৭০
হামিদুর ছেলেটা গায়ে গতরেই বেড়েছে। পেশল বাহু, চিতানো বুক, পেটানো। হাত-পা। নাকের নিচে গোঁফের রেখা। আসলে তো কিশোরই। বয়স কত হবে? ১৮? কিংবা এক বছর কম বা বেশি।
মনের বয়সে সে কিশোরই রয়ে গেছে।
লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম বলেন, সিপাহি হামিদুর।
স্যার।
হামিদুর ক্যানভাসের জুতা মাটিতে ঠুকে স্যালুট দেয়। নামের আগে সিপাহি পরিচয়টা তাকে খুশি করে তোলে।
তোমার হাতের ডাল রান্নাটা কিন্তু পৃথিবীর এক নম্বর। আমাদের লঙ্গরখানার বাবুর্চি আক্কেল আলীর ডাল যা হয়, তাকে ঠিক পাক করা বলে না। ওটা হলো খুঁটা। তোমারটা হলো পৃথিবীর এক নম্বর। কী বলো?
স্যার। সিপাহি আপনার কথায় একটুখানি ওজর আপত্তি করে স্যার।
আমার কথায় ওজর! বলো কী!।
আপনি পারমিশন দিলে বলতে পারি স্যার।
পারমিশন দিচ্ছি। বলো। শুনি তোমার কী আপত্তি!
সিপাহি হামিদুর তার হাত দুটো একত্র করে। বিনয়ের ভঙ্গি আনে চেহারায়। হাত কচলাতে কচলাতে বলে, স্যার, পৃথিবীর সেরা ডাইলটা পাক করে আমার মা স্যার। আমার মায়ের হাতের পাক করা ডাইল যদি খেতেন, তাহলে স্যার কী যে বলতেন! জান্নাতি সুবাস স্যার। মায়ের হাতের ডাইলের কোনো তুলনা হয় না স্যার। আল্লাহ বাঁচি থুলে দেশ স্বাধীন হলে আপনাকে স্যার খাওয়াব স্যার। আপনার কথা স্যার মাকে কত বলিছি। মা বলেছেন, তোর স্যারের এক শ বছর পরমায়ু হবে। নেকদার আদমি।
তাহলে তুমি বোধ হয় ডাল পাক করার কায়দাটা মায়ের কাছ থেকেই শিখেছ। তোমার রান্নার হাতও খুব ভালো।
স্যার। সেটি হয়তো ঠিক কয়ে থাকবেন স্যার। আমার মা তো স্যার পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে। চব্বিশ পরগনার ডুমিয়া থানার চাপড়া গ্রামে ছিলেন। তাঁরা। পাকিস্তান হওয়ার পর ইন্ডিয়া থেকে এইপারে চইলে এসেছে। আসার সময় আর তো কিছু সাথে করে আনতে পারেনি। ডাইল আর লাবড়া পাক করার কায়দাকানুন সাথে করে এনেছে। বলে সিপাহি হামিদুর হাসে। তার দাঁতগুলো ঝকঝকে। তার কচিমুখে দাঁতগুলোকেই সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ে। আর হাসলে তার চোখের তারাও ঝিলিক তোলে। লে. কাইয়ুম স্নেহের চোখে তাকান। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেটা তাঁকে চেপে ধরতে হবে। তিনি সৈনিক। আছেন যুদ্ধের ময়দানে। এখানে মায়া-মমতার স্থান যে নেই বললেই চলে।
ত্রিপুরার এক পাহাড়ের ঢালে তাদের ক্যাম্প। একটা মিউনিসিপ্যাল অফিসের লাগোয়া দুটো টিনে ছাওয়া পাকা ঘর। তারই পাশে ঘন গাছগাছালির আড়ালে তাঁবু। সেই তাঁবুর রংও ধূসর। দূর থেকে দেখে কেউ বুঝবে না এখানে ক্যাম্প গাড়া হয়েছে। মাঠে সবুজ ঘাস। এই এলাকায় বৃষ্টি হয় খুব বেশি। পশ্চিম দিকে শ্রীমঙ্গল। চা-বাগান সীমান্তের ওপার ওপার দুই পারেই। সমান মাপে কাটা চা-বাগানের মাথার ওপারে ছায়াবৃক্ষের সারি।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। পশ্চিমাকাশে কে যেন হলদি গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে। অস্তরাগ এসে পড়েছে হামিদুর রহমানের মুখের এক পাশে। চুলের এক পাশটায় রঙিন আলো ওর মুখে শৈশবের লালিত্যকে উসকে দিতে চাইছে। কিন্তু তার শক্ত চোয়াল ফুটিয়ে তুলতে চাইছে সৈনিক জীবনের দৃঢ়তা। অবরুদ্ধ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তারা লড়ছেন। ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে তারা প্রায়ই ঢুকে পড়ছেন দেশের ভেতরে। মুক্তিবাহিনীর জীবন, কঠিন জীবন।
হামিদুর বলে, স্যার। আপনার কথা শুনে আমার আরেকটা কথা বলতে ইচ্ছে করতিছে। বলি স্যার?
বলো। লে. কাইয়ুম বসে আছেন একটা টিপয়ের ওপরে। মিউনিসিপ্যাল ঘরটার বারান্দায়। হামিদুর রহমান মাঠে। মাঠের ঘাস চারদিকে লেফট-রাইট করার লাইন ধরে মরে একটা ট্র্যাক তৈরি করে রেখেছে।
হামিদুর বলে, স্যার। আপনি বললেন না, পাক করার কায়দার কথা। আমার মায়ের নামও স্যার কায়দা।
লে. কাইয়ুম বলেন, মানে?
আমার মায়ের নাম স্যার কায়েদাতুননেসা। তাইলে স্যার কায়দাই হলো?
তা হলো।
আর তোমার বাবার নাম?
আমার পিতার নাম স্যার আক্কাস আলী মণ্ডল।
তার দ্বারা কী বোঝা গেল?
স্যার?
তার দ্বারা বোঝা গেল তোমার পিতা মোড়ল ছিলেন।
না স্যার। জমিজমা কিছু নাই স্যার। সে আমাদের দাদা বা দাদার দাদার কোনো দিন কিছু ছিল কি না তা তো জানি না। কিন্তু আমাদের স্যার কিছু নাই তো। বাবা তো দিনমজুরি করে খায়। এই ধরেন আমাকে নিয়েই তাদের যত আশা। আমি তো স্যার বলেছি, তোমাদের চিন্তা করতে হবি নানে, আমার স্যার আছেন। আমাকে তিনি রান্নার কাজ থেকে প্রমোশন দিয়ে সিপাহি করেছেন। তোমরা দোয়া করো। দেশ স্বাধীন হলে তোমাদের অভাব থাকবিনে। কারও অভাবই থাকবে না। আমিও তো সিপাহি হয়েই গিয়েছি। দেশ স্বাধীন হলে স্যার মানুষ কি আর না খেয়ে কষ্ট পাবি স্যার?
না। তা কেন পাবে?
স্যার। মা বলিছেন, মা আপনের জন্যি অনেক দোয়া করেন স্যার। নামাজের শেষে নামাজের জায়গায় বসেই দোয়া করেন।
কবে বললেন তিনি তোমাকে এত কথা?
আমি স্যার গেলাম না মার্চ মাসের শেষের দিকে। চট্টগ্রাম থেকে চলে গেলাম তো ঝিনাইদহে। সেখান থেকে ধরেন আমাদের কালীগঞ্জের খদ্দ খালিশপুর গ্রামে। অল্পের জন্যে না সেই রাতে বেঁচে গেলাম। আপনিও বাঁচলেন, আমাদেরও বাঁচালেন। আগে থেকেই তো বলে রেখেছিলেন যে ওরা আক্রমণ করার আগেই আমরা রিভোল্ট করব। তবু তো স্যার কত বাঙালি জওয়ান আর অফিসারকে পাঞ্জাবিরা মেরে ফেলল। আমরা না হয় আপনার অর্ডারে আর বুদ্ধি-বিবেচনায় সটকে যেতে পারলাম। তবে স্যার আমি প্রথমে বাড়ি গিয়েছিলাম।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলে। তাই আমাদের বিদ্রোহী দলে না এসে ঝিনাইদহ চলে গেলে।
হামিদুর লজ্জা পায়। গোধূলির আলোয় তার মুখখানা আরও লাজরাঙা হয়ে ওঠে। সে বলে, না স্যার। ভ্যাবাচেকা খাই নাই। মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল স্যার। ঝিনেদাতে স্যার মুজাহিদ বাহিনীতে জয়েন করেছিলাম। লেখাপড়া তো বেশি দূর করিনি। ক্লাস ফাইভ পাস দিয়েছি। পরে গিয়েছিলাম হাইস্কুলে। পড়াশোনা করার সামর্থ্য তো ছিল না স্যার। বাবা দিনমজুর। ববাঝেনই তো। তো জয়েন করলাম মুজাহিদ বাহিনীতে। সেখানেই দেখি, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা ট্রেনিং করছে। কী সুন্দর মার্চ করে, পিটি প্যারেড করে। খোঁজখবর নিয়ে আমিও জয়েন করে ফেললাম। সেখান থেকে ট্রেনিং করতে চলে গেলাম চট্টগ্রামে। ট্রেনিং আর কী স্যার। খালি গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর। শেখ সাহেব তো দেশ স্বাধীন করে ফেলবেই। পাঞ্জাবিরা বিদায় নিবে। যদি দরকার হয় আমরা হাতিয়ার হাতে নিব। শেখ সাহেব একবার হুকুম দিলেই হয়। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমরা তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম স্যার। তাই ভ্যাবাচেকা খাই নাই। কিন্তু মায়ের মুখটা মনে পড়ল স্যার। মা তো স্যার। আমারে দেখতে চায়। চট্টগ্রাম মেসে থেকে বের হব, দেখি হলুদ পোস্টকার্ড। মায়ের চিঠি। মা লেখাপড়া তেমন জানে না। তবু চিঠি লেখে। লিখছে, বাবা হামিদুর তোমাকে কত দিন দেখি না। মনটা পোড়ে। দেশের পরিস্থিতিতেও তোমাকে নিয়া ভাবনা হয়। চিঠিটা পড়ে ভাবলাম, দেশের লাইগে যুদ্ধে তো যাবই। যাই, মায়ের মুখটা একটু দেখে আসি। মায়ের দোয়া হলো আসল দোয়া। কী বলেন স্যার।
নিশ্চয়ই। রাতের বেলা ডালটা তুমি রাধবে তো, হামিদুর?
অবশ্যই স্যার। ডাল রাঁধব। আজ রাতে স্যার রুটি না স্যার। ভাতই পাক করব স্যার। আপনে আমার হাতের পাক পছন্দ করেন। আপনি আমাকে বাবুর্চি থেকে সিপাহিতে প্রমোশন দিয়েছেন। আপনি যা বলবেন, আমি তা-ই করব স্যার। আপনি বললে স্যার এখনই জান দিয়ে দেব। ধরেন স্যার পাকিস্তানি ট্যাংক আসতেছে। আপনি বললেন, যাও হামিদুর এই মাইন বুকে বেঁধে ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ো। লাই ডাউন। আমি বলব, ইয়েস স্যার। থ্যাংক ইউ স্যার। জয় বাংলা। আমি আল্লাহর নাম নিয়ে শুয়ে পড়ব।
তা তুমি করবে আমি জানি।
চট্টগ্রামে ট্রেনিং একাডেমিতে স্যার আমাদের বাঙালি অফিসারদের আর জওয়ানদের স্যার ২৫ মার্চ রাতে যেভাবে ওরা পাইকারিভাবে ক্লোজ করে লাইন করে গুলি করেছে স্যার…আমাকে স্যার অর্ডার দেন স্যার আমি এখনই চলে যাব স্যার…মাইন দেন…গ্রেনেড দেন…।
ঠান্ডা হও হামিদুর। এক দিনে লড়াইয়ে জেতা যায় না। একটা একটা করে ব্যাটল লড়তে হয়। অনেক ব্যাটলে তুমি সামনে এগোবে। অনেক ব্যাটলে পেছনে হটবে। আসলে তুমি জিততে চাও ওয়ার। রাইট?
ইয়েস স্যার।
সূর্যের আলো কমে আসছে। আকাশে ঝাঁক বেঁধে পাখিরা ঘরে ফিরছে। আর্মি ব্যাটালিয়নের মতো একজন তার পেছনে দুজন তার পেছনে তিনজন–এই অর্ডারে পাখিরা উড়ছে। মাথার ওপরে একটা কামরাঙাগাছ। টিয়াপাখি ঝাঁক বেঁধে হল্লাচিল্লা করা শুরু করেছে।
যাও হামিদুর। আজকে রাতের খাবার রান্নাটা তুমি একটু টেককেয়ার করো।
স্যালুট স্যার। আমি নিজ হাত পাক করব স্যার।
.
হামিদুর লঙ্গরখানার দিকে যায়। স্যারের জন্য সে আজকে ভাত রাঁধবে। মুরগি জোগাড় করতে হবে। এই শিবিরে খাবারের অবস্থা তেমন ভালো নয়। রাতে দুটো করে রুটি আর খোসাসমেত ডাল। দুপুরে ভাত আর সবজি। মাছ বা মুরগি সপ্তাহে দুদিন। নিজেদের ডেইলি ভাতা থেকে চাঁদা দিয়ে তারা মাঝেমধ্যে একটু ভালো খাওয়ার চেষ্টা করে। লে. কাইয়ুম বলেন, খাওয়া ভালো দরকার সৈনিকদের। তাহলে তারা যুদ্ধটা ভালোমতো করতে পারবে।
.
অক্টোবর মাস। ২৮ তারিখ। হেমন্তের এই দিনেই এবার শীত পড়েছে ভয়ংকর। সারা রাত কুয়াশায় ঢাকা থাকে চা-বাগান, ছায়াবৃক্ষ আর পাহাড়ের ঢাল ভরে থাকা বিচিত্র বৃক্ষরাজি। এরই ফাঁক দিয়ে বয়ে যায় স্রোতস্বিনী পাহাড়ি ঝরনা। দুপুরের দিকে রোদ পড়লে দূর থেকে মনে হয় গলে যাওয়া রুপার বিছা যেন কোনো পাহাড়ি রমণীর শ্যামল কোমর ঘিরে ঝকমক করছে।
সীমান্তের ওপারে শ্রীমঙ্গলের ধলই। সেখানে পাকিস্তানি পোস্ট। ওই পোস্ট আক্রমণ করা হবে। দখলমুক্ত করা হবে ধলই। সেখানে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-হলুদ-সবুজ পতাকা।
লে. কাইয়ুমের নেতৃত্বে চলেছে মুক্তিবাহিনীর দল। কুয়াশার আড়ালে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে যাওয়া সহজ হবে। ওরা টেরও পাবে না। তিন দিক থেকে ঘিরে ধরবে ওরা শত্রুদের। পেছনের দিকটা খোলা রাখবে যাতে শত্রুরা পশ্চাদপসরণ করতে পারে।
তাদের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ আছে পর্যাপ্ত। এই যুদ্ধে জয়লাভ না করার কোনো কারণ নেই। তবে যথাসম্ভব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের লক্ষ নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি যত কম করা যায়। আর শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা যায় যত বেশি। ওদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ দখল করা যায় যত বেশি।
তাদের মুক্তিসেনার দলে এবার থাকছে সিপাহি হামিদুরও। রান্নার কাজ থেকে প্রমোশন দিয়ে তাকে লে. কাইয়ুম তাঁর রানার বানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমে মুজাহিদের ট্রেনিং পাওয়া আর পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রেনিং তার মনোবল আর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। সে তাই সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া শুরু করেছে। কোদালকাঠি পাকিস্তানি পোেস্ট দখলের লড়াইয়ে দেখা গেছে হামিদুর ভালো করেছে। অল্প বয়স, শরীর-স্বাস্থ্য সুঠাম, আর বেসিক ট্রেনিং অনেক এফএফের চেয়ে ভালো। যোদ্ধা হিসেবে তাই তার ভালো করারই কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তার সাহস আছে, সে কথা শোনে, যা বলা হবে, তা-ই পালন করবে। এমন সৈনিকই তো অধিনায়কদের প্রথম পছন্দের।
কুয়াশার চাদরে ঢেকে তারা ধীরে ধীরে পা রাখে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে। ধলই পোস্টটার চারদিকে গাছগাছালি কেটে ওরা পরিষ্কার করে রেখেছে। সেটা ১৬০০ বর্গগজের বেশি জায়গা নয়।
কিন্তু তার চারপাশে চা-বাগান, পাহাড়ের চড়াই-উতরাই, গাছগাছালি প্রচুর। আক্রমণ করার জন্য আদর্শ জায়গা। অসুবিধা হলো, ওদের পোস্টটা ওরা বানিয়েছে উঁচুতে। সেখান থেকে গুলি ছুড়লে নিচের আক্রমণকারীরা অসুবিধায় পড়বেই।
তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলা সম্পন্ন। লে. কাইয়ুম প্রথম ফায়ারটা করবেন। তারপর তিন দিক থেকে একযোগে প্রচণ্ড আক্রমণ করবে মুক্তিযোদ্ধারা। প্রথমেই প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করলে অনেক সময় কাজ হয়। শত্রুরা শক্তির প্রচণ্ডতা আঁচ করে সহজেই রণে ভঙ্গ দেয়।
কিন্তু কুয়াশা এত নিচু হয়ে আছে যে ঠিকভাবে ওদের পোস্টটা দেখা যাচ্ছে না। গাছের ওপরে আলো ফুটে আছে। কিন্তু মানুষসমান উচ্চতায় কুয়াশা। তারা সামনে কিছুই দেখছে না।
একটা উপায় আছে। একজনকে গাছে তুলে দেওয়া।
সে ওপর থেকে দেখুক, এক্সাক্টলি কোন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটিটা।
একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলে উঠে পড়ে গাছে। স্যার, ঠিক এই বরাবর স্যার।
বলতেই না বলতেই শত্রুবাহিনী গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। মুহূর্তেই গর্জে ওঠে লে. কাইয়ুমের রাইফেল। আর তিন দিক থেকে শত্রুবাহিনীর গুলির উৎস। অভিমুখে একযোগে পাল্টা গুলি চালাতে থাকে মুক্তিবাহিনী।
উভয় পক্ষ গুলি চালাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী এগোতে পারছে না। ওদের এলএমজি পোস্টটা বড় জ্বালাচ্ছে। ঠিকমতো বসিয়েছে তারা এলএমজি। সেই। এলএমজির নাগালের মধ্যে কিছুতেই ঢোকা যাচ্ছে না।
না। আর তো সহ্য করা যায় না। আজ যে করেই হোক, ধলই তারা শত্রুমুক্ত করবেই।
একটাই করণীয়।
একজনকে সাহস দেখাতে হবে। ক্রল করে যেতে হবে পোস্টের একেবারে হাতের নাগালে। হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে হবে এলএমজি পোস্টের বাংকারে। তাহলেই নিষ্ক্রিয় হবে শত্রুর এলএমজি। তারপর ধলই দখল মুহূর্ত কয়েকের ব্যাপার।
লে. কাইয়ুম তখন একটা নালার ভেতরে। দুপাশে নলখাগড়া, ঢোলকলমি, কলমিলতা, ধঞ্চে, লজ্জাবতী, শটির ঝোঁপঝাড়। কাশেমের পায়ে সেঁক গেঁথে বসেছে। নলিনের কনুই ছড়ে গেছে কাঁটাগাছে। রক্ত ঝরছে। কিন্তু যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে এগুলো কোনো খেয়াল করার মতো ব্যাপারই নয়।
মাথার ওপর দিয়ে শাই করে শাঁই করে গুলি উড়ে যাচ্ছে।
পাখিরা আর্তনাদ করে উড়ে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে যেদিকে পারে।
লে. কাইয়ুম বললেন, একজন সাহসী জওয়ান আমার দরকার। কে যাবে? এলএমজি পোস্টে যাবে পেছন দিক দিয়ে। ক্রল করে, চা-পাতা, ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে দ্রুত। দুটো গ্রেনেড দিচ্ছি সঙ্গে। বাংকারের ভেতরে গ্রেনেড ছুঁড়তে হবে। এলএমজিটা থামিয়ে দিতে পারলেই উই উইল ব্রেক ইন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তিন দিক থেকে একযোগে ঢুকে যাব। ওদের বাকি লোকেরা তখন পালানোর পথ পাবে না। ওদের এলএমজি পোস্ট হবে আমাদের এলএমজি পোস্ট। কে যাবে?
হামিদুর বলল, আমি যাব স্যার।
সময় নেই। দ্রুত দুটো গ্রেনেড তুলে দেওয়া হলো হামিদুরের হাতে।
হামিদুর ক্রল করছে গুইসাপের মতো। কিন্তু দ্রুত। চা-পাতা নড়ছে। বিষকাটালির ঝোঁপ দুলছে।
লে. কাইয়ুম বললেন, শত্রুর দৃষ্টি ঘোরাতে হবে। ডান দিকে সরে যাও। আক্রমণ বাড়াও।
ডান দিক থেকে হঠাৎ আক্রমণ। শত্রু বিভ্রান্ত।
বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন কাইয়ুম। কুয়াশাটা কি আজকে যাবেই না। না যাওয়াই ভালো। তাহলে কুয়াশার আড়ালে হামিদুর পৌঁছে যেতে পারবে শত্রুর পোস্টে।
.
দ্রিম দ্রিম। দুটো গ্রেনেড চার্জের শব্দ।
তারপর স্তব্ধতা। মানে এলএমজি পোেস্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
কুইক মার্চ।
এক দল মুক্তিবাহিনী ছুটে গেল এলএমজি পোস্টে। তখনো সেখানে ধোঁয়া উড়ছে। সেখান থেকে নিজেদের এলএমজি বসিয়ে এবার তারা গুলি ছুঁড়তে লাগল শত্রুসেনাদের ওপরে। শত্রুরা দ্রুত পশ্চাদপসরণ করছে।
ধলই শত্রুমুক্ত হলো। সেকেন্ড ইন কমান্ড দ্রুত পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলল। সেখানে উড়িয়ে দেওয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মুক্তিসেনারা জয় বাংলা বলে স্যালুট করল স্বাধীন বাংলার পতাকাকে।
কিন্তু হামিদুর কই?
লে. কাইয়ুম চিৎকার করে উঠলেন, হামিদুর, হামিদুর।
পাহাড়ের ঢালে ঢালে সেই ডাক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠতে লাগল।
স্যার। স্যার…মা গো!
ছুটে গেল সবাই। এলএমজি পোস্টের ১০ গজ নিচে পড়ে আছে হামিদুর। রক্তে তার কাঁধ ভেসে যাচ্ছে। পেটের দিকটায় রক্তের বন্যা।
হামিদুর বলল, স্যার, একটা কথা। আমি তো যাচ্ছি। আপনারা কথা দেন, দেশকে স্বাধীন করবেনই, আমার মা…
আর কথা বলতে পারল না সে। স্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু।
মুক্তিযোদ্ধারা তার বডি কাঁধে তুলল।
নিয়ে এল তাকে আম্বাসার হাতিমারাছড়ায়। ত্রিপুরা জেলায়।
সেখানেই কবরস্থ করা হচ্ছে তাকে। কাঁচা মাটি দেওয়া হচ্ছে তার বডির ওপরে। দেশের মুক্তির জন্য সে শহীদ হয়েছে। হে আল্লাহ, তাকে শহীদের মর্যাদা দাও। তার গোরটা বেহেশতের বাগানে পরিণত করো।
কাইয়ুম মোনাজাত ধরেন। সবাই তাঁর সঙ্গে বলে ওঠে আমিন।
.
বহুদিন লে. কাইয়ুমের মনে হয়েছিল, হামিদুর কী বলতে চেয়েছিল শেষ মুহূর্তটিতে?
তাঁকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, মাতৃভূমি কী। তিনি বলেছিলেন, দেশই হলো মা।
সে কি মায়ের কাছে ফিরতে চেয়েছিল? সে কি চেয়েছিল তার শেষ আশ্রয় হোক মায়ের কোলে? কবরটা হোক দেশের মাটিতে?
তার শহীদ হওয়ার ৩৬ বছর পরে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কবর উত্তোলন করে ত্রিপুরা থেকে ঢাকার মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নেওয়া হয়।
হামিদুর তার মায়ের কাছে ফিরে আসতে পেরেছে।
৭১
সারা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার তীব্র নিন্দা করছিলেন। বিশ্ববিবেক নড়ে উঠেছিল। শুধু আমেরিকার নিক্সন ও কিসিঞ্জার ছাড়া পুরো আমেরিকার প্রতিটা সচেতন মানুষই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর ডেকে বললেন আমেরিকার বিখ্যাত পপগায়ক জর্জ হ্যারিসনকে, বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হলো পৃথিবীর প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট। ১ আগস্টের সেই দুপুরে আর রাতে ৪০ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল। বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্লাপটন, বিলি প্রেস্টন, লিয়ন রাসেলের মতো মহাতারকারা গাইলেন। ব্যাডফিঙ্গারের মতো ব্যান্ড মঞ্চে উঠল। আকবর আলী খান আর রবিশঙ্কর তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটামাটির জন্য জয় বাংলা ধুন বাজালেন। আমেরিকার সাধারণ মানুষ ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বাল্টিমোরের বন্দরে পদ্ম নামের জাহাজ ঘিরে ধরেছিল, যাতে পাকিস্তানকে আমেরিকা অস্ত্র পাঠাতে না পারে। আঁদ্রে মার্লে, ৭০ বছর বয়সী ফরাসি দার্শনিক, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী, লেখক, যিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, ঘোষণা করেন, তিনি বাংলাদেশে যাবেন, বাংলাদেশের মানুষের হয়ে পাকিস্তানি নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। ১৯৭১ সালে পৃথিবীর দেশে দেশে যে প্রবাসী বাঙালিরা ছিলেন, তাঁরা একযোগে তৎপরতা শুরু করেন। রাজপথে মিছিল করে, গান গেয়ে, অবস্থান। ধর্মঘট করে, লবি করে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানে দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিকদের অনেকেই পক্ষ ত্যাগ করেন। এমনকি খোদ পাকিস্তানে বহু সাহিত্যিক বাংলাদেশের পক্ষে কলম ধরে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস নামের এক পাকিস্তানি সাংবাদিককে পাকিস্তানি জান্তা পূর্ব পাকিস্তান সফরকারী সাংবাদিক দলে অন্তর্ভুক্ত করে সবকিছু স্বাভাবিক আছে এই কথা লেখার জন্য, তিনি ফিরে গিয়ে প্রথমে তাঁর পরিবার-পরিজনকে বিলেতে পাঠান, তারপর নিজে বিলেত গিয়ে ১৩ জুন সানডে টাইমস-এ প্রকাশ করেন এক ভয়াবহ প্রতিবেদন, যার শিরোনামই ছিল জেনোসাইড। যেমন লিখেছিলেন সায়মন ড্রিং, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে সেনাবাহিনীর নজর এড়িয়ে পালিয়ে গিয়ে, ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ ৩০ মার্চ ১৯৭১, আল্লাহ ও পাকিস্তানের নামে শুরু করা লড়াইয়ে ঢাকা এখন ধ্বংস ও ভীতির নগরী। ক্রমাগত লিখে গেছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এ সিডনি শনবার্গ। আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় হয়েছিলেন হোর্হে লুইস বোর্হেস আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো সাহিত্যিকেরা। অ্যালেন গিন্সবার্গ কবিতা লিখেছিলেন : সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। জোয়ান বায়েজ গান বেঁধেছিলেন : বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এমন কোনো পরিবার নেই, যারা দেশের ভেতরে বা বাইরে পালায়নি, আবাস বদল করেনি। এমন থানা নেই, যেখানে হাজারো মানুষ মারা যায়নি। প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। কলেরায়, অনাহারে, অপুষ্টিতে, পথের ক্লান্তিতে তাদের কতজন যে মারা গেছে। দুই লাখ থেকে চার লাখ নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। পৃথিবীর বিবেকবান সচেতন মানুষ প্রতিবাদ করেছে, নিন্দা করেছে, কিন্তু যাদের হাতে ছিল মানুষকে বাঁচানোর ভার, সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর তাঁর উপদেষ্টা কিসিঞ্জার একটিবারের জন্যও ইয়াহিয়া আমাদের বন্ধু এই নীতি থেকে সরেননি। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানের জন্যই চাপ সৃষ্টি করছিল।
ইন্দিরা গান্ধী দেখলেন তিনি একা। ৫৩ বছরের ভারতীয় নারী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা একা। তবে তাঁর সঙ্গে আছে দেশের মানুষ। বিরোধী দলের ভীষণ চাপ, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও। তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিশ্বজনমতকে নিজের দিকে নেওয়ার জন্য।
প্রথমে ব্রাসেলস, তারপর ভিয়েনা। তারপর গেলেন লন্ডন। তিনি শুধু সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করলেন তা নয়, সিভিল সোসাইটির সঙ্গে বসলেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেন।
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয় : ভারত কি গেরিলাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে শরণার্থীর স্রোত তৈরি করছে না। সেটা বন্ধ করে কি পরিস্থিতি শান্ত করা যায় না?
ইন্দিরা গান্ধী দৃঢ়কণ্ঠে বললেন : তার মানে কি আমরা ম্যাসাকার চলতে দেব? এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে তখন, যখন একজনও গেরিলা সেখানে ছিল না। পরিস্থিতি শান্ত করা মানে কী? আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? যখন হিটলার তার হত্যাযজ্ঞ শুরু করল, তখন কেন আপনারা বলেননি যে এসো শান্ত হয়ে থাকি। শান্ত হয়ে থাকা মানে কী? এর মানে কি আপনি গণহত্যা চলতে দেবেন? আপনারা কেন বলেননি ইহুদিদের মরতে দাও, বেলজিয়ামকে মরতে দাও, ফ্রান্সকে মরতে দাও? এই ঘটনা ঘটতেই পারত না, শুরুতে যখন আমরা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম, তখন যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
৪ নভেম্বর ওয়াশিংটন ডিসির ওভাল অফিসে ইন্দিরা গান্ধী, হাকসার, নিক্সন, কিসিঞ্জার বসলেন।
নিক্সন বললেন, আপনারা সৈন্য প্রত্যাহার করুন। পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার করবে। ইয়াহিয়া খান রাজি আছে প্রাদেশিক সরকারের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। আমি অবশ্য বলতে পারি না যে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলবে কি না। এটা তাদের ব্যাপার। আর আমি ইয়াহিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার মতো কিছু করতে বলতে পারি না। সামরিক পদক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক হবে।
ইন্দিরা বললেন, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান এক থাকবে, এটার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা আর নেই। আর সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ।
নিক্সন আর কিসিঞ্জার পরের দিন এই নিয়ে আলোচনা করেছেন। কথাবার্তা এমন ছিল, নিক্সন বললেন, আগেই বলিনি, ইন্দিরা একটা কুত্তি। আমরা বুড়ি কুত্তির মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছি।
ইন্ডিয়ানরা বাস্টার্ড। ও একটা কুত্তি। ওরা একটা যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে। সে তো এসেছে যুদ্ধ শুরু করার অজুহাত খুঁজতে। আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম, আমেরিকা আমাকে ভালোমতো বরণ করেনি। রাগে-দুঃখে আমি যুদ্ধ শুরু করলাম।–এটা আর সে বলতে পারবে না।
নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছেন, তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেন। না, ইয়াহিয়াকে বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে, তারা শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য দিতে থাকবে। কিন্তু ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায় তার পরিণতি খুব খারাপ হবে। সুপারপাওয়ারগুলো নাক গলাবে।
নিক্সন জানান, আমরা কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করছি।
ইন্দিরা গান্ধীও জানিয়ে দেন, আমরা রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছি।
কিসিঞ্জার ভারতের প্রধান সচিব হাকসারকে, যাকে তিনি আড়ালে ডাকেন একজন ক্লাউন বলে, বললেন, গত তিন মাসে তোমরা কী করেছ? সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছ আমরা তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু, ক্রমাগতভাবে আমাদের গালিগালাজ করেছ, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছ আর কেনেডিকে নিয়ে গেছ ভারতে। এখন এসে আমাদের বলছ সব সমস্যার সমাধান করব আমরা। যাও।
বিকেলে তারা আবার বসলেন। নিক্সন বলে রেখেছিলেন, এবার আমি কুল থাকব।
কিন্তু কুল থাকলেন ইন্দিরা। তিনি দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে একটা কথাও বললেন না। আমেরিকার বিদেশ নীতি নিয়ে নানান কথা বলতে লাগলেন।
এক মাস পরেও নিক্সন সে কথা ভুলতে পারেন না। মহিলা এমন শীতল। সে তো আমাকে জব্দ করে মারল। আমি তার সামনে সহজ হতেই পারলাম না।
.
ইন্দিরা গেলেন নিউইয়র্কে। সেখানে একটা সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হলো।
পোড়া কমলা রঙের ব্লাউজ, সাদা কমলাটে প্রিন্টের শিফন ধরনের শাড়ি, কান পর্যন্ত চুল, কিছুটা বলা যায় ববকাট চুল, ঈষৎ সাদা, বাকিটা কাঁচা, ৫৩ বছরের ইন্দিরা কথা বলছিলেন মাটির দিকে চোখ রেখে। মনে হচ্ছিল। টেলিভিশনের ক্যামেরা এবং উজ্জ্বল আলোর দিকে তিনি তাকাতে পারছিলেন না।
মিসেস গান্ধী, পাকিস্তান পরিস্থিতি কী রকম? প্রথম প্রশ্ন।
খুবই সিরিয়াস। বলে তিনি থামলেন। তারপর বললেন, দুটো সেনাবাহিনী মুখোমুখি। তারা প্রায়ই একে অপরের দিকে গোলা ছুড়ছে। আমি আসার আগে তা-ই দেখে এসেছি।
এটা কতটা সম্ভব যে পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করে বসবে?
যখন একটা দেশে অরাজকতা হয়, তখন এই রকম আক্রমণ হতে পারে, যাতে করে বাইরের আক্রমণ একটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে।
আপনার অবস্থা কী? এমন কি হতে পারে আপনি পাকিস্তান আক্রমণ করে বসবেন?
আমি আশা করি, না। তিনি হাসলেন। আবার বললেন, ভারতের অবস্থান হলো শান্তির পক্ষে, মীমাংসার পক্ষে। কিন্তু আমরা আমাদের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করতে পারি না।
আপনি কি মনে করেন যে ভারত-পাকিস্তান একটা যুদ্ধ আসন্ন?
এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। কারণ, আমি বলেছি, আমরা যেভাবে করা সম্ভব যুদ্ধ এড়ানোর জন্য করছি।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রস্তাব করছেন আপনি আপনার কিছু সৈন্য সীমান্ত থেকে প্রত্যাহার করে নিন।
পাকিস্তান আমাদের আগে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে। আমাদের বিপন্ন করেছে। তখন কেউ কিছুই বলেনি। তারপর আমরা সৈন্য নিয়ে গেছি। এখন সারা পৃথিবীর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে বলি, আমার কিন্তু কোনো দ্বিতীয় চিন্তা নেই। আমরা আর কিছু করব বলে ভেবে রাখিনি। ওরা সৈন্য সমাবেশ করবে, আর আমি সৈন্য প্রত্যাহার করব, আমার দেশের জন্য মানুষের জন্য আমার কর্তব্য তাতে পালিত হয় না। একটা কথা বলি। আমরা কখনো কখনো কখনো কাউকে আঘাত করি নাই। তিনবার আমরা আক্রান্ত হয়েছি।
কিন্তু আপনি কি বাংলাদেশ গেরিলাদের সমর্থন করেন?
এটা সমর্থন করা না-করার ব্যাপার নয়। কথা হলো, কী ঘটতে যাচ্ছে। আপনি আপনার প্রতিবেশী দেশে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তার ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেন না। আমি খোলাখুলিভাবে বলে আসছি, পাকিস্তান রাষ্ট্রটা এখন যেভাবে আছে সেই ভাবে থাকতে পারে না।
আপনি কি মনে করেন না আপনি যদি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতেন, একে অপরকে বুঝতেন তাহলে আপনার বিপদ কম হতো?
আপনি কি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কোনো ভাষণ কিংবা সাক্ষাৎকার পড়ে দেখেছেন?
জি পড়েছি।
তারপরেও আপনি মনে করেন তাঁর সঙ্গে দেখা করলে উদ্দেশ্য সফল হবে?
আপনি দেখা করলে বুঝতেন যে কেন আপনার সৈন্য ওখানে সমবেত হয়েছে।
আমি খুব বুঝি কেন সমবেত হয়েছে। কারণ, আমার দেশ বিপন্ন। আমার জনগণ হুমকির মুখে। আপনি জানেন না যে আমি কতটা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছি। আমার দেশের মানুষ কিন্তু এতটা ধৈর্য ধরতে চাইছে না। আপনি আমার সঙ্গে বসতে বলছেন এমন একটা সরকারকে যারা লাখ লাখ মানুষ মেরে ফেলেছে। হিটলার ইহুদিদের সঙ্গে যা করেছে, তা ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।
পূর্ব বাংলার ভাগ্যে কী হবে?
এটা পূর্ব বাংলার নেতারা ঠিক করবেন।
এত শরণার্থী আসছে। কতখানি সহ্য করবেন?
আমরা সহ্য করতে আর পারছি না।
কী করবেন?
আমি একটা কথা বলি, সব ধর্মের সব শরণার্থীকে ফিরে যেতে হবে।
ইন্দিরা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪০০ জন শ্রোতার সামনে কথা বলেন। তিনি বলেন, ৯০ লাখ শরণার্থীর ভার আমরা আর সইতে পারছি না। আমরা আপনাদের সমর্থন চাই, সহানুভূতি চাই, সাহায্য চাই। তবে ইন্ডিয়া প্রস্তুত এবং ইন্ডিয়া সক্ষম একাকী এই লড়াই করতে, যে লড়াই করা উচিত বলে সে মনে করে।
ভীষণ জেদ নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী উঠলেন বিমানে। আমেরিকা তাঁকে এত অপমান করতে পারল? তবে ছেলের বউদের জন্য কুড়ি মিনিটে ৬টা ড্রেস নিজে ট্রায়াল দিয়ে কিনতে তিনি ভুললেন না।
ঠিক আছে। আমিও এর শোধ নেব। আমিও আমার বাবারই মেয়ে।
তিনি ফ্রান্সে গেলেন। ফ্রান্স ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। তারা কথা বলল মেপে। ব্রিটেন বলল, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানো। যায়।
ইন্দিরা বললেন, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক কী করবে?
মুজিবকে নিয়ে বসলে কী হয়?
মুজিবও স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছুতে রাজি হতে পারবেন না।
সৈন্য প্রত্যাহার করুন।
বেশি দূরে নিতে পারব না।
.
হাকসার আর কাউলের সঙ্গে বসলেন অন্য ব্রিটিশ কর্তারা।
সরাসরি মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া বসতে পারেন না? ব্রিটিশ কর্তারা বললেন।
পারেন হয়তো। তবে স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছুর জন্য না।
তবে ইয়াহিয়া লোকটা তো মাতাল। স্টুপিড। সে তো কোনো আলাপেই রাজি না। বললেন ব্রিটিশরা।
জার্মানদের সঙ্গে কথা একই হলো। ইন্দিরা বললেন, পাকিস্তান শেখ মুজিবের সঙ্গে বসুক। সমস্যার সমাধান করুক। আমরা গেরিলাদের সমর্থন করি। যতটুকু না করলেই নয়। ভারত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক চায় না।
.
জার্মানরা বুঝল, যুদ্ধ আসন্ন।
৭২
ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকায়। কূটনৈতিক সূত্রে খবর, নিক্সন, কিসিঞ্জার তাঁকে পাত্তা দেবেন না। তার মানে, তিনি আরও বেশি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকবেন। ইয়াহিয়া সেপ্টেম্বরে ইসলামাবাদে আসা ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত জয় কুমার অটলের মাধ্যমে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইন্দিরার কাছে। ছয় দফার ভিত্তিতে ফয়সালার জন্য আলোচনা শুরু করতে ইয়াহিয়া রাজি আছেন, এই ছিল চিঠির প্রতিপাদ্য। ইন্দিরা চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই মহিলার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সে যুদ্ধ করতে চায়। আমরাও যুদ্ধ করব। আমাদেরটা জিহাদ। গেলাসে নিজ হাতে হুইস্কি ঢেলে নিয়ে আরেক গ্লাস ভুট্টোর দিকে ঠেলে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়া। খান বললেন, জুলফি, যুদ্ধ হলে আমরা জয়লাভ করব কি না!
ভুট্টো তখনো গ্লাস হাতে ধরেননি। তিনি বললেন, ডিপেন্ড করে দুটো ফ্যাক্টরের ওপরে।
কোন দুটো ফ্যাক্টর?
এক. চীন আমাদের পাশে দাঁড়াবে কি না। ভারতকে আক্রমণ করে বসবে। কি না। দুই. সে ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাফেরগুলোকে ঠেকাতে মহান। আমেরিকা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে কি না-ভুট্টো এবার গ্লাস হাতে নিলেন। এক টুকরা বরফ তার সোনালি পানীয়তে ভাসছে।
নো নো। আমরা জানি আমাদের কে হেল্প করবেন। এটা জিহাদ। আমাদের একজন সৈন্য হিন্দুস্তানের এক শ সৈন্যের সমান।
কিন্তু যে সৈন্যদের প্রধান একজন মাতাল, তাদের পাশে কি আল্লাহ আসবেন?
জুলফি। আমি তো মাতাল নই। আমি কখনো মাতাল হই না। ইয়েস, বেহেশতে গেলে আমি তো ড্রিংক করবই। এখন সামান্য করি। যতটুকুন। ডাক্তার আমাকে অ্যালাউ করেন। আর মাতাল না হলে তার সৈন্যদের অবশ্যই খোদা সাহায্য করবেন। আমি মুসলমান। মুসলমানরা যুদ্ধে কখনো কাফেরদের সঙ্গে হারতে পারে না–ইয়াহিয়া আরেক পেগ হুইস্কি গ্লাসে ঢাললেন।
.
ভুট্টোরও তিন পেগ খাওয়া হয়ে গেছে। হুইস্কি পেটে পড়লেই হুসনা চলে আসে। ভুট্টোর মাথায় তখন হুসনা শেখ, বাঙালি উকিলের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী, পাঠান-বাঙালি রক্তের এক অপ্রতিরোধ্য-আকর্ষক নারী, দুই সন্তানের জননী, যে চলে এসেছে পশ্চিম পাকিস্তানে, করাচিতে দুটো বাড়ির মালিক, যাকে কারাবাসের দিনগুলোতে ভুলে যেতে চেয়েছিলেন ভুট্টো, সেই ১১ বছর ধরে যার সঙ্গে তার অকথ্য অসহ্য প্রেম, নুসরাত ভুট্টো যার নাম শুনলেই কাঁদতে থাকে। ভুট্টোর প্রথম কাজিন-বউ থাকে লারকানার তাদের বিশাল বাগানবাড়িটিতে। ভুট্টো হুসনা শেখকে কথা দিয়েছেন, তিনি তাকে বিয়ে করবেন ১৯৭১ সালের মধ্যেই।
ভুট্টো বাতাসে হাত নেড়ে হুসনাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, আগাজি, আমাকে ডেকেছেন কেন?
সহজবোধ্য কারণে। তোমার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তোমার মেয়েমানুষগুলোর সঙ্গে তোমার সম্পর্কের চেয়েও মধুর। তুমি পিকিং যাও। চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে দেখা করো। মাও সে তুংয়ের সঙ্গে দেখা করো। যদিও চীন আমাদের অনেকবার বলেছে, ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে তারা চুপ করে থাকবে না, কিন্তু কী করবে, এটা জানা দরকার। চুপ করে থাকব না, গান। গাইব, চুপ করে থাকব না, কান্নাকাটি করব–এসবের কোনো মানে হয় না। তারা কি মিলিটারিলি কিছু করবে? ইন্ডিয়া অ্যাটাক করবে? যাও। তুমি তোমার যে প্রতিভা দিয়ে নারী পটিয়ে থাকো, সেটার চরম ব্যবহার করে এসো। যাও। চীনের কাছ থেকে কথা নিয়ে এসো।
ভুট্টো আরও এক গেলাস ঢকঢক করে খেলেন। ততক্ষণে তার কথাও জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। হুসনাকে তিনি বিয়ে করবেন। নুসরাত কী করবে? ইয়াহিয়া খান আর কত দিন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বহু আসন খালি বলে ডিক্লেয়ার করেছেন, উপনির্বাচন দেবেন, এর ফলে, ভুট্টোই হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির লিডার, অতএব তিনিই হতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, অতএব নুসরাত হবে অফিশিয়াল ফার্স্ট লেডি। সে কেন আমাকে হুসনাকে বিয়ে করতে দেবে না? কেন? আমি হুসনাকে ভালোবাসি। আমি তাকে বিয়ে করব।
আগাজি, আমি যাচ্ছি পিকিং। সঙ্গে আর কে কে যাবে?
কাকে কাকে চাও। ফরেন সেক্রেটারি সুলতান খান, বিমানবাহিনী প্রধান মার্শাল রহিম খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান খান।
.
নভেম্বরের ৫ তারিখ বিকেলে প্লেন গিয়ে নামল পিকিংয়ে, বিমানবন্দরে স্বয়ং চৌ এন লাই, চীনের প্রধানমন্ত্রী। জুলফি নিজের জুলফিতে হাত দিলেন। তিনি হলেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট পুরুষ। চৌকে আসতেই হবে।
আরও ২৪ ঘণ্টা পরে, ৬ নভেম্বর বিকেলে, চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে কথা শুরু হলো।
ভুট্টো বললেন, চীন আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
চৌ নির্বিকার মুখে বললেন, সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং প্রতিবেশী। আমাদের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
ভুট্টো বললেন, ভারত তোমাদের পুরোনো শত্রু। আমাদেরও। আমরা দুই দেশই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি এবং যুদ্ধ করব।
চৌ চুপ করে থাকলেন।
ভুট্টো বললেন, ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে। যুদ্ধ কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা ভারতকে ছিন্নভিন্ন করে দেব।
চৌ বললেন, এভাবে না ভেবে বলি, যুদ্ধ এড়ানো ভালো। আমেরিকা ও রাশিয়া ভারতকে যুদ্ধ করতে দেবে না। মীমাংসাই শ্রেষ্ঠ পথ। তোমরা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ফয়সালা করে ফেলো।
তা আমরা করছি। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে টিক্কা খানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের লোক আর অন্যান্য দলের লোক নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি আসছে।
তাহলে ভালো। যুদ্ধ হচ্ছে না।
যুদ্ধ হচ্ছে। ভারত ছাড়বে না। আমরাই-বা ছাড়ব কেন। যখন মহান চীন আমাদের পাশে আছে।
দেখো বন্ধু, যুদ্ধ যদি হয়ই, তোমাদের কাজ হবে ছোট আকারে যুদ্ধ করা। যুদ্ধটাকে দীর্ঘস্থায়ী করা। কিছু জায়গা যদি ভারত দখলও করে ফেলে, ফেলুক। তোমাদের কাজ হবে সারা পৃথিবীকে দেখানো যে ভারত সম্প্রসারণবাদী। তারা দখলদার। তখন পৃথিবী তোমাদের জন্য এগিয়ে আসবে।
পৃথিবী দিয়ে আমাদের কাজ নেই। আমরা তোমাদের চাই। তোমরা কী করবে?
আমরা তোমাদের সমর্থন দেব। আমরা জাতিসংঘে এক চায়না হয়ে বসছি। এখন আমাদের ভয়েস আরও স্ট্রং হবে।
জাতিসংঘ বাদ দাও। তোমরা আমাদের যুদ্ধে সাহায্য করবে কী করে?
আমরা তোমাদের অস্ত্র দিচ্ছি। অস্ত্র দিয়ে যাব। টাকাপয়সা দেব। আমরা ভারতকে সাহায্য করব না। তবে আমাদের পরামর্শ হলো, যুদ্ধ কোরো না। মীমাংসা করো। রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করো।
ভারত আমাদের সীমান্তের ভেতরে রোজ গোলা ছুড়ছে। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক জায়গা দখল করে নিয়েছে। এরপরও বলছ যুদ্ধ করব না।
হ্যাঁ। যুদ্ধ কোরো না। করলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ করো। ওদের ঠেকিয়ে রাখো।
ভুট্টোর মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল বরফের সাপ নেমে যাচ্ছে। চৌ একবারও বলছে না যে তারা যুদ্ধে জড়াবে। সৈন্য সমাবেশ করবে। ভারতের সীমান্তে কিছুটা হলেও গোলাগুলি করবে।
ভুট্টো এবং তার দল খালি হাতে ফিরবেন?
চৌ তাঁদের বউদের জন্য অনেকগুলো ড্রেস তুলে দিলেন তাঁদের হাতে। বললেন, এগুলো তোমাদের সুন্দর বউদের জন্য।
ভুট্টো ভাবলেন, আমার তো আড়াইটা বউ। শেষ অর্ধেকটাই আসল। আমি এই ড্রেস ভাগাভাগি করব কী করে?
চৌ খুব দামি মদের বোতল দিলেন তাদের। বললেন, এটা ১০০ বছরের পুরোনো মদ। কাইন্ডলি আমাদের গুড ফ্রেন্ড আগা ইয়াহিয়াকে পৌঁছে দেবেন।
ভুট্টো ফিরে এলেন।
চীনারা যা বলে, তা করার চেষ্টা করে। তারা পাকিস্তানকে উড়োজাহাজ পাঠানোর নির্ধারিত চালান আটকে দিল। বার্তা পরিষ্কার : যুদ্ধ কোরো না।
৭৩
তাজউদ্দীন আহমদ তার অফিসকক্ষে বসে আছেন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। তিনি জানালা দিয়ে একবার বৃষ্টি দেখছেন, আরেকবার পথের দিকে তাকাচ্ছেন। বাঁ কবজিটা তুলে সময়ও দেখলেন। তিনি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। অধীর শব্দটা তাজউদ্দীনের জন্য প্রযোজ্য নয়। তিনি সব সময়েই সুধীর। কাজেই। তার অপেক্ষাটাও সুধীর অপেক্ষা। বৃষ্টি থেমে গেল।
যখন বৃষ্টি পড়ছিল, বাড়িটার আঙিনায় জমা পানিতে বেশ একটা মজার দৃশ্য রচিত হচ্ছিল। জমা পানি সুচের মতো আকার নিয়ে বৃষ্টির ফোঁটার দিকে উঠে আসছিল। অনেকটা সুন্দরবনের মাটি থেকে উঠে আসা শ্বাসমূলের মতো। এখন বৃষ্টি নেই। এখন জমা পানিতে ওই রকমের কোনো সুচ তৈরি হচ্ছে না।
দরজায় নক হলো। তাজউদ্দীন বললেন, আসেন।
ভেতরে এলেন যিনি, তাঁর গায়ে একটা রেইনকোট। হাতে একটা ছাতা। তিনি ছাতাটা বন্ধ করলেন। রেইনকোটের আবরণ দিয়ে তার মাথা ঢাকা।
তাজউদ্দীন বললেন, সিরাজুল আলম খান সাহেব, আপনি মাথার ঢাকনাটা খুলুন। ঘরে বেশ গরম। আপনি পুরা রেইনকোটটাই খুলে রাখুন। আমি আপনাকে গামছা এনে দিচ্ছি। আপনি মাথা মুছে নিতে পারবেন।
সিরাজুল আলম খান দাড়ি হেঁটেছেন। তবু অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাসের মতো নাতিদীর্ঘ দাড়ি আছে গালজুড়ে। গোঁফের রেখায় শুধু যত্নের ছাপ।
সিরাজুল আলম খানের ওজনটা একটু বেড়ে গেছে মনে হলো।
সিরাজ দেখলেন, তাজউদ্দীন ভাই শুকিয়ে গেছেন। তার চোখ গর্তে বসে গেছে। তবু চোখ দুটো ভাসা-ভাসা। চোখের মধ্যে অসহায় হরিণের মায়া।
সিরাজ বললেন, আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে আমাদের ট্রেনারদের একপ্রকারের বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাদের বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা আপনি এবং আপনার সরকার করেছেন।
তাজউদ্দীন বললেন, আপনাদের বাহিনী আমি তৈরি করি নাই। ট্রেনিং সেন্টার আমি বসাই নাই। আমি বন্ধ করবার কে? যারা বানিয়েছে, বন্ধ যদি হয়ে থাকে, তারাই কেবল তা করতে পারে।
সিরাজ বললেন, আমাদের বলা হয়েছে আমাদের বাহিনীকে হয় নিরস্ত্র করতে হবে, না হয় নিরস্ত করতে হবে।
তাজউদ্দীন বললেন, কথাটা কী হলো।
সিরাজ বললেন, হয় ডিজআর্ম করতে হবে, না হলে ডিঅ্যাক্টিভেট করতে হবে। এই রকমই নির্দেশ।
তাজউদ্দীন বললেন, সিরাজ সাহেব, আপনি খুবই ইন্টেলিজেন্ট মানুষ। লার্নেড় মানুষ। একটা যুদ্ধে দুইটা আর্মি আলাদা কমান্ডে চলবে, এটা হয় না। আমার কাছে রিপোর্ট আছে, মোট কত জায়গায় মুক্তিবাহিনী আর বিএলএফ নিজেরা যুদ্ধ করেছে। আপনারা ওসমানী সাহেবের কমান্ডো বাহিনীকে মার্জ করান। অথবা মুভ করান।
সিরাজ বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, আমার সঙ্গে মণির মতপার্থক্য আছে, সেটা জানেন। পার্থক্যটা আদর্শের। আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মণি করে না। আপনিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। এই জায়গায় আমরা এক হতে পারি।
তাজউদ্দীন বললেন, এখন জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। এটা হয়ে গেলে পরের ফেজ হলো সমাজতন্ত্র। এখন আমাদের কমন এবং ভয়াবহ অত্যাচারী দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে হবে।
সিরাজ বললেন, আমাদের ফোর্স পলিটিক্যাল ফোর্স। প্রায় সাড়ে আট হাজার বিএলএফ দেশের মধ্যে আছে। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজাকার নিমূলের। দেশে এক লাখ রাজাকার আছে। ওদের নির্মূল করলে তা আপনাদেরকেই হেল্প করবে।
তাজউদ্দীন বললেন, হেল্প করবে যদি তারা মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরে। আপনি এটা এনশিয়ের করেন।
সিরাজ বললেন, আমি সেই মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি ওসমানী সাহেবের বাহিনীকে নির্দেশ দেন মুজিববাহিনীকে যেন ঢুকতে বাধা না দেয়।
তাজউদ্দীন একটু ভাবলেন। আপনারা এক কাজ করুন। আপনাদের কমান্ডারদের নির্দেশ দেন, নিজ নিজ সেক্টর কমান্ডার, সাব-কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ভেতরে ঢুকতে। একটা কোড ঠিক করে নিলেই তো সেমসাইড হবে না।
তাঁরা ব্যাপারটা নিয়ে আরও খানিকক্ষণ আলোচনা করলেন। সিরাজ বললেন, আপনি মণিকে বলবেন না যে আমি এসেছিলাম। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের কাজ করব। দেশ শত্রুমুক্ত হলে আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কাজ করব। মুজিব ভাইকে বোঝাতে হবে।
তাজউদ্দীন বললেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে তো সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে। মুজিব ভাই জেনে-শুনে-বুঝে করেছেন। চীন সফর করেছেন দুবার। তিনি ওদের অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রশংসা করেন। তবে আমাদের সমাজতন্ত্র হবে আমাদের মতো।
সিরাজ বললেন, আমাদের মতো সমাজতন্ত্র হয় না। সমাজতন্ত্র একটাই। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। মুজিব ভাই আসুক। তবে এটাকে মুজিববাদ হিসেবে দাঁড় করাতে হবে।
সিরাজ আবার রেইনকোট পরে নিলেন। সিঁড়িতে নামার আগেই বিশাল আকারের ছাতাটা দিয়ে মাথা ঢাকলেন।
৭৪
রেনু জয়ের কথা ধুচ্ছেন। কাপড় চিপে, নিংড়ে তিনি হাঁক পাড়লেন, রেহানা, কাথাগুলান বারান্দায় রোদে মেলে দে।
রেহানা কথা মেলে দিতে লাগলেন বারান্দার তারে। বারান্দায় রোদ পড়েছে ঝাঁঝরির মতো। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। তার জামাল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। জামাল ভাই এখন কই? তিনি কি যুদ্ধ করছেন? কামাল ভাইই-বা কই? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ওই ঘোষণাটা যখন হয়, তখনই কামাল ভাইয়ের গলা শোনা যায়-ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি।
মাঝেমধ্যে রণাঙ্গন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আসেন। জামাল ভাইয়ের দুই বন্ধু জানু ভাই, পান্নু ভাই জামাল ভাইয়ের হাতে লেখা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। এ বাড়ির আবদুল বাজার করতে যেত। খোকা চাচা থাকতে তিনি বাইরে যেতেন। দুলাভাই থাকতে তিনি যেতেন। এদের হাত দিয়ে চিঠি আসত। এখন আবদুলও গেছে নিজের গ্রামের বাড়ি। রমা ছাড়া গৃহপরিচারক আর কেউ নেই এ বাড়িতে।
কী বাড়ি ছিল। কী রকম ফাঁকা হয়ে গেল। ৩২ নম্বর লোকজনে সারাক্ষণ গমগম করত। ১৮ নম্বর রোডের এই বাড়িতে গৃহবন্দী হওয়ার পরও তো খোকা চাচি, মমতাজ চাচি, তার বাচ্চাকাচ্চারা ছিল। জামাল ভাই চলে যাওয়ার পর খোকা চাচাকেই সন্দেহ করল মিলিটারি। বলল, তুমিই গাড়ি করে পার করে দিয়েছ। মমিনুল হক খোকা চাচাকে হত্যা করার অর্ডার হয়ে গিয়েছিল। কী বিবেচনায় কে জানে, ধরে নিয়ে গিয়েও তাকে ছেড়ে দেয় শেষ মুহূর্তে। একটা ফোন এসেছিল। মেজর নাকি বলেছিল, তোমার ভাগ্য ভালো। আধঘণ্টা পরে যদি এ ফোনটা আসত, ততক্ষণে তুমি আজরাইলের ঘরে।
শুনে মা তাকে বলেছেন, ভাইডি, তুই এই বাড়িতে আর থাকিস না। তোকে আবার কবে ধরে নিয়ে যায়, কোনো ঠিকঠিকানা আছে। ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেললে আমি ভাইহারা হব। এটা আমি চাই না।
ভেজা কাথা থেকে পানি পড়ছে টপটপ। রেহানা সেদিকে তাকালেন। খোকা চাচা, চাচি ও তাঁদের বাচ্চারা চলে গেছেন। যে ফুফু-খালারা ছিলেন, তারা তো আগেই গেছেন। দুলাভাই ছিলেন, তাঁরও শরীরটা খারাপ। তিনি ভর্তি হয়েছেন পিজি হাসপাতালে।
বাড়িতে ফরিদ নামের যে চীনাম্যান কাজের ছেলেটা ছিল, সে একদিন বাজার করতে গেছে। আর ফেরে না। মা যে কত দুশ্চিন্তা করলেন। পাকিস্তানি মিলিটারি, রাজাকার, বিহারি, আলবদর, চারদিকে মৃত্যুদূতেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হাসু আপা জয়কে কোলে নিয়ে পায়চারি করছেন, আর ছড়া শোনাচ্ছেন।
খোকা ঘুমুল পাড়া জুড়ল, বর্গি এল দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিব কিসে! সত্যি দেশে বর্গি এসে গেছে, রেহানা মনে মনে বললেন।
মায়ের ওপর দিয়ে যা ধকল যাচ্ছে। আম্বিয়ার মা থাকলে রান্নাবান্নার কাজে মা অনেক সাহায্য পেতে পারতেন। কোটা-বাছা, থালাবাসন মাজা, মসলা পেষা। এখন আবদুল নেই। ফরিদ নেই। শুধু রমা একা। রমা কাজে কিছুটা সাহায্য করেন। কিন্তু তরকারি কোটা তো আর রমাকে দিয়ে হয় না। মা আবার জয়ের কাপড়চোপড় অন্য কারও হাতে ধোয়া হোক, এটা চান না। রেহানা যতটুকু পারেন, মাকে কাজে সহযোগিতা করেন। হাসিনাও মাঝেমধ্যে জয়কে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কিংবা রেহানার কোলে দিয়ে সংসারের কাজে হাত লাগান। কোনো দিন রান্না করেন। কোনো দিন মাছ কুটে দেন। একদিন তো মাছ কোটা নিয়ে হাসির কাণ্ড ঘটে গেল। হাসু আপা মাছ কুটেছেন। আবদুল মাছ ধুয়েছে। রান্না করলেন মা। দেখা গেল, মাছ তিতা। মানে হলো পিত্তথলি ফেলা হয়নি। পিত্ত গলে তরকারির সঙ্গে মিশে তিতা হয়ে গেছে। আপা বলেন, আবদুল কেন ধোয়ার সময় ফেলেনি! শুনে মা হাসলেন। বললেন, ঠিকই তো আবদুল, তুই কেন মাছ ধোয়ার সময় পিত্তিটা বার করে ফেলে দিলি না!
রাসেল এল বারান্দায়। দেনা আপা কী করো?
এই তো আকাশ দেখি।
আসো খেলি। খেলবা?
কী খেলা?
যুদ্ধ যুদ্ধ।
ঘরে আসবাব নেই। দুইটা মাত্র মিলিটারি খাট।
তার একটাতে থাকে জয়। আরেকটাতে চাচি থাকতেন। এখন এটা রাসেলের দখলে। তারা বিছানায় গেল। খেলার নিয়ম হলো, বালিশের আড়ালে দুইটা কাপড়ের বানানো পুতুল নিয়ে রাসেলের মুক্তিবাহিনী। আর দুইটা পুতুল নিয়ে রেহানার পাকিস্তানি মিলিটারি। রেহানা বালিশের আড়াল থেকে তার সৈন্য বের করলে রাসেলের মুক্তিবাহিনী গুলি করবে।
রেহানা আর রাসেল সত্যিকারের গুলি হাতে নিয়ে দেখেছে। সত্যিকারের গ্রেনেড নাড়াচাড়া করেছে। দাদা-দাদি পিজি হাসপাতালের কেবিনে। সেখানে মা, খোকা চাচা যেতেন রাসেল রেহানাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে। পেছনে থাকত আর্মির গাড়ি। কেবিনে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র রেখে যেত। টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে সেই গ্রেনেড নিয়ে রেহানা রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষমাণ আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে তুলে দিতেন।
মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ারা বলেন, আমাদের ওপর কঠোর নির্দেশ আছে। যে বাসায় থাকবা, সে বাসায় অস্ত্র রাখবা না। অপারেশন শেষ হলে সেই বাসায় ফিরতে পারবা না। আমরা থাকি এক জায়গায়, অস্ত্র রাখি আরেক জায়গায়। হাসপাতাল অস্ত্র রাখার জন্য সেইফ। আর আমরা তো আশপাশেই অপারেশন। করব। তারপর অন্যখানে চলে যাব।
ফলের ঝুড়িতে করে রিভলবার আসে। ডানোর কৌটায় আসে গ্রেনেড। একদিন তো বেডপ্যানের ভেতরে এল একটা মেশিনগান।
আবার সেটা নিচে মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের হাতে তুলে দিয়ে আসতে হয়। ডাক্তার সেজে একজন এলেন। রেহানা তো দেখেই বুঝলেন কে এসেছেন। তিনি বললেন, তুমি এই ব্যাগটা নাও। রাসেল বলে, আমি এই ব্যাগটা নিই। তারা অস্ত্র নিয়ে ডাক্তারবেশী গেরিলার পেছন পেছন নিচে চলে যান। আর ডাক্তার নাসিম নামে একজন আছেন পিজি হাসপাতালে। তাঁর সঙ্গে কানেকশন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের। তিনি প্রায়ই অস্ত্র নিয়ে এসে দাদা-দাদির খাটের নিচে রেখে দিতেন ওদের কাপড়ের ঝুড়িতে।
দাদা-দাদির কেবিনটা অস্ত্র রাখার একটা ভালো আস্তানা হয়ে যায়।
কামাল ভাই এখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। আর্মির ট্রেনিং নিয়ে অফিসার হয়ে গেছেন। সে খবরও তারা পান। জামাল ভাই ট্রেনিং নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরে গেছেন। যশোর, সাতক্ষীরার দিকে। মুজিবনগর থেকে লোকজন এসে খবর দিয়ে যায় চুপি চুপি। আবদুল বাজার করতে গেলে তার পিছু নেয় গেরিলারা। ফট করে একটা চিঠি দিয়ে কেটে পড়ে। একদিন তো রেহানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। অমনি একটা ঢিল এসে পড়ল তাঁর পায়ের কাছে। তাকিয়ে দেখলেন, সাইকেল নিয়ে জামাল ভাইয়ের এক বন্ধু চলে গেলেন। ঢিলটা হাতে তুলে দেখলেন, চিঠি। জামাল ভাই খবর পাঠিয়েছেন। তিনি এখন রণাঙ্গনে। মাকে বলেছেন, দোয়া করো।
মা চিঠি পড়ে চোখের পানি মোছেন। আর বলেন, বাইরে মেশিনগান ফিট করে মিলিটারিরা দাঁড়ায়ে আছে, এদের কি জানের মায়া নাই?
রাসেলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা খেলেন রেহানা। রাত হলে প্রথম কাজ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা। আব্বার ৭ মার্চের ভাষণ রোজ প্রচার করা হয়। বজ্রকণ্ঠ। পিজি হাসপাতালের কেবিনে কামাল ভাইয়ের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা জিল্লু ভাই বলেন, সব মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রোজ রাতে শোনে, তবু আবার শুনতে ভালো লাগে। জিল্লু ভাই বলেন, ৭ মার্চের ভাষণটা শুনলে রক্তে আগুন লাগে। মনে হয়, এক্ষুনি ছুটে যাই রণাঙ্গনে। গুলি করে শত্রুদের নির্মূল করি।
রাসেল বলে, এই দেনা আপা, তোমার সৈন্য মরে গেছে তো। মুক্তিরা গুলি করেছে তো।
মা বলেন, রাসেল, আস্তে কথা বলো। বাইরে ওরা শুনলে কি-না-কি ভাববে।
হাসু আপা বলেন, রেহানা, জয়কে একটু নে। আমি একটু রান্নাঘরে যাই।
রেহানা জয়কে কোলে নেন। জয় চোখ গোল গোল করে তাকায়। একা একা কী যেন বলে।
রাসেল বলে, জয় বলো, জয় বাংলা।
জয় একটা কিছু বলে। রাসেল বলল, বলেছে বলেছে। জয় বাবু জয় বাংলা বলেছে।
.
বিকেলবেলা তাঁরা শুয়ে বসে আছেন।
একা একা কষ্ট করতে করতে রেনু অসুস্থ বোধ করেন। মেঝেতে শুয়ে থেকেও বোধ হয় ঠান্ডা লেগে গেছে। তিনি হাঁচি দিচ্ছেন।
হাসিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
একটা আশার খবর শোনা যাচ্ছে। চারদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা মার খাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা এরই মধ্যে অনেক জায়গা দখল করে নিয়েছে। মুক্তাঞ্চলের আয়তন ক্রমাগত বাড়ছে। ঢাকাতেও গেরিলা অভিযানের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়ে গেছে। প্রায়ই গোলাগুলি হয়। গভর্নর মোনেম খানকে ঢাকায় তার বাসার ভেতরে মুক্তিবাহিনী গুলি করেছিল। পরে তিনি মারা গেছেন।
ঢাকায় গভর্নর বদল হয়েছে। চোখের ডাক্তার মালিক হয়েছেন গভর্নর। রেডিওতে এই সব খবর শোনা যায়। মা বলেন, এই ডা. মালিকটা আবার কেডা? তার মন্ত্রীগুলানও হয়েছে একেকটা দশাসই। আবুল কাশেম, এ এস এম সোলায়মান, মওলানা এ কে এম ইউসুফ, আব্বাস আলী খান, আখতারউদ্দীন আহমদ, নওয়াজেশ আহমদ, মওলানা ইসহাক, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, শামসুল হক, মং সু প্রো। টিক্কা খান আর গভর্নর নেই। পরাজয় আসন্ন দেখে কেটে পড়েছে, নাকি তাঁকে সরানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা দেখে। মালিক গভর্নর। নিয়াজি সামরিক আইন প্রশাসক। রাও ফরমান আলী বেসামরিক প্রশাসক। ওরা কি আমেরিকাকে বোঝাতে চাইছে। বাংলাদেশে এখন বাঙালির শাসন। বাঙালিকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। এরপর কেন ওরা স্বাধীনতা চায়?
পাকিস্তান রেডিওর খবর শুনতে শুনতে হাসিনা বললেন, যুদ্ধে হেরে যাবে বলে পাকিস্তানি মিলিটারিরা পালাচ্ছে, আর এই বেইমানগুলো মিরজাফরি করতে এগিয়ে এসেছে। এরা চিরটাকাল এই রকম বেইমানিই করেছে। এদের পরিণতি হবে মোনেম খানের মতোই।
রোজার মাস। রেনু, রেহানা, রমা রোজা আছেন। একটু পরে ইফতারের সময় হয়ে আসবে। রেনু উঠলেন। হাসিনা বললেন, মা তোমার শরীরটা ভালো না। তুমি শুয়ে থাকো। আমি ইফতারি সাজাচ্ছি।
রেহানা একটা ঠোঙা পড়ছেন। কাগজের ঠোঙায় করে বাজার এনেছিল রমা।
রাজাকারদের সাফল্যজনক অভিযান। দৈনিক পাকিস্তান। সিলেট থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, রাজাকারদের আলশামস বাহিনী সুনামগঞ্জে উত্তর পশ্চিম এলাকায় টহল দেওয়ার সময় দুটো সন্দেহজনক নৌকাকে আটক করলে আরোহীরা তাদের প্রতি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ফলে একজন রাজাকার আহত হয়। রাজাকাররা সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা গুলি চালালে নৌকার আরোহীরা পানিতে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের ৪ জন নিহত হয়। রাজাকাররা নৌকা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করে।
রেহানা মন খারাপ করেন। কে জানে, এই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জামাল ভাই, কামাল ভাই, জিল্লু ভাই বা তাদের বন্ধুবান্ধবও আছে কি না!
মাকে এই খবর বলা যাবে না। রেহানা রেডিও ঘোরাতে থাকেন।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্বমন্ত্রী এ কে এম ইউসুফ গত সোমবার সাতক্ষীরায় স্থানীয় অফিসার ও রাজাকারদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। মন্ত্রী জাতির প্রতি রাজাকারদের সেবার উচ্চ প্রশংসা করেন। স্থানীয় পৌরসভা হলে এক জনসভায় ভাষণদানকালে মন্ত্রী বলেন, যদি ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে, তবে তাকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।
রেহানা রেডিও খুলে আকাশবাণী ধরলেন। গান হচ্ছে : রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে, রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে। রানার গ্রামের রানার, সময় হয়েছে নতুন খবর আনার। হেমন্তের গানের সঙ্গে রেহানা নিজের গলা মেলান আর জয়কে হাঁটুর ওপরে রেখে দোলাতে থাকেন।
সত্যি তো সময় হয়েছে নতুন খবর আনার! তা পেতে হলে রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে হবে। বিবিসিতেও ভালো ভালো খবর থাকে।
রাসেল বলল, দেনা আপা খেলবা না!
আমি যে জয়কে কোলে করে রেখেছি ভাই! রেহানা বললেন।
আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা দলে দলে আত্মসমর্পণ করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রেহানা কান খাড়া করলেন…সময় হয়েছে নতুন খবর আনার।
রেডিও বন্ধ করলেন। সন্ধ্যা নেমে আসছে। ইফতারের সময় হয়ে এল।
৭৫
রিমি বলল, আজ ঈদ। আজকেও আলু আসবে না।
রিপি বলল, নিশ্চয়ই আসবে।
দুপুরে আজ কী দিয়ে ভাত? আম্মু। রিমি চিৎকার করল।
রান্নাঘর থেকে লিলি গলা উঁচিয়ে বললেন, বেগুনভর্তা, আলুভর্তা আর ডাল। শোনো, আমি পোলাও-কোরমা রাঁধতে পারতাম। কিন্তু ভেবে দেখো, শরণার্থীশিবিরে কত লক্ষ লক্ষ মানুষ কী খাচ্ছে, আদৌ খেতে পাচ্ছে কি না আমি তো জানি না।
সোহেলের জ্বর। লিলি একবার করে গিয়ে তার কপালে হাত দেন।
.
২০ নভেম্বর ১৯৭১ সকালে নামাজ হয়েছে থিয়েটার রোডের বাড়ির মাঠে। তাজউদ্দীন নামাজ পড়েছেন, কর্নেল ওসমানী, শেখ কামাল নামাজ পড়েছেন। শেখ কামালের সঙ্গে নামাজ শেষে তাজউদ্দীন কোলাকুলি করছেন, এই ছবি জয় বাংলা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল।
রিমি, রিপি সারা দিন অপেক্ষা করে। আব্বু আসবেন। তাদের আব্বু এলেন না।
ব্যারিস্টার আমীর, জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম আসেন রিমি রিপিদের বাসায়।
লিলি বললেন, আপনাদের ভাইকে একটু বাসায় আসতে বলেন। কত দিন দেখা হয় না। আজকে ঈদের দিন একবার এলে কী হয়!
আমীর বললেন, তাজউদ্দীন ভাইয়ের কতগুলো আবেগ আছে। যে কেউ বলতে পারেন, তরল ভাবালুতা। আমি বলব, তার ইনোসেন্স এবং সিনসিয়ারিটি। এক রাতে ঝড় এসেছে। বৃষ্টির পানি ঢুকছে জানালা দিয়ে। তিনি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে করলেন না। জানালায় মুখ লাগিয়ে বাইরের ঝড়বৃষ্টি দেখতে লাগলেন। তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, শরণার্থীশিবিরে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ঝড়ে না জানি কত কষ্ট করছে। যে কেউ বলবে, আমিও বলব, এটার কোনো মানে হয় না। উনি জানালা বন্ধ করলেই কী, না করলেই কী। তাতে শরণার্থীশিবিরের মানুষদের দুঃখ-শোক কমবে বা বাড়বে না। তাদের দুঃখ দূর করতে হবে দেশ শত্রুমুক্ত করে। সেটা তিনি মানবেন না। বুঝবেনও না। এখানে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করে গেলে মোটেও কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু তিনি এটা করবেন না। তিনি যাবেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রন্টে।
লিলি বললেন, উনি না এলে আপনারা কাইন্ডলি ওনাকে জোর করে আনবেন।
রিমি-রিপি বুঝে গেল, আব্বু আসবেন না।
.
তাজউদ্দীন জিপে উঠেছেন। জনসংযোগ অফিসার নজরুল ইসলামও আছেন তাঁর সঙ্গে। গাড়ি ডা. সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে দিয়ে গেল। এই বাড়িতেই মন্ত্রীদের পরিবার থাকে। জোহরা তাজউদ্দীন থাকেন।
নজরুল ইসলাম বললেন, স্যার, গাড়িটা থামাই। ভাবি একটুক্ষণের জন্য যেতে বলেছেন। আমাদের বলেছেন আপনাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তাজউদ্দীন বললেন, নো।
গাড়ি চলছে। কলকাতা থেকে তারা সোজা যশোর সীমান্তের দিকে রওনা হয়েছেন। বিকেলের আলো এসে পড়ছে তাদের চোখেমুখে।
সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকার নেমে এল। গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল। খানিকক্ষণ চলার পর ড্রাইভার বললেন, এসে গেছি।
তাঁরা নামলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি। মুক্তাঞ্চল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এখানে ক্যাম্প করে আছে। মাথার ওপরে গাছগাছড়ার ছাদ। তাজউদ্দীন এগিয়ে যেতে লাগলেন ক্যাম্পের দিকে। তাঁর সঙ্গের সিকিউরিটির লোকেরা দৌড়ে আগে গেল। ক্যাম্পের কমান্ডার এলেন। তাজউদ্দীন কমান্ডারকে জড়িয়ে ধরলেন।
পেছনের গাড়িতে ফল, বিস্কুট, খেজুর ছিল। তাজউদ্দীন কমান্ডারের হাতে সেসব তুলে দিয়ে বললেন, ডিস্ট্রিবিউট করে দিয়ো।
তাদের ক্যাম্পের ভেতরে বসতে বলা হলো। চেয়ার নেই। তারা মাটিতে বসলেন। ছেলেরা সেমাই রান্না করেছে। তাজউদ্দীনকে একটা বাটিতে করে সেমাই এনে দেওয়া হলো।
তাজউদ্দীনের ডায়াবেটিস। আজ সারা দিনের পর প্রথম তাজউদ্দীন মুখে খাবার তুললেন। তারপর বললেন, ভাইয়েরা, আর কটা দিন কষ্ট করো। আজ বাংলার ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ নাই। আছে স্বজন হারানোর কান্না। কিন্তু আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আগামী ঈদ আমরা মুক্ত স্বদেশে পরিপূর্ণভাবে করতে পারব।
.
রাত বাড়ছে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিশুতি রাতের অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে গেল।
রিপি বলল, আব্বু আজকে বোধ হয় আর আসবেন না।
রিমি বলল, আম্মু, আব্বু ঈদের রাতেও আসবেন না।
লিলি বললেন, তোমাদের আব্বু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গেছেন বলে খবর পেলাম। কলকাতা আসতে আসতে ভোর হয়ে যাবে। তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো।
দুই বোন চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল।
৭৬
শেখ মুজিবুর রহমানকে একটা সেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিচার অকারণে দীর্ঘ হচ্ছিল। এক দিকে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান এই ঘোষণার মাধ্যমে যে এই বিচার অবৈধ, অন্য দিকে সাক্ষীদের যখন মি. ব্রোহি জেরা করেন, তখন প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছিল যে সাক্ষীদের সাজিয়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা হয়েছে। যা তারা বলছে, তা তারা দেখেনি, শোনেনি। ইয়াহিয়া তখন নতুন আইন জারি করেন, সাক্ষীদের জেরা করারও দরকার নেই, ম্যাজিস্ট্রেটের সইসহ প্রাপ্ত সাক্ষ্যই যথেষ্ট। শেখ মুজিবকে তাই আর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। ফলে সেলের বাইরেও তাকে বেরোতে দেওয়া হয় না। তিনি এক জায়গায় একা একা থাকতে থাকতে দিনক্ষণের হিসাব ভুলে গেছেন।
একদিন তাকে সেমাই খেতে দেওয়া হলো। তিনি বললেন, ব্যাপার কী? সেমাই কেন?
খাবার আনা লোকটা বলল, হুজুর, আজকে ঈদ।
একটু পরে এল কতগুলো ফল।
তিনি সেসব ছুঁয়েও দেখলেন না। তিনি বললেন, আজকে ঈদ। আমাকে নামাজ পড়তে জামাতেও যেতে দিল না? এর আগেও তো নিঃসঙ্গ সেলে ছিলাম। তখনো তো ঈদের দিন জামাতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো। ঠিক আছে। দরকার হবে না।
আমি ২৫ মার্চ দেখেছি, তোমরা ঘুমন্ত দেশবাসীকে কামান, ট্যাংকের গোলা দিয়ে হত্যা করছিলে, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছিলে। আমি জানি না আমার দেশবাসী ঈদ করতে পারছে কি না। আমি এখন সেমাই, ফল খেতে পারব না।
তিনি অজু করলেন। দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তাকবিরের সঙ্গে পাঠ করলেন। তারপর দুহাত তুলে ধরে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ, আমি আমার দেশ আর আমার দেশের মানুষের নিরাপত্তার ভার তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি তাদের রক্ষা করো। তুমি তাদের ভালো রেখো। আমিন।
এই তার ঈদ।
৭৭
মওলানা ভাসানী এখন দিল্লিতে। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের হাসপাতালে একটা কেবিনে।
তার পেটের পীড়া হয়েছিল। অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন হলে তাকে উড়িয়ে দিল্লি আনা হয় দেরাদুন থেকে।
ঈদের দিন। মওলানা ভাসানী ঠিক করেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দাওয়াত খাওয়াবেন। প্রধানমন্ত্রী আসবেন হাসপাতালে।
ইন্দিরা গান্ধীর জন্য কী কী খাবারের আয়োজন করতে হবে, তা তিনি ধরিয়ে দিলেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে। শুনেন, বিরিয়ানি হইতে হইব খুঁটি ঘিয়ের। ডালডা দিয়া বানাইলে হইব না।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তিনি যখন যা চাইতেন, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। তিনি বলেছেন, ওরসে যাব। গেছেন। জনসভায় বক্তৃতা দেব। দিয়েছেন। তিনি প্রায় অসম্ভব ধরনের ফরমাশ দিতেন। টাকি মাছের ভর্তা খাব। ঢেঁকিশাক ভাজি খাব। তাঁর সেই চাওয়া পূরণ করা পাহাড়ি শহরগুলোতে কঠিন হতো। তবু ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। হঠাৎ করে তিনি বলে বসতেন, মৌসুরী যাব। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো। এইভাবে তিনি কত জায়গা যে বেড়িয়েছেন। তার সচিব সাইফুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন, লছমনঝুলা, গীতাভবন, মহেশ যুগীর হিমালয়ের আশ্রম, ঋষিকেশ, হরিদ্বার, নরিন্দনগর, দক্ষযজ্ঞের ভিটা, বশিষ্ঠ মুনির তপোবন, মিরাট, অরুন্ধতীর গুহা আরও কত জায়গা যে গেছেন। তিনি বললেন, আসাম যাব। আসাম বিষয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের দোনোমনা ছিল। কিন্তু শেষে আসামের ভাসানের চরেও তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে তিনি স্বাধীন ছিলেন। কিন্তু সব জায়গাতেই নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে ঘিরে দূর থেকে নজরে রাখত। কাজেই তিনি নজরবন্দী ছিলেন।
এখন, ২০ নভেম্বর ১৯৭১ তিনি দিল্লির হাসপাতালে বিরিয়ানি, ফিরনি, সেমাইয়ের ব্যাপক আয়োজন করতে বলেছেন। জাদুর মতো তা-ও হয়ে গেছে। ডাক্তার, নার্স, আমন্ত্রিতরা চলে এসেছে। কিন্তু বিরিয়ানির ডেকচির ঢাকনা খুলে তিনি বললেন, এই বিরিয়ানি তো ঘিয়ের না। ডালডার।
ওরা বলল, না হুজুর, ঘিয়ে পাকানো।
ঘিয়ে পাকানো হইলে গন্ধ কই?
এটা মোষের দুধের ঘি।
না, হইব না। খাঁটি গব্যঘৃতের বিরিয়ানি লাগব।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তর্ক করা নিষেধ। ভারতীয়রা দৌড়াল খাঁটি গব্যঘৃত দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে আনতে। এক পাতিল বিরিয়ানি এল। তিনি ঢাকনা খুলে চামচে বিরিয়ানি তুলে বললেন, দেখলা সাইফুল, এইবার
সুবাসটা কী রকম ফার্স্টক্লাস!
জি হুজুর। খুব ফার্স্টক্লাস।
ইন্দিরা গান্ধী সেদিন এলেন না।
তবে তাঁর পাঠানো উপহার, ফুল, মিষ্টি, ফল নিয়ে এলেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, সেবক, কর্মচারীরা।
মওলানা ভাসানীই গেলেন ইন্দিরা গান্ধীর সফদরজং রোডের কার্যালয়ে। ইন্দিরা গান্ধী ভবনের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে জোড় হাতে নমস্কার করে হুজুরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।
সাইফুল সঙ্গে ছিলেন। তিনি প্রমাদ গুনছেন, এই বুঝি হুজুর ইন্দিরা গান্ধীকে বলে বসেন বিরিয়ানিতে ঘি সমস্যা হয়েছিল। ভাসানী তা করলেন না। বললেন, আপনার বাবার সঙ্গে আমার দোস্তি ছিল। মওলানা আবুল কালাম আজাদ আমার বন্ধু ছিলেন। আপনি আমার মেয়ের মতো।
ইন্দিরা হেসে বললেন, আমি তো আপনার মেয়েই। তো মেয়ের মেহমানদারিতে কোনো ত্রুটি হচ্ছে না তো?
না না। আর কোনো ত্রুটি হলে তা কি আপনার কানে না উঠিয়ে ছাড়তাম। তবে এসেছিলাম যুদ্ধ করতে, থাকলাম রাজ-অতিথি হয়ে। এই আরকি!
মেয়ের বাড়িতে বাবা এসে যদি সমাদরে ত্রুটি দেখতে পান, মেয়ের বদনাম হবে। কিন্তু আপনি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির মিটিংয়ে যাচ্ছেন না কেন?
গেলেই ঝগড়াঝাটি লেগে যাবে।
ঝগড়াঝাটি কোথায় হয় না? এক পরিবারের মধ্যে হয় না? এক পার্টির ভেতরে হয় না?
তা ঠিক।
আপনি কাইন্ডলি উপদেষ্টা পরিষদের মিটিংয়ে যাবেন।
যাব। খালি একটা কথা। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন না কেন?
সময় হলেই দেব। কিন্তু লড়াইটা আপনাদের। আপনাদেরই করতে হবে। আপনারা লড়াই ঠিকভাবে করুন। আমার কাজও আমি করব।
আচ্ছা আমি কমিটির মিটিংয়ে যাব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের মুক্তিসংগ্রামে আমাদের পাশে থাকবার জন্য।
কথা হলো উর্দুতে। মওলানা ভাসানী এরপর বিশাল লেকচার দিলেন চীন আর রাশিয়া যদি এক হতে পারে, তার সুফলটা পৃথিবীতে দেশে দেশে নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য কীভাবে কাজে লাগবে তা নিয়ে।
সাইফুল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন শাড়ি পরিহিত ইন্দিরা গান্ধীর দিকে। এই ভদ্রমহিলা মাত্র আমেরিকা, ইউরোপ ভ্রমণ করে এসেছেন। আসার পরেই বলে দিয়েছেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, তবে যুদ্ধ বেধে গেলে কী করতে হবে আমরা জানি। আমরা প্রস্তুত। আর তিনি এখন এই নব্বই বছরের আগুনখেকো মওলানার লেকচার মন দিয়ে শুনছেন! এত সময় কোথায় তার!
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বিশ্লেষণ করবে :
ইন্দিরা গান্ধীর হিসাব পাকা। রোজ এক কোটি শরণার্থীকে খাওয়ানো আর যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়ার তুলনায় মওলানা ভাসানীকে তার যা ইচ্ছা তা-ই খাওয়ানো এবং যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। মওলানা ভাসানীর একটা প্রতীকী মূল্য আছে। যার বিনিময়ে চীনাপন্থীদের সামলে রাখা যাবে। এমনকি হয়তো তাঁর কারণেও চীনারা ভারতের দিকে তাক করা বন্দুকের নল নামিয়ে নিতে পারে। কাজেই ইন্দিরা গান্ধী বুঝেশুনেই মওলানা ভাসানীর কথা হেসে হেসে শুনছেন আর তার সব সাধ-আহ্লাদ পূরণ করে চলেছেন।
৭৮
এবিএম মূসা লম্বা, তামাটে বর্ণ, চোখ দুটো উজ্জ্বল, গোলাকার নাকের একজন হাসিখুশি মানুষ। ১৯৭১-এ বয়স ৪০। মে মাসে এশিয়ান নিউজ-এর হয়ে কাজ করবেন বলে হংকংয়ের উদ্দেশে রওনা দেন। তারপর সেখান থেকে সোজা কলকাতা। মুজিবনগর সরকারের নিকটবর্তী হলেন এশিয়ান নিউজ এর প্রতিনিধি হিসেবেই। উঠলেন ভাড়া বাসায়, সল্ট লেকে। ছোট্ট দুই রুমের বাসায় নিজ পরিবার ছাড়াও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ ও অন্য বন্ধু সাংবাদিকেরা গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে ঘুমোন। তিনি খবর পাঠান বিবিসি ও লন্ডনের সানডে টাইমস-এ। তার পরিচয় তিনি বিদেশি সাংবাদিক। প্রায়ই তিনি যান মুক্তাঞ্চলে। খবর আর ছবি পাঠান তার প্রতিষ্ঠানগুলোয়। মুজিববাহিনীর তোফায়েল আহমেদ, শেখ মণি আর শেখ শহীদুল ইসলাম। তাঁকে মুক্তাঞ্চলে যেতে সাহায্য করেন।
বিকেলবেলা বিদেশি সাংবাদিকেরা রোজ সমবেত হন কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে। সবাই মিলে খবর লেখেন। ফোর্ট উইলিয়ামে প্রতিদিন ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল জ্যাকব ব্রিফ করেন। মুজিবনগরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া কক্ষে থাকেন আমিনুল হক বাদশা।
নভেম্বরের শেষ পক্ষে একদিন এবিএম মূসা যাচ্ছেন রণাঙ্গনে। কলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়। যশোর মুক্ত হচ্ছে। যশোরের একটা মুক্তাঞ্চলে চলেছেন তাঁরা। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন, তার সঙ্গে গাইড হিসেবে আছে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি।
হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন একটা ট্রেঞ্চে একটা বালক মুক্তিযোদ্ধা। সে একটা মেশিনগান হাতে পজিশন নিয়ে আছে। এবিএম মূসা ছবিটা তুলে ফেললেন। ছবি তুলে একটু কথা বললেন জামালের সঙ্গে। কিশোর জামাল আগাগোড়াই চুপচাপ, এবিএম মূসা পরে তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর এই ছেলেটা অমিশুক, লাজুক। তবে মূসা জানেন, জেনারেল এস এস উবানের বড় প্রিয় এই কিশোর। দেরাদুনে ট্রেনিংয়ের সময় জেনারেল উবান তাঁকে ডাকেন কাব টাইগার। বাচ্চা বাঘ। উবান জামালের ব্যাপারে মুগ্ধ, তাকে নিজের ছেলের মতো যত্ন করেন, ভালোবাসেন, তাকে কাছছাড়া করতে চান না। আর জামাল বঙ্গবন্ধুর ছেলে হিসেবে বাড়তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা তো করেনই না, তা পেলে সযত্নে এড়িয়ে যান। তিনি উবানকে বলেছেন যে তিনি শেখ মুজিবের ছেলে, কাজেই তাকে এমন কাজ করতে হবে, যাতে বাবার মান বজায় থাকে, এমন কাজ তিনি করতে পারবেন না যাতে বাবার বদনাম হয়। ফলে তিনি নিজে নিজে কঠিন সব কাজ বাছাই করতেন। প্রশিক্ষণের সময়টাতে দেরাদুনের ঠান্ডার মধ্যে জামাল দিনরাত খাটতেন, কঠোর পরিশ্রম করতেন। অস্ত্রচালনায় দ্রুতই দক্ষ হয়ে ওঠেন। তবে তিনি যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতেন, আর তাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হতো, তখন তার চোখ দিয়ে পানি গড়াত। তিনি তাঁর মায়ের জন্য কাঁদেন, রাসেলের জন্য কাঁদেন, হাসু আপা আর সদ্যোজাত ভাগনে জয়ের জন্য কাঁদেন, রেহানার জন্য কাঁদেন। কিন্তু সেই অঞ কাউকে দেখাতে চাইতেন না। উবান তাকে তার বাগানবাড়িতে ডেকে নিতেন, গল্প করতেন। উবানের মনে হলো, এই ছেলে বড় হয়ে বাবার নাম রাখবে।
.
এবিএম মূসা ছবি আর খবর পাঠিয়ে দিলেন সানডে টাইমস, লন্ডনে। খবর আর ছবি ছাপা হলো ২ ডিসেম্বর। খবরের শিরোনাম বয়েজ অব টুয়েলভ ফাইট দ্য ওয়ার। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বেরোল ইন্ডিয়ান টাইম ফ্রন্টিয়ার টাউন স্টিল আন্ডার ফায়ার। তার সঙ্গে ছবিতে দেখা যাচ্ছে শেখ জামাল, হাতে হেভি মেশিনগান।
ছবি ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুজিবনগরে হইচই পড়ে গেল। ডাকা হলো
এবিএম মূসাকে। করেছেন কী!
কেন, কী করেছি?
আপনার খবর তো ভালো। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর ভাষণে এই খবরের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ছবিটা যে শেখ জামালের। বঙ্গবন্ধুর মেজ ছেলের।
সেই জন্যেই তো স্কুপ করেছি। আমি তো পরিচয় দিইনি যে এটা শেখ জামাল।
কিন্তু পাকিস্তানিরা তো তাকে চেনে। বেগম মুজিব এত দিন ধরে পাকিস্তানি মিলিটারিকে বলে এসেছেন, আমার ছেলে হারিয়ে গেছে। তোমাদের বন্দিশালায় ছিল সে। কেমন করে হারাল? তাকে বের করে দাও। এখন ওরা কী বলবে? বেগম মুজিবের ওপরে না আবার অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দেয়। ছেলে কী করে মুক্তিবাহিনীতে গেল!
.
সেসব কিছু হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল ঘোরতর যুদ্ধ।
৭৯
যুদ্ধ তো চলছিল সেই ২৫ মার্চ রাত থেকেই। ঢাকায় ইপিআর যুদ্ধ করেছে, পুলিশ যুদ্ধ করেছে, ছাত্রজনতা ব্যারিকেডে গুলি খেয়ে মরার আগে হাতে যা ছিল তা ছুঁড়ে মেরেছে পাকিস্তানি মিলিটারির দিকে, কিন্তু রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, ফরিদপুর–সর্বত্র, সবখানে সংগ্রাম কমিটি, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, বাঙালি সৈন্য, বাঙালি নৌসেনা, বাঙালি বিমানসেনা একযোগে বিদ্রোহ করেছে, সমবেত হয়েছে, দলে দলে, তারা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করেছে, কোথাও গুলি খেয়ে মরেছে, কোথাও হাজার হাজার মানুষ গিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিদের পরাজিত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে, চট্টগ্রামে বা কুমিল্লায় বা রংপুরে মিলিটারিরা বাঙালি সৈনিকদের ঘুমন্ত অবস্থায় পুরো পরিবারসহ গুলি করে মেরেছে, বেশির ভাগ জায়গায় মার্চ, এপ্রিলে বাঙালিরাই শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ দখল করে উড়িয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ-হলুদ পতাকা, মানুষ গোলার সামনে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে, মরেছে, কিন্তু মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে এবং দখল ধরে রেখেছে, গড়ে উঠেছে মুক্তিবাহিনী। পাবনায় যেমন বাংলাদেশ সরকারের সিলমোহর বানিয়ে নুরুল কাদের খান সরকারি প্রশাসনের কাজ শুরুও করে দিয়েছিলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা বাঙালি অফিসারদের নেতৃত্বে লড়াই করেছে, প্রতিরোধ গড়েছে। কুষ্টিয়ায় ইপিআর, পুলিশ, বাঙালি সৈন্যদের সমবায়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানি ক্যাম্প সার্কিট হাউসে হামলা করতে গেছে, হাজার হাজার মানুষ তখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যার যা কিছু তাই নিয়ে যোগ দিয়েছে এবং কুষ্টিয়া মুক্ত করে ফেলেছে।
তারপর স্বাধীনতার ঘোষণা, সরকার গঠন, সেনাপতি নিয়োগের পর আস্তে আস্তে একটা সমন্বয় গড়ে উঠেছে। বেশির ভাগ জায়গা পাকিস্তানি মিলিটারিরা ট্যাংক, কামান বিমানযোগে আক্রমণ করে দখল করে নিয়েছে। কিন্তু দিন ছিল ওদের, রাত ছিল গেরিলাদের। প্রশাসন ছিল ওদের, মানুষ ছিল জয় বাংলার। বাঁচার জন্য হয়তো পাকিস্তানি পতাকা বাইরে তোলা ছিল, ভেতরে ছিল মুক্তিপাগল গেরিলাহৃদয়। সাধারণ মানুষ, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে হয়তো ৫ লাখ পাকিস্তানপসন্দ, বাকি ৭ কোটি ৪৫ লাখ মানুষই হয়ে উঠেছিল গেরিলা। মুক্তি। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, তাদের অস্ত্রশস্ত্র রসদ বহন করে দিয়েছে, তাদের খবরাখবর এনে দিয়েছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মারা গেছে হাজারে হাজারে, তাদের ঘরবাড়ি পাকিস্তানিদের আগুন জ্বালানোর অস্ত্রে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তাদের নারীরা ধর্ষিতা হয়েছে। কিন্তু মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে হয়ে। উঠেছে নিজেরাই মুক্তিযোদ্ধা।
ক্যাপ্টেন এম এ মতিন, যিনি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন, তিনি বলবেন, জুলাই মাসে খালেদ মোশাররফ একদল গেরিলাকে পাঠালেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। তাদের মধ্যে একজন ছিল স্বপন সাহা, নারায়ণগঞ্জে তার বাবার ছিল ছোটখাটো ব্যবসা। ছেলেটার বাবা আগরতলায় মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা শিবিরের পাশে শরণার্থীশিবিরে থাকতেন। মেজর খালেদ বললেন, মতিন!
স্যার।
তুমি কি শুনেছ, স্বপন সাহা মারা গেছে।
স্যার।
টানবাজার অপারেশনটা ভালোভাবেই হয়েছিল। তবে ফেরার পথে এক রাজাকারের গুলিতে ছেলেটা মারা যায়।
সিঅ্যান্ডবি ব্রিজ পার হওয়ার সময়!
সম্ভবত। ছেলেরা ফিরে এসেছে। তুমি ডিটেইল জেনে নাও। ভালো ছিল ছেলেটা।
জি স্যার। চোখ দুটো সব সময় হাসত। আর দাঁত দুটো বেরিয়ে থাকত বলে মনে হতো সব সময়ই হাসছে।
ওর ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র আছে। আর কিছু টাকা নাও। ওর বাবাকে ডাকো। তার হাতে জিনিসগুলো তুলে দাও। টাকা দাও। আর সান্ত্বনা দাও।
ইয়েস স্যার।
ক্যাপ্টেন মতিন লোক পাঠালেন। শ্রাবণের বৃষ্টিদিনে থিকথিকে কাদায় দুর্গন্ধময় শরণার্থীশিবির থেকে স্বপন সাহার বাবা সুবোধ সাহাকে ডেকে আনা হলো। বয়স ৪৫ কি ৪৮, ধবধবে ফরসা, মাথায় চুল নেই বলে মাথা চকচক করছে, বৃষ্টিজলে আর ঘামে মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, কপালে একটা লাল জরুল, সুবোধ সাহা এলেন।
স্যার, আমাক ডাকছেন?
জি। স্বপন সাহা তো আপনার ছেলে!
আজ্ঞে।
ও তো আমাদের মুক্তিবাহিনীতে ছিল।
আজ্ঞে।
নারায়ণগঞ্জে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে মারা গেছে।
সুবোধ সাহা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
দেশের জন্য মারা গেছে। এর চেয়ে বড় দান তো আর কিছু হতে পারে। আপনার ছেলের কাপড়চোপড় আছে এই ব্যাগে। আর আমাদের মেজর আপনার জন্য দুই হাজার টাকা দিয়েছেন। এগুলো রাখেন।
কাপড়চোপড়গুলো দ্যান। স্মৃতি থাকুক। টাকা লাগব না।
না, রাখেন।
সুবোধ সাহার চোখ ভিজে গেল। একটু পরে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বলতে লাগলেন, আমার একটামাত্র ছেলে। আমার একটামাত্র ছেলে।
মতিন বললেন, একটামাত্র ছেলে হারানোর শোক কী আমি বুঝি সুবোধবাবু।
চুপ করে চেয়ে রইলেন তিনি।
দাদা কী চিন্তা করছেন, ক্যাপ্টেন মতিন বললেন।
সুবোধ চোখ মুছলেন। কান্না থামালেন। তারপর বললেন, আমি চিন্তা করছি ভগবান কেন আমাকে মাত্র একটা ছেলে দিল। আরেকটা ছেলে থাকলে তো আমি তাকে আজকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারতাম। সে যুদ্ধে যাইতে পারত। দ্যাশটা স্বাধীন করতে যুদ্ধ করত।
.
এই রকম বাবারা আছেন। এই রকম সেনাকর্তারা আছেন। ১১টা সেক্টর। নৌসেনারা যুদ্ধ করে পানিতে পাকিস্তানিদের চলাচল কঠিন করে তুলেছে। বন্দরগুলো অকেজো। বিমানবাহিনী গড়ে উঠেছে। প্রায় এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছে। এর মধ্যে বিশ হাজার নিয়মিত সৈন্য। মুজিববাহিনী আট-দশ হাজার। কিন্তু আরও এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইল এলাকায় গড়ে উঠেছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাঁদেরিয়া বাহিনী, তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আঠারো হাজারে উন্নীত হয়, আর তার সঙ্গে যুক্ত থাকে ৫০ হাজার সক্রিয় কর্মী মানুষ, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ইপিআরের হাবিলদার হেমায়েত তার এলাকায় ৮০০ জনের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়েন, যাঁরা আবার ৫ হাজার জনকে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক সৈনিক আফসার উদ্দীন তার এলাকা ময়মনসিংহের ভালুকায় গড়ে তোলেন ৮০০ জনের আফসার বাহিনী, আত্রাই এলাকায় ছিল ওহিদুর বাহিনী, শ্রীপুরে আকবর বাহিনী, রৌমারী রাজীবপুরের আফতাব বাহিনী, শরণখোলা এলাকায় জিয়া বাহিনী–এ রকম আরও আরও বাহিনী গড়ে উঠেছিল, যারা মার্চে দুইটা-তিনটা রাইফেল বন্দুক নিয়ে শুরু করে থানা আক্রমণ করে আরও অস্ত্র দখল করে, তারপর মিলিটারিদের ওপরে অ্যামবুশ করে তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে অস্ত্রভান্ডার বাড়িয়েছে, আর বাড়িয়ে গেছে। গেরিলার সংখ্যা, আক্রমণের পর আক্রমণ করে একেকটা এলাকাকে পাকিস্তানিদের দখলমুক্ত করে রাখতে সমর্থ হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের সারা সীমান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সীমান্ত শহরগুলোতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের প্রতিরোধ ঘটি শক্তিশালী করেছে, সিমেন্ট দিয়ে বাংকার বানিয়েছে। তারা জেনেছে যে ভারতীয়দের উদ্দেশ্য হলো পূর্ব পাকিস্তানের একটা অংশ দখল করে সেখানে শরণার্থীদের পাঠিয়ে দেওয়া আর সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয় স্থাপন।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, এ ধরনের পরিকল্পনা যে ভারতীয় সেনাধ্যক্ষদের আছিল না, তা কওয়া যাইব না।
ব্যাঙ্গমি বলে, আপাতত তাদের পরিকল্পনা হইল, মুক্তিবাহিনীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ মাইল পর্যন্ত সাপোর্ট দিয়ে যাওয়া, যাতে পাকিস্তানি মিলিটারি ঢাকা থেকে সইরা আসে আর তাদের রক্তক্ষরণ হইতেই থাকে। হইতেই থাকে।
ব্যাঙ্গমা বলে, ডিসেম্বর থাইকা তাগো পরিকল্পনা দ্রুত বদলায়া যায়। ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব দাবি করেন যে তিনি এই পরিকল্পনা পাল্টে ফেইলা শহরগুলো দখল করার মরিয়া চেষ্টা ত্যাগ করেন। আর যত দ্রুত সম্ভব ঢাকার দিকে যাওয়ার জন্য তার বাহিনীকে পরিচালিত করেন। যা সুফল আইনা দেয়।
সেই কাহিনি শুনব আমরা যথাসময়ে, যথাস্থানে।
.
মধ্য নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী ইউরোপ, আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন আহত সিংহের ক্ষোভ বুকে নিয়ে। যখন ওয়াশিংটনে তিনি নিক্সনের পাশে হেঁটে হেঁটে অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন, নিক্সনকে তাঁর পাশে দেখাচ্ছিল ইঁদুরের মতো, কিন্তু নিক্সন তো ইন্ডিয়ানদের বাস্টার্ড আর ইন্দিরা গান্ধীকে দ্যাট ওল্ড বিচ ছাড়া আর কিছুই মনে করতেন না। ইন্দিরা দিল্লিতে ফিরেই মানেকশকে ডাকলেন, বিমানবাহিনী-নৌবাহিনীর প্রধানকে ডাকলেন, বললেন, তোমরা কি প্রস্তুত?
ইয়েস ম্যাম।
আমরা একটা ন্যায়সংগত যুদ্ধ করছি। আমরা নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি। আমরা মানুষের মৃত্যু রোধ করতে চাইছি। আমরা রক্তপাত বন্ধ করতে চাচ্ছি। আমাদের যুদ্ধ ন্যায়যুদ্ধ। আমরা কোনো দেশ দখল করব না। আমরা শুধু আমাদের প্রতিবেশী দেশটাকে অত্যাচারী অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করব। ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার শুনেছ। সে নাকি আমাকে বলবে, শাটআপ উম্যান, লিভ মি অ্যালোন অ্যান্ড লেট মাই রিফিউজিস ব্যাক। আমাকে সে বলেছে, আমি মেয়েমানুষও নই, লিডারও নই, কিন্তু দুটোই হতে চাই।
সে শুধু আমাকে অপমান করেনি, সে সারা পৃথিবীর সব নারীকে অপমান করেছে। সে আমাদের মাকে অপমান করেছে। যাও। লড়ো। তবে একটা কথা। পৃথিবী যেন দেখে, বলে যে পাকিস্তান আগে আক্রমণ করেছে। মুক্তিবাহিনীকে বলো, পূর্ব বাংলার সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে যেতে। তাদের পাশাপাশি তোমরাও এগিয়ে যাও। তোমরা তাদের সাপোর্ট দাও। অল আউট সাপোর্ট।
তার মানে তো যুদ্ধ!
হ্যাঁ। তার মানে যদি যুদ্ধ হয়, তবে যুদ্ধ। যাও।