অধ্যায় ৯ – নিহনবাশি থানার ডিটেকটিভ

অধ্যায় ৯ – নিহনবাশি থানার ডিটেকটিভ

এক

ক্রাইম সিন এক ঝলক দেখেই হিরোশি উয়েসুগির মনে হয়েছে এই কেসটা সহজ হবে না। এরকম মনে হওয়ার কোনো বিশেষ কারণ নেই অবশ্য। তবে তার মনে হচ্ছে এই কেসে ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছে খুনি।

১০ই জুন রাত আটটা নাগাদ এক নারীর লাশ পাওয়া যায় কোদেনমাচোর একটা অ্যাপার্টমেন্টে। ভিক্টিমের বান্ধবী দেখা করতে এসে তার লাশ খুঁজে পায়।

লাশের অবস্থা দেখে ধারণা করা হয় আবিস্কার হওয়ার সময় থেকে পূর্ববর্তী দুই ঘন্টার মধ্যে খুনটা করা হয়েছে। ভিক্টিমের সাথে মূলত ঘন্টাখানেক আগে মানে সন্ধ্যা সাতটায় দেখা করার কথা ছিল তার বান্ধবীর। শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা না বদলালে হয়ত খুনটা হওয়ার সময়ই এসে হাজির হত সে। দেখতে পেত খুনিকে। এই ব্যাপারটা ভেবেই উয়েসুগির মনে হয়েছে খুনির কপাল ভালো।

নিহনবাশি থানায় তদন্তের জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। খুনের কেসটা এই থানার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। ক্রাইম সিনে গিয়েই একজন ডিটেকটিভের সাথে দেখা হয় উয়েসুগির। তার নাম কাগা। কয়েকদিন আগেই নিহনবাশিতে বদলি হয়ে এসেছে। নামটা পরিচিত উয়েসুগির। কাগার সমাধান করা খুনের কেসগুলো নিয়ে অনেক কানাঘুষা শোনা যায়। গুজব আছে কাগা নাকি অল-জাপান কেন্দো চ্যাম্পিয়ন।

কাগার পাতলা গড়নের দেহ দেখেই বোঝা যায় একসময় ক্রীড়াবিদ ছিল সে। তবে তার গম্ভীর চেহারায় কখনোই খেলোয়াড়সুলভ পেশাদারিত্ব ফুটে ওঠে না। কাগার পোশাকের দিকেও নজর যায় উয়েসুগির। টিশার্টের ওপর একটা হাফ হাতা শার্ট পরনে ছিল তার।

“কাগা, ডিউটিতে সবসময়ই এই রকম পোশাকই পরেন নাকি?” এটাই ছিল তাকে বলা উয়েসুগির প্রথম কথা।

“সবসময় নয়, তবে বেশিরভাগ সময়ই,” সংক্ষেপে জবাব দেয় কাগা। “ যে গরম পড়েছে।”

লোকটা অদ্ভুত, ভাবে উয়েসুগি। কাগা ও তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ব্যাপারে এত প্রশংসা শোনার পর তাকে দেখে হতাশ হয় সে। লোকটার কি মতিভ্রম হয়েছে? নাকি তার ব্যাপারে শোনা সবকিছু নিছকই গুজব আর অতিরঞ্জিত কথাবার্তা? এই লোকটি যদি এতটাই দক্ষ হত তবে তো থানা থেকে ছো মেরে উঠিয়ে নিয়ে যেত টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ।

ভিক্টিমের প্রোফাইল দাঁড় করাতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। তার নাম মিনেকো মিতসুই, ছয়মাস আগে ডিভোর্স হয় তার, একাই থাকত আর কাজ করত অনুবাদক হিসেবে। যে বান্ধবী তাকে খুঁজে পায় সেও একজন অনুবাদক।

লাশটা খুঁজে পাওয়ার পরদিন ক্যাপ্টেন উয়েসুগিকে নির্দেশ দেয় একজন জুনিয়র ডিটেকটিভকে সাথে নিয়ে ভিক্টিমের সাবেক স্বামী মিস্টার নাওহিরো কিয়োসির সাথে দেখা করতে।

সাবেক স্ত্রীর খুন হওয়ার খবরটি দিলে সেটা হজম করতে কষ্ট হয় বেচারার। হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ, ব্যাপারটা হজম করতে সময় নেয়।

“আপনারা কি সত্যি বলছেন?” একসময় বিড়বিড় করে বলে ওঠে সে। “খুন হয়েছে, ও…? এত মানুষ থাকতে কেন ওকেই খুন হতে হল…?“

কিয়োসির প্রতিক্রিয়া অকৃত্রিম বলেই মনে হয় উয়েসুগির। সার্বিক সহযোগিতা করে সে, কিন্তু তার দেয়া তথ্য কেসটা সমাধানে কোনো কাজে আসে না। বোঝাই যায়, লোকটা অর্ধ বছর নিজের সাবেক স্ত্রী’কে দেখেনি। খুনের সময় গিনজায় এক ক্লায়েন্টের সাথে ডিনার করছিল বলে জানায় সে। দ্রুতই নিশ্চিত করা যায় তার অ্যালিবাই।

এরপর উয়েসুগি ও তার জুনিয়র পার্টনার গিয়ে দেখা করে মিনেকো মিতসুয়ির ছেলে কোকি কিয়োসির সাথে। একটা ছোটখাটো থিয়েটারের অভিনেতা সে।

বাবার মতোই ছেলেরও কোনো ধারণা ছিল না কেন কেউ তার মাকে খুন করবে। মায়ের সাথে বছর দুয়েক ধরে যোগাযোগ ছিল না তার। বাবা-মা’র ডিভোর্সের ব্যাপারে কোনো আগ্রহই ছিল না কোকির, এমনকি জানেও না কেন ডিভোর্স হয়েছিল তাদের।

“আজকাল অনেক মানুষ বয়স হয়ে গেলে ডিভোর্স নিয়ে নেয়,” বলে সে। “আমার মতে, ইচ্ছা হলে নিয়ে নিক ডিভোর্স।”

আস্ত গর্দভ, ভাবে উয়েসুগি, এরা মনে করে বাবা-মা ছাড়া একা একাই এতবড় হয়েছে। যেন বাপ-মা’র কোনো অবদান-ই নেই জীবনে।

কলেজ পাশ করে অভিনেতা হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করছিল কোকি। তার বোঝার ক্ষমতা নেই, বাবা-মা’র সমর্থন ও স্বাধীনতা দিয়েছে বলেই এমন একটা বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পেয়েছে।

ছেলেটা এখনো অপরিণত, এমনটাই মনে হয়েছিল উয়েসুগির তার বাবা-মার উচিত ছিল নজর রাখা, খেয়াল রাখা যাতে ছেলে সঠিক পথে এগোয়, ঠিকভাবে মানুষ হয়। সকল বাবা-মা’র এমনটাই করা উচিত।

একজন ওয়েট্রেসের সাথে এক ছাদের নিচে থাকে কোকি। মেয়েটার নাম অ্যামি আয়োইয়ামা। যে অ্যাপার্টমেন্টে ওরা থাকে সেটা এই মেয়ের নামেই রেজিস্টার করা।

অবাক হলাম না কেন? ভাবে উয়েসুগি, যেমনটা ভেবেছিলাম, এই ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই। নিজের খেয়াল রাখার জন্য একজনকে খুঁজে নিয়েছে সে। আমি এর বাপ হলে এর ঘাড় ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতাম।

ভিক্টিমের ছেলে বা সাবেক স্বামীর থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ লিড বা তথ্য পেতে ব্যর্থ হয় উয়েসুগি ও তার পার্টনার। অন্যান্য তদন্তকারীরাও সুবিধা করতে পারেনি। মাত্র একজন সাক্ষীর-ই সাক্ষ্য পায় ওরা। সাক্ষীটা হল এক ইন্স্যুরেন্স কর্মী, খুনের দিন ভিক্টিমের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বিকাল ৫:৩০ নাগাদ বের হয়ে যায় সে। ওই ইন্স্যুরেন্স কর্মীর কথাবার্তায় অসঙ্গতি খুঁজে পেলে ওদের মনে হয় কিছু একটা হয়তো জানা যেতে পারে। কিন্তু খুব দ্রুতই তারও অ্যালিবাই পাওয়া যায়। (উয়েসুগির জানা নেই কিভাবে ব্যাপারটা ঘটেছে।)

টাস্কফোর্স প্রায় প্রতিদিনই প্রত্যেক ডিটেকটিভকে নিয়ে মিটিংয়ে বসলেও সন্দেহভাজনের কোনো প্রাথমিক তালিকাও দাঁড় করাতে পারেনি। ভিক্টিম মিনেকো মিতসুইর খুব বেশি বন্ধুবান্ধবও ছিল না। তার পরিচিত সবার দাবী এরকম একটা মানুষের কোনো শত্রু থাকা সম্ভব নয়। এমনকি পুলিশও এমন কাউকে খুঁজে পায়নি যে কিনা তার মৃত্যু থেকে লাভবান হবে। ক্রাইম সিন দেখে বোঝা যায় ডাকাতি বা ধর্ষণের কোনোরকম মনোভাব ছিল না খুনির।

একমাত্র অগ্রগতি বলতে, কেসটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ছোটখাটো যে রহস্যগুলো সামনে এসেছিল ওগুলো সমাধান করা। যেমন: ক্রাইম সিনে পাওয়া কেকে কেন ওয়াসাবি থাকবে অথবা ভিক্টিমের রান্নাঘরে ভালো কিচেন সিজরস থাকা সত্ত্বেও কেন নতুন একজোড়া কিচেন সিজরস পাওয়া যাবে। প্রত্যেকদিনের মিটিংয়ের ঘোষণার সুরে বলা হত, “এই এই ঘটনা ও ডিটেইলগুলো এই কেসে অপ্রাসঙ্গিক ও অসম্পর্কিত।” উয়েসুগির কোনো ধারণাই ছিল না কে, কিভাবে এই রহস্যগুলো সমাধান করেছে।

খুনের ছয়দিন পর ওরা অবশেষে এমন কিছু পায় যা লিড বা সূত্র বলার যোগ্য। খুন হওয়ার কয়েক মিনিট আগে মিনেকো মিতসুইর মোবাইল ফোনে কল করে কেউ একজন। ওরা জানতে পারে কলটা ধরার সময় কোথায় ছিল মিতসুই। তার অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই একটা পেস্ট্রি শপে দাঁড়িয়ে কলটা ধরে সে। একজন শুনতে পায় তার কথোপকথন। কথোপকথনের সারসংক্ষেপ :

“হ্যালো, হ্যাঁ?…ওহ, তুমি। কিন্তু পে ফোন থেকে কল করছো কেন?…আহারে। আচ্ছা, দাঁড়াও এক সেকেন্ড।”

“সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল তার কথার মধ্যে ছিল বন্ধুত্বসুলভ ভাব। তাই ধরে নেয়া যায়, মিনেকো মিতসুই কথা বলছিল পরিবারের কোনো সদস্য, আত্মীয় অথবা কোন বন্ধুর সাথে

যদিও এই কলারকে সরাসরি খুনি বলে রায় দেয়া যায় না। তবে এটুকু বলা যায়, ওই কলারের সাথে খুনের কোনো সংযোগ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ঠিক করা হয় আবারও ভিক্টিমের সকল পরিচিত মানুষের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হবে। এমনকি শিক্ষার্থী অবস্থায় যারা তার পরিচিত ছিল, খুঁজে বের করা হবে তাদেরও। জানার চেষ্টা করা হবে, অতি সম্প্রতি কেউ তার সাথে যোগাযোগ করেছিল কিনা।

এই কাজে নিয়োজিত ডিটেকটিভদের মধ্যে একজন ছিল উয়েসুগি। একটা বিষয় খোঁচাচ্ছিল তাকে। মিনেকো মিতসুয়ি পেস্ট্রি শপে গিয়েছে এটার খোঁজ কে পেল? তদন্তকারী দলের কাছে এর ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারেনি। উয়েসুগির মনে হতে থাকে এই পুরো তদন্তে কিছু একটা ঠিক নেই।

দুই

পেস্ট্রি শপের কর্মচারীর সাক্ষ্য শুনে তদন্ত দল উৎসাহ পেলেও, ভিক্টিমের আত্মীয়, বন্ধু বা পরিচিতরা দরকারী কোনো তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। শুধু একটা নতুন তথ্য সামনে আসে- যে আইনজীবীর সহায়তায় ডিভোর্স নেয় মিনেকো মিতসুই, তার সাথেই আর্থিক বিষয় নিয়ে পরামর্শ করছিল সে। যদিও সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। কিন্তু সাবেক স্বামীর সাথে আবারও দর কষাকষি করতে চাইছিল মিনেকো। স্পষ্টতই নিজের পায়ে দাঁড়ানো যতটা জটিল ভেবেছিল, বাস্তবে ব্যাপারটা তার থেকেও জটিল।

ধারণা করা হয় নাওহিরো কিয়োসির বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণ দাবী করে মামলা করতে চাইছিল মিতসুই। আইনজীবীর সাথে এর প্রাথমিক দিকগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছিল কেবল। এজন্যই ভিক্টিমের আইনজীবী শিজুকু তাকামাচির দিকে অতটা নজর দেয়নি পুলিশ।

দ্রুতই নাওহিরো কিয়োসির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া শুরু করে পুলিশ। একজনকে তার রক্ষিতা বলে সন্দেহ হয় ওদের। ডিভোর্সের পর ইউরি মিয়ামোতো নামের এক মেয়েকে নিজের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেয় কিয়োসো। কোম্পানির মধ্যে গুজব রটিয়ে পড়ে এই মেয়ে তার প্রেমিকা।

যদি মিনেকো প্রমাণ করতে পারত এই অবৈধ সম্পর্কের জন্যই তাদের ডিভোর্স হয়েছে তাহলে বেশ বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেত সে। অবশেষে পুলিশ এমন কাউকে পায় যে মিনেকোর খুন থেকে লাভবান হয়েছে। তবে ওইদিনের অ্যালিবাই ছিল নাওহিরো কিয়োসির। তবে এর মানে এই নয় সে কাউকে ভাড়া করে খুন করায়নি। আজকাল ডার্ক ওয়েব থেকে খুনি ভাড়া করা কঠিন কিছু নয়। ইউরি মিয়ামোতোর সাথে নাওহিরোর সম্পর্ক খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয় উয়েসুগিকে।

“এই লোকের বাড়ি গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করো,” ইয়োসাকু কিশিদার নাম ঠিকানা উয়েসুগির হাতে দিয়ে বলে ক্যাপ্টেন।

“কিশিদা? এই নামটা আমি আগে কোথাও দেখেছি।”

“এই লোক একজন অ্যাকাউন ট্যান্ট। কিয়োসির কোম্পানির আর্থিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করে সে। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কিয়োসিকে চেনে। কোম্পানির কোনো কর্মীকে ইউরির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে বলে: ‘বসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে কিশিদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।”

“মনে পড়েছে কোথায় এই লোকের নামটা দেখেছি। মিনেকো মিতসুইর সেলফোনের কললিস্টের ইনকামিং কলে এই লোকের কোম্পানির নাম ছিল, ঠিক না?”

“ঠিক। কিশিদা বলেছে মিতসুইর নাকি নিজের ট্যাক্স রিটার্নের ব্যাপারে আলাপ করতে কল করেছিল তাকে।”

“শুধু এটুকুই?”

“সবকিছুর সাথে এই ব্যাপারেও তাকে জিজ্ঞেস করবে।”

“ঠিক আছে।”

কাগজের টুকরোটা পকেটে পুড়ে নেয় উয়েসুগি।

“তোমার সাথে কি জুনিয়র কাউকে দেব?”

“সমস্যা নেই। এরকম ব্যাপার আমি একাই সামলাতে পারব।”

“উয়েসুগি পুলিশ স্টেশন থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই একজন ডাক দেয় দেয় তাকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে ডিটেকটিভ কাগা তার পিছে পিছে আসছে।

“আমি সাথে আসলে কোনো সমস্যা?”

“আপনি জানেন আমি কোথায় যাচ্ছি?”

“কিশিদার ট্যাক্স অ্যাকাউন্টেন্সি অফিসে। চিফের সাথে এই ব্যাপারে আপনাকে আলাপ করতে শুনলাম,” উত্তর দেয় কাগা

“যাওয়ার জন্য এত আগ্রহী কেন? অপনার মনে হয় তাকে গ্রেফতার করব?”

হাসে কাগা, “এমন কিছু ঘটলে কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আপনার। ওইখানে যাওয়ার পেছনে আমার নিজস্ব কারণ আছে। ‘

“আপনার নিজস্ব কারণ?” “

“পরে বলব। আপনার সাথে গেলে অসুবিধা নেই তো?”

“আপনাকে তো আর বাঁধা দিতে পারব না।” নাক দিয়ে শব্দ করে বলে উয়েসুগি।

ছয়তলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় কিশিদার অফিস। ঢুকেই একটা গাসডোরের অপর পাশে রিসিপশন ডেস্ক। রিসিপশনিস্টের পিছে বসে আছে একজন দুবলা পাতলা গড়নের পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি, নিজের ল্যাপটপে টাইপ করতে ব্যস্ত সে।

ভেতরে ঢুকে নিজের পরিচয় দেয়ার পর কিশিদার সাথে দেখা করতে চায় উয়েসুগি। উঠে দাঁড়ায় পেছনের লোকটা। সে-ই কিশিদা। একটু বিচলিত দেখায় তাকে। দুজন ডিটেকটিভকে নিয়ে মিটিং এরিয়াতে চলে আসে।

ওদের হাতে বিজনেস কার্ড দিয়ে নিজের পরিচয় দেয় কিশিদা। নাওহিরোর কিয়োসির সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে চায় উয়েসুগি। ইতস্তত করলেও কিশিদা জানায় দীর্ঘদিন ধরে একে অপরকে চেনে তারা দুজন।

“আর কিয়োসির পরিবারের সাথে? মৃত মিনেকো মিতসুইকে চিনতেন?”

সংশয়ে মাথা উঁচু করে কিশিদা।

“কিয়োসির স্ত্রীর সাথে ওরকম কোনো যোগাযোগ ছিল না আমার। ওদের বাড়িতে কখনো যাইনি বলা যায়।”

“জুনের ২ তারিখে মিস মিতসুইর ফোন কল পান আপনি। কেন কল করেছিল আপনাকে?”

“আপনাকে তো এরইমধ্যে জানিয়েছি।”

“আবারও একই প্রশ্ন করছি দেখে দুঃখিত। দয়া করে আরো একবার জানান আমাদেরকে। বিস্তারিত।” নোটবুক বের করে উয়েসুগি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিশিদা।

“সে জানতে চাইছিল তার ট্যাক্স রিটার্নের যত কত টাকা পারিশ্রমিক নেব আমরা। যেহেতু তার আয় বা খরচের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না সেহেতু কিছু বলতে পারিনি। শুধু জানাই, কাজটা আমাদের করতে দিলে যেভাবেই হোক ঠিকভাবে করে দিবো।”

“এছাড়া আর কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল?”

“নাহ, এটুকুই। বেশিক্ষণ কথা হয়নি তার সাথে।”

“কিয়োসির ডিভোর্সের কারণ সম্পর্কে কিছু জানেন?”

একমুহূর্ত ভাবে কিশিদা।

“যতদূর জানি মিনেকোই ডিভোর্স চেয়েছিল। এটুকুই জানি শুধু। এই ব্যাপারটা ওরা দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। এখানে আমার নাক গলানোর মত কিছু ছিল না।”

“আপনার মনে হয় না ডিভোর্সের পিছনে মিস্টার কিয়োসিরও কোনো কারণ ছিল? অন্য কোনো নারীর সাথে সম্পর্ক বা এমন কিছু?”

চোখ বড় হয়ে যায় কিশিদার। জোরে মাথা নেড়ে নাকচ করে দেয় সে।

“আমার মনে হয় না। মিস্টার কিয়োসি অনেক কড়া প্রকৃতির মানুষ। এরকমটা করার কথা না তার।”

সরাসরি প্রসঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় উয়েসুগি।

“সম্প্রতিই একজন নতুন ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগ দিয়েছে সে। মেয়েটার নাম ইউরি মিয়ামোতো। তার ব্যাপারে কি জানেন? পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে চাকরিটা দেয়া হয়েছে নাকি তাকে?”

“নাহ…ইয়ে… না,” তোতলিয়ে বলল কিশিদা। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তার চেহারা। “দেখুন, আমি একজন হিসাবরক্ষক। আমার ক্লায়েন্ট কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স সম্পর্কে আমার ধারনা নেই। যতদূর শুনেছি, চাকরি দেয়ার আগে থেকেই মিস মিয়ামোতো মিস্টার নাওহিরোর পরিচিত। এটুকুই জানি শুধু।”

“তারা ‘পরিচিত’ ছিল? এই ‘পরিচিত’ এর ধরনটা কেমন?”

“ভাই আমি সত্যিই জানি না। এটাই বলতে চাইছি এতক্ষণ ধরে, স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলে কিশিদা।

লোকটা ভয় পেয়েছে। মুখ খুললে নিশ্চিত তাকে শূলে চড়াবে কিয়োসি, ভাবে উয়েসুগি।

“শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?” উয়েসুগি হাঁটা ধরতে গেলে বলে উঠে কাগা। “দশ জুন সন্ধ্যায় আপনি কোথায় ছিলেন, মিস্টার কিশিদা?

হতবিহ্বল হয়ে কাগার দিকে তাকায় কিশিদা। চমকে যায় উয়েসুগিও। ভিক্টিমের সাথে সম্পর্কিত সবার অ্যালিবাই খতিয়ে দেখা স্বাভাবিক হলেও কিশিদাকে সন্দেহভাজন মনে করার কোনো উপায়ই নেই। এখন কিশিদাকে যদি অ্যালিবাইয়ের জন্য জোর দেয় কাগা, তবে পুরো ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হতে পারে, সেইসাথে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে তদন্তেও।

“কি? আমাকে সন্দেহভাজন ভাবছেন?” নিশ্চিতভাবেই ক্রোধের ছায়া পড়ে কিশিদার চেহারায়।

“আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন এই পুরো বিষয়টাই একটা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া মাত্র। বাকিদেরও একই প্রশ্নই করেছি আমরা,” দ্রুত বলে কাগা। উয়েসুগির দিকে উদ্বিগ্ন ও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় কিশিদা। হেসে মাথা নেড়ে সায় জানায় উয়েসুগি।

“দুঃখিত, এটাই নিয়ম। বুঝতেই পারছেন।”

“একটু যেন স্বস্তি পায় কিশিদা। বিড়বিড় করে অফিসের ভেতরে যায় সে, একটু পর ফিরে আসে একটা নোটবুক নিয়ে।

“জুনের দশ তারিখ কাজ শেষে আমার ছেলের ওখানে যাই,” ডায়েরির পাতা উল্টে জানায় কিশিদা।”

“এখান থেকে কখন বের হয়েছিল?”

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ। এর থেকে নির্দিষ্ট করে সময়টা বলতে পারছি না।”

বিস্তারিত বলে কিশিদা। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা বুকস্টোরে যায় সে। সেখান থেকে আটটা নাগাদ যায় তার ছেলের অ্যাপার্টমেন্টে। রাত নটার একটু পর সেখান থেকে বেরিয়ে শিনবাশির একটা বারে যায় সে। ওখানে যাওয়া তার প্রতিদিনের রুটিন। এরপর মাঝরাত নাগাদ বাড়ি ফেরে সে। কিশিদার কাছ থেকে তার ছেলে, ছেলের স্ত্রী ও শিনবাশির ওই বারের ঠিকানা চায় কাগা।

“আমার পক্ষ থেকে আপাতত এটুকুই,” জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করার জন্য ঘোষণার সুরে বলে কিশিদা।

রাস্তায় নামার সাথে সাথেই কাগাকে ধরে উয়েসুগি।

“অ্যালিবাইয়ের জন্য লোকটাকে জোর-জবরদস্তি করার সঠিক সময় ছিল না ওটা। এরকম বোকার মত কাজ করবেন না। ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি।”

“তাকে জিজ্ঞাসা করার অধিকার আমার নেই এমনটা বলতে পারবেন না আপনি। ওইদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত ওই লোকের কোনো অ্যালিবাই নেই।”

“এতে সমস্যাটা কোথায়? অ্যালিবাই থাকা লোকের থেকে অ্যালিবাই না থাকা লোকের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া কিশিদাকে সন্দেহ করার কোনো কারণই নেই।”

থেমে গিয়ে বুলভার্দে চলতে থাকা গাড়িগুলোর দিকে তাকাল কাগা।

“কোকি কিয়োসির সাথে দেখা করেছেন?” হুট করেই জিজ্ঞেস করল সে। তার চোখ রাস্তায়। “ভিক্টিমের একমাত্র ছেলে?”

“হ্যাঁ, খুনের পরদিনই দেখা করতে গিয়েছিলাম,” বলে উয়েসুগি। “ছেলেটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গর্দভ একটা।”

কাঁধ ঝাঁকায় কাগা। “ বেশ রুঢ়ভাবে বললেন।”

“এরকম ছেলেপেলে আমার একেবারে অপছন্দ। ঈশ্বর এদেরকে পৃথিবীতে পাঠায়, কিন্তু ছাগলগুলো নিজেদের জন্য কিছুই করতে পারে না। আসলে দোষ এদের বাপ-মার। ছেলে মেয়ে ঘৃণা করবে ভেবে অনেক বাবা-মা সন্তানকে একেবারেই শাসন করে না। এতে হিতে-বিপরীত হয়। একেবারে নষ্ট হয়ে যায় সন্তানরা।”

অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না উয়েসুগি। গলা খাকরি দেয় সে। “ওই গর্দভকে দিয়ে কি-ই বা হবে?” জিজ্ঞেস করে উয়েসুগি।

“তার মায়ের কথা বলার ধরন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। মানে কার সাথে তার মা আন্তরিক ছিল আর কার সাথে নয়।”

পে ফোনে কে ফোন দিয়েছিল মিতসুইকে সেটা জানার চেষ্টা করেছে কাগা, এটা দেখে অবাক হয় উয়েসুগি। আগ্রহী না হয়ে পারে না সে।

“ওহ?”

“তার মতে, মিস মিতসুই আর দশটা মানুষের মতোই ছিল। পরিচিত কারোর সাথে তার মা বেশ স্বচ্ছন্দ্যেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলত। আর একটু অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলত গম্ভীর, অপ্রস্তুতভাবে।”

“ছেলেটা অকর্মার ঢেঁকি। ওর কাছ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর আশা করাটা বোকামি।”

“তাকে একটা তালিকা দিতে বলেছিলাম। যাদের সাথে মিয়েকো মিতসুী স্বাভাবিক ও আন্তরিকভাবে কথা বলত তাদের নাম থাকবে ওই তালিকায়। গত দুই বছর মার সাথে দেখা হয়নি তার। অনেককেই ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তার। কিন্তু চেষ্টা করে কয়েকটা নাম দিয়েছে সে। ধারণা করতে পারবেন কে আছে ওই তালিকায়?” নাটকীয় ভঙ্গিতে থেমে যায় কাগা। “ইয়োসাকু কিশিদা, কোম্পানির হিসাবরক্ষক।”

“কি!” বড় হয়ে যায় উয়েসুগির চোখ। “ইয়ার্কি করছেন নাকি?”

“আমাদের এই হিসাবরক্ষক প্রায়ই কিয়োসির বাড়ি যেত। তার সাথে বেশ স্বচ্ছন্দ্যেই মা’কে কথা বলতে শুনতো কোকি। যেহেতু তার স্বামীর সাথে কিশিদার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, ফলে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া পরিচিত মানুষদের সাথে বেশ আন্তরিকই ছিল মিস মিতসুই’র ব্যবহার।”

গুঙিয়ে ওঠে উয়েসুগি। “আর একটু আগে কিশিদা আমাদের বলল সে কিয়োসির ওখানে প্রায় কখনোই যায়নি!”

“সন্দেহের গন্ধ পাচ্ছেন না?” হেসে বলে কাগা।

ঠোঁট কামড়ে কাগার দিকে তাকায় উয়েসুগি।

“এখন বুঝলাম কেন আমার সাথে আসার জন্য এত আগ্রহী ছিলেন আপনি। ভাবছি এই অসঙ্গতি কিশিদাকে সন্দেহভাজন হিসেবে দেখার জন্য যথেষ্ট কিনা? মিনেকো মিতসুইকে খুন করার মত কোনো মোটিভ-ই নেই এই লোকের।”

“হয়তো আমরা এখনো মোটিভটা খুঁজে পাইনি।”

“বাদ দিন। এভাবে ভাবলে সন্দেহভাজনের অভাব হবে না। “ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরে উয়েসুগি। কয়েক ধাপ যাওয়ার পর থেমে আবারও ঘুরে দাঁড়ায়। “কাউকে গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলে অন্য কোনো পার্টনার খুঁজে নিন। উপরমহল আমাকে যা বলবে আমি সেটাই করব। এর বেশিও না, কমও না। আমার অবসরের সময় ঘনিয়ে আসছে।”

হাসে কাগা। উয়েসুগি বোঝে না তার বলা কথাটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছে কিনা সে।

তিন

দ্রুত গর্জন করে চলে যায় একটা বিশাল ট্রাক। পাশে দ্রুত গতিতে ছুটে চলে একটা লাল রংয়ের গাড়ি। পিছন থেকে ধেয়ে আসে একটা এসইউভি।

হুট করে হাজির হয় একটা মোটরবাইকও। এসইউভি ছাড়িয়ে এটা জায়গা করে নেয় ট্রাক ও লাল গাড়িটার মাঝে।

এক ক্যান কফি হাতে দৃষ্টিসীমার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত বাইকটা দেখতে থাকে উয়েসুগি। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক দেয়। ভাবে তার শারীরিক অবস্থা কফির স্বাদে প্রভাব ফেলছে কিনা।

নাইটক্লাবে ঘণ্টাখানেক থাকার পর পুলিশ স্টেশনে ফিরছে উয়েসুগি। ওই নাইটক্লাবে হোস্টেস হিসেবে কাজ করত ইউরি মিয়ামোতো। ফলে তার পুরানো কর্মক্ষেত্র একটু খতিয়ে দেখাটা জরুরিই। নাওহিরো কিয়োসির সাথে ইউরি মিয়ামোতোর সম্পর্কের ধরনটা যাচাই করতে হবে, সম্পর্কটা যদি শারীরিক হয়ে থাকে তবে জানা দরকার কবে থেকে চলছে এটা।

কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে উয়েসুগি। প্রত্যেকেই দিয়েছে একইরকম হতাশাজনক উত্তর, নাওহিরো কিয়োসি আর ইউরি মিয়ামোতোর মধ্যে কিছুই চলছে না।

“তাদের দুজনকে একসাথে দেখলেই আমার কথাটা বুঝতে পারবেন,” কালো স্যুট পরা নাইটক্লাবের এক কর্মী বলে। “মিস্টার কিয়োসির পছন্দের মেয়ে ইউরি, এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মনে হয় না ইউরির প্রতি কোনো লালসা আছে তার। ইউরির সাথে শুধুই কথা বলতে পছন্দ করে সে। কিভাবে বোঝাই? বরং ওদের সম্পর্কটা বাবা-মেয়ের মত।”

সম্ভবত এখানে সময় নষ্ট করছি আমি, ভাবে উয়েসুগি। আমরাই হয়তো বেশি জটিল করে ভাবছি। হয়তো নিজের পছন্দের হোস্টেসকে স্বাভাবিকভাবেই চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে কিয়োসি; আর কিছু না। এক্ষেত্রে মিনেকো মিতসুই কোনোভাবেই ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারত না। কিয়োসিরও খুনের কোনো মোটিভ থাকার কথা নয়।

ঈষৎ উষ্ণ কফিটা গেলার সাথে সাথেই পিছন থেকে একজনের ডাক শুনতে পায় উয়েসুগি। “মনে হচ্ছিল আপনাকে এখানেই পাবো,” তার দিকে এগিয়ে এসে বলে কাগা ।

“কিভাবে জানলেন আমি এখানে?” জিজ্ঞেস করে উয়েসুগি।

“আপনার এক কলিগ জানালো আপনি জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিনজায় গিয়েছেন। তার মতে, এই রাস্তা ধরেই ফিরবেন আপনি।”

ফাঁকা ক্যানটা হাতের চাপে পিষে ফেলে উয়েসুগি।

“এরা মুখ বন্ধ রাখা শিখল না।

যেহেতু তার সহকর্মী কাগাকে এই জায়গা সম্পর্কে বলেছে, সেহেতু উয়েসুগি এখানে কি কাজে এসেছে, সেটাও আর অজানা নেই। কাগার দিকে না তাকিয়ে পারেনা উয়েসুগি। “কি চান?” জিজ্ঞেস করে।

“একটা ব্যাপারে আপনার মতামত চাই। আপনি কি আমার সাথে ওই হিসাবরক্ষকের ছেলের ফ্ল্যাটে যাবেন?

“আবার ওই হিসাবরক্ষক? আপনি আসলেই জানেন না কখন কোনটা বাদ দিতে হয়।”

“ব্যাপারটা ট্যাক্স রিটার্নের নয়।”

“এবার কি বলতে চাইছেন তাহলে?”

“মিস্টার কিশিদার অফিসে কল করেছিল মিস মিতসুই। কিশিদা বলেছে, ট্যাক্স রিটার্নের ব্যাপারে আলাপ করতে কল দিয়েছিল সে। আমার মনে হয় না কথাটা সত্য।”

“তাহলে কেন কল করেছিল সে?”

“আমার ধারণা সে কিশিদাকে কল করেছিল তার সাবেক স্বামী ও ইউরি মিয়ামোতোর সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে। সম্পর্কটা শারীরিক কিনা, কবে শুরু হয়েছে- এসব। ট্যাক্স রিটার্ন সম্পর্কিত কিছু হয়তো শুরুতে জিজ্ঞেস করেছিল তবে সেটা অযথাই।”

“কিছুক্ষণ চুপ থাকে উয়েসুগি। তার কাছে যৌক্তিকই লাগে কাগার থিওরি। সাবেক স্বামীর প্রেম সম্পর্কে জানার জন্য তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করাই ছিল মিনেকোর জন্য সবথেকে সহজ পথ। আর লোকটা তার পরিচিতও।

“কিশিদার সাথে দেখা করতে গিয়ে কেন এই প্রসঙ্গ তুললেন না?”

“তখন আমার মনে হয়েছিল নাওহিরো কিয়োসি ও ইউরি মিয়ামোতোর সম্পর্কের ব্যাপারে জানে সে। আর আমাদের থেকে সেটা লুকানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু এখন বুঝছি, ব্যাপারটা এরকম নয়। মিস্টার কিয়োসি ও মিস মিয়ামোতোর মধ্যে কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই, অন্তত রোমান্টিক কিছু তো নয়ই। আমার ধারণা আপনি গিনজাতে গিয়েও এমন কিছুই জেনে এসেছেন, ঠিক না ডিটেকটিভ?”

কাগার দিকে তাকায় সে।

“কিভাবে জানলেন সেটা?”

“এই ব্যাপারে পরে বলব। যাইহোক, মিস্টার কিয়োসি ও মিস মিয়ামোতোর মধ্যে যেহেতু কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই, সেহেতু আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকানোর মতও ছিল না মিস্টার কিশিদার। তাহলে কি মিস মিতসুয়ি ফোনে তার কাছে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে চেয়েছে? যেভাবেই ভাবুন না কেন, কিছু একটা ঠিক নেই। “ ঘুরে উয়েসুগির চেহারার দিকে তাকায় কাগা। “এখনও কি মানবেন না ইয়োসাকু কিশিদার ব্যাপারে ঠিকমত খোঁজখবর নেয়া জরুরি?”

হিসিয়ে ওঠে উয়েসুগি।

যদি এটা করতেই চান, তবে আমার ক্যাপ্টেনের সাথে আলাপ করুন আগে। আপনার জন্য ভালো একজন পার্টনার নিযুক্ত করবে সে, যে এই কাজের যোগ্য। দুজন মিলে ভালোমতোই গ্রেফতার করতে পারবেন।”

“কিন্তু কিশিদাকে খতিয়ে দেখার দায়িত্ব তো আপনাকে দেয়া হয়েছে। যাইহোক, এখান থেকে ট্যাক্সি ধরে পনেরো মিনিটের মধ্যে কিশিদার ছেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাতে পারব আমরা।”

“হ্যাঁ, কিন্তু…“

উয়েসুগিকে পাত্তা না দিয়ে হাত উঁচিয়ে একটা ট্যাক্সি থামায় কাগা। ট্যাক্সির দরজা খুলে উয়েসুগিকে ওঠার আমন্ত্রণ জানায়।

বিরক্ত হয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসে উয়েসুগি।

******

ট্যাক্সিতে করে অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার পথে কিশিদার পুত্র ও পুত্রবধূর ব্যাপারে সংক্ষেপে উয়েসুগিকে জানায় কাগা। একটা কনস্ট্রাকশন কনসাল্টিং কোম্পানিতে কাজ করে কাতসুয়া কিশিদা। সে ও তার স্ত্রী দুজনেরই বয়স ঊনত্রিশ। তাদের একমাত্র ছেলের বয়স পাঁচ।

“এত কিছু যেহেতু জানেন, নিজেই গিয়ে কাজটা সেরে আসুন না। আমি কিছু মনে করব না।”

জবাব দেয় না কাগা। “ওই যে, ওই বিল্ডিংটা,” আঙুল দিয়ে ইশারা করে কাগা। আগে থেকেই ঠিকানাটা বের করে রেখেছিল সে।

বাড়িতে ফেরেনি কাতসুয়া কিশিদা। তার স্ত্রীর মতে ক্লায়েন্টদের আপ্যায়নের দিকটা দেখভাল করতে হয় তার, এজন্য ফিরতে ফিরতে রাত হয়।

খুনের ব্যাপারটা উল্লেখ না করেই কাতসুয়ার স্ত্রীকে উয়েসুি জিজ্ঞাসা করে দশ জুন সন্ধ্যায় ইয়োসাকু কিশিদা এসেছিল কিনা। রেইকো জানায় আটটার দিকে এসেছিল সে। সেদিন আগে থেকেই কিশিদা ফোন দিয়ে জানিয়ে রেখেছিল সন্ধ্যায় আসবে তার স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী আয়োজনের ব্যাপারে আলাপ করতে। উয়েসুগি জানতে চায় সেদিন কিশিদার আচরণ কেমন ছিল। তাকে স্বাভাবিকই লাগছিল বলে জানায় রেইকো। এই জিজ্ঞাসাবাদকে খুব বেশি গুরুত্বের সাথে নেয়নি ওই মহিলা। আর প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে ঘরটার চারিদিকে তাকায় উয়েসুগি। তার চোখে পড়ে কয়েকটা জিনিস : ঘরের তুলনায় অতিরিক্ত বড় টিভি, বিদেশি মদের বোতল, সোফায় পড়ে থাকা দামী ব্র্যান্ডের হ্যান্ডব্যাগ।

মেঝেতে বসে একটা লাটিম নিয়ে খেলছিল পাঁচ বছরের ছেলেটা। আগ্রহী দেখায় কাগাকে, বাচ্চার মাকে জিজ্ঞেস করে লাটিমটা কোত্থেকে কেনা। সে জানায়, তার শ্বশুর ইয়োসাকু কিশিদা বারোই জুন সন্ধ্যায় এনে দিয়েছে এটা।

“আপনি নিশ্চিত ওইদিন ১২ জুন ছিল?”

“হ্যাঁ, নিশ্চিত। কেন কি হবে এতে?”

“তেমন কিছু নয় আরকি,” বিড়বিড় করে কাগা। তার চোখের উজ্জ্বলতা চোখ এড়ায় না উয়েসুগির।

খামোখা সময় নষ্ট হল,” বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরিয়ে বলে উয়েসুগি। “কিশিদার সেদিন আটটায় আসার ব্যাপারে মনে হয় সত্যিই বলছে মহিলা। যদিও এটা কিশিদার অ্যালিবাই পুরোপুরি নিশ্চিত করছে না। তবে ভাবছি কেন সেদিন এখানে আসবে সে?”

“আমরা এখনো জানি না। তবে আপনি ওই স্বামী-স্ত্রী’র জীবনযাপনের ধরনটা দেখলেন? এটা কি আপনাকে খোঁচাচ্ছে না?” জিজ্ঞেস করে কাগা।

“নিশ্চিতভাবেই বেশ বিলাসী জীবনযাপন করে ওরা। তবে বলব না ব্যাপারটা আমাকে খোঁচাচ্ছে। সময় খারাপ হোক অথবা ভালো, পয়সাওয়ালা লোকের হাতে সবসময়ই পয়সা থাকে।”

“ঠিক এটাই বলতে চাইছিলাম। মহিলা বলল, প্রায়ই ক্লায়েন্টদের সাথে সময় কাটাতে হয় তার স্বামীকে। আমি ঐ কোম্পানিতে কল দিয়েছিলাম ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য। ওরা জানাল কাতসুয়া কিশিদা অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। আমি যতদূর জানি, ক্লায়েন্টদের আপ্যায়ন অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টের লোকদের কাজ নয়।”

থেমে কাগার দিকে তাকায় উয়েসুগি।

“কি বলতে চাইছেন?”

“আমি নিজেও এখনো জানি না,” কথাটা বলে হাত উঁচু করে কাগা। ওদের পাশে এসে থামে একটা ট্যাক্সি।

চার

পরদিন ভিন্ন একটা কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে উয়েসুগি। তবে টাস্কফোর্স হেডকোয়ার্টারে গেলে ক্যাপ্টেন ডেকে পাঠায় তাকে। উয়েসুগিকে ঢুকতে দেখে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় ক্যাপ্টেন, এরপর ডেস্কের ভেতর থেকে বের করে একটা জিনিস। জিনিসটা দেখে শ্বাসরোধ হয়ে আসে উয়েসুগির।

ক্যাপ্টেনের হাতে একটা লাটিম: কাঠের তৈরি লাটিমটার সবুজ ও হলুদ রঙের নকশা করা। এই লাটিমটা নিয়েই কাতসুয়া কিশিদার ছেলে খেলছিল।

“এটা এখানে কি করছে?” মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল উয়েসুগি।

“নিনগিয়োচোর এক খেলনার দোকান থেকে এটা নিয়ে এসেছে কাগা। এই লাটিমের সাথে একপ্রস্থ দড়িও পাওয়া যায়। দড়িটা ফরেন্সিকে পাঠিয়েছে কাগা। দাগের সাথে দড়িটা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।”

দাগ? মানে শ্বাসরোধে কারণে ভিক্টিমের গলায় পড়া দাগটা।

খুনের অস্ত্রের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। খুনটা করতে ব্যবহৃত হয়েছে তিন থেকে চার মিলিমিটার উচ্চতার দড়ি, এটা জানা থাকলেও এরকম ধরনের কিছু এখনো পায়নি ওরা।

“ওহ, আর এটা তোমাকে দিতে বলেছে সে।”

উয়েসুগিকে একটা হাতে লেখা চিরকুট ধরিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন।

চিরকুটে লেখা: “নিনগিয়োচোর এক খেলনার দোকান থেকে এরকম একটা লাটিম চুরি গিয়েছে ১০ জুন সন্ধ্যায়। কাগা।”

খুনের দিনে চুরি!

“কাগা চায় তুমি যেন আমাকে এই লাটিমের ব্যাপারে বিস্তারিত বলো। লোকটা কিসের কথা বলছিল?” বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ক্যাপ্টেনের কন্ঠে।

প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় উয়েসুগি। “ফরেনসিক কি বলেছে?” জিজ্ঞেস করে সে।

ক্যাপ্টেন বুঝতে পারল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মেজাজে নেই উয়েসুগি। ডেস্কের কোনা থেকে একটা ডকুমেন্ট তুলে নেয় সে।

“দড়ির পুরুত্ব আর ফাইবারের প্রস্থ ভিক্টিমের গলার দাগের সাথে পুরোপুরি মিলে গিয়েছে।

“শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে উয়েসুগি। তার রক্ত সঞ্চালনের গতি বেড়ে গিয়েছে। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল ক্যাপ্টেন, কিন্তু তাকে থামিয়ে দেয় উয়েসুগি।

“কাগা কোথায়?”

“জানি না। কোথাও গিয়েছে হয়তো। বলে গিয়েছে এই সম্পর্কিত আরও কিছু বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে।

“আচ্ছা। তার সাথে কথা বলে আমার রিপোর্ট অপনাকে দিব। একটু অপেক্ষা করতে হবে।”

“ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি?”

ক্যাপ্টেনের কড়া দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে বাউ করে বেরিয়ে যায় উয়েসুগি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাতটা বাজছে কেবল।

আটটার কাছাকাছি সময়ে ফিরল কাগা। বাহু আঁকড়ে টেনে হিঁচড়ে তাকে প্যাসেজওয়েতে নিয়ে যায় উয়েসুগি।

“কি সমস্যা আপনার? রাস্তাভর্তি লোকজনের মাঝে নায়ক হওয়ার ইচ্ছা থাকলে হবেন। তবে আমার সাথে নাটক করবেন না।”

ভদ্রভাবে তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয় কাগা।

“ছোটখাটো থানার ডিটেকটিভরা কখনো একা একটা কেস সমাধান করে না। এখন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল লাটিম। শুনেছেন?”

“হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন বলেছে। কেন এটা নিয়ে পড়ে ছিলেন?”

“ঠিক জানি না, সত্যিই। লাটিম জিনিসটা মূলত নববর্ষের উপহার হিসেবে দেয়া হয়। তাছাড়া এমন নয় যে সব দোকানে সবসময় অহরহ লাটিম পাওয়া যায়। কোথায় এই জিনিস বিক্রি হতে পারে? আমার মাথাতে শুধু একটা জায়গারই নাম আসে।”

“নিনগিয়োচোর খেলনার দোকানে? ভালোই মনে রেখেছেন দেখছি।”

“মাথা নেড়ে সায় জানায় কাগা ।”

“এখানে বদলি হয়ে আসার পর থানার আশেপাশে প্রায়ই ঘুরে বেড়াই আমি। কোথায় কি বিক্রি করে ভালো ধারণা আছে আমার।“

“মনে তো হয় না প্রতিদিন আপনাকে দেখে দোকানদাররা খুব বেশি খুশি হয়।”

“আমারও তাই মনে হয়। এজন্যই এমনভাবে যাই যেন আমাকে দেখে পুলিশ মনে না হয়,” শার্টে সামান্য টোকা দিয়ে বলে কাগা।

তাহলে এটাই কারণ, ভাবে উয়েসুগি, এজন্যই সে এরকম পোশাক পরে ঘোরে।

“বললেন লাটিমটা চুরি করা?”

“দশ জুন সন্ধ্যায় চুরি করা হয় এটা। ঠিক খুনের আগে।”

“দোকান থেকে চুরি করে জিনিসটা ক্রাইম সিনে নিয়ে যায় খুনি? কেউ এমনটা করতে পারে?”

“ঈশ্বরই জানেন। তার দুনিয়াতে সম্ভব।”

“দড়ির সাথে গলার দাগটা মিলে গিয়েছে। কিন্তু প্রমাণ করতে পারব না ঠিক এই দড়িটা দিয়েই শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।”

“জানি। তবে লাটিম থেকে দড়িটা ইয়োসাকু কিশিদাই খুলে নিয়েছিল এটুকু অন্তত নিশ্চিত হতে পারছি আমরা।

ভ্রু কুঁচকায় উয়েসুগি। বুঝতে পারে না কাগা কি বলতে চাইছে। “কিশিদা তার নাতিকে একটি লাটিম ও দড়ি দেয়। তবে ওই দড়ি লাটিমের সাথে থাকা দড়িটা নয়। ওটা বিনুনি করা দড়ি, পেঁচিয়ে বানানো না। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও থেকে আরেকটা দড়ি জোগাড় করে এনে আসল লাটিমের সাথে জুড়ে দেয় কিশিদা।”

“আপনার মতে খুনের পর আসল দড়িটা ফেলে দিয়েছে সে?”

“হ্যাঁ, আমার সেটাই ধারণা।”

“এর মানে…. একমুহূর্ত ভাবল উয়েসুগি। “যে দোকান থেকে কিশিদা বিনুনি করা দড়িটা কিনেছিল সেই দোকানটা বের করতে পারলে দারুণ হবে।”

“এজন্যই দোকানটা খোঁজার চেষ্টা করছি আমি,” বলে কাগা।

“খুঁজে পেয়েছেন নাকি?

“সম্ভবত,” কয়েকবার মাথা নেড়ে সায় জানায় কাগা। “দুই তিনদিনের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে যাবো।”

পাঁচ

ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা বাজছে। পার্ক করে রাখা গাড়িতে বসে আছে উয়েসুগি ও কয়েকজন ডিটেকটিভ। নজর রাখছে পাশের বিল্ডিংয়ের লবিতে। এই বিল্ডিংয়ের ভেতরেই কিশিদার অফিস। ভেতরেই আছে সে। আরেকটা দল নজর রেখেছে পেছনের দরজায়। যদিও কিশিদার গ্রেফতারী পরোয়ানা এখনো জারি হয়নি। তবে আপাতত তাকে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উঠিয়ে আনাটাই পরিকল্পনা। উয়েসুগির মতে তাকে একবার কাস্টডিতে আনতে পারলে স্বীকারোক্তি পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

নতুন একসেট লাটিম নিয়ে এসেছে কাগা: ছোট,বড়, মাঝারি তিন আকৃতির লাটিম আছে ওতে। দোকানের সব লাটিমই বক্স সমেত উঠিয়ে এনেছে সে। রাস্তার ধারের একটা হস্তশিল্পের দোকানে পেয়েছে ওগুলো। সবগুলো লাটিমের দড়িই বিনুনি করে বানানো

“শুধু লাটিমের দড়ি কেনা যায় না। আমার ধারণা দড়ির জন্য একটা নতুন লাটিমই কিনেছিল কিশিদা। যে দোকান থেকে প্রথম লাটিমটা চুরি করেছিল সে, ওখান থেকে দ্বিতীয়টা কেনার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার। এজন্য আরেকটা দোকান খুঁজে বের করেছি আমি, যারা কাঠের লাটিম বিক্রি করে।”

“প্রত্যেকটা আকৃতির লাটিমের দড়ি ভিন্ন। কাগার ধারণা ছিল অনেকগুলো দড়ি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর যেটা আসল লাটিমের সাথে মিলে সেটাই কিনে আনে সে।

কাগার সন্দেহ-ই সঠিক। ফরেনসিকক বক্সগুলো খতিয়ে দেখে যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পায় সেটা মিলে যায় কিশিদার বিজনেস কার্ডের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে।

এখন শেষ যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন সেটা হল, কেন কিশিদা লাটিমটা তার নাতিকে দিতে গেল, আর দেয়ার জন্য কেনই বা এত ঝক্কি পোহাল। এই ব্যাপারেও কাগার একটা থিওরি আছে।

“জুনের দশ তারিখে কিশিদা তার ছেলের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই লাটিম নিয়ে কিছু একটা ঘটেছিল। তাছাড়া এত ঝক্কির মধ্যে যেত না সে।”

কিন্তু এই “কিছু একটা” আসলে কি? এই প্রশ্নের উত্তরে খোঁজে এখন কাতসুয়া কিশিদার অ্যাপার্টমেন্টেই গিয়েছে কাগা। কাতসুয়ার স্ত্রী রেইকোর কাছ থেকে প্রকৃত তথ্যটা পাওয়ার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী সে।

ঠিক সাড়ে ছ’টা নাগাদ উয়েসুগির ফোনে একটা কল এলো।

“উয়েসুগি বলছি,” বলল সে।

“কাগা বলছি। কেবল কাতসুয়া কিশিদার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম।” “

“যা জানার জন্য গিয়েছিলেন সেটা কি জানতে পেরেছেন?”

“অবশ্যই পেরেছি। আমার ধারণাই ঠিক। দশ জুন সন্ধ্যায় কিশিদার ব্রিফকেসে একটা লাটিম ছিল। যেটা চুরি গিয়েছে, ঠিক সেটার মতোই। ব্রিফকেস নিয়ে টানাহেঁচড়া করার সময় তার নাতি খুঁজে পায় এটা।”

দ্রুতই ব্যাখ্যা করল কাগা। শুনে গেল উয়েসুগি।

“আচ্ছা। এক কথায়, গাড্ডায় পড়ে যায় সে। নাতিকে লাটিমটা না দিয়ে উপায় ছিল না তার।”

“আমি পরোক্ষভাবে রেইকো কিশিদাকে জানিয়ে এসেছি ইয়োসাকু কিশিদার অ্যালিবাই অর্থহীন আর লাটিমের দড়িটা ভিন্ন। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এখন ফোনে কথা বলছে সে। হয় তার শ্বশুর নয়তো স্বামীর সাথে।”

“আচ্ছা। বাকিটা আমার হাতে ছেড়ে দিন।“

ফোন রেখে দিলো উয়েসুগি।

দশ মিনিট পর বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো কিশিদা। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। সন্ধ্যার অস্তমিত সূর্যের ছায়া পড়ছে চেহারায়।

নিজের লোকদেরকে ইশারা করল উয়েসুগি। সব ডিটেকটিভ কার থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল কিশিদার দিকে।

পথ রোধ করে দাঁড়ানোর পরও কিছু বলল না কিশিদা। আনমনে উয়েসুগির দিকে তাকাল, মনে হল তার মনোযোগ অন্য কোথাও। হঠাৎ করেই যেন ডিটেকটিভদের উপস্থিতি টের পেল সে, বড় হয়ে গেল চোখ। তবুও কিছু বলল না।

“মিস্টার কিশিদা,” বলল উয়েসুগি। “আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা আছে। আমাদের সাথে একটু আসতে পারবেন?”

চোয়াল ঝুলে পড়ল কিশিদার, চোখে ভয়ের ছাপ। শুকনো গালের কারণে তাকে জীবন্ত মানুষের থেকে মৃত বলেই বেশি মনে হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে কেঁপে উঠে হাঁটু ভেঙে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল কিশিদা।

ছয়

ইয়োসাকু কিশিদার জবানবন্দি

সাতাশ বছর আগে নাওহিরো কিয়োসি প্রথম যোগাযোগ করে আমার সাথে। একই কলেজে পড়তাম আমরা। যদিও আমার থেকে এক বছরের বড় সে। একটা ক্লিনিং কোম্পানি দাঁড় করানোর কথা ভাবছিল, এজন্য আমার সাহায্য চায় সে। তখন কেবল নিজের অ্যাকাউন্টিং ফার্মটা শুরু করেছি আমি। আমার ব্যবসার অবস্থা তখন খুব একটা ভালো নয়, দ্বিতীয়বার না ভেবেই তার প্রস্তাব গ্রহণ করি আমি। কিয়োসির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতার ব্যাপারে অবগত ছিলাম বলে আমার মনে হয়েছিল নিজের ব্যবসায় সফল হবে সে।

সত্যিই সফলতার মুখ দেখে তার ব্যবসা, আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায় সেই সফলতা। শুরুতে আমি বুঝতেই পারিনি ক্লিনিং কোম্পানির চাহিদা কত বেশি। দ্রুতই বাড়তে থাকে তার ব্যবসার পরিধি।

কিয়োসির বিয়ের পর আমরা ঠিক করি দ্বিতীয় একটা কোম্পানি দাঁড় করাবো। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য নামেমাত্র একটা কোম্পানি। তার স্ত্রী মিনেকোকে এই নতুন ব্যবসার প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেয় সে। মিনেকোকে বেতন দিতো অবশ্যই। মিনেকোর নামে বিশেষ এক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি আমি। তার নামে হলেও এটার দেখভাল আমিই করতাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই অ্যাকাউন্ট আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাখা।

এভাবেই বিশ বছর কেটে যায়। কিয়োসি ও আমার বন্ধুত্ব অটুট থাকে। যদি কোনো পরিবর্তন আসে তবে সেটা ওদের মধ্যে এসেছিল। দেখতেই তো পেয়েছেন ডিভোর্স হয়েছে ওদের। ডিভোর্সের কারণ খুব বেশি জানা নেই আমার। ডিভোর্সের পর কিয়োসি এক সাবেক বার হোস্টেসকে নিজের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়। আমি অনেকটাই নিশ্চিত এই মেয়েই ওদের ডিভোর্সের কারণ নয়।

নিজেদের সম্মতিতেই ডিভোর্স নেয় ওরা। একজন আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন দাবী করে মিনেকো। উভয় পক্ষই নিজেদের সকল ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত জানায় দর কষাকষির জন্য। ওখানে উপস্থিত ছিলাম আমি, যদিও বেশিরভাগ সময়ই নীরব ছিলাম। আমার বিশ্বাস ন্যায্য ভাগই পায় মিনেকো। এই বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি কিয়োসি, আর যা পেয়েছে সেটাতেই খুশি হয় মিনেকো। বলা চলে, সহজেই ডিভোর্সটা হয়ে যায়। ভেবেছিলাম, বিষয়টা এখানেই শেষ।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল। এই মাসের শুরুর দিকে আমার অফিসে কল দেয় মিনেকো। চাইছিল আমি যেন তার হয়ে কিছু বিষয় খতিয়ে দেখি। বলে বিষয়টা কিয়োসির থেকে গোপন রাখতে। আমার ধারণাই ছিল না বিষয়টা কি।

টোকিও স্টেশনের কাছাকাছি এক ক্যাফেতে দেখা করি আমরা। মিনেকোকে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। বিবাহিত থাকা অবস্থায় যেমন বিমর্ষ দেখাত সেটার থেকে অন্তত ভালো। ভাবতেই ভালো লাগছিল জীবনে যা চেয়েছে অবশেষে সেটা পেয়েছে সে।

টুকটাক কথাবার্তা হওয়ার পর সরাসরি প্রসঙ্গে চলে যায় মিনেকো। বিষয়টা ছিল ইউরি মিয়ামোতোকে নিয়ে। কোম্পানির প্রেসিডেন্টের নতুন সহকারী নিয়োগ আর ওই সহকারীর অতীত সম্পর্কে গুজবগুলো কানে গিয়েছে তার। ওরা সম্পর্কে আছে কিনা আমার কাছে জানতে চায় সে। শুরুতেই বলেছি, আমার মনে হয় না ইউরি মিয়ামোতো ওদের ডিভোর্সের কারণ ছিল। এটা বলেছি মিনেকোর সাথে আমার কথোপকথনের কারণেই। কেননা বোঝাই যায় ডিভোর্সের আগে ইউরি মিয়ামোতোর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিল না মিনেকো।

তাকে বলি আমার মনে হয় না ওদের মধ্যে সম্পর্ক আছে। আর এটাই সত্যি। আমি আসলে এখনো জানি না। কিয়োসির পছন্দের হোস্টেস ছিল সে। ওদের মধ্যে কিছু একটা চলার সম্ভাবনা আছে ঠিকই। কিন্তু কিয়োসি নিজে কখনো এই ব্যাপারে মুখ খোলেনি।

ইউরি মিয়ামোতো যে সাবেক স্বামীর প্রেমিকা এই ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা ছিল না মিনেকোর। শুধু সে জানতে চায় এই সম্পর্কটা কবে শুরু হয়েছে। তখনই টের পাই বিশ্বস্ততা ভাঙার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার পরিকল্পনা করছে সে। বলি কিয়োসি আর ইউরির সম্পর্কের ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না আমি। সে প্রস্তাব দেয় কিয়োসির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নজর রাখার। ওদের দু’জনের সম্পর্ক থাকলে অবশ্যই মেয়েটাকে নগদ টাকা ও বিভিন্ন জিনিস কিনে দিবে কিয়োসি। তাকে বলি কিয়োসির অ্যাকাউন্ট থেকে যে অর্থ খরচ হয়েছে সেটা ডিভোর্সের খাতেই। মিনেকো তখন বলে, হয়ত কোম্পানির টাকা খরচ করছে সে। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জন্য এটা একেবারে ডালভাত। আমি কথাটার বিরোধিতা করি। জানাই এমনটা সম্ভব নয়। সে এরকম কিছু করলে সবার আগে আমিই জানবো। কেননা অ্যাকাউন্টগুলো আমিই দেখভাল করি।

কিন্তু কোনো কথাই শোনে না মিনেকো। আমি তার সাবেক স্বামীর বন্ধু বলে তাকে হয়ত আড়াল করার চেষ্টা করছি বলে মনে করে। চাইছিল কোম্পানির হিসাব-নিকাশ পুনরায় খতিয়ে দেখা হোক। আমার ধারণা এই কাজের জন্য ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগ দিতে চাইছিল সে।

পুরো বিষয়টাই গোলমেলে ঠেকছিল আমার কাছে। মনে হচ্ছিল সবকিছু খুবই দ্রুত ঘটছে।

আমার ভয়টা বাস্তবে রূপ নেয় মিনেকো ওই ভুয়া কোম্পানির প্রসঙ্গ তুললে, যেটা আমরা প্রায় বিশ বছর আগে খুলেছি। কাউকে দিয়ে ওই কোম্পানির হিসাব খতিয়ে দেখতে চাইছিল সে। ডিভোর্সের সময় এই ভুয়া কোম্পানিকে “মূল কোম্পানির স্থায়ী সম্পদ” হিসেবে দেখায় কিয়োসি। ফলে আড়ালেই ছিল এটা।

বাইরে শান্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ওই ভুয়া কোম্পানির ব্যাপারে কাউকে জানতে দেয়ার ইচ্ছে ছিল না।

ওই কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর অ্যাকাউন্ট থেকে বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে টাকা উঠাচ্ছিলাম আমি। অ্যাকাউন্টটা ছিল মিনেকোর নামে। ওই কোম্পানির প্রত্যেকটা অ্যাকাউন্টের দায়িত্ব আমার হাতে দিয়েছিল কিয়োসি। সেটারই ফায়দা লুটেছি। আমার নিজের কোম্পানির অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো পাচার করতে থাকি। সবমিলিয়ে ত্রিশ মিলিয়ন ইয়েনের মত

আসলে টাকাগুলো দিয়ে দেনা শোধ করেছি। আমার নিজের ব্যবসার অবস্থা খারাপ বলেই এমনটা করিনি। আমার জুয়ার বদভ্যাসও এর পেছনে দায়ী। সবসময় ভেবেছি, কেউ খেয়াল করার আগেই ওই অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো ফিরিয়ে দেব। সেটা করতে পারিনি।

যাইহোক, একসপ্তাহ পর আবারও ওই একই ক্যাফেতে দেখা করব বলে ঠিক করি আমরা। এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে যাই আমি ও মিনেকো। চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। এই পরিকল্পনা কাউকে না জানানোর পরামর্শ দিই তাকে। কিন্তু জানতাম, আমি কোনো পদক্ষেপ না নিলে আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে সরাসরি কিয়োসিকে গিয়ে ধরবে সে। কিয়োসিকে ভালোমতোই চিনি। যেহেতু তার লুকানোর কিছু নেই, খুশিমনেই মিনেকোকে সবকিছু ইচ্ছামত খতিয়ে দেখতে দেবে। এতে ফাঁস হয়ে যেত আমার কেলেঙ্কারি, ধ্বংস হয়ে যেতাম একেবারে।

সপ্তাহ কেটে যায়, বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। দ্বিতীয়বারের মত দেখা করি মিনেকোর সাথে। অধৈর্য্য হয়ে উঠেছিল মিনেকো। বুঝতে পারছিলাম তাকে সাহায্য না করলে সরাসরি কিয়োসির কাছে যাবে। আতঙ্কিত হয়ে তাকে কথা দিই কয়েকদিনের মধ্যে একটা রিপোর্ট দেব। সত্যি বলতে কোনো ধারণাই ছিল না কি করব। ওই রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। মিনেকোকে কিভাবে সামাল দেব এটা ভেবেই পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই মাথাতে আসেনি। স্বাভাবিকের চেয়েও যেন দ্রুত সময় কেটে যাচ্ছিল।

জানি না কখন সমাধানটা আমার মাথায় এলো। পরেরদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময়ই টের পেয়ে গেলাম কি করতে হবে। ছেলেকে কল দিয়ে বললাম রাত আটটা নাগাদ ওর ওখানে যাবো। আসলে নিজের একটা অ্যালিবাই দাঁড় করাতে চাইছিলাম। হ্যাঁ, এভাবেই। মিনেকোকে মরতে হবে, এটাই ছিল মাথায় উঁকি দেয়া একমাত্র সমাধান। জানি, কাজটা পাপ। কিন্তু আর কি-ই বা করার ছিল আমার?

ব্রিফকেস নিয়ে কোদেনমাচোর উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সাবওয়ে স্টেশনে গিয়ে বুঝতে পারি নিজের ভুলটা। তাকে খুন করার মত কোন অস্ত্র নেই আমার হাতে। শক্তসমর্থ লোক হয়ত ধস্তাধস্তি করে মানুষ মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু আমি? আমাকে দিয়ে এটা সম্ভবই না। তার আ্যপার্টমেন্ট থেকেই খুনের জন্য কোনো কিছু জোগাড় করে নেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণও

ট্রেন থেকে নেমে আশেপাশে ঘুরতে থাকি ছুরির আশায় সবধরনের দোকান ছিল ওখানে। কিছুক্ষণ পর একটা দোকানে যাই, দোকানটার নাম কিসামিয়া। ছুরি-কাঁচির দোকান এটা। ব্যবসা করে আসছে সেই এদো আমল থেকে। ডিসপ্লেতে সব রকমের হাতে বানানো ছুরি ছিল ওদের।

কিসামিয়াতে থাকা অস্ত্রগুলো বেশ ভীতিকর। দেখেই অশুভ কিছু মনে হয়। ওগুলো দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার। ওই দোকানে ছিল বিশাল বিশাল সব কাঁচি। শাসিমি ছুরির থেকেও দ্বিগুন ওসবের আকার। আঁতকে উঠি দেখে। বুঝতে পারি ছুরি দিয়ে কাজটা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাকে দ্রুত খুন করতে হবে, যাতে পালানোর সুযোগ না পায়। ছুরি দিয়ে কাজটা করতে গেলেও রক্ত ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। আর ছুরিটা লুকিয়ে ফেলাও কঠিন। সবথেকে বড় কথা এই জায়গা থেকে ছুরিটা কেনা হয়েছে সেটাও হয়ত বের করে ফেলবে পুলিশ। সবমিলিয়েই এতে বড় ঝুঁকি।

ছুরি না ব্যবহার করলে আর কি দিয়ে কাজটা করতে পারি? শ্বাসরোধ করে খুন করাটাকেই সবথেকে ভালো উপায় বলে মনে হচ্ছিল। এতে সে চিৎকার করতে পারবে না, সেইসাথে রক্ত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও নেই। দড়ির খোঁজ করতে শুরু করি। নিজের নেকটাই ব্যবহার করতে চাইছিলাম না। মনে হচ্ছিল এর ফাইবার গলাতে থেকে গেলে পুলিশ সহজেই ধরে ফেলতে পারবে আমাকে।

দড়ি যেকোনো জায়গা থেকেই কেনা সম্ভব। একটা দোকানে দড়ি কিনতে গিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা নজরে পড়লে ফিরে আসি ওখান থেকে। কি ধরনের দড়ি ব্যবহৃত হয়েছে বোঝার পর নিশ্চিতভাবেই এই এলাকায় লোক পাঠাবে পুলিশ। দড়ির পরিমাণ ছিল আরেকটা সমস্যা। আমার প্রয়োজন সর্বোচ্চ এক মিটারের দড়ি। ব্যবহার না করা বাকি দড়িগুলোর কি ব্যবস্থা করব?

দোকানটা থেকে বেরিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকি, এমন এক জায়গা খুঁজতে থাকি যেখানে আমার কাজের উপযোগী দড়ি বিক্রি হয়। একটা ফ্যাব্রিক স্টোর নজরে পড়ে। সবধরনের দড়ি ও সুতা বিক্রি হয় ওখানে। আমার মত এক লোক হুট করে থেমে দড়ি কিনছে এটা লোকজনের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। দোকানী নিশ্চিত মনে রাখবে আমাকে। এরপর কয়েক জায়গাতে গেলাম যেখানে বিক্রি হয় বেল্ট ও টাই। কিন্তু স্নায়ুতে চাপ পড়ার কারণে কিনতে পারলাম না ওখান থেকেও। কিছু কিনি আর না কিনি আমি নিশ্চিত ওই দোকানদার ও আমাকে মনে রেখেছে।

ঠিক এরপরই লাটিমের দোকানটা নজরে পড়ে আমার। দোকানটার নাম খেয়াল করিনি। তবে এর বাইরে সাজানো ছিল সব ধরনের কাঠের খেলনা। ওগুলোর সাথে ছিল লাটিমও।

ভাগ্য ভালো ছিল। আমার আশেপাশে বা রাস্তায় কেউ ছিল না তখন। একটা লাটিম ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত স্যুটের পকেটে ভরে নিই। এরপর দ্রুত চলে যাই ওখান থেকে। জীবনেও দোকান থেকে কিছু চুরি করিনি আগে, আমার হৃদপিণ্ড যেন ছুটছিল। দোকান থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর লাটিমটা বের করে ওটা থেকে দড়িটা আলাদা করি আর লাটিমটা ঢুকিয়ে দিই ব্রিফকেসে। কাউকে খুন করার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে হয় ওই দড়িটা। ওটা পকেটে ঢুকিয়ে চলে যাই নিকটস্থ পে-ফোনের কাছে। নিজের সেলফোন ব্যবহার করিনি, এতে মিনেকোর ফোনে থেকে যেত আমার নম্বর।

দ্রুতই ফোনটা ধরে মিনেকো। পে-ফোন থেকে কল করেছি দেখে অবাক হয়। মিথ্যে বলি তাকে, জানাই ভেঙে গিয়েছে আমার ফোন।

বলে বাইরে আছে সে, তবে দ্রুতই বাড়ি ফিরবে।

জিজ্ঞেস করি তার অ্যাপার্টমেন্টে দেখা করতে যাওয়া যাবে কিনা। বলে সমস্যা নেই, আটটার মধ্যে আলাপ শেষ করলেই হবে। কেননা তখন এক বান্ধবী দেখা করতে আসবে। জানাই, কাছাকাছি রয়েছি আমি ও আলাপ করতে বেশি সময় লাগবে না।

সাতটার একটু পরপর, লোকজনের নজর এড়িয়ে ঢুকি ওই বিল্ডিংয়ে। তার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ডোরবেল বাজাই। দড়িটা পকেট থেকে বের করে শক্ত করে হাতে ধরে ছিলাম তখন

একফোঁটাও সন্দেহ করেনি মিনেকো। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় সে। আমি আর সে-ই ছিলাম শুধু।

যে-ই না সে পিছে ঘুরল আমি দড়িটা পেঁচিয়ে ধরলাম তার গলায়, শক্ত করে ধরি দড়িটা, চাপ বাড়াতে থাকি দুই হাত দিয়ে।

মিনেকোর ধারণাই ছিল না কি দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে তাকে। হতবিহ্বল হয়ে শুরুতে বাঁধা দেয়ারও চেষ্টা করেনি। প্রায় দশ সেকেন্ড পর হাত-পা ছড়ানো শুরু করে। এটা করতেও বেগ পেতে হয় তাকে কেবল-ই মাথা নাড়াতে থাকে। খুব বেশি আওয়াজও করেনি, সম্ভবত করতে পারেনি।

হঠাৎ করেই স্থির হয়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল মিনেকো। নিথর দেহটার দিকে না তাকানোর চেষ্টা করে গলা থেকে খুলে নেই দড়িটা। সদর দরজা অল্প ফাঁক করে চলে যাই হলওয়েতে। কেউই ছিল না, ফলে বেরিয়ে পড়ি ওখান থেকে। যাওয়ার আগে রুমাল দিয়ে মুছে দিই দরজার ডোরনব ও ডোরবেল।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে কয়েক ব্লক যাওয়ার পর একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সরাসরি চলে যাই আমার ছেলের অ্যাপার্টমেন্টে। আটটার একটু আগেই ওখানে পৌছাই আমি। ওদের সাথে আমার স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ব্যাপারে আলাপ করার কথা ছিল। কিন্তু এতই চিন্তিত ছিলামযে কিছুই বলতে পারিনি প্রায়।

তখনই আমার পাঁচ বছর বয়সী নাতি ব্রিফকেসে লাটিমটা দেখে ফেলে। আমার পুত্রবধূ জিজ্ঞেস করে কেন এই জিনিস নিয়ে ঘুরছি আমি। যথাযথ উত্তর না খুঁজে পেয়ে দাঁড় করাই খোঁড়া অজুহাত। তাকে বলি এক বন্ধু আমাকে দিয়েছে এটা, ভুলে অফিসে ফেলে এসেছি এর দড়ি। সত্যি বলতে দড়িটা তখনও আমার পকেটে। যে দড়ি দিয়ে একজনকে খুন করেছি, ওই দড়ি নিয়েই আমার নাতি খেলছে এটা ভাবতেই শিউরে উঠি তখন। লাটিমটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিই। কথা দিই পরেরবার দড়ি ও লাটিম একসাথে নিয়ে আসব। লাটিমটার জন্য উপযুক্ত দড়ি অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করব বলে ঠিক করি।

ছেলের বাড়ি থেকে শিনাবাশিতে যাই। বরাবরের মতোই হুইস্কি পান করি ওখানকার এক বারে গিয়ে। অবশ্য নিজের অ্যালিবাই খাড়া করাও একটা উদ্দেশ্য ছিল ওখানে যাওয়ার। ততক্ষণে দেহটা আবিস্কার হয়ে গিয়েছে, ফলে ওখানে যাওয়াটা একপ্রকার অর্থহীনই ছিল। তবে মনে হয়েছিল একা থাকার চেয়ে লোকের মাঝে থাকলে একটু ভালো লাগবে। মাঝরাতের দিকে বাড়ি ফিরে পুড়িয়ে দিই দড়িটা।

পরেরদিন চারিদিকে সাড়া ফেলে দেয় খুনটা। এমনকি আমার অফিসেও খবর চলে আসে। লাটিমের নতুন দড়ি খুঁজতে যাওয়ার পরিকল্পনাটা ঠিক বলে মনে হয় না আমার কাছে। এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সারাদিন আতঙ্কে থাকি, মনে হয় এই বুঝি গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে কোনো ডিটেকটিভ এসে হাজির হবে।

প্রথমবারের মত পুলিশ আমার সাথে যোগাযোগ করে বারোই জুন। ওরা ফোন দিয়ে বলে মিনেকোর ফোনের ইনকামিং লিস্টে আমার নম্বর পাওয়া গিয়েছে। ভালো ব্যবহারই করে ওরা, জানতে চায় কি ব্যাপারে আমার সাথে আলাপ করেছিল মিনেকো।

একটা গল্প বানিয়ে বলে দিই ওদের। বলি, ট্যাক্স রিটার্ন নিয়ে আলাপ করতে ফোন করে মিনেকো। ডিভোর্সের পর অনুবাদক হিসেবে কাজ করছিল সে, এজন্য ট্যাক্স রিটার্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চায়। মনে হয়েছিল আমার গল্প বিশ্বাস করেছে ডিটেকটিভ।

পুলিশ ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছে ভেবে একটু আত্মবিশ্বাস পাই। ওইদিন সন্ধ্যায় লাটিমের দড়ির খোঁজে বের হই। বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না কোথায় পাওয়া যাবে এটা। দরকার ছিল লাটিমের দড়ির, কিন্তু টের পেলাম এর জন্য আরেকটা নতুন লাটিম কিনতে হবে। কোথাও লাটিম বিক্রি করে বলে মনে পড়ল না, চলে গেলাম নিনগিয়োচোতেই।

যেখান থেকে লাটিম চুরি করি ওই জায়গাতে যেতে অস্বস্তি লাগছিল। ফলে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করার পর একটা হস্তশিল্পের দোকানের খোঁজ পাই। এর বাইরে সাজানো ছিল কাঠের লাটিম। তিন আকৃতির লাটিম ছিল ওখানে: ছোট, বড়, মাঝারি। ওগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করি কোনটা আমার চুরি করা লাটিমের সাথে মিলে। অবশেষে ছোট লাটিমের সাথে মিল পাই। লাটিম কিনে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওটা থেকে দড়ি আলাদা করে লাটিমটা ছুড়ে ফেলি কাছের এক ডাস্টবিনে। এরপর সরাসরি ছেলের বাড়িতে গিয়ে নাতিকে পুরানো লাটিম আর নতুন কেনা দড়িটা উপহার দিই। ভেবেছিলাম, আমায় অপরাধের সকল ছাপ সফলতার সাথে ঢেকে ফেলেছি।

তবে পুলিশকে বোকা বানানো সম্ভব হয়নি। একেবারেই না। টের পাই, প্রতিদিনই ওদের সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। আমার ছেলে ও ছেলের বৌয়ের ওখানে ডিটেকটিভ গিয়েছে জেনে মারাত্মক ভয় পাই। আমার খেল খতম, ভাবি আমি।

আমার ছেলের স্ত্রী জানায়, যে লাটিমটা দিয়েছি ওটার সঠিক দড়িটা রেখে গিয়েছে কাগা নামের এক ডিটেকটিভ। তখনই বুঝে যাই, পার পাওয়ার আর উপায় নেই।

মিনেকোর সাথে যা করেছি সেটা ক্ষমার অযোগ্য। কাজটা করার সময় আমার ভেতর শয়তান ভর করেছিল। টাকা আত্মসাতের ব্যাপারটা স্বীকার করে শাস্তি মাথা পেতে নেয়া উচিত ছিল আমার। সেটা না করে, নিজের সুনাম রক্ষার স্বার্থে ভুল পথে পা বাড়িয়েছি। নিষ্পাপ এক নারীকে খুন করেছি আমি। যত কঠিন শাস্তিই দেয়া হোক না কেন, মাথা পেতে নেব।

সাত

ইয়োসাকু কিশিদার স্বীকারোক্তিতে কোনো ফাঁক নেই। এই স্বীকারোক্তিটা পড়ার পর পুলিশ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়, সে যা যা বলেছে সেগুলো আসলেই সত্যি কিনা। তদন্তে দেখা যায় সত্যিই ওই ভুয়া কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে ত্রিশ মিলিয়ন ইয়েন সরানো হয়েছে। এছাড়াও প্রায় বিশ মিলিয়ন ইয়েন ওঠানো হয়েছে মিনেকো মিতসুয়ির নামে। এভাবে টাকাগুলো সরানো হয়েছে সেটা জানা নেই নাওহিরো কিয়োসির। নিজের হিসাবরক্ষকের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল তার। হাজার হলেও ত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব বলে কথা।

মনে হচ্ছে দেরিতে হলেও সমাধান হতে চলেছে কোদেনমাচোর এই হত্যা রহস্যের। ক্যাপ্টেন ও দায়িত্বরত অন্যান্য ডিটেকটিভের চেহারায় সন্তুষ্টির ছাপ স্পষ্ট।

যা যা প্রমাণ দরকার সেগুলো কি হাতে আছে? সবথেকে বড় কথা হল আত্মসাৎ করা টাকাগুলো দিয়ে কিশিদা কি করেছে সেটা বের করা। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক, ওই টাকাগুলো দিয়ে ব্যবসা ও জুয়ার দেনা শোধ করেছে। অফিসের খতিয়ান ও কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গিয়েছে অতটাও খারাপ ব্যবসা করছিল না তার কোম্পানি। এছাড়াও কিশিদা একজন জুয়াড়ি এটা তার অতি পরিচিত মানুষদের কাছেও অজানা।

এই বিষয়ে পুলিশ জোরাজোরি করলেও বারবার একই কথাই বলেছে কিশিদা। ইচ্ছা করেই নাকি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে চেয়েছে সে। আর জুয়ার বদভ্যাস আড়ালে রেখেছিল পরিচিতিদের থেকে

কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কর্মকর্তাদের মনে হল যথেষ্ট হয়েছে। খুনি নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তাকে অভিযুক্ত করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণও আছে হাতে। তার আত্মসাৎ করা টাকা কোথায় গিয়েছে সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

জিজ্ঞাসাবাদে নেতৃত্ব দিয়ে কিশিদার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে উয়েসুগিই। কিন্তু এই কেস থেকে নিজেকে একধাপ পিছিয়ে নেয় সে। তার মতে এই কেস সমাধানের সব ক্রেডিট স্থানীয় থানার এক ডিটেকটিভের। সে-ই খোলাসা করেছে পুরো ব্যাপারটা। এটা প্রকাশ্যে স্বীকার করলে টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ হোমিসাইড ডিভিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে। এজন্য টাস্কফোর্স থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়াই শ্রেয় বলে মনে হয়েছে উয়েসুগির।

******

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আমাজাকি গলিতে হাঁটছে উয়েসুগি, হাতে ছাতা। এসময় ফোন বেজে উঠল। বের করে দেখল কে ফোন করেছে। কলটা ডিটেকটিভ কাগার।

“কি চাই?” জিজ্ঞেস করল উয়েসুগি।

“কোথায় আপনি?”

“বাইরে, হাঁটছি একটু।”

“আপনি নিনগিয়োচোর আশেপাশে থাকলে, আমি কি একটু দেখা করতে পারি?”

“আবার কি দরকারে ভাই?”

“দেখা হলে বলছি। সাবওয়ে স্টেশনে অপেক্ষায় থাকলাম, এটুকু বলেই ফোন রেখে দিলো কাগা।

উয়েসুগি স্টেশনে পৌঁছালে তার দিকে হাত নেড়ে ইশারা করল কাগা। এরপর একটা ক্যাব নিয়ে আসাকুশাবাসিতে যাওয়ার নির্দেশ দিলো।

“কোন জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

“ব্যাপারটা সারপ্রাইজ রাখতে চাইছি। এতেই বেশি উপভোগ্য হবে,” বলল কাগা।

পৌঁছানোর আগেই গন্তব্যের ব্যাপারে ধারণা করল উয়েসুগি। এখানে আগেও গিয়েছে সে। থিয়েটার কোম্পানির পারফরম্যান্স সেন্টার এটা। এখানেই কাজ করে কোকি কিয়োসি।

“কি কারণে এখানে আনলেন?”

“ভেতরে গেলে বুঝবেন।”

ছোট্ট জায়গায় রিহার্সেলে ব্যস্ত অভিনেতারা। ওদেরকে দেখে কয়েকজন ঘুরে তাকাল। মাথা নেড়ে ওদেরকে হ্যালো বলল কাগা। আগ্রহ হারিয়ে ফেলে নিজের কাজে মন দিলো ওরা। কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার এনে পাশাপাশি সাজাল কাগা। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বসে পড়ল উয়েসুগি। কাগাও একই কাজ করল।

স্টেজে নাটকের রিহার্সেল চলছে। সাজসজ্জ্বা ও স্টেজের কর্মব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে শীঘ্রই প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে।

সিনের ফাঁকে ফাঁকে বদল হচ্ছে স্টেজের আবহ। দক্ষতার সাথে দ্রুত নিজেদের মত কাজ করে চলেছে স্টেজকর্মীরা। উয়েসুগির মনে হল অভিনেতাদের মত স্টেজকর্মীদেরও প্রতিনিয়ত চর্চা করা লাগে।

একজনকে চিনতে পারল উয়েসুগি। ছেলেটা কোকি কিয়োসি। তার মাথাতে তোয়ালে পেঁচানো আর পরনে হাতকাটা শার্ট। ঘামে চকচক করছে তার নগ্ন কাঁধ

“এই ছোড়াও কি এই নাটকে অভিনয় করছে?” বিড়বিড় করল উয়েসুগি। ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করল কাগা

দীর্ঘদিন আগে ইংল্যান্ডে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। অভিনেতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। মূল চরিত্র এক বৃদ্ধ। এই বৃদ্ধটা একজন ডিটেকটিভ ছিল, অবসর নেয়ার পর অতীতের কেসগুলোর স্মৃতিচারণ করে।

দুজন ডিটেকটিভই বসে নাটকটি পুরোটা দেখল। মাঝখান থেকে দেখা শুরু করলেও নাটকটি উপভোগ করেছে উয়েসুগি। নাটকটি বেশ মর্মস্পর্শী, একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে যায়।  

“খারাপ না, কি বলেন?” মন্তব্য করল কাগা।

“বলতে পারেন,“ জানায় উয়েসুগি। যদিও অনেক ভালো লেগেছে তার।

একটা ব্যাপার বিব্রত করল তাকে। পর্দা নামার ঠিক আগে এসে বাউ করল কোকি কিয়োসি। এই নাটকে কোনো অভিনেতা নয় বরং একজন স্টেজকর্মী ছিল সে, বুঝতে পারল উয়েসুগি। ঠিক তখনই ওদের কাছে এসে অভিবাদন জানাল কোকি কিয়োসি। তোয়ালে সরিয়ে ফেলল মাথা থেকে, ঘামে ভিজে আছে তার চুল। কাগার সামনে বাউ করল সে।

“আমাদের জন্য যা করেছেন সেকারণে কৃতজ্ঞ, ডিটেকটিভ। আমার মায়ের পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ জানালাম।”

“ব্যাপার না। আমরা কেবল আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।“

উয়েসুগির দিকে তাকাল কাগা। মাথা নেড়ে সায় জানালো উয়েসুগি।

“জানি আপনার জন্য সময়টা কঠিন। শুভকামনা আপনাকে।

“ধন্যবাদ।”

“আপনি আজকে অভিনয় করলেন না?”

““নাহ, কয়েকদিন ধরে অভিনয় করছি না,” একটু লজ্জিত হয়ে বলল কোকি। তার চোখে দৃঢ়তার ছাপ

“যা ঘটেছে সেটার কারণে?” সামান্য ইতস্তত করে বলল উয়েসুগি।

“মায়ের খুন একটা কারণ। মূল চরিত্রটা ছেড়ে দিতে হয়েছে কারণ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। মনে হয় ছেড়ে দিয়েই ভালো হয়েছে। এখনও প্রস্তুত নই। নিজেকে নিয়ে আরও কাজ করার পর আবারও অভিনয় শুরু করব। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে।

“কাজে ফিরতে হবে আমাকে। আপাতত বিদায়,” বলল কোকি, এরপর ফিরে গেল ব্যাকস্টেজে।

যেতে পারি আমরা?” বলল কাগা।

শুধুমাত্র এই নষ্ট ছেলেটার সাথে দেখা করতে আমাকে এতদূর টেনে এনেছেন?”

অবাক হল কাগা। “একে দেখে আপনার নষ্ট ছেলে মনে হল? “,

“না হয়তো,” গাল ঘষে বলল উয়েসুগি। “তবে ছোড়াটার মধ্যে ভিন্ন কিছু একটা আছে।

“অবশ্যই আছে।”

“কি সেটা?

“পরে বলছি। আমাকে আরেকটু সহ্য করুন। বেশিক্ষণ লাগবে না।”

******

এরপর কোদেনমাচোর এক পেস্ট্রি শপে গেল কাগা ও উয়েসুগি। ওখানকার ক্যাফে এরিয়াতে বসল দুই ডিটেকটিভ। জায়গাটা কেকের জন্য বিখ্যাত হলেও, কাগার মত উয়েসুগিও আইস কফি অর্ডার করল।

“নিশ্চিত এই জায়গায়…

“হ্যাঁ। খুন হওয়ার ঠিক আগে এখানে এসেছিল মিনেকো মিতসুই, কাউন্টারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল কাগা। “ওই বিক্রয়কর্মীকে দেখছেন? সে-ই মিস মিতসুইর কাছে আসা ফোনকলের ব্যাপারে তথ্যটা আমাদের দিয়েছে।”

“তাহলে আপনিই এই জায়গাটা খুঁজে বের করেছেন? আমার বস এই ব্যাপারে কিছুই বলেনি। কিভাবে খুঁজে পেলেন জায়গাটা?”

“অন্য একটা কথা বলতে চাই আপনাকে। আগে আমাকে সবকিছু ঠিকভাবে সাজাতে দিন।” কফিতে লম্বা চুমুক দিলো কাগা, যেন দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রাইস ক্র্যাকার শপের ঘটনা দিয়ে শুরু করল কাগা। বলল সেই ইন্স্যুরেন্স কর্মীর কথা, ভুয়া অ্যালিবাইয়ের কারণে যাকে সন্দেহভাজন মনে করে পুলিশ।

এরপর বলল পুরানো ধাঁচের রিয়োতেই রেস্তোরাঁর ঘটনাটা। ওখানকার ওয়াসাবি কেক পাওয়া যায় মিনেকোর অ্যাপার্টমেন্টে। পরের ঘটনাটা ক্রোকারিজ দোকানের। ওখানকার মালিক শুধুমাত্র চেহারায় চিনত মিনেকো মিতসুইকে। এরপর বলল মিনেকোর অনুবাদক বান্ধবীর কথা। একটা ঘটনাও খুনের সাথে সম্পর্কিত নয়। কাগার বলা ঘটনাগুলো শুনে নিজেকে গালি দিলো উয়েসুগি। স্থানীয় থানার এই ডিটেকটিভ নগন্য সব বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখেছে, যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয় ভেবে বাতিল করে দিয়েছিল ওরা। খুনের সাথে সম্পর্কিত হোক বা না হোক, যখনই যে খড়কুটো পেয়েছে সেটাই আঁকড়ে ধরেছে কাগা।

অবশেষে এই পেস্ট্রি শপের ঘটনায় আসলো কাগা। কোকি কিয়োসির নাম শুনে কেঁপে উঠল উয়েসুগি। এখানে কাজ করা ওই গর্ভবতী মেয়েটাকে ভুলে নিজের ছেলের প্রেমিকা ভেবেছিল মিনেকো, ব্যাখ্যা করল সে।

“ওই যে মেয়েটা,” কাউন্টারের পিছে থাকা মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল কাগা। মেয়েটার পেট স্ফীত।

“এই ঘটনাটা তাহলে এরকম; ছেলে বাবা হতে চলেছে ভেবে রোমাঞ্চিত হয় মিস মিতসুই। ছেলের কাছাকাছি থাকার জন্য এই এলাকায় এসে ওঠে। যেহেতু তার গুণবান ছেলে একজন অভিনেতা, সেহেতু ছেলের কোনো স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা ছিল না। তখনই সাবেক স্বামীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবীর কথা মাথায় আসে মিস মিতসুইর। যাতে ওই টাকাটা দিয়ে ছেলেকে সাহায্য করা যায়?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল উয়েসুগি। “এজন্যই তাকে আজ আলাদা দেখাচ্ছিল। ‘

“শুধুমাত্র এটাই প্রভাবিত করেনি তাকে।”

“আরেকটা ঘটনা বলা শুরু করল কাগা। উয়েসুগির মতে যা এখন পর্যন্ত সবথেকে চমকদার। ইউরি মিয়ামোতো, যাকে ভাবা হচ্ছিল নাওহিরো কিয়োসির রক্ষিতা, বাস্তবে ইউরি আসলে নাওহিরোর মেয়ে

“ব্যাপারটা দয়া করে গোপন রাখবেন। ওরা এটা এখনো কাউকে জানায়নি,” বলল কাগা।

অবাক হয়ে মাথা নাড়ল উয়েসুগি।

“বিশ্বাস-ই করতে পারছি না এই কেসের আড়ালে এতগুলো ঘটনা ঘটেছে। যাইহোক, এরপরও যদি ছেলেটা জীবন নিয়ে সিরিয়াস না হয়, তাহলে আর কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই বুঝেছে বাবা-মাকে হালকাভাবে নিতে হয় না।”

“ঠিকই ধরেছেন, উয়েসুগি।” সামনে ঝুঁকে বলল কাগা। “কাজ করতে গিয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কোনো অপরাধ ঘটলে অপরাধীকে ধরা আমাদের প্রথম কর্তব্য। তবে এটাও জানতে হবে কেন অপরাধটা ঘটেছে। কারণটা না জানলে অন্য কাউকে এই একই ভুল করা থেকে বিরত রাখতে পারব না আমরা। সত্যটা জানলে আমরা অনেক মূল্যবান শিক্ষা পেতে পারি। কোকি কিয়োসিকে দেখুন। শিক্ষা পেয়ে নিজেকে বদলে ফেলেছে সে। এই বদলে যাওয়ায় তার থেকে আর কে বেশি লাভবান হয়েছে বলুন?”

স্ট্র দিয়ে আইস কফি নাড়ছিল উয়েসুগি। পুরোপুরি থেমে গিয়ে কাগার চোখের দিকে তাকাল সে।

“কি বলার চেষ্টা করছেন?”

“সম্ভবত জানেন কি বলতে চাইছি। মনে হয় আমাদের থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে কিশিদা। কেন তাকে সত্যিটা স্বীকার করার জন্য আরো জোর দিচ্ছেন না?”

নিজের হাতের দিকে তাকাল উয়েসুগি। “আমি এখনও আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”

“সম্ভবত কিশিদার প্রতি সহানুভূতি ছিল আপনার? যেভাবে এখন সবকিছু ঘটেছে এতে কি আপনি সন্তুষ্ট? সত্যি তো?”

“শুনুন,” সামনে হেলে কাগার দিকে দৃষ্টি হানল উয়েসুগি। “যদি সত্যিই কিছু বলার থাকে তাহলে ভণিতা না করে সরাসরি বলছেন না কেন?”

কালো হয়ে এলো কাগার চেহারা। চোখে দেখা দিলো এক অচেনা জ্যোতি, যেটা আগে কখনো দেখেনি উয়েসুগি। “আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে কিশিদাকে মুখ খোলাতে পারতেন। তাহলে সেটা করলেন না কেন? তাকে সত্যি বলতে বাধ্য করুন।”

হারামজাদা! আমার ব্যাপারে সব জানে কাগা, ভাবল উয়েসুগি। তিন বছর আগে বোকার মত যে ভুলটা সে করেছিল, সেটার ব্যাপারে না জানলে কখনোই এভাবে কথা বলত না কাগা।

“ওই ব্যাপারে আর আগ্রহী নই আমি,” নরম সুরে বলল উয়েসুগি। “আমি একটা খারাপ লোক। পুলিশে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই আমার। অবসরের জন্য আবেদন করেছিলাম আমি, কিন্তু অবসর নেয়া হয়নি। মত পরিবর্তনের জন্য আফসোস হয় আমার। ইশ, যদি ইস্তফা দিতে পারতাম।”

“আপনার এই আফসোস সন্দেহভাজনের সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন না কেন? এরপর দেখা যাক কি ঘটে।”

আইস কফির গাসটা হাতে নিয়ে ঝাঁকাল উয়েসুগি। এলোমেলো হয়ে গেল বরফকুচিগুলো।

“ফালতু যত্তসব,” বিড়বিড় করল সে।

আট

শেষবার উয়েসুগি যেমন দেখেছিল তার থেকেও বেশি শুকনা দেখাচ্ছে কিশিদাকে। ভেঙে পড়েছে তার গাল, চোখ একেবারে ঢুকে গিয়েছে কোটরের ভেতরে। জ্যাকেটের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কাঁধের হাড়। মনে হচ্ছে যে কোনো কঙ্কালের গায়ে স্যুট চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

উয়েসুগির দিকে তাকাচ্ছে না কিশিদা। ওই চোখ কি আদৌও কিছু দেখছে, ভাবল উয়েসুগি। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লোকটা।

“থানাতে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এক ডিটেকটিভ আছে,” শুরু করল উয়েসুগি। “তার মতে আমিই একমাত্র এই কাজটি করতে সক্ষম এজন্যই আবার আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসা। সত্যি বলতে, জানা নেই আপনার মুখ খোলাতে সক্ষম হবো কিনা। আমি নিজেই আত্মবিশ্বাসী নই। অন্তত আমার কথাগুলো শুনে আমাকে রেহাই দিন। এর থেকে বেশি কিছু করতে পারব না আমি।”

চায়ের কাপে চুমুক দিলো উয়েসুগি।

“এই বছর আমার বয়স পঞ্চান্ন হবে। আমি একুশ বছর ধরে বিবাহিত। বাচ্চা নেয়ার খুব শখ ছিল আমাদের। কিন্তু বাচ্চা নিতে পারছিলাম না সমস্যার কারণে। গর্ভবতী হতে তিন বছর সময় লাগে আমার স্ত্রীর। পরের বছর সে একটা পুত্রের জন্ম দিলে আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি।”

মনে হল না কিশিদা শুনছে, তবে সামান্য পরিবর্তন হল মুখভঙ্গিতে, কুঁচকে গেল ভ্রু।

“হয়তো বেশি বয়সে বাবা হয়েছি বলেই ওকে আদর করতাম প্রচুর। সবসময় মাথায় তুলে রাখতাম। এমনকি কাজে থাকলেও সময় পেলে বাড়িতে ফোন দিতাম ছেলেটার আওয়াজ শুনতে। তখন কেবলই বলতে শিখছে ও। সত্যিকারের পিতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করছিলাম। জানি হাস্যকর শোনাচ্ছে, কিন্তু আমি এসবের জন্য মোটেও লজ্জিত নই, বরং গর্বিত।”

“আবার মনে হল একটু বলেছে কিশিদার অভিব্যক্তি।

“আমি আমার ছেলেকে প্রচুর আদর করতাম, কেউই এটা অস্বীকার করবে না। তবে আদর করা আর যত্ন নেয়া দুটো ভিন্ন জিনিস। ছেলের যত্ন নিতে চাইলে এমনকিছু করতে হয় যা ওদের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করবে। আমি সেটা করতে পারিনি। আমি ওকে ভালোবাসতে পেরেই আবেগে ভাসছিলাম আমি।”

আবারও কাপে চুমুক দিলো উয়েসুগি।

“আমার কাছে বিষ্ময়কর ছিল আমার ছোট্ট ছেলেটার বেড়ে ওঠা। বাচ্চারা সারাজীবন আদুরে থাকে না। এক পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে শুরু করে। বেশিরভাগ বাবাই এগুলো পাত্তা দেয় না। কাজের ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে বাঁচতে চায়। আমিও সেটাই করেছি। আমার স্ত্রী যখনই ছেলের জন্য কল করত তখনই ব্যস্ততা দেখাতাম। ছেলের সমস্যা নিয়ে কখনোই আলাপ করার চেষ্টা করিনি তার সাথে। বাবার দায়িত্বের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতাম, ‘আমি একটা ফুলটাইম চাকরি করি’ নির্লজ্জের মত পরিবারের সকল ঝামেলা চাপিয়ে দিতাম আমার স্ত্রী’র কাঁধে। আমাদের ছেলে বাজে সঙ্গে র পাল্লায় পড়েছে জানার পরও তেমন কোনো উদ্বেগ দেখাইনি। ‘সব বাচ্চাই একটু আধটু এরকম হয়,’ স্ত্রীকে বলি আমি। ভালো দিকটাই দেখতে চাইছিলাম আমি। ধোকা দিচ্ছিলাম নিজেকে।”

উয়েসুগির দিকে তাকাল কিশিদা। চোখে চোখ পড়তেই নজর সরিয়ে নিলো সে।

“তিন বছর আগের ঘটনা। আমি তখন টোকিওর মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টারের স্ট্যান্ডবাই। একদিন একটা কল আসে আমার কাছে। কলটা করেছিল এক স্থানীয় পুলিশ অফিসার। একটা কেসে একবার একত্রে কাজ করেছিলাম তার সাথে। যাইহোক, সে জানায় একটা ছেলেকে ধরেছে। ছেলেটা হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালাচ্ছিল। ধরার পর সে নাকি বড় গলায় বলেছে তার বাবা ডিটেকটিভ উয়েসুগি, টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হোমিসাইড কর্মকর্তা। সে আমার সন্তান এটা নিশ্চিত হতেই পুলিশটা আমাকে ফোন দেয়। বিস্তারিত শুনে তাকে জানাই হ্যাঁ, ছেলেটা আমার। বেশ অবাক হই আমি। হেলমেট ছাড়া বাইক চালানো খারাপ, তবে আরও খারাপ হল আমার ছেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। সেই অফিসার জিজ্ঞেস করে কি করবে? আমি সরি বলি তাকে। কিন্তু এভাবে দেখেও না দেখার ভান করলে ছেলে কী মানুষ হয়?”

কর্কশ হয়ে উঠছে উয়েসুগির কন্ঠস্বর। চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়িয়েও মাঝপথে থেমে গেল। বুঝতে পারল চা শেষ।

“আমার কথামতই কাজ করল পুলিশটা। যেহেতু সে আমার ছেলেকে বাইক চালানোর সময় ধরেনি সেহেতু তাকে ঝামেলা ছাড়াই শুধুমাত্র সতর্ক করে ছেড়ে দিলো। স্বস্তি পেলাম। ছেলে কেবলই ভালো হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। এই কারণে স্কুল থেকে বহিষ্কারও হতে পারত। কিছুদিন পরই বুঝতে পারি কি ভুলটাই না করেছি। আরও কড়া হওয়া উচিত ছিল আমার। আমার উচিত ছিল পুলিশকে বলা তাকে যেন নিয়ম মেনে যথাযত শাস্তি দেয়। তাহলে সম্ভবত…”

“কণ্ঠরোধ হয়ে এলো উয়েসুগির। কয়েকবার গভীর শ্বাস নিলো সে।

“অবশ্যই ছেলেকে বকাঝকা করেছিলাম আমি। কিন্তু মনে হয় না সেগুলো গায়ে লাগিয়েছিল ও। হয়ত মনে হয়েছিল রাগের মাথায় এসব বলছে বাবা। সপ্তাহখানেক পর খবরটা পাই, হাইওয়েতে অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে আমার ছেলের। আশি মাইল বেগে বাইক নিয়ে ছুটছিল সে, একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খায়। লাইসেন্স ছিল না ওর। বাইকটা ছিল বন্ধুর থেকে ধার নেয়া। সপ্তাহখানেক আগে হেলমেট ছাড়া যে বাইকটা চালিয়ে ধরা পড়েছিল ওটা সেই একই বাইক। পরে জানতে পারি, বন্ধুদের কাছে বড়াই করত সে। বলত উর্ধ্বতন ডিটেকটিভ কর্মকর্তা বাবার নাম ভাঙিয়ে যেকোনো অপরাধ করেই পার পেয়ে যাবে।”

“চেয়ারে সোজা হয়ে বসে টেবিলের দিকে ঝুঁকে থাকা কিশিদার দিকে তাকাল উয়েসুগি।

“আমার ছেলে একটা ভুল করেছিল, তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম আমি। সত্যি বলতে রক্ষা করে তাকে আরও ভুল পথের দিকে ঠেলে দিয়েছিলাম। বাবা ও পুলিশ উভয় ক্ষেত্রেই আমি ব্যর্থ বাবা-মার দায়িত্ব হল সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, সেটা কড়া শাসনে রেখে হলেও। কিন্তু সত্যিটার মুখোমুখি না হয়েই কি আপনি মূল্য চুকাতে চান? এতে আরও অনিষ্ট ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। বুঝেছেন?”

কাঁপতে শুরু করেছে কিশিদা। ধীরে ধীরে কম্পন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। মাথা তুললে দেখা গেল পানি গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। লাল হয়ে গেছে চোখ।

“সত্যিটা বলুন আমাকে,” আদেশের সুরে বলল উয়েসুগি।

নয়

বিগত কয়েকদিনের মধ্যে প্রথমবারের মত আকাশ মেঘমুক্ত। একেবারে ঝকঝকে নীল দেখাচ্ছে। যেন কয়েকদিনের বাজে আবহাওয়ার জরিমানা হিসেবেই এই সুন্দর আকাশ উপহার দিয়েছে প্রকৃতি। যদিও উত্তাপ কমেনি। ঘেমে একাকার হয়ে কফি শপে পৌঁছাল উয়েসুগি।

একটা টেবিলে বসে আছে ডিটেকটিভ কাগা। ওই টেবিলটা থেকে রাস্তা দেখা যায়। ন্যাপকিনে কিছু একটা লিখছিল সে। উয়েসুগিকে দেখে হ্যালো বলল।

“কি করছেন ওখানে?” বিপরীত দিকে বসে জিজ্ঞেস করল উয়েসুগি। পুরো ন্যাপকিন জুড়ে কলমের দাগাদাগি।

“এটা কি?” ন্যাপকিনটা হাতের তালুতে পিষে বল বানিয়ে বলল কাগা। “এতে হিসেব করেছি এই রাস্তা দিয়ে কতজন লোক জ্যাকেট পরে ও জ্যাকেট ছাড়া গিয়েছে।”

ওয়েট্রেসকে ডেকে আইস কফি অর্ডার করল উয়েসুগি।

“কাতসুয়া কিশিদা তার চাকরী দাতার থেকে কত টাকা চুরি করেছে সেটা নিশ্চিত হতে পেরেছি আমরা। প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন ইয়েন

“বাহ, মোটেও নগন্য অঙ্ক নয়,” বলল কাগা। নিরস দেখাচ্ছে তাকে।

জানা গিয়েছে নিজের দেনা শোধ করার জন্য টাকা সরায়নি ইয়োসাকু কিশিদা। ছেলে এসে দয়া ভিক্ষা চাইলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও টাকা সরাতে শুরু করে সে। যে কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি করত সেখান থেকে নিজেও গোপনে টাকা সরাত কাতসুয়া। অডিট বসলেই ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে।

“অবাক করা ব্যাপার হল, কাতসুয়ার ধারণাই নেই কিভাবে এতগুলো টাকা তার বাবা জোগাড় করল। ভেবেছিল, তার বাবার হাতেই ছিল টাকাগুলো। অদ্ভুত ব্যাপার! কাতসুয়ার স্ত্রীও জানতো না তার স্বামীর এই টাকা চুরির ব্যাপারে। তাদের জীবন স্বাভাবিকের থেকেও বেশি এলোমেলো, এই ব্যাপারে মোটেও অবগত ছিল না মহিলা।”

কিছুই বলল না কাগা। জানালা দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে থাকল কেবল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে উয়েসুগি দেখল রাস্তার অপর পাশের একটা রাইস ক্র্যাকার শপের সাইনবোর্ডের দিকে চেয়ে আছে সে।

চলে এলো উয়েসুগির আইস কফি, স্ট্র ছাড়াই এবার চুমুক দিলো কফিতে।

“আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে। কখন সন্দেহ করলেন কিশিদার ছেলেকে?”

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কাগা।

“সত্যি বলতে সেভাবে সন্দেহই করিনি তাকে।

“সত্যিই? আমি তো ভেবেছি আপনি আগেই টের পেয়েছিলেন সেও জড়িত। আর ইচ্ছা করেই আমাকে নিজের পার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছেন।”

আবারও মাথা নাড়ল কাগা, এবার আরও দ্রুততার সাথে। মাথা নেড়ে দ্বিমত প্রকাশ করল সে।

“আপনার মত ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ডিটেকটিভের পার্টনার কে হল না হল তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। যে কাউকে নিয়েই কাজ করতে পারবেন আপনি। আমাকে বেছে নিয়েছেন কেন জানি। আমার ছেলের সাথে যা ঘটেছে সেটা আপনি শুনেছিলেন। এরপর ভাবলেন, কিশিদার মুখ খোলানোর জন্য আমিই উপযুক্ত ব্যক্তি। ঠিক বলছি না?”

ব্যাপারটা আসলে এভাবেই ঘটেছে। উয়েসুগি নিশ্চিত, স্থানীয় থানার এই ডিটেকটিভ পুরো ব্যাপারটার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এভাবেই সামলেছে।

বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে মাথা নাড়ল কাগা।

“আমাকে একটু বেশিই কৃতিত্ব দিয়ে ফেলছেন আপনি।”

“তাহলে আমাকেই বেছে নিলেন কেন?”

“দুইটা কারণে,” দুটো আঙুল উঁচিয়ে বলল কাগা। “প্রথমটা হল, ইয়োসাকু কিশিদাকে খতিয়ে দেখার দায়িত্ব ছিল আপনার ওপর। অন্য কাউকে দায়িত্বটা দেয়া হলে হয়ত তার সাথেই কাজ করতাম দ্বিতীয়ত, আমি জানতাম আপনার ছেলের ব্যাপারটা। শুনেছি, যা ঘটেছে সেটার জন্য প্রায় ইস্তফা দিয়ে ফেলেছিলেন। অভিজ্ঞতাটা ভয়াবহ, আর অভিজ্ঞতা যতই ভয়াবহ হয়, ডিটেকটিভ হিসেবে নিজেদের কাজে ততই সেটা প্রয়োগের চেষ্টা করি আমরা। এজন্যই আপনাকে পার্টনার হিসেবে বেছে নিই আমি।”

উয়েসুগির দিকে শীতল, অসংলগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল কাগা। অন্যদিকে তাকিয়ে গাসে জমা পানির বিন্দুটা আঙুল দিয়ে মুছল উয়েসুগি।

“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার ব্যাপারে সবকিছুই জানেন আপনি। আসলে কতটা জানেন?”

“আপনি জানেন আপনার ব্যাপারে আমার ধারণাই সঠিক।”

“তাই নাকি?” বিড়বিড় করল উয়েসুগি। পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে সে। আপনার ব্যাপারেও আমি সব জানি, বলতে চাইল। এই টাস্কফোর্সে যোগ দেয়ার আগে যে ঘটনাটা সে শুনেছে সেটা মনে করার চেষ্টা করল।

একসময় টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হোমিসাইড ডিভিশনে ছিল কাগা। একটা খুনের কেসে কোর্টে সাক্ষী হিসেবে হাজির হতে হয় তাকে। এরপর স্থানীয় থানায় অবনমিত করা হয়। কেননা ভিক্টিমের পরিবার অভিযোগ করে “তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ”। এজন্য কেসটা সমাধানে বিলম্ব হচ্ছে। (তবে কঠিন ওই কেসটা নিষ্পত্তিতে কাগার অবদান ছিল অনেক।)

“কিন্তু নিজের মুখ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় উয়েসুগি। সম্ভবত আফসোস করে সময় নষ্ট করার মত লোক নয় ডিটেকটিভ কাগা।

“যেকোনো দিন ইয়োসাকু কিশিদার ট্রায়াল আরম্ভ হয়ে যাবে। একটু দ্রুতই শুরু হচ্ছে আরকি। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।”

উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর কফির দামটা রাখল উয়েসুগি।

“আরেকদিন আসুন। আপনাকে এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখাবো।”

“আরেকটু ঠাণ্ডা পড়লে ভেবে দেখা যাবে,” কথাটা বলে বেরিয়ে যেতে লাগল উয়েসুগি।

তখনই রাস্তা থেকে একটা মেয়ে এসে ঢুকল। মেয়েটার পরনে জিন্স ও টিশার্ট, ছোট করে ছাটা চুলগুলো বাদামী রঙ করা। কাগার দিকে দ্রুত এগিয়ে এলো সে।

“আবারও ঘুরতে বের হয়েছেন ডিটেকটিভ?

“মোটেও না। টহলের দায়িত্বে আছি আমি।”

“দেখে মনে হচ্ছে না। এরকম করলে তো জীবনেও পদোন্নতি পাবেন না।“

হাসল কাগা।

“বানানা জুস খাবেন? আমার ট্রিট।”

“নাহ, ধন্যবাদ। নতুন কিছু হেয়ারস্টাইল আইডিয়া এসেছে মাথায়। পরে দেখা করব আপনার সাথে।”

ক্যাফেতে থেকে বেরিয়ে রাস্তার সামনের রাইস ক্র্যাকার শপে ঢুকল মেয়েটা।

“ওই দোকানটা যারা চালায় সেই পরিবারের মেয়ে সে,” বলল কাগা। “হেয়ারস্টাইল নিয়ে পড়াশোনা করছে।”

টেবিলের কাছে আবারও ফিরে এসেছে উয়েসুগি। “আপনাকে শেষ একটা প্রশ্ন করতে পারি, ডিটেকটিভ কাগা? মানুষ হিসেবে আপনি কেমন?”

টেবিলে পড়ে থাকা কাগজের পাখাটা তুলে নিজেকে বাতাস করতে শুরু কাগা।

“আমি? তেমন বিশেষ কেউ নই। এই এলাকায় নবাগত এক ডিটেকটিভ।”

শেষ –

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *