইংরাজিতে ওটা লিখেছিলেন। কে অনুবাদ করেছেন এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে অস্বীকার করেন।
–অদ্ভুত লোক তো! বলেন ম্যাকগ্রেগরী।
দমিয়ে বলেন, অতি অদ্ভুত লোক। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি যে বিনা পারিশ্রমিকে তার কেস হাতে নিতে চেয়েছিলাম এজন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমি জিজ্ঞাসা করি–আপনি কি এ দ্বীপের দেশীয় আন্দোলনে যোগ দিতে চান? জবাবে গগ্যা বলেছিলেন না। আমি এই তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে গভীরতর অরণ্যে চলে যাচ্ছি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেখানে। কী করবেন আপনি? জবাবে উনি বলেছিলেন–ছবি আঁকব। বুঝলেন প্রফেসর, জিনিসটা আমার কাছে একেবারে উদ্ভট লেগেছিল–শিক্ষিত সভ্য একজন মানুষ এভাবে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একটা পলিনেশিয়ান মেয়েকে নিয়ে অমন জঙ্গলে গিয়ে কেমন করে বাস করতে পারে আমি তো ভেবে পাইনি। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম–How could you explain yourself? আপনি এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কি ব্যাখ্যা দেবেন? লোকটা জবাবে কি বললেন জানেন?
-কি?
বললে, A mans work is the explanation of that man–একটা মানুষের সৃষ্টিই তার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা!
প্রফেসর মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এর চেয়ে খাঁটি কথা হয় না!
মোটকথা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি ম্যাকগ্রেগরী–তবু শিল্পীর কোন সন্ধান পেলেন না। শিল্পীর সৃষ্টির মাধ্যমেও যে কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাবেন তারও সুযোগ হল না। গগন পালের হাতের কোন কাজ দেখতে পেলেন না কোথাও। বাধ্য হয়ে ব্যর্থমনোরথ ম্যাকগ্রেগরী ফিরে এলেন মারকুয়েশাস্ দ্বীপ থেকে মূল দ্বীপেতাহিতির রাজধানী পাপীতিতে।
নিতান্ত ঘটনাচক্রই বলতে হবে, –জাহাজ ছাড়ার দিন-ছয়েক আগে ওঁর সামান্য জ্বর হল। তাহিতিতে ম্যালেরিয়া আছে; অধ্যাপক তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের শরণ নিলেন। ওঁর হোটেলের অনতিদূরে ডক্টর ওয়াটকিন্স-এর চেম্বারে গিয়ে হাজির হলেন এবং ঘরে ঢুকেই জ্বরের কথা ভুলে গেলেন।
হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু, স্যার?
ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর আহ্বান কানে গেল না অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীর। প্রাচীরে। বিলম্বিত একটি তৈলচিত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, ডক্টর! এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন? এ কার আঁকা?
শিল্পীকে চিনবেন না। খ্যাতনামা কেউ নয়। আমার একজন পেসেন্ট ছিলেন।
–ছিলেন? এখন তিনি কোথায়? কি নাম ওঁর?
–ওঁর নাম পল গগ্যা। মারা গেছেন।
অধ্যাপক নির্নিমেষ নয়নে দেখছিলেন তৈলচিত্রটি। একটি নিসর্গ দৃশ্য। পশ্চাৎপটে কালো মেঘ আর পাহাড়। দু-একটি নারকেল গাছ, একটি কুঁড়ে ঘর। চওড়া একটা পথ এঁকেবেঁকে সরু হতে হতে পাহাড়ের কোলে হারিয়ে গেছে। টুপি-মাথায়, বাঁকাঁধে একজন স্থানীয় মালবাহী মেহনতি মানুষ দর্শকের দিকে পিছন ফিরে চলেছে ঐ অরণ্যমুখো। দর্শকের দিকে সে পিছন ফিরেছে; তার একলা চলার পথে শুধু অরণ্য আর পর্বত-সামনে সূরযকরোজ্জ্বল এক উপত্যকা। কাঁধের ভারে লোকটা নুয়ে পড়েছে।
-আপনার কি কোন অসুখ করেছে? ডক্টর ওয়াটকিন্স-এর প্রশ্ন।
–তা করেছে। জ্বর। কিন্তু সে কথা পরে। আপনি ঐ চিত্রকর সম্বন্ধে যা জানেন তাই আগে বলুন। তাতেই হয়তো আমার জ্বর ছেড়ে যাবে।
অধ্যাপক তার তাহিতি আগমনের কারণ অতঃপর জানান। ডক্টর ওয়াটকিন্স শুধু কুইনাইন দিলেন না, –পল গগ্যার শেষ জীবনের একটি বিচিত্র কাহিনীর সুগার-কোটও দিলেন। অদ্ভুত সে কাহিনীঃ
ডক্টর ওয়াটকিন্স পাপীতিতে প্র্যাকটিস করছেন আজ ত্রিশ বছর। একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি আছে তার। তাতেই রুগী দেখতে যান। বছর পাঁচেক আগে একবার মারকুয়েশাস্ দ্বীপ থেকে তার ডাক এল। টারাভাও গ্রামের মোড়লনীর অসুখ। সমুদ্র পার হয়ে ঐ। গ্রামে যেতে হয়। ওরা একটা এক-ঘোড়ায় টানা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। নৌকো ছেড়ে সাত-আট মাইল ঘোড়ার গাড়িতে পাড়ি দিয়ে ডাক্তার সাহেব টারাভাও গ্রামে এসে। পৌঁছলেন। ডাক্তার সাহেব ভাল কথক। টারাভাও গ্রামের বৃদ্ধা মোড়লনীর স্থলকায় দেহ, তার প্রকাণ্ড খাটখানা, তার পাতায় ছাওয়া ঘর, চুরুট খাওয়ার নিখুঁত বর্ণনা দিলেন। রোগী দেখা শেষ হলে ওরা ডাক্তার সাহেবকে পাশের ঘরে নিয়ে এল। সেখানে তার আহারের আয়োজন হয়েছে। সাহেব মানুষের জন্য একটা চারপায়া টেবিল আর টুলের ব্যবস্থাও ওরা করেছিল–না হলে ওরা সচরাচর মাটিতে বসেই খায়। কাঁচা মাছ, কঁকড়া কঁচকলা ভাজা, ঝলসানো মুরগী আর নারকেলের একটা তরকারী। এলাহী আয়োজন। ডাক্তার সাহেব আহার করতে করতেই লক্ষ্য করেন বছর সাতেকের একটা ছোট মেয়ে বারে বারে সে ঘরে ঢুকতে চাইছে, আর সকলে তাকে বারে বারে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট মেয়েটির মাজায় বাঁধা ন্যাকড়াটা শতছিন্ন এবং ধূলি-ধূসরিত। মাথার চুলগুলো জটা পাকানো। ও কি ভিখারীর মেয়ে? ভিক্ষা চাইছে? আহারান্তে গাড়িতে চড়বার সময়ও ডাক্তার সাহবের নজর পড়ল মেয়েটির দিকে। ডাগর চোখ মেলে সে তাকিয়ে আছে ওঁর দিকে। সবার ধমকে আর কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। ডাক্তার সাহেব পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে ওকে দিতে গেলেন, মেয়েটি নিল না। দু হাতে মুখ ঢেকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইল।
–ও কার মেয়ে? কি চায়? জানতে চাইলেন উনি।
ভীড়ের মধ্যে কে যেন বলে, –ও হচ্ছে দাড়িওয়ালা পাহাড়িয়ার মেয়ে। ভিখারী নয়।
দাড়িওয়ালা পাহাড়িয়া? সে আবার কে? ওরা বুঝিয়ে বলে, –উই পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের ভিতর বাস করে একজন দাড়িওয়ালা বিদেশী। আর থাকে তার বউ। মেয়েটি ওদেরই। ডাক্তার সাহেব গ্রামে এসেছেন শুনে ও তাঁকে ডাকতে এসেছে। ওর বাপ, ঐ বিদেশীটার কি অসুখ করেছে বলছে। কিন্তু মুশকিল এই যে, ওদের ঐ কুঁড়েঘরে যেতে হলে পাকদণ্ডী পথ দিয়ে হাঁটাপথে যেতে হবে। গাড়ি যাবে না। তাও পাক্কা তিন মাইল। ডাক্তার সাহেব জানতে চান বিদেশীর পরিচয়, কোন্ দেশের লোক, কি নাম। ওরা বললে, তা ওরা জানে না। লোকটা কোন কাজকাম করে না। স্রেফ ছবি এঁকে দিন কাটায়। আর বাঁশী বাজায়। তবে খায় কি?কি আবার খাবে? জঙ্গলের ফলমূল, নারকেল; আর ওর বৌ য়ামায়া একপাল মুরগী পুষেছে। শহরে এসে ডিম, মুরগী বেচে যা পায় তাই খায়। গাঁয়ের লোকেরা ঐ বিদেশীর উপর চটা। লোকটা জেলখাটা দাগী আসামী। সেটা বড় অপরাধ নয়–পুলিসের হাতে পড়লে জেল তো খাটতেই হবে, সে কথা নয়, কিন্তু লোকটা অমন ছন্নছাড়া কেন? না ধরে মাছ, না করে চাষবাস, না পারে নারকেল গাছে উঠতে, না যায় সাহেবের খামারে খাটতে।
ছোট মেয়েটা তখনও পিছন ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ডাক্তার সাহেবের শুধু কৌতূহলই নয়, করুণাও হল। একটা বিদেশী অসুস্থ মানুষকে না-দেখে ফিরে যেতে তার মন সরল না। বলেন, চল্ রে, আমি যাব তোর বাপকে দেখতে।
মেয়েটি তুরুক করে এদিকে ফেরে। খুশিতে ওর জলভরা দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে।
পাক্কা তিন মাইল চড়াই ঠেঙিয়ে ডাক্তার সাহেবের মেজাজ খিঁচড়ে গেল। দেহও ক্লান্ত। পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি পাতায়-ছাওয়া কুটির। পথের উপরেই বিদেশীর স্ত্রী–ঐ য়ামায়া দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা মুখকাটা ডাব। মেয়েটিকে বুদ্ধিমতী বলতে হবে। এতটা পথ চড়াই ভেঙে এসে ডাক্তার সাহেব যে প্রথমেই জল চাইবেন তা ঠিকই আন্দাজ করেছে সে।
ডাবটা নিঃশেষ করে ডক্টর ওয়াটকিন্স বলেন, কোথায় তোর মরদ?
মেয়েটি তার ডান হাতটা বাড়িয়ে পাতায়-ছাওয়া কুটিরখানি দেখিয়ে দিল। দরজাটা খোলাই আছে। দাওয়ার উপর বস্ত্র দেড়েকের একটা উলঙ্গ শিশু খেলা করছে।
কি হয়েছে রে তোর মরদের? কি করছে সে? ঘুমোচ্ছে?
না, ও ছবি আঁকছে।
–ছবি আঁকছে! বলিস কি রে? তাহলে পাহাড়ের মাথায় আমাকে হটিয়ে আনলি কেন? সে গাঁয়ে যেতে পারত না?
য়ামায়া একথার জবাব দিল না। মুখ নিচু করে নখ খুঁটতে থাকে। বাচ্চাটাকে তুলে নিল কোলে। তারপর এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। ঘরে ঢোকে না কিন্তু। দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল ওঁকে ভিতরে যেতে। ওর ব্যবহারে একটু অবাক হলেন ডাক্তার সাহেব। এগিয়ে এলেন তিনি ঘরের ভিতর। সেখানে একজন বিদেশী লোক মাটিতে বসে একখানা ছবি আঁকছে আপন মনে। রঙ-তুলি চারদিকে ছড়ানো। লোকটা কোন্ দেশের তা বোঝা যায় না। একমাথা রুক্ষ চুল, একমুখ দাড়ি-ঊধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পদশব্দে সে পিছনে ফিরে তাকায়। ডাক্তার সাহেবকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে বিস্ময়ের চেয়ে বিরক্তিই বেশি। ওর ভ্রতে জেগেছে একটা কুঞ্চন। হঠাৎ রুখে ওঠে জঙলি লোকটা। বলে, কি চাই?
ডাক্তার সাহেব এক কথায় জবাব দিতে পারলেন না। বলতে পারলেন না আমি কিছু চাই না, তোমার স্ত্রী আমাকে ডেকে এনেছে। অভিজ্ঞ ডাক্তার ওর মুখে শুধু বিরক্তির ব্যঞ্জনাই দেখেননি–দেখতে পেয়েছিলেন গভীরতর আর কিছু। গ্রহণের আগে সূর্যের উপর যেমন একটা ধূসর বর্ণের পেনাস্ত্রীয় স্নান ছায়াপাত হয়, তেমনি ঐ দৈত্যের মত মানুষটার মুখে কোন্ অলক্ষ্য মহাকাল এক করাল ছায়াপাত করেছেন। ওঁর পা দুটি যেন মাটিতে প্রোথিত হয়ে গেল। মানুষটার অভদ্র ব্যবহারে রাগ করতে ভুলে গেলেন। তিনি। নিরতিশয় বেদনা আর করুণায় তার অন্তঃকরণ আপ্লুত হয়ে গেল। বললেন, আপনার নাম কি? আপনি কোন্ দেশের লোক?
–সে খোঁজে আপনার কি প্রয়োজন? বডি-ওয়ারেন্ট আছে?
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি ভুল বুঝছেন!
কিছু ভুল বুঝিনি। আমি তো দুনিয়াকে ছেড়ে এসেছি। তবু
-আপনি অহেতুক রাগ করছেন। আমি পুলিসের লোক নই। আমার নাম ডক্টর ইভান ওয়াটকিন্স। আমি পাপীতিতে প্র্যাকটিস করি। টারাভাওয়ে রুগী দেখতে এসেছিলাম। আপনার স্ত্রী য়ামায়া আমাকে ডেকে এনেছে। আপনি নাকি অসুস্থ।
য়ামায়া একটা গাড়োল। আমার কিছু হয়নি। একটু জ্বর মত হয়েছিল, আর গা হাত পায়ে ব্যথা আছে। ও কিছু নয়, দুদিনেই সেরে যাবে। ভাল কথা, আপনার ব্যাগে কুইনিন আছে?
-আপনি আমার আগের প্রশ্নের জবাব দিন। আপনার পরিচয়?
আমার নাম গগন পাল। আমি ভারতীয়। কুইনিন আছে আপনার ব্যাগে?
–আছে। কিন্তু আপনার ম্যালেরিয়া হয়নি। কুইনিন খেতে হবে না আপনাকে।
—ও!
আপনি ঐ আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখুন দেখি—
–কেন?
ডাক্তার সাহেব জবাব দেন না। লোকটা একটু অবাক হয়ে যায়। তার দৃষ্টি চলে যায় ঘরের ওপ্রান্তে। সেখানে পড়ে ছিল কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা সস্তা হাত-আয়না আর কাকুই। য়ামায়ার প্রসাধনের সরঞ্জাম হয়তো। বারকতক পর্যায়ক্রমে ডাক্তার সাহেব এবং ঐ আয়নাটার দিকে তাকিয়ে লোকটা সেদিকে এগিয়ে যায়। তুলে নেয় হাত-আয়নাটা। সরে আসে জানালার কাছে, আলোর দিকে। নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে থাকে নিজ প্রতিবিম্বের দিকে।
আয়নায় কিছু দেখতে পাচ্ছেন?
জঙলি মানুষটা আজ দশ বছর চুল আঁচড়ায়নি, দাড়ি কামায়নি। কত যুগ-যুগান্তর পরে সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল তা তার মনেই পড়ে না। সত্যি কথা বলতে গেলে তাকে স্বীকার করতে হত্যা, আমার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে।
–তা সে বলল না কিন্তু। বললে, কী আবার দেখব? নিজের মুখটাই দেখছি।
কিছু নজরে পড়ছে না? একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন না? নাকটা ফোলা ফোলা, গাল দুটো লাল লাল–মুখখানা কেশর ফোলানো সিংহের মত মনে হচ্ছে না কি?
গগন জবাব দেয় না। একদৃষ্টে নিজ প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু যেন দিশেহারা।
মিস্টার পাল, আমি দুঃখিত–আপনার একটা দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে!
দুরারোগ্য ব্যাধি?…আমার?…কি হয়েছে আমার?
দুটি মাত্র অক্ষর। কিন্তু কথাটা আটকে গেল অভিজ্ঞ ডাক্তার সাহেবের মুখে।
ডক্টর ওয়াটকিন্স অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীকে বলেন, –প্রফেসর, ত্রিশ বছর প্র্যাকটিস করছি আমি। দুরারোগ্য ব্যাধি যেখানে ধরা পড়েছে আমার সন্ধানী দৃষ্টিতে সেখানে আমি অকপটে সেকথা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করিনি কখনও। এই আমার নিয়তি। লোকে বলে, আমি কর্কশভাষী। কি করব বলুন? কিন্তু এ জাতীয় মর্মান্তিক দুসংবাদ আমি সচরাচর রোগীকে বলি না; বলি তার নিকট আত্মীয়কে। যেখানে নিকট আত্মীয় কেউ নেই, সেখানে বাধ্য হয়েই কথাটা রোগীকে বলতে হয়েছে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তার অনিবার্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছি যাতে হতভাগ্য মানুষটা সেটা সহ্য করার কিছু সময় পায়। কিন্তু এবার আমি ছিলাম নিতান্ত নিরুপায়।
জঙলি মানুষটা আয়নাখানা মাটিতে নামিয়ে রাখে। এগিয়ে আসে সামনে। দু হাত মাজায় রেখে ডাক্তার সাহেবের মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে, বলুন! কী হয়েছে আমার?
এবার চুপ করে থাকা চলে না। দুটি মাত্র অক্ষরে মৃত্যুদণ্ডজ্ঞা ঘোষণা করলেন ডাক্তার ওয়াটকিন্সঃ
কুষ্ঠ!
আশ্চর্য লোকটার মনের জোর! এত বড় বজ্রাঘাত সে গ্রহণ করল অবিচলিত চিত্তে। কেঁপে উঠল না থরথর করে, বসে পড়ল না মেঝেতে; মুখের একটি পেশীও কুঞ্চিত হল না। মিনিটখানেক নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে বললে, মায়া জানে?
এ রোগ এ দ্বীপে এত ব্যাপক যে, ওর বুঝতে অসুবিধা হয়নি বোধহয়। না হলে আপনার সামান্য জ্বর দেখে সে এভাবে আমাকে ডেকে আনত না।
গগন পাল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। দেখে, দাওয়ায় ও-প্রান্তে বসে আছে। য়ামায়া। দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর নগ্ন বুকে বাচ্চাটা লেটে আছে। বড় মেয়েটা দূরের আমগাছের আড়ালে আত্মগোপন করেছে-তার চোখে আতঙ্ক। গগন হাত বাড়িয়ে বাঁশের খুঁটিটা ধরে। ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে মুখ তুলে অস্ফুটে কি যেন স্বগতোক্তি করে। দুর্বোধ্য ভাষায়। তার মাতৃভাষায়। ডাক্তার ওয়াটকিন্স জানেন না–সে কী বলেছিল, কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল। অনুমান করতে পারেন না–সেটা খেদোক্তি, অভিশাপ, না প্রার্থনা।
..কী বলেছিল গগন? কাকে বলেছিল? তাহিতির রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের দিকে মুখ তুলে কার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার? পুরনো পল্টনের মেয়েদের স্কুলের কোন দিদিমিণি? তার আঁকড়াচুলো ফ্রক-পরা মেয়েটা, না কচি শালের চারার মত তার দাদাকে? অথবা হয়তো মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মনে পড়ে গিয়েছিল আর একটি শ্যামাঙ্গী মেয়েকে সুলেখা দেবনাথকে। ও কি দুনিয়াকে ডেকে বলেছিল–তোমরা দেখে যাও, তোমাদের সব অভিশাপ আমি মাথা পেতে নিয়েছি! ঈশ্বরকে অভিশাপ। দিয়েছিল কি? অথবা হয়তো জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে সে তার অনবদ্য উদাসীনতায় ঝট দিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিল ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর ঐ ছেঁদো মৃত্যুদণ্ডাদেশ; বলেছিল, ঝাঁট দে!
ঘুরে দাঁড়ায়। দেখে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছেন ডাক্তার সাহেব।
–ডক্টর! কতদিনের মেয়াদ আমার?
-তা কে বলতে পারে? কখনও কখনও দীর্ঘ বিশ বছরও এ রোগের মানুষকে ভুগতে দেখেছি। দু-এক বছরের মধ্যে যার যন্ত্রণার অবসান হয় সেই তো ভাগ্যবান। মৃত্যুই এরোগে একমাত্র আশীর্বাদ!
গগন পাল ধীরে ধীরে ফিরে যায় তার কুটিরে। বেরিয়ে আসে পরক্ষণেই। হাতে তার সদ্য সমাপ্ত একটি অয়েলকালার। সেটা বাড়িয়ে ধরে আগন্তুকের দিকে বলে, — ডক্টর, ভিজিট দেবার ক্ষমতা য়ামায়ার নেই। তুমি এই ছবিটা নিয়ে যাও বরং।
ডাক্তার সাহেব বলেন, ধন্যবাদ। ভিজিট তোমাকে দিতে হবে না।
হঠাৎ চটে গেল জঙলি লোকটা। গম্ভীর স্বরে বললে, –ডক্টর! আমার স্ত্রী গরীব। কিন্তু গরীবের আত্মসম্মানজ্ঞান থাকবে না, এমন কোন কথা নেই। এটা ধর। আর তুমি যা ভাবছ তা ঠিক নয়। এখানা যত্ন করে রেখে দিও। একদিন এ ছবি তোমার ভিজিটের শতগুণ তোমাকে ফেরত দেবে। কথাটা আজ তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, নয়?
বিশ্বাস সত্যিই হয়নি ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর। তাহিতির একটি নিসর্গচিত্র। পাহাড় আর গাছ, পিছন-ফেরা বাঁক কাঁধে একটি মাত্র মেহনতি মানুষ। ছবির ফ্রেমটাও নিতান্ত বাজে কাঠের। বিশ্বাস হবার কথাও নয়। তবু একটি মৃত্যুপথযাত্রী চিত্রকরের শেষ অভিমানটাকে আঘাত করতে মন সরেনি। হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছিলেন ছবিটা। ও পাশে য়ামায়া তখন ফুলে ফুলে কাঁদছে। গগন তাকে ধমকের সুরে সান্ত্বনা দেয়, আরে বুদ্বুর মত কাঁদছিস কেন রে পাগলি?
তাহিতি দ্বীপে কুষ্ঠরোগোক্রান্তদের পৃথকীকরণের কোন ব্যবস্থা নেই।
হঠাৎ অশ্রুআর্দ্র মুখ তুলে য়ামায়া বলে ওঠে, ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে না?
গগন বলে, -না। তার আগেই আমি জঙ্গলে চলে যাব।
ডাক্তার সাহেব বলেন, জঙ্গলে মানে? এটাই তো জঙ্গল।
-না। আরও গভীর জঙ্গল আছে পাহাড়ের ওপাশে। সেখানে আদিবাসীরাও যায় । সেখানে এই ন্যাকড়াখানাও মাজায় জড়াবার দরকার হবে না। মিশে যাব অরণ্যে।
ডাক্তার সাহেব মনের চোখ দিয়ে দেখতে পান দৃশ্যটা। সভ্য জগতের একটা মানুষ আদিম অরণ্যে সম্পূর্ণ অরণ্যচারী হয়ে গেছে! বেবুন- সিম্পাঞ্জি-গেরিলার স্বগোত্র সে। একমাথা চুল, একবুক দাড়ি নিয়ে এই বিংশ শতাব্দীতে তাহিতি দ্বীপের কোন অনাবিষ্কৃত। পর্বতকরে আবার একটা উলঙ্গ নিও-হোমোস্যাপিয়ান নূতন আলতামেরার সৃষ্টি করছে!
য়ামায়া উঠে আসে। ককালে নিয়েছে উলঙ্গ বাচ্চাটাকে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। শুধু। মাতৃত্বের অমৃতরসে নয়, উত্তেজনাতেই যেন ফুলে উঠেছে তার বুক। কটিদেশে একমাত্র লাজবস্ত্র। দুচোখে আর তার জল নেই, আছে আগুন। বললে, না! তোকে আমি একলা যেতে দেব না! আমরা সবাই যাব!
কী পাগলি রে তুই!–ওকে ধমক দেয় গগ্যা। বলে, –তোর তো আর অসুখ করেনি। তুই পাপীতিতে ফিরে যা। তোর আবার বিয়ে হবে, নতুন মরদ পাবি, সংসার পাবি। ছেলেমেয়েরা রইল। তুই কেন মরতে যাবি আমার সঙ্গে? কী এমন বয়স তোর?
হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল য়ামায়া। বাঁ কাঁকালে শিশু–ডান হাত দিয়ে সে জড়িয়ে ধরল প্রকাণ্ড দৈত্যটার হাঁটু; আর্ত চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল বনভূমি—
-না, না, না! তুই আমার মরদ! তোকে ছেড়ে আমি বাঁচব না!
পাথরে গড়া পল গগ্যার অক্ষিকোটরেও তাহলে জল থাকে! অর্ধশতাব্দীকাল দুনিয়াদারি করে গগন পাল নিজেই কি সেটা জানতে পেরেছিল কোনদিন? ফোলা ফোলা কুষ্ঠগ্রস্ত লাল গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ল য়ামায়ার রুক্ষ চুলে। দু চোখে জল, তবু অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল পাগল শিল্পী। সভ্যজগতের একমাত্র সাক্ষীটাকে দেখে ইংরাজীতে বললে, -মেয়েমানুষ জাতটাই এমনি নেমকহারাম! সমাজ আজও ওদের শেখাতে পারেনি সভ্যতার মূল মন্ত্রটা–চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! স্রেফ জোঁকের মত! যাকে ধরে তাকে ছাড়ে না! জোঁকের তবু নুন আছে; এরা নিমককেও ভয় পায় না, এমনই নেমকহারাম!
য়ামায়া বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারে না? সচকিত হয়ে মুখ তুলে বলে, -কী কী বলছিস তুই ডাক্তার সাবকে? আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
না রে পাগলি! তাই কি পারি! আমি যে তোর মরদ!
ডাক্তার ওয়াটকিন্স প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এ-রোগে রোগীকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াটা প্রহসনের মত শোনাবে। তাই নীরবেই বিদায় নিলেন। পাকদণ্ডী পথে ফিরে চললেন ছবিটা নিয়ে। পাপীতিতে ফিরে এলেন পরদিন সন্ধ্যায়। ক্রমে ভুলে গেলেন দ্বীপান্তরের একটি জঙলি কুষ্ঠরোগীর কথা।
প্রায় দু বছর পরে আবার তার কথা মনে পড়ল তার। কারণ বছর দুয়েক পরে আবার তিনি রুগী দেখতে এসেছিলেন টারাভাওতে–সেই মোড়লনীকে দেখতে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কুষ্ঠরোগীটার কথা। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, পাহাড়ের মাথায় সেই দাড়িওয়ালা জঙলি বিদেশীটা বেঁচে আছে?
–আছে বোধহয়।
বোধহয়। ওরা ঠিক জানে না। এ শুধু অনুমান। বছরখানেক আগেও তাকে দেখা গেছে। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড একটা মানুষ নির্জন পাহাড়-পর্বতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাথা রুক্ষ চুল, একবুক কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখখানা কেশর-ফোলানো সিংহের মত থমথমে। খালি গা, খালি পা। ছবি আঁকত সে পাহাড়ের ধারে, -ঝরনার কিনারে কখনও দূর সমুদ্রের বেলাভূমিতে। কখনও মধ্য রাত্রে ভেসে আসত একটা বাঁশের বাঁশীর সুর। গ্রামের দিকে ভুলেও আসত না। আসত য়ামায়া, গভীর রাত্রে চুপিচুপি। গ্রামের এক দোকানদারের কাছ থেকে সওদা করে নিয়ে যেত। বিনিময় প্রথা। নিয়ে আসত মুরগী, ডিম, নারকেল, কলার কাঁদি। নিয়ে যেত নুন, মোমবাতী, দেশলাই, কাপড়। দিনের বেলা আসত না। গ্রামের মানুষ সহ্য করত না তাকে। ও যে ছোঁয়াচে রুগীর রোগজীবাণু সর্বাঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর ছেলেমেয়েরাও আসে না গ্রামে। তারপর আর বছরখানেক লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবু সে মরেনি বোধহয়। কারণ তাহলে য়ামায়া ফিরে আসত। য়ামায়া যে বেঁচে আছে এটুকু ওরা জানে, তাকে চোখে না দেখলেও। বাঁশীর শব্দটাও বন্ধ হয়েছে।
এবার কেউ ওঁকে যেতে বলেনি। তবু ডাক্তার ওয়াটকিন্স একটা মলম, কিছু বিস্কুট, গুঁড়ো দুধ, দেশলাই আর নুন নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলে স্থির করলেন। কেউ পথ দেখিয়ে সঙ্গে যেতে রাজী হল না। ও পাহাড়টা নিষিদ্ধ-অঞ্চল বলে মেনে নিয়েছে ওরা। অগত্যা একাই রওনা হলেন তিনি।
বনপথটা মুছে এসেছে। পায়ে-চলা পথে পায়ের দাগ আজকাল পড়ে না। দু পাশের আদিম অরণ্য তার সাবেক অধিকার ফিরে পাওয়ার উৎসাহে ঝুঁকে পড়েছে। পথে অসংখ্য ডাব পড়ে আছে; কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যায়নি। গতবার এত বন্য জন্তুও দেখেননি। এবার খরগোশ আর বন্য মোরগদের দেখলেন নির্ভয়ে পথের উপর চলাফেরা করতে। পায়ে-চলা পথটা ক্রমশঃ মিলিয়ে এসেছে–বু ক্ষীণ একটা চিহ্ন আজও আছে। তাই শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারলেন পাহাড়ের মাথায় সেই পাতায় ছাওয়া কুটিরের সামনে।
কাত হয়ে পড়েছে ঘরটা। সংস্কারের অভাবে। য়ামায়া কুটিরের সামনে একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নারকেলের ছোবড়া ছাড়াচ্ছিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ সে। পদশব্দে ব্ৰস্তা হরিণীর মত ঘরের ভিতর ছুটে পালিয়ে যায়। ডাক্তার-সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। একটু পরে ফিরে আসে য়ামায়া, তার মাজায় জড়ানো একখণ্ড কাপড়। কাকালে সেই শিশুটি। বছর দুই বড় হয়েছে ইতিমধ্যে।
-তোমার মরদকে দেখতে এসেছি. সে কোথায়?
–আচ্ছা, ওকে খবর দিই।
য়ামায়া ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। ডাক্তার সাহেবও ওর পিছন পিছন যাচ্ছিলেন, হাত নেড়ে বারণ করল মেয়েটি। দ্বারের বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়েন উনি। খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছে একটা দুর্গন্ধ। এ গন্ধ ডাক্তার সাহেবের পরিচিত। গলিত কুষ্ঠের পুঁজের গন্ধ। ঘরের ভিতরে যে কথোপকথন হল তা সবই স্বকর্ণে শুনলেন উনি। গগনের কণ্ঠস্বর বিকৃত। ডাক্তার সাহেব বুঝতে পারেন ওর গলার স্বরনালীও এতদিনে মহামারীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত। য়ামায়া বেরিয়ে আসে। বলে, –ও দেখা করবে না। তুই চলে যা।
একথা স্বকর্ণেই শুনেছিলেন ডাক্তার সাহেব। তবু তিনি পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু প্রভুভক্ত কুকুরীর মতই য়ামায়া দরজা আড়াল করে দাঁড়াল। ভিতরে যেতে দিল না ওঁকে। ডাক্তার সাহেব হতাশায় কাঁধ ঝাঁকালেন। উপহারের পুটলিটা দাওয়ায় রেখে পিছন ফিরলেন। অহেতুক এতটা পথ হেঁটে এসেছেন তিনি। তারপর য়ামায়াকে বলেন, তোমার মেয়েকে ডাক, আমাকে ফিরে যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিক।
-সে নেই।
নির্বিকার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দূরের আমগাছ তলাটা দেখিয়ে দিল। সদ্য কবর দেওয়া হয়েছে কাউকে, মাটিটা উঁচু হয়ে আছে। সহানুভূতিতে ডাক্তার সাহেবের মনটা ভারী হয়ে আসে। বলেন, এখানে তুমি কেন পড়ে আছ? তুমি পাপীতিতে ফিরে যাও। ও বাঁচবে না। ওকে মরতে দাও।
আয়ত দুটি চোখ মেলে য়ামায়া একবার তাকায়। সে রীতিমত রোগা হয়ে গেছে। চোখ দুটি বসে গেছে। চোয়ালের হনু দুটো উঁচু হয়ে উঠেছে। আজকাল সেও বোধকরি চুল আঁচড়ায় না, মাথায় জটা হয়ে গেছে তার। বললে, –ও যে আমার মরদ!
এত দুঃখেও হাসি পেল ডাক্তার সাহেবের। ঠিকই, বলেছিল সেদিন ঐ জঙলি মানুষটা! মেয়েমানুষ জাতটাই নিমকহারাম! যুগ-যুগান্তর ধরে তালিম দিয়েও সভ্য সমাজ ওদের শেখাতে পারেনি মানব-জীবনের সেই মূল মন্ত্রটা–চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!
–আবার যদি কখনও এদিকে আসি, তোমাদের জন্য কি নিয়ে আসব?
–কিছু রঙ। ।
রঙ? ও কি এখনও ছবি আঁকতে পারে?
–ও তো ছবিই আঁকছে বসে। দিন-রাত ছবি আঁকে।
–ও ক্যানভাস পায় কোথায়?
না, দেওয়ালে ছবি আঁকছে এখন।
–কী রঙ চাই, ওকে জিজ্ঞাসা করে এস।
য়ামায়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, –যে কোন রঙ। ও তো চোখে দেখে না। দুটি চোখই ওর নষ্ট হয়ে গেছে।
এ আবার কী কথা? যে চোখে দেখতে পায় না সে ছবি আঁকে? ডাক্তার সাহেব আর কথা বাড়াননি। য়ামায়া ওঁকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেল। লোকালয়ের কাছাকাছি এসে বললে, –এবার আমি যাই। ওরা দেখতে পেলে ইট মারবে!
আরও মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন বিলাতের ডাক এসেছে। ডাকে এক বাক্স স্যাম্পেল ওষুধ পেলেন ডাক্তার সাহেব। সদ্য আবিষ্কার। কুষ্ঠ রোগের। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল টারাভাওয়ের সেই অন্তেবাসী শিল্পীর কথা। য়ামায়া কিছু রঙ চেয়েছিল, তাও তো দিয়ে আসা হয়নি। এবার কেউ তাকে ডাকেনি। তবু অন্তরে য়ামায়ার আহ্বান শুনতে পেলেন যেন। ওষুধের প্যাকেট, কিছু খাবার আর কয়েক টিউব রঙ নিয়ে উনি স্বতঃপ্রবত্ত হয়ে আবার এলেন টারাভাওয়ে।
টারাভাওয়ের লোকেরা বললে, য়ামায়া এখনও ফিরে আসেনি। এবারও একাই তাকে সেই পাকদণ্ডীর পথ বেয়ে পাহাড়ে উঠতে হল। এবার আদিম অরণ্য আরও নির্ভয়ে অগ্রসর হয়ে এসেছে পথ-চলতি পাকদণ্ডী সড়কের উপর। সেটার চিহ্নমাত্র নেই। তবু দুবার এ পথে এসেছেন। অনেকটা চেনা হয়ে গেছে। অবশেষে পাহাড়ের মাথায় সেই পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরখানির সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবার য়ামায়ার সাড়া পাওয়া গেল না। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু অজানা পাখির ডাক, আর বন-ঝিঁঝির একটানা একটা শব্দ। ডাক্তার ওয়াটকিন্স পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে যান ঘরের দিকে। হাট করে ভোলা আছে দরজাটা। ঘরটা আরও বেঁকে গেছে। বারান্দায় ভাঙা একটা মাটির কলসী। জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। য়ামায়ার নাম ধরে ডাকলেন বার দুয়েক। প্রতিধ্বনিই ফিরে এল শুধু। খোলা দরজা দিয়ে একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। নাকে রুমালটা চেপে ধরেন তিনি। তারপর ভিতরে ঢুকে পড়েন।
ভিতরটা রীতিমত অন্ধকার। দরজাটা অত্যন্ত ছোট–তা দিয়ে অল্প আলো আসছে, জানলাটা বন্ধ। প্রখর সূর্যালোক থেকে ও-ঘরে ঢুকে কিছুই দেখতে পেলেন না উনি। তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেল। সান্ধ্য-আকাশের তারার মত এখানে ওখানে একটি একটি করে ফুটে উঠল কয়েকটি দৃশ্য। কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল ওঁর। এ কী! উনি তো কোন ঘরের ভিতর নেই–তার চারদিক ঘিরে শুধু গভীর অরণ্য! গাছ গাছ আর গাছ! পাহাড় ঝরনা-ঘন বেতের ট্রপিক্যাল জঙ্গল! দূরে দূরে কিছু নারকেল গাছ, আম গাছ–আর বাদবাকি সবই অচেনা গাছ। কিন্তু জঙ্গল তো নির্জন নয়। ঐ তো কতকগুলি সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানুষ!
–প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী, আমি ছবির কিছুই বুঝি না। ও ছবিরও কিছু বুঝতে পারলাম না। মেঝে থেকে সিলিঙ পর্যন্ত চারদিকের দেওয়ালে একতিল কোথাও ফাঁকা নেই, এটুকু দেখলাম শুধু। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। একটা অতিকায় আদিম জন্তু যেন তার আঁশওয়ালা লেজ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আমি সিসটিন চ্যাপেলে মিকেলাঞ্জেলোর লাস্ট-জাজমেন্টও দেখেছি কিন্তু সেখানে মনকে তৈরী করেই নিয়ে গিয়েছিলাম–আমি জানতাম মিকেলাঞ্জেলো মহান শিল্পী, আমি জানতাম, সিটিন চ্যাপেল বিশ্বের এক বিস্ময়! কিন্তু এ কী! তাহিতি দ্বীপের এক দূরপ্রান্তে পর্ণকুটীরে এ জিনিস যে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। আমার কেমন মনে হল জানেন? একবার ইংল্যাণ্ডে ডার্টমুরে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। নীর অন্ধকার রাত্রি। শুধু আকাশ ভরা তারা ছিল। আমি হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছিলাম। মনে হচ্ছিল–এ পথ অসীমে গিয়ে মিশেছে, এ রাত্রিও বোধহয় নিষ্প্রভাত! বিশ্ব চরাচরে আমি একা, নিতান্ত একা! হঠাৎ আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে হাত বুলিয়ে দেখি যাতে হোঁচট খেয়েছি সেটা একটা কবর। আমার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। তারার আলোয় হঠাৎ নজর হল, পথ ভুলে আমি একটা গোরস্থানে এসে পৌঁছেছি! আমার চারদিকে শুধু কবর, কবর আর কবর! সারি সারি ক্রুশচিহ্ন! তারা হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছিল! কারা যেন উইলো পাতার নিঃসরণের সঙ্গে তাল রেখে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমাক বলতে চাইছিল তাদের অতীত ইতিহাসের কথা যখন তারা রক্ত মাংসের জীব ছিল! অথচ কবরগুলো বোবা! ভয়ে আমি সেবার আর্তনাদ করে উঠেছিলাম!…এখানেও ঐ প্রাচীরচিত্রের উলঙ্গ নরনারীর দল যেন আমাকে কী কথা বলতে চায়, বলতে পারছে না-বলছে, অথচ আমি বুঝতে পারছি না; এখানেও তেমনি কে যেন আমার কাঁধের উপর উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলল! কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। আমি চিৎকার করতে গেলাম, কিন্তু স্বর ফুটল না আমার কণ্ঠে! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি য়ামায়া!
ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম অন্ধকূপ থেকে। হ্যাঁ, য়ামায়াই। বারান্দার খুঁটি ধরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে প্রেতাত্মার মত।
–য়ামায়া! য়ামায়া!
মেয়েটা মুখ তুলে তাকায়। মেয়ে নয়, তার কঙ্কাল! তার প্রেতাত্মা!
তোমার মরদ কোথায়?
একই ভঙ্গিতে তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে এবারেও সে দেখিয়ে দিল দূরের আমগাছটা। আগের বার যে সমাধিস্থূপটা দেখেছিলাম তারই অদূরে পড়ে আছে গগন পালের মৃতদেহ। গলিত কুষ্ঠের অন্তিম অবশেষ! দুর্গন্ধটা তারই। গাছের ডালে বসে আছে কটা শকুন। গাছের আড়ালে ওগুলো শেয়াল অথবা নেকড়ে!..
গগ্যা মারা গিয়েছিল দুদিন আগে। য়ামায়া তাকে টানতে টানতে ঐ গাছতলা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। একটা গর্ত খুঁড়বার চেষ্টাও সে করেছে দুদিন ধরে। কিন্তু অনাহারে সে দুর্বল। একা হাতে অতবড় দানবটাকে সে মাটির বুকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। ঐ শকুন আর শেয়ালের হাত থেকে তার মরদকে রক্ষা করতেই বেচারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ডাক্তার ওয়াটকিন্স ওর হাত থেকে কোদালটা তুলে নিলেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সমাধিস্থ করলেন জঙলি মানুষটাকে। খাদ্যদ্রব্য কিছু ছিল না। ভাগ্যে উনি কিছু বিস্কুট আর পাঁউরুটি এনেছিলেন। কতদিনের অনাহার কে জানে? য়ামায়া দুর্ভিক্ষপীড়িতের মত খেল। ডাবের জল খেল। একটু সুস্থ হয়ে বসল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।
-ওর বাড়ির ঠিকানা জান?
য়ামায়া তার রুক্ষ চুলের মাথাটা ঝাঁকালো।
-তোমার ছোট ছেলেটাকে দেখছি না! সে কই?
এবারও একইভাবে মাথা ঝাঁকায়, অর্থাৎ সেটাও গেছে!
ডাক্তার সাহেব বলেন, ভেবে আর কি হবে য়ামায়া! তুমি আমার সঙ্গে চল, তোমাকে গ্রামে পৌঁছে দিয়ে যাব।
আবার মাথাটা ঝাঁকায় বলে, -ঐ ঘরটা–
-ঘরটা?
তাই তো। ঘরখানার কথা মনে পড়ল এতক্ষণে। ওটার কথা মনেই ছিল না। ঘরটায় কি যেন অদ্ভুত সব ছবি আঁকা আছে না? কি ছবি? মনে পড়ছে না। অথচ ঘন্টাখানেক আগে ওটার ভিতর অদ্ভুতদর্শন কি যেন দেখেছিলেন মনে পড়ছে। ভয় পেয়েছিলেন। এবার য়ামায়াকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করেন সেই পাতায় ছাওয়া ঘরখানায়। দেওয়ালের ছবিগুলো ভাল করে দেখতে।
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী আর কৌতূহল দমন করতে পারেন না। বলেন, চিত্রের বিষয়বস্তুটা ঠিক কি ছিল বলুন তো? কী বলতে চেয়েছেন শিল্পী।
তা আমি কি জানি? কিছুই বোধগম্য হয়নি আমার। একটা আদিম অরণ্যকে দেখেছিলাম, এটুকু মাত্র মনে আছে। সৃষ্টির আদিতে আদম আর ঈভ যে অরণ্যে বাস করত সেই হারিয়ে যাওয়া বনভূমিই যেন এতদিনে প্রাণ পেয়ে উঠেছে। অদ্ভুত সুন্দর সে বনভূমি বীভৎস আর ভয়াবহ। প্রকৃতির অন্তর্লীন আত্মাকেই উদঘাটিত করেছেন শিল্পী। গাছপালা, পাহাড় আর নদী–সবই যেন জীবন্ত। সবই যেন প্রাণরসে ভরপুর প্রতিটি পার্চিং স্টোন! আর সেই আদিম অরণ্যে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে কতকগুলো অপার্থিব অদ্ভুত জীব। তারা বিশ কোটি বছর আগেকার জুরাসিক যুগের অতিকায় টিরানোসরাসের স্বগোত্র হতে পারে, আবার অতি আধুনিক মানব-মনের অবচেতন-অরণ্যের বাসনা কামনাও হতে পারে! আর ছিল মানুষ–হ্যাঁ, পুরুষ-স্ত্রী-শিশু বৃদ্ধ-পূৰ্ণযৌবনা নারী! সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের কেউ কেউ আবার টেরোডেটিলের মত আকাশে ভেসে। চলেছে। তাদের সত্তা আছে, ওজন নেই। ওরা মানুষের মত দেখতে, অথচ ঠিক মানুষ। নয়। যেন অস্থি-মজ্জা-মেদ-রক্ত-মাংস দিয়ে ওদের গড়েননি সৃষ্টিকর্তা–গড়েছেন ঈর্ষা প্রেম-দ্বন্দ্ব-করুণা আর জিঘাংসা দিয়ে। তারা মানুষখেকো বাঘের মত নিষ্ঠুর অথচ দেহাতীত প্রেমের মত স্বর্গীয়! আমি আপনাকে বোধ হয় ঠিক বোঝাতে পারছি না প্রফেসর। তবে এটুকু বলব, আপনি নিজেও সে ছবি দেখলে চমকে উঠতেন। কারণ আপনার মনে হত ওগুলো কোন অলৌকিক জীবের চিত্র নয়। মনে হত ওগুলো আদৌ কোন ছবি নয়–দেওয়াল-জোড়া ওটা একটা আয়না; কারণ আপনার প্রতিবিম্বই দেখতে পাচ্ছেন আপনি! ও ছবি আপনারই!
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী উৎসাহে উঠে দাঁড়ান। বলেন, –ডক্টর! আমাকে নিয়ে চলুন সেখানে। ও-ছবি নিয়ে আসা যাবে না । কিন্তু আমার কাছে কালার্ড ফিল্ম আছে। প্রতিটি দেওয়ালের
বাধা দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন, আমি দুঃখিত প্রফেসর। সে ছবি নেই।
–নেই! কেন? কি হল ঘরখানার?
ডাক্তার সাহেব তার শেষ দিনের অভিজ্ঞতা বলতে থাকেন। য়ামায়াকে তিনি সভ্য দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন সঙ্গে করে। মেয়েটি রাজী হয়নি। বলেছিল, সে পরে আসবে। তার বুঝি কী একটা কাজ ওখানে বাকি আছে। কী কাজ, জানতে চেয়েছিলেন ডাক্তার-সাহেব। জবাবে য়ামায়া বলেছিল–ঘরখানা জ্বালিয়ে দিতে হবে!
মৃত্যুর পূর্বে গগন নাকি য়ামায়াকে নির্দেশ দিয়ে যায়–তার জিনিস কাপড়, রঙ, তুলি, ছবি সব কিছু ঐ ঘরখানায় ভরে যেন তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কুষ্ঠব্যাধির বীজের যেন কোন অবশেষ না থাকে। ডাক্তার সাহেব য়ামায়াকে বারণ করলেন। ছবির কিছু না বুঝলেও উনি এটুকু বুঝেছিলেন যে, এ এক অদ্ভুত সৃষ্টি। কিছু ফটো তুলে রাখার কথা তার মনে হয়েছিল। সেকথা তিনি জানিয়েছিলেন জঙলি মেয়েটিকে। বলেছিলেন আমি নিজে ডাক্তার, এ রোগের সংক্রামতার কথা আমার চেয়ে কেউ বেশি বোঝে না। আমি বারণ করছি। দু-চারদিন পরেই আমি ফিরে আসব, দুদশখানা ফটো নেব। তারপর আমি নিজেই জ্বালিয়ে দিয়ে যাব।
য়ামায়া চুপ করে অবসন্নের মতো বসে রইল। হা-না কিছুই বলল না। অগত্যা একাই ফিরে চললেন ডাক্তার সাহেব। আধখানা পথও আসেননি–হঠাৎ দেখতে পেলেন পাহাড়ের মাথায় আগুন লেগেছে। আবার চড়াই ভেঙে উপরে উঠে গেলেন। দেখেন, প্রভুভক্ত কুকুরীর মত য়ামায়া তার মরদের শেষ আদেশ পালন করেছে নিঃশব্দে। পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরখানা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত!
…একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরীর।
ডাক্তার ওয়াটকিন্স তার দীর্ঘ কাহিনী শেষ করে একটা চুরুট ধরান। বলেন, –শিল্পীর ছবিখানা আমি আমার চেম্বারেই টাঙিয়ে রেখেছি। আচ্ছা, প্রফেসর! গগন পাল কি সত্যিই একজন প্রতিভাধর শিল্পী? এ ছবিখানি আমি যদি বিক্রি করতে চাই তার খদ্দের হবে?
প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরীও তার পাইপ ধরাতে ব্যস্ত ছিলেন। বলেন, -হবে। খদ্দের আপনার সামনে উপিস্থত। ছবিখানা আমি কিনব। কত দাম নেবেন?
ডাক্তার সাহেব ইতস্ততঃ করে বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, ছবির কী রকম দাম হয় আমার কোন ধারণা নেই। আপনি যা ন্যায্য মনে করুন, দিন।
–বেশ। তাই দিচ্ছি আমি। একটু হিসাব কষি তাহলে। আগে বলুন, আপনি সারাদিনের জন্য দূর গ্রামে রুগী দেখতে গেলে কত ভিজিট নেন?
–একথা কেন?
বলুনই না!
দশ ডলার।
অধ্যাপক তার বুক-পকেট থেকে ভারি ওয়ালেটটা বার করে বলেন, আপনি তিনবার শিল্পী গগন পালকে দেখতে গিয়েছিলেন। সুতরাং ত্রিশ ডলার আপনার প্রাপ্য। আপনি নিজেই বলেছেন যে, শিল্পী আপনাকে বলেছিলেন–গরীবের যে আত্মসম্মান জ্ঞান থাকবে না এমন কোন কথা নেই
–আপনি কি পুরো ত্রিশ ডলার দাম দিতে চান? ঐ সামান্য ছবিটার?
না। তাহলে শিল্পী গগন পাল হবেন মিথ্যাবাদী, আর আমি জোচ্চোর।
তার মানে?
–শিল্পী আপনাকে আরও বলেছিলেন–এ ছবি ভবিষ্যতে আপনার ভিজিটের শতগুণ আপনাকে দেবে। এই নিন–তিন হাজার ডলার ।
ডক্টর ওয়াটকিন্স জবাবে কি বলেছিলেন তা আর বলেননি অধ্যাপক। দ্বৈপায়ন-দাদুকে শুধু বলেছিলেন, ডক্টর লাহিড়ী! আপনি জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বাড়ি-গাড়ি-পশার প্রতিপত্তি সবই হয়েছে। তবু কিছু মনে করবেন না–আজ থেকে একশো বছর পরে কেউ যদি আপনার নাম উচ্চারণ করে তবে তা করবে এজন্য যে, আপনি গগন পাল আর চন্দ্রভান গর্গের বন্ধু ছিলেন!
কথাটা জীবনে এই প্রথম শুনছেন না ডক্টর দ্বৈপায়ন লাহিড়ী। তফাত এই যে, প্রথমবার সেটা পাগলের প্রলাপ মনে হয়েছিল–এবার আর তা হল না!