অধ্যায় ৫ – পেস্ট্রি শপের বিক্রয়কর্মী

অধ্যায় ৫ – পেস্ট্রি শপের বিক্রয়কর্মী

এক

“তিনটা চেরি অ্যান্ড ফিগ টার্টস- তাহলে সব মিলে দাঁড়াচ্ছে এক হাজার সাতশ পঁচিশ ইয়েন,” কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার হাতে বক্সটা তুলে দিয়ে বলে মিয়ুকি।

ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স ত্রিশের কোঠায়। একটা দু হাজার ইয়েনের নোট বের করে মানি ট্রেতে রাখল সে। মিয়ুকি সেটা তুলে ক্যাশ রেজিস্ট্রে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে খুচরা টাকাগুলো ফেরত দিল রশিদের সাথে। “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

মহিলা চলে যাওয়ার পর ফোনের ডিসপ্লেতে সময় দেখে নিল মিয়ুকি। সাতটা বাজতে আর পনেরো মিনিট। প্রতিদিন সাতটা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় কুয়াত্রো পেস্ট্রি শপ।

মিয়ুকি সামনের দিকে ঝুঁকে সেদিনকার অবিক্রিত কয়েকটা কেক ডিসপ্লে কেসে সাজিয়ে রাখছে এসময় দোকানের সামনের দরজাটা খুলে গেল। “শুভ সন্ধ্যা,” সবসময়কার মত উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে মিয়ুকি। মুখে আপনা আপনি চলে এসেছে হাসিটা। ওদের নিয়মিত একজন কাস্টোমার দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।

দোকানে সদ্য প্রবেশ করা মহিলাও পাল্টা একটা হাসি উপহার দিল মিয়ুকিকে। কিছু মানুষ থাকে, যাদের দেখলেই উষ্ণতায় ভরে ওঠে মন। এই ভদ্রমহিলা সেরকমই একজন। চোখের দৃষ্টিতে জ্বলজ্বল করছে মায়া। একদিন কথায় কথায় মিয়ুকিকে সে বলেছিল যে তার বয়স চল্লিশের বেশি। কিন্তু ভদ্রমহিলার নিপাট দেহবল্লরী এবং চেহারার ঔজ্জ্বল্য দেখে যে কেউ তাকে ত্রিশ বছর বয়সী বলে ভুল করবে।

“হ্যালো, আপনাদের দোকান কি এখনও খোলা?” জিজ্ঞেস করে সে।

“জ্বি।”

“আজকে আমার এক প্রতিবেশী অনেকগুলো স্ন্যাক কেক দিয়ে গেছে আমাকে, তাই এখানে আসার আসলে কোন যুক্তি নেই। কিন্তু পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম, তাই আর নিজেকে সামলাতে পারিনি!” ডিসপ্লে কেসে রাখা আইটেমগুলোর দিকে তাকালো ভদ্রমহিলা। তার চুলগুলো ওরকম সুন্দর করে ছাটা বলেই কিনা মিয়ুকির কাছে মহিলার চলাফেরা ভীষণ মার্জিত মনে হয়। “জাপানি পিঠা বা মিষ্টি আমার খারাপ লাগে না, কিন্তু বড় কোন কাজ শেষে কেক খেয়ে উদযাপন করতে পছন্দ করি। নিজেই নিজেকে উৎসাহ যোগাই আর কি।”

“আপনার কাজটা কি?”

“আপনি অনুমান করুন দেখি।”

“কি হতে পারে…”

একদিকে ঘাড় কাত করে মিয়ুকি। তার দিকে তাকিয়ে একবার রহস্যময় ভঙ্গিতে চোখ টেপে ভদ্রমহিলা। “কাজটা বাসায় বসেই করতে পারি। অনেকটা পার্ট টাইম চাকরির মতন।”

“জবাবে কেবল ‘ইয়ে’ আর ‘মানে’-ই বলতে সক্ষম হলো মিয়ুকি।

“কিন্তু আজ আমার ভাগ্য খারাপ মনে হচ্ছে। জেলি কেকগুলোর একটা খেতে চাচ্ছিলাম। আপনাদের এখানকার প্যাশন ফ্রুট অ্যান্ড অ্যালমন্ড জেলি কেকের কোন তুলনা হয় না।” আবারো ডিসপ্লে কেসের দিকে তাকায় ভদ্রমহিলা।

“দুঃখিত। ওগুলো বিক্রি হয়ে গেছে।”

“যেরকম গরম পড়েছে। সবার ওরকম মিষ্টি আর ঠাণ্ডা কিছুর প্রতি চোখ যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাহলে আজকে কি নেয়া যায়?

এসময় ভদ্রমহিলার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা মোবাইল ফোনের রিংটোন ভেসে এলো। ভুজোড়া সামান্য কুঁচকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনে চোখ রাখল সে। বিভ্রান্তি ভর করলো চেহারায়।

“হ্যালো, হ্যাঁ?…ওহ, তুমি। কিন্তু পে ফোন থেকে কল করছো কেন?…আহারে। আচ্ছা, দাঁড়াও এক সেকেন্ড।” ফোনটা এক হাতে চেপে ধরে অন্য হাতটা উঁচিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি করলো সে। “সরি, আজকে মনে হয় আর কিছু নেয়া হবে না। আগামীকাল আসবো।”

“আসবেন কিন্তু।”

আরো একবার সরি বলে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল ভদ্রমহিলা।

মিয়ুকি লম্বা একটা শ্বাস ফেলেছে কেবলই, এসময় ক্যাফের পেছনের দিক থেকে বেরিয়ে এলো রেইকো নাকানিশি। কুয়াতে পেস্ট্রি শপের ম্যানেজার সে।

“আজ খুব ব্যস্ত একটা দিন গেল, মিয়ুকি। বাকি কাজ আমি সেরে ফেলব।”

“আরে না। আমিই সামলাতে পারব। সমস্যা হবে না।”

“আমি চাই না তুমি অতিরিক্ত কাজ করো। খুব ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?”

“অত ক্লান্ত লাগছে না কিন্তু। ইদানিং আগের তুলনায় শরীরে বেশ বল পাচ্ছি।”

“শুনে ভালো লাগল,” হেসে বলে রেইকো নাকানাশি, কিন্তু পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যায় তার চেহারা। “ভদ্রমহিলা কিছু না কিনেই চলে গেলেন?”

“যেটা নিতে এসেছিলেন, বিক্রি হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা। একটু দেরি করে এসেছেন আজকে। প্রতিদিন তো ছ’টার মধ্যে এসে পড়েন। শোন মিয়ুকি, তুমি আজকে ডিসপ্লে কেসটা পরিষ্কার করে চলে যেও, আর কিছু করতে হবে না।”

“ঠিক আছে।”

কেসের পেছন দিকে হাঁটু ভাঁজ করে বসার পর না হেসে পারল না মিয়ুকি। ভেতরে বেশ কয়েকটা অবিক্রিত ক্রিম পাফ দেখা যাচ্ছে। কেনিচি মিষ্টি জিনিস খুব একটা পছন্দ না করলেও ক্রিম পাফ আগ্রহ নিয়ে খায়। কুয়াত্রোর কর্মীরা প্রতিদিনকার বেঁচে যাওয়া পেস্ট্রিগুলো থেকে চাইলে বাসায় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পরিবারের সদস্য বাদে অন্য কাউকে সেগুলো দেয়ার নিয়ম নেই। কারণ যে ব্যক্তি একবার মুফতে পেস্ট্রি পাবে, সে আর কিনে খাবে না।

কেবলই যে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেল, সে-ও ক্রিম পাফ পছন্দ করে। সাধারণত ছ’টার দিকে আসে সে, যেমনটা রেইকো নাকানিশি বলছিল। ডিসপ্লে থেকে কিছু একটা পছন্দ করে সেটার সাথে এক কাপ চা নিয়ে ক্যাফে এরিয়াতে বসে খায়। দোকানে ভিড় না থাকলে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকায় মিয়ুকি। প্রতিবারই চোখাচোখি হওয়া মাত্র মহিলা মিষ্টি একটা হাসি উপহার দেয়।

মিয়ুকি তার বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানে না। দু’মাস আগে প্রথমবার এখানে আসে সে। এরপর থেকে এক দিন পরপর আসতে শুরু করে। কুয়াত্রোর স্টাফদের সবাই তাকে চেনে। এখানকার খাবার যে তার ভাল লাগে, এটা বুঝতে শার্লক হোমস হতে হবে না।

তার চাকরিটা কি হতে পারে? ভাবে মিয়ুকি। পরেরবার আসলে সরাসরি জিজ্ঞেস করবো।

দুই

দরদর করে ঘামছে কোকি কিয়োসি। মাথা ঝোঁকানোয় সেই ঘাম এসে পড়লো চোখের উপরে। টিশার্ট ভিজে গেছে পুরোপুরি। গলায় পেচানো তোয়ালে দিয়ে চেহারার ঘাম মুছে নিল একবার। এরপর আবার কাজে লেগে পড়লো। যত দ্রুত সেট সাজানো শেষ হবে, নাটকের রিহার্সালও শুরু করে দিতে পারবে সবাই মিলে। চারপাশে নাট্যদলের অন্যান্য সদস্যরা ব্যস্ত স্টেজ আর কস্টিউম সাজাতে। দলটা খুব একটা বড় না, তাই অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই সবকিছু করতে হয়।

মাটিতে রাখা আরেকটা বল্টুর দিকে হাত বাড়াতে যাবে এসময় বেজে উঠলো ফোনটা। লম্বা শ্বাস ফেলে পকেট থেকে সেটা বের করে আনলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা কলারের নাম দেখে বিরক্তিতে কুঁচকে গেল মুখ। একবার ভাবলো ধরবে না কলটা; এই লোকের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চায় না ও।

অবশ্য যে ফোন দিয়েছে তারও ওর সাথে কথা বলার খুব একটা শখ নেই। কোন একটা কারণ আছে বলেই ফোন দিয়েছে নিশ্চয়ই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কলটা ধরলো কোকি।

“হ্যাঁ, কি হয়েছে,” বললো ও।

“আমি,” নাওহিরো’র কথা বলার ধরণও পাল্টায়নি।

“হ্যাঁ, নম্বর সেভ করাই আছে ফোনে। কি হয়েছে বলো? আমি একটু ব্যস্ত।”

“শুধু এটা বলার জন্যে ফোন দিয়েছি যে পুলিশের পক্ষ থেকে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”

“পুলিশ? কেন? আমি তো কিছু করিনি।”

“তুমি না। মিনেকো।”

নামটা শুনে কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গেল কোকি। বেশ লম্বা একটা সময় কাউকে এটা বলতে শোনেনি।

“মা’র কিছু হয়েছে?”

নাওহিরো তৎক্ষণাৎ কিছু বললো না।

“বাবা?” কোকি আবার বলে।

“আমাকে জানানো হয়েছে ও মারা গেছে। “কি!”

“সকালবেলা কয়েকজন ডিটেকটিভ এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। মিনেকো গতকাল রাতের বেলা মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।”

লম্বা একটা শ্বাস নেয় কোকি। কিছু বলতে পারছে না। মিনেকোর চেহারাটা ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে। ওর স্মৃতিতে সে এখনও হাসছে, সেই মায়াকাড়া ভঙ্গিতে।

“শুনছ আমার কথা?” নাওহিরো জিজ্ঞেস করে।

“কি বলছো এসব?” কোকি বলে। “মা? মানে, কি? কোন দুর্ঘটনা?“

“পুলিশের ধারণা ওকে খুন করা হয়েছে।“

হৃৎস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল কোকির। এরপর হঠাৎ করেই টের পেল পুরো শরীরে রক্তের সঞ্চালন। গরম লাগতে লাগল হঠাৎ করেই।

“কে খুব করেছে?” জিজ্ঞেস করে ও।

“সেটা এখনও জানা যায়নি। তদন্ত কেবল শুরু হয়েছে। এজন্যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।”

“কোথায় হয়েছে ঘটনাটা? মা কোথায় ছিল তখন?”

“ওর অ্যাপার্টমেন্টে।”

“মা’র অ্যাপার্টমেন্ট? কোথায়?”

“নিহনবাশি ডিসট্রিক্টে।”

“নিহনবাশি!”

“ওখানকার কোদেনমাচোতে আরকি। ডিটেকটিভদের কাছে শুনলাম একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতো মিনেকো।

কোকি যেখানে থাকে, সেখান থেকে জায়গাটা একদম কাছে। কোদেনমাচো থেকে আধ মাইল দূরে আসাকুসাবাশিতে থাকে ও।

এত জায়গা থাকতে এখানে উঠেছিল কেন মা? ওর নিজের মা খুন হয়েছে, এই সত্যটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কোকি। বাস্তব মনে হচ্ছে না।

“তুমি কিছু জানো?”

“কোন ব্যাপারে?”

“কেন খুন হতে হলো তোমার মাকে?

“কিভাবে জানব? আমাদের যোগাযোগ নেই অনেক দিন হলো। “ ফোনের অপর প্রান্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নাওহিরো। “সেটাই ভেবেছিলাম।”

“কি করতে হবে এখন আমাকে?”

“তোমাকে কিছু করতে বলার জন্যে ফোন দেইনি। পুলিশের লোকেরা নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে তোমার সাথে, এজন্যে আগে থেকে জানিয়ে দিলাম। তোমার নম্বর নিয়ে গেছে ওরা।”

“আচ্ছা।”

“এটুকুই বলতে চেয়েছিলাম।”

“বাবা?”

“হ্যাঁ, বলো?

“শেষকৃত্যের কি হবে? “কিছুক্ষণের জন্যে আবারো চুপ মেরে গেল নাওহিরো। “ওটা তো এখন আর আমার দায়িত্ব নয়।”

“তা ঠিক।”

“আপাতত দূরেই থাকব। যদি ওরা আমাকে ফোন করে কিছু

করতে বলে, তাহলে করবো।”

নাওহিরো নিশ্চয়ই বোঝাতে চেয়েছে মিনেকোর পরিবার থেকে ফোন করে শেষকৃত্যের খরচের ব্যাপারে কিছু বললে অবশ্যই সাহায্য করবে। সেটুকু করা তোমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, ভাবে কোকি।

কল কেটে যাওয়ার পর স্থানুর মত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কোকি। বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে আসছে মাথার ভেতরটা। এখন কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছে না।

“কোকি, কোন সমস্যা?”

কেউ একজন বলে ওঠায় বাস্তবে ফিরে এলো ও। শিনোজুকা, নাট্যদলের প্রধান ডাক দিয়েছে ওকে।

“আমার মা। খুন…হয়েছে।”

বিস্ফোরিত নয়নে ওর দিকে তাকালো শিনোজুকা। “কি বলছো এসব?”

“মা…খুন হয়েছে…নিজের অ্যাপার্টমেন্টে,” বলে মাটিতে বসে হাঁটুতে মুখ লুকালো কোকি।

******

পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলো আরো প্রায় ঘন্টাখানেক পর। কোকি তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। সহকর্মীরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বলেছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু ও-ই জোর করে রয়ে গেছে। ওর ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে রিহার্সালের শিডিউলে সমস্যা হোক, এটা চায়নি। তাছাড়া, বাসায় আগেভাগে ফিরে গিয়ে করার মত কিছু নেই। ব্যস্ত থাকলে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও ভুলে থাকতে পারবে।

ফোনটা এসেছে টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উয়েসুগি নামের এক ডিটেকটিভের কাছ থেকে। উয়েসুগি যত দ্রুত সম্ভব সামনাসামনি দেখা করে কথা বলতে চায়। তাই একটু পর থিয়েটারের কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করবে ওরা।

রেস্তোরাঁয় পৌঁছে কোকি দেখল দু’জন স্যুট পরিহিত ডিটেকটিভ অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। দু’জনেই হোমিসাইড ডিভিশন থেকে এসেছে। তাদের মধ্যে উয়েসুগি উর্ধ্বতন আর বয়সে বড়।

সমবেদনা জানানোর পর্ব শেষ হলে উয়েসুগি জানতে চাইল কোকি শেষ কবে তার মা’র সাথে কথা বলেছে।

“গত বছরের আগের বছরের শেষ দিকে,” কোকি বলে।

“গত বছরের আগের বছর!” চোখ বড় বড় হয়ে যায় উয়েসুগির। “এতদিন ধরে দেখা সাক্ষাত হয় না আপনাদের?”

“বাবা এই বিষয়ে কিছু বলেনি আপনাদের?”

“তিনি কেবল বলেছিলেন যে কলেজ থেকে ড্রপআউট হবার পর বাড়ি থেকে চলে আসেন আপনি।”

“হ্যাঁ, সেটা গত বছরের আগের বছরের কথা। এরপর আর মা’র সাথে দেখা হয়নি।”

“ফোন দেয়াও জরুরী মনে করেননি?” ডিটেকটিভের দৃষ্টিতে বিরক্তিটুকু ঠিকই টের পেল কোকি।

জবাব দেয়ার আগে অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ও। এই বুড়ো কি মনে করে নিজেকে?

“আমি বাসা থেকে স্রেফ বেরিয়ে যাই। বাকিটা বুঝে নিন।”

“আর আপনার মা? তিনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি?”

“আগের সিমটা ফেলে দিয়েছি। নতুন নম্বরটা মা বা বাবা কাউকে জানাইনি।”

“কিন্তু আপনার বাবার কাছে তো আপনার নম্বর ছিল।”

“বাবা একজনকে ভাড়া করেছিল আমাকে খুঁজে বের করার জন্যে। টোকিও’র ছোট ছোট নাট্যদলগুলোর মধ্যে খুঁজতে খুঁজতেই আমাকে পায় সে। প্রায় ছ’মাস আগের কথা। এক লোক হুট করে হাজির হয়ে বলে, ‘আপনার বাবার সাথে যোগাযোগ করুন। জরুরি কথা আছে তার।’ তাই তখন ফোন করি।

“জরুরি খবরটা কি ছিল?”

“দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরাসরি ডিটেকটিভের চোখে দিকে তাকায় কোকি।

“আমার বাবা-মা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটু অবাক হয়েছিলাম শুনে, কিন্তু এখন অনেকেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে; অনেক বছর বিবাহিত থাকার পরেও। আমি বলেছিলাম, “তোমরা যদি সেটাই চাও, আমার তরফ থেকে কোন সমস্যা নেই।’ আমাকে না জানিয়ে ডিভোর্সের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না বোধহয় দু’জন।”

“কেন ডিভোর্স নিচ্ছে এই বিষয়ে কিছু বলেছিল? একদিকে ঘাড় কাত করে কোকি।”

“কেউ কিছু বলেনি আমাকে। পরিবারের প্রতি কখনোই তেমন একটা মনোযোগী ছিল না বাবা। আর মা বাসায় সারাদিন একা বসে থেকে থেকে প্রায় পাগল হয়ে গেছিল। ডিভোর্সে দু’জনেরই সুবিধা।”

“আচ্ছা। তাহলে আপনার মা কিছু না করে বাসায় একা থাকতে পছন্দ করতেন ন্যূতাই তো?”

চোখ পাকিয়ে ডিটেকটিভের দিকে তাকায় কোকি।

“আপনারা আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? ডিভোর্সের সাথে খুনের কোন সম্পর্ক আছে নাকি?”

এবারে কিছুটা সতর্ক হয়ে ওঠে ডিটেকটিভ। “সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। আপাতত আমরা আসলে কিছুই জানি না। তবে আপনার মা যেখানে থাকতেন।“

“আমি আজকেই শুনেছি মা কোথায় থাকত। বাবা বলেছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না জায়গাটা এত কাছে।”

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম। এটা কি স্রেফ কাকতাল নাকি অন্য কিছু? মিনেকো মিতসুই ওই অ্যাপার্টমেন্টটায় ওঠেন দুই মাস আগে। আপনি এই এলাকায় থাকেন সেটা জানার পরেই কি এখানে এসেছিলেন তিনি?”

“সেটা তো হতে পারে না। বাবা নিশ্চয়ই মা’কে বলেনি আমার ঠিকানা। কাকতাল ছাড়া আপাতত আমার কাছে আর কিছু মনে হচ্ছে না।”

“তাই?” উয়েসুগিকে দেখে মনে হচ্ছে না এই কথাটা তার বিশ্বাস হয়েছে।

মিনেকোর বন্ধুবান্ধব এবং প্রাত্যাহিক জীবন সম্পর্কে আরো কিছু প্রশ্ন করলো ডিটেকটিভ দু’জন। তাদের যতটুকু সম্ভব, সাহায্য করল কোকি। তদন্তে ও যে খুব বেশি একটা সাহায্য করতে পারবে না, এটা বেশ বুঝতে পারছে। ডিটেকটিভরাও একটু পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।

কোকি অবশ্য ঘটনার ব্যাপারে কিছু তথ্য আদায়ের চেষ্টা করলো তাদের কাছ থেকে, কিন্তু ডিটেকটিভদের বলার মত আসলে খুব বেশি কিছু নেই। তদন্ত কেবল শুরু হয়েছে, এখনও অনেক কিছু জানা বাকি তবে তাদের কথা বলার ধরণ শুনে মনে হলো না কেসটাকে সাধারণ চুরি ডাকাতির কেস হিসেবে বিবেচনা করছে তারা। অনেক সময় চুরি করতে গিয়েও পরিস্থিতির কারণে খুনোখুনি হয়ে যায়।

“শেষ প্রশ্ন,” ডিটেকটিভ উয়েসুগি হাত উঁচিয়ে বলে। “আপনি গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আটটা অবধি কোথায় ছিলেন? “কোকি টের পেল যে মাথায় রক্ত চড়ে গেছে ওর।

“আমার অ্যালিবাই যাচাই করছেন?”

“এটা নিয়মের মধ্যেই পড়ে। কেসের সাথে যারা সম্পৃক্ত, তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। চাইলে আপনি জবাব না-ও দিতে পারেন।”

কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ানোর পর কোকি বললো, “ আমি থিয়েটারেই ছিলাম। চাইলে অন্যান্য অভিনেতাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

“ঠিক আছে তাহলে,” অনাগ্রহের সুরে বললো ডিটেকটিভ।

******

আটটার কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরল কোকি। অন্য সময় হলে থিয়েটারে থেকে সেট সাজানর কাজে সাহায্য করতো, কিন্তু আজকে শিনোজুকা থাকতে দেয়নি।

অ্যাপার্টমেন্টের জানালায় বাতি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। অ্যামি নিশ্চয়ই ফিরেছে। সামনের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোকার পর ওর গার্লফ্রেন্ড পেছনে ফিরে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো, “কোকি? আজকে তাড়াতাড়ি এসে পড়েছ!” টিভি দেখছিল সে।

কিন্তু কোকি যখন মা’র বিষয়টা খুলে বললো, মুষড়ে পড়লো অ্যামি।

“হায় ঈশ্বর! আজকে আমার কাজের ওখানে বসও এই বিষয়ে কথা বলছিল।”

“কোন বিষয়ে?”

“আজকে অনেক বেশি পুলিশের আনাগোণা দেখা গেছে এলাকায়। আমাদের দোকানটা তো কোদেনমাচোর কাছেই। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না! কিভাবে সম্ভব…” চোখ ছলছল করছে অ্যামির।

“জানি না। ডিটেকটিভরা কেবল বলেছে যে খুন হয়েছে মা। আর কিছু না।”

“কি করবে তুমি? শেষকৃত্যে তো যেতে হবে।”

ডিভোর্সের পর ওর মা’র জীবন কেমন ছিল সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কোকির। আসলে জানার ইচ্ছেটাও ছিল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছিল জীবনটা। ওর মা’রও একই কাজ করার পূর্ণ অধিকার ছিল। শুধু সেটাই না, গত এক বছর আসলেও প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কেটেছে।

ফুটনে লম্বা সময় শুয়ে থাকলেও ঘুম এলো না। পাশে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে থাকা অ্যামিরও একই অবস্থা। অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে সিলিংয়ের দাগগুলো মোটামুটি স্পষ্টই দেখতে পেল কোকি।

অ্যামি আওইয়ামার সাথে একটা মিউজিক্যালে দেখা হয়েছিল কোকির। ওর পাশের সিটে বসেছিল সে। বেশ আলাপ জমেছিল সেদিন। ফুকুশিমায় জন্ম অ্যামির। ওর চেয়ে বছরখানেকের বড় ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়তে পাড়ি জমিয়েছে টোকিওতে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি করছে।

যে অ্যাপার্টমেন্টটায় ওরা থাকে, সেটা প্রথমে অ্যামিরই ছিল। কোকি পরবর্তীতে উঠে আসে তার সাথে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে থাকার সময় নাটকে আগ্রহী হয়ে ওঠে কোকি। স্থানীয় থিয়েটারগুলো ঘুরে দেখার সময় শিনোজুকাদের ছোট নাট্যদলটা চোখে পড়ে ওর। তখনই ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে নাট্যদলে নাম লেখায়।

আরো কিছু দিন পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দেয়ার। এই সিদ্ধান্তের ঘোর প্রতিবাদ জানায় নাওহিরো। এতে অবশ্য অবাক হয় না ও। কিন্তু মিনেকো, ওর মা’রও মত ছিল না এতে।

“তুমি যদি আসলেই ড্রপ আউট হতে চাও, তাহলে আমি কিছু বলবো না। কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য আশা করবে না। নিজের পথ নিজে দেখে নাও এবারে,” বাবা বলে।

“আমিও সেটাই চাই,” পাল্টা ঝাঁঝের সাথে বলে কোকি। ডাইনিং টেবিল থেকে নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে।

বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিনেকো আসে পেছন পেছন। “নিজের থাকার কোন জায়গা খুঁজে পেলে আমাকে জানিও,” ফিসফিস করে বলে সে।

মাথা ঝাঁকায় কোকি।

“তোমাকে কিছু জানাবো না আমি। ফোন নম্বরও পাল্টে ফেলব।”

“কিন্তু—”

“মিনেকো!” ডাইনিং রুম থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে এসময়। “ যেতে দাও হারামিটাকে!

“বিষাদ এবং বিস্ময় একাকার হয়ে যায় মিনেকোর চেহারায়। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হনহন করে হাঁটা দেয় কোকি!

এখন শুনছে ওর মা নাকি খুন হয়েছে। জীবিতদের মাঝে তার আর কোন স্থান নেই। কোকি জানে যে এটাই বাস্তব, তবু বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন সিনেমার ঘটনা।

তিন

পরদিন অ্যামি কাজে যাওয়ার সময়েই বের হয়ে পড়লো কোকি হোরিদোমেচোতে একটা ক্যাফেতে চাকরি করে অ্যামি। কোদেনমাচোর পাশেই এলাকাটা।

অ্যামির বাইসাইকেলে করে তাকে ক্যাফে অবধি পৌঁছে দিল কোকি। ওরা প্রায়ই যাতায়তের জন্যে একটা সাইকেলই ব্যবহার করে। আগে ও যখন টোকিও স্টেশনের বেইজমেন্টে একটা রেডিমেড লাঞ্চ শপে চাকরি করতো তখনও এই একই সাইকেলে চেপে যাওয়া আসা করেছে। নাটকের প্রদর্শনী কাছাকাছি চলে আসায় কয়েক দিনের বিরতি নিয়েছে কোকি কাজ থেকে

কোদেনমাচো মোড়ে দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল ওরা। সাইকেল থেকে নেমে পড়লো কোকি। অ্যামি ওর জায়গা নিল। “আজকে রাতে ক্লাস আছে,” প্যাডেল মেরে চলে যাওয়ার আগে বললো সে। অর্থাৎ, আজকে ফিরতে দেরি হবে তার।

“ঠিক আছে,“ মাথা নেড়ে জবাব দেয় কোকি

অ্যামি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার পর চারপাশে তাকালো কোকি। একটা দোকান চোখে পড়ায় এগোলো সেদিকে।

ভেতরে কোন কাস্টোমার নেই। চুলে বাদামী রং করা এক তরুণ শেলফে স্যান্ডউইচ আর রাইস বল তুলে রাখছে।

“বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত,” কোকি বলে। “কিন্তু আপনি কি গত রাতে এই এলাকায় যে খুনটা হয়েছে, সেটার বিষয়ে কিছু জানেন?”

অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ছেলেটা।

“সরি, আমার শিফট ছিল না তখন।

“ওহ…আচ্ছা। ধন্যবাদ।”

ছেলেটার উদ্দেশ্যে একবার মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলো কোকি। কাছাকাছি আরো কয়েকটা দোকানে খোঁজখবর নিল, কিন্তু সদ্য ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনাটার বিষয়ে কিছ জানে না। যখনই তারা বোঝে ও কিছু কিনতে আসেনি, ব্যবহারের ধরণ পাল্টে যায়। কাস্টোমার না, এরকম কারো সাথে সময় নষ্ট করতে চায় না কেউই।

বেশ কয়েক জায়গায় এরকম ঘোরাফেরার পর অবশেষে একটা স্টেশনারী দোকানে আকাঙ্ক্ষিত উত্তরটা পায় কোকি।

“যে ভদ্রমহিলা খুন হয়েছে, তার ব্যাপারে বলছেন? ওই তো ওই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে,” কিছুটা দূরে হাত তুলে দেখায় টেকো লোকটা। গতকাল পুলিশের ওখান থেকে একজন এসেছিল সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে কিনা জানতে। এর আগের দিন রাত ন’টার দিকে বোধহয় মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। আমাদের দোকান আরো কয়েক ঘন্টা আগেই বন্ধ হয়ে যায়। সেটাই বলি।”

“অ্যাপার্টমেন্ট নম্বরটা জানা আছে আপনার?”

“সরি, সেটা জানা নেই। এই বিষয়ে আপনার আগ্রহের কারণ? ‘

“আসলে…ভিক্টিম আমার পরিচিত…”

“আহহা। শুনে খারাপ লাগল,” গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো দোকান মালিক।

তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো কোকি। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার দিকে হাঁটছে। একটা লম্বা, ক্রিম রঙ্গা বিল্ডিং। দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি পুরনো নয়।

এত জায়গা থাকতে মা এখানে এসে উঠলো কেন? কোকির নানাবাড়ি ইয়োকোহোমাতে। ভেবেছিল ডিভোর্সের পর সেখানেই ফিরে যাবে মা। একা একা কোথাও থাকতে পারে, সেটা মাথাতেও আসেনি।

তবে মিনেকো যেরকম ছিল, খুব একটা যে অবাক হয়েছে কোকি, সেটা বলা যাবে না। সংসারের একঘেয়ে দুনিয়া থেকে বেরিয়ে বাইরের ‘আসল জগত’-এর অভিজ্ঞতা নেয়ার ইচ্ছে তার সবসময়ের।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে সে। ইচ্ছে ছিল অনুবাদক হবার। কোকি এটাও জানে যে গ্র্যাজুয়েশনের পর উচ্চশিক্ষার জন্যে ইংল্যান্ডে যাবে বলেও মনস্থির করেছিল মিনেকো।

কিন্তু হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে পড়ায় সব পরিকল্পনা নস্যাত হয়ে যায়। মিনেকো জানত তার বাচ্চার বাবা কে- নাওহিরো কিয়োসে। ত্রিশের কোঠার নাওহিরো তখন একজন সফল উদ্যোক্তা। নিজের ব্যবসায় কেবলই নাম কামিয়েছে।

নাওহিরোকে বিষয়টা অবহিত করার পর তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় সে। মিনেকো প্রস্তাবটা মেনে নেয়। পরিবারের কারোও কোন অভিযোগ ছিল না। এরকম অবস্থায় বিয়ে তখনকার দিনে একটা নিয়মিত দৃশ্য।

তবে কোকি জানে যে ওর মা আসলে বিবাহিত জীবনে কখনোই খুব একটা সুখী ছিল না।

তখনও জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্র ও। একদিন স্কুল থেকে ফিরে মা’কে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলতে শুনে ফেলে।

“আমি এবারে বাইরের জগতে নিজেকে একটু পরখ করে দেখতে চাই। তুমি তো বুঝতে পারছ কি বলছি আমি, তাই না? আমার বয়স কেবল সাইত্রিশ। বাকি জীবন এভাবে কাটাতে হবে ভাবলেই খারাপ লাগে। তোমাকে আর তোমার চাকরিকে তো হিংসেও হয় মাঝেমাঝে। তখন যদি আমার পেটে কোকি না আসতো, তাহলে এই অবস্থায় পড়তে হতো না। নাওহিরো আর আমিও বোধহয় বিয়ে করতাম না। ওই বয়স গর্ভবতী হয়ে পড়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। যতদিনে জানতে পারি বাচ্চাটা নষ্ট করার উপায়ও ছিল না। তাছাড়া, আমি নিজের বাচ্চাকে বড় করার অভিজ্ঞতাটাও উপভোগ করতে চাইছিলাম আমি। তবে সেটা আসলে যথেষ্ট না। শুধু মায়ের ভূমিকা পালন করার জন্যে জগতে আসিনি আমি। যতক্ষণ জেগে থাকি স্বামী আর সন্তানকে নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। আমার নিজেরও তো একটা জীবন আছে, নাকি?

ওই বয়স গর্ভবতী হয়ে পড়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। এই কথাগুলো ছুরির মত বেঁধে কোকির বুকে

কোকি এটা আগে থেকেই বুঝতে পারত যে ওর বাবার সংসারের প্রতি কোন মন নেই, কিন্তু মা’র ভালবাসা নিয়ে কোন প্রকার সন্দেহ কাজ করেনি কখনো- সেই মুহূর্ত অবধি। ওর জন্যে যত্ন নিয়ে রান্না করতো মা, সব চাহিদার প্রতি নজর রাখত। যদি কখনো মেজাজ হারাত, সেটাও পক্ষান্তরে ওর ভালোর জন্যেই।

অন্তত তেমনটাই ধারণা ছিল কোকির। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে মিনেকো কেবল কাঁধের উপর চেপে বসা মা’র ভূমিকাটা পালন করে গেছে। লম্বা একটা সময় ধরে।

সেদিন থেকে কোকি খেয়াল রাখত মা’র যেন ওর জন্যে বিশেষভাবে কিছু করতে না হয়। ওর কারণে মা’র জীবনটা নষ্ট হচ্ছে, এটা মনে মনে দগ্ধ করতো ওকে

এখন অবশ্য কোকির ধারণা পাল্টেছে। এমনটা আর ভাবে না যে মিনেকো তার একমাত্র সন্তানকে ভালোবাসত না। সেদিন ফোনে বান্ধবীকে যে কথাগুলো সে বলেছে, মানুষ হতাশা থেকে তা বলতেই পারে। তবে নিজের জীবনটা আবারো নতুন করে সাজাবে, এই কথাটা কেবল বলার জন্যে বলেনি সে। এ কারণেই ডিভোর্সের পরে মা-বাবা’র বাসাতে ফিরে না গিয়ে টোকিওতে নিজের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে।

কিন্তু এত জায়গা থাকতে এখানেই কেন? বিল্ডিংটার দিকে কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে থাকে কোকি। মা’র এখনকার জীবন নিয়ে খুব বেশি ধারণা নেই ওর। তবুও থাকার জন্যে নিহনবাশিই কেন পছন্দ করলো সে, তা ওর মাথায় ঢুকছে না।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে, এমন সময় তিনজন লোক বেরিয়ে এলো দালানটা থেকে। তাদের মধ্যে নাওহিরোকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো কোকি।

নাওহিরোও ভীষণ অবাক হয়েছে।

“কি ব্যাপার! তুমি এখানে কি করছো?!”

“তুমি এখানে কি করছো, বাবা!”

“ডিটেকটিভদের সাহায্য করছি। মিনেকোর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম।”

“আপনি কি ভিক্টিমের ছেলে?” স্যুট পরিহিত লোকটা জিজ্ঞেস করে। “ঠিকানা পেলেন কার কাছে।”

“আশপাশে জিজ্ঞেস করে বের করেছি। গতকাল দু’জন ডিটেকটিভ এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে, কিন্তু তারা কিছু বলেননি।”

“ঠিক আছে,” বলে নাওহিরোর দিকে মুখ ফেরায় লোকটা “আপনার ছেলেকে কি অ্যাপার্টমেন্টটা ঘুরে দেখাব একবার?”

“সেটার কোন দরকার নেই। মা’র সাথে দু’বছরে কোন কথা হয়নি ওর।”

“ওহ, তাহলে থাক। আপনি কি আমাদের সাথে একটু থানায় যেতে পারবেন, মি. কিয়োসি?

“নিশ্চয়ই।”

“কোকিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ডিটেকটিভরা চলে গেল ওখান থেকে। তাদের ব্যবহার থেকে এটা পরিষ্কার যে সাহায্য করতে পারবে না, এমন কারো সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই। নাওহিরো তাদের পিছু পিছু যাওয়ার সময় হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল।

“এখানে ঘুরঘুর করলে তদন্তে ব্যাঘাত ঘটাবে কেবল। তোমার নাট্যদলের বন্ধুদের কাছে ফিরে যাও বরং।”

চোখ পাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল কোকি। “কি করবো সেটা তোমার কাছ থেকে শুনতে হবে না আমার।”

জবাব দেয়াও প্রয়োজন মনে করলো না নাওহিরো। ডিটেকটিভদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।

সেই মুহূর্তে কেউ একজন পেছন থেকে বলে উঠলো, “এক্সকিউজ মি।” ঘুরে দাঁড়াল কোকি। কালো টিশার্টের উপরে নীল শার্ট চাপানো এক ভদ্রলোক কেবলই বের হয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা থেকে। চেহারা দেখে বোঝা যায় রোদে বেশ ঘোরাফেরা করে সে।

“মাফ করবেন। কিন্তু লবিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের কথা না শুনে পারিনি। আপনি মিস মিতসুইয়ের ছেলে?”

“হ্যাঁ। আপনি কে?”

পেছনের পকেট থেকে একটা পুলিশের আইডি কার্ড বের করে দেখাল লোকটা। নিজেকে নিহনবাশি থাকার ডিটেকটিভ কাগা বলে পরিচয় দিল।

“আপনি বোধহয় দেখতে এসেছিলেন ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে।”

“হ্যাঁ, কাছেই থাকি আমি।”

“কাছেই? ঠিক কোথায় থাকেন?”

“আসাকুসাবাশি।”

“তাহলে তো আসলেই কাছে। আপনি কি হেঁটে এসেছেন?”

“না। আমার গার্লফ্রেন্ড কাছেই একটা জায়গায় চাকরি করে। একসাথে সাইকেলে চেপে এসেছি।

“আচ্ছা,” কিছুক্ষণ কি নিয়ে যেন ভাবে কাগা, এরপর কোকির চেহারার দিকে তাকায়। “ক্রাইম সিনটা দেখতে চান?”

অবাক না হয়ে পারল না কোকি। “সেটা কি সম্ভব হবে?”

“ক্রাইম সিনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে যেহেতু আমিই আছি, সম্ভব না হওয়ার কারণ দেখছি না,” বলে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে কাগা।

******

মিনেকোর অ্যাপার্টমেন্টটা চতুর্থ তলায়। মেরেকেটে দু’শো স্কয়ার ফিটের মতন হবে। আসবাব বলতে একটা সিঙ্গেল বেড, কম্পিউটার ডেস্ক,বুকশেলফ,টেবিল আর একটা আর্মচেয়ার। সবকিছু একদম চকচক করছে। তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা জায়গায় ঠেসে ঢুকানো হয়েছে সবকিছু। কোকি এটা ভেবে অবাক হলো যে এতগুলো বছর বড় একটা বাসায় কাটানোর পর এরকম ছোট একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে মানিয়ে নিয়েছে ওর মা।

“কি হয়েছিল আসলে?” প্রবেশপথের কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে কোকি।

“আপনার মা’র এক বান্ধবী খুঁজে পায় তাকে। সেদিন একসাথে ডিনার করার কথা ছিল দু’জনের। বেশ কয়েকবার ডোরবেল চাপার পরেও ভেতর থেকে যখন কোন সাড়া আসেনা, দরজা খুলে মিনেকোকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সে। প্রথমে ভেবেছিল অজ্ঞান হয়ে গেছে বা স্ট্রোক করেছে। কিন্তু গলার কাছে হাতের দাগগুলো চোখে পড়ার সাথে সাথে পুলিশে ফোন দেয়।” কোন প্রকার ডাইরি বা নোট না দেখেই কথাগুলো হড়বড় করে বলে গেল কাগা। এদিকে কোকি এটা ভেবে পাচ্ছে না যে কাগা ওকে সবকিছু এভাবে জানিচ্ছে কেন? গতকালের দুই ডিটেকটিভ পুরোপুরি বিপরীত আচরণ করছিল।

“বান্ধবীটা কে ছিল?”

“মিস মাতসুইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। অনুবাদক হিসেবে চাকরি করেন এক জায়গায়, ডিভোর্সের পর থেকে তাকে নিয়মিত সাহায্য করতেন মিনেকো।”

“ওহ আচ্ছা…”

তাহলে মা তার স্বপ্ন পূরণের পথেই হাঁটছিল, ডিভোর্সের পর যে একদম অথৈ সমুদ্রে পড়ে যায়নি কোকি তা একটু শান্তি দিল কোকিকে

অনুবাদক হিসেবে নতুন জীবন শুরু করার দিকে এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। অ্যাপার্টমেন্টে নজর বুলানর সময় একটা জিনিস চোখে পড়লো ওর। ঘরের এক কোণায় একটা ম্যাগাজিন র‍্যাক আছে। সেই র‍্যাকে এমন একটা ম্যাগাজিন চোখে পড়েছে যেটা ওর মা’র কাছে থাকাটা একটু বেমানান। ম্যাগাজিনটা নব্যজাত শিশুর পরিচর্চা বিষয়ে

“কোন সমস্যা?” কাগা জানতে চায়।”

“আসলে…মানে ওই যে বাচ্চাদের ম্যাগাজিনটা। ওটা এখানে কি করছে বুঝতে পারছি না,” ম্যাগাজিন র‍্যাকটার দিকে হাত দিয়ে দেখায় কোকি।

হাতে একটা ল্যাটেরে গ্লোভস গলিয়ে সেদিকে এগিয়ে ম্যাগাজিনটা তুলে নেয় কাগা।

“আপনার কথায় যুক্তি আছে।”

“মানে…মা তো…গর্ভবতী ছিল না?” একটু অস্বস্তির সাথে প্রশ্নটা করলো কোকি।

“থাকলেও এখন অবধি জানতে পারিনি আমরা,” জলদগম্ভীর স্বরে বলে ম্যাগাজিনটা আগের জায়গায় নামিয়ে রাখে কাগা। “আপনি কি জানতেন যে আপনার মা এখানে দু’মাস আগে এসেছেন? এর আগে কামাতায় এক বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকতেন, এখান থেকে দশ মাইল দূরে জায়গাটা।”

“তাই নাকি?”

“আপনার মা’র মৃতদেহ যে ভদ্রমহিলা খুঁজে পান, তিনি বলেন যে একদম হুট করেই কোদেনমাচোতে চলে আসেন মিস মিতসুই। এখানেই কেন বাসা নিলেন এটা জিজ্ঞেস করায় আপনার মা জবাবে বলেন, ‘অনুপ্রেরণা’।”

“অনুপ্রেরণা…?”

“এ কথা কেন বলেছিলেন তা আন্দাজ করতে পারেন আপনি? আর এখানেই কেন বাসা নিলেন?”

মাথা একদিকে কাত করে হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কোকি। “অন্য সবার মতন আমিও আসলে অবাকই হয়েছি শুনে। মা যে এত কাছে থাকত, এটা আমার কল্পনাতেও আসেনি।”

“আপনি তো আসাকুসাবাশিতে থাকেন। সেটার সাথে কোন সম্পর্ক আছে কি?”

“গতকাল যে ডিটেকটিভ এসেছিলেন, তিনিও এই প্রশ্নটা করেন আমাকে। তবে আমার মনে হয় না কোন সম্পর্ক আছে,” বেশ জোর দিয়েই বলে কোকি। “মা’র তো কোনভাবেই জানার কথা নয় যে আমি আসাকুসাবাশিতে আছি। পুরো বিষয়টাই কাকতালীয়।”

“তাই কি?”

“আপনার কি ধারণা? মা’র এখানে চলে আসার সাথে খুনের কোন সম্পর্ক আছে?”

“সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ভিক্টিমের পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কারো তার এই এলাকায় থাকতে আসার কারণ না জানার বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমাকে।”

“নানা নানীর সাথে দেখা করেছেন ইয়োকোহামায়?”

“আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে পাঠানো হয়েছিল একজনকে। তবে তারাও জরুরী কিছু জানাতে পারেননি।”

এই কথার প্রেক্ষিতে চুপ থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না কোকির।

“যা দেখার দেখেছেন?”

“হ্যাঁ।”

হলওয়েতে বেরিয়ে এলো কোকি। কাগা এলো পেছন পেছন। দরজায় আবারো তালা দিয়ে দিয়েছে।

“আপনাকে একটা কথা বলি, ডিটেকটিভ?”

কোকির দিকে ফেরে কাগা। “নিশ্চয়ই, কি?”

“আমার মা এমন একজন মানুষ, যার এই দুনিয়াতে কোন শত্রু নেই। হয়তো সব ভিক্টিমের পরিবারের লোকজনকেই এমনটা বলতে শুনেছেন আপনি, কিন্তু আমার মা’র ক্ষেত্রে কথাটা সত্য।”

কাগা হাসে। কিন্তু তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে কেমন কুকড়ে যায় কোকি।

“কিন্তু আপনার মায়ের জীবনে গত দুই বছরে কি ঘটেছে, সেই বিষয়ে তো কিছু জানা নেই আপনার। ভুল বললাম?”

“না, সেটা সত্যিই বলেছেন, কিন্তু …”

এবারে নরম হয়ে এলো কাগার অভিব্যক্তি।

“আপনি মাত্র যা বললেন তা আমাদের তদন্তে কাজে আসবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে একদম নিরীহ মানুষেরাও খুন হয় তবে খুনীকে অবশ্যই ধরবো আমরা। কথা দিচ্ছি আপনাকে।”

কাগার এই আত্মবিশ্বাসের কারণ বুঝতে পারে না কোকি, তবে কথাগুলো শুনে একটু হলেও শান্ত হয় মন। ডিটেকটিভের উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে কোকি, যেন বলতে চাইছে, অবশ্যই ধরবেন ডিটেকটিভ। আপনার উপরে ভরসা আছে আমার।

চার

মিনেকো খুন হয়েছে পাঁচ দিন হতে চললো। এই কয়দিনে পুলিশের অগ্রগতি কতদূর, সেই বিষয়ে কিছু জানে না কোকি। ডিটেকটিভদের কেউ যোগাযোগ করেনি ওর সাথে। নাওহিরোও ফোন দেয়নি।

তবে ওর বড় মামা কল করেছিল সেদিন। পুলিশের তরফ থেকে মিনেকোর মৃতদেহ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, এখন শেষকৃত্যের প্রস্তুতি শুরু করবে তারা। তবে তদন্তের বিষয়ে কোকির মতনই অন্ধকারে আছে সে-ও।

“আমরা কেউই আসলে জানতাম না মিনেকো ঠিক কি করতে চাইছিল ডিভোর্সের পরে। নতুন করে সবকিছু শুরু করার ব্যাপারে কথা বলেছিল কয়েকবার, তাই আমরাও বিরক্ত করতে চাইনি।”

মামার গলার সুর শুনেই কোকি বুঝতে পারে যে ডিভোর্সি, একাকী বোনের পাশে না দাঁড়ানোর আক্ষেপ থেকে এসব বলছে সে।

সেদিনই ওদের নাট্যদলের রিহার্সাল সেন্টারে এলো ডিটেকটিভ কাগা। কয়েকটা দৃশ্যের মহড়া শেষে কেবলই বিশ্রাম নিচ্ছিল সবাই।

কোকি আর কাগা বাইরের লবিতে গিয়ে একটা পুরনো বেঞ্চে বসলো।

“অভিনেতাদের আসলে মন অনেক শক্ত। এই যে আপনি এত বড় একটা ঘটনা সত্ত্বেও ঠিকই নিয়মিত রিহার্সালে আসছেন…”

“বাসায় বসে থেকে কিছু করার নেই তো আমার। মা’কে আর ফিরে পাব না। আগামীকাল শেষকৃত্যের বিষয়ে সাহায্য করার জন্যে ইয়োকোহামা যাচ্ছি,” ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে বলে কোকি। “তদন্ত কেমন চলছে আপনাদের? নতুন কিছু খুঁজে পেলেন?”

“চলছে ভালোই। কিছু সূত্রও পেয়েছি। এখন আমরা জানি আপনার মা মৃত্যুর দিনে ঠিক কি কি করেছেন,” শান্ত কণ্ঠে বলে কাগা। “তবে একটা বিষয় বেশ অদ্ভুত। খুন হবার আগে একটা ইমেইল লিখতে বসেছিল আপনার মা, কিন্তু সেটা আর পাঠানো হয়নি।”

নোটবুকটা খোলে কাগা।

“ওখানে লেখা-? ‘কেবলই ফিরেলাম আমি। প্রতিদিন যে প্লাজাতে যাই, সেখানেই গিয়েছিলাম। কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়েছি। কোবুনাচোর ঘড়ির দোকানের লোকটার সাথেও দেখা হয়েছিল। আমরা যে প্রতিদিনই প্রায় একই সময়ে হাঁটতে বের হই, এটা নিয়ে একচোট হাসাহাসিও হয়েছে।

“এসবের মানে কি?”

“আমি খোঁজ খবর নিয়েছি টুকটাক। এটা শুনলে অবাক হবেন যে আপনার মা যে কুকুরছানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে সেটা আসলে একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি।”

“মূর্তি?”

“সুইতেনগু মন্দিরের বিষয়ে কিছু জানেন? গর্ভধারণ ও নিরাপদ প্রসবের জন্যে প্রার্থনা করা হয় ওখানে।”

“হ্যাঁ, শুনেছি তো।”

“সেখানেই একটা মা কুকুর আর তার কুকুর ছানার মূর্তিটা আছে। অনেকেই বিশ্বাস করে যে কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া সৌভাগ্য বয়ে আনে। ইমেইলটা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে মিনেকো মিতসুই প্রায়ই যেতেন সেখানে

“মা ওখানে যাবে কেন প্রায়ই…?”

“তার অ্যাপার্টমেন্টে একটা নবজাতকের পরিচর্চার ম্যাগাজিন দেখেছিলেন, মনে আছে? সেখান থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে আপনার মা’র পরিচিত কারো বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল শিঘ্রই। নতুবা প্রতিদিন মন্দিরে যাওয়ার কথা না। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে হাজার খোঁজ করেও যার জন্যে আপনার মা মন্দিরে যেতেন তাকে খুঁজে পাইনি। আপনার বাবাকেও জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেননি।”

“আমিও আপনাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারব না, কোকি বলে। “যেমনটা আগেই বলেছি, গত দুই বছরে মা’র সাথে কোন কথা হয়নি আমার।”

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে কাগা।

“মেইলটা যাকে পাঠানো হচ্ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হত না?”

“করেছি তো। ওটা আপনার মা’র আইনজীবিকে পাঠানো হচ্ছিল আসলে। ডিভোর্সের ব্যাপারে তিনিই সাহায্য করেছিলেন মিস মিতসুইকে। আইনজীবি ভদ্রমহিলা জানতেন যে আপনার মা প্রতিদিন হাঁটতে যান, কিন্তু সুইতেনগু মন্দিরে যাওয়ার বিষয়ে কিন্তু জানা ছিল না তার। কোন একটা কারণে ইচ্ছেকৃতভাবেই এই বিষয়টা ধোঁয়াশায় রেখেছেন আপনার মা।”

“কেমন যেন অদ্ভুত গোটা বিষয়টা।”

মা আসলে কি নিয়ে ব্যস্ত ছিল? কি চলছিল তার মাথায়? মিনেকোর সাথে যোগাযোগ না করার জন্যে নিজেকে আরো এক চোট গালাগাল করে কোকি

“আমি দেখি খোঁজ নিয়ে আরো কিছু জানতে পারি কিনা। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।” বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায় কাগা।

******

পরদিন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে সাহায্য করার জন্যে ইয়াকাহামাতে চলে আসে কোকি। কফিনের ভেতরে শুয়ে থাকা মিনেকো দেখে মনে হয় যেন ঘুমোচ্ছে। গলার কাছটায় একটা সাদা স্কার্ফ জড়ানো, যেন শ্বাসরোধ করার দাগগুলো না বোঝা যায়।

মা’র পরিবারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বড্ড লজ্জা লাগে কোকির। মিনেকো যখন স্বাধীনভাবে নতুন করে জীবন শুরু করতে যায়, তখন তার পাশে থাকতে পারেনি ও।

তবে মিনেকোর পরিবারের কেউ ওর সাথে কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করলো না। বরং মা’কে হারানোর জন্যে স্বান্তনাই জোগাল সবাই। তবে, নাওহিরোর সাথে খুব একটা কথা বললো না কেউ।

কোকি বেশ কয়েকজনকে মিনেকোর মন্দিরে যাওয়ার ঘটনাটার ব্যাপারে বললো। কিন্তু কারোই বিন্দুমাত্র কোন ধারণা নেই যে কার জন্যে ওখানে যেত সে।

ফিউনারেল হলে মৃতদেহের সাথে কাউকে থেকে যেতে হতো সেই রাতটা। কোকি বলে দেয় যে সে-ই থাকবে। ওর কাজ খুব বেশি না, সুগন্ধী ধূপ যেন না নিভে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে এখনকার ধূপগুলো বিশেষভাবে তৈরি বিধায় সারারাতই হয়তো কিছু না করে বসে থাকতে হবে ওকে

সবাই চলে যাওয়ার পর ফিউনারেল হলে কোকি একাই রয়ে গেল। একটা স্টিলের চেয়ারে বসে বেদিতে রাখা মা’র ছবিটার দিকে তাকালো। হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মিনেকো ওখান থেকে সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ছবিটা এক বান্ধবীর সাথে ছুটিতে ঘুরতে গিয়ে তোলা।

হঠাৎই কোকির বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। চোখ জ্বলছে। মানুষের মন কি অদ্ভুত! কফিনের ভেতরে মা’র মৃতদেহ দেখেও বাস্তব মনে হয়নি তখন। অথচ এখন এই ছবিটা তারস্বরে যেন ঘোষণা করছে মিনেকো মিতসুই আর কখনোই ফিরে আসবে না।

পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এসময়। কল ধরার আগে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো কোকি। অ্যামি ফোন দিয়েছে।

“ভালো সময়ে কল দিয়েছ। আরেকটু পর আমিই ফোন দিতাম।“

কোকি খুলে বললো যে আজকের রাতটা ফিউনারেল হোমেই থেকে যাবে ও।

“ঠিক আছে। কিন্তু নিজের দিকে খেয়াল রেখ।“

“সমস্যা হবে না। তোমার ওখানে সব ঠিকঠাক?”

“আজকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। একজন ডিটেকটিভ এসেছিল আমাদের ওখানে। কাগা নাম তার।

ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে কোকি।

“কুরোচায়াতে?”

অ্যামির যে ক্যাফেটায় পার্ট-টাইম চাকরি করে সেটার নাম কুরোচায়া।

“হ্যাঁ। আমাকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে সে।”

“কি?”

“জিজ্ঞেস করে যে তোমার মা…তোমার মা কখনো এসেছিল কিনা।“

“আমার মা?” অ্যামির কথার পুনরাবৃত্তি করে কোকি। “আমার মা তোমাদের ক্যাফেতে যাবে কেন? সে তো জানত না আমি কোথায় থাকি, আর এটা তো আরো জানত না তোমার সাথে থাকছি আমি।”

“বেশ অনেকক্ষণ ছিল ডিটেকটিভ লোকটা। এমনকি ছবিও দেখায় একটা। আমাদের মালিকও ছিল সেখানে।”

“তিনি কি বলেন?”

“বলেন যে তোমার মা’কে আগে কখনো দেখেননি। ডিটেকটিভ লোকটা আমাদের কথা বিশ্বাস করেছে খুব সম্ভবত। কথা না বাড়িয়ে চলে যায় এরপর। এসব কেন জিজ্ঞেস করতে এসেছিল?”

“জানি না, অ্যামি। পরেরবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো, যদি দেখা হয় আর কি। আর কিছু?”

“নাহ।”

“ঠিক আছে। কালকে শেষকৃত্যের পর আমি চলে আসব।“

লাইন কেটে যায়। চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে কোকি। মা’র ছবিটার দিকে তাকায় আরেকবার।

তবে এবারে মিনেকোর মুখের হাসিটা রহস্যময় ঠেকে তার কাছে।

পাঁচ

কোকির মামার সুব্যবস্থাপনার কারণে কোন প্রকার ঝুট ঝামেলা ছাড়াই অনুষ্ঠান শেষ হয়। ওরা যেরকম লোক আসবে আশা করেছিল, সেরকমই এসেছে।

কফিনটা বাইরে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের অন্য সবার সাথে ফিউনারেল হল থেকে দাহ করার জায়গায় চলে আসে কোকি। তবে ওখানে অপ্রত্যাশিত একজনের সাথে দেখা হয়ে যায় ওর- কাগা। নিয়ম অনুযায়ী আজ একটা কালো টাই পরে এসেছে ডিটেকটিভ।

“এরকম একটা সময়ে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, কিন্ত একটা বিষয় আপনাকে যত দ্রুত সম্ভব জানানোর দরকার ছিল,” একবার বাউ করে বলে কাগা।

মিনেকোর দেহ দাহ করতে বেশ সময় লাগবে। কোকির একবার মনে হলো ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছে কিনা কাগা। ওকে সে যা-ই বলতে আসুক না কেন, নিশ্চয়ই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেটা।

দুইজন বাইরে চলে এলো। পাশেই সুন্দর একটা পার্ক। বেশ কয়েকটা বেঞ্চ ফাঁকা পড়ে আছে। ওগুলোর একটায় বসে পড়লো ওরা।

“আপনার মা কেন কোদেনমাচোতে থাকতে এসেছিলেন, সেটা জানতে পেরেছি আমরা,” কাগা শুরু করলো। “এবং আমাদের কোন ভুল হয়নি বলেই বিশ্বাস আমার।”

“বলুন তাহলে, কেন?”

“আপনি কি মিসেস মাচিকো ফুজিওয়ারা কাউকে চেনেন?”

“নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে…“

“মিসেস ফুজিওয়ারা আপনার মায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী। তিনি বলেছেন আপনাদের বাসায় নাকি প্রায়ই আসতেন একসময়।“

“ওহ, আচ্ছা,” কোকি বলে। “বুঝতে পেরেছি কার কথা বলছেন। হ্যাঁ, প্রায়ই আসতেন উনি। মা ‘মাচি’ বলে ডাকত।”

“হ্যাঁ, তিনিই।” মাথা নেড়ে বলে কাগা। “আপনার মা’র কম্পিউটার ঘাটাঘাটি করেছি আমরা। অ্যাড্রেস বুকে যার যার নাম পেয়েছি, সবার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু মিসেস ফুজিওয়ারাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারণ, তিনি এখন অ্যামেরিকার সিয়াটলে থাকেন স্বামীর সাথে। ওখানে একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন তার স্বামী। আজ সকালে অবশেষে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। তিনি আপনার মা’র মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু জানতেন না, কাজটা কার হতে পারে সেটা জানা তো দূরের কথা। তবে আমাদের তিনি বলেছেন কেন কোদেনমাচোতে থাকতে গিয়েছিলেন আপনার মা।”

“কেন?”

“আপনার জন্যে।”

“আমার জন্যে?”

“মিসেস ফুজিওয়ারা টোকিও থেকে সিয়াটলে যান গত মার্চে। দেশ ছাড়ার আগে একদিন নিহনবাশি দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ করেই পরিচিত একজনকে দেখতে পান। আপনি।” কোকির দিকে সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকায় কাগা। “একজন মেয়েকে পেছনে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে কোথাও চলেছিলেন আপনি। কিছুক্ষণ পর থেমে মেয়েটাকে নামিয়ে আবার চলে যান। মিসেস ফুজিওয়ারার যেহেতু আপনাকে অনুসরণ করার কোন উপায় ছিল না, তাই মেয়েটাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। খানিক বাদে একটা বন্ধ ক্যাফেতে ঢুকে পড়ে মেয়েটা। তথ্যটা আপনার মা’কে জানাতে দেরি করেননি মিসেস ফুজিওয়ারা। তিনি জানতেন যে আপনাকে হন্য হয়ে খুঁজছেন মিস মিতসুই। এর পরপরই যেহেতু কোদেনমাচোতে চলে আসেন আপনার মা, সেহেতু আমরা ধরে নিতেই পারি যে আপনাকে খুঁজতেই এসেছিলেন তিনি।”

হতবুদ্ধ ভঙ্গিতে কাগার কথা শুনে গেল কোকি। এখন অবধি ওর মনে একবারের জন্যেও এই চিন্তা আসেনি যে মিনেকো ওকে খুঁজতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাই সবচেয়ে যুতসই ব্যাখা। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর তার পরিবার বলতে একমাত্র কোকিই।

“তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করলো না কেন? অ্যামি কোথায় চাকরি করতো, সেটা তো জানা ছিল নিশ্চয়ই। ওকে জিজ্ঞেস করলেই হতো।”

“আপনার মা সেটাই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে যে আপনার গার্লফ্রেন্ডকে চাক্ষুস দেখার পর সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন তিনি।”

“মানে?”

“অ্যামেরিকায় চলে যাওয়ার পরেও আপনার মা’র সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন মিসেস ফুজিওয়ারা। সে কারণেই তিনি জানতেন যে মিস মিতসুই কোদেনমাচোতে থাকছেন। ধরেই নিয়েছিলেন খুব শিঘ্রই হয়তো আপনার সাথে দেখা হবে তার। কিন্তু একদিন হঠাৎ একটা ইমেইলে তাকে মিস মিতসুই বলেন যে আপাতত আপনাদের সাথে দেখা করবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দূর থেকে নজর রাখবেন কিছুদিন। হয়তো কোন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে ভেবে মিসেস ফুজিওয়ারা আর কিছু বলেননি।“

চুলে হাত বুলায় কোকি। “কেন?”

“মিসেস ফুজিওয়ারার মতে আপনার মা প্রায়ই যেতে অ্যামি আওইয়ামার কর্মস্থলে, কিন্তু কখনো নিজের পরিচয় দেননি। কারণ হিসেবে বলেছিলেন এতে মেয়েটা ভয় পেয়ে যেতে পারে।”

“তাই আপনি নিজেই কুরোচায়ায় গিয়েছিলেন। গতরাতে অ্যামি বলেছে আমাকে। পুরো বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকছে আমার কাছে। মানে, অ্যামি নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়েছে যে মা’কে কখনো দেখেনি সে।”

“সেটাই তো! তাহলে আপনার মা’র ইমেইলগুলো থেকে আমরা কি বুঝবো? মিসেস ফুজিওয়ারাকে কি সব বানিয়ে বানিয়ে বলতেন তিনি?”

“এরকম একটা বিষয় নিয়ে বানিয়ে কথা বলবে কেন?” ভ্রু কুঁচকে বলে কোকি। কেমন যেন অস্থির লাগছে অর।

কোকির অভিব্যক্তি দেখে একটা বড় হাসি ফোটে কাগার চেহারায়।

“ভাববেন না, বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলেননি তিনি। মিস মিতসুই আসলেই আপনার গার্লফ্রেন্ডের কর্মস্থলে অনেক বার গিয়েছেন। এটা শতভাগ সত্য।”

“কিন্তু অ্যামি তো বললো মা’কে কখনো- “

“দুঃখিত, আমি ঠিকভাবে বলতে পারিনি কথাটা,” কাগা বলে। “তিনি আসলে এমন একটা জায়গায় অনেকবার গিয়েছেন, যেখানে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে আপনার গার্লফ্রেন্ড চাকরি করে।“

কোকির বিমূঢ় চেহারা দেখে জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো কাগা। কোদেনমাচোর আশপাশের এলাকার একটা খসড়া ম্যাপ একে এনেছে সে। কোকি চিনতে পারল জায়গাটা।

“এটা নিয়ে এসেছেন কেন?”

“মিসেস ফুজিওয়ারা আপনাকে আর আপনার গার্লফ্রেন্ডকে দেখার পর মিস মিতসুইকে ইমেইল করে জানান দোকানটার অবস্থান। কিভাবে যেতে হবে সেটার বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে- ‘কোদেনমাচো চৌরাস্তা থেকে নিনগিয়োচোর দিকে এগোলে আরেকটা চৌরাস্তা চোখে পড়বে তোমার। বাম দিকে একটা স্যাঙ্কিয়ো ব্যাঙ্ক আছে দেখবে। বামে ঘুরলেই ব্যাঙ্কের পাশে একটা ক্যাফে চোখে পড়বে। ওটাই।’ দিক নির্দেশনাটা শুনে কেমন মনে হচ্ছে আপনার?”

“জানি না…মানে, শুনে তো ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।” ওই এলাকার একটা ছবি ভেসে উঠলো কোকির মনে। ভুল তো কিছু বলেনি মিসেস ফুজিওয়ারা।

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিলেন তিনি। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে আর কি।”

“বুঝলাম না।”

“মিসেস ফুজিওয়ারা যখন আপনাদের দু’জনকে দেখতে পান, তখন ছিল মার্চের প্রথম দিক। আর আপনার মা কোদেনমাচোতে যান এর দুই সপ্তাহ পর। বান্ধবীর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কোদেনমাচো চৌরাস্তা থেকে নিনগিয়োচোর এগোতে থাকেন। মিসেস ফুজিওয়ারা যে স্যাঙ্কিয়ো ব্যাঙ্কটার কথা উল্লেখ করেছেন ইমেইলে, সেটা ওখান থেকে তিন রাস্তা দূরে। কিন্তু দুই রাস্তা পরে প্রায় একই নামের আরেকটা ব্যাঙ্ক আছে। সেটার নাম স্যাঙ্কিয়ো-দাইতো ব্যাঙ্ক। স্যাঙ্কিয়ো ব্যাঙ্ক আর দাইতো ব্যাক একীভূত হয়ে যায় কিছুদিন আগে। মিসেস ফুজিওয়ারা আপনাদের দেখার পরে ঘটে ঘটনাটা। এবারে বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি? মিসেস ফুজিওয়ারা যেদিন ওখানে গিয়েছিলেন, সেদিনও ব্যাঙ্কটার নাম ছিল দাইতো ব্যাঙ্ক। কিন্তু আপনার মা যতদিনে সেখানে যান, নাম বদলে স্যাঙ্কিয়ো-দাইতো ব্যাঙ্ক হয়ে গেছে। তাই তিনি সেই গলিতেই ঢুকে পড়েন। এতে তাকে দোষ দেয়া যায় না।”

“কিন্তু মা ভুলটা বুঝতে পারেনি কেন? ওই ব্যাঙ্কের পাশে নিশ্চয়ই কোন ক্যাফে…” কাগার অভিব্যক্তি বদলে যেতে দেখে থেমে যায় কোকি। “অসম্ভব! মজা করছেন আপনি?”

“নাহ,” কাগা বলে। “ওই ব্যাঙ্কটার পাশেও একটা ক্যাফে আছে। তবে একদম সঠিকভাবে বললে ঠিক ক্যাফে না, একটা পেস্ট্রি শপ। কিন্তু সেখানেও একটা ছোট ক্যাফে এরিয়া আছে পেছন দিকে। চাইলে চা-কফি খাওয়া যায় সেখানে বসে। আপনার মা কেন ভেবেছিলেন যে তিনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, তা পুরোপুরি বুঝতে পারছি আমি।”

“মা তাহলে ওখানেই যেত নিয়মিত?”

“আমি খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। পেস্ট্রি শপটার নাম কুয়াত্রো। ওখানে যে মেয়েটা কাজ করে তাকে আপনার মা’র ছবি দেখালে সাথে সাথে চিনতে পারে। বলে যে বেশ কয়েকবার ওখানে গিয়েছেন মিস মিতসুই। অর্থাৎ, সেই মেয়েটাকেই আপনার গার্লফ্রেন্ড মনে করে বসেন তিনি।”

অবিশ্বাসে মাথা ঝাঁকায় কোকি।

“আমি বুঝতেই পারছি না কিছু। মেয়েটার সাথে কথা বললেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যেত। এরপরেও তো দু’মাস ওখানে গেছে সে।”

“তিনি কিন্তু মিসেস ফুজিওয়ারাকে বলেছিলেন যে আপাতত কিছুদিন দূর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। দোকানে গিয়ে মেয়েটাকে দেখার পর তাকে নিশ্চয়ই চমকে দিতে চাননি মিস মিতসুই। সবকিছু ঠিকঠাক গেলে এরপর কথা বলতে চেয়েছিলেন।”

“সেটা কেন?”

“আপনি যদি পেস্ট্রি শপটায় যান, তাহলে নিজেই বুঝতে পারবেন। মেয়েটাকে দেখে আসুন। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলবো যে কোদেনমাচোতে আপনার মা’র সময়টা দারুণ কাটছিল। চুপিসারে কারো খেয়াল রাখছিলেন তিনি। ভবিষ্যত নিয়েও আশাবাদী ছিলেন নিশ্চয়ই।”

কাগা কি বলছে তার মাথামুণ্ডু কিছুই মাথায় ঢুকছে না কোকির। এখনও পুরোপুরি ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে সে। “যান ওখানে একদিন, তাহলে বুঝতে পারবেন আমি কি বলেছি, কেন বলেছি, “ বলে ডিটেকটিভ।

ছয়

দোকান বন্ধ করার পনেরো মিনিট আগে এলো কেনিচি। আজকে একটা স্যুট তার পরনে।

“আমাদের কোম্পানির সবচেয়ে বড় কাস্টোমারদের একজনের অফিস কাছেই। তাদের সাথে মিটিং ছিল আজ। বসকে ফোন দিয়ে এখান থেকেই বাসায় ফেরার অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। একসাথে যাই তাহলে?”

“খুব ভালো করেছো। অপেক্ষা করতে করতে এক কাপ কফি খাও?” মিয়ুকি বলে।

পেস্ট্রি শপটার ক্যাফে এরিয়াতে চলে এলো কেনিচি। রেইকো নাকানিশি তার অর্ডার নিল আগেই পরিচয় হয়েছে দু’জনের।

কেনিচি বরাবরই ভীষণ খেয়াল রাখে মিয়ুকির, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে যত্নআত্তির পরিমাণটা বেড়ে গেছে বহুগুণে, ভাবে রেইকো।

এসময় পেটে একবার হাত বুলায় মিয়ুকি। ওর গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাস চলছে। এখন দূর থেকে দেখলেও বোঝা যায় ।

ক্যাশ রেজিস্টারের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটার দিকে তাকালো একবার। ফোনের সাথে একটা স্ট্র্যাপ ঝুলছে। আর স্ট্র্যাপটায় ঝুলছে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের কুকুর। কিছুদিন আগ অবধিও যে মহিলাটা নিয়মিত আসত দোকানে, সে এটা দিয়েছিল তাকে।

“সুইতেনগু মন্দির থেকে কিনেছি, যেন আপনার বাচ্চাটা একদম সুস্থ-সবল হয়,” দেয়ার সময় বলেছিল সে।

মিয়ুকি আসলে কখনোই বোঝেনি কেন তার সাথে সবসময় ওরকম ভালো ব্যবহার করতো সে। কোনদিন বুঝতেও পারবে না। কারণ মারা গেছে ভদ্রমহিলা। এর আগের দিন যে ডিটেকটিভ লোকটা এসেছিল, সে বলেছে কথাটা।

প্রথমে একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে ছবির মহিলাকে চিনতে পারছে কিনা। মিয়ুকি অবাক হয়ে যায়। ওই মায়াকাড়া হাসিটা যেখানেই দেখবে, সেখানেই চিনতে পারবে সে। জবাবে এটাই বলে। কিন্তু তার জবাব শুনে হঠাৎ বিষণ্নতা ভর করে ডিটেকটিভের চেহারায়। এরপর আরো কয়েকটা প্রশ্ন করে। মহিলার সাথে কি বিষয়ে কথা হতো, শেষ কবে দোকানে এসেছিল সে- এসব।

অস্বস্তির পরিমাণটা বাড়তে থাকায় মিয়ুকি এক সময় নিজেই প্রশ্ন করে বসে। কি হয়েছে? তিনি কি ঠিক আছেন?

প্রথমে জবাব দিতে চায় না ডিটেকটিভ। মিয়ুকির ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হয়। মারা গেছে সেই মায়াকাড়া চাহনির ভদ্রমহিলা। না, মারা যায়নি, খুন করা হয়েছে তাকে!

ভদ্রমহিলার নাম কখনোই জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি মিয়ুকির কিন্তু কথাটা শুনে আর কান্না চেপে রাখতে পারেনি। কষ্টে দুই চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে টপটপ করে।

নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে ডিটেকটিভের প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দেয়ার চেষ্টা করে। তদন্তের কাজে আসবে, এরকম খুব বেশি কিছু না জানাতে পারলেও স্মৃতিগুলো ঠিকই মনে পড়ে যায়।

“আবারো আসতে পারি,” যাওয়ার সময় বলে যায় ডিটেকটিভ। লোকটার চেহারা থেকে সমবেদনা আর সহমর্মিতা ঠিকরে বেরুচ্ছিল তখন। মিয়ুকি বুঝতে পারে না মহিলার কথা শুনে এতটা আবেগী কেন হয়ে উঠেছিল ডিটেকটিভ।

দোকানের বাইরে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। কাঁচের দরজাটা খুলে যায় এসময়, ভেতরে প্রবেশ করে এক অল্প বয়সী যুগল। বিশের আশপাশে হবে দু’জনই।

“শুভ সন্ধ্যা,” অভ্যাসবশত বলে বসে মিয়ুকি।

যুগলের আচরণ কেমন যেন অন্যরকম ঠেকে তার কাছে। মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে আর ছেলেটা হা করছে দেখছে তাকে। অদ্ভুত, মিয়ুকি ভাবে।

মুখে কেবলই আন্তরিক একটা হাসি ফুটিয়েছে সে, এসময় ভীষণ অবাক হতে হয়। ছেলেটার চোখআগে কখনো তাকে দেখেনি মিয়ুকি, কিন্তু চোখ দু’টো কেন যেন খুব পরিচিত লাগছে।

ক্যাশ রেজিস্টারের দিকে তাকালে পাশে রাখা ফোনটা নজরে আসে। স্ট্র্যাপটাও চোখে পড়ে আবার। আবারো মুখ তুলে তরুণের দিকে তাকায় মিয়ুকি।

ছেলেটার চোখজোড়া হুবহু ওই ভদ্রমহিলার মতন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *