৫০
মেলাঘর গেরিলা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে জঙ্গলের মধ্যে প্রাতঃকৃত্য সেরে টিউবওয়েলের হাতল চেপে চেপে হাতমুখ ধুচ্ছিল ১৫ বছরের তৌফিকুর রহমান। তৌফিকুর তার ঢাকার শাহিন স্কুলের নাম। আব্বা-আম্মা তাকে ডাকেন পাশা বলে। শাহিন স্কুলে ক্লাস টেন শেষ করে পাশা প্রস্তুতি নিচ্ছিল স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করার জন্য। রাজনীতি সে বোঝে না। রাজনীতির খোঁজখবর করার কোনো দরকার তার ছিল না। ডান হাতে হাতল চেপে বা হাত দিয়ে পানি ধরে চোখেমুখে ছিটা দিলে তার আরাম বোধ হয়। এই পাহাড়ি এলাকা জুন মাসের গরমে সবাইকে সেদ্ধ করে মারছে। মুখের ভেতরে পানি নিয়ে কুলি করতে গেলে টিউবওয়েলের পানির আয়রনের ধাতব স্বাদ এবং একধরনের গন্ধ তাকে একটুখানি ধাক্কা দেয়। ঢাকার চানখারপুলে রশিদ বিল্ডিংয়ের মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারের নিচতলার ৭ নম্বর ফ্ল্যাটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্টাফ আব্বা, তার সদা উদ্বিগ্ন, সদা স্নেহশীল আম্মা আর ছোট দুই ভাইয়ের কথা যেন টিউবওয়েলে পানির তেতো স্বাদ ধুয়ে দিতে চায়। বাড়ি ছেড়ে সে যখন যুদ্ধে যোগ দেবে বলে ভোরবেলা পালিয়ে যায়, তখন আব্বা-আম্মার জন্য একটা ছোট্ট চিঠি লিখে রেখে এসেছিল :
আব্বা, আম্মা
আমি বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে চাই। কারণ, আমি মনে করি, আমাদের দেশের মানুষের দুর্দশা লাঘব করতে আমারও কর্তব্য রয়েছে। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। অচিরেই আমরা বর্বর, নিষ্ঠুর পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরব। শান্ত থাকার চেষ্টা করুন, নিজেদের এবং ভাই দুটির যত্ন নিন।
আব্বা-আম্মা কি চিঠিটা পেয়েছিলেন? তারা কি পড়েছেন? কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাঁদের?
হাতমুখ ধুয়ে টিনের থালা আর টিনের মগ হাতে নাশতার লাইনে দাঁড়াল। পাশা। খাকি রঙের দুধ-চা আর তেলে ভাজা পুরি নিয়ে ব্যারাকের উঠানে ঘাসের ওপরে বসে নাশতা করতে লাগল। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে, মাটি ভেজা।
আকাশের দিকে তাকাল, পুবের আকাশে একটা কালো মেঘের পেছন থেকে সূর্য টর্চলাইটের মতো করে রশ্মি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, আর কদম ফুলের পাপড়ির মতো রশ্মিগুলো মেঘ ফুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
সকালের নাশতা হিসেবে পুরি তো অমৃত। ১৪ জুন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা মানিক ভাইয়ের নির্দেশিত পথ ধরে এসেছে। তার সঙ্গী কামাল আর বেলাল, দুজনেই মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা, সমবয়সী, সুতরাং বন্ধু। পল্টনের ছাত্রনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলন এবং ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী রেজাউল করিম মানিক যুদ্ধে গেছেন, পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করছেন, আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে মেজর খালেদ মোশাররফ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা থেকে ব্রাইট স্টুডেন্ট ইয়ুথদের যুদ্ধে পাঠাতে। পল্টনে মানিক ভাইদের বাড়িতে এই কিশোরেরা দেখা করেছিল তাঁর সঙ্গে, তিনি তাদের বারবার সাবধান করে দিয়েছেন, যুদ্ধ খুব কঠিন ব্যাপার, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হবে, অখাদ্য জুটবে, বিছানা পাবে না, ঘুম হবে না, বাথরুম তো আর কোনো দিনও জুটবে না, মাইলের পর মাইল হাঁটতে হবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে হবে, গুলি এসে বুকে বিঁধতে পারে, তুমি মরতে পারো, পাশের জন মরতে পারে, ধরা পড়লে প্রচণ্ড অত্যাচারের মধ্যে পড়বে, চামড়া কেটে লবণ লাগিয়ে দেবে, তবু মুখ বন্ধ রাখতে হবে, পারবে না। ফিরে যাও। পাশারা বলেছে, পারব।
পাশাদের এই কথা বলার কারণ আছে। চানখারপুলে ২৫ মার্চ রাতে গুলির শব্দ, গোলার শব্দে তারা ঘুমাতে পারেনি, সারা রাত মেঝেতে শুয়ে ছিল। কিন্তু ৩০ ইঞ্চি দেয়ালের পুরোনো বাড়িতে তারা ঠিক টের পায়নি বাইরে আসলে কী ঘটেছে। ফলে রোজ বাজার করে করে বাজারসর্দার হিসেবে সুনাম অর্জনকারী পাশা ২৬ মার্চ সকালবেলা বাজার করতে বেরোলে চারদিকে সব সুনসান আর রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা দেখে বিস্মিত হয়। তখন হঠাই গুলির শব্দ আসতে থাকে। কিছু বোঝার আগে সে শুধু ঠাহর করতে পারে যে কার্জন হল থেকে গুলি করতে করতে পাকিস্তানি মিলিটারি–তারা দেখতে শ্বাপদের মতো–মাথায় হেলমেট, হাতে উঁচানো অস্ত্র, পায়ে বুট, কোমরভরা কার্তুজ–সার বেঁধে চানখারপুলের দিকে আসছে। সে দৌড়ে বাসায় ঢোকে। আব্বা-আম্মা বাড়ির সব চাল, ডাল, আটার বস্তা দরজায় দিয়ে ওদের সবাইকে মেঝেতে শুইয়ে দেন। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে অনেকক্ষণ। তারপর একসময় নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দুপুরবেলা পাশা চুপি চুপি দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। আব্বা-আম্মা টের পান না। দুপুরবেলা কোনো শহরে ভুতুড়ে নীরবতা এবং নির্জনতা নামতে পারে, এই ধারণা পাশার ছিল না। মেডিকেল কলেজের বাগানের ভেতর দিয়ে সে শহীদ মিনারে গিয়ে দেখতে পায়, এটা অর্ধেকটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখান থেকে সন্তর্পণে সে হাঁটতে থাকে ভূতে পাওয়া বালকের মতো। মাথার ওপরে সূর্য, সে যাচ্ছে জগন্নাথ হলের দিকে, কেন যাচ্ছে সে জানে না, জগন্নাথ হলের মাঠের পাশে এসে তার দোজখ দেখার অভিজ্ঞতা হয়, মাঠের মধ্যে মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে, অসংখ্য, গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত, কতটা, বিশটা, ত্রিশটা, একশটা, দুইশটা! দুইশ জন মানুষ এখানে। মরে শুয়ে আছে! এই দৃশ্য দেখার জন্য বালক পাশা তৈরি ছিল না, সে বমি করে দেবে, তার সমস্ত নাড়িভুড়ি উগরে বের হয়ে আসতে চাইছে নাক-মুখ দিয়ে। সে উল্টো দিকে দৌড়ে বুয়েটের ভেতর দিয়ে রেললাইনে চলে আসে, তারপর রেললাইন ধরে আরেক দৌড়ে চলে আসে তাদের রশিদ ভবনের সামনে। রশিদ ভবনের কাছেই আবুল আর করিমের দোকান। করিম তার চেয়ে সামান্য ছোটই হবে, আবুল তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হতে পারে, তারা দুই ভাই তাদের বাবা-মাকে সাহায্য করার জন্য এই দোকানটা চালায়। পাশার সঙ্গে তার সম্পর্কটা খদ্দের-দোকানির নয়, প্রায় বন্ধুর মতো। শাটার অর্ধেক খোলা দেখে পাশা দোকানের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে দুজন চিত হয়ে একজন আরেকজনের গায়ে পড়ে আছে, পুরো দোকানের পাটাতন রক্তে ভেসে গেছে, সেই রক্তে এখনো বুদবুদ উঠছে, হয়তো সকালে তাদের গুলি করেছে। পাশা ঘরে ফিরে আসে। ২৬ মার্চ রাতে তারা বাড়ি থেকে দেখতে পায় বিশেষ ধরনের ফ্লেম গান থেকে চানখারপুল রেললাইনের দুই পাশের বস্তিগুলোতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, রাতের অন্ধকার চিরে আগুনের লেলিহান শিখা দপদপ করে আকাশে উঠছে, এত তাপ যেন আকাশ পুড়ে যাবে, তার আঁচ রশিদ ভবনের জানালা থেকে পাশারা দেখতে পায়, আর তাদের আব্বা আম্মা দাতে দাঁত চেপে বলতে থাকেন, জানালা থেকে সরে আয়, মেঝেতে শুয়ে পড়। বস্তিবাসী মানুষেরা, নারী-পুরুষ শিশু চিৎকার করতে করতে বাইরে আসছে, পালানোর চেষ্টা করছে, আর ব্রাশফায়ারের ট্যা টা ট্যা গুলির মুখে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে, উল্টে পুড়ে যাচ্ছে।
এরপর পাশা কি ঘরে বসে থাকতে পারে?
মানিক ভাই তাদের মেলাঘর যাওয়ার নির্দেশিকা দিয়েছেন, সেটা ধরে, তিন দিন, তিন রাত বাস, রিকশা, হাঁটা, নৌকা, হাঁটা, বাস করে তারা এসে পৌঁছেছে মেলাঘরে। মানিক ভাইয়ের বলে দেওয়া রুটটা তারা মুখস্থ করে রেখেছিল : ফুলবাড়িয়া থেকে বাসে নরসিংদী, নৌকাযোগে নবীনগর, হেঁটে কোনিকরা, হেঁটে কড়ইবাড়ি, রাত্রিযাপন, হেঁটে পীর কাশেমপুর, হেঁটে কুটি, হেঁটে ষাইটশালা, হেঁটে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিঅ্যান্ডবি বাইপাস, রাতের বেলা সিঅ্যান্ডবি রোড ক্রস, হেঁটে রেললাইন, সীমান্ত পেরিয়ে কোনাবন, কোনাবন শরণার্থীশিবিরে রাত্রিযাপন, বাসে আগরতলা, সিপিএম অফিসে রিপোর্ট। পথে কড়ইবাড়িতে তারা ছিল এক কৃষকবাড়িতে, যার ঘরে কিছুই ছিল না, সেই কৃষকবধূ নিজেদের পর্ণকুটিরে তাদের আদর করে থাকতে দিয়েছিল, নিজের মুরগি জবাই করে মসলাছাড়া বেশি করে ঝাল আর হলুদ দিয়ে ঝোল বেঁধে খাইয়েছিল, সেই মমতার কথাও তো কোনো দিনও ভুলবে না পাশা। ১৪ জুন বেরিয়ে ১৬ জুন আগরতলা পৌঁছে টানা ষোলো ঘণ্টা হাঁটার ক্লান্তিতে ধ্বস্ত দেহটা যখন খাবার চাইছিল, তখন কাঁঠাল কিনে খেয়ে জঠরজ্বালা দূর করেছিল তারা।
আগরতলা থেকে চান্দের গাড়িতে চড়ে ৩০ মাইল পাহাড়ি পথের সবুজ বন বনানী চড়াই-উতরাই পাহাড় কেটে করা জুম কৃষিখেত দেখতে দেখতে তারা এসে পড়েছিল মেলাঘরে। ট্রেনিং ক্যাম্পটা কোথায়, জিজ্ঞেস করে পথ জেনে নিয়ে কর্দমাক্ত কাঁচা পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যবর্তী পথ ধরে এক ঘণ্টা হেঁটে অবশেষে মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রবেশপথ। বাঁশ দিয়ে গেট বন্ধ করে রাখা। কয়েক মাইল দৈর্ঘ্য, কয়েক মাইল প্রস্থ পাহাড়, পাহাড়ের শানুদেশ, জল-জঙ্গল, বন-বনানী, উপত্যকা, মাঠজুড়ে এই ক্যাম্প। বাঁশের তৈরি ব্যারাক।
ভেতরে খবর পাঠিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর প্রবেশানুমতি। একজন নন-কমিশন অফিসার তাদের নিয়ে গেল যার সামনে, পাশা পরে জানবে যে তিনিই মেজর এ টি এম হায়দার। ধারালো চিবুক, কোঁকড়ানো চুল, বুদ্ধির ঝলকানি দেওয়া চোখ, হাফহাতা শার্ট, গাঢ় রঙের প্যান্ট, পায়ে কেডস। মেজর হায়দার প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলেন আর পায়চারি করতে লাগলেন। পাশা কামাল বেলালের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে জানালেন, প্রশিক্ষণ হবে ভয়াবহ কঠিন, কোর্সটা হবে সংক্ষিপ্ত, শেখানো হবে গেরিলা লড়াই, ছোট ছোট আগ্নেয়াস্ত্র চালানো আর বোমা বানানো।
তোমরা দুপুরে খেয়েছ?
না।
এই এদের খেতে দাও আর এরা কোথায় থাকবে, দেখিয়ে দাও।
এখন সকালবেলা পুরি খেতে খেতে চায়ের মগে চুমুক দিয়ে একটুখানি। দুধের সর জিবেতে চটকাতে চটকাতে পাশা ভাবছে প্রথম দুপুরের খাবারটার কথা। নায়েক রশিদ তাদের বড় একটা সেগুনগাছের নিচে বসিয়ে খাবার এনে দেবেন। পাশা তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ের ঢালগুলোর মধ্যে একটা অংশ সমান, সেটার গাছপালা কেটে সেটাকে বানানো হয়েছে প্রশিক্ষণের মাঠ, আর পাঁচটা বাঁশের ব্যারাকের ইউ আকৃতির মধ্যখানে একটা উঠান। ব্যারাকের বাঁ পাশে উপত্যকায় রান্নার জায়গা। নায়েক রশিদ এনে দিলেন মোটা রুটি আর খেসারির ডাল। রুটি ছিঁড়তে কসরত করে খেসারির খোসাসমেত ডাল মুখে দিতেই মনে হলো, এই খাবার গরুর পক্ষেও অখাদ্য। ক্যাম্পের পুরোনো লোকেরা তাদের দুরবস্থা দেখে বলল, চিন্তার কিছু নাই, সব অভ্যাস হইয়া যাইব।
১২তম প্লাটুনের ৩৮ জনের একজন পাশা। তাদের দলনায়ক সাদেক হোসেন খোকা। শফি ইমাম আর জাহানারা ইমামের ছেলে শাফী ইমাম রুমী এই প্লাটুনেই আছে। আছেন শাহাবুদ্দিন। ছবি আঁকেন। আর্ট কলেজের ছাত্র। কয়লা দিয়ে কাগজে এঁকেছেন বঙ্গবন্ধুর মুখ।
আছেন গায়ক আজম খান। তাদের প্রত্যককে দেওয়া হলো একটা করে কম্বল। থাকার জায়গা হলো একটা বাশের খাঁটিয়া। মাথার ওপরে বাঁশের চাটাই। রাতের বেলা ছয়টা হারিকেন আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি–এই প্রতিজ্ঞায় ময়লা চিমনির ভেতর থেকে আলো দেয়। একটা করে রাইফেলও পেল পাশারা, তবে তা জমা রাখতে হলো অস্ত্রাগারে।
প্রথম দিন নাশতার পরে মেজর হায়দার নিজের পরিচয় দিলেন। ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছেন, ৬৫ সালে গ্র্যাজুয়েট, ৬৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করছেন।
সারা দিন কঠোর প্রশিক্ষণ, খাওয়াদাওয়া, রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চিত্তবিনোদন, ৯টায় বাতি নিভিয়ে ঘুম। চিত্তবিনোদনের সময়টায় আজম খান। গান ধরেন, আর সবাই থালাবাসন দিয়ে বাজনা সংগত করে। আজম খান মান্না দের গান করেন, হেমন্তর গান করেন, নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়। আর তখন সবাই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের ফাঁকে চাঁদের মায়াবী মুখখানা দেখে, দেখে দূরে ওই নক্ষত্ররাজিকে–অরুন্ধতী স্বাতী। নীহারিকা সপ্তর্ষিমণ্ডল। আজম খান গান ধরেন, শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি… স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান।
রুমির বাড়ি থেকে টাকা এলে রোববার ছুটির দিনে দুপুরে ঝরনার জলে গোসল সেরে তারা যায় স্থানীয় বাজারে। একদিন আগরতলায় গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখে আসাও চলে। ট্রেনিং কঠোর, রাইফেল চালাতে শেখায় ভারতীয় ট্রেনার, গুলি টার্গেটে না লাগলে খেপে যায়, রাইফেলের গুলি বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাঁধে ধাক্কা লাগে, শিশ্ন উত্থিত হয়। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার শেখানো হয়। কোনটা ডেটোনেটর, কোনটা ফিউজ…গ্রেনেড ছোঁড়া। এমনকি এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর চালানোও শিখছে তারা।
এখন নাশতা খেতে খেতে পাশার তার আম্মার কথা মনে পড়ে। আম্মা তার বড় ছেলের খাওয়া নিয়ে কী যে করতেন! পাতে মাংস, মাছ তুলে তুলে দিতেন। মাঝে মাঝে নিজেই খাইয়ে দিতেন। পাশার চোখ ছলছল করে। মনে পড়ে দুই ছোট ভাই রামা আর ডারার কথা। ওরা এখন কী করছে?
মাঝেমধ্যে মেজর খালেদ মোশাররফ আসেন। তাঁকে প্রথম পাশা দেখে বিকেলে, তিনি একটা পাহাড় থেকে নেমে আসছিলেন, সেটা ছিল পুব দিকে, আর পশ্চিম থেকে আসা অস্তগামী সূর্যের হলুদ আলো এসে পড়েছিল খালেদের চোখে, মুখে, চুলে। তাঁকে সোনার তৈরি গ্রিক দেবতার ভাস্কর্য বলে মনে হচ্ছিল। হাফহাতা বুশ শার্ট পরা খালেদ মোশাররফ তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলে, তুমি এখানে কী করো?
স্যালুট দিয়ে পাশা বলল, স্যার আমি যুদ্ধ করতে এসেছি। ট্রেনিং নিচ্ছি।
তোমার বয়স কত?
১৫ স্যার।
তাহলে তুমি এখানে কেন?
আমি স্যার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছি। আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমি লড়াই চালিয়ে যাব।
খালেদ পাশার পিঠে হাত রাখলেন, দুটো চাপড় মেরে বললেন, শাবাশ। তোমার মতো ছেলেদের দেখে আমরা ভরসা পাই, যুদ্ধে আমরা জয়ী হবই।
একদিন বিকেলে মেলাঘরের মাঠে সমবেত হলো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েক শ জওয়ান। তারা সার বেঁধে বসল নিয়মমাফিক। মোটিভেশনাল ক্লাস। লেকচার দেবেন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, পরিষদ সদস্য। দুপুরের খাওয়াটা তেমন ভালো হলো না। মিজান চৌধুরীর একটু পান। চিবোনো দরকার। পানের কৌটাটা খুলে দেখলেন পান নেই। একটু সুপুরি পেলেন, সেটাই চিবুতে চিবুতে হাজির হলেন খোলা মাঠে। চারদিকে পাহাড়। দূরে ঘন জঙ্গলের ওপারে নীল পাহাড়ের হাতছানি।
মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খালেদ মোশাররফ বললেন, আমরা আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে পেয়েছি। তোমরা জিজ্ঞেস করো, আওয়ামী লীগ তোমাদের জন্য কী করেছে?
মিজান চৌধুরী কাউকে আর মাইক্রোফোন দিলেন না। তিনি বলতে লাগলেন, ভুলে যাবেন না, আপনারা ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য। আপনারা কীভাবে ভারতে আশ্রয় পেলেন? কেন ভারত আপনাদের আশ্রয় দিল? এই ব্যবস্থা কে করেছে? আপনাদের খাওয়া-পরা, অনুশীলন, প্রশিক্ষণ–এই ব্যবস্থা কে করেছে? পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের কারণে। আজকে যে সারা দেশের মানুষ এক দেহ এক মন হয়ে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণবাজি রেখে লড়ছে, এই উদ্দীপনা, এই প্রেক্ষাপট, এই পটভূমি কে তৈরি করে দিয়েছে? আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা করেছেন আওয়ামী লীগ সংগঠনের মাধ্যমে। সারা দেশে প্রতিটা জেলায়, প্রতিটা মহকুমায়, প্রতিটা থানায় ২৫ মার্চ থেকে যে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়, সেটা কে করে? কীভাবে করে? কেন করে? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি করে, যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে করে। করে, কারণ শেখ মুজিবুর রহমান এই নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
পরে ফেরার পথে গাড়িতে সঙ্গী আবদুল মালেক উকিল, সংসদ সদস্য নুরুল হক, ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর সঙ্গে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল মিজান চৌধুরীর।
মিজান চৌধুরী বললেন, খালেদ মোশাররফ মেজর হায়দারের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা বিরূপ মনোভাব আছে। তারা বলতে চায়, সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতারা আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন, মোটিভেটর হিসেবে ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে বক্তৃতা করছে, আর যুদ্ধ করছে তারা।
নুরুল হক বললেন, ঠিক। এটা যে একটা পলিটিক্যাল ওয়ার, পলিটিকস না থাকলে তাদের কাজটা যে টেররিজম বলে সারা পৃথিবীতে অগ্রহণযোগ্য হতো, এটা কি তারা বোঝে না?
মিজান চৌধুরী বললেন, ক্যাপ্টেন সুজাত, আপনি ভালো বলতে পারবেন। তবু আমি আমার মতটা বলি। আমাদের আর্মির ট্রেনিংটা হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানি অফিসারদের মতো সিভিল সমাজকে হেয় করে দেখার এই মানসিকতা আমাদের বাঙালি অফিসারদের কারো কারো মধ্যেও আছে। তার মধ্যে এই অফিসারদের অনেকেরই ফ্যামিলি রয়ে গেছে দেশে। তাদের জন্য দুশ্চিন্তায় আর ভারতের মাটিতে এসেও পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রশস্ত্র, কামান, ট্যাংক, বিমান না পাওয়ায় তাদের মানসিক ভারসাম্য কখনো কখনো লোপ পেয়ে যায়। একমাত্র জিয়াকে দেখি এই মনের চাপটা দমিয়ে রাখতে পারেন। একদিন অবশ্য আগরতলার সাবরুমে তিনি তাঁর ফ্যামিলির কথা মনে করে আমার সামনে চোখের জল ঝরিয়েছিলেন নীরবে।
আবদুল মালেক উকিল বললেন, জিয়াউর রহমানের মধ্যেও অ্যাম্বিশন আছে। তা না হলে কী করে চট্টগ্রাম রেডিওর ঘোষণায় একবার সে নিজেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেয়?
মিজান চৌধুরীদের গাড়ি আগরতলা এসে পৌঁছায়।
.
পাশাদের ট্রেনিং শেষ হলো।
এবার সমাপনী অনুষ্ঠান। খালি পা, লুঙ্গি পরা, ছেঁড়া গেঞ্জি মুক্তিযোদ্ধারা লাইনে দাঁড়াল। হাতে রাইফেল। শাহাবুদ্দিনের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিটা একটা বড় খুঁটির ওপরে টাঙানো। আরেকটা বাঁশের খুঁটিতে বাংলাদেশের পতাকা তুললেন মেজর খালেদ মোশাররফ।
মুক্তিযোদ্ধারা, গ্রাম থেকে আসা চাষি মুক্তিযোদ্ধা, কুলি মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা, তৌফিকদের মতো শাহিন স্কুলে পড়া মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মিলে গাইতে লাগল :
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…
মেজর হায়দার নির্দেশনা দিলেন, এরপর কী করা হবে। প্রথমে পাঠানো হবে মন্দাবাগে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রেগুলার সোলজারদের পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করার জন্য। সেখানকার যুদ্ধাভিজ্ঞতা তোমাদের কাজে লাগবে। এরপর তোমাদের পাঠানো হবে ঢাকা শহরে। তোমরা ঢাকা শহরে গেরিলা অ্যাটাক করবে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠবে।
মেজর খালেদ মোশাররফ শপথবাক্য পাঠ করালেন। এরপর সবাই স্লোগান ধরল :
জয় বাংলা।
জয় বাংলা।
মহান জাতির মহান নেতা
শেখ মুজিব শেখ মুজিব
তোমার নেতা আমার নেতা
শেখ মুজিব শেখ মুজিব।
.
তৌফিক উত্তেজিত। তারা যুদ্ধে যাবে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সঙ্গে যাবে মন্দাবাগ। সরাসরি যুদ্ধ। যদিও ক্যাম্পের খাবার তার পেটে সহ্য হয়নি। পেটের পীড়ায় ভুগেছে সে।
তাদের একটা করে রাইফেল দেওয়া হয়েছে। চারটা করে অ্যামুনিশন ক্লিপ। প্রতিটায় ১০টা করে গুলি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাক ৩৮ জন। গেরিলাকে মন্দাবাগ স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নামিয়ে দিয়ে গেল। ধানখেত, মাঠ, চষা খেত, ছোট জলা পেরিয়ে তারা পৌঁছালেন অপারেশন হেডকোয়ার্টার্সে। মুজিব ব্যাটারির কামান দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেন। গোলন্দাজদের। তাদের পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। আবারও হাঁটা। মন্দাবাগে পৌঁছানোর পর তাদের স্বাগত জানালেন কমান্ডার এইচ এম এ গাফফার।
৫১
চীনে যাচ্ছি। চীনে যাচ্ছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের মস্তিষ্কের কোষে কোষে একটা মৌমাছি একটা গুঞ্জনই তুলে চলেছে অবিরাম। আমি তারে পারি না এড়াতে। সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়। চীনের সঙ্গে আমেরিকার প্রকাশ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। চীনে আমেরিকার কোনো দূতাবাস নেই। আমেরিকায়ও চীনের কোনো দূতাবাস নেই। যা আছে তা হলো নিউইয়র্কে, জাতিসংঘ দপ্তরে। কিন্তু শীতল যুদ্ধের এই সময়ে আমেরিকা জানে, চীনের সঙ্গে দোস্তিটা খুবই দরকার। বিশেষ করে সোভিয়েত-চীন যুদ্ধের পর এই প্রেম অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কিসিঞ্জার যাচ্ছেন অভিসারে। অতিগোপনে তিনি যাবেন চীনে। সে জন্য তাকে যেতে হবে প্রথমে ভারতে। তারপর পাকিস্তানে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, যিনি কিনা নিক্সনের অনির্বচনীয় প্রেমের উৎস আর গন্তব্য, তিনি এই প্রেমের দূতিয়ালি করছেন। আমেরিকার কাছে ইয়াহিয়ার গুরুত্বের একটা গোপন কারণ এই দৌত্য। কিন্তু পৃথিবীর নিয়ম এই যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানে যেতে পারেন না, যদি না আগে তিনি ভারতে যান।
কিসিঞ্জার ভারতে যাবেন, থাকবেন মাত্র দুই দিন। এটাও ভারতকে একটা শিক্ষা দেবে। যদি ভারতীয়দের শেখার আদৌ কোনো ইচ্ছা থেকে থাকে।
সখী কেমনে বাধিব হিয়া, আমার বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া-ভারত যদি জানত, আসলে কিসিঞ্জার যাবে চীনে, তাহলে হয়তো এই গানটাই গাইত।
কিসিঞ্জার একটা প্লেনে উঠেছেন, জুলাইয়ের ৬ তারিখে। ট্যাকটিক্যাল এয়ার কমান্ডের কাছ থেকে এই প্লেনটা ধার করে নেওয়া হয়েছে, কারণ প্রেসিডেন্টের উড়োজাহাজগুলো একটাও আজার নাই। ভয়াবহ একটা প্লেন, কিসিঞ্জার বিড়বিড় করেন। এটা কি আকাশ দিয়ে যাচ্ছে, নাকি চন্দ্রপিঠে চাকার ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। এর চেয়ে ভারত-পাকিস্তানের গরুগাড়িগুলো বেশি আরামদায়ক নয়? উফ, কী ঝাঁকি দিচ্ছে রে বাবা। এই রকমের একটা ভয়াবহ উড়াল শেষে দিল্লি এয়ারপোর্টে নামার সময় কিসিঞ্জার আবার নিজেকে বললেন, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফরটা আমি করতে যাচ্ছি, আমি চীনে যাচ্ছি।
দিল্লি তখন বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টি বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে দিল্লি বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছে ভারতীয় বিক্ষোভকারীরা। গ্যারি জে ব্যাস দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম বইতে তার সরস মনোহর বর্ণনা দেবেন। বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করছে, বড় বড় ব্যানারে লিখে এনেছে, খুনি কিসিঞ্জার ফিরে যাও, কিসিঞ্জার অব ডেথ, গো ব্যাক। বিক্ষোভকারীরা সঙ্গে করে এনেছে পচা টমেটো আর পচা ডিম। পচানোর জন্য তাদের দিল্লির প্রচণ্ড গরমে এই ডিম আর টমেটোগুলো তিন দিন ঘরের ছাদে, আঙিনায় ফেলে রাখতে হয়েছে। কিসিঞ্জার এবং তার সঙ্গী-সাথিদের গাড়িবহরে তুলে গোপন পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিল্লির অশোকা হোটেলে। বিক্ষুব্ধ জনতা এয়ারপোর্টের বাইরে যে গাড়িকে বেরোতে দেখছে, তাতেই ডিম আর টমেটো ছুঁড়ে মারছে। গন্ধে দিল্লির বৃষ্টিভেজা বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠছে। বিক্ষোভকারীরা সমবেত হয়েছে দিল্লির আমেরিকান দূতাবাসে। সেখানে তারা গেট ভেঙে সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়ে, খুনি কিসিঞ্জার ফিরে যাও বলতে বলতে পরবর্তী গেট ভাঙতে যাচ্ছে, আর ইউএস ম্যারিনরা তাজ্জব হয়ে তাদের কাণ্ড দেখছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মতো। দিল্লি পুলিশ এসে তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে একটা লাল পতাকা আমেরিকান দূতাবাসের আঙিনায় মাটিতে গাঁথা হয়ে থাকে।
ভারতীয়রা আনুষ্ঠানিকভাবে কিসিঞ্জারকে বলে, পশ্চিম বাংলা ত্রিপুরা সীমান্তে যে শত শত শরণার্থীশিবির আছে, সেসবের যেকোনো একটা পরিদর্শনে চলুন। আমেরিকান ডলার দিয়ে কী করা হচ্ছে, স্বচক্ষে দেখুন, দাদা। কিসিঞ্জার বললেন, না। প্লেনে এমন ঝাঁকুনি খেয়েছি যে পশ্চাদ্দেশে ব্যথা হয়ে গেছে। নিতম্বেরও খানিকটা বিশ্রাম তো চাই।
নিক্সনের যেমন কিসিঞ্জার, ইন্দিরা গান্ধীর তেমনি হাকসার। পি এন হাকসার সাউথ ব্লকে তার অফিসে কিসিঞ্জারের মুখোমুখি হলেন।
হাকসার বললেন, আমি নিউইয়র্ক টাইমস-এ পড়েছি, আমেরিকা পাকিস্তানকে ২৯ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব?
কিসিঞ্জার মাথা চুলকান। দার্জিলিং চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এর গন্ধ উপভোগ করতে করতে বললেন, আমিও কাগজেই পড়েছি।
এই চালান আপনাদের বন্ধ করতে হবে।
এটা এত সামান্য যে এর কোনো দামই নেই। বাদ দিন তো। এসব অস্ত্র মারণাস্ত্র নয়। মানুষ মারার কোনো ক্ষমতাই এসবের নেই।
অস্ত্রের মানুষ মারার ক্ষমতা নেই, এসব দিয়ে ফুলবাগানে সার বানানো হবে?
আপনি কি শুধু এই সামান্য বিষয় নিয়েই কথা বলবেন, তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই।
কথাটা একটু বেশি কড়া হয়ে গেল নাকি? কিসিঞ্জার ভাবলেন। কড়া ডোজটাকে একটু মিষ্টি দিয়ে ঢাকা দরকার। তিনি বললেন, আমার প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন, ভারত একটা বিশাল পাওয়ার, কিন্তু এদের পাওয়ার হচ্ছে শান্তি আর স্থিতিশীলতা আনবার পাওয়ার।
হাকসার বললেন, ধর্মই যদি একটা রাষ্ট্র হওয়ার শর্ত হয়, তাহলে পুরো ইউরোপ তো রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতে পারত। দেখুন, আমাদের দেশে সত্তর লক্ষ শরণার্থী এসেছে, এদের ৯০ শতাংশ হিন্দু। আমরা তো একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। পাকিস্তান আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরে আক্রমণ করছে।
কিসিঞ্জার বললেন, ভারত একটু বেশি চিল্লাচিল্লি করছে। এটা করে ইস্ট পাকিস্তানে তারা আগ্রাসন চালানোর প্লট তৈরি করছে।
আর এত শরণার্থী যে আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে!
ভারত বাঙালিদের সাপোর্ট করে জিনিসটা উসকে দিচ্ছে।
তোমাকে আমি খোলাখুলি একটা কথা বলি, কোনো রাখঢাক না রেখে-বললেন হাকসার, ভারত বাঙালি গেরিলাদের কোনো রকমের অস্ত্র দিচ্ছে না। (লেখক গ্যারি জে ব্যাস বলেন, যখন আমেরিকা কিংবা ভারত কোনো মিথ্যা কথা বলে, তার আগে তারা এই কথা বলে, একটা কথা খোলাখুলি বলি।)
কিসিঞ্জার চাইছেন হাকসারকে ঠান্ডা করতে। তিনি বললেন, তোমরা একটু কম উত্তেজিত হও। তোমরা যদি ঠান্ডা হও, আমরা আগামী কয়েক মাসে শরণার্থী সমস্যার সমাধানে কাজ করতে পারি।
হাকসার বললেন, আমরা যুদ্ধে যেতে চাই না, কিন্তু আমরা জানি না যুদ্ধে না গিয়ে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যাবে।
কিসিঞ্জার বললেন, আমরা আসলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চাই। যদি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, চীন চুপ করে থাকবে না, পাকিস্তানের পক্ষ নেবে, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষ নেবে, তাহলে আমেরিকার পক্ষে তো চুপ করে বসে থাকা চলবে না।
হাকসার বললেন, সে ক্ষেত্রে আমেরিকার উচিত ভারতের পক্ষ নেওয়া।
কিসিঞ্জারের সকালটা গেল বাথরুমে, কমোডে দুবার বসে থেকে। ভারতের জীবাণুরা তাঁকে আক্রমণ করেছে। তবে এটা স্ক্রিপ্টে ছিল না। তার স্ক্রিপ্টে আছে, পাকিস্তানে গিয়ে তিনি অসুস্থ হবেন, আর গোপন ঘরে একা থেকে চিকিৎসা নেবেন। ওই ফাঁকে দুনিয়ার চোখ এড়িয়ে তিনি যাবেন পিকিং।
জীবাণুদের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া কমোডে ব্যক্ত করে তিনি গেলেন ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রাতরাশ করতে। কে সুব্রামানিয়াম, ভারতের রণবিদ্যাবিশেষজ্ঞ পণ্ডিত, আক্রমণ করে বসলেন কিসিঞ্জারকে, তুমি নিজে একজন রিফিউজি। তুমি জানো না রিফিউজিদের কী বেদনা! ১৯৩০-এর দশকে ইহুদিদের ওপরে অত্যাচার শুরু হলে হিটলারের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে তোমরা যে ভুল করেছ, আজকে সেই একই ভুলের হুবহু পুনরাবৃত্তি করছ।
দুপুরে হাকসারের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনও একই রকমের তিক্ততায় বিস্বাদময় হয়ে পড়ল। তবে কিসিঞ্জার ভারতীয় প্রতিপক্ষদের, হাকসারকে, শরণ সিংকে আশ্বস্ত করলেন, আমেরিকা চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে, তবে চীন যদি ভারত আক্রমণ করে বসে, আমেরিকা ভারতের পক্ষই নেবে।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কিসিঞ্জার বৈঠকে বসেছেন। ইন্দিরা গান্ধী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ৭০ লাখ শরণার্থী! এই চাপ আমি শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে বহন করছি।
কখন আপনাদের সইবার ক্ষমতা শেষ হবে?
অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। পাকিস্তান কী করছে? সবকিছুতেই হিন্দু-মুসলিম। সবকিছুইতেই জিহাদ। ভারতে তো ছয় কোটি মুসলমান আছে, নাকি! আপনারা পাকিস্তানকে অস্ত্র আর টাকাপয়সা দিয়েই যাচ্ছেন।
না না, সামান্য। খুব সামান্য।
এটা খুব বেশি না খুব সামান্য, তার প্রশ্ন নয়। এটা তো একটা সাইকোলজিক্যাল এবং রাজনৈতিক উৎসাহ যে এসব অপকর্ম আরও করতে পারো। আমরা সহ্য করছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বেধে যাবে না, এটা আমরা বলতে পারি না।
আসলে আমরা ভাবতেও পারিনি যে পাকিস্তান এই রকমের আক্রমণ করে বসবে। শোনেন, আপনারা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র, ৫০ কোটি মানুষ, আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই। যদি চীন ভারত আক্রমণ করে, আমেরিকা ভারতের পক্ষে থাকবে।
ভারতীয়রা এই একটা কথাই গ্রহণ করল।
.
এরপর কিসিঞ্জার উড়ে গেলেন পাকিস্তানে। ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি দেখা হলো, ওয়ান টু ওয়ান। রাওয়ালপিন্ডির কাছে, প্রেসিডেন্ট ভবনে। পুলিশরা যে ভবনটাকে বলে থাকে পতিতালয়।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণ নিক্সনকে কিসিঞ্জার এভাবে দেবেন—
কিসিঞ্জার বললেন, ইয়াহিয়া কোনো প্রতিভাবান নন।
আচ্ছা। নিক্সন ভাবলেশহীনভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এটা আমার ধারণা যে ইয়াহিয়া এবং তাঁর সঙ্গীরা আইকিউয়ের জন্য কোনো পুরস্কার পাবেন না। কিংবা তাদের রাজনৈতিক বোধের জন্যও না। তারা অনুগত, মাথামোটা সৈনিক।
কিন্তু তাদের সত্যিকারের বুদ্ধিগত সমস্যা আছে, তারা বোঝে না কেন পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অংশ থাকতে পারে না।
কী রকম?
ইয়াহিয়া এবং তাঁর সহকর্মীরা এটা বুঝতেও পারেন না যে ভারত তাদের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে।
আচ্ছা।
আর যদি যুদ্ধ বাধেও, তাহলে তাঁদের ধারণা তারাই জয়লাভ করবেন।
তাই নাকি। কীভাবে?
এই প্রশ্নটাই আমি তাদের করেছিলাম, আপনারা কেন ভাবছেন যে আপনারা ভারতের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন। ভারত তো সব সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রবলে আপনাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। তখন তাঁরা কী বললেন, জানেন?
কী বললেন?
বললেন যে ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম সৈন্যরা উন্নততর।
হুঁ।
তারপর আমি বললাম আমার পেটব্যথা। ডিনারের সময় বললাম। তখন ইয়াহিয়া চিৎকার করতে লাগলেন, সবাই বলে আমি একজন একনায়ক। তিনি প্রতিটা টেবিলে গেলেন, প্রত্যেক অতিথিকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, অ্যাম আই আ ডিক্টেটর? আমি কি একজন স্বৈরশাসক?
তিনি আমার কাছেও এলেন। আমাকে বললেন, মিস্টার কিসিঞ্জার, আমি
কি একজন ডিক্টেটর?
আমি বললাম, আমি তো জানি না। তবে এইটা আমি জানি, আপনি এমন একটা লাউজি ইলেকশন করেছেন, যেটা একজন ডিক্টেটর করতে পারে না।
.
কিসিঞ্জারের পেটব্যথা খুবই বেড়ে গেল।
তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে নাথাইগলিতে।
এর আগে আমেরিকান নিরাপত্তাকর্মীরা জায়গাটা ঘুরে গেছেন। তারা সেখানে যাওয়ার পথে উট দেখে লাফিয়ে উঠেছিলেন, উট উট। ভালুক দেখে তো তারা অজ্ঞান, ভালুক ভালুক।
ভোজসভা শেষে সব অতিথিকে বিদায় করে দিয়ে অতিগোপনে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো রাওয়ালপিন্ডির বিমানবাহিনী সাইটে। সেখান থেকে তিনি পিআইএর একটা বিমানে চড়ে উড়ে গেলেন।
কিন্তু সবাই জানল যে তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসেই আছেন। তাঁর পেটে ব্যথা।
তাঁর এত পেটব্যথা যে তাঁকে নাথিয়াগলিতে বিশ্রামে রাখতে হবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে নিয়ে মোটর শোভাযাত্রা রওনা হলো নাথিয়াগলির দিকে।
কিসিঞ্জার পৌঁছালেন পিকিংয়ে।
এদিকে নাথাইগলিতে একজন নিরাপত্তাকর্মী সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে দেখানোর জন্য অ্যাবোটাবাদ থেকে একজন ডাক্তার ডেকে আনা হলো।
তিনি রোগী দেখার পর বললেন, কিসিঞ্জার কই?
তাঁকে বলা হলো, আছেন। আপনার জানার দরকার নাই।
তিনি অসুস্থ। আমি ডাক্তার। আমি অবশ্যই কিসিঞ্জারকে দেখব।
না না। দেখা চলবে না।
ওই ঘরেও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি কিসিঞ্জার নিখোঁজ!
তিনি নিজ দায়িত্বে এসপিকে বললেন, কিসিঞ্জার নিখোঁজ হয়েছে।
এসপি ভাবলেন এত বড় খবরটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো দরকার।
তখন সেই এসপিকে হাতে-পায়ে ধরে থামানো হলো। কিসিঞ্জার কোথায় গেছে, এটা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য। এটা নিয়ে কোনো কথা বললে আপনার চাকরি যাবে।
সবার ধারণা কিসিঞ্জার গেছেন বন্দী শেখ মুজিবের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতে।
আরেকটি খবরও রটেছিল। কিসিঞ্জার বন্দী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। এ খবর পত্রিকাতেও প্রকাশ হয়। পরে পাকিস্তান সরকার বিবৃতি দিয়ে এই খবরের সত্যতা অস্বীকার করে।
.
তবে একজন পাকিস্তানি সাংবাদিক খবরটি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ অফিসে পাঠালেন–কিসিঞ্জার চীনে। ডেইলি টেলিগ্রাফ খবরটি গাঁজাখুরি হিসেবে বিবেচনা করে বাজে কাগজের ঝুড়িতে দিল ফেলে।
তিন দিন পর কিসিঞ্জার পাকিস্তানে ফিরে এলেন একই প্লেনে।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, কিসিঞ্জারের লগে চীনের প্রধানমন্ত্রীর কী কথা হইল?
ব্যাঙ্গমি বলল, কী কথা হইল। শুনো তাইলে…
.
কিসিঞ্জার বললেন, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, আমরা ভারতকে সামরিক সরঞ্জাম দিই না।
হ্যাঁ। আমি তা-ই শুনেছি। কিন্তু আপনারা পাকিস্তানকে কিছু অস্ত্র দিচ্ছেন। চৌ এন লাই মাথা নেড়ে বললেন।
হ্যাঁ। আপনারাও তো তা-ই করেন।
চৌ এন লাই বললেন, তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারের হেডকোয়ার্টার ভারতে। এটা কি পাকিস্তান সরকারের জন্য ক্ষতিকর নয়?
আপনি জানেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আমরা খুব পছন্দ করি। আমরা তার এবং তার দেশের জন্য গভীর বন্ধুত্ব অনুভব করি।
চৌ এন লাই বললেন, দয়া করে ইয়াহিয়া খানকে বলবেন, যদি ভারত কোনো আগ্রাসন চালায়, তাহলে আমরা পাকিস্তানের পক্ষ নেব। আপনারাও তো তা-ই নেবেন।
আমরা অবশ্যই ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা করব। কিন্তু সামরিক দিক থেকে আমাদের কিছু করার নেই।
আপনারা তো অনেক দূরে।
হ্যাঁ। আমরা ১০ হাজার মাইল দূরে।
আপনারা ভারতকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করুন।
চীন তো কাছে।
হ্যাঁ। আমরা ১৯৬২-এর যুদ্ধে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা আমরা আবার করতে পারি।
চীন নিক্সনকে আমন্ত্রণ জানাবে এমন কথার মধ্য দিয়ে কিসিঞ্জার প্লেনে উঠলেন। তাঁকে দেওয়া হলো অনেক চীনা ফল, মাও সে তুংয়ের বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ। এবং এই ট্রিপের ফটো অ্যালবাম।
কিসিঞ্জার হাসতে হাসতে বললেন, আপনাদের দেশে অনেক বিদেশি এসেছে, আগ্রাসন করেছে। কিন্তু আমার মতো এত অসভ্যভাবে বোধ হয় আর কেউ আসেনি।
৫২
রাসেলের খুব কান্না পায়। তার আব্বার কথা মনে পড়ে। তার কামাল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। তার মনে পড়ে জামাল ভাইয়ের কুকুর দুটো–টমি আর টিকলির কথা। কিন্তু সে তো প্রকাশ্যে কাঁদতে পারে না। সে তো বড় হয়ে গেছে। তার বয়স ৬+। কিছুদিন পরে ৭ হবে। সে কীভাবে সবার সামনে কাঁদবে।
সে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখের পানি ফেলে। দেনা (রেহানা) আপা আসেন। বলেন, এই রাসেল সোনা, কাঁদছ কেন? রাসেল বলে, কই কাঁদছি না তো। চোখে কুটা পড়েছে।
শেখ রেহানার চোখ ছলছল করে। তিনি আপার কাছে যান। আপা, দেখো, রাসেল কী বলে। কাঁদে আর বলে, না, কাঁদছি না তো। চোখে কুটা পড়েছে।
বাইরে পাকিস্তানি আর্মির লোকেরা পাহারা দিচ্ছে। রাসেল তাদের সামনে তো জয় বাংলা বলতে পারে না, বলে, জয় জয় জয়, গাছের পাতা হয়।
জামাল বারান্দায় উঁকিঝুঁকি মারেন। ১৭ বছরের ছেলের পক্ষে কি ঘরে আটতে থাকা সম্ভব?
মিলিটারির লোকেরা বলে, খবরদার ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবে না। ধরে পা ওপরে তুলে মারতে মারতে মেরেই ফেলব।
জামাল রেহানাকে বলেন, দ্যাখ, কবে যে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে! আমি বরং বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যুদ্ধে যাই। তাতেই আমি বেঁচে যেতে পারব। কবে যে আমি মামা হব? ভাগনে হোক, ভাগনি হোক, মুখটা দেখেই আমি চলে যাব।
রাতে সবাই মিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন। সবচেয়ে বেশি মন দিয়ে শোনেন রেনু। রাসেলের মুখস্থ হয়ে যায় এই গান : জয় বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়ই।
একদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসে একটা আহ্বান : ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি।
আরে এ তো কামালের গলার আওয়াজরেনু বলেন।
এই ঘোষণা এরপর মাঝেমধ্যেই দেওয়া হতো আর হাসিনা, রেহানা, জামাল, রেনু, ওয়াজেদ মিয়া সবাই বলতেন হা হা এটা কামালের গলা। কামাল ভাইয়ের গলা। তখন তাদের মধ্যে একটা গভীর আশ্বাস কাজ করতে লাগল। যাক, কামাল ঠিকমতো মুজিবনগরে পৌঁছে গেছেন। আর জামাল বলতে লাগলেন, আমিও যুদ্ধে যাব। মুজিবনগর যাব। ঠিক যুদ্ধে যোগ দিতে পারব।
রাসেল বলল, আব্বার নগরে যাবা? আব্বার দেখা পাবা?
তখন সবাই চুপ হয়ে গেল।
হাসিনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির প্রহরারত সৈন্যদলের প্রধান একজন মেজর। ওয়াজেদ মিয়া তার সঙ্গে কথা বললেন। মেজর জানালেন, হাসিনার যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে, তিনি অন্য বাড়ির মেয়ে, কাজেই তিনি তার স্বামীর সঙ্গে বাইরে যেতে পারবেন। ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি এনে দাঁড় করালেন বাড়ির সামনে। হাসিনা অতিকষ্টে হেঁটে এসে গাড়িতে উঠলেন। ওয়াজেদ সাহেব গাড়ি চালিয়ে গেলেন ডা. এম এ ওয়াদুদ সাহেবের ক্লিনিকে। হাসিনার শরীর ভালো না। একে তো খেতে ইচ্ছা করে না, তা-ও। ভালো, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করলে খাবারই-বা পাবেন কোথায়। ১৭ বছরের। আবদুলকে অবশ্য বাইরে বাজার করতে পাঠানো যায়। কিন্তু সে তো দিনে। মাত্র একবার। বাড়িতে ফ্রিজ নেই যে কোনো খাবার রেখে দেওয়া যাবে।
ওয়াদুদ সাহেব ভালো করে চেকআপ করলেন। বললেন, যদিও ডেট আগস্টে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়িই ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। হাসিনাও জানালেন, তিনি ব্যথা অনুভব করেন।
এরই মধ্যে বাড়ির প্রহরায় নিযুক্ত দলের কমান্ডার মেজর হোসেনের বদলে এসেছেন মেজর ইকবাল। তার ব্যবহার খুবই খারাপ।
যখন হাসিনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হবে, রেনু। বললেন, আমিও মেয়ের সঙ্গে যাব। আমি মা। আমার মেয়ের বাচ্চা হওয়ার। সময়টাতে আমি তার পাশে থাকব।
মেজর ইকবাল বললেন, না। তা হবে না। ওপরের অর্ডার। বেগম মুজিব। কিছুতেই বাইরে বের হতে পারবেন না।
হাসিনা কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠলেন। রেনুও কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বিদায় দিলেন।
তখন খোকা বের হয়ে গেলেন হাসিনাদের ছোট ফুফু লিলির বাসায়। লিলিকে জানালেন সব কথা। লিলি বললেন, আমিই গিয়ে হাসুর সঙ্গে কেবিনে থাকব।
জুলাই ১৯৭১। আরবান গেরিলারা ঢুকে পড়েছে ঢাকায়। তারা একটার পর একটা অপারেশন করছে। ঢাকা শহরের মিলিটারি পোস্ট, কেপিআই বা কি পয়েন্ট ইনস্টলেশনে হামলা হচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা মারা যাচ্ছে। এর মুখে-ওর মুখে সেসব কথা পত্রেপুষ্পে পল্লবিত হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসিতেও সেসব খবর শোনা যাচ্ছে। আর ওয়াজেদ মিয়া কিংবা খোকা যখন বাইরে যান, এসব খবর পান। এসে রেনুকে শোনান। হাসিনাকে শোনান। ১৯ জুলাই গেরিলারা ঢাকার কতগুলো পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিল। পরের দিন সেই খবর প্রচার করল স্বাধীন বাংলা বেতার। কেন্দ্র। রেনু বললেন খোকাকে, এই সব অপারেশনে কি কামালও আছে?
.
২৭ জুলাই রাত আটটার দিকে হাসিনার কোলজুড়ে আসে এক পুত্রসন্তান। হাসিনার লিলি ফুফু বাচ্চা দেখেই বলে, ছেলে হয়েছে, দেখতে একদম তার দাদার মতো হয়েছে।
ওয়াজেদ মিয়া হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজান দিলেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হাসিনা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন। ওয়াজেদের মুখেও মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কথা শোনেন। তাঁর ব্যথা অনেকটাই কমে যায়।
রেনু গৃহবন্দী। কাঁদেন। ওয়াজেদের কাছে, খোকার কাছে খোঁজ নেন, হাসু কেমন আছে?
খোকাকে তিনি বললেন, ও খোকা। হাসুর কী খবর। ভাইডি যা না একটু ফোন কর না!
খোকা তখন বাড়ি থেকে বের হলেন। গেলেন পাশের বাড়িতে। এটা কবি সিকান্দার আবু জাফরের বাসা। গিয়ে বললেন, ফোন করব। ফোন করার জন্য খোকা এর আগেও এ বাড়িতে এসেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফোন করে কেবিন নম্বর দেওয়া হলো। একটু পরে লিলির গলা শোনা গেল।
হ্যালো।
লিলি, আমি খোকাভাই। কী খবর।
খবর ভালো। হাসুর ছেলে হয়েছে। হাসু-ছেলে দুজনেই ভালো আছে। ছেলে দেখতে একদম ভাইজানের মতো হয়েছে।
কবি জাফরকে ধন্যবাদ জানিয়ে মমিনুল হক খোকা ফিরে এলেন সৈন্যঘেরা বাড়িটাতে। রেনুকে জানালেন সুখবরটা। রেনু খুশিতে কী করবেন, কী বলবেন বুঝে উঠছেন না। শেষে বললেন, তুই যে আমাকে কত বড় সুসংবাদ দিলি কী করে বোঝাব। আলহামদুলিল্লাহ। শোন তুই যা চাইবি, আমি তোকে তা-ই দেব। বল কী চাস!
আমি কিছু চাই না, ভাবি। একটাই জিনিস চাই, মিয়া ভাই যেন নিরাপদে আমাদের মধ্যে ফিরে আসেন। আল্লাহর কাছে মিয়া ভাইয়ের প্রাণভিক্ষা চাই।
ভাবি বললেন, সেই দোয়াই তো আল্লাহর কাছে সব সময় করি। তবু তোকে আমি কী দেই, নে, এই আংটিটা নে। বলে তিনি তার হাতের আঙুল থেকে সোনার আংটি খুলে খোকার হাতে দিলেন।
রেনু কাঁদছেন। খোকাও আংটি হাতে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
রেহানা খুশি। জামাল খুশি। কিন্তু কিছু করার নেই। তাদের ঘরের বাইরে পা রাখা নিষেধ।
কদিন পরে হাসিনা নবজাতককে কোলে করে বাসায় ফিরলেন।
রেহানা আর আপার বিছানার কাছছাড়া হয় না। রাসেলও বিছানায় তার ভাগনের পাশে বসে গেল। বলতে লাগল, মামা, মামা!
দুদিন পরে ওয়াজেদ মিয়া বললেন, ছেলের নাম কী রাখবা?
হাসিনা বললেন, আব্বাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আব্বা আপনার নাতি বা নাতনির নাম কী রাখবেন? আব্বা তখন অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে খুব ব্যস্ত। বললেন, একটু ভাবি। কাল আবার জিজ্ঞেস করিস। পরের দিন জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ওর নাম হবে জয়! ও বাংলার জয় এনে দেবে। আমি বললাম, যদি মেয়ে হয় তাহলে। ও হো এটা তো ভাবি নাই। আরও ভাবি… পরে আবার ধরলাম আব্বাকে। বললাম, আব্বা, আমার মেয়ে হলে কী নাম রাখব? আব্বা বললেন, ভাবি নাই। শোন, তোর ছেলেই হবে। যাহ। শোন, সহজ বুদ্ধি আছে। মেয়ে হলে নাম রেখে দিবি জয়া।
রেনু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি নাতিকে কোলে তুলে নিলেন, বললেন, সত্যিই এ আমার জয়। আমার কোনো ভাই নাই, এবার আমি পেলাম ভাই, জয় ভাই। আর শোনো, হাসুর আব্বা রেখেছেন ডাকনাম, ভালো নাম আমি রাখব। মুজিবের সাথে মিলায়ে ওর নাম রাখো সজীব।
ওয়াজেদ সাহেব খুশিই হলেন। সবাই মিলে ঠিক করা হলো, ছেলের নাম হবে সজীব ওয়াজেদ জয়।
জামাল রেহানাকে বললেন, শোন, ভাগনে এসে গেছে। মামা-ভাগনে যেখানে আপদ নাই সেখানে। আমার প্যান্টের ভেতরে একটা গোপন পকেট সেলাই করে বানিয়ে দে।
রেহানা বললেন, প্যান্টের ভেতরের পকেট দিয়ে কী হবে?
বলতে পারি, কিন্তু তোকে কসম কাটতে হবে, তুই কাউকে বলবি না। মাকে না, আপাকে না। কাউকে না।
আচ্ছা বলব না।
আমি যুদ্ধ করতে চলে যাব।
কেমন করে? বাড়ি থেকে বের হবা কী করে?
চুপ করে শোন। একজন মিলিটারি আছে পয়েন্দা খান। ওর সঙ্গে গল্প করে করে খাতির করে ফেলেছি। সে বলেছে, বাড়ির পেছনে যখন ওর ডিউটি থাকবে, সে আমাকে দেয়াল টপকাতে দেবে।
কী বলো? গুলি করে যদি?
না করবে না।
বাইরে বের হয়ে কী করবা? তোমাকে রাস্তায় আর্মি ধরবে।
একটা আইডি কার্ড বানাইছি।
কেমন করে?
আবদুলকে দিয়ে। আবদুল বাইরে গিয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা দোকান থেকে বানিয়ে দিয়েছে।
তারপর তোমার প্ল্যানটা কী?
তোকে প্ল্যান বলব কেন? চুপ করে থাক।
রেহানা চুপ করে থাকলেন। বাড়ির গার্ড মিলিটারিগুলোও যা অত্যাচার শুরু করেছে। রাতের বেলা তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছিলেন, হঠাৎ স্টেনগান নিয়ে একজন হাবিলদার ঢুকে পড়েছে, বলে, তোমরা স্বাধীন বাংলা শোনো। জামালকে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে পা উল্টা করে ঝুলিয়ে পিটিয়ে চামড়া তুলে নেব।
জামাল সেদিনই ঠিক করে রেখেছেন, আর নয়। যুদ্ধে যেতেই হবে। এই অপমানের শোধ নিতেই হবে।
রেহানা বাথরুমে ঢুকে জামালের প্যান্টে গোপন পকেট বানিয়ে দিলেন।
সকাল আটটার দিকে জামাল দেয়াল টপকালেন।
তার কিছুক্ষণ পর রেনু বললেন, জামাল কই।
রেহানা চুপ। আবদুল চুপ।
রেনু কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
৫৩
ব্যাঙ্গমা বলল, কিশোর শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াটা আছিল খুবই ঝুঁকির কাজ!
ব্যাঙ্গমি বলল, বেসম্ভব ঝুঁকির কাজ। এক নম্বর হইল, তিনি নিজে গৃহবন্দী। ঘরে বইসা তিনি তার সমবয়সের আবদুলকে বাইরে পাঠায়া যাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট করলেন। প্রথমে তিনি গেলেন ভিআইপি স্টোরের সামনে। সেই রকমই কথা আছিল। ভিআইপি স্টোরের কর্মচারী ফিরোজের বাড়ি কুমিল্লা বর্ডারের কাছে। সে তারে কথা দিল বর্ডার পার কইরা দিবে। এই এক কথায় বাসা থাইকা বাইরায়া ভিআইপি স্টোরের সামনে গিয়া ফিরোজরে খুঁইজা বাইর কইরা তার বাসায় গিয়া তিনি রাইত কাটাইলেন। এই দিকে বাড়িতে কান্নাকাটি। মিলিটারি গো মইধ্যে তোলপাড়। ছেলে হারায়া গেছে। মিলিটারিরা যখন খোঁজা শুরু করছে, তহনো জামাল ঢাকায়। ৫ আগস্টে বাইর হইলেন। ৬ আগস্ট বেবিট্যাক্সি লইয়া রওনা দিলেন কাঁচপুর ফেরিঘাটের দিকে। কাঁচপুর ফেরিঘাটে গোলযোগ হইছে, গোলাগুলি হইছে, ওই দিকে কেউই যাইতে চায় না। বেশি টাকা ভাড়া দিয়া রাজি করায়া জামাল আর ফিরোজ গেলেন ফেরিঘাটে। দেখেন, মিলিটারি লোকজনরে নৌকা পার করতে তদারক করতাছে। সেই মিলিটারির সামনে দিয়া নৌকায় উইঠা তারা নদী পার হইলেন। এইভাবে একবার নৌকায়, একবার হাইটা, আবার নৌকায় কইরা পাঁচ দিন ধইরা পথ চইলা তারা বর্ডারে পৌঁছান। জামালের পরনে আছিল লুঙ্গি। অনেক জায়গায় রাত কাটাইছেন। লোকে টের পাইছে মজিবরের পোলা। তারা আদর করছে। লুঙ্গি কিইনা দিছে। মুরগি জবাই কইরা খাওয়াইছে। আবার বেশি জানাজানি হইলে ধরা পড়ার ভয়ে পলাইতে হইছে। এইটা আছিল রিস্কের উপরে রিস্ক। আর ১৭ বছরের জামাল পথে গান ধরছেন :
বিশ্বকবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নাইকো শেষ
বাংলাদেশ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আজ্জম ভূঁইয়ার আগরতলার ক্যাম্প হাফানিয়াতে পৌঁছানোর পর তাঁরা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাইলেন বলা যায়।
.
আজ্জম ভূঁইয়া তাদের শ্রমিকনেতা আবদুল মান্নানের কাছে পৌঁছে দেন। আবদুল মান্নান শেখ জামালকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন, এমনি রকম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁকে পৌঁছে দিলেন শেখ মণির কাছে।
শেখ মণির আগরতলার আস্তানায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়েন জামাল।
শেখ মণি বললেন, কে?
গলা চিনে জামাল বললেন, মণি ভাই, আমি জামাল।
মণি ছুটে এলেন। লুঙ্গি পরা, ধূলিধূসরিত, এ কে? জামাল! জামাল!
দুজন দুজনকে ধরে কাঁদতে থাকলেন। গোবেচারার মতো তাকিয়ে রইলেন ফিরোজ।
শেখ মণি বললেন, তুই ক্যান আসছিস?
যুদ্ধ করতে।
যাহ। যুদ্ধ করতে হবে না।
না। আমি যুদ্ধ করব।
তোর বয়স ১৮ হয় নাই।
১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সীরাও যুদ্ধ করতেছে।
ওকে। তাহলে তুই আমাদের মুজিববাহিনীতে যোগ দে।
ক্যান? আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিব।
আরে আমাদেরটাও মুক্তিবাহিনী। তবে আমাদেরটার নাম মুজিববাহিনী। আরেকটা নাম আছে। বিএলএফ। বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট। মুক্তিবাহিনীতে আর্মিরা আছে, তারা পাকিস্তানে ট্রেনিং নেওয়া। আর আছে চীনপন্থীরা। নকশালরা। আছে ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ। এরা কোনো দিনও আওয়ামী লীগের নেতাকে নেতা মানে নাই। ভবিষ্যতেও মানবে না। ছয় দফাঁকে বলেছে, সিআইএর তৈরি কাগজ। স্বাধীনতাযুদ্ধকে বলছে, দুই কুকুরের মারামারি। কাজেই আমরা মুজিববাহিনী করছি। আমরাও যুদ্ধ করি। আমরাও পাকিস্তানিদের সঙ্গে লড়াই করি। কিন্তু আমরা শেখ মুজিবের ক্যাডার। বুঝলি?
জি। বুঝেছি।
তাহলে তুই কোনটাতে যাবি? মুক্তিবাহিনী না মুজিববাহিনী?
মুজিববাহিনী।
গুড।
.
শেখ শহীদও মুজিববাহিনীর ট্রেনিংয়ে গেলেন। হলেন মুজিববাহিনীর ফরিদপুর অঞ্চলের কমান্ডার।
শেখ জামাল মুজিববাহিনীর ট্রেনিং শেষে যশোর খুলনা অঞ্চলের ফ্রন্টে চলে গেলেন।
৫৪
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি বলাবলি করতে লাগল :
কিসিঞ্জারের গোপন চীন সফরের পর ইয়াহিয়া খানের সবকিছু বেড়ে গেছে। তিনি এখন আরও বেশি করে মদ খান। আরও বেপরোয়াভাবে নারীসঙ্গ করেন। সকাল থেকেই নারীরা তার প্রেসিডেন্ট হাউসে ঢুকতে থাকে। সারা দিন থাকে। কেউ কেউ থাকে সারা রাত। হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে বলা হবে, ৫০০ নারী প্রেসিডেন্ট হাউসে যাতায়াত করেছেন ১৯৭১ সালে। এদের প্রত্যেকে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন জেনারেল নাসিম, হামিদ, লতিফ, খুদাদাদ, ইয়াকুব, রিয়াজ, পীরজাদা, মিয়া এবং আরও অনেকের স্ত্রীগণ। এরা ছিলেন নিয়মিত দর্শনার্থী। আরও আছেন বেগম জুনাগড়, নাজলি বেগম, মিসেস জয়নব ১, মিসেস জয়নব ২, আনোয়ারা বেগম, ঢাকার শিল্পপতি লিলি খান, লায়লা মোজাম্মিল, নায়িকা শবনম, শাগুফতা, নাগমা।
ব্যাঙ্গমা বলল, এটা তুমি কী কইতাছ? ৫০০ জন নারী?
ব্যাঙ্গমি বলল, আমি কইতাছি না যে ৫০০ জনের প্রত্যেকের লগে তাঁর আকামের সম্পর্ক হইছিল, কিন্তু হ্যাঁগো অনেকেই প্রেসিডেন্টের কাছ থাইকা অনেক অবৈধ সুযোগ আদায় কইরা লইতে সক্ষম হইছিল।
এইটা অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য।
ব্যাঙ্গমা বলল, ইয়াহিয়া ইসলামাবাদ আর লাহোরের রাজপথে খোলা জিপে চইড়া তাঁর বান্ধবীদের লইয়া ঘুরতেন। এমনকি গাড়িতে খাড়ায়া খোলা আকাশের নিচে প্রকাশ্যে তিনি বান্ধবীকে চুমাচুমি করতে লাগলেন। এইটা তিনি প্রতি রাইতে করতেন। একেক দিন একেকজন থাকত তাঁর পাশে। তাঁর পেছনে পেছনে যাইত নিরাপত্তারক্ষীরা। হ্যারা সবই দেখত।
.
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসপি সরদার মুহাম্মদ চৌধুরী গেলেন ডিআইজি কাজী মুহাম্মদ আজমের কাছে।
স্যার।
বলুন।
প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি নিয়ে আমার একটা উদ্বেগ আছে, স্যার।
কী সেটা, বলুন।
স্যার, প্রেসিডেন্ট রোজ রাতে খোলা জিপ নিয়ে বের হন। ভোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে পাশের সঙ্গিনীকে প্রকাশ্যে চুম্বন করেন। এই নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যেই নানান গুঞ্জন। তারা নিজেরাই ক্ষুব্ধ। যেকোনো দিন কেউ যদি খেপে গিয়ে কিছু করে বসে, স্যার।
সরদার, দেশে কী হচ্ছে, আপনি জানেন। পূর্বে আমাদের সৈনিকেরা যুদ্ধ করছে। সেখানে আমাদের সৈনিকেরা মারা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্টের ওপরে কত চাপ। তাঁর কত উদ্বেগ। তার তো একটু আমোদ-ফুর্তির দরকার আছে। তা না হলে তিনি রাষ্ট্রীয় কার্য চালাবেন কী করে।
তা তো বটেই, স্যার। তা তো বটেই, স্যার।
ইয়াহিয়া আর পারছেন না। আর ভালো লাগে না। পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যরা লড়াই করছে। ভালো খবর আসছে। খারাপ খবরও আসছে। খারাপ খবরের মধ্যে হলো ভারতীয়রা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে নানাভাবে। ইন্দিরা গান্ধী অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন। তাঁর ওখানে নাকি ৭০ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি তিনি তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে একটা প্রবাসী সরকারকেও ওই দেশে আশ্রয় দিয়েছেন। রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র দিচ্ছে। আমেরিকা পাকিস্তানকে দিয়েছে অল্প কিছু অস্ত্র। এখন চীনের সাহায্য দরকার। নিক্সনকে চীনে পাঠিয়ে এই অঙ্গীকার আবারও পাওয়া গেছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগলে চীন পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করবে।
তিনি সোজা উঠলেন শামীমের বাসায়। মিসেস কে এন হুসেন। তাঁর স্বামীকে পশ্চিম পাকিস্তানে আনা হয়েছিল স্পেশাল ব্রাঞ্চের আইজি করে। এরপর স্বামী বেচারাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সুইজারল্যান্ডে, রাষ্ট্রদূত করে। এখন শামীম তার বাসায় একা। প্রেসিডেন্ট সেখানে গিয়ে উঠলেন।
বাইরে নিরাপত্তারক্ষীরা সব দাঁড়িয়ে আছে।
ইয়াহিয়ার আর বেরোনোর নাম নেই। তিন দিন তিন রাত প্রেসিডেন্ট সেই বাড়িতে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগহীন অবস্থায় কাটিয়ে দিলেন।
চতুর্থ দিন তাঁকে দেখা গেল বেরোতে। তাঁর বগলে শামীম। শামীমকে নিয়ে তিনি উঠলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। সেখানে শামীমকে চাকরি দেওয়া হলো। পদের নাম, ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর।
এখন আর প্রেসিডেন্টের কোনো অসুবিধাই রইল না শামীমের সঙ্গসুধা ভোগের। যখনই ইচ্ছা হতো, তিনি চলে আসতেন এই অতিথি ভবনে।
তিনি লাহোরে চলে যেতেন প্রায়ই। সেখানে আসতেন ম্যাডাম নুরজাহান।
নুরি!
সরকার।
তোমার এখনকার ড্রেসটা আরও সুন্দর।
সকালেরটা কি খারাপ ছিল।
না। তবে এটা আরও সুন্দর।
রাতেরটা আরও সুন্দর হবে, সরকার। নুরজাহান ইয়াহিয়াকে ডাকতেন সরকার বলে।
নুরজাহান বললেন, সরকার, আমি টোকিও যাব। আমার ডলার দরকার।
সরকারি টুরে যাচ্ছ। যাও। ডলার নিয়ে যাও।
আপনার লোকেরা আমাকে ডলার দিতে রাজি না। এটা নাকি নিয়মে নাই। আমি টাকা পেতে পারি। কিন্তু ডলার না।
নিয়ম কী? সামরিক আইনে সামরিক আইন প্রশাসক যা বলবে তা-ই নিয়ম। যাও। ডলার তোমার ঘরে পৌঁছে যাবে।
নুরি আর ইয়াহিয়া এক ঘরে। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ডাক এসেছে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে। খুবই জরুরি একটা কাজ করতে হবে।
কে ঢুকবে রাষ্ট্রপতির কক্ষে।
আবারও ডাক পড়ল জেনারেল রানি ওরফে আকলিমের।
রাষ্ট্রপতির একটা জিনিস ছিল, তিনি তার খাসকামরার বিশাল কাঠের দরজার কপাটে কখনো ছিটকিনি লাগাতেন না।
দুটো নক করে আকলিম ঢুকে গেলেন ইয়াহিয়ার ঘরে।
পরে তিনি হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্তে বলবেন, ম্যাডাম নুরি ও আগা জানি সম্পূর্ণ নগ্ন। ম্যাডামের সমস্ত শরীরে ইয়াহিয়া হুইস্কি ছিটাচ্ছেন। আর জিব দিয়ে সেই হুইস্কি তিনি পান করছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা পরে সেই কথা প্রকাশ করে দেবেন।
আরেক দিনের ঘটনা। অনেক রাতে আকলিমের কাছে এসেছেন তার আগা জানি। তাঁর পা টলটলায়মান। তাঁর কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, রানি, রানি, তুমি কি ওই গানটা জানো? চিচে দা চালা।
না।
আরে ধি রানি সিনেমার গান।
গান শোনার সময় কই আমার, আগা জানি।
কিন্তু ওই গানটা যে আমার এখনই শুনতে হবে, রানি।
আপনি বসেন। আপনার পদসেবা করে ধন্য হই।
না। ইসহাক। ইসহাক।
স্যার।
আমার এখনই এই গান শুনতে হবে-চিচে দা চালা। যাও, যেখান থেকে পারো ওই গানের ক্যাসেট আনো।
স্যার। এখন বাজে রাত দুটো, স্যার।
তো?
সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, স্যার।
তাতে কী? আমি পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। আমার এখন গান শুনতে ইচ্ছা করছে। আমি এখনই শুনব। যাও। দোকানে যাও। দোকান ভাঙো। ক্যাসেট নিয়ে আসো।
সৈনিকেরা ছুটল তখনই। ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে দোকানির ঘুম ভাঙাল। ক্যাসেট জোগাড় করল। রাত তিনটার মধ্যে আকলিমের বাড়িতে চলে এল সেই ক্যাসেট।
আগা জানি সেই গান শুনে ভুড়ি দুলিয়ে নাচতে লাগলেন।
.
নাজলি বেগম তাঁর এক লীলাসঙ্গিনী।
পার্টিতে গিয়ে তিনি কোলে বসে পড়লেন ইয়াহিয়ার।
কী ডার্লিং। কী চাও?
আপনার অনুগ্রহ চাই। জনাব।
অনুগ্রহ কেন! তুমি আমার প্রেম পাবে।
জনাব। আমি পিআইসিসি ব্যাংক থেকে লোন চেয়েছি। ব্যাংকের এমডি আমাকে লোন দিচ্ছে না।
ওকে। কালকেই ওর চাকরি খেয়ে ফেলব। তোমার মতো সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে যে অপমান করবে, তার স্থান পাকিস্তান মুলুকে হবে না। হতে পারে না।
পরের দিনই বেচারা ব্যাংক এমডির চাকরি চলে গেল।
.
৬১, হারলি স্ট্রিট রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া একটা প্রাসাদ বানালেন। বলা ভালো, প্রমোদকুঞ্জ। সেখানে তিনি যেতেন, সেনাপ্রধান হামিদ যেতেন। নরক গুলজার হতো। নাচ-গান, মদ-নারী। হুল্লোড়-পার্টি।
এমনি এক পার্টিতে ইয়াহিয়া বললেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করব। আই উইল কিল মুজিব। কীভাবে মারব? কী বলো তোমরা? বিচার করব, নাকি বিচার না করেই মারব।
একজন বান্ধবী চিৎকার করে বলল, কিসের বিচার। কোনো বিচার লাগবে না। জাস্ট হ্যাং হিম।
আরেকজন বলল, নো নো। ফাঁসি না। আমি চাই তাঁকে শুট করবে।
একজন বান্ধবী মদালস গলায় বলল, বিচার করবে।
কেন, বিচার করব কেন? ইয়াহিয়া বললেন।
কারণ, তুমি তো তাঁকে মারবেই। বিচারের রায় তো মৃত্যুদণ্ডই হবে। বিচার করে তাঁর রায় মৃত্যুদণ্ড হলে সবাই বলবে, বিচার হয়েছে। তা না হলে সবাই বলবে, তুমি খুন করেছ।
রাইট। রাইট। তিনি তাঁর এই বান্ধবীকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়লেন।
ইয়াহিয়া বান্ধবীর কথার গুরুত্ব বুঝেছেন। বিনা বিচারে মুজিবকে মেরে ফেলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার বিচার করতে হবে। লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ১৯ জুলাইয়ে প্রকাশিত সাক্ষাঙ্কারে ইয়াহিয়া বললেন, শেখ মুজিবের বিচার করা হবে। বিচার হবে গোপনে। তা হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, তার অনেকগুলোর শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড।
২ আগস্ট প্রেসনোট জারি করা হলো। শেখ মুজিবের বিচার শুরু হচ্ছে সামরিক আদালতে। ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন ইয়াহিয়া। ঘোষণা করলেন, শেখ মুজিবের বিচার শুরু হচ্ছে। পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তার বিচার হবে। রাষ্ট্রের আইন অনুসারেই বিচার হবে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো বিদ্বেষ নেই। বরং তার দুঃখই হচ্ছে যে কৃতকর্মের জন্য শেখ মুজিবকে শাস্তি পেতেই হবে।
.
সানডে টাইমস-এর রালফ শ সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। ইয়াহিয়া তাঁকে সময় দিয়েছেন বেলা তিনটায়। বেলা তিনটায়ও ইয়াহিয়ার সামনে গেলাসে করে হুইস্কি এল। বরফ এল।
ধন্যবাদ, প্রেসিডেন্ট, আমি সূর্য ডোবার আগে ড্রিংক করি না। রালফ শ বললেন। আপনাকে ধন্যবাদ আপনি আমাকে একান্ত সময় দিচ্ছেন। আমার প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিব কি বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। শেখ মুজিব বেঁচে আছেন।
তিনি এখন কোথায়?
তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে একটা প্রথম শ্রেণির জেলখানায় রাখা হয়েছে।
তিনি কেমন আছেন?
সুস্থ আছেন। ভালো আছেন। তবে আজকের পর তাঁর জীবনে কী হবে, সে ওয়াদা আমি করতে পারব না।
মানে কী? আপনি কি তাকে হত্যা করবেন?
তার মানে এই নয় যে আগামীকালই তাকে গুলি করা হবে। তার তো স্বাভাবিক মৃত্যুও হতে পারে। তাকে প্রথম শ্রেণির কারাগারেই রাখা হয়েছে। তাকে কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। তার ঘরে ফ্যান আছে, বাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থা আছে, বিছানা আছে। তবে ঘরটা ছোট। এটা ঠিক।
তার স্বাস্থ্য কেমন আছে?
ভালো আছে। রোজ একজন ডাক্তার তাকে দেখেন। তিনি তো পশ্চিম পাকিস্তানের খাবার খেতে পারতেন না। এ জন্য তাঁকে একজন বাঙালি বাবুর্চি দেওয়া হয়েছে। এখন তার ওজন আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তিনি আগে কোনো কথা বলতেন না। এখন অনেক গল্প করেন। কথার তুবড়ি ছোটে তাঁর মুখ থেকে।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, এই সাক্ষাৎকার ৮ আগস্ট সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত হয়।
.
শেখ মুজিবকে মিয়ানওয়ালি জেল থেকে হেলিকপ্টারে তুলে আনা হয়েছে ফয়সালাবাদ লায়ালপুর জেলে। এখানে তাকে একজন বাঙালি পাঁচক দেওয়া হয়েছে। কারণ, মিয়ানওয়ালি জেলে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড গরমে জানালাহীন ছোট্ট সেলে থাকতে থাকতে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এখন তাঁকে আনা হবে জেলখানার ভেতরেই একটা আদালতের সামনে। বিচারকসহ বেশ কিছু মানুষ তাঁকে দেখবে। এই অবস্থায় জীর্ণশীর্ণ মুজিব তাঁদের করুণার উদ্রেক করতে পারে।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে দেড় শ মাইল দূরে লায়ালপুর জেল। তাঁর সেলের কাছেই একটা লাল ইটের একতলা ভবনকে আদালত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হলো ১১ আগস্ট। একজন ব্রিগেডিয়ার প্রধান বিচারপতি, দুজন সেনাবাহিনীর অফিসার, একজন নৌবাহিনীর অফিসার, আরেকজন জেলা জজকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে ৫ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
শেখ মুজিবকে বলা হলো, আপনার পক্ষে কাকে আপনি উকিল নিয়োগ করতে চ
শেখ মুজিব বললেন, ড. কামাল হোসেনকে।
না। তা করা যাবে না। সে নিজেই তো পাকিস্তানের কারাগারে। আপনি অন্য কাউকে বাছাই করুন।
মুজিব বললেন, এ কে ব্রোহি।
ব্রোহি পাকিস্তানি, কিন্তু তিনি আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবের আইনজীবী ছিলেন। ব্রোহিকে নিযুক্তি দেওয়া হলো।
মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১২টি। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগ এমন করে সাজানো হয়েছে যে সেসবের প্রতিটার জন্য শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড।
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হলো। মুজিব নির্বিকার রইলেন।
২৬ মার্চে রেডিও-টেলিভিশনে দেওয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণের টেপ বাজিয়ে শোনানো হলো আদালতে।
মুজিব বললেন, আমি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছি। আমি ইয়াহিয়া খানের বিচার করতে পারি। ইয়াহিয়া খান আমার বিচার করতে পারে না। এই আদালত সম্পূর্ণ অবৈধ। এই অবৈধ আদালতের কোনো কাজে অংশ নেওয়া মানে অবৈধ কাজ করা। আমি এর অংশ হতে পারব না। মি. ব্রোহি, আপনি যেতে পারেন। আমি এই বিচারকাজের কোনো কিছুতেই অংশ নেব না।
ব্রোহি মনে মনে খুশি হলেন। এই প্রহসনের বিচারে তিনিও থাকতে চাইছিলেন না। কিন্তু আদালত বললেন, মিস্টার ব্রোহি, আপনি থাকুন। আপনার উপস্থিতি আমাদের দরকার।
.
রোজ সকাল ১০টায় শেখ মুজিবকে লম্বা করিডর পার করে আনা হয়। আদালতকক্ষে। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। শেখ মুজিব কোনো কিছু শোনেন না। তিনি আদালতকক্ষের জানালা দিয়ে আকাশ দেখেন।
তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে এসেছেন একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী। সরকারি উকিল তাঁর সঙ্গে কানে কানে কথা বললেন। বিচারকেরা তাঁদের চেয়ারে বসে আছেন। মাড়োয়ারি বললেন, শেখ মুজিব তাঁকে বলেছেন, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হলো পাকিস্তানকে ধ্বংস করা।
ব্রোহি দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, কবে শেখ মুজিব এটা বলেছিলেন?
আমার ঠিক তারিখটা মনে নেই।
কোথায় বলেছিলেন?
তাঁর বাসায়।
তাঁর বাসাটা কোথায়?
ঢাকা।
ঢাকায় কোথায়?
আমার ঠিক জায়গাটার নাম মনে পড়ছে না।
আপনি তাঁর বাসায় কবে গিয়েছিলেন?
মনে পড়ছে না।
তাঁর বাড়িটা কয়তলা? আপনারা কী ধরনের লিফটে চড়ে তাঁর ফ্ল্যাটে গেলেন।
আমার ঠিক মনে নেই।
আপনি কি নিজ কানে এটা শুনেছেন?
না। আমার এক বন্ধু শুনেছে।
ব্রোহি আবার গেলেন মুজিবের কাছে। আপনি কথা বলুন।
মুজিব বললেন, এই আদালত অবৈধ। আমি কিছু বলব না।
ইয়াহিয়া খানের কাছে মামলার অগ্রগতির কাগজ এসেছে। ইয়াহিয়া বললেন, আচ্ছা, মুজিব কিছু বলছে না। এইভাবে চলবে না। তিনি নতুন ফরমান জারি করলেন। ৮৮ নম্বর সামরিক বিধি। এতে বলা হলো, শেখ মুজিবের বিচারের সময় অভিযুক্ত পক্ষের উকিলের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। সাক্ষীর সাক্ষ্য পুরোটা লিপিবদ্ধ করার দরকার নেই। শুধু সারসংক্ষেপ নথিভুক্ত করলেই চলবে। কোনো সাক্ষী যদি বিরক্তিকর, অপ্রয়োজনীয়, কিংবা লম্বা সাক্ষ্য দিতে থাকে, যা বিচারকার্যকে বিলম্বিত করতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়, সে সাক্ষীকে সামরিক আদালত বাতিল করতে পারবে।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, সরকারপক্ষ মোট ১০৫ জনের নাম সাক্ষী হিসেবে দিছিল। এদের মধ্যে বেশির ভাগই আছিল বাঙালি সামরিক সেনা কর্মকর্তা। প্রচণ্ড নির্যাতন কইরা তাগো কাছ থাইকা জবানবন্দি আদায় কইরা নিয়া স্বাক্ষর করায়া নেওয়া হইছিল। তবে আদালতে বেশির ভাগ সাক্ষীকেই হাজির করতে সেনা কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হইছিল। আর এ কে ব্রোহি এবং তাঁর চার সহযোগীর জেরার মুখে সাক্ষীরা সবাই আউলা-ঝাউলা কথা কইতে থাকলেন।
ব্যাঙ্গমি বলে, শেখ মুজিবের বিচার গোপন সামরিক আদালতে হইতেছে, এই খবর ছড়ায়া পড়ার সাথে সাথে সারা পৃথিবীর সব বিবেকবান মানুষ একযোগে এবং আলাদাভাবে প্রতিবাদ কইরা উঠলেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে জানাইলেন, এইটা উচিত হইতেছে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শেখ মুজিবকে প্রিজনার অব কনশায়েন্স বইলা অভিহিত করল। ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্টস কমিশন এই বিচারের বৈধতা নিয়াই প্রশ্ন তুলল। বহু দেশ, বহু সরকার, বহু সংগঠন শেখ মুজিবের এই বিচার-প্রহসন বন্ধ করার লাইগা বিবৃতি দিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ কইরা বলার চেষ্টা করল, শেখ মুজিবকে য্যান ফাঁসি দেওয়া না হয়।
.
১১ আগস্ট ইন্দিরা লিখেছিলেন নিক্সনকে, আমাদের শঙ্কা, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার অজুহাত হিসেবে তথাকথিত বিচারকে ব্যবহার করা হবে। তার ফলটা দাঁড়াবে এই, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, ভারতের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে ভারতেও এর প্রতিক্রিয়া হবে চরম। আমাদের অনুরোধ, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপরে আপনি আপনার প্রভাব খাটান, যেন তিনি একটা বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন।
৫৫
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন এ আর মল্লিক আর আনিসুজ্জামান। তাঁরা বেরিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে সভা-সেমিনার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠন করতে।
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল আলিম। তিনি সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ-সভার। একমাত্র বক্তা মল্লিক। আনিসুজ্জামানের কাজ শুধু উপস্থিত থাকা।
আনিসুজ্জামানদের ঘুরে ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখানো হচ্ছে।
তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের সফরসূচি। ঘড়ির কাঁটা ধরে কখন খাওয়া, কখন সভা, কখন বেড়ানো, কখন প্রাতরাশ। সবই চলছে নিয়মমাফিক।
আনিসুজ্জামান বাংলায় বললেন মল্লিক সাহেবকে, সব ঠিক আছে। কিন্তু কোথাও প্রাণের ছোঁয়া নাই।
মল্লিক বললেন, ভারতের সব জায়গায় দেখেছি, বেশির ভাগ মুসলমান। স্বাধীন বাংলাদেশ চায় না। তারা আমাদের কাজ সমর্থন করে না। তারা চায় পাকিস্তান এক থাকুক।
আনিসুজ্জামান বললেন, আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও এই মনোভাব। তোমরা আত্মীয়। এসেছ। সমাদর যা করার করব। কিন্তু মুসলমানদের একটা দেশ হয়েছে, সেটা কেন ভাঙছ।
মল্লিক বললেন, শুনেছি ভারতের মুসলমানরা নাকি ক্রিকেট খেলায় ভারতকে সমর্থন না করে পাকিস্তানকে সমর্থন করে!
আনিসুজ্জামান বললেন, তা অবশ্য আমি জানি না।
আনিসুজ্জামান আর মল্লিক এই মুহূর্তে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে। গাড়ি করে ক্যাম্পাস ঘুরছেন তাঁরা। এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাচ্ছেন। চিকিৎসাকেন্দ্রে দেখার মতো কী থাকবে?
তবু তারা নামলেন। উঁচু সিঁড়ি। বেশ বড় বড় কলামওয়ালা ভবন। তাদের। নেওয়া হলো চিফ মেডিকেল অফিসারের কক্ষে।
দেয়ালে টাঙানো স্বাস্থ্যবিষয়ক বড় পোস্টার, যেখানে মানবদেহের ছবি। একটা কাঁচের আলমারিতে মোটা মোটা বই। বড় একটা টেবিল। টেবিলে ওষুধ কোম্পানির কলমদানি।
আনিসুজ্জামান ও মল্লিক বসলেন। চিফ মেডিকেল অফিসারের সঙ্গে পরিচিত হলেন তাঁরা। তাঁর নাম ডা. এস এম ইউসুফ।
পুরো আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এখানে-ওখানে যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, আর যা-ই পাওয়া যাক, আন্তরিকতার স্পর্শ তারা পাননি।
এই প্রথম কাউকে পাওয়া গেল, যিনি খুবই আগ্রহভরে তাঁদের বসালেন। বললেন, চা খান। আসুন, একটু গল্প করি। আমি আপনাদের বাংলাদেশ আন্দোলনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করি।
তাই নাকি? মল্লিক তাকালেন আনিসুজ্জামানের চোখে।
ডা. এস এম ইউসুফ বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়?
আনিসুজ্জামান বললেন, তিনি তো পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। তবে কোন কারাগারে, কী অবস্থা, জানতে দেওয়া হয় না।
তার কি বিচার করা হবে?
আনিসুজ্জামান বললেন, ইয়াহিয়া খান বারবার করে তা-ই বলছেন। তবে বিচার তো হবে ক্যামেরা ট্রায়াল। রায় ইয়াহিয়া খান দেবেন।
ডাক্তার সাহেব উদ্বিগ্ন। বললেন, তাঁর মুক্তির ব্যাপারে চাপ দেওয়া যায় না?
মল্লিক বললেন, ভারত সরকার যথেষ্ট চাপ দিচ্ছে। নানা দেশ থেকেও ইয়াহিয়া খানকে বলা হচ্ছে শেখ সাহেবের মুক্তির জন্য।
আনিসুজ্জামান বললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আর যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের মধ্য দিয়েই শেখ সাহেবকে মুক্ত করা সম্ভব।
ডাক্তার ইউসুফ আরও নানা প্রশ্ন করলেন। চা এল। আঙুর, আখরোট এল।
মল্লিক আর আনিসুজ্জামানেরও গল্প করতে ভালোই লাগছে।
শেষে আনিসুজ্জামানের কৌতূহল হলো। যেখানে ভারতীয় মুসলিমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানেরই সমর্থক, সেখানে ডা. ইউসুফ বাংলাদেশের প্রতি এত সহানুভূতি দেখাচ্ছেন কেন? শেষে আনিসুজ্জামান কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব, আপনার পুরো নামটা কি জানতে পারি? এস এম…
সাহেবজাদা মোহাম্মদ ইউসুফ খান।
আনিসুজ্জামান দ্বিধান্বিত কণ্ঠে শুধালেন, আপনি কি সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের কেউ হন, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন?
জি। উনি আমার নিজের ভাই। নিজের মায়ের পেটের ভাই।
আনিসুজ্জামান ও মল্লিক সব বুঝলেন।
তাঁদের মনে পড়ল, সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। তিনি বাঙালিদের পছন্দ করতেন। কষ্ট করে বাংলা শিখেছিলেন। তাঁর আরও একটা ভাই আছে। বড় ভাই। সাহেবজাদা ইউনুস খান। ইয়াকুব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় কর্তা। ইউনুস ভারতের সেনাবাহিনীর বড় কর্তা। দুজনে একসঙ্গে পড়তে গিয়েছিলেন ব্রিটেনে, ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর কোর্সে। দুজনেই সেখানে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে দুজন দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে সীমান্তের দুদিকে পরস্পরের দিকে কামান তাক করলেন। বড় ভাই ইউনুসের ছোঁড়া গুলি এসে লাগল ছোট ভাই ইয়াকুবের গায়ে। বড় ভাই চিৎকার করে বললেন, ছোট ভাই, দুঃখ করিস না রে, আমাদের যে সৈনিকের জীবন, কর্তব্য যে আমাদের পালন করতেই হবে।
সেখান থেকে ২৩ বছর পর। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ইয়াকুব পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এর আগে। আহসানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে গভর্নরের পদ থেকে। কারণ, আহসানও পূর্ব পাকিস্তানে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে। সে বড় বেশি নরম।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া অ্যাসেম্বলির অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত করে দিল, আর ভেতরে ভেতরে ঠিক করল, কামান দাগিয়ে, ট্যাংক চালিয়ে বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হবে, আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে কোনো দিনও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না, ইয়াহিয়া খানের বিশ্বস্ত সহযোগী প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এস জি এম পীরজাদার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন ইয়াকুব।
পীরজাদা বললেন, প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসছেন না। তোমরা অপারেশন ব্লিজ নিয়ে এগোতে থাকো। কামান আর ট্যাংকই সমাধান।
ইয়াকুব বললেন, আমি আমার নিজের দেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনের ওপর গুলি চালাতে পারব না। আমি পদত্যাগ করছি।
শুনে ইয়াহিয়া ভয়াবহ খেপে গেলেন। ইয়াকুবকে পাকিস্তানে ডেকে নেওয়া হলো। ইয়াহিয়া বললেন, ইয়াকুবের বিচার হবে। কোর্ট মার্শাল।
.
আনিসুজ্জামান বললেন, ইয়াকুব সাহেবের খবর কী?
ডাক্তার ইউসুফ বললেন, তাকে হাউস অ্যারেস্ট করে রাখা হয়েছে। তার বিচার করার কথা।
আপনি কি নামের শেষে খান লেখেন না?
না।
ও আচ্ছা। আমিও তাই ভেবেছিলাম।
ভালো থেকো। বিদায়!
আনিসুজ্জামান এবং এ আর মল্লিক মেডিকেল সেন্টার থেকে বের হয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন। ডা. ইউসুফের চোখের কোণে এক ফোঁটা জলে তাঁদের গাড়ির প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল কি উঠল না, তা আর আনিসুজ্জামান দেখতে পেলেন না।
৫৬
শেখ লুত্যর রহমানের বয়স নব্বইয়ের বেশি। সায়েরা খাতুনের বয়সও আশির বেশি। তারা এখন ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ডা. নুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে মমিনুল হক খোকা তাঁদের পিজি হাসপাতালের কেবিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি তো পুড়ে ছাই। গ্রামে এ মেয়ের বাড়ি ও মেয়ের বাড়ি রিফিউজি জীবন যাপন করে ঢাকায় এসে উঠেছিলেন সোবহানবাগ কলোনিতে ছোট মেয়ের বাড়িতে। দুজনই অসুস্থই ছিলেন। জানতে পেরে রেনু খোকাকে বললেন, তাদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দাও।
দাদা-দাদি হাসপাতালে। রেহানা আর রাসেল তাদের দেখতে যেতে চায়। যদিও বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে, তাদের ভাগনে জয়, তার আকর্ষণও কম নয়।
রেনু খোকাকে বললেন, খোকা, আব্বা-আম্মাকে তো দেখতে যাতি হয়!
খোকা বললেন, এদের অফিসারকে বলে দেখেন। আপনাকে কি বের হতে দেবে?
মেজরের সঙ্গে কথা বললেন খোকা। অসম্ভব। শেখ মুজিবের স্ত্রীকে বের হতে দেওয়া হবে না।
তখন একটা বুদ্ধি করা হলো। বলা হলো, বেগম মুজিবের চোখ খারাপ হয়ে গেছে। চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে।
মেজর হোসেন বললেন, ওকে, ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
রেনু বললেন, অসম্ভব, মরে গেলেও ক্যান্টনমেন্ট যাব না।
মেজর হোসেন বললেন, ইউ আর সো অ্যালার্জিক টু ক্যান্টনমেন্ট।
ওকে। কাল বিকেলে রেডি থাকবেন। আমি গাড়ি নিয়ে আসব।
মেজর হোসেন গাড়ি নিয়ে এলেন। খোকা তাঁর গাড়িও বের করলেন। সেই গাড়িতে সামনে খোকা, পাশে একজন প্রহরী, পান্ডা খান। পেছনে রেনু, রেহানা, হাসিনা। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শান্তিনগরের দিকে। রেনু কত দিন পর খোলা আকাশ দেখছেন। শান্তিনগরে ডা. মতিনের বাসভবনে থামল মেজর হোসেনের গাড়ি। রেনু, খোকা ভেতরে গেলেন। মেজর হোসেন। বললেন, চোখের অসুবিধা ছাড়া আর কোনো বিষয় নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
ডাক্তার মতিন চোখ দেখলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বেগম ফজিলাতুন্নেছার চোখ ঠিক আছে। তবু তিনি গম্ভীরভাবে চোখ দেখতে লাগলেন আর নানা ওষুধ লিখে দিলেন। মেজর হোসেন বের হয়ে বললেন, গাড়ি সোজা ধানমন্ডির বাড়ি যাবে। বলে তিনি ক্যান্টনমেন্ট চলে গেলেন।
খোকা বললেন পান্ডা খানকে, পিজি হসপিটালে যেতে হবে ওষুধ কিনতে।
পান্ডা খান রাজি হলেন।
পিজিতে গিয়ে রেনু বললেন, ওপরে এদের দাদা-দাদি আছে। আপনিও চলুন। একনজর দেখে আসি।
এবারও পান্ডা খান রাজি হলেন।
দরজায় নক করে কেবিনে ঢুকে পড়লেন রেনু, রেহানা, রাসেল।
লুৎফর রহমান, সায়েরা খাতুন তাদের কন্যাসম পুত্রবধূকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে লাগলেন রেহানা, চোখের জল গোপন করার চেষ্টা করতে লাগল রাসেল।
রেহানা বলল, আমি নিচের থেকে কমলা কিনে নিয়ে আসি।
খোকা টাকা দিলেন। রেহানা গেলেন নিচে।
পিজির নিচে হঠাৎ চিৎকার : রেহানা।
রেহানা দেখলেন, এপির সাংবাদিক নাজমুল। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৬৯ সালে লন্ডন গিয়েছিলেন এবং হোটেলে একই রুমে ঘুমাতেন।
রেহানা বললেন, নাজমুল চাচা, কথা বলবেন না। আমাদের ওপরে নজর আছে।
নাজমুল বললেন, খুব জরুরি খবর আছে। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে একটা রুমে আমাকে ঢোকাল। একপাশে দেখি মুজিব ভাই। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হলো। তিনি ইশারা করে শান্ত থাকতে বললেন।
জরুরি খবরটা রেহানা কেবিনে এসে মাকে, দাদা-দাদিকে দিলেন। আবারও সবাই কাঁদতে শুরু করলেন তাঁদের প্রিয় মানুষ হাসুর আব্বার জন্য।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, নাজমুলরে ধইরা নিয়া গেছিল মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওনের লাইগা।
ব্যাঙ্গমি বলবে, কেন তারে ছাড়ছে, আল্লাহ জানেন। তবে নাজমুলের শেষ রক্ষা হয় নাই, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘ গঠিত আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি মিলিটারির সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে তালিকা ধইরা বাড়ি বাড়ি গিয়া বুদ্ধিজীবীগো ডাইকা আইনা অত্যাচার কইরা কইরা হত্যা করছিল। সেই তালিকায় নাজমুলের নামও আছিল। তিনিও শহীদ হন। ডিসেম্বরেই।
৫৭
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি স্মরণ করবে :
কিসিঞ্জার ফিরে গেলেন ওয়াশিংটনে। এরপর ঘোষণা এল, পরের বছর প্রেসিডেন্ট নিক্সন যাচ্ছেন চীনে।
জয় বাংলা পত্রিকার ২৩ জুলাই ১৯৭১ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বেরোল : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের সংবাদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আর জয় বাংলার সম্পাদকীয়তে বলা হলো, কিসিঞ্জার ভারত থেকে পাকিস্তান গেলে ৯ জুলাই হঠাৎ করে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে নাথিয়াগলিতে চিকিৎসা নেন মর্মে ইসলামাবাদ থেকে যে খবর দেওয়া হয়েছিল, তার পেছনে আসলি বাত হলো, কিসিঞ্জার গোপনে পিকিং সফরে যান। সম্পাদকীয়তে বলা হলো, নিক্সন ১০ মাস পরে চীনে যাবেন, তাতে যদি পৃথিবীর মুক্তিকামী দেশগুলো মুক্তির লড়াই বেগবান হয় তো ভালো, না হলে তা কোনো সুফল আনবে না। আমেরিকার সাধারণ মানুষ এবং অনেক রাজনীতিবিদ যে বাংলার মানুষের পক্ষে কাজ করছেন, সম্পাদকীয়তে তা-ও উল্লেখ করে বলা হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে এশিয়ায় শান্তি আসবে না।
খন্দকার মোশতাক যতই নিক্সনের আসন্ন সম্ভাব্য চীন সফরকে সাধুবাদ জানান না কেন, ভারত এই খবরে খুবই উদ্বিগ্ন হলো।
আমেরিকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাঁকে কিসিঞ্জার ডাকলেন ১৭ জুলাই। বললেন, যদি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায়, আর চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করার থাকবে না।
ইন্দিরা গান্ধী এই বার্তা পেলেন। তিনি বললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলো।
ইন্দিরা গান্ধী তার অফিস রুমে। সামনে বসে আছেন হাকসার, ডি পি ধর, পররাষ্ট্রসচিব কাউল।
ইন্দিরা গান্ধী একটা ধবধবে সাদা কাপে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিলেন। তিনি চান এবার সোভিয়েত-ভারত চুক্তিটা স্বাক্ষর হোক। চায়ের কাপে সবুজ উষ্ণ পানীয়র দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, সবুজসংকেতটা দিতে তার দুই বছর লাগল। ১৯৬৯ সাল থেকেই এই চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি জোটনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন। এটা পেয়েছেন তার বাবার কাছ থেকে। এ ধরনের একটা চুক্তি করলে তার দেশের বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া কী হবে, আমেরিকা কী করবে, চীন কতটা বৈরী হবে, পাকিস্তানই-বা কী করবে, সাত-পাঁচ নানা হিসাব তাঁকে করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন এসব হিসাব করার সময় নয়। চীন-আমেরিকা নতুন প্রেম দেখা দিয়েছে। নতুন প্রেম সব সময়ই উত্তেজনাকর। এর মধ্যে আবার চীন-আমেরিকার প্রেমটা নিষিদ্ধ প্রেম। কিসিঞ্জার পিকিং গেছেন চুপি চুপি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন যাবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এবার চুক্তি সই করতেই হয়!
হাকসার খুশি। ধর তো এই চুক্তি করার জন্য বারবার করে লিখছিলেন। এদের সোভিয়েতপন্থী মনোভাব গোপন কিছু নয়।
ধর বললেন, তাহলে আমি মস্কো চলে যাই। সবকিছু অ্যারেঞ্জ করি।
৩ আগস্ট মস্কো পৌঁছালেন ধর। চুক্তির ভাষা কী হবে, এই নিয়ে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্টুে গ্রোমিকোর সঙ্গে বড় বড় বৈঠক করলেন। তারপর তারা উড়ে এলেন দিল্লি। আগস্টের ৯ তারিখে দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আর সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর মধ্যে মৈত্রী, শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। ১৩ আগস্ট ১৯৭১ জয় বাংলা পত্রিকার খবরে ঠিক জায়গাটাকেই বড় করে দেখানো হয়, দুই দেশের কোনো একটা দেশ তৃতীয় কোনো দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে সেই আক্রমণ মোকাবিলার জন্য কী করণীয়, তা দুই দেশ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে। ঠিক করবে।
আমেরিকা কিছুই জানত না। কিসিঞ্জার খবরের কাগজে পড়লেন এই চুক্তির কথা।
কিসিঞ্জারের হাতের কফির পেয়ালা থেকে কফি ছিটকে পড়ল। এটা কি খবর নাকি বোমশেল!
.
আনিসুজ্জামান গেছেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে। তাজউদ্দীন বললেন, একটা বিবৃতি লিখেছি। আপনি একটু দেখে দিন।
আনিসুজ্জামান বললেন, কী বিষয়ে?
ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে এই বিবৃতি।
আনিসুজ্জামান বললেন, হ্যাঁ। এই চুক্তি আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে।
তাজউদ্দীন বললেন, এই চুক্তি করার ব্যাপারে আমিও মিসেস গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমাদের এই বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখতে বলেছিলেন। তাই আমরাও একেবারে মুখ বন্ধ করে ছিলাম। আর আমাদের উপহাইকমিশনার হোসেন আলী সাহেব স্টেটসম্যানকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, বলেছেন, এই চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো অনুকূল অবদান রাখবে বলে তিনি মনে করেন না।
কী বলেন!
আপনি চিন্তা করেন, এই রকম একটা সেনসিটিভ ইস্যু, এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, হোসেন আলী সাহেব আমাদের সঙ্গে কথা বলে নেবেন না?
তাই তো। আমিও ভাবছি এটা কী করে সম্ভব হলো?
বুঝতে পারছেন না, কী করে সম্ভব হলো?
কিছুটা। আপনার অফিস তো দূরে। খন্দকার মোশতাকের অফিস তো তাঁর মিশনে। খন্দকার মোশতাক আর তার সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম চাষী নিশ্চয়ই এই মত পোষণ করেন।
তাজউদ্দীন সাহেবের লেখা প্রেস বিজ্ঞপ্তিটা ইংরেজিতে লেখা। তাজউদ্দীন নিজ হাতে লিখেছেন। তিনি নিশ্চয়ই আশা করছেন, আনিসুজ্জামান এটার বাংলা করে দেবেন। পড়তে পড়তে আনিসুজ্জামান এটার বাংলা তরজমা ভাবতে থাকেন : বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি নিয়ে যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির যথাযথ প্রতিফলন ঘটেনি। আসলে যেসব দেশ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন জানাচ্ছে, সেসবের দুটি দেশের মধ্যে এই ধরনের মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন খুবই ইতিবাচক একটি ঘটনা বলে বাংলাদেশ সরকার মনে করে।
আনিসুজ্জামান বিবৃতিটা পড়ার পর বললেন, মোশতাক সাহেব, মাহবুবুল আলম চাষীর এই ধরনের প্রতিক্রিয়ার কারণ কী!
তাজউদ্দীনের মুখটা লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, মোশতাক সাহেব আমেরিকার সাথে যোগাযোগ করছেন। জহিরুল কাইয়ুম সাহেবকে পাঠিয়েছেন আমেরিকান কনসুলেটে। তাঁরা আলাপ করছেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হবে, আর তাতে মধ্যস্থতা করবে আমেরিকা।
বাস্তবে তা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
আমি ইয়াহিয়া খানকে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না। আমাদের সঙ্গে স্রেফ মিথ্যা কথা বলেছে একটা লোক। আমরা ২৫ তারিখে তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর লোকটা লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে ঠান্ডা করার নির্দেশ দিচ্ছিল। এখন এই ধরনের একটা বৈঠকের কথা বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে থামিয়ে দেওয়ার এটা একটা চক্রান্ত হবে। আমাদের যুদ্ধ একবার থেমে গেলে সে আবারও আমাদের হত্যা করবে। এটা একটা ফাঁদ। এই ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
.
খন্দকার মোশতাকও একটা পত্রিকা বের করেন। নাম অভিযান। কবি সিকান্দার আবু জাফর ধানমন্ডিতে বেগম মুজিবদের বন্দী করে রাখা বাসার পাশেই থাকতেন। তিনি পালিয়ে কলকাতা চলে এসেছেন। কিছুদিন অভিযান এর সম্পাদক থাকলেন। কিন্তু পরে পদত্যাগ করেন তিনি।
সিকান্দার আবু জাফরের শরীরটা ভালো নয়। তিনি জয় বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের হাতে একটা চিঠি দিয়েছেন। প্রাপক তাজউদ্দীন আহমদ। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, খন্দকার মোশতাকের উদ্দেশ্য ভালো। নয়। তারা আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ বন্ধ করে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসা। মুখে তাঁরা বলছেন, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তি। এই জন্য পত্রিকায় বড় অক্ষরে শিরোনাম করেছে, বঙ্গবন্ধু না স্বাধীনতা।
তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর পরিচারক মগফুরের মাথায় পানি ঢালছেন। ছেলেটার জ্বর। তাজউদ্দীন আহমদকে এই ছেলেটা রান্না করে দেয়।
এই সময় দরজার ওপাশে হাজির হলেন ফারুক আজিজ খান।
তাজউদ্দীন বললেন, কে?
আমি ফারুক আজিজ খান।
তাজউদ্দীন বললেন, ফারুক সাহেব। ভেতরে আসেন।
তাজউদ্দীন মগফুরের মাথার ভেজা চুল গামছা দিয়ে মুছে দিলেন। তারপর। বালতিটা সরিয়ে রাখলেন একপাশে। বললেন, ছেলেটার জ্বর। ও সুস্থ না হলে তো আমার খাওয়া নিচের ক্যানটিন থেকে। ডায়াবেটিসের কারণে আমি মেপে খাই। ক্যানটিনের খাবারে আমার একটু অসুবিধা হয়। নিজের স্বার্থেই মগফুরের সুস্থতা জরুরি। আপনি নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা বলবেন। চলেন, ওই ঘরে গিয়েই বলি।
তারা পাশের অফিসঘরে এসে বসলেন। কলকাতায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ইদানীং। তাতে গরম কমছে না। তাজউদ্দীন ফ্যানটা ছেড়ে দিলেন।
ফারুক আজিজ খান বললেন, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এসেছেন। তিনি নিক্সন প্রশাসনের বাংলাদেশ নীতির সবচেয়ে বড় সমালোচক। তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে সিনেটে কথা বলে যাচ্ছেন, বাইরে জনমত তৈরি করছেন। তার সঙ্গে আপনার কথা বলা উচিত। দিল্লি তার সফরসূচি চূড়ান্ত করছে। আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন কি না।
তাজউদ্দীন বললেন, আমি ব্রিটিশ এমপি ডগলাসম্যানের সঙ্গে দেখা করেছি। তার সঙ্গে বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে দেখা করেছি। এপ্রিলে সেই ঘটনা। আপনি আসার আগে। তবে আপনি নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু আমি টেড কেনেডির সঙ্গে দেখা করব না।
কেন করবেন না। আমার ধারণা, কেনেডি আমাদের জন্য বড় রকমের একটা সাপোর্ট হবেন। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তিনি শোরগোল তুলবেন। তিনি নিক্সনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাঁকে বাংলাদেশের পাশে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য খুবই হেল্পফুল হবে।
তাজউদ্দীন বললেন, শোনেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাদের হাকিম নড়বে, হুকুম নড়বে না। আজকে যদি কেনেডি নিক্সনের জায়গায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকতেন, নিক্সন যা যা করছে, হুবহু তা-ই করতেন।
না না। তা কেন হবে। কেনেডির নীতি তো আলাদা।
তাজউদ্দীন বললেন, ফারুক আজিজ সাহেব। আপনি সমাজতন্ত্র চাইবেন, আবার আমেরিকানদের সাহায্য-সমর্থন চাইবেন, তা তো হতে পারে না।
ফারুক আজিজ তাজউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মানুষটার আদর্শবাদিতার কোনো তুলনা নেই। তবে সোনাতে একটুখানি খাদ মেশাতে হয়। শুধু সোনা দিয়ে অলংকার হয় না। তাজউদ্দীন সাহেব কি বাস্তবতাবাদী নন? আমেরিকার প্রতি এতটা বিমুখ হলে কি বাস্তব দুনিয়ায় চলা যাবে?
৫৮
আমির হোসেন বসে আছেন কলকাতার বাংলার বাণী অফিসে। তাঁর সামনে এক তরুণ। বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, বিষণ্ণ তরুণ।
আমির হোসেনের ৩১ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুড়িকে কানায় কানায় পূর্ণ বলা যাবে না। দৈনিক ইত্তেফাক-এর রিপোর্টার তিনি, বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণীতে উপসম্পাদকীয় লিখতেন। মাদারীপুরের ছেলে। তাকে ছাত্রলীগে আনেন আবদুর রাজ্জাক। ইত্তেফাক-এ আওয়ামী লীগসংক্রান্ত খবর সংগ্রহ করতেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত।
এখন তিনি কলকাতায়, ভবানীপুরের চিত্তপ্রসাদ সড়কের সেই বাড়িটির নিচতলায়, যে বাড়ির ঠিকানা বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতাদের মুখস্থ করিয়েছিলেন। এই বাড়িটি বেশ বড়সড়। এর দোতলায় সাধারণত থাকেন তোফায়েল আহমেদ। শেখ মণি থাকেন আগরতলা। সিরাজুল আলম খান থাকেন শিলিগুড়ি। রাজ্জাক থাকেন মেঘালয়ের তুরা।
তারা কখনো কলকাতা এলে এই বাড়িতে থাকেন।
চিত্ত সুতারের মাধ্যমে র-এর কানেকশন উন্মোচিত হয়েছে। এই চার নেতা বিএলএফ তথা মুজিববাহিনী গড়ে তুলেছেন।
শেখ মণি আমির হোসেনকে দায়িত্ব দিয়েছেন কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী বের করতে হবে।
আমির হোসেন সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করছেন। পত্রিকা বের করা। চাট্টিখানি কথা নয়। আর এখানে তাঁকে খালি সম্পাদকগিরি করলে চলে না। জুতা সেলাই থেকে শুরু করে চণ্ডীপাঠ করতে হয়। নিউজপ্রিন্ট জোগাড় করা, পত্রিকা ছাপানো, পত্রিকা বিলি করা–ঝামেলা কি কম?
আমির জানেন, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মণির বনাবনি নেই। আমির হোসেন ইত্তেফাক-এর ঝানু সাংবাদিক, এ-ও বোঝেন, মোশতাকের সঙ্গে তাজউদ্দীনের দ্বন্দ্ব প্রবল। শেষের দুজনেরটা আদর্শিক এবং ব্যক্তিগত। মোশতাক ডানপন্থী, আমেরিকাপন্থী, সমাজতন্ত্রবিরোধী, ইসলামপসন্দ। তাজউদ্দীন মধ্যবাম, আমেরিকাবিরোধী, সমাজতন্ত্রপ্রেমী, নিজে ধর্মকর্ম করলেও প্রবল অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী। ব্যক্তিগত সমস্যা হলো, মোশতাক সিনিয়র, কাজেই তিনি মনে করেন যে প্রধানমন্ত্রী তাঁরই হওয়া উচিত। আমির বোঝেন, মোশতাক শুধু তাজউদ্দীনের চেয়ে নিজেকে। যোগ্য মনে করেন তা নয়, বঙ্গবন্ধুর চেয়েও নিজেকে বেশি শিক্ষিত ও যোগ্য মনে করেন।
দলের মধ্যে ইজম আছে। তাজউদ্দীন ঢাকার এমপিদের নিয়ে ভেতরে ভেতরে করেন ঢাকা-ইজম। মোশতাকের আছে কুমিল্লা-ইজম। কামারুজ্জামানের আছে উত্তরবঙ্গ-ইজম।
এই নিয়ে সহকারী মুকুলের সঙ্গে আমির মাঝেমধ্যে কথা বলেন।
মুকুল বলে, মোশতাক সাহেব সিনিয়র মোস্ট। উনি তো বঙ্গবন্ধুরও বড়। তাঁর দাবি তো কম নয়। তিনিও ছয় দফার জন্য জেল খাটছেন।
আমির বলে, মোশতাক আওয়ামী লীগ ছাড়ছিলেন। আওয়ামী লীগ যখন মুসলিম শব্দ বাদ দিল, তখন আওয়ামী লীগ ছেড়ে যান আবু হোসেন সরকারের চিফ হুইপ হওয়ার লোভে। আর মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবও তো সিনিয়র-মুকুল নিউজপ্রিন্টের একটা নোটপ্যাডের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আলপিন গাঁথতে গাঁথতে বললেন।
ক্যাপ্টেন মনসুর তো মামলা খেয়েছিলেন। সেই মামলা উইথড্র না হলে তার তো এই পর্যন্ত আসারই কথা না।
সৈয়দ নজরুল?
বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগ রিভাইভ করলেন, সৈয়দ নজরুল তখন সম্মিলিত বিরোধী দল করার জন্য কিছুদিন নিজেকে বিরত রাখছিলেন। একমাত্র তাজউদ্দীন আগাগোড়া আওয়ামী লীগার। আর বঙ্গবন্ধুর ডান। হাত।
মণি ভাইদের বিরোধিতাটা কি ব্যক্তিগত? মুকুল প্রশ্ন করলেন।
আমির বললেন, না। ব্যক্তিগত খানিকটা থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধুর। ভাগনে। তাই তিনি ভাবতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর পর উত্তরসূরি তিনিই হবেন। কিন্তু সেটা বড় না। আসল পার্থক্য মতের। দৃষ্টিভঙ্গির। তাজউদ্দীন দেশ স্বাধীনের মিশনটা দ্রুত করতে চান। তিনি চান ইন্ডিয়া স্বীকৃতি দিক। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হোক। মণি ভাই চান যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হোক। বাংলার গ্রামে গ্রামে তিনি লাখ লাখ ক্যাডার তৈরি করবেন। তারা মুজিববাদে দীক্ষিত হবে। তখন তাদের দিয়া নতুন দিনের নতুন সমাজ গড়া যাবে। এর মধ্যে সিরাজুল আলম খান চায়, এদেরকে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী ক্যাডার করে তুলতে।
একদিন বাংলার বাণীতে তাজউদ্দীন আহমদের খবর আর ছবি দিয়ে প্রথম পাতা সাজানো হলো। শেখ মণি আমিরকে ডেকে বললেন, কাগজটা কি আমার নাকি তাজউদ্দীনের?
আমির শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা দুপুরে নিজের ডেস্কে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য সম্পাদকীয় লিখছিলেন। তাঁর সামনে এসে বসেছে এক তরুণ। তাকে ভয়াবহ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চুল এলোমেলো। চোখ গর্তে বসা। গায়ের কাপড়চোপড় ধূলিধূসরিত। সে বলল, আমার নাম ফজলার রহমান। আমি মাদারীপুর থেকে এসেছি। ছাত্রলীগ করি।
বসো।
আমার খুব খিদে পেয়েছে। একটু খাবারদাবার হবে?
বসো। আমি খাবার আনাচ্ছি।
তিনি অফিসের সহকারীকে দিয়ে খাবার আনালেন। ভাত, ডাল, সবজি। ছেলেটা বাথরুম থেকে হাত-পা ধুয়ে এসে গোগ্রাসে খেতে লাগল। আমির তার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু ভাত-ডালও যে মানুষ কত যত্ন করে, কত আগ্রহভরে খেতে পারে!
খাওয়ার পর বোধ করি একটু শক্তি ফিরে পেল। বলল, আমার ভাইকে মিলিটারিরা খুন করেছে। আমি প্রতিশোধ নেব। যুদ্ধে যাব বলে এসেছি। বনগা শিবিরে উঠেছি। ওখানে খাবারদাবারের কষ্ট। তা হোক। কিন্তু ট্রেনিংয়ে তো পাঠাচ্ছে না। আপনি ব্যবস্থা করে দেন। তাড়াতাড়ি ট্রেনিং দরকার। আপনি বলে দেন যেন ট্রেনিংয়ে পাঠায়।
তোমার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হবে। তুমি বনগা ক্যাম্পে ফিরে যাও। আমি বলে দেব। তোমাকে নেক্সট ব্যাচেই নিয়ে নেবে।
ফজলার রহমানকে বনগা ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন আমির।
৫৯
থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকার কার্যালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রিসভার বৈঠক বসেছে। এই গরমের মধ্যে তাজউদ্দীনের পোশাক যথারীতি হাফহাতা শার্ট আর ফুলপ্যান্ট, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেবের সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর খন্দকার মোশতাকের আচকান। মাথায় টুপি। মোশতাক সাহেবের বিশেষ অনুরোধেই আজকের বৈঠক।
এর মধ্যে সুন্দর ফুলহাতা শার্ট, ইস্তিরি করা প্যান্ট আর ঝকঝকে জুতা পরে এসেছেন কাজী জহিরুল কাইয়ুম।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীন দিল্লি থেকে ঘুরে এসেছেন।
তাজউদ্দীনের মনটা বেশ খারাপ। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম আলাপ খুব ভালো হয়েছে। মাঝখানের আলাপটা চিন্তায় ফেলেছে। শেষের আলাপটা তাকে মুষড়ে দিয়েছে।
সৈয়দ নজরুল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। তিনি আলাপ শুরু করলেন। বললেন, আমরা সভার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করি। আপনাদের একটু জানিয়ে রাখি, দিল্লিতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের আলাপ ভালো হয়েছে। তিনি খুবই ভালো মুডে ছিলেন। তিনি মনে করছেন, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বেশ একটা ভরসার জায়গা তৈরি করেছে। তিনি এখন তৃতীয় কোনো দেশের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে আছেন। তারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের গতি বাড়ানো, আমাদের চাহিদা মোতাবেক অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়েছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের মনটা খচখচ করে উঠল। এটা ঠিক, ভারতের নীতিনির্ধারকেরা ভারত-সোভিয়েত চুক্তির পর আর পেছনের দিকে নয়, সামনের দিকে তাকাচ্ছেন। তারা মনে করছেন, শীতের আগেই সমস্যার সমাধান করতে যা কিছু করণীয় তারা করতে পারবেন। কিন্তু তাঁকে উদ্বিগ্ন করেছে একটা সংবাদ। তা হলো, পি এন হাকসার অবসরে যাচ্ছেন। তার জায়গায় আসছেন ডি পি ধর। হাকসারের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বোঝাপড়াটা বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। মস্কোতে এত দিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডি পি ধর। তার সঙ্গে রসায়নটা কী হবে তিনি জানেন না। ৩ নম্বর যে বিষয়ে তাজউদ্দীন রীতিমতো বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন, তা হলো বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) বা মুজিববাহিনী প্রসঙ্গ। র-এর প্রধান আর এন কাও এবং হাকসারের সঙ্গে তাঁদের দুজনের-সৈয়দ নজরুল এবং তাজউদ্দীনের একান্ত বৈঠকে তাজউদ্দীন কথাটা তুলেছিলেন। বলেছিলেন, মুজিববাহিনী খুবই ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এলাকা থেকে খবর আসছে, তারা কোথাও কোথাও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে মেতে তাদের অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে। তাদের ট্রেনিং ভালো, তাদের অস্ত্র ভালো, তাদের নেতাদের অবস্থানও উচ্চে। এটা আমাদের সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর জন্য খুবই বিব্রতকর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আমাদের নিয়মিত বাহিনীর অফিসাররা খুবই ক্ষিপ্ত। আর আমাদের গেরিলা বাহিনীর ছেলেরা হতাশ। আমাদের আরেকটা বাহিনী থাকতেই পারে। একটা দেশের নানা ধরনের বাহিনীই তো থাকে। কিন্তু সেটা তো বাংলাদেশ সরকারের অধীনে হতে হবে। তারা প্যারালাল অথরিটি হয়ে উঠছে, আর বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে।
হাকসার এবং কাও দুজনেই নীরব থেকে গেলেন। সৈয়দ নজরুলও আর কথা বাড়ালেন না। তাজউদ্দীন বুদ্ধিমান লোক। তিনি বুঝতে পারলেন, এই সিদ্ধান্ত অতি উচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে। তার মানে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদন আছে।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে কথা বলে। তারা যা বলে, তার মর্মার্থ হলো :
বঙ্গবন্ধু মার্চের কোনো একদিনে তাজউদ্দীন, শেখ ফজুলল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক আর সিরাজুল আলম খানকে বাড়ির ভিড়ের ভেতর থেকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে যান তার পড়ার ঘরে। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেন, আলোচনা চলছে, কিন্তু আলোচনা ফেইল করতে পারে। আমাদের সেকেন্ড অপশন ওপেন রাখতে হবে। কলকাতায়। আমার লোক রাখা আছে। বহু বছর হলো সে সেখানে আছে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার কন্ট্যাক্ট আছে। নামটা মনে রাখো, চিত্তরঞ্জন সুতার। বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতা। চিনতে পারছ অনেকেই। কোথাও লিখতে পারবা না, মুখস্থ রাখো। ভবানীপুর ২৬ প্রসাদ রোড। যদি আমাদের উপরে হামলা হয়, মিলিটারি রুল চালানোর চেষ্টা করে, তাজউদ্দীনসহ তোমরা ৫ জন কলকাতা চলে যাবা। চিত্তরঞ্জন সুতারের সাথে যোগাযোগ করবা। বাকিটা সে তোমাদেরকে করে দিবে। তাজউদ্দীন পারবে। কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু এবার আর আপস করা যাবে না।
এই কথা অনুসারে চার যুবনেতা কলকাতায় এসে ২৬ প্রসাদ রোডে যান এবং চিত্ত সুতারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম এই বাড়ি খুঁজে পাননি। এর কারণ হলো, রাস্তাটার নাম আসলে রাজেন্দ্র প্রসাদ রোড। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের নাম অনুসারে। আর চিত্তরঞ্জন সুতার এই বাড়িতে থাকতেন ভুজঙ্গভূষণ রায় নামে। নাম পাল্টিয়ে। তাজউদ্দীন কলকাতা এসে তাদের বিএসএফের তত্ত্বাবধায়ক সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে এই নাম এবং ঠিকানা বলেন এবং সেখানে যেতে চান। তারা টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে এই রোডও খুঁজে পাননি, এই নামেরও কাউকে পাননি। এর মধ্যে দিল্লির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হলে তারা দিল্লি চলে যান।
যুবনেতারা এই প্রপার চ্যানেলে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইন্দিরা গান্ধী র-এর ওপরে দায়িত্ব দেন এই যুবনেতাদের চাহিদামাফিক ব্যবস্থা নিতে। ভারতীয়দের বিবেচনায় থাকে :
১. সব ডিম এক পাত্রে রাখতে নাই। কোনো কারণে তাজউদ্দীনের সরকার ব্যর্থ হলে এই যুবনেতারা এবং তাদের লাখো অনুসারী যেন বিকল্প নেতৃত্ব ও সংগ্রাম সংঘটিত করতে পারে।
২. ওই সময় দিল্লি সরকারের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ এবং সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে রাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র কার্যক্রম চলছিল। ভারত সরকার অত্যন্ত কঠোরহস্তে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সেই বিদ্রোহীদের দমন করছে। পুরো ঘটনাটা ঘটাচ্ছিল চীন। ভারতে এই স্লোগান প্রকাশ্যে দেওয়া হচ্ছিল, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে এই বিদ্রোহীদের প্রতিনিধিরা ডেলিগেট হিসেবে উপস্থিত ছিল। এদের অস্ত্র, অর্থ এবং নির্দেশনা আসত চীন। থেকে। এখন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দিলে তা। যে বামপন্থী ভারতীয় পিকিংপন্থী বিদ্রোহী কিংবা নাগা বা মিজো গেরিলাদের হাতে চলে যাবে না, এই নিশ্চয়তা কী?
৩. বাংলাদেশেও চীনা বিপ্লবী সশস্ত্র দলগুলো সক্রিয় আছে। তারা স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামকে দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে অভিহিত করে ভারতের সম্প্রসারণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর স্বাধীনতাসংগ্রাম যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এই সংগ্রাম বামপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। ভারতের পাশের একটা দেশ চীনা বিপ্লবীদের খপ্পরে পড়লে বা স্থায়ী নৈরাজ্যের কবলে পড়ে গেলে তার কুফল ভারতও ভোগ করতে থাকবে।
চার যুবনেতাকে নিয়ে ভারতীয়রা ব্যাপক গবেষণা করে। মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই চার নেতার সঙ্গে কাজ করার। তিনি ছিলেন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল।
শেখ ফজলুল হক মণির লক্ষ্য ছিল বামপন্থার বিপদ থেকে মুজিববাহিনীকে রক্ষা করা। কিন্তু সিরাজুল আলম খানের ছিল নিজস্ব প্ল্যান। তিনি চেয়েছিলেন মুজিববাহিনীকে সমাজতন্ত্রের সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে। যাতে স্বাধীনতার সংগ্রাম আর সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম পাশাপাশি চলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। তোফায়েল আহমেদ সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান শক্ত ছিল না। ডাকসুর ভিপি হিসেবে দেশজোড়া ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল। তিনি যখন যুবশিবিরে যোদ্ধা রিকুটের জন্য যেতেন, তখন সবাই সব শৃঙখলা ভেঙে তাকে দেখতে ছুটে আসত। রাজ্জাক ছিলেন সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুগত। কিন্তু এঁদের প্রত্যেকের রক্তের মধ্যে ছিল একটা অচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য, এঁরা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত, এঁদের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। বামপন্থীদের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করতে গিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের অজান্তেই বামপন্থীদের হাতেই বিএলএফ তথা মুজিববাহিনীকে তুলে দিয়েছিলেন। বাস্তবে সিরাজুল আলম খান সব ট্রেইনার নিযুক্ত করেছিলেন তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাদের, যারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ছেলেদের সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে মাতোয়ারা করে দিতে চাইতেন।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, এই মুজিববাহিনী থাইকাই পড়ে জাসদ হইব। মণি আর সিরাজ আলাদা হইয়া যাইব। এইভাবে মুজিবের অনুগত বাহিনী গড়তে গিয়া নিজের অজান্তে অথবা সজ্ঞানে ভারতীয়রা মুজিববিরোধী বাহিনী গইড়া তুলছিল। সে আরও এক বছর পরের কথা।
জেনারেল উবান পরে একখান বই লেখছিলেন- ফ্যান্টম অব চিটাগাং। তাতে আরও দুইজনের কথা তিনি বিশেষভাবে লেখেন। একজন হইলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আর একজন। হইলেন কিশোর শেখ জামাল। সৈয়দ আশরাফ কোনো দিনও যুদ্ধের সময় কলকাতায় তার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেন নাই। তার কথা আছিল, আমি যুদ্ধ করতে আইছি, ফ্যামিলি ট্রিপ করতে আসি নাই। তিনি যুদ্ধের ময়দানেই আছিলেন। আর শেখ জামালও ট্রেনিং শেষ কইরা যুদ্ধ করতে চইলা যান। বর্ডারে। মাঝেমধ্যে তিনি তাঁর আব্বার কথা মনে কইরা, মায়ের কথা মনে কইরা কানতেন।
অহন আসো ১৬ আগস্ট ১৯৭১-এ, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার। বৈঠকে–ব্যাঙ্গমা ঠোঁট নাড়ে।
ব্যাঙ্গমি বলে, হ। এইখানে কাজী জহিরুল কাইয়ুম কইব তার আমেরিকা কানেকশন ওপেনের কথা।
ব্যাঙ্গমা বলে, তার আগে মোশতাকের কথাটা পাইড়া লও।
খন্দকার মোশতাক ১৯১৮ সালে কুমিল্লায় জন্ম নেন। বঙ্গবন্ধুর চায়া দুই বছরের বড় আছিলেন। নিজেরে মনে করতেন শিক্ষিত, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাইকা বিএল ডিগ্রির বেশি কোনো ডিগ্রি আছিল না।
ব্যাঙ্গমি বলে, চিরটাকাল তিনি মনে করতেন শেখ মুজিব অশিক্ষিত, আর তাঁর নিজের যোগ্যতা শেখ মুজিবের চায়া বেশি। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় জেলে থাইকাই মুজিব যুগ্ম সম্পাদক হইছিলেন, এইটা মোশতাক মাইনা নিতে পারেন নাই। তিনি প্রকাশ্যে নিজেরে কমিউনিজমবিরোধী আমেরিকার লাইনের লোক বইলা দাবি করতেন। তার বেশভূষা, চালচলন কথাবার্তা আছিল পাকিস্তানের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। শেখ সাহেবের সামনে তিনি হাত কচলাইতেন, ত্যালের ডিব্বা উজাড় কইরা দিতেন। আড়ালে আড়ালে তারে ঈর্ষা করতেন, তাঁর বিরুদ্ধে কথা কইতেন। ষড়যন্ত্র করতেন। তাজউদ্দীন আছিল তাঁর দুই চোখের বিষ। তাজউদ্দীন শার্ট প্যান্ট পরেন, সমাজতন্ত্ররে নিজের আদর্শ বইলা প্রচার করেন, অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র বুকে ধারণ করেন, এইটা তার আরও অসহ্য লাগত।
ব্যাঙ্গমা বলে, আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আর সৈয়দ নজরুলসহ সবার চাইতে বয়সে বড় হিসেবে তিনি ভাবতেন, প্রধানমন্ত্রী কি প্রেসিডেন্ট হওনের তিনিই সবচায়া বড় দাবিদার। তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রিত্ব তিনি মানতেই পারতেন না। তাজউদ্দীন দ্যাশ স্বাধীন কইরা ফেলব, এইটা তিনি কেমনে মানেন! আর তাজউদ্দীনের প্ল্যানটা কী? তাজউদ্দীন মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিংয়ে বাম দলগুলানরে জায়গা দিতাছেন। অহন হিন্দুস্তান-সোভিয়েত চুক্তিরে তিনি যহন সন্দেহের চোখে দেখতাছেন, তখন তাজউদ্দীন সেইটারে স্বাগত জানায়া পাল্টা বিবৃতি দিতাছেন। মানেটা হইল, ইন্ডিয়া-সোভিয়েত ইউনিয়ন মিইলা যুদ্ধ কইরা পাকিস্তানরে হারায়া দিব। এইটা হইলে বাংলাদেশ রুশ-ভারত অক্ষশক্তিতে ঢুইকা যাইব। আর দ্যাশ স্বাধীন হইলে তাজউদ্দীনের ক্ষমতা পাকাপোক্ত। তার বদলে মোশতাকে চক্রান্ত করলেন, আমেরিকার লগে লাইন বাইর করার। আমেরিকা মধ্যস্থতা করুক, ইয়াহিয়া খান-শেখ মুজিব বৈঠক করুক, ছয় দফার আলোকে একটা কনফেডারেশন হউক, পাকিস্তানি মিলিটারি সইরা যাক, তাইলে তো আর তাজউদ্দীনের এই খবরদারি চোখের সামনে দেখা লাগে না। এই জন্য তিনি ডেসপারেট হইয়া এরে জিগান, ওরে জিগান, আমেরিকার লগে লাইন দেওন যায় ক্যামনে। টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিকরেও একই কথা কইলেন। টাইম-এর সাংবাদিক কইল, কলিকাতাতেই তো আমেরিকার উপদূতাবাস আছে। তাগো সাথে ডাইরেক্ট যোগাযোগ করলেই তো হয়। মোশতাক বসতেন বাংলাদেশ হাইকমিশনেই। হোসেন আলীরে কইলেন, লাইন লাগাও। মাহবুবুল আলম চাষী তার সচিব। ব্লু আয়েড বয় বইলা সবাই তারে পাত্তা দিত। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে আছিলেন। ওয়াশিংটনে পোস্টিং আছিল। তারপর কুমিল্লায় স্বনির্ভর আন্দোলন করতেন। নিজের নামের লগে চাষী তিনি নিজেই লাগায়া নিছেন। সেইখান থাইকা মোশতাক তারে আইনা পররাষ্ট্রসচিব বানাইছেন। আমেরিকা কানেকশন তার আগে থাইকাই আছে।
এই অবস্থায় মোশতাক কথা কইতেছিলেন কুমিল্লার এমএনএ কাজী জহিরুল কাইয়ুমের লগে। জহিরুল কাইয়ুম কলকাতার আমেরিকান কনসুলেটে গেলেন। কী হইল তিনি জানাইতাছেন মন্ত্রিসভারে।
কাইয়ুম কইলেন, আমি প্রথমে গেছি কনসুলেটে। তারা আমার সব খবরই রাখে। আমারে খুব ভালো চিনল। আমি তাগো বললাম, দ্যাখো, শেখ সাহেবরে তোমরা আটক করছ। এখন তোমরা তারে রাখছ পাকিস্তানে আটকায়া। আগে কও তোমরা, তিনি বাঁইচা আছেন, না তারে মাইরা ফেলছ?
তারা জানাইল, তিনি বাইচা আছেন। এরপর আমি তাদের বললাম, দ্যাখো, আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দল। যারা আমেরিকাবিরোধী ছিল, তারা ন্যাপ কইরা আলাদা হইছে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। শেখ সাহেবও আমেরিকার লাইনেই বেশি আস্থা রাখেন। তোমরা তারে ছাড়ো। তিনি জেল থাইকা বাইরায়া ইয়াহিয়া খানের লগে বসবেন। আর মধ্যস্থতা করবেন নিক্সন। দশ মিনিটে সব সমস্যার সমাধান।
.
মন্ত্রিপরিষদের সবাই কাইয়ুমকে বললেন, আপনি এই লিয়াজোঁ এগিয়ে নিয়ে যান।
শুধু তাজউদ্দীন আহমদ বিষণ্ণ এবং ভেতরে-ভেতরে বিধ্বস্ত। আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার পড়ে না। আমেরিকার সাহায্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে হবে কেন?
জহিরুল কাইয়ুম ও মোশতাক মন্ত্রিপরিষদের কাছে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গোপন রাখলেন :
১. মোশতাক নিজে হোসেন আলীকে দিয়ে এবং চাষীর মাধ্যমে আমেরিকান কনসুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
২. মোশতাক এ কথা বলছেন যে শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে। তারা স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু পেলেও স্বাধীনতাসংগ্রাম ত্যাগ করতে রাজি আছেন।
৩. বাগেরহাট এলাকা থেকে নির্বাচিত এমএনএ নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ইসলামাবাদ চলে গেছেন। তা-ও ঢাকা দিয়ে। তিনি ইসলামাবাদে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে মিটিং করেছেন। ফারল্যান্ড সারা দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেই থাকেন। তাঁরা এক বৈঠকে দুজনে মিলে এক বোতল হুইস্কি সাবাড় করেন। ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার কথা হচ্ছে। ইয়াহিয়া খান রাজি থাকলে তারা একটা আপস-মীমাংসায় আসতে পারেন। শুধু শেখ মুজিবকে হত্যা করে ফেলো না।
মন্ত্রিপরিষদ এই কথাগুলো যেহেতু জানে না, তারা জহিরুল কাইয়ুমকে সাধুবাদই জানাল।
মোশতাক আমেরিকানদের জানালেন যে ইয়াহিয়া তার ভালো বন্ধু। তাঁর সঙ্গে বসতে তার কোনো অসুবিধা নেই।
শুনে ইয়াহিয়া জানালেন যে মোশতাক ভালো লোক। তাঁর সঙ্গে বসতেও ইয়াহিয়ার কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু ভারত কথাটা জেনে গেল। ওয়াশিংটনের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জন আরউইন জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি কথা হচ্ছে। ওয়াশিংটন মধ্যস্থতা করছে। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হতে পারে। ইয়াহিয়া খানও রাজি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু পেলেও সমঝোতা করতে রাজি। দিল্লি ব্যাপারটা তাজউদ্দীনকে জানাল। ভারতীয় গোয়েন্দারাও জহিরুল কাইয়ুম এবং মোশতাকের ওপরে নজর রাখল। মোশতাককে ভারতীয় কর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা সত্য কি না। মোশতাক সরাসরি অসত্য বললেন যে এ ধরনের কোনো কথা হয়নি।
২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনসংলগ্ন মাহমুদ আলীর বাড়িতে মোশতাক আমেরিকান পলিটিক্যাল অফিসার জর্জ গ্রিফিনের সঙ্গে রাতের বেলা ৯০ মিনিট বৈঠক করেন। মোশতাক বললেন, আমি কমিউনিজমবিরোধী। আমার কমিউনিস্টদের প্রতি কোনো দুর্বলতা নাই। কিন্তু আপনারা কী করছেন? আপনারা ইয়াহিয়া খানকে সাহায্য করছেন কেন? তাদের সাহায্য করা বন্ধ করুন। আপনাদের অস্ত্র দিয়ে তারা বাংলার মানুষকে মারছে, এটা বন্ধ করুন। এবার মোশতাক মন্ত্রিপরিষদের কাছ থেকে পাওয়া দাবিগুলো উপস্থাপন করলেন :
১. বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা।
২. শেখ মুজিবের মুক্তি।
৩. স্বাধীনতার পর পুনর্গঠনের জন্য আমেরিকান সাহায্য।
৪. স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন।
৫. বাংলাদেশের নেতাদের কাছে দেশ ফিরিয়ে দেওয়া।
৬. প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনা।
৭. হাইকমিশনারের মাধ্যমে পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হবে একমাত্র মাধ্যম।
মোশতাক সতর্ক করে দিলেন, আমেরিকা যদি এটা করতে না পারে, তাহলে যুদ্ধ চলবে। রুশরা এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশ বামপন্থীদের হাতে চলে যাবে।
কিসিঞ্জারের কাছে এই আলোচনার প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিসিঞ্জার দেখলেন, এরা চায় পূর্ণ স্বাধীনতা আর ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা। ইয়াহিয়া খান বারবার করে বলেছেন, মুজিবের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। রাষ্ট্রদ্রোহীর সঙ্গে কিসের আলোচনা! তার মানে এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না। কিসিঞ্জার পরবর্তীকালে লিখবেন, এই উদ্যোগ এখানেই শুকিয়ে যায়।
কিন্তু আমেরিকা ক্রমাগতভাবে পরামর্শ দিতে থাকে, ইয়াহিয়া খান যেন পূর্ব বাংলায় সামরিক অভিযান বন্ধ করে পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। তারই অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করবেন বাঙালি আবদুল মোত্তালিব মালিককে। টিক্কা খানকে সরিয়ে দেবেন। সে আরও পরের কথা।