আবার যদি ইচ্ছা কর – ৪

০৪.

কিন্তু চন্দ্রভান? সে কি সত্যিই সন্ন্যাসী হয়ে গেল নাকি?

চন্দ্রভানের কাহিনী বলতে গেলে একটু আগে থেকে শুরু করতে হবে।

জমিদার বাড়ির ছেলে চন্দ্রভান একটু অদ্ভুত ধরনের ছেলে ব্রাবরই। ওর চরিত্রের মূলে ছিল। একটা দুরন্ত অভিমান। এ অভিমানটা ঠিক কার প্রতি তা বলে বোঝানো যাবে না। তবে আঘাতটা কেমন করে এসেছিল তার একটা হদিস পাওয়া যায়।

আট বছর বয়সে মাতৃবিয়োগে ওর বালক মনে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছিল। কিন্তু তার চেয়েও আঘাত পেয়েছিল কাকা কাকীমার ব্যবহারে। সম্পত্তির এই দুই ভাগীদারকে তারা বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাদের সোনার চাঁদ ছেলেদের প্রাপ্যে ভাগ বসাতেই আছে ওরা দুজন। কাকা কাকীমার উদাসীনতার আইসবার্গ আর পাঁচজনের নজরে পড়ে নি, কিন্তু চন্দ্রভান তার শিশুমন নিয়েই বুঝতে পেরেছিল ঐ নিরুত্তাপ ভাসমান আইসবার্গের নিচে নিমজ্জিত হয়ে আছে বহুগুণ ঘৃণা আর বিদ্বেষ! শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে নিল চন্দ্রভান, আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল মা-হারা ভাই সূরযকে। প্রাণধারণের জৈবিক বৃত্তিতেই বোধকরি শিশু বুঝতে পারে কোথায় পাওয়া যাবে স্নেহ-ভালবাসা। সূরযভান নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল তার দাদাকে। দাদাই তাকে জামা পরিয়ে দেয়, জুতো পরিয়ে দেয়–দাদাই তাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ায় বনে বাদাড়ে। অগ্নিভান কি বুঝলেন তা তিনিই জানেন। দু-ভাইকে সরিয়ে ফেললেন জমিদার বাড়ি থেকে। কলকাতার বাড়িতে এনে রাখলেন ওদের, গৃহ-শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। ফলে, যে বয়সে মায়ের স্নেহ আর বাপের ভালবাসা শিশুরা জীবনরস সংগ্রহ করে সেই বয়সে ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল। মজা হচ্ছে এই যে, চার পাঁচ বছরের ভিতরেই ওদের ভূমিকাটা গেল বদলে। সূরযভান বয়সে ছোট হলেও সাধারণ বুদ্ধি তার বেশী। সেই হয়ে উঠল চন্দ্রভানের অভিভাবক। দাদার জামাকাপড়ের হিসাব পর্যন্ত রাখত সে।

অগ্নিভান সূরযকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু কিছুতেই রাজী করাতে পারে নি সূরযভানকে। দাদাকে ছেড়ে সে থাকবে না। শেষ পর্যন্ত অগ্নিভান মাসান্তে ওদের নামে টাকা পাঠানো ছাড়া ওদের সম্পর্কই ভুলে যেতে বসেছিল।

হঠাৎ নাটকীয়ভাবে একটা কাণ্ড ঘটে গেল একদিন। একদিন নয়, সে একটা চিহ্নিত তারিখ ইতিহাসের পাতায়। উনিশ-শ পাঁচের সেই ষোলোই অক্টোবর-ত্রিশে আশ্বিন। বড়লাট লর্ড কার্জনের হুকুমজারী করেছেন, ঐদিন বাঙলা মায়ের অঙ্গ কেটে দুখানা করা হবে। পূব বাঙলা আর আসামের লাট হবেন ব্যামফিল্ড ফুলার। কলকাতা টাউন হলে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে বাঙলার সুধীজন জানালেন প্রতিবাদ। তারপর ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মৈমনসিঙ, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি বাঙলার এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে ক্রমাগত প্রতিবাদ সভা হল। ডন পত্রিকায় সতীশচন্দ্র তীব্র প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু ক্ষমতামদমত্ত শাসকশ্রেণী কর্ণপাত করল না। তারা অচল রইল তাদের সিদ্ধান্তে ঐ ত্রিশে আশ্বিনই বাঙলাকে কেটে দু টুকরো করা হবে।

তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ল সমস্ত দেশ। এ-পার বাঙলা ও-পার বাঙলা। বাঙলার কবি বললেন–এ দিন রাখীবন্ধন উৎসব হবে। রামেন্দ্রসুন্দর বললেন–ঐ সঙ্গে অরন্ধন। সমস্ত দিনের মত কর্মসূচী তৈরী হয়ে গেল। আর্যমিশনেও এসে লাগল ঢেউ। চন্দ্রভান অবশ্য তখন ঐ স্কুলের ছাত্র নয়। পাস করে ইতিমধ্যে মিশন কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সূরয তখনও ঐ স্কুলের ছাত্র। চন্দ্রভান, সূরয, গগন, দ্বৈপায়ন আর সুশীল ভোর বেলায় এসে জড়ো হল স্কুলের মাঠে। সমস্ত দিনের মত ওদের কর্মসূচী তৈরী হয়ে আছে। সূর্যোদয়ের আগে থেকেই দলে দলে সারা কলকাতার মানুষ চলেছে। গঙ্গার ধারে। ওরাও কজন গিয়ে স্নান করল গঙ্গায়। তারপর দল বেঁধে সবাই চলল বিডন উদ্যানে আর সেন্ট্রাল কলেজ প্রাঙ্গণে। সেখানে হল রাখীবন্ধন উৎসব।

সারা শহরে সেদিন অরন্ধন। কোন বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে নি। দোকান-পাট হাট বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ। পথে পাল্কি, ঘোড়ার গাড়ি বা গোরুর গাড়ি চলছে না। শুধু পদাতিক। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। শুধু বন্দেমাতরম্। গান গাইছে কোন কোন শোভাযাত্রী ছেলের দল—

বাঙলার মাটি, বাঙলার জল, বাঙলার বায়ু, বাঙলার ফল,
–পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।

সে কী গান! কে বাঁধল গো এমন গান? কে আবার? জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কবি রবীন্দ্রনাথ। আবার কেউ গাইছে–ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টুটবে।

গানের গলা চার বন্ধুর কারও নেই–একমাত্র ব্যতিক্রম গগন পাল। সুরেলা কণ্ঠ তার। ওদের সকলের হয়ে একাই সে সারাদিন গান গাইল।

এ ওর হাতে রাখী বেঁধে দেয়–ও এর হাতে।

বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে ওরা কবন্ধু চলে এল আপার-সার্কুলার রোডে। এখানে বঙ্গ-ভবন স্থাপনের উদ্দেশ্যে সভা হওয়ার কথা। সভাপতিত্ব করতে এলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা আনন্দমোহন বসু। তিনি তখন রোগশয্যায়। রোশয্যায় নয়, আসলে মৃত্যুশয্যায়; কারণ এই রোগভোগের অল্পকাল পরেই তিনি অমর ধামে চলে যান। আরামকেদারায় করে সভাপতিকে সভামঞ্চে নিয়ে আসা হল। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ভাইস-চ্যান্সেলার স্যার গুরুদাস সভাপতি বরণ করলেন। সভায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। অন্তত পঞ্চাশ হাজার লোক সভাপতি বরণের সঙ্গে সঙ্গে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিল। আনন্দমোহন রোগশয্যায়, তাই তাঁর ভাষণটি বজ্রকণ্ঠে পড়ে শোনালেন সুরেন্দ্রনাথ। অভিভাষণ পাঠের পর আনন্দমোহনের স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র পড়ে শোনানো হল। ইংরাজিতে সেটি পাঠ করলেন স্যার আশুতোষ চৌধুরী এবং বাঙলায় সেটি পাঠ করে শোনালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ গল্প থামিয়ে দ্বৈপায়ন-দাদু বলেন, সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম। আমার বয়স তখন ষোলো, রবীন্দ্রনাথের চুয়াল্লিশ।

আমি বলি-তারপর?

তারপর সন্ধ্যায় আমরা সবাই দল বেঁধে চললাম বাগবাজার স্ট্রীটে। পশুপতি বসু মশায়ের বাড়িতে। কর্মসূচী অনুসারে এখানেই স্বদেশী কাপড় তৈরী করার জন্য ভাণ্ডার খোলা হবে। আমাদের হেঁটে যেতে হয় নি। ভীড়ের চাপে আপনা থেকেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বাগবাজারে। জনসমাবেশ লক্ষাধিক হয়েছিল। সে আমলে এ একটি রেকর্ড। সভায় স্থির হল, স্বদেশী বস্ত্র তৈরীর জন্য একটি ভাণ্ডার স্থাপন করা হবে। যার পকেটে যা ছিল সবাই দান করল। আমাদের কাছে বিশেষ কিছুই ছিল না । কিন্তু চন্দ্রভানের হাতে ছিল একটি আংটি। কবছর আগে উপনয়নের সময় পেয়েছিল। হাত থেকে খুলে সেটিই সে ফেলে দিল ভিক্ষাপাত্রে।

সব মিটতে সেই যার নাম রাত দশটা।

সমস্ত দিন অভুক্ত আছি। নিরম্বু উপবাস। ক্লান্ত দেহে টলতে টলতে সবাই বাড়ি ফিরে এলাম। অন্যের কথা জানি না, আমি তো বিছানায় পড়েই মড়ার মত ঘুমিয়ে পড়ি। কদিন পরে খবর পাওয়া গেল চন্দ্রভান বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

খবরটা শুনেছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। এমন সাহস নেই যে, ওদের বাড়িতে গিয়ে যাচাই করে আসি। খবরটা জানিয়ে গেল সুশীল। ঐ সুশীল সেন।

পরদিন সকালেই নাকি চন্দ্রভান চলে এসেছিল সুশীলদের বাড়িতে। চোখ দুটো লাল, মুখখানা থমথম করছে। সুশীল অবাক হয়ে বলে-কী হয়েছে চন্দরদা? অসুখ করেছে আপনার?

চন্দ্রভান বলেছিল-সুশীল, সেদিন তুই যুবক সঙ্ঘের কথা বলছিলি। ওদের আস্তানাটি কোথায় জানিস?

–কেন জানব না? গোলদিঘির ধারে। কতবার গিয়েছি সেখানে। কেন চন্দরদা?

–তুই আমাকে সেখানে নিয়ে চল। পথে কথা হবে।

সুশীল যেমন ছিল বেরিয়ে আসে। পথে নেমে প্রশ্ন করে কি হয়েছে চন্দরদা?

–আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি সুশীল। আর ওবাড়িতে ফিরব না। তুই সেদিন বলেছিলি যুবক সঙ্ঘে অনেক ছেলে কাজ করে। ওরা থাকতে দেয়, খেতে দেয়। আমি ওদের দলে নাম লেখাব।

–সে কী? আর কোনদিন বাড়ি ফিরবেন না?

না!

 সূরয কোথায়? সে জানে?

সূরয বেঁচে আছে কিনা তাই জানি না!

 পথের মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল সুশীল। চন্দরদার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?

সমস্তটা শুনে অবশ্য বুঝতে পারে চন্দ্রভানের মস্তিষ্কবিকৃতি হয় নি আদৌ। দুরন্ত অভিমানে সে তার পরিচিত দুনিয়ার গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। গতকাল সূর্যোদয়ের আগেই দু-ভাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে–সেসব কথা তো সুশীল জানেই। সেও ছিল দলে। সারাদিন ওরা পথে পথে ঘুরেছে। বন্দেমাত্রম করেছে, গান গেয়েছে আর সভায় জয়ধ্বনি করেছে। চন্দ্রভান জানতে পারে নি, সকালের দিকেই পাগলাচণ্ডী থেকে অগ্নিভান এসেছিলেন তাঁর কলকাতার বাড়িতে। উনি বড় একটা কলকাতায় আসেন না। তবে নাকি এ বছর সরকারী খেতাব পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে–তাই কলকাতায় এসে কিছু তদবির-তদারক করে যেতে এসেছেন। ওঁদের কলকাতার বাড়িতেও অরন্ধনের ব্যবস্থা হয়েছিল। জমিদার-মশাই এসেই ব্যবস্থাটা পালটে দিলেন। সব বাজার বন্ধ। শুনে অগ্নিভান ক্ষেপেই আগুন। শেষ পর্যন্ত সরকার মশাই ফিরিঙ্গি পাড়ার হগ সাহেবের বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন কাঁচা আনাজ। উনান জ্বলেছে, খানা পাকানো হয়েছে। কিন্তু রাজপুত্রেরা কোথায়? গৃহ শিক্ষক মথুরাবাবু আমতা-আমতা করে বলেছিলেন তিনি ঠিক জানেন না। সরকার মশাইও যখন বললেন চন্দ্রভান আর সূরযভানের অবস্থান সম্বন্ধে তিনিও কোন খবর রাখেন না তখন বোমার মত ফেটে পড়েছিলেন অগ্নিভান। হুকুমজারি করেন–যেখান থেকে পার, ধরে নিয়ে এস ওদের!

সমস্ত দিন চাকর, দারোয়ানের দল সারা কলকাতা চষে বেড়িয়েছে। বিডন স্কোয়ার থেকে বাগবাজার। কিন্তু সে জনারণ্য থেকে কেমন করে খুঁজে বার করবে ওদের? একপ্রহর রাত করে দুই রাজপুত্র যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন অগ্নিভানের সমস্ত দিনের নিরুদ্ধ আক্রোশ ফেটে পড়েছিল!

সুশীল ভয়ে ভয়ে বলে–খুব মারধর করেছেন বুঝি?

না, এমন আর বেশী কি? ওঁর আক্রোশ মিটাবার আগেই নুরুল মিঞার চাবুকটা ভেঙে গেল যে!

নুরুল মিঞা ওদের ল্যাণ্ডো গাড়ির কোচমান। সুশীল তাকে চেনে। বললে–চাবুক মেরেছেন? আপনাকে?

কোঁচার খুঁটে মুখটা মুছে নিয়ে চন্দ্রভান বললেন, আমাকে নয়, সূরযকে।

আশ্চর্য শাসন-পদ্ধতি! অগ্নিভান তাঁর সমস্ত আক্রোশ মিটিয়েছেন কনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র সূরযভানের উপর। চাবুকের পর চাবুকের আঘাতে সূরযভান যখন মাটিতে লুটোপুটি খেতে খেতে আর্তনাদ করেছে–ও কাকা আর কখনও করব না, ছেড়ে দাও। তখন চন্দ্রভান দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল দর-দালানের থামের সঙ্গে। কারও সাধ্য হয় নি অগ্নিভানকে বাধা দিতে। চাবুকটা ভেঙে যাওয়ার পর অগ্নিভান একটি পদাঘাত করেছিলেন, তাতে রকের উপর থেকে সূরযভানের মূৰ্ছিত দেহটা গড়িয়ে পড়েছিল উঠানে। অগ্নিভান উঠে চলে গিয়েছিলেন দ্বিতলে। সরকার মশাই পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সূরষের অচৈতন্য দেহটা। চন্দ্রভানের বাঁধনটা খুলে দেওয়ার কথা আর কারও খেয়াল হয় নি!

যুবক সঙ্ঘের অফিস ঘরখানি অতি ছোট। দিনের বেলাতেও যেন আলো জ্বাললে সুবিধা হয়। দরজা খোলাই ছিল। সুশীল আর চন্দ্রভান ঢুকতেই এক ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। এতক্ষণ একটা হাতলহীন চেয়ারে বসে টেবিলের উপর একখানি খবরের কাগজ বিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি। গতকালকার শহর তোলপাড় করা খবরই বোধহয়। সুশীলকে দেখে বললেন–কি খবর সুশীল? এ কাকে নিয়ে এসেছ?

সুশীল বলল-ইনি আপনাদের যুবক সঙেঘর সভ্য হতে চান কদমদা। এঁর নাম চন্দ্রভান গর্গ। এ বছরই আর্যমিশন থেকে পাস দিয়েছেন। এখন কলেজে পড়ছেন।

ভদ্রলোক চন্দ্রভানের চেয়ে বছর কয়েকের বড়ই হবেন। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে কটকি চটি। কাঁধে একটা ময়লা আলোয়ান। তবু আপনি বলেই কথা বললেন চন্দ্রভানের সঙ্গে, বললেন-বসুন। আমাদের যুবক সঙেঘর নিয়মাবলী দেখেছেন? প্রতিজ্ঞাপত্র দেখেছেন?

চন্দ্রভান তক্তপোশের একপ্রান্তে বসে পড়ে। টেবিল-চেয়ার ছাড়া ঘরে ঐ একখানি তক্তপোশ পাতা। তার উপর মাদুর বিছানো। মাথার কাছে গুটানো একটা ছোট বিছানা। তালপাতার হাতপাখাও আছে একখানা। পিছনের দেওয়ালে ছত্রপতি শিবাজীর ছবি। আরও একখানা ফটো আছে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের। চন্দ্রভান বললেনা, নিয়মাবলী দেখি নি। তবে আপনাদের উদ্দেশ্যের কথা সুশীলের কাছে শুনেছি। আমি সর্বান্তঃকরণে দেশের কাজে নামতে চাই। তবে একটা কথা আমাকে আশ্রয় দিতে হবে। আমি গৃহত্যাগ করে এসেছি।

কদম দাস একটু গম্ভীর হল। বললে, আপনার নামটাই শুনেছি। আপনার পরিচয়?

চন্দ্রভান আত্মপরিচয় দিল।

কদম দাস আরও গম্ভীর হয়ে বলল-কিছু মনে করবেন না। আপনার কাকা একজন প্রভাবশালী বিশিষ্ট জমিদার। আপনাকে আশ্রয় দিতে হলে আমাকে একবার বড়দার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। বড়দা, মানে যিনি আমাদের প্রেসিডেন্ট আর কি। ব্রজরাখালবাবু। তিনি হয়তো এখনই এসে পড়বেন।

চন্দ্রভান খবরের কাগজখানা টেনে নেয়। কদম দাস সুশীলের সঙ্গে গল্প করতে থাকে। গতকালকার সভার আলোচনা। কাল নাকি বাগবাজারের মিটিঙে পঞ্চাশ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছে।

একটু পরেই এসে গেলেন ওদের সভাপতি ব্রজরাখাল রায়। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। গলাবন্ধ আলপাকার কোট আর ধুতি। পায়ে ফিতা বাঁধা জুতো। গালে কুচকুচে কালো চাপ দাড়ি। কদম দাস তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ব্রজরাখাল বসতে বসতেই প্রশ্ন করেন–আত্মোন্নতি সমিতি থেকে নিবারণ এসেছিল?

না বড়দা। তাঁর আসার কথা আছে নাকি?

হ্যাঁ। একজনকে গ্রামে পাঠাতে হবে। রেভারেণ্ড শারদাঁ একজন কর্মী চেয়েছেন

 হঠাৎ চন্দ্রভানের দিকে নজর পড়ায় বলেন–এঁকে? এঁকে তো চিনি না।

কদম দাস চন্দ্রভানের সব কথা বুঝিয়ে বলে।

উপসংহারে বলে, আমি বলেছি, বড়দা রাজী না হলে আমরা কিছুই

কথার মাঝখানেই ব্রজরাখাল বলে ওঠে–এ শুধু ঠাকুরের কৃপা। বাওয়ালীতে কাকে পাঠাব তাই ভেবে মরছি। আর এদিকে ঠাকুর তাঁর কাজ করা লোককে এখানে বসিয়ে রেখেছেন। না হে চন্দ্রভানবাবু, আর দ্বিতীয় কথা নয়। তুমি তৈরী হয়ে নাও। গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে তো?

চন্দ্রভান সবিনয়ে বললে–আমি গ্রামেরই ছেলে। নদে জেলার পাগলাচণ্ডীতে ছেলেবেলা কেটেছে আমার। কোথায় যেতে হবে?

–গ্রামটার নাম বাওয়ালী। হাঁটা পথে মাইল পনের। বজবজের দক্ষিণে। তা নৌকাতেও যেতে পার। অনেকটা পথ চলে যাবে। রাজারামপুরের ঘাটে নামলেই হবে। ওখান থেকে মাইল তিনেক যেতে হবে দক্ষিণ-পূর্বমুখো। সেখানে রেভারেণ্ড আঁরি শারদাঁকে এক ডাকে সবাই চিনবে। উনি একজন পাদরী। তিনিই লোক চেয়েছেন

চন্দ্রভান একটু ইতস্তত করে বলে-কালকেই শপথ নিলাম বিলাতী জিনিস বর্জন করব–আর আজই আপনি আমাকে একজন ইংরাজ ভদ্রলোকের কাছে চাকরি করতে যেতে বলছেন?

ব্ৰজরাখাল কোর্টের বোতামগুলি খুলতে খুলতে বলে–এটা তো বুদ্ধিমানের মত কথা হল না চন্দ্রভানবাবু। প্রথমতঃ, ইংরাজ আমাদের শত্রু নয়, ইংরাজশাসকই আমাদের শত্রু। মার্গারেট নোবলও ইংরাজ, ভুলে যেও না-স্বামীজীর দেহান্তের পর তিনিই আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। দ্বিতীয়তঃ, রেভারেণ্ড শারদাঁ ইংরাজ নন, তিনি ফরাসী। আত্মভোলা মানুষ। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। বাওয়ালীতে উনি খুব ভাল কাজ। করছেন। একটি অনাথ আশ্রম খুলেছেন, তাঁত বসিয়েছেন বাড়িতে। সম্প্রতি একটি ছোটদের বিদ্যালয় খুলেছেন তার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। তুমি চাকরি করতেও যাচ্ছ না, যাচ্ছ বাওয়ালী গ্রামে দেশসেবা করতে।

একটু থেমে আবার বলেন–দেখ, যদি কোন কুণ্ঠা থাকে তবে খোলাখুলি বল।

চন্দ্রভান দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলে–আমারই ভুল বড়দা। আমি যাব।

–ব্যস্ ব্যস্। তবে আর দেরি নয়। এখনই রওনা হলে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছবে।

 সুশীল সেন চট করে বলে-বড়দা, আমার মনে হচ্ছে উনি একেবারে একবস্ত্রে বেরিয়ে এসেছেন–

-তাই নাকি? তা হোক। আমি আজই মাইনে পেয়েছি

হাত পেতে ভিক্ষা কখনও নিতে হয় নি। চন্দ্রভান কিছুতেই হাতটা পাততে পারে না।

সুশীল যেন বুঝতে পারে ওর অবস্থা। বলে, কাল আংটিটা ওভাবে খোয়া না গেলে আজ তোমার এ অবস্থা হত না চন্দরদা–

–আংটি খোয়া গেছে? কেমন করে?

সুশীল হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে দেয়। ব্রজরাখাল বুঝতে পারে, সম্ভ্রান্ত জমিদার ঘরের এ ছেলেটি লজ্জায় হাত পাততে পারছে না। তাই কদমের হাতেই টাকা কটা ফেলে দিয়ে বলে কদম, তুমিই বরং ওকে দিও, ধুতি-টুতি যা লাগবে। আচ্ছা দেখ তো, আমাদের দরিদ্র ভাণ্ডারের তহবিলে কিছু আছে? ফাদার শারদাঁর কাছে খানকতক বর্ণ-পরিচয় আর শ্লেট-পেনসিল ইত্যাদি পাঠিয়ে দিতে পারলে ভাল হত।

 কদমকেশর লক্ষ্মীর ঘটটি উপুড় করে দেখিয়ে দেয়। ভাঁড়ে ভবানী!

তবে থাক। এর পরে না হয় দেখা যাবে। তাহলে চন্দ্রভানবাবু—

 চন্দ্রভান বললে–আপনি কদমদাকে নাম ধরে ডাকেন। আমাকেও নাম ধরেই ডাকবেন, আমি ওঁর চেয়ে বয়সে ছোট

–তা বেশ তো! তাই না হয় ডাকব এবার থেকে।

চন্দ্রভান উঠে দাঁড়ায়। কদমকেশর একখানা রুলটানা খাতা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে–এখানে একটা সই করতে হবে।

চন্দ্রভান সই করবার জন্য কলমদানি থেকে কলমটা তুলে নিতেই হাঁ হাঁ করে বাধা দেয় ব্রজরাখাল। বলে–অমন কাজও কর না চন্দ্রভানবাবু। না পড়ে কোন কাগজে কখনও সই কর না। আগে পড়ে দেখ–

চন্দ্রভান বলে–পড়ে আর কি দেখব বড়দা? আপনারা দেশের ভাল করতে চান, নিয়মাবলী সেই ভাবেই করেছেন। ও আর দেখার কি আছে?

এ কথাটা ঠিক হল না চন্দ্রভানবাবু। কী প্রতিজ্ঞা করছ, কী কথা দিচ্ছ

চন্দ্রভান হেসে বলে, কথা দেওয়ার আর মূল্য কি বড়দা? এই তো একটু আগে আপনি আমাকে কথা দিলেন, আমাকে নাম ধরে ডাকবেন–অথচ এখনও বলছেন চন্দ্রভানবাবু!

দিলখোলা হাসি হাসল ব্রজরাখাল। বললে–আচ্ছা ভাই চন্দ্রভান, এবার থেকে তোমাকে নাম ধরেই ডাকব। কথার খেলাপ করব না।

নৌকায় গিয়েছিল চন্দ্রভান। আর বাড়িমুখো হয় নি। এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছিল সংসার থেকে। এ দুনিয়ায় এখন থেকে সে একা। সূরয বড় হোক, মানুষ হোক। তারপর তার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে। যখন সূরয নিজের ইচ্ছায় পা ফেলতে পারবে। চন্দ্রভান বুঝতে পেরেছে কাকার আসল রাগ চন্দ্রভানের উপর। তার জন্যেই সূরযকে মার খেতে হয়েছে। ইচ্ছে করেই কাকা ওকে বেত মারে নি, কারণ অত্যাচারী বুঝেছিল নিজের পিঠের চেয়ে সূরযের পিঠেই চাবুকের আঘাত বেশি করে বাজবে চন্দ্রভানের। তাই ওর এ সিদ্ধান্ত। ও বুঝেছে, সংসার থেকে সরে না এলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়বে সূরযের উপর।

মেটিয়াবুরুজের ঘাটে দক্ষিণগামী একটি নৌকায় ঠাঁই পেয়েছিল। বজবজ পার হয়ে রাজারামপুরের ঘাটে যখন নামল তখন পড়ন্ত বেলা। ওখান থেকে বাওয়ালী নাকি মাইল তিনেক। মাঝি দেখিয়ে দিল রাস্তাটা সিধে দক্ষিণমুখো।

আম কাঁঠালের বাগান। তার মাঝখান দিয়ে পথ। দু-পাশে আশশ্যাওড়া আর বন ধোঁধলের আগাছা। মাঝে মাঝে মজা পুকুর, পড়ো ভিটে। বাঁশের ঝাড় নুয়ে পড়েছে পথের উপর। সরু পথটা একটু পরে গিয়ে মিশেছে দিগন্ত অনুসারী সবুজ ধানের ক্ষেতে। কার্তিকের প্রথম। ধানগাছের এবার রঙ ফেরানোর পালা। সবুজ থেকে সোনালী। ধানগাছের তলায় এখন জমে আছে থকথকে কাদা আর গেরুয়া ঘোলাজল। আর সেই ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে কুমারী মেয়ের সিঁথির মত একফালি আলপথ চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। ঐ পথে যেতে হবে তাকে। একেবারে দিগন্তের কাছে দেখা যাচ্ছে গ্রাম্য জনপদ–আম কাঁঠাল-নারকেল ছাওয়া।

প্রায় ঘন্টাখানেক টানা হেঁটে ও এসে পৌঁছলো গ্রাম প্রান্তে। গ্রাম-সীমানায় মস্ত একটা তেঁতুলগাছ। তার তলায় খানকতক চালাঘর। সামনে একটা গো-গাড়ি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ওপাশের একটা ভাঙা জমিতে কতকগুলো উলঙ্গ ছেলে কপাডি খেলছে। ভিনদেশী মানুষকে আসতে দেখে সামনের চালাঘর থেকে একজন বুড়োমতন মানুষ হেঁকে ওঠে–কে যায়?

আদুল গা, পরনে ময়লা একটা খাটো ধুতি। হাতে হুঁকা। ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধ পড়ন্ত রৌদ্র থেকে দৃষ্টিটা আড়াল করতে চোখের উপর তুলেছে একখানা হাত।

চন্দ্রভান এগিয়ে এসে বলে–আমি শহর কলকাতা থেকে আসছি। বাওয়ালী যাব। ফাদার অঁরি শারদাঁর বাড়ি। পথটা বলতে পারেন?

–এটাই বাউলী। কি নাম তোমার? কি জাতি?

আজ্ঞে, আমার নাম শ্রীচন্দ্রভান গর্গ। আমরা ব্রাহ্মণ।

–পেন্নাম হই। তা সাহেবের বাড়ি যাবেন? এই সড়ক ধরে সিধে চলে যান। এট্টু এগুয়েই দেখবেন রথতলা। সেখানে ডানবাগে মোড় ফিরবেন। গাঁয়ের একেবারে শেষ সীমানায় সাহেবের কুঠি।

চন্দ্রভান লক্ষ্য করে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেওয়ামাত্র বৃদ্ধ তাকে তুমি ছেড়ে আপনিতে উন্নীত করেছেন। কথা না বাড়িয়ে সে এগিয়ে যায়।

এককালে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। রথতলায় হোগলা দিয়ে ছাওয়া একটা রথ রয়েছে। পথে পড়ল পাকা দোলমঞ্চ। অসংখ্য ছোট বড় মন্দির। এই মন্দিরগুলি যেন বৃত্তাকারে ঘিরে ধরেছে গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়িটিকে। জমিদার বাড়ি। মণ্ডল মশায়দের। সেটাকে ডান হাতে রেখে এগিয়ে যেতে গ্রাম পাতলা হয়ে আসে। এদিকে আর বাড়িঘর নেই। ফাঁকা ফাঁকা। বেশ বড় একটা মাঠ পার হয়ে ওদিকে খানকতক চালাঘর দেখা যায়। তার একটা আবার রাণীগঞ্জ টালি দিয়ে ছাওয়া। জিজ্ঞাসা করে জানল ওটাই সাহেবের কুঠি।

এ তল্লাটে একজনই সাহেব। খুঁজে নিতে বেগ পেতে হল না। ব্রজরাখালও তাই বলেছিল–দশ বিশ মাইলের মধ্যে ঐ একজনই সাদাচামড়ার লোক আছেন। বাড়ি খুঁজে নিতে কোন অসুবিধা হবে না।

সাহেববাড়ির দোরগোড়ায় যখন এসে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। মাটির দেওয়াল, টালির ছাদ, বারান্দার খুঁটিগুলো তালের। সামনে বিস্তীর্ণ বাগান। মৌসুমী ফুলের চারা। ফুল ফুটেছে হরেক রকম। অচেনা সব বিলিতি ফুল। সব কখানা বাড়ি একটি প্রকাণ্ড বেড়া দিয়ে ঘেরা। পিছন দিকে হেঁচা-বেড়া এবং ফণীমনসার ঝোঁপ, শুধু সামনেটা মেদি পাতার সুন্দর করে ছাঁটা বেড়া। প্রবেশ পথে একটি কাঠের গেট। গেটের গায়ে একটা কাঠের ফলক। তার লেখাটা পড়ে ঘাবড়ে যায় চন্দ্রভান। কাঠের ফলকটাতে ইংরাজি হরফে লেখা আছে Rev. Henry Chardin। সর্বনাশ! ফাদার আঁর শারদাঁর বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এ কোন রেভ. হেনরি চার্ডিন-এর বাড়ি এসে উপস্থিত হল সে? কিন্তু গাঁয়ের মানুষদের আর দোষ দিয়ে কি হবে? সাহেব বলতে তারা এই একজনকেই চেনে। সাহেবের নাম আর কে মুখস্থ রাখে? সাহেব সাহেব। কিন্তু ঐ চার্ডিন সাহেব কোন্ বুদ্ধিতে এই অজ পাড়াগাঁয়ে নিজের বাড়ির ফটকে ইংরাজি হরফে নামটা লিখেছেন? তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ বা ওটা পড়েছে কখনও?

কাকে খুঁজছেন?

 বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যায় চন্দ্রভান।

তার কাছ থেকে হাত দশেক দূরে, বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। বয়স কত হবে ওর? বড় জোর পনের! টকটকে ফর্সা রঙ। কলকাতার ফিরিঙ্গি পাড়ায় এমন দুধে-আলতা রঙ, এমন নীল চোখ অথবা এমন সোনালী চুল কিছু অবাক করা দৃশ্য নয়-কিন্তু আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা এই বিজন প্রান্তরে অমন মেয়ের আবির্ভাবে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। মেয়েটিকে মেমসাহেবের মত দেখতে হলে কি হয়, ও কথা বলছে পরিষ্কার বাঙলায় কাকে খুঁজছেন আপনি?

–এটা রিক রেভ. হেনরি চার্ডিনের বাড়ি?

মেয়েটি মুখ টিপে হাসল। দুহাত মাজায় রেখে মাথাটি কাত করে বললে–আপনি বুঝি ইংরাজি পড়তে পারেন?

চন্দ্রভান থতমত খেয়ে যায়।

–এতক্ষণ বানান করে কি পড়লেন তাহলে?

চন্দ্রভান বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে। এটা নেহাৎ বোকার মত প্রশ্ন করছে সে। বাড়ির দোরেই তো গৃহস্বামী নিজ পরিচয় ঘোষণা করে রেখেছেন। তারপর আর এ বাহুল্য প্রশ্ন কেন? সামলে নিয়ে বলে–ভারি মুশকিলে পড়লাম তো! এতক্ষণ খুঁজে খুঁজে এই ভর সন্ধ্যে বেলায় শেষমেশ ভুল ঠিকানায় এসে পৌচেছি। আচ্ছা এখানে আর কোন সাহেব বাড়ি আছে?

আপনি কাকে খুঁজছেন তাই তো বলছেন না!

-আমি খুঁজছি ফাদার আঁরি শারদাঁকে। শুনেছি তিনি বাওয়ালী গ্রামেই থাকেন। আচ্ছা, এটাই বাওয়ালী তো?

কলকাতা থেকে আসছেন বুঝি?

–হ্যাঁ। এখন এই ভর সন্ধ্যে বেলায়

-তাই তো! এখনই এসব জঙ্গলে শেয়াল বের হবে। ওরা আবার কলকাতার মানুষ দেখলেই খ্যাঁক করে তেড়ে আসে। আসুন, ভিতরে আসুন।

চন্দ্রভান কলকাতার ছেলে নয়। গ্রামের অভিজ্ঞতা তার আছে। মেয়েটিকে বেশ ফাজিল বলেই মনে হল। কিন্তু ওর মনের অবস্থা তখন উপযুক্ত জবাব দেবার মত নয়। খোলা গেট পেয়েও ঢুকবে কিনা বুঝে উঠতে পারে না।

–এটা রেভ. হেনরি চার্ডিনের বাড়ি বটে, তবে এখানে আজ সন্ধ্যেবেলায় ফাদার আঁরি শারদাঁ আসবেন। আসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন সঙের মত?

ও! শারদাঁসাহেব আজ এখানে আসবেন? তবে তো ভালই হল।

মেয়েটি ওকে নিয়ে আসে ভিতরে। লাল সুরকি বিছানো পথটা দিয়ে টালি-ছাওয়া বাড়ির দাওয়ায়। ভিতর থেকে দুটি বেতের মোড়া বার করে আনে। একটি বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। একটিতে নিজে বসে পড়ে।

একটি জনমজুর শ্রেণীর লোক এসে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। বলে–আজ চলি দিদিমণি। কাল আসব তো?

-হ্যাঁ, আসবে বইকি। আর পরাণকেও নিয়ে এস। আলুগুলো কালকেই বসিয়ে দেব।

লোকটা কুণ্ঠিতভাবে বলে–ঘরে মালক্ষ্মী একেবারে বাড়ন্ত দিদিমণি–

–ও, আচ্ছা নিয়ে যাও।

মেয়েটি উঠে যায় ভিতরে। একটু পরেই নিয়ে আসে ছোট একটি বেতের টুকরিতে করে কিছু ধান। ঢেলে দেয় লোকটার প্রসারিত গামছায়। পেন্নাম সেরে লোকটা চলে যেতেই পরিবেশটা একেবারে নির্জন হয়ে পড়ে।

এমন জনমানবহীন বিজন প্রান্তরে একটি উদ্ভিন্ন-যৌবনা মেমসাহেবের সঙ্গে একান্তে চুপচাপ বসে থাকতে রীতিমত অস্বোয়াস্তি বোধ করে চন্দ্রভান। মেয়েটি শাড়ি-জ্যাকেট পরে নি, পরেছে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা ফ্রক-জাতীয় একটি পোশাক। তাই ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে আরও সঙ্কোচ হয়। বুকের উপর আঁচল না থাকলে কি এই বয়সী মেয়েদের দিকে তাকাতে পারা যায়? এতক্ষণে গোধূলির আলোও ক্রমে স্নান হয়ে যেতে বসেছে। চারদিক থেকে কেমন যেন একটা রহস্য-ঘন অন্ধকার ওদের ঘিরে। ধরছে। গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে এই অস্তেবাসী কুটিরগুলি। গ্রামের মানুষজনের। সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এখান থেকে। বিশ্বচরাচরে যেন আর কেউ নেই, আর কিছু নেই। আছে মুখোমুখি বসা ওরা দুজন।

অস্বোয়াস্থিকর নীরবতা ভেঙে চন্দ্রভান বলে–চার্ডিন সাহেব কোথায় গেছেন?

গোবিন্দপুরের হাটে। এখনই এসে পড়বেন। আপনি ব্রজরাখালবাবুর কাছ থেকে আসছেন তো?

–আপনি কেমন করে জানলেন? কে বলেছেন? শারদাঁ সাহেব?

মেয়েটি তার ফ্রকের প্রান্ত থেকে চোরকাঁটা ছাড়তে ছাড়াতে মুখ নিচু করে বললে না, চার্ডিন সাহেবও তাহলে নিশ্চয় সেটা ওই শারদাঁ সাহেবের কাছে শুনেছেন।

তাই হবে।

হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মেয়েটি। এর মধ্যে হাসির কি আছে? আবার হঠাৎই হাসি থামিয়ে বলে একটু বসুন, একটা আলো নিয়ে আসি।

উঠে যায় ভিতরে। একটু পরেই আসে ডোন-দেওয়া একটা কেরোসিনের বাতি নিয়ে। রাখে সেটা মাটিতে। বাইরে এতক্ষণে ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। গোধূলির আলো সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। ঝোপে ঝাড়ে জ্বলছে মুঠো মুঠো জোনাকি।

মেয়েটি নিজে থেকেই বলে–আমার নাম ঊর্মিলা–

–ঊর্মিলা কী? চার্ডিন না শারদাঁ?

চার্ডিন।

 –ও! আমার নাম শ্রীচন্দ্রভান গর্গ।

–গর্গ? আপনারা কি কায়স্থ?

–না, ব্রাহ্মণ।

–ও! তাহলে আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

চন্দ্রভান ওর কথামত বিছানা আর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে পিছন পিছন এগিয়ে যায়। মেয়েটি ওকে নিয়ে যায় বাড়ির পিছন দিকে কুয়োতলায়। বলে ঐ দড়িবালতি রয়েছে, এক বালতি জল তুলুন।

জল কি হবে?

–আপনি মুখ-হাত ধোবেন। খাবেন। বামুন মানুষ আমার তোলা জল তো আর আপনি খাবেন না। ঐ ঘটি রেখেছি, এক ঘটি জল নিয়ে আসুন।

চন্দ্রভান আর দ্বিরুক্তি করে না। কুয়োর জলে ভাল করে মুখ-হাত ধুয়ে নেয়। ঘটিটা মেজে এক ঘটি জল নিয়ে ফিরে এসে দেখে–মেটে দাওয়ায় একটি পশমের আসন বিছানো রয়েছে। সামনে একটি পদ্মপাতায় কয়েক টুকরো কাটা পেঁপে, শসা, কলা আর বাতাসা।

–আপনি খাবেন তো?–সৌজন্য বোধে প্রশ্ন করে চন্দ্রভান।

–আমি কি ফলারে বামুন?

 ক্ষিধে পেয়েছিল প্রচণ্ড। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি। চন্দ্রভান বসে পড়ে বিনা বাক্যব্যয়ে। মনে হয় মেয়েটি মুখরা। অমন সুন্দর দেখতে, অথচ কথাগুলো কেমন যেন খোঁচা খোঁচা!

মেয়েটি আকাশের দিকে মুখ করে একটি স্বগতোক্তি করে ব্রজরাখালবাবুর যেমন কাণ্ড! ফলারে বামুন পাঠাতে কে বলেছিল!

চন্দ্রভানের রীতিমত রাগ হয়ে যায়। এ মেয়েটির মোড়লি করার কি আছে? কলাটা কোনক্রমে গলাধঃকরণ করে বলে–তাতে আপনার কি?

না, আমার আর কি? আমার তো হাঙ্গামা কমলই। আপনাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে না।

ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝে উঠবার আগেই শোনা গেল অশ্বখুরধ্বনি। সাহেবরা নিশ্চয় ফিরে এলেন হাট থেকে। খাওয়া হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রভানের। উঠে পড়ে মুখটা ধুয়ে নেয়।

দুজন নয়, একজনই এলেন ঘোড়ায় চেপে! ঘোড়াটা এসে থামল একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায়। সাহেব নামলেন ঘোড়া থেকে। সঙ্গে ছিল ওষুধের একটা ব্যাগ। সেটা ঊর্মিলার হাতে দিলেন। সাদা আলখাল্লার মত একটা জোব্বা পরা, সাদা দাড়ি, চুলগুলি সাদা বাবরি চুলের গোছা কাঁধের উপর পড়েছে। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসু নেত্রে চন্দ্রভানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। চন্দ্রভানকে পরিচয় দিতে হল না। ঊর্মিলা বললে ইনি মিস্টার চন্দ্রভান গর্গ। ব্রজরাখালবাবু পাঠিয়েছেন।

বৃদ্ধ তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–আমি দুঃখিত। অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে বসিয়ে রাখিয়াছি।

চন্দ্রভান বৃদ্ধের প্রসারিত করটি গ্রহণ করে, সশ্রদ্ধ অভিবাদন করে বলে–আমাকে আপনি তুমি বলেই কথা বলবেন।

বৃদ্ধ হঠাৎ হা হা করে হেসে ওঠেন–বলেন–আমাকে মার্জনা করতে হবে চন্দ্রভানবাবু। বাঙলা ভাষায় ঐ আপনি-তুমি-তুই–এ আমার কিছুতেই অভ্যাস হইল না। ক্রিয়াপদগুলিও ঐ সঙ্গে বদল হয়ে যায় কিনা। আমি ঐ একটিই অভ্যাস করেছি। তাই সকলকেই আপনি বলি।

আপনার মেয়েকেও?

–কার কথা বলিতেছেন আপনি?

ঊর্মিলা আগ বাড়িয়ে বলে–উনি বোধহয় আমাকে–মীন করছেন।

-ওঃ না! ও আমার মেয়ে নয়, আমার…আমার…

–ভাইঝি, ভ্রাতুষ্পুত্রী। পাদ পূরণ করে ঊর্মিলা।

–এক্সাক্টলি! ভ্রাতুষ্পুত্রী। যাই হোক আসুন, ভিতরে বসা যাক।

ওরা ঘরের ভিতরে এসে বসে। মাটির দেওয়াল, মাটির মেজে। কিন্তু সমস্তটা ঝকঝক্ তকতক্ করছে। ঘরের দেওয়ালে এ গ্রামের সঙ্গে নিতান্ত বেমানান খানকতক ছবি। বেশ বড় মাপের। রঙিন ছবি। চন্দ্রভান চেনে না, তাই বুঝতে পারে না এগুলি পশ্চিমের বিখ্যাত চিত্রকরদের প্রিন্ট। করেজজোর কিউপিডের শিক্ষা, লিওনার্দোর শিলাসীনা কুমারী, রাফাইলের আকাদেমী, এল গ্রেকোর সেন্ট মার্টিন ও ভিখারী, রেমব্রান্টের রাতের পাহারা, গেনসবরার ব্লু বয়।

ঘরের একপ্রান্তে মাটি দিয়ে তৈরী একটি তুলসীমঞ্চের বেদীর মত। তার উপর একটি মূর্তি। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর। তার উপরে লক্ষ্মীর সরার মত গোলাকৃতি আর একটি রঙিন ছবি। একটি সুখী পরিবারের। বাপ, মা ও শিশুপুত্রের। বাপ সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, মা তার ডান হাতটা তুলে কাঁধের উপর বসা শিশুটিকে আকর্ষণ করছে। পশ্চাৎপটে কয়েকজন উলঙ্গ লোক। ওরা কেন এমন প্রকাশ্য স্থানে উলঙ্গ হয়ে সারি সারি বসে আছে বোঝা গেল না।

তিনজনে আসন গ্রহণ করলে বৃদ্ধ ঊর্মিলাকে ইংরাজিতে বললেন-মিষ্টার গর্গের জন্য কিছু খাবার-টাবার—

বাধা দিয়ে চন্দ্রভান বলে–উনি আগেই সেটা সেরেছেন। আমার আহার হয়েছে; কিন্ত একটা কথা। ফাদার আঁর শারদাঁ আজ সন্ধ্যেবেলায় এখানে আসবেন শুনেছিলাম

বৃদ্ধ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকান। হঠাৎ একটা খুক খুক শব্দ শুনে পাশে ফিরে দেখেন ঊর্মিলা প্রাণপণে হাসি চেপে বসে আছে। বৃদ্ধ একটু সামলে নিয়ে বলেন আমিই অঁরি শারদাঁ!

চন্দ্রভান নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি শুধরে নেয়–ওঃ মাপ করবেন! আমি ভেবেছিলাম আপনি হেনরি চার্ডিন!

আর নিজেকে সামলাতে পারল না মেয়েটি। উচ্ছ্বসিত হাসির বন্যায় ফেটে পড়ল আর তৎক্ষণাৎ ছুটে পালিয়ে গেল ভিতরে। বৃদ্ধ যেন অত্যন্ত অপ্রস্তুত বোধ করছেন। কুণ্ঠিত হয়ে আমতা আমতা করে বলেন–আপনি ভুল করিতেছেন চন্দ্রভানবাবু। আমার নাম ফরাসী উচ্চারণে অঁরি শারদা। রোমান হরফে ওটা Henry Chardin।

চন্দ্রভান মরমে মরে যায় । কিন্তু মরার তখনও বাকি ছিল তার। বৃদ্ধ ওর হাত দুটি ধরে বললেন–আমার ভ্রাতুষ্পুত্রীর প্রগলভতার জন্য আমি মার্জনা ভিক্ষা করিতেছি।

.

বাওয়ালী গাঁয়ে চন্দ্রভান ছিল প্রায় এক বছর। এসেছিল কার্তিকের প্রথমে, ফিরে আসে পরের বছর অঘ্রাণের শেষাশেষি। এর মধ্যেই বাওয়ালী গ্রামটিকে ও ভালবেসে ফেলেছিল। ফাদার অঁরি শারদাঁ তার অন্তরে একটি স্থায়ী শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এমন গভীরভাবে সে আর কোনও মানুষকে শ্রদ্ধা করবার সুযোগ পায় নি। গুরু বলতে যা বোঝায় যিনি জ্ঞানাঞ্জনশলাকা পরিয়ে দেন, মুক্তি পথের ইঙ্গিত যিনি দিতে পারেন-রেভারেণ্ড অঁরি শারদাঁ ছিলেন তাই। অদ্ভুত মানুষ। শ্রদ্ধায় আপনিই মাথা নত হয়ে আসে। একদিনে চন্দ্রভান সব কথা জানতে পারেনি। জেনেছিল ক্রমে ক্রমে।

রেভারেণ্ড আঁরি শারদাঁ ছিলেন মেথডিস্ট চার্চের পাদরি। অল্প বয়সেই তিনি সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। বিবাহ করেন নি। প্রথমে ছিলেন ইটালিতে-রোমে। তারপর এসেছিলেন ভারতবর্ষে। খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারের ব্রত নিয়ে। চার্চ সম্প্রদায় থেকেই ওঁর পাথেয় দেওয়া হয়। প্রথমে এসে ওঠেন পণ্ডিচেরীতে, পরে ফরাসী চন্দননগরে। বাঙলাদেশে এসে এক নতুন ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় হল তার। আলাপ হল কেশবচন্দ্রের সঙ্গে, ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে। তর্ক করলেন এঁদের সঙ্গে; ভাব বিনিময় হল। তারপর দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এক অদ্ভুত ভাবুকের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। কেমন যেন বদলে যেতে থাকে আজন্মের ধ্যান ধারণা। অনশনক্লিষ্ট নিরন্ন হিদেনগুলোকে নানাভাবে প্রলোভিত করে চার্চের ছত্রচ্ছায়ায় টেনে আনার মধ্যেই যে পরমার্থ আছে এ বিশ্বাসটাতেই ফাটল ধরল। ওঁর চালচলন ভাল লাগল না কর্তৃপক্ষের। ওঁকে হুঁসিয়ার করে দেওয়া হল। তবু আঁরি শারদাঁ সাবধান হতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হলেন তিনি। উনি নাকি হিন্দু হয়ে গেছেন। ফাদার শারদাঁ প্রতিবাদ করেননি। ওদের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছিলেন একদিন। বেছে নিয়েছিলেন এই অবোসীর জীবন। না, ধর্ম তিনি ত্যাগ করেন নি। মনে প্রাণে আজও তিনি নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টান। এ গ্রামে যখন প্রথম এসে উঠেছিলেন তখন নানা দিক থেকে বাধা উপস্থিত হয়েছিল। হিন্দুসমাজ এবং জমিদার লাগল তার পিছনে। কিন্তু ক্রমে সকলের হৃদয়ই জয় করে নিলেন তিনি। ওরা দেখল, এ পাদরি সাহেব গাঁয়ে কোন চার্চ বানাতে চাইল না, একটি মানুষকেও খ্রীষ্টান করল না। বরং এসে যোগ দিল ওদের চণ্ডীমণ্ডপের সংকীর্তনে, ওদের দোল-দুর্গোৎসবে। একে একে ভয় ভাঙলো গ্রামের লোকের। পাগলাসাহেবের মতিগতি বোঝা ভার। গাজনের আসরেও তাকে দেখা যায়, দোলের দিনে আবীরও মাখায়, আবার শোনা যায় নাকি আপন মনে পিয়ানো বাজিয়ে ধর্মসঙ্গীতও গায়। সবচেয়ে বড় কথা পাগলা সাহেব ছিল ধন্বন্তরী ডাক্তার। কোথায় কার অসুখ করেছে কাকের মুখে বার্তা পেয়ে সে ছোটে। ভিজিট নেয় না, ওষুধের দাম নেয় না সারিয়ে তোলে! এমন মানুষকে কি আপন না করে পারা যায়।

পাগলা-সাহেব ধুয়ো ধরল সে একটি অনাথ আশ্রম খুলবে। যেসব অনাথ ছেলেমেয়ে বেওয়ারিশভাবে পথে বেপথে ভিক্ষা করে ফেরে, বাপ-মায়ের অবাঞ্ছিত সন্তান যারা সমাজে পরিত্যক্ত, তাদের সে বাঁচবার সুযোগ দিতে চায়। কথাটা বেয়াড়া; কিন্তু তাতে সায় দিলেন স্থানীয় জমিদার মশাই। নিজ ব্যয়ে তৈরী করে দিলেন খান দুই চালাঘর। পাগলা-সাহেব নিয়ে এসে তুলল গ্রাম-গ্রামান্তরের ঐ সব বেওয়ারিশ বাচ্চাদের। অথচ আশ্চর্য, জাত মারল না কারও। খ্রীষ্টানের ছোঁওয়া পর্যন্ত খেতে হল না তাদের। কোন্ বিধবা বামুনবুড়িকে এনে তুলল তার অনাথ আশ্রমে। তিনি সকলের ন’পিসি। কোথাকার কার ন’পিসি তা কে-ই বা জানে? বড়পিসি-মেজপিসি কেউ কখনও ছিলেন কিনা তাও জানা যায় না। বৃদ্ধা পিসি ওদের দায়িত্ব নিল। তিনকুল খাওয়া এই বিধবা বুড়ি এসেছিল ভাত কাপড়ের লোভে; কিন্তু ঐ অনাথ শিশুগুলিকে পালন করবার মধ্যেই বালবিধবার বঞ্চিত মাতৃত্ব তৃপ্ত হয়েছে। ঐ অপোগণ্ডগুলিকে সেও ভালবেসে ফেলেছে।

–আপনি আর খ্রীষ্ট ধর্ম দীক্ষা দেন না কাউকে?- প্রশ্ন করেছিল চন্দ্রভান।

না। আমার সে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

–আপনি রোজ বাইবেল পড়েন?

পড়ি। মহাভারতও পড়ি। রামায়ণও পড়ি। কোরাণের কোন অনুবাদ পাই নাই। পাইলে তাও পড়িতাম।

–আপনি আমাকে বাইবেল পড়ে শোনাবেন? বুঝিয়ে দেবেন?

সানন্দে; কিন্তু বিনিময়ে আপনি আমাকে গীতা পড়িয়া শুনাইবেন। বুঝাইয়া দিবেন। আপনি তো ব্রাহ্মণ।

এমনিভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের ভাবের আদান-প্রদান। আঠারো বছরের চন্দ্রভান আর আটষট্টি বছরের শারদাঁর বন্ধুত্ব। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ওখানেই ব্রজরাখালের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। উনি জানতেন, ব্রজরাখালের একটি যুবক সমিতি আছে। তাই তার কাছেই খবর পাঠিয়েছিলেন। গুটি আট-দশ বাচ্চাকে আশ্রয় দিয়েছেন; কিন্তু তাদের লেখাপড়া শেখাবার একটা ব্যবস্থা না হলে যে ওরা মানুষ হয়ে উঠবে না। এতদিনে চন্দ্রভান আসায় বৃদ্ধের মনোবা চরিতার্থ হয়েছে। চন্দ্রভান তাদের পড়ানোর ভার নিয়েছে। সাতটি ছেলে আর তিনটি মেয়ে। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের। রোজ সকালে ওদের নিয়ে বসে। মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের বর্ণপরিচয় নিয়ে। আর ধারাপাতের নামতা মুখস্থ করায়। একটারও অক্ষর পরিচয় নেই। সন্ধ্যাবেলা সাহেব নিজেই এসে বসেন। মুখে মুখে নানান দেশ বিদেশের গল্প বলেন। তত্ত্বকথা শেখান।

একদিন চন্দ্রভান সাহস করে প্রশ্ন করে বসল–আচ্ছা, এই ছবিতে ঐ উলঙ্গ লোকগুলিকে আঁকা হয়েছে কেন?

ফাদার শারদাঁ তার বৈঠকখানায় গোলাকার ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলেন–ছবির ঐ বাপ-মা আর শিশু কে জানেন?

আজ্ঞে না। ওঁরা কে?

যোশেফ, মেরী এবং যীশু। এঁরা হলেন হোলী ফ্যামিলি। এ ছবিটি একটি বিখ্যাত তন্দো। তন্দো মানে গোলাকৃতি ছবি, আপনাদের যেমন লক্ষ্মীর সরা আর কি! এটা এঁকেছেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তাঁর নাম মিকেলাঞ্জেলো বুয়োনরতি। নামটা শুনিয়াছেন?

চন্দ্রভান আবার মাথা নেড়ে বলে না।

–ছবিটা মিকেলাঞ্জেলো এঁকেছিলেন একজন ইটালিয়ান কাউন্টের জন্য। তিনি পশ্চাৎপটের ঐ নগ্ন মানুষগুলিকে হোলি ফ্যামিলিতে দেখে সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। বলেন, ছবিটি অশ্লীল। পরে তিনি মিকেলাঞ্জেলোর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন ও ছবিটিা কিনিয়া নেন। ঐ ছবি আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র। কেন তাহা বলি শুনুন।

মিকেলাঞ্জেলোর দোনি তন্দোর প্রসঙ্গে সেই যুগান্তকারী শিল্পগুরুর গোটা জীবনটাই শুনিয়েছিলেন তিনি। আর শুধু কি মিকেলাঞ্জেলো? ঐ প্রসঙ্গে রেনেসাঁ কি তা-ও বুঝিয়েছিলেন। রাফাইল, লিওনার্দো, জর্জনে, এল গ্রেকো, তিশান সবাই এসেছিলেন ভীড় করে সেই বাওয়ালী গ্রামের টালি ছাওয়া ঘরে। চিত্রকর থেকে চিত্রের প্রসঙ্গ। দেওয়াল থেকে ছবিগুলি পেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নানান তথ্য।

–আপনি চিত্রকরদের বিষয়ে এত কথা জানলেন কেমন করে?

–আমি যে চার্চে ছবি আঁকতাম।

–আপনি ছবি আঁকতে পারেন? কই দেখি আপনার ছবি!

বৃদ্ধ হেসে বলেছিলেন–আমি কাগজে ছবি আঁকি না। দেওয়ালে আঁকি। টেম্পারা ও ফ্রেসকো।

তারপর বলেন–আপনি দেখিতে ইচ্ছা করেন? আচ্ছা আসুন।

রেভারেণ্ড আঁর শারদাঁর শয়নকক্ষে সেই তার প্রথম পদার্পণ। মাটির দেওয়াল, খড়ের চালা। ঐ টালি-সেডের পিছনেই। ঢুকেই স্তম্ভিত হয়ে গেল চন্দ্রভান। ঘরের একপ্রান্তে মাটিতে পাতা একটি বিছানা। মাথার কাছে একটি কলসি। অপর প্রান্তে দেওয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। তার পায়ের কাছে আল্পনা আঁকা একটি মাটির ঘটে স্থলপদ্ম। আর ঘরের চতুর্দিকের দেওয়ালে প্রকাণ্ড বড় বড় অপূর্ব সব ছবি। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে। চুন, গিরিমাটি, হলুদ ও নীল রঙ গুলে জলরঙে আঁকা। মোটা মোটা রেখা। রঙ কোথাও গাঢ় থেকে হালকা করা হয় নি। এক এক রঙ এক এক জায়গা জুড়ে। অথচ সবটা মিলিয়ে ভারি হালকা একটি আমেজ।

–আপনি এত সুন্দর ছবি আঁকেন!

বৃদ্ধা হাসলেন শুধু।

–এটা কার ছবি? এঁর সারা গায়ে এমন তীর বেঁধা কেন? আর থামের সঙ্গে এঁকে অমন করে বেঁধে রেখেছে কেন?

উনি স্টিসেন্ট সিবেয়ান। আপনাকে ওঁর গল্প শুনাইব।

চন্দ্রভানের মনে পড়ে গেল তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ঠিক ঐ রকমভাবেই তাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল সেদিন। সূরযভানের পিঠের উপর পড়া প্রতিটি কশাঘাত ঐভাবেই তীরের মত বিঁধেছিল তার বুকে।

–আর ইনি? এই মাথায় মুকুট-পরা মহিলাটি? ক্রুশ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি। ইনি কি মা-মেরী।

না। মাতা মেরীর মাথায় আমি মুকুট আঁকিব কেন? তিনি তো সামান্য মেহনতী-ঘরের বধূ–আর ক্রুশকাষ্ঠই বা কেন দিব তাঁর হাতে? উনি সেন্ট হেলেনা। সম্রাট কনস্টান্টাইন–যাঁর নামে কন্সড়ানটিনোপল শহর–উনি তাঁর মা। তিনিই প্রভু যীশুর ক্রুশকাষ্ঠটি খুঁজিয়া বাহির করেন।

চন্দ্রভান তন্ময় হয়ে ছবিগুলি দেখছিল। ওদের বাড়িতেও বড় বড় ছবি আছে। সেগুলি অধিকাংশই বিলাতী ঢঙে আঁকা নিরাবরণা অপ্সরা অথবা নিসর্গ চিত্র। কিছু আছে রবি বর্মার প্রিন্ট। এ ছবির জাত আলাদা। মোটা মোটা তুলির আঁচড়। মূর্তিগুলির যেন ভার নেই–যেন শূন্যে ভাসছেন তারা!

বললে–এমন অপূর্ব ছবি আপনি এমন কাঁচা দেওয়ালে এঁকেছেন? এ আর কদিন টিকবে?

ফাদার শারদাঁ ক্রুশলাঞ্ছিত নিজ বক্ষদেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন–এটাও যে কাঁচা দেওয়াল চন্দ্রভানবাবু। এটাই বা আর কতদিন টিকবে?

কিন্তু মিকেলাঞ্জেলোর দোনি তন্দো তো চারশ বছর টিকে আছে।

-ঠিক কথা। মিকেলাঞ্জেলো পৃথিবীর জন্য এঁকেছিলেন। তিনি ছিলেন শিল্পী। কিন্তু এ ছবির একজনই দর্শক। নেহাৎ আপনি আজ দেখিতে চাইলেন তাই আপনাকে দেখাইলাম।

চন্দ্রভান এ যুক্তি মেনে নিতে পারে না, কিন্তু প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করতেও তার সঙ্কোচ হয়।

বৃদ্ধ বলেন–বাওয়ালী গ্রামের জমিদার মণ্ডলমশায়ের রাধাকান্ত মন্দিরের খিলানে পোড়া মাটির মূর্তিগুলি দেখেছেন চন্দ্রভানবাবু? তাও শিল্প হিসাবে অপূর্ব। মণ্ডলমশাই কাঁচা দেওয়ালে আঁকেন নাই। কিন্তু মহাকালের হিসাবে দু বছর আর দুশ বছরে কী প্রভেদ?

এবারও জবাব দেয় নি চন্দ্রভান।

ঊর্মিলার উপাখ্যানও শুনেছে শারদাঁর কাছে। মেয়েটি চন্দ্রভানের মত হতভাগ্য। বোধ করি তার চেয়েও বেশি। ঊর্মিলার বাবা জাক-লুই শারদাঁও একদিন ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন সুদূর ফরাসী দেশ থেকে এই ভারত ভূখণ্ডে। একটি কোম্পানীর ম্যানেজার হিসাবে। তখন তার উঠতি বয়স। এখানে এসে একটি বঙ্গললনাকে তার ভাল লেগে গেল। মেয়েটি সুন্দরী, গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের। কেমন করে পর্দানসীন একটি বঙ্গনারীর সঙ্গে ঊনবিংশ শতকের সেই শেষ পাদে একটি ফরাসী ভদ্রলোকের দেখাসাক্ষাৎ হত সে কথা আর বিস্তারিত বলেন নি ফাদার শারদাঁ, হয়তো সে নেপথ্যের ইতিহাস তার জানাও ছিল না। জেনেছিলেন তার ফলশ্রুতিটকু। তা ঐ ঊর্মিলা।

কাহিনীর উপসংহারটি করুণ। জাক-লুই শারদাঁ আবার ফিরে গেছেন দেশে। ঊর্মিলার মা অবশ্য সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়েই মুক্তি পেয়েছিল। ঊর্মিলা সেই শিশুকাল থেকে ফাদার শারদাঁর সংসারে আছে। ফাদার শারদাঁ তাকে কলকাতার মিশনারী স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। সেখানেই ছাত্রাবাসে থেকে পড়ে ঊর্মিলা। প্রতি ছুটিতে বাওয়ালীতে আসে।

 কাহিনী শেষ করে বৃদ্ধ বলেছিলেন–এ সকল কথা যেন ওর সম্মুখে আলোচনা করিবেন না। অত্যন্ত অভিমানী মেয়ে। আর এখনও তো ও নিতান্ত ছেলেমানুষ।

ছেলেমানুষ! হিন্দু সমাজে এমন পনের-ষোলো বছরের কচি খুকি থাকলে বাপ মায়ের গলা দিয়ে ভাত নামতো না। চন্দ্রভান আর কথা বাড়ায়নি।

.

–শুনছে গুরুমশাই! ছেলেদের আজ ছুটি দিয়ে দিন।

স্লেট থেকে মুখ তুলে চন্দ্রভান দেখতে পায় পাঠশালার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ঊর্মিলা। আজ আর ফ্রক নয়। পরেছে বাসন্তী রঙের একখানা ধনেখালি, গায়ে ঐ রঙের জ্যাকেট। স্নানান্তে পিঠের উপর মেলে দিয়েছে কোঁকড়া কোঁকড়া এলো চুল। কপালে পরেছে একটা লাল টিপ। ঠিক লক্ষ্মী ঠাকরুণটির মত লাগছে আজ ওকে।

–কেন? ছেলেদের হঠাৎ ছুটি দিয়ে দেব কেন?

–ন’পিসির জ্বর হয়েছে। মাথা তুলতে পারছে না। আজ আপনাকে রাঁধতে হবে।

চন্দ্রভান বিব্রত বোধ করে। আমতা আমতা করে বলে রাঁধতে হবে। আমি যে রান্নার কিছুই জানি না!

ফিক করে হেসে ফেলে ঊর্মিলা বলে–এটা কি রকম কথা হল রসুয়ে বামুনমশাই! এটা যে আপনার কুলকর্ম!

চন্দ্রভান গম্ভীর হয়ে বলে–আমি রসুয়ে বামুন নই। আমি রান্না করতে পারব না। ফলার খাব।

-ও আপনি বুঝি রসুয়ে বামুন নন, ফলারে বামুন! নিন, উঠুন উঠুন! আপনি না হয় ফলার করবেন–এতগুলো বাচ্চা খাবে কি?

রাখাল রুহিদাস সর্দার পোড়ো। সাহস করে বলে–তাহলে আমাদের ছুটি, মাশাই?

চন্দ্রভান কিছু বলার আগেই ঊর্মিলা ধমকে ওঠেনা, তোমার ছুটি নয়। কাঠগুলো চেলা করতে হবে। বাদবাকির ছুটি–যাও!

মাশায়ের নির্দেশের জন্য আর অপেক্ষা করল না ওরা। ছুটি-ছুটি-ছুটি চিৎকার করতে করতে দুর্দাড় করে বেরিয়ে গেল মাঠে।

চন্দ্রভান বইপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ে। বলেচলুন, রান্নাঘরে যাই!

বাঃ! কী বামনাই বুদ্ধি আপনার! ছত্রিশ জাতের ছেলেকে ছুঁয়েছেন, সে খেয়াল আছে? যান আগে স্নান করে আসুন!

চন্দ্রভান হেসে বলেজাত যায় আমার যাবে! আপনার কি?

–জাত খোয়াবার জন্য যেন বড় বেশি উৎসাহ দেখছি। নজরটা কোন দিকে?

চন্দ্রভান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে-মানে?

-মানে, একা আপনার জাতের কথা তো হচ্ছে না! ন’পিসির জন্যেও তত পথ্য বেঁধে দিতে হবে আপনাকে। সে বেচারী কেন জাত খোয়ায় আপনার গরজে

–আমারই বা গরজটা কি?

–তা আপনিই জানেন। কী উঠবেন, না বকবকই করবেন শুধু?

 রান্নাঘরে এসে নানান বিড়ম্বনা। ঘরে ঢুকতে পারে না ঊর্মিলা। চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধমক দেয়–ওটা কী হচ্ছে? নাড়ুন, নাড়ুন-তলাটা ধরে যাবে না? আঃ! বাঁ হাত দিয়ে ধরুন হাঁড়িটা! এই দেখ! শুধু হাতে ধরতে বলেছি নাকি? ন্যাকড়া দিয়ে তো ধরবেন? দেখি, দেখি-হাতটা পুড়ে গেল তো? আমারই হয়েছে যন্ত্রণা! এমন বামুনের জাতই যাওয়া উচিত!

চন্দ্রভান প্রতিবাদ করে না। নির্দেশ অনুযায়ী কাজগুলি করে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সে যা কিছু করতে যায় তাই কি ভুল? প্রতিপদেই ধমক খাচ্ছে বেচারি। আচ্ছা, নাড়তে বলেছি মানে কি ঘন্ট বানাতে বলেছি? ক্রমাগত অত নেড়ে চলেছেন কেন? আলুগুলো যে ঘেঁটে একশা হয়ে গেল। ওকি? হাতটা ধুয়ে নিন–এঁটো হল না?

চন্দ্রভান হঠাৎ ঘুরে বসে বলে-বামুনের সঙ্গেই আপনার বিয়ে হওয়া উচিত! এত এঁটোকাঁটার বিচার শিখলেন কোথায়?

খিলখিল্ করে হেসে ওঠে ঊর্মিলা, বলে– রক্ষে করুন। মুর্গীই খেতে পারব না সারা জীবনে।

–মুর্গী বুঝি আপনি খুব ভালবাসেন?

আপনি কি ভেবেছিলেন? আর কাউকে ভালবাসি? তাই বামুন বাড়িতে আমাকে চালান করতে চাইছিলেন?

উঠে দাঁড়ায় চন্দ্রভান। এগিয়ে যায় দ্বারের দিকে এক পা।

–আপনার হাত এঁটো।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চন্দ্রভান। হাত দুটির দিকে তাকিয়ে দেখে।

-পুড়ে গেল যে ওদিকে! নামান নামান।

–পুড়ে গেল? কি পুড়ে গেল? নামাতে হবে? কাকে, কিসের থেকে?

.

গ্রামের অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে চন্দ্রভানের। চরণ, মণ্ডল, নিতাই, রুহিদাস, জীবন কর্মকার আর গোপেন পাড়ুই। মাঝে মাঝে ওদের ওখানে গিয়ে আড্ডা মেরে আসে। ওরা ওকে ডাকে মাস্টারমশাই বলে। জমিদারমশাই একদিন স্কুল কেমন চলছে তা দেখতে এসেছিলেন। ওকে নিমন্ত্রণ করে গেলেন রাধাকান্তজীর প্রসাদ গ্রহণ করতে।

সেদিন ছিল রবিবার। ওদের স্কুলের ছুটি। ফাদার শারদাঁ সকাল বেলাতেই ঘোড়া নিয়ে চলে গেলেন কোন্ দূর গাঁয়ে। রোগী দেখতে। চন্দ্রভান আশ্রয় পেয়েছিল ঐ পাঠাশালা ঘরেই। মাটিতে সতরঞ্চি বিছিয়ে শুতে। মাথার কাছে একটি কলসি। নিজেকেই জল ভরে রাখতে হয় তাতে। সকালে উঠে বিছানা গুটিয়ে রাখে। তখন সেটা পড়াশুনার আসর। আজ ছুটির দিন। আজ একটু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা যেতে পারে। চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে থাকে। এই চার মাসের ভিতর সে কলকাতার কোন চিঠি পায়নি। কোন চিঠি নিজেও লেখেনি কাউকে। ওর ঠিকানাই তো জানে না কেউ। আচ্ছা সূরয কেমন আছে? কলকাতাতেই আছে নিশ্চয়। এতদিনে হাফইয়ার্লি পরীক্ষা হয়ে গেছে। সামনেই ওর ছুটি। ছুটিতে নিশ্চয় সে পাগলচণ্ডী যাবে। এখানে সূরয এলে কী মজা হত! গগ্যাটা পাস করতে পারে নি। করবে কোথা থেকে? পড়াশুনা যে করত না একদম। বটুক ভর্তি হয়েছে বরিশাল কলেজে। আর দীপু? দ্বৈপায়ন? সে তো প্রেসিডেন্সির ছাত্র এখন! মস্ত পণ্ডিত হবে একদিন ওর বন্ধু দীপু।

আচ্ছা কোম্পানির বাগানে সেই সন্ন্যাসী কেন বলেছিলেন-যবন কাহাকা! যবন? মানে খ্রীষ্টান? ও যদি খ্রীষ্টান হত তাহলে কার কি ক্ষতি হত? ক্ষতি নয় লাভই হত। হাত পুড়িয়ে ওকে রান্না করতে হত না। ঊর্মিলাই রেঁধে খাওয়াতো তাকে। আচ্ছা ঊর্মিলা কি–? ঊর্মিলা মেয়েটা বড় অদ্ভুত। ওর অর্ধেক কথা বোঝাই যায় না। ওদের স্কুল নিশ্চয় খুলে গেছে। মেয়েটা তো হস্টেলে ফিরে গেল না! কেন?

হঠাৎ কার যেন ছায়া পড়ল ঘরের ভিতর খোলা দরজা দিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে চন্দ্রভান দেখে দোরগোড়ায় ঊর্মিলা এসে দাঁড়িয়েছে।

–এমন চুপচাপ শুয়েও থাকতে পারে মানুষ! বাব্বাঃ!

 চন্দ্রভান চোখ দুটি বুজে বলে, রবিবারেও জ্বালাতে আসা হয়েছে!

উঠুন উঠুন। অনেক কাজ আছে

কাজ নেই। আজ সাবাথ ডে 

–আপনি কি খ্রীষ্টান?

হলে যেন খুশি হও তুমি!

–এই খবর্দার! আপনি আমাকে তুমি বলছেন যে!

–কেন, তুমি কি আমার গুরুজন?

অনুমতি না দিলে অনাত্মীয়া কোন মেয়েকে তুমি বলতে নেই তাও জানেন না?

–অনুমতি তো তুমি দিয়েছ?

–ঈস! কী মিথ্যুক আপনি! কবে অনুমতি দিলাম?

মুখে দাও নি, দিয়েছ তোমার চোখের তারায়, তোমার ঠোঁটের হাসিতে।

-ওঃ! কাব্য হচ্ছে বামুন-ঠাকুরের। নিন, উঠুন উঠুন। বেগুন গাছগুলোর তলায় আগাছা হয়েছে। নিড়িয়ে দিতে হবে। একা হাতে আমি কত পারি?

–আমি কি তোমার মুনিষ, পরাণ রুহিদাস?

না! পরাণ বল্লভ! উঠুন! বেগুন খাবার বেলায় তো চারখানা হাত বার হয় দেখি।

–তা তো বের হবেই। আমি হলাম হিন্দু তায় বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, চতুর্ভুজের উপাসক। তার মর্ম যবনী হয়ে তুমি কি বুঝবে?

নারায়ণ চার হাতে খান না ঠাকুরমশাই। নিন উঠুন!

 অগত্যা উঠেই পড়তে হয়।

মুখহাত ধুয়ে ছোলা গুড় মুখে দিয়ে চন্দ্রভান নেমে আসে বেগুনের ক্ষেতে। ঊর্মিলা খুরপি নিয়ে তার আগেই এসেছে। রৌদ্রের তেজ এর মধ্যেই বেশ বেড়ে গেছে। টকটকে লাল হয়ে গেল তার মুখটা। ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে! চন্দ্রভান বলে–এ গ্রামে তোমার কোন বান্ধবী নেই?

কেমন করে থাকবে বলুন? এখানে আমার বয়সী সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা সব শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেবেলায় যাদের চিনতাম এখন তারা সবাই খোকার মা! সমবয়সী আর যারা আছে এ গাঁয়ে, তারা মেয়ে নয়, এ গ্রামের বউ। তাদের গল্প আমার মত কুমারী মেয়ের সঙ্গে জমে না।

–কেন জমে না?

ঊর্মিলা মুখ তুলে আবার তাকায়। তারপর আবার মুখটা নিচু করে বেগুন গাছে গোড়া খুঁড়তে খুঁড়তে বলে, একটা কথা বলবেন সত্যি করে?

-কী?

আপনি সত্যি কি? ফুল না নেভ?

তার মানে?

তারও মানে? থাক ও কথা!

চন্দ্রভান একটু ঘনিষ্ঠ হবার জন্য বলে–তোমার সঙ্গে আমার জীবনের খুব মিল। তাই নয় ঊর্মি।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। চন্দ্রভান অপ্রস্তুত হয়ে বলে, এর মধ্যে হাসির কি হল?

না, ভাবছিলাম, লা-টা কোন্ গাঙে ডুবে মল?

 তার মানে?

-সব কথারই মানে? আমার নামের লা-টা কোথায় গেল মশাই!

 চন্দ্রভানও উঠে দাঁড়ায়। ছায়ায় সরে এসে বলে, তোমার সঙ্গে কোন সিরিয়াস কথা বলা যাবে না।

–ও! সিরিয়াস কথা বলবেন বুঝি? তা আগে বলতে হয়। কী, বলুন? ঊর্মিলাও সরে আসে ছায়ায়। গম্ভীর হয়ে তাকায়। যেন ব্রতকথা শুনছে।

বলছিলাম কি, জানো, আমারও মা নেই!

সে তো জানিই আমি!

–তুমি কেমন করে জানলে?

-বাঃ, জানব না? আপনি এখানে কত তারিখে এসেছেন খেয়াল আছে? পয়লা কার্তিক। মা থাকলে কখনও ছেলেকে অগস্ত্য-যাত্রার দিন চাকরি করতে পাঠায়।

উঃ! আশ্চর্য মানুষ তুমি! এত বার ব্রত তিথি-নক্ষত্র–

–অর্থাৎ বলতে চাইছেন, কোন বামুন বাড়ির বউ হলেই আমাকে ঠিক মানায়, তাই না? কিন্তু সে গুড়ে বালি মশাই–মুর্গী ছাড়া

হঠাৎ ওর হাতখানা ধরে ফেলে চন্দ্রভান। উত্তেজনায় সে থর থর করে কেঁপে ওঠে, বলে–সে কথা তুমি আগেও বলেছ ঊর্মি, কিন্তু আমি যদি খ্রীষ্টান হয়ে যাই

ঊর্মিলা একটুও উত্তেজিত হয় নি, কিন্তু ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, পাগলামি করবেন না চন্দ্রভানবাবু!

ম্লান হয়ে যান চন্দ্রভান। বলে, পাগলামি? কী বলছ তুমি?

ঊর্মিলা জবাব দেয় না। ধীর পদে ফিরে যায় বাড়ির দিকে। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায় চন্দ্রভান। পথ রোধ করে, বলে কিন্তু জবাবটা তুমি দিয়ে যাও ঊর্মিলা!

জবাব তো দিয়েছি আমি। আপনি তাই যদি আশা করে থাকেন, তবে ভুল বুঝেছেন। আমি অন্যপূর্বা!

ধীর পদে সে চলে যায় টালি-ছাওয়া বাড়িটার দিকে। বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্রভান। না, এ হতে পারে না, এ অসম্ভব! এ ডাহা মিথ্যা কথা।

–সেইদিনই আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়ে গেল চন্দ্রভানবাবু। আমি অনুভব করিলাম, যত মত তত পথ!

ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে গিয়েছিলেন ফাদার আঁর শারদাঁ। সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করছিলেন। ঠাকুর স্বয়ং সর্বধর্মের নির্যাস গ্রহণ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। খ্রীষ্টান ধর্মাচরণ করেছেন, সুফী ধর্মের মর্মকথা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, তন্ত্রসাধনা করেছেন, বৈষ্ণব ধর্মের রসে অবগাহন স্নান করেছেন। তারপর তিনি বুঝেছেন–যে কৃষ্ণ, সেই খ্রীষ্ট! সব পথ গিয়ে মিশেছে একই সঙ্গমে। তাই গিরীশ, নরেন, মথুরাবাবুকে তিনি ভিন্ন ভিন্ন পথে যাত্রা করতে বলেছিলেন। জানতেন, সবাই ফিরে আসবে একই সমের মাথায়। ফাদার শারদাঁ তার পথ খুঁজে নিয়েছেন। তিনি খ্রীষ্টান কিন্তু গোঁড়ামি নেই তার এক তিল!

রাত্রে বিছানায় শুয়ে সেই কথাই ভাবছিল চন্দ্রভান। জাত আর ধর্ম তো এক নয়! কী ক্ষতি হবে দুনিয়ার, সে যদি আজ খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে? এই হবে চরম প্রতিশোধ। চাবুক তার নিজের পিঠে পড়ে নি সেদিন, পড়েছিল অন্যত্র। ও নিজেও প্রতিপক্ষের উপর চাবুক চালাবে। বিসর্জন দেবে তার জাত! এতে যদি কারও পিঠে চাবুক পড়ে, তবে সে নাচার! উত্তেজনায় সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরময় পায়চারি করে। ঠিক কথা! কালই বলতে হবে ফাদার শারদাঁকে। এভাবেই সে প্রতিশোধ নেবে! পূর্বজন্মে সে যবন ছিল। ত্রিকালজ্ঞ সন্ন্যাসী জানতেন যে, ম্লেচ্ছ ধর্ম গ্রহণ তার অনিবার্য নিয়তি। তাই বলে উঠেছিলেন–যবন কাহাকা।

ম্লেচ্ছ ধর্ম! যে ধর্ম জ্ঞানবুদ্ধি মতে গ্রহণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন, গ্রহণ করেছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, যে ধর্ম নিজে আচরণ করে দেখেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তা কেন অশ্রদ্ধেয় হবে! সেন্ট জন, সেন্ট সিবেস্টিয়ান, সেন্ট পল, সেন্ট জেভিয়ার–এঁদের পূত জীবন কথা, এঁদের আত্মোৎসর্গের কথা কি শোনেন নি চন্দ্রভান? এঁদের সাধনা কি বুদ্ধ-চৈতন্য-বিবেকানন্দের চেয়ে খাটো? শিশু যীশু ক্রোড়ে মা মেরীর ছবির সঙ্গে মা যশোদা বা গণেশজননীর প্রভেদ কোথায়?

আর তাছাড়া ঊর্মিলা?

ঊর্মিলা রহস্যময়ী। সেদিন নিশ্চয়ই একটা বাজে ওজর তুলেছিল সে। ঊর্মিলা তাকে ভালবাসে। এ সত্য সূর্যোদয়ের মত স্পষ্ট। তার মনের মানুষ যদি কলকাতাতেই থাকবে তবে কেন সে ছুটির পরেও পড়ে আছে এখানে? কেন চলে যায় না কলকাতায়? আসার পর থেকে ঊর্মিলার প্রতিটি দিনের আচরণ আবার যাচাই করে নেয়। না, ভুল তার হয় নি। ঊর্মিলার প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি ইঙ্গিত একটি ধ্রুবসত্যের দিকে নির্দেশ করছে! ঊর্মিলা জানে, তাদের দুজনের মধ্যে আছে জাতের বাধা। দুরতিক্রম্য সে বাধা। তাই একটা মনগড়া বাধার সৃষ্টি করে সে চন্দ্রভানকে একটা মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চায়। চন্দ্রভানকে রক্ষা করতে চায়। তার ধর্মকে রক্ষা করতে চায়। চন্দ্রভান সব বোঝে! সে ফুলও নয়, সে নেভও নয়–সে প্রেমিক!

.

পরদিনই ঊর্মিলাকে জনান্তিকে পাকড়াও করে ফেলে। এ কদিন ঊর্মিলা রীতিমত এড়িয়ে এড়িয়ে চলছিল; কিন্তু আজ চন্দ্রভানও মরিয়া হয়ে উঠেছে। কুয়োতলাতে যেই ঊর্মিলা জল তুলতে এসেছে অমনি কলসিটা হাতে নিয়ে সেও উপস্থিত।

-তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।

ঊর্মিলা মুখ টিপে হেসে বললে, সেদিনের মত সিরিয়াস কথা নয় নিশ্চয়।

-না, বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণই! সেদিন তুমি যে কথাটা বলেছিলে সেটা বাজে ওজর, তাই নয়?

–সেদিন তো কত কথাই বলেছিলাম। ঠিক কোনটা বলুন তো?

–তুমি একটি ছেলেকে ভালবাস!

খিলখিল্ করে হেসে ওঠে ঊর্মিলা। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে, ঠাকুরমশায়ের কি হিংসে হচ্ছে না কি?

চন্দ্রভান ধমক দেয়–কী ইয়ার্কি হচ্ছে! বল, সত্যি করে বল–আমি যদি তোমাকে বিবাহ করতে চাই

ঊর্মিল হাসি থামায়। অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে সেদিনের কথাগুলিই পুনরুক্তি করে আপনি কি পাগল হয়ে গেছে চন্দ্রভানবাবু। এ সব কী বলছেন? আপনি নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণ

–সেটাই কি একমাত্র বাধা?

 আবার হেসে ফেলে। হাসি ওর একটা রোগ। বলে–তা কেন? বাধা আরও কত আছে!

আমার চেহারা কি তার মধ্যে একটা?

এতে হাসির কি আছে? আবার খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে ঊর্মিলা, বলে–ষাট বালাই! কোন্ শত্তুর এমন কথা বলে? তাই তো অগস্ত্য-যাত্রার দিন এসে হাজির।

তার মানে?

 আপনি এসেই বললেন, এই দেখ আমি পয়লা নম্বর কার্তিক।

–তুমি কি একটুও সিরিয়াস হতে পার না ঊর্মি?

সিরিয়াস কথাটা যে আপনি বিশ্বাস করছেন না। আমার সঙ্গে একটি ছেলের বিয়ে স্থির হয়ে আছে।

ফাদার শারদাঁ জানেন?

–কী পাগল আপনি! লুকিয়ে প্রেম করলে কি গুরুজনদের বলতে হয়?

এই প্রগলভা মেয়েটিকে কেমন করে বাগে আনবে বুঝে উঠতে পারে না চন্দ্রভান। ও অত্যন্ত মুখরা, লজ্জা-সরমের বিন্দুমাত্র নেই! কী নির্লজ্জের মত বললে কথাটা! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্রভান।

–তবে আপনার একটা জিনিস আছে গর্ব করবার মত!

–কী?

-আপনার কান দুটো! এত বড় বড় খরগোশের মত কান আমি কোনও ছেলের দেখি নি।

চন্দ্রভানের ডান হাতটা নিজের অজ্ঞাতসারেই চলে যায় কানের দিকে। অমনি খিলখিলিয়ে হাসির জলতরঙ্গে ভেঙে পড়ে ঊর্মিলা।

–আপনার প্রেমে না পড়লেও আপনার লম্বকর্ণ দুটির প্রেমে আমি সত্যিই পড়ে গেছি! আপনার কান দুটো আমাকে উপহার দেবেন?

চন্দ্রভান কি একটা জবাব দিতে চায়; কিন্তু তার আগেই দেখে ন’পিসিও আসছেন কুয়োতলায় জল তুলতে।

.

কিন্তু রাজী হলেন না ফাদার শারদাঁ। বললেন–কেন আপনি ধর্মত্যাগ করিতে চান তাহা আমাকে বলুন। আমি তো মনে করি হিন্দু ধর্মেও মানুষ ঈশ্বরের কাছে যাইতে পারে।

চন্দ্রভান বললে আপনিই বলেছেন, যত মত তত পথ!

না, ঠাকুর বলিয়াছিলেন!

বেশ, তাই না হয় হল; কিন্তু কে কোন্ পথে যাবে তা তো সেই বেছে নেবে। হিন্দু ধর্মের পথে যদি ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়, তবে খ্রীষ্টান ধর্মের পথেও তা যাওয়া যাবে। আমি যদি তাই পছন্দ করি?

কিন্তু আমি তো হিন্দু ধর্মের মর্মকথা বুঝিয়াও আপন ধর্ম বিসর্জন দিই নাই।

–তাতে কি হল? আমি যদি দিই, আপনার আপত্তি কোথায়? নাকি আপনি মনে করেন খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ পাপ কাজ?

বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ান। বুকের উপর ক্রুশ চিহ্ন আঁকেন। তারপর অশান্তভাবে কয়েকবার পদচারণ করে ফিরে এসে বলেন–আপনি সত্য কথা বলুন–ধর্ম ত্যাগের সহিত, পার্থিব কোন বাসনা কামনা জড়িত আছে কি?

মাথাটা নিচু হয়ে যায় চন্দ্রভানের, বলে–আছে! আপনি যদি অনুমতি করেন তবে আমি ঊর্মিলা দেবীর পাণিগ্রহণ করতে চাই।

আমিও এমত অনুমান করিয়াছিলাম। আপনি কি তাঁহার সম্মতি লাভ করিয়াছেন?

না, তার সম্মতি পাই নি এখনও। তবে আশা রাখি পাব। কিন্তু ঐ সঙ্গে এ কথাও আমি জানিয়ে রাখতে চাই ফাদার, আমার এ সিদ্ধান্ত তার অনুমতিসাপেক্ষ নয়। ধর্মজীবনটা আমার নিজের, কর্মজীবনটাই অপরের অনুমতিসাপেক্ষ। তিনি শেষ পর্যন্ত আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি মর্মাহত হব নিশ্চয়, কিন্তু তাতে আমার খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত বদলাবে না।

আপনি প্রকৃত তত্ত্ববিজ্ঞানীর মত কথা বলিয়াছেন। কিন্তু একটা কথা

সরল সাধক মানুষটি এবার যা বললেন তা রীতিমত সংসারভিজ্ঞের মত। তাঁর বিচিত্র ভাষায় চন্দ্রভানকে বুঝিয়ে দিলেন–আইনতঃ তিনি মিস্ ঊর্মিলা শারদাঁর অভিভাবক নন। ঊর্মিলার বয়স ষোলো বৎসর তিন মাস। সে সাবালিকা হবার পর অবশ্য তাকে পিতার অনুমতির অপেক্ষায় থাকতে হবে না। সুতরাং আগামী দুবছর চন্দ্রভানকে অপেক্ষা করতেই হবে। দ্বিতীয়তঃ, চন্দ্রভান জমিদারের ছেলে। ধর্মান্তর গ্রহণ করলে সে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এ কথাটাও যেন সে ভেবে দেখে। তৃতীয়তঃ, গার্হস্থ্যজীবনে প্রবেশ করার আগে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। উপার্জনক্ষম হতে হবে। জীবনে তার লক্ষ্য কী তা স্থির করতে হবে। চতুর্থতঃ, খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে হলে তাকে ঐ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন পাদরির দ্বারস্থ হতে হবে। ফাদার শারদাঁ সে অধিকার থেকে বঞ্চিত।

চন্দ্রভান এবার দৃঢ়স্বরে বলে-ফাদার! আপনি যদি নিজে আমাকে ব্যাপটাইস না করেন তবে বুঝব খ্রীষ্ট-প্রচারিত ধর্মও আমাদের বার ব্রত তিথি-নক্ষত্রের বেড়াজালে আটকানো হিন্দুধর্মের মতই একটা পঙ্কিল ধর্ম! তাহলে আমি খ্রীষ্টান হতে চাই না!

বৃদ্ধ দুই হাত প্রসারিত করে বললেন–আপনি ক্ষান্ত হন। আপনি আমাকে গভীর সমস্যায় নিক্ষেপ করিয়াছেন। But you are downright correct! আপনি আমাকে একদিন সময় দিন। আমি বিবেচনা করি।

চন্দ্রভান অভিবাদন করে বেরিয়ে আসছিল। তাকে ফিরে ডাকলেন ফাদার শারদাঁ; বললেন-আপনিও একটি দিন আপনার নিজের সহিত বোঝাপড়া করুন। দেখুন, এ আপনার অন্তরের নির্দেশ কিনা।

পুনরায় অভিবাদন করে বেরিয়ে এসেছিল চন্দ্রভান।

নিজের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি।

দাঁড়ান!

চন্দ্রভান মুখ তুলে দেখেছিল আজ ঊর্মিলাই দাঁড়িয়ে আছে তার পথরোধ করে। আজ আর সে ছলনাময়ী প্রগলভা মেয়েটি নয়। চন্দ্রভান বললে, কিছু বলবে?

-হ্যাঁ! কেন আপনি খ্রীষ্টান হচ্ছেন?

আড়াল থেকে সবই শুনেছ আশা করি।

–শুনেছি। আপনি কিন্তু ভুল করছেন। এভাবে নিজেকে ঠকাবেন না। যীসাকেও ঠকাবেন না।

-কি বলতে চাইছ ঊর্মিলা?

 –বলতে চাইছি, আপনি ধর্মের জন্য ধর্মত্যাগ করছেন না, করছেন

–শেষ কর! তোমার জন্য! তাই নয়?

কিন্তু আমাকে আপনি পাবেন না, এটা জেনে রাখুন।

–এ কথা তুমি আগেও বলেছ ঊর্মিলা। দুটো কথা আমি বলব। প্রথম কথা, যদি তোমার জন্যই আমি আজ ধর্মকে ত্যাগ করি, তাতে প্রমাণ হয় তোমাকে আমি কতটা ভালবাসি। দ্বিতীয় কথা, আমি বিশ্বাস করি প্রেম বিশ্বজয় করতে পারে–তুমি তো সামান্য একটা মেয়ে।

হাসির উৎস বুঝি ফুরিয়ে গেছে প্রগলভা মেয়েটির। হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলেনা, না, এ হবার নয়, বিশ্বাস করুন! পাগল! আপনি বদ্ধ পাগল!

ফাদার শারদাঁ শেষ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন। দীক্ষা দিলেন চন্দ্রভানকে। ওর ক্রিশ্চান নাম হল ভিন্সেন্ট। গোটা নামটা মস্ত বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে শারদাঁ বললেন, নাম হোক ভিন্সেন্ট চন্দ্র গর্গ। ব্যবস্থাটা ভাল লাগে নি চন্দ্রভানের। বলেছিল, ওর  ভাইয়ের নাম সূরযভান, ভাইয়ের সঙ্গে যোগসূত্রটুকু ছাড়তে রাজী হল না। তাই ওর নতুন নাম হল ভিন্সেন্ট ভান গর্গ!

ফাদার শারদাঁ শেষ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন, পারল না ঊর্মিলা।

চন্দ্রভান যেদিন দীক্ষা নিল সেইদিনই সে তড়িঘড়ি ফিরে গেল কলকাতায়।

ফাদার শারদাঁর যুক্তিটা মেনে নেয় ভিন্সেন্ট। ঊর্মিলাকে সময় দিতে হবে। শারদাঁ বলেছিলেন, এক্ষেত্রে যতদিন না ঊর্মিলা সাবালিকা হয় ততদিন ভান গর্গকে অন্তরালে সরে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে সে যেন তার জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক করে নেয়। ঈশ্বর ওকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন বিশেষ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। কী সে উদ্দেশ্য তা নিজেকেই বুঝে নিতে হয়, খুঁজে নিতে হয়।

ভিন্সেন্ট বললে, মানুষের বড় দুঃখ। আমি ঐসব দুঃখী মানুষদের সেবা করতে চাই। প্রকৃত সেবাব্রতী খ্রীষ্টানের মত। আপনার মত। আপনি আমাকে সুযোগ করে দিন শুধু। আমি খ্রীষ্টধর্মের প্রচারে আত্মনিয়োগ করতে চাই।

–এ অতি উত্তম প্রস্তাব; কিন্তু প্রভু যীশুর ধর্ম প্রচার করিবার পূর্বে আপনাকে সে কার্যের উপযুক্ত হইতে হইবে।

ছবি আঁকার আগে জমি তৈরী করতে হয়। ফাদার শারদাঁ বসলেন ওকে নিয়ে সেই কাজে।

ঊর্মিলা কলকাতায় ফিরে এসেছে। চন্দ্রভান রাত থাকতে ওঠে। প্রদীপ জ্বেলে পড়তে বসে। বাইবেল, খ্রীষ্টধর্মের বিষয়ে নানান গ্রন্থ, সন্ত মার্ক লিখিত সুসমাচারে প্রভু যীশুর জীবনী, এমন কি মেরী বেকার এডি লিখিত ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্সের গ্রন্থ। খ্রীষ্টধর্মের ইতিহাস, রোমান ক্যাথলিক ধর্মের সঙ্গে মার্টিন লুথারের মতবিরোধ, জার্মান হল্যাণ্ড-স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান চার্চ-সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ, প্রটেস্টান্ট ধর্মের জন্ম, চার্চ-অব ইংল্যাণ্ডের আবির্ভাব, এবং তারপর আবার নূতন নূতন চিন্তাধারা–জর্জ এক্স-প্রবর্তিত সোসাইটি অফ ফ্রেণ্ডস বা কোয়েকারস। জন ওয়েসলে-প্রবর্তিত মেথডিসম, নন্ কনফার্মিস্ট ফ্রি-চার্চগুলির বক্তব্য–সবই একে একে ধারাবাহিকভাবে মুখে মুখে শিখিয়ে গেলেন শিষ্যকে। বলেন, খ্রীষ্টধর্মের ভিতর যুগে যুগে অন্যায়-পাপ-সংকীর্ণতা-অবিচার প্রবেশ করেছে, আর যুগে যুগে উদারনৈতিক ধর্মপ্রচারকের দল সেই ক্লেদ দূরীভূত করে চার্চকে নিষ্কলুষ করে গেছেন। বলতেন, মনে রাখবেন, ধর্মের সবচেয়ে বড় কথা ক্যাথলিসিটি-উদারতা, পরধর্মসহিষ্ণুতা। তাই প্রভু যীশুর বাণী প্রচার করতে হলে আপনাকে জানতে হবে অপর ধর্মের কথাও। তাই শেখাতেন অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের জীবনী ও বাণী। গৌতম বুদ্ধ ও জৈন তীর্থঙ্করদের কাহিনী শোনাতেন ব্রাহ্মণ সন্তান চন্দ্রভান গর্গকে শেখালেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূল তত্ত্ব–সাঙ্খ্য, বেদান্ত, উপনিষদের বক্তব্য। শোনালেন কোরাণের হজরত মহম্মদ ও আবুবকরের সংগ্রামের ইতিকথা, কনফুশিয়াস আর লাও-সে প্রবর্তিত ধর্মের বাণী। আর সব শেষে বললেন,আপনি ঠাকুর রামকৃষ্ণের ঐ কথাটি কখনও ভুলবেন না–যত মত তত পথ!

চন্দ্রভান জিজ্ঞাসা করেছিল,–আমি যদি বাওয়ালীতে থেকেই কাজ করি, তাতে ক্ষতি কি?

কিন্তু এ ব্যবস্থাপনায় ফাদার শারদাঁ রাজী হতে পারেন নি। বলেন, এ-গ্রামে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কোন পরিকল্পনা তার নেই। তিনি এখানে সম্পূর্ণ নূতনভাবে একটি পরীক্ষাকার্য করতে চান। তাছাড়া ঊর্মিলা প্রতি ছুটিতে বাওয়ালীতে আসে। চন্দ্রভান ওর দৃষ্টির অন্তরালে থাকুক, এটাই ফাদার শারদাঁর ইচ্ছা। বলেন, আমি পনের বৎসর পূর্বে আসানসোলের নিকটে একটি কয়লাখনিতে খ্রীষ্টধর্মের প্রচার করিতাম। আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি আসানসোল মেথডিস্ট চার্চের রেভারেণ্ড মার্লোকে একটি পরিচয়পত্র দিতে পারি। কয়লাখনির মানুষগুলি বড় দুঃস্থ, বড় অসহায়। ঈশ্বরের আশীর্বাদ তাহাদের নিতান্ত প্রয়োজন।

চন্দ্রভান রাজী হয়ে যায়।

তার ক্যাম্বিসের ব্যাগ আর বিছানার বাণ্ডিলটা বগলে নিয়ে একদিন সে রওনা হয়ে পড়ে আসানসোলের উদ্দেশে। পাঠাশালার পড়ুয়ার দল সার দিয়ে দাঁড়াল ওকে বিদায় জানাতে। ন’পিসি রাধাগোবিন্দজীর প্রসাদী ফুলটা গুঁজে দিলেন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারকের বুক পকেটে; আর ভিন্সেন্ট ভান গর্গ তার ধর্মগুরুর কাছে বিদায় নিল তার পায়ের ধুলো মাথায় তুলে নিয়ে। রেভারেণ্ড অর শারদাঁ এতে বিসদৃশ কিছু দেখলেন না–চরণ দুটি সরিয়ে নিলেন না, বরং বলিরেখাঙ্কিত দুটি হাত ওর মাথায় রেখে আশীর্বাদ করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *