আগুন! আগুন!

আগুন! আগুন!

আজ থেকে বহু যুগ আগে–সন-তারিখের হিসাব ধরলে আড়াই হাজার বছরের কম হবে না–একদল পণ্ডিত ছিলেন, তারা ভেবে ভেবে বের করেছিলেন আমাদের এই পৃথিবী গোড়ায় পাঁচটা জিনিস দিয়ে তৈরি। সেই আদত জিনিসগুলো হল–মাটি, পানি, আগুন, বাতাস আর আকাশ। তাঁদের কঠিন পণ্ডিতী ভাষায় বলতে গেলে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ আর ব্যোম। পৃথিবীর এই পাঁচটা গোড়ার উপাদানকে তাঁরা বললেন ‘পঞ্চভূত’ বা পাঁচটা ভূত।

সেই পাঁচটা ভূতের একটা ভূত হল আগুন। তাঁরা বললেন, আগুন আমাদের জীবনের সাথে একেবারে মিশে আছে, আগুন না হলে আমাদের একেবারেই চলে না। তাই আগুন হল দুনিয়ার পাঁচটা একেবারে গোড়ার জিনিসের একটা।

সেই এত পুরনো যুগের লোকেরা যদি আগুনের এমন দাম দিয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের আজকের এই সভ্য জীবনে আগুনের দাম তো আরো অনেক বেশি হবার কথা।

তখনকার মানুষ বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত; শিকার করে ফলমূল খেয়ে থাকত। সামান্য চাষবাসও তারা শিখেছিল। রান্নার জন্যে, বুনো জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আর জন্তু-জানোয়ারকে তাড়িয়ে নিয়ে শিকার করবার জন্যে তাদের আগুনের দরকার হত।

আমাদের আজ যে শুধু ঘরের কাজ-কর্মের জন্যেই আগুনের দরকার, তা নয়। আগুন না হলে রেলগাড়ি, জাহাজ, উড়োজাহাজ, কোন রকম যানবাহনই তো চলবে না। আগুনের অভাবে সব রকমের কল-কারখানার চাকা বন্ধ হয়ে যাবে।–কাপড়-জামা, নুন, চিনি, ঘড়ি, সাইকেল এসব রোজকার দরকারের কোন জিনিসই আর তৈরি হবে না। এক কথায় আমাদের জীবনযাত্রাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

আগুন এমন কাজের জিনিস বলেই আগুনের কথা জানাটাও আমাদের সবার জন্যেই দরকার। আর এর কথা ভাল করে জানলেই একে আমরা আরও বেশি করে। কাজে লাগাতে পারব।

আগুনের ব্যবহার যে সেই কোন আদ্যিকালে শুরু হয়েছিল, তা আজ আর ঠিক করে বলবার উপায় নেই! যে-ই এর ব্যবহার আবিষ্কার করে থাকুক, এটা মানুষের সভ্যতার জন্যে এমনই জরুরি যে, সেদিক থেকে একমাত্র মানুষের ভাষা, হরফের সাহায্যে লেখা আর কৃষির আবিষ্কারকেই এর সাথে তুলনা করা চলে।

যতদূর জানা যায়, আগুন তৈরি করতে শেখার আগেই মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। বড় বড় বনে শুকনো গাছের ডালে ডালে ঘষা লেগে দাবানল জ্বলে ওঠত; মানুষ দেখত বুনো পশু-পাখি বন ছেড়ে পালাচ্ছে। ঝড়ো মেঘ থেকে বাজ পড়েও কখনো কখনো শুকনো গাছপালায় আগুন ধরে যেতো। মানুষ দেখত আগুনের কাছে দাঁড়ালে শীতের হাত থেকে বাঁচা যায়; আগুন জ্বালানো থাকলে বুনো জন্তু–জানোয়ার সেখানে ঘেঁষে না। এমনি করেই আগুন হয়ে দাঁড়াল মানুষের আত্মরক্ষার আর আরামের একটা বড় রকমের উপকরণ।

হয়তো কোনদিন শিকারের মাংস হঠাৎ ফসকে আগুনে পুড়ে ঝলসে গেল; মানুষ খেতে গিয়ে দেখল আগুনে পুড়ে মাংসটা যেমন নরম হয়েছে, তেমনি হয়েছে সুস্বাদু। এমনি করেই হল আগুন দিয়ে রান্নার সূত্রপাত।

কিন্তু তখন নিজের হাতে আগুন তৈরি করতে মানুষকে বড় বেগ পেতে হত। দুটো শুকনো কাঠের চেলা জোরে জোরে ঘষে তারা আগুন জ্বালাত। কখনো নরম পাতলা কাঠের গায়ে ফুটো করে তার ভেতর একটা শক্ত কাঠের কাঠি ঢুকিয়ে দুহাতের তালু দিয়ে জোরে ঘোরানো হত; তাতেই জ্বলে ওঠত আগুনের ফুলকি। তারপর কোন এক জায়গায় সব সময়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত; সবাই দরকারমতো সেখান থেকে আগুন নিয়ে যেত। আজকালও অস্ট্রেলিয়ার কোথাও কোথাও আদিম অধিবাসীরা এমনি করে আগুন জ্বালায়, আর সে আগুনকে জিইয়ে রাখে।

আগুন এমন দরকারী বলেই, আর তা মানুষের ভয়ংকর রকম ক্ষতি করতে পারে বলেই, সেই আদ্যিকাল থেকে আগুনকে দেবতা মনে করে পুজো করা শুরু হয়। প্রাচীন আর্যদের আগুনের দেবতার নাম হল ‘অগ্নি’। এখনও পারসিরা আগুনকে পুজো করে; তাদের পুজোর মন্দিরে সব সময় আগুন জ্বালিয়ে রাখবার সেই পুরনো রেওয়াজ আজও চালু আছে। এই আগুন নিভে যাওয়াকে তারা এক ভয়ংকর অমঙ্গলের চিহ্ন বলে মনে করে।

কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালানো ছাড়া আগুন জ্বালাবার আরো কায়দা পরে আবিষ্কৃত হয়। কেউ হয়তো একদিন হঠাৎ লক্ষ্য করল, লোহার সঙ্গে চকমকি পাথর ঠুকলে আগুন জ্বলে ওঠে, তা থেকে শুকনো ঘাস-পাতায় আগুন ধরানো যায়। এই কায়দাটাই উন্নত করে আজকালকার সিগারেট লাইটার তৈরি হয়েছে। আজকাল। যেমন একটা দিয়াশলাই-এর বাক্সের গায়ে এর রাসায়নিক মশলা মাখানো কাঠি ঠুকলেই দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে, আগে আগুন জ্বালানো মোটেই অত সহজ ছিল না।

তোমাদের মনে নিশ্চয়ই এ প্রশ্ন জাগছে? কিন্তু আগুন জিনিসটা আসলে কি? আর আগুন কি করেই বা জ্বলে ওঠে। বিজ্ঞানীরা বলেন, কোন জিনিস যখন খুব তাড়াতাড়ি হাওয়ার অক্সিজেন গ্যাসের সঙ্গে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মিশতে থাকে, তখন প্রচুর আলো আর তাপের সৃষ্টি হয়—আর তাকেই আমরা আগুন জ্বলা বলি। মনে রেখো, অক্সিজেনের সঙ্গে যোগ হওয়াটা বেশ তাড়াতাড়ি ঘটা চাই, তা নইলে কিন্তু আগুন জ্বলবে না। লোহা বাইরে ফেলে রাখলে যে মরচে পড়ে, তাও আসলে অক্সিজেনের সঙ্গে লোহার যোগ। কিন্তু সে যোগটা হল ধীরে ধীরে–তাই তাকে আগুন জ্বলা বলব না।

অনেক সময় কঠিন বা তরল জিনিস সরাসরি অক্সিজেনের সঙ্গে তাড়াতাড়ি মিশতে পারে না। তার জন্যে দাহ্য উপাদানটা আগে বাষ্পে পরিণত হওয়া দরকার। মোমবাতি প্রদীপের সলতের কাছে যখন আগুন ধরা হয় তখন খানিকটা মোম বা। তেল প্রথমে বাষ্প হয়ে যায়। তারপর সেই বাষ্প হাওয়ার অক্সিজেনের সাথে মিশে জ্বলতে থাকে। যে অংশটা অক্সিজেনের সঙ্গে মেশে না সেটা হয় তৈরি করে ধোঁয়া আর নইলে ছাই হিসেবে তলায় পড়ে থাকে।

সব জিনিস আবার সমান তাড়াতাড়ি আক্সিজেনের সাথে মেশে না। প্রত্যেক জিনিসই এক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে গরম হলে তবেই তাতে আগুন ধরবে। যে জিনিস যত কম গরম হলে আগুন ধরে সেটা তত বেশি দাহ্য। যেমন কয়লার চেয়ে কাঠ বেশি দাহ্য, আবার কাঠের চেয়ে কাগজ বা কেরোসিন বেশি দাহ্য; কেরোসিন তেলের চেয়েও বেশি দাহ্য হল পেট্রল বা ফসফরাস। সেই জন্যে যে জিনিস যত বেশি দাহ্য, সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করবার সময় তত বেশি সাবধান হওয়া দরকার।

দাহ্য জিনিস নাড়াচাড়া করবার অসাবধানতার দরুন অনেক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শুধু এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব নিলে দেখা যায়, সেখানে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে প্রায় দশ হাজার লোক মারা যায়; আরো যে কত লোক জখম হয়, তার ইয়ত্তাই নেই। সে দেশে প্রতি বছর আগুন লাগার ফলে লোকসান হয় কয়েক শো কোটি ডলার–আগুন যে কী দারুণ ‘ভূত’ এ থেকেই তা বোঝা যায়।

আমাদের দেশেও বছর বছর এই ভূতের হাতে ক্ষতি কিছু কম হয় না। সামান্য একটা স্ফুলিঙ্গ থেকে হয়তো কোথাও আগুন লাগে। সময়মতো নেভানো না হলে হাওয়ায় সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অনেকের বাড়ি পোড়ে, অনেক মানুষ ঘড়হারা হয়। অনেক সময় বড় বড় পাটের গুদামে আগুন লেগে বহু কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়।

আগুনের এই ভূত যাতে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্যে একে নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় খুব সাবধান!

Leave a Reply to তানিম হোসেন জিসান Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *