১২০. পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ

১২০

ইয়াহিয়া মদকন্দ্র কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, পূর্ব সেক্টরে যুদ্ধবিরতি হয়েছে বটে। তবে পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ চলবে।

ভারত একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে পশ্চিম সীমান্তে। ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীকে দেখাতে চান, তারা আগ্রাসন চালাননি, একটি জাতির ন্যায়সংগত সংগ্রামে পাশে থেকেছেন মাত্র।

শরণ সিং জাতিসংঘে বললেন, যেহেতু ঢাকা এখন স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী, কাজেই আর যুদ্ধ করার কোনো মানে আমরা দেখছি না। আমরা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলাম।

এক দিন পর ইয়াহিয়া বললেন, আমরা পশ্চিম সেক্টরেও যুদ্ধবিরতি মেনে নিচ্ছি।

.

আমেরিকায় কিসিঞ্জার ফোন করলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে।

হ্যালো।

হেনরি বলছি। কংগ্রাচুলেশনস, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।

নিক্সন বললেন, আসলেই। তবে এই ক্রেডিট কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীকে। দেওয়া যাবে না। সে তো আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তারপর ফায়ার ব্রিগেডে খবর দিয়েছে।

কিসিঞ্জার বিজয় উদ্যাপন করছেন। ক্যাচ ধরার পর ক্রিকেটের ফিল্ডার যেমন করে, গোল দেওয়ার পর ফুটবলাররা যেমন করে দৌড় দেয়, দৌড়ে ফার্স্ট হয়ে দৌড়বিদ যেমন করে ভি চিহ্ন দেখায়, কিসিঞ্জার সারা দিন তা-ই করলেন। খবরের কাগজে ফোন করে করে বললেন, আমরা জিতে গেছি। আমাদের ঠিকভাবে ক্রেডিট দিয়ো। সহকর্মীদের মধ্যে যারা যারা তাঁকে সহায়তা করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিতে লাগলেন তিনি, তোমাকে ধন্যবাদ, এই বিজয়ে তোমার অবদান অনেক বেশি।

কিসিঞ্জার বাথরুমে গেলেন। তার ভয়ানক পেশাব পেয়েছে। আরাম করে জলবিয়োগ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, ঠিক আরাম হচ্ছে না। পুরো পেশাব বেরোচ্ছে না।

ঢাকার পতনটা কি তাহলে পুরোপুরি আমেরিকার বিজয় হিসেবে গণ্য হবে? আমি বলতে চাইছি, ঢাকার পতনটা না হোক, অন্তত রাওয়ালপিন্ডিকে রক্ষা? আমরা না থাকলে ভারত এতক্ষণে পিন্ডিতে পতাকা ওড়াত আর আজাদ কাশ্মীর পুরোটাই দখল করে নিত।

তিনি পেশাবের শেষ সঞ্চয়টুকু ঢেলে দেবার কোশেশ করলেন। কিন্তু সফল হলেন না।

১২১

ঢাকা পতনের দুদিন পরের কথা। ইয়াহিয়া ঠিক করলেন, তিনি আইয়ুব মিলনায়তনে ভাষণ দেবেন সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে।

জুতার মালা নিয়ে অফিসাররা তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

তবে জুতা মারলে কম মারা হবে। তাঁকে ছিঁড়েই ফেলবেন অফিসাররা।

ইয়াহিয়া আর গেলেন না সেনাকর্তাদের সামনে। গেলেন সেনাপ্রধান আবদুল হামিদ। অফিসাররা শিস দিলেন, দুয়ো দিলেন। টিটকারি করে, গালিগালাজ করে মিলনায়তন থেকে বের করে দিলেন তাঁকে।

ইয়াহিয়াকে আশ্রয় দেওয়া হলো মাংলা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে যুদ্ধবন্দী সৈনিকদের স্ত্রীরা ঝাড়ু হাতে ঘিরে ধরল তার ঘর। সেখান থেকে চুপটি করে সরিয়ে তাঁকে রাখা হলো খারিয়ানের কাছে বান্নি বাংলা নামের এক জায়গায়।

রাতের বেলা সেখানে নেকড়ে ডাকে।

তার দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত এক পুলিশকর্তাকে তিনি বললেন, এ কোথায় এনে রাখলে আমাকে? রাতে তো নেকড়েরা ঘোরাফেরা করে।

পুলিশকর্তা বললেন, নেকড়েরাও একই কথা বলে। কাকে এনে রেখেছ এখানে। এ তো নেকড়ের চেয়েও ভয়ংকর এক লোক।

২০ ডিসেম্বর ভুট্টো হয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইয়াহিয়াকে মাঝেমধ্যেই নিয়ে যাওয়া হয় কমিশনের সামনে জবানবন্দি দিতে।

হেলিকপ্টারে যান তিনি।

তিনি তাঁর নিরাপত্তা কর্মকর্তা সরদার চৌধুরীকে বললেন, আমি হেলিকপ্টারে যাব না। আমাকে গাড়িতে নিয়ে যাও।

তা সম্ভব নয়।

কেন?

কারণ, রাস্তায় মানুষ আপনাকে দেখলে ছিঁড়ে ফেলবে। মেরে ফেলবে।

কেন? আমি কী করেছি?

কারণ, ঢাকার পতন। আমাদের সৈন্যরা ভারতে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় আছে।

এ জন্য আমি দায়ী নই। এ জন্য দায়ী রাজনীতিবিদেরা।

জনগণ তা বোঝে না। ওরা মূর্খ।

আমি কি এখন গ্রেপ্তার অবস্থায় আছি?

না। আপনি নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন।

তাহলে আমার নিরাপত্তার কথা আমাকে ভাবতে দাও। আমাকে নিয়ে চলো সড়কপথে। আমি রাওয়ালপিন্ডিতে আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

স্যার, আমি আপনাকে জনগণের রোষ থেকে রক্ষা করতে চাই।

কেন। আমি কি নিচু জাতের লোক? আমি কি কারও মাগির পাছায় খামচি দিয়েছি?

পুলিশকর্তা রেগে গেলেন। আচ্ছা চলুন, আপনাকে সড়কপথেই নিয়ে যাই।

গাড়ি চলছে। একটা লেভেল ক্রসিংয়ে রেলগাড়ি যাচ্ছে বলে গাড়ি থামল।

তখনই জনতা দেখে ফেলল যে গাড়িতে ইয়াহিয়া।

তারা ঢিল ছুঁড়তে লাগল। ঢিল এসে পড়ছে গাড়ির উইন্ডশিল্ডে। এখন কী হবে?

রেলগাড়ি চলে গেল। লেভেল ক্রসিংয়ের গেট খোলা হলো। গাড়ি জোরে চালিয়ে তারা সামনে যেতে লাগলেন। কিন্তু চারদিক থেকে জনতা এসে তাঁদের সামনে যা পেল তা-ই দিয়ে ঢিল ছুঁড়তে লাগল। কাঁচ গেল ভেঙে।

ইয়াহিয়া থরথরিয়ে কাঁপতে লাগলেন।

তিনি প্যান্টের ভেতরে পেশাব করে দিলেন ভয়ে।

ভেজা প্যান্টের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমাকে কি একবার ফাঁকরার কাছে নিয়ে যাওয়া যায়? এই নারীটিকে আমি সারা জীবন শুধু কষ্টই দিয়েছি।

১২২

শেখ মুজিবের কাছে দিন আর রাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সোমবার আর মঙ্গলবার তিনি আলাদা করতে পারেন না। সপ্তাহ যাচ্ছে নাকি মাস, তিনি জানেন না। বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই, রাতে তীব্র শীত, তিনি শুধু এতটুকুনই বোঝেন। আর বোঝেন যে তার বাবুর্চি বাঙালি, সে তাকে ভাত বেঁধে দেয়, কখনো দেয় মুরগির ঝোল, কখনোবা মাছ। এই ভালো খাওয়ানোর কারণও স্পষ্ট। তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তার সেলের উল্টো দিকে একটা দড়িতে ফাসের চিহ্ন বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

শেখ মুজিব মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।

হঠাৎই এক রাতে পাশের ছাদ থেকে ঢিল এবং গালিগালাজ বর্ষিত হতে লাগল। তিনি সেলের ভেতরেই রইলেন। বুঝলেন না ব্যাপার কী।

একটু পরে গুলির শব্দ। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি হলো।

এরপর ছয়জন সশস্ত্র প্রহরী এসে দাঁড়াল তার সেলের আঙিনায়। তারা অস্ত্র উঁচিয়ে রইল।

তিনি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। সারাটা জীবন জেলে জেলে কাটিয়েছেন, জেলের ব্যাপার তিনি কিছু বোঝেন। তার সেলের সামনে আবার গর্ত খোঁড়া হয়েছে। আগে কাউকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর। পেতেন, যুদ্ধ বেধে গেছে। বিমান আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ট্রেঞ্চ। সাইরেন বাজত, বিমান আসত, আশপাশের ওয়ার্ডে, তার সেলের প্রহরীরাও ট্রেঞ্চে গিয়ে ঢুকত।

কিন্তু ইদানীং তিনি বুঝতে পারেন, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এখন আর বিমানের শব্দ কিংবা সাইরেনের শব্দ শোনা যায় না। তাহলে কেন এই গর্ত?

এরা কয়েদিদের লেলিয়ে দিতে চাইছে তার বিরুদ্ধে। তারপর গুলি করে মেরে বলবে, জেলখানার ভেতরে বন্দিবিদ্রোহে মুজিব মারা গেছে। এদের তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার সাহসও কি নেই।

হইচই থেমে গেল। পাশের ওয়ার্ডের ছাদে সমবেত বন্দীরা বোধ করি চলে গেছে। খানিকটা নীরবতা। সেই নীরবতার মধ্যে একটা তক্ষক কোথাও ডেকে চলেছে।

মুজিব নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বিছানায় একমাত্র কম্বলটার নিচে হাত-পা সেঁধিয়ে তিনি ঘুমানোর চেষ্টা করছেন।

গভীর রাতে দরজায় শব্দ হলো।

কে?

বাতি জ্বালালেন তিনি। দেখতে পেলেন, জেলের গভর্নর হাবিব আলীকে।

তাঁর ছোটখাটো শরীর, গোলাকার মুখ, চ্যাপ্টা নাক।

তিনি বললেন, আমি জেল গভর্নর হাবিব।

এত রাতে?

আমি আপনাকে নিতে এসেছি। আপনি আমাকে সহযোগিতা করুন।

কোথায় নেবে? আজ রাতেই কি আমার ফাঁসি হচ্ছে? হলে হবে। মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আজ রাতেই কি আমার ফাঁসি হচ্ছে তাহলে?

না।

দেখুন, আজ রাতে যদি আমার ফাঁসি হয়, তাহলে তা জানার অধিকার আমার আছে। আমি গোসল করব। অজু করব। একটুখানি কোরান শরিফ থেকে পড়ব।

না। ফাঁসি নয়। জেলের মধ্যে কয়েদিরা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তারা আপনার ওপরে ক্ষিপ্ত।

কেন?

কারণ পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়ানদের কাছে সারেন্ডার করেছে।

মুজিব হিসাব-নিকাশ কিছু বুঝছেন না। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

হাবিব বললেন, কথা বলার সময় এখন নেই। আপনাকে জেলের মধ্যে খুন করে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। আমি আপনাকে বাঁচাতে চাই। আমি আপনাকে জেলের বাইরে লুকিয়ে রাখব।

কোথায়?

আমার বাড়িতে। আপনি চুপ করে নিজেকে কম্বলে মুড়ে বেরিয়ে আসুন। আমরা একটা ট্রাকে উঠব।

মুজিব বুঝতে পারছেন না যে হাবিব আলী সত্য বলছে, নাকি তাঁকে কিছু লুকাচ্ছে। তিনি তার তামাক, পাইপ, ব্যক্তিগত জিনিসগুলো গোছাতে লাগলেন।

হাবিব বলল, টুথব্রাশ-রেজর এগুলো নিতে হবে না। বেঁচে থাকলে পরেও জোগাড় করা যাবে। আপনি চলুন।

তিনি হাবিবের কথায় আস্থা রাখলেন।

সশস্ত্র প্রহরীরা বন্দুক উঁচিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চলল। তাঁকে জেলগেটের বাইরে আনা হলো। মুক্ত আকাশের নিচে এলেন মুজিব। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে তিনি জানেন না। তার মনের মধ্যে ঝড়। তার মনের মধ্যে তরঙ্গ। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়ান সৈন্যদের। কাছে? ঘটনা কী? কেন? আসল ব্যাপারটা কী?

সামনে একটা ট্রাক। হাবিব বললেন, এর পেছনে উঠে পড়ুন। আমিও উঠছি।

ট্রাকের মধ্যে অনেক খড়। সেই খড়ে হাবিব নিজে শুয়ে পড়লেন আর বললেন, দয়া করুন। আপনিও শুয়ে পড়ুন।

মুজিব খড়ের গাদায় শুয়ে পড়লেন। ট্রাক চলতে লাগল।

রাত অনেক। শীতের বাতাস এসে লাগছে গায়ে। ভাগ্যিস কম্বলটা এনেছিলেন। তা দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখলেন মুজিব।

ঘন বনের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে বোঝার চেষ্টা করলেন মুজিব। একসময় ট্রাক থামল। হাবিব বললেন, শেখ সাহেব, আমরা এখানে নামব। এরপর খানিকটা হাঁটতে হবে। ১০ মিনিটের মতো লাগবে।

মুজিব ট্রাকের পেছন থেকে নামলেন। হাবিবও নামলেন।

তারা হাঁটতে লাগলেন। সঙ্গে একজনমাত্র স্টেনগানধারী প্রহরী। বাকি। প্রহরীরা ফিরে গেল।

ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে।

বাংলোটা সুন্দর। সবচেয়ে বড় কথা, এটা একটা সরকারি কোয়ার্টার। এর বিছানা সুন্দর। বাথরুম সুন্দর। টেবিল-চেয়ার আসবাব সুন্দর।

মুজিবকে তাঁর ঘর দেখিয়ে হাবিব বললেন, আপনি এখানে আরাম করে ঘুমান।

মুজিব চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর জীবনে কী ঘটছে, তিনি কিছুই বুঝছেন না।

সকালবেলা তিনি বেগম হাবিব, তাঁর সন্তানদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে নাশতা করলেন।

হাবিব তাঁকে জানালেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পাকিস্তানি মিলিটারি ইস্টার্ন সেক্টরে সারেন্ডার করেছে। ইন্ডিয়ান আর্মি বাংলাদেশে আছে। আপনি রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আর তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। তবে আল্লাহর কসম আপনি এই কথা কাউকে বলবেন না। আপনি এখনো বন্দী। বন্দীর সঙ্গে আমি এত কথা বলেছি, তা প্রকাশিত হলে আমার চাকরি তো থাকবেই না। আমার জীবনও চলে যাবে। আমার স্ত্রী আর সন্তানদের আপনি দেখলেন। তারা অনাথ হোক, এটা নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন না।

মুজিবের মনের মধ্যে চলচ্চিত্রের মন্তাজের মতো এক হাজার বছরের দৃশ্য, মুজিবের চোখের সামনে টাইম ডাইলুশন, এক সেকেন্ডে মহাকাল যেন ঝলকে উঠল তাঁর মনের পর্দায়, আহা, হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি মহিত্তাপদ গায়ে উত্তরীয় জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গনগনে সূর্যের নিচে দুই হাত প্রসারিত করে বলছেন :

পাপ-পুণ্য বেণি তিড়িঅ সিকল মোড়িঅ খম্ভা ঠাণা।
গঅণ টাকলি লাগি রে চিত্তা পইঠ ণিবানা।

পাপ-পুণ্যে বানানো শেকল ছিঁড়ে, ভেঙে স্তম্ভ-স্থান
গগন শিখরে উঠে চিত্ত প্রবেশিল নির্বাণ।

যেন রঙ্গলাল সেন এখনি গেয়ে উঠবেন :

স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।

যেন নজরুল বলছেন, বলো বীর, বলো চির-উন্নত মম শির, যেন। জীবনানন্দ দাশ বলছেন, তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব, যেন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত…যেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহীরা ঘিরে ধরছে গোরা সৈনিকদের, যেন ফকিররা ছুটছে গাদা সাদা ঘোড়ার খুরে ধূলি উড়িয়ে, যেন কৈবর্তরা লগি-বইঠা হাতে ছুটে চলেছে বিদ্রোহ করতে, যেন নীলকরদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে লাঠি সড়কি হাতে ছুটে যাচ্ছে প্রজারা, যেন বারভূঁইয়ারা সমতটে সমবেত হচ্ছে। মোগলশক্তির বিরুদ্ধে, যেন বাঁশের কেল্লায় মরিয়া সমাবেশ ঘটাচ্ছেন তিতুমীর, যেন এইমাত্র মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করলেন, আর প্রীতিলতার হাত থেকে বিষের শিশিটা কেড়ে নিলেন, যেন এইমাত্র ফাঁসির দড়ি গলা থেকে ছিঁড়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছে ক্ষুদিরাম, যেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব, শরৎ বসু শেষবারের মতো মোলাকাত সেরে নিলেন, যেন আজিমপুর কবরে শহীদ বরকত, শফিউর, রফিক, জব্বাররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে নক্ষত্রের গায়ে গায়ে বর্ণমালা বসিয়ে দিচ্ছে…স্বাধীনতা, আহা স্বাধীনতা..

মুজিব বললেন, না। আমি আর কিছু জানতে চাই না। আমার জন্য এই কথাই যথেষ্ট যে আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমি জানতাম, আমার মানুষ পারবে। আমি জানতাম, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন পারবে। আমি জানতাম আমরা যখন মরতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। মুজিব কাঁদতে লাগলেন। অবিরল জলধারা গড়াতে লাগল তার দুচোখ বেয়ে। কান্নার ভেতর থেকেই তিনি হাসছেন। কাঁদতে কাঁদতে হাসছেন তিনি, হাসতে হাসতে কাঁদছেন!

তিনি হাবিবকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন।

তার দেশের মানুষের কথা মনে পড়তে লাগল! আমার দেশবাসী ভালো আছে তো? তখন আবার তাঁর আব্বার মুখটা মনে পড়ছে। আব্বা বলেছেন, অনেস্টি অব দ্য পারপাজ, সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ।

তার মায়ের মুখ মনে পড়তেই মনে হলো, টুঙ্গিপাড়ায় বাইগার খালের ধারে বটের একটা গাছ ছিল, তাতে লাল লাল ফল ধরত, পাখিরা সারাক্ষণ কূজন করত বটের ডালে ডালে, নিচে বসলে কী মধুর হাওয়া এসে শরীর মনে শান্তির পরশ বোলাত, তাকাও তুমি দিগন্তের দিকে, ধানের খেতে বাতাসের ঢেউ…বাড়ির পেছনে একসার আমগাছ…আমগাছে বসন্তকালে মুকুল ধরত। সেই মুকুলের কী যে মাদকতাময় গন্ধ, বসন্তের বাতাসে উড়ে এসে নাকে লাগত।

তিনি গুনগুন করতে লাগলেন :

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে–
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে–
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দুই চোখ বেয়ে উষ্ণ জল গড়াতেই থাকল!

আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

১২৩

দমদম বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার প্রস্তুত। সকাল থেকেই কলকাতার আকাশ ঢেকে রেখেছে সাদা কুয়াশার চাদর। সূর্য উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। হেলিকপ্টার উড়বে রোদ ওঠার পর। আবার অন্ধকার নামার আগেই সেটাকে পৌঁছাতে হবে ঢাকায়। ২২ ডিসেম্বরের দুপুরবেলা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান আর খন্দকার মোশতাক এসে পৌঁছালেন কলকাতা বিমানবন্দরে। সবাই আবেগপ্রবণ। একদিন, প্রায় ৯ মাস আগে, যে যার মতো করে ঘর ছেড়েছিলেন অজানার উদ্দেশে, অনিকেত ঝোড়ো পাখির মতো, জানতেন না তারা যে তাঁদের গন্তব্য কী, নিয়তিতে কী লেখা আছে। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় মনে হয়েছিল, আর কি কখনো ফিরে আসতে পারবেন জন্মভূমিতে–গন্তব্য অনিশ্চিত, পথ অজানা, কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির, অর্জুনের মতোই তারা দেখতে পেয়েছিলেন পাখির চোখ–বাংলাদেশের স্বাধীনতা! আজ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, স্বদেশের রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছেন তারা! আবেগাপ্লুত হওয়ার মতোই একটা সন্ধিক্ষণ বটে। তাজউদ্দীনের মনে পড়ে, এপ্রিলে সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময় তার মনে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের লিপিকার বাণী, এ পথ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়। তাজউদ্দীন চেয়েছিলেন, এই যাওয়ার পথ যেন ফেরার পথটাকে তৈরি করে নেয়।

মুজিবনগরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এসেছেন বিমানবন্দরে। এসেছেন মন্ত্রীদের পরিবারের অনেক নারী-পুরুষ-শিশু সদস্য। সবার মুখে একই সঙ্গে আনন্দ আর বিষাদ। চোখের কোণে যে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে, তা কেবল দুঃখের নয়–প্রাপ্তির, অর্জনের এবং আশারও। এ এমন এক অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

বিমানবন্দরে উপস্থিত আছেন রুস্তমজি, বিএসএফের ডিজি, উপস্থিত আছেন গোলক মজুমদার। বিদায়ী করমর্দন হচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদের মনে পড়ছে যে আমীর-উল ইসলাম আর তিনি এই দমদম বিমানবন্দরে এসেছিলেন মলিন ধূলিধূসরিত পোশাকে, এপ্রিলের এক রাতে। গোলক মজুমদার সীমান্ত থেকে গাড়ি করে তুলে এনেছিলেন তাঁদের, ভিআইপি লাউঞ্জের বাথরুমে বিএসএফের দেওয়া নতুন পোশাক পরে নিয়ে তারা উঠে পড়েছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর কার্গো বিমানে, দিল্লির উদ্দেশে। সেদিন তাঁদের ছিল মলিন বেশ, কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধের তন্ত্রীটা বাজছিল চড়া সুরে, আমরা একটা স্বাধীন দেশের নেতা হিসেবেই আরেকটা স্বাধীন দেশে এসেছি, নিপীড়িত জনগণের মুক্তির জন্য সাহায্য চাইতে।

রুস্তমজির হাতের মধ্যে তাজউদ্দীনের হাত।

রুস্তমজি বললেন, আসুন। অল দ্য বেস্ট। আমি আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে।

তাজউদ্দীনের চোখ ছলছল করছে। তিনি কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা আনলেন, বললেন, হ্যাঁ, দুটো স্বাধীন দেশ সমমর্যাদার ভিত্তিতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যে মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখে, সেই মৈত্রীর সম্পর্ক ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চির-অটুট থাকবে। দুটো স্বাধীন দেশ, কেউ কারও ওপরে চাপ সৃষ্টি করবে না, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করবে না–এই হলো মৈত্রীর প্রথম কথা।

গোলক মজুমদার বিস্মিত বোধ করলেন। তাজউদ্দীন এমন আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ ধারণ করেন!

রুস্তমজিও সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়লেন!

হেলিকপ্টারের দরজা বন্ধ হলো। পাখা ঘুরছে।

সৈয়দ নজরুল প্রসন্ন মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কলকাতাকে বিদায় জানাচ্ছেন। কামারুজ্জামান মনে মনে একটা কবিতার পঙক্তি ভাবছেন, কবিতাটা আসি আসি করেও কেন যেন আসছে না। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ভাবছেন, হেলিকপ্টার কি সরাসরি ঢাকায় নামবে, নাকি যশোরে জ্বালানি নিতে থামতে হবে।

খন্দকার মোশতাকের মনটা বিষিয়ে আছে। মুখে তেতো স্বাদ। আমেরিকাকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে শেখ মুজিবকে বের করে আনার তার উদ্যোগটা ভেস্তে গেল। আর ভারত ও তাজউদ্দীন তাকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে রাখল। এখন তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার দেশ স্বাধীন করে ফেলল, সেখানে মোশতাকের জায়গা কই? মুজিব এসে কী বলবেন? ঢাকায় নেমেই প্রথমে মোশতাককে যেতে হবে বেগম মুজিবের কাছে। ভাবি বলে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে দেবেন তিনি। বলবেন, আমি মুজিব ভাইকে ছাড়ানোর কত চেষ্টা করলাম, তাজউদ্দীনের ষড়যন্ত্রের কারণে পারলাম না। তা না হলে আজকে মুজিব ভাই পাকিস্তানি সৈন্যদের কান ধরে বের করে দিতেন। ভারতীয় সৈন্যও এই দেশে থাকত না। মুজিব ভাইয়ের জীবন নিয়ে আমাদের এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। আল্লাহ, তুমি মুজিব ভাইরে ভালো রাখো। আমি এসে গেছি ভাবি, আর আপনাদের কোনো চিন্তা নাই। তাজউদ্দীন তো চায় না শেখ মুজিব ফিরুক দেশে। তাহলে তো তার আর প্রধানমন্ত্রী থাকা হয় না। আমি এসে গেছি, বাংলার মাটিতে শেখ মুজিবকে আনবই আনব।

.

হেলিকপ্টার এসে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বাইরে হাজার হাজার মানুষ। তারা সব নিরাপত্তাবলয় ভেঙে ছুটে এল নেতাদের ফুলের মালা পরিয়ে দেবে বলে।

গার্ড অব অনার দেওয়া হলো ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে।

এই ভিড়ের মধ্যে সামনে ১৪ জনের ভিআইপি লাইন। তাতে আছেন একজন। আবদুল আজিজ বাগমার।

তাজউদ্দীন বাগমারকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বাগমার, আপনি বেঁচে আছেন। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম আপনি মারা গেছেন। আতিয়া কেমন আছে?

মন্ত্রীরা গাড়িতে উঠলেন। তাঁরা শহীদ মিনারে যাবেন। তারপর যাবেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে।

বাগমার গতকালই ধানমন্ডির ১৮ নম্বরে বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। আতিয়াও সঙ্গে ছিলেন।

বেগম মুজিব সব সময়ই আন্তরিক, মেহমানদারিতে কোনো ত্রুটি রাখেন না। কাল ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১, তাকে মনে হয়েছে খুব বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

বাগমারকে রেনু বলেছেন, শুনেছেন নাকি ভাই, আপনাদের মুজিব ভাইকে নাকি চীনে পাঠায় দিচ্ছে?

বাগমার বলেছেন, না তো ভাবি, শুনি নাই।

কী যে হবে? সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হয়।

বাগমার বলেছেন, ভাবি, দুশ্চিন্তা করবেন না। ৯০ হাজার পাকিস্তানি অফিসার-সোলজার আটক আছে। মুজিব ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করার সাহস পাকিস্তানিরা পাবে না। সারা পৃথিবীর সবাই মুজিব ভাইয়ের মুক্তি চায়।

এই সময় একজন বাঙালি মেজর এসেছেন। বেগম মুজিবকে জানিয়েছেন, আপনাকে একটা সুখবর দিতে এলাম। শেখ কামাল আজকেই আসছেন। তিনি আমাদের সেনাপতির এডিসি ছিলেন। তাঁকে প্রটোকল দিয়ে রিসিভ করা হবে।

কামাল আসতেছে–বেগম মুজিব প্রায় চিৎকার করে উঠেছেন।

.

এখন, ২২ ডিসেম্বরে, তেজগাঁও বিমানবন্দরের গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ বাগমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ঢাকার এসপি জিয়াউল হক লোদী সাহেবের।

বাগমার তাঁকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বেঁচে আছেন লোদী সাহেব, আপনি বেঁচে আছেন!

চোখের পানি মুছে লোদী বললেন, বেঁচে আছি। সেই যে ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালায় দুজনের দেখা হয়েছিল। আপনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি বেঁচে থাকবেন। আবার ঢাকার এসপি হবেন। আমি বেঁচে আছি। আবার এসপি হিসেবে ডিউটি করছি। বাগমার সাহেব, আপনি তো জ্যোতিষী। আপনি তো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। চলেন। আপনাকে ছাড়ছি না। কোথায় যাবেন, বলেন? আমি পৌঁছে দিচ্ছি…।

সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রীরা বিমানবন্দর থেকে সোজা গেলেন ধানমন্ডিতে, ১৮ নম্বর রোডে বেগম মুজিবের ভাড়া করা বাড়িতে। তাঁদের সবার চোখে পানি। আমরা তো এসেছি, স্বাধীনতা এসেছে, বঙ্গবন্ধুকেও আনব–এই তাঁদের প্রতিজ্ঞা।

১২৪

একজন কর্নেল এল। জুতা ঠুকে স্যালুট করল মুজিবকে। বলল, স্যার, প্রেসিডেন্ট আসছেন।

মুজিব এখন একটা প্রাসাদোপম বাংলোয়। মেঝেতে দামি গালিচা, অনেক উঁচুতে ছাদ, সেখান থেকে নেমে এসেছে ঝাড়বাতি, মেহগনি কাঠের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের আসবাব–চেয়ার-টেবিল, খাট-পালঙ্ক। হাবিবের বাড়ি থেকে বিদায় করিয়ে মুজিবকে আনা হয়েছে এই প্রাসাদে।

প্রেসিডেন্ট আসছেন! ইয়াহিয়া খান! শেখ মুজিব দরজার দিকে তাকালেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে কতগুলো মিলিটারি গাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে।

মুজিবের ঘরে একটা লং প্লে রেকর্ড প্লেয়ার আছে। মুজিব ছোটবেলা থেকেই গ্রামোফোনে গান শুনতে অভ্যস্ত। মুজিব একটা গান ছেড়ে দিলেন।

ইয়াহিয়া খান নয়, নীল স্যুট, লাল টাই পরা ভুট্টো জুতা মচমচ করতে করতে ঢুকলেন ঘরে।

শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টো, তুমি? আমি তো প্রেসিডেন্টকে আশা করছিলাম!

ভুট্টো হাসলেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বললেন, আমিই এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট!

কী বলো? তা কী করে হয়! যত দূর মনে পড়ে, ইলেকশনে তুমি আমার চেয়ে অর্ধেক আসন কম পেয়েছিলে!

শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক!

শেখ মুজিব বিস্মিত। একজন সামরিক লোক প্রেসিডেন্ট হয়, এটা আমি শুনেছি, কিন্তু একজন বেসামরিক লোক সামরিক আইন প্রশাসক হয়, এটা এই প্রথম শুনলাম! মুজিব বললেন, তা ইয়াহিয়া এখন কোথায়?

ও। তার নাম মুখে আনবে না। তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তার বিচার হবে।

মুজিব ভুট্টোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ভুট্টো বললেন, বসো। বসে কথা বলি। ২০ ডিসেম্বর আমি ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়েছি। পাওয়ার ট্রান্সফারের আগে ইয়াহিয়া খান আমাকে একটা এনভেলাপ দিয়েছে। একটা মৃত্যুদণ্ডাদেশ। শেখ মুজিব, তোমার বিচার হয়েছে সামরিক আদালতে। আদালতের রায়ে তোমার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়া তোমার মৃত্যুপরোয়ানায় সই করে রেখেছে। শুধু ডেটটা দেয়নি। আমাকে বলেছে, আমি যেন ব্যাকডেট দিয়ে নিই। যেকোনো একটা তারিখ বসিয়ে দিয়ে সুবিধামতো সময়ে তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাই।

মুজিব ভুট্টোর মুখ নিরীক্ষণ করে তাঁর মন পড়ার চেষ্টা করছেন। লোকটা বলতে চায় কী!

ভুট্টো বলে চলেন, আমাকে ইয়াহিয়া বলেছেন, আমার উচিত ছিল আরও অনেক আগে মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো। মুজিব একটা বিশ্বাসঘাতক। পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু।

তুমি কী বললে?

আমি বললাম, মুজিবকে হত্যা করা হলে বাঙালিরা বসে থাকবে না। তারা উন্মাদ হয়ে যাবে আর যেখানে যত পাকিস্তানি পাবে, তাদের সবাইকে ছিঁড়ে ফেলবে। এই পাগলামোর কোনো মানে হয় না। আপনি মুজিবের ভার আমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। এটা আমি ভালোভাবে সামলাতে পারব।

মুজিব বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলবে, ভুট্টো এই দাবি মুজিবের কাছে বারবার কইরা করব যে ইয়াহিয়া মুজিবরে ফাঁসি দিতে চাইছিল, আর ভুট্টো তারে বাঁচাইছে।

কিন্তু ইতিহাসে উল্টা কথাও আছে। ইয়াহিয়া খান তার জবানবন্দিতে কইছিলেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভুট্টো আইসা ইয়াহিয়া খানের উপরে চাপ দিছিল য্যান শেখ মুজিবরে তখুনি ফাঁসিতে ঝুলায়া দেওয়া হয়!

.

ভুট্টো বললেন, আমি তোমার কাছে সাহায্য চাই। ইন্ডিয়ানরা তো ঢাকা দখল করে নিয়েছে। তোমার দেশ এখন ভারতীয় সৈন্যদের বুটের নিচে।

শেখ মুজিব মনে মনে হাসেন। জেলার হাবিব তাকে গোপন কথা বলে রেখেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে।

কিন্তু মুজিব এই কথা ভুট্টোকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিতে চান না।

তিনি বললেন, তাই নাকি? এ তো সর্বনাশের কথা! তাহলে আমাকে এখনই ঢাকা যেতে হবে। ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আওয়ামী লীগ আমাকে ছাড়া এটা পারবে না। তুমি এখনই আমাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করো।

ভুট্টো বলেন, হ্যাঁ। আমাদের দুজনার দুজনকে সহযোগিতা করতে হবে। এক দিনে সব কথা শেষ হবে না। আমি তোমার সঙ্গে আবারও দেখা করব। কথা বলব।

ভুট্টো চলে গেলেন।

মুজিব আবারও গেলেন গ্রামোফোনটার কাছে। গানটা সম্ভবত তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই বাড়িতে ভুট্টো নিশ্চয়ই গোপন রেকর্ডার নিয়ে এসেছিল বা পেতে রেখেছে। শেখ মুজিব ও ভুট্টোর কথোপকথন ভুট্টো বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইবে। তিনি সেই ফাঁদে পা দিচ্ছেন না।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে : বঙ্গবন্ধুরে শাহুল্লা ওরফে সিহালা গেস্টহাউসে রাখা হয়। একটা সময় তাঁরে রেডিও দেওয়া হয়। খবরের কাগজও দেওয়া হয়। শেখ মুজিব রেডিও পাইয়াই দেশ-বিদেশের খবর শুনতে থাকেন। দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। তাঁর কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হইতে থাকে যে ভুট্টো তারে মিথ্যা কওনের চেষ্টা করতেছে। পরে, কুলদীপ নায়াররে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুজিব এই কথা স্পষ্ট করেন, মুজিব বলেন, আরে ভুট্টো তো একটা প্যাথলজিক্যাল লায়ার, হাড়ে হাড়ে মিথ্যাবাদী। তবে এইটা ঠিক যে ভুট্টো তাঁর প্রাণ বাঁচাইছেন–ভুট্টোর দেওয়া এই ধারণা বঙ্গবন্ধু অনেক দিন ধইরা রাখছিলেন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টরে দেওয়া সাক্ষাঙ্কারেও সেইটা আছে। এটুখানি শোনো :

ফ্রস্ট : আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেলার একসময় সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এ কি সত্য?

বঙ্গবন্ধু : ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তাঁর কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তোবা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটায় সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলোতে দুদিন যাবৎ রক্ষা করল। এই দুদিন আমার কোনো সামরিক পাহারা ছিল না। দুদিন পর এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার-পাঁচ কিংবা ছদিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।

ফ্রস্ট : এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে, তা-ই ভাবছি।

বঙ্গবন্ধু : আমিও জানি না। ওদের ওপর কোনো আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থ শুভকামনা রয়েছে।

ফ্রস্ট : এমনকি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?

বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনিটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিল, মিস্টার। ভুট্টো, আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেওয়া।

ফ্রস্ট: ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!

বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় পরে বলেছিল, ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।

ফ্রস্ট : ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?

বঙ্গবন্ধু : ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিল, না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের সামরিক বাহিনীর এক লাখ তিন হাজার লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দী রয়েছে। তা ছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক। ভুট্টো এ কথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর কাছে আমি অবশ্যই এ জন্য কৃতজ্ঞ।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, বঙ্গবন্ধু এরপর অনুরোধ করেন কামাল হোসেনরে এই গেস্টহাউসে আইনা দেওনের লাইগা।

কামাল হোসেন যে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, এইটা শেখ সাহেব উকিলদের মুখের কথায় আগেই বুইঝা ফেলছিলেন।

কামাল হোসেনরে এই গেস্টহাউসে আনা হয়।

ভুট্টো আবারও এই বাড়িতে আহেন। পাকিস্তানের সাথে কোনো একটা শিথিল সম্পর্ক রাখা যায় কি না, বিবেচনা কইরা দেখতে মুজিবরে অনুরোধ করেন।

শেখ মুজিবের এক কথা : আগে আমারে আমার মানুষের কাছে যাইতে দাও। তারপর আমি মুখ খুলব। তার আগে আমি এই ব্যাপারে একটা কথাও বলব না।

ভুট্টো বলে, তোমারে মুক্তি দিতে হইলে আমারেও আমার জনগণের কাছ থাইকা অনুমতি লইতে হইব। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে আমার একটা জনসভা আছে। করাচিতে হইব। সেইখানে আমি তোমার মুক্তির ব্যাপারটা পাস করায়া নিমু।

বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাইতাছেন, এইটা স্পষ্ট হয়। ফরেন সেক্রেটারি আজিজ আহমেদ, অহন পাকিস্তানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইসা দেনদরবার করেন। কেমনে শেখ সাহেব ফ্লাই করবেন, কোন দেশে যাইবেন, এই সব।

ড. কামাল বলেন, জেনেভা বা ভিয়েনা।

আজিজ বলেন, সম্ভব না। আপনারা ইরান যান।

কামাল বলেন, প্রশ্নই আসে না।

আজিজ বলেন, লন্ডন।

শেখ মুজিব এবং ড. কামাল একযোগে বইলা উঠেন : হ। হ। লন্ডন।

৭ জানুয়ারিতে শেখ মুজিব আর ড. কামালরে হেলিকপ্টারে লইয়া যাওয়া হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। ভুট্টো তাগো ডিনার খাওয়ান। খাওয়াদাওয়া হইলে ভুট্টো শেখ মুজিবের হাতটা ধইরা কন : আমার শ্যাষ রিকোয়েস্ট। পাকিস্তান নামটা ছাইড়ো না। এটা লুজ কনফেডারেশন কইরা রাখো।

শেখ মুজিব হাত ছাড়ায়া লন। বলেন, ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের নিচে পাকিস্তান মারা গেছে। এই রিকোয়েস্ট আমি রাখতে পারব না। তবে দুইটা আলাদা স্বাধীন দেশ, আলাদাভাবে এই পৃথিবীর দুই প্রান্তে শান্তিপূর্ণভাবে থাকবে। এইটা তো হইতেই পারে।

ভুট্টো বলেন, তাইলে আইজকা আর প্লেন যাইতে পারবে না। ইরানের শাহ আসবে কাইলকা ভোরে। সব এয়ার রুট সিল কইরা দেওয়া হইছে।

শেখ মুজিব বলেন, প্লেন আসবে কাইলকা। আর আইজকা এয়ার রুট বন্ধ করার মানে কী? ইরানের শাহ আসার আগেই আমরা ইউরোপের আকাশে চইলা যাব। তুমি প্রেসিডেন্ট। তুমি সিএমএলএ। তোমার অর্ডারই অর্ডার। বইলা দাও, শেখ মুজিবের প্লেন চলব।

ভুট্টো তার স্টাফদের সাথে কথা কন। শেষে নির্দেশ দেন, করাচির উপর দিয়া ফ্লাই করো।

করাচির উপর দিয়া? ড. কামাল লাফায়া উঠেন। করাচিতে আমার বউ বাচ্চারা আছে। তাদেরও তাইলে তুইলা লই।

ভুট্টো হাইসা কন, আচ্ছা, কামাল সাহেবের ফ্যামিলিরে একই প্লেনে লন্ডন পাঠায়া দেও।

.

গভীর রাতে রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে শেখ মুজিব ওঠেন প্লেনে। তাঁকে এগিয়ে দিতে প্লেন পর্যন্ত ওঠেন ভুট্টো। কামাল হোসেন যখন বিমানের ভেতরে। পা রাখলেন, দেখতে পেলেন, তাঁর স্ত্রী হামিদা এবং তার দুই ছোট্ট মেয়ে ডানা আর সারা প্লেনে বসা। চোখের পানিতে নয় মাস পর একটা পরিবারের পুনর্মিলন সম্পন্ন হলো। চার বছরের সারা তার ডাগর চোখ মেলে তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের জেলে নিয়েছিল কেন? কারণ কি এই যে তোমরা ইলেকশনে অংশ নিয়েছিলে?

বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেলেন হামিদা হোসেনের দিকে। দুই মেয়ের মাথার চুল নেড়ে দিয়ে, গাল টিপে তাদের আদর করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধের এই দিনগুলোতে তোমরা কেমন ছিলে!

শেখ মুজিবকে তার আসনে বসানো হলো। সিটবেল্ট বাঁধলেন মুজিব। ককপিট থেকে পাইলট ঘোষণা দিচ্ছেন, আমি এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী। আপনাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন। আমরা লন্ডনের দিকে যাত্রা আরম্ভ করতে যাচ্ছি। আমরা লন্ডন সময় ছয়টার দিকে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছাব বলে আশা করছি। আপনার সিটবেল্ট বেঁধে রাখুন। আবহাওয়া ভালো। আমাদের ফ্লাইট নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে বলে আমরা আশা। করছি।

প্লেন উড়তে আরম্ভ করল। শেখ মুজিব জানালা দিয়ে রাতের রাওয়ালপিন্ডির আলোর দ্রুত পশ্চাদপসরণ দেখতে লাগলেন।

তার মনে হতে লাগল, এবার বোধ হয় সত্যিই মুক্তি। জেলখানা থেকে যাত্রা অবারিত প্রান্তরে। পরাধীনতার নিগড় থেকে পাখা মেলা আলো বাতাসভরা অনন্ত সম্ভাবনার আকাশে।

আকাশে বিমান উঠে গেলে ক্যাপ্টেন জাফর চৌধুরী তাঁর আসন ছাড়লেন। যাত্রীদের কেবিনে এলেন। কামাল হোসেন ও শেখ মুজিব পাশাপাশি বসেছেন। তারা কথা বলছেন। জাফর বুঝছেন না শেখ সাহেবের সঙ্গে তিনি কী বলবেন। তিনি শুধু কামাল হোসেনকে সালাম দিলেন।

বিমানে খাবার পরিবেশন করা শুরু হলো। বিমানের ভেতরে পরিবেশটা বোধ হয় হালকা হয়ে গেছে। মুজিব তাঁর আসনে ফিরে এসেছেন। পাইলট এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী গিয়ে মুজিবকে বললেন, স্যার, গুড মর্নিং। খাওয়ার সময় সালাম দিতে হয় না। তাই দিলাম না। আমি এই বিমানের পাইলট।

আচ্ছা। বসুন। আপনাদের কী অবস্থা!

এই তো স্যার চলছে।

যুদ্ধে পিআইএর কোনো ক্ষতি হয়নি?

না স্যার। ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার বিমানবাহিনীর হয়ে থাকতে পারে। পিআইএর শুধু একটা টুইন অটার ঢাকা এয়ারপোর্টে বিধ্বস্ত হয়েছে। আমাদের কিছু স্টাফ ঢাকায় আটকা পড়েছেন। আর পিআইএর সব বিমান আমরা পশ্চিমে নিয়ে আসতে পেরেছি।

শেখ মুজিব বললেন, ইয়াহিয়া খান লোকটা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলল।

সে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।

জাফর বললেন, কিন্তু তা তিনি করতে পারেননি। কারণ, আল্লাহ আপনার হায়াত রেখেছেন।

মুজিব বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর রহমত। আর মানুষের ভালোবাসা। আমার দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে। তারা আমার জন্য লড়েছে। আমার কিছু হলে তারা ছাড়ত না।

আচ্ছা, আপনি রেস্ট নিন। বলে ক্যাপ্টেন ককপিটে ফিরে গেলেন।

শেখ মুজিব চোখ বন্ধ করলেন। ঘুম আসতে চাইছে না। বিমান যাচ্ছে। লন্ডনে। তিনি একটা স্বাধীন দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি সেই মর্যাদা নিয়ে ব্রিটেনে পা রাখতে চান। ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তার মধ্যে চলে গেলেন। স্বপ্নে দেখলেন তার বড় মেয়ে হাসিনাকে। হাসিনার কোলে একটা শিশু। তিনি বললেন, মা, তোর শরীরটা কেমন? হাসিনা বলল, আব্বা, তোমার শরীর এত খারাপ হয়ে গেছে কেন? তখন রাসেল এল দৌড়ে। বলল, আব্বা, তোমাকে ওরা ভাত খেতে দেয়নি। শুধু রুটি খেতে দিয়েছে। তখন হঠাৎই গুলি শুরু হলো। তাঁদের ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতলার রুমের মেঝেতে বৃষ্টির মতো গুলি পড়তে লাগল।

ঘুম ভেঙে গেল। বিমানের ক্রুরা নাশতা নিয়ে এসেছে। মুজিব উঠে টয়লেটে গেলেন। চোখেমুখে পানি দিলেন। ফিরে এসে নাশতার সামনে বসলেন। ক্যাপ্টেন জাফর এসেছেন। তিনি বললেন, তেল নেওয়ার জন্য একটা জায়গায় আমরা অবতরণ করতে পারি। এরপর এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা লন্ডন পৌঁছে যাব। লন্ডনে নামার ঠিক এক ঘণ্টা আগে আমরা তাদের জানাব যে আমরা আপনাকে নিয়ে সেখানে নামছি।

মুজিব বললেন, আপনি একটা ব্যাপার নিশ্চিত করুন। আমাকে রিসিভ করতে যেন ব্রিটিশ সরকারের ফরেন অফিসের অফিসাররা উপস্থিত থাকে।

জাফর তাঁর স্টুয়ার্ডকে বললেন, উপহারগুলো আনো। একটা বড় ঝোলা ব্যাগ এল। জাফর দুটো পাইপ আর একটা জায়নামাজ তুলে দিলেন মুজিবের হাতে। বললেন, এই ফ্লাইট একটা ঐতিহাসিক ফ্লাইট। আমি জাফর কত ফ্লাই করেছি। আমার নাম তো ইতিহাসে কোথাও থাকবে না। কিন্তু আজকের এই ফ্লাইটের কারণে ইতিহাসে আমার নামটা থেকে যেতেও পারে। আমি একটা দেশের মহান নেতাকে এই ফ্লাইটে মুক্তির বন্দরে নামিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের পিআইএর পক্ষ থেকে এই ক্ষুদ্র উপহারটা গ্রহণ করুন।

শেখ মুজিব হাসিমুখে জিনিসগুলো হাতে নিলেন। বললেন, আমি এই জায়নামাজে নামাজ পড়ব আর আপনাদের জন্য দোয়া করব। এয়ার মার্শাল, আপনি কিন্তু এটা নিশ্চিত করবেন যে আমাকে নিতে যেন ফরেন সার্ভিসের অফিসাররা বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকে।

.

আজিজ আহমেদ, যিনি শেখ মুজিবের বিদায়ের আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ভুট্টোর নির্দেশে বেশ কিছু ডলার জাফরের হাতে দিয়ে দিয়েছেন। আর দিয়েছেন স্যুট, কোট-প্যান্ট ও প্রিন্স কোট।

বিমান লন্ডনের আকাশে। মুজিব কোট পরে নিলেন। মাফলার জড়ালেন গলায় এবং একটা ওভারকোট রেডি রাখলেন। ৮ জানুয়ারি ভোরবেলা লন্ডনের শীত ভীষণ তীব্র হবে, তাতে মুজিবের সন্দেহ নেই।

৬টা ৩৬ মিনিটে বিমান যখন হিথরোর রানওয়েতে চাকা রাখছে, তখন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ভোরের আলো পৃথিবীকে চুম্বন করছে।

প্লেনের চাকা থামল। প্রধান টার্মিনাল থেকে খানিকটা দূরেই। প্লেনে এসে উঠল বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারী।

জাফর বললেন, স্যার, চলুন। আমরা ভিআইপি লাউঞ্জে যাব।

মুজিব বললেন, যারা এসেছেন, তাঁরা কি ফরেন অফিসের লোক?

না স্যার। এরা এয়ারপোর্টের লোক। তবে ভিআইপি এলেই এরা কেবল তাদের টেক কেয়ার করে। ফরেন অফিসের লোকেরা থাকবে ভিআইপি লাউঞ্জে।

শেখ মুজিব ড. কামালকে বললেন, কামাল। কী করবা? নামবা, না বসে থাকবা?

মুজিব ভাই, চলুন। প্লেনের মধ্যে ফরেন অফিসাররা তো আসবেন না। তারা টার্মিনালের ভেতরেই থাকবেন। আমরা এগোতে থাকি।

শেখ মুজিব ওভারকোটটা পরে নিলেন। ড. কামালও। হামিদা হোসেন উলের স্কার্ফ জড়িয়ে নিলেন। মেয়ে দুটোকে হাতমোজা পরালেন।

তারা ধীরে ধীরে নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে।

ক্যাপ্টেন জাফর, তাঁর সহকর্মীরা এবং হিথরো বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা শেখ মুজিব ও তাঁর সহযাত্রীদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে। ঠান্ডা বাতাসে বঙ্গবন্ধুর হাতের পাইপ নিভে গেল।

ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে একজন ব্রিটিশ পুলিশ। তিনি হঠাৎই বলে উঠলেন, স্যার, স্যার, উই হ্যাভ বিন প্রেয়িং ফর ইউ, স্যার।

শেখ মুজিব কামালের দিকে তাকালেন। বাংলার মানুষ তাকে ভালোবাসে, তার মুক্তির জন্য তারা প্রার্থনা, সংগ্রাম, চেষ্টা করে যাচ্ছে–এটা তিনি নিশ্চিত। কিন্তু একজন ব্রিটিশ পুলিশ সদস্যও তার জন্য প্রার্থনা করেছেন, তাঁর মঙ্গল কামনায় চোখের জল ফেলছেন, ব্যাপারটা বেশ মর্মস্পর্শী।

তারা ভিআইপি রুমে গিয়ে বসলেন সোফায়। কক্ষের টেলিফোন বেজে উঠল। একজন অফিসার ফোন তুললেন, রিসিভার হাতে নিয়ে বললেন, মি. রহমান, ইটস ইয়োর কল।

মুজিব বললেন, কামাল, ধরো তো। দ্যাখো কে?

কামাল বললেন, হ্যালো…

গুড মর্নিং! অ্যাম আই টকিং টু মি. শেখ মুজিবুর রহমান, স্যার?

গুড মর্নিং। দিস ইজ কামাল হোসেন, হিজ কলিগ!

আমি আয়ান সাদারল্যান্ড বলছি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে।

মি. সাদারল্যান্ড। আমরা ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেছি।

মিস্টার শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন?

হ্যাঁ। আমরা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছি।

ও মাই গড। আমি এখনি আসছি। মাত্র এক ঘণ্টা আগে আমাদের অফিসকে জানানো হয়েছে যে মিস্টার রহমান আসছেন। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে রিসিভ করার জন্য। আমাকে বলা হয়েছিল আরও ঘণ্টা চারেক পরে আপনারা আসবেন। আমি আপনাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা আর আপনাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমাকে দশ মিনিট সময় দিন, আমি আসছি।

শেখ মুজিব বললেন, আবু সাঈদ চৌধুরীর ফোন নম্বর নাও। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করো।

আবু সাঈদ চৌধুরীকে কি খবর দেওয়া যায়? কামাল বললেন ফোনে।

তিনি তো গতকালই লন্ডন ছেড়েছেন। এখন বাংলাদেশের পক্ষে সিনিয়র আছেন রেজাউল করিম। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করছেন। আমরা তাঁকে বলছি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

আমাকে তার নম্বরটি দিতে বলুন। ড. কামাল বললেন।

রেজাউল করিম তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁর শিয়রের কাছে ফোন বেজে উঠল। তিনি ঘুমজড়িত কণ্ঠে বললেন, হ্যালো। রেজাউল করিম স্পিকিং।

হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। নিন, কথা বলুন।

কামাল হোসেন ফোন দিলেন বঙ্গবন্ধুকে, ফিসফিসিয়ে বললেন, বাংলাদেশের ফরেন অফিসার রেজাউল করিম।

শেখ মুজিব ফোন ধরে বললেন, রেজাউল করিম। আমি শেখ মুজিব বলছি।

আপনি কেমন আছেন? রেজাউল করিম উত্তেজনায় কথা বলতে পারছেন না।

আছি ভালোই।

স্যার। আপনি পাঁচ মিনিট সময় দিন। আমি আসছি।

.

রেজাউল করিম তার ফোর্ড করটিনা গাড়ি বের করে ছুটছেন হিথরোর দিকে। এত স্পিডে গাড়ি তিনি জীবনেও চালাননি। সাদারল্যান্ড ছুটছেন আরেকটা গাড়িতে। গাড়িতে বিবিসি রেডিও বলছে, বাংলাদেশের মুক্তিদাতা শেখ মুজিবুর রহমান এখন হিথরো বিমানবন্দরে…খবর পেয়ে হিথরোর দিকে ছুটছেন আরও দুজন বাঙালি কূটনীতিক–মহিউদ্দীন আহমদ আর মহিউদ্দীন আহমদ জায়গীরদার।

সাদারল্যান্ড এলেন। এলেন রেজাউল করিম। এলেন দুই মহিউদ্দীন।

ক্যাপ্টেন জাফর বললেন, স্যার, আমি কি এখন বিদায় নিতে পারি?

অবশ্যই। শেখ মুজিব বললেন, এয়ার মার্শাল, আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন, সে জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মানুষেরা এসে গেছে। আমি হলাম জনগণের নেতা। এখন আমি আমার মানুষের সঙ্গে মিলব। আপনাকে ধন্যবাদ।

এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী বিদায় নিলেন।

সাদারল্যান্ড বললেন, স্যার, আপনার জন্য হোটেল ক্ল্যারিজস বুক করা হয়েছে। হোটেলে যাওয়ার জন্য লিমুজিন প্রস্তুত।

মুজিব বললেন, রেজাউল, এরা কী করেছে? আমি টাকাপয়সা পাব কোথায়? ক্ল্যারিজস হোটেল অনেক দামি। অনেক টাকা রুম রেন্ট। আমাকে তুমি রাসেল স্কয়ারের সেই হোটেলটাতে রাখার ব্যবস্থা করো, যে হোটেলে আমি ৬৯ সালে এসে উঠেছিলাম।

রেজাউল করিম বললেন, স্যার, ওই হোটেলে বেকার স্টুডেন্টরা ওঠে। আপনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আপনার নিরাপত্তার বিষয়টা সবার আগে। আপনার ক্ষতি তো আমরা হতে দিতে পারব না।

আর শোনো। এরা লিমুজিন ঠিক করছে। আমি লিমুজিনে উঠব না। এরও ভাড়া অনেক বেশি। আমি রাষ্ট্রপতি। তবে গরিব দেশের রাষ্ট্রপতি।

এর মধ্যে সাংবাদিকেরা এসে ভিড় করেছেন। টেলিভিশনের ক্যামেরা চলে এসেছে।

পাইপে অগ্নিসংযোগ করে মুজিব বললেন, আমি ক্লান্ত। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমি বেঁচে আছি এবং ভালো আছি। আমি পরে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব।

মুজিব লিমুজিনে উঠলেন না। উঠলেন রেজাউল করিমের গাড়িতে। ড. কামাল, তার স্ত্রী-কন্যারা উঠলেন লিমুজিনে।

গাড়ি চলতে লাগল ক্ল্যারিজস হোটেলের দিকে। রেজাউল করিম গাড়ি চালাচ্ছেন। লন্ডনের সকাল। একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে। রেজাউল করিমকে গাড়ি চালাতে হচ্ছে সাবধানে, যাতে কিছুতেই কোনো রকমের দুর্ঘটনা না ঘটে।

শেখ মুজিব তাঁর পাশে। মুজিব বললেন, রেজাউল করিম, এটা কি ঠিক যে আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি!

জি ঠিক। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে। নয় মাসের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। অগণিত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ নারীকে রেপ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কামান দাগানো হয়েছে। শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। লন্ডনের কাগজে বড় বড় হেডলাইন হয়েছে : জেনোসাইড। মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ডা. ফজলে রাব্বি, ডাক্তার আলীম চৌধুরী–এ রকম শত শত বুদ্ধিজীবীকে মেরে ফেলা হয়েছে। এক কোটি মানুষ ইন্ডিয়াতে শরণার্থী হয়েছে…

শেখ মুজিবের চোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়াতে লাগল।

১২৫

ব্যাঙ্গমা বলে, শেখ মুজিব লন্ডনে দারুণ অভ্যর্থনা পাইছিলেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, ক্ল্যারিজস হোটেলের সামনে ভিড় হইয়া যায়। নিরাপত্তাচৌকি বসাইতে হয়।

শেখ মুজিব ফোনে কথা বলেন তাজউদ্দীনের লগে। তিনি বলেন, তাজউদ্দীন, তোমরা চমৎকার কাজ করেছ। চমৎকার কাজ।

তাজউদ্দীন ফোনে কাঁদতে থাকেন।

মুজিব বলেন, শোনো, একটু পরে সংবাদ সম্মেলন করতে হবে। টকিং পয়েন্ট কী হবে?

তাজউদ্দীন বলেন, আমাদের স্বাধীন দেশের প্রধান নীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা…

.

১৮ নম্বরের বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। শেখ নাসের এসেছেন, বঙ্গবন্ধুর চার বোন এসেছেন ছেলেমেয়েসহ। শেখ মণি তো এই বাড়িতেই থাকেন। তাঁরা বিবিসি রেডিওতে কান পেতে রাখেন। সবার চোখে অশ্রু।

এর মধ্যে বেজে উঠল ফোন। এই টেলিফোন সেটটা সরকারি উদ্যোগে সম্প্রতি এই বাড়িতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ফোন ধরলেন কামাল। হ্যালো। প্লিজ হোল্ড অন। শেখ মুজিবুর রহমান উইল স্পিক।

হ্যালো। আব্বা, আমি কামাল।

হ্যালো, তোরা বেঁচে আছিস তো? তোদের মা কেমন আছে?

আব্বা, নেন, মার সাথে কথা বলেন। রেনু এগিয়ে এসে ফোন ধরলেন। হ্যালো, হাসুর আব্বা…

রেনু, তোমরা সবাই বেঁচে আছ তো?

হ্যাঁ। সবাই বেঁচে আছে…তুমি কেমন আছ? তোমার শরীর কেমন আছে…আমরা সবাই আছি…আল্লাহর রহমতে ভালো আছি…। কথার চেয়ে কান্না বেশি। কবে আসবা তুমি?

আমি কবে আসব, এটা এখনো ঠিক হয় নাই। ঠিক হওয়ামাত্র তোমাদের জানাব…

রাসেল ফোন নিল। বলল, আব্বা, তোমাকে কি ওরা ছেড়ে দিয়েছে? আব্বা, তুমি কবে আসবা? আব্বা, ওরা আমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছে।

ঘরের সবাই দাঁড়িয়ে আছেন টেলিফোন ঘিরে। সবাই কাঁদছেন….

শেখ মুজিব বুঝে নিলেন রাসেলের এক কথা থেকে হাজার কথা। ওরা আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছে।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, শেখ মুজিব ফোনে কথা কন ইন্দিরা গান্ধীর লগে। ভারতীয় কূটনীতিকরা তার লগে দেখা কইরা তারে পরিস্থিতি বুঝান।

ব্যাঙ্গমি বলে, তার লগে দেখা করতে স্রোতের মতো মানুষেরা আসতে থাকে। তিনি বাঙালিগো পাঁচটা প্রতিনিধিদলের লগে সাক্ষাৎ করেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস আসেন, ডেভিড ফ্রস্ট আসেন। খানিকটা সময় মুজিব তাদের দেন। আসেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হারল্ড উইন্ডসন। আসেন সাবেক মন্ত্রী পিটার শোর। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন সাপ্তাহিক ছুটি কাটাইতেছিলেন গ্রামে। খবর পাইয়া তিনি ছুঁইটা আসেন। শেখ মুজিব ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যান। হিথ নিজে বাইর হইয়া আইসা গাড়ির দরজা খুইলা দিয়া মুজিবরে ভিতরে নেন।

শেখ মুজিব কন, ব্রিটেন স্বাধীন বাংলাদেশরে য্যান স্বীকৃতি দেয়।

হিথ কন, তা তো দিতেই চাই। উপমহাদেশের তিন দেশের সাথেই আমরা সম্পর্ক রাখতে চাই। তয় ভারতীয় সৈন্য…

ভারতীয় সৈন্য আমি যেদিন বলব সেদিনই বাংলাদেশ ছাইড়া চইলা যাইব…জুনের মধ্যে যাইব, মিসেস গান্ধী কইয়া দিছেন…

কেন নয় মার্চ?

আচ্ছা। আমি কইলে তা-ও হইব…

.

শেখ সাহেব ক্ল্যারিজস হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন। কালো প্রিন্স কোটের বুকে লাল-সবুজ কোটপিন। হাতে পাইপ। এরিনমোর তামাকের ধোয়ার সুগন্ধ ম-ম করছে। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি মুখ খোলেন :

সাংবাদিক বন্ধুরা,

আজ মুক্তির সীমাহীন আনন্দ আমার দেশের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আর কোনো বাধা নেই। এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এ মুক্তি অর্জন করেছি। বাংলাদেশের জনগণের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এ লড়াইয়ের চূড়ান্ত অর্জন। আমি যখন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের জন্য এক সেলে বন্দী, তখন এ রাষ্ট্রের জনগণ আমাকে তাদের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে। আমি ছিলাম ফাঁসির দড়িতে প্রাণদণ্ডের অপেক্ষায়। বাংলাদেশের মানুষের মতো আর কেউ মুক্তির জন্য জীবন আর দুর্ভোগ দিয়ে এত মূল্য দেয়নি। আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আর একটি মুহূর্তের বিলম্বও আমি সইতে পারছি না।

দেশে-বিদেশে থাকা আমার বীর জনতাকে অভিনন্দন জানাই। বিশেষ করে অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি অংশকে, যারা জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গেছে তাদের বহুলালিত স্বাধীনতার লক্ষ্যে। আর আজ আমি শোক জানাচ্ছি মুক্তির সংগ্রামে প্রাণ হারানো লাখো শহীদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। সর্বশক্তিমানের কাছে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

আমি তিনটি জিনিসে বিশ্বাস করি–গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতান্ত্রিক ধাচের অর্থনীতি।

ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে বলবেন কি না? এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, আশা করি আমি বলব। আমি এখন পর্যন্ত যতটা বুঝতে পারছি; আর মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর আচরণ যতটা বুঝতে পারছি, নিশ্চিতভাবে তিনি বাংলা থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করবেন।

১২৬

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রয়্যাল এয়ারফোর্সের কমেট বিমানের ভেতরটা রাজকীয়। সামনে টেবিল পেতে আরাম করে বসে অফিসের কাজও করা যায়। শেখ মুজিব সেই টেবিলটাকে ব্যবহার করছেন তাঁর পাইপ রাখার জন্য। এরিনমোর তামাকের গন্ধে বিমানের এই জায়গাটা ভোর হয়ে আছে।

প্লেনের সিটে ড. কামাল হোসেনের পাশে বসে হামিদা হোসেন বললেন, শেখ সাহেবের কি কোনো ক্লান্তি নাই? আমার তো ঘুমে হাত-পা ভেঙে আসছে।

ক্লান্তিতে শরীরের রণে ভঙ্গ দেওয়ারই কথা। শেখ মুজিব আর কামাল হোসেন সপরিবার পিন্ডিতে পিআইয়ের বিমানে ওঠেন ৭ জানুয়ারি রাতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানে ওড়া। লন্ডনে অনিশ্চিত অবতরণ। তারপর একটার পর একটা কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা, একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আসছেন, বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমনিতেই মুজিব ভাইয়ের ওজন অনেক কমেছে, তাঁকে কাহিল দেখা যাচ্ছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সেলে নির্জন দিবস-রজনী কাটিয়েছেন তিনি। প্রচণ্ড গরম, তীব্র শীতে কষ্ট পেয়েছেন। ঠিকভাবে খাবার পাননি। তারপরও কী উদ্যম তার!

৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিথরো ছাড়ল বিমানটি।

ড. কামাল বললেন, ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন ভারত থেকে বিশেষ বিমান পাঠাবেন। এয়ার ইন্ডিয়ার ভিআইপি উড়োজাহাজ। মুজিব ভাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে না করে দিয়েছেন।

হামিদা বললেন, কেন?

কামাল বললেন, তিনি পৃথিবীবাসীকে একটা বার্তা দিতে চান। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। কোনো একটা দেশের ওপরে তিনি অতিরিক্ত নির্ভর করে নাই।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, ইন্দিরা গান্ধী যখন শুনলেন, শেখ মুজিব ব্রিটিশ বিমানে ফ্লাই করতে চান, প্রথমে একটু মন খারাপ করছিলেন। কিন্তু শক্ত মহিলা। মনের কথা প্রকাশ করেন না। তিনি বললেন, ঠিকই আছে। এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজ সিকিউরিটি সমস্যায় পড়তে পারে। ব্রিটিশ বিমানই নিরাপদ হইব।

.

ব্রিটিশ ফরেন সার্ভিসের কর্তা সাদারল্যান্ডকে মুজিব বলে দিয়েছিলেন, এমনভাবে ফ্লাইটের টাইম শিডিউল করুন, যাতে দিল্লিতে সকাল সকাল পৌঁছানো যায়। ওখানে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি শেষে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা, যাতে দিন থাকতে থাকতে ঢাকায় নামা যায়। শীতকাল। দিন ছোট।

সেভাবেই শিডিউল করা হয়েছে। ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দিল্লির উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ। ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লি অবতরণ। দুপুরের মধ্যে ঢাকা।

শেখ মুজিব এখন কথা বলছেন শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির সঙ্গে। শেখ মুজিব তাঁকে গতকাল যখন প্রথম দেখেন, তখনই চিনতে পারেন। সেই ষাটের দশকে শেখ মুজিব আর মানিক মিয়া দেখা করেছিলেন ভারতীয় উপহাইকমিশনের কর্মকর্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে-বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারত কীভাবে সাহায্য করতে পারে, তা আলোচনা করতে।

লন্ডন থেকে শেখ মুজিবের সহযাত্রী হতে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে দুজনকে দেওয়া হয়েছে–হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া আর শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি।

সামনে কমলার রস, হাতে পাইপ, শেখ মুজিব বেশ খোশমেজাজেই আছেন।

শশাঙ্ককে দিল্লি থেকে একটা বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবকে যেন বলা হয়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি নয়, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র চালু করা ভালো হবে। ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের গণতন্ত্র। দিল্লির পছন্দের একজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থীও আছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

শশাঙ্ক সেই কথা পাড়বার আগেই শেখ মুজিব বললেন, ম্যাডাম ইন্দিরা গান্ধীকে একটা কথা বলতে হবে। আমি দিল্লি ছাড়ার আগেই একটা কমিটমেন্ট যদি পাই, খুব ভালো হবে।

জি বলুন।

প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে আমার কথা হয়েছে। ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী। তারা বলে, মার্চের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। এই কথাটা আপনি দিল্লিকে দ্রুতই জানাবেন। ম্যাডাম ইন্দিরা যেন ৩১ মার্চের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের কথাটা কালকে আমাদের ঢাকার ফ্লাইটের আগেই বলে ফেলেন।

শেখ মুজিব মন খুলে কথা বলছেন। শশাঙ্কও ভদ্রতা-সৌজন্য বজায় রেখে জানালেন, বাংলাদেশে কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রই ভালো পদ্ধতি হবে বলে মনে হয়।

মুজিব লুফে নিলেন কথাটা। বললেন, আমি ছিলাম না, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনরা অনেক কষ্ট করেছে। তারা একটা যুদ্ধকালীন সরকার করেছে। আমি সব সময়ই পার্লামেন্টারি ফর্ম অব গভর্নমেন্টের পক্ষে।

আপনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে কে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন? আমি লন্ডনে একজনের সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, বিচারপতি…।

আবু সাঈদ চৌধুরী। গুড চয়েস। মুজিব হেসে উঠলেন। বললেন, কী ভাগ্য দেখেন, চৌধুরী সাহেব আজকে এই প্লেনে থাকতে পারতেন।

শশাঙ্ক মাথা নাড়লেন।

আমি একটু উঠি। হাঁটাচলা করি। রোজ খানিকক্ষণ না হাঁটলে আমার চলে না। এটা আমার ডেইলি রুটিনের অংশ। শেখ মুজিব হেঁটে কামাল হোসেনদের কাছে গেলেন। তার পাশে বসলেন।

বললেন, কামাল, তুমি তো আইনের লোক। সংবিধানের ব্যাপার তুমি ভালো বুঝবা। পার্লামেন্টারি ফর্ম অব গভর্নমেন্ট কি বেটার নয়?

কামাল বললেন, জি মুজিব ভাই। আমি তো তা-ই মনে করি।

.

মুজিব আবার উঠলেন। হাঁটাহাঁটি করলেন। ভেদ মারওয়ার কাছে গেলে মারওয়া তাঁকে সালাম জানালেন। মুজিব তাঁকে ইংরেজিতে বললেন, আপনি একা একা বসে আছেন কেন, আমার পাশের সিটে এসে বসুন। কথা বলি।

ভেদ মারওয়া খুবই খুশি। তিনি গিয়ে মুজিবের পাশের সিটে বসলেন।

মুজিব বললেন, তাহলে আপনি লন্ডনে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি!

জি স্যার। স্যার, আমি কিন্তু বাংলা জানি। বাংলাভাষী অঞ্চলে আমার পোস্টিং হয়েছিল।

আরে আগে বলবেন তো আপনি বাংলা জানেন। বাংলায় কথা বলতে না পারলে আমার ভালো লাগে না। লন্ডনে অনেকক্ষণ ধরে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে চোয়ালে ব্যথা হয়ে গেল। বাংলা, আহা আমার বাংলা। ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।

ভেদ মারওয়া শেখ মুজিবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন অভিভূতের মতো।

শেখ মুজিব বললেন, ভারত আমাদের জন্য যা করেছে, তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। দুই দেশের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হবে।

শেখ মুজিব জানেন, তাঁর সঙ্গে ভেদ মারওয়ার কথাবার্তা সবই ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত যাবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী উত্থান নিয়ে ভারতের ভেতরে টেনশন হওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গ আবার এই স্রোতে গা ভাসাবে না তো? মুজিবের উচিত ভারতীয়দের আশ্বস্ত করা। তিনি তাই নিজে নিজেই বলতে শুরু করলেন, দেখুন, আমরা প্রথমে বাঙালি। এটা বাংলাদেশের বহু পরিচয়ের একটা। সব পরিচয়ের আগে বাঙালি পরিচয়। আমরা এ পরিচয় নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। এ পরিচয়কে ভিত্তি করেই স্বাধীনতার সব সংগ্রাম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের মুসলিম পরিচয়। আমি বাঙালি। আমি মুসলমান।

ভেদ মারওয়া বিস্মিত বোধ করলেন মুজিবের এই কথায়।

তিন নম্বর হলো, আমাদের আঞ্চলিক পরিচয়। আমি মুসলমান। আমাদের নৃতাত্ত্বিক মিল কিন্তু পাঠান, আফগান, ইরাকি, পারসি, তুর্কি বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশের মানুষদের সঙ্গে নয়। আমাদের মিল দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের সঙ্গেই। এ অঞ্চলের সমস্যাগুলো খুব বেশি অভিন্ন। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো উপায় নেই।

ভেদ মারওয়া বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন। মুগ্ধ হলেন শেখ মুজিবের আশ্চর্য প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়। তিনি দেখবেন, পরের দিন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে শেখ মুজিব এই কথাগুলোই ঠিকঠাকভাবে বলবেন।

দুবার জ্বালানি নেওয়ার জন্য থেমে ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টা ১০ মিনিটে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে রুপালি ব্রিটিশ রয়্যাল বিমানটি অবতরণ করল।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আতাউস সামাদ তখন দিল্লিতে। সরকারি সফরে। তিনি সবার আগে প্লেনে উইঠা পড়লেন। শেখ মুজিবের লগে কয়েক মিনিট গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সাইরা নিলেন।

ব্যাঙ্গমি বলবে, তাজউদ্দীন এরই মধ্যে তাঁর মন্ত্রিসভা একটুখানি বাড়াইছেন, একটুখানি বদলাইছেন। মোশতাকরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাইকা সরায়া সেচমন্ত্রী বানায়া দিছেন। মোশতাক গোস্বা কইরা অসুখের ভান কইরা হাসপাতালে ভর্তি হইছিল। ওয়াজেদ মিয়া গিয়া তার রাগ ভাঙ্গাইছিলেন।

ব্যাঙ্গমা বলবে, দিল্লি এয়ারপোর্টে শেখ মুজিব বিমানের দরজায় দাঁড়াইলেন।

ব্যাঙ্গমি বলবে, য্যান স্বর্গ থাইকা দেবদূত বাইর হইলেন।

তিনি কইলেন, জয় বাংলা।

সমবেত বিশিষ্টজনেরাও বইলা উঠলেন, জয় বাংলা।

পুরো ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের সব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সেইখানে হাজির। আছেন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রীরা, কূটনীতিকেরা, সাংবাদিকেরা। মুজিব নামতাছেন। স্লোগান উঠল, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, লং লিভ শেখ মুজিব। সবুজে কালো প্রিন্স কোট পরা শেখ মুজিব হাত নাড়লেন। দীর্ঘ উড়ালের ক্লান্তিও য্যান তারে কাবু করতে পারতেছে না।

ভি ভি গিরি তারে জড়ায়া ধরলেন। ইন্দিরা গান্ধী মিষ্টি হাসি দিয়া হাত বাড়ায়া তারে উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাইলেন। ক্যামেরার ক্লিক। ক্লিক। মুভি ক্যামেরার ফিতার ঘূর্ণন। তিন বাহিনীর সদস্যরা তারে গার্ড অব অনার দিলেন। তারপর তারে নিয়া যাওয়া হইল ভিআইপি প্যান্ডেলে। ফুলের বৃষ্টি আইসা পড়তেছে তার উপরে। মঞ্চে উঠলেন তিনি। ভারতের জাতীয় সংগীত বাজল। তাঁর গুর্খা বাদকদল বাজাইল : আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…

শেখ মুজিবরে মালাম এয়ারপোর্টে যখন নানা রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়া যাইতে হইতেছিল, তখন ভিআইপি প্যান্ডেলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সবাই চেয়ার ছাইড়া উইঠা শেখ মুজিবরে দেখার জন্য ছোটাছুটি শুরু কইরা দেয়।

.

শেখ মুজিবকে নিয়ে ছয় দরজার মার্সিডিজ গাড়ি যাচ্ছে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে। এরই মধ্যে শশাঙ্ক ব্যানার্জি দেখা করেছেন ডি পি ধরের সঙ্গে। জানিয়ে দিয়েছেন, মুজিব চান ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের সময় তিন মাস এগিয়ে আনা হোক…

নয়াদিল্লিতে একটা জনসভাতেও ভাষণ দেন মুজিব। তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা শুরু করেন লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন বলে…জনতা চিৎকার করে ওঠে, বাংলা বাংলা।

মুজিব তাকান ইন্দিরার দিকে। ইন্দিরা বলেন, আপনি বাংলায় বলুন। তিনি শুরু করেন, ভাই ও বোনেরা আমার…জনতা হর্ষধ্বনি করে ওঠে…

এরই মধ্যে দিল্লি-ঢাকা যৌথ ঘোষণায় অবিলম্বে ভারতীয় সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার ঘোষণা ঠাঁই করে নিয়েছে।

১২৭

পুরো বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পাখি, প্রতিটা প্রাণী, নদীর ঢেউ, আকাশের তারা, প্রতিটা ধূলিকণা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে একটা মানুষের ভালো থাকার জন্য কায়মনোবাক্যে নিশিদিন প্রার্থনা করেছে। প্রতিমুহূর্তে তার নিরাপদ সুস্থ প্রত্যাবর্তনের জন্য দোয়া করেছে। সংগ্রাম করেছে। চেষ্টা করেছে। সেই আশা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। বাঙালির মুক্তিদাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ফিরে আসছেন। রেডিওতে এই ধরনের ধারাবিবরণী হচ্ছে, যা মোটেও বাড়িয়ে বলা নয়।

ছোট্ট রাসেল একটা নতুন মুক্তিযোদ্ধার ইউনিফর্ম পরেছে। এটা তার জন্য তড়িঘড়ি করে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে অনুকরণ করেছে তার ১৭ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ভাই জামালকে। শেখ কামাল এখন বাংলাদেশ আর্মির কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। তিনিও আর্মির ইউনিফর্ম পরেছেন। রেহানা ফুলের মালা গেঁথে রেখেছে নিজের হাতে। বাড়ির আরও শিশু সদস্য ফুল হাতে প্রস্তুত। নব্বই-ঊর্ধ্ব শেখ লুৎফর রহমান বিমানবন্দরে হাজির। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে আছে বিমানবন্দরে। তিন বাহিনীর একটা দল গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওসমানী সেসবের দেখভাল করছেন। সালাম গ্রহণের জন্য মঞ্চ তৈরি।

ব্রিটিশ কমেট দিল্লি থেকে ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বিমান রাজহংসে করে দিল্লি থেকে ঢাকা ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জিনিসপত্র রাজহংসে তোলাও হয়েছিল। মুজিব বললেন, সে কী করে হয়! ব্রিটিশ বিমানে ঢাকা যাব বলেই তো ব্রিটিশদের কথা দিয়ে রওনা দিয়েছি। এখন মাঝপথে বন্ধুর বিমান পেয়েছি বলে ওদের বিদায় করে দিতে পারি না। সেটা অসৌজন্য হবে।

বিমানে আছেন ড. কামালের পরিবার, আবদুস সামাদ আজাদ, প্রটোকল অফিসার ফারুক চৌধুরী, সাংবাদিক আতাউস সামাদ, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাওলা, ভেদ মারওয়া, শশাঙ্ক ব্যানার্জি। শেখ মুজিব বারবার করে গাইছেন : আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

আবদুস সামাদ আজাদ জানাচ্ছেন কী নৃশংস অত্যাচারই না পাকিস্তানি বাহিনী করেছে বাঙালিদের ওপরে!

আতাউস সামাদও মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছেন অসংকোচে। কামাল। হোসেন নানা বিষয়ে মত দিচ্ছেন।

ফারুক চৌধুরী জুনিয়র অফিসার, দিল্লি এয়ারপোর্টে দেওয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণ তিনি লিখেছেন অশোক হোটেলের কামরায় বসে, সংকোচে দূরে বসে আছেন।

মুজিব বললেন, আমাদের পতাকায় বাংলাদেশের ম্যাপটার কি দরকার আছে?

না, পৃথিবীর কোনো দেশের পতাকায় তো ম্যাপ থাকে না।

একজন জানালেন, এরই মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব একই কথা বলেছেন। ম্যাপের আকার ঠিক হয় না। ম্যাপে জায়গা কমানোও ভালো নয়, বাড়ানোও ভালো নয়। ম্যাপটা না রাখাই ভালো।

জাতীয় সংগীত হিসেবে আমার সোনার বাংলা ছাড়া আর কি কিছু হতে পারে?

না না। হতে পারে না। দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে এই গান অর্জন করে নিয়েছে।

আচ্ছা, সরকার কোন ধরনের হওয়া উচিত?

সংসদীয় পদ্ধতির। সবারই তা-ই মত।

ব্রিটিশ স্টুয়ার্ড এসে জানালেন, বিমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢুকে গেছে।

মুজিব জানালায় গিয়ে বসলেন। তিনি বাংলাদেশের রূপ দেখবেন। বললেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটা চক্কর দিতে বলো। আমি দেশটাকে একবার ভালো করে দেখে নিই।

তা-ই হলো। ৪৫ মিনিট ধরে চক্কর দিল বিমান। মুজিব আবৃত্তি করতে লাগলেন, নমো নমো নমো বাংলাদেশ মম চির মনোরম চির মধুর…

১০ জানুয়ারি ১৯৭১। দুপুরবেলা। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার অভিসন্ধি করছে। ডানায় রোদের গন্ধ মুছে নিয়ে রুপালি ব্রিটিশ বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল। তেজগাঁও থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা পাগলের মতো হয়ে গেল।

সব প্রটোকল, সব শৃঙ্খলা ভেঙে গেল, যখন বিমানের দরজায় শেখ মুজিব এসে দাঁড়ালেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ফুলের মালা হাতে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে। নজরুল মালা দিলেন। মুজিবকে আলিঙ্গন করলেন। তাজউদ্দীন মালা দিলেন। মুজিবকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর দুজনে প্রাণভরে কাঁদতে লাগলেন। এত কান্নাও বুঝি এই দুজনের বুকে জমাট বেঁধে ছিল! কাঁদতে কাঁদতে তাজউদ্দীন বললেন, মুজিব ভাই, আপনি আসছেন, আমার কাঁধের বোঝা নেমে গেল। বঙ্গবন্ধু বললেন, তাজউদ্দীন, তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস ছিল, আমি জানতাম, পারলে তুমিই পারবে। এর মধ্যে ছাত্রনেতারা উঠে গেছেন সিঁড়িতে। তোফায়েল, রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, মাখন, রব, শাজাহান সিরাজ…

শেখ কামাল প্যারেডের পাশে। শেখ লুৎফর রহমান নিচে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন…মানুষের ঢেউ সামলাতে পারছে না বাংলাদেশের পুলিশ, ভারতীয় সৈন্যরা…

রেনু, হাসিনা, রেহানা, রাসেল, সায়েরা খাতুন সবাই ধানমন্ডি ১৮ নম্বরের বাড়িতে রেডিওর পাশে বসে আছেন। তাঁরা ধারাবিবরণী শুনছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটা খোলা ট্রাকে উঠেছেন। তাঁর পাশে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, মোশতাকসহ মন্ত্রীরা। তাঁর পাশে ছাত্রনেতারা। জনতার ভিড় ঠেলে গাড়িবহর এগোতে চেষ্টা করছে। দুই পাশে মানুষ আর মানুষ। শেখ মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপছে। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাতেও তাঁদের দুই ঘণ্টা লেগে গেল। অনেক উঁচু করে বানানো মঞ্চে উঠতে মুজিবের জন্যও যেন সুই পরিমাণ জায়গা নেই। মানুষ পাগলের মতো ছুটে আসছে মুজিবকে একটু ছোঁয়ার জন্য। অতি কোশেশ করে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠতে পারলেন। রেসকোর্স ময়দান উপচে পড়ছে মানুষে।

শেখ মুজিব চোখ মুছতে মুছতে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। তাঁকে কাঁদতে দেখে বিশ লাখ চোখ সিক্ত হয়ে উঠল। কালো প্রিন্স কোট পরা মুজিবকে অনেক শুকনো দেখাচ্ছে। তিনি বললেন :

আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে, যাদের হত্যা করা হয়েছে, আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি।

আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে–আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায়া রাখতে পারবে না। আমার যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আজ প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ এত সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই, যা আমার সাত কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোনো আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিয়ো–এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।

আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই, যারা আমাকে সমর্থন করেছে।

আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই সারা বিশ্বের মজলুম জনগণকে, যারা আমার এই মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয় এক কোটি লোক এই বাংলাদেশ থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল, ভারতের জনসাধারণ, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের আমি মোবারকবাদ না দিয়ে পারি না। অন্য যারা সাহায্য করেছেন, তাঁদের আমার মোবারকবাদ দিতে হয়।

তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, ও বাঙালি, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করেছ, আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই বহু। কর্মী আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই, তাদের আমি দেখব না।

আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।

দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন–আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই। আমার জনগণ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই, দিতে হবে। আমি আমরা হার মানব না। আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করোনি। কবিগুরুর আজ মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি, আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।

আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের যুবক যারা আছে, তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।

একটা কথা, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে–অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না, তাদের বলছি, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি, তাদের উপর হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ। ভালোবাসি।

তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই, স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।

আমায় আপনারা পেয়েছেন, আমি আসছি। জানতাম না, আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান–একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না। এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।

ভাইয়েরা আমার, যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে, আমার সকল জনগণকে দরকার। যেখানে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বুনো, কর্মচারীদের বলি, একজনও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন, তখন সুযোগ ছিল না, আমি অপরাধ ক্ষমা করব না।

ভাইয়েরা আমার, যাওয়ার সময় আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন, নজরুলরা আমাকে ছেড়ে যায়। আমি বলেছিলাম, সাত কোটি বাঙালির সাথে মরব, আমাকে ডেকো না, আমি আশীর্বাদ করছি। ওরা কাঁদছিল। আমি বলি, তোরা চলে যা, আমার আস্থা রইল। আমি এই বাড়িতে মরতে চাই। এটাই হবে বাংলায় জায়গা। এখানেই আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করতে আমি পারব না।

ডা. কামালকে নিয়ে তিন মাস জেরা করছে, আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও, কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। তাদের আমরা জানি চিনি এবং তাদের বিচারও হবে। আপনারা বুঝতে পারেন…

নমো নমো নমো বাংলাদেশ মম চির মনোরম চির মধুর, বুকে নিরবধি বহে শত নদী চরণে জলধির বাজে নূপুর। আজ আমি যখন এখানে নামছি, আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি। বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।

পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা-বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না, শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।

তোমাদের সাথে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধু হতে পারে, তা ছাড়া বন্ধু হতে পারে না। তবে যারা অন্যায়ভাবে অন্যায় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আমি আরেক দিন বক্তৃতা করব, একটু সুস্থ হয়ে লই। আপনারা চেয়ে দেখেন, আমি সেই মুজিবুর রহমান আর নাই। আমার বাংলার দিকে চেয়ে দেখেন, সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে গেছে। এমন কোনো পরিবার নাই, যার মধ্যে আমার লোককে হত্যা করা হয় নাই।

কত বড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ লোককে এভাবে হত্যা করে, এভাবে সামরিক বাহিনীর লোকেরা, আর তারা বলে কি আমরা পাকিস্তানের মুসলমান! সামরিক বাহিনী! ঘৃণা করা উচিত! জানানো উচিত, দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশই দ্বিতীয় মুসলিম দেশ, ভারত তৃতীয়, পাকিস্তান চতুর্থ।

আমরা মুসলমান। মুসলমান মা-বোনদের রেপ করে? আমার রাষ্ট্রে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যাঁরা জানতে চান, আমি বলে দিবার চাই, আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা হয়েছে, আমি আপনাদের বলতে পারি, তাকে জানি, আমি তাকে শ্রদ্ধা। করি, সে পণ্ডিত নেহরুর কন্যা, সে মতিলাল নেহরুর ছেলের মেয়ে। তারা রাজনীতি করেছে, ত্যাগ করেছে, তারা আজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। যেদিন আমি বলব, সেদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু সরিয়ে নিচ্ছেন।

যে সাহায্য তিনি করেছেন, আমি আমার সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে তাকে, তার সরকারকে, ভারতের জনগণকে শ্রদ্ধা, অন্তরের অন্তস্তল থেকে মোবারকবাদ জানাই।

ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নাই, যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে বলেছেন, তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বলো শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে, একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে। এক কোটি লোক নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছে! এমন। অনেক দেশ আছে, যেখানে লোকসংখ্যা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। শতকরা ৬০ ভাগ দেশে লোকসংখ্যা এক কোটির কম আর আমার বাংলা থেকে এক কোটি লোক মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিল, কত অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, কত না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, কত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এই পাষাণদের দল!

ক্ষমা করো, আমার ভাইয়েরা, ক্ষমা করো আজ, আমার কারও বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই। একটা মানুষকে তোমরা কিছু বোলো না। অন্যায় যে করেছে, তাকে সাজা দিব। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ো না। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। ছাত্রসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। শ্রমিকসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। বাংলার হতভাগ্য হিন্দু মুসলমান, আমার সালাম গ্রহণ করো।

আর আমার কর্মচারী পুলিশ, ইপিআর, যাদের উপর মেশিনগান চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা মা-বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে, তার স্ত্রীদের ধরে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তোমাদের আমি সালাম জানাই, তোমাদেরকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।

নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে–এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি–এই আশীর্বাদ এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন। এই কথা বলে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিবার চাই। আমার সহকর্মীদের আমি ধন্যবাদ জানাই, যাদের আমি যে কথা বলে গিয়েছিলাম, তারা সকলে একজন একজন করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে, মুজিব ভাই বলে গিয়েছে, তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দাও, বাংলার মানুষকে মুক্ত করো। আমার কথা চিন্তা কোরো না। আমি চললাম। যদি ফিরে আসি…আমি জানি আমি ফিরে আসতে পারব না। আজ আল্লাহ আছে, তাই আজ আমি আপনাদের কাছে। ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। আমি জানি, কী কষ্ট তোমরা করেছ। আমি কারাগারে ছিলাম। ৯ মাস আমাকে কাগজ দেওয়া হয় নাই। এ কথা সত্য, আসার সময় ভুট্টো আমায় বললেন, শেখ সাব দেখেন, দুই অংশের কোনো একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি! আমি বললাম, আমি বলতে পারি না। আমি বলতে পারব না। আমি কোথায় আছি বলতে পারি না। আমি বাংলায় গিয়ে বলব। আজ বলছি, ভুট্টো সাহেব, সুখে থাকো, বাধন ছিঁড়ে গেছে, আর না। তুমি যদি কোনো বিশেষ শক্তির সাথে গোপন করে আমার বাংলার। স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, মনে রেখো, দলের নেতৃত্ব দিবে শেখ। মুজিবুর রহমান। মরে যাব, স্বাধীনতা হারাতে দিব না।

ভাইয়েরা আমার, আমার চার লক্ষ বাঙালি আছে পাকিস্তানে। আমি অনুরোধ করব…তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে জাতিসংঘের মাধ্যমে অথবা ওয়ার্ল্ড জুরির পক্ষ থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে–কী পাশবিক অত্যাচার, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে আমার লোকেদের, এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানতে হবে। আমি দাবি করব জাতিসংঘকে, বাংলাদেশকে আসন দাও এবং ইনকোয়ারি করো। ভাইয়েরা আমার, যদি কেউ চেষ্টা করেন ভুল করবেন। আমি জানি, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। সাবধান বাঙালিরা, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।

একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, একদিন। বলেছিলাম যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে যুদ্ধ করো, বলেছিলাম এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এ জায়গায় ৭ মার্চ। আজ বলছি, তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো, কারও কথা শুনো না।

ইনশা আল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি, স্বাধীন থাকব–একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে এই সংগ্রাম চলবে। আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না, একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করব। আপনারা আমাকে মাফ করে দেন। আপনারা আমাকে দোয়া করেন,

আপনারা আমার সাথে সকলে একটা মোনাজাত করেন। বঙ্গবন্ধু হাত তুলে মোনাজাত ধরেন। সেটা শেষ করে তিনি নিজেই স্লোগানের নেতৃত্ব দিতে লাগলেন–

বললেন, স্লোগান ধরুন : জয় বাংলা।

জয় বাংলা স্লোগানে পৃথিবী কেঁপে উঠল।

শহীদস্মৃতি

অমর হোক।

এবার বঙ্গবন্ধু একটা নতুন স্লোগান ধরবেন। তিনি প্রথমে নিজেই প্রস্তাব এবং জবাব, দুটো অংশই বললেন–বাংলাদেশ-ভারত ভাই ভাই।

তিনি হাবিব ও কলরেডি মাইকের মাউথপিসে বললেন, বাংলাদেশ ভারত।

দশ লাখ কণ্ঠ জবাব দিল, ভাই ভাই।

বঙ্গবন্ধু এরপর শহীদ মিনারে যান। তিন নেতার মাজারে যান। তারপর ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের বাড়িটিতে আসে তাঁর গাড়ি। সেখানেও মানুষ আর মানুষ। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ক্যামেরা। টেলিভিশন ক্যামেরা। চলচ্চিত্রের ক্যামেরা। বাড়ির ভেতরেই গাড়ি ঢোকে। মানুষের ভিড়ে বঙ্গবন্ধু বেরোতে পারছিলেন না। ভিড় ঠেলে তিনি নামলে তাঁর বড় মেয়ে হাসিনা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জামালের কোলে ছিল রাসেল। বাবা-মেয়ের মোলাকাত শেষ হলে রাসেল আব্বার কোলে ওঠে। তারপর কামালের কোলে তার স্থান হলে মুজিব বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। হলরুমে রেহানা তাঁকে ফুল দেন। বাড়ির ছোটরা ফুল ছিটাতে থাকে। ভিড় ঠেলে মুজিব গেলেন তার আব্বার কাছে। তার পায়ের কাছে নত হলেন। শেখ লুত্যর রহমান তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চোখের পানি সামলালেন অতিকষ্টে। মুজিব গেলেন মায়ের কাছে। মা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো বাড়ির সবাই তখন চোখ মুছছে।

মানুষের ভিড়ের চাপে তিনি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে পারছিলেন না। অনেক কষ্টে রেনুর ঘরে গেলে রেনু তাকে বললেন, সব ঘরেই মানুষ, বাইরে মানুষ, তুমি বাইরের ঘরেই বসো। আমি দেখি, চায়ের ব্যবস্থা কী করা যায়। তুমি জয়কে দেখো। ওকে কোলে নাও।

হাসিনা আনলেন তার ৫ মাস ১৩ দিন বয়সী সন্তান জয়কে।

রেনু বললেন, আমার ভাই তো দেখতে তার নানার মতো হয়েছে।

রেহানা আর রাসেল আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মুজিব বললেন, রাসেল আসো। ভাগনেকে তুমি আদর করো?

রাসেল বলল, হ্যাঁ। অনেক আদর করি।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ঢোকার পথ করে উঠতে পারছেন না। সবখানে মানুষ আর মানুষ।

পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। বসলেন বাইরের ঘরে। বঙ্গবন্ধু এলেন সেই ঘরে। তাজউদ্দীনের পাশে বসে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ মুজিব কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, আজ আমি বড় ক্লান্ত। আজকে আর নয়। আরেক দিন সংবাদ সম্মেলন করে কথা বলব।

ভিড়ের চোটে এই বাড়িতে টেকা দায়। তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। শেখ মুজিবকে গরম পানি করে দিয়েছেন রেনু। বললেন, তুমি গোসল সেরে নাও। একটুখানি ভাত খাবে। রেনুর ঘরেই ভাতের ব্যবস্থা হলো।

রাতে এলেন চার ছাত্রনেতা। রাজ্জাক, তোফায়েল, মণি, সিরাজ। ওয়াজেদ মিয়া তাদের বসালেন তাঁর ঘর আর বেগম মুজিবের ঘরের মধ্যখানে ড্রেসিংরুমে। শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে শুনলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কাহিনি। ওয়াজেদ মিয়া পাশে বসে সব শুনলেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, ওয়াজেদ মিয়া তার বইয়ে লেখছেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, কলকাতায় প্রবাসী সরকার, তাগো মন্ত্রী, সেক্টর, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি প্রসঙ্গে চার ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুরে ব্রিফ করলেন। এখন সংকট কোথায়, কী করণীয়, তা-ও তাঁরা কইলেন। বঙ্গবন্ধু সব শুনলেন। রাত নয়টায় তিনি ছাত্রনেতাগো বিদায় দিলেন।

এই বাড়ি ছোট। উল্টা দিকের একটা দোতলা বাড়ি বেগম মুজিব ভাড়া নিয়া রাখছিলেন। সেই বাড়িতে জিনিসপাতি লওয়া হইতেছিল। ভারতীয় সৈন্যরা এত দিন এই বাড়ি পাহারা দিতেছিল। এবার ১৫-২০ জন বাঙালি পুলিশ চইলা আসল। মুজিব ভারতীয় মেজররে কইলেন, তোমরা আমার জন্য অনেক কষ্ট করছ। আমি আইসা গেছি। আমার নিজের দেশে আমার কোনো ভয় নাই। বাঙালি পুলিশ আছে। তারাই যথেষ্ট। তোমরা আর কষ্ট কইরা বাড়ির সামনে খাড়ায়া থাইকো না। ক্যান্টনমেন্টে গিয়া আরাম কইরা ঘুমাও।

.

ভারতীয় সৈন্যরা রেনুকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিল।

বহু রাতে বাড়িটা একটু হালকা হলো। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বাদে নেতা কর্মীরা বিদায় নিলেন।

মুজিব এলেন রেনুর ঘরে। রাসেল তখনো জেগে।

রাসেল বলল, আব্বা, তুমি এসেছ। আর তোমাকে আমরা ছাড়ব না।

রেনু বললেন, আমারও একই কথা হাসুর আব্বা। তুমি এই দেশকে স্বাধীন করতে চাইছিলা। স্বাধীন করছ। আর তোমাকে আমরা ছাড়ব না। আর শোনো, আমি কিন্তু বঙ্গভবন বা হেয়ার রোডে কোথাও যাব না। সামনের দোতলাটা ভাড়া নিছি। সেখানে থাকব। ৩২ নম্বরের বাড়ি মেরামতের কাজ শেষ হলে সেখানে উঠব। তাজউদ্দীনের ওয়াইফ লিলি আসছিল। তাজউদ্দীনরা হেয়ার রোডের বাড়িতে উঠছে। ওদের ধানমন্ডির বাড়িতেও তো কিছু নাই। ঝাঁঝরা কইরে দিয়েছে। যাক, ওরা উঠছে উঠছে। আমি ধানমন্ডি ছাড়তাছি না।

মুজিব বললেন, তুমি যা বলবা, তা-ই হবে। আমি কি আর বঙ্গভবনের মতো প্রাচীরঘেরা বাড়িতে উঠতে পারি! আমি জনগণের নেতা। আমাকে জনগণের মধ্যেই থাকতে হবে। দেশটা একটু ঠিক হোক, পরিস্থিতি ভালো হোক, দেখো আমি টুঙ্গিপাড়ায় চলে যাব। সেখানে বাইগার নদীতে মাছ ধরে সময় কাটাব। কিন্তু তার আগে যে অনেক কাজ!

রেনু বললেন, হ্যাঁ। আমিও কত কথা শুনি। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। মিছিল হইছে। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ তাজউদ্দীনের কথায় অস্ত্র জমা দিবে না। আবার মোশতাক ভাই এসে কত কথা বলে গেল। মণিরা আরেক দিকে নানান কথা কয়। তুমি ছাড়া এই পরিস্থিতি কেউ সামলাতে পারবে না।

আমি যেদিন বলব, সেদিনই আমার ছেলেরা অস্ত্র জমা দিবে। কিন্তু দ্যাখো কত কাজ। রাস্তাঘাট ভাঙা। ব্রিজ-কালভার্ট নাই। বাড়িঘর বিধ্বস্ত। একটাই জিনিস আছে। আমার দেশের মানুষ। আর আমার দেশের মাটি। আমি এই দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য আবার যদি একটু বাইরে যাই, তুমি মাইন্ড কোরো না। কয়েকটা দিন।

আব্বা, শুধু কয়েকটা দিন? আচ্ছা। রাসেল মাথা তুলে বলল।

রেনু বললেন, আমি কি কোনো দিনও তোমাকে দেশের কাজ করতে বাধা দিছি? তুমি তোমার জীবন উৎসর্গ করে রাখছ দেশের জন্য। দেশের জন্যই তো তুমি কাজ করবা। আমার কোনো আপত্তি নাই। এখন স্বাধীন দেশ। এখন তো সংসারটা সামলাতে আগের মতো কষ্ট পেতে হবে না। নয়টা মাস আমরা কী কষ্ট করছি। তবে দেশের মানুষের কষ্টের তুলনায় সেটা কিছু না। আমার ৩২ নম্বরের বাড়ি ছারখার করছে, টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি পোড়ায়া দিছে।

মুজিব বললেন, আবার সব হবে। এই দেশের মাটি সোনার। আমরা সোনার বাংলাই গড়ব, রেনু। তুমি কেঁদো না…

.

ভোর হচ্ছে। পাখিরা ডাকছে ধানমন্ডির গাছে গাছে। কুয়াশা ভেদ করে আলো আসছে পুবের জানালা দিয়ে। জয় ঘুম থেকে উঠেছে, হাসিনা তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছেন। ওয়াজেদ মিয়া মর্নিংওয়াক করতে বাইরে বেরোলেন। রেনু নামাজ শেষে জায়নামাজ গুটিয়ে উঠলেন।

শেখ মুজিবের ঘুম ভেঙে গেলে তিনি দেখতে পেলেন, রাসেল তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। তার গা থেকে লেপ সরে গেছে। তিনি ছেলের গায়ে লেপ তুলে দিলেন। রাসেল হাত সরাচ্ছে না। শেখ মুজিব বিছানা ছাড়তে পারছেন না। তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘুমজড়ানো চোখে দুপায়ে শব্দ তুলে এই ঘরে এলেন রেহানা। তার আব্বার আরেক পাশে শুয়ে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আব্বা, আমি ছোটবেলায় ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আপনি রাতের বেলা বাড়ি ফিরে আমাকে ভাত তুলে খাওয়াতেন। আজকে আমি আপনাকে ভাত তুলে খাওয়াব!

রেনু জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। দেখা গেল, কতগুলো পায়রা বাইরে ওড়াউড়ি করছে। ৩২ নম্বরের পায়রাগুলো কি বেঁচে আছে? থাকলে কোথায় থাকে তারা? কী খায়? কে তাদের খাবার দেয়!

হাসিনা এলেন জয়কে কোলে নিয়ে। জয়কে তার নানা আর খালার মাঝখানে শুইয়ে দিলেন তিনি।

আলো এসে পড়েছে হাসুর আব্বার মুখে। আব্বার মুখটা বেশ রোগা দেখা যাচ্ছে। জয় খিলখিল করে হেসে উঠলে শেখ মুজিব বললেন, ফেরেশতারা জয়কে হাসাচ্ছে। এত ছোট বাচ্চারা তখনই হাসে, যখন ফেরেশতারা তাদের হাসায়।

[যারা ভোর এনেছিল উপন্যাসধারা সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *