অধ্যায় ৭ – ক্লিনিং কোম্পানির প্রধান

অধ্যায় ৭ – ক্লিনিং কোম্পানির প্রধান

এক

ঠোঁটে পাইপ নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে আছে কোকি কিয়োসি। কোলের ওপর মোটা একটা ফাইল। খানিক বাদে দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল।

“এসেছ নাকি, মার্শ?” নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল ও। “ভেতরে এসো।”

দরজা খুলে গেল, ভেতরে এলো ইকুও ইয়ামাদা। তার মাথায় একটা ধূসর পরচুলা

“আমাদের স্মৃতিকথার পঞ্চম খণ্ডটি শেষ করেছি, ওয়াইক।“ কণ্ঠে সমীহ টেনে বলার চেষ্টা করল ইয়ামাদা।

“অবশেষে শেষ হল তাহলে, হ্যাঁ? আমাদের হাতে এখন একেবারে প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে ‘দ্য ফুল রেকর্ড অফ দ্য মার্ডার অ্যাট দ্য এভিল প্রিন্স’স ম্যানশন’। এটার কথা ভালোমতোই মনে আছে আমার। বিশেষ করে এর রোমাঞ্চ ও উত্তেজনা। কিন্তু আফসোস হল ওই মাস্টারমাইন্ড ক্রিমিনালের সাথে দেখা করতে পারিনি। যে নিজেকে সত্যিকারের শিল্পী বলে দাবি করত আর…”

“থামো,” বলে উঠল কেউ একজন। কন্ঠটা শিনোজুকার, থিয়েটার কোম্পানির পরিচালক সে। চমকে গেছে কোকি।

“কি সমস্যা, কোকি? তোমার পারফরম্যান্স খুবই ম্যাড়মেড়ে লাগছে আজকে। এরকম সংলাপের জন্যে আরেকটু গাম্ভীর্যতা প্রয়োজন, তা বলে দিত্যে হবে নাকি? স্মৃতিকাতরতা ও বিষাদের যেন ছাপ থাকে, অনেকটা কেকের ওপর চেরির মত। আরও আবেগ দেয়ার চেষ্টা করো,” চেহারায় কাঠিন্য টেনে বলে শিনোজুকা।

“দুঃখিত। আরেকবার চেষ্টা করে দেখি।”

“নাহ, এখন একটা ছোট্ট বিরতি নিবো সবাই। অন্য একটা ব্যাপার একটু সামলাতে হবে আমাকে। ঠিক আছে তাহলে, বলল শিনোজুকা। “দশ মিনিটের বিরতি।”

ছোট্ট পারফরম্যান্স স্পেসের উত্তেজনা হঠাৎ করেই মিইয়ে গেল। কোকির মনে হল চরিত্র থেকে বাস্তব জীবনে ফিরে এসেছে সে। বিরতির নির্ধারিত দশ মিনিট পার হয়ে গেলেও রিহার্সেল শুরু হল না। পরিচালক ও প্রধান চরিত্র অফিসে বসে কথা বলছে। কথা বলছে বলা ভুল হবে, সম্ভবত একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাইছে ওরা। স্পষ্টতই পারফরম্যান্সে মনোযোগ দিতে পারছে না কোকি। তাকে বাদ দিতে চাইছে শিনোজুকা।

ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল কোকি। সে জানে ঠিকই বলছে পরিচালক।

“আমি দুঃখিত। আমি ভালো করার চেষ্টা করব। মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা থাকবে।”

“থামো, ক্ষমা চাইতে হবেনা তোমাকে। জানি কেন মনোযোগ দিতে কষ্ট হচ্ছে তোমার। তোমার মা খুন হয়েছে, আর খুনি এখনো ধরা পড়েনি।

“মাথা তুলে শিনোজুকার চোখের দিকে তাকাল কোকি।

“আমি যেভাবেই হোক মনোযোগ বাড়ানোর একটা উপায় খুঁজে বের করবই।”

ভ্রু কুঁচকালো শিনোজুকা।

“তুমি আমার কথাটা ধরতে পারছো না কোকি। চেষ্টা করলেই যদি আমরা কোন মনোযোগী হতে পারতাম, তাহলে জগতী দুঃখী কেউ থাকত না। জানি তুমি সেরাটাই দিচ্ছ; আর তোমার প্রতিভার প্রতি আমার যথাযথ সম্মান রয়েছে। কিন্তু তোমার বর্তমান মানসিক অবস্থায় অভিনয় চালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরিচালক হিসেবে এটাই আমার শেষ কথা।”

আবারও মাথা নিচু করল কোকি, তবে এবার ক্ষমা চাওয়ার জন্য নয়। হতাশায় নুয়ে পড়েছে সে।

“এমন কিছু কি করার আছে আমার যা করলে আপনার মত বদলাবে?”

“আপাতত নেই,” ভদ্রভাবেই বলল শিনোজুকু। “ভবিষ্যতে তোমার প্রতিভার প্রয়োজন পড়বে এই কোম্পানির। তবে এখন তোমাকে নেয়া সম্ভব নয়। যখন এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে আর অভিনয়টা জোর করে করতে হবে না, তখন তোমাকে আবার আমার নাটকে নিবো। অবশ্যই লিড রোলে।”

দাঁত চেপে শিনোজুকার দিকে তাকাল কোকি।

জবাবে উৎসাহ দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল পরিচালক।

“তোমার মায়ের হত্যা রহস্যের সমাধান হলেই ফিরে এসো।”

“ঠিক আছে,” পাল্টা জবাব দিলো কোকি।

******

তাকামাচি কনসাল্টিং ল অফিসের নেমপ্লেট দেখে কোকি ভাবল এখানে কত খরচ পড়তে পারে। তার মতে আইনজীবীরা হচ্ছে টাকার ওপর গড়াগড়ি করতে থাকা মোটাসোটা বিড়ালের মত।

অফিসটা তৃতীয় তলায়। কাঁচের স্লাইডিং দরজার পিছে বসে আছে একজন তরুণী রিসিপশনিস্ট। ভেতরে ঢুকে নিজের নাম বলল কোকি।

“মিস তাকামাচির সাথে চারটার সময় আমার দেখা করার কথা রয়েছে। আইনী বিষয়েয় কিছু নয়, তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব শুধু…”

“ঠিক আছে স্যার। বসুন আপনি।”

ফোনে কোকির আসার ব্যাপারটা জানাল রিসিপশনিস্ট। এরপর রিসিভার রেখে ওকে নিয়ে ছোট্ট করিডোর পেরিয়ে চলে এলো একটা মিটিংরুমে। এখানে অপেক্ষা করতে বলল ওকে।

ঘরটা ছোট। একটা টেবিল ও কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার রয়েছে ভেতরে। দরজার বিপরীত দিকে ঘুরে বসল কোকি, একটু নার্ভাস লাগছে ওর। শিনোজুকা ওকে বাদ দেয়ার পর কি করবে, সেটা নিয়ে ভেবেছে অনেকবার। মায়ের খুনটা চাপ ফেলছে ওর ওপর, তবে কেসটার এখনো সুরাহা হয়নি বলে নয়। মায়ের জন্য কখনো তেমন কিছু করেনি ও। কিন্তু এখন অপরাধবোধ হচ্ছে।

বাড়ি ছাড়ার পর অভিনয় নিয়ে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল কোকি যে বাবা-মা’র কথা সেভাবে কখনো ভাবেইনি। তাদের ডিভোর্সের ব্যাপারে জেনেও তেমন কিছু মনে হয়নি ওর! দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, হোক আলাদা, সমস্যা কোথায়? তাদের ছেলে বলেই যে ওকে তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে হবে, এমন নয়। সত্যি বলতে এসবে কিছুই যায় আসেনি কোকির।

কিন্তু মিনেকোর ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। ডিভোর্সের পর নিজ পায়ে দাঁড়াতে হত তাকে। নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ ও কাজের ব্যাপারে গুরুতর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। তবে কোকির ব্যাপারে ভাবত সে, কেননা তার নিজের পেটের সন্তান ও।

অচেনা অপরিচিত এক এলাকায় গিয়ে ওঠার কারণ ছিল মিনেকোর। কারণটা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জায়গাটা এক পেস্ট্রি শপের কাছে, ওই পেস্ট্রি শপে কাজ করে তার ছেলের প্রেমিকা। এক পর্যায়ে সে জানতে পারে তার ছেলের প্রেমিকা অন্তঃসত্ত্বা। ছেলের প্রেমিকার ওপর ভালো মনেই নজর রাখতে চেয়েছিল।

বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করেনি মিনেকো, ছেলের প্রেমিকার কাছে নিজের পরিচয়ও দেয়নি। সম্ভবত ভেবেছিল কোকি জানলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। অথবা ভেবেছে নাওহিরো ব্যাপারটা ভালোমত নেবে না।

“ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় কোদেনমাচোতে নিজের জীবন ভালোই উপভোগ করছিল আপনার মা। নীরবে কারোর ওপর নজর রেখে ভবিষ্যতের ব্যাপারে ভাবা তার জন্য হয়ত বড় কিছুই ছিল।“ এই কথাগুলোই বলেছিল ডিটেকটিভ কাগা। ব্যাপারটা তখন ঠিকমত বুঝতে পারেনি কোকি। এখন স্পষ্ট বুঝতে পেরে কষ্ট পাচ্ছে ও।

পেস্ট্রি শপটার ঠিকানা কোকিকে দিয়েছে কাগা। অ্যামি ওখানেই কাজ করে বলে ধারণা ছিল মিনেকোর। কিন্তু অ্যামি কাজ করত একটা ক্যাফেতে। অ্যামি ও কোকি দুজনেই ওই পেস্ট্রি শপে যায়, ওখানকার অন্তঃসত্ত্বা কর্মীকে দেখে আবেগে কেঁদে ফেলে ওরা। কোকির মায়ের সাথে কখনো দেখা না হলেও, আফসোস করে অ্যামি। “ইশ, উনার যদি ভুলটা না হত। বাস্তবেই যদি আমি হতাম। তাহলে কত সুন্দরই না হত ব্যাপারটা?”

মিনেকোর কথা ভাবলেই বুকের ভেতর কষ্টের চিনচিনে অনুভূতি হয় কোকির। অবশেষে বুঝতে পেরেছে মায়ের ভালোবাসা কতটা অমূল্য। অথচ বোকার মত অবলীলায় সেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ও। যা ঘটেছে এর জন্য নিজেকেও দায়ী মনে হয় ওর। যদি মায়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত, তাহলে হয়ত তাকে এভাবে খুন হতে হতো না।

শিনোজুকা ঠিকই বলেছে : এখন কোনোভাবেই অভিনয়ে মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয় কোকির পক্ষে। সম্ভবত অন্য কিছু করতে পারে ও, মায়ের ব্যাপারে খোঁজ নিতে পারে।

সমস্যাটা হল কোথায় থেকে শুরু করবে জানা নেই ওর। মায়ের কোদেনমাচোর অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে পুলিশের তত্ত্বাবধায়নে। ফলে ছেলে বা যে-ই হোক সেখানে গিয়ে মিনেকোর নতুন জীবনের ব্যাপারে ধারণা নেয়ার কোনো সুযোগই নেই।

অনেক ভাবার পর মাথায় আসে ডিটেকটিভ কাগা ওকে বলেছিল ডিভোর্সের সময় একজন আইনজীবী নিয়োগ করে ওর মা। আর ওই আইনজীবী মহিলার সাথে ভালোই যোগাযোগ ছিল মিনেকোর। হয়তোবা তার নতুন জীবন সম্পর্কে কিছু জানাতে পারবে ওই আইনজীবী।

সমস্যা দেখা দিলো আইনজীবীকে খুঁজে বের করতে গিয়ে একটা উপায় জানা ছিল কোকির; বাবার সাথে যোগাযোগ করা। যা করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না ওর। কিন্তু নাওহিরো, মানে ওর বাবাকে ফোন করেই শেষপর্যন্ত আইনজীবীর ঠিকানা সংগ্রহ করে।

“তোমার এত জানার কি দরকার?” বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে নাওহিরো। “এই ফালতু আইনজীবীর সাথে তোমার কি কাজ?”

“তোমার জেনে কাজ নেই। যা শুনতে চাইছি সেটা বলো।”

“আমি বলবো না। তুমি খামোখা নাক গলিয়ে তদন্তে ভজকট পাকালে বড় সমস্যা দেখা দেবে।”

“এমন কিছু হবে না। আমি শুধু মায়ের ব্যাপারে আরও কিছু জানতে চাই।”

“ঠিক এটাকেই নাক গলানো বলেছি আমি। তোমার মায়ের ঠিকুচি-গোষ্ঠী ঠিকই খুঁজে বের করবে পুলিশ। ততদিন পর্যন্ত চুপচাপ বসে অপেক্ষা করো। তোমার কোনো যোগ্যতাই নেই এসবের, ফলে খামোখা নাক গলিও না।”

“তুমি ঠিক বুঝছ না। আমি কেসটা সমাধান করতে চাইছি না। আমি কেবল মায়ের ব্যাপারে জানতে চাইছি।”

“কি জানতে চাও?”

“যেকোনো কিছুই। মনে হচ্ছে মায়ের ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না আমি। আমি নিশ্চিত, তুমিও জানো না কিছু, জানো? বলতে পারবে খুন হওয়ার আগে কি চলছিল তার মনে? বলতে পারবে কেন আমার কাছাকাছি অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া নেয় সে? পারবে না, কারণ তুমি জানো না।”

নীরবতা নেমে আসে ফোনের অপর প্রান্তে ।

“তুমি বলছো তুমি জানো?” জিজ্ঞেস করে নাওহিরো ।

“হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু এর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। এসবের সাথে নূন্যতম লেনাদেনাও নেই তোমার, বুঝতে পারছ কি বলছি? বলতে পারো একজন নির্বোধ মহিলা ছিল মা। তোমার কিছু না জানাই ভালো বাবা। কিন্তু আমি…আমি তোমার মত নয়। মায়ের ব্যাপারে সবকিছু জানতে চাই আমি। তবে কথা দিচ্ছি তোমাকে কোনো ঝামেলায় ফেলব না।”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে কোকি। আবারও নেমে আসে নীরবতা। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শোনা যায় দীর্ঘশ্বাস। অবশেষে নাওহিরো বলে, “এক মিনিট অপেক্ষা করো।”

আইনজীবীর নাম ও ঠিকানা ওকে দেয় নাওহিরো। আইনজীবীর নাম শিজুকু তাকামাচি।

“এখন এই কথাটা তোমাকে বলে কোনো লাভ নেই যদিও,” বলে নাওহিরো। “তবে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই আমাদের ডিভোর্সটা হয়েছে। মিনেকোই জোর দিয়েছে এর জন্য। বলেছিল ‘নতুনভাবে জীবন’ শুরু করতে চায়। তাকে স্বার্থপর মনে হয়েছিল আমার, তবুও রাজি হয়ে যাই। ওই আইনজীবী সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। তবে সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি আমাদের মধ্যে।”

“তাহলে আমাকে জানাতে চাইছিলে না কেন? ওই আইনজীবী ও তো একই কথাই বলবে- যদি তোমার কথা সত্যি হয় তো।”

“একেকজনের দৃষ্টিকোণ একেক রকম। আইনজীবী নিশ্চয়ই বলবে কত ভালো মধ্যস্থতা করেছে সে। কিন্তু সত্যিটা হল, কোনো আইনজীবী দরকার-ই ছিল না আসলে। কোনো বিবাদ ছিল না আমাদের মধ্যে। তোমাকে শুধু এটুকুই বলতে চাই।”

“এই ‘মধ্যস্থতা’ বা ‘বিবাদ’ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এসব নিয়ে একবিন্দুও মাথা ঘামাইনা আমি।”

আইনজীবীর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানার পর বাবাকে আর কিছু বলার ছিল না কোকির। ফোন রেখে দেয় ও।

******

শিজুকু তাকামাচির বয়স চল্লিশের মত। চেহারার ভাবভঙ্গি আন্তরিক। কোকির মনে হল ওর মায়ের মত ক্লায়েন্টদের কাছে এই মহিলা বেশ ভরসার।

উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে দেখা করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাল কোকি। শিজুকু তাকামাচি ইশারায় বসতে বলল ওকে।

“আপনার প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে। জানি কঠিন সময় পার করছেন।”

“অনেক,” বলল কোকি।

“আমিও চমকে গিয়েছি। সম্ভবত জানেন, আমার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করতে এসেছিল আপনার মা। একবিন্দুও বুঝতে পারিনি সামনে তার বিপদ। দেখে মনে হত স্বাধীনভাবে ভালোই আছে সে।”

“কেন খুন হয়েছে এই ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণাই নেই তাহলে?”

“নাহ, এই কেসে সহায়তা করার মত ওরকম কিছু আমার মাথায় আসছে না।”

“প্রথম কবে আমার মা’র সাথে দেখা হয় আপনার?’ “আপনার মা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিলে। তার একজন বন্ধু আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর আমার অ্যাপয়েনমেন্ট নেয় মিস মিতসুই।”

“কিন্তু ডিভোর্সের পরেও আপনাদের যোগাযোগ ছিল। আপনারা কি বন্ধু ছিলেন?”

ভ্রু কুঁচকালো আইনজীবী। মহিলা বেশ আন্তরিক হলেও শব্দচয়নে খুবই সতর্ক।

“বন্ধু। সহজে ব্যাখ্যা করতে চাইলে বলা যায়, হ্যাঁ। মিস মিতসুই ইমেইল করত আমাকে। সময় পেলে আমি জবাব দিতাম। এমনটাই ছিল আমাদের সম্পর্ক। নতুন ডিভোর্স হওয়া মহিলাদের জন্য জীবনটা বেশ কঠিন। ফলে তার পাশে ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম কথা বলার মত কাউকে প্রয়োজন তার। অনেকটা ফলো আপের মত। যদি আইনগত বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম তাহলে মোটেও বিনামূল্যে করতাম না।”

“কেবলই বললেন তার খুনের কেসে সাহায্য করার মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাথায় নেই আপনার। টুকটাক কোন কিছু কি মাথায় আসছে যা খুনের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে হয়?”

ম্লান হাসি ফুটে উঠল শিজুকু তাকামাচির ঠোঁটে।

“আপনার মা ও আমি দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা। টুকটাক কোন ব্যাপার নিয়ে আলাপ হত না আমাদের।”

“তাহলে ইমেইলে কি নিয়ে আলাপ করতেন?”

“আপনি তার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যাপারে আপনাকে বলতে পারব না। কোনো বিষয় গোপন রাখা ক্লায়েন্টদের প্রতি আইনজীবীদের কর্তব্য। আর যতদূর মনে হয় আপনার মৃত মা এখনো আমার ক্লায়েন্ট।”

ভদ্রভাবেই বলল আইনজীবী মহিলাটা। তবে তার সততা ও নিজ দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা মুগ্ধ করল কোকিকে। নিশ্চয়ই কোর্টে মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলতে ওস্তাদ এই মহিলা, ভাবল ও।

অপ্রত্যাশিতভাবে হেসে উঠলো ভদ্রমহিলা।

“যেমনটা বললাম, আপনার মাকে হাসিখুশিই মনে হত আমার কাছে। তার ইমেইল পড়ে এমনটাই ভেবেছি। নিজের ভবিষ্যতের কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করছিল সে। তবে মনে হয় না ওসবের সাথে খুনের কোনো সম্পর্ক আছে।”

আবারও নিজের বুকের ভেতর আবেগের উত্তাপ অনুভব করল কোকি। ওর মায়ের এই হাসিখুশি থাকার উৎস ছিল তার প্রথম অনাগত নাতি/নাতনি। তবে এই আইনজীবীর মতে তারা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ছোটখাটো ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। তাহলে কি ব্যাপারে তার সাথে আলাপ করত মিনেকো? কোকি বুঝল এই তথ্য এই আইনজীবীর কাছ থেকে বের করা যাবে না। ভাবল কি করা যায়।

ঠিক তখনই মনের আয়নায় ভেসে উঠল একটা চেহারা। নিশ্চয়ই লোকটা জানবে, ভাবল ও।

“আপনি ঠিক আছেন তো?” বলল আইনজীবী।

“ঠিক আছি। সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনি নিশ্চয়ই অনেক ব্যস্ত,” উঠে দাঁড়িয়ে বলল কোকি।

দুই

বেজে উঠল টেবিলের ইন্টারকম। একটা ডকুমেন্ট পড়ছিল নাওহিরো, রিসিভার উঠিয়ে নিলো সে।

“হ্যাঁ?”

“মিস্টার কিশিদা এসেছেন,” কর্কশ কণ্ঠে বলল ইউরি। তার বলার ধরন দেখে মনে বল সবকিছু ঠিকই আছে।

“পাঠিয়ে দাও,” বলল নাওহিরো ।

দরজা খুলে গেলে দেখা গেল ইয়োসাকু কিশিদাকে। লোকটা এতই পাতলা গড়নের, তাকে দেখে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো স্যুট বলে মনে হয়।

“নম্বরগুলো খতিয়ে দেখেছো?” মিটিংরুমের আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে বলল নাওহিরো।

“হ্যাঁ, দেখেছি। ওগুলো খুব একটা ভালো নয়।”

“নাওহিরোর সামনের চেয়ারে বসে ব্রিফকেস থেকে একটা ফাইল বের করে টেবিলে রাখে সে।

“সমস্যাটা কি? মজুরির পরিমাণ এসব?”

“এইযে এইটা এইমুহূর্তে আমাদের একাত্তর জন খণ্ডকালীন কর্মী রয়েছে। টানেলের শেষপ্রান্তে আলোর রেখা দেখতে চাইলে সংখ্যাটা পঞ্চাশে নামিয়ে আনতে হবে।”

“বিশ জনকে ছাঁটাই করতে বলছো? পাগলের প্রলাপ যত্তসব। ব্যবসা লাটে উঠবে এটা করলে।”

“তাহলে কমপক্ষে দশজনকে করুন।”

দরজা খোলার সাথে সাথে গুঙিয়ে উঠল নাওহিরো।

এক্সকিউজ মি,” অফিসে ঢুকে বলল ইউরি। তার হাতের ট্রেতে রয়েছে চায়ের দুটো কাপ। একটা নাওহিরো, আরেকটা কিশিদার সামনে রাখল সে। ইউরির গড়ন বেশ লম্বাটে, তার হাত, পা, আঙুল সবই লম্বা। পরনের স্কার্টের ইতি ঘটেছে হাঁটুর ঠিক ওপরেই। কনিষ্ঠায় হাতে বানানো রূপালী আংটি। জিনিসটা তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে নাওহিরো। ঠিক তার গলার হীরা বসানো নেকলেসটার মতোই।

কাজ শেষে বাউ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইউরি। সে থাকাকালীন একটা কথাও বলেনি কিশিদা ও নাওহিরো।

“সত্যিই দশজনকে ছাঁটাই করা জরুরী?” জিজ্ঞেস করল নাওহিরো। “কাজটা করতে ভালো লাগবে না আমার।”

“সম্প্রতি কয়েকটা কোম্পানি নতুন গ্র্যাজুয়েটদের চাকরীর সুযোগ দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। দুনিয়াটা এভাবেই চলছে। কিচ্ছু করার নেই আমাদের। দশজন খণ্ডকালীন ও অস্থায়ী কর্মীদের বিদায় করতেই হবে। যেহেতু করতেই হবে তাহলে আরও একজনকে বিদায় করে সংখ্যাটা এগারো করে ফেলুন নাহয়? চা বানানোর জন্য তো স্থায়ী কর্মী রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।”

কাপের ঢাকনা সরিয়ে গ্রীন টি’তে চুমুক দিলো কিশিদা।

“আবারও ঘুরে ফিরে ওই একই কথা,” ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল নাওহিরো।

“কতদিন আগে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন?”

“ছাব্বিশ বছর আগে।”

“আসলে সাতাশ। এই ক্লিনিং সার্ভিস কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সময় আপনার বয়স ছিল ত্রিশ। কখনোই আশা করিনি এই কোম্পানি এতদূর যাবে। আর ভাবিনি আপনার সাথে কাজ করে হাতখরচের চেয়ে বেশি কিছু আয় করতে পারব। তখন কেবল একজন ট্যাক্স অ্যাকাউন্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছি। আমার কোনো ক্লায়েন্ট ছিল না বলেই আপনার হিসাব নিকাশের দায়িত্বটা নিই।”

“হ্যাঁ, তুমি ভাবতে এই কোম্পানি কখনোই সফল হবে না। এই কথাটা বলতে কখনোই ক্লান্তিবোধ করোনি।”

“নিজের দিকে চায়ের কাপ টেনে নিলো নাওহিরো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নাওহিরোর এক বছরের ছোট ছিল কিশিদা। নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর কিশিদার কাছে সাহায্য চায় নাওহিরো। কোম্পানির আর্থিক বিষয়গুলো তখন থেকেই সামলায় কিশিদা। চোখের পলকেই যেন কেটে গিয়েছে সাতাশ বছর।

“ব্যবসায়ী হিসেবে আপনার দক্ষতাকে আমি সম্মান করি। আপনার ব্যবসায় নাক না গলানোর চেষ্টাই করি আমি। কিন্তু ওই মেয়েটার ব্যাপারে কথা বলতেই হবে।”

“আবার?”

“হ্যাঁ, শেষবারের মত। আপনি ওই মেয়েকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে বাদ দেয়া কঠিন হলে, তাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করুন। তাকে আপনার সেক্রেটারি হিসেবে রাখাটা দৃষ্টিকটু।”

“এখানে দৃষ্টিকটুর কি আছে?”

চায়ে চুমুক দিলো কিশিদা।

“গতকাল অফিসে আমার সাথে একজন ডিটেকটিভ দেখা করতে এসেছিল। অনেকগুলো প্রশ্ন করেছে আমাকে। তবে তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আপনার সেক্রেটারি। কয়েকবার জানতে চেয়েছে, মিস্টার কিয়োসির সাথে ওই মেয়ের সম্পর্কের ধরনটা কেমন? কিভাবে তাদের পরিচয়? প্রশ্নগুলোর ঠিকমত উত্তর দিতে পারিনি আমি। নার্ভাস লাগছিল আমার।”

“নার্ভাস লাগার কিছু নেই। যা জানো লোকটাকে সেটাই বলবে।”

“কি? আমার কি লাগত একসময় সে তোমার পছন্দের নাইটক্লাবে হোস্টেস ছিলো?” “

“এতে সমস্যাটা কোথায়?”

“আমি এটা বলতে পারতাম না। শুধু বলেছি কিছুই জানি না তার ব্যাপারে। আর কি-ই বা বলতে পারতাম?”

“মনে হচ্ছে না খুব একটা বড় সমস্যা এটা,” ঘোঁতঘোঁত করল নাওহিরো।

“সমালোচনা করছি না ঠিক। তবে প্রেমিকাকে কাজের জায়গায় নিয়ে আসা উচিত হয়নি আপনার। আপনি কিন্তু এখন অবিবাহিত। মেয়েটাকে পছন্দ হয়ে থাকলে বিয়ে করে ফেলুন। কেউ কিছু বলবে না।”

কিশিদার চেহারার দিকে তাকাল নাওহিরো।

আমার স্ত্রীর খুনের ঠিক পরপরই আমাকে আরেকটা বিয়ে করার পরামর্শ দিচ্ছ তুমি? ব্যাপারটা কেমন দেখাবে বলে তোমার মনে হয়?”

“আচ্ছা বিয়ের কথা বাদ দিন। মেয়েটার সাথে লিভ-ইন করলে কেমন হয়?”

“পাগল হয়েছ নাকি? এটা আরও বাজে দেখাবে। দেখো, আমার ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানো বন্ধ কর। আমার ব্যক্তিগত জীবন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়নি।”

“আপনার জীবন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিচ্ছি না আমি। কেবলমাত্র সাবধান করছি…”

“টেবিলে থাকা ফাইলটা উঠিয়ে নিলো নাওহিরো। “এগুলোতে ভালোভাবে চোখ বুলাবো। কি করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তোমার সাথে যোগাযোগ করব।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশিদা। মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।

“আপনার কর্মচারীরাও এসব পছন্দ করছে না। হুট করেই এরকম একজন মেয়েকে নিয়ে আসলে ওদের এরকম ভ্রু কুচকানো স্বাভাবিক।”

“ওরা যা খুশি তাই মনে করুক। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। অফিসের বসকে নিয়ে মজা লুটতে সব হারামজাদাই পছন্দ করে।”

“সম্ভবত আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।”

কিশিদা বেরিয়ে যাওয়ার কয়েকমুহূর্ত পর দরজায় নক হল। এরপর দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকলো ইউরি। বিহ্বল দেখাচ্ছে তাকে।

“দরজায় কান পেতে ছিলে নাকি?” জিজ্ঞেস করল নাওহিরো। “না পেতে পারিনি। মনে হয় তোমার অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছি আমি।”

“দুশ্চিন্তা কোরো না। কোম্পানিটা আমারই।”

“হ্যাঁ, কিন্তু… গতকাল বাড়ি ফেরার পথে এক ডিটেকটিভ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। লোকটার নাম কাগা।”

ভ্রু কুচকাল নাওহিরো।

“জানি কার কথা বলছ। লোকটা স্থানীয় থানার। পুলিশ মিনেকোর অ্যাপার্টমেন্ট তদারকি করার সময় তার সাথেই দেখা হয়েছিল আমার। তোমার সাথে তার কি কাজ?”

“জানি না। অসংখ্য প্রশ্ন করেছে আমাকে, যেগুলোর সাথে খুনের কোনো সম্পর্ক-ই নেই।”

“যেমন?”

যেমন, ‘আপনি বেশ লম্বা। কোনো খেলাধুলা করেন নাকি?’ আর ‘কি ধরনের জিনিসপত্র আপনার পছন্দ?”

“জিনিসপত্র?”

“আমার আঙুলের রিংটা লক্ষ করে সে। বলে জিনিসটা একটু অন্যরকম,” হাত উঁচু করল ইউরি। “আমার কাছ থেকে নিয়ে এটা দেখতে চায় সে।”

“দেখিয়েছ?”

“না দেখানোর কোনো কারণ খুঁজে পাইনি।“

“ভালো হয়নি ব্যাপারটা,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাওহিরো।

“কি-ই বা করতে পারতাম?”

“কিছুই করার দরকার নেই তোমার,” বলল নাওহিরো। “দুশ্চিন্তারও কিছু নেই। এই ডিটেকটিভ আমাদের কিছুই করতে পারবে না।”

তিন

একটা পুরানো ধাঁচের কফিশপে দেখা করবে বলে ঠিক করেছে ওরা। কফি শপের দেয়ালটা ইটের আর জানালাগুলো কাঠের। লাল রঙের সাইনে গাঢ় করে লেখা “স্থাপিত ১৯১৯”। ভেতরটা সাধারণ কাঠের টেবিল-চেয়ার দিয়ে সাজানো

জায়গাটার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পূর্ণ। এদের মধ্যে কয়েকজন কর্মজীবী আর বেশিরভাগ-ই স্থানীয় লোকজন। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে ওরা। কোকি শুনেছিল স্থানীয় কফিশপগুলোর অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু এই জায়গাটা দেখে ওরকমটা মনে হচ্ছে না।

“দেখেছেন, সামনে সাইন ঝুলিয়ে এই জায়গাটার নাম কিভাবে লেখা হয়েছে?” কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল কাগা “চিত্রলিপিতে দেখানো হয়েছে চা, অবকাশ ও প্রস্থানের চিহ্ন। বরাবরের মতোই ডিটেকটিভের পরনে সাধারণ পোশাক। টিশার্টের ওপর একটা সাদা শার্ট।

“আমিও ভেবেছি এটা নিয়ে। এর মানে কি?”

“জেন বৌদ্ধ মতবাদ অনুযায়ী একটা শব্দগুচ্ছ বোঝায় এটা দ্বারা। এর মানে ‘এক কাপ চা পান করুন’।”

“সত্যিই?”

“যদিও আসল অর্থটা একটু ভিন্ন। আসল অর্থ হল ‘সবকিছু পেছনে ফেলে এক কাপ চা পান করে সামনে এগোও।’ কিন্তু একসময় গিয়ে এই অর্থটা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। এখন ব্যবহৃত হয় মানুষকে স্বাগত জানাতে।”

“বাহ, আপনি দেখছি এই এলাকার ব্যাপারে ভালোমত জানেন।“

হাসল কাগা।

“মাত্র কয়েকদিন হল এখানে বদলি হয়ে এসেছি। সেই হিসেবে বললে এখনও নবাগত একজন। এখানকার একজন স্থানীয় বাসিন্দার কাছ থেকে শুনেছি। এলাকাটা দারুণ কিন্তু। যেকোনো রাস্তা ধরে হাটলেই মজার কিছু না কিছু চোখে পড়ে। যেমন এখানকার জনপ্রিয় ইয়াকিতরি গ্রিল্ড চিকেন রেস্তোরাঁর বিখ্যাত খাবার হচ্ছে রোলড অমলেট। আপনার মা প্রায় প্রতিদিনই সুতেনগু মন্দিরে যেতেন। আমি নিশ্চিত হেঁটে ওখানে যাওয়াটা উপভোগই করতেন তিনি।”

বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলে ধীরেসুস্থে তার মায়ের খুনের প্রসঙ্গে এগোচ্ছে কাগা। এটা নিয়েই মূলত আলাপ করতে বসেছে ওরা। ডিটেকটিভের কথা বলার ধরনে মুগ্ধ কোকি।

“আমার সাথে কি ব্যাপারে কথা বলতে চাইছেন আসলে?” জিজ্ঞেস করল কাগা।

আইস কফিতে চুমুক দিলো কোকি। এরপর জানাল, ইমেইলে আইনজীবীর সাথে ওর মায়ের কি নিয়ে আলাপ হত সেটা জানতে আগ্রহী ও। বলল, শিজুকু তাকামাচি খুবই সামান্য তথ্যই দিয়েছে।

কাপের দিকে তাকিয়ে নীরবে শুনে গেল কাগা। কোকির বলা শেষ হলে, মাথা তুলে কয়েকবার চোখ পিটপিট করল।

“ব্যাপারটা দুঃখজনক। তবে আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি চলমান কোনো তদন্তের তথ্য জানানোর মত মানুষ? এমনটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“আমি সেটা জানতেও চাইনি। আমি আমার মায়ের সাম্প্রতিক জীবন সম্পর্কে জানতে মরিয়া। আপনার দ্বারস্থ হওয়া ব্যতীত অন্য কোনো পথ নেই। আমাদের আগেও দেখা হয়েছে। তাই ভাবলাম আপনার কাছে এই ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে…ক্ষমা চাইছি আমি।” নিজের উরুর ওপর হাত রাখল কোকি। ঘেমে গিয়েছে ওর হাতের তালু।

কফির কাপ নামিয়ে রাখল কাগা। হাসছে সে।

“আপনার সাথে একটু মজা করছিলাম আরকি। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সবকিছু খুলে বলতে পারব না হয়তো, তবে কিছু তথ্য আদান-প্রদান করলে তদন্ত সামনে এগিয়ে নিতে সুবিধা হয়।”

অবাক হয়ে ডিটেকটিভের দিকে তাকাল কোকি।

সামনে হেলে দুটো কনুই রাখল টেবিলের ওপর।

“যা জানতে চেয়েছেন সেটা বলার আগে আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনার বাবা-মা ডিভোর্স কেন নিয়েছিল বলে মনে হয়? রাখঢাক করবেন না।”

সামান্য পিছে হেলে গেল কোকি।

“তাদের ডিভোর্সের কারণ? অন্য ডিটেকটিভও এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। আমার ধারণা মতের অমিল-ই এর মূল কারণ।”

“এই ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কি? এটা এড়ানো কি অসম্ভব ছিল?”

“খবরটা পেয়ে অতটা অবাক হইনি। বাবার মতে, আমার মা ছিল স্বার্থপর ও লোভী। অপরদিকে বাবা আমাদের দুজনের কোনো খেয়ালই রাখত না। ফলে তার প্রতি মায়ের ভালোবাসা শেষ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।”

“আচ্ছা।”

“এসবের সাথে কেসের কি সম্পর্ক?”

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল কাগা। “ডিভোর্সের সময় আপনার বাবার সাথে মায়ের কি সমঝোতা হয়েছিল জানা আছে আপনার?” জিজ্ঞেস করল কাগা।

আবারও চেয়ারে হেলে গেল কোকি।

“ধারণা নেই।”

“ওহ, আসলেই?”

“আমি কি…”

“আপনার মা,” বলল কাগা। “আপনার বাবার কাছ থেকে সম্প্রতি নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ অর্থ চান। সমঝোতার অর্থটা আগেই পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার মনে হয়েছিল ওই টাকাটা যথেষ্ট নয়। আমার মনে হয়েছে এর পেছনে সম্ভাব্য দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, অনুবাদের কাজটার ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না। কারণ যার মারফত তিনি এই কাজটা পান, সে বিদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দ্বিতীয় কারণটা সম্ভবত ধারণা করতে পারছেন: মিস মিতসুইর মনে হয়েছিল শীঘ্রই তিনি দাদী হতে চলেছেন। তরুণ দম্পতিকে সাহায্য করা ছাড়া আর কি-ই বা উদ্দেশ্য থাকতে পার?”

বাতি জ্বলে উঠল কোকির মাথায়।

“ওহ, বুঝতে পারছি। নিজের আইনজীবীর সাথে টাকা-পয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপ করত মা।”

নিজের কাপের দিকে হাত বাড়াল কাগা।

“এই ব্যাপারটা আমি আসলে শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলতে ও পারবো না আবার বাতিলও করতে পারব না। স্পষ্টতই, অপর পক্ষ, মানে নাওহিরো কিয়োসির সাথে আবারও দর কষাকষি করতে চাইছিলেন মিস মিতসুই। টাকা ভাগাভাগির ব্যাপারে।”

“বেশ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ,” বলল কোকি। “আমার বাবার ভুল থাকতে পারে কিন্তু ডিভোর্স তো মা-ই চেয়েছিল। আর সমঝোতাও হয়ে গিয়েছিল।“

“ব্যাপারটা সহজভাবে নিন,” বলল কাগা। “যেমনটা বললাম, মিস মিতসুই’র জীবনে কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটেছিল। হুট করেই আবারও দর কষাকষি করতে চাননি তিনি। তার বিশ্বাস ছিল, এই কাজটা করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।”

“যৌক্তিক ভিত্তি?”

“বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ না থাকার আরও নতুন কোনো কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। তার মনে হয়েছিল, দায়টা যদি অপর পক্ষের কাঁধে চাপানো যায় তবে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন।”

ডিটেকটিভের কিছুটা জটিল কথাবার্তা বিভ্রান্ত করছে কোকিকে। তবে কয়েকবার ভাবার পর ও বুঝতে পারল কি বলতে চাইছে কাগা।

“আপনি বলতে চাইছেন আমার বাবার পরকীয়া সম্পর্ক আছে?”

“আপনার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে আপনি জানতেন না।“

মাথা নাড়ল কোকি।

“কিভাবে জানবো? তার সাথে দীর্ঘদিন দেখা হয়নি। তার ব্যাপারে এরকম কিছু জানা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

“আগে অবস্থা কেমন ছিল? আপনার বাবা কি অন্য নারীদের দিকে নজর দিত? এই বিষয়ে কি আপনার বাবা-মার মধ্যে ঝামেলা হয়েছে?”

“না, যতদূর জানি। বাবা আমাদেরকে সময় দিতে পারত না কাজের চাপের জন্য। কিন্তু প্লেবয় ধরণের মানুষও নয় সে। পরকীয়ার কথা কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছে।”

মাথা নেড়ে সায় জানালো কাগা। এরপর একটু ইতস্তত করে পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করল। কয়েকটা বাটন চেপে কোকির দিকে এগিয়ে দিলো যাতে ও স্ক্রিনটা দেখতে পারে।

“নিয়ম ভাঙছি আমি। কাউকে বলবেন না আপনাকে এটা দেখিয়েছি।”

স্যুট পরিহিত এক তরুণীর ছবি দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ছবি তোলার ব্যাপারে অবগত নয় তরুণী।

“চুরি করে ছবিটা তুলেছেন?” জিজ্ঞেস করল কোকি।

“আপনাকে বললাম না এটা নিয়ম বহির্ভূত, বলিনি?” শক্ত হয়ে গেল কাগার অভিব্যক্তি। “এই মেয়েকে আগে দেখেছেন?”

“মেয়েটা অনেক সুন্দর। নাহ, তাকে আগে কখনো দেখিনি।”

“ভালোভাবে দেখুন। আপনি নিশ্চিত তাকে চিনতে পারছেন না?”

আরেকবার দেখল কোকি। সম্ভবত ঠিকই বলছে কাগা। আবছাভাবে মনে হচ্ছে এই মেয়েকে আগে কোথাও দেখেছে ও। তবে সেটাকে বাস্তবতার চেয়ে কল্পনা বলেই বেশি মনে হচ্ছে। কাগাকে সেকথাই জানাল।

“ঠিক বলছেন তো?” সেলফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল কাগা।

নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার চেষ্টা করল কোকি।

কে এই মেয়ে?” জিজ্ঞেস করল ও।

একটু ইতস্তত করল কাগা, এরপর বলল, “বর্তমানে নাওহিরো কিয়োসির খুব কাছের কেউ। তবে ভুল কোনো ধারণা মনে নেবেন না। এখনই নিশ্চিত করে বলছি না ওদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে।”

“কিন্তু আপনার সন্দেহ তো সেটাই, ডিটেকটিভ কাগা। আপনার মতে, আমার বাবার রক্ষিতা সে।”

“রক্ষিতা শব্দটা আসলে এক্ষেত্রে ভুল। মিস্টার কিয়োসি একজন সিঙ্গেল পুরুষ এখন। অন্তত ডিভোর্সের পর যেভাবে ইচ্ছা, যার সাথে ইচ্ছা থাকতে পারে সে, সাবেক স্ত্রীর ক্ষতিপূরণের দাবী সত্ত্বেও।”

কোকি বুঝল কোনদিকে ইঙ্গিত করছে কাগা।

“আচ্ছা, তাহলে ডিভোর্সের আগে থেকেই এই মেয়ের সাথে চলাফেরা করছে বাবা। তাহলে তো মা ক্ষতিপূরণ দাবী করতেই পারে।”

“আপনি বেশ বুদ্ধিমান,” হেসে বলল কাগা।

“আপনি যদি মনে করতেন খুনের সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই তবে আপনি এই মহিলার ছবি এভাবে তুলতেন না, ঠিক বলেছি?” একটা আইডিয়া এলো কোকির মাথায়। “আপনার মতে এই মেয়ে ডিভোর্সের আগে থেকেই আমার বাবার প্রেমিকা, আর মা’কে বাবাই খুন করেছে এসব জানাজানি যাতে না হয়, সেজন্য?”

কোকির দিকে তাকাল কাগা।

“আপনার কল্পনাশক্তি দুর্দান্ত, বলতেই হবে।“

“ঠাট্টা করছেন”

বাকি কফিটুকু গিলে আবারও গম্ভীর হল কাগা।

“আমরা সবধরনের সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে চাই। আমাদের দলের একটা অংশ এই সম্ভাবনাটাও খতিয়ে দেখছে।”

“কিন্তু আপনার কি ধারণা, ডিটেকটিভ কাগা? আবার বাবাকে আপনি সন্দেহ করছেন?”

“আমি? ইয়ে…আসলে জানি না। তাছাড়া আমার ধারণায় কিছু যায় আসে না। আমার মত ছোট্ট একটা থানার ডিটেকটিভের কাজ হল মেট্রোপলিটন ডিপার্টমেন্টের ডিটেকটিভদের সহায়তা করা।” ঘড়ির দিকে তাকায় কাগা। “দেরী হয়ে যাচ্ছে। আরেকটু বসতে পারলে ভালো লাগত। তবে আরেকটা জায়গায় যেতে হবে, দুঃখিত।”

বিলটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে।

“বিলটা আমার দেয়া উচিত,” বিলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল কোকি।

“এখনো আপনার সময় আসেনি,” বিলটা ছিনিয়ে নিয়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল কাগা।

চার

বিল্ডিংয়ের লবি থেকে নাওহিরোকে বের হতে দেখে মাথা নিচু করল কোকি। রাস্তার ধারের ফাস্ট ফুড জয়েন্টের দিকে খুব একটা নজর নেই নাওহিরোর। ওই জায়গাতেই বসে আছে কোকি। একটা ক্যাবে করে এখানে এসেছে ও, যদিও ট্রেন ধরে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।

কয়েক মিনিট পরেই একই বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো সাদা টপস পরিহিত এক তরুণী। এই মেয়েটার জন্যই অপেক্ষা করছিল কোকি। লাফিয়ে উঠতে গিয়ে, টেবিলের পায়ার সাথে আঘাত লাগল পায়ে।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে দ্রুত পিছু নিলো মেয়েটার। মনে হচ্ছে সাবওয়ের দিকে এগোচ্ছে সে। ভাগ্য ভালো মেয়েটা একা, ভাবল কোকি।

ছোটবেলা থেকেই বাবার একজন কর্মচারীকে চেনে ও। ওই লোককে গতরাতে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওর বাবা আজকাল কি করছে। খুবই সুচতুরভাবে উত্তর দিয়েছে লোকটি। শেষমেশ মেজাজ হারিয়ে লোকটাকে সরাসরি প্রশ্নটা করে বসে কোকি। জানতে চায় ওর বাবার রক্ষিতার ব্যাপারটা সত্যি কিনা।

“ব্যাপারটা সত্যি নয়, শুধুই গুজব। মেয়েটা কমবয়সী ও সুন্দর এজন্য সবাই তাকে তোমার বাবার রক্ষিতা বলে মজা করছে। এতটা গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।”

লোকটাকে এত সহজে ছাড় দিতে চায়নি কোকি।

“যা চলছে সেটা সরাসরি বলুন। গুজব নাকি অন্যকিছু সেটা আমি ভেবে দেখব,” বলে ও।

তথ্যগুলোর উৎস কোনোমতেই ফাঁস করা যাবে না এই শর্তে লোকটা কোকিকে জানায় মেয়েটার নাম ইউরি মিয়ামোতো। গত এপ্রিল থেকে নাওহিরোর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করছে সে।

কাগার দেখানো ছবির মেয়েটা নিশ্চিতভাবেই ইউরি মিয়ামোতো। এই ব্যাপারে কোকি নিশ্চিত। এখন নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছে ও, সুন্দর বেশভূষার, লম্বা এক মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এত দ্রুত পা ফেলছে যে প্রায় দৌড়াতেই হচ্ছে কোকিকে।

তার পিছে চলে আসার পর একটু ধাতস্থ হয়ে ডাক দিল, “মিস মিয়ামোতো?”

থেমে ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা, তার এক হাতে ব্যাগের স্ট্র্যাপ ধরা। কোকিকে দেখে চোখ বড় হয়ে গিয়েছে তার।

হালকা বাউ করল কোকি।

“আপনাকে এভাবে চমকে দেয়ার জন্য দুঃখিত। আমি নাওহিরো কিয়োসির ছেলে। আমার নাম কোকি।”

“কয়েকবার চোখ পিটপিট করে সে বলল, “তো?”

“আপনার সাথে কথা বলা জরুরি। দশ মিনিটের মত সময় নিবো। অসুবিধে হবে?”

আশেপাশে তাকানো দেখেই বোঝা গেল ইউরির অস্থিরতা। অচেনা মানুষ পথরোধ করলে বিচলিত লাগাটাই স্বাভাবিক। তার স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় রইল কোকি।

বেশিক্ষণ লাগল না।

“ঠিক আছে। চলুন তাহলে,” সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল মেয়েটা।

******

“মিস্টার কিয়োসি,” আমাজাকি গলিটা পার হওয়ার সময় পেছন থেকে একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেল নাওহিরো। পিছে ঘুরে দেখতে পেল তার দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে ডিটেকটিভ কাগা।

“আপনার কথাই ভাবছিলাম। হয়তো আপনার সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা কাকতলীয় নয়?”

মাথা উঁচু করে নিরস ভঙ্গিতে হাসল কাগা। “সম্প্রতি আপনার প্রায়ই নিহনবাশিতে যাওয়া নিয়ে টাস্কফোর্সে আলোচনা হচ্ছে।”

“আমার ওপরে নজরদারি করছেন নাকি?”

“নাটক না করি। সবার ওপরই নজর রাখা তদন্তের জন্য জরুরি।”

শ্রাগ করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল নাওহিরো।

“তাহলে এখন আমার কাছ থেকে কি চান?”

“আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। প্রথমটা হল, এইভাবে নিহনবাশিতে আসছেন কেন আপনি?”

“প্রশ্নটার উত্তর দিতেই হবে?”

“না উত্তর দেয়ার পিছে কি কোনো কারণ আছে?” হেসে পাল্টা জবাব দিলো কাগা।

ঘোঁতঘোঁত করে নাওহিরো বলল, “হেঁটে কথা বলতে কোনো আপত্তি নেই তো?”

“এমনটাই চাই আমি। হাঁটার জন্য এই এলাকাটা বেশ ভালো।“

পাশাপাশি হাঁটতে থাকল দুজন। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে, ঠাণ্ডা পড়েছে হালকা। কাছেই কোথাও থেকে ভেসে আসছে ঘণ্টির আওয়াজ।

একটা স্যামিসেন শপের জানালার কাছে থেমে গেল নাওহিরো।

“আমার ছেলের মতে মিনেকোর এই এলাকায় এসে ওঠার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিল। আমি জানতে চাই কারণটা কি। এজন্যই মাঝেমধ্যে এখানে আসছি আমি। মনে হয়েছে, এখানে এসে ঘুরে বেড়ালে কারণটা সম্পর্কে জানতে পারব আমি। যদিও আমার ছেলে বলেছে এসব নিয়ে আমার মাথা না ঘামালেও চলবে।”

শপের জানালার কাঁচে দেখা যাচ্ছে নাওহিরোর চেহারার প্রতিচ্ছবি। শোকে বিকৃত হয়ে গেল তার চেহারা ।

“মিস্টার কিয়োসে, কেন স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে রাজি হলেন আপনি?”

“ছটফট করে উঠল নাওহিরো, যেন বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে।”

“এটা নিয়ে কি আলাপ করা জরুরী?”

ইউরি মিয়ামোতোর সাথে তো এর কোনো সম্পর্ক নেই, ঠিক না? তার কারণে তো ডিভোর্স নেননি। ঠিক বলেছি না?”

“কি বলতে চাইছেন?”

“এখন, দেরি হয়ে যাওয়ার পর, আপনি উপলব্ধি করেছেন কতটা ভালোবাসেন আপনি মিনেকো মিতসুই… মানে আপনার স্ত্রীকে। এজন্যই আপনি এই এলাকায় এসে যেভাবে পারেন তার ব্যাপারে জানার চেষ্টা করছেন। ঠিক বলছি না?“

ধীরে মাথা ঝাঁকাল নাওহিরো।

“মিনেকোর প্রতি আমার অনুভূতি কখনোই বদলায়নি। ফলে কিছু ‘উপলব্ধি’ করার মত নেই। যাইহোক, ডিভোর্সটা ভালোই হয়েছে, আমাদের দুজনের জন্যই। আমার মনে হয়, আমি জানতে চাই এই নিহনবাশিতেই কি এমন খুঁজে মিনেকো যেটার জন্যই ডিভোর্স নেয় ও।”

একমুহূর্ত ভেবে পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করল কাগা।

“আজ রাতের জন্য আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে, মিস্টার কিয়োসে?”

“আজ রাতে? নাহ।”

“তাহলে চলুন একসাথে বসে কিছু খাওয়া যাক। আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে আলাপ করা যাবে।”

******

ইউরি মিয়ামোতোকে নিয়ে একটা ক্যাফেতে গিয়ে কোণার এক টেবিলে বসল কোকি, যাতে ওদের কথা কেউ না শুনতে পায়।

“সরাসরি কাজের কথাতেই আসি,” কণ্ঠ নামিয়ে বলল ও। “আমার বাবার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”

“আমি তার সেক্রেটারি,” নিজের কফির দিকে তাকিয়ে আছে ইউরি।

“আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমার কথা,” সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এল কোকি। “আমি জানতে চাইছি তার সাথে আপনার কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা।”

চোখ তুলে তাকাল ইউরি মিয়ামোতো।

“বিষয়টা ব্যক্তিগত। আমি আপনাকে জানাতে বাধ্য নই।”

তার কাছ থেকে প্রতি আক্রমণের আশা করেনি কোকি। হালকাভাবে নিয়ে ফেলেছিল। ভেবেছে যা জানতে চাইবে সরাসরি বলে দেবে।

“আমি তার সন্তান। একজন নারীর সাথে তার কি সম্পর্ক সেটা জানার অধিকার সম্ভবত আমার আছে।”

“আপনার এমনটাই মনে হয়ে থাকলে তাকেই গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন।”

“সে আমাকে সত্যটা বলবে না। এজন্যই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।”

“তাহলে তো তো আপনার সাথে আমার কথা বলাই উচিত না। আমি নিশ্চিত এই ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট কিয়োসির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আমারটাও হয়ত একইরকম হবে।”

টেবিলের নিচে পা নাড়াচ্ছে কোকি। উদ্বিগ্ন লাগলে এমনটা করে ও। ওর সামনে একেবারে নিস্পৃহ হয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে ইউরি মিয়ামোতো। তারা চেহারায় কোনো ভাবাবেগ নেই।

মেয়েটার আসলেই দেখার মতৃ কথাটা ভাবতেই বিরক্ত হয়ে উঠল ও। চেহারায় গাম্ভীর্য থাকলেও মেয়েটার বয়স কমই। কোনোভাবেই আমার থেকে দশ বছরের বেশি হবে না তার বয়স, মনে হল কোকির।

“আমার বাবা একজন সন্দেহভাজন। পুলিশের মতে আমার মাকে খুন করেছে সে। আপনি যদি তার রক্ষিতা হয়ে থাকেন আর ডিভোর্সের পেছনে যদি আপনার একটু হলেও অবদান থাকে তবে বাবার থেকে ক্ষতিপূরণ দাবী করার অধিকার আমার মায়ের ছিল। পুলিশ মনে করছে এই ক্ষতিপূরণ যাতে না দিতে হয় সেজন্যই মাকে খুন করেছে সে।”

বড় হয়ে গেল ইউরি মিয়ামোতোর চোখ।

“ব্যাপারটা অদ্ভূত। কিভাবে নিজের বাবাকে সন্দেহ করতে পারেন?”

“পুলিশ তাকে সন্দেহ করছে, আমি নই।“

“জোরে মাথা নাড়ল সে।”

“আপনার মাথায় কি চলছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বাবার ওপর ভরসা থাকলে কখনোই অন্যের কথা দ্বারা প্রভাবিত হতেন না।”

ওকে কি ভালোমন্দ জ্ঞান দিচ্ছে? ভাবতেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো কোকির।

“এরকম পরিস্থিতিতে তাকে খুব বেশি ভরসা করা যায় না।”

“শীতল দৃষ্টি হানল ইউরি মিয়ামোতো।”

“বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন আমাকে?”

“করতে পারলে ভালোই লাগত।“

“আমার কথাতে কার কি যায় আসে? আপনি কি সিরিয়াস? সত্যিই নিজের বাবাকে ভরসা করেন না?”

“না, করিনা। বড় কথা, করতে পারি না। নিজের পরিবারের কখনো খেয়াল রাখেনি সে। এমনকি স্ত্রী ডিভোর্স চাওয়ায় পরও ছিল নির্বিকার। আর ডিভোর্সের পরপরই আপনার মত মেয়ের সাথে মেলামেশা শুরু করেছে। কিভাবে তাকে ভরসা করতে পারি? আমার মায়ের শেষকৃত্যেও আসেনি সে।”

সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিজমনেই বিড়বিড় করল ইউরি মিয়ামোতো।

“কি হলো আপনার?”

ওকে পাত্তা না দিয়ে বিড়বিড় করতেই থাকল সে। মনযোগ দিয়ে শুনে বুঝতে পারল কি বলছে মেয়েটা, “আমি আর নিতে পারছি না। আমি আর নিতে পারছি না “

“কিছু একটা বলতে চলেছিল কোকি তখনই পিছে হেলে গেল মেয়েটার মাথা। শীতল হয়ে এলো দৃষ্টি।

“আপনাকে একটা কথা বলা দরকার, কোকি।”

“হুহ?”

“আমার কথাটা বলা উচিত নয়, কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না। সত্যিটা বলছি আপনাকে।”

“সত্যি? কিসের সত্যি?”

“চুপচাপ শুনুন,” সাহস জোগাড় করতে পুরো ল্যাটে কফি এক চুমুকে গিলে ফেলল ইউরি মিয়ামোতো।

পাঁচ

নাওহিরোকে মাতসুয়া রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল কাগা। পুরানো জাপানি ধাঁচের রেঁস্তোরা হলেও ভেতরে ঢুকে পাশ্চাত্য ঘরনার আসবাব দেখে অবাক হল নাওহিরো। তবে জায়গাটা নিয়ে তার আগ্রহ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পুরোপুরি কাগার দিকে মনোযোগ দিল সে। মিনেকোর কোদেনমাচোতে গিয়ে থাকার কারণ তাকে জানাল কাগা। বললো কিভাবে মিনেকো নিজের ছেলের অবস্থান জানতে পারার পর খোঁজ পায় তার প্রেমিকা অন্তঃসত্ত্বা। এরপর সিদ্ধান্ত নেয় ওদের কাছাকাছি থাকার। তবে মিনেকো জানত না তার ধারণা ভুল ছিল। কোকি ঠিকই বলেছিল, ভাবে নাওহিরো, এসবের সাথে তার আসলেও কোনো সম্পর্ক নেই। মিনেকো খুন না হলে পুরো ব্যাপারটাকে একটা নগন্য হাস্যকর ঘটনা ছাড়া আর কিছুই বলে মনে হত না। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভিন্ন; কাগার বলা কথাগুলো শুনে বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠল তার।

“তো আপনার কি মনে হয়?” বিয়ার উঠিয়ে নিয়ে বলল কাগা।

নাওহিরোও বিয়ার অর্ডার করেছিল। কিন্তু কাগার মত সে-ও এখনো এক বিয়ারের গাসে হাত দেয়নি।

“পুরো ব্যাপারটাই বিশাল চমক। কখনোই ধারণা করতে পারিনি কেন ওই এলাকায় গিয়ে উঠল সে,” বলল নাওহিরো।

“আইনজীবীর মতে মিস মিতসুই ডিভোর্সের সময় আপনার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। তার বিশ্বাস ছিল, আপনার বিষয়ে খোঁজখবর নিলে কিছু না কিছু বেরিয়ে আসবেই। কিন্তু শেষমেশ শান্তিপূর্ণ সমঝোতাই বেছে নেয় সে। নিজের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। তবে পরে গিয়ে আপনার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবী করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে। আর মনে হয় এর পিছে শক্ত কারণও ছিল তার।”

“আমাদের ছেলে বাবা হতে চলেছে বলে? যদিও ওর ধারণাটা ভুল।” বিয়ারে চুমুক দিলো নাওহিরো। “তবে আমাকে কখনোই অবিশ্বাস করেনি সে।”

“শুনেছি আপনার ফার্মে ইউরি মিয়ামোতো নামের এক কর্মীর উপস্থিতি নিয়ে বেশ মুখরোচক কথাবার্তা হচ্ছে ইদানিং। এই গুজবটা আপনার স্ত্রীর কানেও গিয়ে থাকতে পারে। হয়ত এই ব্যাপারটা বিবেচনা করেই ক্ষতিপূরণ দাবী করার কথা ভেবেছিল সে।”

মাথা ঝাঁকিয়ে নাকচ করে দিলো নাওহিরো। “ হাস্যকর কথাবার্তা।”

“আপনার সেটা মনে হতেই পারে। কিন্তু ডিভোর্সের পরপরই এক অচেনা যুবতীকে নিজের প্রাইভেট অফিসে নিয়োগ দিলে লোকে তো ভাববেই কিছু না কিছু চলছে আপনাদের মধ্যে। আর আপনাদের দুজনের মধ্যে তো সম্পর্ক ছিলোও, ঠিক না? আমার প্রশ্নটা হল, ঠিক কি ধরনের সম্পর্ক ছিল আপনাদের মধ্যে? একজন পুরুষ ও একজন অচেনা মহিলার মধ্যে সম্পর্ক বলতে লোকে একটা সম্পর্ককেই বোঝে… কেউই একে রক্তের সম্পর্ক বলে মনে করবে না।”

কঠিন দৃষ্টিতে কাগার দিকে তাকাল নাওহিরো। নিহনবাশি ডিটেকটিভের ভাব দেখে মনে হচ্ছে না এইমাত্র বেফাঁস একটা কথা বলে ফেলেছে, নির্বিকার ভঙ্গিতেই খাবার মুখে পুড়ছে সে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাওহিরো।

“কেন আমি অবাক হইনি? যখন শুনলাম আপনি ইউরির সাথে কথা বলেছেন তখনই বুঝতে পেরেছি আপনি জেনে গিয়েছেন ইউরিকে ওর হাতের রিংয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন, ঠিক না?”

“তার বা হাতের কনিষ্ঠায় থাকা রিংটা হাতে বানানো। কোনো সমালোচনা করার ইচ্ছা নেই, তবে দেখেই মনে হয় জিনিসটা কোনো পেশাদারের হাতে তৈরি নয়। যখনই দেখলাম তার বেশভূষার সাথে জিনিসটা ঠিক যায় না, তখনই মনে হল এটা হয়তো তাকে বিশেষ কেউ উপহার দিয়েছে। এই একই ধরনের রিং আমি আগেও দেখেছি- রিংটা পঞ্চাশ ইয়েনের কয়েন থেকে বানানো।”

আঙুল দিয়ে ভ্রূ’র কোনা চুলকে নির্বোধের মত হাসল নাওহিরো।

“বিশ বছর আগে এই ধরনের রিং বেশ জনপ্রিয়তা পায়। যাদের দামী রিং কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারা এই ধরনের রিং বানিয়ে প্রিয়জনকে উপহার দিত। আজকাল কেউ এসব বানায় না, কনিষ্ঠার জন্য তো নয়ই।”

“আমি ওই রিংটা ওর মাকে উপহার দিয়েছিলাম।”

“এরকমই কিছুই ধারণা করেছিলাম। তার মা নিশ্চয়ই পাতলা গড়নের, যার হাত ও আঙুলগুলোও কাঠির মত। রিং ফিঙ্গারে পরার জন্য ঠিক সাইজের ছিল ওই আংটিটা।”

“আমার বয়স তখন ছিল কেবল বিশ বছর, একটা পয়সাও ছিল না আমার কাছে,” এক ঢোক বিয়ার গিলে বলল নাওহিরো।

সেসময় মানুষ প্রাইভেট রুম ভাড়া না নিয়ে বারে গিয়ে ক্যারাওকেতে গান গাইত, বলতে থাকল নাওহিরো। কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর চাকরী না পেয়ে একটা ক্যারাওকে বারে কাজ নেয় সে। খুব সামান্যই পেত ওখান থেকে আর বয়সও ছিল কম। টাকা জমানোর কথা মাথায় আসেনি তখনও।

তোকিকো নামের একটা মেয়েও কাজ করত ওই বারে। ম্যানেজার ছিল মেয়েটা, বয়সে নাওহিরোর থেকে পাঁচ বছরের বড়। ডিভোর্সি ছিল সে।

একরাতে বেশি মদ গিলে ফেলে তোকিকো। তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায় নাওহিরো। এরপর থেকেই সব শুরু। ভালোবাসায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে নাওহিরো, ভাবে মেয়েটারও একই দশা।

তোকিকোর জন্মদিনে, বার বন্ধ হওয়ার পর তাকে একটা উপহার দেয় সে। পঞ্চাশ ইয়েনের কয়েন কেটে বানানো রিং। এই রিং দিয়েই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আবেগাক্রান্ত হয়ে কেঁদে ফেলে নাওহিরো। বারবার ধন্যবাদ জানাতে থাকে তাকে। কথা দেয় সারাজীবন রিংটা নিজের কাছে রাখার। তবে বিয়ের প্রস্তাবের কোনো জবাব সেই রাতে নাওহিরোকে দেয়নি সে।

“কালকে তিনদিনের জন্য বাবার বাসায় যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরেই তোমাকে উত্তরটা জানাবো। তোমাকেও কিছু একটা দিতে চাই আমি।” হেসে বলে তোকিকো, যদিও তার চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত।

পরবর্তী তিনদিন কাজে আসে না তোকিকো। কিন্তু চতুর্থদিনেও দেখা মেলে না তার। বারটেন্ডার নাওহিরোকে জানায় চাকরী ছেড়ে দিয়েছে তোকিকো।

ছুটে তোকিকোর অ্যাপার্টমেন্টে চলে যায় নাওহিরো। জায়গাটা একেবারেই ফাঁকা দেখতে পায়। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সে। কয়েকদিন পর একটা চিঠি পায়। কোনো ঠিকানা ছিল না চিঠিতে।

চিঠিতে লেখা ছিল বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে আনন্দিত হলেও, সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে তোকিকো। নাওহিরোর মত একজন তরুণের জীবনে বোঝা হয়ে থাকা তার কাছে ঠিক বলে মনে হয়নি। জীবন কেবল শুরু নাওহিরোর। তার বাবা-মা তাকে কলেজে পড়িয়েছে, নিশ্চিতভাবেই তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করে তারা। সে যেন অবশ্যই জীবনে ভালো কিছু করে।

চিঠিটা পড়ে নাওহিরোর মনে হচ্ছিল তার মাথার ওপর কেউ এক বালতি ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। হঠাৎ-ই মনে হয় বাবা-মা’র ওপর কতটা নির্ভরশীল ছিল সে, বুঝতেই পারেনি জীবনের কঠোর বাস্তবতা সম্পর্কে। তোকিকোর চিঠিটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হলেও, বোঝাই যায় নাওহিরোর অপরিপক্কতার ব্যাপারে অবগত সে

ওইদিন থেকেই নিজেকে বদলে ফেলে নাওহিরো। বারের চাকরী ছেড়ে একটা সেবাদানকারী কোম্পানিতে যোগ দেয় সে। সিদ্ধান্তটি তার নিজের জন্যে কল্যাণকর হিসেবেই প্রমাণিত হয়। ওখান থেকে যে জ্ঞান সে লাভ করে, সেটা পরবর্তীতে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে তার ক্লিনিং কোম্পানি চালুর সময়।

“কয়েক বছর আগে এক গিনজা হোস্টেস ক্লাবে ইউরির সাথে দেখা হয় আমার। সে দেখতে একেবারে তোকিকোর মত। ব্যাপারটা দেখে নিঃসন্দেহে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আরও বেশি অবাক হই ওই রিংটা তার কাছে দেখে।”

“তার সাথে আপনার দেখা হওয়ার সময় তার আঙুলে ওই রিংটা ছিল?”

মাথা নেড়ে সায় জানালো নাওহিরো।

“রিংটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি তাকে। রিংটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে জেনে চমকে উঠি আমি। তিনবছর আগে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে মারা গিয়েছে তার মা। ‘তোমার মায়ের নাম কি?” জিহ্বার আগায় ছিল প্রশ্নটা। কিন্তু নিজেকে থামাই। নিজেকে শান্ত করে ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু ভাবা জরুরি ছিল তখন।

“এরপর বারবার ওই ক্লাবে যেতে থাকি। যতবার গিয়েছি অতিরিক্ত পয়সা দিয়েছি, যাতে ইউরি আমাকে সময় দেয়। নিজের সর্বোচ্চটাই দিয়েছি আমি, যাতে সে মন খুলে কথা বলে আমার সাথে। এরকম হোস্টেসরা সত্যি বলছে কিনা বোঝা কঠিন, তবে ইউরি আমাকে বলে মা-ই একা হাতে বড় করেছে তাকে।“

তবে একসময় একটা তথ্য জানতে পারে নাওহিরো: ইউরির জন্ম তারিখ। নাওহিরো ও তোকিকো সম্পর্কে থাকার সময়ই পেটে আসে ইউরি।

একদিন রাতে নাওহিরো সিদ্ধান্ত নেয় এখনই সঠিক সময়। সে একান্তে কথা বলতে চায় ইউরির সাথে।

“জরুরি একটা কথা বলতে হবে তোমাকে। কথাটা তোমার মা সম্পর্কিত। মনে হয় তোমার মায়ের নাম তোকিকো। ঠিক না?”

চোখ বড় হয়ে যায় ইউরির, “আপনি কিভাবে জানলেন? জিজ্ঞেস করে সে।”

“তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় নাওহিরো। মাথা ঘুরিয়ে উঠে তার। এরকম কিছু কি বাস্তবেই ঘটে? ভাবে সে।

ওই রাতে ক্লাব বন্ধ হওয়ার পর ইউরিকে একটা জাপানিজ রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সে। ওই রেস্তোরাঁয় যায় কেননা সেখানে প্রাইভেট রুম ছিল। একান্তে বসার পরই নাওহিরো স্বীকার করে সে- ই তার বাবা। তোকিকোর সাথে যা যা হয়েছে সব খুলে বলে নাওহিরো। এটাও জানায়, সে জানত না তোকিকো অন্তঃসত্ত্বা ছিল।

“ওদেরকে যে কষ্টটা দিয়েছি এর জন্য ক্ষমা চাই আমি। এটা বুঝতে এরকুল পোয়ারো হতে হয় না যে কঠিন একটা সময় পার করতে হয়েছে ওদের। হয়তো আমার অগোচরেই ছিল ব্যাপারটা, কিন্তু এক অর্থে দায় তো আমারই। আমি যদি তখন অপরিণত না হতাম, তাহলে হয়ত আমাকে বিয়ে করতে রাজি হত তোকিকো, বলল নাওহিরো।”

“মিস মিয়ামোতোর প্রতিক্রিয়া কি ছিল?” জিজ্ঞেস করল কাগা।

“চমকে গিয়েছিল। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে সময় লেগেছে ওর এক্ষেত্রে তাকে দোষও দেয়া যায় না। তবে একসময় বুঝতে পারে আমি অন্যান্য বৃদ্ধদের মত ওর পিছে পড়ে নেই। ওইদিন সন্ধ্যায় খুব বেশি কথা বলেনি ইউরি। তবে কয়েকদিন পর এসে ঠিকই কথা বলে।”

“এখন তো মনে হয় সবকিছু ঠিকঠাক,” বলল কাগা।

“যেহেতু আমার একটা পরিবার ছিল, সেহেতু তাকে গোপনেই সাহায্য করার জন্য মনস্থির করি আমি।”

“ঠিক তখনই আপনার স্ত্রী ডিভোর্স চেয়ে বসল?”

নাক দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করে নাওহিরো। “ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তাই না? তোকিকোর সাথে আমার অভিজ্ঞতা বলে নারীরা পরিশ্রমী পুরুষ পছন্দ করে। কিন্তু মিনেকো বলত এভাবে সব ফেলে পরিশ্রম করা ঠিক নয়। সমস্যাটা আমারই। আমি কোনদিক-ই সামলাতে পারিনি।”

“কিন্তু মিনেকোকে হারিয়ে ইউরিকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন আপনি।”

“মেয়েটার পরিপূর্ণ বাবা হতে চেয়েছি কেবল। স্বাভাবিকভাবেই ওই গিনজা ক্লাবে হোস্টেস হিসেবে আর কাজ করতে দিতে চাইনি ওকে। জানতাম আমার অফিসে নিয়োগ দিলে নানান কথা ছড়াবে চারদিকে। তবে ও যে আমার মেয়ে সেটা সময়মতো প্রকাশ করার পরিকল্পনা ছিল আমার। কোকিকে জানাতে চেয়েছিলাম প্রথমে। কিন্তু মিনেকোর খুন অসম্ভব করে দিলো সবকিছু। এখন কোকি আমাকে আগের থেকেও বেশি ঘৃণা করে।”

“বিয়ারের শেষ অংশটুকু গিলে ফেলল নাওহিরো। সবসময়ই স্বপ্ন ছিল ছেলের সাথে এভাবে বসে ড্রিঙ্ক করবে, তার সব সমস্যাগুলো শুনবে, পরামর্শ দেবে। কিন্তু বাস্তবে তার সাথে কথা বলতে গেলে প্রত্যেকবারই ঝগড়া লেগে গিয়েছে।

“আমি ভাবি, আপনি ও আপনার স্ত্রী ডিভোর্সের পর ভালো কি পেলেন?”

তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল নাওহিরোর। “বলার মত ভালো কিছু নয় সেটা।’

“ইয়ার্কি করছি না আমি। মিস মিতসুই কোনো কারণে ভাবত আপনার ছেলের প্রেমিকা অন্তঃসত্ত্বা। তার কাছাকাছি থাকার জন্য ওই এলাকায় গিয়ে ওঠে সে। আর আপনি একা হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ইউরিকে নিয়োগ দেন। অন্যভাবে বললে আপনারা দুজনই একই জিনিস চেয়েছিলেন: পরিবার। পরিবারের বন্ধন বেশ দৃঢ় মিস্টার কিয়োসি। আপনি আর কোকিও কিন্তু পরিবার, এটা ভোলা উচিত নয় আপনার।”

কাগার দিকে তাকাল নাওহিরো। হাসল ডিটেকটিভ। টেবিলের ওপর চপস্টিকটা নিয়ে নড়াচড়া করছে সে।

“দুঃখিত, কথাটা বলা উচিত হল না আমার। নিজের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি আমি।”

“নাহ,” বিড়বিড় করল নাওহিরো। জ্যাকেটের পকেটে থাকা সেলফোন জানালো একটা মেসেজ এসেছে।

“একটু,” পকেট থেকে ফোনটা বের করল সে। মেসেজটা ইউরির। লেখা আছে, “জরুরী,” মেসেজটা দ্রুতই পড়ল নাওহিরো। আমি আমার ছোট ভাইয়ের সাথে আছি। কল করো, সম্ভব হলে আমাদের এখানে আসো।

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে জমে গেল নাওহিরো।

“কোনো সমস্যা?” জিজ্ঞেস করল কাগা।

নাওহিরো নীরবে মেসেজটা দেখাল তাকে। সামান্য ভ্রুকুচকে হাসল কাগা।

মনে হচ্ছে অবশেষে আপনার পরিবার একত্র হয়ে গিয়েছে। যান, ওদের সাথে দেখা করুন।”

“ধন্যবাদ,” উঠে দাঁড়াল নাওহিরো। “ওই রিংটা দেখেই কি বুঝে ফেলেছিলেন ইউরি আমার মেয়ে?” টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল সে।

এটা আমার কাজেরই অংশ, আর নিজের কাজে কখনোই খুব একটা খারাপ ছিলাম না আমি, মনে মনে ভেবে রহস্যজনক হাসি হাসল কাগা।

আমার প্রবৃত্তি এমন কিছুই বলছিল। তাকে প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল এমনটা।”

“ইয়ার্কি করছেন না তো?”

“ওরা দুজন দেখতে অনেকটা এক রকম, ইউরি আর কোকি।” আবারো নাক দিয়ে শব্দ করল নাওহিরো।

“কোকি বলেছিল মেয়েটার চেহারা তার কাছে পরিচিত লেগেছে। সম্ভবত ওরকম চেহারা সে আয়নায় দেখেছিল।“

কাগার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল নাওহিরো।

“শেষ একটা প্রশ্ন করি। আপনার পদমর্যাদা কি?”

“সার্জেন্ট।”

“ওদের উচিত আপনাকে পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্ট বানানো,” কথাটা বলেই দরজার দিকে হাঁটা ধরল নাওহিরো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *