অধ্যায় ৩ – ক্রোকারিজ দোকানের পুত্রবধু
এক
“ইগা ফিশ প্লেটটা এই তাকে কেন? এখানে তো কালো বাইজেনটা ডিসপ্লেতে থাকার কথা। আবারো ভুল করেছ। একই কথা কতবার বলতে হবে তোমাকে? আর ভালো লাগে না।”
আপনমনে গজগজ করতে করতে দোকানের তাকে ডিসপ্লেতে রাখা প্লেটগুলো সাজাচ্ছে সুজু। জবাবে নাওইয়া কেবল খবরের কাগজটা চেহারার সামনে আরেকটু তুলে ধরে কথাগুলো না শোনার ভান করলো। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর এরকম হাজারটা অভিযোগ শুনতে কারোই ভালো লাগার কথা না।
দিনের এই লগ্ন দোকানে কাস্টোমার আসার মোক্ষম সময়। কিন্তু বাইরের ব্যস্ত ফুটপাত থেকে কেউ ভেতরে ঢুকছে না। সাধারণত এরকম গরমে দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হাওয়া খেতে ঢোকে অনেকেই। এরপর ভদ্রতার
এরপর ভদ্রতার খাতিরে ডিসপ্লেতে রাখা জিনিসগুলোয় চোখ বুলায়। তবে দুর্ভাগ্যবশত ওদের দোকানটায় কোন এসি নেই। মাথার উপরে ঘুরছে আদ্দিকালের কয়েকটা বৈদ্যুতিক ফ্যান। সামনের দরজাটা হাট করে খেলা।
“কাস্টোমার চাইলে দোকানে এসি লাগাতেই হবে,” সেদিন মন্তব্য করেছিল মাকি। গত শরতে বিয়ে করেছে সে আর নাওইয়া। ক্রোকারিজ দোকান-কাম বাড়িটায় এটা তার কাটানো প্রথম গ্রীষ্ম।
“এসি লাগিয়ে লাভ কি? আমাদের দোকানের সামনের দিকটা তো খোলা। এসি লাগালেও ঠাণ্ডা হবে না,” জবাবে কাটাকাটা স্বরে নাওইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে সুজু। সাধারণত কথা বলার সময়েও একে অপরের দিকে তাকায় না নাওইয়ার জীবনের এই দুই নারী।
“তাহলে বন্ধ করে দিলেই হয়। কাঁচের দরজা লাগালে লোকজন বাইরে থেকে দেখতেও পারবে সবকিছু আবার ঠাণ্ডা বাতাসও ভেতরে থাকবে,” নাওইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে মাকি।
নাওইয়া ভুল করে সম্মতিসূচক অস্ফুট একটা শব্দ করা মাত্র সুজুর মনে হয় তার পাল্টা যুক্তি দেখানো উচিৎ।
“আমরা যদি বাইরে স্লাইডিং ডোর লাগাই, কাস্টোমারদের ভেতরে আসতে কষ্ট হবে। তাছাড়া, রাস্তায় যে জিনিসগুলো ডিসপ্লেতে রাখা আছে, ওগুলোর কি হবে তখন? সবকিছু ভেতরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিব? তখন সবাই ভাববে ইয়ানাগিসাওয়াদের দিন শেষ, ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে এবার।”
“ভেতরে একদম বয়লার রুমের মতন গরম। দুয়েকজন কাস্টোমার যা আসে, যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যেতে পারলে যেন বেঁচে যায়। কেউ ঠিক মত শেলফগুলো দেখেও না।”
“এটা ভুয়া কথা। সব কাস্টোমারেরই যে এসি লাগবে, এমনটা নয় কিন্তু। কেউ কেউ তো এসে আমাদের উইন্ড চাইমগুলো নিয়েও মন্তব্য করে। বলে ওগুলোর শব্দ শুনলেই শরীরটা ঠাণ্ডা হয়।”
“একমাত্র আদ্দিকালের মানুষেরাই ওরকম কিছু বলবে।”
“ওই ‘আদ্দিকালের মানুষেরাই’ আমাদের দোকানের জন্যে অনেক কিছু। তারাই মূল কাস্টোমার।”
শাশুড়ি এবং পুত্রবধুর মধ্যে এরকম তীর্যক কথা চালাচালি লেগেই থাকে। নাওইয়া মাঝে পড়ে হাসফাস করে। নির্দিষ্ট একজনকে সমর্থন দেয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিছুক্ষণ পরপর মাথা নাড়া আর ভেতরে ভেতরে গুঙিয়ে ওঠাই তার কাজ। কিন্তু এতেও যদি নিস্তার মিলত। তর্ক শেষে দুই পক্ষ থেকেই জোরাজুরি করা হয় সেই নির্দিষ্ট বিষয়টায় ওর মতামতের জন্যে।
“এই সেরেছে,” অস্ফুট স্বরে বলে নাওইয়া। এরপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে দু’জনের দিকে তাকিয়ে বোকাটে ভঙ্গিতে হাসে একবার। “আমি একটু ভাবি ব্যাপারটা নিয়ে? আপাতত ডিনার করে নিলে কেমন হয়?”
চুপ হয়ে যায় সুজু আর মাকি। সেই উত্তপ্ত পরিবেশেই শেষ হয় ডিনার। ইয়ানাগিসাওয়াদের বাড়িতে একটি নৈমত্তিক দৃশ্য।
আসলে নাওইয়া চায় না তার মা এবং স্ত্রী’র মাঝে সম্পর্কটা এমন থাকুক। কিন্তু কিভাবে দু’জনকে শান্ত করবে, সেটাও জানা নেই তার। অফিসের এক বয়স্ক সহকর্মীর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ শোনার পরেই সেই সহকর্মী সাফ জানিয়ে দেয় যে এই সমস্যার কোন সমাধান নেই।
“বউ-শ্বাশুড়ির যুদ্ধে স্বামীর আসলে কিছুই করার থাকে না। কখনো সামনাসামনি কিছু বলবে না। বরং দু’জনের কথাই আলাদা আলাদা ভাবে শুনবে। খবরদার, তাদের কথার মাঝে কিছু বলতে যাবে না আবার, অন্য কোন উপায়ও বাতলে দেয়ার দরকার নেই। তাহলে কিন্তু আগুনে ঘি ঢালা হবে। পুরোটা শোনার পর তাদের বোঝাবে যে তুমি বিষয়টার সাথে একমত। তারা কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথাটা বলছে, সেটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছ, তাদের যুক্তিতে কোন ভুল নেই। কথা দিবে এক পক্ষের মতামত অন্য পক্ষের কাছে সময় সুযোগমত তুলে ধরার। এরপরের কাজটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিষয়ে আর কখনো কারো সামনে কোন কথাই বলবে না, ব্যস। হ্যাঁ, তোমার কান কিন্তু দু’জন মিলে ঝালাপালা করে দিবে। কিন্তু একটু হেসে, মাথা নেড়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। তাদের রাগটা তোমার উপরে নিয়ে আসবে, এটাই সবচেয়ে মোক্ষম সমাধান।”
“খুব মজার কিছু বলে মনে হচ্ছে না,” বিড়বিড় করে বলে নাওইয়া।
“এভাবেই সামলাতে হবে তোমাকে,” ওর মাথায় চাটি মেরে বলে সেই সহকর্মী। “বিয়ে তো করেছো কম বয়সী সুন্দরী একজনকে। তার জন্যে এটুকু হ্যাপা নিতে পারবে না?”
নাওইয়ার মা এবং স্ত্রী’র মধ্যে যে তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকে, সেজন্যে তার প্রতি সমব্যাথী হওয়া তো দুরে থাক, বরং বেশিরভাগ মানুষই ওর অল্প বয়সী স্ত্রী’কে নিয়ে ঈর্ষান্বিত।
মাকির সাথে নাওইয়ার দেখা হয় একটা হোস্টেস ক্লাবে। ওখানেই চাকরি করতো মাকি। নাওইয়া গিয়েছিল তার এক বন্ধুর সাথে।
সেদিন রাতে একটা ফ্যাকাসে নীল রঙের পোশাক পরেছিল মাকি। তার মখমলের মতন ত্বক একদম জ্বলজ্বল করছিল যেন। গতানুগতিকভাবে খুব একটা সুন্দরী হয়তো বলা যাবে না তাকে, কিন্তু চোখ দু’টো ভীষণ মায়াময়। আসলে সেই চোখজোড়াই কাছে টেনেছিল নাওইয়াকে। কথা বলায় ভীষণ পারদর্শী মাকি চোখ বড় করে মনোযোগ দিয়ে শোনে নাওইয়ার বলা প্রতিটা কথা (খুব কাজের কিছু বলছিল ও, এমন নয়)। প্রাণোচ্ছ্বল, চঞ্চল স্বভাবের মাকির হাসি কাঁচভাঙ্গা শব্দের মতন শোনায় নাওইয়ার কাছে।
ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাকি আবিষ্কার করে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে ও। পরদিন আবারো ক্লাবটায় একা একাই যায় সে। যায় তার পরদিনও। ও যা বেতন পায়, সেটাকে কোনভাবেই খুব বেশি বলা যাবে না। কিন্তু পুরনো পৈতৃক নিবাসে থাকার কারণে খরচ তেমন একটা হয় না। বয়সের তুলনায় বেশ ভালো অঙ্কের টাকাই জমিয়েছিল ব্যাঙ্কে। নাওইয়ার মনে হয় যে মাকি এমন কেউ, যার পেছনে টাকা উড়ানোই যায়।
যে বন্ধুর সাথে প্রথম ক্লাবটায় গিয়েছিল ও, সে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলেও বিষয়টা আমলে নেয় না।
“যা করছিস, একটু ভাবনা চিন্তা করে দ্যাখ। তোর মত ছাপোষা এক চাকুরিজীবির এরকম পেশাদার কোন হোস্টেসের প্রেমে পড়া মানায় না। পটাতে পারবি না, এটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে। সময় থাকতে থাকতে ফিরে আয়।”
কিন্তু কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই পরবর্তী সতর্কবার্তাটা আসে খোদ মাকির কাছ থেকে।
“এভাবে বারবার এলে তো আপনার জমানো টাকা সব শেষ হয়ে যাবে মি. ইয়ানাগিসাওয়া। এখন তো একাই আসেন প্রায়ই। কোম্পানির নামেও বিল করতে পারবেন না
“ও নিয়ে ভাববেন না। আমাকে দেখে হয়তো মনে বোঝা যায় না, কিন্তু টাকাপয়সা ভালোই জমিয়েছে এই ক’দিনে।”
“যত টাকাই জমান না কেন। এভাবে চলতে থাকলে সব ফুরিয়ে যাবে।”
“কিন্তু মাকি-চান, এখানে না এলে আপনাকে দেখব কিভাবে?”
নাওইয়ার স্বভাব চরিত্রের কারো জন্যে এমন মন্তব্য করাটা ছোটখাটো কোন বিষয় নয়। তার এই কথাতেই সেদিন বরফ গলে গিয়েছিল।
“আমরা নাহয় কোন একটা উইকেন্ডে অন্য কোথাও যাই? ডেটে?” মাকি বলে।
প্রথমে তো নাওইয়া ভাবে, ওর সাথে বুঝি মজা করছে মাকি কিন্তু এরপর একদিন আসলেই দিনক্ষণ জানতে চেয়ে ইমেইল পাঠায় সে।
প্রথম ডেটে টোকিওর ডিজনিল্যান্ডে যায় ওরা। দিনের বেলায় মার্কিকে আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় আর পরিণত মনে হয় নাওইয়ার কাছে। নাইটক্লাবে আলো-আঁধারিতে বড্ড বেশি বাচ্চা বাচ্চা লাগতো। পরে মাকি স্বীকার করে যে নাইটক্লাবে ইচ্ছে করেই বয়স কমানোর চেষ্টা করতো সে। আসলে তার বয়স একুশ নয়, চব্বিশ বছর। নাওইয়া বুঝে উঠতে পারে না যে মাত্র তিন বছর লুকিয়ে কি এমন লাভ। তখন মাকি জানায়, কম বয়সী হওয়ার অভিনয় করায় কাস্টোমার এবং ম্যানেজমেন্ট- দুই পক্ষ থেকেই লাভবান হয়েছে সে। অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়েছে
কিন্তু মাকির বয়স নিয়ে কোনই মাথাব্যাথা ছিল না নাওইয়ার। এরকম একটা মেয়ে যে ওর সাথে ডেটে যেতে রাজি হয়েছে, তা ভাবলেই নিজেকে স্বর্গের রাজপুত্র মনে হচ্ছিল।
ধীরে ধীরে ওদের ডেটের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। আগের চেয়ে ঘনঘন দেখা করতে শুরু করে দু’জনে। এক পর্যায়ে নাওইয়া বলে ও চায় না যে ওর গার্লফ্রেন্ড নাইট ক্লাবে কাজ করুক।
“তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিলেই পার,” বলে নাওইয়া।
কথাটা শুনে অস্বস্তি ফোটে মাকির চেহারায়।
“আসলে আমি তো অন্য কোন কাজ পারি না। এই বয়সে কোন অফিসে নেবেও না আমাকে। আর যদি নেয়ও, এখন যা উপার্জন করি, তার ধারে কাছেও পাব না। বাসা ভাড়া দেয়াই মুশকিল হয়ে যাবে
তখন।”
নাওইয়া বেশ কয়েকবার মার্কির অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছে। ভুল কিছু বলেনি সে। একজন সাধারণ অফিস কর্মীর পক্ষে ওরকম জায়গা ভাড়া করে থাকা সম্ভব নয় কিছুতেই।
“সেক্ষেত্রে…”
এরপর যে কথাগুলো বলে ও, তা নিয়ে আগে যে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করেছে এমন নয়। “আমরা তাহলে বিয়ে করে ফেলি, তাহলে আমাদের এখানে চলে আসতে পারবে তুমি?”
কথাটা শুনে বিস্ময় ফুটে ওঠে মাকির চেহারায়; চোখ নামিয়ে একবার লাজুক ভঙ্গিতে হেসে কান্নায় ফেটে পরে পরমুহূর্তেই। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নাওইয়াকে।
কয়েক দিন পর মাকিকে সুজুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নাওইয়া। সেই সাক্ষাতে কোন ঝামেলা হয় না। মাকি নাইটক্লাবে চাকরি করে শোনার পর একটু মুখ বাঁকালেও, বিয়ের বিপক্ষে কিছু বলে না সে। আর বিয়ের পর স্বামীর সাথে তাদের চিনামাটির ক্রোকারিজ দোকান কাম বাসায় শ্বাশুড়ির সাথে থাকতে হবে, সেটা নিয়েও আপত্তি করে না মাকি। নাওইয়ার তখন মনে হয়েছিল সবকিছু একদম ঠিকঠাকই চলবে।
প্রথম কয়েক দিন ভালোই যায়। মাকিও দোকানের কাজে সাহায্য করে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণে পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে ওঠে একদিন।
আর সেই কারণটা হচ্ছে একটা বাসন পরিষ্কার করার ন্যাকড়া।
গত বছরের শেষ দিকে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে নাওইয়া দেখে মুখ ফুলিয়ে আছে সুজু। “মাকি কোথায়?” জিজ্ঞেস করে ও।
“জানি না,” কাটা কাটা স্বরে জবাব আসে।
কিছু একটা ঘটেছে, তা বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে উপরতলায় নিজেদের বেডরুমে চলে আসে নাওইয়া। ভেতরে ঢুকে দেখে একটা কাপড়ের টুকরো হাতে নিয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে মাকি। “কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করে ও।
“দেখো,” বলে হাতের জিনিসটা মেলে ধরে ধরে মাকি
একবার তাকিয়েই নাওইয়া বুঝে নেয় যা বোঝার। পরিস্থিতি যে গুরুতর সেটা ধরতেও অসুবিধে হয় না।
ন্যাকড়াটা বানানো হয়েছে বেশ কয়েকটা পুরনো তোয়ালের টুকরো জোড়া দিয়ে। সেখান থেকে হ্যালো কিটি নকশার সাদা তোয়ালেটা চকিতে চিনে ফেলে নাওইয়া। মাকি খুব ছোট থেকেই হ্যালো কিটি ব্র্যান্ডের ভক্ত। এই ব্র্যান্ডের সবকিছু সংগ্রহে থাকা চাই তার। তোয়ালেটাও সেই সংগ্রহেরই অংশ। নিজের এত প্রিয় একটা জিনিসকে বাসন পরিষ্কারের ন্যাকড়া হিসেবে দেখতে যে কারোরই খারাপ লাগার কথা। আর কাজটা কার, সেটাও স্পষ্ট। সুজুর।
তখনই নিচতলায় এসে মা’র সামনে ন্যাকড়াটা মেলে ধরে নাওইয়া। “এই কাজটা কেন করেছ মা?” রাগত কন্ঠে জানতে চায় ও।
“করবো না কেন? বছর শেষে সব পরিষ্কার করি আমরা, জানো না? তখন অনেক ন্যাকড়া লাগে।”
“আমি ওটা বলিনি। জিজ্ঞেস করছি এই তোয়ালেটা কেন ব্যবহার করলে ন্যাকড়া বানানোর কাজে? এমন তো না যে তোয়ালের অভাব পড়েছিল।”
“যে কোন তোয়ালে দিয়ে ন্যাকড়া বানানো যায় না। যেগুলো পুরনো, অনেক দিন ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোই সবচেয়ে ভাল। ।”
“কিন্তু মা, এটা তো মাকির সবচেয়ে প্রিয় তোয়ালে। এটা ব্যবহার করা একদমই উচিৎ হয়নি তোমার।”
“আমরা তো উপহার হিসেবে নতুন কিছু তোয়ালে পেয়েছি সেদিন। ওখান থেকে একটা ব্যবহার করুক না কেন।”
“সেটা তো বিষয় না। মাকির এই হ্যালো কিটি তোয়ালেটা খুব পছন্দের। এটা অনেক দিন ধরে আছে ওর কাছে।”
“উফ! একটানা বকবক করেই যাচ্ছ সেই তখন থেকে! আর এই হ্যালো কিটি-ফিটি, এসব কি, হ্যাঁ? এই বয়সে বিড়াল নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো মানায় নাকি? আবার বাচ্চাদের মতন ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে একজন।”
যা করেছে তা নিয়ে কোন অনুতাপ ছিল না সুজুর মধ্যে। মাফ চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মাকি যদি বিষয়টা ভুলে যেত, তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারত কিছুটা। কিন্তু মাকিও রণে ভঙ্গ দেয়ার মতন মানুষ নয়। স্বামীকে সে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়। তার মা সরি না বলা পর্যন্ত একটা কথাও বলবে না। নাওইয়া সুজুকে এই কথা জানালে সে বলে, “ওর যা ইচ্ছে করুক, আমার কি? আমি কেন সরি বলবো?”
সেদিন থেকেই বিনা ঝঞ্ঝাটে তরতর করে এগোতে থাকা নাওইয়ার বিবাহিত জীবন হোঁচট খেতে শুরু করে। ঝোড়ো বাতাসে বেসামাল দুলতে থাকে জীবন নামের নৌকাটা।
দুই
সুপারমার্কেট থেকে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে দোকানে ফিরল মাকি। পরনে টি-শার্ট আর ছেড়া জিন্স। জিন্সের ছেড়া জায়গাগুলো ডিজাইনের অংশ হলেও সুজুর এই বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না যে কেউ কেন ইচ্ছেকৃতভাবে ছেড়া জামাকাপড় পরবে। সপ্তাহ দুয়েক আগে এই ছেড়া জিন্সের ব্যাপারটা নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হয়ে গেছে বিস্তর।
“বাইরে আজকে পুরো আগুন,” হাত দিয়ে মুখে বাতাস করতে করতে বলে মাকি। “সুপারমার্কেট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে ঘেমে গেছি।”
“আহারে,” বলে বৈদ্যুতিক ফ্যানটা তার দিকে ঘুরিয়ে দেয় নাওইয়া।
“একটু বাতাসও নেই,” ফ্যানের দিকে পিঠ দিয়ে বলে মাকি। ঘর্মাক্ত শরীরে ঠাণ্ডা বাতাস লাগায় কিছুটা ভালো লাগছে এখন “এজন্যেই বোধহয় ইয়ানাগিসাওয়া উইন্ড চাইমগুলো আজকে ওরকম চুপচাপ, নাকি?”
“ওহ…মানে…হ্যাঁ।
“এই মন্তব্যটা না করলে হতো না তোমার? নাওইয়া ভাবে। সুজুকে শুনিয়েই ইচ্ছে করে কথাটা বলেছে মাকি
“আমি গিয়ে বিক্রির রশিদগুলো নিয়ে একট বসি,” এসময় ঘোষণা করে সুজু। “একা একা শেলফের সবকিছু গোছানো চাট্টিখানি ব্যাপার না। তাড়াহুড়ো করে গোছাতে হয়েছে, আজকে রাতে স্থানীয় দোকান মালিক সমিতির ওখানে মিটিং আছে যে, এজন্যে। কেউ কেউ তো আবার অন্যদের জন্যে কাজ বাড়িয়ে মজা পায়। এদের মতিগতি বুঝি না আমি।”
মাকির চেহারায় মেঘ ঘনায় কথাটা শুনে। তার দিকে না তাকিয়ে স্যান্ডেল পায়ে হনহন করে দোকানের পেছনের ঘরটার দিকে চলে গেল সুজু।
“শেলফের সবকিছু আবার গোছানোর ব্যাপারে কি বলছিল? জিজ্ঞেস করে মাকি।
“ওই ইগা ফিশ প্লেট আর বাইজেনগুলো রাখা নিয়ে আর কি। সাদা আর কালোগুলো নাকি একসাথে হয়ে গেছে।”
মাকির চেহারা দেখে মনে হলো টক লেবুতে কামড় বসিয়েছে বুঝি। “সাদা হোক বা কালো, তাতে কি আসে যায়? ডিসপ্লেগুলো ওভাবে সাজাতে অনেক কষ্ট করেছি আমি।”
“আসলে একেকজনের রুচি একেকরকম।”
মানে? আমার রুচিতে সমস্যা? তুমিই কিন্তু আমাকে বলেছিলে যে চাইলে আমার রুচি অনুযায়ী ডিসপ্লে সাজাতে পারি।”
“জানি। কিন্তু আজকের জন্যে নাহয় মা যেভাবে সাজিয়েছে, ওভাবেই থাক?” দুই হাত সামনে বাড়িয়ে মিনতির স্বরে বললো নাওইয়া।
আবারো মুখ ফোলায় মাকি।
“ওহ আচ্ছা, ভুলেই গিয়েছিলাম। এসির ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ? গরম কিন্তু আরো বাড়বে। তার আগেই একটা ইউনিট ইন্সটল করে ফেলতে পারি আমরা।”
ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠলো নাওইয়া। আবার সেই একই কথা!
“ভাবছি কি করা যায়।“
“এত ভাবাভাবির কি আছে, শুনি? নাকি মা’র পক্ষ নিচ্ছ এবারো?”
“না।” মাকির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এর চেয়ে ভালো কিছু বলতে না পেরে মোচড়াচ্ছিল নাওইয়া, এসময় বাইরে থেকে একজনের কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
“হ্যালো!”
কাস্টোমার নিশ্চয়ই! ভালো সময়ে এসেছে! ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায় নাওইয়া।
“শুভ অপরাহ্ন।”
“লোকটার পরনে কালো টিশার্টের উপরে ফ্যাকাসে নীল রঙের একটা শার্ট। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বয়স ত্রিশের আশপাশে।
“আপনারা নিশ্চয়ই মি. এবং মিসেস ইয়ানাগিসাওয়া?” প্রহমে নাওইয়া, এরপর মাকির দিকে তাকিয়ে বলে সে।
“জ্বি, ঠিক ধরেছেন,” নাওইয়া জবাব দেয়। “কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”
“মিসেস মাকি ইয়ানাগিসাওয়া?”
“আমি।”
“হেসে পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করলো লোকটা।”
“এখানে আমার পরিচয় পাবেন। একটু সাহায্যের দরকার ছিল। কার্ডের লেখাগুলো পড়ে আয়ত চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায় মাকির। “আপনি পুলিশের লোক!”
“কি?!” নাওইয়াও অবাক হয় ।
মাকি কার্ডটা বাড়িয়ে ধরে ওর দিকে। দোকানে যে এসেছে, সে নিহনবাশি থানার একজন ডিটেকটিভ। নাম কিয়োচিরো কাগা।
“আপনি কি মিনেকো মিতসুই নামের কাউকে চেনেন?” কাগা জানতে চায়।
“মিতসুই? নাহ, এই নামটা তো শুনিনি,” মাকির দিকে তাকিয়ে বলে নাওইয়া।
কিছুক্ষন ভাবনার পর মাকি দ্বিধান্বিত স্বরে বলে- “উনি কি কোদেনমাচোতে থাকেন?”
“জ্বি, জ্বি,” বেশ কয়েকবার মাথা নেড়ে বলে কাগা। “তাহলে আপনি চেনেন তাকে?”
“আমাদের এখানে জিনিসপত্র কিনতে এসেছেন বেশ কয়েকবার। কিছু হয়েছে নাকি?”
“কাগার চেহারাটা শক্ত হয়ে যায় হঠাৎ করেই। স্বামী-স্ত্রী’র মুখের দিকে তাকায় সে এক এক করে।
“বিষয়টা দুঃখজনক। কিন্তু দু’দিন আগে খুন হয়েছেন উনি।“
বিস্ময়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে আসে মাকির মুখ থেকে। “কি? কিভাবে?” বিড়বিড় করে বলে সে।
“শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে তাকে। আমরা খুন ধরে নিয়েই তদন্ত পরিচালনা করছি।”
“খুন!” বলে স্ত্রী’র দিকে তাকায় নাওইয়া। তারও একই অবস্থা মুখ হা হয়ে গেছে।
“এখানে তাহলে বেশ কয়েকবার এসেছেন তিনি? আরেকটু পরিষ্কার করে বলবেন? মানে প্রতি সপ্তাহেই আসতেন?”
মাথা ঝাঁকায় মাকি।
“নাহ, মাসে একবার বলতে পারেন।”
“শেষবার এসেছিলেন কবে?”
“একটু ভাবি,” ডেস্ক ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকায় মাকি। “প্রায় সপ্তাহখানেক আগে।”
“তাকে তখন কেমন দেখাচ্ছিল, সেটা মনে আছে আপনার?”
“হ্যাঁ। একদম স্বাভাবিক।”
“তার সাথে কথা বলেছিলেন?”
“বলেছিলাম। খুব বেশি না অবশ্য।“
“কি নিয়ে কথা হয়েছিল আপনাদের। এসব জিজ্ঞেস করছি দেখে কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।”
“কি নিয়ে কথা হয়েছিল?” বলে থামে মাকি। “চপস্টিকস কিনতে এসেছিলেন উনি। উপহার দেয়া যায় এমন কিছু খুঁজছিলেন। তবে তার যেটা পছন্দ হয়, সেটা আমাদের স্টকে ছিল না। তাই খালি হাতেই ফিরে যান।”
“চপস্টিকগুলো কার জন্যে কিনতে চেয়েছিলেন, জানেন?”
“সেটা তো আমার জিজ্ঞেস করার কথা না, ডিটেকটিভ।“
“তিনি যে চপস্টিকগুলো চেয়েছিলেন, সেগুলো কি পরে স্টকে এনেছিলেন আপনারা?”
“তখনই অর্ডার করে দেই আমি, কিন্তু এখনও আসেনি। তবে আপনি চাইলে ক্যাটালগের পাতাটা দেখাতে পারি।”
ঝলমল করে উঠলো কাগার চোখ। “খুব ভালো হয় তাহলে।’
একটু দাঁড়ান, “ বলে ক্যাশ রেজিস্টারের একপাশে রাখা ক্যাটালগটা তুলে অভ্যস্ত হাতে কয়েক পাতা উল্টায় মাকি। “এই যে এই সেটটা। ‘
“নাওইয়া স্ত্রী’র কাধের উপর দিয়ে উঁকি দেয়। একটা হিজ অ্যান্ড হাস (কোন দম্পতি বা যুগলের জন্যে বানানো) পুরুষদের জন্যে বানানো চপস্টিকটা কালো রঙের আর নারীদেরটা টকটকে লাল। দু’টোই চেরি ব্লসম মোটিফ দিয়ে নকশা করা।
“খুব সুন্দর,” কাগা বলে।
“এই সেটটা আমাদের সর্বাধিক বিক্রিত আইটেমগুলোর একটা। বিয়ের মৌসুমে বেশি বিক্রি হয়।”
মাকির কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুরটুকু একদম স্পষ্ট। একটা হাঁসকে পানিতে ছেড়ে দিলে যেভাবে আপনা আপনিই সাঁতার কাটতে শুরু করে, সেভাবেই এই ব্যবসার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে মাকি। সুজু এখানে থাকলে নিশ্চিত কোন একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বসতো। “হুহ! এখানে এসেছে এখনও এক বছরও হয়নি, আর কথা শুনে মনে হয় সব বুঝি জেনে গেছে।”
“ধন্যবাদ,” বলে ক্যাটালগটা মাকিকে ফিরিয়ে দেয় কাগা।
“ডিটেকটিভ, আমার একটা প্রশ্ন ছিল,” নাওইয়া বলে এসময় “উনার আমাদের দোকানে আসার সাথে কি খুনের ঘটনাটার কোন সম্পর্ক আছে?”
“না, না,” হাত নেড়ে হাসিমুখে বলে কাগা। “মিস মাতসুয়ি নিয়মিত যেসব দোকান থেকে কেনাকাটা করতেন, সেগুলোয় একটু ঘুরে দেখছিলাম আরকি। ওনার সম্পর্কে আমাকে কি আপনার আর কিছু বলার আছে, মিসেস ইয়ানাগিসাওয়া?”
মাথা একদিকে কাত করে কিছুক্ষণ ভাবে মাকি, এরপর না করে দেয়। খুনের সাথে সম্পর্ক না থেকে থাকলে ডিটেকটিভ লোকটা এতক্ষণ ধরে প্রশ্ন করছে কেন বুঝে পায় না নাওইয়া ।
“ঠিক আছে। আমি যাওয়ার পর যদি কিছু মনে পড়ে, তাহলে অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। ফোন নম্বরটা কার্ডে পেয়ে যাবেন। এসব কেসে কোন তথ্যই ছোট নয়,” মার্কির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললো কাগা।
“জানাবো নিশ্চয়ই।”
“অজস্র ধন্যবাদ। এরকম অসময়ে এসে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।” দু’জনের উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল কাগা ।
তিন
ডিটেকটিভ চলে যাওয়া মাত্র নাওইয়া বাইরে থেকে একটা খবরের কাগজ কিনে আনল। খুনের প্রতিবেদন জোরে জোরে পড়ে শোনালো মাকিকে। শুধুমাত্র রবিবারে দোকানে বসে নাওইয়া, তাই মিনেকো মিতসুইয়ের সাথে তার দেখা হয়নি।
“দেখতে খুব সুন্দর ছিল। পেপারে তো লিখেছে তার বয়স পয়তাল্লিশ। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হতো না। আমি সবসময়ই ভেবেছি ত্রিশের আশপাশে হবে হয়তো। খুন হয়েছে ভাবতেই খারাপ লাগছে,” ডিনারের সময় গম্ভীর স্বরে বললো মাকি। “ভালো মানুষ ছিলেন একজন। আমার জন্যে একবার আইসক্রিম কিনে এনেছিল, জানো?”
সুজু দোকান সমিতির মিটিংয়ে যাওয়ায় আজ খাবার টেবিলে কেবল ওরা দু’জনই। এরকম শান্তিপূর্ণ পরিবেশে খাবার খাওয়াটা উপভোগই করছে নাওইয়া। অনেক দিন পর বিয়ারের স্বাদটাও ভালো লাগছে আজকে।
“কিন্তু ডিটেকটিভ লোকটা আমাদের দোকানে কেন এসেছিল তা বুঝলাম না,” নাওইয়ার চোখে মুখে বিভ্রান্তি।
“বলেছে তো কেন। মিস মিতসুই যেসব দোকানে কেনাকাটা করতেন, সবগুলোতে খোঁজ নিচ্ছেন তিনি।”
সেটা আমিও শুনেছি। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, সে কি করে জানল যে ভদ্রমহিলা. এখানে আসেন? হয়তো কারো সাথে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছিল উনার। প্রতিবেদনটায় লেখা যে একাই থাকতেন মিস মিতসুই।”
“পুলিশের লোকেরা আমাদের দোকানের কোন রশিদ খুঁজে পেয়েছে হয়তো।”
“কবেকার রশিদ। তুমি তো বললে গত সপ্তাহে কিছু কেনেননি উনি।”
ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবে মাকি। এরপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিষয়টা মাথা থেকে বের করে দেয়।
“তাহলে আমার কাছে আর কোন উত্তর নেই। যখনই পাক, আমাদের সাথে তো আর এসবের কোন সম্পর্ক নেই।”
“জানি আমি, তবুও…” নাওইয়া কেবলই একটা মুলার আচার মুখে দিয়ে বিয়ারের গ্লাসটা হাতে নিয়েছে এসময় কথাটা মনে হলো হঠাৎ করেই। “ডিটেকটিভ লোকটা তোমার নাম জানত।”
“কি?”
“এসে মাকি ইয়ানাগিসাওয়াকে খুঁজছিল সে। আমি নিশ্চিত।”
“আসলেই?”
“হ্যাঁ। এটা একটু অদ্ভুত লাগছে না তোমার কাছে? মানে উনি যদি কেবল মিস মিতসুইয়ের যাওয়া দোকানগুলোতে ঢুঁ মেরে দেখতেন, তাহলে তো তোমার নাম জানার কথা ছিল না। আসলেই অদ্ভুত বিষয়টা।”
নাম বলেছিল? তুমি ঠিক শুনেছ তো?” এঁটো বাসনগুলো টেবিল থেকে তুলে নিতে নিতে বললো মাকি।
“কিভাবে জানল সে এটাই ভাবছি। তোমার নাম লেখা কিছু ছিল না তো ভদ্রমহিলার অ্যাপার্টমেন্টটায়?
“আরে বাবা, বললাম তো জানি না। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করলে প্রশ্নের উত্তর আপনা আপনি মাথায় উদয় হবে নাকি?”
“নাওইয়া কেবলই বুকের উপরে হাত ভাঁজ করেছে, এসময় একটা কন্ঠস্বর কানে এলো। “আমি ফিরেছি।” সুজু এসে পড়েছে মিটিং থেকে।
এখন আর খুন নিয়ে আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না। মাকি রান্নাঘরে ঢুকে দ্রুত বাসনগুলো ধোয়া শুরু করে দিল।
“মিটিংটা যে এত অকাজের ছিল আজকে, কি আর বলবো! ওই বুড়োর হদ্দগুলো নিজেদের মত বকেই যাচ্ছিল। কিছু বলে যে বেরিয়ে যাব, সেই উপায়ও ছিল না,” দুই হাতে কাঁধ ডলতে ডলতে রুমে পা দিল সুজু। “কিসব ‘হোম পেজ’ না কি নিয়ে আলাপ করছিল আজকে। মাথায়ই ঢুকছিল না আমার। ওরা নিজেরা জানে কিনা সন্দেহ।
“তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত অনেক। কিছু খেয়েছ?’
খাবার ছিল মিটিংয়ে,” টেবিলে বসে পড়লো সুজু। “কিন্তু একটু শাজুকে (বাসী ভাতের ওপরে চা ছড়িয়ে বানানো খাবার) খাওয়াই যায়। এটা আবার কি?” মুলার আচারটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে সে।
“মাকি বানিয়েছে। খুব মজা হয়েছে, খেয়ে দেখ।”
“তোমার মাথায় এতদিনেও ঘিলু-টিল কিছু হলো না, নাকি? তুমি জানো না আমি দাঁতের জন্যে শক্ত খাবার কিছু খেতে পারি না। ও ইচ্ছে করেই এমন খাবার বানায়, যেটা আমার পক্ষে হজম করা কঠিন।”
“মা!”
চোখ পাকিয়ে সুজুর দিকে তাকিয়ে থাকলো নাওইয়া। কিন্তু সেই অগ্নিদৃষ্টিকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে অবলীলায় ভাতের উপরে গ্রিন টি ঢেলে নিচ্ছে সুজু।
মাকি নীরবে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মুলার আচারের তরকারিটা সরিয়ে নিল টেবিল থেকে। ফ্রিজে রেখে কোন কথা না বলে চলে গেল রুম থেকে। তার দুদ্দাড় করে উপরে যাওয়ার শব্দ শুনে দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে পারল না নাওইয়া।
এসময় সুজু খবরের কাগজটা তুলে নিল টেবিল থেকে।
“এটা আবার এখানে কি করছে? মানে এই মেয়েটা কি কিছু পরিষ্কার করাও শেখেনি, নাকি?”
“তুমি কিন্তু এখন বাজে বকছো, মা। আমি বাইরে গিয়ে একটা কারণে খবরের কাগজটা নিয়ে এসেছি। কোদেনমাচোতে কি হয়েছে শুনেছ?”
“কোদেনমাচো? না তো।”
নাওইয়ার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো সুজু। ডিটেকটিভ কাগার আগমনের ব্যাপারে সব খুলে বললো ও। তবে এই বিষয়টা সযত্নে এড়িয়ে গেল যে ডিটেকটিভ মার্কির নামটা আগে থেকেই জানত। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।
“তুমি এখন বলাতে মনে পড়ছে, কিসামিয়ার মালিকও তার দোকানে একজন ডিটেকটিভ আসার কথা বলছিল তখন।”
“কিসামিয়া হচ্ছে এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী একটা কাটলারির দোকান। এদো যুগে যাত্রা শুরু করা দোকানটায় হাতে বানানো বাহারি ছুরি, চামচ, কাটাচামচ বিক্রি করা হয়। ছুরিতে শান দেয়ার ব্যবস্থাও আছে।
“ভদ্রমহিলা খুন হওয়ার আগে কিসামিয়াতেও গিয়েছিল। কি যেন কিনেছিল ওখান থেকে? ওহ হ্যাঁ, কিচেন সিজরস (রান্নাঘরের কাজে ব্যবহৃত কাঁচি)।”
“কিচেন সিজরস? তদন্তের জন্যে এসব তথ্যও জরুরি নাকি?”
“কিসামিয়ার মালিক তো বলছিল যে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল ডিটেকটিভ। যে খুন হয়েছে সে নিয়মিত ওখান থেকে কেনাকাটা করে কিনা? কিচেন সিজরস কি কাজে লাগবে, সেটা বলেছিল কিনা? এসব আর কি।“
“তাই নাকি? কি উত্তর দিয়েছিল কিসামিয়ার মালিক?”
“তাকে খুব সম্ভবত আগে কখনো দেখেনি। আর কিচের সিজরটা কেন কিনেছে, সেটা একজন কাস্টোমারকে জিজ্ঞেস করা অশোভন।”
“প্রশ্নটা আসলেই অদ্ভুত।”
“কিন্তু ডিটেকটিভের কথায় যুক্তি ছিল। কিচেন সিজর তো সস্তায় যে কোন জায়গা থেকে কিনে নেয়া যায়। যারা কিসামিয়ার মত দোকান থেকে হাতে বানানো কাটলারি কিনে, তাদের কোন না কোন উদ্দেশ্য তো থাকবেই। আর মালিকের মতে, ভদ্রমহিলাকে দেখে নাকি মনে হয়নি তার ওরকম কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল।”
“ওহ্…….”
মিনেকো মিতসুই কিচেন সিজরস কিনল নাকি কিনল না, এতে কি আসে যায়? ভাবে নাওইয়া। খুনের সাথে কি এটার কোন সম্পর্ক আছে? থাকতেও পারে, পুলিশ তো আর এমনি এমনি খোঁজ নিবে না নিশ্চয়ই।
“কত বললে মহিলার বয়স? পয়তাল্লিশ?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে সুজু। “বেচারি। এত কম বয়স। মানুষের জীবনে কখন যে কি ঘটে যায়। তাই সুযোগ থাকতে থাকতে জীবনটা উপভোগ করে নেয়াই ভালো।”
“তুমি কিন্তু সেটাই করছো, মা,” নাওইয়া বলে। “আগামী সপ্তাহে তোমার গানের গ্রুপের বান্ধবীদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা, তাই না? ইসে তে যাচ্ছ তো তোমরা?”
“হ্যাঁ। ওখানকার মন্দিরটা দেখার ইচ্ছা। শিমা উপত্যকায়ও যাব। মূলত আমি যাচ্ছি শিমাতে ঘোরার জন্যেই। ওখানকার এবালোন (সামুদ্রিক ঝিনুক জাতীয় খাবার) অনেক বিখ্যাত।”
“বাহ।”
“খুনের কেসটা নয়, বরং আসন্ন প্রমোদ ভ্রমণ নিয়েই আলোচনা করতে বেশি আগ্রহী সুজু। তার চা খাওয়া শেষ হলে টেবিল থেকে উঠে গেল নাওইয়া। এখন মা’র সাথে খুব বেশি সময় কাটালে পরে আবার মাকি মুখ ফুলিয়ে থাকবে।
চার
নাওইয়া একটা নামকরা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির হয়ে কাজ করে। ওর মুল দায়িত্ব হচ্ছে ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ির ক্রেতাদের আফটার সেলস সার্ভিস নিশ্চিত করা। তোয়োচোর একটা বাড়ির বিক্রয় পরবর্তি তিন মাসের তদারকি শেষে অফিসে ফেরার পথে ও সিদ্ধান্ত একবার বাসা হিওয়ে যাবে। নিনগিয়োচো বুলভার্দে ছোট ভ্যানটা পার্ক করে দোকানে এসে উঁকি দেয়। ভেতরে সুজু কারো সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত, কিন্তু মার্কিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
“আপনাদের কাছে কোন ক্যাটালগ বা লিফলেট আছে নাকি? আমাকে একটা পাঠিয়ে দিতে পারবেন? কি কি আইটেম আছে আপনাদের কাছে? জাপানিজ লবস্টার? বাহ! আর কিছু? মাতসুসাকা বিফ?…কি? ওহ, বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, ওটা কিনে ফেলা যায়। অনেকক্ষণ সময় দিলেন। ধন্যবাদ।”
সুজু খেয়াল করেনি যে নাওইয়া ভেতরে ঢুকেছে। ফোন রেখে ঘুরে তাকাতেই চমকে উঠলো ভীষণ।
“তুমি এই সময়ে বাসায় কি করছো?”
“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম একবার ঢুঁ মেরে যাই। কার সাথে ফোনে কথা বলছিলে? তোমার ট্যুরের ব্যাপারে কিছু নাকি?”
“বলতে পারো…”
“আচ্ছা মা…?”
“হেয়ারড্রেসারের কাছে গেছে। এটাই তো জানতে চাও নাকি?, এবারে না জানি কি রং করে চুলে।”
সুজুর চেহারায় অসন্তোষ।
নাওইয়া প্রায়ই ভেবে অবাক হয় যে এই দুই নারী তার অবর্তমানে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে একে অপরের সাথে। কথা তো বলে না। তাহলে সুজু কি করে জানলো মাকি হেয়ারড্রেসারের কাছে গেছে?
“শুভ অপরাহ্ন,” উষ্ণ হেসে নাওইয়ার পেছনে দাঁড়ানো কারো উদ্দেশ্যে বললো সুজু
ঘুরে দাঁড়িয়ে আগের দিন দোকানে আসা ডিটেকটিভকে দেখতে পেল ও। আজকে তার হাতে একটা কাগজের ব্যাগ।
গতকাল আমাকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ, মি. ইয়ানাগিসাওয়া।”
“ডিটেকটিভ কাগা, তাই না?”
“হ্যাঁ। মনে রেখেছেন তাহলে?”
প্রশ্নাতুর চোখে নাওইয়ার দিকে তাকালো সুজু।
“এই ভদ্রলোকই থানা থেকে এসেছিলেন গতকাল আমার আর মাকির সাথে কথা বলতে,” বললো ও।
“ওহ। শুনলাম আপনি কিসামিয়াতেও গিয়েছিলেন, “ ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে বলে সুজু।
“কথা তাহলে দ্রুতই ছড়ায় এখানে। আমার জন্যে ভালোই হলো অবশ্য। কিসামিয়ার কেউ কি আপনাকে বলেছে যে ওখানে একটা কিচেন সিজরস কিনতে গিয়েছিলেন মিস মিতসুই?”
“হ্যাঁ, বলেছে। ওটা জানা কি জরুরি নাকি?”
জবাবে কিছু না বলে হাসলো কেবল কাগা। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের এখানে কিচেন সিজরস আছে নাকি?”
“কি!” সুজু আর নাওইয়া একসাথে বলল এবার।
আছে একটা,” খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে সুজু। আমাকে কি একটু দেখাতে পারবেন, যদি খুব বেশি সমস্যা না হয়?”
“নিশ্চয়ই। কিন্তু কেন, সেটা জানতে পারি?”
বোকার মতন মাথা চুলকাল কাগা ।
“আমার মতন স্থানীয় থানায় যারা চাকরি করে, তদন্তের খাতিরে তাদের এমন অনেক কিছুই করতে হয়, যার সাথে হয়তো কেসের আপাত কোন সম্পর্কই নেই। কিচন সিজরসের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়াও তেমনই একটা কাজ। তাই এই কেসের সাথে যাদের সামান্যতম সম্পৃক্ততা আছে, তাদেরকেও এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে হচ্ছে। জানি, খুবই বিরক্তিকর। মাফ করবেন সেজন্যে।”
মাথা নিচু করে কাগা এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো যে সুজুর আর বলার মত কিছু থাকল না। “একটু অপেক্ষা করুন,” বলে দোকানের ভেতরে উধাও হয়ে গেল সে।
“ভালোই ঝামেলা তাহলে আপনার?” নাওইয়া বলে।
“সে আর বলতে,” বিমর্ষ হাসি ফোটে কাগার মুখে।
একটা কিচেন সিজর নিয়ে ফিরে আসে সুজু।
“একদমই সাধারণ একটা কাঁচি। কিসামিয়ায় যেরকম হাতে বানানো নকশাদার কাঁচি বিক্রি করা হয়, ওরকম না,” কিচেন সিজরটা ডিটেকটিভকে দেখিয়ে বলে সুজু।
“দেখতে তো নতুনই মনে হচ্ছে। কিছুদিন আগেই কিনেছেন নাকি?”
“দু’বছর তো হয়েই যাবে। খুব একটা ব্যবহৃত হয় না তো, তাই চকচকেই আছে।”
“ধন্যবাদ,” বলে জিনিসটা সুজুকে ফিরিয়ে দিল কাগা।”
“আর আপনার স্ত্রী?”
“ও বাইরে গাছে একটু,” নাওইয়া বলে। ‘হেয়ারড্রেসারের কাছে।”
“ঠিক আছে। ওহ, আরেকটা ব্যাপার, আপনারা রাইস ক্র্যাকার খান নাকি?” হাতের ব্যাগ থেকে একটা রাইস ক্র্যাকারের প্যাকেট বের করে সুজুর দিকে বাড়িয়ে ধরলো কাগা। “এগুলো রেখে দিন। দুইদিন আগে কিনেছিলাম অবশ্য।”
“আমাজাকি গলিটায় যে রাইস ক্র্যাকারের দোকানটা আছে, ওখান থেকে কিনেছেন নাকি? আগে খুব খেতাম, কিন্তু এখন দাঁতের জন্যে আর পারি না…” বলে নাওইয়ার দিকে তাকায় সুজু। “কিন্তু ওদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”
“দাঁতের ব্যাপারে সতর্ক থাকাই ভালো। আপনাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্যে। আমি বরং যাই এখন।”
“ওদের উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল কাগা। নাওইয়া এগোলো তার পিছন পিছন
“মাফ করবেন, ডিটেকটিভ। কিন্তু কালকে থেকে একটা কথা ঘুরছে আমার মাথায়।“
“তাই নাকি?” থুতনিতে হাত বুলিয়ে বলে কাগা। “ঠাণ্ডা কিছু খেতে খেতে আলাপ করি নাহয়?”
স্থানীয় একটা কফি শপে গিয়ে দোতলায় জানালার ধার ঘেঁষে একটা টেবিলে বসলো ওরা দু’জন।
সরাসরি কাজের কথা তুললো নাওইয়া। জানতে চাইল কাগা কিভাবে ওর স্ত্রী’র পুরো নাম জানতে পেরেছে। জবাবে টেবিলে একবার শব্দ করে চাপড় দিল কাগা। যদিও তার হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন এলো না।
“ঠিক বলেছেন। আপনার স্ত্রী’র পুরো নাম ব্যবহার করেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম কেসের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। ভুল হয়ে গেছে।”
“মানে?” সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে নাওইয়া। “মাকি এসবের সাথে কোনভাবে জড়িত নাকি? আপনার পরপর দু’দিন আসা, কিচেন সিজরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা- আমি জানতাম কোন ঘটনা আছে নিশ্চয়ই। কি হয়েছে বলুন তো।”
নাওইয়া উত্তেজিত হয়ে উঠলে হাত নেড়ে তাকে ঠাণ্ডা হতে বললো কাগা।
“আরে ওরকম জরুরী কিছুও না। আপনার চিন্তার কারণটা অবশ্য ধরতে পারছি আমি। আচ্ছা, বলছি শুনুন। ভিক্টিমের অ্যাপার্টমেন্টে একটা কিচেন সিজর পেয়েছিলাম আমরা। সেখান থেকেই শুরু।”
“আবার কিচেন সিজর?”
“হ্যাঁ, কিন্তু ওই কিচেন সিজরটা একদম নতুন। তখনও কিসামিয়ার মোড়কে মোড়ানো ছিল। সেজন্যেই তো অবাক হই আমরা। ওনার রান্নাঘরে আগে থেকেই একটা সিজর ছিল। খুব যে একটা পুরনো, তাও না। তাহলে নতুনটা কিনলেন কেন? কাউকে উপহার দেয়া জন্যে? কিন্তু উপহার দিলে তো প্রাইস ট্যাগটা রেখে দেয়ার কথা না। উপহারের ক্ষেত্রে আমরা চাই না যে প্রাপক দামট দেখুক।
“আরেকটা ব্যাপার, মিস মিতসুইয়ের কম্পিউটারে একটা ইমেইল দেখতে পাই আমরা। একটু ঘাটাঘাটি করে বুঝতে পারি মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ওই ইমেইলটা পাঠিয়েছেন তিনি।” পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে কাগ। “ওখানে কি লেখা ছিল, সেটাও বলতে পারব আপনাকে। ‘কিনেছি আমি। ৬৩০০ ইয়েন লেগেছে। পরেরবার আসার সময় নিয়ে আসবো।’ তখন বিষয়টা বুঝিনি। এত দাম দিয়ে যে কেউ কিচন সিজরস কিনতে পারে সেটা মাথাতেই ঢুকছিল না। কিন্তু পরে যখন কিসামিয়াতে যাই, দেখি যে ওদের কিচন সিজরটার দাম ৬৩০০ ইয়েন। আর ইমেইলটা পাঠানো হয়েছিল-
“মাকি ইয়ানাগিসাওয়াকে।”
“ঠিক ধরেছেন,” কাগা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে। “তাছাড়া ওই অ্যাপার্টমেন্টে আপনাদের দোকানের একটা রশিদও খুঁজে পাই আমরা। সেখান থেকেই আন্দাজ করি যে সিজরটা আপনার মা বা স্ত্রী— এই দু’জনের একজনের জন্যে কেনা হয়েছিল। তবে একটা কথা আপনাকে বলে রাখি, আপনার স্ত্রী খুব সম্ভবত ইমেইলটা পাননি। ওনার ফোনে কেবল টেক্সট মেসেজ দেখায়, ইমেইল না। যতদুর আমার ধারণা, এই প্রথম আপনার স্ত্রী’কে ইমেইল পাঠিয়েছিলেন মিস মিতসুই। তাদের পরিচয়ও খুব বেশিদিনের নয়।”
“তাহলে আপনার ধারণা মাকিই মিস মাতসুইকে দিয়ে কিনিয়েছে কিচেন সিজরটা?”
“আসলে সেজন্যেই গতকাল এসেছিলাম। কিন্তু আপনার স্ত্রী তো কিছু উল্লেখ করলেন না এই বিষয়ে। সেজন্যেই বলেছিলাম আপনার স্ত্রীর এই কেসের সাথে কোন সংযোগ নেই।!
“ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই ভালো হবে বোধহয়।”
একটা উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসি দিয়ে কোল্ড কফির গ্লাসে চুমুক দেয় কাগা।
“আসলে পুলিশের লোকেরা আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না। আমাদের যদি মনে হয় কেউ কিছু লুকাচ্ছে, তাহলে একদম শেষ মুহূর্ত অবধি অপেক্ষা করি। এমনটাও হতে পারে যে মুখ না খোলার পেছনে সম্পূর্ণ যৌক্তিক কোন কারণ আছে আপনার স্ত্রী। হয়তো পারিবারিক কিছু।”
“পারিবারিক কিছু’ কথাটা কানে আসা মাত্র একটা একশো ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠলো নাওইয়ার মাথায়। “ওহ!”
“কি হয়েছে?” কাগা জানতে চায়।
“না কিছু না।” স্ট্রতে মুখ লাগিয়ে টান দেয় নাওইয়া ।
“একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। আপনার স্ত্রী মিস মিতসুইকে কেন কিচেন সিজরটা কিনতে বললো? কিসামিয়া দোকানটা তো আপনাদের ওখান থেকে কাছেই। চাইলে যে কোন সময় নিয়ে আসতে পারত। তাছাড়া নতুন একটা কিচেন সিজর লাগবেই বা কেন? আপনার মা আমাকে যেটা দেখাল, সেটা তো ঠিকঠাকই আছে। ভেবেছিলাম আপনার স্ত্রী হয়তো যুতসই কিছু একটা বলবেন, তখন সব খাপে খাপে বসে যাবে। অবশ্য এমনটাও হতে পারে যে বিষয়টা নিয়ে আপনার সামনে কথা বলতে চাইছিলেন না। কোন কারণে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন।”
“ঠিকই বলেছেন মনে হয়।”
“কিছু বুঝলেন?” কৌতূহলী দৃষ্টিতে নাওইয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কাগা।
“একটু একটু আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু আপনাকে বোঝাতে চাইলে এখন আমার পারিবারিক কিছু বিষয়ে কথা বলতে হবে। খুব সুখকর বিষয়, এমনটাও নয়। কিন্তু না বললে আপনার মন থেকে আসলে সন্দেহ দুর হবে না। আমাদের পরিবারে এখন একটু ঝামেলা চলছে আসলে।”
পরবর্তী কয়েক মিনিটে কিছুটা বিস্মিত কাগাকে নিজের মা এবং স্ত্রী’র মধ্যে চলমান শীতল যুদ্ধের বিষয়ে বিস্তারিত খুলে বলে নাওইয়া। এই প্রথম কারো সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেয়ে স্বস্তিবোধ হচ্ছে ওর।
“বউ-শ্বাশুড়ির যুদ্ধ। সেই পুরনো কাহিনী। কিন্তু এর সাথে কিচেন সিজরসের কি সম্পর্ক?”
“আপনার ভাগ্য নেহায়েত ভালো, ডিটেকটিভ। সেজন্যেই এরকম কোন অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু নারীরা কিছু বিষয়ে মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এই যেমন আমার মা এবং স্ত্রী দু’জনেই রান্না করে, কিন্তু তারা একই জিনিস ব্যবহার করতে নারাজ। মোদ্দা কথা, আমাদের বাড়িতে রান্নার সব কিছুই দু’টা করে। একটা আমার মিসেসের, আরেকটা আমার মায়ের।’
“ওহ,” ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে কাগা। “এবারে তাহলে বুঝতে পারছি আপনার স্ত্রী কেন আরেকটা কিচেন সিজর কিনতে চাইছিলেন। রান্নাঘরে নিজে ব্যবহারের জন্যে।”
“আমার সেটাই ধারণা। আর মিস মিতসুইকে কিনতে বলেছে যাতে আমার মা জানতে না পারে। কিসামিয়ার সবাই মাকিকে খুব ভালো করেই চেনে। তাই হয়ত ভেবেছিল তারা মা’কে বলে দেবে।”
“আমাকে জানানোর জন্যে ধন্যবাদ। ভালোই সমস্যা চলছে তাহলে দু’জনের মধ্যে?”
“ভাই, আমার যে কি অবস্থা। মাঝে মাঝে মনে হয় যুদ্ধের ময়দানে থাকছি,” নাওইয়ার কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। “আমার মা সামনের সপ্তাহে একটু বেড়াতে যাবে পরিচিত কয়েকজনের সাথে। কয়েকটা দিন একটু শান্তিতে থাকব আশা করি।”
“তাই নাকি? কোথায় যাচ্ছেন?”
“ইসে আর শিমা উপত্যকায়। ওখানকার এবালোন নিয়ে এখন থেকেই নানারকম জল্পনা-কল্পনা করছে মা। খেতে নাকি ভীষণ মজা। কিন্তু সেটা শুনে মাকি আবার বলে বসেছে- ‘আমাকে কেউ কোথাও নিয়ে যাচ্ছে না কেন?”
“ওহ, এবালোন…” শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে কাগা।
পাঁচ
দু’দিন পর অফিস থেকে ফিরে নাওইয়া দেখল বাড়িতে পুরো থমথমে অবস্থা।
আগের মতন চিৎকার চেঁচামেচি অবশ্য করছিল না কেউ। বরং পাথুরে মুখ করে লিভিং রুমে টিভি দেখতে ব্যস্ত সুজু আর মাকি বেডরুমে শুয়ে কাঁদছে।
“কি হলো আবার?” নাওইয়া জিজ্ঞেস করে স্ত্রী’কে।
“এবারে কি ভুল করেছি কে জানে! আমি তো ঘরদোর পরিষ্কার করছিলাম,” নাক টেনে বলে মাকি। “তখন একটা খাম হাতে পড়েছিল। অমনি তোমার মা’র মাথা পুরো বিগড়ে যায়।”
মাকির কথা অনুযায়ী সেলাইয়ের বাক্সটা গোছগাছ করে রাখছিল সে, এসময় মিসেস ইয়ানাগিসাওয়া নাম লেখা একটা খাম দেখতে পায়। ওটা কেবলই হাতে নিয়েছে, এসময় সুজু চিৎকার জুড়ে দেয়। বারবার বলছিল মাকি নাকি অভদ্রের মতন অন্যের চিঠিতে হাত দিয়েছে।
“তুমি চিঠিটা খোলোনি?”
“না! সেটা কেন করতে যাব আমি?”
কি একটা অবস্থা! মনে মনে বলে নিচতলায় চলে আসে নাওইয়া সুজু তখনও মুখ বাঁকা করে টিভি দেখায় ব্যস্ত
“মা, তোমার নাম লেখা একটা চিঠি হাতে নিয়েছে দেখে মাকির সাথে এত দুর্ব্যবহার করেছ কেন? এটা কিন্তু বেশি বেশি!”
চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকায় সুজু।
“শোনো, বিষয়টা একদম সহজ। আমরা একটা পরিবার ঠিকই, তাই বলে কারো ব্যক্তিগত কিছু থাকতে পারবে না, এমন নয় কিন্তু প্রাইভেসি বলে একটা বিষয় তো আছে, নাকি?”
“মাকি চিঠিটা পড়েনি। খামও খোলেনি।”
“তাতে কি? ওর হাতে খামটা দেখেছি আমি।”
“সেলাইয়ের ঝুড়িটা ঠিক করে রাখতে গিয়ে হাতে পড়েছে। আর কিছু না।”
“এটা তো আরো অপছন্দ আমার। তাছাড়া ও কোন কিছু সেলাইও করে না।”
“আমার শার্টের একটা বোতাম ছিড়ে গিয়েছে। সেটাই লাগিয়ে দিত।”
“ঠাট্টা করছো নাকি? সেলাইয়ের স-ও জানে না ও।”
“বেশ কয়েকদিন ধরেই অনুশীলন করছে মাকি। এখন আগের তুলনায় ভালোই কাজ পারে। পুরো দোষটাই আসলে তোমার এরকম উল্টোপাল্টা জায়গায় চিঠি লুকানোর দরকারই বা কি?”
টেবিলে রাখা একটা ধূসর খাম এসময় চোখে পড়লো নাওইয়ার। “এটা নিয়েই কি সব অশান্তি?”
নাওইয়া খামটার দিকে কেবলই হাত বাড়িয়েছে, এসময় ওটা ছোঁ মেরে তুলে নিল সুজু।
“আমার ছেলে বলেই সব কিছু দেখার সুযোগ পাবে ভাবলে ভুল করেছ। আমার ব্যক্তিগত চিঠির খাম খোলার অধিকার একমাত্র আমার।”
“এতই যদি গোপনীয় কিছু হয়ে থাকে, তাহলে চিঠিটা লুকানোর জন্যে এর চেয়ে ভালো কোন জায়গা খুঁজে বের করো।”
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো। আমাকে দোষারোপের চেষ্টা করে লাভ নেই। ভুল করেছে তোমার বউ। কিছু বলার থাকলে ওকে গিয়ে বলো।”
হনহন করে নিজের ঘরে ছুটে গিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল সুজু।
আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নাওইয়া। যদিও ওর এখন অনেক ক্ষুধা পেয়েছে, এই মুহূর্তে কাউকে খাবারের কথা বলা সম্ভব না। আপাতত শাজুকে খেয়ে নেই, আগের দিনের ভাত থাকার কথা, মাথা চুলকাতে চুলকাতে হতাশ মনোরোথে সিদ্ধান্ত নেয় ও।
ছয়
আর এক দিন পর বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাবে সুজু। সেদিন সন্ধ্যায় সাবওয়ে স্টেশন থেকে নামার পর কাউকে নিজের নাম ধরে ডাক দিতে শুনলো নাওইয়া। পেছনে ঘুরতেই দেখল ডিটেকটিভ কাগা ছুটে আসছে ওর দিকে।
“আমার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। আপনার সাথে দেখা করতেই আসছিলাম।”
“এখন? আবার?”
“অত জরুরি কিছু না। তবে কথাটা শুনলে আপনি একটু শান্তি পেতেন। আপনার কি সময় হবে?”
“এখন?”
“জায়গাটা কাছেই। চাইলে এখনই যেতে পারি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে অবশ্য। তাহলে আপনার বুঝতে সুবিধা হবে।” নাওইয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাঁটতে শুরু করলো কাগা।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে কিসামিয়ার সামনে আবিষ্কার করলো নাওইয়া। কাঁচের দরজাটা বন্ধ থাকলেও ভেতরে আলো জ্বলছে। ধূসরাভ চুলের দোকান মালিক একটা নিচু গ্লাস ডিসপ্লের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কাগাকে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দেখে হাসি ফুটলো তার মুখে।
“এখনও তদন্তে ব্যস্ত, নাকি ডিটেকটিভ? আরে নাওইয়া, কেমন আছ তুমি?”
“শুভ অপরাহ্ন,” একবার বাউ করে বললো নাওইয়া। এই প্ৰবীণ ভদ্রলোককে ছোটবেলা থেকেই চেনে ও
কিসামিয়া দোকানটা ছোট। ভেতরে একটা ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির ডিসপ্লে কেস। সেটাই বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে। কেসের ভেতরে চকচকে সব কাটলারি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। দেয়াল জুড়েও কাঁচের ডিসপ্লে। সেখানে রাখা কাটলারিগুলো অবশ্য বেশিরভাগই এদো যুগের নকশার। বিক্রির জন্যে নয়। দোকানটাকে একটা ছোটখাট ছুরির জাদুঘর বলা চলে।
“কি অবস্থা, বস?” কাগা বলে। “আমার জন্যে জিনিসটা আনাতে পেরেছেন?”
জবাবে মুচকি হেসে পেছনের ডিসপ্লে থেকে একটা সিজর বের করে আনলো দোকান মালিক। ফলাগুলো লম্বায় দশ সেন্টিমিটারের মতন। একপাশ ভোতা।
“এগুলো কি?” নাওইয়া জানতে চায়।
“আপনার স্ত্রী আসলে এই সিজরগুলোই কিনতে চেয়েছিলেন। মিস মিতসুই ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। ভুল করে তাই কিচেন সিজরস কিনে ফেলেন।”
“মানে?” ভ্রু কুচকে বলে নাওইয়া।
“এগুলোর কি নাম, বস?”
আত্মতুষ্ট ভঙ্গিতে বুকের উপরে হাত ভাজ করে রাখল কিসামিয়ার মালিক।
“আসলে নির্দিষ্ট কোন নাম নেই। আমরা বলি ফুড সিজরস।”
“ফুড সিজরস?” ঘাড় একদিকে কাত করে বলে নাওইয়া ।”
“আপনার স্ত্রী এগুলোর কথাই বলেছিলেন আসলে। আমার ধারণা মিস মিতসুই ফুড সিজরস আর কিচেন সিজরস গুলিয়ে ফেলেছেন,” কাগা বলে।
“অনেকেই এই ভুলটা করে,” ঝলমল করছে বয়স্ক ভদ্রলোকের চেহারা।
“এই সিজরগুলোর কাজটা কি?” প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে নাওইয়া ।
“যে খাবারগুলো একটু বেশি শক্ত, চিবোতে অসুবিধা হয়, সেগুলো কেটে খাওয়া যায়। এই যেমন অক্টোপাস, স্কুইড। বিশেষ করে যাদের দাঁতে সমস্যা, তাদের অনেক সুবিধা হয় এসব ক্ষেত্রে।”
“এবালোনও খাওয়া যায়,” কাগা যোগ করে।
মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে যায় নাওইয়ার।
“এবারে বুঝলেন তো?” হেসে বলে কাগা। “আপনার মা’র দাঁতে সমস্যা। শক্ত খাবার খেতে পারেন না। কিন্তু ট্যুরে গিয়ে এবালোন খাওয়ার ভীষণ শখ তার। সেজন্যেই আপনার স্ত্রী এই সিজরটা অর্ডার দিয়েছিলেন।”
“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না…”
“গতকাল এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন ফুড সিজরস কিনতে। আমি এখানকার বসকে বলে গিয়েছিলাম যে কেউ যদি ওরকম কিছু কিনতে আসে, তাহলে যেন আমাকে জানানো হয়। উনি ফোন দেয়ার সাথে সাথে চলে আসি। সৌভাগ্যক্রমে ওই ভদ্রমহিলার সাথেও দেখা হয়ে যায়। আমি যেমনটা আন্দাজ করেছিলাম। তিনি আপনার স্ত্রীর বন্ধু। আসলে আপনার স্ত্রী-ই তাকে এখানে পাঠিয়েছেন সিজরটা কেনার জন্যে। আপনার মা আগামীকাল রওনা দিবেন। তার আগেই সিজরটা পেতে হতো তাই। আমার বিশ্বাস এতক্ষণে ওটা আপনার স্ত্রী’র কাছে চলে গেছে।”
“মাকি…আমার মা’র জন্যে?”
“মেয়েদের বোঝা একটু মুশকিল, মি. ইয়ানাগিসাওয়া। তাদের
দেখে আপনার মনে হতে পারে যে একে অপরকে হয়তো দেখতে পারে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভিন্ন চিত্র। এর উল্টোটাও হতে পারে। একজন ডিটেকটিভ হিসেবে এরকম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই সবচেয়ে কঠিন কাজ আমার জন্যে।
“আমাকে কি এই জ্ঞানের কথা শোনানোর জন্যেই নিয়ে এসেছেন এখানে?”
“মাফ করবেন। একটু বেশিই বলে ফেলেছি মনে হয়।”
মাথা ঝাঁকায় নাওইয়া।
“না, আপনি মূল ঘটনাটা খুঁজে বের করেছেন দেখেই এখন একটু শান্তি পাচ্ছি আমি। মাকিকে এখন কি বলবো?”
“আমার পরামর্শ থাকবে এই বিষয়ে একদমই মুখ খুলবেন না আপনি। আর এবালোনের ব্যাপারটা…” তর্জনী নাচিয়ে বলে কাগা। “আমি মোটামুটি নিশ্চিত আপনার মা ওখানে গিয়ে এবালোন স্টেক খাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন। এটা ওখানকার বিখ্যাত একটা খাবার। কাচা এবালোনের মত শক্ত নয় একদমই। যাদের দাঁত খারাপ, তারাও খেতে পারে।”
“তাই নাকি?”
“আপনার স্ত্রীকে আবার এই কথা জানাবেন না,” ঠোঁটে আঙুল ছুইয়ে বলে কাগা।
নাওইয়া যতক্ষণে বাড়ি ফিরল, ওদের দোকানটা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। রান্নাঘরে রাতের রান্না প্রায় শেষ করে এনেছে মাকি। নিচু টেবিলটায় বসে বিক্রির রশিদ থেকে হিসেব খাতায় তুলছে সুজু।
“কি খবর?” নাওইয়া বলে।
“এইতো,” সুজু জবাব দেয়। মাকি অবশ্য একবার পিছনে ফিরেও তাকায় না। আবার ঝগড়া হলো নাকি, ভাবে নাওইয়া। তাহলে তো মাকি ওর মা’কে সিজরটা দিতে পারবে না।
কাপড় বদলানোর জন্যে উপরতলায় যাওয়ার সময় সিড়ির পাশে একটা ছোট স্যুটকেস দেখতে পেল নাওইয়া। নিশ্চয়ই মা’র স্যুটকেস, ভাবে ও।
মাকি ফুড সিজরটা দিতে পেরেছে কিনা জানার জন্যে কৌতূহলী হয়ে স্যুটকেসের চেইন খুলে ফেলে দ্রুত। একটা টয়লেট্রিজের ব্যাগ আর কিছু কাপড় দেখতে পেলেও কোন সিজর চোখে পড়লো না। এখনও খুব সম্ভবত জিনিসটা দিতে পারেনি মাকি।
স্যুটকেসটা বন্ধ করছে এসময় একপাশের পকেটে সেই খামটা চোখে পড়ে নাওইয়ার। এই চিঠিটাই সেলাইয়ের ঝুড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল সুজু। কৌতূহল দমাতে না পেরে খামটা বের করে খুলে ফেলে ও।
ভেতরে ইয়েশিমা গিফট শপের একটা ক্যাটালগ। পাতাগুলো উল্টে না হেসে পারে না নাওইয়া। একটা পাতায় লেখা ‘ইয়েশিমা লিমিটেড এডিশন হ্যালো কিটি প্রোডাক্টস’।
ডিটেকটিভ লোকটা ভুল বলেনি, নাওইয়া ভাবে। ওর আসলে সুজু আর মাকিকে নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। নিজেদের মত করেই একে অপরের খেয়াল রাখে তারা।