অধ্যায় ৮ – হস্তশিল্প দোকানের ক্রেতা
এক
দোকানের পেছনে নিজের ডেস্কে বসে আছে মাসায়ো ফুজিয়ামা। সামনে থাকা রশিদগুলো নিয়ে কাজ করার সময় একজন ক্রেতা এলো। ঘড়িতে সময় ছয়টায় একটু বেশি। ছুটির দিনগুলোতে নিজের কাজে মাসায়ো এতই মগ্ন থাকে যে দুয়েকজন ক্রেতা আসলে টেরও পায় না
তবে ওর জানার কথা নয় ওই ক্রেতা আসলেই কিছু কিনবে কিনা। অনেক ক্রেতা শুধু ঘুরতে আসে। কিন্তু কোনো ক্রেতার সাথেই দুর্ব্যবহার করে না মাসায়ো। এজন্য উঠে দরজার কাছে গেল ও। পুরুষ ক্রেতা, বয়স ত্রিশের মত। পরনে একটা টিশার্টের ওপর নীল রঙয়ের হাফহাতা শার্ট।
একটা লাটিমের দিকে নজর পড়ল লোকটার। আকৃতি অনুযায়ী তিন ধরণের লাটিম আছে দোকানে- ছোট, মাঝারি, বড়। লাল, সাদা ও সবুজ রঙয়ে সজ্জিত ওগুলো। একটা ছোট্ট লাটিম হাতে উঠিয়ে নিলো লোকটা।”
“পুরানো ধাঁচের সুন্দর লাটিম, তাই না?” বলল মাসায়ো। ছোটবেলায় হয়তো এগুলো নিয়ে খেলে থাকবেন।”
“আমিও ঠিক এটাই ভাবছি,” মাথা তুলে হেসে বলল লোকটা লোকটার চেহারায় বয়সের হালকা ছাপ। “সাধারণ নিনগিয়োচো ধরনের এগুলো। টোকিওর আর কোনো দোকান এসব জিনিস নিজেদের সংগ্রহে রাখে না।
“আমাদের সংগ্রহে অনেক রকমের পুরানো ধাঁচের খেলনা রয়েছে। আপনার আগ্রহ থাকলে দেখাতে পারি,” আরেকটা ডিসপ্লে টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল মাসায়ো। “যেমন ধরুণ ওই প্যালেট ড্রাম কিংবা জ্যাকব ল্যাডার। সবগুলোই জাপানি জিনিসপত্র দিয়ে হাতে তৈরি। ‘
“কিভাবে? এগুলো কি ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ হস্তশিল্প?”
“হস্তশিল্পের অংশ আরকি। খেলনাগুলো কি দিয়ে বানানো সেটা না জেনে আমি বিক্রি করি না। কেননা ছোট বাচ্চারা অনেকসময় খেলনা মুখে দেয়। তাই প্রস্তুতকারকরা এগুলোতে রঙ ব্যবহারে সতর্ক থাকে। বাচ্চাদের জন্য একদম নিরাপদ।”
“বাহ, চমৎকার!” ডিসপ্লের অন্যান্য খেলনায় চোখ বুলালো লোকটা। আবারও নজর দিলো হাতের লাটিমে। মনে হচ্ছে জিনিসটা ভালোই মনে ধরেছে তার।
“এই লাটিমটা তৈরি গুনমা এলাকায়। সাধারণ অবস্থায় কিনে এনে এখানেই রঙ করেছি আমরা।”
“আর এই দড়িটাও কি গুনমাতে তৈরি?”
“এটা অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করা। তবে এর কাঁচামাল অকৃত্রিম।”
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে মাসায়োর সামনে লাটিমটা উঁচিয়ে ধরল লোকটা।
“এটা নেব আমি।“
“অসংখ্য ধন্যবাদ।”
লাটিম ও টাকা নিয়ে দোকানের পিছনে চলে গেল মাসায়ো। লোকটার সাথে কথা বলা যায়। ওর অভিজ্ঞতায় বলে, হস্তশিল্প পছন্দ করা লোকজন সামাজিক হয়ে থাকে।
প্রায় চব্বিশ বছর আগে নিনগিয়োচোতে এই দোকানটা খোলে মাসায়ো। দোকানের নাম হোজুকিয়া। নিহনবাশিতে আগে সুতার ব্যবসা ছিল ওর পরিবারের। ওই ব্যবসারই একটা অংশ বলা যেতে পারে ওর এই হস্তশিল্পের দোকানটা। ছোটবেলা থেকেই ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পে আগ্রহ ওর। এই ব্যবসা চালুর অনেক আগে থেকে হস্তশিল্প সংগ্রহ করতো। নিজে কারখানাগুলো ঘুরে পছন্দ করে নিয়ে আসে। আবার অনেক কাঁচামাল সরাসরি নেয় পারিবারিক ব্যবসা থেকেই।
লাটিমটা কাগজে মুড়িয়ে ক্যাশ রেজিস্টার থেকে ভাঙতি বের করল। মাথা তুলে দেখল লোকটা ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে দাঁড়িয়ে ব্যাগের শেলফটা দেখছে।
“বিশেষ ফ্যাব্রিক্স দিয়ে বানানো হয়েছে এগুলো সব,” বলল মাসায়ো। “বেঁচে যাওয়া অংশ জোড়া দিয়ে কিছু বানাই না আমরা। জোড়াতালি দেয়া জিনিস এখানে বিক্রি হয় না।”
হাসল লোকটা।
“আপনি দেখছি আপনার জিনিসপত্রের ব্যাপারে বেশ সচেতন।“
“অবশ্যই। এগুলো তদারকির জন্য লোকও আছে এখানে।“
লাটিম আর ভাঙতি টাকাটা দিয়ে দিলো মাসায়ো।
ভাঙতি টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে দোকানের চারিদিকে তাকাল সে।
“কতক্ষণ পর্যন্ত খোলা থাকে আপনার দোকান?”
“কখন বন্ধ করি? সেটা আসলে অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে। তবে সাতটার আশেপাশেই বন্ধ করে দিই।”
“আপনাদের ব্যস্ত সময় কাটে কখন?“
দুঃখভরা হাসি হাসল মাসায়ো।
“ছুটির দিন ও সপ্তাহের শেষদিকে মোটামুটি বেশি ক্রেতা আসে এখানে। কিন্তু কখনোই এই জায়গাটা ওরকম ব্যস্ত থাকে না। এই দোকানটা মূলত শখের বশেই চালাই আমি।”
হাতে থাকা কাগজে মোড়ানো লাটিমটার দিকে তাকাল লোকটা।
“আচ্ছা। এই লাটিমগুলো কি বেশি বিক্রি হয়?”
“বেশি? নাহ মাঝেমধ্যে বিক্রি হয় আরকি। এর ক্রেতারা মূলত বৃদ্ধ বা মধ্যবয়স্করা। বাচ্চাদের উপহার হিসেবে কেনে। আজকাল কম্পিউটার গেমের প্রচলন বেশি হলেও এসব খেলনা অনেকেই পছন্দ করে।”
“ঠিক বলেছেন। সম্প্রতি কেউ কি এই ধরণের লাটিম কিনেছে?”
“এই লাটিম? দাঁড়ান ভাবি…
বিভ্রান্ত লাগছে মাসায়োকের। এই লোকটা এত প্রশ্ন করছে কেন? অন্য কেউ লাটিম কিনেছে কিনা জেনে তার কি লাভ?
মাসায়োর চেহারাতেই ফুটে উঠল সন্দেহের ছাপ
বোকাটে ভঙ্গিতে হাসলো লোকটা। “দুঃখিত, আমার প্রশ্নগুলো বোধহয় আপনাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
“ওহ, আপনি পুলিশের লোক…”
“হ্যাঁ, নিহনবাশি থানার। আমাদের আলাপটা সহজ ও স্বাভাবিক রাখতে চাইছিলাম আরকি। এজন্যই কিছু বলিনি।”
লোকটা পুলিশ জানার পর তাকে আরেকবার ভালোভাবে দেখে নিলো মাসায়ো। ওর মনে হল তার এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের আড়ালে ভিন্ন কিছু একটা রয়েছে।
“আমার এখানকার লাটিম নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি?” নার্ভাস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল মাসায়ো।
“না, না, না,” হাত নেড়ে নাকচ করে দিলো কাগা। “লাটিমটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি আসলে একজনকে খুঁজছি যে অতি সম্প্রতি এই লাটিম কিনেছিল।”
“কিসের তদন্ত করছেন আপনি?”
“বলা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি আপনার দোকানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আচ্ছা, তবুও না ভেবে পারছি না। আমার কোনো ক্রেতা এর সাথে জড়িত, তাই না?”
“আমরা এখনো নিশ্চিত নই, ফলে প্রশ্ন না করাই ভালো। যত জানবেন ততই ঝামেলা হবে আপনার। বেশি না জানাই ভালো।“
“হ্যাঁ, হয়তো ঠিকই বলেছেন।”
“সম্প্রতি লাটিম কিনেছে এমন কারোর কথা মনে পড়ছে আপনার?” জিজ্ঞেস করল কাগা।
“একটু দাঁড়ান।”
“বিক্রির রশিদগুলো উল্টে পাল্টে দেখল মাসায়ো। ওগুলো দেখে ধারণা করা যাবে কোন জিনিসটা কখন বিক্রি করা হয়েছে।
মিনিটখানেক আগে কাগাকে বলেছে এখানে প্রায়ই লাটিম বিক্রি হয়। এতে ব্যাপারটা জট পাকিয়ে গিয়েছে। কেননা সম্প্রতি কোনো লাটিম বিক্রি হওয়ার ঘটনা মনে নেই ওর।
“আহ,” রশিদের দিকে তাকিয়ে বলল ও।
“পেয়েছেন কিছু?”
“বারোই জুন একটা বিক্রি করেছিলাম। আপনি যে সাইজটা কিনেছেন সেটাই, ডিটেকটিভ।”
“এর আগে কবে?”
“এর আগে… এটারও প্রায় একমাস আগে।”
“আচ্ছা, ওই বারো তারিখ লাটিমটা যে কিনেছিল তার ব্যাপারে কিছু কি মনে করতে পারেন?”
“ওইদিন সম্ভবত আমি ছিলাম না। এটা বিক্রি করেছে মিসাকি, আমাদের অস্থায়ী কর্মী।”
“ওহ, আচ্ছা। কখন পাওয়া যাবে তাকে?”
“আগামীকাল।”
“আগামীকাল এসে তার সাথে একটু কথা বললে সমস্যা হবে?”
“কোনো সমস্যা নেই। ওকে কি জানাতে পারি যে আপনি আলাপ করতে চান?”
“নিশ্চয়ই।”
লাটিম নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে লোকটা নিজেকে পরিচয় দিলো ডিটেকটিভ কাগা বলে।
******
“ভাবছি কোদেনমাচোতে হওয়া খুনটার সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে নাকি,“ অ্যাপ্রন বাঁধতে গিয়ে বলল মিসাকি সুগাওয়ারা।
“কোদেনমাচোতে খুন হয়েছে নাকি?” অবাক হয়ে বলল মাসায়ো। এই ব্যাপারে প্রথম শুনল ও।
“হ্যাঁ। জানেন না নাকি? নাহোর ওখানে পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল।”
ওমাকারা নামের রাইস ক্র্যাকার শপ ও হোজুকিয়া রাস্তার একই পাশেই। নাহোই ওই দোকানটা চালায়। তার ও মিসাকির বয়স প্রায় একই। বন্ধু বলা চলে দু’জনকে।
“ওই রাইস ক্র্যাকার শপে কি করছিল পুলিশ?”
মাথা উঁচু করল মিসাকি।”
“জানি না। অত বিস্তারিত কিছু বলেনি নাহো।”
“পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত লাগছে। আমাদের এখানকার কোন লাটিম খুনের সাথে সম্পর্কিত হলে খুবই ভয়াবহ হবে। যদি জিনিসটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হয়, তাহলে…”
“জানেনই তো, বাজে খবর রটার চেয়ে বিশ্রী কিছু আর হয় না।“
“হ্যাঁ, জানি। আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এতে।”
ভাবছি… ডেস্কে থাকা ক্যালেন্ডার দেখে বলল মিসাকি। যাইহোক, আমরা লাটিমটা বিক্রি করেছিলাম বারো তারিখ। আমি অনেকটাই নিশ্চিত, খুনটা এর আগে হয়েছে। মনে হয় না এটা এভিডেন্স বা ওরকম কিছু।”
তোমার সত্যি এমনটা মনে হয়?
“হ্যাঁ। হয়তো ওটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নয়,” ঘোষণার সুরে বলে প্রসঙ্গের ইতি টানলো মিসাকি।
লাঞ্চের পরপর এলো কাগা। পেছনের ডেস্কে বসে মিসাকি ও কাগার আলাপ শুনল মাসায়ো।
“বারো তারিখ ঠিক কয়টার সময় কেনা হয় লাটিমটা?”
“ছয়টার পরপর, মনে হয়। তখন কেবল সন্ধ্যা নামছিল।”
“যে কিনেছিল তার ব্যাপারে কিছু মনে আছে?”
“লোকটা মধ্যবয়স্ক, খুব বেশি লম্বা নয়। পরনে ছিল স্যুট। মনে হচ্ছিল অফিস থেকে ঘরে ফিরছে।” সুন্দরভাবে বলল মিসাকো ভাগ্যিস তাকে আগে থেকেই এই ব্যাপারে জানিয়ে রেখেছিল মাসায়ো, ফলে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পেরেছে।
“ছবি দেখালে লোকটিকে চিনতে পারবেন?”
“মনে হয় না। ক্রেতাদের চেহারার দিকে খুব একটা তাকাই না আমি। ওদের হাত ও পিঠই বেশি নজরে পড়ে আমার।”
মেয়েটার সাথে কথা বলা দরকার আমার, মিসাকির উত্তর শুনে ভাবল মাসায়ো, ক্রেতাদের চেহারা না দেখে ওরা কি চায় সেটা কিভাবে বুঝে ও?
“লোকটার ব্যাপারে কিছু কি মাথায় আছে আপনার? যেকোনো কিছু। সামান্য কিছু হলেও।”
মাথা নাড়ল মিসাকি। “তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না…”
“লাটিমগুলো তিনটা সাইজের হয়- ছোট, বড়, মাঝারি। সে ছোট সাইজটা নিয়েছিল?”
“হুম। আসলে আরেকজন ক্রেতাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তখন আরকি, এজন্য ঠিক নিশ্চিত নই। যতদূর মনে পড়ে, সময় নিয়ে লাটিমগুলো দেখছিল সে।”
আবারও দায়সারাভাবে উত্তর দিলো মিসাকি।
“বেশ তো,” বলে মাসায়োর দিকে ঘুরল কাগা। “বারো তারিখের পর আর কোনো লাটিম বিক্রি করেননি আপনি, ঠিক?
“এরপর গতকাল আপনিই কিনলেন।
“আচ্ছা। ডিসপ্লের সব লাটিম আমাকে দিন, আমি দাম দিয়ে দিচ্ছি।”
“সবগুলো?”
“হ্যাঁ, সবই। কাগজে মোড়ানোর দরকার নেই। কত হল সবমিলিয়ে?” ওয়ালেট বের করল কাগা।
“ডিটেকটিভ?” বলে উঠল মাসায়ো “কোদেনমাচোতে হওয়া খুনের সাথে আমাদের লাটিমের কি কোনো সম্পর্ক আছে? এগুলো কি এভিডেন্স বা ওরকম কিছু হিসেবে ব্যবহৃত হবে?”
স্থির হয়ে গেল কাগা, চোখ বড় হয়ে গিয়েছে তার। প্রশ্নটা নিশ্চিতভাবেই বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে তাকে। প্রথমে মাসায়ো এরপর মিসাকির দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাল। কোনোমতে নিজেকে সামলে হাসল অপ্রস্তুতভাবে।
“এই এলাকায় সবাই সবাইকে চেনে। গুজব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে।”
“উত্তরটা তাহলে হ্যাঁ?”
একমুহূর্ত পর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কাগা। অভিব্যক্তি গম্ভীর।
“আপনাদের লাটিমের সাথে এই কেসের কোনো সংযোগ নেই। আর কোনো সংযোগ নেই বলেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
ভ্রূ কুঁচকে তাকাল মাসায়ো। “এর মানে কি?’
“শীঘ্রই হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারব বিষয়টা। আপাতত ধৈর্য্য ধরতে হবে আপনাদের। দয়া করে একটা রশিদ করে দেবেন?” ওয়ালেট থেকে দশ হাজার ইয়েনের নোট বের করে বলল কাগা।
দুই
পিজ্জার মেন্যু দেখছিল রেইকো কিশিদা। টেবিলের ওপর থাকা সেলফোনটা বেজে উঠল তখনই। কোনায় তাকিয়ে দেখতে পেল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা। ফোন দিয়েছে ওর শ্বশুর, কিন্তু ধরার ইচ্ছা নেই ওর। জানে লোকটা কি চায়। তা সত্ত্বেও কয়েক মুহূর্ত ফোনের দিকে তাকিয়ে কলটা ধরল ও।
“রেইকো বলছি।”
“হ্যাঁ, আমি। কাতসুয়া বলল তোমার ওখানে নাকি পুলিশ এসেছিল?”
“হ্যাঁ। গতপরশু এসেছিল ওরা।”
“হ্যাঁ? আমি এখন এলাকাতেই আছি। তোমার ওখানে এলে কিছু মনে করবে?”
“এখন? চাইলে আসতে পারেন। তবে কাতসুয়া এখনো ফেরেনি। ওর ফিরতে রাত হবে।”
যতটা পারা যায় অনাগ্রহী ভাব দেখাতে চাইলো রেইকো। চায় না ওর শ্বশুর আসুক, এতে সে যা ভাবে ভাবুকগে। কিচ্ছু যায় আসে না ওর। বরং সে বুঝতে পারলেই ভালো।
তবে তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া পেল না ও।
“তাই? আচ্ছা, সমস্যা নেই। তোমার সাথেই কথা বলতে চাই আমি। তুমিই পুলিশের সাথে কথা বলছো।”
“হ্যাঁ, কিন্তু…”
“আমি শুধু শুনতে চাই কি ঘটেছে। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব আমি। দুঃখিত তোমাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য।”
কেটে গেল কলটা।
যদি সত্যিই দুঃখিত হয়ে থাকেন তবে আসছেন কেন? সেলফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবল রেইকো। ফোনটা ধরার জন্য নিজেকেই গালি দিলো ও। ওর নিঃসঙ্গ শ্বশুর খালি ওদের কাছে আসার ছুতো খোঁজে। এই মাসেই কতবার এরকম করল।
লিভিংরুমের চারপাশে তাকাল রেইকো। কেউই ঘরটাকে গোছানো বলবে না। সোতোর খেলনা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিন ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেতে। সোফা কাপড়-চোপরে ভর্তি।
কি যন্ত্রণা, উঠে দাঁড়িয়ে ভাবল ও। এলোমেলো ঘরে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল পিজ্জা ডেলিভারি মেন্যুটা। ঠিকমত রান্না না করার জন্য খোঁচা শুনতে রাজি নয় ও।
সোফাটা গোছানোর সময় সোতো এসে উঁকি দিলো, যার এখন ঘুমানোর কথা।
“কি করছো, আম্মু?”
“গোছগাছ করছি। তোমার দাদা যেকোনো সময় চলে আসবে।”
“দাদা আসবে?” পাঁচবছর বয়সী ছেলেটার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।”
“মনে হয় না বেশিক্ষণ থাকবে। তোমার দাদা তো ব্যস্ত মানুষ।“
যেন নিজেকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কথাটা বলল রেইকো।
কয়েক মিনিট পরেই বেজে উঠল সদর দরজার ইন্টারকম।
রেইকোর শ্বশুর, ইয়োসাকু কিশিদা এসেছে। সাথে করে নিয়ে এসেছে ক্রিম পাফস। এগুলোর জন্য পাগল সোতা।
“ডিনারের সময় হাজির হওয়ার জন্য দুঃখিত। রান্নায় ব্যস্ত ছিলে নাকি?”
আর্মচেয়ারে বসে কিচেনের দিকে তাকাল ইয়োসাকু।
“আসলে কয়েক মিনিট আগে বাড়ি ফিরেছি। রান্না শুরু করতেই যাচ্ছিলাম,” শ্বশুরের হাতে বার্লি চায়ের গাস ধরিয়ে বলল রেইকো। একঝলক সোতার দিকে তাকাল ও, দাদার ব্রিফকেস নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে ছেলেটা। “সোতা, দুষ্টামি বন্ধ কর।”
“দুঃখিত, বাজে সময়ে এসে পড়েছি, “ ব্রিফকেস নিজের দিকে টেনে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল ইয়োসাকু।
“যত দ্রুত পারি আলাপ শেষ করব। পুলিশ আসলে কি জানতে চাইছিল?”
“তেমন কিছু নয়। জানতে চাইছিল দশ তারিখ সন্ধ্যা কয়টা নাগাদ এসেছিলেন আপনি, এই ধরনের প্রশ্নই সব।”
“বিস্তারিত বলো।”
“বিস্তারিত?”
টেবিলের দিকে তাকাল রেইকো।
দুজন ডিটেকটিভ এসেছিলো। টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিটেকটিভ উয়েসুগি ও নিহনবাশি থানার ডিটেকটিভ কাগা। জীবনে এর আগে কখনোই কোন ডিটেকটিভের মুখোমুখি হয়নি রেইকো।
বেশিরভাগ কথা উয়েসুগিই বলেছে। একটা চলমান তদন্তে বিভিন্ন লোকের বিবৃতি যাচাই করে দেখছিল ওরা। প্রথমেই জানতে চায় ১০ জুন সন্ধ্যায় ইয়োসাকু এখানে এসেছিল কিনা। এসেছিল বলে জানায় রেইকো, তখন আরেকটু বিস্তারিত জানতে চায় উয়েসুগি। বিস্তারিত বলে ও; আটটা নাগাদ আসে ইয়োসাকু, এক ঘণ্টার মত ছিল সেদিন।
“এরপর জানতে চায় কি প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল আমাদের। আমি বলেছি, দাদির মৃত্যুবার্ষিকীর প্রস্তুতির ব্যাপারে আলাপ করছিলাম আমরা।”
কথাটা সত্যিই। সেদিন দুপুরে ইয়োসাকু কল করে জানায় মৃত্যুবার্ষিকীর প্রস্তুতির ব্যাপারে আলাপ করতে আসবে সে। ডিনারের পর আসবে শুনে বেশ স্বস্তি পেয়েছিল রেইকো।
“আর কিছু জিজ্ঞেস করেছে ওরা?” কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে ইয়োসাকু। অস্বস্তি হচ্ছে রেইকোর।
“আর কিছু?”
মনে করার চেষ্টা করছে রেইকো। নিজের মত খেলছিল সোতা। ওদের দিকে এগিয়ে এলো সে।
“দাদু, এটা ঘুরিয়ে দেবে একটু?” একটা লাটিম বাড়িয়ে ধরে বলল বাচ্চাটা।
“হ্যাঁ, তবে একটু পরে, আচ্ছা?” নাতির মাথায় হাত নেড়ে বলল ইয়োসাকু।
“মনে পড়েছে। লাটিমের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল ওরা।”
“কি!” সতর্ক দেখাল ইয়োসাকুকে। “এটা কি ওদেরকে দেখিয়েছ?”
“নাহ দেখাইনি। পুলিশরা আসলে ওইদিকে ছিলো সোতা। এরপর…”
কাগার চোখেই পড়ে জিনিসটা। “বেশ অন্যরকম একটা খেলনা কিনে দিয়েছেন ছেলেকে। পুরানো দিনের খেলনা। কোথায় থেকে পেয়েছেন?” জিজ্ঞেস করে কাগা।
“বলেছি জানি না। আমি এটা কিনিনি। জানিয়েছি, আপনি কিনে এনেছেন সোতার জন্য। কবে, জানতে চায় কাগা।”
“কি বললে?” জিজ্ঞেস করে ইয়োসাকু।
“বলেছি বারো তারিখ,” বলল রেইকো। “বারো তারিখ নাগাদ এটা নিয়ে আসেন আপনি। ভুল কিছু বলেছি?“
“না, না… ঠিক আছে। ওই লাটুর ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করেছে সে?”
“নাহ, এটুকুই। বেশিক্ষণ থাকেনি ডিটেকটিভ দুজন। বলতেই হয়, দুজনই বেশ ভদ্র আর ব্যবহারও অমায়িক।”
“ওহ, তাই?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাটিমে সুতা পেঁচিয়ে বলল ইয়োসাকু।
“জানেন পুলিশ কি ব্যাপারে তদন্ত করছে? আপনি কি কোনভাবে জড়িত?“
“তেমন গুরুতর কিছু নয়। আমার এক কর্পোরেট ক্লায়েন্ট ছোটখাটো জালিয়াতিতে জড়িত। সেটাই খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এজন্য আমার ব্যাপারেও খোঁজখবর নিচ্ছে ওরা। বুঝতে চাইছে আমিও কোনভাবে জড়িত কিনা।”
“হায় ঈশ্বর!”
কর ব্যবস্থাপনার ব্যবসা রয়েছে ইয়োসাকুর। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো হল তার ক্লায়েন্ট। সাম্প্রতিক মন্দার কারণে হয়ত সবকিছু জটিল হয়ে পড়েছে, ভাবল রেইকো। সোতার সামনে, মেঝেতে লাটিম ছুড়ে মারল ইয়োসাকু। ঘুরতে থাকল জিনিসটা, থেমে গেল দ্রুতই। কিন্তু মজা পেয়েছে সোতা।
“আগের মত আর পারি না। আগে দারুণ লাটু ঘুরাতে পারতাম। “ মেঝে থেকে লাটিমটা উঠিয়ে নিলো ইয়োসাকু।
******
রাত দশটা নাগাদ বাড়িতে ফিরল কাতসুয়া কিশিদা। লাল হয়ে আছে তার চেহারা, রেইকো ভাবল ড্রিঙ্ক করে এসেছে নাকি সে। অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে, টাইয়ের ফাঁস আলগা করে সরাসরি রান্নাঘরে চলে গেল পানি খেতে।
“আজ রাতেও পিজ্জা? সমস্যাটা কি!” বলল সে। নিশ্চিত পিজ্জার ফাঁকা বক্সটা দেখেছে।
“তাতে তোমার কি? বাইরে তো দামী খাবার দিয়ে ডিনার করে এসেছ।”
“মজা করতে যাই না আমি। একে বলে রিলেশনশিপ বিল্ডিং। আমার দুশ্চিন্তা বাচ্চার পুষ্টি নিয়ে। এসব আজেবাজে জিনিস বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য মোটেও ভালো নয়।”
“এসব ‘আজেবাজে জিনিস’ ও খায় না। ওর জন্য যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার রান্না করি আমি।”
“জানি না ফ্রোজেন ফুড আর প্যাকেটজাত সিদ্ধ খাবারকে পুষ্টিকর বলা… “ ফ্রিজ খুলে অভিযোগের সুরে বলল কাতসুয়া। কথা না শেষ করেই প্রসঙ্গ পাল্টালো। “ওহ, কেউ কি এসেছিল নাকি আজ?”
ক্রিম পাফের বক্স দেখতে পেয়েছে সে।
“ইয়োসাকু এসেছিল।”
“বুড়ো আবারও এসেছিল? এবার কি চায়?” শার্টের কয়েকটা বাটন খুলল কাতসুয়া, এরপর হেলে পড়ল সোফার ওপর।
“গত পরশু পুলিশের সাথে কি আলাপ হয়েছে সেটা জানতে চাইছিল। তুমি নাকি তাকে পুলিশ আসার ব্যাপারে জানিয়েছো।”
“তাই? এই ব্যাপারে বুড়ো কি বলেছে?”
ইয়োসাকুর সাথে হওয়া আলাপ তাকে জানালো রেইকো। সব শুনে ভ্রু কোচকালো কাতসুয়া।
“অ্যাহ? ক্লায়েন্টের জালিয়াতি? তার জন্য তো খুব ভালো কিছু নয় ব্যাপারটা।”
টেবিলের ওপর থেকে লাটিমটা উঠিয়ে নিলো সে। ঘুমিয়ে পড়েছে সোতা।
“তোমার বাবার ফার্ম ঠিকঠাক আছে তো? এসবের জন্য ফার্মটা বন্ধ হয়ে যাবে না তো আবার?”
“সেই সম্ভাবনা নেই। আমি নিশ্চিত সব ঠিকই থাকবে।” লাটিমের সাথে দড়ি বেঁধে, লাটিমটা মেঝেতে ছুঁড়ে দিলো কাতসুয়া। তবে মেঝেতে পড়ে ঘুরল না ওটা, কয়েকবার লাফিয়ে গিয়ে ধাক্কা খেল কোনায় থাকা স্কেটিং বোর্ডের সাথে।
“দেয়ালে দাগ ফেলে দিও না।”
“আজব,” লাটিমটা উঠিয়ে মাথা উঁচু করল কাতসুয়া। “আগে তো বেশ ভালো লাটিম ঘুরাতে পারতাম।”
“ওহ, কেবল মনে পড়ল। ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি থেকে কল করেছিল।”
জায়গায় জমে গেল কাতসুয়া।
“কি চায় ওরা?”
“তোমার পেমেন্টের ব্যাপারে কথা বলছিল। তোমার মোবাইল নম্বর চেয়েছে আমার কাছে। কালকে ওরা তোমাকে কল করতে পারে। এখন বোলো না তুমি আবার ওসব শুরু করেছ।”
“কি শুরু করেছি?”
“পেমেন্ট না দেয়া। বড় ঝামেলায় পড়বে কিন্তু।”
“দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
“সত্যিই? কে জানে বাবা!”
“এরকম করছো কেন? আমি একাই ক্রেডিট কার্ড থেকে খরচ করি না। তুমিও তো ফ্যামিলি ক্রেডিট কার্ডটা রয়ে সয়ে ব্যবহার করো না।”
“আমার কার্ডের লিমিট খুবই সামান্য। একটা কি দুটো দোকানে গেলেই শেষ হয়ে যায়।”
“তুমি এখনো খরচ করেই চলেছ,” লাটিম টেবিলে ছুড়ে দিয়ে, জ্যাকেটটা উঠিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কাতসুয়া।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিভি চালু করল রেইকো। পঞ্চাশ ইঞ্চির এই ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভিটা এই বছরের শুরুতেই কিনেছে। শপিংয়ের পর পছন্দের মুভি দেখাই ওর প্রিয় কাজ
যতই কাতসুয়া বলুক দুশ্চিন্তার কিছু নেই, রেইকোর সন্দেহ আবারও ধার শোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। আগেও একবার এরকম হয়েছিল, ইয়োসাকু গিয়ে ছাড়িয়ে আনে কাতসুয়াকে।
পাঁচ বছর প্রেমের পর ছয় বছর আগে বিয়ে করেছে ওরা। একই হাইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রী দু’জন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেই বিয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না কাতসুয়ার। তার ইচ্ছে ছিল চাকরিতে ঢুকে নিজের পায়ের তলায় মাটি আরেকটু শক্ত করার। সে আসলে চাইত সম্পর্ক পরিণতি পাওয়ার আগে আরেকটু সামর্থ্যবান হতে, রেইকো বুঝত সেটা। কিন্তু ও চাইত না ওকে এভাবে ঝুলিয়ে রেখে অবশেষে ছেড়ে দিক সে। বিয়ের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিল রেইকো, নিজে চাকরী খোঁজারও প্রয়োজন বোধ করেনি।
কাতসুয়াকে ফাঁসিয়ে, তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় ও। কোনো কঠিন কাজ ছিল না সেটা। শুধু গর্ভবতী হলেই চলত। যৌনতার সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষার দিকটা রেইকোর হাতেই ছেড়ে দেয় কাতসুয়া। ফলে রেইকো যেদিন বলল, “আজ কোনো সমস্যা নেই” সেদিন একবারও সন্দেহ উঁকি দেয়নি কাতসুয়ার মনে। এরপর যা হবার সেটাই হল, বাচ্চা চলে এলো রেইকোর পেটে। মোটেও খুশি হয়নি কাতসুয়া, তবে খবরটা শুনে ওদের দুজনের বাবা-মা’ই খুশি হলে সে ভাবে বিয়ে করে ফেলাটাই শ্রেয়।
বিবাহিত জীবন নিয়ে স্পষ্টতই কোন আপত্তি ছিল না রেইকোর যদিও বাচ্চা লালন-পালন একটু কঠিনই ছিল ওর জন্য, তবে এক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মা। যতটা পারে করেছে সে। তাদের বাসা কাছেই। ফলে সোতাকে সেখানে রেখে যখন ইচ্ছা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যেতে পারে রেইকো। টাকা-পয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা মোটেও পছন্দ নয় ওর। কাতসুয়ার বেতন বা জমানো টাকার ব্যাপারে কোনো ধারণাই রাখে না ও। নিজের যা মনে হয় কেনে ও, যা খেতে ইচ্ছে হয় খায়।
ওর ধারণাই নেই বাকিসব তরুণ দম্পতির থেকে কতটা বিলাসবহুল ভাবে জীবনযাপন করে ওরা। আর এই ব্যাপারে কখনোই কোনো অভিযোগ করেনি কাতসুয়া। ফলে ও ধরেই নিয়েছে সব ঠিকঠাক চলছে।
রেইকোর মনে হয়, ব্যাংকে জমানো টাকা শেষ হলেও সমস্যা নেই। কিছু হলে ইয়োসাকু তো আছেই। আবারও কাতসুয়া ক্রেডিট কার্ডের ধার শোধ করতে ব্যর্থ হলে তাকে বাঁচাবে ইয়োসাকু।
তিন
“হ্যালো, বলল কেউ একজন। মাথা উঁচু করল মাসায়ো। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ডিটেকটিভ কাগা
“ওহ, মিস্টার ডিটেকটিভ। আজকে আবার কি দরকার?” রিডিং গাস চোখ থেকে খুলে বলল মাসায়ো।
“কোনো দরকারে এসেছি বলব না ঠিক। বলা যায় আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এলাম।” ডেস্কের কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা সাদা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো কাগা। একটা সাদা বক্স রয়েছে এর ভেতরে। “তদন্তে সাহায্য করার জন্য আপনার উপহার। এতে ফ্রুট প্যাস্ট্রি ও অ্যালমন্ড জেলি আছে। আশা করি ভালো লাগবে আপনার।”
“ওহ, এসবের আবার কি দরকার ছিল,” ব্যাগটা নিয়ে বলল মাসায়ো।
তিনদিন আগে এসেছিল কাগা। এরমধ্যে কেসে কোনো অগ্রগতি ঘটেছে কিনা ভাবল ও। না পেরে শেষ অব্ধি জিজ্ঞাসাই করে বসল। মাথা নেড়ে সায় জানালো কাগা।
“আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার বদৌলতে একটা ব্লু পেয়েছি যা কেসটায় সহায়তা করেছে। সমাধান করতে আর বেশি সময় লাগবে না।”
“ভালো সংবাদ,” বলল মাসায়ো। একমুহূর্ত পর কাগার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো ও।
কোনো সমস্যা?” বলল কাগা।
“আমাকে ধন্যবাদ জানালেন আপনি। এর মানে আমাদের দোকানের লাটিম ওই খুনের একটা অংশ ছিল।”
“নাহ, ওরকম কিছু নয়,” ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল কাগা।
“তাহলে দয়া করে ঘটনাটা কি বলুন। ঝেড়ে কাশুন তো। আপনি এখানে ঘুরে যাওয়ার পর কোদেনমাচোতে হওয়া খুনটার ব্যাপারে পড়েছি। পত্রিকায় লেখা ছিল শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে মহিলাটাকে। তখনই বুঝলাম কে এখান থেকে লাটিম কিনেছে এটা জানতে কেন আগ্রহী আপনি।”
“ওহ, কেন বলে আপনার মনে হয়?” গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল কাগা।
“অবশ্যই লাটিমের দড়ির জন্য। লাটিমটা হয়ত এদিক-সেদিক পড়ে ছিল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে এর দড়ি, ঠিক না? দড়ি দিয়ে সহজেই তো শ্বাসরোধ করা যায়।” কাগার বুকে আঙুল স্পর্শ করে বলল মাসায়ো। তবে এই ধারণাটা মাসায়োর মাথাতে আসেনি। ওকে এটা বলেছে দোকানের অস্থায়ী কর্মচারী মিসাকি।
বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল কাগার চেহারায়।
“হায় ঈশ্বর, কিভাবে ধারণা করলেন?”
“এটুকু ধারণা করতে শার্লক হোমস হওয়া লাগে না। যেহেতু আমাদের এখানকার একটা লাটিম খুনের গুরুত্বপূর্ণ “
“আপনার ভুল হচ্ছে। বড় ভুল। আপনি লাটিমটা বিকি করেছিলেন বারো তারিখ, ঠিক না? কিন্তু খুনটা হয় দশ তারিখে। আমার মনে হয় না আপনার থিওরি সঠিক।”
অপ্রস্তুত বোধ করল মাসায়ো।
মিসাকিও একই কথাই বলেছে। দোকানের লাটিমের ওপর পুলিশ আগ্রহ দেখিয়েছে ঠিকই। কিন্তু খুনের সময় বিবেচনা করলে দেখা যায় এটা খুনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না।
“ফরেন্সিকের সাহায্যে আমরা জানতে পেরেছি ঠিক কি ধরনের দড়ি খুনের সময় ব্যবহার করা হয়েছে। বাজারে থাকা লাটিমগুলোর প্রত্যেকটার দড়ি ভিন্ন। দেখতে পেলাম এরকম অসংখ্য ধরনের দড়ি রয়েছে।”
মাসায়োর চোখে চোখ পড়ল কাগার। লজ্জিত হয়ে হাসল কাগা। “যাইহোক, লাটিমের দড়ির ব্যাপারে লেকচার দিতে আসিনি আমি। আমি এসেছি আপনার মতামত জানতে।”
“লাটিমের দড়িগুলো বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন বিনুনি করা, হাতে বোনা আরও আছে, দাঁড়ান,” কথা বলতে বলতে নিজের আঙুলে গোনা শুরু করল মাসায়ো ।
“আপনার বিক্রি করা লাটিমের দড়িগুলো বিনুনি করা, ঠিক না?”
“হ্যাঁ, অনেকগুলো ফাইবার একত্রে বিনুনি করে বানানো হয়। হাতে নয়, বরং মেশিনে করা হয় এটা। কিন্তু বানানোর ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকে এর কারিগর, লক্ষ রাখে রঙটা যেন লাটিমের সাথে মিলে যায়। যে কোন একটা দড়ি দিলেই হয়ে যায়, এমন নয় কিন্তু।”
“তা তো নিশ্চয়ই,” বলল কাগা। “যাইহোক, বিনুনি করা দড়ি দিয়ে খুনটা করা হয়নি।”
“হয়নি? ঠিক বুঝতে পারলাম না তাহলে কি করছেন আপনি। যদি এটা জেনেই থাকেন, তাহলে আমাদের দোকানের লাটিমের পিছে লাগলেন কেন? নাকি এখানে শেষবার যখন এসেছিলেন তখন জানতেন না কি ধরনের দড়ি দিয়ে খুনটা করা হয়েছিল?”
“নাহ, জানতাম দড়িটা বিনুনি করা নয়।”
“রহস্য তো আরও জট পাকাচ্ছেন আপনি। তাহলে কেন এসেছিলেন?”
কাগার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল মাসায়ো।
হেসে দোকানের চারিদিকে তাকাল কাগা
“মাত্র কয়েকদিন আগেই আমাকে এই এলাকায় বদলি করে পাঠানো হয়েছে। এখানে নতুন আমি। এই এলাকাটা চিনছি কেবল।”
“ওহ?” বিভ্রান্ত দেখাল মাসায়োকে।
“চারিদিকে ঘুরেফিরে যত দ্রুত পারি চেনার চেষ্টা করছি এই এলাকাটা। টোকিওর অনেক আধুনিক সংস্কৃতি এখানেও লক্ষ করেছি। টোকিওর সংস্কৃতি না বলে ‘জাপানিজ সংস্কৃতি’ বলাই ভালো। আমার মতে এই কারণেই দোকান খোলার জন্য এই এলাকাটা বেছে নিয়েছেন আপনি।
“ঠিক বলেছেন। এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই এই এলাকাটা পছন্দ করেছি।”
“সম্ভবত টোকিওর মধ্যে একমাত্র এই অঞ্চলেই কাঠের তৈরি লাটিম পাওয়া যায়। তবে শুধুমাত্র আপনার দোকানেই নয়। নিনগিয়োচো বুলভার্দের আরেকটা খেলনার দোকানেও এরকম লাটিম বিক্রি হয়।”
“ওই দোকানটা আমি চিনি। ওখানেও পাওয়া যায়। ‘
“ওদের ওখানে বিভিন্ন ধরনের লাটিম আছে, তবে ওগুলোর দড়ি ভিন্ন ধাঁচের। ওদের লাটিমগুলোর দড়ি পেঁচিয়ে বানানো।”
“পেঁচানো দড়ি। আসলেই?”
কল্পনায় অনেকগুলো সুতা পেঁচিয়ে বানানো দড়ি দেখতে পেল মাসায়ো।
“বলতে চাইছেন পেঁচানো দড়ি দিয়েই খুনটা করা হয়েছে?” কিছুই বলল না কাগা। হেসে কাঁধ ঝাঁকাল কেবল।
“লাটিমের দড়ি বানানো হয় লাটিম ঘুরাতে, মানুষকে খুন করতে নয়। যাইহোক, যেতে হবে আমাকে।”
উঠে দাঁড়িয়ে দোকানের বাইরে চলে গেল কাগা।
চার
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে শপিং ব্যাগগুলো সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলল রেইকো। সবার আগে একটা গাঢ় নীল বাক্স বের করে খুলল সেটা। বক্স থেকে টিস্যুতে মোড়ানো একটা নতুন হ্যান্ডব্যাগ বের করল ও। ব্যাগটা নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে এলো। দোকানের আয়নায় ব্যাগটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দীর্ঘসময় ধরে পোজ দিয়েছে ও। আরও ভালোমত দেখতে চাইছে ব্যাগটাতে কেমন মানিয়েছে। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও ঘুরে ফিরে বিভিন্ন পোজ দিতে থাকল রেইকো। কোন ভঙ্গিতে নিজেকে সেরা দেখায় আর কিভাবে অন্য নারীদের ঈর্ষার কারণ হওয়া যায় ভাবতে থাকল।
ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্ট না করা প্রসঙ্গে আর কিছু বলেনি কাতসুয়া। রেইকো ধরেই নিয়েছে সমস্যাটার সমাধান করে ফেলেছে সে। এটা ধরে নিয়েই খুশি মনে শপিংয়ে গিয়েছিল ও। একটা পোশাক, অনেকগুলো কসমেটিকস আর এই ব্যাগটা কিনেছে। ওর মনে হচ্ছে আরও কিছু কিনতে পারত, কিন্তু আপাতত এটুকুই ঠিক আছে।
ব্যাগটা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে লিভিংরুমে ফিরে এলো রেইকো। ড্রেসটা পরে দেখতে যাবে এমনসময় শুনতে পেল ডোরবেলের আওয়াজ। নিশ্চয়ই ডেলিভারি ম্যান এসেছে, ভাবল ও। ছয়টা বাজে কেবল। ওর বাবা মা সোতাকে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে। সাতটার সময় আবার ওখান থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
ইন্টারকম রিসিভারটা উঠিয়ে নিলো ও।
“কে?”
“এভাবে হুট করেই চলে আসার জন্য দুঃখিত। আমি ডিটেকটিভ কাগা। কয়েকদিন আগে এসেছিলাম।”
“চিনলাম না ঠিক।”
“ওইযে সেদিন আরেকজন ডিটেকটিভের সাথে এসেছিলাম। ডিটেকটিভ উয়েসুগির সাথে।”
“ওহ, হ্যাঁ।”
“কিছুক্ষণ সময় দিতে পারবেন? আপনাকে কিছু ব্যাপারে একটু জিজ্ঞাসা করতাম।
“এখন?”
“হ্যাঁ, তেমন বড় ব্যাপার নয়। বেশিক্ষণ লাগবে না। পাঁচ মিনিট সময় দিলেই হবে।”
বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেইকো। এই ডিটেকটিভকে চাইলেও বিদায় করে দেয়া যাবে না। ভাবল, কি ধরনের ঝামেলায় জড়িয়েছে ইয়োসাকু।
“আচ্ছা, ওপরে আসুন।
“কিনে আনা জিনিসগুলো আড়াল করার সময় বেজে উঠল অ্যাপার্টমেন্টের দরজার ডোরবেল।
দরজা খুলে দেখল একটা প্লাস্টিকের সাদা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে কাগা।
“নিনগো-ইয়াকি এনেছি। এর অর্ধেক সুইট বিন পেস্ট বাকিটা সাধারণ। যে পেস্ট্রিশপ থেকে এগুলো নিয়েছি ওদের বেশ সুনাম রয়েছে।”
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
রেইকোর বাবা-মা দুজনেই মিষ্টি পছন্দ করে। এই জাপানি কেক ওদের জন্য নিয়ে গেলে বেশ খুশি হবে।
কাগাকে লিভিংরুমে বসিয়ে কিচেনে
কিচেনে চলে গেল ও। রেফ্রিজারেটরে থেকে ওলং চা’র বোতল বের করে গাসে ঢালল।
“আপনার বাচ্চাটা কোথায়?” জিজ্ঞেস করল কাগা।
“আমার বাবা-মা’র সাথে চিড়িয়াখানায় গিয়েছে।”
“বাহ, ভালো।”
চা নিয়ে লিভিংরুমে ফিরে দেখল দাঁড়িয়ে আছে কাগা। তার পায়ের কাছে ঘুরছে লাটিম।
“বাহ, দারুণ তো,” বলল রেইকো। “আসলেই ভালো লাটিম ঘুরাতে পারেন আপনি।”
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসল কাগা। “অতটাও নয়।”
“আরে দেখুন না, কি নিখুঁতভাবে ঘুরছে। আমার স্বামী বা শ্বশুর কেউই এত ভালোভাবে ঘুরাতে পারে না। আমার স্বামী তো একেবারেই পারে না, ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে লাগে লাটিমটা।”
চায়ের ট্রে টেবিলে রাখার পর সাদা কিছু একটা চোখে পড়ল রেইকোর। জিনিসটা হল লাটিমের দড়ি। টেবিলের ওপর কেন এটা? এটা ছাড়া কিভাবে লাটিম ঘুরালো কাগা
নিচু হয়ে ঘুরতে থাকা লাটিমটা উঠিয়ে নিলো কাগা।
“বাইরে গিয়েছিলেন নাকি?” লাটিম টেবিলে রেখে, সোফায় বসার পর বলল সে। দড়িটা হাতে নেই তার
“হ্যাঁ, এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কাপড় বদলানোর সময়টাও পাইনি। কেবল ফিরেছি।”
“তাই? বন্ধুর সাথে দেখা করার পর শপিং করেছেন তাহলে?”
“হুহ?”
“দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে আসলেন দেখলাম।”
চায়ের গাস উঠিয়ে নিলো কাগা।
তাহলে হুট করেই ডিটেকটিভ এসে হাজির হয়নি। আশেপাশেই ঘুরঘুর করছিল সে, অপেক্ষায় ছিল ওর ফেরার। বলল, “তেমন বড় ব্যাপার নয়”। কিন্তু সে কি সত্যি বলছে? উদ্বিগ্ন লাগছে রেইকোর।
“কোথায় শপিং করতে গিয়েছিলেন?
“গিনজায়।”
“নিহনবাশিতে গিয়েছেন কখনো?”
“মাঝেমধ্যে যাই। মিতসুবিশি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা তো ওখানেই।”
“ট্যাক্সি করে ওখানে যেতে কতক্ষণ লাগে?”
“নিহনবাশিতে… এই… পনেরো মিনিটের মত।”
“বাহ, বেশ ভালো জায়গাতেই তো থাকেন আপনারা।”
যদিও ওদের অ্যাপার্টমেন্ট স্থানীয় সাবওয়ে স্টেশন থেকে দূরে, তবে গিনজা ও নিহনবাশিতে চাইলেই যেকোনো সময় যাওয়া যায়। এজন্যই থাকার জন্য এই এলাকাটা বেছে নিয়েছে রেইকো।
“ডিটেকটিভ, আজকে কি কাজে এসেছেন আপনি?”
চায়ের গাস রেখে সোফায় সোজা হয়ে বসল কাগা।
“জুনের দশ তারিখের ব্যাপারে একটু আলাপ করতে চাই। পুরো ব্যাপারটা আমাকে আরেকটু বলবেন?”
“পুরো ব্যাপারটা? আমার মনে হয় না আপনাকে যা বলেছি সেটার থেকে বেশি কিছু আর বলার মত আছে।”
আপনার শ্বশুর ইয়োসাকু কিশিদা সেদিন তার স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছিলেন। সেটা কি জরুরী কিছু ছিল?”
মাথা একদিকে বাঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেইকো। “প্রশ্নটা আমাকে করে মনে হয় না লাভ আছে। মৃত্যুবার্ষিকী এখনো দুই মাস পরে; তাই আমার স্বামী এটা নিয়ে এখনো অতটা মাথা ঘামাচ্ছে না। কিন্তু আমার শ্বশুর আবার একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
রেইকোর নিজেরও বেশি মাথাব্যথা নেই এই বিষয়ে।”
“তাহলে সেদিন উনারা এই বিষয়ে আলাপ করেছেন। এরপর?”
“বলব না আলাপ করেছে। বরং বলা চলে, এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা শুরু করেছে।”
“এটুকুই? মনে হচ্ছে না তার দেখা করতে আসার কারণ শুধুমাত্র এটাই ছিল।”
“আমারও মনে হয় না,” বিড়বিড় করল রেইকো।
ভ্রু কুঁচকে ডিটেকটিভের দিকে তাকাল ও।
“যাইহোক, আমাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন কেন? ওরা কি নিয়ে আলাপ করেছে সেটাতে কি কিছু যায় আসে? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“না, হয়নি।”
“তাহলে এখানে এসে কি নিয়ে খোঁজ করছেন আপনি? আমার শ্বশুর এসবের সাথে কিভাবে জড়িত? আমাকে বলুন, প্লিজ। না বললে আমি আপনার সামনে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করব না। আপনার সাথে কথা বলতে বাধ্য নই আমি।”
কড়া ভাবে কথাটা বলল রেইকো। এই ভাবটা ধরে রাখলে ওর জিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
চেহারায় বিরক্তির ছাপ পড়লো কাগার। কিন্তু মাথা নেড়ে সায় দিল অবশেষে।
“মনে হয় আপনার দাবি ঠিকই আছে। আমরা কি ধরনের অপরাধ তদন্ত করছি সেটার ব্যাপারে বলতে পারি শুধু।”
“কর্পোরেট হিসাব ব্যবস্থাপনার দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করছেন?”
“নাহ, খুনের তদন্ত করছি আমরা।”
“কি!”
ভ্রু কুঁচকাল রেইকো। এমন কিছু শোনার আশা করেনি ও।
“দশ জুন সন্ধ্যায় একটা খুন হয়। এখনও খুনিকে চিহ্নিত করতে পারিনি আমরা। এই কেসের সাথে জড়িত সকলের অ্যালিবাই খতিয়ে দেখছি। ইয়োসাকু কিশিদাও এদের মধ্যে একজন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সে জানায় সেদিন সন্ধ্যায় নাকি এখানে ছিল। এই ব্যাপারটাই নিশ্চিত করতে এসেছি আমি।”
কথাটা শুনে শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হল রেইকোর। বেড়ে গিয়েছে হৃৎস্পন্দন, যেন বুকের মধ্যে হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে কেউ। কয়েকবার লম্বা শ্বাস ফেলেও স্বাভাবিক হতে পারল না ও।
“এটাই কি আপনার আসার কারণ? আমার শ্বশুর এই বিষয়ে একটা কথাও…”
“সম্ভবত আপনাদের দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায়নি সে। একটা মার্ডার কেসের তদন্তে জড়িয়ে পড়েছে জানলে আপনারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন। না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।”
“ইয়ার্কি করছেন না তো? আমার বুক কিন্তু ধরফর করছে। ডিটেকটিভের দিকে তাকাল রেইকো
“আচ্ছা, ব্যাপারটা যদি এমন কিছুই হয়ে থাকে, তবে আমি আমার দিকটা পরিষ্কার করি। আমার শ্বশুর সেদিন রাত আটটা নাগাদ এসেছিল। ঠিক সাড়ে নটার পরপর সে চলে যায়। এরপর কি করেছে আমার জানা নেই…”
হাসল কাগা।
“মিস্টার কিশিদা আমাদের বলেছেন এখান থেকে যাওয়ার পর শিনবাশির এক বারে গিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত পান করেন তিনি। এই ব্যাপারেও আমরা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি।”
“শুনে ভালো লাগল। তাহলে তার অ্যালিবাই আছে।” হুট করেই সন্দেহের মেঘ জমা হল রেইকোর মনের মধ্যে। গম্ভীর হয়ে গেল ওর চেহারা। “কিন্তু টিভিতে অনেক ক্রাইম সিরিয়াল দেখেছি। কোনো ডিটেকটিভই তো পরিবারের সদস্যদের কথা বিশ্বাস করে না।”
“এটা বলব না যে পরিবারের লোকদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না,” হেসে বলল কাগা। “তবে সাক্ষ্য হিসেবে তাদের কথার ভার কম। পরিবারের লোকদের ক্ষেত্রে একে অপরকে আড়াল করার সম্ভাবনা থাকে।”
রেইকো বুঝল কেন এত বার ১০ই জুন সন্ধ্যার কথা জিজ্ঞেস করেছে কাগা। সে ভেবেছে মিথ্যা বলতে পারে ও। ওরা সবাই মিলে যদি একসাথে গল্প ফেঁদে থাকে, তবে ওইদিনের ব্যাপারে বারবার জিজ্ঞেস করলে মুখ ফসকে কোনো ভুল করার সম্ভাবনা থাকবে।
“বিশ্বাস করুন ডিটেকটিভ কাগা। ওইদিন রাতে সত্যিই আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিল আমার শ্বশুর। ঈশ্বরের দোহাই।”
আস্তে করে বলল রেইকো। প্রতিবেশীরা যদি জানে ওর শ্বশুর খুনের সন্দেহভাজন তাহলে কি ভাববে ওরা? সোতাকেও কি স্কুলে হেনস্তা করা হবে?
“ব্যাপারটার কোনো প্রমাণ দিলে সব থেকে ভালো হয়,” বলল কাগা।
“প্রমাণ?” দশ-ই জুন সন্ধ্যার স্মৃতি হাতড়াতে থাকল রেইকো। ইয়োসাকু সেদিন এখানে এসেছিল সেটা প্রমাণ করার কোনো না কোনো উপায় তো আছেই।
“আপনি বললেন মিস্টার কিশিদা এইটা বারো তারিখ কিনে এনেছিল?” বলল কাগা। লাটিমটা ধরে আছে সে। সবুজ আর হলুদ রঙয়ের বৃত্তাকার নকশা করা এতে। “ভাবছি কেন এটা দশ তারিখে নিয়ে আসেনি সে, যদি সেদিন-ই এসো থাকে।”
প্রশ্নটা যথেষ্ট যৌক্তিক। লাটিমটাকে প্রমাণ হিসেবে ধরে যদি ভেবে নেয়া হয় ইয়োসাকু দশ তারিখে এখানে আসেনি তবে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে। আতঙ্ক টের পেল রেইকো।
“নাহ, আপনি ঠিকই বলেছেন। এটা দশ তারিখেই সাথে করে নিয়ে এসেছিল সে।”
“দশ তারিখ? কিন্তু সেদিন তো বারো তারিখ বললেন।
মাথা ঝাঁকাল রেইকো।”
“নাহ, এটা দশ তারিখেই সাথে করে নিয়ে এসেছিল সে, তবে সেদিন দড়িটা আনতে ভুলে যায়।”
“দড়িটা আনতে ভুলে গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ, দড়িটা ফেলে রেখে এসেছিল। প্রথমে সে বলেনি সাথে করে লাটিম এনেছে। সোতা, মানে আমার ছেলে, দাদুর ব্রিফকেস খুলে লাটিমটা দেখতে পায়। তখন আমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করি ওটার কথা। জবাবে সে বলে একটা বন্ধু এটা তাকে দিয়েছে।”
“আর এটা সে নিয়ে এসেছে নাতিকে উপহার দেয়ার জন্য। তখনই সে বুঝতে পারে দড়িটা ফেলে এসেছে- ঠিক না?”
“হ্যাঁ, ঠিক। তার মনে হয়েছিল ওটা অফিস ডেস্কে ফেলে এসেছে। লাটিমটা সাথে করে নিয়ে যায় সে, বলে যায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দড়িসহ এটা এনে দেবে।”
“তো এরপর বারো তারিখে দড়ি সহ লাটিমটা নিয়ে আসে সে?”
“হ্যাঁ। নতুন খেলনাটার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিল সোতা। তাই আমার শ্বশুরকে দ্রুত আনতে বলি আমি। ‘
“আচ্ছা,” বলল কাগা। “বুঝতে পেরেছি।”
“ডিটেকটিভ কাগা, আমার কথা বিশ্বাস করতেই হবে আপনাকে। আমার শ্বশুর দশ তারিখ সন্ধ্যায় আমাদের এখানেই ছিল।”
মরিয়া দৃষ্টিতে ডিটেকটিভের দিকে তাকাল রেইকো। কেন ওর শ্বশুরকে কেউ সন্দেহ করবে জানা নেই ওর, তবে ওর শ্বশুরের নিখুঁত অ্যালিবাই আছে। আর এটাই নিশ্চিত করতে চাইছে ও।
ভদ্রভাবে হাসল কাগা।
“আমার বিশ্বাস আপনি সত্যিই বলছেন। আপনার কথা ভরসাযোগ্য। আপনাকে ধন্যবাদ, সবকিছু এখন ঠিকঠাক মিলে যাচ্ছে।”
“সত্যিই?” স্বস্তি পেয়েও উদ্বিগ্নতা ঢাকতে পারল না রেইকো ওর ঠিক কোন কথাটা “ভরসাযোগ্য”? কি “ঠিকঠাক মিলে যাচ্ছে”?
উঠে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্য ওকে ধন্যবাদ জানাল কাগা।
দরজার পাশে জুতোয় পা গলিয়ে পকেটে হাত ঢুকালো সে।
“এটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার ছেলেকে দেবেন। এটা পেলে খুশি হবে।”
কাগার হাতে একটা দড়ি। ওর শ্বশুরের দেয়া দড়িটার থেকে একটু চিকন। এই দড়িটা পেঁচিয়ে তৈরি করা।
“লাটিম ভালোভাবে ঘুরানোর জন্য ঠিকঠাক দড়ির দরকার হয়। এই দড়ি ব্যবহার করলে আরও ভালোভাবে ঘুরানো যায় লাটিম।”
দরজা দিয়ে বেরিয়ে হলওয়েতে গিয়ে রেইকোর দিকে ঘুরে দাঁড়াল কাগা।
“আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। খুনের সময় ও জায়গার ব্যাপারে আরকি। খুনটা হয়েছে নিহনবাশির কোদেনমাচোতে আর খুনের আনুমানিক সময়কাল ওইদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে।
“নিহনবাশিতে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে?” কথাটা আনমনেই পুনরাবৃত্তি করল রেইকো, এরপর কেঁপে উঠল। মানে ওর শ্বশুরের আটটার সময় এখানে থাকার সাক্ষ্যটা কোনো অ্যালিবাই-ই নয়।
তাহলে কিসের খোঁজ নিতে এসেছিল কাগা? তাকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে বিদায় নিয়ে হাঁটা ধরেছে সে।
পাঁচ
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কিচ্ছু টের পাওয়ার আগেই এরকম বৃষ্টি মানুষকে ভিজিয়ে দেয়। বর্ষাকালের আগমনী বার্তাও এই বৃষ্টি বাইরে বেরিয়ে শামিয়ানা টেনে দিলো তোরু সাগাওয়া। এরপর ডিসপ্লেতে থাকা জিনিসগুলোর তালিকা দোকানের সামনে রাখল। এই দোকানের জিনিসগুলোর বেশিরভাগ-ই হল পুরানো ধাঁচের খেলনা: বিল্ডিং ব্লক, কাপ-বল খেলার সরঞ্জাম, দারুমা পুতুল। দোকানটা সুতেনগু মন্দিরের কাছাকাছি হওয়ায় অনেক সদ্যজাত শিশুর বাবা-মা এখানে আসে। ফলে ওদের জন্য আকর্ষণীয় অনেক জিনিস বাইরে সাজিয়ে রাখে সাগাওয়া। আবার এলিমেন্টারি বা মিডল স্কুলের বাচ্চাদের জন্য আকর্ষণীয় জিনিসগুলো কখনোই বাইরে রাখে না সে চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে। একবার সুন্দর কিছু খেলনার সেট বাইরে সাজিয়ে রেখেছিল। সবথেকে সুন্দর খেলনাটা চুরি হয়ে যায় সেখান থেকে। সেটটা রয়ে যায় অসম্পূর্ণ অবস্থায়। স্মৃতিটা খুব একটা সুখকর নয়।
আকাশের অবস্থাটা দেখছিল সাগাওয়া। দেখতে পেল সাদা শার্ট পরা এক লোক এগিয়ে আসছে দোকানের দিকে। এই লোকের সাথে আগেও দেখা হয়েছে সাগাওয়ার। লোকটার নাম কাগা। একজন ডিটেকটিভ সে, সম্প্রতিই বদলি হয়ে এসেছে নিহনবাশি থানায়
“বৃষ্টি শুরু হয়েছে,” দুই হাত একত্র করে বলল কাগা ।
“যেকোনো দিন বর্ষাকাল শুরু হয়ে যাবে। আমাদের জন্য বেশ খারাপ মৌসুম। তবে এরপরই শুরু হবে ব্যবসার মৌসুম।”
বর্ষাকালে বাচ্চাদের রাস্তায় দেখা যায় না বললেই চলে। তবে স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটি দিলে বাচ্চারা ভিড় জমা করে সাগাওয়ার দোকানের সামনে। সেসময় আতশবাজি বিক্রি করে সে। বিশ বছর ধরে খেলনার ব্যবসা করছে সাগাওয়া। জানে কোন মৌসুমে কোন জিনিস ভালো বিক্রি হয়।
কাঠের তৈরি খেলনা নেড়েচেড়ে দেখছে কাগা। সবুজ ও হলুদ রঙের বৃত্তাকার নকশার লাটিম নজর কেড়েছে তার।
“যে দোকানটার কথা জানতে চাইছিলেন সেদিন, ঐযে লাটিম বিক্রি করে যারা, ওই দোকানটা কি খুঁজে পেয়েছেন?” জিজ্ঞেস করল সাগাওয়া।
হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো কাগা ।
“হ্যাঁ, পেয়েছি। আপনি ঠিকই বলেছিলেন। হোজুকিয়াতেও লাটিম বিক্রি হয়।”
“বলেছিলাম না? না? ওখানকার জিনিসগুলোর মান ভালো। মাঝেমধ্যেই গিয়ে দেখে আসি ওখানকার জিনিসপত্র।”
শেষবার এখানে এসে কাগা লাটিমের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তাকে। তার প্রথম প্রশ্নটা ছিল: সম্প্রতি সাগাওয়া কোনো লাটিম বিক্রি করেছে কিনা?
“বিক্রি? না করিনি। তবে হ্যাঁ, চুরি হয়েছে,” উত্তর দেয় সাগাওয়া। তখনই আগ্রহ জাগে ডিটেকটিভের। জানতে চায় কখন হয়েছে চুরিটা।
জুন মাসের দশ তারিখে। দোকানের প্রত্যেকটা জিনিসের প্রতিদিন হিসাব রাখে সাগাওয়া। একারনেই ধরতে পারে বাইরে থেকে লাটিম চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা।
একটা লাটিম কিনে তার সামনেই এর দড়িটা আলাদা করে ডিটেকটিভ। দড়িটা ভালোভাবে দেখে বিড়বিড় করে বলে এটা পেঁচানো দড়ি। খুব কম মানুষ-ই লাটিমের দড়ির ব্যাপারে জানে, ফলে অবাক হয় সাগাওয়া।
এরপর কাগা জানতে চায় আর কোনো দোকান কাঠের তৈরি লাটিম বিক্রি করে কিনা। দোকানদার হোজুকিয়ার কথা বলে। সাগাওয়ার কাছ থেকে জেনে সরাসরি ওখানেই যায় কাগা।
“আমাকে কোনো প্রশ্ন করলেন না যে?”
“কি প্রশ্ন?”
“আমার তদন্তের ব্যাপারে,” বলল কাগা। “জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে লোকে প্রথমে এই ব্যাপারেই জানতে চায়। ‘কি হয়েছে? কি তদন্ত করছেন?”
হাসে সাগাওয়া।
“আমার মত গরীবের এসব জেনে কি হবে? ডিটেকটিভ এলে বুঝে নিতে হবে খারাপ কিছুই ঘটেছে। বেশি জানতে গেলে খারাপ লাগবে।”
“অন্যরাও যদি আপনার মত হত,” বলল কাগা।
একটা লাটিম তুলে নেয় সাগাওয়া ।
“খেলনার দোকান হল স্বপ্ন বিক্রির জায়গা। আমাকে তাই সবসময়ই হাসিখুশি থাকতে হয়। নেতিবাচক কোন কিছু থেকে যতটা দূরে সম্ভব থাকার চেষ্টা করি। তবে একটা প্রশ্ন করতে চাই। এখান থেকে চুরি হওয়া লাটিমের সাথে আপনার কেসের কি সম্পর্ক? বিস্তারিত বলার দরকার নেই। শুধু বলুন আপনার কেসে এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে নাকি ফেলেনি? “একমুহূর্ত চুপ থেকে মাথা নাড়ল কাগা।
“ওই প্রসঙ্গে আর না যাই। ব্যাপারটা গোপনীয়।
“ঠিক আছে, অবাক হইনি। বাদ দিন, আপনার কেসের জন্য শুভকামনা।”
“দেখা হবে,” বৃষ্টিতেই হাঁটা ধরল ডিটেকটিভ।