আবার যদি ইচ্ছা কর – ১২

১২.

এরপর আবার বেশ কিছুদিন ওদের খবর পাই না। বরাহনগরের বস্তীতে আমি খোঁজ নিতে যাইনি। যোগেশ মিত্র রোডেও যাইনি। হগমার্কেটে একদিন বিকেলের দিকে কি একটা কাজে গিয়েছিলাম। বটুকের দোকান বন্ধ ছিল। পাশের দোকানদার জানিয়েছিল–আজ দীর্ঘদিন ধটুক দোকানে আসছে না। ওদের সম্বন্ধে কৌতূহল ছিল ঠিকই, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। পরে অবশ্য জেনেছিলাম যে কদিন ঐ বস্তীতে ছিল তার ভিতর বটুক কোন ছবি আঁকেনি। বোধহয় মন বসাতে পারেনি। আর সে ওখানে রাতটুকুই থাকত শুধু। সকালবেলা উঠে চলে যেত ভবানীপুরে। নিজের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে থাকত সারাদিন। গগন বাড়ি থেকে আদৌ বার হত না। দৈনিক বাজারটা পর্যন্ত করত সুলেখা। দু-একবার বটুক তার পিছনে পিছনে ঘুরেছে। সুলেখা তাকে যেন চিনতেই পারেনি। আজকের কলকাতা শহর নয়। সে আমলে বাড়ির মেয়েরা জগুবাবুর বাজারে থলি-হাতে বাজার করতে আসার কথা কল্পনাই করতে পারত না। তাই ঐ বাঙালি মেয়েটাকে সকলেই চিনে ফেলেছিল। পথের মাঝখানে ওর সঙ্গে কথা বলতে সাহস পেত না বটুক। তবু একদিন সুযোগ বুঝে বাড়ির সামনেই বটুক সুলেখার হাত চেপে ধরেছিল। তাকে ক্ষমা করতে বলেছিল। সুলেখা শুধু হাতটা ছাড়িয়েই নেয়নি, বটুককে একটি চড় বসিয়ে দিয়েছিল। কোন কথা বলেনি সে।

এ সব কথা আমি জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে। সুলেখার মৃত্যুর পরে। চিরকাল যেভাবে বিনিয়ে-বিনিয়ে গল্প করত বটুক সেইভাবেই শুনিয়েছিল আমাকে। দু চোখের জলে ভাসতে ভাসতে, শ্মশানঘাটে বসে। আমাদের চোখের সামনেই জ্বলছিল চিতাটা। ভবানীপুর অঞ্চলে কয়েকজন শ্মশানযাত্রীও ছিল। তারা বসেছিল একটু দূরে। ওখান থেকেই হতাশ-প্রেমিক বটুককে লক্ষ্য করছিল তারা। বটুকেশ্বরের কীর্তিকাহিনীর কথা জানতে বাকি ছিল না কারও।

ব্যাপারটা নিয়ে আমি পরে অনেক চিন্তা করেছি। কেন সুলেখা এমন কাণ্ডটা করল! গগ্যার প্রতি তার তীব্র ঘৃণা সত্ত্বেও কেমন করে সে তার কাছে ধরা দিল; আর বটুকের প্রতি তার মমতা, তার ভালবাসা কিভাবে একেবারে নিঃশেষিত হয়ে গেল! বোধহয় ভুল বুঝেছিলাম আমরা, সুলেখা গগ্যাকে ঘৃণা কোনদিনই করেনি, করেছে ভয়। আর সেই

আতঙ্কের উৎসমুখে ছিল সে নিজেই। অর্থাৎ সুলেখা গগ্যাকে ভয় করেনি, করেছে। নিজেকে। আমরা তার মুখ ফিরিয়ে থাকাটা শুধু দেখেছি কিন্তু সুলেখার অবচেতন মন জানত, কেন সে অমন প্রবলভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে চায়। চুম্বক যেমন জানে সমধর্মী চুম্বকের দিক থেকে ছিটকে সরে আসতে হবে তাকে কারণ ঐ চুম্বকখণ্ডের বিপরীত মেরুর আকর্ষণকে সে ভয় করে। গগ্যা যেমন তার নিশ্চিন্ত নির্ভর পুরনো পল্টনের বাসা ছেড়ে অজানার আকর্ষণে একদিন ছুটে বেরিয়ে এসেছিল, সুলেখার অন্তরাত্মাও তেমনি কেন্দ্ৰাতীগ বেগে সব কিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল। সুলেখা জানত, তার অতৃপ্ত কামনা বাসনাযা মিটিয়ে দেবার ক্ষমতা ছিল না বটুকের–একমাত্র তৃপ্ত হতে পারে ঐ লোমশ দানবটার কাছে। ঠিক সচেতনভাবে হয়তো জানত না; কিন্তু সে এ সত্যটা প্রতি রোমকুপ দিয়ে অনুভব করেছিল নিজের অজান্তেই। তাই ঐ চুম্বককণ্ডের বিপরীত মেরুটাকে তার ভয়। তাই ও বারে বারে মুখ সরিয়ে নিয়েছে। গগনকে ভবানীপুরের বাসায় নিয়ে আসার প্রস্তাবে সে দৃঢ় প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু বটুক শোনেনি। গগ্যাকে বটুক ভয় পায়নি–বোকাটা শুধু সুলেখার বিকর্ষণী মনোভাবেই নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিল। তারপর কখন কী ভাবে চুম্বকখণ্ডটা পাশ ফিরেছে জানা নেই। দক্ষ নার্সের মত নিরলস নিষ্ঠায় কাজ করে গেছে সুলেখা। ওর মুখের কাছে ধরেছে ফিডিং কাপ, বাঁ হাতে হয়তো ওর মাথাটা চেপে ধরেছে বুকে। ওর লোমশ হাত-পা স্পঞ্জ করিয়ে দিয়েছে। জামা কাপড় পালটে দিয়েছে। আঁচড়ে দিয়েছে ভিজে চুল, মুছিয়ে দিয়েছে দাড়ি। হয়তো সুলেখা নিজেও টের পায়নি, কখন সঙ্গোপনে ঐ চুম্বকখণ্ডের পাশ পরিবর্তন হল। কিন্তু তখন আর তার পালাবার পথ ছিল না। তখন সে নিরুপায়। সুলেখা তখন কামিনী নয়, কামনা!

সুলেখার মৃত্যুর কথাটা বলি।

তখনও ভাল করে সকাল হয়নি। আমি ঘুমোচ্ছিলাম। আমাকে ডেকে তোলা হল। নিচে কে ডাকছে। জরুরী ডাক। ডাক্তার মানুষের এসব বিড়ম্বনা নিত্যকর্মপদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। ভাবলাম আমার রুগীদের মধ্যে নিশ্চয় কারও নাভিশ্বাস উঠেছে। চটিটা পায়ে দিয়ে নিচে নেমে এসে দেখি, বটুক। বললে, দীপু, সর্বনাশ হয়েছে! ও আত্মহত্যা করেছে!

তারপরে আরও কতকগুলো শব্দ ও বলে গেল। ওর ঠোঁট দুটিই নড়ছিল কথা কিছু বার হয়নি। নিতান্ত একটা বোবা ভাঁড়ের মত সে হাত-পা নেড়ে কি একটা বোঝাতে চাইছে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না। আমার হঠাৎ ভীষণ রাগ হল। ওর কাধ ধরে একটা ঝকানি দিয়ে বলি, কী বলছিস আঁও আঁও করে? কী হয়েছে ঠিক করে লে! কে আত্মহত্যা করেছে?–যদিও আমি বুঝতে পেরেছিলাম কার কথা বলছে সে।

ও ধপ্ করে বসে পড়ে একখানা চেয়ারে। আমার বাহুল্য প্রশ্নটার জবাব সে দিল না। বললে, কাল রাত্রে। গগ্যা কাল সকালেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে!

কিভাবে আত্মহত্যা করেছে?

–বিষ খেয়ে!

কতক্ষণ আগে মারা গেছে?

–না, মারা যায়নি, এখনও বেঁচে আছে।

 –তাহলে পাগলের মত কী বকছিস এতক্ষণ? কোথায় আছে সে? ভবানীপুরে?

না, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।

–একটু বস্। আমি জামা-জুতো পরে আসি। ওখানকার সব ডাক্তারই আমার চেনা। দাঁড়া, গাড়িটা বার করি।

আমি জামা-জুতো পরে নিতে নিতেই বটুক দুচারটে অসংলগ্ন কথা বলে গেল। যা থেকে মোটামুটি বুঝতে পারি–খবরটা প্রথম টের পায় দ্বিতলবাসী ভাড়াটে। কাল সকালে নাকি গগ্যা আর সুলেখা ঝগড়া করে। তারপর গগ্যা তার জামাকাপড় বেঁধে নিয়ে কোথায় চলে যায়। সুলেখা রাতে একাই ছিল বাড়িতে। সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে। মাঝরাতে একটা গোঙানির শব্দ শুনে ওঁরা প্রতিবেশীদের ডেকে তোলেন। বটুক দরজা ভেঙে ফেলতে চায়

–তুই ওখানে অত রাত্রে কোথা থেকে এলি?

-ঝগড়াটা কাল সকালে যখন হয় তখন আমি ঐ চায়ের দোকানেই ছিলাম। গগ্যা চলে গেল তা আমি দেখেছি। তারপর আমি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ি-সুলেখা খুলে দেয়আমাকে দেখে থাক সেকথা! মোট কথা আমি আর বরানগরে ফিরে যাইনি। ঐ চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চেই রাত্রিটা

দরজা ভেঙে এঁরা দেখতে পান যন্ত্রণায় সুলেখা কাতরাচ্ছে! খাটের উপর থেকে আধখানা দেহ ঝুলে পড়েছে তার। সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল সুলেখার। ওঁরা পাশের বাড়ি থেকে একজন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এলেন। তখনই অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেওয়া হল। সুলেখা বিষ খেয়েছিল। জিভটা তার বিশ্রীভাবে পুড়ে গেছে। কিন্তু তখনও সে কথা বলতে পারছিল।

-তোকে কিছু বললে?

বটুক মুখটা নিচু করে। তারপর আবার আমার মুখের দিকে তাকায়। বলে, –ও আমাকে চলে যেতে বললে! ডাক্তারবাবু আমাকে ওর সামনে থেকে সরে যেতে বললেন।আমি বাইরের ঘরে সরে এলাম। অ্যাম্বুলেন্স যখন এল, তখন আমাকে ওরা রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকতে বলল। আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম।

ইতিমধ্যে আমি তৈরী হয়ে নিয়েছি। প্রতিবেশীদের তাড়া খেয়ে বটুক কখন কোথায় লুকিয়ে ছিল শোনার ধৈর্য ছিল না আমার। বলি, -চ, হাসপাতালে চল্।

শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের একটি কেবিনে সুলেখাকে রাখা হয়েছে। ওখানকার ডাক্তার-নার্স অনেকেই আমাকে চেনে। রোগীকে দেখতে কোন অসুবিধা হল না। কিন্তু বটুককে ওরা কেবিনে যেতে দিল না। নার্স বললে, -ডাক্তারবাবুর বারণ আছে। ওঁকে দেখলেই উনি উত্তেজিত হয়ে উঠবেন।

বটুক ওয়ার্ড অ্যাটেণ্ডেন্টের টুলে বসল। বললে, তুই বরং দেখে আয়। জিজ্ঞাসা করিস, গগ্যাকে দেখতে চায় কিনা। সে হতভাগা কোথায় তা অবশ্য জানি না; কিন্তু লেখা যদি চায়…

আমরা এগিয়ে যাই। সুলেখার জ্ঞান ছিল। কথা বলছিল না। মুখটা পুড়ে গেছে। আমাকে দেখে চিনতে পারল। চোখ দুটি বন্ধ করল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, -খুব কষ্ট হচ্ছে?

সুলেখা জবাব দিল না। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

 আবার বলি, বটুক এসেছে। বাইরে বসে আছে। তাকে ডাকব?

না, না, না! আমাকে শান্তিতে মরতে দিন!

বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। নার্স বললে, –অক্সালিক অ্যাসিড। বাঁচবে না নিশ্চয়। তবে দু-তিন দিন বেঁচে থাকবেন বোধহয়। ডাক্তারবাবু বিকেলে আসবেন। পুরো ব্যাপারটা তখন এলে জানা যাবে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ডান হাতে ব্যাণ্ডেজ কেন?

সিস্টার বললে, কি জানি! ওঁর ডান হাতের তালুতে বিরাট একটা ফোস্কা পড়েছে। পুড়ে গেছে। কেমন করে জানি না। সে একটা মিস্ট্রি!

বলি, অজ্ঞান হয়ে যাবার পর ওর হাতটা জ্বলন্ত কোন কিছুর উপর পড়েছে নিশ্চয়।

না! যাঁরা ওঁকে রেসকিউ করেন তাঁরা বলেন, তেমন কোন জ্বলন্ত জিনিস ছিল না ওঁর হাতের কাছে-পিঠে! অজ্ঞানও উনি হননি!

এ রহস্যের সমাধান হয়নি। ও কি গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল? তাহলে সারা গায়ে আর কোথাও তো আগুন লাগেনি? শুধু হাতটা পুড়ল কেমন করে? যেন মনে হয়–সে হাতের তালুতে একখণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে মুঠা করেছিল; অথবা প্রদীপের শিখায় পুরো এক মিনিট ধরে রেখেছিল হাতখানা। কেন? সুলেখা তার জবাবদিহি করে যায়নি।

কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই বটুক বললে, ঘরে আর কে ছিল?

আর কে থাকবে?

–তবে আমাকে শান্তিতে মরতে দিন বলল কে?

সিস্টার বললে, উনিই বলেছেন। ওঁর ভোকাল কর্ডটা জ্বলে গেছে কিনা, তাই স্বরটা আপনি চিনতে পারেননি।

বটুক শুধু বললে, -ও!

তৃতীয় দিনে সুলেখা মারা গেল। গগন কোথায় আমরা জানতাম না। তাকে খবর দেওয়ার উপায় ছিল না। খবর পেলেও সে আসত কিনা সন্দেহ। বটুকের স্ত্রীর পরিচয়ে হিন্দু মতেই ওর সৎকার হল। বটুকই মুখাগ্নি করল।

চিতায় জল ঢেলে দিয়ে বললাম, চ, আমার বাড়িতে চল্।

বটুক রাজী হল না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সদর দরজার চাবিটা বার করে সে। একদৃষ্টে খানিকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বললে, না, আমি বাড়ি যাব।

-আমি আসব তোর সঙ্গে?

না, আমি একাই যেতে চাই। একটু একলা থাকতে চাই।

যোগেশ মিত্র রোডের মুখে ওকে নামিয়ে দিয়ে আমি ফিরে এলাম।

দিন-সাতেক পরে বটুক এসে আমার সঙ্গে একদিন সন্ধ্যায় দেখা করল। এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে সে। শ্মশান-বৈরাগ্যেই বোধহয়, মনের সাম্য ফিরে পেয়েছে। কথা বলল পরিষ্কারভাবে, অসংলগ্ন কাটা কাটা ভাষায় নয়। বললে, এতদিনে কলকাতার বাস তুলে দিয়ে সে দেশে ফিরে যাবে বলে স্থির করেছে। ওর বাবা এখনও জীবিত। তার কাছেই ফিরে যাবে। ও আশা করছে বাপ-মা ওকে ক্ষমা করবেন। দোকান সে বিক্রি করে দিয়েছে। ওর ছবি আর ফার্নিচার একটি নিলামওয়ালার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ তাকে বরিশালের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ছবিগুলো দিলি কেন?

–ছবি আঁকা ছেড়ে দিলাম যে! বাবার মহাজনী কারবার দেখব এবার থেকে।

অর্থাৎ আমার তিন আর্টিস্ট বন্ধুর একজনের মৃত্যু হল। চন্দ্রভান, গগ্যা আর বটুকেশ্বর–আমার তিন সহপাঠী বন্ধুই ছবি আঁকতে চেয়েছিল। চন্দ্রভান আর গগ্যা এখন কোথায় কি করছে জানি না; কিন্তু আর্ট স্কুলের পাস করা বন্ধুটি এতদিনে খসে পড়ল এ প্রতিযোগিতা থেকে।

বটুক কাগজে-মোড়া একখানা ছবি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, –এখানা তোর জন্যে এনেছি। এটা দেখলে আমার কথা মনে পড়বে।

ক্রুশবিদ্ধ যীশু! যেখানা বড়দিনে সে সুলেখাকে উপহার দিয়েছিল।

আমি বলি, –তোর নিলামদারের নাম-ঠিকানা বল্। আরও একখানা ছবি কিনতে হবে আমাকে

–কোনখানা? পূজারিণী?

না। সেই ডাচেস অফ-আলভার পোজে আঁকা ছবিখানা। সেই বেনারসী পরে শুয়ে থাকা ছবিটা। যেটা প্রাইজ পেয়েছিল।

বটুক মুখটা নিচু করে আস্তে আস্তে বললে, –সেখানা নেই। নষ্ট করে ফেলেছি।

নষ্ট করে ফেলেছিস? বলিস কি রে! কেন?

বটুক জবাব দিল না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মনে হল সে কিছু একটা কথা বলতে চায়; কিন্তু মনস্থির করে উঠতে পারছে না। তারপর সে বোকার মত হেসে উঠল।

-কি হল, হাসছিস যে?

–তুই রাগ করবি না বল?

রাগ করব কেন? কি করেছিস তুই?

কাল গগ্যার ওখানে গিয়েছিলাম। ওর বরানগরের বস্তীতে।

শেষ বিদায় জানাতে এসেছে বটুক। না হলে আমি ওকে উঠতে বলতাম। এত কাণ্ডের পরেও বটুক যে বন্ধুকৃত্য করতে গগ্যার ওখানে যেতে পারে এ আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। তাই বটুক বললে, –তুই তো আগেই বলেছিস, আত্মসম্মানজ্ঞান বলে আমার কিছু নেই। তাহলে আজ আবার নতুন করে চটছিস কেন?

সেই চিরন্তন বিদূষক!

–গগ্যার কাছে কেন গিয়েছিলি? বিদায় জানাতে?

না, ওর আঁকা একখানা ছবি ফেরত দিতে।

–ওর?

–হ্যাঁ। শোন তাহলে বলি।

বটুক অতঃপর একটা বিচিত্র কাহিনী শুনিয়েছিল আমাকেঃ

শ্মশান থেকে ফেরার পথে সেদিন আমি যখন যোগেশ মিত্র রোডের মোড়ে বটুককে নামিয়ে দিয়ে গেলাম তখন বাড়ির দিকে যেতে ওর পা সরছিল না। কত দিনের কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার উপরের দিকে তাকায়। দ্বিতলে আলোগুলো নেবানো। দ্বিতলের ভাড়াটে নিশ্চয় কোথাও বেরিয়েছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল তার-না হলে প্রতিবেশীর সান্ত্বনায় উত্যক্ত হতে হত ওকে। নিঃশব্দে তালা খুলে ঘরে ঢোকে। বাইরের ঘরে ঢোকে। বাতিটা জ্বালে না। যেন নিজের বাড়িতেই চুরি করতে ঢুকেছে–প্রতিবেশীরা যেন টের না পায়! দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়। ঘরে প্রতিটি আসবাবের অবস্থান তার মুখস্থ। রাস্তায় আবছা আলোয় অল্প অল্প নজর চলছে। বটুক ওর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। এ-ঘরে পাশের বাড়ির থেকে আলো বেশ আসছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। যেখানে যা ছিল সব আছে। বিশৃঙ্খলার। আভাসমাত্র নেই। শুধু বিছানার চাদর এলোমেলো। কিন্তু ও কি? ওদের জোড়া খাটে তো দু-জোড়া বালিশ নেই! আলোটা জ্বেলে দেয় সে এবার। না। ওদের ডবল বেডের খাটে শুধু একটাই বালিশ! বটুক ছুটে এসে এবার বাইরের ঘরের আলোটা জ্বালে। কী আশ্চর্য! বাইরের ঘরের খাটে একটা বিছানা পাতা। বটুক বসে পড়ে খাটের প্রান্তে। কেন এমন হল? ওরা কি ঝগড়া করেছিল? শেষ দিকে ওরা কি আলাদা বিছানায় শুতো? না কি বরাবর সুলেখা ও-ঘরে একলা শুয়েছে? সেটা অবিশ্বাস্য–তবু জলে-ডোবা মানুষ যেভাবে ভাসমান খড়কুটোর দিকে হাত বাড়ায় তেমনিভাবে বটুকের মনে হল-গগ্যা কোনদিনই ওর খাটে এসে শোয়নি। সুলেখা ঐ বর্বরটাকে ঢুকতেই দেয়নি ওদের শোবার ঘরে। আপন মনে হেসে ওঠে বটুক। খুশিয়াল হয়ে ওঠে।

আলনায় সুলেখার শাড়ি সায়া-জ্যাকেট। জুতোর র‍্যাকে তার জুতো আর চটি। বটুক রান্নাঘরে গিয়ে একবার উঁকি মারল বাসনপত্র সব সাজানো আছে। ঝি আসত বিকেল বেলায়। তাহলে সে রাত্রে লেখা কিছুই খায়নি। না হলে এঁটো বাসনটা থাকত। রান্নাও হয়নি সেদিন। উনানে ছাই নেই। তার মানে শেষ দিনটা শুধু মনের সঙ্গে লড়াই করেছে সুলেখা। রান্না-খাওয়ার কথা মনেই আসেনি তার। আর কেমন করে তা আসবে? মৃত্যু যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে তার কি রাঁধার কথা মনে থাকে?

হঠাৎ বটুকের নজরে পড়ল টেবিলের উপর একটা মোমবাতি খাড়া করে বসানো রয়েছে। মোম গলে গলে পড়েছে। ওদের বাড়িতে বিজলি বাতি আছে। শেষ দিন কি আলো ফিওজ করেছিল? না হলে মোমবাতি জ্বেলেছিল কেন সুলেখা? ঝুঁকে পড়ে দেখল মোমবাতির সলতেটা মোমের মধ্যে ঢুকে গেছে, সেটা থেতলে গেছে–যেন জ্বলন্ত অবস্থায় সেটা কেউ উপর থেকে চাপড় মেরে নিবিয়ে দিয়েছে। এ রহস্যের কোন কিনারা করতে পারল না বটুক।

আশ্চর্য, সবই আছে কিন্তু সব কিছুই আজ নিরর্থক।

 হঠাৎ দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বটুক, –লেখা! লেখা!

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। দ্বিতলের বাসিন্দা বোধহয় ফিরলেন। চট করে বাতিটা নিবিয়ে দিল বটুক। ওঁরা উঠে গেলেন। বটুক আবার চলে আসে বাইরের ঘরে। এখন এ-ঘর ওর! কেউ বাধা দেবার নেই! কেউ এসে বলবে না–আর কত বেলা করবে, এবার ওঠ! স্নান করগে যাও! কেউ এসে ওর হাত থেকে তুলি কেড়ে নিয়ে ধমকাবে না রাত কত হল খেয়াল আছে! চোখের মাথাটা না খেলেই নয়! চোদ্দ বছর পর আজ সে একা!

ওপাশে থাক দিয়ে রাখা আছে ওর আঁকা ছবি। যীশুখ্রীষ্টের ছবির তলায় পোড়া ধূপকাঠি আর ছাই। হঠাৎ বটুকের নজর পড়ল ঘরের ও-প্রান্তে একটা বড় ক্যানভাসের দিকে। ছবিটা দেওয়ালে ঠেসান দেওয়া; দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বড় সাইজের ক্যানভাস। এতবড় ছবি কোনটা? ওর মনে পড়ে না। সে উঠে এসে ছবিটা তুলে বসিয়ে দেয় চৌকির প্রান্তে। একটু দূরে সরে গিয়ে তাকিয়ে দেখে।

তৎক্ষণাৎ বটুকের মাথার মধ্যে টলে উঠল। সুলেখা যেমন টলতে টলতে পড়ে যেত ফিট হবার সময় তেমনি করেই ও বসে পড়ে একটা চেয়ারে। একটা আর্ত চিৎকার তার কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসতে চায় কিন্তু স্বর ফোটে না তার মুখে। ওর হাত পা যেন অসাড় হয়ে যায়।

ওর থেকে হাত চারেক দূরে খাটের উপর খাড়া করে রাখা আছে একটা ক্যানভাস। এইমাত্র যেটা সে নিজেই বসিয়েছে। ছবিটা বটুকের আঁকা নয়। ছবিটা এ বাড়িতে ছিল না। ছবিটা একটা ন্যুড! যে পোজে সুলেখার ছবি এঁকে সে প্রাইজ পেয়েছিল অবিকল সেই ভঙ্গিমায় মেয়েটি শুয়ে আছে। শুধু কল্কাপাড় বেনারসী শাড়িখানা অন্তর্হিত! ডাচেস অফ আলভা নয়–লেখা, দি ন্যুড!

হঠাৎ হিংস্র শ্বাপদের মত লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। লেখা নেই, গগ্যা নেই, কিন্তু ঐ ছবিখানা আছে! ওর সমস্ত আক্রোশ ফেটে পড়ল ঐ ছবিখানার উপর। ঐ ক্যানভাসখানা ফালা ফালা করে ছিঁড়ে না ফেলা পর্যন্ত ওর আত্মা শান্ত হবে না। ও হাত বাড়িয়ে ধারালো একটা কিছু খুঁজতে থাকে। ঐ নগ্নিকার নরম বুকের মাঝখানে ওকে এখনই বসিয়ে দিতে হবে তীক্ষ্ণ একটা শলাকা! সেই হবে ওর চরম প্রতিশোধ! বটুকের হাতে ঠেকল একটা পেন্সিল কাটা ছুরি। উন্মত্ত ঘাতকের মত সেখানা নিয়ে সে এগিয়ে এল

দৃশ্যটার বর্ণনা করছিল বটুক আমার টেবিলের অপর প্রান্তে বসে। উত্তেজনায় সে থরথর করে কাঁপছিল। যেন সে রাত্রে ঘটনাটা সে আবার সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করছে। যেন সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে তার ব্যভিচারিণী স্ত্রীর নিলজ্জ উলঙ্গ দেহটা। হঠাৎ সে আমার টেবিল থেকে তুলে নিল একটা পেন্সিল কাটা ছুরি। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ওঠালো–ঠিক যে ভঙ্গিতে বোধকরি সে সেরাত্রে ঐ ছবিটার বুকে ছুরি বসিয়েছিল। তারপর ওর হাতটা আলগা হয়ে গেল। আমার টেবিলের উপর ঝন্‌ঝন্ করে ঝরে পড়ল ছুরিটা।

বিদূষক বটুকের অভিনয় নিখুঁত। আমি বলি, তারপর?

–আমার হাতটা সেদিন অবশ হয়ে গেল দীপু। লেখার বুকের মাঝখানে ঐ তীক্ষ্ণ অস্ত্রটা বিঁধিয়ে দেবার জন্য আমি মুষ্টিবদ্ধ হাতটা তুললাম। আর ঠিক তখনই আমার নজরে পড়ল–

কী?

–ছবিখানা! 

ছবিখানা? মানে?

ইট ওয়াজ এ গ্রেট পীস্ অফ আর্ট!

 দু হাতে মুখ ঢেকে বটুক বলে উঠল, –পারলাম না রে দীপু, কিছুতেই পারলাম না। সেই রাত্রেই চুড়ান্তভাবে হেরে গেলাম আমি গগ্যার কাছে। প্রতিশোধ নেওয়া হল না আমার। ন্যুড স্ট্যাডি তো কতই দেখেছি কিন্তু একটা চরিত্রকে ছবির মাধ্যমে এমনভাবে প্রাণ পেয়ে উঠতে আমি কখনও দেখিনি। লেখা মরেনি। তার মৃত্যু নেই। ঐ ছবিখানার মধ্যে সে বেঁচে আছে। লেখাকে আমি নতুন করে চিনতে পারলাম। যে কথা গগ্যা মুখ। ফুটে বলেনি, যে কথা লেখা স্বীকার করে যায়নি–ঐ ক্যানভাসটা আমাকে তাই জানিয়ে দিল। ওর রতিক্লান্ত অর্ধস্তিমিত চোখের তারা, ওর বাণীহীন ওষ্ঠাধর, ওর অনাবৃত যৌবনপুষ্ট দেহের প্রতিটি আনন্দঘন লোমকূপ যেন চিৎকার করে বলে উঠলগগ্যার কাছে ও এমন কিছু পেয়েছে, যার স্বাদ সে বত্রিশ বছরেও জানত না! আমি আর্টিস্ট! আমার কাছে এ ছবি মৃত্যুঞ্জয়ী। এ আমি নষ্ট করতে পারি না! কিন্তু আর্টিস্ট হলেও আমি তো মানুষ। কদাকার কুৎসিত হলেও আমি তো প্রেমিক। জানি না, কেন এ ছবিটা গগ্যা ফেলে রেখে গেছে; কিন্তু ওটাকে যেমন নষ্ট করতে পারি না তেমনি ওটাকে সহ্যও করতে পারব না। কাকে দেব? ও ছবি যে আমার স্ত্রীর লাজবস্ত্র হরণ করেছে। তোকেও দিতে পারি না।

আমি বলি, -তাই বুঝি সেই ছবিখানা গগ্যাকে দিয়ে এলি?

 –একমাত্র তাকে দেওয়া ছাড়া আর আমার কি উপায় ছিল বল?

গগ্যা কি বলল?

বললে তুই এতদিনে একটা বুদ্ধিমানের মত কাজ করতে যাচ্ছিস মটকু। মহাজনী কারবারে তোর পসার হবে?

বটুক নির্বিকারভাবে বলেছিল কথাটা। কিন্তু আমার গালে সে যেন ঠাস্ করে একটা চড় মারল। গগ্যা তার দৈত্যের মত দেহটা নিয়ে যদি সেই মুহূর্তে আমার সামনে উপস্থিত হত তাহলে বটুকের হস্তচ্যুত ঐ পেন্সিল কাটা ছুরিটা আমি বোধকরি আমূল বসিয়ে দিতাম তার চোখের মধ্যে! যে চোখ দিয়ে সে দেখেছিল–লেখা, দি ন্যুড!

বটুকের নিলামদারের কাছ থেকে পূজারিণী ছবিখানা আমি নিলামে ডেকে কিনেছিলাম। তার পঁচিশ বছরের শিল্প-সাধনা কোন এক রবিবারে নিলামদারের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। পূজারিণীখানা কিনেছিলাম একশ ষাট টাকায়। বড় দু-একটি ক্যানভাস আড়াইশ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হয়। অভিমান করে রঙ-তুলি ছুঁড়ে ফেলে দিল বটুক, লেগে থাকলে আরও নাম করত সে।

বটুকের চিত্রসম্ভারের মধ্যে একখানার তলায় স্বাক্ষর ছিল জি. পি.। সেটা বরানগরের সেই বস্তীর অয়েল কালারখানা। সেই নিচে সবুজ বাচ্চা, উপরে চিল, আর মাঝখানে মড়া-বেড়ালের ছানা! নিলামদার সেখানাও বটুকেশ্বর দেবনাথের আঁকা ছবি বলে দিব্যি চালিয়ে দিল। বিষয়বস্তুটা কী, তাই নিয়ে অনেক শিল্পরসিক নিজেদের মধ্যে গবেষণা করছিলেন। নিলামদার প্রারম্ভিক দর ধরেছে পাঁচশ টাকা। গগ্যার হাতে-আঁকা ছবি আমার কাছে একখানিও ছিল না। হাজার হোক সে আমার বাল্যবন্ধু!

বললাম, -খাঁ সাহেব, এ-ছবির নিচে জি. পি. সই কেন? বটুকেশ্বরবাবুর আর কোন ছবিতে তো এমন সই দেখিনি!

কথাটা খরিদ্দারদের অনেকের কানে যায়। সবাই সইটা লক্ষ্য করে দেখে নিলামদার ভদ্রলোক আমার এ মন্তব্যে কিছুটা বিরক্ত হন। কিন্তু খরিদ্দার হচ্ছেন মা লক্ষ্মী, তার উপর রাগ করতে নেই। বলেন, আজ্ঞে না স্যার, ওটা পি নয়, ডি। একটু কায়দা করে লেখা। আর্টিস্টিক স্টাইলে। ডি-এর বাঁকা লাইনটা খাড়া-লাইনের তিন পোয়া অংশে এসে লেগেছে। বটুকবাবুর ডাকনাম ছিল গোপাল। তাই সই আছে জি. ডি.-গোপাল দেবনাথ। এটা নতুন ঢঙে এঁকেছেন বলে নতুন নামে এটাকে অভিষিক্ত করেছেন।

ওর কৈফিয়তে খরিদ্দারদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ওঠে। ছবিটা জাল–এমন একটা কথা উঠে পড়ে। একে তো স্বাক্ষরে গণ্ডগোল, তায় এটা বটুকেশ্বরের স্টাইলের সঙ্গে মিলছে না, এবং বিষয়বস্তুটা যে কী তাই ভাল বোঝা যাচ্ছে না। এ ছবির ডাক হল না। নিলামদার দাম কমিয়ে ধরলেন। তাও কেউ ডাকে না। শেষে আমি বলি যে, –খাঁ সাহেব, দশটা টাকা দিতে পারি। দেবে?

খাঁ সাহেব রাজী হয়ে গেল। সেও বোধকরি বুঝতে পেরেছিল ছবিটা সাচ্চা নয়। জাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *