০০১. আমার এই দেশেতে জন্ম

রক্তে আঁকা ভোর – আনিসুল হক
প্রথম প্রকাশ : ভাদ্র ১৪২৮, সেপ্টেম্বর ২০২১

উৎসর্গ

মুক্তিসংগ্রামে আত্মদানকারী ত্রিশ লাখ
শহীদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে

.

জরুরি প্রসঙ্গ

যারা ভোর এনেছিল, উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে, এখানে থেমো না–এই পাঁচটি বইয়ের পর এই বই, রক্তে আঁকা ভোর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়পর্ব এই ডকু-ফিকশনের পটভূমি।

এই বই রচনার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ, সংবাদপত্র, প্রামাণ্যচিত্র থেকে ব্যাপক সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও কোনো কোনো বই থেকে প্রায় হুবহু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এই গ্রন্থকারের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংকলকের, সংগ্রাহকের বা সম্পাদকের। কোন অংশ কোন বই থেকে নেওয়া হয়েছে, তার সূত্র বা উৎস নির্দেশ করতে গেলে টীকা-টিপ্পনী, তারকাচিহ্ন আর সংখ্যায় বইটি কণ্টকিত দেখাত, কিংবা সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু তাতে উপাখ্যান হিসেবে বইটি পাঠ করাটা হয়ে পড়ত কঠিন। তাতে সত্যের দাবির প্রতি সম্মান দেখানো যেত, কিন্তু হৃদয়ের দাবি হতো উপেক্ষিত। পরিস্থিতি বোঝাতে একটা উদাহরণ দিই। আনিসুজ্জামান স্যার এই বইয়ের একটি চরিত্র। তাঁর মনের অনেক কথা, অনেক সংলাপ লিখতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে তাঁর লেখা আমার একাত্তর বইয়ের।

১৯৭১ সাল এত বড় একটা ব্যাপার যে লক্ষ পৃষ্ঠা লিখলেও এর পরিপূর্ণ অবয়বের একটা রেখাচিত্রও সম্পূর্ণভাবে দাঁড় করানো যাবে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি সাড়ে সাত কোটি গ্রন্থ রচনা করেন, তাহলেও বহু কথা।–বলাই থেকে যাবে। তারপরও বলব, নতুন প্রজন্মের সদস্যরা যদি রক্তে আঁকা ভোর পড়েন, তাহলে তারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপুল মহাসমুদ্রের বিশালতা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করতে পারবেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের একাত্তর পর্বের বিভিন্ন টুকরা-টাকরা অংশকে একত্র করার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। সবটা জোড়া দিলে একটা ছবি হয়তো দাঁড়িয়ে যায়।

আবারও বলছি, বইটি অন্য অনেক বই, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সংবাদ, প্রামাণ্যচিত্র থেকে সংগ্রহ করা ও বর্জন করা অসংখ্য টুকরো ছবির একটা সংযুক্তি। একজন সৃজনশীল লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা ইতিহাসের একটা পর্ব, যার প্রধান উপাদান মানুষ–ছোট-বড় অসংখ্য মানুষ, দেশি-বিদেশি নানা কুশীলব।

এই গ্রন্থ পাঠ করতে হবে উপন্যাস হিসেবে, ইতিহাস হিসেবে নয়। এই প্রয়াসের সার্থকতা-ব্যর্থতা নিরূপণের ভার ভবিষ্যতের হাতে তোলা রইল।

সবাইকে ধন্যবাদ।

আনিসুল হক
ঢাকা, আগস্ট ২০২১

আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি–ডি এল রায়ের গানের চরণ কেন মনে পড়ছে মুজিবের! তিনি কি মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছেন! মৃত্যুর গন্ধ, নাকি ভয়! ভয়ডর জিনিসটা তো টুঙ্গিপাড়ার বাইগার-মধুমতীতীরের মানুষটার দিলের মধ্যে আল্লাহ তাআলা দেননি। মৃত্যুর মতো সত্য পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। জন্ম অনিশ্চিত ব্যাপার, কিন্তু একবার জন্ম নিলে একটা পরিণতিই তারপর একেবারে নিশ্চিত, অনিবার্য, অপরিহার্য-তার নাম মৃত্যু। মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুকে বরণ করতে পারতে হবে হাসিমুখে! তবে মৃত্যুও কাম্য, সুন্দর, কাঙ্ক্ষিত, বরণীয় হয়ে উঠতে পারে, তা যদি বড় কোনো উদ্দেশ্যের জন্য, লক্ষ্যের জন্য হয়। আব্বার ভাষায় সিনসিয়ার এবং অনেস্ট পারপাজের জন্য হয়। তার জীবনে আর কোনো আফসোস নেই। কোনো খেদ নেই। ১৯৪৭ থেকে তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য–বাংলার স্বাধীনতা। সেই লক্ষ্য পূরণ এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। তাকে হত্যা করা হবে কি হবে না, এটা তিনি জানেন না। দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। তাকে হত্যা করা হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন। অথবা তাকে হত্যা করা হবে না, তাহলেও দেশ স্বাধীন। এই কথা গত ১৮টা ঘণ্টা ধরে তার বারবার মনে হয়েছে। কথাটা আজ সন্ধ্যার পর রেনুও বলেছেন, তিনিও উচ্চারণ করছেন।

দেশ স্বাধীন–কথাটা মনে হওয়ামাত্রই তাঁর মুখ একটা প্রশান্ত হাসিতে ভরে ওঠে। আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, মোর চোখ হাসে, মোর মুখ হাসে, মোর টগবগিয়ে খুন হাসে। এই সৃষ্টি স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। এই সৃষ্টি একটা নতুন দেশের সৃষ্টি। আজ সন্ধ্যার পর যখন তিনি নিশ্চিত হলেন, মিলিটারি আক্রমণ করতে আসছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পালিয়ে যাচ্ছেন, তখন থেকেই তিনি আপনমনে, পাগলের প্রায় হাসছিলেন। আই হ্যাভ গিভেন ইউ ফ্রিডম, নাউ গো, অ্যান্ড প্রিজারভ ইট। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা, কে জানে! ফায়ারিং স্কোয়াডে নেওয়া হতে পারে, ফাঁসিতে ঝোলানো হতে পারে। মৃত্যু যদি আসেই, হাসিমুখে বীরের মতোই বরণ করে নেবেন তিনি, কারণ তাঁর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তবে তিনি চান, তার মৃত্যু বাংলার মাটিতেই হোক। বাংলার মাটিতেই হোক তার শেষ আশ্রয়। বাংলা মায়ের কোলেই যেন তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান, অনন্তের ঘুম। ঘুমাতে পারেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতারা তাকে অভিধা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু, মানুষ তাকে এই নামে ডাকে, পত্রপত্রিকায় তাঁর নামের আগে বঙ্গবন্ধু লেখা হয়, মার্চের শুরু থেকেই ছাত্ররা তাঁকে ডাকতে শুরু করেছে জাতির পিতা বলে; তাঁর আব্বা এখনো তাকে ডাকেন খোকা নামে, মা-ও তাই; রেনুর কাছে তিনি হাছুর আব্বা, ছেলেমেয়েদের কাছে আব্বা; তাজউদ্দীন থেকে শুরু করে তরুণতর ছাত্রনেতা–রাজ্জাক, সিরাজ, তোফায়েল, শাহ মোয়াজ্জেমদের কাছে মুজিব ভাই, বহু মানুষের কাছে শেখ সাহেব। কিন্তু নিজের কাছে কী তিনি?

বন্দুক, কামান, ট্যাংকের গর্জন, গুলি-বোমার অস্তিত্ব চুরমার করা আওয়াজ, শ্রুতিকে বধির করা হুংকার, একটু আগে রাসেলকে ফিডারে দুধ খাওয়ানোর ফলে হাতে লেগে থাকা দুধের গন্ধ, সেই গন্ধের সঙ্গে মেশা বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, ঘরপোড়া ছাইয়ের গন্ধ–এই সবকিছুর মধ্যে তিনি বসে আছেন মিলিটারি ট্রাকে, যাচ্ছেন অচেনা ব্যক্তিগত গন্তব্যে, আর বাংলার সুনিশ্চিত স্বাধীনতার অনিবার্য গন্তব্যের অনিশ্চিত পথরেখা ধরে। তার মনের মধ্যে অকারণেই এই প্রশ্ন জাগে, নিজের কাছে তিনি কী! এর জবাবে একটুখানি হাসির প্রভা তাঁর উদ্বিগ্ন-ক্লান্ত মুখটাকে প্রসন্ন করে তোলে : কিছুই তো করতে পারলাম না, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছিমাত্র। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, নীতি ও আদর্শের জন্য, তিনি একজন সামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী মাত্র!

বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়, যদি কেন, স্বাধীন তো হয়েই গেছে, তার মুখের হাসি উজ্জ্বলতর হয়–লক্ষকোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা হিমালয় থেকে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, মধুমতী বয়ে পলি পড়ে পড়ে গড়ে উঠেছে যে বদ্বীপ, যে বদ্বীপের মানুষেরা চিরটাকাল কেবল শোষিত হয়েই এসেছে, অথচ একদিন যা ছিল সোনার বাংলা, মধুকর ডিঙা নিয়ে লখিন্দরেরা যে বাংলার নদী-সমুদ্র বেয়ে বাণিজ্যতরি নিয়ে ভাসানে যেত, মসলিনে, মসলায়, ধানে, শস্যে যে বাংলা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী এলাকা, বিদেশি শোষণে-শাসনে যে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণতপ্রায়, সেই বাংলার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হবে স্বাধীনতা। বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে, বাংলার মানুষ মুক্তি পাবে–হয়তো তিনিই তখন থাকবেন না। তাঁকে যদি হত্যা করা হয়, তাঁকে যেন বাংলার মাটিতে অনন্তশয্যায় শায়িত রাখা হয়। আমার এই মাটিতে জন্ম যেন এই মাটিতে মরি…

বিপরীত দিকে বেঞ্চিতে বসা একজন সৈনিক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোত্থেকে আসা একটা চকিত আলোর ঝলকানিতে তিনি দেখতে পান। সৈনিকটির হেলমেট-ছায়াচ্ছন্ন মুখ। সম্ভবত মুজিবের মুখে হাসি দেখে সে। বিস্মিত। একা একা হাসছে একটা লোক। তা-ও মিলিটারি ট্রাকে সশস্ত্র। শত্রুসৈন্যদের মাঝখানে বসে থেকে, ব্যাপারটা কী! সৈন্যটি কি তাকে পাগল ঠাওরাচ্ছে!

তার দুই পাশে খাকি পোশাক পরা অস্ত্রধারী সৈনিক। বিপরীত দিকেও বেঞ্চিতে সৈন্যরা বসা। এই ট্রাকের সামনের দিকে একটা ভারী অস্ত্র বসিয়ে সদা প্রস্তুত আরেকটা সৈনিক। ওই অস্ত্রটা কী? এলএমজি? রকেট লঞ্চার? শেখ মুজিব তা জানেন না। তার ৫১ বছরের জীবনে কোনো দিন তিনি। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেননি। গোলাবারুদ, বন্দুক, কামান তার অস্ত্র নয়। তার অস্ত্র ন্যায্যতা। তার অস্ত্র মানুষের ঐক্য। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।

মাঝেমধ্যেই গোলাগুলির শব্দ কানে আসছে। সামরিক কনভয় চলার ভটভট শব্দ ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসছে জনতার চিৎকার। স্লোগান। তাকে বহনকারী গাড়ির সামনে আরেকটা ট্রাক, পেছনে আরেকটা। হেডলাইট নেভানো। শেখ মুজিব পকেট হাতড়ে লাইটার বের করলেন। ব্যথা অনুভব করলেন ডান হাতে। তার বডিগার্ড মহিউদ্দিনের সঙ্গে সৈন্যদের ধস্তাধস্তির সময় মুজিব এগিয়ে গিয়েছিলেন মহিউদ্দিনকে বাঁচাতে। সৈনিকদের একজনের একটা আঘাত তাঁর ডান কাঁধে লেগেছিল। তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, তখন সৈন্যরা ছিল ঠিক তার পেছনে। তারা তাদের অস্ত্রের বাট দিয়ে তার পেছনে আঘাত করছিল। সে সময় টের পাননি, এখন পাইপে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, বুড়ো আঙুলে জোর পাচ্ছেন না। তিনি বাঁ হাতে লাইটারটা নিলেন। একজন মেজর বলল, নো লাইট স্যার। নো ফায়ার।

শেখ মুজিব তাদের মনোভাবটা আঁচ করার চেষ্টা করছেন। তারা আলো ভয় পায়। বাংলার মানুষ যদি টের পায় যে এই গাড়িতে তাদের নেতা শেখ মুজিব আছেন, তারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসবে। তারা মরবে, তবু শেখ মুজিবকে নিয়ে যেতে দেবে না।

শেখ মুজিব তাঁর কাজ করেছেন। তিনি তাঁর ওয়্যারলেস বার্তা পৌঁছে। দিতে পেরেছেন। হয়তো এই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। হাজি মোরশেদের কাছে ফোনকল এসেছিল। বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক তাঁর কাজ করেছেন। আশা করা যায়, ওয়্যারলেস যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করেছে। বার্তা প্রচারের পর তারা জানতে চেয়েছে যন্ত্র কী করব? তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যন্ত্র ধ্বংস করে পালিয়ে যেতে।

সেনাবাহিনীর এই ট্রাকটা ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তার বা পাশে বসা সৈনিকটির মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ভাবভঙ্গি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে মুজিবের পাশে সে ঠিকঠাকমতো বসতে পারছে না। সংকোচ বোধ করছে। গাড়ির গতি ধীর। তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় এরা?

মুজিবের মনে হলো, এরা তাঁকে হত্যা করবে না। তার কাছে খবর ছিল, তিনি যদি পালানোর চেষ্টা করেন, তবে সেই গাড়িতে বোমা মারা হবে। গাড়িতে পলায়নরত অবস্থায় মরে পড়ে থাকবেন, এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি ভেবেছেন, মারলে তাকে বাড়িতেই মারুক। প্রথম দফাতে যখন মারেনি, তখন তাকে আপাতত এরা হয়তো খুন করবে না। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মতো পেছন থেকে গুলি করে মারতে পারে কি?

আপাতত নিজের জীবন নিয়ে তিনি ভাবিত নন। নিজের জীবন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি কমই ভেবেছেন জীবনে। এত গোলাগুলির আওয়াজ আসছে! কত মানুষই না মারা পড়ছে! বহু মানুষ রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। তাদের কি নির্বিচার গুলি করা হচ্ছে?

এত শব্দ কেন? এত গর্জন কেন? এত আগুন কেন? এত বোমা-বারুদ ট্যাংক। বাংলাদেশের মানুষ তো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। এবার নেবে। বাঙালি পুলিশ, বাঙালি আনসারের হাতে অস্ত্র ও গোলা বিকেলের মধ্যেই তুলে দেওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়ে রেখেছেন। বাঙালি ইপিআরও প্রস্তুত। বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করতে চায়, এই খবর তাঁর কাছে অনেকবার এসেছে। আর যদি একটা গুলি চলে…যদি বাংলার মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। নির্দেশ পরিষ্কার। ১৪ মার্চ ৩৫টি নির্দেশনা লিখিতভাবে জারি করা হয়েছিল, তাতে তো লিখিতভাবেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের শাসনভার হাতে তুলে নেওয়া হলো। বলা হয়েছিল, আই অ্যাপিল টু দ্য পিপল টু রিমেইন রেডি ফর অ্যানি স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড শুড ফোর্স বি আনলিশড অ্যাগেইনস্ট দেম, টু রেজিস্ট ইট বাই অলমিনস। যদি হামলা হয়, সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করতে হবে।

রেনু এখন কী করছে? রাসেল কি ফিডারের দুধ শেষ করতে পেরেছিল? হাসিনা, রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া অন্য বাড়িতে। ওরা কি নিরাপদে আছে? কামাল কি এখনো রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে? যে হারে গুলি হচ্ছে, কামাল বেঁচে থাকবে কি না সন্দেহ!

এরা কি ভেবেছে? গুলি করে আমার মানুষদের স্তব্ধ করে দেবে? এটা হয়? আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না।

গাড়ি নির্মীয়মাণ পার্লামেন্ট হাউসের সামনে এসেছে সম্ভবত। ক্যানভাসের ছাউনির নিচে দুই সৈনিকের মধ্যখানের ফোকর দিয়ে বাইরের গাছপালা ঘরবাড়ি দেখে তিনি তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন। ট্রাকের সামনে পেছনে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, লুই কানের নকশা করা পার্লামেন্ট ভবনের সামনেই তারা এখন অবস্থান করছেন।

ফার্মগেটের দিক থেকে স্লোগান শোনা যেতে লাগল উচ্চ স্বরে। আর মানুষের দৌড়ের আওয়াজ। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের নেতৃত্ব দেওয়া লে. কর্নেল জেড এ খান প্রমাদ গুনলেন। জনতা নিশ্চয়ই শেখ মুজিবকে উদ্ধার করতে আসছে। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, হাতিয়ার তোলো। ফায়ার করার জন্য প্রস্তুত হও।

দূর থেকেই ভেসে এল গুলির শব্দ। পায়ের আওয়াজ। জনতা পালাচ্ছে। একটু পরে জেড এ খান জানতে পারলেন, জনতা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছিল। কামান, এলএমজি, রকেট লঞ্চারের তোপের মুখে পড়িমরি পালিয়েছে। পালানোর আগে মরেছে, দৌড়ে পালাতে পালাতে পড়ে গেছে।

গাড়িবহর ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেল না। নির্মাণাধীন অ্যাসেম্বলি ভবনের সামনে দাঁড়াল। সৈন্যরা এক সারি আগে নামল। তারপর শেখ মুজিবকে। বলল, আপনাকেও নামতে হবে। মুজিব ট্রাক থেকে নামলেন। সিঁড়ির ওপরে পা রাখলেন।

সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন তাঁরা। অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না এই সিঁড়িগুলো এতটা ওপরে উঠে গেছে। একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে ভবনের বাইরে জনচক্ষুর আড়ালে একটা জায়গা বাছাই করে থামলেন তাঁরা।

জিপ থেকে খুলে নিয়ে আসা একটা গদি পেতে সিঁড়িতেই তাকে বসতে দেওয়া হলো। খোলা আকাশের নিচে তারা। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। চৈত্রের আকাশে অনেক তারা। এক কোণে মেঘ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই। বসন্তের বাতাস বইছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ নয়, বারুদ, আগুন, ছাই, রক্তের গন্ধ। তা সত্ত্বেও ঘর্মাক্ত শরীরে এই দখিনা বাতাস যেন মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিতে চাইছে।

আকাশে ট্রেসার বুলেট জ্বলছে। কালো আকাশ বিদ্যুৎ-চমকিত হয়ে পুড়ে যাচ্ছে। বোমা বিস্ফোরণের শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে কাক উড়তে শুরু করেছে আকাশে। হঠাৎ সেই আকাশে তিনি দেখতে পেলেন যেন আব্বার জ্যোতির্ময় মুখ। শেখ লুত্যর রহমান যেন তাকে বললেন, অনেস্টি অব দ্য পারপাজ আর সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ তোমার আছে। তুমি বিজয়ী হবে। বাংলার মানুষ বিজয়ী হবে।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছের ডালে বসে থাকতে পারে না। চারদিকে আগুন, চারদিকে গুলির শব্দ, চারদিকে মানুষের আর্তনাদ, মানুষের পালানোর পায়ের শব্দ। ট্যাংকের ঘর্ঘর আওয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস লক্ষ করে কামান দাগা হচ্ছে। শিক্ষকদের কোয়ার্টারে গিয়ে নাম ধরে ধরে শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে ব্রাশফায়ার করা হচ্ছে। জগন্নাথ হল থেকে ছাত্রদের ধরে এনে মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে চালানো হচ্ছে গুলি। জ্বলছে বস্তিগুলো। জ্বলছে ঘরবাড়ি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশেরা ট্যাংক, কামান, রিকোয়েললেস রাইফেল, এলএমজির গোলাগুলির বিরুদ্ধে তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে। আমৃত্যু মরিয়া প্রতিবাদ। জ্বলছে পিলখানা। লাশ আর লাশ। আগুন আর আগুন। গোলা আর বারুদ। নরকের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলায়। আক্রমণ চলছে বাঙালি পুলিশদের ওপর। থানায় টেবিলের ওপারে ডিউটিতে বসে থাকা পুলিশ আকস্মিক আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকছে টেবিলের ওপরেই, বহু জায়গায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈনিক এবং তাদের পরিবার-পরিজন নারী-শিশুদের ওপরে চালানো হচ্ছে গুলি, বিছানা বালিশের ওপরে পড়ে থাকছে রক্তাক্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধের লাশ।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ত্রিকালদর্শী। কিন্তু জাহান্নামের আগুনকে হার মানানো এই পরিস্থিতিতে তারাও স্তম্ভিত। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে তারা। আশ্রয় নেয় রামপুরা বিল পেরিয়ে এক হিজলগাছের ডালে। বিলের একধারে বস্তির আগুনে আকাশ লাল হয়ে আছে। আর তারই আভায় নিচে পানিতে দেখা যাচ্ছে লাশ আর রক্তের স্রোত। সেখানেই-বা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি থাকে কী করে? তারা বলে, চলো আবার যাই বটগাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছে। বটগাছটার মায়া তারা ছাড়তে পারে না।

ব্যাঙ্গমা বলে, বঙ্গবন্ধুরে গাড়িতে তুইলা মেজর জেড এ খানের মনে। পইড়া যায়, তারে হুকুম দেওয়া হইছে শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করার। কিন্তু ধরার পর কই লইয়া যাইতে হইব, এইটা তো কওয়া হয় নাই।

ব্যাঙ্গমি বলে, ৩২ নম্বরে গোলাগুলি, বোমাবাজি কইরা শেখ মুজিবরে পাইয়াই তারা ওয়্যারলেসে জানায় দিছিল, বড় পাখিটারে পাওয়া গেছে।

ব্যাঙ্গমা বলে, লে. কর্নেল জেড এ খান শেখ সাহেবরে অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে বসায়া রাইখা গেলেন ক্যান্টনমেন্টে। লে. জেনারেল টিক্কা খানের লগে দেখা করলেন। টিক্কা খান বহুত খুশদিল। শেখ মুজিবরে ধরা হইছে, সারা ঢাকা জ্বালায়া দেওয়া হইতেছে। বহুত খুব। শেখ মুজিবের ওয়্যারলেস বার্তা রেডিওতে ধরা পড়ছে, টিক্কা খানের সহকারী একটা রেডিও নিয়া ছুঁইটা আইছিল, স্যার স্যার শোনেন, শেখ মুজিব ওয়্যারলেসে মেসেজ দিতাছে। রেডিওতে ধরা পড়ছে। এইবার ব্যাটা নিজেই ধরা পড়ছে। মুজিবরে ধইরাই মেজর ওয়্যারলেসে জানান দিছে, বিগ বার্ড ইজ ইন দ্য কেজ।

জেড এ খান বুট টুইকা স্যালুট মারলেন। মনে মনে কইলেন, আমি হালায় গোলাগুলির মধ্যে অ্যাকশন কইরা আইলাম, আর আপনে আরাম কইরা চেয়ারে বইসা গুনগুন কইরা গান গাইতাছেন। দেই আপনের শান্তি নষ্ট কইরা।

টিক্কা খান জিগায়, শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করছ?

আমি তো ঠিক শিওর না। একটা লোকরে আনছি। দেখতে মজিবরের মতন। কিন্তু মজিবরই কি না কেমনে কই? বাঙালিরা বিচ্ছু জাত, মজিবরের মতো দেখতে বসায়া রাইখা মজিবররে সরায়া রাখতে পারে।

টিক্কা খান সিট থাইকা ছিটকায়া পড়ল।

.

টিক্কা খান পাঠালেন কর্নেল এস ডি আহমদকে। যাও, দেখে এসো, ঠিকঠাক লোককে ধরা হয়েছে কি না।

এস ডি আহমেদ গেলেন অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে। চারদিকে সশস্ত্র পাহারা। তার মধ্যে জিপের সবুজ সিটে বসা দীর্ঘাঙ্গী একজন মানুষ। তার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পায়জামা। মুখে জ্বলন্ত পাইপ।

দেখামাত্রই এস ডি আহমেদ চিনে ফেললেন শেখ মুজিবকে।

তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, স্যার। আপনার এখানে তো আসার কথা প্রধানমন্ত্রী হয়ে। অথচ আপনাকে আনা হলো কয়েদি হিসেবে।

মুজিব বললেন, আমার জীবনে এটা তো নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে জিপের গদিতে বসা একটা নতুন ঘটনা!

কর্নেল বললেন, আপনি কি চা খেতে চান? আমি ব্যবস্থা করতে পারি।

মুজিব হাসলেন। বললেন, চমৎকার হবে। চা দেন। আমার জীবনে চা খাবার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি। ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল। দিস ইজ দ্য বেস্ট টাইম অব মাই লাইফ টু হ্যাভ টি।

কর্নেল এস ডি আহমেদ ফিরে গেলেন জেনারেল টিক্কা খানের কাছে। ঠিক লোককেই ধরা হয়েছে।

মেজর জেড এ খান বললেন, স্যার, তাহলে শেখ সাহেবকে আমরা কোথায় রাখব?

টিক্কা খান পিঠ চুলকানোর জন্য তাঁর বেতের লাঠিটা হাতে ধরলেন। বেকায়দা জায়গায় চুলকাচ্ছে। তাই তো। সব ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হবে, সেটা তো ঠিক করা হয়নি।

কর্নেল এস ডি খান বললেন, স্যার। অফিসার্স মেসে রাখলে কী হয়? আগরতলা মামলায় তো সেখানেই রাখা হয়েছিল।

বহুত খুব।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা হলো সেই মেসে। একটা রাত রাখা হলো তাঁকে সেখানে।

ভোররাতে টিক্কা খান হাঁক পাড়লেন, এই কে আছিস? কর্নেল এস ডি খানকে বোলাও। আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে সেই পুরোনো মেসে মুজিবকে রাখা হয়েছে। জনতা যদি টের পায় মুজিব এখানে, হাজারে হাজারে আসবে, লাখে লাখে আসবে। ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তাদের নেতাকে। সরাও তাঁকে।

সকাল সকাল শেখ মুজিবকে তারা সরিয়ে নিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আদমজী স্কুলে।

হেডমাস্টারের রুমে আনা হলো তাকে। রুমে একটা ইজিচেয়ার আছে। বড় টেবিল আছে। সামনে বসার জন্য অনেকগুলো হাতলওয়ালা চেয়ার আছে। কিন্তু কোনো বিছানা-বালিশ নেই। বাথরুম নেই।

অফিসার বললেন, স্যার, আপনি এই ইজিচেয়ারে আরাম করুন। আমরা বিছানা-বালিশের ব্যবস্থা করছি।

মুজিব বললেন, আরাম করব?

ইয়েস স্যার।

মুজিব বললেন, শোনেন অফিসার। আপনি হুকুমের চাকর। আপনাকে আমি কিছু বলব না। শুধু একটা কথা আমি বলি। এই জীবনে অত্যাচার আমি। অনেক সহ্য করেছি। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে জুলুম করছেন। কিন্তু আমি অপমান সইতে পারি না। আপনারা বাঙালিদের শুধু জুলুম করেন নাই, অপমানও করেছেন। এর শাস্তি আপনারা পাবেন। সমস্ত বাংলাদেশ কামান, ট্যাংক, বন্দুকের বোমা, গোলা, আগুনে ধ্বংস করে দিয়ে আপনি বলছেন আমাকে ইজিচেয়ারে আরাম করতে। আপনি যদি আমার সামনে থেকে সরে যান, কেবল তাহলেই আমি আরাম পেতে পারি। বুঝেছেন?

ইয়েস স্যার। স্যালুট দিয়ে অফিসার রুম থেকে বিদায় নিলেন। বাথরুম এই রুমের বাইরে, টানা বারান্দার মাথায়। শেখ মুজিব রুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে যাচ্ছেন। হঠাই চিৎকার, মামা গো!

একটা ঘর থেকে এই নারীকন্ঠের চিৎকার আসছে। ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে শেখ মুজিব দেখতে পেলেন, আম্বিয়ার মা ও মামা গো বলে গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করছে। ভেতরে আরও আছে রমা, ফরিদ, নিয়াজ, আজিজ মিয়া–তাঁর বাড়ির কাজের লোকেরা। মুজিব রেগে গেলেন। সেন্ট্রিদের বললেন, এই, তোমাদের অফিসার কে আছে, ডাকো তো এক্ষুনি।

অফিসার এলেন। মুজিব রাগতস্বরে ইংরেজিতে বললেন, আমাকে এনেছ এনেছ। তোমরা আমার বাড়ির কাজের লোকদের কেন এনেছ? এই বুড়িকে আনার মানে কী? এক্ষুনি এদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।

২৮ মার্চ একটা ট্রাকে করে বাড়ির গৃহকর্মীদের তুলে নিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়। মিরপুর রোডে, আইয়ুব গেটের কাছে।

ব্যাঙ্গমা বলে, বিবিসি লন্ডন ২৬ মার্চ রাত দশটায় এই খবর প্রচার করে।

ব্যাঙ্গমি বলে, খবরটা ইংরেজি। তুমি বাংলা কইরা শোনাও। ব্যাঙ্গমা বাংলায় বিবিসির ২৬ মার্চের খবর শোনায় :

বিবিসি লন্ডন। ২৬ মার্চ ১৯৭১। এ.৪৩। ২২.০০ পাকিস্তান-ওয়ান।

ইয়াহিয়া খান তাঁর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পর এবং ভারত থেকে পাওয়া খবর অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল বলেন, বিদ্রোহ দমনের জন্য ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত থেকে পাওয়া আগের খবর হলো, একটা গুপ্ত বেতার থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।

আমি ভেতরে, তাজউদ্দীন বাইরে-মুজিব ভাইয়ের বহু বছর আগে বলা। কথাটা হঠাৎই তার কানে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব বড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, ১১ মার্চ হরতালে পিকেটিং করছিলেন, জিপ নিয়ে পুলিশ তাকে ধাওয়া করছিল, আর তিনিও সাইকেলে চড়ে রাস্তার এক মোড়ের সমাবেশ থেকে আরেক সমাবেশে যাচ্ছিলেন, জিপিওর সামনে থেকে গেলেন ইডেন বিল্ডিংয়ে, তোপখানা রোডের সচিবালয়ের সামনে, মুজিব ভাইকে পুলিশ এখনই গ্রেপ্তার করবে, মুজিব ভাই ইঙ্গিত করলেন, তাজউদ্দীন, তুমি গ্রেপ্তার এড়াও। আমি ভেতরে, তুমি বাইরে। তাজউদ্দীন খবরের কাগজের রিপোর্টার সেজে পকেট থেকে নোটবই বের করে নোট করতে লাগলেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার না করে মুজিব ভাই এবং অন্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে গেল।

কাঠের চৌকিতে একটা চাদর পেতে শুয়ে আছেন তাজউদ্দীন। পাশে আমীর-উল ইসলাম। আমীর ডান কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন শব্দ না করে। কিন্তু দুর্বল চৌকি কাঁচ কাঁচ করে আর্তনাদ করল।

ঘুম তো কিছুতেই আসে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় কে ঘুমাতে পেরেছে?

রাতে বাড়ি থেকে লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি পরে নিয়ে একটা রাইফেল, একটা রিভলবার, একটা কাঁধে ঝোলানো থলে নিয়ে বেরিয়েছেন তাজউদ্দীন। আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে কামাল হোসেনও ছিলেন। কামাল হোসেন ধানমন্ডির ১৩ নম্বর সড়কে তার এক আত্মীয়ের বাড়ির গেটে নেমে গেছেন। তাজউদ্দীন আর আমীর-উল এগিয়ে যাচ্ছেন, উত্তরের দিকে, ইচ্ছা আছে, কোনোরকমে পশ্চিমের নদীর ধারে চলে যাওয়া। আলপথ ধরে জলাজঙ্গল পেরিয়ে একটা নৌকা যদি রাতের অন্ধকারে জোগাড় করে ফেলা যায়, তাহলে হয়তো আপাতত গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু উত্তর দিক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে মিলিটারি কনভয়। গাড়ি ডানে ঘুরিয়ে ফেলে তারা ঢুকে পড়লেন লালমাটিয়ার মধ্যে।

আমীর-উল চালককে বললেন, গফুর সাহেবের বাড়ির সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ভেগে যাও।

রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ির পাশের বাড়িটাই লালমাটিয়ার সংগ্রাম পরিষদের বাড়ি। ছেলেরা তখনো ওই বাড়িতে ভিড় করে আছে। তাজউদ্দীন ছেলেদের ডাকলেন। বললেন, এই বাড়ির বাতি নিভিয়ে দাও। পতাকা নামিয়ে ফেলো। তোমরা এখনই নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। সরে থাকো। গ্রেপ্তার এড়াও। যাও।

ছেলেরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথা শুনল। তারা পতাকা নামাল। বাতি নিভিয়ে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করল। ততক্ষণে গুলির শব্দ, বোমার শব্দ কানে আসতে শুরু করেছে।

.

ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে তাজউদ্দীন বেল টিপলেন। মনে মনে তারা আল্লাহকে ডাকছেন যেন গফুর সাহেব বাড়ি থাকেন। দরজা খুলে গেল। তাজউদ্দীন বললেন, গফুর সাহেব, আপনার বাড়িতে মেহমান এসে গেছে। তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলুন।

আসেন আসেন। বাড়িতে কোনো মহিলা নাই। আমরা দুই চাচা ভাতিজা। আরও দুইজন পুরুষ মানুষ আরামে থাকতে পারবেন। তবে অসুবিধা হলো কোনোরকমে একটা চৌকি আছে। আপনাদের ওই চৌকিতেই থাকতে হবে। ফার্নিচার কেনার সময়-সুযোগ-মন কোনোটাই অসহযোগের মধ্যে ছিল না।

তাজউদ্দীন বললেন, এর মধ্যে আর খাট আর চৌকি। একটা আশ্রয় পেলেই হলো।

আবদুল গফুর সাহেব দরজা বন্ধ করে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বললেন, এত গোলাগুলি। কী পরিস্থিতি, তাজউদ্দীন সাহেব?

তাজউদ্দীন বললেন, পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাক করেছে। মুজিব ভাই চট্টগ্রামে মেসেজ পাঠিয়েছেন রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলার জন্য। দেশের অন্য। জায়গাগুলোতে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা মেসেজ করেছেন। ইনডিপেনডেনস হ্যাঁজ বিন ডিক্লেয়ারড। তবে আমি তার হাঁটু ধরে বলেছি, সরে যান। বাড়ি ছাড়েন। তিনি আমাদের চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু নিজে কোথাও যাবেন না। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। আল্লাহ জানে তার কী অবস্থা হবে!

চৌকিতে বসেছেন তাজউদ্দীন আর আমীর।

বাইরে প্রচণ্ড শব্দ হলো, এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলো, মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পড়ছে মাথার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চৌকির চার পা আত্মসমর্পণ করল, আর চৌকিটা বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ল নিচে। আমীর ও তাজউদ্দীন চৌকি থেকে ছিটকে পড়লেন। চারদিক থেকে একযোগে গুলির শব্দ আসছে। গুলির শব্দ, গোলার শব্দ, ট্যাংকের চাকার ঘর্ঘর আওয়াজ আসছে পুবে ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে, দক্ষিণে পিলখানার দিক থেকে, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিক থেকে, আরও কোন কোন দিক থেকে, কীভাবে হিসাব মেলাবেন তাজউদ্দীন! তাঁরা বাড়ির ছাদে উঠলেন। অমাবস্যার অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আকাশে ফাটছে ট্রেসার বুলেট, আগুনে আলোয় বিজুলিতে, শব্দে, গর্জনে, আর্তনাদে কিয়ামত নেমে এসেছে ঢাকায়। ওই ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বুঝি কামান-ট্যাংকের গোলায় মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরান ঢাকা বোধ হচ্ছে গোটাটাই পুড়ছে। আকাশ গনগনে লাল। কোথাও কোথাও থেকে জনতার স্লোগান আসছে, জয় বাংলা। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প এলাকা থেকে শোনা যাচ্ছে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি। তারপর সব স্লোগান থেমে গেল। রইল শুধু থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। গোলার আওয়াজ। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির শব্দ। ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার এই বাড়ির অদূরে। আর্মি সেখানে ক্যাম্প করছে, অন্ধকারের মধ্যেও তা বোঝা যাচ্ছে।

২৬ মার্চ সকাল হলো। তাজউদ্দীন একটা জানালার পাল্লা একটুখানি খুলে দিলেন, অমনি ঘরপোড়া ছাইয়ের পাশুটে গন্ধ তার নাকে এসে লাগল। তিনি আবার জানালা বন্ধ করে দিলেন। আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, একটা কাজ করি। দাড়ি কেটে আসি। তাজউদ্দীন ভালো করে শুনলেন সেই কথা। মানুষের জীবনে এমন সময় আসে, যখন একমুহূর্তে এক লক্ষ ভাবনা মস্তিষ্কের কোষে হানা দিতে পারে! মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন, থাকলে কোথায় আছেন? লিলি, রিমি, রিপি, মিমি কেমন আছে? ঢাকাবাসীর কতজন বেঁচে আছে? কতজন মারা গেছে? কতজন গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখনো কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়?

আমীর-উল বাথরুম থেকে বেরোলেন। তার গাল-চিবুক নিকোনো উঠোনের মতো পরিষ্কার। তাঁকে চেনাই যাচ্ছে না। তাজউদ্দীন বললেন, একেবারে নতুন একজন মানুষকে দেখছি। আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।

ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আর্মি ক্যাম্পে ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। এই বাড়িটা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে।

গফুর সাহেব উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে এই ঘরে ঢুকলেন। তার গেঞ্জির গলাটা অকারণে বড়, লুঙ্গির অনেকটাই ঝুলন্ত গেঞ্জি ঢেকে রেখেছে। তার হাতে একটা গামলা। গামলায় কিছু মুড়ি। বললেন, শুকনা মুড়ি গলা দিয়ে ঢুকবে না। মুড়ি ভিজায়ে আনি। গুড় আছে। গুড় দিয়ে মেখে খাই।

.

আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, আমাকে তো আর চেনা যাচ্ছে না। আমার নাম আজ থেকে রহমত আলী। আমি পাবনা থাকি। গফুর সাহেবের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।

তাজউদ্দীন বললেন, আমার নাম মোহাম্মদ আলী। গফুর ভাই, আপনি কন্ট্রাক্টর। আমি আপনার ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনা করি।

পানিতে ভেজানো মুড়ি এসে গেল। কিন্তু তাজউদ্দীনের গলা দিয়ে সেই মুড়িও নামতে চাইছে না।

রেডিওতে ঘোষণা শোনা গেল–কারফিউ। দিনের বেলাতেও থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আসছে। রোদে পোড়া একটা অসহ্য অকথ্য দিন পেরিয়ে গেল। রাতের বেলা রেডিওর পাশে বসে আছেন চারজন শ্রোতা। থ্রিব্যান্ড রেডিও। রেডিও অস্ট্রেলিয়া, বিবিসি, আকাশবাণী জানাল, পাকিস্তানি মিলিটারি ট্যাংক কামান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপরে হিংস্র শ্বাপদের মতো আক্রমণ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। কী করা উচিত, কী করা কর্তব্য–তিনি ভাবছেন। তার মনে পড়ছে, মুজিব ভাই তাকে এবং কজন ছাত্রনেতাকে ডেকে ১৮ জানুয়ারি কলকাতার একটা ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, মণি, রাজ্জাক, তোফায়েল ছিলেন। ছাত্রনেতাদের বলেছিলেন, আমার অবর্তমানে তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবা। কলকাতার ঠিকানাটা মুখস্থ আছে তো! ২৬ রাজেন্দ্র প্রসাদ রোড, ভবানীপুর, কলকাতা। চিত্তরঞ্জন সুতার হলো কন্ট্যাক্ট পারসন। তাঁর কাছে যাবা।

.

এই বাড়ি থেকে লালমাটিয়ার পানির ট্যাংক দেখা যাচ্ছে। মিলিটারির লোকজন এগিয়ে গেল পানির ট্যাংকের কাছে। তারা দারোয়ানকে বেদম প্রহার করছে। দারোয়ান চাবি নিয়ে পানি ছাড়তে গেল। সব দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট। সব বোঝা যাচ্ছে। এই বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। তারা পর্দা টেনে দরজা-জানালা বন্ধ করে রইলেন।

রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনতে হলো। রেডিওর ঘর্ঘর শব্দের সঙ্গে ইয়াহিয়া মদ-ভারী কণ্ঠে বলছেন :

মাই ডিয়ার কান্ট্রিমেন,

আসোলামু আলাইকুম…

শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করা হলো। আসলে আরও কয়েক সপ্তাহ আগেই শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। শেখ মুজিব এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তিনি দেশের ঐক্য ও সংহতিকে আক্রমণ করেছেন। এ অপরাধের শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। হিজ ক্রাইম উইল নট গো আনপানিশড।

উই উইল নট অ্যালাউ সাম পাওয়ার-হাঙ্গরি অ্যান্ড আনপ্যাট্রিয়াটিক পিপল টু ডেস্ট্রয় দিস কান্ট্রি অ্যান্ড প্লে উইথ দ্য ডেসটিনি অব ১২০ মিলিয়ন পিপল।

পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।

পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছে।

.

প্রচণ্ড গরম। একটা জানালা একটু খুলে দিলে হয়। গফুর সাহেব জানালা খুললেন। বাতাসের ঝাঁপটা এসে জানালার পর্দা দোলাতে লাগল। ছাইগন্ধ, বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধের মধ্যেও তাজউদ্দীনের ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে এসে ধরা পড়ল আমের মুকুলের গন্ধ। মুজিব ভাইয়ের প্রিয় গান আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসিতে একটা লাইন আছে, ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে…পাক সার জমিন সাদ বাদ নিভন্ত দীপের মতো ম্লান হয়ে এল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসির সুর আচ্ছন্ন করে ফেলল তাজউদ্দীনের সমস্ত ইন্দ্রিয়।

সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না হাসিনা। শরীরের ভেতরে সন্তানের নড়াচড়া টের পাচ্ছিলেন। শরীরটা তত ভালো নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সমস্তটা মন। আচ্ছন্ন করে রেখেছে ভয়, শঙ্কা, দুশ্চিন্তা। রাতভরে আকাশ যেন জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। গোলাগুলি, চিৎকারের শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। গুলির ছররা এসে লাগছে বাড়ির দেয়ালে। মেঝেতে তোশক পেতে শুয়ে ছিলেন তাঁরা। শেখ হাসিনা, রেহানা, আর ওয়াজেদ মিয়া, রেহানাদের খালাতো বোন শেখ ফরিদা ওরফে জেলি। আরও আছে ৩২ নম্বরের বাড়ির পুরোনো পরিচারক ওয়াহিদার রহমান পাগলা। তারা ঘুমাতে পারেননি কেউ। আল্লাহকে ডেকেছেন। সাতমসজিদ রোডের ওপরে ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের ভাড়া বাসা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়াজেদ মিয়া এই বাসাটা ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরই নির্দেশে ২৫ মার্চ রাতে তাঁরা এসে উঠেছেন আসবাববিহীন এই বাড়িতে। অদূরেই ইপিআর সদর, পিলখানা। গোলাগুলির অন্ত ছিল না। সকালের দিকে গোলাগুলির শব্দ কমে এল। মাইকে শোনা যেতে লাগল অবাঙালি কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা বাংলার ঘোষণা :

সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হইয়াছে। কেহ ঘরের বাহিরে আসিবেন না। বাহিরে কাহাকে দেখা গেলে দেখামাত্র গুলি করা হইবে। যাহাদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাইবে, তাহাদিগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা লওয়া হইবে।

ভোর হলো। আজান শোনা গেল না। পাখিরা ডাকল না। শুধু মাইকে এই ঘোষণা। সকাল হলো।

রেহানা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। জানালায় পর্দা নেই। তিনি বললেন, আমাদের বাসার দিক থেকে গুলির শব্দ এসেছিল। আব্বা-মা না জানি কেমন আছে? কেমন আছে রাসেল? কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। কান্না এসে কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে।

জেলি বললেন, হাসুবুর জন্য যত চিন্তা। ওনার তো খাওয়া দরকার।

রেহানা বললেন, দুলাভাই, আপার তো খাওয়া দরকার। কী ব্যবস্থা করা যায়? আব্বা আমাকে সকালে বাসায় যেতে বলেছেন। আমি দেখি যাওয়া যায় কি না।

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, রেহানা, পাগলের মতো কথা বলিস না। ওরা বলছে দেখামাত্রই গুলি। আর তুই কিনা কারফিউয়ের মধ্যে বাইরে যেতে চাস! চুপচাপ বসে থাক। পাগলা, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কী করা যায়?

পাগলা বলল, চাউল আছে। ডাল আছে। খিচুড়ি পাক করা যায়। এই বাড়িতে কি চুলা আছে?

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, কেরাসিনের স্টোভ তো আছে একটা।

পাগলা খিচুড়ি বসাতে গেল। জেলি এগিয়ে গেলেন তাকে সাহায্য করতে। হাসিনাও উঠে একবার গেলেন রান্নাঘরের দিকে। পুরা বাড়িতে কোনো আসবাব নেই। বাসনকোসন নেই।

পেঁয়াজ কাটার মতো কোনো চাকু-ছুরি-বঁটিও নেই।

পাগলা দরজার পাল্লার ফাঁকে পেঁয়াজ ধরে পেঁয়াজ থেতলা করতে লাগল।

হাসিনার চোখ এমনিতেই জ্বলছিল। এবার অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু হলো।

রেহানা আবার বারান্দায়। কীভাবে ৩২ নম্বর যাওয়া যায়? এই পথ ধরে এক দৌড় দিলে কত মিনিট লাগবে? বড় রাস্তাটা পার হতে পারলেই তো ভেতরের রাস্তা। সেখানেও কি মিলিটারি থাকবে?

একটা চড়ুই পাখি মাথার ওপরে চক্কর খাচ্ছে। পাখিটা একটা ভেন্টিলেটরে বসল। আরেকটা চড়ুই পাখি কোত্থেকে এসে কিচিরমিচির করে ডাকতে লাগল। নিচে খড়কুটা পড়ে আছে। বোধ হয় পাখিগুলো বাসা বানাবে।

রেহানা, এই রেহানা–কিশোরী কণ্ঠের ডাকে চমকে উঠলেন রেহানা। আরে এ যে স্বপ্ন! ওর বাসা যে পাশেরটাই, রাতের অন্ধকারে তা ঠাওর করে উঠতে পারেননি রেহানা। এখন দিনের আলোয় এই কথাটা তার মনে পড়ল! বন্ধু স্বপ্নদের বাড়িই তো ওইটা!

আয় আয়, ভেতরে আয়-রেহানা দরজা খুলে দিলেন। সালোয়ার-কামিজ পরা স্বপ্নারও চোখের নিচে কালি। গোলাগুলির শব্দে ওরও নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি।

স্বপ্ন ভেতরে এলেন। আপা দ্যাখো। স্বপ্না এসেছে। ওর বাসা তো পাশেরটাই, রেহানা বললেন। স্বপ্ন এসেছিস, খুব ভালো হয়েছে, এই বাড়িতে একটা ছুরি বা বঁটি কিছুই নাই। তোর বাসা থেকে একটা ছুরি বা বঁটি এনে দে না।

হাসিনা বললেন, না না, স্বপ্ন। পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। আর্মিরা পাগলের মতো করছে।

ঠিক এই সময় আবারও গুলির গুড়ুম গুডুম শব্দ কান ফাটিয়ে ফেলতে লাগল। জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। একঝক কাক বাড়ির চারপাশজুড়ে কা কা করে ডাকতে লাগল ভয়ার্ত স্বরে।

হাসিনা কথা শেষ করার আগেই স্বপ্ন বললেন, না বাবা, আমি যাই। স্বপ্ন দৌড় ধরলেন নিজের বাড়ির দিকে।

পাগলা খিচুড়ি বসিয়েছে। চাল-ডাল সেদ্ধ হওয়ার গন্ধ আসছে। হাসিনার গলা পর্যন্ত জ্বলছে সম্ভবত অ্যাসিডিটির কারণে।

সময় যেতে চায় না। শঙ্কাকুল একেকটা হৃদয় দেয়ালের ওপারের মুকুলভরা আমগাছের পাতার মতো কাপে। তবু সময় বয়ে যায়। বিকেলে দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ।

সবার বুক ধড়াক করে ওঠে। কে এল? মিলিটারি নাকি?

রেহানা উঠলেন দরজা খুলতে। হাসিনা তাকে টেনে ধরলেন, তুই যাস না। মিলিটারি যদি আসে!

আবারও দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঠক ঠক ঠক ঠক। রেহানা একটুখানি দরজাটা ফাঁক করলেন। না, মিলিটারি না। আরেকটু খুললে দেখতে পেলেন, ওমর ভাই। কামাল ভাইয়ের বন্ধু। আপা। ওমর ভাই।

রেহানা দরজা খুললেন। ওমর ভেতরে ঢুকে কবাট বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। তিনি হাঁপাচ্ছেন। ওমর ভাই কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ৩২ নম্বরে বাড়ির লনে বহুদিন ক্রিকেট খেলেছেন। রেহানা তাদের বল-ব্যাট বয়ে দিয়েছেন কত!

ওমর বললেন, কামাল আমাকে পাঠাল। ও বলল, যাও, আমার বোনেরা পাগল হয়ে রাস্তায় বার হয়ে পড়বে। যাও, খবর দিয়া আসো। তাই আসলাম। ওরে বাপ রে! আসা যায়। রাস্তা অ্যাভয়েড করে বাড়িগুলোর ভিতর দিয়া আসলাম। বাইশটা ওয়াল টপকাতে হলো।

হাসিনা উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওমরকে ঘিরে আছেন সবাই। ওয়াজেদ মিয়া, হাসিনা, রেহানা, জেলি এবং পাগলা।

হাসিনা বললেন, ওমর। আর কী খবর? আমাদের বাসার সবাই কেমন আছেন? আব্বা? মা? জামাল? রাসেল?

ওমরের পরনে একটা গ্যাবারডিনের প্যান্ট, গায়ে পোলো শার্ট, পায়ে বাটার স্যান্ডেল শু। একটুখানি শ্বাস টেনে দম নিয়ে মুখটা বিষাদে ভরে তুলে তিনি বললেন, খালুকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। খালাম্মা, জামাল, রাসেল গেছে বাবুদের বাড়িতে। ডাক্তার আঙ্কেলের বাড়িতে।

হাসিনা রোদন করে উঠলেন, মা তো কখনো বাড়ি থেকে বের হন না। মা বাড়ি ছাড়ল কেন? কী করেছে ওরা? আব্বার কোনো ক্ষতি হয় নাই তো?

ধরে নিয়ে গেছে। এতটুকুন জানি। খালাম্মা, জামাল, রাসেল ভালো আছে। বাড়ির অন্য সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।

সবাই কাঁদছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল পাগলা। সাহেব সাহেব, আম্মা আম্মা।

ওমর বললেন, আমি যাই। আবার কেউ দেখে ফেললে আপনাদেরও ক্ষতি হতে পারে।

ওমর চলে গেলেন।

রেহানা বললেন, আমি যাব। আমি যাব ৩২ নম্বরে। আব্বা কাল রাতে আমাকে বলে দিয়েছেন সকাল সকাল যেতে!

ওয়াজেদ বললেন, পাগলামো করিস না, রেহানা।

.

বাদুড়ের পাখায় ভর করে রাত নেমে আসতে লাগল ধানমন্ডিতে। নতুন বাকা চাঁদ উঠল ধানমন্ডি লেকের তরুসারির ওপরে। সৈন্যদের কনভয় ছুটে যাচ্ছে। কুকুর আর্তস্বরে ডাকছে। আবারও খিচুড়ি রাঁধছে পাগলা। ডাল-চালের মিশ্রণে তেল নুন-পেঁয়াজ পড়ায় একটা গন্ধও আসছে বলক ওঠা হাঁড়ি থেকে। রেহানা রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন। কোথাও যদি জানা যায় আব্বার খবর! হাসিনা তোশকে আধশোয়া। একটা পত্রিকা জোগাড় করে তাকে বাতাস করছেন জেলি।

২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন বাসা ছেড়ে চলে গেলেন আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে, গাড়িতে। বুকটা হঠাই পাখি উড়ে যাওয়া দরজা খোলা খাঁচার মতো শূন্য মনে হতে লাগল লিলির। বাসায় রিমি, রিপিও নেই। তাঁতীবাজারে ওদের খালার বাড়িতে গেছে। ছোট্ট মিমি আর দুধের বাচ্চা ১৪ মাস বয়সী সোহেল আছে এই বাড়িতে। পিলখানার দিক থেকে তখন গুলির শব্দ আসছে। বাসাটা একেবারে সাতমসজিদ রোডের ওপরে। আর্মি নেমে গেছে। এই খবর তো জানাই। তাজউদ্দীনের খোঁজে যে আর্মিরা এই বাড়িতে আসবে, কোনো সন্দেহ নেই। তাজউদ্দীনকে না পেলে তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে, তা না-ও হতে পারে। বাড়ির সামনে গাছগাছালির নিচে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন জোহরা তাজউদ্দীন ওরফে লিলি। এখনই মিমি আর সোহেলকে নিয়ে মগবাজারে চলে যেতে হবে। আব্বা এই বাড়িতে আছেন। তিনি থেকে যেতে চান। থাকলে থাকবেন। আছে ভাগনে আর ভাতিজা দুজন। ওরা তো আর্মির টার্গেট হতে পারে না। যদিও কারোরই এই বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। বেশি চিন্তা করতে পারছেন না লিলি। ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি স্টার্ট দাও।

ড্রাইভার গাড়ি রেডি করে ফেলল।

এবার তিনি বাচ্চাদের এনে গাড়িতে উঠবেন। তখনই আকাশ ভেঙে বজ্রপাতের মতো শব্দ আর আলো বর্ষিত হলো যেন। ফ্লেয়ার ছুড়ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আর ছুড়ছে অবিশ্রান্ত গুলি। তারা এই দিকেই ছুটে আসছে।

লিলি তাড়াতাড়ি মিমিকে এক হাতে ধরে আরেক হাতে ঘুমন্ত সোহেলকে কোলে তুলে ছুটলেন দোতলার দিকে।

লিলির আব্বা তার রুম থেকে বের হয়ে এসেছেন। গোলাগুলির শব্দের মধ্যে তিনি হতভম্ব। লিলি বললেন, বাড়িতে আর্মি আসছে। আমি দোতলায় গেলাম। আমি ভাড়াটিয়া সেজে থাকব।

দোতলার ভাড়াটে আবদুল আজিজ বাগমার। আর আছেন তাঁর স্ত্রী আতিয়া।

.

আবদুল আজিজ বাগমারের প্রসঙ্গ এলে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তাঁর পরিচয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেয়।

ব্যাঙ্গমা বলে, আবদুল আজিজ বাগমার তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলার ভাড়াইটা, এতটুকুন কইলে হইব না।

ব্যাঙ্গমি বলে, তা তো হইবই না।

ব্যাঙ্গমা বলে, বাগমার ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আছিলেন। তোলারাম কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ইলেকটেড হইছিলেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে বাগমার পুরাপুরি জড়িত আছিলেন। ওই সময়ই তারা গইড়া তুলছিলেন অপূর্ব সংসদ। অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সংক্ষেপে অপূর্ব সংসদ। এই সংসদের সভাপতি আছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। সেক্রেটারি হইছিলেন বাগমার নিজে। বাংলারে স্বাধীন করতে। হইব–এই রকম চিন্তাভাবনা তারা করতে আছিলেন।

ব্যাঙ্গমা বলে, তাগো লিফলেটে আমার সোনার বাংলা গানটা ইউজ করা হইছিল। আর সেই লিফলেট লেইখা দিছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আহমদ শরীফ।

ব্যাঙ্গমি বলে, পরে বাগমার ব্যারিস্টারি পড়তে চইলা যান লন্ডন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে বাংলা স্বাধীন করার লাইগা ইন্টারন্যাশনাল কানেকশনের খোঁজে লন্ডন যান। তখন শেখ সাহেবের লগে লগে আছিলেন বাগমার। শেখ সাহেবের ৬ দফার মাঝেই বাগমার বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার উপায় খুঁইজা পাইলেন।

ব্যাঙ্গমা বলে, এবার ব্যারিস্টার হইয়া বাগমার দ্যাশে আইছেন। ব্যারিস্টারি করেন। শেখ মুজিব তার লিডার। বঙ্গবন্ধু কইলেন, বাগমার, দ্যাশে থাকো। দ্যাশের কাজ করো। বাগমার আওয়ামী লীগের কাজে ঝাপায়া পড়লেন। ইলেকশনের কাজ। শেখ মুজিব কইলেন, শোনো, তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলা ভাড়া হইব। পলিটিক্যাল লিডারের বাড়ি কেউ ভাড়া নিতে চায় না। তুমি ওই বাসা ভাড়া লও। মুজিবের কথা মানেই আদেশ। বাগমার গিয়া উঠলেন তাজউদ্দীন আহমদের বাসার দোতলায়। ৭৫১ সাতমসজিদ রোড। বাগমার তাঁর বইয়ে লেখছেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা জেলায় ছয় দফার ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়া তিনি মোট ৩০২টা জনসভা করছিলেন। একবার তাজউদ্দীনের লগে জনসভা করতে গিয়া সাত দিন পর বাড়ি ফেরেন। আইসা তাজউদ্দীনের ওয়াইফ জোহরা ভাবি ওরফে লিলির কাছ থাইকা জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী আতিয়া রাগ কইরা লন্ডন চইলা গেছে। রাগ ভাঙায়া তারে লন্ডন থাইকা দেশে ফিরায়া আনতে বাগমারকে নানা কসরত করতে হইছিল। আতিয়ার সাথে বাগমারের প্রেমের বিয়া। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়া প্রেম করছেন। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু হইয়া লন্ডন সফর করেন, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া তার লগে একই হোটেলে থাকলেন, ওই সময় আতিয়া আর বাগমারের প্রেম দেইখা হাসিনা ঠাট্টা-রসিকতা করতেন, কইতেন, প্রেম অনেক দেখছি, এই রকমের প্রেম দেখি নাই।

.

দোতলায় আবদুল আজিজ বাগমার, তাঁর স্ত্রী আতিয়া নিজেদের বেডরুম ছেড়ে দিয়েছেন লিলি আর তার দুই শিশুসন্তানকে। লিলি এই বাড়িতে এসেই শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ পরে নিয়েছেন। এই বাড়ির আরেকটা বেডরুমে আছেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, তাঁর নতুন বিবাহিত স্ত্রী শামীম বানু। তাঁরা বেড়াতে এসেছেন, মেহমান। আরেকটা ঘরে লিলু। ক্লাস ফোরের ছাত্র। রেসিডেনসিয়ালে ভর্তি হয়েছে। বাগমারের ভাইয়ের ছেলে। এই বাসা থেকেই ক্লাস করবে, তেমনি কথা।

বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। শব্দের চোটে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। আর দরজা-জানালার ফাঁক গলে আসছে বাইরের আলো আর আগুনের ঝলকানি। ফ্লেয়ারের আলোয় পিলখানা, মোহাম্মদপুর, সাতমসজিদ রোড ঝলসে যাচ্ছে।

লিলি কানে হাত দিয়ে শব্দের আঘাত থেকে বাঁচতে চাইছেন। ছয় বছরের ছোট্ট মিমি ঘুমাচ্ছে। শব্দে আলোয় সোহেলের ঘুম ভেঙে গেছে। সে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। ভাগ্যিস রিমি, রিপি তাঁতীবাজারে। ১৭ মার্চ থেকেই তারা তাদের সেজ খালার বাসায় আছে। এমন গোলাগুলি শুরু হলো কেন? আজ রাতেই কি রোজ কিয়ামত হয়ে যাবে?

তাজউদ্দীন যে কই গেলেন? আমীর আছেন সঙ্গে। ড. কামাল আছেন। নিশ্চয়ই নিরাপদ কোনো গোপন জায়গাতেই থাকবেন। কিন্তু পৌঁছাতে পারবেন তো ঠিক জায়গায়।

৩২ নম্বর থেকেও গোলাগুলির শব্দ আসছে। মুজিব ভাই, ভাবি, ছেলেমেয়েরা ভালো আছে তো? লিলির বুক থরথরিয়ে কাঁপছে।

নিচে গাড়ির ভটভট শব্দ। গুলির ব্রহ্মাণ্ডবিদারী আওয়াজ। দানবেরা এসে গেছে। লিলি বিছানা থেকে দ্রুত নামার চেষ্টা করলেন। কিছুদিন আগে তিনি পা ভেঙে বিছানায় পড়ে ছিলেন। এখনো পা পুরো সারেনি। কিন্তু যখন নিচতলা ঘিরে ফেলেছে শত শত সৈন্য, গুলি আঘাত করছে বাড়ির দেয়ালে, তখন পায়ের ব্যথার কথা কারই-বা মনে থাকবে!

লিলি দরজা খুলে বৈঠকখানায় গেলেন। সামনে হতবিহ্বল বাগমার ও আতিয়া। বাগমার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে আত্মগোপন করতে চেয়েছিলেন, আতিয়া তাকে বাড়ি ছাড়তে দেননি।

লিলি বললেন, আজরাইল এসে গেছে। আতিয়া তুমি আমার সাথে আসো। আমরা ওই ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকি।

লিলি আর আতিয়া বেডরুমে গেলেন। দরজা বন্ধ করলেন।

নিচতলায় প্রচণ্ড শব্দ হলো। বিস্ফোরণ হলো। মিলিটারি প্রবেশ করল দরজা উড়িয়ে দিয়ে। পুরো বাড়ি আর্মিরা ঘিরে রেখেছে।

.

পাকিস্তানি মিলিটারি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। সামনে পড়ল কাজের ছেলে কিশোর বয়সী দিদার।

তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, তাজউদ্দীন কই?

দিদারের সামনে বন্দুক উঁচিয়ে ধরে আছে আজরাইলের মতো কয়েকজন ভয়ংকরদর্শন দস্যু। বালক বলল, সাহেব, মেমসাহেব দুপুরবেলাই ছেলেমেয়ে লইয়া বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে গা। কই গেছে কইয়া যায় নাই।

রুমে রুমে সার্চ করা শুরু হলো। এক রুমে শুয়ে আছেন রিমি-রিপিদের নানা। তিনি বিছানায় উঠে বসেছেন। দরজায় বুটের লাথি পড়লে তা আপনা আপনি খুলে গেল।

হোয়ার ইজ তাজউদ্দীন?

আই হ্যাভ নো আইডিয়া!

তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়?

মুঝে নেহি পাতা।

আটাত্তর বছর বয়সী ভদ্রলোক সৈয়দ সেরাজুল হক বুক বরাবর ধরে রাখা স্টেনগানের নলের দিকে একবার তাকিয়ে সৈন্যদের মুখের দিকে তাকালেন। উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে জবাব দিতে লাগলেন।

সৈন্যরা তাকে হুকুম দিল শুয়ে পড়বার। তিনি ভাবলেন, এই শোয়াই শেষ শোয়া। তারা গুলি করবে এরপর। তিনি জোরে জোরে কলেমা পড়তে পড়তে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…

সৈন্যরা বাড়ি সার্চ করে পেল তাজউদ্দীনের ভাগনে হাসান, ভাতিজা তফাজ্জল, বাড়ির কেয়ারটেকার বারেক মিয়াকে। তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে এক জায়গায় করা হলো।

বুটের শব্দে বাড়ি কাঁপিয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল দোতলায়।

.

আর্মিরা ওপরে উঠছে।

লিলি আর আতিয়া ঠিক করেছেন, তারা পরিচয় দেবেন তারা বিহারি। এই বাড়িতে ভাড়া থাকেন। দুজনের পরনেই সালোয়ার-কামিজ। লিলির। কোলে এক বছর বয়সী শিশুপুত্র সোহেল।

মিলিটারি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে গেল দোতলায়।

বাগমার বৈঠকখানায়। চারদিকে গুলির শব্দ। পুরো বাড়িতে আলো আর আলো। যেন আকাশের সব বজ্র একই সঙ্গে নেমে এসেছে এই বাড়িতে। তিনি টের পাচ্ছেন, বাড়ির চারদিকে মিলিটারি। সাতমসজিদ সড়কের পাশে খেলার মাঠের দিক থেকে শত শত সৈন্য তাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর নল ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের এই বাড়ির দিকে তাক করে রেখেছে।

তিনি টের পাচ্ছেন আর্মিরা দোতলায় উঠেছে। বুটের শব্দ হচ্ছে খটখট।

দরজা খুলতে হলো না। গুলি করে দরজা ভেঙে একদল সৈন্য অস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল দোতলার ঘরের ভেতরে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল দেয়াল।

তারা সঙিন উঁচিয়ে উর্দুতে বলল, তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়? বাগমার উর্দু জানতেন। উর্দু জানেন লিলি আর আতিয়াও।

বাগমার জবাব দিলেন, উপর সব কেরায়াদার রেহতে হ্যায়…ওপরে সব ভাড়াটে। উয়ো গ্রাউন্ডফ্লোর মে হ্যায়…উনি নিচের তলায়।

সঙ্গে সঙ্গে একরাশ গুলি ছাদের পলেস্তারা খসিয়ে ফেলল। শব্দ আর আলোয় বাগমারের দৃষ্টি-শ্রুতি বিদীর্ণ হওয়ার জোগাড়।

ইয়ে বাতাও। তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়?

তিনি সাহস হারালেন না, বললেন, আমরা ভাড়াটে। নিচের বাড়িওয়ালা কোথায়, আমরা জানব কী করে?

বাগমার আর লিলুকে বারান্দায় নেওয়া হলো। তাঁদের ঘিরে রইল গোটা দশ-বারো সৈন্য।

এবার সৈন্যরা গেল বেডরুমে। দরজা ধাক্কা দিতে লাগল ভয়ংকরভাবে। চিৎকার করে বলতে লাগল, দরওয়াজা খোল দো। নেহি তো গোলিছে উড়া দেঙ্গে।

আতিয়া পাল্টা চিৎকার করে উঠলেন, কৌন হ্যায়?

ফৌজি।

আতিয়া দরজা খুললেন, মালুম হ্যায় কিতনি রাত হুই? ইতনি রাত গ্যায়ে ইধার কিউ আয়ে?

সৈন্যরা দ্বিধাগ্রস্ত। এ তো দেখা যাচ্ছে উর্দুওয়ালা ফ্যামিলি। তারা বলল, হামলোগ কওমকি দুশমন তাজউদ্দীনকে তালাশ মে হ্যায়। কেয়া ও ইধার হ্যায় জি?

আতিয়া বিরক্তির অভিনয় করলেন। ঠোঁট উল্টে বললেন, হামলোগ কেরায়াদার হ্যায়। তাজউদ্দীন এতনে রাত মে এধার কিউ আয়েগা? ঠিক হ্যায়, আপ আন্দর আইয়ে আওর খুদ দেখ লিজিয়ে। এতনে রাত গ্যায়ে আপকা ইয়ে কাম গলত হ্যায়।

লিলির মনে ভয়, নিচের দেয়ালে তাঁদের ফটো ফ্রেমে বাঁধাই করা আছে, তাকে না মিলিটারিরা চিনে ফেলে। সোহেলকে মুখের কাছে ধরে মুখটা ঢেকে রেখে তিনি আতিয়ার উদ্দেশে বললেন, আরে জি তুমহে তো প্যাহেলে হি মানা কিয়েথে ইয়ে সাব পলিটিশিয়ানকে ঘর কেরায়া নেহি লেনা, আখের এহি থা নাসিবমে…তোমাকে আগেই বারবার করে মানা করেছিলাম, রাজনীতি করা লোকের বাড়ি ভাড়া নিয়ো না। এখন বুঝলে তো। আমাদের কপালে এই দুর্ভোগ ছিল। কালকেই টিকিট কেটে করাচি চলে যাব। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…।

হামসে গালতি হো গ্যায়া। আপলোগ ইতমিনান সে রাহিয়ে, মুঝে অওর কুছ। নেহি কারনা। বলে সৈন্যরা বেডরুমে ঢুকে বিছানার নিচ, আলমারি, বাথরুম সব তালাশ করল। বারান্দায় তন্ন তন্ন করে খুঁজল তাজউদ্দীনকে পাওয়া যায় কি না।

পাওয়া গেল না। তারা বেরোনোর সময় বলল, ব্যাহেন, আপকো তকলিফ দিয়া। হামলোগকো মাফ কর দিজিয়ে। মিমির ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে বসল। আতিয়া তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে বললেন, সো যাও মেরা বাচ্চা, ঘাবড়ানেকা কোই বাত নেহি।

আর্মিরা এবার আরেকটা বেডরুমের দরজা ধাক্কাতে লাগল। আতিয়াকে বলল, ব্যাহেন, এই রুমে কারা আছে?

আতিয়া বললেন, মেহমান হ্যায় জি। নয়া শাদিশুদা মেহমান। নববিবাহিত মেহমান। আতিয়া ডাকলেন, শামীম, দরওয়াজা খোল দো।

শামীম বানু দরজা খুললেন। শামীমও ভালো উর্দু জানেন। উর্দুতে জানালেন, তাঁরা মেহমান। বিয়ের পর শখ করে ঢাকা বেড়াতে এসেছেন।

বুটের শব্দ তুলে সঙিন উঁচিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে সৈন্যরা প্রতিটি ইঞ্চি তল্লাশি করে দেখল কোথাও তাজউদ্দীনের দেখা মেলে কি না।

লিলুকে আর আজিজ বাগমারকে এক জায়গায় রাখা হয়েছে। তাদের নিচে নামানো হচ্ছে বন্দুকের গুঁতো মেরে মেরে।

আতিয়া বললেন, বাচ্চেকো কিউ লে যা রহে হো?

বাগমার আর লিলুকে আনা হলো বৈঠকখানায়। দরজার জায়গাটা একটা বিশাল গহ্বর। সিমেন্ট, কাঠ, ইটের টুকরাটাকরা ধ্বংসস্তূপটাকে ভয়াবহ দেখাচ্ছে।

আতিয়ার মনে ভয়, ওই ওপাশের টেবিলের কাগজে বাগমার বোমা বানানোর ফর্মুলা ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন। সেদিকে না নজর যায়। সৈন্যদের নজর গেল দেয়ালে ঝোলানো রবীন্দ্রনাথের ফটোর দিকে। এই বুঝি সবাই ধরা পড়ে যান যে এরা উর্দুভাষী নন। কমান্ডার প্রশ্ন করল, ইয়ে কৌন হ্যায় জি?

আতিয়া জবাব দিলেন, ও হামারি পীর ছাহেব হ্যায়। মগর জিন্দা নেহি হ্যায়। কমান্ডার ডান পা তুলে মেঝেতে বুট ঠুকে স্যালুট করল পীর সাহেবকে।

আর্মিরা ওপর থেকে টেনেহিঁচড়ে নামাল আজিজ বাগমারকে, লিলুকে, তাঁদের বাবুর্চি আবদুলকে। নিচের তলা থেকে তফাজ্জল, হাসান, বারেক মিয়াকে বন্দুকের মুখে এক জায়গায় জড়ো করল। বালক দিদারকে তারা ছেড়ে দিল। আর ছেড়ে দিল লিলুকে। বাচ্চে তুম উপর ওয়াপস চলে যাও। লিলুও বুঝে ফেলল, বাংলায় কথা বলা যাবে না। সে চাচাকে চোখের ভাষায় জিজ্ঞেস করল ওপরে যাবে কি না। বাগমার তাকে ইশারা করলেন ওপরে যেতে।

বাকিদের তারা বন্দুকের বাড়ি দিতে দিতে তুলে ফেলল ট্রাকে। বাগমার ট্রাকে উঠলেন।

বিকট শব্দ হলো। একটা গুলি তাঁর মাথার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ঝকড়া লম্বা চুলের অনেকটা পুড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। চুলপোড়া গন্ধ বেরোতে লাগল।

আতিয়ার অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ফ্লেয়ারের আলোয় হঠাৎ ঝলসে ওঠা আবদুল আজিজ বাগমারের উদ্বিগ্ন মুখে।

আতিয়া কাঁদতে লাগলেন শব্দ করে। চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে সেই কান্না হারিয়ে গেল মহাকালের অতলে।

দিদার রিমিদের নানার ঘরে গেল। দেখল, ভয়ার্ত নানা তখনো জোরে জোরে পাঠ করে চলেছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…

.

সময় পাথর হয়ে জমে থাকে। সময় অগ্নিকুণ্ড হয়ে জ্বলে। সময় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বয়েও যায়। লিলি জানেন না কী করে ২৫ মার্চ রাতটা কেটে গিয়ে ২৬ মার্চের ভোর এল। কামানের গর্জন, মর্টারের গোলা। আগুন, বারুদ, বিস্ফোরণ। সমস্ত আকাশ কাল রাতে পুড়ে গেছে। কাল রাতের আকাশ ছিল গনগনে জ্বলন্ত গলন্ত লোহার মতো লাল। ভোরবেলায়। গোলাগুলির শব্দ একটু কমে এসেছে। রাস্তায় মিলিটারি ট্রাক, মিলিটারি জিপ মাইক লাগিয়ে ঘোষণা করছে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। লিলি একবার। ঘুমন্ত মিমির দিকে তাকালেন। ওর কপালে ঘাম, জানালা গলে আসা আলোয় দেখা যাচ্ছে ঘামের মধ্যে ওর পাতলা চুল আটকে আছে। সোহেলের এক হাত শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে, তিনি বাচ্চাটাকে আলতো করে ধরে হাতটা মুক্ত করে নিলেন। রিমি, রিপি ভাগ্যিস এই বাড়িতে নেই, তাই ওরা হয়তো ভালোই আছে। তাজউদ্দীন রাইফেল আর পিস্তল হাতে করে চলে গেছেন কোনো অন্ধকার অনির্দিষ্ট পথে, হয়তো আলোকিত ভোর আনবেন বলে। কিন্তু এই বাড়িতে থাকা কি নিরাপদ হবে? তাজউদ্দীনের খোঁজে মিলিটারিরা কি আবার আসবে না? তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের জিম্মি করে রাখবে না, যাতে পাখি। স্বেচ্ছায় এসে ধরা দেয়! না, এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়। লিলি বিছানা। ছাড়লেন। ভাঙা দরজা, ধ্বংসচূর্ণ, কাঁচ, কাঠ, সিমেন্টের জঞ্জাল পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন তিনি। বাইরে মিলিটারির গাড়ি চলাচল করছে।

আবারও দূরে গর্জন শোনা গেল। কোথাও কামানের তোপ দাগা হচ্ছে। এই বাড়ি ছেড়ে পালাতেই হবে। লিলি ভাবলেন।

তিনি নিচতলার দরজা খুলে পেছনের বাগানে গেলেন। মাধবীলতার ঝাড় থেকে আসা একটা বুনো গন্ধ বারুদের গন্ধকে পরাজিত করে তার নাকে এসে লাগল। তিনি বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের এপাশ-এপাশ নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। বাসার দক্ষিণ দিকে একতলা বাড়ি। গাছগাছড়ায় ঢাকা। বাড়িওয়ালা থাকেন না বাড়িতে। থাকেন এক ব্যবসায়ী ভাড়াটে। মার্চের শুরু থেকেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামে। রেখে গেছেন এক বয়স্কা মহিলাকে, বাড়িটা দেখভাল করার জন্য। বাড়িতে কিছু হাঁস-মুরগি আছে, গাছগাছালি আছে, সেসব দেখারও তো লোক লাগে। সেই মহিলাকে দেখা গেল সকালবেলা। ঘরের বাইরে এসে হাঁস-মুরগির খোয়াড়ের কপাট খুলে দিলেন। একটা লাল রঙের মোরগ দৌড়ে বেরিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে মাথা উঁচু করে ডেকে উঠল কুকুরুকু। মুরগিগুলো শুরু করে দিল ছোটাছুটি।

লিলি বললেন, এই শোনেন, একটা টুল আপনাদের দেয়ালের ওই পারে রাখেন তো। আমি আপনাদের বাসায় আসব। বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে আসব।

মা গো মা, বাড়িত কেউ নাই, আমি তো বাড়ির ভিতরে থাহি না, আমি ঘরের বাহিরে থাহি। বলে এক দৌড়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

লিলি প্রমাদ গুনলেন। বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর। অবশ্য মহিলাকে দোষও দেওয়া যাবে না। তিনি নিজেই পরের বাড়িতে থাকেন। তা-ও বাহির বাটিতে। তিনি কী করে বাইরের মানুষকে আশ্রয় দিতে পারবেন? পরাশ্রিতরা কখনো আরেকজনকে আশ্রয় দিতে পারে না। দিতে চায়ও না।

কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটু আনমনা ছিলেন লিলি। উত্তর দিকের বাসায় থাকেন একজন বিদেশি কূটনীতিক। যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধি। এ মুহূর্তে তিনি একাই আছেন। স্ত্রী-সন্তানদের মাসের শুরুতেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্বদেশে। সেই ভদ্রলোককে দেখা গেল একটা বাদামি রঙের স্লিপিং গাউন পরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। লিলির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোককে দেখা গেল উত্তেজিত। গত রাতের গোলাগুলির পর তিনি হয়তো আশা করেননি যে পাশের বাড়ির কর্তী বেঁচে থাকবেন। তিনি এগিয়ে এলেন। ইশারায় জানতে চাইলেন, ডু ইউ নিড হেল্প। ডু ইউ নিড শেল্টার। ইউ ক্যান কাম হিয়ার।

লিলি বাইরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। রাস্তার ওপরেই মিলিটারি প্রহরা। ওই বাড়ির দেয়াল অনেক উঁচু। সেটা পার হওয়া অসম্ভব। আর গেট দিয়ে বের হওয়ামাত্র পড়তে হবে মিলিটারির কবলে। হঠাৎ লিলির চোখে পড়ল তাদের বাসার একটা জানালার সানশেডের ওপরে। ও মা! একি! একটা ওয়্যারলেস বসিয়ে রেখে গেছে মনে হচ্ছে। সব কথা এখান থেকে চলে যাচ্ছে মিলিটারির কাছে?

এই ভোরবেলাতেই লিলি একটা কাজ করিয়েছেন দিদারকে দিয়ে। তার যত ছবি ছিল ঘরের দেয়ালে, সব কটি সরিয়ে দিয়েছেন।

লিলি আবার দোতলায় গেলেন। যাওয়ার আগে নিজের ঘরের শূন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পা এখনো পুরোপুরি সারেনি। একটু কষ্টই হয় সিঁড়ি ভাঙতে।

দোতলায় গিয়ে ডাইনিংয়ে একটা চেয়ারে বসলেন লিলি। আতিয়াও এসে পাশের চেয়ারে বসলেন। তাকে দেখাচ্ছে ছিন্নভিন্ন। হাবিব সাহেবরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা আর কলবেলের কর্ণবিদারী শব্দ। বাইরে গাড়ির আওয়াজ। বুটের খটখট পিলে চমকানো শব্দ।

লিলির আব্বা সেরাজুল হক সাহেব দরজার কাছে গেলেন। তারা তাকে হুকুম করল, বাড়ির ছাদে কালো পতাকা কেন, পতাকা নামাও।

সেরাজুল হক সাহেব ভদ্রভাবে বললেন, জি। কালো পতাকা নামানো হবে।

মিলিটারিরা চলে গেল। দিদার ছুটল পতাকা নামাতে। পতাকা নামিয়ে দিদার ট্রে-ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে দোতলায়। ঘড়িতে তখন আটটা। লিলি ধমক দিলেন, এই তুই ক্যানো খাবার নিয়ে ওপরে উঠেছিস। আমরা তো দোতলার ভাড়াটে। নিচতলার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। লিলি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তিনি উর্দুতে কথা বলছেন। দিদার এই উর্দুর কিছুই না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আগের রাতে একটা আকিকার দাওয়াত ছিল। সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু মেজবানরা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই খাবার সেরাজুল হক সাহেব ওপরে পাঠিয়েছেন।

কে খাবে খাবার? কার গলা দিয়ে এখন খাবার নামবে? খাবার পড়ে রইল টেবিলে। টেবিলের পাশে বসে আছেন আতিয়া। তার শরীর এলায়িত। একরাশ হতাশা মেঘের মতো ছেয়ে রেখেছে মুখখানা। বসে আছে মিমি। সোহেল লিলির কোলে। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন হাবিব আর তাঁর স্ত্রী। কেউই খাচ্ছেন না।

টেবিলের ওপরে একটা রেডিও। তাতে একটা কাপড়ের ঢাকনা। লিলি রেডিওর নব ঘোরাতে লাগলেন। ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ। নব ঘুরিয়ে এ কেন্দ্র ও কেন্দ্র ছুঁড়ে শোনা গেল বিকৃত বাংলা। তার মানে হলো, কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যায়নি। উর্দুওয়ালাদের ধরে এনে রেডিও চালানোর চেষ্টা চলছে।

আতিয়া বললেন, ভাবি, আজিজ কখন ফিরবে?

কে জানে এই প্রশ্নের উত্তর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল আটটার সময় কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আছে যে ২৫ মার্চ রাতে যাকে ধরা হয়েছে, সে কবে ছাড়া পাবে পাকিস্তানিদের দোজখখানা থেকে?

লিলি বললেন, কারফিউ আর কতক্ষণ। কারফিউ তুলে নেবে। আর আজিজও চলে আসবে। ভেবো না আতিয়া।

আতিয়া বললেন, ফিরে আসবে, না? আসেন তাহলে নাশতা খাই।

আতিয়া হাসলেন। প্রত্যুত্তরে হাসলেন লিলিও। তাঁরা জানেন পরস্পর পরস্পরকে ঠকাচ্ছেন। নিজের অন্তরকেও প্রবোধ দিচ্ছেন। তারা নাশতা খেতে আরম্ভ করলেন।

লিলির মনে হলো, কাল রাতে তিনি তাজউদ্দীনের জন্যও টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছিলেন। প্লেট সাজিয়েছিলেন। তা না খেয়েই চলে গেছেন। তাজউদ্দীন।

আবার রেডিওর বোতাম ঘোরাচ্ছেন লিলি। এবার শোনা গেল আকাশবাণী কলকাতা। তারা বলছে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভয় নেই। ভারত আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

ভয়ে, উত্তেজনায়, উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় দুপুর গড়িয়ে এল বিকেল। লিলি এবার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। আর এই বাড়িতে থাকা নয়। তাঁকে পালাতেই হবে। তিনি নিচে গেলেন। আবার চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করে দেখতে লাগলেন।

পাশের বাড়ির সাকিবার আব্বাও বারান্দায়। মিসেস তাজউদ্দীনকে দেখে তিনি অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, ভাবি, ভাবি, আপনি আমাদের বাসায় চলে আসেন।

লিলি একটা মুহূর্ত নিলেন ভেবে নেওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে আর্মি আবার আসবে। এখানে থাকা কিছুতেই নিরাপদ না।

তিনি উঠলেন দোতলায়। আতিয়াকে ডেকে বললেন, আতিয়া। আমি সাকিবাদের বাড়ি যাই। তোমার নিজেরই বিপদ। আমি থাকলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। নিচে আব্বা আছেন। তিনি তোমার দেখাশোনা করবেন।

আতিয়া কেবল এই প্রস্তাবে সায় দিলেন তা-ই নয়, একটুখানি গোছগাছ করে নিতে সাহায্য করলেন লিলিকে। লিলির কোলে সোহেল, আতিয়ার কোলে মিমি। তারা নিচে নামলেন।

লিলি গেলেন তার আব্বার ঘরে। তাঁর পিতা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। লিলি বাবাকে কদমবুসি করলেন। বললেন, আব্বা, আমি পাশের বাসায় যাচ্ছি।

সেরাজুল হকের চোখের নিচে পিঁচুটি। গলায় শ্লেষ্ম জমে গেছে। ঘর্ঘরে গলায় তিনি বললেন, কারফিউ তো। কীভাবে যাবি?

রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। দেয়াল টপকাব।

মিলিটারি দেখলে গুলি করবে।

সাবধানে যাব। যখন দেখব রাস্তায় আর্মির গাড়ি নাই, তখন দেয়াল টপকাব।

লিলি আর সময় নেবেন না। দ্রুত আব্বার সামনে থেকে সরে যেতে হবে। না হলে মায়া এসে জড়িয়ে ধরবে। আব্বা এখানে কার সঙ্গে থাকবেন? কে তাকে খাবার দেবে? বিপদে-আপদে কে তাকে দেখবে, এসব কথা ভাবতে গেলেই পা আটকে যাবে শিকলে। আগে সটকে পড়তে হবে। পরের চিন্তা পরে।

পাশের বাড়িটি মুবিন সাহেবের। এর আগে পরিচয় হয়নি লিলির। বাড়ির পেছনের দিকে দেয়ালের পাশে আসতেই দেখা গেল ওই বাড়ির লোকজন তাদের সাহায্য করার জন্য সবাই উপস্থিত। এ পাশে উঁচু টুল পাতা হলো। ও পাশে মই। আতিয়া সাহায্য করলেন এই পারে। ওই পারে মুবিন সাহেব বললেন, মা, সাবধানে পার হও। তাড়াহুড়া নেই। রাস্তা থেকে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে না।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলবে :

এই মুবিন সাহেব হলেন সিলেটের মানুষ, আবদুল মুবিন চৌধুরী। তাঁর ছেলে শমসের মুবিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে যাবেন, বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করবেন। সে-ও তো যুদ্ধদিনের কথা, যুদ্ধ শেষের কথা।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি স্মরণ করবে :

৩২ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত ও আটককৃত অচেতন হাজি মোরশেদকে প্রথমে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে, তারপর আদমজী স্কুলের রুমে রাখা হয়, তারপর নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় সামরিক হাসপাতালে। আবদুল আজিজ বাগমারসহ তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি থেকে ধরে আনা লোকদের প্রথমে সংসদ ভবনের সিঁড়ি, তারপর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকার একটা গুদামে এনে ঢোকানো হলো। ওইখানে সার বেঁধে ৫টা গুদাম। গুদামের গেটে লেখা : পি ডব্লিউ কেইজ। প্রিজনার্স অব ওয়ার কেইজ। তার আগে তাদের মেরে-পিটিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত করা হয়। এই খাঁচাতেও তাঁদের ওপরে চলে নিয়ম করে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন। মোহাম্মদপুর থানার বাঙালি পুলিশদেরও আনা হয়েছিল একই খাঁচায়। মারতে মারতে তাদের মেরেই ফেলা হয়েছিল। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে বের করে এনে হাজি মোরশেদকেও এই হায়েনার খাঁচায় এনে পোরা হলো। তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে ধরা পড়া আবদুল আজিজ বাগমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ধরা পড়া হাজি মোরশেদের।

হাজি মোরশেদ দুর্বল শরীরে অস্ফুট স্বরে বললেন, মুজিব ভাইকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।

বাগমার ফিসফিস করে বললেন, তাজউদ্দীন ভাই মিলিটারি আসার আগে আগেই আমীর-উল ইসলাম, কামাল হোসেনের সঙ্গে গাড়ি করে বাড়ি ছেড়েছেন। কোথায় আছেন, কেমন আছেন–আর কিছু জানি না।

হাজি মোরশেদ কাতর কণ্ঠে বললেন, আমাকে পিটিয়ে তো শেষ করে ফেলেছে। আরও নির্যাতন নিশ্চয়ই করবে।

বাগমার ব্যথিত গলায় বললেন, আমাদেরও অমানুষিক নির্যাতন করছে।

হাজি মোরশেদ চোয়াল শক্ত করে বললেন, বাগমার ভাই, আমাকে মেরে ফেললেও আমি স্বীকার করব না যে আমি আপনাকে চিনি। আপনিও কোনো কিছু স্বীকার করবেন না। দোয়া করি যেন বেঁচে থাকেন।

বাগমারও দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনার জন্য আমি অন্তর থেকে দোয়া করি। আপনার এই কথা যে আমাকে কত সাহস দিল, আপনাকে বোঝাতে পারব না।

ব্যাঙ্গমা বলল, ২৫ মার্চ থাইকা পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকাসহ সারা বাংলায় দোজখের আগুন ছড়ায়া দেয়।

ব্যাঙ্গমি বলল, ট্যাংক, কামান, মর্টার, এলএমজি, মেশিনগানের অবিরাম তোেপবর্ষণ, ছাত্রাবাস, বস্তি, পুলিশ ব্যারাক, ইপিআর ঘাটি, আনসার ঘাঁটি, লোকালয়, জনপদে অগ্নিসংযোগ আর নির্বিচার মানুষ হত্যা। তালিকা ধইরা ধইরা ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতাকামী মানুষের ঘরে ঘরে গিয়া গুলি কইরা হত্যা। জগন্নাথ হল থাইকা ছাত্রদের ধইরা আইনা মাঠে লাইন কইরা দাঁড় করায়া ব্রাশফায়ার। গর্ত কইরা সব লাশ চাপা দেওয়া মাটির তলায়। এই সবের বর্ণনা কি শেষ করা যায়! কারও পক্ষে সম্ভব পুরা নরকের ছবিটা আঁকা? ভাষায় ধারণ করা?

ব্যাঙ্গমা বলে, ২৫ মার্চ রাইতের হত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যু, আগুন, গোলাবর্ষণের বিবরণ কারও পক্ষেই কুনুদিনও দেওয়া সম্ভব হইব না।

ব্যাঙ্গমি বলে, কারও পক্ষেই কুনুদিন সম্ভব না। আমরা এক কাম করতে পারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র বইয়ের অষ্টম খণ্ড থাইকা ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সুইপার ইন্সপেক্টর সাহেব আলীর বিবরণ অবলম্বন করার লাইগা তারে ফলো করতে পারি।

.

সাহেব আলী সুইপারদের ইন্সপেক্টর। রাতে আছেন প্রসন্ন প্রসাদ লেনে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে। সন্ধ্যার দিকে বেরিয়েছিলেন ডিউটিতে। রাতের বেলা ঢাকা শহরের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া তাদের কাজ। তিনি ইন্সপেক্টর। নিজের হাতে ঝাড় দিতে হয় না। তার দলের লোকেরা ঝাড়ু দেয়। তিনি দেখভাল করেন। মুখে একটা পান পুরে ২৫ মার্চ সন্ধ্যাতেও ডিউটি সেরেছেন। রাস্তায় জনতা ব্যারিকেড দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পুরান ঢাকার রাস্তা দখল করে রেখেছে। রাত নয়টার পর পরিস্থিতি থমথমে হতে লাগল। সাহেব আলী জানতে পারলেন, পাকিস্তানি মিলিটারি রাতে হামলা করতে পারে। তাই জনতা বেশি করে ব্যারিকেড দিচ্ছে। আলোচনা ভেঙে গেল। সাহেব আলী মন খারাপ করে এসেছেন ছোট বউয়ের কাছে।

ঠিকমতো খেতে পারলেন না। ছোট বউ যত্ন করে মুরগির গোশত দিয়ে বুটের ডাল বেঁধেছেন। নিজ হাতে আটা ছেনে বেলনা দিয়ে বেলে রুটি বানাচ্ছেন আর গরম-গরম তার পাতে তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু সাহেব আলীর হাত রুটি ছিঁড়তে পারছে না।

বউ বললেন, কী হইল। কার কথা ভাবেন? বড় বউয়ের কথা?

সাহেব আলী বললেন, কিছু জিগাইলা? মনটার মধ্যে কু-ডাক দিতাছে। আজ রাইতে না জানি কী হয়!

খানিক পরেই গোলাগুলির শব্দ শুরু হলো। সাহেব আলী বাড়ি থেকে বের হলেন।

বউ বললেন, করেন কী! কই যান?

সাহেব আলী বললেন, কোথাও যামু না। ঘটনা কী, মালুম কইরা আহি।

সাহেব আলী একটু একটু করে এগোচ্ছেন। জনতা চিৎকার করছে জয় বাংলা। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, পুরা ঢাকার রাতের আকাশ আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার মনে হলো, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, মালিবাগ গোয়েন্দা অফিস, বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে। আর সব বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাহেব আলীর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি সুইপার কলোনির দোতলায় গেলেন। বড় বউ আর ছেলেপুলেদের বললেন, হুঁশিয়ার থাকো। সবাই মাটিতে শুইয়া থাকো।

আপনেও আহেন। আল্লার দোহাই লাগে, বাইরে যায়েন না।

না। যামু না। একটু বুঝার চেষ্টা করি, কুনহানে কী হইবার লাগছে।

সারা রাত মেঝেতে শুয়ে থেকে কিয়ামতের প্রলয়কাণ্ডের খানিকটা টের পেলেন। শব্দ, আগুন, চিৎকার। ঘুমাতে পারলেন না। এর মধ্যে ছোট ছেলেটা বারবার করে কেঁদে উঠছে। ডর লাগে। ডর লাগে। তার মা তাকে বুকের মধ্যে ঠেসে ধরে থাকেন।

ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহেব আলী বের হলেন। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দিক থেকে রাতে অনেক গোলাগুলির শব্দ এসেছিল। দেখে আসা দরকার। ফাঁড়ির পুলিশদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ খাতির। রোজ রাতে ডিউটি করার সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয়। লাশ উদ্ধার করে মর্গে নেওয়ার সময়ও সাহেব আলীদের ডাক পড়ে।

অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। পুবের আকাশ ফরসা হচ্ছে। পুরান ঢাকার গলির মধ্যে হোটেলগুলোর ছাদে কাক ভিড় করে হল্লাচিল্লা করতে শুরু করেছে। কুকুরের দল ছোটাছুটি করছে অকারণে। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দৃশ্য না দেখাই ভালো ছিল। ১০ জন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ পড়ে আছে। তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত। সেই রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। মেঝেতে রক্ত। চেয়ারে-টেবিলে রক্ত। দেয়ালে গুলিতে ঝাঁঝরা।

সাহেব আলী জানেন না যে বাইরে কারফিউ। তিনি তাঁর সহকর্মীদের ডাকলেন। ঠেলাগাড়ি আনালেন। লাশগুলো তুললেন ঠেলাগাড়িতে। ঠেলে নিয়ে গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানকার লাশঘরে স্তূপ করে রাখলেন মানুষের মৃতদেহ।

শাঁখারীবাজারে এলেন। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। রিকশার পাশে পড়ে আছে রিকশাওয়ালার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। রাস্তার ধারে হাতে ভিক্ষার থালা ধরে পড়ে আছে ভিখারির পা না-থাকা দেহ। জজকোর্টের কোনায় হোটেল রেস্টুরেন্টের সামনে পড়ে আছে লাশ। সব গুলিবিদ্ধ। সুইপারদের সঙ্গে মহল্লাবাসী তরুণ-যুবক-ছাত্ররাও এসে হাত লাগাল। তারা লাশ তুলে রাখলেন। ঠেলাগাড়িতে নিয়ে নামিয়ে দিয়ে এলেন হাসপাতালের লাশঘরে।

রাস্তায় জনতার ভিড় বাড়তে থাকল। এবার মাইকে ঘোষণা আসতে লাগল–কারফিউ। সেনাবাহিনীর গাড়ি অস্ত্র উঁচিয়ে আসতে লাগল পুরান ঢাকাতেও। সাহেব আলী রাস্তা থেকে সরে পড়লেন। সুইপার কলোনিতে গেলেন। গোসল সেরে নিলেন। বিকেল ৫টার দিকে দেখতে পেলেন, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কোর্ট হাউস এলাকায় মিলিটারিরা সার বেঁধে অস্ত্র উঁচিয়ে যাচ্ছে আর গুলিবর্ষণ করছে নির্বিচার, ফায়ারগান দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সামনে যা পাচ্ছে তাতেই। সারা রাত গুলিবর্ষণ চলল। চলল। আগুন লাগানো। রাতের পুরান ঢাকা জ্বলে-পুড়ে অগ্নিকুণ্ড হয়ে গেল। দোজখেও এত আগুন আছে কি না, সাহেব আলীর মনে সন্দেহ।

২৭ মার্চ বেলা একটায় নবাবপুর রোড, ইংলিশ রোডের দোকানে দোকানে আগুন দিতে লাগল মিলিটারিরা। মানুষ ছুটে পালাতে লাগল আগুনের দাহ থেকে বাঁচতে। অমনি চলল গুলি। তাঁতীবাজারের কাছের মন্দিরে শেল বর্ষণ করে সেটাকে গুঁড়িয়ে দিল আর্মিরা।

আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ইংলিশ রোডের আগুন ঘরবাড়ি, দোকান পুড়িয়ে এগিয়ে আসছে সুইপার কলোনির দিকে। সাহেব আলী সব সুইপারকে নিয়ে পানি জমাতে শুরু করলেন। কিন্তু একটু পরে মিলিটারি এদিকায় এসে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই পালাতে শুরু করল।

২৮ মার্চ। রেডিওতে ঘোষণা আসছে, সব সরকারি কর্মচারীকে যোগ দিতে হবে কাজে।

২৯ মার্চ কাল ১০টার সময় ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে ডিউটি রিপোর্ট করলেন সাহেব আলী। কনজারভেন্সি অফিসার ইদ্রিস বললেন, সাহেব আলী। ডোমদের নিয়ে বার হও। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পইড়া আছে। চায়া আছ। ক্যান। সাহেব আলী, বাইর হয়া পড়ো, বাঁচবার চাও তো বারায়া পড়ো। কেউ বাঁচব না, তুমি না আমি না। কাউরে রাখা হইব না, সবগুলানরে কুত্তা বিলাইয়ের লাহান মাইরা ফেলা হইব।

পৌরসভার চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান। তার গলার স্বর আরও চড়া। মেজাজ কামানের মতো গরম। এই হারামজাদারা, চেয়ে আছ। কেন? বের হও। নিকলো, বাহার যাও।

সাহেব আলী বের হলেন। সুইপার ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন, সুইপার ইন্সপেক্টর কালীচরণ, সুইপার সুপারভাইজার পাঞ্চাম, সুইপার ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন–পাঁচজন অফিস থেকে বের হলেন। সাহেব আলীর ডিউটি পড়ল ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটফলে ফেলার। তিনি পরদেশি ডোম, মন্টু ডোম, লেমু ডোম, গোলাপ চান ডোম, দুঘিলা ডোম ও মধু ডোমকে নিয়ে কাজে লেগে পড়লেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১। সাহেব আলীর দল লাশ তুলছে। যেমন করে ঢাকার সোয়ারীঘাটে সকালবেলা ট্রাকে ট্রাকে ইলিশ মাছ আসে, একসঙ্গে ডালা ভরে মাছ নামানো হয়, ট্রাকে রিকশায়-ভ্যানে তোলা হয়, তেমনি করে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর থেকে সাহেব আলী অন্য ডোমদের নিয়ে লাশ বের করে করে ট্রাকে তুলতে লাগলেন। মানুষের লাশ। দুই ট্রাক লাশ তারা তুললেন। সাহেব আলী একটা করে লাশ তুলছেন, আর বোঝার চেষ্টা করছেন, এঁরা কে কী করতেন। তার মনে হলো, কেউ সরকারি কর্মচারী। পুলিশ, আনসার ও পাওয়ারম্যানদের খাকি পোশাক পরা লাশগুলো এরই মধ্যে বিকৃত হয়ে গেছে। লাশ তুলতে তুলতে পরদেশি ডোমের হাতে এক কিশোরীর লাশ উঠল। সম্পূর্ণ নগ্ন। তার শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন, তার বুক থেকে স্তন কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, লজ্জাস্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, নিতম্বের মাংসও কাটা। এরপর আরেকটা নগ্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর। বছর দশেক বয়সী একটা বালিকার উলঙ্গ ক্ষতবিক্ষত লাশ। সারা দেহে বুলেটের আঘাত।

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে এক মেজর ফোন করেছেন পৌরসভায়। রোকেয়া হলের চারদিকে মানুষের লাশের পচা গন্ধ। বসা যাচ্ছে না। এখনই ডোম পাঠিয়ে লাশ তুলে ফেলা হোক।

সাহেব আলীকে বলা হলো, যাও। রোকেয়া হল এলাকায় যাও। ছয়জন ডোম নিয়ে রোকেয়া হলে গেলেন সাহেব আলী। রোকেয়া হলের রুমগুলোয় তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোনো লাশ পেলেন না। চারতলার ছাদের ওপর গিয়ে এক তরুণীর উলঙ্গ লাশ দেখতে পেলেন। সাহেব আলীর সঙ্গে ছিল মিলিটারি সোলজার। সাহেব আলী বললেন, এই ছাত্রীর বডিতে কোনো গুলির চিহ্ন নেই, মাগার মারা ভি গেছে ক্যামনে? সৈন্যটি বিকট শব্দে হেসে উঠল। বোঝে না। আমরা পাকিস্তানিরা এখানে এসেছি তোমাদের কওমের চেহারা বদলে দিতে। আমরা সারা রাত ওকে…

তার দুই দিকের গালে পশুদের কামড়ের চিহ্ন, বুকে দংশনের ক্ষতচিহ্ন। সাহেব আলী একটা রুম থেকে একটা চাদর নিয়ে এলেন। লাশটি ঢেকে দিয়ে নিচে নামালেন। রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকে দেখলেন, পাঁচজন নারীর লাশ আর আটজন পুরুষের লাশ পড়ে আছে। লাশ দেখে মনে হলো মৃত্যুর আগে সবাই বিছানায় শুয়ে ছিল। ডোমরা সেই লাশগুলো তুলল।

তারা ট্রাক নিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সামনে। তিনতলায় অধ্যাপকের কোয়ার্টার। চারটা লাশ পড়ে আছে। সাহেব আলীর মনে হলো, এসব হিন্দু অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলের লাশ। আশপাশের লোকেরা ফিসফিস করে বলল, তার দুই মেয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন।

লাশগুলো স্বামীবাগ আউটকলে ফেলে দিয়ে তারা ট্রাক নিয়ে চললেন বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে। ভাসমান হাত-পা, চোখবাধা অসংখ্য যুবকের লাশ পানিতে ভাসছে। ৩০ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে তিন ট্রাক লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটকলে ফেলেছে সাহেব আলীর দল। পাকিস্তানি সেনারা শ্রমিক লাগিয়ে আগেই সেখানে বিরাট বিরাট গর্ত করে রেখেছিল। ৩১ মার্চ সাহেব আলীর দল মোহাম্মদপুর এলাকার জয়েন্ট কলোনির কাছ থেকে সাতটা পচা-ফোলা লাশ তুলল। ইকবাল হলে কোনো লাশ পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল লাশপোড়া ছাইভস্ম। পাকিস্তানি সেনারা আগেই ইকবাল হলের লাশ পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিয়ে রেখেছে। তারা আরও দশটা লাশ তুলেছে জগন্নাথ হল এলাকায়। সাহেব আলীর মনে হয়েছে, এরা বস্তি এলাকা থেকে জগন্নাথ হলে আশ্রয়ের জন্য ছুটে এসেছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি।

ফেরার পথে ঢাকা হলের ভেতর থেকে চারজন ছাত্রের উলঙ্গ লাশ তুললেন তারা। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল কচুক্ষেত, ড্রাম ফ্যাক্টরি, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, দ্বিতীয় রাজধানী এলাকার ঢাকা বিমানবন্দরের ভেতরের এলাকায়, ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেকে কয়েকটা পচা লাশ তুলেছিলেন।

এরপর প্রতিদিন তাদের তুলতে হয়েছে লাশ। প্রতিদিন। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় থেকে হাত-পা, চোখবাধা অসংখ্য মানুষের লাশ তাঁরা তুলতেন। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজের হল থেকে ১০ জন ছাত্রের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছেন। রায়েরবাজার রাস্তা, পিলখানা, গণকটুলী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, এয়ারপোর্ট রোডের পার্শ্ববর্তী এলাকা, তেজগাঁও মাদ্রাসা থেকে অসংখ্য মানুষের পচা-ফোলা লাশ তাদের তুলতে হয়েছে। তার মনে থাকবে যে অনেক লাশের হাত-পা পেয়েছিলেন, মাথা পাননি। মেয়েদের লাশগুলো ছিল উলঙ্গ ও ক্ষতবিক্ষত।

একদিন তাকে হুকুম করা হলো সাধনা ঔষধালয়ে যেতে হবে। লাশ সরাতে হবে। সাহেব আলী ডোমদের নিয়ে গেলেন স্বামীবাগের সাধনা ঔষধালয়ের কারখানায়। গিয়ে দেখতে পেলেন, ঔষধালয়ের মালিক প্রফেসর যোগেশ চন্দ্রের লাশ। বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত তাজা লাশ তুলে কাঁদতে কাঁদতে তারা স্বামীবাগ ফেলে দিয়ে এলেন। যোগেশবাবুর লাশ জিব বের করে হাঁ হয়ে ছিল। গায়ে ছিল ধুতি আর গেঞ্জি।

রাতের বেলা বড় বউয়ের কাছে গিয়ে সাহেব আলী হাঁসফাঁস করেন। ছোট বউয়ের কাছে এলেও ঘুমাতে পারেন না। উঠে বসে থাকেন।

ছোট বউ বলেন, কী হইল আপনার। তড়পান ক্যান?

সাহেব আলী কথা বলেন না।

ও গো। তোমার হইছেটা কী? আমারে কও।

সাহেব আলী বলেন, বিবি, লাশ।

আরে মরার কথা হুনো। তুমি সুইপার। ডোম গো লইয়া তোমার কাম। তুমি লাশ দেখবা না।

সাহেব আলী কাঁদতে থাকেন, লাশ আর লাশ। মরদ পোলার লাশ, জোয়ান পোলার লাশ, যুবতী মাইয়া গো উলঙ্গ লাশ। লাশে লাশে নদীর পানি পুরা ঢাইকা রইছে। পানি দেখা যায় না। খালি লাশ আর লাশ। জন্তু জানোয়ারের না। মাইনষের লাশ…।

বউ নরম হন, কাইন্দেন না গো। কাইন্দেন না। আল্লাহর কাছে বিচার দ্যান। আল্লাহ বিচার করব। আল্লাহ বিচার করব।

মমিনুল হক খোকা মোহাম্মদপুরের বাসায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন শেষ রাতে। ক্যালেন্ডারে তখন ২৭ মার্চ ১৯৭১। তাঁর স্ত্রী মমতাজও ঘুমাতে পারছিলেন না। এই রাতে ঘুমানো যায়?

উঠে পড়লা যে? মমতাজ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলতে থাকা টেবিলঘড়ির রেডিয়াম কাটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কটা বাজে।

ঘুমাতে পারছি না। অস্থির লাগছে। খোকা বিছানায় বসে দুই পা মেঝেতে রেখে বললেন।

আমারও ভালো লাগছে না। বুকটা কাঁপছে।

কাল রাতে বিবিসিতে বলল, মিয়া ভাই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

হ্যাঁ। আমিও তো শুনলাম।

৩২ নম্বরের দিকে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। জানি না মিয়া ভাই কেমন আছেন। ভাবি কেমন আছে। ছেলেমেয়েগুলান কে কেমন আছে। বেঁচে আছে। নাকি মারা গেছে।

আল্লাহ মাফ করুক। মারা যাবে কেন।

মিয়া ভাই আমাকে বলেছে ভাবি-ছেলেমেয়েদের দেখতে। আমি যাই।

কই যাবা?

৩২ নম্বরে।

কারফিউ না বাইরে?

বড় রাস্তা দিয়া যাব না। গলির ভিতর দিয়া দিয়া যাব।

যাবা যদি, একটা টুপি পরে নাও। আর্মি ধরলে বলবা, নামাজ পড়তে যাচ্ছ।

আচ্ছা। দাও একটা টুপি। ওই যে আলনার বাম দিকে দেখো।

মমিনুল হক খোকা মোহাম্মদপুরের নিউ কলোনি থেকে বের হলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঢুকে পড়লেন লালমাটিয়ার রাস্তায়। আকাশ তখনো অন্ধকার। রাস্তার লাইটপোস্টের ঝুলে থাকা বাল্ব সেই অন্ধকার তাড়াতে পারছে না। আকাশে মেঘ। একটু ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাস্তায় কুকুরেরা হল্লা করছে। তিনি একটা গলির ভেতরে ঢুকে গেলেন। পুরো ভুতুড়ে পরিবেশ। কোথাও জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। খোকা রাস্তা ছেড়ে একটা দেয়াল টপকে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। তারপর সেই বাড়ির লন উঠান পেছনের বাগান পেরিয়ে আবার টপকালেন আরেকটা প্রাচীর।

এইভাবে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। লালমাটিয়া থেকে এবার যেতে হবে ধানমন্ডি এলাকায়। মধ্যখানে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের বড় রাস্তা। এটা পার হওয়াই কঠিন। তিনি ডানে তাকালেন। বাঁয়ে তাকালেন। রাস্তার একটা জায়গায় বাতি নেই। অন্ধকারটা ওই জায়গায় বেশ গাঢ় হয়ে আছে। ওই জায়গা দিয়েই দ্রুত রাস্তাটা পার হতে হবে তাকে।

দেয়াল টপকে টপকে অন্ধকার জায়গাটায় গিয়ে বড় রাস্তার উত্তর পাশে একটা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলেন খোকা। তার বুকের শব্দ তিনি নিজেই শুনতে পাচ্ছেন। দম নিলেন। ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। এই সুযোগ। আল্লাহর নাম নিয়ে মাথা নিচু করে তিনি এক দৌড়ে রাস্তার দক্ষিণ পাশের বাড়ির সামনে প্রাচীরের ধারে কামিনী ফুলের ঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিলেন।

.

ধানমন্ডির বেশির ভাগ বাড়ি এক বিঘা জমির ওপরে। চারদিকে অনুচ্চ পাঁচিল। গাছপালা, বাগান। একতলা বাড়িই বেশির ভাগ। সেসব দেয়াল টপকানো তেমন কষ্টের কিছু নয়। শুধু ভয়, বাড়িতে না আবার কুকুর থাকে! বিওয়্যার অব ডগস দেখলে সেই বাড়ি এড়াতে হবে।

এইভাবে অতিকষ্টে প্রথমে তিনি পৌঁছালেন আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায়। ততক্ষণে আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। কাকেরা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। খানিকক্ষণ দম নিয়ে খোকা গলি-ঘুপচি, বিভিন্ন বাড়ির কোমর অবধি বানানো দেয়াল, বাড়ির সামনে-পেছনে, চারদিকে বিস্তারিত বাগানের গাছপালার আড়াল ধরে ৩২ নম্বর সড়কে বাহাউদ্দিন সাহেবের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালেন। তারা জেগে উঠেছেন।

মিসেস বাহাউদ্দিন ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কে?

ভাবি, আমি খোকা। মমিনুল হক খোকা।

আপনি? কই যান?

মুজিব ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয়েছি।

ঘরে আসেন। কথা আছে!

মমিনুল হক খোকা এগিয়ে গেলেন। একটার পর একটা পাঁচিল টপকানোর ধকলে তিনি ক্লান্ত এবং ঘর্মাক্ত। মিসেস বাহাউদ্দিনের চোখের নিচে কালি। ঘরে পরা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে তিনি ফিসফিস করে বললেন, খোকা ভাই। রাতের বেলা কামাল এসেছিল। মহিউদ্দিন এসেছিল। দেয়াল টপকে টপকে ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে এসেছিল। রাতে আমার এখানে ছিল। ভোরবেলা চলে গেল। কোথায় গেল তা তো বলে গেল না!

খোকা খানিকক্ষণ বসলেন। দম নিলেন। মিসেস বাহাউদ্দিন তাকে পানি এনে দিলে তিনি ঢক ঢক করে গেলাস খালি করলেন। তারপর উঠলেন। আবারও দেয়াল টপকে টপকে বড় রাস্তা এড়িয়ে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়ার অভিযানে নেমে পড়লেন তিনি।

৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির পাশের বাড়িতে এসে পৌঁছালেন মমিনুল হক খোকা। এই বাড়িটা গাছগাছালিতে ঢাকা। আমগাছের নিচে মুকুল ঝরে পড়ে আছে। একটা বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। এদিক ওদিক তাকালেন তিনি। কোথাও আর্মি-পুলিশ দেখলেন না। আরেকটা দেয়াল টপকে গেলেন মিয়া ভাইয়ের ৬৭৭ নম্বর দোতলা বাড়িটির সামনে। পোড়োবাড়ির মতো পড়ে আছে বাড়িটা। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন খোকা। এগিয়ে গেলেন। দরজা খোলা। বারান্দা পেরোলেন। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। এখানে-ওখানে গুলির খোসা। দেয়ালে গুলির দাগ। বারান্দায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

বাড়িতে কেউ নেই। নিজের পায়ের আওয়াজ নিজেই পাচ্ছেন।

বাইরে এলেন। কবুতরগুলো বাকবাকুম করছে। তাকে দেখামাত্র জামালের কুকুর দুটো ছুটে এল। তার পায়ের কাছে এসে মিনতি করে কী যেন বলতে চাইল। আর দেখতে পেলেন খাঁচার মধ্যে একটা বানর। কাল পুরোটা দিন গেছে, ২৬ মার্চ, এদের কেউ খেতে দেয়নি। খোকাকে দেখে বানরটা কুঁই কুঁই করতে লাগল। তার চোখে মিনতি। খোকা কেঁদে ফেললেন। বাড়িতে কেউ নেই। কে কোথায়? কামাল গিয়েছিল বাহাউদ্দিনের বাড়িতে। সে জীবিত আছে। মিয়া ভাই কোথায়? ভাবিরা কে কোথায়?

পাশের বাসার লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। তিনি ডা. সামাদের বাড়ির দেয়াল টপকে তাতে ঢুকে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন। বাড়ির নিচতলার প্রবেশমুখে। ভেতরে প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

সামাদ সাহেবের ছেলে বাবু এগিয়ে এলেন। বললেন, চাচা, আপনি দেয়াল টপকে আসছেন কেন? কারফিউ তো এখন উইথড্র করেছে। চারটা পর্যন্ত কারফিউ থাকবে না। তারপর আবার কারফিউ।

খোকা বললেন, ভাবিদের খোঁজে এসেছি।

ওনারা আমাদের বাসায় আছেন। আসেন। বাবু শার্টের বোতাম ঠিক করতে করতে বললেন।

ভাবিরা এই বাসায় আছে! খোকার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। তিনি এগিয়ে গেলেন।

আকাশ গুমোট। গাছগাছড়ায় বাড়ির নিচতলা অন্ধকার। বাইরের ঘরেই বসে আছেন রেনু, জামাল, রাসেল।

খোকাকে দেখেই রেনু হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন, ভাইডি, তুই আসছিস!

রেনুর কান্না আর থামে না। ভাইডি, কত যে গোলাগুলি করল বাড়িতে, তোর মিয়া ভাইকে ধরে নিয়ে গেল!

জামাল বললেন, এই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।

রেনু বললেন, ভাইডি। আমরা কোথায় যাব?

খোকা বললেন, কারফিউ তুলে নিয়েছে চারটা পর্যন্ত। আমি তাহলে আমার গাড়িটা আনি। আপনাদের নিয়ে যাই।

জামাল বললেন, কই নিয়ে যাবেন। আপনার বাসাও নিরাপদ হবে না। রেডিওতে শুনলাম, সারা দেশে মিলিটারি পাগলা কুকুরের মতো মানুষ মারছে। সবাইকে অ্যারেস্ট করছে। আপনার বাড়িতেও মিলিটারি হামলা করবে।

খোকা বললেন, গাড়ি নিয়ে আসি। জাকি ভাইয়ের বাড়িতে আমার গাড়ি আছে। আমি যখন এসে গেছি, আর কোনো চিন্তা করিস না।

খোকা উঠলেন। দ্রুতপায়ে হেঁটে ৩২ নম্বরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রিকশা-বেবিট্যাক্সি কিছুই নেই।

এই সময় রাস্তায় একটা গাড়ি দেখা গেল। গাড়িটা এদিকেই আসছে। খোকার সামনে এসে গাড়িটা ভটভট শব্দ তুলে থামল। ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলেন তারেক। খোকা চিনতে পারলেন গাড়ির চালককে, শেখ কামালের বন্ধু। তিনি বললেন, চাচা, কোথায় যাবেন? চলেন আমি নামিয়ে দিয়ে আসি।

তারেক। জামাল, রাসেল, ভাবি আছে। তাদেরকে নিয়ে চলো তো একটু ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের দিকে যাই।

আচ্ছা। চলেন।

খোকা দৌড়ে ডা. সামাদ সাহেবের বাড়ির ভেতরে গেলেন। বললেন, ভাবি, একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। আসেন আসেন। তাড়াতাড়ি আসেন।

রেনু, জামাল, রাসেল বসল গাড়ির পেছনে। সামনে তারেকের পাশে বসলেন খোকা। বললেন, ২ নম্বরের দিকে চলো।

খোকার চিন্তাটা হলো, ২ নম্বরে তার বন্ধু ও আত্মীয় মোরশেদ মাহমুদের বাসা। সেখানে যাওয়া যেতে পারে।

তারেক ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে মোরশেদ মাহমুদের বাসার সামনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

খোকা বাড়ির দোরঘণ্টি বাজালেন।

মোরশেদ মাহমুদ দরজা খুললেন। তারা ভেতরে ঢুকে দেখলেন, সবাই বাক্সপেটরা বাধছে। ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে।

রেনু অসহায়ের মতো তাকালেন খোকার দিকে। এরা নিজেরাই তো চলে যাচ্ছে। আমরা কী করে থাকব, ভাইডি।

খোকা বললেন, আপনারা এই বাসাতেই একটু বসেন। আমি আমার গাড়িটা আনি।

খোকা গাড়ি আনতে গেলেন। রেনুর মনে দুশ্চিন্তা কত রকমের। হাসুর আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কেউ জানে না। হাসু-রেহানাই-বা কোথায় আছে, কী করছে! কামাল রাতের বেলা একবার এসেছিল। ২৭ মার্চ ভোর রাতের দিকে। এ-বাড়ি ও-বাড়ির দেয়াল টপকে, মানুষের বাড়ির পেছন দিয়ে, বাগানের গাছগাছালির ভেতর দিয়ে সে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিল। গিয়ে যখন সে দেখতে পেয়েছিল, বাড়িতে কেউ নেই, তখন বুদ্ধি করে সে চলে এসেছিল ডাক্তার সাহেবের বাসায়। সেখানে গিয়ে সে মা, জামাল আর রাসেলের দেখা পেয়েছিল।

এরপর একসময় কামাল বলেছিল, মা, বাসায় কিছু জরুরি জিনিসপত্র আছে। আমি একটু আমার ঘরে যাই। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসি।

তখন কারফিউ চলছে। কামাল দেয়াল টপকে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ঢুকেছিল। তার পরপরই বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। বাইরে পাকিস্তানি মিলিটারির বহর পাহারা দিচ্ছিল। বাড়ির ভেতরে মানুষের নড়াচড়া টের পেয়ে তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিয়েছিল।

রেনু তখন ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে জায়নামাজে বসে আল্লাহকে ডাকছেন, হে আল্লাহ, কামালকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ, কামালকে রক্ষা করো। কিছুক্ষণ পরে গোলাগুলি থেমে গিয়েছিল।

জামাল আর সঙ্গী কিশোর বয়সী গৃহপরিচারক আবদুল ডাক্তার সাহেবদের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বোঝার চেষ্টা করছিল মিলিটারি আছে কি নেই। আবদুলের সাহস বেশি। দেখতেও সে ছোটখাটো। সে আরেকটু সামনে এগিয়েছিল। একটা বকুল ফুলের ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে এদিক-ওদিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, না, সামনে কেউ নেই। মিলিটারিরা চলে গেছে। জামাল গুলির খোসা কুড়াচ্ছিলেন।

রেনু বলেছিলেন, এই জামাল, কী করিস। ঘরের ভেতরে আয়।

জামাল বলেছিলেন, কত গুলি যে করেছে। ঝরাপাতার মতো আমাদের বাড়ির চারদিকে গুলির খোসা পড়ে আছে। কিছু কুড়ায়া রাখি।

রেনু বলেছিলেন, পাগল নাকি। কখন আর্মি এসে পড়ে। ঘরে আয়।

জামাল বলেছিলেন, আর্মির গাড়ি চলে গেছে। শুধু দূরে গার্লস স্কুলের ছাদে এলএমজি ফিট করে রেখেছে।

রেনু বলেছিলেন, তাইলে আমি একটু বাসায় ঢুকব। কামাল জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য বাসার দিকে যে গেল, তারপরেই তো গুলি শুরু হলো। জানি

সে বাইচে আছে নাকি মারা গেছে। কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকটা কেঁপে উঠেছিল, গলায় কান্না চলে এসে দলা পাকাচ্ছিল। কী ভয়াবহ উকণ্ঠাভরা মুহূর্ত একেকটা। তপ্ত লোহা গলে গলে পড়ে যেমন করে, তেমনি করে যেন একেকটা সেকেন্ড তার মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। কামাল ওই বাসায়, আর গগনবিদারী শব্দ করে গুলির এসে বিদ্ধ করছে তাদেরই সেই বাসার দেয়াল, ভেঙে পড়ছে কাঁচের জানালা। সেলাই মেশিনের সুইয়ের মতো গুলি এফেঁড়-ওফোড় করছে তাদের বাড়ির দেয়াল, দরজা, জানালা, ছাদবারান্দা।

রেনু দেয়াল টপকে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। দরজা সিলগালা করে দিয়ে গেছে। তিনি এ-ঘর ও-ঘরের বারান্দা দিয়ে ভেতরে তাকিয়েছিলেন। কামালের ঘরের জানালার কাঁচ নেই। কাঁচের গুড়া পড়ে আছে বারান্দায়। তিনি ভেতরে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখছিলেন। না, কোথাও কামাল নেই। তিনি মেঝেতে বিছানায় ভালো করে তাকালেন। কোথাও লাশ পড়ে নেই তো! এই চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে শরীর-মন অবশ। হয়ে গিয়েছিল। না, লাশের মতো কিছু দেখা যায়নি। রক্তের দাগও না। শুধু ২৫ মার্চ রাতের রক্তচিহ্নগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে ছিল নিচতলায়। নতুন করে রক্তপাত ঘটেনি এ বাড়িতে।

.

কামাল কোথায় গেল? এই দুর্ভাবনা অক্টোপাসের মতো রেনুকে চারপাশ থেকে জাপটে ধরে থাকে। মোরশেদ মাহমুদের বাসার ড্রয়িংরুমে সোফায় রাসেলকে কোলে করে বসে আছেন তিনি। ওদের বাঁধাছাদা, তৈরি হওয়ার ব্যস্ততার দিকে একবারের জন্য অসহায় দৃষ্টি মেলে ধরে নিজের ভাবনার জগতে ডুবে থাকেন রেনু। এত উদ্বেগ, এত অনিশ্চয়তা, এত আতঙ্ক। মাথা ঠিক রেখে কোনো কিছু চিন্তাও তো করা যাচ্ছে না।

খোকা গাড়ি নিয়ে এসেছেন, ভাবি, ওঠেন।

ভাইয়েরা, তাহলে আসি। মোরশেদ মাহমুদের বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মমিনুল হক খোকার গাড়িতে উঠলেন রেনু, জামাল, রাসেল।

রেনু বললেন, কামাল বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিছুই জানি না। তোর কি মনে হয় ভাইডি, কামাল বেঁচে আছে তো, তাই না?

খোকা বললেন, আল্লাহকে ডাকেন ভাবি। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।

রেনু বললেন, আবদুলকে বলেছি বানরটাকে আর গরুগুলোকে ছেড়ে দিতে।

জামাল বললেন, আবদুল গরু ছেড়ে দিয়েছে। বানরটাকেও ছেড়ে দিয়েছে। বানরটাকে আমরা আমাদের সাথে আনতে পারতাম।

রেনু বললেন, মানুষই বাঁচে না আর বানর। ছেড়ে দিলে বানরটা হয়তো বাঁচবে। আমাদের সাথে থাকলি না-ও বাঁচতে পারে।

গাড়ি চলছে। ঢাকার রাস্তায় মানুষ বনপোড়া হরিণপালের মতো দৌড়াচ্ছে। যে যেখানে পারছে, সরে যাচ্ছে।

জামাল বললেন, চাচা, আমরা কই যাব?

মমিনুল হক খোকার স্টিয়ারিংয়ে এক হাত, গিয়ারে আরেক হাত, তিনি বা হাতটা শূন্যে নেড়ে বললেন, জানি না রে। একটা কাজ করতে পারি। রহমানের বাসা যেতে পারি। ১৫ নম্বরে থাকে।

রেনু বললেন, বশীরের ওখানে?

মমিনুল হক খোকা মাথা নাড়লেন, জি ভাবি।

.

ব্যাঙ্গমা বলল, এইহানে আমরা বানরটার কথা খানিক কইয়া লইতে পারি।

ব্যাঙ্গমি বলল, হ। তা তো পারিই।

ব্যাঙ্গমা বলল, শেখ মুজিবের বাড়ির সাথেই আরেকটা বাড়ি আছিল, জাপানি কনসাল জেনারেলের বাড়ি। তার নাম আছিল হিগাকি। হিগাকি তো ২৫ মার্চ-২৬ মার্চের গোলাগুলির মধ্যে পইড়া ভ্যাবাচেকা খাইছেন। একটাই সুবিধা আছিল, বউ-বাচ্চারে আগেই জাপান পাঠায়া দিছিলেন। ২৭ তারিখে কারফিউ তুইলা দিলে তিনি উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করলেন। ৬৭৭ নম্বর বাড়ি থাইকা শেখ সাহেবরে ধইরা নিয়া গেছে, এইটা তিনি খোঁজখবর পাইলেন নিজের বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভার, নানাজনের কাছ থাইকা।

এইবার তিনি ছাদে উইঠা শেখ সাহেবের বাড়ি আগাগোড়া নিরীক্ষণ করলেন। গুলির খোসা তার বাড়ির ছাদেও পাওয়া গেল। শেখ সাহেবের বাড়ির পায়রাগুলো উড়তাছে, ছাদে বসতাছে, সানশেডে বসতাছে, তারা তাগো মালিকরে খুঁজতাছে। আহা! রোজ শেখ সাহেব কবুতরগুলারে খাইতে দিতেন। হিগাকি নিচে তাকাইলেন। গরুগুলা নাই। ওই ওইখানে বাথানে গরু বান্ধা থাকে। ওই চাড়িতে গরুগুলান পানি-খইল খায়। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা বাঁদর। একটা সানশেডে বইসা অসহায়ভাবে তাঁর দিকে চায়া আছে।

তিনি কইলেন, আবুল কাশেম। একটা কাজ করো। ওই বানরটা শেখ সাহেবের বড় প্রিয় ছিল আমি জানি। না খেতে পেয়ে বানরটা মারা যাবে–এটা আমি চাই না। ওকে আমাদের মেহমান করে নিয়ে এসো।

চৌকিদার আবুল কাশেম তাই করল। দুটো পাকা কলা (দুদিন আগে কেনা, পাইকা গইলা গেছে) হাতে নিয়া দেয়াল টপকায়া নাইমা গেল পোড়োবাড়ি ৬৭৭-এ। বানরটার দিকে আবুল কাশেম কলা বাড়ায়া ধরতেই সে দুই লাফে সানশেড থাইকা নাইমা আবুল কাশেমের বাড়ায়া ধরা হাতে বসল।

এরপর থাইকা বানরটা জাপানি কনসাল জেনারেল হিগাকি সাহেবের কাছেই থাইকা যায়। মেহমান হিসেবে বানরটা ভালোই খাতির-যত্ন লাভ করে।

ব্যাঙ্গমি বলল, কিন্তু হিগাকি সাহেব জানেন না, তার বাড়ির ভিতরে একটা তেঁতুলগাছ আছিল, ভীষণ ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ, তার তলাটা আছিল ঘন অন্ধকার, সেই অন্ধকার গাছের নিচে আরও আরও গাছপালা, লতাগুল্মের মধ্যে দুই ঘণ্টা নিজেরে লুকায়া রাখছিলেন শেখ কামাল। নিজের বাড়িতে যাওনের পর যখন মিলিটারির গুলির মধ্যে পড়লেন, তিনি লাফায়া দোতলা থাইকা প্রথমে একতলার ছোট ছাদে নামেন। সেইখান থাইকা আরেক লাফ দিয়া নামেন গ্যারেজের ছাদে। তারপর আরেক লাফ দিয়া রান্নাঘরের চাল। সেইখান থাইকা আরেক লাফ দিয়া তিনি নামেন জাপানি কনসালের বাড়ির ভিতরে। সেইখানে তেঁতুলগাছের গায়ের সাথে গা লাগায়া তিনি বইসা থাকেন টানা দুই ঘণ্টা। তখন মাথার ওপর দিয়া শা শাঁ কইরা গুলি উইড়া যাইতাছে।

.

মমিনুল হক খোকা গাড়ি ঘোরালেন ধানমন্ডি ১৫ নম্বর সড়কের ক্যাপ্টেন বশীর রহমানের বাড়ির গেটের দিকে। গেটে দারোয়ান ছিল, উঁকি দিল, খোকা গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলে দারোয়ান তাকে চিনতে পারল, লোহার গেট ঠেলে খুলে দিল। খোকা গাড়ি বাড়ির ভেতরে নিলেন।

গাড়ি থেকে নামলেন রেনু, জামাল, রাসেল, খোকা। বেল টিপতেই বেরিয়ে এলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন রহমান। তিনি এঁদের আগে থেকেই চিনতেন, সাদরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

এরই মধ্যে দারোয়ানের মুখে শোনা গেল, ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের কাছে পড়ে আছে একটা লাশ। কার লাশ কেউ বলতে পারে না। তবে লোকে বলাবলি করছে, শেখ কামাল মারা গেছে।

শুনে রেনু মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন, কামাল রে, তুই কই গেলি রে…।

মমিনুল হক বের হলেন ঘটনা কী তা জানার জন্য। বললেন, ভাবি, আমি খোঁজ নিতে বের হচ্ছি, কামাল কই আছে, সেটাও বের করব। হাসিনা রেহানাদের ওখানেই যাই। ওদের খবরও তো জানা দরকার।

হাসিনার তো ভালো খাবারদাবার দরকার। একটু বিশ্রাম দরকার। ভালো রকমের একটা বিছানা পেলেও তো তিনি খানিকটা জিরিয়ে নিতে পারতেন। ওয়াজেদ মিয়া উদ্বিগ্ন বোধ করেন। কাল সারাটা দিন গেছে একই খিচুড়ি খেয়ে। আজকে সকালেও আর কোনো উপায় নেই। খিচুড়িই চুলায় বসাচ্ছে। পাগলা।

রেহানা বারবার বারান্দায় যাচ্ছেন। আকাশ মেঘলা। বাইরের আকাশ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, বেলা বাড়ছে। হঠাৎই ডোরবেল বাজার শব্দ।

রেহানা এগিয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন স্বপ্ন দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা জগ। বললেন, মা পাঠিয়েছেন। হাসিনা আপার জন্য। দুধ।

রেহানা দরজা খুললেন।

স্বপ্ন বললেন, কারফিউ উইথড্র করেছে।

ওয়াজেদ মিয়াও এগিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, কারফিউ উইথড্র করেছে! তাহলে চলো, আমরা ৩২ নম্বরে যাই।

হাসিনা বললেন, হ্যাঁ। সেটাই ভালো।

জেলি বললেন, আমি একটু দুধটা গরম করে দিই।

স্বপ্ন বললেন, গরম করতে হবে না। জ্বাল দেওয়া দুধ।

পাগলা একটা গেলাস এগিয়ে দিল। স্বপ্ন তাতে দুধ ঢেলে হাসিনার দিকে। এগিয়ে ধরলেন।

পাগলা বলল, কারফিউ নাই। আমি ৩২ নম্বর গেলাম। আম্মা, রাসেল ভাই আর সাহেবের খবর আগে লই। তারপর বাকি কথা। সে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

ওয়াজেদ মিয়া বাইরে বের হয়ে একটা ধাক্কামতো খেলেন। গেটের সামনে দুটো মিলিটারি জিপ। জলপাই রঙের জিপে সশস্ত্র সৈনিকদের মনে হচ্ছে যমদূত। গাড়িটা গ্যারেজে। সেখানে যেতে হলে গেটের বাইরে মিলিটারি জিপ পার হয়ে যেতে হবে। ওয়াজেদ মিয়া সাহস করে এগোলেন। মিলিটারিদের বললেন, এই গ্যারেজে আমার গাড়ি আছে।

মিলিটারিরা তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দিল।

ওয়াজেদ মিয়া গ্যারেজের দরজা খুললেন। ভেতরে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা আর কাঁচের মধ্যে জয় বাংলা পোস্টার। বাড়ির ভেতর থেকে পানি আর ন্যাকড়া এনে পোস্টার তুললেন ঘষে ঘষে। বাংলাদেশের পতাকা খুলে ফেললেন। তারপর গাড়ি এনে রাখলেন বাড়ির সিঁড়ির সামনে।

হাসিনা, রেহানা, জেলি গাড়িতে উঠে বসলে ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি স্টার্ট দিলেন। প্রথমে তারা গেলেন ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে। বাড়ি সিলগালা করা। ভেতরে ঢোকা গেল না।

গাড়ির শব্দ পেয়ে ডাক্তার সাহেবের বড় ছেলে বেরিয়ে এলেন তাঁদের বাসা থেকে। বললেন, আপনারা বাসার ভেতরে আসুন।

ডাক্তার সাহেব ছিলেন। তিনি বললেন, মিনিট পাঁচেক আগে খোকা ভাই এসেছিলেন। তিনি ভাবি, জামাল, রাসেলকে নিয়ে গেছেন। ধানমন্ডি ২ নম্বরের দিকে গেছেন।

রেহানা বললেন, খোকা চাচার বন্ধুদের বাসা আমি চিনি। ২ নম্বর রোডে তাঁর খুব খাতিরের বন্ধু আছে। চলেন আমরা সেখানে যাই। যদি খোঁজ পাওয়া যায়।

২ নম্বরে ঠিক বাসাতেই গেলেন ওয়াজেদ মিয়া। শুনতে পেলেন একটু আগে খোকা এখান থেকে চলে গেছেন বেগম মুজিবদের নিয়ে। এইখানে তো সারা রাত গোলাগুলি হয়েছে। কাছেই পিলখানা। একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র। হয়ে গিয়েছিল এই রাস্তাটা। আমরা চলে যাচ্ছি গ্রামে।

একজন বললেন, কামাল ভাই মারা গেছে জানো। ৮ নম্বরে লাশ পড়ে আছে।

আরেকজন বললেন, না না। ওইটা কামাল না। পানাউল্লাহ সাহেবের ছেলে খোকনের লাশ। ও রাতে ওখানে ব্যারিকেড দিচ্ছিল। তখন মারা গেছে।

হাসিনা, রেহানা, জেলি পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে যে কামাল মারা যাননি। কারণ, ওমর ভাই খোঁজ দিয়ে গেছেন। কামাল ভাই-ই তাকে পাঠিয়েছিলেন।

হাসিনা বললেন, মা তো আমাদের খোঁজে আমাদের ভাড়া করা বাড়িতেও যেতে পারে। চলো, ওই বাড়ির দিকে যাই।

রেহানা বললেন, হ্যাঁ। তা-ই হতে পারে। মা আগে আমাদের খোঁজ নিশ্চয়ই নিতে যাবেন।

ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি চালাতে শুরু করলেন।

১৫ নম্বর সড়কের ভাড়া বাসার কাছে যেতেই হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল, হাছু আপা, দেনা আপা, দুলাভাই…

রাসেলের গলা। ওয়াজেদ মিয়া ব্রেক কষলেন। ১৫ নম্বরে ক্যাপ্টেন রহমান সাহেবের দোতলায় রাসেল।

সামনে দেখা গেল খোকা চাচার গাড়ি।

সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দোতলায় গেলেন।

বেগম মুজিব ওরফে রেনু মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি প্রলাপ বকছেন। ওয়াজেদ সাহেবকে দেখে তিনি বললেন, বাবা, ওরা কামালকে মেরে ফেলেছে।

রেহানা বললেন, মা, যে লাশটাকে সবাই কামাল ভাই ভাবছে, ওইটা কামাল ভাই না। খোকন ভাই। তুমি কান্নাকাটি কোরো না। কামাল ভাই খবর দিয়ে ওমর ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। উনি ভালো আছেন।

রেনু বললেন, ও বাসায় ঢোকার পর যা গুলি করেছে, কেমনে বেঁচে থাকে!

ঠিক এই সময় আবার ডোরবেল বেজে উঠল। দেখা গেল, কামাল এসেছেন।

রেনু মেঝেতে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। জড়িয়ে ধরলেন কামালকে। বললেন, তোদের আব্বাকে তো আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ করতে পাঠাইছি, তোরা আমার বুকটা খালি করিস না।

ক্যাপ্টেন রহমান তার স্ত্রীকে বললেন, সবার জন্য নাশতার আয়োজন করো। এই জয়নাল, দ্যাখ তো দোকানপাট কিছু খুলছে নাকি। দুইটা রেজর কিনে আন। না পেলে ব্লেড আন। কামাল, খোকা, তোমরা তোমাদের গোঁফ শেভ করে ফ্যালো।

একটু পরে এলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা।

.

ওয়াজেদ মিয়ার চিন্তা হলো, কে কোথায় থাকবে। সবাই একসঙ্গে থাকা যাবে না।

খোকা বললেন, ভাবি রাসেল জামালকে নিয়ে আমি ওয়ারীতে যাই। শ্বশুরবাড়িতে উঠি। পরে চিন্তা করে বের করা যাবে কোথায় আশ্রয় নেওয়া যাবে।

রেহানা বললেন, আমিও মার সঙ্গে থাকব। মাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, আমার অফিসের কলিগ ড. মোজাম্মেলের বাসা আছে খিলগাঁওয়ে। গ্রামের দিকের ওই বাসায় সহজে মিলিটারি যাবে না। আমি, হাসিনা ওই বাসায় থাকতে পারি। আমি একটু গিয়ে দেখে আসি, ওই বাসার কী অবস্থা।

হাসিনা বললেন, আচ্ছা যাও। দেখে আসো।

ওয়াজেদ মিয়া বের হলেন। টেবিলে নাশতা সাজানো হচ্ছিল। তা খাওয়ার সময় নেই। বিকেল ৪টা থেকে আবার কারফিউ।

ওয়াজেদ মিয়া রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন। মানুষ ছুটছে। মানুষ পালাচ্ছে। বোচকাঁপাতি নিয়ে, সন্তান কোলে, বাক্সপেটরা ঘাড়ে চেপে, হেঁটে, রিকশায়, ঠেলাগাড়িতে, গরুর গাড়িতে, গাড়িতে, বেবিট্যাক্সিতে, ট্রাকে, বাসে মানুষ পালাচ্ছে। দুই ধারে পোড়া ঘরবাড়ি। এখানে-ওখানে পড়ে আছে লাশ।

রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার পুড়ে ছাই। এখনো কোনো কোনো কাঠ থেকে, কয়লা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। পেট্রলপোড়া গন্ধ, বোমা-বারুদের গন্ধ, বাড়িঘর পোড়া গন্ধ, মানুষপোড়া গন্ধ।

ওয়াজেদ সাহেব গাড়ি চালাচ্ছেন। তার শরীর শিউরে উঠছে দুপাশের নারকীয় পরিস্থিতি দেখে।

খিলগাঁওয়ের রাস্তার দুই ধারে ধানখেত, কলাবাগান। দু-চারটা সদ্য ওঠা বাড়ি। ওয়াজেদ মিয়া তার সহকর্মী ড. মোজাম্মেলের বাড়ির সামনে গাড়ি রাখলেন। ভেতরে ঢুকলেন। এই বাড়িতে মোজাম্মেল সাহেব থাকেন, তাঁর আব্বা-আম্মা থাকেন, আর থাকেন ওয়াজেদ মিয়াদের আরেক কলিগ ড. ফয়জুর রহমান, একটা রুমে। তিনি মোজাম্মেল সাহেবের বোনাই হন।

.

ওয়াজেদ সাহেবের গাড়ি দেখেই সবাই ছুটে এলেন, বঙ্গবন্ধু এখন কোথায়? সবার প্রশ্ন। ওয়াজেদ সাহেব সংক্ষেপে পরিস্থিতি খুলে বললেন। তাঁর স্ত্রী শেখ হাসিনা সন্তানসম্ভবা, তার একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার, এখানে তারা থাকতে পারবেন কি না, এই হলো প্রশ্ন। ফয়জুর রহমান বললেন, ওয়াজেদ ভাই, আপনি এখনই ভাবিকে নিয়ে চলে আসুন। আমার ঘরটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি। একদম অসুবিধা হবে না।

ওয়াজেদ সাহেব তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন ক্যাপ্টেন রহমান সাহেবের বাড়িতে।

হাসিনা, জেলি, চটপট উঠে পড়ো গাড়িতে। আমরা খিলগাঁওই যাচ্ছি। সব ব্যবস্থা করে এসেছি। ফয়জুর সাহেব ঘর ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের। জন্য।

হাসিনা উঠলেন। চলাফেরায় কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু সেটা তিনি কাউকে বলবেন না। মা চিন্তা করবেন।

আপার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলেন রেহানা, আপা, তুমি কোথায় যাচ্ছ। আমরা কোথায় যাচ্ছি। কিছুই তো জানি না। আর কীভাবে দেখা হবে। কীভাবে খোঁজ পাব?

হাসিনা ঠিক করেছেন তিনি কাঁদবেন না। এটা কাদার সময় নয়। তিনি বললেন, মাকে দেখে রাখিস। জেলি, চল।

হাসিনা, জেলি গাড়িতে উঠলেন। ওয়াজেদ মিয়া গাড়ি স্টার্ট দিলেন। রওনা হলেন খিলগাঁওয়ের দিকে। হাসিনাকে মিলিটারি চিনে ফেলতে পারে। আবার রাস্তায় চেকপোস্টে তল্লাশিও হতে পারে। সামনের সিটে ওয়াজেদ মিয়ার পাশে বসেছেন জেলি। পেছনের আসনে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে

আছেন হাসিনা। নানা ঘুরপথে ওয়াজেদ মিয়া কারফিউয়ের আগেই। খিলগাঁওয়ে মোজাম্মেল সাহেবের বাড়িতে পৌঁছাতে সমর্থ হলেন।

.

রাতের বেলা মাদুর পেতে একসঙ্গে খেতে বসেছেন তারা। মোজাম্মেল সাহেবের বোন একটা সাংঘাতিক কথা বললেন–

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মি তাদের কন্ট্রোল রুম থেকে বিভিন্ন ইউনিটকে যে সমস্ত ওয়্যারলেস মেসেজ দিয়েছিল, সেই সবকিছুই তিনি রেকর্ড করে রেখেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরও জানা গেল, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বিভিন্ন দেশের রেডিওতে সেই ঘোষণা আসছে। চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকেও বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।

ব্যাঙ্গমা বলে, মোজাম্মেল সাহেবের বোন যেমন নিজের রেডিওতে শুইনা ফালাইছিলেন পাকিস্তানি মিলিটারি গো ওয়্যারলেস মেসেজ, টিক্কা খানের অ্যাসিস্ট্যান্টও তেমনি শুইনা ফালাইছিলেন শেখ সাহেবের ওয়্যারলেস মেসেজ, নিজের রেডিওতে। সেই রেডিও লইয়া তিনি দৌড়ায়া গেছিলেন টিক্কা খানের কাছে।

.

ওয়াজেদ মিয়া মুখের ভাত চিবুতে পারছেন না। স্বাধীনতা আসছে। স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়। তাঁর মনে পড়ল, গাড়ি নিয়ে চলাচল করার সময় কত অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি দেখেছেন। দেখেছেন রাস্তার পাশে পড়ে আছে মানুষের লাশ।

হাসিনা মাদুরে বসতে পারছেন না। তাকে একটা টুল দেওয়া হয়েছে। হারিকেনের আলোয় তার মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, আব্বা। ওয়্যারলেসে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং এম আর সিদ্দিকীকে মেসেজ পাঠানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, হ্যাঁ। কামাল হোসেন সাহেবরা একটা ইংরেজি মেসেজ রেডি করছিলেন, আর সিরাজুল আলম খানদের সঙ্গেও উনি একটা বার্তা রেডি করে রাখা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ওরাও বোধ হয় একটা ড্রাফট ওনাকে দিয়েছিলেন।

হাসিনা বললেন, একটা আশ্চর্য ঘটনা আছে জানো! আমরা একবার চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আজ থেকে বছর দশেক আগে হবে। ওখানকার আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ সাহেব তো আব্বার খুব বন্ধু ছিলেন। আজিজ কাকার ছেলে মঞ্জু, মেয়ে বিলকিস, আমি, কামাল–আমরা খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা খুব বেড়াতাম জানো। প্রথমবার চট্টগ্রামে গেছি। পাহাড় দেখছি। পাহাড়ে উঠতাম। আমরা প্লেইন ল্যান্ডের মানুষ। পাহাড় আমাদের খুব টানে। পাহাড় দেখে আশ্চর্য হই। কীভাবে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। কীভাবে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপরে রাস্তা উঠে গেছে! আবার চট্টগ্রাম সম্পর্কে কত কাহিনি বইয়ে পড়েছি। কত কথা শুনেছি। কত ইতিহাস। এই চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লব করেছিলেন। প্রীতিলতা জীবন দিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুটের কাহিনি কত পড়েছি লুকিয়ে লুকিয়ে। এই সব বই পড়া তো নিষিদ্ধ। আজিজ কাকা আমাদের টাইগার পাস দেখাতে নিয়ে গেলেন। বললেন, দেখো মা, আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ এখান থেকেই শুরু হবে। তারপর তিনি নিয়ে গেলেন কালুর ঘাট বেতার দেখাতে। চারদিক ফাঁকা। কেবল একটা বিল্ডিং। আজিজ কাকু বললেন, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা আমরা প্রচার করব এই বেতার থেকে।

ওয়াজেদ মিয়া বললেন, আজিজ সাহেব তো মারা গেছেন?

হ্যাঁ। ১৯৬৯-এ মারা গেছেন।

আশ্চর্য তো। তিনি কী করে এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারলেন?

পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, চট্টগ্রামের পাহাড় থাইকাই আসলে স্বাধীনতার যুদ্ধ এক অর্থে শুরু হইছিল।

ব্যাঙ্গমি বলবে, ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক ২৪ মার্চেই রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের পাহাড়ে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করছিলেন।

.

ওয়াজেদ মিয়ার মনের মধ্যে দুই বিপরীত চিন্তা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করল। শ্বশুর সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বিশ্ববাসী সে খবর জেনে গেছে। এই ঘোষণা বাংলার মানুষকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে প্রেরণা জোগাবে। কিন্তু শ্বশুরসাহেবকে তো ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। তার বিচার করা হবে, ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আর ফিরবেন কি না, কে জানে? স্বাধীনতার মূল্য না জানি কত বেশি দিতে হয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *