০১০. সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে

১০

সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দুপুর গড়িয়ে পড়ছে। হেলে পড়া মার্চের সূর্য ধানমন্ডি লেকের ধারের শিরীষগাছগুলোর পাতায় পাতায় হলদেটে হতে শুরু করেছে। খোকা বললেন, ভাবি, চলেন ওয়ারীতে যাই। অনেক দূরের পথ।

রেনু বললেন, রাসেলকে একটু খাওয়ায়ে নিই।

তাঁকে ধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালো দাগ। সদা প্রশান্ত হাসিমুখ ভাবটা উধাও।

জামাল এক কাপড়েই আছেন দুই দিন। তাঁর দাড়ি বড় হয়ে গেছে।

ধানমন্ডি থেকে খোকার গাড়িতে বেরোলেন রেনু, জামাল, রেহানা, রাসেল। রেনু অনেক বড় করে ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন মুখখানা। রেহানাও ওড়না পেঁচিয়ে নিলেন মাথার ওপরে, ঘাড়ে। তারা যাবেন ওয়ারী। রাস্তায় লোকজন পড়িমরি ছুটছে। যেন মড়কে গ্রাম উজাড় হবে। পাকমোটরের কাছে এসে তারা দেখতে পেলেন রাস্তায় জনস্রোত। গাড়ি চলারই জায়গা নেই। সবাই ছুটছে বুড়িগঙ্গা অভিমুখে। নদী পার হতে পারলেই যেন প্রাণে বেঁচে যাবে মানুষেরা।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ত্রিকালদর্শী, তারা বলবে :

নদী পার হইয়াও বহু মানুষ বাঁচতে পারে নাই, এপ্রিলের শুরুর দিকে পাকিস্তানি মিলিটারি হামলা করে নদীর ওইপারে, কামান দাগায়া ছুটন্ত মানুষ, মানুষগো উড়ায়া দেয়, নারী-পুরুষ-শিশু হাজারে হাজারে ছুটতে গিয়া গুলি খায়, গুলি খায়া দৌড়াইতে থাকে, মরা মানুষ ছোটে, মাথা ছাড়া শরীলও দৌড়াইতে থাকে, মাথা উইড়া যাইতে যাইতে চিৎকার কইরা উঠে, জয় বাংলা।

.

গাড়ি নিয়ে এগোনো যাচ্ছে না।

শহীদ মিনারের পাশে গিয়ে রেহানা বললেন, মা দেখো।

রেনু বললেন, কী।

শহীদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলা যাচ্ছে না। গলি উপগলি ধরে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো।

খোকা বললেন, ভাবি, মনে হয় না কারফিউয়ের আগে ওয়ারী পৌঁছাতে পারব।

রেনুর কণ্ঠে একরাশ উকণ্ঠা, তাইলে উপায় কী হবি?

আমার ভাগনির বাড়ি আছে কাছে। সেখানে যাই।

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টো দিকে সাকুরার কাছে পিপল পত্রিকার অফিস। পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। পত্রিকাটার অপরাধ, তারা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে ছিল। পুরা মার্চ তাদের কলম থেকে ঝরেছিল আগুন।

গুড়ুম গুড়ুম। গোলাবর্ষণ শুরু হলো। কোন দিক থেকে গুলি আসছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খোকা ভয় পাচ্ছেন। গাড়ির মেঝেতে বসা রাসেল কেঁদে উঠল।

খোকা বললেন, মগবাজারের গলিতে সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আলী সাহেবের ফ্ল্যাটবাড়ি। ওই সব ফ্ল্যাটে সব আমাদের লোকেরাই থাকে। ওইখানে ঢুকে পড়ি।

তা-ই করা হলো। ওই ফ্ল্যাটে থাকেন চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবীর, অভিনেতা আলী আহসান সিডনি–এই রকম বিখ্যাত মানুষেরা। ফ্ল্যাট বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ার পর দেখা গেল মোরশেদ মাহমুদও পরিবার নিয়ে এখানেই উঠেছেন। উঠেছেন অভিনেতা আবুল খায়ের, যিনি ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ ও প্রচার করেছিলেন। ৩২ নম্বরে তার আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত।

বেগম মুজিব এসেছেন, সবাই ভিড় করে এল দেখতে। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, কে কার চেয়ে বেশি আদর-আপ্যায়ন করতে পারবেন।

একটা রেডিও চলে এল। এতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী রেডিও শোনা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের নেতা হান্নান সাহেব বঙ্গবন্ধুর বার্তা পড়ে পড়ে শোনাচ্ছেন। ভালো করে শোনাও যায় না। শুধু বোঝা যায়, জয় বাংলা।

জয় বাংলা রেডিওর ঘোষণার উত্তেজনা, চট্টগ্রাম এখনো শত্রুমুক্ত, এসব খবরের মধ্যে আসতে লাগল মারাত্মক সব সংবাদ।

মোরশেদ মাহমুদের ভাই মাহমুদুর রহমান বেনু এলেন। ঘরের মধ্যে অনেক মানুষ। বেগম মুজিব আছেন, খোকা আছেন, মোরশেদ আছেন, আলমগীর কবীর আছেন। এক কোণে রেহানা, জামালও আছেন।

বেনু বললেন, মিলিটারিরা শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে লিখে রেখেছে, মসজিদ।

একজন বললেন, কী সর্বনাশ।

আলমগীর কবীর বললেন, প্রফেসর গোবিন্দচন্দ্র দেব নাকি জগন্নাথ হলের সামনে ছুটে গিয়েছিলেন। মিলিটারিদের বলছিলেন, এদের মেরো না। এরা সবাই হিন্দু। উনি হয়তো ভেবেছিলেন, মাইনরিটির কথা শুনলে মিলিটারিরা আর ছাত্রদের মারবে না। মাইনরিটিকে রক্ষা করা তো মেজরিটির পবিত্র কর্তব্য। কিন্তু তাতে কোনো কিছুই রক্ষা করা যায়নি। জি সি দেবকেও ওরা মেরে ফেলেছে। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের বের করে মাঠে নিয়ে গিয়ে লাইন করে গুলি করে হত্যা করেছে।

বেনু বললেন, আগরতলা মামলার আসামি কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে বাড়ি গিয়ে হত্যা করেছে। তাকে বলেছিল, বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা জিন্দাবাদ, এক দফা জিন্দাবাদ।

আরেকজন জানালেন, ইকবাল হলের ছাত্রদের তো মেরেছেই, কর্মচারীদেরও মেরেছে। ইকবাল হলের দারোয়ান মশারির নিচে স্ত্রীসহ মরে পড়ে আছে।

মধুদাকে মেরেছে। মধুদার বাড়ির সবাইকে গুলি করেছে।

ঢাকা ইউনিভার্সিটির আরও আরও টিচারকে মেরে ফেলেছে।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার অচেতন শরীর স্ট্যাটিসটিকসের প্রফেসর মনিরুজ্জামান আর ছেলেদের গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে পড়ে ছিল। দুই রাত বাড়িতে রেখে তার ফ্যামিলি নাকি তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠাতে পেরেছে। মনে হয়, তিনিও বাঁচবেন না।

জগন্নাথের সহকারী টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও মেরেছে।

১০ জনের মতো শিক্ষক, তাঁদের পরিবার-পরিজন, বহু কর্মচারী আর অসংখ্য ছাত্রকে মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা। হামলা করেছে রোকেয়া হলেও।

.

আরও আরও হত্যা, মৃত্যু, আগুন, ধ্বংসের খবর উচ্চারিত হতে হতে একসময় সবাই চুপ হয়ে যায়।

পুরো ঘর স্তব্ধ হয়ে আসে। পুরো চরাচর যেন স্তব্ধ। কবরের নীরবতা নেমে এসেছে এই পৃথিবীতে আজ।

১১

৪১ বছর বয়সী ফারুক আজিজ খান মনোমুগ্ধকর পাহাড়-ঝরনা সরোবরশোভিত ছোট্ট শহর কাপ্তাইয়ের একটা চমৎকার কাঠের বাংলোয় ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। রাত এগারোটা। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে, পাহাড়ি গাছগাছড়ায় জোনাকির মেলা বসেছে, কুকুর এবং শিয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে–এসবের সঙ্গে ফারুক খান আজ আড়াই বছর ধরেই অভ্যস্ত। ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটের সহকারী বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার পদ থেকে তাঁকে ১৯৬৮ সালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে, সুইডিশ-পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পরিচালক করে। দুই শিশুপুত্র আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ক্যাম্পাসের ভেতরে তাঁর ছবির মতো বাংলোটিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই বাড়িতে আরও আছে। বারো বছর বয়সের বাদশা মিয়া, ছোটখাটো কাজের তদারকি করে থাকে সে। আছেন ফারুক খানের চাচাশ্বশুর, এসেছেন পর্যটন এলাকায় বেড়াতে।

সবাই বিছানায় শুয়ে আছেন, যার যার মতো করে। আর আছেন একজন বয়স্ক গৃহপরিচারিকা।

ফারুক খান জানেন, যেকোনো সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করতে শুরু করে দেবে। গোটা মার্চই তো আগুনঝরানো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এই শহরেও সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। রাজপথগুলো দিনের বেলা থাকে মানুষের মিছিলের পদভারে কম্পিত। মানুষের হাতে হাতে লাঠিসোটাসমেত নানা ধরনের প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র। ছাদে ছাদে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-হলুদ পতাকা। মিলিটারি শহরের বন্দুকের দোকানগুলো থেকে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ জব্দ করেছে।

যদি যুদ্ধ শুরুই হয়ে যায়, এই কাঠের তৈরি বাংলো, তাতে আবার কাঁচের অনেক জানালা, সেখানে কি আদৌ বেঁচে থাকা যাবে? ফারুক আজিজ খান ভাবছিলেন, আর তাঁর চোখের ঘুম উবে যাচ্ছিল।

ক্রিং ক্রিং। তীব্র শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন।

তাঁর স্ত্রী মাথা তুললেন সবার আগে। কী হয়েছে? এত রাতে ফোন কেন?

ফারুক ফোনের রিসিভার তুললেন, বললেন, হ্যালো।

স্যার। আমি মুজিবুল হক স্যার। ফারুক খানের পিএসের কণ্ঠস্বর।

হ্যাঁ, মুজিব বলো!

স্যার। চট্টগ্রাম থেকে এইমাত্র ফোন এসেছে স্যার। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

কে এই খবর দিয়েছে?

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি হান্নান সাহেব স্যার।

ইপিআরের ক্যাপ্টেন হারুনকে খবরটা দিয়েছ?

খবর নিয়ে লোক গেছে স্যার। একজন বাঙালি সুবেদারকে পাঠানো হয়েছে।

আচ্ছা।

আমরা কী করব স্যার?

তুমি আগের মতোই টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মনিটর করো। এরপর কিছু করতে হলে আমি বলব।

ফারুক খান ফোন রেখে দিলেন। এরপর কী করতে হবে, তিনি যদি জানতেন!

তাঁর স্ত্রী এরই মধ্যে বিছানায় উঠে বসেছেন। আরেকটা খাটে তার দুই সন্তান ঘুমুচ্ছে।

স্ত্রী বললেন, কার ফোন? কী বলল?

মুজিবুল ফোন করেছিল। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টা পার হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ শুরু হয়ে গেছে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে। রেডিয়ামজ্বলা হাতঘড়ি তুলে নিয়ে দেখলেন ফারুক খান।

তাঁর স্ত্রী আর্তনাদ করে উঠলেন। তারপর আলো জ্বালিয়ে কোরআন শরিফ নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলেন।

ফোনের শব্দ শুনে ফারুক খানের চাচাশ্বশুরও জেগে গেছেন। তিনিও জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর?

শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

তাঁর কাছে টুপি ছিল না। তিনি অজু করে মাথায় একটা রুমাল বেঁধে নামাজে বসে গেলেন।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন গৃহপরিচারিকা। তিনি বুঝতে পারলেন মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে। তাঁর রোদন করা উচিত। তিনি সশব্দে কান্না জুড়ে দিলেন।

বাদশা মিয়া বলল, স্যার, আঁই কী করতাম?

তা বটে। এটা একটা প্রশ্ন বটে। এই বালক এখন কী করবে? ফারুক আজিজ খান বললেন, তুমি এক কাজ করো। জানালা দিয়ে ইপিআর ক্যাম্পটার দিকে নজর রাখো। মাথা অল্প তুলবে। যা দেখছ, আমাকে বলো।

.

ক্যাপ্টেন হারুনের কাছে খবর গেল। এম এ হান্নানের কল এসেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই এলাকার ইপিআরের তিনি সেকেন্ড ইন কমান্ড। প্রধান কমান্ডিং অফিসার মেজর পীর মোহাম্মদ একজন পাকিস্তানি। হারুন দ্রুত অ্যাকশনে গেলেন। বাঙালি জওয়ানদের নিয়ে পীর মোহাম্মদকে সবার আগে অ্যারেস্ট করে ফেললেন। এরপর আর যারা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ছিল, তাদের নিরস্ত্র করে বেঁধে একটা হলঘরে রাখার ব্যবস্থা করা হলো।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, ঢাকা থাইকা অনেক দূরে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের খবর হইল এই।

ব্যাঙ্গমি বলে, সারা দেশের অনেক জায়গাতেই এই রকমের ঘটনা ঘটতে থাকে। থানায়, পোস্ট অফিসে, ইপিআরের ওয়্যারলেসে আসতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। প্রতিরোধ করো। আজ থাইকা বাংলাদেশ স্বাধীন। বাঙালি সৈন্যরা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বিদ্রোহ করতে থাকে। বাঙালি ডিসি, এসপি, পুলিশ, আর্মি, ইপিআর, আনসার একযোগে নানান জেলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন কায়েম করতে থাকে। তাগো নেতৃত্বে থাকে সংগ্রাম পরিষদ। লগে লাঠিসোটা, বল্লম, বন্দুক হাতে যোগ দেয় ছাত্র-জনতা। বঙ্গবন্ধুর মেসেজ ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় পৌঁছায়, বহু জায়গায় পৌঁছায় নাই। রাজারবাগে হামলা হইছে, পিলখানায় হামলা হইছে, অথবা স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে পশ্চিমারা বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতাছে, নানাভাবে খবর পাইয়া ২৫ মার্চ রাত থাইকাই বিভিন্ন জায়গায় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ, লড়াই, প্রতিরোধ শুরু হইয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি ইপিআর, বাঙালি সৈন্য, বাঙালি পুলিশ, বাঙালি আনসার, বাঙালি অফিসাররা বিদ্রোহ কইরা প্রতিরোধযুদ্ধে শামিল হন।

একজন আরেকজনরে জানায়া দেয় ওয়্যারলেসে, আমরা বিদ্রোহ করতাছি। তোমরাও করো। আর অন্যদিকে পাকিস্তানি অফিসার সৈন্যরা বাঙালি অফিসার সৈন্যদের নিরস্ত্র কইরা গুলি কইরা মারতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। একটা অহিংস স্বাধীনতাসংগ্রাম বারুদের স্কুপে অগ্নিসংযোগ হওয়ামাত্র বিস্ফোরিত হইয়া মুক্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হইয়া যায়।

১২

আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক। ৩৪-৩৫ বছর। বয়স। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরবেলা। তাঁর বাড়ির ফোন বেজে উঠল।

হ্যালো। তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে ফোন ধরলেন তিনি। রাতে দেরি করে ফিরেছেন। উপাচার্যের কার্যালয়ে ছিলেন প্রায় ভোররাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে নানা ধরনের খবর আসছে। ঢাকায় ভয়াবহ কিছু একটা ঘটেছে। ঠিক কী ঘটেছে, তা জানার জন্য ঢাকার বিভিন্ন নম্বরে ফোন করেছেন তাঁরা। সব ফোনই প্রায় ছিল ব্যস্ত। কোনো লাইন পাওয়া যাচ্ছিল না। ইত্তেফাক অফিস, পূর্বদেশ অফিস পাওয়া গেল। জানা গেল, রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক বেরিয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাত ১২টার পর টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারা তবু উপাচার্যের কক্ষে বসে রইলেন। যদি কিছু জানা যায়। আনিসুজ্জামান বাড়ি ফিরলেন ম্যালা রাতে।

বাড়িতে তাঁর স্ত্রী বেবি তো আছেনই, আছে দুই কন্যা সাড়ে ছয় বছরের রুচি আর দেড় বছরের শুচি। বেবির ভাই আজিজুল ওয়াহাব, তাঁর স্ত্রী রুবা, তাদের ছোট্ট একটা মেয়েও এসেছে মেহমান হিসেবে। সবার চোখেমুখেই উদ্বেগের ছায়া।

এরই মধ্যে এল এই ফোন।

স্যার, আমি খোকন বলছি স্যার। আবদুল আলী খোকন?

হ্যাঁ। খোকন! বলো, কোনো খবর আছে?

জি স্যার। আছে স্যার। বলো। তুমি কোথায়?

স্যার। আমি সিআরবি পাহাড়ে স্যার।

হ্যাঁ। কী অবস্থা ওখানে!

অবস্থা স্যার ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন স্যার। কাল রাত থেকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে স্যার।

বলো কী?

স্যার। ক্যাপ্টেন রফিক সাহেব আমার সামনে আছেন। আপনি কথা বলেন স্যার। আমি দিচ্ছি স্যার।

আচ্ছা দাও।

ফোনে শোনা গেল ক্যাপ্টেন রফিকের কণ্ঠ, স্যার। সালাম আলায়কুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসোলাম।

স্যার আমি ক্যাপ্টেন রফিক স্যার।

জি। আনিসুজ্জামান বলছি।

স্যার আমরা ইপিআর গত রাত থেকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি স্যার। হালিশহরে পাকিস্তানি সবাইকে বন্দী করা হয়েছে। ইপিআরের নিয়ন্ত্রণ আমরা নিয়ে নিয়েছি। যুদ্ধ চলছে। আপনাকে ফোন করেছি এই কথা বলার জন্য, সবাইকে জানিয়ে দেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। মরব, কিন্তু লড়াই থামাব না। আমাদের লড়াই বিজয় অর্জিত না হওয়া। পর্যন্ত চলবে।

মুহূর্তে আনিসুজ্জামানের রক্ত যেন উষ্ণ হয়ে উঠল।

স্যার। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্টনমেন্টের ওপরে নজর রাখুন। কোনো কিছু দেখলে আমাদের জানাবেন। আলীকে জানালেই স্যার আমরা খবর পেয়ে যাব।

আচ্ছা। আমি অবশ্যই জানাব।

স্যার। আমি অনেক ব্যস্ত। এখন রাখি স্যার?

ঠিক আছে।

বেবি ঘুম থেকে উঠেছেন। আজিজও। তাঁরা আনিসুজ্জামানের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে আছেন।

কী খবর? আজিজ জানতে চাইলেন।

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

বেবি তাড়াতাড়ি টেবিলে নাশতা সাজাতে লাগলেন। পাউরুটি, মাখন, ডিম, চা।

আজিজের মেয়েটা উঠে পড়েছে। রুবা তাকে নিয়ে আরেক ঘরে ব্যস্ত। বাচ্চাটা একবার কেঁদে উঠল।

আজিজ বললেন, দরকারি জিনিস কিন্তু কিনে রাখতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের দুধ। পরে আর কেনার সুযোগ না-ও পাওয়া যেতে পারে।

আনিসুজ্জামান রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, হ্যাঁ। দেখি একবার বাজারে যেতে হবে।

রেডিওতে সামরিক ফরমান শোনানো হচ্ছে। উর্দুঘেঁষা কণ্ঠের পাঠ। ফরমান এক। ফরমান দো। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ, বেশ বোঝা যাচ্ছে।

আবারও টেলিফোন এল। এবার উপাচার্যের অফিস থেকে। স্যার, ভিসি স্যার সালাম দিয়েছেন।

আচ্ছা আমি আসছি।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আনিসুজ্জামান তাঁর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

বেবি বললেন, বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন? কিছু জানতে পারলে?

না বেবি। নানা গুজব। আসলে কী ঘটছে, কে বলতে পারে?

.

গাড়ি পার্ক করে আনিসুজ্জামান ভিসির অফিস কক্ষে ঢুকলেন। বিশাল কক্ষ। বড় টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে অধ্যাপক করিম, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বসে আছেন। সালাম দিয়ে আনিসুজ্জামানও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। ক্যাপ্টেন রফিকের খবরটা জানানো দরকার।

এরই মধ্যে অধ্যাপক আর আই চৌধুরী, মোহাম্মদ আলীও এসে গেছেন।

উপাচার্য এ আর মল্লিক বললেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এম এ হান্নান, এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সন্ধ্যার সময় এম আর সিদ্দিকীর কাছে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন নির্দেশ এসেছে। তিনি বলেছেন, আলোচনা ফেইল করেছে। পাকিস্তানি আর্মি অ্যাটাক করছে। আস্ক বেঙ্গলি আর্মি, ইপিআর, পুলিশ নট টু সারেন্ডার অ্যান্ড গিভ আ কল টু পিপল টু গিভ রেজিস্ট্যান্স।

আনিসুজ্জামান বললেন, ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। সিআরবি পাহাড়ে আছেন তারা।

এ আর মল্লিক বললেন, হ্যাঁ। এম আর সিদ্দিকী সাহেব জানালেন। চট্টগ্রাম ডাকবাংলো, চট্টগ্রাম রেলওয়ে রেস্টহাউস সংগ্রাম পরিষদের হাতে।

আনিসুজ্জামান বললেন, ক্যাপ্টেন রফিক ক্যান্টনমেন্টের ওপর নজর রাখতে বলেছেন। কোনো মুভমেন্ট হলে তাঁকে জানাতে বলেছেন।

এ আর মল্লিক বললেন, আমাদের সিএসআইআরের কাছে। বাইনোকুলার আছে না?

থাকা উচিত। একজন বললেন। সায়েন্টিফিক রিসার্চ সেন্টার বলে কথা।

ক্রিং ক্রিং। উপাচার্যের ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন ধরলেন।

ফোন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার সিদ্দিকী সাহেব, স্যার, আমার বাসায় ইপিআরের কয়েকজন সোলজার এসেছেন। সঙ্গে আরও কিছু সংগ্রাম কমিটির লোকজন।

কেন?

তারা বলছে, এই বাসা থেকে ক্যান্টনমেন্টের ওপরে নজর রাখতে সুবিধা হবে। আমাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলে। কী করব?

বাঙালি?

জি। বাঙালি।

হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে?

জি আছে।

ইপিআরের ইউনিফর্ম আছে?

জি আছে।

আচ্ছা, তাহলে বাসা ছেড়ে দেন। আমরা বাইনোকুলার দিচ্ছি রিসার্চ সেন্টার থেকে।

স্যার, বাসা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু ওদের খাওয়াদাওয়ার তো ব্যবস্থা করতে হবে।

আচ্ছা আমি দেখছি।

.

ভিসির কার্যালয় এই এলাকার সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একটু পরে গোলাগুলির শব্দ। অধ্যাপকেরা সচকিত হলেন। ভিসি ফোন করলেন ট্রেজারার সিদ্দিকীর বাসার নম্বরে। ফোনে ওদের একজনকে পাওয়া গেল।

গোলাগুলির শব্দ কোত্থেকে আসছে?

আমাদের দিকেই বাইরে থেকে গুলি আসছে স্যার।

বাইরে মানে কোন দিক থেকে?

উল্টা দিকে কতগুলো পশ্চিম পাকিস্তানির বাড়ি আছে। কোনো একটা বাড়ি থেকে হবে স্যার।

আচ্ছা। ভালো করে ওয়াচ করেন। বাইনোকুলার কাজ করছে তো?

জি স্যার। স্যার আমরা কি আক্রমণ করব স্যার। আমরা বের হয়ে গিয়ে ওই বাড়ি উড়ায়া দিয়া আসতে পারি।

না না। তার প্রয়োজন দেখছি না।

.

এ আর মল্লিক সাহেব আর উপাচার্য থাকলেন না, সেই মুহূর্তে সেনা কমান্ডারের স্থান অধিকার কইরা লইলেন। কোথায় আক্রমণ করতে হইব, কোথায় প্রতিরক্ষা, সে নির্দেশও তিনি দিতে লাগলেন-ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি টিপ্পনী কাটল।

.

ভিসি বললেন, তোমরা বাড়ি থেকে বের হবে না।

স্যার গুলিতে সামনের রাস্তার ইলেকট্রিক লাইনের তার ছিঁড়ে গেল স্যার।

একটু পরে ওই বাড়ির সঙ্গে টেলিফোন লাইনও কেটে গেল।

আনিসুজ্জামান বেরিয়ে গেলেন উপাচার্যের কক্ষ থেকে। তাকে বাজারে যেতে হবে। বাসায় শিশু আছে। দুধ অন্তত কেনা দরকার।

তিনি গাড়ি নিয়ে গেলেন হাটহাজারী বাজারে। বাজারে বেশ ভিড়। সবাই কেনাকাটা নিয়েই ব্যস্ত। সবারই চোখেমুখে একটা অজানা শঙ্কার ছাপ যেন দেখা যাচ্ছে। কী হয় না হয়, অনিশ্চয়তার ছায়া। তবে যাকে বলে প্যানিক বায়িং, তা হচ্ছে না। কারণ, আজ মাসের মোটে ২৬, লোকের হাতে টাকাপয়সা তেমন নেই। শুক্রবার। ব্যাংক বন্ধ। শুধু গাড়িতে তেল ভর্তি করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, পেট্রল কম কম করে দেওয়া হচ্ছে।

বাজারে পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। খাকি ইউনিফর্ম পরা। আনিসুজ্জামানকে দেখে তারা সালাম দিলেন।

আনিসুজ্জামান বললেন, ঢাকার খবর শুনেছেন কিছু?

জি স্যার। কিছু কিছু শুনেছি।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা করেছে, শুনেছেন?

জি স্যার শুনেছি। খুব চিন্তা হচ্ছে স্যার।

.

ভিসি চট্টগ্রাম শহর সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

এম এ হান্নান সাহেব ফোনে বললেন, ভিসি সাহেব, বঙ্গবন্ধুর মেসেজ আমরা পেয়েছি। এটা প্রচার করছি। এইখানে ডাকবাংলোতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে মাইকে পড়ে শোনালাম।

ভিসি বললেন, মেসেজটা কী?

হান্নান সাহেব পড়তে লাগলেন :

Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night [March 25, 1971], West Pakistan armed forces suddenly attacked the police barracks at Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh. Violent clashes between EPR and police on the one hand and the armed forces of Pakistan on the other are going on. The Bangalees are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.

ভিসি মন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটা শুনলেন।

.

আনিসুজ্জামান তাঁর বাসায় বাজার-সদাই নিয়ে ফিরলেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কাল মোটামুটি সারা রাত নিঘুম গেছে। খেতে বসে পাঞ্জাবিতে ঝোল লেগে গেছে। বেবি সাবান-পানি এনে বললেন, একটু ভিজিয়ে দিই। তা না হলে হলুদের দাগ যাবে না।

আনিসুজ্জামান পাঞ্জাবি খুলে দিয়ে বললেন, ওই জায়গাটাই শুধু ভেজাও।

শরীরটা এলিয়ে পড়ছে। একটু শুয়ে ঘুমিয়ে নেবেন নাকি, আনিসুজ্জামান ভাবছেন।

তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। একটু শুয়ে রেস্ট নাও।

হুম।

বঙ্গবন্ধুর কোনো খবর জানতে পারলে?

না।

আমার কিন্তু খুব ভয় হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর কোনো ক্ষতি করার সাহস তো ওদের হওয়ার কথা না।

আচ্ছা তুমি একটু শুয়ে চোখ বন্ধ করো।

আনিসুজ্জামান চোখ বন্ধ করলেন। মুহূর্তে ঘুম এসে তাকে নিয়ে গেল। স্বপ্নের জগতে। রুচি বলছে, শেখ মুজিব এসেছে, আসাদ আসে নাই?

ক্রিং ক্রিং। ফোন বেজে চলেছে। রুচিই ফোন ধরল, হ্যালো।

ড. আনিসুজ্জামান নেই?

আছেন।

একটু ডেকে দেওয়া যাবে।

আপনি কে বলছেন?

আমার নাম রফিকুল আনোয়ার।

ফোনের শব্দে আনিসুজ্জামানের ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি উঠলেন। মেয়ে। বলছে, বাবা, তোমার ফোন।

কে?

রফিকুল আনোয়ার।

আনিসুজ্জামান তাকে চিনতে পারলেন সহজেই। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, এখন সংগ্রাম পরিষদের নেতা।

হ্যালো।

স্যার সালাম আলায়কুম। স্যার একটা জরুরি মেসেজ আছে। কাগজ কলম নিয়ে লিখে নিন।

কিসের জরুরি মেসেজ।

বঙ্গবন্ধুর মেসেজ।

আচ্ছা। আমি লিখে নিচ্ছি। তুমি বলো।

ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পড়ে শোনালেন আনোয়ার। তারপর বললেন, স্যার, আপনি একটু যদি এটা তাড়াতাড়ি করে বাংলায় অনুবাদ করে দেন।

তারপর ক্যাম্পাসে বিলি করার ব্যবস্থা করেন।

আচ্ছা আমি করছি।

আনিসুজ্জামান কাগজ-কলম নিয়ে বার্তাটা অনুবাদ করলেন। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।

পাঞ্জাবিটার একটা জায়গা ভেজা। সেইটাই পরে নিয়ে তিনি বের হলেন ঘর থেকে। তিনি তার অফিসে গেলেন।

এইটা সাইক্লোস্টাইল করা দরকার।

টাইপিস্ট ওখানেই ছিলেন। তিনি কাগজটা নিয়ে টাইপ করতে আরম্ভ করলেন।

তার অফিস সহকারীরা বলতে লাগল, এম এ হান্নান চট্টগ্রাম রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি থেকে বঙ্গবন্ধুর এই মেসেজটা বাংলাতেই পড়েছেন। মাঝেমধ্যে এই ঘোষণা রেডিও থেকে শোনা যাচ্ছে। এটার নাম দিয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

আনিসুজ্জামান সহজে আবেগাপ্লুত হন না। কিন্তু তার শরীরে রোমাঞ্চ জাগছে। স্বাধীন বাংলা বেতার হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা পড়া হচ্ছে। তখন অপরাহু। সূর্যের আলো হেলে পড়ছে। মাঠে ঘূর্ণিবায়ুতে চৈত্রের ঝরাপাতা পাক খেতে খেতে আকাশে উড়ছে। এই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে। সংগ্রাম চলছে। সংগ্রাম ক্রমশ যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, এম এ হান্নান আছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

ব্যাঙ্গমি বলে, তিনি আলফা ইনস্যুরেন্সের ম্যানেজারও আছিলেন। কাজেই শেখ সাহেবের লগে যে তার খাতির খুবই আছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ব্যাঙ্গমা বলে, ২৫ মার্চ রাতে, সাড়ে ১১টার দিকে, চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাড়ির ফোন বাইজা উঠে। ক্রিং ক্রিং। ফোন ধরলেন ডা. নুরুন্নাহার জহুর। জহুর সাহেবের ওয়াইফ। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।

ব্যাঙ্গমি বলে, নুরুন্নাহার ফোন ধরলে উল্টা পাশ থাইকা কয়, একটা মেসেজ আছে। লেইখা নেন। নুরুন্নাহার ছেলেরে কন, কাগজ-কলম দ্যাও তো। ছেলে কাগজ-কলম আগায়া দেয়। ডাক্তারের বাড়িতে ওষুধ কোম্পানির দেওয়া কাগজ আর একটা পেটে কালি ভরা ঝরনা কলম তৈরিই আছিল।

নুরুন্নাহার কাগজ-কলম লইয়া লেখতে থাকেন : মেসেজ টু দ্য পিপল অব দ্য বাংলাদেশ অ্যান্ড পিপল অব দ্য ওয়ার্ল্ড। পাক আর্মি সাডেনলি অ্যাটাকড…

ব্যাঙ্গমি বলে, ২৬ তারিখ সকালবেলা আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ভিড়। গোলাগুলির আওয়াজ রাত থাইকাই আসতাছে। জনতা রাস্তা ছাড়তাছে না। সেই ভিড়ের মধ্যে হকার চিল্লাইতাছে, টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম, ঢাকা শহরত এক লাখ লোক মারি ফেলিয়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করি দিয়ে…

ব্যাঙ্গমা বলে, দুপুরে এম এ হান্নান সংগ্রাম পরিষদের লোকজনরে লইয়া গেলেন চট্টগ্রাম রেডিওর রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার মির্জা নাসিরউদ্দীনের বাসায়। তারা মির্জারে কইলেন, চলেন, রেডিও ট্রান্সমিটার অন করতে হইব। মির্জা কয়, মাথা খারাপ। আমি তো রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার। ট্রান্সমিশন অন করতে হইলে রিজিওনাল ডাইরেক্টরের অর্ডার লাগব।

তারে আমরা পামু কই। চলেন।

তিনি বলেন, আমারে বিপদে ফেলবেন না ভাই।

জনতার ভিড় হইয়া গেছে মির্জা সাহেবের বাড়ির সামনে। নেতারা তারে ধমক দিলেন। ওই মিয়া আপনে উঠবেন না আমরা অ্যাকশনে যামু? মির্জার বউ-বাচ্চারা কানতে লাগল। একরকম জোর কইরাই তারে ধইরা তোলা হইল গাড়িতে। নেওয়া হইল রেডিও স্টেশনে। সম্প্রচার যন্ত্র চালু কইরা আবদুল। হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পইড়া শুনাইলেন। রেডিওতে প্রচার হইল। চট্টগ্রাম আর তার আশপাশের এলাকার মানুষজন শুনতে পাইল।

পরের দিন সারা দুনিয়ার কাগজে বাইর হইল, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হইল : শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে সিভিল ওয়ার শুরু হইয়া গেছে।

১৩

২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম স্টেশন রোডের রেস্টহাউসের বাইরে লাঠিধারী কড়া প্রহরা, তিনজন রেডিও কর্মীকে তাঁরা কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। সংগ্রাম পরিষদের অফিস। ভেতরে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী। আগের রাতে তার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর বার্তা। এসেছে, রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে বিলি করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ভেতরে রেস্টহাউসের বারান্দায় গিজগিজ করছে মানুষ, খবর এসেছে, ইপিআর বিদ্রোহ করেছে; বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করছে চারদিকে, দেশের এখানে-ওখানে, বীর চট্টগ্রামবাসী লাঠি, সড়কি, বন্দুক, পিস্তল–যা হাতের কাছে পাচ্ছে, তা-ই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরোনোর পথ রুদ্ধ করে মানবদুর্গ রচনা করে বসে আছে। এই সময়ে তিনজন লোক এসেছেন–একজন বেলাল মোহাম্মদ-লম্বা, হালকা, পাঞ্জাবি পরা, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, মানে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। কবিতা লেখেন, ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন, উদাসীনতা তাঁর ঝাঁকড়া চুলে বসন্ত বাতাসে উড়ছে, পাঞ্জাবির বুকপকেটে কলমের কালির অসাবধান দাগ। তিনি কাজ করেন চট্টগ্রাম বেতারে, স্টাফ রাইটার। চুক্তিভিত্তিক চাকরি যদিও। আছেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ। আছেন সদা তৎপর ভঙ্গি নিয়ে বেতারের নতুন প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক। তার হাওয়াই শার্টের হাতা গোটানো। তিনি যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারেন, এমনকি দেশ স্বাধীন করতে বললে তিনি জিজ্ঞেস করবেন, এখনই করে ফেলব? জাস্ট কোত্থেকে শুরু করব, বলুন। সন্দ্বীপ দুই বছর ছিলেন বেলাল মোহাম্মদের বাসাতেই, ফটিকছড়ির চাকরির ফাঁকে প্রায়ই আসেন চট্টগ্রামে, থাকেন বেলাল মোহাম্মদের বাসায়। একজোড়া ঝোলানো ওড়ানো গোঁফ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার মতো উড়িয়ে দিয়েছেন ঠোঁটের দুই পাশে। বেলাল মোহাম্মদ অসহযোগের দিনগুলোয় নিজের বাসায় তালা দিয়ে উঠেছেন ডাক্তার মোহাম্মদ শফীর বাসা মুশতারী লজে। আগ্রাবাদের সরকারি কলোনির বাসা ফাঁকা, দারাপুত্ৰপরিবার। গ্রামের বাড়িতে কাটাচ্ছে অসহযোগের দিনগুলো। বেগম মুশতারী শফী মহিলাদের মাসিক পত্রিকা বান্ধবী সম্পাদনা করেন, জয় বাংলা বলে স্লোগান। দেন রাস্তায়, এক দফা এক দাবি বাংলার স্বাধীনতা বলে ছড়া লেখেন, আর সব অ্যাকটিভিস্টের জন্য নিজের বাড়ির মেঝেতে তোশক বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করেন, আবার হাঁড়ি ভরে ভাত রান্না করে রাখেন। সন্দ্বীপও সেই গণরুমের বাসিন্দা ও ফ্রি হোটেলের আহারী। ২৬ মার্চ সকালে সেই মেঝেতে বসে বেলাল রেডিওর নব ঘোরাচ্ছিলেন, আর ঢাকা কেন্দ্র থেকে শুনছিলেন উর্দুমিশ্রিত ফরমান, কিন্তু চট্টগ্রাম রেডিও সাড়াশব্দহীন। দরজায় বেল বাজল, কে এসেছে, দেখার জন্য বেলাল পা বাড়াতেই ঘরে ঢুকলেন আবদুল্লাহ ফারুক। বললেন, রেডিওতে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় মিছিল, লোকজন সব লাঠিসোটা হাতে ক্যান্টনমেন্ট পাহারা দিয়ে রাখতে যাচ্ছে; ভাবলাম রেডিওতে না গিয়ে আপনার কাছেই আসি।

বেগম মুশতারী শফী শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে এই ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।

বেলাল মোহাম্মদ বললেন, রেডিও বন্ধ। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

ফারুক বললেন, আপনি যাননি, আমি যাইনি, খুলবে কে?

মুশতারী বললেন, খুললে কিন্তু ভালো হতো। আমরা সাতই মার্চের ভাষণ প্রচার করতে পারতাম। উদ্দীপনামূলক কথিকা পড়ে শোনাতে পারতাম।

সন্দ্বীপ বললেন, ঠিক বেলাল ভাই। চলেন সংগ্রাম পরিষদ অফিসে যাই।

তাই তো বেরিয়ে পড়া সংগ্রাম পরিষদ অফিসের দিকে।

রেস্টহাউসের গেটে পাহারা তো রাখতেই হবে। শত্রুরা তো হামলা করতেই পারে। তাই বলে এই তিনজন জয় বাংলার লোককে ঢুকতে দেবে না, এ-ও কি হয়।

অনেক দেনদরবারের পর শুধু বেলাল মোহাম্মদ ঢুকতে পারলেন রেস্টহাউসের ভেতরে। বারান্দায় লোকে গিজগিজ করছে। একজন একটা সাইক্লোস্টাইল কাগজ থেকে ইংরেজিতে পড়ে শোনালেন বঙ্গবন্ধুর বার্তা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন বেলাল। তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল।

একজন সেটা আবার বাংলা অনুবাদ করে পড়ে শোনাচ্ছেন। তাঁর গলার রগ ফুলে ফুলে উঠছে।

বেলাল এই উত্তেজিত সদা ব্যস্ত নেতা-কর্মীদের কাউকে যে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে নিজের মনের কথাটা পাড়বেন, সে উপায় নেই! প্রত্যেকেই ব্যস্ত। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, রাস্তা দখল রাখতে হবে, আর্মিকে ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখতে হবে, কাজ কি কম!

সামনে পাওয়া গেল অ্যাডভোকেট রফিককে।

রফিক ভাই, বেলাল মোহাম্মদ বললেন।

জি বলেন।

একটা খুব জরুরি কথা আছে।

জি বলেন।

আমাকে কয়েকজন লড়াকু কর্মী দেন। হাতে লাঠিসোটা আর যা যা। আছে, তা-ই নিয়ে তারা চলুক আমার সঙ্গে। আমরা বেতার দখল করব। আগ্রাবাদ বেতার ভবন আর কালুরঘাট ট্রান্সমিটার দখল করে রাখতে হবে। আমরা বেতারে আমাদের প্রোগ্রাম প্রচার করতে পারব। বঙ্গবন্ধুর মেসেজটা তো রেডিওতে প্রচার করা দরকার।

অ্যাডভোকেট রফিক একে ডাকলেন, ওকে ডাকলেন। কেউ কোনো কথা শুনতে চাইছে না। সবাই দেশ স্বাধীন করবে। সবার অনেক কাজ।

বেলাল মোহাম্মদের চোখেমুখে হতাশা। বারান্দায় হঠাৎ করে চৈতালি বাতাস বইল, তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম শুকিয়ে নিয়ে আরামের স্পর্শ দিল, তিনি বারান্দার ভিড় ঠেলে নিচে নামছেন, এই সময় বসন্তের বাতাসের মতোই দমক দিয়ে সামনে দাঁড়ালেন মমতাজউদ্দীন আহমদ। শিক্ষক এবং আন্দোলনরত বুদ্ধিজীবী। দিন দশেক আগে লালদীঘি ময়দানে তিনি নাটক মঞ্চস্থ করেছেন–এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

আরে বেলাল ভাই।

মমতাজ ভাই। শোনেন। একটা কাজের কাজ করার আছে। কাউকে পাচ্ছি না যাকে বলব। হেল্প পাব। চট্টগ্রাম রেডিও বন্ধ আছে। আমরা সেটা। দখল করে আমাদের প্রোগ্রাম চালু করতে পারি।

তাই তো। আমি তো আমাদের বেতারের জন্য প্রোগ্রাম লিখতে পারি। কথিকা পড়তে পারি। টক দিতে পারি। দারুণ আইডিয়া।

কিন্তু একটা সমস্যা আছে। আমরা প্রোগ্রাম করা শুরু করামাত্রই আর্মি অ্যাটাক হতে পারে। এটা আমাদের পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। লাঠি হাতে গোটা কুড়ি কর্মী যদি পাওয়া যেত।

মমতাজউদ্দীন হাসতে লাগলেন। চন্দ্রাহত মানুষের হাসি। তার চোখ এই জগতে নেই, তার দৃষ্টি ওই দূরে মেঘলা আকাশের মেঘের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। তাঁর চোখ গনগনে লাল, বোঝাই যাচ্ছে তিনি সারা রাত ঘুমাননি। তিনি বললেন, লাঠি দিয়ে তো বেতারকেন্দ্র পাহারা দেওয়া যাবে না। অস্ত্র লাগবে। সৈন্য লাগবে! সশস্ত্র সৈনিক!

বেলাল বললেন, কিন্তু আমরা সশস্ত্র সৈনিক কোথায় পাব?

হা হা হা। মমতাজউদ্দীন আবার হাসলেন, ঘটনা ঘটে গেছে। লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন রফিক, বেলাল ভাই, ক্যাপ্টেন রফিক। ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক মুভ করেছেন। পাঞ্জাবিদের সব বন্দী করেছেন। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। আপনি কোনো খবরই রাখেন না। উই হ্যাভ আওয়ার আর্মি নাউ। উইথ আর্মস। রফিক ইজ দ্য ম্যান। এখন ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্য অফিসাররাও বিদ্রোহ করছে। আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। চলুন, বেলাল ভাই, আমরা ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে যাই। রেলওয়ে পাহাড়ে আছেন তিনি।

যাব তো বটেই। কিন্তু যাব কীভাবে? সময় নষ্ট করা যাবে না।

আবারও হাসলেন মমতাজউদ্দীন। হালকা-পাতলা মানুষ, টিপিক্যাল বাঙালি চেহারা, নাকের নিচে চার্লি চাপলিন গোঁফ, চোখ দুটো বুদ্ধির দীপ্তিতে জ্বলজ্বলে। তিনি বললেন, আমার নাম মমতাজউদ্দীন, যেখানে উপায় নেই, সেখানেই গোলাম হোসেনকে দিয়ে আমি উপায় বের করে থাকি। বাইরে একটা জিপ দেখা যাচ্ছে। ওই জিপটা ওই যে সাদা-পাকা সাহেব, ওঁর। সাদা-পাকা সাহেব, কাম হিয়ার প্লিজ। আমাদের রক্ত দিন, আমি আপনাদের স্বাধীনতা দিব। কে বলেছেন? নেতাজি সুভাষ বসু। সাদা-পাকা সাহেব, আপনি এবার আপনার জিপটা দিন, আমি আপনাদেরকে স্বাধীনতার রেডিও দেব। বুঝলেন তো। কুইক। ড্রাইভারকে ডাকুন। বলুন, জিপটা আমাদের কথামতো তেজি ঘোড়ার মতো চলবে।

জিপ জোগাড় হলো। চার আরোহী–মমতাজ, বেলাল, ফারুক, সন্দ্বীপ ছুটে চলেছেন ক্যাপ্টেন রফিকের উদ্দেশে, রেলওয়ে পাহাড়ে।

ক্যাপ্টেন রফিককে পাওয়া গেল। ভীষণ ব্যস্ত তিনি। নিজে তো বিদ্রোহ করেছেনই, সেনাবাহিনীর ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের সঙ্গে সমন্বয় করা, তাদের সঠিক তথ্য দেওয়া, তাদের বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করা আর বালুচ রেজিমেন্টের আক্রমণ থেকে বাঙালি সৈন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করার কঠিন কঠিন সব কাজে তাকে ব্যস্ততার অধিক ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, ক্যাপ্টেন রফিক লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বা আ টেল অব মিলিয়নস বইতে ২৫ মার্চ রাতে তাঁর বিদ্রোহের এবং ওই রাতের চট্টগ্রাম ঘটনার বিবরণ লেইখা রাখছেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, হ লেখা আছে তার বইয়ে। সেই কথায় আমরা পরে যাই। ওইটা আগের রাইতের ঘটনা। অহন আমরা ২৬ মার্চ রেলওয়ে পাহাড়ে রফিকের লগে মমতাজউদ্দীন, বেলাল মোহাম্মদ, ফারুক আর সন্দ্বীপের বাতচিতে আছি।

.

মমতাজউদ্দীন বললেন, ক্যাপ্টেন সাহেব। আসল লোক এসে গেছেন।

ক্যাপ্টেন রফিকের পাতলা ঠোঁট, পাতলা নাক, ছোট করে ছাঁটা চুল মাকড়সার হালকা জালের মতো রেশম কোমল, তাঁর মুখে ক্লান্তি, চোয়ালে দৃঢ়তা, চোখে আশা আর প্রতিজ্ঞার ঝিলিক। তিনি বললেন, আসল লোক মানে?

মমতাজউদ্দীন দিগন্তবিস্তারী হাসি ফুটিয়ে বললেন, রেডিওর লোক। রেডিও সেন্টার চালাবে। জয় বাংলা রেডিও।

ক্যাপ্টেন রফিক বললেন, রাইট স্যার। রেডিও, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করার জন্য আমি আমার সৈন্যদের অলরেডি রাতের বেলাতেই পাঠিয়ে দিয়েছি।

বেলাল মোহাম্মদ বললেন, শুধু আগ্রাবাদ পাহারা দিলে হবে না। কালুরঘাটে ট্রান্সমিটার। সেখানেও পাহারা লাগবে।

রফিক বললেন, ২০ জন জওয়ান থাকবে আগ্রাবাদে, ১৫ জন। কালুরঘাটে। আপনারা যান। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে সব ব্যবস্থা করছি।

মমতাজউদ্দীন বললেন, শাবাশ ক্যাপ্টেন। আপনি আমাদের স্বাধীনতার বীর সৈনিক। আপনার অবদান আমাদের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা থাকবে। বেলাল ভাই, চলুন যাওয়া যাক পরের অভিযানে। ফরোয়ার্ড মার্চ।

বেলাল মোহাম্মদ, মমতাজউদ্দীন, ফারুক, সন্দ্বীপ উঠে বসলেন জিপে। জিপ চলছে। চুল উড়ছে। পাঞ্জাবির প্রান্ত উড়ছে। কিন্তু বেলাল মোহাম্মদ জানেন, আসল কাজটা প্রকৌশলীদের। টেকনিক্যাল কাজ। ইঞ্জিনিয়ারদের সহযোগিতা না পেলে চলবে না।

ইঞ্জিনিয়ারদের কারও বাড়ির ঠিকানা বেলালের জানা নেই। একজন আছেন, মাহবুব হাসান, চুক্তিভিত্তিক কর্মী, কারিগরি কাজ নিজে নিজে শিখে নিয়েছেন, তাঁর কাছে যাওয়া যায়। তার মাধ্যমে অন্য ইঞ্জিনিয়ারদের খোঁজও মিলে যেতে পারে।

গাড়ি গিয়ে মাহবুবের বাড়িতে থামে। রাবেয়া খাতুন লেনে গাড়ি রেখে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই দেখা গেল মাহবুব বা হাতে দরজা খুলছেন, ডান হাতে তার ভাত, আসেন বেলাল ভাই, ভাত খান।

সঙ্গে ছিলেন মমতাজউদ্দীন, তিনি বললেন, খেলে তো ভায়া বেলাল একা খাবে না, মমতাজউদ্দীনও অনাহারী, দুপুরে ভাত খেতে অপছন্দ করে না।

ভাত ঝটপট খেয়ে নিলেন তিনজনই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর গাড়ি যেতে লাগল একেকজন প্রকৌশলীর বাসায়।

দুজন প্রকৌশলী মোসলেম খান আর দেলওয়ার হোসেনকে জিপে তুলে তারা ছুটলেন কালুরঘাটের দিকে। কালুরঘাট ট্রান্সমিটার অন করা হলো। ইঞ্জিনিয়ার দুজনকে রেখে মাহবুব হাসান, মমতাজউদ্দীন আহমদ, বেলাল এবার ছুটলেন আগ্রাবাদের দিকে। পথে মমতাজউদ্দীন নেমে গেলেন–সারা রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে একে তো তিনি ধ্বস্ত, তার মধ্যে তাঁর মাথায় এসেছে একটা স্ক্রিপ্টের প্লট। রেডিও খুললেই তো হবে না। তাতে প্রচারের জন্য ম্যাটেরিয়াল দিতে হবে।

গাড়ি ছুটছে। বাতাসে রোদের গন্ধ। বাতাসে লাশের গন্ধ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হাজারের বেশি বাঙালি সৈন্য এবং তাদের পরিবার পরিজনকে হত্যা করেছে ২০ বালুচ বেঙ্গলের সৈন্যরা।

আগ্রাবাদে পথে পথে ব্যারিকেড। পাকিস্তানি অস্ত্রসমেত জাহাজ এসেছে বন্দরে। সোয়াত। খবর পেয়ে বন্দর অভিমুখী সড়কে বাঙালিরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। অস্ত্র খালাস করতে দেবে না তারা। পিচের ড্রাম এনে রাখা হয়েছে, ইট, কাঠ, পাথর, পানির ট্যাংক, গাছের গুঁড়ি–ব্যারিকেডের স্তূপগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। পিচের ড্রামে আগুন দেওয়া হয়েছে, পিচপোড়া গন্ধ, ধোয়া, আগুনে রাস্তা দিয়ে চলাও মুশকিল।

বাদামতলী ব্যারিকেডে গাড়ি রেখে দৌড়ে আগ্রাবাদ বেতারকেন্দ্রে গেলেন বেলাল আর মাহবুব। বেতার ভবনের গেটে কোনো প্রহরা নেই…পুরো এলাকাটা পোড়োবাড়ির মতো নির্জন। তারা সেই ভুতুড়ে বাতি না জ্বালানো ভবনে ঢুকে খুঁজে পেতে সুইচ অন করে বাতি জ্বালালেন। প্রধান নিয়ন্ত্রণকক্ষের দরজা খুললেন।

ফোন বেজে উঠল। কালুরঘাট থেকে ফোন। দুই ইঞ্জিনিয়ার চলে যেতে চান। আঞ্চলিক পরিচালক, আঞ্চলিক প্রকৌশলী অর্ডার না দিলে তারা ট্রান্সমিটার অন করতে পারেন না।

বেলাল মোহাম্মদ বললেন, ওয়েট। আপনারা দশ মিনিটের মধ্যে অর্ডার পেয়ে যাবেন ওনাদের কাছ থেকে।

ভাই মৌখিক অনুমতিতে হবে না। লিখিত অর্ডার লাগবে।

আচ্ছা তা-ই আনছি।

বললেন বটে, কিন্তু আঞ্চলিক পরিচালকই-বা কোথায় আর ইঞ্জিনিয়ারই বা কোথায়। ফোন করলেন আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা নাসিরউদ্দীনকে।

হ্যালো আমি বেলাল মোহাম্মদ বলছি। আপনার কাছে আসছি। আপনি লিখিত অর্ডার দেবেন। বেতার চালু করতে হবে।

ভাই আমাকে কেন বিপদে ফেলছেন। দুপুরে এম এ হান্নান সাহেব জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ট্রান্সমিটার চালু করেছেন। শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে শোনালেন। এরপর তিনি তো চলে গেছেন। আমাদের চাকরি কি আর থাকবে? চাকরি যেমন-তেমন, বালবাচ্চাসহ নিজেরা বাঁচব তো!

কী বলেন। দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের প্রমোশন হবে।

ভাই, আর্মি এসে তো আমাদের স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলবে।

তা হবে না। কমান্ডার রফিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা বেতার ভবন পাহারা দেওয়ার জন্য বাঙালি সৈন্য পাচ্ছি।

ভাই আমাকে ক্ষমা করেন। আমার বউ-বাচ্চা আছে। আমি তো অর্ডার দেওয়ার লোক না। অর্ডার দিতে পারেন আঞ্চলিক পরিচালক। তাঁকে বলুন। তিনি বললেই হবে। আমি বললে হবে না।

ওনাকে যে ফোন করব, ওনার নতুন কোয়ার্টারে এখনো ফোন লাগেনি।

উনি এআরডি ওয়ানের বাসায়। আমার সঙ্গে এখনই ফোনে কথা। হয়েছে। আপনি ফোন করুন। পাবেন।

এর মধ্যে সন্দ্বীপ ও ফারুকও এসে হাজির কন্ট্রোল রুমে।

বেলাল মোহাম্মদ সাদা রঙের ফোনটার পেটের নম্বর ঘোরাতে লাগলেন। এআরডি ওয়ান কাহার সাহেব। পরিচালক নাজমুল আলম সাহেব। দুজনেই ওই বাড়িতে আছেন। ফোন ধরলেন কাহার।

রিসিভার এ পাশে দেওয়া হয়েছে সন্দ্বীপের হাতে।

কাহার জিজ্ঞেস করলেন, কে আছে ওখানে?

সন্দ্বীপ বললেন, বেলাল সাহেব আছেন।

বেলাল সাহেবকে দিন।

হ্যালো-বেলাল মোহাম্মদ বললেন।

শোনেন, বেলাল সাহেব-কাহার সাহেব বললেন-আপনারা সম্প্রচার করতে চান করুন। শুধু একটা বুদ্ধি দিই। আগ্রাবাদ থেকে করতে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ, এখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট কাছে। নৌবাহিনীর বেস কাছে। আর্মি অ্যাটাক করলে মারা পড়বেন। আপনারা কালুরঘাট যান। কালুরঘাটে স্টুডিও আছে একটা। কোনো অসুবিধা হবে না।

আপনি কালুরঘাটের ইঞ্জিনিয়ারদের ফোন করে এখনই বলে দেন যে আমরা যাচ্ছি। আমাদের যেন সহযোগিতা করে।

আচ্ছা। বলে দিচ্ছি।

যাক। অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। বেলাল মোহাম্মদ, ফারুক, সন্দ্বীপ উঠলেন।

দীর্ঘ করিডর। তাঁদের পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে নিজেদেরই কানে। তাঁরা চমকে চমকে উঠছেন।

কিন্তু আরও চমকে উঠলেন নারীকণ্ঠ শুনে। তাকিয়ে দেখতে পেলেন। অনুষ্ঠান ঘোষিকা হোসনে আরাকে। তার সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক। হোসনে আরা বললেন, উনি আমার চাচা। ওনার নাম ডা. আনোয়ার আলী। আওয়ামী লীগের কর্মী।

আনোয়ার আলী বললেন, আপনারা বেতার চালু করবেন। প্রচার করবেন কী? এই নিন।

তিনি এগিয়ে দিলে একটা সাইক্লোস্টাইল করা কাগজ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বর্বর পাকিস্তানি আর্মি অকস্মাৎ পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেছে…স্বাক্ষর শেখ মুজিবুর রহমান…

.

কাগজটা পেয়ে বেলাল মোহাম্মদ পড়তে লাগলেন। তাঁর শরীরে আগুনের পরশমণির ছোঁয়া লাগল যেন। থ্যাংক ইউ ডাক্তার সাহেব। এটাই হবে আমাদের প্রথম ঘোষণা।

মাহবুব হাসান বললেন, চলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসায় যাই। লিখিত অর্ডারটা নিয়ে আসি।

তাঁরা গেলেন মির্জা নাসিরের কাছে। তিনি ফোন করে অর্ডার দিলেন কালুরঘাটকে। হ্যালো, ট্রান্সমিটার চালু করেন…বেলাল মোহাম্মদ সাহেবরা যাচ্ছেন…

ফোন রেখে তিনি বললেন, আপনারা ইপিআর জওয়ান নিয়ে যান। এমন ভাব করবেন যেন ভবিষ্যতে ওরা বলতে পারে বন্দুকের মুখে ওদের কাজটা করতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে কেউ কি বলতে পারে বলেন…।

.

ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এসে দেখেন জিপ নেই। এখন উপায়?

এগিয়ে এলেন ডাক্তার আলী। বললেন, আমার সঙ্গে পিকআপ আছে। সেটা নিয়ে যাই চলেন।

ডাক্তার আনোয়ার আলী গাড়িটা পেয়েছেন ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলামের কাছ থেকে। গাড়ির নম্বর চট্টগ্রাম ট ৯৬১৫। বিদ্রোহী ইপিআর সদস্য আর সেনাদের জন্য খাবার রসদ সরবরাহ আর আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সকাল থেকেই চট্টগ্রামের আপামর জনগণ তৎপর হয়ে উঠেছে। সকালবেলা জনতার ভিড়ের মধ্যেই হকার টেলিগ্রাম বিলি করছিল, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, বাংলাদেশ স্বাধীন…তিনি গাড়ি থামিয়ে সেই টেলিগ্রামের একটা সঙ্গে নিয়েছিলেন।

গাড়ি নিয়ে তারা ছুটছেন কালুরঘাটের দিকে। পথে গাড়ি আটকালেন একজন। তার মাথার চুল এলোমেলো। পাঞ্জাবি ময়লা। বয়স্ক এই মানুষটাকে চট্টগ্রামের সবাই চেনে। কবি আবদুস সালাম। তিনি বলতে লাগলেন, নাতি, আমি একটা কথিকা লিখছি। এইটা প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারবা?

পারব। আপনি ওঠেন গাড়িতে।

.

দুই ইঞ্জিনিয়ার মোসলেম খান আর দেলোয়ার একটা রিকশায়, তারা ট্রান্সমিশন অফিস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ব্রেক ব্রেক। টায়ারে শব্দ তুলে জিপ থামল। বেলাল। মোহাম্মদ লাফ দিয়ে নেমে রিকশার সামনে দাঁড়ালেন। কই যান?

ভাই আমাদের মাফ করে দেন। আমরা পারব না।

পারবেন না মানে। আপনাদের না আরই ফোন করলেন?

তিনি আবার ফোন করেছেন। বলেছেন, যদি বেতার চালু করতে চাও, নিজ দায়িত্বে করো। আমি দায়িত্ব নিতে পারব না।

আপনাদের তো যাওয়া চলবে না। আপনাদের আমরা জোর করে আটকে রাখব।

ডা. আলী বললেন, আপনারা দাঁড়ান। আমি ব্যবস্থা করছি।

তিনি গাড়ি ঘোরালেন। গাড়ি ছোটালেন রেলওয়ে পাহাড়ের দিকে। ক্যাপ্টেন রফিককে লাগবে। এখনই কয়েকজন জওয়ান নিয়ে আসতে হবে। তিনি নিজের গাড়িতে করে কয়েকজন ইপিআর সদস্যকে নিয়ে এলেন। এরপর দুই ইঞ্জিনিয়ার গেলেন ট্রান্সমিটার ভবনে।

ট্রান্সমিটার ভবনের অফিসকক্ষে বসলেন বেলাল মোহাম্মদরা। কাগজ কলম নিলেন। বেলাল মোহাম্মদ লিখলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

সন্দ্বীপ বললেন, বেলাল ভাই, বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র দেন। বিপ্লবটা থাকুক।

আচ্ছা। তুমি যখন বলছ।

এর মধ্যে সুলতানুল ইসলাম এসে গেছেন। তিনি নিয়মিত ঘোষক। দুপুরে রেডিওতে এম এ হান্নান সাহেবের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর তার বন্ধুরা বলতে লাগল, তুমি বসে আছ কেন, যাও রেডিওতে। তিনি একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে এসেছেন কালুরঘাটে। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করতে চান।

সন্দ্বীপ বেলালকে বললেন, বেলাল ভাই, সুলতানকে দিয়ে তো আপনি বিপ্লবী কথাটা বলাতে পারবেন না।

কেন?

ও তো কনজারভেটিভ। বিপ্লব জিনিসটা ও মানতে পারবে না।

আরে আমি যা লিখব তা-ই পড়বে।

না, আগে আপনি বা আমি রেডিওর নাম ঘোষণা করে দিই। তারপর সুলতানকে দেন।

তাহলে তুমি আরম্ভ করো।

এর মধ্যে ফোন এসে গেল। ফোন করেছেন চট্টগ্রাম রেডিওর নিউজ এডিটর। তার নাম সুলতান আলী। তিনি ফিসফিস করে বললেন, এই আপনারা দেরি করছেন কেন। রাত পৌনে আটটায় বিবিসি। সবাই বিবিসি। শুনবে। এখনই শুরু করে দেন। এরই মধ্যে সাড়ে সাতটা পার হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না।

১৯৭১ সাল। ২৬ মার্চ। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল, পাঠ করতে শুরু করলেন, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।

ডা. আলীর সঙ্গে তার ভাতিজি হোসনে আরা। তিনি নিয়মিত ঘোষক। বেলাল বললেন, হোসনে আরা, আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনাকে কথা বলতে দেওয়া যাবে না। কারণ, এটা তো গোপন বিপ্লবী বেতার। আপনার কণ্ঠ শুনলে লোকে ধরে ফেলতে পারবে আমরা কোথায় আছি। আপনি কাইন্ডলি কিছু মনে করবেন না।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কাগজটা বারবার করে পড়া হলো। কবি আবদুস সালামের কথিকাটা কবি নিজে পড়লেন। এতে কোরআন শরিফ থেকে উদ্ধৃতি আছে, মুক্তির যুদ্ধ যে ইসলাম ধর্মের আলোয় ন্যায়সংগত সে সম্পর্কে যুক্তি আছে। তিনি পড়ছিলেন :

নাহমাদুহু ওয়ানু সাল্লিহি আলা রাসুলিহিল করিম।…আসোলামু আলায়কুম। প্রিয় বাংলার বীর জননীর বিপ্লবী সন্তানেরা। স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুত্বলোভীদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে, আমাদের ভবিষ্যৎ জাতির মুক্তিযুদ্ধে মরণকে বরণ করে যে জানমাল আমরা কোরবানি দিচ্ছি, কোরআনে করিমের ভাষায় তারা মৃত নহে, অমর। দেশবাসী ভাইবোনেরা আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রাম করছি।…নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব। জয় বাংলা।

আবদুল্লাহ ফারুক, সুলতানুল ইসলামের কণ্ঠেও বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত জরুরি ঘোষণা পঠিত হলো বারবার।

একটু পর স্টুডিওর গেটে নক। ইশারায় ডাক। ডাকছেন ডাক্তার আবু জাফর। বেলাল বাইরে গেলেন। দেখলেন, আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, আমি বঙ্গবন্ধুর মেসেজটা পড়ব।

আসুন ভেতরে আসুন। আপনি তো দুপুরে পড়েছেন। এখন আবার পড়বেন। তবে একটা শর্ত। আপনার নাম বলা যাবে না।

কেন?

এটা গোপন বেতার। অবস্থান জানাতে চাই না। পাকিস্তানিরা এয়ার অ্যাটাক করতে পারে। আপনি পড়েন। চট্টগ্রামের সবাই আপনার গলা চেনে।

হান্নান বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তিনি আবারও বঙ্গবন্ধুর নামে আসা। সাইক্লোস্টাইল ঘোষণাটা পাঠ করলেন।

প্রায় আধঘণ্টা অধিবেশন চলল।

তারও আগে ডা. আলী ভাতিজিকে নিয়ে গাড়িতে চলে গেছেন।

আগামীকাল সকাল ৭টায় আবার অধিবেশন বসবে। ঘোষণা দিয়ে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে বাইরে এলেন সন্দ্বীপ, সুলতান, বেলাল। এসে দেখেন, কোথাও কেউ নেই।

ইঞ্জিনিয়াররা নেই। ইপিআর জওয়ানেরা নেই।

শুধু হান্নান সাহেবের জিপ স্টার্ট দিচ্ছে।

বেলাল মোহাম্মদেরা গেলেন জিপের কাছে। আমরা শহরে যাব। আমাদের নিয়ে যান।

জিপে তো তিনজনের জায়গা হবে না। হান্নান সাহেবের জিপ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

অন্ধকার।

জোনাকি জ্বলছে।

তিনজন হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতেই তাঁরা ফিরলেন মুশতারী লজে।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, বেলাল মোহাম্মদ ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের দৈনিক স্বাধীন পত্রিকায় একটা কবিতা লিখছিলেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, হ লিখছিলেন তো। কবিতাটা কও তো শুনি। ব্যাঙ্গমা কবিতাটা মুখস্থ বলে :

এই দিনটি আমার দিন
হান্নানের দিন
সালামের দিন
কাসেমের দিন, ফারুকের দিন–
এই দিনটিতে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে
একটি ছিন্নপত্রে আমি
লিখেছিলাম একটি নাম :
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র–
মাইকের সামনে কাসেমকে সেটা পড়তে দিয়েছিলাম।

হান্নান ঘোষণা করেছিলেন।
সালাম ভাষণ দিয়েছিলেন।

১৯৭১-এর এই দিনটির পর পটিয়া থেকে
আমি ডেকে এনেছিলাম ট্রান্সমিটারে
মেজর জিয়াকে–তারপর এসেছিল
একে একে আমাদের হাবিবুদ্দীন,
আমিন, রাশেদ, শারফুজ্জামান,
শাকের, মুস্তফা, রেজাউল।

কিন্তু আল্লার কসম, সেদিন
মি জানতাম না, এ দিনটি
হবে একটা দেশের স্বাধীনতা দিবস (১৮.৩.৭৩)।

ব্যাঙ্গমা বলে, বেলাল মোহাম্মদ এই কবিতা প্রকাশ করছেন ১৯৭৩। সালে। তখন বঙ্গবন্ধুও বাঁইচা, জিয়াউর রহমানও বাইচা।

১৪

সারা রাত নির্ঘম কাটিয়ে ভোরের দিকে একটুখানি তন্দ্রামতো এল ক্যাপ্টেন রফিকের। চট্টগ্রাম সিআরবি হিলে এসে উঠেছেন তারা।

লাল রঙের রেল ভবন ব্রিটিশ স্থাপত্যের সৌন্দর্য আর ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা আবাসিক ভবনের নিচতলায় তাঁর অস্থায়ী সদর দপ্তর। সেখানেই একটা চেয়ারে বসে আছেন তিনি। শুয়ে ঘুমানোর প্রশ্নই আসে না।

এই ভবনটিতে রেলের কর্মকর্তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেন। রেলওয়ে হিলে ক্যাপ্টেন রফিক তার জওয়ানদের নিয়ে যখন আসেন, ২৫ মার্চ বেশি রাতে, তখন এই পরিবারগুলো–নারী-পুরুষ-শিশুরা–তাঁদের হাততালি দিয়ে শুধু অভিনন্দন জানাননি, তাদের খাবার দিয়ে, পানি দিয়ে সাহায্য করেছেন। এমনকি ট্রেঞ্চ খুঁড়তে নিজেরা কোদাল ধরেছেন। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিজেরা নামিয়ে দিয়েছেন। নতুন টেলিফোন লাইন লাগিয়ে দিয়েছেন রেলের কর্মচারীরা। খাবার তৈরি করতে হাত লাগিয়েছেন।

সৈনিকেরা ট্রেঞ্চে পজিশন নিয়ে আছে। সম্ভাব্য আক্রমণের যেন জবাব দেওয়া যায়। ক্যাপ্টেন রফিক ঘুরে ঘুরে দেখেছেন ট্রেঞ্চের পজিশন। ৩ ইঞ্চি মর্টার বসানো হয়েছে।

রফিক আশ্চর্য হয়ে একটা কথা ভাবছেন। পাকিস্তানি আর্মি আক্রমণ করলে যাতে অসামরিক লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য তিনি সবাইকে বলেছেন, এই এলাকা ছেড়ে তারা যেন নিরাপদ জায়গায় চলে যান। নারী শিশুরা অনেকেই রাতে আবাসিক এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। পুরুষেরা, তরুণেরা, এমনকি কিশোরেরা যায়নি। তারা বলেছে, আমরা থাকব। আপনাদের পাশে থাকব। সাহায্য করব। যুদ্ধ করব। রফিক আশ্বস্ত বোধ করেছেন। এই দেশ স্বাধীন হবেই। এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হবই।

দেশের মানুষ সবাই একদেহ একমন হয়ে উঠেছে। এই জাতিকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটা মনে পড়ে রফিকের। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।

.

একটা গাড়ি ওপরে উঠছে। সব গাড়ির ওপরে ওঠার কথা নয়। কে এল?

২৬ মার্চ সকালবেলা রেলওয়ে হিলে একটা চেয়ারে বসে তন্দ্রাজড়িত চোখে রফিক গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গাড়ি থেকে নামছেন ডা. জাফর।

রফিক মার্চ মাসের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। বাঙালি মিলিটারি অফিসারদের সঙ্গেও কথা বলছেন। চট্টগ্রামে আছে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সেখানে বাঙালি সৈন্য বেশি। পুলিশ ইপিআর আর্মি একসঙ্গে অপারেশন শুরু করলে পুরো চট্টগ্রাম এলাকাই বাঙালিরা মুক্ত রাখতে পারবে, এই ছিল রফিকের মত এবং পরিকল্পনা। সেটা নিয়ে তিনি অনেকবারই কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে, মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে, লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীর সঙ্গে। শেষের দুজন তার কথার সঙ্গে একমত হননি। তাদের মত ছিল, আর্মির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা যাবে না, আর বড় ধরনের গণহত্যায় পাকিস্তান আর্মি যাবে না।

রফিকের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের অনেক নেতারই যোগাযোগ। সবচেয়ে বেশি খাতির ডা. জাফরের সঙ্গে। চোখের ডাক্তার এ কে জাফর। আওয়ামী। লীগের নেতা। ছয় দফার নামে পাগল ছিলেন। এখন উন্মত্ত এক দফা নিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। তবে তিনি ঠান্ডা মাথার লোক। ক্যাপ্টেন রফিকের চোখ দেখানোর দরকার পড়ত। তাই তিনি যেতেন ডা. জাফরের কাছে। তার চেম্বারের দেয়ালে চোখের রেটিনার ছবির পাশে বঙ্গবন্ধুর ক্যালেন্ডার। হাত উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু। পাশে লেখা ৬ দফা।

চোখ পরীক্ষা করতে করতে জাফর বলতেন, কী মনে করেন, ইয়াহিয়া খান কি ক্ষমতা দেবে?

রফিক আস্তে আস্তে নিজের হৃদয়টাকে উন্মোচিত করতে শুরু করেন ডা. জাফরের সামনে। চোখের মধ্যে টর্চ ধরে ডা. জাফর বলতেন, ওপরের দিকে তাকান? কী? জয় বাংলা দেখতে পান?

চোখ দেখে কি মন পড়ে ফেলা যায় নাকি।

ক্যাপ্টেন রফিক বলতেন, ডাক্তার সাহেব, আমার পরনে উর্দি থাকে। কিন্তু মনটা থাকে কাঁটাতারের বাইরে।

আচ্ছা বাম চোখটা একটু মেলুন। চোখে এক ফোঁটা ওষুধ দিতে দিতে ডা. জাফর বলতেন, সেটা কী রকম?

আমি তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে পড়তাম। মোতাহার হোসেন সাহেব আমার টিচার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন। থেকে শুরু করে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে আমি যুক্ত ছিলাম।

আপনার চোখে সেসব লেখা আছে। আমি পড়ে ফেলছি। ডাক্তার জাফর প্রসন্ন একটা হাসি দিলেন। রফিকের চোখ থেকে জল ঝরছে তখন।

চোখ কিন্তু মনের কথা বলে। আমি আপনার মন পড়ে ফেলছি, রফিক সাহেব।

তাহলে সর্বনাশ। আমি যে যশোের থাকার সময় ১৯৬৯-এ বিদ্রোহ করার চেষ্টা করছিলাম, সেটা আবার আপনি পড়ে ফেলছেন না তো! যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমি তখন রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট।

সেটা না করে ভালো করেছেন। বঙ্গবন্ধু ইলেকশনটা করেছেনই জনগণের ম্যান্ডেট পৃথিবীবাসীকে দেখানোর জন্য। তিনি জানতেন একবার নির্বাচন হলে জনগণ কী চায় সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া সামরিক বিদ্রোহ দিয়ে তো পৃথিবীর কোনো দেশ স্বাধীন হতে পারেনি। বায়াফ্রার উদাহরণ তো আমাদের সামনে আছেই।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু আলোচনা করে কোনো ফল পাবেন বলে মনে হয় না।

সেটা বঙ্গবন্ধু জানেন বলেই মনে হয়।

.

ডা. জাফর গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তার দুই হাতে সসপ্যান। সঙ্গে আরও আছেন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান কায়সার। আরও দুজন নেতাকে নামতে দেখা গেল। সবাই হাতে করে গামলা-সসপ্যান আনছেন। রফিক উঠলেন। সালাম জানালেন।

ডা. জাফর বললেন, আপনাদের জন্য সকালের নাশতা এনেছি।

ফ্লাস্কে করে তাঁরা চা-ও এনেছেন। ক্যাপ্টেন রফিক তাঁর তদারককারীকে ডেকে বললেন, জওয়ানদের মধ্যে নাশতা ডিস্ট্রিবিউট করে দাও।

ডা. এ কে জাফর, আতাউর রহমান কায়সারের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বসলেন ক্যাপ্টেন রফিক।

সকালের আলো ফুটছে। যদিও আকাশটা মেঘলা মেঘলা। পাহাড়ের ওপরে গাছগাছড়ায় ঢাকা এই জায়গায় পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ডা. জাফর আর আতাউর রহমান কায়সারের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রফিকের যোগাযোগটা তো আজকের নয়। সেটা তো শুধু রফিকের চোখ দেখানোর জন্য নয়।

.

৩ মার্চ চট্টগ্রামে মিছিল বেরিয়েছে। সেই মিছিল যেন ছিল উত্তাল বাঁধভাঙা নদী। সমস্ত রাজপথ প্রকম্পিত ছিল স্লোগানে স্লোগানে : এক দফা এক দাবি বাংলার স্বাধীনতা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ওয়্যারলেস কলোনিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাস। সেখান থেকে গুলি হলো। রক্তে ভেসে গেল মিছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে গেল।

আশ্চর্য যে সেখানে ডিউটি দিচ্ছে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা।

ক্যাপ্টেন রফিক গেলেন ঘটনাস্থলে। দেখা পেলেন পুলিশ সুপার শামসুল হক সাহেবের।

রফিক বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আর্মি কেন? এদের কে ডেকেছে?

পুলিশ সুপার অসহায় কণ্ঠে বললেন, কেউ না।

এইখানে অবাঙালি কলোনিতে যে অনেক বালুচ সৈন্য সিভিল পোশাকে আছে, আপনি আশা করি জানেন। রফিক বললেন।

জানি।

কোনো বেসামরিক লোকের কাছে এখন রাইফেল থাকার কথা নয়, তা-ও আপনি জানেন।

জানি।

বিনা উসকানিতে মিছিলে গুলি করেছে বালুচ সৈন্যরা। বুঝতে পারছেন।

পারছি। বহু মানুষ মারা গেছে।

যারা মারা গেছে, তারা সবাই বাঙালি?

হ্যাঁ। যারা মারা গেছে, তারা সবাই বাঙালি।

আমরা কি কাউকে অ্যারেস্ট করেছি। ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকের ভ্র কুঁচকে গেছে। তিনি বুকের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভব করছেন।

না। আমরা কাউকে গ্রেপ্তার করিনি। বালুচ সৈন্যরা একশ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে। আটক সবাই বাঙালি।

সামনে দিয়ে একজন বালুচ মেজর হেঁটে যাচ্ছেন। একবার তিনি তাকালেন রফিক আর এসপি সাহেবের দিকে। তাঁর চোখেমুখে জাতিবিদ্বেষ। ঘৃণার আগুন তার মুখটাকে বিকৃত করে রেখেছে।

রফিকের মনের মধ্যে ঝড় বইতে লাগল। কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে। কী করা যায়? ডা. জাফর বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া সামরিক বিদ্রোহ দিয়ে হবে না। কথা তিনিও মানেন বটে। তবে এ কথার সঙ্গে তিনি এটাও যুক্ত করতে চান, তিনি পাকিস্তানি মিলিটারিদের মনোভাবটা জানেন। এদের মতো নিষ্ঠুর-নৃশংস গোষ্ঠী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই। একটা মার্শাল সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াইটা চলছে। এই লড়াইয়ে জিততে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামরিক পদক্ষেপও লাগবে। ঠিক সময়ে সঠিকতম পদক্ষেপ। রফিকের দুই কান দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। তিনি ফিরে এলেন তার সারসন রোডের বাসায়। ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন। এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কল করতে হয়। এক্সচেঞ্জকে জানালেন ডা. জাফরের বাসায় ফোনটা দিতে।

হ্যালো…ডা. জাফর আছেন…

জি আছেন।

আমি রফিক। ওনাকে একটু ফোনটা দেবেন?

জি।

জাফর ভাই, ভালো মাছ একটা রান্না হয়েছে। আপনি কি একটু সারসন রোডের বাসায় আসবেন। আমার বাবুর্চি আপনার প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসে।

কী মাছ?

বড় মাছ জাফর ভাই। অনেক বড় মাছ।

ডা. এ কে জাফর এই কোড ভাষাটা বুঝতে পারলেন। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খুবই জটিল। আলোচনা করতে হবে ব্যাপারটা।

তিনি বললেন, ওকে। আমি আসছি। আপনি তরকারি বাড়তে বলেন। মাছ ঠান্ডা খাওয়া যাবে। তবে ভাতটা গরম চাই।

.

ডা. জাফর এলেন ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায়। ৩ মার্চ ১৯৭১ রাতের বেলা।

তাঁরা দুজন পাশাপাশি বেতের সোফায় বসলেন।

দুজনে গভীরভাবে শ্বাস নিচ্ছেন। তারা জানেন, যেসব কথা হবে, সেসব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিপজ্জনক। বিপদ শুধু নিজেদের নয়, দেশের মানুষের। যা করতে হবে, বিপদ মাথায় নিয়েই করতে হবে বটে, তবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করতে হবে, যাতে লক্ষ্য হাসিল হয়।

জাফর ভাই। বালুচ সৈন্যদের দিয়ে আজকে এতগুলো মানুষ মারল। আমার কাছে খবর আছে। ২২ বালুচ রেজিমেন্টের একটা রেজিমেন্ট ঢাকায় আনা হয়েছে। ওরা তো সৈন্য আনছে। অস্ত্র আনছে। আমাদের একটা কিছু করা উচিত।

ডা. জাফর ঝিম মেরে গেলেন। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। রফিকের মুখের দিকে। যেন রফিকের মুখের মধ্যে আছে রুটম্যাপ, সেই রুটম্যাপ পাঠ করে এগোতে হবে সামনের দিকে…আজকে ওয়্যারলেস কলোনিতে যা ঘটল, সেটা আমাদের আগের ভাবনাকেই রিকনফার্ম করে। রফিক সাহেব, আমরা আর পাঞ্জাবিদের সঙ্গে থাকতে পারব না। আমাদের আলাদা হতে হবে।

ইয়েস জাফর ভাই। আমাদের স্বাধীন হতে হবে।

ঢাকায় স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের পতাকা বানানো হয়েছে। আমরা স্বাধীনতার দিকেই এগোচ্ছি।

আসেন জাফর ভাই, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। আমি জানি না ডিফেন্সে আর যারা বাঙালি সৈন্য অফিসার আছেন, তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন কি না। কিন্তু আমার আন্ডারে আছে দেড় হাজার ইপিআর। তাদের দিয়ে আমি চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম এক মাস মুক্ত করে রাখতে পারব। এই এক মাসের মধ্যে আপনার দলকে বলেন বন্ধুরাষ্ট্রগুলো থেকে আমাদের জন্য সাপোর্ট আনানোর ব্যাকআপ রাখতে।

ওয়েল। আমি আপনার পয়েন্টটা বুঝতে পারছি। অনেক সেনসিটিভ এবং ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট ইস্যু। আমি একটু এম আর সিদ্দিকী ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি।

আপনি একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করে দেন।

ঠিক আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

৫ মার্চ সন্ধ্যা। চোখ দেখানোর কথা বলে রফিক গেলেন ডাক্তার জাফরের চেম্বারে। সেখানে গাড়ি রেখে বেবিট্যাক্সি নিয়ে তারা গেলেন এম আর সিদ্দিকীর বাসায়। আওয়ামী লীগ সভাপতির বাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্টার। পিতলের তৈরি নৌকা। আর বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা বড় পোস্টার। গেট ঠেলে যখন তারা দুজন ঢুকছিলেন বাড়ির ভেতরে, রাতের বেলা কোকিল ডেকে উঠেছিল। বারুদে তাতানো শহরেও কোকিল ডাকে, বসন্ত বাতাসের একটা পশলা গায়ে মেখে রফিক ভেবেছিলেন।

লিডার। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসছে। ওরা আমাদের আক্রমণ করবে। যেভাবে মানুষ মারছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করা ছাড়া উপায় নেই। আর তা করতে হলে আমাদের সামরিক প্ল্যান লাগবে। রফিক বললেন।

আপনার কথা ঠিক। স্বাধীনতা ছাড়া উপায় নেই। দেখা যাক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ কী বলেন। আর্মির মনের ইচ্ছাটা কী, সেটাও বোঝা দরকার। এম আর সিদ্দিকী বললেন ধীরে ধীরে।

আচ্ছা। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। আপনি আপনার লিডারকে বলেন, আমরা প্রস্তুত। অন্তত আমি রফিক আর আমার ১৫০০ ইপিআর জওয়ান রেডি। বললেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।

আচ্ছা। আমি আপনাকে অবশ্যই জানাব।

রফিক ঘটনাপঞ্জি অনুসরণ করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে তিনি টুকে নিলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশটুকু, যদি আমাদের খতম করবার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমার এ দেশের মানুষের অধিকার চাই, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে, আর যদি একটা গুলি চলে, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ৮ মার্চ রেডিওর সামনে বসে রফিক কথাগুলো লিখে নিলেন ঠিকঠাক।

বাতাস উষ্ণ। বাতাস গরম। বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ। প্রতিটা গাছের পাতা যেন ফিসফিস করে বলছে : স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।

রফিক ১৫ মার্চের দৈনিক পাকিস্তান-এর শিরোনাম পড়লেন : শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, বাঙালিদের স্বাধীনতার উদ্দীপনা কেউ দমাতে পারবে না। তার মনের মধ্যে সেই কথাটা যেন বারবার করে বেজে উঠল, কেউ দমাতে পারবে না, কেউ দমাতে পারবে না।

.

১৭ মার্চ সন্ধ্যা। গাড়ি ছুটে চলেছে চট্টগ্রামের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। হেডলাইটের আলো দুপাশের গাছের ওপরে পড়ে পড়ে সরে সরে যাচ্ছে। রাতের আঁকাবাকা রাস্তার সমস্যা হলো, হেডলাইটের আলো রাস্তায় পড়ে না, পড়ে আশপাশে। রফিকের মনে হলো, তাদের পথটা এই রকমই। পথ আছে। তাতে আলো পড়ছে না। আলো পড়ছে রেইনট্রি সেগুন শালগাছে। কিন্তু পথ আছে। সামনে এগিয়ে যাওয়াই হলো আসল কথা। গাড়িতে আরও আছেন ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সার। আরও একটা গাড়ি আছে পেছনে পেছনে। তাতে আছেন ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন হারুন, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মবিন। ছোট্ট ভক্সওয়াগনটি হারুনের, এই গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের নিয়ে পেছন পেছনে একটা অলৌকিক ব্যাঙের মতো এগিয়ে চলেছে।

তাঁরা গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। লাইব্রেরিয়ান আলমের বাসায়।

পশ্চিমারা তো শক্তি বৃদ্ধি করছে।

হ্যাঁ। সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

আসলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান তারা চায় না। তারা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রাইট।

তারা পূর্ণশক্তি সমবেত করার আগেই আমাদেরই উচিত আক্রমণ করা।

তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।

রফিক বললেন, আমার ১৫০০ ইপিআর আছে। আমি আক্রমণ চালাব। আমি আপনাদের সিগন্যাল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনারাও আক্রমণ চালাবেন। আর এসে আমার সঙ্গে জয়েন করবেন। তাহলে ওরা আর আমাদের সঙ্গে অন্তত চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে পেরে উঠবে না।

ঠিক আছে।

সমন্বয় করবেন ডাক্তার জাফর। তাঁর কাছে চোখ দেখাতে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না।

ঠিক আছে। রাতের অন্ধকারে ডাক্তার সাহেবের গাড়িতে করে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন রফিক। কিন্তু ঘুম আসে না। বিদ্রোহ করবেন, দেশ স্বাধীন করবেন, এই চিন্তা যার মাথায়, তার ঘুম আসবে কী করে।

পরের দিন গেলেন মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীও আছেন সেখানে।

জিয়াউর রহমান ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে বড় অফিসার। তাঁর কমান্ডে আছে ৩০০ জন বাঙালি সৈন্য। এম আর চৌধুরী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সবচেয়ে বড় বাঙালি অফিসার। তার ওখানে আছে ৩ হাজার বাঙালি সৈন্য। অন্য দিকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টে আছে আনুমানিক ৩০০ বালুচ সেনা। তাদের পরাজিত করা সহজেই সম্ভব। দরকার হলে ইপিআর। থেকেও একটা কোম্পানি দেওয়া যাবে।

রফিক দুই অফিসারকে বললেন সেই সম্ভাবনার কথা। ধরা যাক, যুদ্ধ লেগেই গেল, আপনারা কী করবেন। আমরা তো সহজেই বালুচ সেনাদের নিউট্রালাইজ করে ফেলতে পারব। আমি এক্সচেঞ্জ, বেতার, পোর্ট, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, নৌবাহিনীর সদর দপ্তর দখল করে ফেলতে পারব। আপনারা শুধু ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিয়ে বালুচগুলাকে শাটডাউন করবেন।

জিয়া বললেন, না না। আমাদের দিক থেকে মিলিটারি অ্যাকশনে যেতে হবে, এইটা আমার মনে হয় না। পলিটিক্যালি সবকিছু সেটেল হবে।

লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী বললেন, শোনেন। তেমন কিছু যদি ঘটেই, আমরা দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। আমরা অবশ্যই বের হয়ে এসে জনতার কাতারে যোগ দেব।

২৩ মার্চ রফিক গেলেন এম আর সিদ্দিকী সাহেবের কাছে। সঙ্গে ডা. জাফর। এম আর সিদ্দিকীকে বললেন, আপনি শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা যান। তাকে বলেন, চট্টগ্রাম হবে তার কেন্দ্রীয় দপ্তর। এখানে তিনি চলে আসুন। আমরা চট্টগ্রামকে মুক্ত রাখতে পারব। এখান থেকে তিনি সারা দেশের মুক্তির অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।

এম আর সিদ্দিকী বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। বললেন, মুজিব ভাই সাড়ে সাত। কোটি মানুষের নির্বাচিত নেতা। পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মেজরিটি পার্টির ইলেকটেড লিডার। তিনি কেন ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে এসে নেতৃত্ব দেবেন। এটা হয় না। তবে পরিস্থিতি বোঝাতে আমি অবশ্যই তার সঙ্গে কথা বলব। তাকে যেমন বোঝাব, তেমনি তাঁর নির্দেশও আমাদের লাগবে। তাঁর নির্দেশ আমি আপনাকে অবশ্যই জানাব।

রফিক ২৪ মার্চ ভীষণ উত্তেজিত। কারণ, এমভি সোয়াতে এসেছে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। জনতা বন্দরের রাস্তা ঘেরাও করে রেখেছে। ব্যারিকেড দিয়েছে। এই অস্ত্র কিছুতেই নামাতে দেবে না। শ্রমিকেরা অস্ত্র নামাবে না। তারা ধর্মঘট করল। রাস্তা উত্তাল মিছিলে মিছিলে।

অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব ছিল বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের ওপরে। তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন সামরিক বিদ্রোহের জন্য। আগে আক্রমণ করার জন্য। জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না।

ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার আসে। তাতে অবতীর্ণ হন পশ্চিমা মেজর জেনারেল আবুবকর ওসমান মিঠঠা। আরও কয়েকজন অফিসার তার সঙ্গে। তারা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে হেলিকপ্টারে তোলে। প্রথমে তারা অবতরণ করে চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখানে মজুমদারকে মিঠঠা বলেন, মজুমদার, সোয়াতের অস্ত্র আনলোড করো।

ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বলেন, আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি। শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেছে। রাস্তা জনতার দখলে। ব্যারিকেড সব বড় বড়। আমি এখানে অস্ত্র নামানো শুরু করলেই আগুন জ্বলে যাবে। ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা পুরা বন্দর জ্বালিয়ে দেবে। জাহাজে জাহাজে আগুন জ্বলবে।

মিঠঠা বলেন, যদি পুরোটা দেশ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যদি পুরো

কর্ণফুলী নদী রক্তে ভেসে যায়, তাহলেও অস্ত্র খালাস করতেই হবে।

ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত দিতে দেরি হচ্ছিল। বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা তখনই বিদ্রোহ করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে মিথ্যা কথা বলে, অন্য ডিউটি আছে বলে, ঢাকায় নেওয়া হয়।

মজুমদারের বদলে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিয়োগ দেওয়া হলো সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে। শ্রমিকেরা কাজ করছে না, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে আসা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের লাগিয়ে দেওয়া হলো জাহাজ থেকে বাক্স নামানোর কাজে। বাঙালি জনতা উত্তাল হয়ে উঠল। তারা পথে পথে ব্যারিকেড বসাতে শুরু করল। চলল গুলি। গুলিতে যে কতজন মারা গেল, কতজন আহত হলো, রফিক তার হিসাব কষে কুলিয়ে উঠতে পারেন না।

২৪ মার্চ কেন এত তাড়াহুড়া করে অস্ত্রগুলো নামানো হচ্ছিল, ২৬ মার্চ সকালে রফিক খানিকটা বোঝার চেষ্টা করেন। কারণ, ২৫ মার্চ রাত থেকেই হাজার হাজার বাঙালিকে মারার জন্য হাজার হাজার বুলেট দরকার ছিল।

কিন্তু রফিক ২৪ মার্চেই অবস্থান নিলেন তাঁর পরিকল্পিত সদর দপ্তর রেলওয়ে হিলে। রেলের হক সাহেবের ফোন থেকে তিনি তার জওয়ানদের জানিয়ে দিলেন দুটো সংকেত। তার বার্তা ঠিকভাবে পৌঁছেছে তো। ২৪ মার্চ রাতে রফিক যখন অস্থিরচিত্তে অপেক্ষা করছিলেন, তখন একটা বড় গাছের নিচে মাটিতে বসে তিনি একটা কঞ্চি দিয়ে মাটিতে হিজিবিজি আঁকছিলেন। সেই সময় দেখা গেল একটা লাইট জ্বালিয়ে একটা যন্ত্রযান আসছে। কাছে এলে ভটভট আওয়াজে বোঝা গেল এটা একটা বেবিট্যাক্সি। রাস্তার এক পাশে কর্ণফুলী নদীর স্রোতকল্লোল সেই বেবিট্যাক্সির ভটভট আওয়াজে খানিকটা বাধাপ্রাপ্ত হলো। বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী আর মেজর জিয়াউর রহমান। তাদের পেছনে দেখা যাচ্ছে আগ্রাবাদের ভবনগুলোর আলো। বন্দরের বাতিগুলো রাতের নদীর ধারে অমরাবতীর মতো জ্বলছে।

রফিক তাদের স্যালুট করলেন।

তারপর বললেন, স্যার। ওরা মারাত্মক গণহত্যার পরিকল্পনা করছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। বাঁচার একটাই উপায়, বিদ্রোহ করা। আমরা আগে ওদের নিরস্ত্র করব। তা না হলে ওরা আমাদের স্রেফ গুলি করে মেরে ফেলবে।

এম আর চৌধুরী বললেন, ঢাকার সঙ্গে কথা হয়েছে। চরম আঘাত হানার কোনো পরিকল্পনা আর্মির নেই।

জিয়া বললেন, আর্মির চেইন অব কমান্ড ভাঙা ঠিক হবে না। ঢাকা থেকে আমাদের কাছে বিশেষভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, রফিক যেন পাগলামো না করে। ওর পাগলামোর কারণে অন্য সবার বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

২৬ মার্চ সকালে ডা. জাফর আর আতাউর রহমান কায়সারের সঙ্গে নাশতা খেতে খেতে রফিক মাথার চুল ধরে টানতে থাকেন।

২৪ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে বাঙালি সৈনিকেরা আগে আক্রমণ করলে যুদ্ধ অনেক সহজ হতো। এমনকি ২৫ মার্চ যদি কর্নেল এম আর চৌধুরী আর মেজর জিয়া তার পরামর্শমতো অ্যাকশনে যেতেন, তাহলে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হাজারো বাঙালি সৈনিককে এক রাতেই শহীদ হতে হতো না।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, ২৪-২৫ মার্চ হেলিকপ্টারে কইরা ক্যান্টনমেন্ট থাইকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি মেজর জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল খাদেম হুসেন রাজা একটা কইরা মুখবন্ধ খাম লইয়া যান। প্রতিটা ক্যান্টনমেন্টে তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং সেনাবাহিনী প্রধান হামিদের অর্ডার পৌঁছাইয়া দেন যে আজকের রাইতটাই সেই রাত। আজকার রাইতেই অপারেশন সার্চলাইট পরিচালিত হইব।

ব্যাঙ্গমি বলল, রাইত আটটার সময় নয়ীম গহর গেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ভিড় ঠেইলা ঢুকছিলেন ভিতরে। শেখ সাহেবের বডিগার্ড মহিউদ্দীন তাঁরে ভিতরে নিয়া গেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তারে দেইখা কইছিলেন, আমি তোমার লাইগা ওয়েট করতেছিলাম। আলোচনা ফেইল করছে। ইয়াহিয়া উইড়া চইলা গেছে। রাস্তায় ট্যাংক বাইরাইতাছে। অরা যদি অ্যাটাক করে, আমরাও অ্যাটাক করব। চট্টগ্রামকে বলো, ডোন্ট সারেন্ডার। লিবারেট চিটাগাং অ্যান্ড প্রসিড টুয়ার্ডস কুমিল্লা।

ব্যাঙ্গমা বলল, হ। সেইটা তো আগেই কইছি। নয়ীম গহর গেলেন বঙ্গবন্ধুর পাশের বাড়ি মোশাররফ সাহেবের বাড়িতে। মোশাররফ আবার চিটাগাংয়ের এম আর সিদ্দিকীর ভায়রা। সেইখান থাইকা নয়ীম ফোন করলেন এম আর সিদ্দিকীরে। বঙ্গবন্ধুর হুকুম। ডোন্ট সারেন্ডার…।

.

২৫ মার্চ ১৯৭১। ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় এলেন ডা. জাফর। তখন বিকেল। সূর্যের আলো গাছের চূড়ায় চূড়ায়। আমের মুকুলগুলো বিকেলের হলুদ আলোয় সোনাঝুরির মতো লাগছে। রফিক আর জাফর পুরো পরিস্থিতি আলোচনা করলেন। পাকিস্তানিরা সব বাঙালি সৈন্যকে বলছে, অস্ত্র গোলাবারুদ জমা দিয়ে দিতে। তারা সিগন্যাল পোস্টগুলোতে শুধু অবাঙালিদের বসাচ্ছে। লক্ষণ খুব খারাপ। যেকোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করতে পারে।

ডা. জাফর সব শুনলেন। এখানে-ওখানে ফোন করলেন। সন্ধ্যার দিকে জাফর বললেন, রফিক সাহেব। আমি একটু আওয়ামী লীগ অফিস ঘুরে আসি। কোনো খবর এসেছে কি না নিজে চেক করে আসি।

তিনি পার্টি অফিসে গেলে রাত আটটার দিকে এম আর সিদ্দিকীর বাড়ি থেকে ফোন এল, জরুরি খবর আছে। বাসায় চলে আসেন।

জাফরসহ নেতারা ছুটলেন এম আর সিদ্দিকীর বাসায়।

সিদ্দিকী সাহেব দরজা বন্ধ করলেন। বললেন, এইমাত্র নয়ীম গহর ফোন করেছিল মোশাররফ হোসেনের ফোন থেকে। আলোচনা ভেঙে গেছে। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক আসছে। ইয়াহিয়া খান পালিয়ে গেছে। মুজিব ভাই বলে দিয়েছেন, আমাদের আর্মি, পুলিশ, ইপিআরদের তার হুকুম, ডোন্ট সারেন্ডার। অকুপাই চিটাগাং। প্রসিড টুয়ার্ডস কুমিল্লা।

এইটা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ? জাফর জিজ্ঞেস করলেন।

ইয়েস। অ্যাজ আই হার্ড ফ্রম দ্য মাউথ অব নয়ীম গহর।

তাহলে আমাকে এখুনি যেতে হবে। জাফর বেরিয়ে পড়লেন।

.

জাফর চলে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন রফিক খেতে বসলেন। আর্লি ডিনার। সঙ্গে আরেক ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দীন। খাওয়া কেবল শুরু করেছেন তিনি। ভাতের মধ্যে একটা মুরগির মাংস নিয়ে ঝোল তোলার জন্য চামচ ডুবিয়েছেন। বাটিতে। অমনি রুমে ঢুকে গেলেন জাফর। সঙ্গে আরেকজন কর্মী।

তাঁরা দুজনেই ভয়াবহ উত্তেজিত। তাদের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। গাড়ি করে আসা সত্ত্বেও জাফর হাঁপাচ্ছেন।

কী হয়েছে বলেন। বসেন। হাত ধোন। ভাত খান।

না রফিক সাহেব। ভাত খাওয়ার সময় এটা নয়। আলোচনা ফেইল করেছে। ইয়াহিয়া খান পিন্ডি চলে গেছে। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক বের হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু অর্ডার দিয়েছেন, চট্টগ্রাম দখল করতে। আপনাদের সারেন্ডার করতে নিষেধ করেছেন। চট্টগ্রাম দখল করে কুমিল্লার দিকে এগোতে বলেছেন। অর্ডারটা হচ্ছে ওরা যদি অ্যাটাক করে, আমরাও অ্যাটাক করব।

রফিক ভাতের থালা ফেলে উঠলেন। পাঁচক আহমদ জিজ্ঞেস করলেন, স্যার ভাত খাইলেন না যে। পাক কি ভালো হয় নাই? ক্যাপ্টেন রফিকের চোখের সামনে একমুহূর্তে তার সমস্তটা জীবন, ২৮ বছরের জীবন, তার ছাত্রজীবন, তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন, তার ৬১-এর রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া, তার ১৯৬৯-এর বিদ্রোহের চেষ্টা যেন ঝলসে উঠল। ঝলসে উঠল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। যদি আমাদের খতম করবার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। আর যদি একটা গুলি চলে…

রফিক বললেন, জাফর সাহেব, আমি যদি বাঁচতে চাই, আর আমার সৈনিকদের বাঁচাতে চাই, আর যদি আমাদের জনগণকে বাঁচাতে চাই, একটাই পথ আছে। আমি আমার ইপিআর সেনাদের তৈরি করে রেখেছি। আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি। আপনারা একটা কাজ করুন। আপনারা একটু ষোলশহরে যান। আর ক্যান্টনমেন্টে যান। বাঙালি সৈন্যদের বলুন আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। তাদের সঙ্গে কথা বলে এসে আমার সঙ্গে রেলওয়ে হিলে আমার সদর দপ্তরে এসে দেখা করেন।

রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে শেষবারের মতো সারসন রোডের বাড়ি ছাড়লেন ক্যাপ্টেন রফিক। তার মনে প্রশ্ন :

আমি তো যাচ্ছি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। কিন্তু আমার সঙ্গে অন্যান্য বাঙালি সৈন্য যোগ দেবে তো?

শেখ সাহেব ঢাকায় নিজেকে বাঁচাতে পারবেন তো?

এই যুদ্ধের পরিণতি কী হবে? যদি হেরে যাই মৃত্যু। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবে তো! আমার প্রাণের বিনিময়ে যদি দেশ স্বাধীন করে যেতে পারি, তার চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে!

রফিক গাড়িতে উঠলেন। পাশে ড্রাইভার কালাম। সঙ্গে দুজন রক্ষী। রফিকের হাতে স্টেনগান। তিনি ম্যাগাজিনে গুলি লোড করে নিয়েছেন। সমুদ্রের ধার দিয়ে গাড়ি চলছে। বঙ্গোপসাগর শীতল বাতাস পাঠিয়ে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে রফিকদের দেহমনে। ভেতরে-ভেতরে সবাই উত্তেজিত। সবার আগে যেতে হবে ওয়্যারলেস কলোনির দিকে। রাতের অন্ধকার চিরেও দেখা যাচ্ছে ওয়্যারলেসের অ্যানটেনা। এইখানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।

তবু ওয়্যারলেস দখল করতে না পারলে যোগাযোগ করা যাবে না। পাকিস্তানিরা জেনে যাবে তাদের পরিকল্পনা।

ওয়্যারলেস কলোনির গেটে পাহারা দিচ্ছে বাঙালি সেন্ট্রি। সে রফিকদের গাড়ি ঢুকতে দিল। মেসে রফিক সাবধানে পা ফেলে গেলেন হায়াতের রুমে। নক করলেন। হ্যালো হায়াত ঘুমিয়েছ?

না স্যার। কেবল একটু শুয়েছি। সে আলো জ্বালাল। বালিশের নিচ থেকে রিভলবার বের করে নিয়ে তার পোশাকের ভেতরে রাখল।

সব ঠিকঠাক আছে তো।

জি স্যার বলে হায়াত দরজা খুলতেই তার বুক বরাবর রফিকের স্টেনগান নল বাড়িয়ে দিল : দুঃখিত হায়াত। তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হলো।

হায়াত রিভলবারে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতেই তার মাথায় বাড়ি মারলেন। রফিক। বাড়ি মারল ড্রাইভার কালামও। তারপর তার হাত বাঁধা হলো। মুখ বাধা হলো। টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়ে পরের অবাঙালি সুবেদারকে গ্রেপ্তার করার অ্যাকশন শুরু হলো।

রফিকের নির্দেশ পেয়ে বিভিন্ন পোস্টের বাঙালি ইপিআর নিজ নিজ এলাকার অবাঙালি অফিসার সোলজারদের নিউট্রালাইজ করা শুরু করে দিল।

রফিকের সিগন্যাল পেয়ে ইপিআর সদস্যরা তাদের অ্যাকশন সুচারুভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছে।

ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সারদের সঙ্গে এই সব নিয়েই কথা বলছিলেন রফিক।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, আর রফিক আফসোস করেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে বাঙালি সৈনিক ও তাগো পরিবারের হাজারো মানুষকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যে নির্মমভাবে হত্যা করল, সেই ঘটনা লইয়া।

ব্যাঙ্গমি বলে, রফিকুল ইসলাম, পরে যিনি বীর উত্তম খেতাব পান, তাঁর বই লক্ষ প্রাণের বিনিময়েতে আফসোস করবেন, দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করবেন :

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কিন্তু অন্য ঘটনা ঘটে গেল। রাত প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাদের ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে ইবিআরসির বাঙালি সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণ করে বসল। প্রথমেই তারা অস্ত্রাগার দখল করে নেয় এবং সেখানে গার্ড ডিউটিতে থাকা বাঙালি সবাইকে হত্যা করে ফেলে। অন্য বাঙালি সৈন্যরা সে সময় ঘুমিয়ে ছিল। অস্ত্রাগার দখলের পর ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা হত্যার পর বীভৎস উন্মাদনায় মেতে উঠল। সেই রাতে তারা ১০০০-এর বেশি বাঙালি সৈন্যকে। হত্যা করে। তারপর তারা বাঙালি সৈন্যদের ফ্যামিলি কোয়ার্টার এলাকায় চলে যায় এবং সেখানে নাগালে পাওয়া সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করে।

এই হত্যাযজ্ঞ থেকে যেসব বাঙালি সৈন্য বাঁচতে পেরেছিল, তারা রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে চলে যায়। এদের কয়েকজন আমার হেডকোয়ার্টারে এসে এই লোমহর্ষ ঘটনার সবকিছু বর্ণনা করে। অন্যরা চলে যায় ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই রেজিমেন্টের অনেক অফিসার এবং সৈন্যের সবাই ছিল বাঙালি।

১৫

২৭ মার্চ ১৯৭১। স্থান পটিয়া থানা। পুলিশ স্টেশন। বেলাল মোহাম্মদ তাঁর তিন সঙ্গী নিয়ে এসেছেন থানায়। বারান্দা পেরিয়ে ওসির রুমে ঢোকা কঠিন। বাইরে পুলিশের পাশাপাশি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরাও সঙিন হাতে প্রহরারত।

দরজা পেরিয়ে টেবিলের ওপারের মুখটির দিকে তাকালেন বেলাল। ওসির চেয়ারে ইনি কে?

তার মুখের হাসি চওড়া হচ্ছে।

বেলাল বলে উঠলেন, আরে আপনি! বেগম মুশতারী শফীর আপনি মামা হন না!

জি। মুশতারী আমার ভাগনি।

আপনার নাম তো মানিক মিয়া?

জি। আপনারা কী মনে করে?

এখানে বাঙালি মিলিটারির লোকজন এসেছেন। ওনাদের সিনিয়র অফিসার কে আছেন?

মেজর জিয়াউর রহমান।

আছেন উনি?

কেন বলুন তো!

ওনার সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার।

আছেন। দেখা করতে চান কেন?

আমরা তো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার করেছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শুনেছি। ভালোই হচ্ছে আপনাদের অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অনুষ্ঠানটার রেকর্ড নেই আপনাদের কাছে? সেটা বাজান। কাল রাতে তো শুনলাম আবার ১০টার দিকে ইংরেজিতেও একটা আপিল হলো।

অ্যাপিল টু দ্য ম্যানকাইন্ড। বললেন বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে আসা মাহমুদ হোসেন। তিনি হাসছেন। কারণ, গতকাল ২৬ মার্চ রাত ১০টায় তিনিও রেডিও ট্রান্সমিটার দখল করেছিলেন। রিভলবার নিয়ে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারদের বাড়িতে। দুই-দুজন ইঞ্জিনিয়ারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে চলে এসেছিলেন কালুরঘাটে। তারপর নিজেই ৫ মিনিটের একটা ইংরেজি আবেদন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি পাঠ করে শোনান, হে পৃথিবীর মানুষ, তোমরা শোনো। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। মাহমুদ হোসেন লোকটা বেশ রহস্যময়। দেড়-দুই মাস হলো এসে উঠেছেন আগ্রাবাদ হোটেলে। ফ্রান্সে গানের রেকর্ড বের করেন। হরে কৃষ্ণ নামের একটা লং প্লে রেকর্ড নাকি লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। বাংলা গানের রেকর্ডও বের করেন। চট্টগ্রামে এসেছেন কারখানা গড়বেন বলে। মালামাল আসছে। রেডিওতে প্রায়ই যেতেন। বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে রেডিওর ক্যানটিনে দুপুরে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতেন। অসহযোগ শুরু হলে তিনি বললেন, বেলাল ভাই, একটা গীতিনকশা লেখেন। মঞ্চে আনি। বেলাল মোহাম্মদ লিখেছিলেন গীতিনাট্য : জয় বাংলা। সেটার রিহার্সাল হলো কয়েক দিন। তার স্ত্রীর নাম নাকি ভাস্করপ্রভা। লন্ডনে পরিচয়। লন্ডনেই বিয়ে। তাঁদের দুটো নাকি সন্তানও আছে। ভাস্করপ্রভার কাকা হলেন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মোরারজি দেশাই। মাহমুদ হোসেনও চেয়েছেন বিদ্রোহী সেনাদের কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তার সাহায্য নিয়ে বর্ডার পার হয়ে ভারত চলে যেতে চান। ভারতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে ভারত সরকারের সাহায্য চাইবেন। ভারতের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করে উঠতে পারবেন বলেই তার বিশ্বাস। এই মাহমুদ হোসেনের কাছে বেলাল মোহাম্মদ গাড়ি চেয়েছিলেন পটিয়া থানা পর্যন্ত আসা-যাওয়ার জন্য। মাহমুদ হোসেনই ২৭ মার্চ সকাল সকাল ট্যাক্সি ভাড়া করে মুশতারী লজ থেকে বেলাল মোহাম্মদকে তুলে নিয়ে এসেছেন। তার সঙ্গে লোক ছিল দুজন। বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গেও। ট্যাক্সিতে তাই বড় ঠাসাঠাসি করে আসতে হয়েছে।

বেলাল বললেন, আমাদের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবনটা অরক্ষিত পড়ে আছে। এটা পাহারা দেওয়া দরকার। যে কেউ ঢুকে পড়ে ক্ষতি করতে পারে। অ্যাটাক হতে পারে যেকোনো সময়। মেজর সাহেবের কাছে একটু হেল্প চাইতাম।

আচ্ছা আপনারা একটু বসেন। আমি ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসে জানাচ্ছি।

ওসি সাহেব তার রুম ছেড়ে থানার ভেতরের দিকে ঢুকলেন। একটু পরে এসে বললেন, চলেন আপনারা। দুজন আসেন।

বেলাল মোহাম্মদ আর মাহমুদ হোসেন ভেতরে গেলেন। একটা মাঝারি আকারের রুমে এক পাশে চেয়ার-টেবিলের পাশে বসে আছেন মেজর জিয়া। ইউনিফর্ম পরনে। বোঝাই যাচ্ছে, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। চোখেমুখে বিশ্রামহীনতার চিহ্ন।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে :

জিয়াউর রহমানের বয়স তখন ৩৫। বগুড়ার গাবতলী থানার একটা গ্রামে জন্ম। তার বাবা কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজ করতেন কেমিস্ট হিসেবে। জিয়া পড়েছেন বগুড়ার গ্রামে, বগুড়া জিলা স্কুলে, ১০ বছর বয়সের পর কলকাতায়। ১৯৪৬-৪৭ দুই বছর কলকাতার স্কুলে পড়ার পর ভারত পাকিস্তান ভাগ হলো। তারা পাকিস্তানে চলে এলেন। তার বাবা মনসুর রহমানের পোস্টিং হলো করাচিতে। জিয়াও ১১ বছর বয়সে ক্লাস সিক্সে। করাচির স্কুলে ভর্তি হলেন। স্কুল-কলেজ সেরে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৫৫ সালে ১৯ বছর বয়সে কমিশনপ্রাপ্ত হন। কাবুলে মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন, ট্রেনিংয়ে জার্মানিতে গেছেন। ১৯৭০ সাল থেকে চট্টগ্রামের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করছেন।

২৫ মার্চ রাতে তার ডিউটি পড়েছিল সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসে সাহায্য করার। তাঁর কমান্ডিং অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি লে. কর্নেল জানজুয়া তাঁকে ট্রাকে উঠিয়ে দিয়েছেন, রওনা করিয়ে দিয়েছেন বন্দরের দিকে। তাঁর। ড্রাইভার পাকিস্তানি। সঙ্গে আছে আরেক পাকিস্তানি অফিসার। জিয়া বন্দরে পৌঁছাতে পারছিলেন না, কারণ পথে পথে ছিল ছাত্র-জনতার দেওয়া। ব্যারিকেড। আর বন্দরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন পশ্চিমা ব্রিগেডিয়ার আনসারি। জিয়ার মনে শঙ্কা, এই ব্রিগেডিয়ার হয়তো তাকে পরপারে পাঠানোর জন্যই অপেক্ষা করছেন। বন্দরে যাওয়ার পথে ব্যারিকেডে থামতে হলো, জিয়া ট্রাকের সামনের আসন থেকে অন্ধকার রাস্তায় নামলেন। বাঙালি জনতা ব্যারিকেড মজবুত করছে, তাদের হাতে লাঠিসোটা, চোখেমুখে। রোষানল, কণ্ঠে স্লোগান–জয় বাংলা। এই ব্যারিকেড অপসারণ করতে গেলে বাঙালি হয়ে বাঙালির বুকে গুলি চালাতে হবে।

একটা গাড়ি এসে থামল সেখানে। গাড়ি থেকে কে নামলেন ওটা? মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। তিনি দৌড়ে আসছেন জিয়ার দিকে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, একটু কথা আছে।

তারা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে সরে গেলেন। খালেক বললেন, ক্যাপ্টেন। অলি আহমদের কাছ থেকে মেসেজ এসেছে। ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিরা হামলা করেছে। বহু বাঙালিকে হত্যা করেছে।

জিয়া শুনলেন। এই শঙ্কাই তাঁরা করছিলেন। অলি আহমদসহ অন্য অফিসারদের সঙ্গে এর আগে গোপনে মিটিংও করে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ। মুজিবুর রহমান তো বলেই দিয়েছেন, আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শেখ মুজিব ৭ মার্চেই গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে রেখেছেন। কাজেই বিদ্রোহ করার এখনই সময়।

জিয়া বললেন, তাহলে আমি আর জাহাজে যাচ্ছি না। আমাদের এখনই বিদ্রোহ করতে হবে। তিনি ট্রাকে ফিরে এসে পাকিস্তানি ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি ঘোরাও। বন্দরে যেতে হবে না। ড্রাইভার আদেশ পালন করল। সঙ্গের পশ্চিমা অফিসারও কিছু আপত্তি করল না। ট্রাক চলল ষোলশহরের ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ষোলশহর বাজারে বাঙালি সৈন্যরা জড়ো হয়েছে। এখানে পৌঁছানোমাত্র মেজর জিয়া লাফ দিয়ে ট্রাক থেকে নামলেন। বাঙালি। অফিসার ও জওয়ানরা এগিয়ে এল। জিয়া রাইফেল হাতে নিয়ে পাকিস্তানি অফিসারের বুক বরাবর তুলে বললেন, তোমাকে অ্যারেস্ট করা হলো। জিয়া ও বাঙালি অফিসাররা নৌবাহিনীর পাকিস্তানি ৮ জওয়ানকে নিরস্ত্র করলেন, কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার বাড়িতে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। পরে লে. কর্নেল জানজুয়াকে জিয়ার সৈন্যরা হত্যা করে।

এই সময় জিয়া চেষ্টা করেন কমান্ডার রফিকের সঙ্গে যোগাযোগের। জিয়া। পরে লিখেছেন, তারা যোগাযোগ করতে পারেননি। আর রফিক লিখেছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াকে রফিকের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। রফিক চেয়েছিলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ইবিআরসিতে ছুটে চলে যাক, তাদের পাশে দাঁড়াক, ২০ বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমণ করে ঘুমন্ত বাঙালি জওয়ান ও তাদের পরিবারকে বাঁচাক। তাঁদের তরুণ অফিসাররাও তা-ই করতে চেয়েছিলেন। সিনিয়র অফিসাররা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমণ করতে যাওয়া আত্মঘাতী হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন এবং পটিয়ার দিকে সরে যান।

.

এখন জিয়াউর রহমান পটিয়া থানায় অবস্থান করছেন। বেলাল মোহাম্মদ আর রেডিওর লোকেরা তাঁর সামনে।

বেলাল মোহাম্মদ বললেন, আমরা একটা বেতার চালাচ্ছি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।

জিয়া বললেন, হ্যাঁ। কাল রাতে আমি আপনাদের রেডিও শুনেছি। বাংলাটাও শুনেছি। রাত ১০টার দিকে ইংলিশ প্রোগ্রামটাও শুনেছি। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

বেলাল বললেন, দুইটা সাহায্য আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। এক. আমাদের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনটায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ফোর্স দিতে হবে। দুই, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। আপনিও আমাদের বেতারকেন্দ্রে কথা বলুন। আপনার মুখ থেকে কথা শুনলে সেটার একটা আলাদা গুরুত্ব থাকবে। লোকে বুঝবে যে বাঙালি মিলিটারিরা স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিয়েছে।

জিয়াউর রহমান একটুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, আপনারা দুপুরে খেয়েছেন?

না। খাইনি।

আগে খেয়ে নেন।

আমাদের সঙ্গে আরও মানুষ আছে।

ওনাদের ভেতরে আনেন। খাবার নিতে বলেন।

কক্ষটা বড়সড়ই বলতে হবে। এক পাশে একটা টেবিল। টেবিলের ওপরে নানা রকমের খাবার। পাউরুটি, রুটি, পোলাও, ভাজা মাছ, মুরগির রোস্ট, ডাল। এলাকাবাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইরত সৈনিকদের জন্য যে যা পেরেছে, খাবার দিয়ে যাচ্ছে। একটু পর সৈনিকেরা এই ঘরে আসা যাওয়া করছে। বিভিন্ন জিনিস রেখেও যাচ্ছে।

টেবিল থেকে প্লেটে করে খাবার তুলে নিয়ে দাঁড়িয়েই খেয়ে নিলেন। সবাই। মাহমুদ হোসেন তাঁর কথাটা পাড়লেন জিয়ার কাছে, আমি বর্ডার পার হতে চাই। মোরারজি দেশাই আমার কাকাশ্বশুর। ইন্ডিয়াতে গেলে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে পারব। আর্ম অ্যামুনিশেন পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারব।

জিয়া চিন্তিত মুখে বললেন, আর্মস অ্যামুনিশেন আমাদের খুব দরকার।

মাহমুদ বললেন, আপনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে দেন, যাতে রাস্তায় বাঙালি পুলিশ, ইপিআর আমাকে না আটকায়।

জিয়া বললেন, আমার কাছে তো প্যাড নেই, সিল নেই।

মাহমুদ বললেন, আপনি শুধু সাদা কাগজে একটু লিখে দেন। এ আমাদের লোক। একে সাহায্য করো। তারপর আপনার সই। যথেষ্ট হবে।

.

খাওয়ার পর কালুরঘাটের দিকে যাত্রারম্ভ।

সামনে তিন ট্রাক জওয়ান। একটার পর একটা ট্রাক ছাড়ল। একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে।

তারপর জিয়া উঠলেন একটা জিপে। বসলেন ড্রাইভারের পাশের আসনে। ওই গাড়িতে আরও উঠলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। পেছনে সেন্ট্রিরা। তার পেছনে ট্যাক্সিতে উঠলেন বেলাল মোহাম্মদ, মাহমুদ হোসেন এবং তাদের দলবল।

গাড়িগুলো চলেছে পটিয়া থেকে কালুরঘাটের দিকে। রাস্তায় মানুষজন চলছে বিপরীত মুখে। শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। নিরাপত্তার সন্ধানে ছুটছে গ্রামের দিকে। কেউবা রিকশায়, কেউবা গরুর গাড়িতে, কেউবা হেঁটে। মাথায় বোঝা, কাঁধে পোটলা, হাতে বড় বড় ব্যাগ, কোলে-কাখে শিশুসন্তান। একটা বছর ছয়েকের ছেলে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে খাঁচায় ভরা পোষা পাখি, একজন। বৃদ্ধা পিঠে নিয়েছে ছাগলছানা।

জিয়াউর রহমান মানুষের জটলা দেখলেই গাড়ি থামাচ্ছেন। মানুষের উদ্দেশে বলছেন, আপনারা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন? আমরা শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেব। ভয়ের কিছু নেই। দুই দিন লাগবে ওদের বিতাড়িত করতে।

কালুরঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল বিকেল ৫টা।

তাঁরা ছোট্ট স্টুডিওতে বসেছেন। জিয়াউর রহমান একটা বক্তব্য লিখলেন : আই, মেজর জিয়া, হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার দ্য ইনডিপেনডেনস অব বাংলাদেশ।

বেলাল বললেন, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথাটা যোগ করা দরকার।

জিয়া বললেন, নিশ্চয়ই। তাই তো করতে হবে। এবার জিনিসটা দাঁড়াল, আই, মেজর জিয়া, হেয়ারবাই ডু ডিক্লেয়ার দ্য ইনডিপেনডেনস অব। বাংলাদেশ অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জয় বাংলা।

তার এই ঘোষণায় পাকিস্তানিদের হাতে থাকা কতগুলো অস্ত্রশস্ত্রের নাম আছে। নামগুলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নিলেন স্টুডিওর ভেতরে।

বেলাল মোহাম্মদের মনে হলো, এই বক্তব্যটার বাংলা অনুবাদ হওয়া দরকার। অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ তখন ট্রান্সমিশন ভবনে। তাঁকে বলা হলো, অনুবাদ করে দিতে। তিনি অনুবাদ করে দিলেন।

জিয়াউর রহমান পাঠ করলেন বিবৃতিটি।

বাংলা অনুবাদও পাঠ করে শোনানো হলো। খবরের সময় বলা হলো, মেজর জিয়া একটি বিবৃতি পাঠ করেছেন। সেই বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, মহান জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই শত্রুকে পরাজিত করা যাবে। দেশ-বিদেশের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সাহায্য প্রয়োজন। ইত্যাদি…

মাহমুদ হোসেন মেজর জিয়ার কাছ থেকে একটা স্বাক্ষর করা চিরকুট নিলেন। পরিচিতিপত্র ধরনের চিরকুট।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, সেই পরিচয়পত্র কোনো কাজে লাগে নাই। কয় দিন পর সীমান্তের দিকে তিনি যাত্রা করেন। সিআইএর চর সন্দেহে জনতা তারে মাইরা ফালায়। জিয়াউর রহমানের সই তখন তার কোনো কাজে লাগে নাই।

জিয়াউর রহমান এরপর আরও দুই দিন রেডিওতে বিবৃতি দিতে আসেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, বেলাল মোহাম্মদ পরে একটা বই লেখেন, সেই বই অনুসারে মেজর জিয়ার প্রথম ঘোষণা গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। তবে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ আর মল্লিকের স্মৃতিকথা থাইকা মনে হয়, মেজর জিয়া প্রথম সুযোগেই নিজেরে বাংলাদেশের প্রভিশনাল হেড বা অস্থায়ী প্রধান ঘোষণা করছিলেন। যা-ই হোক, প্রথমে হোক, দ্বিতীয়বারে হোক, জিয়া একবার নিজেরে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী প্রধান হিসেবে যে ডিক্লেয়ার করছিলেন, এটা সত্য।

জিয়া যখন নিজেরে প্রভিশনাল হেড অব স্বাধীন বাংলা বইলা ঘোষণা দেন, সেইটা প্রচারিত হইলে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ আর মল্লিক যোগাযোগ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের লগে। লেখক শিক্ষক আবুল ফজলও আওয়ামী লীগ নেতাগো লগে যোগাযোগ কইরা কন, জিয়া এইটা কী করল! একজন মেজর এই কথা কইলে সেটা কু্য হইয়া যায়, স্বাধীনতা হয় না। দেশে-বিদেশে কেউ এইটারে আর সমর্থন দিবে না।

।আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াউর রহমানের লগে যোগাযোগ কইরা সেই ঘোষণা সংশোধন করতে কন। তখন জিয়া আবার রেডিওতে যাইয়া মহান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই সব হইতাছে এই মর্মে কথিকা পাঠ করেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চের ভাষণের সমালোচনা করেন। দেশের মানুষের নির্বাচিত মেজরিটি পার্টি কী কইরা দেশের শত্রু হয়, এই প্রশ্ন তোলেন। বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান বাংলাদেশের পাশে আইসা দাঁড়াইতে।

আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা বইলা তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, ইংরেজি বিবৃতিটা ইউটিউবে আছে, যে কেউ শুইনা দেখতে পারেন। বিভিন্ন বইপত্রেও আছে।

ব্যাঙ্গমা বলে, জিয়া ফাইনালি কইছিলেন :

I, Major Zia, on behalf of our great Leader, the Supreme Commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangla Desh and that the government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed.

It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of 75 million people of Bangla Desh and the government headed by him is the only legitimate government of the people of the independent sovereign state of Bangla Desh, which is legally and constitutionally formed and is worthy of being recognised by all the governments of the world.

I, therefore, appeal on behalf of our great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democratic countries of the world, especially the Big Powers and the neighbouring countries, to recognise the legal government of Bangla Desh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan.

To dub us, the elected representatives of the majority of the people, as secessionists, is a cruel joke and should befool none.

The guiding principle of the new state will be, first, neutrality; second, peace; third, friendship to all and enmity to none.

May Allah help us.

Joi Bangla!

ব্যাঙ্গমা বলে, আনিসুজ্জামান পরে আমার একাত্তর বইয়ে (সাহিত্যপ্রকাশ) লেখবেন :

২৭ মার্চ জানা গেল, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি নিজে অবশ্য সে ঘোষণা শুনিনি, তবে ক্যাম্পাসের অনেকেই শুনেছিলেন। এ সংবাদে আমরা সবাই খুব উল্লসিত হলাম, প্রেরণা ও ভরসা লাভ করলাম। ড. মল্লিক অবশ্য বললেন যে, মেজর জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করেছেন–এতে দেশ বিদেশে ভুল-বোঝাবুঝি হবে। তিনি অনেক কষ্টে হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কথাটা বলেন। তখই জানা যায় যে, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। পরে শুনতে পাই যে, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে খান একটা নতুন খসড়া রচনা করে দেন এবং মেজর জিয়া তা বেতারে পাঠ করেন ২৮ মার্চে। এই ভাষণে জিয়া বলেছিলেন যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। এই ঘোষণাটি বেতারে আমি শুনেছিলাম।

১৬

২৭ মার্চের সকালে আমীর-উল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদকে বললেন, বাইরে তো দেখা যাচ্ছে লোকজন একটু একটু করে বের হচ্ছে। বস্তির লোকজন কলসি-বালতি নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছে কলতলায়।

তাজউদ্দীন আহমদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বললেন, জীবন তো আর থেমে থাকে না। পানি না থাকলে পানি আনতে যেতেই হবে। সে কারফিউ থাকুক আর না থাকুক।

আমীর-উল ইসলাম ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় গেলেন। আরেকটু বাইরের দিকে উঁকি দিলেন। বললেন, রাস্তায় তো দেখা যাচ্ছে দোকানও বসেছে দু-একটা। লোকজন কেনাকাটাও করছে।

গফুর সাহেব বললেন, বাসায় তো কোনো খাবারও নাই। আজকে আমরাই-বা খাব কী!

আমীর বললেন, আচ্ছা, আমি একটু বাইরে থেকে পরিস্থিতিটা বুঝে আসি। আমীর মাথায় একটা টুপি চাপালেন। তারপর গেটটা খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন।

বাতাসে পোড়া ছাইয়ের গন্ধ, বারুদের গন্ধ। তবু ফুটপাতের ওপরে একটা গাছে নতুন সবুজ পাতা যেন জীবনের প্রতীক হয়ে একটু একটু করে মাথা ঝাঁকাচ্ছে।

বাড়ির সামনে একজন টুপি-দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবি পরা প্রবীণ মানুষকে পাওয়া গেল।

আমীর ভাবলেন, গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় যাওয়ার আগে এই চাচার কাছেই শুনে নিই না কেন পরিস্থিতিটা কী! বললেন, আসোলামু আলাইকুম, চাচা!

ওয়ালাইকুম আসোলাম।

চাচা কি আশপাশেই থাকেন?

জি বাবা!

পরিস্থিতি কী বুঝছেন?

না বাবা। বুঝতেছি না। কারফিউ তো চলতেছে। দুই দিন যা গজব গেল, বাড়িঘর পোড়ায়া দিছে, গোলাগুলি…আল্লাহ মাবুদ জানে বাবা। বাবা আপনাকে তো চিনলাম না।

আমীর মুশকিলে পড়লেন। তিনি নাম নিয়েছেন রহমত আলী। বাড়ি পাবনা। তা-ই তাঁকে বলতে হলো। আমার নাম রহমত আলী। আমি এই এলাকার রাস্তাঘাট কিছু চিনি না। পাবনা থেকে এসেছি।

আমার বাড়িও তো বাবা পাবনা।

এই এলাকায় তো অনেক দিন ধরে আছেন।

জি বাবা। নিজের বাড়ি।

আপনি কি এই এলাকায় কুষ্টিয়ার আতাউল হককে চেনেন?

চিনি তো।

কোন বাসা? অনেক দূরে, নাকি কাছে?

না, বেশি দূরে না।

আমাকে একটু বাড়িটা দেখায় দিতে পারবেন?

জি বাবা, পারব। আপনি আমার জেলার মানুষ। চলেন।

আমীর ভাবছেন এখন পাবনা জেলার বিশদ বিবরণ জিজ্ঞাসা করা শুরু হলে তো তিনি মুশকিলে পড়বেন। পাবনার সুজানগর ছাড়া আর কোনো এলাকাই তো তিনি চেনেন না। কাজেই চাচা মিয়াকে বরং প্রশ্নের মধ্যে রাখা ভালো!

কী বুঝছেন চাচা, বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন?

কিছু বুঝতেছি না বাবা। ইয়াহিয়া খান তো বলে দিয়েছে তার বিচার করবে।

হ্যাঁ। তা-ই তো বলল। কিন্তু বিচারের নামে এগুলো কী হলো? এত গোলাগুলি এত আগুন।

এইটা অবিচার বাবা। আল্লাহ তাআলা সহ্য করবেন না।

আতাউল হক সাহেবের বাড়ি পাওয়া গেল। টিনে ছাওয়া বাড়ি। অর্ধেক ইটের দেয়াল। তার ওপরে আবার টিনের বেড়া অর্ধেক। দরজায় কড়া নাড়া হলে আতাউল হক বেরিয়ে এলেন। আরে ভাই, কোথা থেকে এই বিপদের মধ্যে?

আর বলবেন না। আমীর-উল ইসলাম চোখ টিপলেন। মুসল্লি মুরব্বিকে বললেন, চাচা, এক মিনিট। আমি ভেতর থেকে একটু ভাবিকে সালাম করে আসছি।

ভেতরে গিয়ে আমীর-উল বললেন, ওই চাচাকে রাস্তায় পেয়েছি। আপনার বাড়ি চেনেন কি না জিজ্ঞেস করলাম, বললেন চেনেন। তাই তাঁকে। এনেছি। তাকে বলেছি আমার নাম রহমত আলী।

এদিকে ততক্ষণে আতাউল হকের স্ত্রীও সামনে এসে হাজির।

আমীর বললেন, আমার সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেব আছেন। আমরা যে বাড়িটায় রাতে ছিলাম, সেটা থেকে ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার সরাসরি দেখা যায়। ওই বাড়ি আমাদের জন্য নিরাপদ না। আর পরশু রাতে যখন উঠি, তখন অনেকেই দেখেছে যে আমরা ওই বাড়িতে আছি। যে কেউ জেরার মুখে এই বাড়ি দেখিয়ে দেবে।

আতাউল হক বললেন, ওনাকে নিয়ে আসেন।

আচ্ছা চাচাকে বলি ওনাকে আনতে। আমীর বাসা থেকে বেরিয়ে প্রবীণ মানুষটাকে বললেন, চাচা, দয়া করে একটা কাজ করবেন? আমরা যে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, ওই বাড়িতে মোহাম্মদ আলী নামের একজন আছেন। তাঁকে গিয়ে বলবেন, রহমত আলী আপনাকে সবকিছু নিয়ে এই বাড়িতে আসতে বলেছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।

আমীর তাকে পাঠিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাজউদ্দীন সাহেব একজন। অপরিচিত লোকের সঙ্গে আসবেন তো!

পনেরো মিনিটের মধ্যে দেখা গেল লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি পরা তাজউদ্দীন সাহেব আসছেন। প্রবীণ মুসল্লি ভদ্রলোককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তারা এই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। হক সাহেবের স্ত্রী তাদের জন্য নাশতা বানাতে লেগে পড়লেন।

তখনো কারফিউ চলছে। বাড়ির ওই প্রান্তে বস্তি। আরেক পাশে মসজিদ। হঠাৎ হইচই। কয়েকজন লোককে দেখা গেল, মুখ রুমালে ঢেকে মাথায় খাকি রঙের পট্টি বেঁধে বস্তিগুলোতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিচ্ছে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসছে। তখনই শুরু হলো মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলি।

তাজউদ্দীন, আমীর, আতাউল হক, তার স্ত্রী মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। আগুন, গুলি থেকে যে মানুষেরা বাঁচতে পেরেছে, তারা কেউ মসজিদের ভেতরে, কেউ এই বাড়ির পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের পাশে শুয়ে পড়ল। চারদিকে আর্তনাদ, গুলির শব্দ, মানুষের মরণচিৎকার, কান্না…

তাজউদ্দীনদের মাথার ওপর দিয়ে টিনের বেড়া ফুটো করে গুলি বেরিয়ে যেতে লাগল। স্বাধীনতা বড় বেশি দাম চাইছে। কত মৃত্যু, কত রক্ত, কত লাশ মুক্তির সোপানতলে উৎসর্গিত হলে তবে আসবে স্বাধীনতা? তাজউদ্দীন ভাবছেন।

একটু পর গোলাগুলির শব্দ কমে এল। কমে এল আগুনের আঁচ।

আমীর বললেন, এই বাড়িটার মধ্যে থাকলে যেকোনো সময় গুলি লাগবে। আমি পাশের বাড়ির ভেতরে ঢুকব।

আতাউল হক বললেন, পাশের বাড়ির চাবি কিন্তু আমার কাছে আছে! যাবেন? বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকালেই হবে।

আমীর বললেন, যাব।

তাজউদ্দীন বললেন, আপনি যেতে পারেন। আমি আর এখান থেকে নড়ছি না।

একটু পরে অনেকটাই নীরবতা নেমে এল। আতাউল হক সাহেবের রেডিওতে ঘোষণা এল, কারফিউ বিকেল ৪টা পর্যন্ত শিথিল।

আমীর-উল ইসলাম এই বাড়িতে ফিরে এলেন। তাজউদ্দীন বললেন, চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।

তাঁরা বের হলেন। তাজউদ্দীন রাইফেলটা আর সঙ্গে নিলেন না। রিভলবার নিলেন পাঞ্জাবির ভেতরের লুকানো পকেটে। মাথায় টুপি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, হাতে বাজারের থলে। বের হয়ে প্রথম কাজ হবে সাতমসজিদ রোডটা পার হওয়া। এই রাস্তা দিয়ে মিলিটারি জিপ, ট্রাক যাতায়াত করছে। সেসব যানের সামনে মেশিনগান বসানো।

তাঁরা বের হয়ে এগোচ্ছেন। বড় রাস্তায় আর্মির ট্রাক দেখা গেল। একটা মসজিদে ঢুকে পড়লেন তারা। তবু নিজেকে নিরাপদ মনে হলো না। মনে হলো, মসজিদে অবাঙালি লোক বেশি।

আবার বের হলেন। একটা গলির মুখে আশ্রয় নিলেন। এরই মধ্যে একজন-দুজন করে ছাত্র চলে এসেছে সেই গলির মুখে। তারাও বড় রাস্তায় কী ঘটছে, সে ব্যাপারে কৌতূহলী। আর কী করা কর্তব্য, তা-ও জানতে চায়। তারা অনেকেই টের পেয়ে গেল যে এখানেই তাজউদ্দীন আছেন। তারা এসে এসে খবর দিতে লাগল, কোথায় কী ঘটেছে।

তাজউদ্দীন বললেন, রহমত আলী সাহেব, যে করেই হোক, সাতমসজিদ রোডটা পার হতে হবে। চলুন।

আমীর বললেন, জি চলুন।

একজন ছাত্র আগে আগে গেল।

তাঁরা সাতমসজিদ রোডে উঠতেই দূরে দেখা গেল একটা মিলিটারি গাড়ি। রাস্তার ওপরে প্রথম যে বাড়িটার গেট, সেটা খুলে তাঁরা ভেতরে ঢুকে

পড়লেন।

আমীর বললেন, এই বাড়ির লোক যদি জিজ্ঞেস করে, কেন তাদের বাড়ি এসেছি, কী বলব?

তাজউদ্দীন বললেন, বলব যে একটা টেলিফোন করতে পারি কি? খুব জরুরি একটা কল করা দরকার।

মিলিটারি গাড়ি চলে গেল। তারা আবার বেরোলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দৌড়ে পার হয়ে গেলেন বিপজ্জনক সড়কটি। তারপর আরও খানিকটা হাঁটতে হবে। একটা গলিতে ঢুকে পড়তে পারলে পরে রায়েরবাজারের রাস্তা ধরা যাবে। তাঁরা ধানমন্ডি ১৯-এ ঢুকে পড়লেন।

তাজউদ্দীন বললেন, আমাদের বাসায় একবার যাব নাকি? লিলি কেমন আছে, সোহেল, মিমি কেমন আছে, একটু জেনে যাওয়া যায়। আর বিদায়ও তো নিতে হবে।

আমীর বললেন, এর চেয়ে বড় আত্মঘাতী কাজ আর দ্বিতীয়টা হবে।

আপনি তাই মনে করেন?

হ্যাঁ। ইয়াহিয়া খান ভাষণে বললেন যে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হলো শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগ। শেখ সাহেবের পরে আওয়ামী লীগের এক নম্বর ব্যক্তি কে? তাঁর বাড়িতে আর্মি, পুলিশ, গোয়েন্দা, টিকটিকি থাকবে না, এটা হয়!

শংকর হয়ে হেঁটে হেঁটে তারা পৌঁছে গেলেন রায়েরবাজার। হাঁটা তাজউদ্দীনের অভ্যাস আছে। ছোটবেলা থেকেই বহু পথ হেঁটেই তাঁরা চলাচল করেছেন। আর রাজনীতি করতে গিয়ে হাঁটতে হয়েছে মাইলের পর মাইল। নির্বাচনের সময় তো কথাই নেই। দুয়ারে দুয়ারে গেছেন হেঁটে হেঁটে। ইদানীং একটু ডায়াবেটিসের সমস্যাও হচ্ছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শে যখনই সুযোগ পান, হাঁটেন। মুজিব ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়া-আসা প্রায়ই হেঁটেই সারার চেষ্টা করেন।

রায়েরবাজার খানিকটা স্বাভাবিক। এখানে মিলিটারি ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন নেই।

তবে পথে সর্বত্র এক দৃশ্য। মানুষজন দলে দলে ছুটে যাচ্ছে গ্রামের দিকে। পালাচ্ছে উধ্বশ্বাসে। পরিবার-পরিজন, বাক্সপেটরা নিয়ে ছুটছে তারা। তাদের চোখেমুখে ভয়, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক।

তাজউদ্দীনকে চিনতে পারলেন এলাকার নেতা-কর্মীরা। তাঁরা তাঁদের নিয়ে গেলেন রায়েরবাজার সংগ্রাম পরিষদ অফিসে। অফিসের সামনে রাইফেল হাতে একজন কর্মী পাহারা দিচ্ছে।

তারা তাদের বসতে দিল। নাশতা এনে খেতে দিল। তাজউদ্দীন এই সাহসী মানুষগুলোকে বাস্তব পরিস্থিতি কী করে বলবেন?

একজনকে তিনি ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন, শোনো। একজন। একটা রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর ট্যাংক, কামান, মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না। সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাও। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা কে কোথায় আছে, তাদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলো। তারপর গেরিলা কায়দায় হঠাৎ হঠাৎ করে মিলিটারির ওপরে আক্রমণ করে আবার জনগণের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে হবে। আগে পরিস্থিতি দেখো। ওই রাইফেলধারী কর্মীকে সরে যেতে বলো।

তাদের পায়ে হাঁটার উপযোগী জুতা নেই।

ছেলেরা বলল, আপনাদের কী লাগবে, বলেন?

তাজউদ্দীন বললেন, দুইজনকে দুই জোড়া শক্তপোক্ত স্যান্ডেল শু এনে দিতে যদি পারো, খুব ভালো হয়। ছেলেরা ছুটল স্যান্ডেল শুর খোঁজে।

আমীর বললেন, কাগজ-কলম দাও। একটা জরুরি চিঠি লিখতে হবে। তাজউদ্দীন বললেন, আমাকেও লিখতে হবে।

কাগজ-কলম চলে এল। নেতাদের কাজে লাগতে পেরে কর্মীরা নিজেদের ধন্য মনে করছে।

তাজউদ্দীন আর আমীর দুজনেই দুটো চিরকুট লিখতে বসলেন।

তাজউদ্দীন লিখলেন :

লিলি, আমি চলে গেলাম। আসার সময় কিছু বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিয়ো। আবার কবে দেখা হবে জানি না…মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেয়ো।–দোলনচাঁপা।

একটুখানি আবেগে যেন কেঁপে উঠল তাজউদ্দীনের হৃদয়। দোলনচাঁপা মানে কেউ না বুঝুক, লিলি ঠিকই বুঝবেন।

আমীর-উল ইসলাম লিখলেন লীলার উদ্দেশে। লীলার গর্ভে বেড়ে উঠছে তাঁদের সন্তান। আর তিনি বেরিয়ে পড়েছেন অজানার উদ্দেশে। তিনি জানেন না, তিনি আর ফিরবেন কি না। আমীর-উল লিখলেন :

প্রিয় লীলা,

আমি চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি, কবে ফিরব কিছুই জানি না। শুধু জানি, একটা শোষণমুক্ত, শৃঙ্খলমুক্ত, পরাধীনতার নিগড়মুক্ত সুন্দর একটা রাজ্যের স্বপ্ন নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। কোলজুড়ে আসুক আমাদের অনাগত নতুন প্রজন্ম। তার জন্যই তো চাই মুক্ত একটা স্বদেশ।

ইতি তোমারই…

.

ব্যাঙ্গমা বলে, তাজউদ্দীনের চিরকুটটা পৌঁছাইছিল লিলির কাছে। আমীর-উল ইসলামের চিঠিটা লীলার কাছে পৌঁছায় নাই।

.

দুজনই চিরকুট ভাঁজ করে ঠিকানা লিখে দিলেন কাগজের ওপর পিঠে। বিশ্বস্ত কর্মী স্থানীয় নেতা নাসরুল্লা দায়িত্ব নিল সুবিধামতো ঠিকঠাক ঠিকানায় চিরকুট দুটো পৌঁছানোর।

ততক্ষণে তাদের জন্য দুই জোড়া স্যান্ডেল শু এসে গেছে। পায়ে চমৎকার জুতে গেল। পায়ে ব্যথাও লাগছে না, আবার মনে হচ্ছে, সহজে ছিঁড়বে না।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, তাজউদ্দীন সেই স্যান্ডেল ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশেও পরতেন।

ব্যাঙ্গমি বলল, জয় বাংলার জুতা তো। সহজে ছিঁড়ে না।

এবার সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন তারা। একজন মাত্র কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আর আমীর গেলেন খেয়াঘাটে। ছোট্ট একটা নদী। কিন্তু নদী তো। পার হওয়া যাবে কী করে? শত শত মানুষ নদী পার হয়ে যাচ্ছে। ঘাটে অপেক্ষা করছে অনেকে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী রেজার চাচা নৌকা নিয়ে এলেন ঘাটে। সেটাতে রেজা তুলে দিল তাজউদ্দীন আর আমীরকে। আরও লোকজন উঠল। নৌকা চলছে। আকাশে একখণ্ড কালো মেঘ বড় আকার নিচ্ছে। তবে সূর্যও প্রখর। মনে হয় ঝড়বৃষ্টি হবে। তাজউদ্দীন একবার নদীর দিকে, একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন তীরের মানুষগুলোর মুখে। তাকালেন তাঁদের সঙ্গে নৌকায় ওঠা নারী-পুরুষ, শিশুদের দিকে। গরিব মানুষ। পুষ্টিহীন মানুষ। ভাঙাচোরা মুখ। তাদের সম্পদ বলতেও কিছু নেই। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে কাপড়ের পোঁটলা। হাঁড়িকুড়ি। হাঁস-মুরগি। একজনের কোলে একটা ছাগল। এই মানুষগুলো দুই দিন ধরে ছিল আর্মির প্রধান নিশানা। নির্বিচার বস্তিতে বস্তিতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে গুলি করা হয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা স্বাধীনতা চেয়েছিল। তাদের অপরাধ, তারা মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল।

তাজউদ্দীন পানির দিকে তাকালেন। জলের পোকা পানিতে একটা অপূর্ব নকশা আঁকছে। কালো জলে আকাশের ছায়া পড়েছে। মুজিব ভাইয়ের মুখটা কেন যেন মনে পড়ছে তার।

নৌকা নদীর অপর পারে ভিড়ল। নতুন পাওয়া স্যান্ডেল হাতে ধরে তাজউদ্দীন নামলেন কাদাভরা ঘাটে। মানুষের পা পড়ে পড়ে ঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের সারি চলেছে ঘাট থেকে। গ্রামে হাটের দিনে সাধারণত এই দৃশ্য দেখা যায়।

নদীর পারে আঁটির বাজার। বাজারে পৌঁছাতেই মানুষজন ঘিরে ধরল তাজউদ্দীন আর আমীর-উলকে। তাজউদ্দীনের পূর্বপরিচিত কর্মী সিরাজ এগিয়ে এলেন, তাজউদ্দীন ভাই, ঢাকার খবর কী? বঙ্গবন্ধু কুনহানে? আমরা অহন কী করুম? কত প্রশ্ন সিরাজের! তাঁর এলোমেলো চুলের নিচে কোটরাগত চোখ দুটোর উজ্জ্বল তারা থেকে, তার সাদা হাওয়াই শার্টের গোটা হাতার নিচের পেশল হাতের প্রান্তে দুটো পাঞ্জা থেকে কত যে প্রশ্ন ঝরে পড়ছে!

তাজউদ্দীন কী উত্তর দেবেন। কী উত্তরই-বা আছে তাঁর কাছে।

সিরাজ বললেন, একটা মিনিট খাড়ান। আমি একটু বাড়িত থাইকা আইতাছি। সিরাজ দৌড়াতে লাগলেন। তার চেক লুঙ্গিটা ভাজ করে হাঁটুর ওপরে তুলে তিনি পাড়ি দিচ্ছেন কলাইয়ের খেত।

সিরাজ ফিরে এলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখের তারা আরও উজ্জ্বল। তিনি দুটো ৫০ টাকার নোট বের করে তাজউদ্দীনের হাতে দিলেন।

এইটা একটু রাখতে হইব, না করবার পারবেন না।

আরে কী বলো।

আপনে কই না কই যাইতাছেন। পকেটে টাকা লওনের টাইম পাইছেন। নাকি পান নাই! ঢাকায় মানুষ মাইরা সাফ করছে, সেইটা তো আমরা জানি। নদী দিয়া লাশ ভাইসা যাইতাছে। আপনে এইটা লন। এইটা আমার জয় বাংলা ফান্ডে আমি দিলাম। কিন্তু এই টাকা আপনে পথে খরচ করবেন। গাড়িগুড়ি ভাড়া করবেন। হাইটা আর কত দূর যাইবেন। লন।

আমীর আর তাজউদ্দীনের বড় মায়া বোধ হয়। পথে পথে এই দৃশ্য। গ্রামের মানুষ সব শহরের মানুষদের বরণ করে নেওয়ার জন্য, সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা চিড়া, মুড়ি, গুড়, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতপাখা এনে বাতাস করছেন। আহা আমার সোনার বাংলা! ভায়ের-মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ!

সিরাজ একটা মোটরবাইক জোগাড় করে ফেললেন। তারপর বললেন, এই ফিফটি হোন্ডায় তো তিনজন টানতে পারব না। এক কাজ করি। প্রথম তাজউদ্দীন ভাইরে লই। একটান দিয়া লইয়া যামু মতিউর রহমান ভাইয়ের বাড়ি। তারপর তাঁরে ওইখানে রাখুম। হাত-পা ধুইয়া চা-পানি খাইতে খাইতে আরেকটান দিয়া লইয়া যামু ব্যারিস্টার সাবরে।

তাই করতে শুরু করলেন সিরাজ। মোটরসাইকেলের পেছনে। তাজউদ্দীনকে বসিয়ে ভটভট আওয়াজ তুলে চললেন তিনি। লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় হোন্ডায় চড়া কঠিন–এটা আবিষ্কার করলেন তাজউদ্দীন। কিন্তু সিরাজও তো লুঙ্গি পরা। তার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না!

সিরাজ তাজউদ্দীনকে নামালেন একটা পাটখড়ির বেড়া দেওয়া ঘরের সামনে। চালের ওপরে গাছগাছালি। একটা কামরাঙাগাছের নিচে হলুদ পাতা পড়ে আছে। উঠোনে মোরগ-মুরগি চরছে।

মতিউর এগিয়ে এলেন। সিরাজ বললেন, মতিউর ভাই, চিনছেন তো ভাইরে। তাজউদ্দীন ভাই। আরে আমগো নেতা তাজউদ্দীন ভাই।

মতিউর রহমানের চোখে চশমা। তিনি চশমাটা ঠিকঠাকভাবে নাকে বসিয়ে নিয়ে পানের পিক ফেলে তাকিয়ে বললেন, চিনুম না ক্যান, চিনছি ঠিকই, বিশ্বাস করতে পারি নাই, এত বড় নেতা… এই চেয়ার আন। পানি দে। আপনে বসেন…

সিরাজ বললেন, আমি ব্যারিস্টার সাবরে আনতে গেলাম।

তাজউদ্দীন বললেন, আচ্ছা। যাও তুমি তাড়াতাড়ি। আমি এইখানে একটু বসি। ছায়াঘেরা জায়গাটা বড় শান্তির বলে মনে হচ্ছে।

বাড়ির দাওয়ায় একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলেন তাজউদ্দীন।

বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। হাতলওয়ালা সেগুন কাঠের চেয়ার এল। কাঁসার বদনায় পানি। ধোয়া গামছা।

একটু একটু করে ভিড় হচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল রুস্তমের সঙ্গে।

তাজউদ্দীনই চিনতে পারলেন আগে, আরে রুস্তম, তুমি!

আপনে আসছেন শুইনা চইলা আসলাম।

রুস্তম বাবুবাজারের পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল।

সে বলল, স্যার। কী কমু স্যার। হায়াত আছে বইলা আমি বাইচা পলায়া আসছি। আমগো ফড়ির আর কেউ বাইচা নাই স্যার।

কী বলো?

২৫ তারিখ রাইতে স্যার আমরা ফাঁড়িতে ঘুমায়া আছিলাম। লুঙ্গি পইরা। খালি গাও। যে গরম! এর মধ্যে কোথাইকা আজরাইলের মতন মিলিটারি আসল। দরজা ভাইঙ্গা ঢুইকাই স্ট্রেট ব্রাশফায়ার। মেশিনগানের গুলিতে সক্কলে ওই বিছানাতেই মইরা শ্যাষ। ফাড়ির ডিউটিতে যারা আছিল, তারা ইউনিফর্ম লইয়াই কেউ টেবিলে উপুড় হইয়া পইড়া মইরা আছে, কেউ মাটিত মইরা পইড়া আছে। একজন তো থানার মধ্যে ওয়ালের সাথে গুলিতে গাইথা আছে। আমি মরার ভান কইরা পইড়া থাকলাম। রক্ত আমার উপর দিয়া ভাইসা যাইতে লাগল। মানুষের রক্ত স্যার সেই রকম গরম! মিলিটারি চইলা গেলে কোনোরকমে উইঠা নদীতে ঝাঁপায়া পড়লাম। সাঁতরায়া নদী পার হইয়া বাইচা আইছি।

তাজউদ্দীন স্তব্ধ। তাজউদ্দীন মর্মাহত। এটা কোন ধরনের আচরণ? এটা কোন ধরনের পাশবিকতা? হিটলার কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের ওপর এই রকম নিষ্ঠুরতার বুলডোজার চালাতে পেরেছিল?

আমীরকে নিয়ে সিরাজের মোটরসাইকেল এসে গেল শব্দ আর ধুলো ছড়াতে ছড়াতে।

তাজউদ্দীন বললেন, ব্যারিস্টার সাহেব। রুস্তমের কাছ থেকে শুনুন তার বেঁচে ফিরে আসার কাহিনি। এইভাবে কেউ ঘুমন্ত মানুষকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলতে পারে?

.

বিকেল নেমে আসছে। বাড়ির পাশে একটা সুন্দর পুকুর। টলটল করছে জল। কতগুলো হাঁস পানিতে সারবদ্ধভাবে সাঁতার কাটছে। পানি দেখে তাজউদ্দীন আর স্থির থাকতে পারলেন না। বললেন, আমি গোসল করব।

মতিউর সাহেব বললেন, আমি ধোয়া লুঙ্গি আইনা দিতাছি। আপনে নামেন পুকুরে।

তাজউদ্দীন পুকুরের শীতল জলে ডুব দিয়ে নিজের ক্লান্তি, উদ্বেগ, রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু মানবতার এই অবমাননার অবসান ঘটবে কী করে? এই অপমানের এই লাঞ্ছনার শোধ নেওয়া যাবে কীভাবে?

আমীর গোসল সারলেন তোলা পানিতে। হারিকেনের আলোয় রাতের খাওয়া সেরে তাঁরা পাটখড়ির বেড়ার ঘরে বড় চকিতে চাদর পেতে শুয়ে পড়লেন।

ভোরবেলা আলো ফোঁটার আগেই বাইরে মোটরবাইকের শব্দ পাওয়া গেল। আবদুল আজিজ মণ্ডল মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন। এই মোটরসাইকেলটার পাওয়ার বেশি। এটাতে একসঙ্গে তিনজন ওঠা যাবে। ভোরের বাতাস চিরে মোটরসাইকেলে চলতে গিয়ে চোখেমুখে বাতাসের স্পর্শ অনুভব করলেন তাজউদ্দীন। বোধ হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ক্যালেন্ডারে দিনটা ২৮ মার্চ ১৯৭১।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, মোটরসাইকেল দুইজনরে লইয়া গেল দোহারের এমপিএ সুবেদ আলী টিপুর বাড়ি।

ব্যাঙ্গমি বলে, তারপর আবার মোটরসাইকেলে উইঠা তাঁরা গেলেন জয়পাড়া। আশরাফ আলী চৌধুরীর দোতলা কাঠের বাড়িতে খানিকক্ষণ জিরাইলেন। গরুর গরম দুধ খাইলেন। স্কুলের পিয়ন মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ায়া তাগো লয়া গেলেন পদ্মা নদীর পাড়।

ব্যাঙ্গমা বলে, যখন তারা নদীর তীরে আইলেন, তখন আকাশ ঘন কালো। জোরে বাতাস বইতাছে। বিকেলেই সাঁঝবেলা হইয়া আইল। শুরু হইল বাতাসের দাপাদাপি।

এ মাঝি যাইবা নাকি?

কুনো মাঝি রাজি হয় না।

শেষে তারা উঠলেন একটা তাঁতি পরিবারে। শুকুর মিয়ার বাড়িতে রাতে থাকলেন দুইজন। টিউবওয়েলের পানিতে গোসল সারলেন।

২৯ মার্চ আবার সকাল সকাল হেরা দুইজন ঘাটে গিয়া হাজির। এইবার শক্তপোক্ত নৌকা বাইছা লওয়া হইল। মাঝি আল্লাহর নামে উত্তাল পদ্মার বুক চিইড়া নৌকা ছাড়ল। বইঠা বায়। পাল উড়ায়। হাল ধইরা থাকে। নৌকা ধীরে ধীরে আউগায়। যেইখানে ঢেউ বেশি সেইখানে দোল খায়। যেইখানে পাক বেশি সেইখানে মাঝি শক্ত কইরা হাল ধইরা থাকে। নদীর পানিতে সকালবেলার আলো পইড়া সদ্য ধার দেওয়া ছুরির মতন ঝলকানি ওঠে। তিন। ঘণ্টা পর নৌকা নদীর পশ্চিম পাড়ে নাড়ারটেক ঘাটে ভিড়ে।

ঘাটে নাইমা তারা আওয়ামী লীগ কর্মী গো দেখা পাইলেন।

তারা জানাইল মিলিটারি অহনও ফরিদপুর আহে নাই। তয় আইতে কতক্ষণ। আর যদি আহে, এই ঘাট দিয়াই আইব।

তাড়াতাড়ি ফরিদপুর শহর চইলা যান। কর্মীরা পরামর্শ দিল।

তয় যাওনের কোনো উপায় নাই। একমাত্র উপায় হইল ঘোড়ায় চইড়া যাওয়া।

তখন আমীর একখান আর তাজউদ্দীন আর একখান ঘোড়ায় উঠলেন। তাগো দড়ি ধইরা ছুটতে লাগল দুইজন।

শহরের কাছাকাছি গিয়া দেখা গেল রিকশা আছে। ঘোড়া ছাইড়া তারা রিকশায় উঠলেন।

গেলেন আওয়ামী লীগ কর্মী ইমামউদ্দীন আহমদের বাড়ি। তিনি আছিলেন না। তার স্ত্রী হাসি তাগো দুপুরের খাওয়া খাইতে বসাইলেন। বাড়িতে রেডিও আছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনা যাইতে লাগল। তাজউদ্দীন শুনলেন, আমীর-উল শুনলেন, মেজর জিয়া কইতাছেন, মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হইল। বিশ্ববাসী সাহায্য করেন। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হইল সবার লগে বন্ধুত্ব, কারও লগে শত্রুতা নয়।

আমীর-উল কইলেন, ভালো। আমগো মিলিটারি বিদ্রোহ করছে। এইটা বড়ই আশার সংবাদ।

তাজউদ্দীন কইলেন, হ। আশার সংবাদ। তয় হে আবার পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে ক্যান। কইল তো মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে সরকার হইছে। অহন না আবার সরকার বানায় ফেলে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ আর তার নেতৃত্বে আস্থা রাখে। সামরিক সরকারের ওপরে না। পৃথিবীর মানুষও মুজিব ভাইরে ইলেকটেড প্রতিনিধি হিসেবে জানে, জনগণের নেতা হিসেবে জানে। মিলিটারিগো না।

ব্যাঙ্গমা বলে, তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থাইকা নোট নিয়া রাখছিলেন আজিজ আহমেদ বাগমার। সেই নোট থাইকা তিনি লেখা বানাইছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সেইটা দৈনিক আজকের কাগজ-এ প্রকাশিত হইছে।

ব্যাঙ্গমি বলে, বাগমারের লেখা স্বাধীনতার স্বপ্ন : উন্মেষ আর অর্জন বইতেও তাজউদ্দীনের জবানিতে এই কথা লেখা হইছে।

.

তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ভাবি, বেশি কিছু করতে যাবেন না। শুধু ডাল আর ভাত। এই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

তাজউদ্দীন এটা বলেছিলেন, যাতে হাসি ভাবির কষ্ট কম হয়, তিনি যেন বাড়তি কিছু আয়োজনের চেষ্টা করতে ব্যস্ত হয়ে না পড়েন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। হাঁড়িতে ভাত রান্না করা ছিলই, সে ভাত গরমই, কেবল চুলা থেকে নামানো হয়েছে। সে যুগে সবাই বেশি করে ভাত রাঁধতেন, ভাত বেঁচে গেলে পান্তা করা যায়, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিকেও খাওয়ানো যায় কিন্তু কেউ না কেউ হুট করে এসেই পড়ে, ভাত মেপে রাধলে তখন অসুবিধা হয়। কাজেই গরম ভাত রেডি, কিন্তু ডাল তো আজ রাধা হয়নি। হাসি তাই তাজউদ্দীন আর আমীরকে বললেন, আপনারা খেতে বসেন। হাত-মুখ ধুয়ে নেন। বাড়ির কাজের লোক পানি তুলে দিয়েছে। মেহমানরা হাতমুখ ধুচ্ছেন বারান্দাতেই, পানি গড়িয়ে পড়ছে উঠানে। এই সুযোগে হাসি চুলায় ডাল চড়িয়ে দিলেন। কতক্ষণ আর লাগবে।

তাঁরা দুজন হাতমুখ ধোয়া শেষ করে গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছে আস্তেধীরে এসে বারান্দায় মাদুরে বসলেন খেতে। চুলায় ডাল সেদ্ধ হচ্ছে, পাটখড়ি বেশি করে চুলার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে পাশের বাড়ি থেকে আসা শেফালির মাকে সেটা দেখতে বলে হাসি ভাত বাড়লেন। আলমারি থেকে কাঁচের প্লেট বের করে মাদুরে রাখলেন। ছোট মাছ, লাউ দিয়ে টাকি মাছ করাই ছিল। চটপট আরেকটা চুলায় দুটো ডিমও ভাজা হয়ে গেল। এখন ডালটুকু হলেই হয়।

হাসি মাথায় নীল রঙের শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটাটা বড় করে নিয়ে বললেন, আপনারা খেতে বসেন। আস্তে আস্তে খান। ডাল হতে কতক্ষণ। সিদ্ধ হলেই বাগার দিয়ে দিব।

এর মধ্যে ফরিদপুরের কর্মীরা উঁকি দিতে শুরু করেছে। কেউ একজন ছুটে এল। তার শরীর ঘর্মাক্ত, মুখে রাজ্যের উদ্বেগ, সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মিলিটারি আসতেছে। মিলিটারি।

তাজউদ্দীন ঠান্ডা মাথায় আরেক লোকমা ভাত মুখে পুরে মাছের টুকরার কাটা বাছতে বাছতে বললেন, মিলিটারি আসুক আর না আসুক, আমি ডাল ভাত খেয়েই যাব।

ভাত খাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ডালটা তখনো সেদ্ধ হয়নি। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। খড়ি সব ভেজা। শেফালির মা বাঁশের চোঙা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে চোখ লাল করে ফেলেছেন।

ডাল চুলাতেই রইল।

তাজউদ্দীন আর আমীর আবার যাত্রা শুরু করলেন।

১৭

ব্যাঙ্গমা বলে, পুরো বাংলায় যখন জাহান্নামের আগুন, পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচার গণহত্যা চালায়া যাইতাছে আর বাঙালিরা চেষ্টা করতাছে প্রতিরোধ গইড়া তুলতে, যার যা কিছু আছে তাই লইয়াই, তখন কী করতাছেন আমেরিকার সাহেবেরা? কী করতাছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর কিসিঞ্জার!

ব্যাঙ্গমি বলে, হ, চলো, এটু হোয়াইট হাউস ঘুইরা আহি।

.

হোয়াইট হাউসে বসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা গল্পগুজব করেন। বিষয় : পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অভিযান।

মার্চের ২৯, ১৯৭১। কিসিঞ্জার বলেন, মনে হচ্ছে, ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন।

গুড। নিক্সন মাথা নাড়েন।

অনেক সময় শক্তি প্রয়োগে কাজ হয়। বিরূপ পরিস্থিতিতে কাজ হয়। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৩০ হাজারকে দিয়ে সাড়ে সাত কোটিকে কন্ট্রোল করা যায় না। হয়তো ভবিষ্যতে কথাটা ঠিক বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবকিছু ঠান্ডা মেরে গেছে। কিসিঞ্জার বলেন।

নিক্সন বলেন, হয়তো এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কিন্তু ইতিহাসে অনেক জাতির বেলাতেই দেখা গেছে ৩০ হাজার প্রশিক্ষিত মানুষ সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দমাতে পেরেছে। স্প্যানিশদের দেখুন, তারা কজন মাত্র এল আর ইনকাদের দখল করে ফেলল। ব্রিটিশরাও অল্প কজনই গেছে ভারতে এবং ভারতকে দখল করেছে।

একদম ঠিক। কিসিঞ্জার বললেন। নিক্সন বললেন, যা-ই হোক। আমি ইয়াহিয়ার ভালো চাই। তার মানে। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার চেয়ে না ভাঙা ভালো। তবে আসল কথা হলো, তারা কি এই ঈশ্বরবর্জিত দেশটাকে আসলেই চালাতে পারবে।

কিসিঞ্জার বললেন, তা অবশ্য ঠিক। ইতিহাসে দেখা গেছে, বাঙালিদের শাসন করা সব সময়ই কঠিন।

তারা তাদের কর্তব্য ঠিক করেন। আমরা কিছু করব না। প্রেসিডেন্ট বলেন, বায়াফ্রায় যেমন আমরা কিছুই করিনি, ঠিক সে রকম এবারও আমরা কিছুই করব না। যেমন আমরা বায়াফ্রার ক্ষুধার্ত মানুষকে গুলি করা পছন্দ করি নাই। তবু কিছুই করি নাই।

ঠিক ঠিক। কিসিঞ্জার বললেন।

ঠিক ঠিক বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিসিঞ্জার জানেন। রুল নম্বর ওয়ান : দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নম্বর টু : ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।

২৬ মার্চ বিকেলে কিসিঞ্জার বসেছিলেন ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ নিয়ে। বিষয় পূর্ব পাকিস্তান। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তা ভ্যান হেলেন বলেছিলেন, মিলিটারি দেশটার ভাগ হওয়া বন্ধ করতে একটা চেষ্টা নেবেই, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা শেষ পর্যন্ত তাদের কম্মো নয়।

তখন কিসিঞ্জার বলেছিলেন, আমি তো আজ সকালেও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেছি, তিনি কিছুই না করবার পক্ষে। তিনি এমন একটা অবস্থান না নেওয়ার পক্ষে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে পাকিস্তান ভাঙার কাজে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে। তিনি কোনো অ্যাকটিভ পলিসির পক্ষে না। এর মানে এই যে যুদ্ধ করতে আমরা ইয়াহিয়াকে নিষেধ করব না। তার এই কথায় পুরো গ্রুপ সায় দিয়েছে। মাথা নেড়েছে। মাথা তাদের নাড়তেই হবে। দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।

.

আমেরিকান দুই কূটনীতিক–ঢাকা থেকে আর্চার ব্লাড এবং দিল্লি থেকে রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং-ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠাচ্ছেন বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে। নির্বাচিত গণহত্যা (সিলেকটিভ জেনোসাইড) কথাটা তাঁরা ব্যবহার করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে, ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। এই খবরও পেয়েছেন কিসিঞ্জার। তিনি সিআইএর একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি অধ্যাপক রাজ্জাককেও হত্যা করেছে?

মনে হয়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককেই হত্যা করেছে।

এবার কিসিঞ্জার চুপ করে গেলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পরিচিত মুখটাকে, যার নাম রাজ্জাক। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি স্তব্ধ হয়ে রইলেন।

১৮

মমিনুল হক খোকা গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে জামাল। পেছনে রেনু, রেহানা, জেলি। গাড়ির মেঝেতে রাসেল। রেনু বড় করে ঘোমটা দিয়ে রেখেছেন, যেন কেউ চিনতে না পারে। গাড়ি চলেছে মগবাজার থেকে ওয়ারীর দিকে। ওয়ারী বলধা গার্ডেনের পাশে বাবু ভিলা। খোকার শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই থাকবেন। বেগম মুজিব এবং তাঁর সন্তানেরা।

গাড়ি চলছে। দুই ধারে ধ্বংসযজ্ঞ। রাস্তার ধারে লাশ পড়ে আছে। কুকুর আর কাক লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন একটা। পোড়া বস্তি।

ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো আগুন পুরোপুরি নেভেনি। নিউজপ্রিন্টের স্তূপ থেকে এখনো আগুনের শিখা এবং ধোঁয়া বের। হচ্ছে। বাতাসে ছাই উড়ছে। দেখে শিউরে উঠলেন রেনু। মানিক মিয়ার ইত্তেফাক। হাসুর আব্বার সবচেয়ে বড় সমর্থক। বাঙালির অধিকার আদায়ের সবচেয়ে বড় কণ্ঠস্বর। কত প্রিয় পরিচিতজনই তো ইত্তেফাক-এ কাজ করেন। ২৫ মার্চ রাতেও তো কাজ করছিলেন। তারা কি বেঁচে আছেন?

বাবু ভিলার সামনে গাড়ি দাঁড়াল। গাছপালাঢাকা এক সুন্দর বাড়ি। আরোহীরা গাড়ি থেকে নামলেন।

গাড়ির শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন খোকার শাশুড়ি। খোকার শ্যালকেরা। তারা বেগম মুজিবকে পেয়ে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। কী করবেন, কোথায় রাখবেন, কী খাওয়াবেন, কী করলে তাদের যোগ্য সমাদর হবে, এই নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খোকার শাশুড়ি বললেন রেনুকে, মা, তুমি একদম দুশ্চিন্তা করবে না। নিশ্চিন্ত মনে এখানে থাকবে। আমরা তোমাদের। কোনো অযত্ন হতে দেব না। আর আমার ছেলেগুলোকে দেখেছ। সব তো। পাহাড়ি সাইজ। ওরা লাঠি হাতে পালা করে পাহারা দেবে। কেউ তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

তারা দিনে এই বাড়িতে থাকবেন। রাতে তাদের রাখা হবে পেছনের একটা ফাঁকা বাড়িতে। পেছনের বাড়িতে যেতে হলে দেয়াল টপকাতে হবে। মইয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

খোকার শাশুড়ি বললেন, অসম্ভব। বউমাকে কিছুতেই আমি দেয়াল। টপকাতে দেব না। পাঁচিল ভাঙো।

মিস্ত্রি ডেকে দুই বাড়ির মধ্যকার দেয়াল ভেঙে রাস্তা বানানো হলো।

কিন্তু পাড়াপড়শিরা জেনে গেলেন যে শেখ মুজিবের পরিবার এই বাড়িতে থাকেন। তারা যেমন নিজেদের জন্য ভয় পেতে লাগলেন, তেমনি বেগম মুজিবও এই বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ বলে মনে করলেন না। তিনি খোকাকে বললেন, বাড়ি খোজো। এই বাড়ি তো আমার শেষ আশ্রয় হিসেবে থাকলই। আপাতত অন্য কোথাও যাই।

খোকা চেনেন তাঁর ভাবিকে। ভাবি যখন বলেছেন, তখন তাঁর কথা শুনতেই হবে। বাসা একটা দেখতেই হবে। বিশেষ করে পড়শিদের চোখে মুখে ভয়, এটা খোকার শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য যে বিব্রতকর, ভাবি তা অনুভব করতে পারছেন। তাঁর জন্য আরেকটা ফ্যামিলি কথা শুনুক, এটা তিনি হতে দেবেনই না। রেনু বললেন, খোকা, হাসুর কাছাকাছি থাকতে হবে। মালিবাগের দিকে চল।

খোকা একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে গেলেন মালিবাগের দিকে। বহু বাড়িতে টু-লেট দেখা ঝুলছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে নেমে বাড়ি দেখলেন। একটা বাসা বেশ পছন্দ হওয়ারই মতো। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বললেন খোকা। ভাড়া কত, শর্ত কী কী, সব পাকা হলো।

খোকা খুশি। এই রকম একটা বাড়ি হলে কথাই নেই। এখানে হাসুদেরও এনে রাখা যাবে। যে বেবিট্যাক্সি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা নিয়েই ফিরে এলেন ওয়ারীতে।

রেনু বিদায় নিলেন খোকার শাশুড়িদের কাছ থেকে, মাওইমা, আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করলেন। আসি মাওইমা। ভালো থাকবেন। রেনু, জামাল, রাসেল, রেহানা গাড়িতে গিয়ে বসলেন। গাড়ি চলছে। ততক্ষণে রোদ মরে এসেছে, বিকেল হয়ে গেছে। মালিবাগ পৌঁছাতে পৌঁছাতে রোদ সিঁদুরে আমের মতো লাল হয়ে এল।

মালিবাগ তখন অজপাড়াগা। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই কোত্থেকে ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ এসে ভিড় করল। গাড়ি ঘিরে দাঁড়াল। ঢাকা শহরে তো গাড়ির সংখ্যা এমনিতেই কম। তার মধ্যে এই জলো-জংলা জায়গা। এখানকার মানুষ কি এর আগে গাড়ি দেখেনি নাকি?

এখন এর মধ্যে তারা গাড়ি থেকে নামবেন কী করে? নামার সঙ্গে সঙ্গে লোকে চিনে ফেলবে যে বেগম মুজিব নামলেন। তারা দেখে ফেলবে তারা কোন বাসায় উঠলেন। জানাজানি হয়ে যাবে। মিলিটারি চলে আসবে। এ তো এক ভয়াবহ ব্যাপার হলো।

এদিকে সন্ধ্যা তার কালো মশারি নামিয়ে ফেলছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। একটু পরে শুরু হয়ে যাবে কারফিউ। তখন তো গাড়ি নিয়েও চলা যাবে না। এখন? ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

রেনু বললেন, ভাইডি। আগে গাড়ি এখান থেকে নড়াও।

খোকা গাড়ির ব্রেক থেকে পা সরালেন। গিয়ারে হাত দিয়ে গিয়ার বদলে বাঁ পায়ে ক্লাচ চেপে ধরে ডান পা রাখলেন অ্যাক্সিলারেটরে। গাড়ি চলতে শুরু করল।

অন্ধকার নেমে এসেছে। গাড়ির হেডলাইট জ্বালাতে হলো। বড় রাস্তায় ওঠা মানেই বিপদ। বড় রাস্তায় কারফিউ।

মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার রাস্তায় গাড়ি চলছে। ফাঁকা ফাঁকা ঘরবাড়ি। প্লটে প্লটে বড় বড় ঘাস। কাশবন। রাস্তায় কোনো লোক নেই। লোকজন থাকার প্রশ্নও আসে না। কারফিউ।

এর মধ্যে বিপরীত দিক থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি আসছে দেখা গেল। রেহানা বললেন, চাচা, ওইটা মিলিটারির গাড়ি না তো।

রেনু বললেন, খোকা, গাড়ি গলির মধ্যে ঢোকা।

খোকা সামনে ডানে-বাঁয়ে আর কোনো গলি দেখেন না। বাঁয়ে একটা পলেস্তারা খসা দোতলা বাড়ি। বড় বাউন্ডারি। গেট খোলা। একমাত্র উপায় এই বাউন্ডারির ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দেওয়া। তা-ই করলেন তিনি। অচেনা অজানা একটা বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে হেডলাইট নিভিয়ে দিলেন। হেঁটে এসে পেছনের গেটটা দিলেন বন্ধ করে।

রেনু বললেন, কেউ যদি আপত্তি না করে, তাইলে আমরা রাতটা গাড়িতেই কাটায়ে দিব খোকা। তুই ভাইডি একদম চিন্তা করবি নে।

খোকা বললেন, আমি একটু দেখি, মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি ফাঁকা। মানুষজন

থাকলে ঘরের ভেতরেই থাকা যাবে। দেখে আসি।

খোকা পোড়ো বাড়িটার নিচতলায় উঠলেন। এ ঘর ফাঁকা। ও ঘর ফাঁকা। অন্ধকারে ফাঁকা ঘরগুলোয় মনে হচ্ছে অশরীরী ছায়া পাখা বিস্তার করে আছে। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছেন খোকা।

দোতলাও মনে হচ্ছে ফাঁকা। তবে একটু যেন প্রাণের সাড়া, একটুখানি নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। আচ্ছা, উঠেই দেখি না দোতলাটা। একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলেন। একটা ঘরে কেউ নেই। আরেকটা ঘরে মনে হচ্ছে মানুষ আছে। একটুখানি আলোও জ্বলছে। তিনি দরজায় নক করলেন। তারপর ভেতরে কেউ আছেন বলে কপাট ঠেললেন।

ও মা এ কী? এ-ও কি সম্ভব?

মামা! আপনি! বলে ছুটে আসছেন পলি। বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের মেয়ে। পাশেই দেখা গেল তার স্বামী ওদুদকে।

খোকা নিচে গেলেন। বললেন, ভাবি আসেন। ওপরে পলি আছে। ওদুদ আছে। চলেন চলেন।

বলিস কী? রেনু ওপরে উঠলেন। মামিকে পেয়ে পলি জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। দুই নারী কাঁদতে লাগলেন অঝোরে। দুজনের অশ্রুধারা একধারায় বইতে লাগল।

পলিরা এই বাড়িতে আজই উঠেছেন। আসবাব নেই। বাসনকোসনও নেই। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে কাল তারা বাজারসদাই করবেন। চাদর বিছিয়ে কোনোরকমে আছেন। তবে তার শ্বশুর-শাশুড়ি দুজন। এই বাড়িতে থাকেন। কাজেই তেমন অসুবিধা হবে না।

বাড়িতে খাবার নেই। রাসেলের মুখটা এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে।

পলি বললেন, মামি, এই ছিল আমাদের কপালে। ফাঁকা বাড়িতে আপনাদের তুলতে হলো! এই বাড়িতে তো আমরা থাকি না। আমরা ভয়ে এই বাড়িতে এসে উঠেছি।

রেনু বললেন, আমাদের আর কী কষ্ট! ভেবে দ্যাখ, তোর মামা কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে কি না, আমরা তো কিছুই জানি না। সে কী খাচ্ছে, কোথায় ঘুমাচ্ছে। আল্লাহর কাছে চাই শুধু মানুষটা যেন বেঁচে থাকে!

পলি বলল, ঠিক কথা মামি। আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই করি। মাকে কাঁদতে দেখে কাঁদছেন রেহানা। কাঁদতে লাগল রাসেলও। জামাল তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, চলো রাসেল, ওই দেখো নিচে থোকা চাচার গাড়ি!

রাসেল কোল থেকে নামতে চাইছে। সে বড় হয়ে গেছে। সে জানে, একটা বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একজন বড় মানুষ হিসেবেই সে এই ঝড়টাকে সামলাতে চাইছে। মা কাঁদছেন বলেই তারও কান্না পাচ্ছে। আর আব্বার কথা উঠল যে! আব্বা এখন কোথায় আছে? বেঁচে আছে কি না! সেই ভয়াবহ রাতে গুলির শব্দের মধ্যে আগুন, আলো, ভয়ের মধ্যে আব্বা তো তাকেই দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। তারপর আব্বাকে ধরে নিয়ে গেল। কত কান্নাকাটি, কত আগুন, কত গোলাগুলি, কত রক্ত, কত এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলা।

রাসেল বলল, জামাল ভাই, আব্বা কোথায়? চলো না আব্বাকে খুঁজতে যাই!

এইবার জামালেরও চোখ মোছার পালা!

১৯

হাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠেছিলেন তাজউদ্দীন ও আমীর। কিন্তু রিকশা বেশি দূর যেতে পারল না। পথে পথে ব্যারিকেড। রিকশা ছেড়ে হাঁটতে হচ্ছে।

বিপরীত দিক থেকে একটা জিপ আসছে। সবুজ রঙের জিপ। ভয়াবহ ব্যাপার! তাজউদ্দীন, আমীর-উল একটা গাছের আড়ালে নিজেদের আড়াল করলেন। জিপটাতে তো দেখা যাচ্ছে সাদাপোশাকের বেসামরিক লোকদেরই। তারা রাস্তায় উঠলেন। হাত নেড়ে ইশারা করলেন জিপ থামাতে।

জিপটা থামল। আমীর জিজ্ঞাসা করলেন ড্রাইভারকে, জিপে কে যাচ্ছেন?

এসডিও সাহেব। ড্রাইভার বলল।

পাশের আরোহী বললেন, আমি শাহ মোহাম্মদ ফরিদ। রাজবাড়ীর এসডিও।

আচ্ছা, কী খবর? কোত্থেকে আসছেন? আমীর বললেন।

শাহ মোহাম্মদ ফরিদ বললেন, আমি তো চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। খবর ভালো। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর–সবখানে প্রতিরোধসংগ্রাম খুব ভালোভাবে চলছে। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর মুক্ত হয়ে গেছে। এখন কুষ্টিয়া দখলের প্রস্তুতি চলছে।

আমীর বললেন, বর্ডারের দিকের কী খবর। বর্ডার পর্যন্ত যাওয়া যাবে?

যাবে স্যার। কোনো অসুবিধা নাই।

আচ্ছা আমরা তাহলে চলি। আমীর আর কথা বাড়ালেন না। প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান।

জিপও চলে গেল। আমীর বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, এসডিও মনে হয় আমাদের চিনতে পারে নাই।

তাজউদ্দীন বললেন, না চেনাই ভালো।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ আসার পর পাওয়া গেল একটা বাস। দুজনে বাসে উঠে বসলেন। যাক। খানিকটা তো বসা গেল। সেই বাসও বেশি দূর যেতে পারল না। রাস্তায় বিশাল বিশাল গাছ কেটে রাখা হয়েছে। সেই গাছ সরিয়ে এগোনোর সাধ্য কারও নেই।

তাঁরা দুজন বাস থেকে নামলেন। গাছের ব্যারিকেডের ওপরে উঠলেন। পায়ের ফোঁসকা কষ্ট দিচ্ছে। কী আর করা! হাঁটা অব্যাহত রইল।

.

এভাবে হেঁটে রিকশায়-বাসে চড়ে আবার হেঁটে দুজন এসে পৌঁছেছেন মধুমতী নদীর পারে। ততক্ষণে আকাশ কালো হয়ে গেছে। যেকোনো সময় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। সন্ধ্যাও নেমে আসছে দ্রুত। কামারখালী ঘাটে একটা দোকানে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চলছে। ঘোষণা আসছে : আপনারা সাবধান থাকুন। পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডোরা বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। তারা আক্রমণ করতে পারে।

নৌকা দরকার। নদী পার হতে হবে। ঘাটে নৌকা বাঁধা। কিন্তু কোনো মাঝি রাজি হয় না। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। আমীর ভিজছেন। তাজউদ্দীন ভিজছেন। এই পারে থাকা মানে মূল্যবান সময়ের অপচয়। আজকের রাতটা তাঁরা পথ চলতে চান। যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। তাজউদ্দীন ভাবছেন, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারে নানা ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। এগুলো কে দিচ্ছে, কে জানে। সমন্বয় দরকার। তা না হলে দেখা যাবে, চার জায়গায় চারটা সরকার। চার রকমের ঘোষণা।

একজন বলল, আপনেরা ওই বুড়া মিয়াকে ধরেন। ওনার বাড়ি ওই পারে। ওনাকে তো বাড়ি যেতেই হবে। ধরেন ওনাকে।

আমীর এগিয়ে গেলেন, চাচা! আপনার বাড়ি নদীর ওই পারে?

জি বাবা।

আমারও বাড়ি নদীর ওই পারে। চলেন, আল্লাহর নামে চলে যাই। শুধু। তো বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় তো আর হচ্ছে না।

যাবেন। ভরসা পান?

জি চাচা চলেন। নদীর পানি তো শান্ত আছে। ঢেউ তো নাই।

আচ্ছা চলেন, আল্লাহর নামে পাড়ি দেই।

তারা উঠলেন নৌকায়। মাঝনদীতে বৃষ্টি থেমে গেল। তবে ঘনঘোর অন্ধকার। শুধু নদীর কল্লোল আর বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওই পারে ঘাটে আলো আছে। সেই আলো অভিমুখে চলছে এই নৌকা। একসময় নৌকা ঘাটে এসে পৌঁছাল। মাঝির হাতে পাড়ানির টাকা তুলে দিয়ে দুজন ঘাটে নামলেন।

নদীর পশ্চিম পারে আরও কিছুসংখ্যক মানুষ যানবাহনের খোঁজ করছে। এখান থেকে মাগুরা শহর প্রায় আট মাইল দূরে। কোনো যানবাহন নেই। ২৫-৩০ জন মানুষ একসঙ্গে রওনা হলেন। আমীর আর তাজউদ্দীনও হাঁটছেন। সেই কাফেলা ধরে।

বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা খারাপ। এখানে-ওখানে কাদা। হাঁটতে হাঁটতে আমীর আর তাজউদ্দীনের ভেজা কাপড় শরীরেই শুকাল।

সামনে ছোট্ট একটা খাল। খালের ওপরে আগুন জ্বলছে। কী ব্যাপার? একটা কাঠের সেতু ছিল। প্রতিরোধকামী জনতা সেটাতে আগুন দিয়েছে, যাতে ঢাকা বা ফরিদপুর থেকে পাকিস্তানি সৈন্য এসে পৌঁছাতে না পারে। সংগ্রাম পরিষদের ছেলেরা খাল পাহারা দিচ্ছে। এই ২৫-৩০ জনের দলের প্রত্যেককে তারা দেহতল্লাশি করল।

তাজউদ্দীন আহমদের পাঞ্জাবির ভেতরে বুকের কাছে এক গোপন পকেটে পাওয়া গেল পিস্তল।

সেটাতে হাত দিয়েই আওয়ামী লীগের কর্মী টর্চলাইটের আলো ধরলেন তাজউদ্দীনের মুখের দিকে। ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন তার মুখটাকে। তিন দিনের না কামানো দাড়ি। পরনে লুঙ্গি। লোকটা কে? তাঁর বুকপকেটে পিস্তল কেন? একমুহূর্ত নিলেন তিনি ভাবতে, তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন, লিডার। আপনাকে চিনতে পারছি। আপনি তাজুদ্দীন ভাই। ভাই, আমি ওয়াহেদ।

ওয়াহেদ, বেশি আওয়াজ দিয়ো না। চুপচাপ আমাদের ওই পারে নিয়ে চলো। আমাদের পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ কোরো না।

নৌকা লাগানো হলো ঘাটে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। নৌকা চলতে আরম্ভ করল। ওপাশ থেকে চিৎকার : কে আসে?

বন্ধু।

ঠিক আছে, আসো।

ওই পারে দেখা গেল, রীতিমতো মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। বন্দুক কাঁধে ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে। আনসার বাহিনীর সদস্যরা আছে।

তাজউদ্দীন বললেন, সোহরাব সাহেবের বাড়িতে যাব। সোহরাব সাহেব কোথায়?

সোহরাব সাহেব তো বাড়ি নাই। তবে তার বাড়ি যাওয়ার পথেই তার দেখা আপনেরা পাবেন। চলেন আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।

রিকশাও জোগাড় হয়ে গেল।

রাত তিনটায় তাঁরা পৌঁছালেন মাগুরায় সোহরাব হোসেনের বাড়ি। গোসল সারলেন। রাতের বেলা ভাত চড়ানো হলো চুলায়। খেতে বসলেন। চারটায়। ৩০ মার্চ ১৯৭১। ভোর হচ্ছে।

ঘণ্টা দুয়েক তারা একটুখানি ঘুমিয়ে নিলেন। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লেন পথে। এইবার সোহরাব হোসেনের জোগাড় করা জিপে।

সোহরাব হোসেনই বললেন, মাগুরার এসডিও কামাল সিদ্দিকী খুব ভালো কাজ করছেন। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, সবাইকে নিয়ে বাহিনী গড়ে তুলেছেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সমন্বয় করছেন। ইনশা আল্লাহ জয় আমাদের হবেই।

গাড়ি মাগুরা-ঝিনাইদহ সদর রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল।

সকালবেলা রোদ উঠেছে। গ্রাম-গ্রামান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। সোহরাব আর আমীর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন।

তাজউদ্দীন চুপ করে আছেন। কী সুন্দর নীলাকাশ। কী সুন্দর সবুজ বিস্তৃত মাঠ। কলাইয়ের খেত। কোথাওবা চষা জমি। জল-জঙ্গল-বিল। হাঁস যাচ্ছে দল বেঁধে, সড়কের ওপর দিয়ে। একটা ছাগলের দড়ি ধরে টানছে একটা কিশোরী। গাড়ি দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। একপাল আধা ন্যাংটো ছেলে দৌড়ে আসছে জিপের পিছু পিছু। কলাগাছের ফাঁকে একটা বেগুনি শাড়ি পরা বধূ ঘোমটা বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ির ধূলি ওড়ানো দেখছে।

তাজউদ্দীন ভাবছেন, রবীন্দ্রনাথের লিপিকায় পড়েছেন–

এই তো পায়ে চলার পথ।

এসেছে বনের মধ্যে দিয়ে মাঠে, মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারে, খেয়াঘাটের পাশে বটগাছের তলায়। তার পরে ও পারের ভাঙা ঘাট থেকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের মধ্যে; তার পরে তিসির ক্ষেতের ধার দিয়ে, আমবাগানের ছায়া দিয়ে, পদ্মদিঘির পাড় দিয়ে, রথতলার পাশ দিয়ে কোন্ গায়ে গিয়ে পৌচেছে জানিনে।

এই পথে কত মানুষ কেউ বা আমার পাশ দিয়ে চলে গেছে, কেউ বা সঙ্গ নিয়েছে, কাউকে বা দূর থেকে দেখা গেল; কারো বা ঘোমটা আছে, কারো বা নেই; কেউ বা জল ভরতে চলেছে, কেউ বা জল নিয়ে ফিরে এল।

২. এখন দিন গিয়েছে, অন্ধকার হয়ে আসে।

একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল আমারই পথ, একান্তই আমার; এখন দেখছি কেবল একটিবার মাত্র এই পথ দিয়ে চলার হুকুম নিয়ে এসেছি, আর নয়।

নেবুতলা উজিয়ে সেই পুকুরপাড়, দ্বাদশ দেউলের ঘাট, নদীর চর, গোয়ালবাড়ি, ধানের গোলা পেরিয়ে সেই চেনা চাউনি, চেনা কথা, চেনা মুখের মহলে আর একটিবারও ফিরে গিয়ে বলা হবে না, এই যে! এ পথ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়।

তাজউদ্দীন ভাবছেন, এ যেন তাঁর শুধু চলার পথ না হয়, যেন তাঁর ফেরার পথও হয়। তা হতেই হবে। তা না হলে এই শাশ্বত বাংলা যে আর থাকবে না!

১০টা ৩০ মিনিটে গাড়ি গিয়ে থামল ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আজিজ সাহেবের বাড়ির প্রাঙ্গণে। তিনি এলাকার সংসদ সদস্যও। বাড়ির সেই ভোলাজুড়ে অনেক কবুতর। সাদা, কালো, বাদামি কবুতরগুলো গাড়ি দেখেও সাইড দিচ্ছিল না। শেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটুখানি উড়ে একটুখানি সরে গিয়ে জায়গা করে দিল।

আজিজ ছুটে এলেন। আসেন আসেন। এই দুর্দিনে কী সৌভাগ্য আমার। স্বয়ং তাজউদ্দীন ভাই। ব্যারিস্টার ভাই। আসেন আসেন।

আমীর বললেন, আমাদের আসল নাম বলবেন না কাউকে। ওনার নাম মোহাম্মদ আলী, আর আমার নাম রহমত আলী।

আজিজ সাহেব বললেন, জি আমীর ভাই জি, কাউকে নাম বলব না।

ঝিনাইদহের সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী। এই দুজনকে আজিজ সাহেব খবর পাঠালেন। তারা গাড়ি নিয়ে চলে এলেন।

মাহবুব বললেন, কী অবস্থা হয়েছে যে আপনাদের চেহারার। আমি তো চিনতেই পারছিলাম না।

আমীর বললেন, আপনি পুলিশ হয়ে না চিনলে চলবে? গ্রামে-গঞ্জে লোকেরা কিন্তু আমাদের ঠিকই চিনে ফেলেছে।

তাজউদ্দীন বললেন, কেউ না চিনুক, সেই রকম বেশ নিতেই তো চেয়েছি। কী অবস্থা এখানে বলেন।

তৌফিক-ই-ইলাহী মানুষটা ছোটখাটো। কিন্তু কথায় স্পষ্ট। কাজে নিখুঁত। তিনি পুরো পরিস্থিতির একটা ছবি তুলে ধরলেন।

বললেন, এখানে ইপিআরের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। তিনি তাঁর পুরো বাহিনী নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। মাহবুব সাহেবের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ, কুষ্টিয়ার পুলিশ, মেহেরপুরের পুলিশ, আনসার-সব আমাদের সঙ্গে।

মাহবুব বললেন, আজকেও কুষ্টিয়ায় যুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের বাহিনী হাজার হাজার মানুষ সঙ্গে নিয়ে কুষ্টিয়া সার্কিট হাউস ঘেরাও করেছে। তবে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র করে। ২৮ মার্চ ঘুমন্ত বাঙালি সৈনিক আর তাদের পরিবার-পরিজন, নারী শিশু সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলে। ওদেরকে বলা হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। ওরা বাইরেই ছিল। চৌগাছা ছিল। ওসমান সাহেব চিঠি দিয়েছিলেন। ওরা বোকার মতো ফিরে গিয়ে অস্ত্র জমা দেয়। তারপর সবাই মিলে মারা পড়ে। দুধের শিশু পর্যন্ত রক্ষা পায়নি।

কুষ্টিয়ার নেতা ডা. আসহাব-উল হক জোয়ারদার এলেন।

আরও দু-চারজন নেতা এসেছেন।

তাঁদের সবার কথা, অস্ত্র দেন। গোলাবারুদ দেন। আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করব। যশোর পুরাটাই দখল করে নেব।

বোঝা গেল, এদের সঙ্গে পরামর্শ করা যাবে। মাহবুব এবং তৌফিক-ই ইলাহীকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাজউদ্দীন বললেন, তোমাদের এক কাজ করতে হবে। আমাদের একটু বর্ডারে নিয়ে যেতে হবে। মুজিব ভাই আমাদের একটা ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। কলকাতার। সেখানে গেলে সাপোর্ট পাওয়া যাবে। এটা মুজিব ভাইয়ের আদেশ। তিনি বলেছেন, ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করলে অস্ত্র-গোলাবারুদ-ট্রেনিং পাওয়া যাবে। তোমরা কী বলো?

মাহবুব এবং তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমাদের অস্ত্র দরকার। গোলাবারুদ দরকার। তাহলে আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো দক্ষিণ পশ্চিম বাংলা মুক্ত করে ফেলতে পারব। আমি এরই মধ্যে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাদের কাছে অস্ত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছি। ওরা আমাদের কাছে জানতে চায়, রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সঙ্গে আছে কি না। শুধু অফিসারের চিঠির ওপরে ওরা ভরসা করতে পারছে না। আপনারা দুজন যদি বিএসএফের সঙ্গে কথা বলেন, ওরা অস্ত্রশস্ত্র দেবে। বিএসএফের আইজি গোলোক মজুমদার জাতীয় নেতা কাউকে খুঁজছেন। আপনারা চলেন আমাদের সঙ্গে বর্ডারে।

ঝিনাইদহ ছেড়ে যাচ্ছে গাড়ি। দেখা গেল, হাজার হাজার মানুষ দা, কুড়াল, বল্লম, শাবল নিয়ে ট্রাকে করে করে যাচ্ছে, তাদের মুখে স্লোগান, যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয় বাংলা। মাহবুব বললেন, জনতা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রেখেছে। কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘেরাও করে রেখেছে মুক্তিকামী জনতা। দুপক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ডিসি সাহেব মারা গেছেন।

সামনের জিপে তৌফিক-ই-ইলাহী। ওই গাড়ি ড্রাইভার চালাচ্ছে। পেছনে জিপে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন মাহবুব। পেছনের আসনে তাজউদ্দীন আর আমীর। তারা প্রথমে গেলেন চুয়াডাঙ্গা। সার্কিট হাউসের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সামরিক সদর দপ্তর। তিনি বেরিয়ে এসে জিপের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে কথা বলে নিলেন দুই নেতার সঙ্গে। দ্রুত বেলা পড়ে আসছে। আবার রওনা দেওয়া দরকার।

আবার স্টার্ট নিল দুই জিপ। তাজউদ্দীনের পরনে তেমনি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। ময়লা হয়ে সেসবের আদি রং আর বোঝা যাচ্ছে না।

তাঁরা পৌঁছালেন জীবননগর থানায়। এটা সীমান্তের সবচেয়ে নিকটবর্তী থানা। সেখান থেকে তারা এগিয়ে গেলেন বেতনাপুর সীমান্তচৌকির দিকে।

সীমান্তের কাছাকাছি একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হলো।

এবার তাঁরা হাঁটতে লাগলেন ভারত সীমান্তের দিকে। নো ম্যানস ল্যান্ডে গিয়ে তাজউদ্দীন এবং আমীর একটা কালভার্টের ওপরে গিয়ে বসলেন। রোদ মরে আসছে। আকাশের মেঘে মেঘে হলুদ, লাল, খয়েরি তুলির টান। ছোট্ট খাল। খালে পানি নেই। কচুরিপানা কাদামাটিতে বেগুনি রঙের ফুল ফুটিয়ে রেখেছে। কাটাগুল্মের আড়ালে একটা বেজি দুপায়ে দাঁড়িয়ে মাথা বাড়িয়ে আগন্তুকদের নিরীক্ষণ করছে।

মাহবুব আর তৌফিক তাজউদ্দীনের সামনে। অস্তগামী সূর্যের লাল আভা পড়েছে দুই যুবকের চোখে-মুখে-চুলে।

তাজউদ্দীন বললেন, মাহবুব-তৌফিক, তোমরা বর্ডার পার হও। তোমরা স্বাধীন দেশের অফিসার। তোমাদের পাঠানো হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। আমাদের স্বাধীন দেশের নেতা হিসেবে ওয়েলকাম জানাতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা ভারতে ঢুকব। তা না হলে জনগণের মধ্যে থেকে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

জি আচ্ছা স্যার। বললেন দুজনেই। সরকারি অফিসার হিসেবে স্যার বলাটা তাদের অভ্যাসের অংশ। আর ১ মার্চ থেকে দেশ যে ৩২ নম্বর থেকে পরিচালিত হয়েছে, আর আদেশগুলো যে তাজউদ্দীন লিখতেন, সেসব খবর তো এই দুজনের অজানা নয়।

তাঁরা দুজন ধীরে ধীরে সীমান্তের দিকে চলে গেলেন।

তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম অপেক্ষা করছেন।

সূর্য ডুবে গেল। আকাশে তবু আভা। তাদের শরীর ক্লান্ত। তারা দুজন দুই রেলিংয়ের ওপরে শুয়ে পড়লেন।

তাজউদ্দীনের মনে হলো :

কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যারবি
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।

.

মাহবুব আর তৌফিক হাঁটছেন। অন্ধকার নেমে আসছে। তারা যাচ্ছেন অচেনা বিওপির দিকে। নিজেদের পায়ের শব্দে নিজেরাই চমকে উঠছেন। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল : হুকুমদার! (হু কামস দেয়ার!)।

মাহবুব বললেন, ফ্রেন্ডস!

হ্যান্ডস আপ!

দুজনেই হাত মাথার ওপরে তুললেন।

এগিয়ে এলেন এক নবীন বিএসএফ অফিসার। তিনি পরিচয় দিলেন, আই অ্যাম মহাপাত্র, বিএসএফ।

ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন তৌফিক। মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশ।

.

আকাশের আভা নিভে যাচ্ছে। তারা উঠছে। জোনাকির আলো জ্বলছে-নিভছে মাথার ওপরে।

কী হলো, তাজউদ্দীন ভাই, ওরা যে আর ফেরে না। আমীর বললেন।

তাজউদ্দীন বললেন, হয়তো ওরা কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। হয়তো ওরা দিল্লিকে জানাচ্ছে।

প্রচণ্ড গরম। একটু একটু করে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করল। হঠাৎ ঝোঁপের ভেতর থেকে অন্ধকারের মধ্যে ধপধপ বুটের আওয়াজ।

ড্রাইভার ছুটে এল আগে আগে। বলল, একজন মেজর আসছেন।

তাজউদ্দীন আর আমীর উঠে বসলেন। মেজর এসে স্যালুট দিলেন দুজনকে।

সঙ্গে এলেন মাহবুব আর তৌফিক।

মাহবুব ফিসফিস করে বললেন, গোলোক মজুমদারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। উনি শুনেছেন যে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের দুজন। এসেছেন। শেখ মুজিবও হতে পারেন। বিএসএফের গোয়েন্দারা তাঁকে আগে থেকেই ইনফর্ম করে রেখেছিল। তাই তিনি নিজেই আপনাদের খোঁজে এই দিকটায় আসছিলেন…

আমি তাকে আপনাদের পরিচয় দিয়েছি। বলেছি, আপনারা ভারতে আসতে নারাজ। দেশের ভেতরে থেকেই সংগ্রাম করতে চান। তিনি আমাদের অনেক করে বোঝালেন। দেশে মুসলিম লীগার আছে, জামায়াত আছে, শত্রু কম নয়। ওদের এপারে চলে আসতে বলুন। আমরা বলেছি, ওরা আসবেন। গার্ড অব অনার দিতে হবে। সেই ব্যবস্থাও হয়েছে।

বিএসএফের অফিসার বললেন, স্যার, ইউ আর ইনভাইটেড টু আওয়ার ক্যাম্প। আমাদের বিএসএফের ইস্টার্ন জোনের আইজি গোলোক মজুমদার আসছেন, আপনাদের রিসিভ করার জন্য।

তাঁরা দুজন হাঁটতে লাগলেন। হেঁটে নো ম্যানস ল্যান্ড পার হলেন। তাজউদ্দীনের বুক ব্যথা করছে। একটা অসহ্য চাপ। নিজের দেশের মাটির বাইরে তিনি পা রাখছেন। অন্ধকারের ভেতর। অজানার ভেতর। রাতের অন্ধকারে শুধু সাধ্যমতো আলো দিয়ে যাচ্ছে জোনাকি। আহা আমার দেশ! আহা আমার দেশের মাটি!

সীমান্তের ওপারে তাজউদ্দীন ও আমীরকে গার্ড অব অনার দেওয়া হলো। সারিবদ্ধ বিএসএফ জওয়ানদের বড় বড় ছায়া পড়েছে মাটিতে।

আলো জ্বলছে ক্যাম্পের সামনে। সালাম গ্রহণ করে তারা ক্যাম্পে গিয়ে বসলেন। তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন কর্নেল চক্রবর্তী। চা-বিস্কুট-ফল দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো।

আমাদের আইজি আসছেন-কর্নেল চক্রবর্তী জানালেন।

বিএসএফ অফিসারদের একজন বললেন, শেখ সাহেবের মেসেজ আমাদের কাছে আছে। টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে মেসেজ এসেছে। আমাদের কাছে প্রিন্ট আছে। তখন তারা একটা কাগজ দেখালেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। তাজউদ্দীন আহমদ টেলেক্স বার্তাটা বারবার করে পড়লেন। একটুখানি শিহরিত হলেন। একটুখানি উদ্বেগও। মুজিব ভাই এখন কোথায় কে জানে? কোন অকূল পাথারে। তাজউদ্দীন তরি ভাসাতে যাচ্ছেন!

.

গোলোক মজুমদার এলেন। পশ্চিমবঙ্গ বিএসএফের আইজি। বছর ৪৫ এর মতো বয়স। ধারালো নাক, তীক্ষ্ণ চিবুক, জ্বলজ্বলে চোখ। পরনে বিএসএফের তারকাখচিত ইউনিফরম। দুহাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। বললেন, একেবারে কৃষকের বেশ নিয়ে এসেছেন। কে বলবে যে ইনি আওয়ামী লীগের সেকেন্ড ইন কমান্ড শেখ মুজিবের ডান হাত তাজউদ্দীন।

ব্যারিস্টার আমীর নিজের পরিচয় দিলেন।

তাজউদ্দীন বললেন, মুজিব ভাই আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে। লড়াই চালিয়ে যেতে। তবে তিনি বের হতে পেরেছেন। কি না জানি না। তিনি কোথায় আছেন কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না, আমরা কেউই সেটা বলতে পারছি না। এই নিয়েই আমার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তবে মুজিব ভাই আমাদের বলে রেখেছেন, ভারত আমাদের শেষ ভরসা। আগেই ভরসার জায়গাটা নষ্ট কোরো না। ওদের বিব্রত কোরো না। তাই আমরা দেশেই ফিরে যাব।

না না। ভারত একদম বিব্রত হবে না। আপনাদের পাশে ভারত আছে। আমাদের পার্লামেন্টে এ নিয়ে কথা হয়েছে।

আমাদের এখন অস্ত্র-গোলাবারুদ দরকার। আপনি অস্ত্র-গোলাবারুদের ব্যবস্থা করুন। আপনি কথা দিন যে আপনারা অস্ত্র দেবেন। আর তা দেবেন। এখনই। অস্ত্র-গোলাবারুদ পেলেই আমরা সারা বাংলাদেশ থেকে একযোগে ঢাকায় ঢুকে পড়তে পারব এবং ঢাকা দখল করতে পারব। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সঙ্গে যাবে। বলুন, আপনারা অস্ত্রশস্ত্র দেবেন?

গোলোক মজুমদার বললেন, আপনাদের এই প্রশ্নের জবাব মাত্র একজনের কাছে আছে। তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজি। আপনি চাইলে আমি তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দিতে পারব! আপনারা আমার সঙ্গে চলুন।

কোথায়?

প্রথমে যাব দমদম এয়ারপোর্ট। বিএসএফের ডিজি রুস্তমজি আসছেন দিল্লি থেকে। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতেই। চলুন।

তাজউদ্দীনের জীবনে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন। মুজিব ভাই বলেছেন, ভারতকে বিব্রত কোরো না। আবার মুজিব ভাই-ই তাকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকার ভারতীয় উপহাইকমিশনে, মার্চের প্রথম সপ্তাহে, প্রস্তাবটা ছিল এই যে, মুজিব যদি ইউনিল্যাটেরাল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেনস করেন, যদি একপক্ষীয়ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে সাহায্য করবে? তারা কি বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেবে? তারা কি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং দরকার হলে ট্রেনিং দেবে? কাজেই মুজিব ভাইয়ের পক্ষ থেকে এটা পাওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ ছিল না তো বটেই, বরং অনুরোধই ছিল। ১৪ মার্চে বঙ্গবন্ধু আবার পাঠিয়েছিলেন। সুজাত আলীকে, ভারতের কাছ থেকে এই সংকটময় মুহূর্তে দরকারি সাহায্য চাওয়ার বার্তা নিয়ে। তাজউদ্দীন তা-ও জানেন। কাজেই যদি অস্ত্র, গোলাবারুদ সবকিছু পেতে হয়, তাহলে ভারতে যেতে হবে, আর যেহেতু গোলোক মজুমদার বলছেন যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার দেখা করিয়ে দেবেন, এই সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। কাজেই তিনি এই সুযোগটা নিতে চান। সে ক্ষেত্রে তার উচিত হবে তাঁর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেওয়া।

তিনি বললেন, তাহলে আমি একটু দেশের ভেতরে যাই। আমাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আসি।

ঠিক আছে। আসুন।

তাজউদ্দীন ও আমীর-উল আবার সীমান্ত অতিক্রম করলেন। তৌফিক আর মাহবুব তো ছিলেনই। বিএসএফের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অন্য নেতাদের খবর দেওয়া হলো। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এলেন। নির্বাচিত পরিষদ সদস্য আসহাব-উল হক এলেন। সবার সঙ্গে আলাপে তাজউদ্দীন খোলাখুলিভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে লাগলেন : আমাদের অস্ত্র লাগবে। ট্রেনিং লাগবে। সরকার লাগবে। হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করলে কোনো লাভ হবে না। কেবল মৃত্যুর সংখ্যাই বাড়বে। আপনারা অনুমতি দিলে আমি কলকাতা যাব, দিল্লি যাব, অস্ত্র, গোলাবারুদ চাইব। আপনারা কী বলেন।

সংসদ সদস্যরা এবং অফিসাররা তখন অস্ত্র আর গোলাবারুদের জন্য। মরিয়া হয়ে আছেন। আজকে কুষ্টিয়ার লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী জয়লাভ করেছে, আগামীকাল কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প দখল করা হবে। অস্ত্র চাই। অস্ত্র। আর অস্ত্র পেলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করা কোনো ব্যাপারই নয়।

সবাই বললেন, আপনি ভারতে যান। আমাদের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ পাঠান। আমরা লড়াই করব।

জয় বাংলা বলে সবার কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত বিদায় নিয়ে আবারও তাজউদ্দীন এবং আমীর-উল ফিরে এলেন নদীয়া জেলার টুঙ্গি সীমান্তচৌকিতে।

গোলোক মজুমদারের সঙ্গে তারা এক গাড়িতে উঠলেন। আরও আছেন কর্নেল চক্রবর্তী। গাড়ি চলেছে দমদম এয়ারপোর্টের দিকে।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, অহন আমারে কও। বিএসএফের ডিজি ছুঁইটা আসতাছেন। বিএসএফের আইজি আইসা বইসা আছেন বর্ডারে তাজউদ্দীনরে রিসিভ করবার জন্য। এইটা কি বিএসএফ নিজে নিজে করল? নাকি এইটা একটা পলিটিক্যাল ডিসিশন আছিল ভারতের!

ব্যাঙ্গমি বলল, ভারত একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাগো বিএসএফ দিল্লির গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া নিজেরা নড়াচড়া করা শুরু করল, এই রকম ভাবা একদম বোকামি হইব। হয়তো তারা ভাবছিল, শেখ সাহেব নিজেই আইছেন। তাগো গোয়েন্দারা তাগো ভুল খবর দিছিল। কিন্তু এইটা হইতেই পারে না যে দিল্লির অতি উচ্চ পর্যায় থাইকা হুকুম না পাইয়াই রুস্তমজি ছুঁইটা আসতেছেন দিল্লি থাইকা।

.

গাড়ি ছুটছে। অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে। সামনে-পেছনে বিএসএফের আরও আরও এসকর্ট গাড়ি। পেছনের গাড়ির হেডলাইট এই গাড়িতে পড়ছে। এই গাড়ির হেডলাইট সামনের গাড়িতে পড়ছে। পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম বাংলার দৃশ্যপটে খানিকটা পার্থক্য আছে। জল-জঙ্গল, বন-বনানী পশ্চিমে কম।

গোলোক মজুমদার বললেন, বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুবৃত্ত। বাংলায় চিরকাল বর্গিরা হানা দিয়েছে, কিন্তু কোনো দিনও এইখানে বাংলার মানুষের বীরত্বের সঙ্গে পারেনি। মানসিংহ এসে হার মেনেছেন ঈশা খাঁর তরবারির কাছে। আজকে পাঞ্জাবিরা এসেছে আপনাদের ধ্বংস করবে বলে, কিন্তু তারাও পারবে না। হার তাদের স্বীকার করতেই হবে। জয় বাংলার জয় হবেই।

দমদম এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জে গেলেন তারা। তাজউদ্দীন আর আমীর–দুজনের পোশাক লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। গোলোক মজুমদার নির্দেশ দিলেন, এঁদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করো। পোশাক এল। দাড়ি কামানোর রেজর এল, সাবান এল, ব্রাশ এল। ভিআইপি লাউঞ্জের বাথরুমে ঢুকে দুজনেই ভদ্রস্থ হয়ে এলেন। তাজউদ্দীন সবচেয়ে বেশি অনুভব করছিলেন চশমার অভাব। কাছের জিনিস দেখতে পারছিলেন না ঠিকমতো। রিডিং গ্লাস চলে এল।

রাত ১১টা ৪৫। দমদম বিমানবন্দর। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের একটা বিমান এসে বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। বিমান থেকে নেমে এলেন কে এফ রুস্তমজি। বিএসএফের ডিজি। একটা কালো অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এল। রুস্তমজি প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা। তিনি সোজা এলেন গোলোক মজুমদার, তাজউদ্দীন ও আমীর-উলের কাছে। হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন শেষে তারা অ্যাম্বাসেডরে উঠলেন।

গাড়ি গিয়ে থামল কলকাতার অসম হাউসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *