অধ্যায় ৪ – ঘড়ির দোকানের পোষা কুকুর
এক
এসি পুরোদমে চলছে। তা সত্ত্বেও ভিজে উঠেছে আফিকুমি ইয়োনেওকার বগলের কাছটা। এই মুহূর্তে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে ব্যস্ত সে। আঙুলের ডগাগুলো নড়ছে শিল্পীর হাতের মতন। এরকম সময়েই সবচেয়ে বেশি ঘামে সে। এজন্যে অবশ্য একটা বাড়তি টি-শার্ট এনে রেখেছে দোকানে। হাতের এই কাজটা শেষ করে কাপড় বদলে ফেলব, মনে মনে ভাবে আফিকুমি। হাতে ধরা সন্না(ক্ষুদ্র চিমটা) দু’টো চলছে আগের মতনই।
কিছুক্ষণ পর আকাঙ্খিত স্কু’টা জায়গামতো বসিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা। স্কুটা বড়জোর এক মিলিমিটার হবে দৈর্ঘ্যে। দোকানে ঢোকার দরজাটা খুলে গেল এসময়। আরেকটু আগে এলেই কাজটা ঘেটে যেত, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। অনেক সময় এরকম হুটহকট কাস্টোমার ভেতরে ঢুকে গেলে শুধুমাত্র মনোযোগই বিঘ্নিত হয় না, প্রায়শই হাত থেকে জরুরী কোন যন্ত্রাংশ পড়ে যায় মাটিতে।
যে লোকটা ভেতরে ঢুকেছে তার বয়স হবে মধ্য ত্রিশের আশপাশে, আফিকুমির চাইতে একটু বড়। টিশার্টের উপরে একটা শার্ট চাপানো তার। হাতে ছোট ব্রিফকেস। একদম পেটানো শরীর, এক ছটাক মেদ নেই চেহারার কোথাও। মুখে হাসি লোকটার। এটা স্বস্তি দিল আফিকুমিকে। কারণ লোকটার দৃষ্টিতে এমন কিছু একটা আছে যা দেখলে মনে হয় তাকে ঘাটানো ঠিক হবে না।
“শুভ অপরাহ্ন,” বলে আফিকুমি।
আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে তার দিকে একটা ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে ধরলো লোকটা।
“আসলে আজকে কোন ঘড়ি কিনতে আসিনি আমি।”
ভিজিটিং কার্ডের লেখাগুলো পড়ে চেহারা শক্ত হয়ে গেল আফিকুমির। ভদ্রলোকের নাম কিয়োচিরো কাগা। নিহনবাশি থানা থেকে এসেছে।
কোন সমস্যা হয়েছে কি?” জিজ্ঞেস করে আফিকুমি।
“বলতে পারেন,” স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি তথ্য দেয়ার ইচ্ছে নেই ডিটেকটিভের। “মি. গেনিশি তেরাদা আছেন?”
“জ্বি। উনিই এই দোকানের মালিক।“
দোকানটার নামই ‘তেরাদা ক্লক শপ’।
“উনি আছেন তাহলে?”
“পেছনের ঘরে আছেন। ডাক দিব?”
“যদি কিছু না মনে করেন,” হেসে বলে কাগা।
দোকানের পেছনে মূল ওয়ার্কশপ। আর সেটার পেছনে তেরাদা পরিবারের লিভিং রুম। এই মুহূর্তে ওয়ার্কশপে বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে একটা আধখোলা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে গেনিশি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে।
“বস?” আফিকুমি ডাক দেয়।
“একটা গিয়ারে সমস্যা।”
“কি?”
“দু’টা ঘাট খুলে পড়েছে।” ছোট গিয়ার হুইলটার দিকে দেখিয়ে বলে গেনিশি।
সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে আফিকুমি। ভুল বলেনি তার বস। জটিল নকশার যন্ত্রাংশগুলোর মধ্যে একটা গিয়ার আসলেই নষ্ট।
“আপনার জন্যে খুব বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।”
চোখ কপালে তুলে আফিকুমির দিকে তাকায় গেনিশি। কেন সমস্যা হবে না?”
“হবে কেন? গিয়ারটা তো বেশি ছোট না। নতুন দু’টা ঘাট সোল্ডার করে দিলেই হবে। আপনি চাইলে আমি করতে পারি কাজটা।”
“তুমি কি গর্দভ নাকি?” হিসিয়ে ওঠে গেনিশি। “এখানে তো মূল সমস্যাটা ঘাট লাগানো নিয়ে না; কেন ঘাটগুলো খুলে গেল সেটা জানতে হবে আগে। চাইলে আমি নিজেই বদলে দিতে পারবো। কিন্তু এতে যে পরবর্তীতে আরো ঘাট খুলবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? আর তুমি বলছো নতুন ঘাট জোড়া দিতে? এতদিন ধরে কি শিখলে, বলো তো?” “
“তাহলে এখন পুরো নতুন একটা গিয়ার হুইল বসাবেন? “নিদেনপক্ষে সেটা তো করতেই হবে,” বলে আবারো ঘড়িটার দিকে মনোযোগ দিল গেনিশি।
আফিকুমি এবারে বুঝতে পারছে তার বসের দুশ্চিন্তার কারণ। ঘড়িটা হচ্ছে একটা অ্যান্টিক, অনেক আগের জিনিস। এটার জন্যে নতুন যন্ত্রাংশ খুঁজে বের করা রীতিমত অসম্ভব এখন। গেনিশিকে নিজ হাতে নতুন একটা গিয়ার হুইল তৈরি করতে হবে।
ঘড়িটা যে কাস্টোমার নিয়ে এসেছিল, সে শুরুতেই বলে দিয়েছে খুব বেশি পয়সা খরচ করতে ইচ্ছুক নয় এটার পেছনে। এখন নতুন গিয়ার হুইল বানাতে গেলে খরচ আলবত বেড়ে যাবে। আর গেনিশির কথার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে সে অন্যান্য গিয়ার হুইলগুলোর অবস্থা নিয়েও চিন্তিত। এখন সেই কাস্টোমারের সাথে আবার দেখা হলে কথা কাটাকাটি হয়ে যেতে পারে, সেজন্যেই গেনিশি অস্থির হয়ে আছে মনে মনে।
“ওহ, বস। বলতে ভুলে গেছি। বাইরে পুলিশের একজন লোক অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। কি নিয়ে যেন কথা বলবে।” কাগার কার্ডটা তাকে দেখায় আফিকুমি।
“পুলিশ এসেছে? কেন?”
আমি জানি না,” একদিকে মাথা কাত করে আফিকুমি।
“নিশ্চয়ই ওই বদটার কাজ। কোন একটা ঝামেলা করছে,” ধীরে ধিরে সামনের ঘরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ায় গেনিশি।
বসের পেছন পেছন যায় আফিকুমি। ওয়ার্ক টেবিলে রাখা একটা ঘড়ি মনোযোগ দিয়ে দেখায় ব্যস্ত কাগা। আফিকুমি এই ঘড়িটা নিয়েই কাজ করছিল একটু আগে।
“আমি গেনিশি তেরাদা,” গেনিশি বলে।
“বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, মি. তেরাদা। আমি জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ, তবে আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।”
“কি?”
“আপনি কি মিনেকো মিতসুই নামে কাউকে চেনেন?”
“মিতসুই? আমাদের এখানে কোন কাস্টোমার হতে পারে, “ডান চোখের ভ্রু’র কাছটা চুলকে নিয়ে বলে গেনিশি।
আফিকুমি এই নামের কোন কাস্টোমারকে চেনে না।
মাথা ঝাঁকায় কাগা। “আমার মনে হয় আপনি তাকে চেনেন। এই দেখুন,” বলে ব্রিফকেস থেকে একটা ছবি বের করে কাগা। রিডিং গ্লাস চোখে দিয়ে ছবিটার দিকে তাকায় গেনিশি।
“তাকে কোথাও দেখেছি আমি, কিন্তু সেটা যে কোথায় তা মনে করতে পারছি না,” গলা খাদে নামিয়ে বলে।
“জুনের দশ তারিখ সন্ধ্যা ছ’টার দিকে কোথায় ছিলেন আপনি?” কাগা জানতে চায়।
“জুনের দশ তারিখ?” ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায় গেনিশি। “মানে পরশু দিন?”
“বস,” পাশ থেকে আফিকুমি বলে ওঠে। “ছ’টার সময় তো বোধহয় ডনকিচিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন।”
“কি? ওহ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমাদের কুকুরটাকে হাঁটাতে বের হয়েছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে যাই আমরা।”
এবারে আন্তরিক একটা হাসি উপহার দিল কাগা।
“হয়তো হাঁটার পথে কারো সাথে দেখা হয়েছিল আপনার? “কারো সাথে দেখা হয়েছিল…?” গেনিশি বলে। পরমুহূর্তেই বিস্ফোরিত নয়নে কাগার দিকে তাকায় সে।
“ওনার সাথেই দেখা হয়েছিল!”
“মনে পড়েছে তাহলে?”
“হ্যাঁ। কুকুরটাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়ে তাকে প্রায়ই দেখতাম আমি। আমাকে খুব সম্ভবত নিজের নামও বলেছিল।”
“ওনার পুরো নাম মিনেকো মিতসুই। আপনি কি নিশ্চিত যে তার সাথে দেখা হয়েছে?”
“হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। মানে হাঁটার সময় কয়েকবার কুশল বিনিময় হয়েছে আর কি,” ছবিটা কাগাকে ফিরিয়ে দেয় গেনিশি।”
“কোথায় দেখা হয়েছিল।
“দেখা হয়েছিল আপনার–”
এটুকু বলেই থেমে যায় গেনিশি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ডিটেকটিভের দিকে। “দাঁড়ান, দাঁড়ান। প্রথমে আমাকে জানতে হবে কিসের তদন্ত করছেন আপনি? ওনার সাথে দেখা হওয়ায় কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে নাকি?”
“না, না। আমি আসলে এমনিই একটু খোঁজ খবর করছি। দয়া করে বলতে পারবেন মিস মিতসুইয়ের সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল আপনার?”
“বলবো না কেন। আমার তো লুকোনোর কিছু নেই। পার্কে দেখা হয়েছিল।”
“পার্কে? কোন পার্কে?”
“হামাচো পার্ক। এখানে যাদের কুকুর আছে, তাদের জন্যে বিশেষ একটা জায়গা ওটা। থিয়েটারটা থেকে একটু সামনে এগোলে…”
শুকনো হেসে হাত উঁচিয়ে গেনিশিকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল কাগা।
“আমি চিনি জায়গাটা। মিস মিতসুই কি সেদিন একাই ছিলেন?”
“হ্যাঁ। একাই থাকেন সাধারনত।”
“কি নিয়ে কথা হয়েছিল আপনাদের?” পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে কাগা
“কি নিয়ে কথা হয়েছিল? যেমনটা আপনাকে বললাম ডিটেকটিভ। সাধারণ কুশল বিনিময় ছাড়া ওরকম কোন কথা হয় না আমাদের মাঝে।“
“মিস মিতসুই কি তখন কোথাও যাচ্ছিলেন, জানেন আপনি? ওরকম কিছু বলেছিলেন?”
“এক মুহূর্তে ভেবে বুকের ওপরে হাত বেঁধে মাথা ঝাঁকায় গেনিশি। “না, আমার সাথে এই বিষয়ে কোন কথা হয়নি তার। দেখে তো মনে হয়েছিল একা হাঁটতে বেরিয়েছেন।”
“কি পরে ছিলেন তিনি তখন? কোন ব্যাগ সাথে ছিল?”
“কি পরে ছিল এটা আমার মনে নেই,” গেনিশি ভ্রু কুঁচকে বলে। “মনে হয় না কোন ব্যাগ ছিল সাথে, তবে এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”
হাসি চাপতে কষ্ট হলো আফিকুমির। নিজে কি গায়ে দিয়েছে, সেটা জিজ্ঞেস করলেই হয়তো বলতে পারবে না গেনিশি। অন্য একজন নারী দিন আগে কি পরে হাঁটতে বেরিয়েছিল, সেটা বলা তো দুরের কথা। এমনকি তার নিজের স্ত্রী’ও যদি দারুণ কিছু পরে বাইরে যায়, তাহলে গেনিশি ভাববে সে হয়তো বাজার করতে গেছে।
“মিস মিতসুইকে দেখে কেমন মনে হয়েছিল আপনার?”
“জ্বি?”
“মানে অন্যরকম কিছু চোখে পড়েছিল সেদিন তার মধ্যে? যে কোন কিছু হতে পারে সেটা।”
“নাহ, বিশেষ কিছু মনে হয়নি দেখে। ভালো মেজাজেই ছিলেন।”
“ভালো মেজাজে ছিলেন?” এই প্রথমবারের মত কাগার দৃষ্টিতে সন্দেহ খেলা করতে দেখল আফিকুমি।
“আসলে ‘ভালো মেজাজ’ হয়তো ঠিক শোনাচ্ছে না। তবে এটুকু মনে হয়েছিল যে হাঁটতে ভালোই লাগছে তার। বুঝতে পারছেন কি বলছি?”
“জ্বি, নিশ্চয়ই,” উৎসাহ ব্যঞ্জক স্বরে বলে নোটবুকটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল কাগা। “আপনার কাজের মাঝে এসে বাগড়া দেয়ার জন্যে দুঃখিত।”
“আর কিছু কি জানার আছে আপনার?”
“না, আর কিছু নেই। তবে-” বলে ওয়ার্কবেঞ্চে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকায় কাগা। “এই ঘড়িটা বেশ অদ্ভুত কিন্তু। এরকম তিনটা ডায়াল।”
কাগা যে ঘড়িটার কথা বলছে, সেটার নকশা আসলেই অনন্য। একটা প্রিজমের তিন ধারে তিনটা ডায়াল।
“সবগুলো ডায়াল কি একই সময় দেখায়?”
“হ্যাঁ, সব ডায়ালের কাটাই একসাথে নড়ে “একসাথে?”
“একটা ডায়াল খারাপ হয়ে গেলে বা কাটা ঘোরা বন্ধ হলে বাকিগুলোও থেমে যায়।”
“বাহ! দারুণ তো!” ঘড়িটার দিকে শেষবারের মতন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আফিকুমি আর গেনিশির উদ্দেশ্যে বাউ করলো কাগা। সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ,” বলে বেরিয়ে গেল দোকান ছেড়ে।
“এ কিরকম উপদ্রব ভাই? এরকম ডিটেকটিভ তো আগে দেখিনি,” গেনিশির কণ্ঠে কৌতূহল।
দুই
ডিটেকটিভ দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার দুই কি তিন মিনিটে মধ্যে ফিরলো শিমাকো। তার একহাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ, আরেক হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ। এমনিতেও লম্বা-চওড়া গড়নের সে। আজ আরো বেশি অতনু মনে হচ্ছে। আফিকুমি তেরাদা জুটির নাম দিয়েছে ‘লম্বু যুগল’।
“দাইফুকু পিঠা নিয়ে এসেছি। চলো সবাই মিলে চা খাওয়া যাক,” বলে পেছনের ঘরে উধাও হয়ে গেল সে।
কয়েক মিনিট পর আফিকুমিকে ডাক দিল দোকানের পেছনের ওয়ার্কশপ থেকে। ওখানকার ওয়ার্কবেঞ্চের পাশেই শোভা পাচ্ছে তুলতুলে, মিষ্টি পুর ভর্তি পিঠা আর তিন কাপ বার্লি চা। প্রতিদিন দুপুর তিনটায় ঘটা করে চা খায় তেরাদারা।
“কে যেন কালকে খবরের কাগজে পড়ে বললো কোদেনমাচোতে নাকি জঘন্য একটা ঘটনা ঘটেছে। ডিটেকটিভ ভদ্রলোজ সেজন্যেই এখানে এসেছিল কিনা কে জানে,” শিমাকোকে সব জানানোর পর মন্তব্য করে সে।
“কেউ একজন খবরের কাগজে পড়ে বলেছে? মানে তুমি নিজে পড়োনি?” গেনিশি বলে।
“না। বাজারে গিয়েছিলাম যে, তখন কয়েকজন আলাপ করছিল। “ওহ, তাই তো বলি।”
“মানে? আমি নিজেও মাঝে মাঝে খবরের কাগজ পড়ি কিন্তু।”
“স্বামী ও স্ত্রী’র পারস্পরিক বিষদৃষ্টি বিনিময় পর্বকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গত দুই দিনের খবরের কাগজ নিয়ে বসলো আফিকুমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেল প্রতিবেদনটা। কোদেনমাচোতে একটা খুন হয়েছে। ভিক্টিম একজন পয়তাল্লিশ বছর বয়সী মহিলা। একাই থাকত সে। মহিলার নাম দেখে খাবি খাওয়ার জোগাড় হলো আফিকুমির। মিনেকো মিতসুই।
প্রতিবেদনটা গেনিশিকে দেখাল। মুখ কালো করে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করলো ঘড়ির দোকানের প্রবীণ মালিক।
“বিশ্বাসই হচ্ছে না। এই তো সেদিনও দেখলাম। জঘন্য ব্যাপার।”
“মহিলা কেমন ছিল?” শিমাকো জিজ্ঞেস করে।
“তার ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানি না আমি। তবে রাস্তায় দেখা হলে টুকটাক কথা হতো আর কি।”
“পয়তাল্লিশ বছর বয়সেও একা থাকত। এই বয়সে কেউ অবিবাহিত শুনলে কেমন যেন লাগে।”
“খুব সম্ভবত একবার বলেছিল তার একটা ছেলে আছে।
“স্বামী মারা গেছে তাহলে?”
“সেটা আমি জানি না। এই ব্যাপারে কিছু বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি।”
“চাকরি-বাকরি কিছু করতো কে জানে।“
“উফ, কত প্রশ্ন করো তুমি? আমি জানি না। কতবার বলতে হবে এক কথা?”
“তোমাকে তো কিছু জিজ্ঞেস করিনি আমি। একাই ভাবছিলাম। বেচারি। পয়তাল্লিশ বছর বয়স। আমার সমানই হবে প্রায়,” প্রতিবেদনটা পড়ার সময় মাথা বারবার এদিক-ওদিক ঝাঁকাতে লাগল শিমাকো।
“প্রায় সমান মানে? হুহ! তোমার বয়স পঞ্চাশের অনেক বেশি।”
ওই তো। যাহাই পয়তাল্লিশ, তাহাই পঞ্চান্ন। ওনার বাচ্চাটা কত বড় কে জানে! আমাদের কানায়ে থেকে কম হবে বোধহয়।”
কানায়ে নামটা কানে আসা মাত্র মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিল আফিকুমি।
“এসবের মধ্যে আবার ওকে টানছ কেন?” এবারে গেনিশির কণ্ঠস্বর আগের তুলনায় অনেক বেশি কর্কশ শোনালো।
“ওরকম কোন কারণ নেই। আমি কেবল ওই ভদ্রমহিলার ছেলে বা মেয়ের বয়স কত হতে পারে, সেটা ভাবছিলাম।”
“আমাদের মেয়ের সাথে তো আর ঘটনার দুর দুরান্ত পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই। ভেগে গেছে কানায়ে। ওর ব্যাপারে আমি একটা কথাও শুনতে চাই না।”
“নিজের মেয়ের নাম ইচ্ছে করলে বলতেই পারি আমি।”
“চুপ করো তুমি। একদম চুপ!”
যেমনটা আফিকুমি ধারণা করেছিল, ঘরের পরিবেশ আসলেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পিঠাগুলো খেয়ে চা পুরোপুরি গলাধঃকরণের আগেই নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল।
*******
ঘড়ির দোকানটায় কাগা দ্বিতীয়বার উপস্থিত হল পরদিন সন্ধ্যায়। গেনিশি কেবলই ডনকিচিকে হাঁটিয়ে ফেরত এসেছে। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। আফিকুমি বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
“গতকাল বলছিলেন মিনেকো মিতসুইয়ের সাথে হামাচো পার্কে দেখা হয়েছিল আপনার। এই বিষয়ে আপনি কি পুরোপুরি নিশ্চিত?” আগের দিনের তুলনায় আজকে কিছুটা কঠোর শোনাচ্ছে কাগার কন্ঠস্বর। চেহারার অভিব্যক্তিও অন্যরকম।
“মোটামুটি নিশ্চিত।”
“একটু ভালোমত চিন্তা করে দেখুন তো। স্মৃতিরা প্রায়ই ধোঁকা দেয় আমাদের। শেষ যেবার দেখা হয়েছিল আপনাদের, সেদিনের কথা ভাবুন। আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত তার সাথে হামাচো পার্কেই দেখা হয়েছিল?”
“আরে, আপনি দেখি আমার মিসেসের মত শুরু করলেন, ডিটেকটিভ। যা বলছি, জেনে-বুঝেই বলছি।”
“তাই?” কাগার চেহারায় সন্দেহ।
“আমি বরং জানতে চাই যে আপনি কি করে জানলেন আমার সাথে মিস মিতসুইয়ের দেখা হয়েছিল সেদিন। এই বিষয়টা খোঁচাচ্ছে আমাকে।”
“বলিনি আপনাকে? তার কম্পিউটারে একটা খসড়া ইমেইল পেয়েছি আমরা ড্রাফট ফোল্ডারে। সেখানে লেখা ছিল যে কোরুনাচোর ঘড়ির দোকানের মালিকের সাথে দেখা হয়েছে হাঁটার সময়।“
“ইমেইল!” গেনিশি খানিকটা অবজ্ঞাভরে বলে।
“গতকাল আপনি এটাও বলেছিলেন যে মিস মিতসুইক একাই হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। এই বিষয়েও কি আপনি নিশ্চিত? একটু ভেবে উত্তর দিন, প্লিজ।”
“হ্যাঁ, একাই ছিল। আর কেউ সাথে থাকলেও আমার চোখে পড়েনি অন্তত।”
“হামাচো পার্কেই দেখা হয়েছে?” অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে গেনিশির দিকে তাকায় কাগা।
“হ্যাঁ। হামাচো পার্ক,” পাল্টা দৃষ্টি হেনে বলে গেনিশি।
সেদিন হাঁটা শেষে কখন দোকানে ফিরেছিলেন?”
“এই সাতটার দিকে।”
ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে যায় কাগা।
“এই ডিটেকটিভ আসলেই অদ্ভুত,” বিড়বিড় করে বলে দোকানের পেছনে চলে যায় গেনিশি।
তিন
পরদিন দরজা খোলার শব্দ শুনে মুখ তুলেই অবাক হয়ে গেল আফিকুমি। কাগা এসেছে, আবার! এই নিয়ে পরপর তিনদিন দোকানে পা রাখল নিহনবাশি থানার নবাগত এই ডিটেকটিভ। তবে আজ তার পরনে ধূসর রঙের একটা স্যুট।
“আবার এসেছেন?”
“জানি, বারবার বিরক্ত করছি আপনাদের। মাফ করবেন। একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না আমার।”
“বসের সাথে যদি কথা বলতে চান, তাহলে বলবো ভুল সময়ে এসেছেন। বাইরে গিয়েছেন একটু। ফিরতে দেরি হবে,” আফিকুমি বলে। এক বন্ধুর মেমোরিয়াল সার্ভিসে গেছে গেনিশি।
“তাই নাকি? তাহলে তো ঝামেলা।” তবে ডিটেকটিভের চেহারা দেখে মনে হলো খুব একটা হতাশ হয়েছে সে। আফিকুমির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। “প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজতে চললো। কুকুরটার হাঁটার সময় না এটা? মিসেস তেরাদা আজ ডনকিচিকে নিয়ে বেরুবেন নাকি?”
“মিসেস তেরাদা একটু বাজার করতে বেরিয়েছেন। আমিই যাব আজকে।”
“তাহলে দোকানের কি হবে?”
“বন্ধ করে যাব। বিকেলের এই সময়ে খুব বেশি কাস্টোমার আসে না। তাছাড়া প্রতিদিনই ছ’টা নাগাদ দোকান বন্ধ করি আমরা। আজকে বস বলে গেছে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বন্ধ করে দিতে।”
“আচ্ছা। তাহলে আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনারা হাঁটার সময় কি আমি থাকতে পারি?”
“মানে, ডনকিচিকে হাঁটানোর সময়? নিশ্চয়ই! কোন সমস্যা নেই। তবে আমি প্রতিদিনকার মতন সেই একই পথেই যাব কিন্তু।”
“আপনাদের প্রতিদিনকার পথ নিয়েই আমার মূল আগ্রহ। তাই, আপনি যদি কিছু না মনে করেন…”
ভদ্রতাবশত মাথা নিচু করে অনুরোধ জানালো কাগা। জবাবে শব্দ করে একবার শ্বাস ছাড়ল আফিকুমি।
ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় সিকিউরিটি গেটটা নামিয়ে দিয়ে পাশের একটা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আফিকুমি। সামনেই অপেক্ষা করছিল কাগা। কুকুরটাকে দেখে হাসি ফুটল ডিটেকটিভের মুখে।
“আপনাদের কুকুরটা যে একটা শিবা ইনু, এটা জানতাম না। বয়স কত?”
“আট বধহয়।”
কাগার দিকে একবার তাকিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল ডনকিচি। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে এখন। গেনিশি সবসময়ই অভিযোগ করে আসছে যে তাদের কুকুরটার মধ্যে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু ডনকিচিকে সবচেয়ে বেশি আদর সে-ই করে।
কুকুরটা হাঁটতে শুরু করলে পিছু নিল আফিকুমি। ডনকিচি ভালো করেই জানে কোনদিক দিয়ে যেতে হবে।
“ওর নামটা কিন্তু কুকুর হিসেবে অদ্ভুত। ডনকিচি। আপনার বস রেখেছে নাকি?” আফিকুমির পাশে পাশে হাঁটার সময় জিজ্ঞেস করে কাগা।
“না, ওনার মেয়ে রেখেছে নামটা। কুকুরটা আসলে তার জোরাজুরিতেই কেনা হয়।”
“উনাদের একটা মেয়েও আছে?”
“আমার বেশি কথা বলার অভ্যাসটা গেল না, ভাবে আফিকুমি। তবে আজকে একজন ডিটেকটিভের সাথে কথা বলছে সে। লোকটা চাইলেই যে কোন তথ্য নিজেই বের করে নিতে পারে। তাই কিছু গোপন করার কোন মানে নেই।
“কিছুদিন আগেই বিয়ে করে বাড়ি থেকে চলে গেছে সে। এখন রিয়োগোকুতে থাকে।”
“তাই নাকি? সে-ই নাম রেখেছিল ডনকিচি?”
“আসলে সে নাম রাখে ডনকি। কিন্তু তার বাবা বলে যে ইংরেজি নামটা তাদের পরিবারের সাথে যাচ্ছে না। তাই ওকে ডনকিচি বলে ডাকতে শুরু করে তারা। ব্যস, ওটাই রয়ে যায়। আমারও মনে হয় যে ওকে ডনকি’র চাইতে ডনকিচি নামেই বেশি মানায়।”
ডনকিচি নিজেই বেশ উৎসাহ নিয়ে গদাইলস্করি চালে দুলে দুলে হাঁটছে। টানটান হয়ে আছে গলার বেল্টটা। জিহ্বা ঝুলছে খোলা মুখটা থেকে। গরম লাগছে নিশ্চয়ই।
এলিমেন্টারে স্কুলটা পার হয়ে বামের রাস্তায় ঢুকে পড়লো ওরা একটা নামকরা চিকেন রেস্তোরাঁ আছে এখানে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় নিনগিয়োচো বুলভার্দে চলে এলো। আরেকটু সামনে গেলেই আমাজাকি গলি আর হামাচো পার্ক।
তবে এখানে হঠাৎ করেই থেমে গেল ডনকিচি। বারবার ডানে- বামে তাকাচ্ছে। যেন বুঝতে পারছে না কোন দিকে যাবে।”
“তোর আবার কি হলো আজকে?”
“আমরা বোধহয় ভুল পথে যাচ্ছি।”
“না, এদিক দিয়েই যাই সবসময়।”
আফিকুমি বেল্টটায় একবার টান দিয়ে আমাজাকি গলির দিকে যাওয়ার ইশারা করলো ডনকিচিকে। বাধ্য ছেলের মতন আবারো আগের ছন্দে হাঁটতে শুরু করলো কুকুরটা।
কিছুদুর যাওয়ার পর একটা ট্রাফিক আইল্যান্ডে পৌঁছে গেল ওরা। আইল্যান্ডের দুই পাশে বিপরীতমুখী দু’টা রাস্তা। আইল্যান্ডটা সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা। প্রবেশপথের পাশে যোদ্ধা সন্ন্যাসী বেনকেইয়ের একটা মূর্তি। ডনকিচি মুর্তির বেদিতে পা ঘষার চেষ্টা করলে আফিকুমি বেল্টে টান দিয়ে সরিয়ে নিল তাকে।
“আপনাদের দোকানের তিন কোণা ঘড়িটা কিন্তু আসলেই দারুন,” আনমনা স্বরে বলে কাগা। “বিশেষ করে একটা নষ্ট হলে, তিনটাই থেমে যাওয়ার ব্যাপারটা। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম প্রতিটা ডায়াল আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে। কিন্তু ওগুলো একসাথে ওভাবে চলে কিভাবে?”
হাসে আফিকুমি। “আসলেই দারুণ, তাই না? আমি প্রথমবার ঘড়িটা খোলার পর অবাক হয়ে যাই। আগেকার দিনের ঘড়ি নির্মাতাদের হাত ছিল একদম অন্যরকম।”
ওটার ভেতরের কলকব্জা কিভাবে কাজ করে সেটা আমাকে ব্যাখা করা যাবে?
“আসলে…পরে,” নাক দিয়ে একবার শব্দ করে আফিকুমি।। সামনের থিয়েটারটা দেখা যাচ্ছে এখন। ওখান থেকে হামাচো পার্ক খব বেশি দুরে নয়।
“তেরাদা ক্লক শপের বয়স কেমন?” কথা বলার বিষয় পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করে কাগা।
“এটা আমার বসের বাবার ব্যবসা। তখন দোকানটা ছিল কায়াবাচোর কাছে। কিন্তু ওই দোকানটা পুড়ে গেলে এখনকার জায়গায় চলে আসে।”
“তাহলে তো অনেক আগের ব্যবসা বোধহয়?”
শুকনো হাসি ফোটে আফিকুমির চেহারায়।
“পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়ে খুব বেশি হম্বিতম্বি করে না আমার বস। নিহনবাশির এখানে বেশিরভাগ দোকানই প্রায় একশো বছরের পুরনো। কিন্তু তাদের মত আমরা আমাদের জিনিসগুলো নিজে বানাই না। ম্যানুফ্যাকচারার আর সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে নিয়ে এসে বিক্রি করি কেবল। তাছাড়া, দোকানের বেশি কামাই হয় ঘড়ি সারাই থেকে।”
“আমি শুনেছি ঘড়ির সারাইয়ে আপনাদের কোন জুড়ি নেই। ঘড়ি সম্পর্কিত যে কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় আপনাদের কাছে।”
“আমার বসের হাতের কাজের আসলেই কোন তুলনা হয় না। যে কোন ঘড়ি সারতে পারেন। ওরকম গোবদা গোবদা হাতে সুক্ষ্ম কাজগুলো ভালোই করেন। আমি কখনো তার মত কাজ শিখতে পারব না।”
“এই দোকানে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন আপনি?”
“এর পেছনে আসলে ওরকম বিশেষ কোন কাহিনী নেই। ছোট থেকেই ঘড়ির প্রতি আগ্রহ কাজ করতো আমার। সাধারণ কোয়ার্টজ বা ব্যাটারি চালিত ঘড়ি না আবার, মেকানিক্যাল ওয়াচ বলে যেগুলোকে। কয়েল স্প্রিং আর পেন্ডুলামে চলে যেসব। আমার মনে আছে, প্রথমবার একটা পুরনো আমলের ঘড়ির ভেতরটা দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। মনে হয়েছিল, বাকি জীবন এসব নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারব।”
“আমার কিন্তু গল্পটা শুনতে ভালোই লাগল,” মাথা নেড়ে বলে কাগা। “তেরাদারাও নিশ্চয়ই আপনার মত একজন কর্মীকে দলে পেয়ে ভীষণ খুশি। চাইলে আপনি নিজেই ব্যবসাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।”
“এখনও সেজন্যে পুরোপুরি তৈরি নই আমি। আরো ভালো কাজ শিখতে চাই। বিশেষ করে এখন যেহেতু মেকানিক্যাল ঘড়ি সারাই করতে পারে এরকম দক্ষ মানুষের সংখ্যা একেবারেই কমে এসেছে। অবশ্য মেকানিক্যাল ঘড়ির ক্রেতাও কমে গেছে। ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে।”
“গুণগত মান বা উৎকর্ষতা কিন্তু কখনো পুরনো হয় না। যা গুণগত দিক দিয়ে ভালো, সেটার আকর্ষণ সবসময়ই সমান,” কাগা বলে অনুপ্রেরণার স্বরে।
হাঁটতে হাঁটতে হামাচো পার্ক অবধি চলে এলো ওরা। মোজাইকের ছোট্ট একটা প্লাজা পেরিয়ে ঘাসে ছাওয়া জায়গাটার দিকে এগোল। ওখানেই কুকুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, গল্প করছে।
“এখানে প্রতি সন্ধ্যায় জড়ো হয় কুকুর মালিকেরা,” নিচু স্বরে ব্যাখা করে বলে আফিকুমি।
“দেখে তো সেটাই মনে হচ্ছে। আমি শুনেছি এখানে নাকি কুকুরদের যত্নআত্তি নিয়ে মত বিনিময় করে তারা,” জবাবে বলে কাগা। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে আগে থেকেই খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে সে।
ধুসর চুলের এক বৃদ্ধা স্বাগত জানালো ওদের। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট্ট পুডল প্রজাতির কুকুরটা। “শুভ সন্ধ্যা,” পাল্টা বলে আফিকুমি। এখানকার সবার আচার ব্যবহার পুরোপুরি পেশাদার।
কাগার দিকে দৃষ্টি ফেরায় বৃদ্ধা। পা থেমে মাথা অবধি চোখ বুলিয়ে বলে, “আরে! আপনি!” চশমার পেছনে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায় তার।
“কালকে আমাকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ,” একবার বাউ করে বলে কাগা।
“যা খুঁজছিলেন, পেয়েছেন?”
“নাহ, পাইনি। সময় খুব একটা ভালো যাচ্ছে না আমার।”
“আহারে। ডিটেকটিভের জীবন আমি যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ততটা সহজ নয় তাহলে।“
বৃদ্ধা হেঁটে বেরিয়ে গেল।
“কি খুঁজে পাননি কালকে?
“এনাকে,” একটা ছবি বের করে কাগা। মিনেকো মিতসুইয়ের এই ছবিটায় এক দিন আগে দোকানে দেখিয়েছিল কাগা। “কিংবা বলতে পারেন, এনাকে যে বা যারা দেখেছে।”
“মানে?”
পরশু যখন মি. তেরাদার সাথে কথা বলি, তিনি আমাকে বলেন জুনের দশ তারিখে সন্ধ্যা ছ’টায় এখানে এসেছিলেন মিস মিতসুই।”
“হ্যাঁ…মনে আছে আমার।”
“গতকাল আমি এখানে এসেছিলাম এনাদের সাথে কথা বলতে। একটু খোঁজ খবর নেই যে কেউ মিস মিতসুইকে দেখেছে কিনা। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও ইতিবাচক জবাব দেয়নি। সবাই কিন্তু মি. তেরাদা আর ডনকিচিকে দেখেছিল সেদিন। সব শুনে যা বুঝলাম, ডনকিচি ছোটখাট একজন সেলেব্রিটি এখানে।”
“তাদের সাথে কথা বলার সময়েই মি. তেরাদা ডনকিচিকে নিয়ে হাজির হন। আমি চাইনি তার নজরে পড়তে, এজন্যে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাই। এরপরেই আপনাদের দোকানে আসি।”
“ওহ আচ্ছা, এজন্যেই এসেছিলেন তাহলে গতকাল।”
“আমাকে একটা বিষয় ভীষণ অবাক করেছে। মানে আপনার বসের সাথে মিস মিতসুইয়ের দেখা হবার ব্যাপারটা।”
আফিকুমি এতক্ষণে বুঝতে পারল কাগা গতকাল কেন বারবার গেনিশির সাথে মিস মাতসুইয়ের দেখা হয়েছে কিনা, তা বারবার জিজ্ঞেস করছিল।
“মিস মিতসুইয়ের কি কোন কুকুর ছিল নাকি?”
“না, ছিল না।”
“এজন্যেই বোধবয় বস বাদে আর কেউ দেখেনি তাকে। কুকুর নিয়ে সবাই যেখানে জড়ো হয়, সেখানে আসেননি তিনি।”
“সেক্ষেত্রে কিন্তু আরেকটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।”
পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে আফিকুমির দিকে বাড়িয়ে ধরে কাগা।
দেখতে অনেকটা কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটের মতন।
কেবলই ফিরেলাম আমি। প্রতিদিন যে প্লাজাতে যাই, সেখানেই গিয়েছিলাম। কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়েছি। কোবুনাচোর ঘড়ির দোকানের লোকটার সাথেও দেখা হয়েছিল। আমরা যে প্রতিদিনই প্রায় একই সময়ে হাঁটতে বের হই, এটা নিয়ে একচোট হাসাহাসিও হয়েছে।
“একটা কুকুর ছানার কথা বলেছেন মিস মিতসুই। আমার মনে হয় না কোন রাস্তার কুকুরের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি এখানে। আপনার বসের সাথে দেখা হবার আগে নিশ্চয়ই অন্য কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার, যার সাথে কুকুর ছিল।”
“বুঝতে পারছি কি বলতে চাইছেন,” বলে কুকুর মালিকদের তাকালো আফিকুমি। “এমনও হতে পারে যে আপনি যাকে খুঁজছেন সে দশ তারিখে এসেছিল, কিন্তু গতকাল বা আজ আসেনি।”
“আমার মাথাতেও এই চিন্তাটা এসেছিল, কিন্তু এখন অবধি এরকম কারো খোঁজ তো পেলাম না। এখানে যারা নিয়মিত আসে তারা কোন কুকুর ছানা দেখেনি। আমাদের সাথে যে বয়স্ক ভদ্রমহিলা কথা বললেন তিনি সবার কুকুরকে চেনেন। এমনকি সেই কুকুর মালিকদের সাথে পরিচয় না থাকলেও অন্তত মুখ চেনা।”
“সেরকমটাই হবার কথা, ভাবে আফিকুমি। ডনকিচিকে সচরাচর হাঁটাতে বের হয় না সে। কিন্তু যে দিনগুলোতে বের হয়, বারবার মনে হয় কেউ যেন নজর রাখছে।
“আপনার কাজটা আসলেও কঠিন, ডিটেকটিভ। মানে এরকম বিষয় নিয়েও খোঁজ খবর করতে হয়।”
“সহজ কাজ বলে আবার কিছু আছে নাকি? তদন্ত করতে আমার ভালোই লাগে আসলে। মজার সব ঘটনা ঘটে প্রায়ই।”
“তাই নাকি?”
“এই যেমন,” নাটকীয় ভঙ্গিতে ক্ষণিকের জন্যে চুপ করে কাগা। “স্ন্যাকস কেকে কেউ কেন ওয়াসাবি পেস্ট মেশাবে?”
“ওয়াসাবি!”
“আজকে এই রহস্য উদঘাটনের জন্যে একটা নামকরা জাপানিজ রেস্তোরাঁয় যাচ্ছি আমি। সেজন্যেই তো স্যুটটা পড়েছি।”
“ওহ, আচ্ছা,” আফিকুমি বলে। যদিও তার কোন ধারণা নেই কাগা কোন বিষয়ে কথা বলছে।
পার্কে একবার চক্কর লাগিয়ে দোকানের দিকে হাঁটা দেয় তারা। “আচ্ছা সেদিন ‘নিশ্চয়ই ওই বদটার কাজ’ বলতে কার কথা বুঝিয়েছিলেন মি. তেরাদা?” হঠাৎ জিজ্ঞেস করে কাগা।
“হু?”
“পরশু মি. তেরাদা বললেন না? মনে নেই আপনার?”
“ওহ, হ্যাঁ,” আফিকুমি এবারে ধরতে পেরেছে। সে যখন গেনিশিকে জানায় যে পুলিশ স্টেশন থেকে একজন এসেছে দেখা করতে, তখন এই কথাটা বলে তার বস। “আপনি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন তাহলে?”
“আসলে মি. তেরাদা তখন জোরেই কথা বলছিলেন। যাইহোক, কার কথা বলছিলেন তিনি?”
“ওনার মেয়ের সঙ্গী।”
“সঙ্গী মানে আবার কি? ওনার মেয়ে-জামাই?”
“বসের সামনে এই কথা বললে রেগে আগুন হয়ে যেতেন কিন্তু, মুখে হাসি ফোটে আফিকুমির। “পালিয়ে বিয়ে করেছে দু’জনে।”
“অনুমতি না নিয়েই?”
“কাউকে আবার বলবেন না যে আমি জানিয়েছি আপনাকে এই কথা।”
“ভাববেন না, কেউ কিছু জানবে না।” কাগার দুই চোখে জ্বলজ্বল করছে কৌতূহল।
চার
কানায়ে, তেরাদাদের একমাত্র মেয়ে হাই স্কুল থেকে পাস করে বেরিয়েছে মার্চ মাসে। কিন্তু গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের পর আর বাড়ি ফেরেনি সে। বরং মা’র মোবাইল ফোনে একটা ক্ষুদেবার্তা পাঠায়- “আমাকে মাফ করে দিও। আমার ভালোবাসার মানুষটার সাথেই থাকব আমি।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সাওয়ামুরাদের বাড়িতে তেড়ে যায় গেনিশি তেরাদা। সাওয়ামুরাদের বড় ছেলে, হিদেকি হচ্ছে কানায়ের প্রেমিক
প্রেমিকার চেয়ে দুই বছরের বড় সে। একই এলিমেন্টারি এবং জুনিয়র হাইস্কুলে পড়েছে তারা। এমনকি কানায়ে হাইস্কুলে পড়ার সময়েও নিয়মিত দেখা হতো দু’জনের। এক পর্যায়ে একে অপরের প্রেমে পড়ে যায় তারা।
কিন্তু গেনিশি হিদেকিকে দেখতেই পারে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সাওয়ামুরাদের বড় ছেলে পড়াশোনার পার্ট না চুকিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়। মড়ার উপর খড়ার ঘা’র মতন হাইস্কুলে থাকাকালীন বাইক চালানোর অভ্যেস ছিল হিদেকির। তখন একজনকে মেরেও দিয়েছিল। হিদেকি প্রায়ই তাকে ‘বখাটেদের সর্দার’ বলে অভিহিত করতো সবার সামনে।
“তুমি যার সাথেই প্রেম করো না কেন, আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ওই ছেলের ছায়াও যেন তোমার আশপাশে না দেখি, “ মেয়েকে পইপই করে বলে দেয় সে।
কিন্তু এখনকার মেয়েদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। বাবা- মা’য়ের এরকম শাসন শুনবে কেন তারা? গোপনে ঠিকই হিদেকির সাথে সম্পর্ক রাখে কানায়ে। সিদ্ধান্ত নেয় গ্র্যাজুয়েশনের পর একসাথে থাকা শুরু করবে।
সাওয়ামুরা পরিবার প্রধান সেইজো অবশ্য গেনিশির কথায় কান দেয়নি। গেনিশিকে ওরকম প্রেশার কুকারের মতন ফুঁসতে দেখেও কোন বিকার ছিল না তার। “দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যদি একে অপরকে ভালোবাসে একসাথে থাকতে চায়, তাহলে আমি তো কোন সমস্যা দেখি না,” ঠাণ্ডা স্বরে বলে সে। রাগ সামলাতে না পেরে হঠাৎই ঘুষি চালিয়ে দেয় গেনিশি। কিন্তু তার জন্যে সিদ্ধান্তটা মোটেও ভালো কিছু ছিল না। জুডোতে ব্ল্যাক বেল্ট জানা সেইজো অবলীলায় এড়িয়ে যায় সেই ঘুষি। এরপর পা ঘুরিয়ে এমন প্যাঁচ কষে যে মাটিতে চিৎপটাং হয়ে যায় গেনিশি।
প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফেরার পর কানায়ের কাছ থেকে একটা ক্ষুদেবার্তা পায় তেরাদা ক্লক শপের মালিক। সেখানে লেখা ছিল ‘নিজের ব্যবহার ঠিক করতে শেখ’। রাগে ফোনটা আছাড় দিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেলে গেনিশি।
“ওকে ত্যাজ্য করলাম আমি,” শিমাকো আর আফিকুমির উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে সে। “ওকে আমি আর নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করি না। এই বাড়িতে ওর নামটাও যেন কেউ উচ্চারণ না করে। বুঝতে পেরেছ কি বলছি?”
আফিকুমির বলা গল্পটা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কাগা। সেইজোর জুডোর প্যাচে গেনিশি কুপোকাপ হয়ে গেছিল শুনে জোরে জোরে হেসেছে সে।
তো এখন আমরা কেউ কানায়ের নামটাও মুখে আনতে পারি না তেরাদাদের ওখানে।”
“কিন্তু আপনি এটা জানেন যে সে রিয়োগোকুতে থাকে।”
“মিসেস তেরাদা সাওয়ামুরাদের মারফত শুনেছে এটা।”
“আপনার বস তো চাইলেই গিয়ে জোর করে মেয়েকে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারে।
“নাহ, বস সাফ বলে দিয়েছে যে ওই মেয়েকে আর কখনোই নিজে থেকে গিয়ে বাসায় নিয়ে আসবেন না তিনি। ‘ও যদি চায় আমি আবার ওকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করি, তাহলে ওকে এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ওই নচ্ছাড়টাকেও ছাড়তে হবে।”
“আপনার বস তাহলে একটু গোয়ার স্বভাবের।”
“একটু বললে কম বলা হয়ে যায় আসলে। তার মতন জেদি মানুষ খুব কমই আছে পৃথিবীতে। কখনো নিজের জায়গা থেকে পিছু হটবে না। ছেড়ে কথা বলবে না। এজন্যেই নিজের কাজে এত ভালো সে।“
যে পথে এসেছিল, সেদিক দিয়েই ফিরছে আফিকুমি আর কাগা। পাশাপাশি হাঁটছে দু’জনে। আফিকুমির হাতে ডনকিচির বেল্ট। কুকুরটা আগে আগে যাচ্ছে এবারেও। কেবলই অর্ধেক মতন গিয়েছে তারা, নিনগিয়োচো বুলভার্দে লাল বাতির জন্যে অপেক্ষা করছে এসময় কাগা বামদিকে কি যেন একটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চেহারার অভিব্যক্তি একদম গম্ভীর।
সবুজ বাতি বন্ধ হলে আবারো হাঁটতে শুরু করলো সবাই। দোকানের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে, এসময় একটা ট্যাক্সি চোখে পড়লো মোড়ের কাছে। সিগন্যালে অপেক্ষা করছে ট্যাক্সিটা। পেছনের সিটে ডান পাশে এক নারী যাত্রী বসে আছে। “আরে!” মহিলাকে চিনতে পেরে বলে ওঠে আফিকুমি। “মিসেস তেরাদা দেখি।”
“কি?” সেদিকে তাকায় কাগা।
ট্যাক্সিটা ছেড়ে যায় তখন। চল্লিশ কি পঞ্চাশ মিটার দুরে গিয়েই আবার থামে।
শিমাকো কেবলই ট্যাক্সি থেকে বের হয়েছে, এসময় দোকানে উপস্থিত হয় আফিকুমি আর কাগা।
“হ্যালো মিসেস তেরাদা,” আফিকুমি বলে।
“হাই আকি,” ওদের দিকে তাকায় শিমাকো। “তুমি বেরিয়েছিলে ডনকিচিকে নিয়ে?” সন্দিহান চোখে কাগার দিকে তাকিয়ে একবার বাউ করে সে।
“এনার ব্যাপারেই সেদিন আপনাকে বলছিলাম আমি,” আফিকুমি বলে। “আমরা কোন রাস্তা দিয়ে ডনকিচিকে হাঁটাই প্রতিদিন, সেটাই দেখতে চাইলেন। তাই নিয়ে গিয়েছিলাম সাথে।”
“তাই নাকি?”
শিমাকোর অভিব্যক্তিতে এটা স্পষ্ট যে সে বোঝার চেষ্টা করছে কাজটা করে কি লাভ হবে কাগার।
“আপনি গিনজাতে শপিংয়ে গিয়েছিলেন নাকি?” শিমাকোর হাতের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলে কাগা। ওখানকার একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের লোগো আঁকা ব্যাগটায়।
“হ্যাঁ। কয়েকটা উপহার কিনতে গিয়েছিলাম।“
“একাই?”
“হ্যাঁ, একাই। কেন?”
“না এমনি। আপনি কি সবসময় গিনজা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ফেরেন?”
“সবসময় না। সাধারণত সাবওয়েতেই আসি। কিন্তু আজকে একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছিল,” চকিতে একবার আফিকুমির দিকে তাকায় শিমাকো। “বুড়োকে আবার কিছু বোলো না। তাহলে টাকা পয়সা খরচ করা নিয়ে জ্ঞান দেয়া শুরু করবে আবার।
“জানি আমি, “ বিড়বিড় করে বলে আফিকুমি।
“আমি বরং এখন যাই,” ঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে কাগা। “সাড়ে ছ’টা তো বেজেই গেল প্রায়। আপনার এতটা সময় নষ্ট করার জন্যে দুঃখিত। তবে আমার আসলেই কাজে এসেছে। অসংখ্য ধন্যবাদ,” আফিকুমির উদ্দেশ্যে বাউ করলো কাগা।
“কাজের কি এমন বলেছ তাকে?” কাগা চোখের আড়াল হওয়া মাত্র জিজ্ঞেস করে আফিকুমি।”
“কে জানে! ওরকম বিশেষ কিছু তো বলিনি,” ঘাড় একদিকে কাত করে আফিকুমি।
দোকানের পেছন দিকে গিয়ে ডনকিচিকে তার খোয়াড়ে ঢুকিয়ে দেয়। ভেতরে ঢুকে দেখে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত শিমাকো।
“আবার কি করেছে? কি বলছো এসব! এই লোকটাকে নিয়ে আর পারলাম না। তুমি নিশ্চিত? কেউ কিছু মনে করেনি? যাক, বাঁচলাম। আমি আসলেও দুঃখিত…জানানোর জন্যে ধন্যবাদ… হ্যাঁ… বাই।”
মুখ কালো করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সে। “আবারো একজনের উপরে চড়াও হয়েছে ও।”
“চড়াও হয়েছে মানে? বস? মেমোরিয়াল সার্ভিসে গিয়ে? শিমাকোর চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না এখন।”
“কে নাকি বলেছে ‘ওরা বড় হয়েছে এখন। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে দিন। আপনি ভালো মানুষ হলে কারো ভালোবাসার মাঝে আসতেন না।”
“এরকম কথা শুনলে তো চেতবেই।”
“বিয়ার ছুড়ে মেরেছিল গেনিশি লোকটার মুখে। এরপরেই ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। এই বয়সে! চিন্তা করো তুমি!”
“জীবনটাই এরকম’ গোছের একটা বিমর্ষ হাসি মুখে ঝুলিয়ে দ্রুত বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে আফিকুমি। গেনিশি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে নিশ্চয়ই। ততক্ষণে এখান থেকে যতটা দুরে সম্ভব, থাকতে চায় সে।
পাঁচ
পরদিন সকালে দোকানে এসে আসলেও গেনিশিকে খারাপ মেজাজে পেল আফিকুমি।
“এই ঘড়িটার সারাইয়ের কি অবস্থা? কাস্টোমারকে না বলেছিলে আজকে ফেরত দিবে?” ‘সারাই’ লেখা বাক্সটা থেকে একটা ঘড়ি তুলে নিয়ে গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে গেনিশি।
“একটা গিয়ারের জন্যে অপেক্ষা করছি। কাস্টোমারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি যে অন্তত আগামী সপ্তাহটা লাগবে।”
“জানিয়েছ? বরাবরের মতনই আমাকে কিছু বলা জরুরী মনে করেনি কেউ।”
আসলে আগের দিনই বিষয়টা গেনিশিকে জানিয়েছিল আফিকুমি, কিন্তু এখন প্রবীণ দোকান মালিকের এরকম মেজাজের সামনে অহেতুক তর্ক করে লাভ নেই।
“সরি,” একবার মাথা নেড়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে বলে সে।
“আমার মাথাতেই ঢোকে না, এখানে কি একজনও এমন কেউ নেই যার উপরে ভরসা করা যায়?” দুদ্দাড় করে দোকানের পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে গেনিশি। একটু পরেই কিছু একটাতে ধাক্কা খায় সে। “উফ! ধুর! এরকম জায়গায় জিনিস রাখে কেউ! হাঁটুতে চোট পেলাম। ‘
“আফিকুমির এটা বলতে খুবই ইচ্ছে করছিল যে গেনিশি নিজেই ‘জিনিসটা’ ওখানে এনে রেখেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল সে।
******
দোকান বন্ধের সময় হতে হতে গেনিশির মেজাজের বেশ উন্নতি ঘটলো।
“এখন তাহলে আমি ডনকিচিকে নিয়ে হাঁটতে বের হই, পেছনের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে আয়েশী ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে গেনিশি। “তুমি এখানে সবকিছুর খেয়াল রাখতে পারবে না?”
“সমস্যা নেই, বস। আপনি যান। আমি সব দেখে নেব।”
গেনিশি চলে যাওয়ার প্রায় মিনিট দশেক পর কেউ একজন সামনের দরজাটা খুলে প্রবেশ করে ভেতরে। আগন্তুককে দেখে ভু কুঁচকে যায় আফিকুমির। ডিটেকটিভ কাগা। আবার এসেছে সে! পরনে গতকাল দেখা সেই ধুসর স্যুট।
“আপনার প্রশ্ন করা শেষ হয়নি?”
তার মুখের সামনে হাত নাড়ে কাগা।
“আরে আজকে প্রশ্ন করতে আসেনি। আপনাদের একটা কথা বলতে চাই।”
“তাই? কিন্তু বস তো একটু আগেই ডনকিচিকে নিয়ে বের হলো।”
“জানি আমি। বাইরে দাঁড়িয়ে সেটারই অপেক্ষা করছিলাম। মিসেস তেরাদা কোথায়?”
“আছে। ডাক দিব?”
“খুব ভালো হয় তাহলে,” হেসে বলে কাগা।
ডিনার রান্নায় ব্যস্ত ছিল শিমাকো। আফিকুমি ডাক দিলে দোকানে এলো সে। চেহারার অভিব্যক্তিকে প্রীতিকর বলা যাবে না কোনভাবেই।
“আপনাদের বারবার এভাবে জ্বালানোর জন্যে দুঃখিত,” কাগা হেসে বলে। “তবে আজকেই শেষ। আর আসবো না আমি। সত্যি।”
“এখন আবার কি হলো?” শিমাকো জিজ্ঞেস করে।
আফিকুমির দিকে তাকায় কাগা। “গতকাল পার্কে আমাদের কোন বিষয়ে আলাপ হয়েছে সেটা মি. এবং মিসেস তেরাদাকে বলেছেন?”
“নাহ, বলিনি। বসের মেজাজ ভালো ছিল না আজকে।”
“বলেননি? যাক, ভালোই হয়েছে। সে না জানলেই বরং ভালো।”
“কি নিয়ে আলাপ হয়েছিল আপনাদের গতকাল?” ওদের দু’জনের দিকে পালা করে তাকায় শিমাকো।
হামাচো পার্কে অন্য কেউ যে মিনেকো মিতসুইকে দেখেনি, সেই বিষয়টা শিমাকোকে খুলে বললো কাগা ।
সব শুনে বিভ্রান্তি ভর করলো ভদ্রমহিলার চেহারায়। “অদ্ভুত তো। আপনার কি ধারণা? আমার স্বামী মিথ্যে বলছে?”
“সেরকমটাই তো মনে হচ্ছে,” বলে আফিকুমির দিকে তাকায় কাগা। “মি. তেরাদার মতে তিনি সেদিন এখান থেকে সাড়ে পাঁচটায় বের হয়ে সাতটা নাগাদ ফিরে এসেছিলেন। অর্থাৎ প্রায় দেড় ঘন্টার মতন হেটেছেন।”
“ওহ!” অবাক হয়ে যায় আফিকুমি। তার বস যখন সেদিন ফিরে আসে, তখন দোকানেই ছিল সে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে একবারের বেশি দু’বার ভাবেনি সে। এখন মনে হচ্ছে কোন একটা ঘাপলা অবশ্যই আছে।
“গতকাল কিন্তু আমরা একই পথ দিয়ে হেঁটেছি। যারা একদম ধীরে হাঁটে, তারাও গোটা পথটা এক ঘন্টার কম সময়ে পাড়ি দিতে পারবে। অবশ্য একেকজনের হাঁটার গতি একেক রকম অবশ্যই। কিন্তু তাই বলে আধা ঘন্টা বাড়তি? এটা একটু বেশি বেশিই হয়ে গেল না?”
“তাহলে কি বস অন্য কোথাও গিয়েছিল?
“যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে এটাই তো মাথায় আসে। আমার ধারণা অন্য কোন পথে গিয়েছিলেন তিনি সেদিন। আর সেখানেই মিস মিতসুইয়ের সাথে দেখা। হামাচো পার্কের ব্যাপারে বলেছে যেন সেই জায়গাটার কথা আমরা না জানতে পারি। আমার অনুমান এটাই।”
“কোথায় যেতে পারে ও?” প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে আফিকুমির দিকে তাকায় শিমাকো।
আমি বুঝতে পারছি না।” ঘাড় কাত করে বলে আফিকুমি।
“আমি আসলে জানি আপনার স্বামী কোথায় যান। আর এটাও খুব সম্ভবত বুঝতে পারছি কেন সে চায় না আর কেউ বিষয়টা সম্পরকে জানুক। তবে একটা কথা এখনই পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি। এসবের সাথে খুনের বিন্দুমাত্র কোন সম্পর্ক নেই। আমি যা বলবো, সেটা যদি সত্যিও হয়ে থাকে, তবুও মি. তেরাদাকে কিছু বলার দরকার নেই। আমাকে আমার দায়িত্বের অংশ হিসেবে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে সবকিছু। সেজন্যেই আপনাদের এখানে আসছি বারবার। ভেবেছিলাম সরাসরি আপনার স্বামীকেই জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু তিনি যেরকম, সত্যটা বলতেন বলে মনে হয় না। জোর প্রয়োগ করলে বা তিনি হাঁটতে গেলে হঠাৎ উপস্থিত হলে হিতে বিপরীত হতে পারত। কারণ আশাই মানুষকে অনেক দুর অবধি নিয়ে যেতে পারে। সেই আশা যতই ঠুনকো হোক না কেন। আর আমি কারো আশাভঙ্গের কারণ হতে চাই না।”
মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো আফিকুমি আর শিমাকো। ডিটেকটিভ কাগার হঠাৎ এরকম বাণী শোনানোর মানে তারা বুঝতে পারছে না।
“সরাসরি কাজের কথায় আসলেই কিন্তু পারেন আপনি। আমার স্বামী প্রতিদিন কোথায় যায়, সেটা বলুন!”
“প্রথমে আপনাকে আপনার মেয়ে সম্পর্কে একটা প্রশ্ন করি। সে তো বিয়ের পরে রিয়োগোকুতে থাকছে?”
“কিছু হয়েছে নাকি ওর?” একরাশ দুশ্চিন্তা এসে ভর করে শিমাকোর চোখেমুখে
বিস্ফোরিত নয়নে কাগার দিকে তাকায় আফিকুমি। হঠাৎ কানায়ের প্রসঙ্গ তুললো কেন ডিটেকটিভ?
“তা বলা যায়। আপনার মেয়ে গর্ভবতী।”
মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো আফিকুমির। শিমাকোর প্রতিক্রিয়া দেখে তার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়লো বৈ কমলো না।
“আপনি কিভাবে জানলেন?”
“উৎফুল্ল ভঙ্গিতে হাসে কাগা। “তাহলে আমি ভুল বলিনি।”
“সত্যি নাকি?” শিমাকোকে জিজ্ঞেস করে আফিকুমি।
“হ্যাঁ, কিন্তু বুড়োকে বলো না।”
“আপনার সাথে এখনও কানায়ের যোগাযোগ হয়?” আফিকুমি জানতে চায়।
“মাঝে মাঝে দেখা করি আমরা। আমি তো কখনো ওদের দু’জনের বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলাম না। হিদেকি একটা চাকরি পেয়েছে এখনও চুক্তিভিত্তিক অবশ্য, কিন্তু কোম্পানিটা ভালো। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে ওদের। কিন্তু বাবা ওরকম গোয়ার্তুমি করলে-” হঠাৎ মুখচাপা দেয় শিমাকো, কাগা যে এখানে আছে সেটা ভুলেই গেছিল এক মুহূর্তের জন্যে। “সরি ডিটেকটিভ, আমার পারিবারিক সমস্যার কথা এভাবে আপনার সামনে বলাটা ঠিক হয়নি।”
আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কাগা। “কোন ব্যাপার না। গতকাল আপনি আপনার মেয়ের সাথে দেখা করেছিলেন। দু’জন একসাথে শপিংয়ে গিয়েছিলেন, না?”
“আপনি কি করে জানলেন?” “
“গতকাল আপনার সাথে দেখা হবার পর ডিপার্টমেন্ট স্টোরটায় বাচ্চাদের সেকশনে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি একটু। দোকানের একজন কর্মী নিশ্চিত করেছে দু’জন নারী বেশ খানিকক্ষণ ছিল ওখানে তাদের চেহারার বর্ণনার সাথে আপনাদের বর্ণনা মিলে যায়। তখনই বুঝতে পারি যে কানায়ে গর্ভবতী।”
“আপনাকে কি আমি বলেছি যে মেয়ের সাথে ছিলাম?”
“না, বলেননি। কিন্তু আপনাকে ট্যাক্সিতে বসে থাকতে দেখে আন্দাজ করেছিলাম।”
“ট্যাক্সি?”
“হ্যাঁ, আপনি পেছনের সিটের ডান পাশে বসে ছিলেন। সাধারণত যারা নিজেই ট্যাক্সি ডাকে, তারা বামপাশে বসেন; কারণ ওদিক দিয়েই রাস্তা থেকে ক্যাবে ওঠে সবাই। কিন্তু আপনি যেহেতু ডান দিকে বসে ছিলেন, সেখান থেকে আন্দাজ করা যায় অন্য কেউ হয়তো ছিল বাম দিকে। তাকে কোথাও নামিয়ে দিয়ে এরপর বাসায় এসেছেন আপনি। আফিকুমির কাছ থেকে আপনাদের পারিবারিক কলহের বিষয়ে আগেই ধারণা পেয়েছিলাম, তাই দুইয়ে দুইয়ে চার করতে বেগ পেতে হয়নি।
অভিভূত দৃষ্টিতে কাগার দিকে তাকায় আফিকুমি। এই ডিটেকটিভ যেন তেন কেউ নয়।
আচ্ছা, ধরলাম আপনি ঠিকঠাকই অনুমান করেছেন যে আমি আমার মেয়ের সাথে শপিংয়ে গিয়েছি। কিন্তু সেটা যে বাচ্চাদের সেকশনেই, তা কি করে বুঝলেন?”
“সেটা সহজ। কারণ আমি আগেই ধারণা করেছিলাম যে আপনার মেয়ে গর্ভবতী।”
“কি?” এবারে মুখ খোলে আফিকুমি। “কানায়ের বিষয়ে মাত্র কয়েক মিনিট আগে আপনাকে বলেছিলাম আমি, সেখান থেকে কিভাবে ধারণা করলেন যে কানায়ে গর্ভবতী?”
আসলে একদম নিশ্চিত ছিলাম, এটা বলবো না। আন্দাজ বলতে পারেন।”
বুকে হাত বেঁধে হতাশায় গুমরে ওঠে আফিকুমি।
“আমার মাথায় কিন্তু কিছু ঢুকছে না, ডিটেকটিভ। আমি এখানে কাজ করি, সারাদিন মি. এবং মিসেস তেরাদার আশপাশে থাকি, কিন্তু আমি কিছু জানি না! সেখানে আপনি কি করে এরকম একটা বিষয় আন্দাজ করলেন? আপনার কি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা-টমতা আছে নাকি?”
“নাহ, দুর্ভাগ্যবশত ওরকম কোন ক্ষমতা নেই। শুনে হয়তো আপনারা অবাক হতে পারেন, কিন্তু ডনকিচি আমাকে সাহায্য করেছে এই বিষয়ে।”
“আমাদের কুকুরটা?”
“গতকাল বিকেলে অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর ও কেমন বিভ্রান্ত আচরণ করছিল, মনে আছে?”
“হ্যাঁ, তাইতো। আপনি বলায় এখন খেয়াল হলো।”
“একদম নিনগিয়োচো বুলভার্দের মাঝামাঝি। আপনি যখন বেল্ট ধরে টান দিলেন তখন লক্ষ্মী ছেলের মত আমাজাকি গলির দিকে গেল। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে ওরকম আচরণের কারণ কি?”
“আপনিই বলুন।”
“তখনই চিন্তাটা মাথায় আসে। মি. তেরাদা হয়তো ওখানে পৌঁছে সোজা না গিয়ে অন্য কোন দিকে যেতেন। বাম দিকে গেলে তো এখানেই ফিরে আসতে হবে। আর ডানে গেলে?”
“ওহ!” শিমাকোর গলা চড়ে যায় অজান্তেই। “সুইতেন গু মন্দির!”
“একদম ঠিক,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে কাগা। “ভিক্টিমের কম্পিউটারে একটা ড্রাফট মেইল পেয়েছি আমরা, যেখানে লেখা ‘সেই প্লাজায় কুকুরছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি আর কোরুনাচোর ঘড়ির দোকানের লোকটার সাথে দেখা হয়েছে।’ প্লাজা শব্দটা দেখার সাথে সাথে পার্কের কথা মাথায় আসে আমার। কিন্তু পরে মনে হয় এটা তো কোন মন্দিরের প্লাজাও হতে পারে। আর সুইতেনগু মন্দিরে একটা কুকুরছানার মুর্তিও আছে কিন্তু।”
কাগা তার মোবাইল ফোনটা বের করে কিছুক্ষণ চাপাচাপির পর স্ক্রিনটা আফিকুমি আর শিমাকোকে দেখায়। ছবিটা দেখে চোয়াল ঝুলে যায় আফিকুমির। ব্রোঞ্জের তৈরি হাসিখুশি একটা কুকুর বসে আছে, তার পাশেই ছোট্ট একটা ছানা।
“এই কুকুরটাকে বলা হয় ‘বাচ্চাদের জন্যে সৌভাগ্যের প্রতীক’। নিচে এই প্রতীকগুলো দেখছেন? এগুলো চৈনিক রাশির একেকটা প্রতীক। আপনার যে রাশিতে জন্ম, সেই রাশির প্রতীকে হাত বুলিয়ে দেয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ। ঠিক একই কারণে কুকুরছানাটার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দেয় অনেকে। সেজন্যেই কেমন চকচক করছে, দেখুন।”
“জানি। আমি নিজেও হাত বুলিয়ে দিয়েছি,” হেসে বলে শিমাকো।
“তখন আমার মনে হলো মিনেকো মিতসুইও হয়তো ব্রোঞ্জের কুকুর ছানাটার মাথায় হারিয়ে দিতেন, ইমেইলে সেটাই বলেছেন। সেক্ষেত্রে নতুন আরেকটা প্রশ্ন জাগে মনে, আপনার স্বামী সেখানে কি করছিলেন? সুইতেনগু তো গর্ভধারণ এবং নিরাপদ প্রসবের মন্দির ।”
“আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয় ডিটেকটিভ,” শিমাতোকো বলে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বিস্ময় ফোটে তার চেহারায়। “তাহলে কি ও জানে যে কানায়ে গর্ভবতী?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানেন। আমার ধারণা, মেয়েকে নিয়ে উদ্বিগ্ন মি. তেরাদা। হাজার হলেও, নিজের মেয়ে বলে কথা। নিশ্চয়ই কোন না কোন ভাবে সব খবর ঠিকই পান।”
“তাহলে তো পালিয়ে বিয়ে করার জন্যে ওকে ক্ষমা করে দিবে বলে মনস্থির করেছেন গেনিশি। লুকিয়ে লুকিয়ে মন্দিরে না গিয়ে সরাসরি বলে দিলেই হয়।”
“সেটা হবে না,” আফিকুমি বলে।
একটা বিমর্ষ হাসি ফোটে শিমাকোর চেহারায়।
“ঠিকই বলেছ। এটা ওর স্বভাবের সাথেই যায় না।”
“তিনি জানেন যে নবদম্পতি তাদের বাচ্চাকে নিয়ে আশীর্বাদের জন্যে আপনাদের সাথে দেখা করতে আসবে। আমার ধারণা সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মি. তেরাদা বলবেন, ‘এই বাচ্চার দিকে তাকিয়ে তোমাদের মেনে নিচ্ছি আমি।”
“কিন্তু আফিকুমি ভুল বলেনি। নিজের দোষ কখনোই স্বীকার করবে না আমার স্বামী। ‘
“আপনার পারিবারিক বিষয়ে আমার আর নাক গলানো ঠিক হবে না। এমনিতেও অনেক বেশি গলিয়ে ফেলেছি। কিন্তু একটা অনুরোধ, আমার সাথে যে আপনাদের এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে, সেটা কেউ না জানলেই ভালো,” কাগা বলে। “আমি আপনার স্বামীর আশার আলোটুকু নিভিয়ে দিতে চাই না।”
ডিটেকটিভের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শিমাকো।
“আপনি কিন্তু অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের তুলনায় এসব বিষয়ে বেশ সহানুভূতিশীল, ডিটেকটিভ।”
“আমি? জানি না!” লাজুক হেসে বলে কাগা ।
“আপনার কথা অবশ্যই রাখবো আমরা। আফিকুমি, তোমার কোন সমস্যা আছে?”
“মোটেও না,” আফিকুমি জবাবে বলে।
একবার ঘড়ির দিকে তাকায় কাগা।
“যা বলতে এসেছিলাম, বলেছি। আপনার স্বামী যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসবেন, আগেভাগেই কেটে পড়ি তাহলে। সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ। ‘
“বাই।”
“শিমাকো আর আফিকুমি দু’জনেই বাউ করলো ডিটেকটিভের উদ্দেশ্যে।
কাগার প্রস্থানের পর লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল দোকান মালিকের স্ত্রী।
“পুলিশের লোকদের মধ্যেও কত পার্থক্য।”
“আমিও এটাই ভাবছিলাম,” আফিকুমি বলে।
“যাইহোক, রান্না শেষ করে ফেলি।”
আফিকুমির পাশ কাটিয়ে দোকানের পেছনের ঘরটার দিকে এগোলো শিমাকো। তার ছলছল চোখ দেখে আফিকুমির বুকেও উষ্ণতার বান ডাকল।
কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির পেছন দিক থেকে উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
“এতক্ষণ কি করছিলে তুমি? আমার খাবার কোথায়?”
ফিরেছে গেনিশি। তার কথা বলার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে না শিমাকোর চোখের পানি নজরে পড়েছে।
“বেশি ক্ষুধা পেলে ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করে খেয়ে নাও। আমারো কাজ থাকে মাঝে মাঝে,” শিমাকোও পাল্টা গলা চড়িয়ে উত্তর দেয়।
“কাজ থাকে? কাজ থাকে মানে? সারাদিন তো খালি ফোনে কথা। এদিকে আমার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে সেই কখন থেকে তাড়াতাড়ি করো।”
“করছি। চুপ করো তো একটু।”
ওয়ার্কবেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনেই হাসে আফিকুমি। তিন কোণা প্রিজম আকৃতির ঘড়িটা নিজের দিকে টেনে নেয়। সারাইয়ের কাজ প্রায় শেষ।
ডিটেকটিভ কাগা এই ঘড়িটা নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে ঘড়িটার কলকব্জার ধরণে খুব বেশি জটিলতা নেই। বেশিরভাগ ঘড়িতেই ডায়ালের ঠিক পেছনেই মূল যন্ত্রাংশগুলো থাকে। কিন্তু এটার ক্ষেত্রে সবকিছু একদম নিচের দিকে। সেখান থেকে তিনটা স্প্রিং উঠে গেছে তিন দিকে। গিয়ারের সহায়তায় ডায়াল তিনটায় সবসময় একইরকম কাটার চলাফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পরেরবার কাগার সাথে দেখা হলে এই বিষয়টা ব্যাখা করতে হবে, আফিকুমি মনে মনে বলে। এসময় একটা ভাবনা খেলে যায় তার মাথায়। তেরাদা পরিবারের সাথে বিশেষ এই ঘড়িটার অনেক মিল। তিনজন মানুষ, দেখে মনে হয় যে তিন দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে, কিন্তু তারা সবাই আসলে একটা যন্ত্রের সাথেই যুক্ত। পরিবার।