আবার যদি ইচ্ছা কর – ১৭

১৭.

দীর্ঘ কাহিনীর উপসংহারে দাদু বললেন, গগনের বিরুদ্ধে আমার পর্বত-প্রমাণ অভিযোগ ছিল। তাকে আমি আজীবন ক্ষমা করিনি। শান্তি দেবীর প্রতি তার নিষ্ঠুরতা, বাবলু-মিণ্টির প্রতি তার নিমর্ম ঔদাসীন্য, বটুকের প্রতি নিক্ষিপ্ত তার পৈশাচিক বিদ্রূপ এবং সুলেখার প্রতি নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতায় আমি মর্মান্তিক ক্ষুব্ধ ছিলাম। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে আমার মনে যে হিমালয়ান্তিক অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তার কৈফিয়ৎ গগন দিয়ে গেছে একটিমাত্র ছত্রে :

—A mans work is the explanation of that man!
একটা মানুষের সৃষ্টিই তার অস্তিত্বের কৈফিয়ত!

আর চন্দ্রভান! ভিন্সেন্ট ভান গর্গ মরেনি, মরতে পারে না! সে বেঁচে আছে এই আমাদেরই আশেপাশেই, –সে নিশ্চয় ফিরে এসেছে এই পৃথিবীতে। শুধু আমরা তাকে ঠিকমত চিনতে পারছি না। তোমাকে কি বলব নরেন, এই বৃদ্ধ বয়সে গোলদীঘির ধারে, কফি-হাউসের কোণায়, মুক্তি-মেলার আসরে আজও তাকে খুঁজে বেড়াই আমি। নিদারুণ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত কোন আর্টিস্টকে যখন কলকাতার ফুটপাতে স্কেচ করতে দেখি আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি! মনে হয়?–ঐ তো ভিন্সেন্ট! সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সেই ময়লা পায়জামা আর ছেঁড়া পাঞ্জাবি! হাতে ভঁড়ের চা, মুখে সবুজ-সুতোর বিড়ি! মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত-ঘরের সন্তান, –কোথায় লেখাপড়া শিখে চাকরিবাকরি করবি, বিয়ে-থা করবি, র‍্যাশন আনবি, সংসার করবি–তা নয়, ওরা ছবি আঁকতে বসেছে। বাড়িতে নিত্য গঞ্জনা, বন্ধুমহলে পাগলা বলে পাত্তা পায় না, বিয়ের বাজারে ওরা কানাকড়ি! কণ্ঠা বারকরা ঘাড় কুঁজো থুবড়িগুলো পর্যন্ত ওদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না! ওরা যে পাগলামির আগুনে ওদের হাতের সব রেখা–সৌভাগ্য-রেখা, আয়ু-রেখা, যশঃ-রেখা–সব পুড়িয়ে ফেলেছে! ভাল কথা বললে শোনে না, গাল দিলে ভ্রূক্ষেপ করে না–বেহায়াগুলোর দু কান কাটা! আমি ওদের মধ্যে খুঁজে বেড়াই–ওর মধ্যে নতুনকরে-জন্ম-নেওয়া কোষ্টা আমার সেই হারানো বন্ধু ‘কানকাট্টা সেপাই’ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ?

.

পরিশিষ্ট

[Vincent Van Gogh]

১৮৫৩ : ৩০শে মার্চ হল্যাণ্ডের পল্লীতে ভান গখ-এর জন্ম। অনুজ তেও ভান গখ ছিলেন চার বছরের ছোট।

১৮৬৮ : হেগ শহরে গোপিল আর্ট ডীলার্স কোম্পানিতে শিক্ষানবিশ হিসাবে প্রথম চাকরিতে প্রবেশ। পাঁচ বছর পরে ভঁার্স হেগ থেকে লণ্ডন অফিসে বদলি হয়ে যান এবং হেগ অফিসে তার শূন্য পদে অনুজ তেও বহাল হন। তেও ঐ কোম্পানিতে সারা জীবন চাকরি করেন।

 ১৮৭৩-৭৪ : লণ্ডনে যে বাড়িতে ভ্যাস থাকতেন সেই ল্যাণ্ড-লেডির চটুল-স্বভাবা কৌতুকময়ী কন্যা উরসুলা লায়রকে ভালবেসে ফেলেন। রহস্যময়ী উরসুলার হৃদয় জয় করেছেন বলে বিশ্বাসও করেন; কিন্তু যেদিন মেয়েটির কাছে বিবাহের প্রস্তাব করলেন সেদিন সে জানালো যে, সে বাকদত্তা। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে ভ্যাঁসঁ ধর্ম-জগতের দিকে ঝুঁকলেন। কাজে মন নেই, ফলে চাকরি গেল।

১৮৭৬-৭৯ : ভান গখ নানান জীবিকার সন্ধানে ফেরেন–স্কুলে শিক্ষকতা, বইয়ের দোকানে সেলসম্যানের চাকরির চেষ্টা করেন, কিন্তু মন বসে না। মনে হয় তিনি কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন; সেটা কী তা বুঝতে পারেন না। ঐ সময় তিনি দিনে আঠারো ঘন্টা পড়াশুনা করতেন–বাইবেল ও সাহিত্য। আমস্টার্ডামে গিয়ে যাজক হবার চেষ্টা করেন এবং গ্রীক ও ল্যাটিন শিক্ষা করেন। ১৮৭৮ সালে শিক্ষানবিশী ঈভানজেলিস্ট হিসাবে ছয় মাসের জন্য নিযুক্ত হন। বেলজিয়ামের বরিনেজ বা কয়লাখনি অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্রেরিত হন। দুর্ভাগ্যক্রমে কয়লাকুঠির কর্তৃপক্ষ এবং চার্চ-সম্প্রদায় উভয়পক্ষের কাছেই তিনি বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। অপরাধ–মালকাটাদের তিনি নিজ বিবেকের নির্দেশ অনুসারে সেবা করতে চেয়েছিলেন। কোলিয়ারির একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত মজদুরদের আত্মার সদ্গতি কামনায় যখন তিনি ফিউনারাল সার্ভিসে রত তখন নাটকীয়ভাবে চার্চ-সম্প্রদায়ের কর্মকর্তারা আসেন, তাঁকে পদচ্যুত ও চার্চ থেকে বিতাড়িত করেন।

১৮৮০ : মালকাটাদের প্রতিকারহীন দুর্দশায় ঈশ্বরের ঔদাসীন্যে মর্মাহত হয়ে ভান গখ ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান। হঠাৎ ছবি-আঁকা শুরু করেন। শিল্পগুরু রেভারেণ্ড পিটারসন ছিলেন ব্রাসেল্স-এ। আশি কিলোমিটার হেঁটে তাঁকে ছবি গুলি দেখাতে আসেন। পিটারসন তাঁর ছবিগুলি প্রথম দেখে হতাশ হন। পরে ঐ স্কেচগুলির ভিতরেই তার প্রতিভার সন্ধান পেয়ে তাকে শেখাতে শুরু করেন। ভান গখ কিন্তু প্রাথমিক পাঠ শেষ করে পুনরায় কয়লাকুঠিতে ফিরে আসেন। নিদারুণ অর্থাভাবে অনশনে যখন তিনি মৃত্যুমুখে, সহসা তেও এসে তাকে উদ্ধার করেন। এই বছরই তিনি তার বিধবা ফার্স্ট কাসিন বা ভগ্নী (মতান্তরে ভাগ্নি) কী ভস্-এর প্রেমে পড়েন; কিন্তু কী তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর্স কী-এর পিতার সম্মুখে তার প্রেমের একনিষ্ঠার প্রমাণ দিতে নিজ দক্ষিণ হস্ত প্রদীপ শিখায় বাড়িয়ে ধরেন। এ দহন চিহ্ন তাঁর বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে ছিল।

১৮৮১-৮৩ : কী-এর কাছে পুনর্বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিল্পী সর্বতোভাবে চিত্রশিল্পে আত্মনিয়োগ করেন। তেও প্রতি মাসে তাঁকে মাসোহারা পাঠাতেন। তাতেই তার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হত। এই সময়ে ক্রিস্টিন হুর্নিক নামে একটি গর্ভবতী বারাঙ্গনাকে একদিন তার বাসায় নিয়ে আসেন। অভিশপ্ত জীবনের ফলশ্রুতি হিসাবে ক্রিস্টিনের একটি সন্তান হয়। শিল্পী ক্রিস্টিনকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দু বছরের মাথায় ক্রিস্টিন তাকে ত্যাগ করে অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যায়। গার্হস্থ্য জীবনের মাধুর্য, রমণীর স্নেহ-ভালবাসা এই দু বছরই পেয়েছিলেন শিল্পী।

১৮৮৩-৮৬ : পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। শিল্পদর্শনে নূতন চিন্তাধারা জাগে। সৌন্দর্যের প্রতি সভ্যজগৎ-স্বীকৃত তথাকথিত বুর্জোয়া মনোভাব তিনি অস্বীকার করেন দুঃখ, দারিদ্র্য, অবহেলিত মনুষ্য-সমাজের যন্ত্রণার চিত্র তার শিল্পে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। কুৎসিত কদাকার বিষয়বস্তুও যে শিল্প-পদবাচ্য হতে পারে এই নূতন সত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। ফলে তাঁর সৃষ্টি স্বীকৃতি পায় না। এমিল জোলার সাহিত্য এবং দেলাক্রোয়ের শিল্পদর্শন তার উপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। Potato Eaters এই যুগে আঁকা।

১৮৮৬-৮৭ : আন্টওয়ার্পে এসে রুবেন্স-এর শিল্প দেখে আকৃষ্ট হন। এই সময়ে অনেকগুলি জাপানী উডকাট দেখেন। সেগুলি প্রচণ্ড ভাল লাগে। তার পরবর্তী জীবনে চিত্রের পশ্চাৎপটে প্রায়ই জাপানী ছবির নক্সা দেখা যায়। পারী আগমন। তুলোজ-লুত্রেক, গুইলমিন, বার্নার্ড, লাভাল, গোগ্যাঁ, রাসেল, পিসারো প্রভৃতি শিল্পীবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। উচ্চবিত্তের তথাকথিত বিশুদ্ধ-আর্টের বন্ধন থেকে চিত্রশিল্পকে মুক্ত করতে এই সময়ে ঐ শিল্পীবৃন্দ একটি কম্যুনিস্ট আর্ট কলোনি স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন, যা বাস্তবায়িত হয়নি।

১৮৮৮ : পারী অসহ্য লাগে। ভান গখ আর্সেতে চলে যান। সেখানে প্রখর রৌদ্র। সূরয হয়ে উঠল শিল্পীর মূল কেন্দ্রবিন্দু। রোলিন নামে একজন প্রতিবেশী ডাকপিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। রোলিন ও তার পুত্রের পোর্ট্রেট আঁকেন। সূরযমুখী ও সাঁকো এই যুগের সৃষ্টি। বন্ধু পল গোগ্যাঁর নিরতিশয় দারিদ্র্যের কথা জানতে পেরে ঐ সময় তাঁকে নিজের কাছে এনে রাখবার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। গোগ্যাঁর কাছে ট্রেনভাড়া ছিল না। তেও শেষ পর্যন্ত গোগ্যাঁকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দেন। গোগার আর্লে আগমন। দুই শিল্পীর মতান্তর থেকে মনান্তর। একদিন ক্ষুর দিয়ে উন্মাদ অবস্থায় ভান গখ বন্ধুকে আক্রমণ করেন। গোগ্যাঁ তৎক্ষণাৎ পারীতে পালিয়ে যান। সেই রাত্রেই ভান গখ ঐ ক্ষুর দিয়ে নিজের দক্ষিণ কর্ণ ছেদন করেন এবং সেটি একটি বার-মেড এর কাছে পাঠিয়ে দেন। মেয়েটি নাকি তার কানের প্রশংসা করেছিল এবং ঠাট্টার ছলে কানটা উপহার চায়।

১৮৮৯ : সেন্ট-রেমি উন্মাদাগারে আশ্রয় লাভ। এই সময় (১৭. ৪. ৮৯) তেও বিবাহ করেন। তাঁর্স ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। বিবাহিত অনুজের উপার্জনে ভাগ বসাতে স্বতঃই তিনি কুণ্ঠা বোধ করেন। এর পর তাঁর চিত্রে সূর্যের বদলে চাঁদ ও তারার দল প্রাধান্য পেতে থাকে। বন্দীদলের চক্রাবর্তন এবং শোকাহত বৃদ্ধ এই যুগে আঁকা। প্রতি তিন মাস অন্তর পর্যায়ক্রমে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন।

১৮৯০ : ২৭শে জুলাই একটি পিস্তল বুকে লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে তেও ছুটে আসেন। ২৯শে জুলাই সজ্ঞানে তার মৃত্যু হয়। শেষ বারো ঘন্টা একমাত্র তেও ছিলেন তাঁর শয্যাপার্শ্বে। ভান গখ-এর মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে তেও উন্মাদ হয়ে যান। উন্মাদ অবস্থায় তিনি স্ত্রীকে আক্রমণ করেন কারণ, ঐ সময় তাঁর ধারণা হয়েছিল স্ত্রীর আগমনেই তাঁর দাদা আত্মহত্যা করেছেন। আরও তিন মাস পরে উন্মাদ অবস্থাতেই তেও প্রাণত্যাগ করেন।

তার তেইশ বছর পরে তেও-এর বিধবা পত্নী হল্যাণ্ড থেকে স্বামীর দেহাবশেষ সংগ্রহ করে আনেন। তাঁর দাদার সমাধির পাশে স্বামীর দেহাবশেষ সমাধিস্থ করেন। পারীর অনতিদূরে দুটি কবর পাশাপাশি আছে–শিল্পরসিকদের তীর্থ। একটি আইভিলতা দুটি সমাধিকে জড়াজড়ি করে আছে!

ভ্যাস ভান গখ-এর জীবদ্দশায় তাঁর একখানি মাত্র চিত্র স্বল্পমূল্যে বিক্রীত হয়েছিল। মৃত্যুর অনতিকাল পর থেকেই তিনি বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের অন্যতম বলে স্বীকৃত!

.

য়োজেন অঁরি পল গোগ্যাঁ  [Paul Gauguin]

১৮৪৮ : ৭ই জুন তারিখে পারীতে পল গোগ্যাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন একজন প্রগতিবাদী ফরাসী সাংবাদিক, মা স্পেন দেশের মেয়ে। স্পেনের লোক হলেও ওঁর দাদামশাই দীর্ঘদিন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে ছিলেন।

১৮৫১ : গোগ্যাঁর বয়স যখন তিন তখন তৃতীয় নেপোলিয়ন ফরাসী দেশের ক্ষমতা দখল করেন। ঐ সময়ে তাঁর বাবা সপরিবারে পেরুতে যাত্রা করেন ইচ্ছা ছিল সেখানেই বাস করবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই জলযাত্রায় শিল্পীর পিতৃ-বিয়োগ হয়। সন্তানদের নিয়ে ওঁর মা চার বছর পেরুর রাজধানী লিমাতে ছিলেন।

১৮৬০ : মায়ের সঙ্গে প্যারীতে ফিরে আসেন এবং ওর্লেতে স্কুলে ভর্তি হন।

১৮৬৫ : সতের বছর বয়সে সদাগরী জাহাজে কাজ নিয়ে কয়েকবার ফ্রান্স ও দক্ষিণ আমেরিকার ভিতর যাতায়াত করেন। পরে ফরাসী নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে সেকেণ্ড লেফটেনান্ট-পদে উন্নীত হন।

১৮৭১-৮২ : নৌবাহিনীর কাজ ছেড়ে দিয়ে শেয়ারের দালালীর কাজ ধরেন। স্টক ব্রোকার হিসাবে তার যথেষ্ট রোজগার হয়। ঐ সময় তিনি মেটি সোফিয়া গ্যাড নামে একটি ওলন্দাজ মহিলাকে বিবাহ করেন। অবসর সময়ে ও ছুটির দিনে, গোগ্যাঁ ছবি আঁকতেন। ১৮৭৬ সালে তার একটি ছবি সালোতে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়। গোগ্যাঁ এতে অত্যন্ত উৎসাহ বোধ করেন এবং স্টক ব্রোকার-এর কাজের ক্ষতি করেও দিবারাত্র ছবি আঁকতে থাকেন। সংসারে এজন্য স্বতঃই অশান্তির সৃষ্টি হয়। কামীল পিসারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।

১৮৮৩ : এতদিনে গোগ্যাঁ তিনটি সন্তানের জনক। এই বছর তিনি সর্বক্ষণ ছবি আঁকার জন্য দালালী সম্পূর্ণ ছেড়ে দেন। পুত্রকন্যাসহ স্ত্রীকে তাঁর পিত্রালয়ে কোপেনহেগেন-এ পাঠিয়ে দিয়ে পারীতে স্টুডিও খুলে দিবারাত্র আঁকতে শুরু করেন। নিতান্ত দারিদ্র্যে মাঝে মাঝে তাকে রাস্তায় পোস্টার সাঁটার কাজ করতে হত। ঐ সময় তাঁর বড় ছেলে ক্লোভিস্ তাঁর সঙ্গে ছিল।

১৮৮৬ : চালর্স লাভাল নামে একজন চিত্রকরের সঙ্গে পানামা যাত্রা করেন। সেখানে লাভালের একজন ধনী ভগ্নীপতি ছিলেন। তাঁর কাছে বিশেষ সাহায্য পাওয়া গেল না। গোগ্যাঁ পানামা খালে মাটি কেটেও গ্রাসাচ্ছাদন করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি য়ুরোপ ফিরে আসেন।

১৮৮৮ : আর্সেতে ভ্যাঁসঁর সঙ্গে বাস ও ভ্যাঁসঁর কাছ থেকে পলায়ন। প্রায় এই সময়েই তেও ভান গখ-এর আগ্রহে ও ব্যবস্থাপনায় গোগ্যাঁর একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়; তাতে ছবি কিন্তু বিশেষ বিক্রী হয়নি। শিল্পী তখন ব্রিটানিতে বসবাস করেন।

১৮৯০ : ভ্যাঁসঁর আত্মহত্যা ও তেওর মৃত্যুতে গোগ্যাঁ হতাশ হয়ে পড়েন। শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা সুদূরপরাহত মনে হয়।

১৮৯১ : ৪ঠা এপ্রিল গোগ্যাঁ এক দুঃসাহসিক অভিযান করেন। পৃথিবীর অপর প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের একান্তে তাহিতি দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের ছবি আঁকবার অভিপ্রায়ে যাত্রা করেন। প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি তাহিতির রাজধানী পাপীতিতে পৌঁছান। এই যুগে তিনি তার জীবনের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ চিত্র আঁকেন, যার ভিতর Ta Mateti অন্যতম। ঐ সময়ে শিল্পী য়ামায়া নামে একটি নিরক্ষর আদিবাসীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। য়ামায়া নিরলস নিষ্ঠায় তাঁর সেবা করেছে। সে জানত শিল্পী বিপত্নীক। অথচ তখন ঐ কুটির থেকেই গোগ্যাঁ কোপেনহেগেনে তার স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত পত্রালাপ করতেন। তাঁর য়ুরোপীয় স্ত্রী য়ামায়ার কথা কোনদিন জানতে পারেননি। বছর দুয়েকের মধ্যেই তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন। য়ামায়াকে ফেলে।

১৮৯৪ : মার্সেলএ আন্না নামে একটি জাভা-দেশীয় স্ত্রীলোকের সঙ্গে গোগ্যাঁ বাস করতে থাকেন। আন্নার অনেকগুলি ছবি তিনি এঁকেছেন। এডগার দেগার সঙ্গে এসময়ে বন্ধুত্ব গাঢ়তর হয়। গোগ্যাঁ এই বছরই শেষবারের মত স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ডেনমার্কে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই পুনরায় ফ্রান্সের ব্রিটানিতে ফিরে আসেন ও আন্নার সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। এই সময়ে আন্নাকে কেন্দ্র করে একবার তিনি কয়েকজন মদ্যপ নাবিকদের সঙ্গে রাস্তায় মারামারি করেন। ফলে তাঁর পা ভেঙে যায়। এর কিছুদিন পরে আন্না তাঁর স্টুডিও থেকে অনেক জিনিস নিয়ে পালায়। ভাঙা পা ও যৌনব্যাধিগ্রস্ত গোগ্যাঁর অবস্থা চরমে ওঠে।

১৮৯৫ : আন্নার কাছে শেষ মার খেয়ে গোগ্যাঁ পুনরায় তাহিতিতে ফিরে যাবেন বলে মনস্থির করেন। সত্যিই তিনি তাহিতিতে ফিরে আসেন। এবার তিনি গভীরতর অরণ্যে বসবাস শুরু করেন। য়ামায়ার সন্ধান পেয়েছিলেন কিনা জানা যায় না।

১৮৯৭ : কন্যা এলিনের মৃত্যুসংবাদে শিল্পী মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়েন। ঐ আঘাতে তিনি তার জীবনের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রূপক চিত্র আঁকতে বসেন। তার বিষয়বস্তু–আমরা কোথা থেকে আসছি-আমরা কি? ও কোথায় যাচ্ছি? পুরো এক বছর দিবারাত্র পরিশ্রম করে ঐ মহান চিত্রটি শেষ করেন।

১৮৯৮ : পূর্বকথিত ছবি আঁকা শেষ হলে আর্সেনিক সেবনে শিল্পী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন; কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৮৯৯-০৩ : ফরাসী সরকারের পাব্লিক ওয়ার্কসে কেরানীর চাকরি নেন। প্রচণ্ড ঝড়ে তার বাড়িটি ভেঙে যায়। Le Sourire পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য তার তিন মাস কারাদণ্ড হয়। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করার পূর্বেই ১৯০৩ সালের ৮ই মে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর এক মাস আগে বন্ধু চালর্স মরিসকে লেখা চিঠির একটি পংক্তি তার সমাধিক্ষেত্রে উৎকীর্ণ হবার যোগ্যঃ

“A mans work is the explanation of that man.”

পারীতে এক সাহিত্যিক বন্ধু তাঁর শিল্পে বর্বরতা দেখে আপত্তি জানানোতে শিল্পী বলেছিলেন, “তোমাদের সভ্যতা হচ্ছে একটা ব্যাধি। আমার বর্বরতা সেই রোগমুক্তির মহৌষধ।”

বর্তমানে গোগ্যাঁ পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদলের অন্যতম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *