৮০
ইয়াহিয়া খান সকাল থেকেই হুইস্কির ওপরে আছেন। বেনসন হেজেসও চলছে। তিনি পীরজাদাকে বললেন, একটা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করো। সব বিদেশি সাংবাদিককে ডাকবে। দেশি সাংবাদিকগুলো সব হারামজাদা।
বিদেশি সাংবাদিকেরা এলেন। নামকরা হোটেলে হচ্ছে এই সংবাদ সম্মেলন। আজকে প্রেসিডেন্ট পরেছেন তার সামরিক পোশাক। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কও তো বটেন।
তার মেডেলগুলো এসির বাতাসে উড়ছিল আর টুংটাং শব্দ করছিল।
তার এক পাশে জেনারেল গুল হাসান। আরেক পাশে পীরজাদা।
প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছি। আর কত উসকানির মুখে আমরা নীরব থাকতে পারি? আপনাদের সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না। ১০ দিনের মধ্যেই আপনারা আমাকে দেখবেন আমি। ফ্রন্টে। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি। আমরা তো জিহাদ করি। আমাদের জয় তাই অবশ্যম্ভাবী।
.
লাহোরের পত্রিকা মাশরিক-এ ছাপা হলো ব্যানার শিরোনাম :
ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য। ঘোষণা দিলেন প্রেসিডেন্ট : আমি ১০ দিনের মধ্যেই ফ্রন্টে যাব।
ফ্রন্টে গেলে তিনি খারাপ করতেন না। মকবুলপুর ফ্রন্টে বাংকারে বাংকারে ছিল নারী। আকাশ থেকে ঝরছিল ভারতীয় গোলা। আর ভেতরে নারীদের সঙ্গ উপভোগ করছিলেন ব্রিগেডিয়ার হেদায়াতুল্লাহ। প্রেসিডেন্ট সেখানে গেলে তাঁর প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনের বাইরের কোনো জীবন পেতেন না। বরং যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাগুলির নিচে নারীদের সঙ্গে মিলিত হতে তাঁর ভালোই লাগত।
.
লাহোরে একটা হোটেলে আয়োজিত এক পার্টিতে যোগ দিলেন ইয়াহিয়া। সেখানে গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে, আলো জ্বলছে-নিভছে। একটার পর একটা গেলাস হাতে নিচ্ছেন ইয়াহিয়া। একেকজন নারীর কোমর ধরে দুলছেন।
তারপর হঠাৎ ইয়াহিয়া খেপে গেলেন। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন ফোলানো সব রঙিন বেলুনের দিকে।
তিনি একটা বেলুনের গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরতেই সেটা ফটাস করে গেল ফুটে। তিনি হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, এইমাত্র ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামকে শেষ করলাম। এবার মানেকশকে খতম করব। তিনি আরেকটা বেলুন ফাটালেন, এইবার শেষ করলাম ইন্দিরাকে। সবশেষ ফাটাব মুজিবকে। একটা বেলুনের দিকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে এগিয়ে গেলেন। চিৎকার করে উঠলেন, মুজিব শেষ। মুজিব শেষ।
তিনি তার হাতের সিগারেটটায় শেষ টান দেওয়ার জন্য ঠোঁটে চাপতেই চিৎকার করে উঠলেন। মাতাল হাতে তিনি সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ ধরেছেন। ঠোঁটে। তার ঠোঁট পুড়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিবকে মারতে গিয়ে তিনি নিজেই পুড়িয়ে ফেললেন তার মুখ।
সব শত্রুকেই তিনি ঘায়েল করেছেন। বীর জেনারেল। এখন তিনি রণক্লান্ত। এবার শান্ত হবেন। এবার তার দরকার বিনোদন। তিনি নুরজাহানকে নিয়ে একটা কক্ষে ঢুকে পড়লেন।
৮১
তাজউদ্দীন বললেন, ওসমানী সাহেব, আমাদের একটা চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী আর ভারতের সেনাবাহিনী মিলে হবে মিত্রবাহিনী। আমাদের একটা যৌথ কমান্ড লাগবে।
ওসমানী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর সামনে বসা। তিনি বললেন, না না, তা কেন হবে। ভারতীয় বাহিনী তাদের মতো যুদ্ধ করবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, গণবাহিনী আমার কমান্ডে যুদ্ধ করবে।
যুদ্ধ তো একটাই। শত্রুও একটাই। দুইটা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় লাগবে না? একটা গাড়িতে দুইটা স্টিয়ারিং থাকতে পারে না। একটা নৌকায় দুইটা হাল থাকতে পারে না। হাল যে-ই ধরুক, স্টিয়ারিং যে-ই ধরুক, হাল থাকবে একটা। স্টিয়ারিং থাকবে একটা।
তাহলে ভারতের বাহিনী আমার কমান্ডে যুদ্ধ করবে? চোখমুখ শক্ত করে বললেন ওসমানী।
তাজউদ্দীন বললেন, আমাদের ট্যাংক নাই, আমাদের সাবমেরিন নাই, আমাদের যুদ্ধজাহাজ নাই, আমাদের যুদ্ধবিমান নাই, এমনকি আমাদের নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদও নাই, আপনি কী করে কমান্ড দেবেন?
আচ্ছা আমরা এ কে খন্দকার সাহেবের পরামর্শ নিই।
তাঁকে ডাকা হলো। তিনি এলেন। তাঁকে ব্যাপারটা খুলে বললেন। প্রধানমন্ত্রী।
এ কে খন্দকার বললেন, যৌথ কমান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানপক্ষও যৌথ কমান্ড করেছিল, মিত্রবাহিনী তো যৌথ কমান্ডই। তা না হলে আমাদের বাহিনী নিয়ে আমরা কয়েকটা সেক্টরে যখন যুদ্ধ করতে থাকব, তখন ভারতীয় বাহিনী ঢাকা ঢুকে যখন সারেন্ডার করাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে, তখন তারা বলবে, এটা হলো পাক-ভারত লড়াই। আর যদি যৌথ কমান্ড থাকে, তখন বলতে হবে যে পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করেছে যৌথ বাহিনীর কাছে।
ওসমানী বললেন, না, হবে না। আমি ভারতীয় কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করতে পারব না। আমি পদত্যাগ করব।
তাজউদ্দীন বললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী, আমি প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এটা আমার আদেশ। আপনাকে শুনতে হবে। শুনতে না চাইলে আপনি পদত্যাগপত্র লিখে জমা দিন।
পরের দিন মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা হলো। সেনাপতি সেখানে উপস্থিত। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো যে যৌথ কমান্ড গঠন করা হবে।
ওসমানী মেনে নিলেন।
৮২
৩১ বছর বয়স্ক মেজর শাফায়াত জামিল ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষে যুদ্ধ করছেন সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলে। ২৬ নভেম্বর ভারতের দুর্ধর্ষ গুর্খা রেজিমেন্ট রাধানগর ও ছোটখেলে প্রচণ্ড হামলা চালায় পাকিস্তানি ডিফেন্স ক্যাম্পের ওপরে। এসব জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা কংক্রিটের বাংকার বানিয়ে রেখেছিল। তাদের প্রতিরোধদুর্গ ছিল দুর্দমনীয়। গুর্খারা রাধানগরে প্রাণপণ আক্রমণ করেও শত্রুদের সরাতে পারেনি। বরং নিজেদের কোম্পানির কমান্ডার মেজর এস পি সিংসহ প্রায় সব সৈন্যকে হারিয়ে ফেলে। ছোটখেল ৬ ঘণ্টার জন্য তারা দখল প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, পাকিস্তানিরা শক্তি বৃদ্ধি করে আবার আক্রমণ চালিয়ে তাদের হটিয়ে দেয়।
২৮ নভেম্বর ভারতীয় সেক্টর কমান্ডার রাজসিং বাংলাদেশ বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খানকে আদেশ করলেন, ছোটখেল আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের হটিয়ে দাও।
নূরুন্নবী জানালেন তার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে। স্যার, আমাদের যৌথ কমান্ডের সেক্টর কমান্ডার অর্ডার করেছেন ছোটখেল অ্যাটাক করতে। কী করব?
এটা একেবারে আত্মহত্যা! স্রেফ আত্মহত্যা। জানি না কেন ইন্ডিয়ান কর্নেল এটা আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছে। তাতে কী লাভ? আমরা এক সপ্তাহ এটার দখল ধরে রাখলাম। পরের সপ্তাহেই তো এটা হারাতে হবে।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, আসলে পাকিস্তানিদের সীমান্তের দিকে টাইনা আনা, আর ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করার রণকৌশলটা হয়তো মাঠপর্যায়ের সবাই জানতেন না। বস্তুত এইটা কেবল ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সমরবিদেরাই জানতেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, যা-ই হোক, আমরা শাফায়াত জামিলের কাছে ফিরা যাই।
.
নূরুন্নবী বললেন, তাহলে আমরা কী করব?
শাফায়াত জামিল বললেন, আমরা অবশ্যই অর্ডার ক্যারি করব। তবে এই ভারতীয়দের আমরা দেখিয়ে দিতে চাই, ওরা যা পারেনি, আমরা তা করে ছাড়ব। চলো। আমিও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাব।
নূরুন্নবী বললেন, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে আপনার তো যাওয়ার কথা না।
শাফায়াত বললেন, তোমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে আমি নিরাপদ দূরত্বে বসে কমান্ড করে যাব, হবে না। গুর্খারা পরশু ১৭ জন মরেছে, ৪০ জন আহত। আমাদের দেশের মুক্তির জন্য আমাদের তো মরতে হলে মরতে পারতে হবে। লেটস গো অ্যান্ড ফাইট।
সৈন্যদের উদ্দেশে বললেন, আমাদের দুই প্লাটুন যাচ্ছে লড়াইয়ে। দুই প্লাটুন কমান্ডার নূরুন্নবী আর আলী নেওয়াজ থাকবে সামনে। কিন্তু আরও একজন থাকবে। সে হলো আমি। আমি নিজে যাব লড়তে। চলো, গুর্খারা যা পারেনি, তা করে আমরা দেখিয়ে দিই, বাঙালি বীরের জাতি।
তখনো আঁধার কাটেনি। ভোরের কুয়াশা এসে ঢেকে রেখেছে অঘ্রানের পাকা ধানখেত।
অগ্রহায়ণ বাংলাদেশের এক বিশেষ ঋতু। ধান কাটা হয়ে যায়, এলোমেলো খড়, কাটা ধানের গোড়ালি পড়ে থাকে খেতে। শিশির জমে দূর্বাঘাসে। সকালের রোদ পড়লে মনে হয় সারা মাঠে মুক্তাদানা ছড়িয়ে আছে। একটু একটু শীত পড়ে। খয়েরি শালিক হলুদ ঠ্যাংয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেতের পোকা ঠুকরে খায়।
শাফায়াত জামিলের সঙ্গে এক শ সৈন্য। তারা মাথা নিচু করে ধানখেতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। ধানের পাতা লেগে তাদের হাতের কবজি কেটে যাচ্ছে। কিন্তু আজ তো মরণপণ যুদ্ধ। তারা শত্রুর ৩০০ গজ দূরে মাত্র। কুয়াশা ভেদ করে দুরবিনে দেখা যাচ্ছে তাদের অবস্থান।
শাফায়াত জামিল বললেন, জয় বাংলা। তাঁদের ১০০টা এসএলআর গর্জে উঠল। তারা দৌড়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলেন। জয় বাংলা, আল্লাহু আকবর।
জয় বাংলা বাহিনীকে সাপোর্ট দিচ্ছে গোরা গ্রামে পোস্ট করা দুটো মেশিনগান, একটা রিকোয়েললেস রাইফেল। দ্রুত সামনে এগিয়ে তারা শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমে পড়লেন।
পাকিস্তানিরা এই প্রভাতে এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সামনে থেকে গুলি আসছে, পাশের খড়ের গাদা, ধানখেতে গ্রামবাসী আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে এগিয়ে আসছে তাদের বাংকারের দিকে। বাঁচার জন্য পিছু হটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তারা প্রথমে কিছুক্ষণ চেষ্টা করল পাল্টা গুলি চালাতে। তারপর এত কাছে জয় বাংলা ধ্বনি শুনে আর গুলির প্রচণ্ডতায় উঠে পালাতে লাগল। পড়ে পড়ে মরল। আহত হলো।
তাদের ছোঁড়া একটা গুলি এসে বিদ্ধ হলো শাফায়াত জামিলের কোমরে।
শাফায়াত জামিল উষ্ণ তরলের স্পর্শ অনুভব করতে পারলেন। দুজন সৈন্য তাকে কোলে করে নিয়ে গেল পেছনে। চিকিৎসার জন্য।
বাঙালি সৈন্যরা পুরো গ্রামটা দখল করে নিয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ। দেখা গেল, তাদের বাংকার মাটির নিচে তিনতলা। সেখানে পাওয়া গেল ৭ জন নারীর সদ্যমৃত দেহ। তারা ফেলে রেখে গেছে শত শত বাক্স গুলি, তিন শ বেডিং, দুটো টেলিফোন সেট, ৪৫টা চামড়া ছাড়ানো মুরগি, বাইনোকুলার, কম্পাস, মানচিত্র। আশু কাজে লাগল সদ্য ভাজা গরম পরোটা, সবজি আর চা। বাঙালি সৈন্যরা ওদের বাংকার দখল করে পজিশন নিয়ে নাশতা সেরে নিচ্ছে, এই সময় ওয়্যারলেসে কর্নেল রাজসিং বললেন, কংগ্রাচুলেশনস, টাইগার্স। তোমরা প্রমাণ করেছ তোমরা বীর।
শাফায়াত জামিলকে মুক্ত এলাকায় জিপে তুলে গাড়ি ছুটতে লাগল শিলংয়ের দিকে। শিলং মিলিটারি হাসপাতালে নেওয়ামাত্র তাঁকে ঢোকানো হলো অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশন করে ডাক্তাররা বুলেট বের করলেন। ১৩ ডিসেম্বরে তার ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি। তিনি আবারও চলে এলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৫ ডিসেম্বর সিলেটের লাকামজি ফেরিঘাটে এসে দেখা গেল, তাঁর ব্যাটালিয়ন ফেরির জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ড নিয়ে নিলেন। তারপর এল ১৬ ডিসেম্বর।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর আসতে আমগো অহনো কয়েক দিন বাকি আছে। আমরা দিন শুরু করছি ২৮ নভেম্বরে।
ব্যাঙ্গমি বলবে, চলো সেইখান থাইকা আবারও স্মরণ করতে থাকি।
৮৩
কলকাতা শহর, শহরতলির সব মানুষ হাজির হয়েছে ময়দানে। ইন্দিরা গান্ধীর জনসভা। হেমন্তের বিকেলে ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে চিলেরা ভিড় করেছে ব্রিগেড ময়দানের বিস্তারিত আকাশে। সব পাখি ঘরে ফেরার বদলে ময়দানের দুপাশের ভবনে আর শিরীষ, দেবদারু, পামগাছের আশ্রয়গুলোতে ক্লান্ত পাখা গুটিয়ে দুপায়ে ভর দিয়ে বসে গ্রীবা বাড়িয়ে নিচে চেয়ে দেখছে মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ তো কলকাতায় বাস করে না। কোত্থেকে এল মানুষ? শহরতলি থেকে? বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, রাঢ়, কোচবিহার থেকে? নাকি শত শত আশ্রয়শিবিরে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে আছেন পূর্ব বাংলার যে শরণার্থীরা, তারা এসেছে? ইন্দিরা গান্ধীর জনসভায় এত মানুষ, এত মানুষ, এ যে মানুষবালুকণায় ভরা এক আদিগন্ত মরুভূমি। হ্যাঁ, এটাকে জনসমুদ্র বলা যাবে না, কারণ মানুষ শান্ত। আজ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই, কালো পতাকা নেই, চারু মজুমদার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, নকশালিরাও আজ চুপচাপ করে কান পেতে শুনতে চাইছে ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ। ইন্দিরা মঞ্চে উঠলেন, শান্ত-সমাহিত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ভারত শান্তির পক্ষে, তবে কেউ যদি আমাদের ওপরে জোর করে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায়, ভারত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তার গায়ে একটা গেরুয়া চাদর, তিনি একবার চাদরটা ঠিক করে নিলেন। এই সময় মঞ্চে একটা চিরকুট নিয়ে ভাষণদানরত প্রধানমন্ত্রীর ডায়াসে রেখে। এলেন জি সি দত্ত, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার। প্রধানমন্ত্রী চিরকুটটা দেখলেন।
পাকিস্তান এয়ার অ্যাটাক করেছে।
প্রধানমন্ত্রী জানেন, এটাই হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী চাইছিলেন পাকিস্তান এমনভাবে ভারতকে আক্রমণ করুক, যাতে দুনিয়াকে দেখানো যায় যে আমরা আক্রমণ করিনি। আমরা নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিমাত্র। মুখে যেন হাসি ফুটে না ওঠে। তাকে চিন্তিত দেখাল।
তিনি দ্রুতই ভাষণ শেষ করে গাড়িতে উঠে পড়লেন।
আজ শুক্রবার। তিনি কলকাতা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাটনা। সেখান থেকে তিনি যাবেন বেঙ্গালুরুতে। অর্থমন্ত্রী বোম্বে, সেখান থেকে যাবেন পুনে। মানেকশ যে কোথায়, তিনি জানেনও না।
তিনি রাজভবনে গেলেন। রাজভবনে শিল্পী-সাহিত্যিক-সুধীজন সমবেত হয়েছেন। এই বিদগ্ধসভা বাদ দিয়ে তিনি হঠাৎ করে চলে যেতে পারেন না। এঁরা মনঃকষ্ট পাবেন।
শিল্পীরা একই রঙের শাড়ি, একই রঙের পাঞ্জাবি পরে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে লাগল : যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো। গানটার একটা হিন্দি অনুবাদও ধরল তারা। ইন্দিরা এই গান আগে থেকেই জানেন : ইফ নোবডি রেসপন্ডস টু ইয়োর কল দেন গো ইন ইয়োর ওয়ে অ্যালোন।
তিনি উত্তম কুমারের সঙ্গে হেসে কথা বললেন, সুচিত্রা মিত্রকে বললেন, নমস্কার। তারপর সবাইকে বললেন, আজকে আমার একটু তাড়া আছে। আমি দিল্লি চললাম।
দ্রুত তিনি উঠলেন গাড়িতে। গাড়ি সোজা ছুটল দমদমে। তাঁর জন্য বিমান তৈরি হয়েই ছিল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমান। তার পাশে এসে বসলেন ডি পি ধর। তিনি বললেন, পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশে বিমান হামলা হয়েছে। অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, আম্বালা, আগ্রা, যোধপুর বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানিরা হামলা করেছে। অমৃতসর, পাঠানকোটে স্থলপথেও আক্রমণ করা হয়েছে।
থ্যাংক গড, দে হ্যাভ অ্যাটাকড আস-ইন্দিরা বললেন।
ডি পি ধর মাথা নেড়ে বললেন, পি এন ধর আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন নেপোলিয়নের একটা কথা। নেভার ইন্টারাপ্ট অ্যান এনিমি হোয়েন হি ইজ মেকিং আ মিসটেক। তোমার শত্রু যখন ভুল করছে, তখন তাকে বাধা দিয়ো না। ভুল করতে দাও।
তারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন ৪ ডিসেম্বর তারা আক্রমণে যাবেন, আকাশে পূর্ণিমা থাকবে। রাতের আঁধার জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিতালি করবে, উড়বে তখন ভারতের বিমানগুলো।
এখন পাকিস্তানিরা আমাদের এই প্লেনে হামলা করবে না তো? ইন্দিরার চোখেমুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন।
আমাদের বিমানবাহিনী জানে যে এই বিমান দিল্লি যাচ্ছে। এসকর্ট করা আছে। চারটা প্লেন আপনার বিমানের চারপাশে পাহারা দিয়ে রেখেছে। আমাদের সবগুলো যুদ্ধবিমান, বিমানবিধ্বংসী কামান, রাডার অ্যালার্ট আছে। ডি পি ধর আশ্বস্ত করলেন ইন্দিরাকে।
বিমান দিল্লিতে নামল নিরাপদেই। তখন রাত ১১টা বাজবে বাজবে করছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বিমানে উপস্থিত। তাঁরা সোজা চলে গেলে সেনা সদর দপ্তরে।
স্যাম মানেকশ আছেন। নৌবাহিনীর প্রধান আছেন। বিমানবাহিনীর প্রধান আছেন।
মানেকশ পরিস্থিতি ব্রিফ করলেন। পশ্চিমে আমরা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছি। পুবে আমরা একযোগে ঢুকে পড়তে চাই। আপনি অর্ডার দিন।
ইন্দিরা বললেন, অর্ডার দেওয়া হলো।
তিনি বিমানবাহিনীর প্রধানকে বললেন, পাল্টা হামলা করুন। দিস ইজ অ্যান অফিশিয়াল অর্ডার।
ভারতের প্রেসিডেন্ট রাতের বেলাতেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা বক্তৃতা লিখছেন। ইন্দিরা রেডিওতে ভাষণ দিলেন মধ্যরাতে–আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ এসে পড়েছে ভারতের ওপর। এটা এখন। ভারতেরও যুদ্ধ। দীর্ঘকাল কৃচ্ছ্ব পালনের জন্য আপনাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
পরের দিন পার্লামেন্ট বসল। ইন্দিরা বললেন, আমরা শান্তি চেয়েছি। আমরা সব সময় যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। আমাদের ওপরে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন যুদ্ধের মধ্যে।
ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি।
.
মেজর জেনারেল জ্যাকব নয়াদিল্লিতে সেনাসদরেই ছিলেন। তাঁর কাছে ফোন এসেছিল, ফোন করেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ, পাকিস্তান তোমাদের ওপরে বিমান হামলা করছে, তোমাদের প্রতিক্রিয়া কী? জ্যাকব তাঁর মেস থেকে এক বোতল পানীয় আনিয়ে নিয়েছিলেন, সেটা থেকে এক ঢোঁক খেয়ে নিয়ে তিনি বললেন, আমরা এখন পানাহারে ব্যস্ত।
তোমার প্রতিক্রিয়া বলো।
এইবার আমরা দেখিয়ে দেব আর্মি কাকে বলে।
শোনো। তোমরা যখন ঢাকা যাবে, আমাকে তোমাদের সঙ্গে নেবে, কথা দাও!
৮৪
ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একতলা বাড়ির ছাদে মিলিটারিরা বাংকার বানিয়ে পজিশন নিয়ে আছে। বাড়ির সামনে বালুর বস্তা। তারা রাতের বেলা ট্রেঞ্চ খুঁড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে।
মমিনুল খোকা এখন এই বাসাতেই থাকেন। স্ত্রী-কন্যাদের রেখে এসেছেন শ্বশুরবাড়িতে। ওয়াজেদ মিয়া হাসপাতালে। বাড়ি পুরুষশূন্য। এটা হতে দেওয়া উচিত নয়।
খোকা বিছানায় বসে রেডিও ঘোরাচ্ছেন। তিনি বললেন, আকাশবাণী বলল, পাকিস্তান বিমান হামলা করেছে ইন্ডিয়ার অনেক জায়গায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রপতি। বলছে, যেকোনো সময় ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দেবেন।
রেনু বললেন, ইন্দিরাজির ভাষণ শুনে ঘুমাতে যাব।
হাসিনা বললেন, হ্যাঁ। কত রাতে ভাষণ দেবেন!
রেহানা বললেন, বেশি রাত করবে না। সবাই যদি না-ই শুনতে পাবেন, ভাষণ দিয়ে লাভ কী!
রাতে ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শুনলেন সবাই। খোকা বললেন, ইন্দিরাজি খুবই ইন্টেলিজেন্ট। বললেন না যে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করছি। বললেন, বাংলাদেশের যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ হয়ে গেছে।
হাসিনা বললেন, আরেকটা পয়েন্ট খুবই সূক্ষ্ম। কিন্তু এইটা খেয়াল করার মতো। শুধু ধর্ম বা ভাষার ভিত্তিতে মানুষের ঐক্য হয় না, মানুষের ঐক্য হয় একটা উচ্চ আদর্শবোধ থেকে।
রেহানা বললেন, আপা, জিনিসটা কী বুঝি নাই।
হাসিনা বললেন, ধর্মের ভিত্তিতে যদি এক দেশ হতো, তাহলে তো সব আরব দেশ এক দেশ হতো। আবার ভাষার ভিত্তিতে যদি এক দেশ হতো, তাহলে তো আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এক দেশ হতো। তা
তো হয় না। দেশ হয় যখন দেশের সব মানুষ মনে করে তারা একটা দেশ হতে চায়।
খোকা বললেন, হ্যাঁ। আর ইন্ডিয়ানদের মনে একটা টেনশন কাজ করে, এক ভাষার সবাই এক দেশ হলে পশ্চিমবঙ্গ না আবার আলাদা হতে চায়। এটা যে না, সেটা ইন্দিরা গান্ধীজি সবাইকে জানিয়ে দিলেন।
হাসিনা বললেন, আমাদের জাতীয় পতাকার মাঝখানে তো বাংলাদেশের ম্যাপ সে জন্য দিয়ে দেওয়াই হয়েছে। এই বাংলা হলো পূর্ব বাংলা।
হঠাৎ রাসেল জয়ের পাশ থেকে মাথা তুলে বলল, এই তোমরা ঘুমাও না কেন?
রেহানা বললেন, তুমি ঘুমাও নাই। চুপ করে শুয়ে আছ?
রাসেল বলল, আমি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা শুনলাম।
রেহানা বললেন, তুমি ইংরাজি বোঝে।
রাসেল বলল, আমার কাছে আসো। কানে কানে বলব।
রেহানা রাসেলের পাশে গিয়ে শুয়ে কান পাতলেন। রাসেল বলল, যদি। হঠাৎ করে আব্বা ভাষণ দেন, তাই জেগে আছি।
৮৫
৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা। কলকাতার রাস্তাঘাটে অস্বস্তিকর তাড়াহুড়া। শনিবার, লোকজন কাজে যায়নি, সব ফাঁকা ছিল, তবু লোকজন কিছু শেষ মুহূর্তের জরুরি কেনাকাটা সেরে দ্রুত যার যার বাড়ি ফিরছে। এই জরুরি জিনিসের তালিকায় আছে মোমবাতি আর কেরোসিন। বিমান হামলা হতে পারে, তাই রাতে হবে নিষ্প্রদীপ মহড়া।
তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খান তার ভাড়া করা বাসায়। লোয়ার সার্কুলার রোডে এই বাড়িটি চুন-সুরকির। মোটা মোটা কলাম, খিলান, কড়িবর্গার। চিলেকোঠার ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারেই গল্প করছিলেন। যুদ্ধ যে বেধে গেল, চীন কি বসে থাকবে? সোভিয়েত-ভারত চুক্তি কি ফল দেবে? আমেরিকা কি কলকাঠি নাড়ছে?
এই সময় ডাক এল। ফারুক সাহেব, ফারুক সাহেব। আছেন নাকি? ফারুক আজিজ দরজা পেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ালেন। একটা ছোট্ট বাল্ব আলো দিচ্ছে, আকাশ থেকে আসা অস্তরাগও খানিকটা তার মুখে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় ওরফে এস চ্যাটার্জি। তাঁর পাঞ্জাবির বুকপকেটের ফাউন্টেন পেন লিক করেছে, পকেটের কোনায় কালি দেখা যাচ্ছে।
আপনি কোথায় ছিলেন?
কেন? এখানেই?
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আপনাকে খুঁজছিলেন। তিনি চলে গেছেন। কালকের আগে আর ফিরবেন না। আমার এখন একটা সিলমোহর দরকার। বাংলাদেশ সরকারের সিলমোহর।
সিলমোহর দিয়ে কী করবেন?
একটা চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। আজ রাতেই সেটা সাইন হবে। সেই জন্য আপনাদের স্ট্যাম্প দরকার।
চিলেকোঠা থেকে দ্রুত নামলেন ফারুক। জুতা পরা হয়নি। পায়ে চপ্পল। সেটা ছ্যারাৎ ছ্যারাৎ শব্দ করছে। গাড়ি প্রস্তুত ছিল। তারা উঠলেন। থিয়েটার রোডের অফিসের দোতলায় নিজের ঘর খুলে সিল নিলেন। প্যাড নিলেন।
এস চ্যাটার্জি বললেন, সময় নাই। দৌড়াতে হচ্ছে। আজ রাতেই যৌথ কমান্ড গঠনের চুক্তিতে সই করতে হবে।
ফারুক বললেন, যৌথ কমান্ডের চুক্তি হচ্ছে কার সঙ্গে? ভারত কি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে?
একটা হলে আরেকটা অটোমেটিক হয়ে যায় নাকি?
.
পরের দিন ফিরে এলেন তাজউদ্দীন।
তাঁর কাছে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন ফারুক। তাজউদ্দীন বললেন, যৌথ কমান্ড চুক্তি স্বাক্ষর করে এলাম। এই যুদ্ধ এখন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ যুদ্ধ। ব্যাপারটা এখন অনেক বেশি সম্মানের হলো।
তাঁরা রেডিও শুনতে লাগলেন।
লাহোরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলা। সীমান্তে বিভিন্ন স্থানে স্থলপথে যুদ্ধ শুরু। মুজিবনগর অফিসে খবর আসতে লাগল, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, যশোর, দিনাজপুর সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকা, যশোর বিমানবাহিনীর শক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলেছে। ভারতীয় নৌবাহিনীও আক্রমণ করেছ, তারা কক্সবাজার বিমানবন্দর অকেজো করে দিয়েছে। আর আক্রমণ করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ৩ ডিসেম্বর রাতে, ৪ ডিসেম্বর ভোরে।
৮৬
৩১ বছর বয়স্ক স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ উত্তেজনায় কাঁপছেন। পাকিস্তান বিমান আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বোমা ফেলেছে। আজ রাতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম বিমান হামলা করা হবে। সুলতান যাবেন নারায়ণগঞ্জের দিকে। তেলের ডিপোর ওপর বোমা ফেলতে। তারা যাবেন এলুয়েট ৩ হেলিকপ্টার নিয়ে। এই হেলিকপ্টারটা ভারতের বিমানবাহিনীর কাছ থেকে উপহার পাওয়া।
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর বিমানবাহিনী লাগবে, সে জন্য বিমান দরকার, এই চাওয়াটায় ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি। পাকিস্তানের সুসজ্জিত বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তিন গুণ বেশি শক্তিশালী ভারতীয় বিমানবাহিনী তো আছেই। মুক্তিবাহিনী বিমান দিয়ে কী করবে?
কিন্তু পাকিস্তান থেকে বিমানবাহিনীর অনেক অফিসার এসেছেন, বৈমানিক ও বিমানসেনা এসেছে, তারা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে স্থল যুদ্ধ করছেন, কিন্তু কয়েকটা বিমান পেলেই তো তারা আকাশপথে যুদ্ধ করতে পারবেন। জরুরি রসদ, সরঞ্জাম, সেনানায়কদের দ্রুত জায়গামতো পৌঁছে দিতে পারবেন।
কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসেছেন ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপচন্দ্র লাল। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার।
খন্দকারের সামনে চা নিয়ে এলেন লীলা লাল। কলকাতার মহিলা। সদালাপী বন্ধুবৎসল।
লীলা বললেন, আপনি বিমানবাহিনীর কর্তা। আপনাদের শুনলাম অনেক বৈমানিক পাইলট বিমানসেনা আছে। আপনারা করছেনটা কী?
এ কে খন্দকার বিষণ্ণ হাসি দিয়ে বললেন, আমি তো সদর দপ্তরে কাজ করছি। আর বৈমানিকেরা হয় বসে আছে, নয়তো ল্যান্ডে যুদ্ধ করছে। আমরা ভারতের কাছ থেকে কয়েকটা বিমান আর হেলিকপ্টার চেয়েছিলাম। ভারতের মন্ত্রী-সচিবেরা এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন না। তাই মন খারাপ।
লীলা বললেন, শোনেন। আমার বাড়ি কুমিল্লা। আমার নাড়ি পোঁতা আছে আমাদের বাড়ির পেছনে বাঁশবাগানে। প্রতাপ, তুমি অবশ্যই কয়েকটা বিমান দেবে। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর বিমান আছে, সেটা যেমন সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে সাহস দেবে, আর ওদের নিজেদের ছোটখাটো প্রয়োজনে তোমাদের ওপরে নির্ভর করে বসে থাকতে হবে না।
লীলা তার স্বামীর সঙ্গে লেগে রইলেন।
দুটো ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফট আর একটা রটারি উইং হেলিকপ্টার পেল মুক্তিবাহিনী। গঠন করা হলো বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। যোধপুরের মহারাজা দান করলেন একটা ডাকোটা বিমান।
সুলতান মাহমুদ ছিলেন করাচির মাসরুর, মৌরিপুরের বিমানঘাঁটিতে কর্মরত। পালিয়ে কলম্বো হয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ঢোকেন। তারপর অক্টোবরে তিনি আগরতলায় এসে পৌঁছান। এসেই যুদ্ধে যোগ দেন। চট্টগ্রামে যুদ্ধ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসা শেষ করে এবার তিনি যোগ দিয়েছেন বিমানবাহিনীতে। ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলমের বয়স ২৪। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে আকাশ থেকে ভূমিতে রকেট নিক্ষেপের কাজে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। পাকিস্তানের সাবগোদায় তাঁর বিমানঘাঁটি থেকে তাঁকে সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর কাজ করতে ঢাকা পাঠানো হয়। তাঁকে সাবগোদায় মার্চে বদলি করে দেওয়া হলে তিনি আর পাকিস্তান যাননি। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি আগরতলায় যান।
৩ ডিসেম্বর রাত। আকাশে জোছনা দুধের নহরের মতো বয়ে যাচ্ছে। আবার কুয়াশাও আছে। তেলিয়াপাড়া পাহাড়ের ওপরে হেলিকপ্টার এলুয়েট ৩ কে আগের রাতেই এনে রাখা হয়েছে। সুলতান আর বদরুল হেলিকপ্টারে ওঠার আগে সবকিছু চেক করে নিলেন। হেলিকপ্টারের পেছনে নেওয়া হচ্ছে ১৪টি রকেট, এক বস্তা লিফলেট, মেশিনগান, মেশিনগানের গুলি। মেশিনগান চালানোর জন্য একজন গানার।
রাত ১১টা ৪৫। হেলিকপ্টারের বসলেন দুই পাইলট। কিন্তু হেলিকপ্টার আকাশে উঠছে না। এমনিতেই এই হেলিকপ্টারটা যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য জিঞ্জিরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। রকেট ছোঁড়ার জন্য পড। শত্রুর গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক ইঞ্চি পুরু স্টিলের প্লেট বসানো হয়েছে হেলিকপ্টারের তিন পায়ের মধ্যখানে। ওজন বেশি হয়ে গেছে। যদি একটুখানি সমতল জায়গা পাওয়া যেত, তাহলে খানিকটা দৌড়ে এটা টেকঅফ করতে পারত।
কিন্তু অর্ডার এসেছে নারায়ণগঞ্জে হামলা করতে হবে। আমাদের পারতেই হবে। আচ্ছা লিফলেটের বস্তা হালকা করো। সুলতান মাহমুদ বললেন। তা-ই করা হলো। বস্তার বদলে অল্প কটা লিফলেট নেওয়া হলো। ভরকেন্দ্র বদলে গেছে। সামনে হালকা। কিছু জিনিস আমাদের পেছনে রাখো। গুড। এবার চেষ্টা করি। আল্লাহ ভরসা।
হেলিকপ্টার উড়ল আকাশে। কম্পাস অনুসারে তারা যাত্রা করতে পারেন। কিন্তু কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। নিচের ল্যান্ডমার্ক দেখা না গেলে হেলিকপ্টার চালানো যায় না। ভরসা হলো ফকফকা জোছনা। তারা ঢাকা যাওয়ার পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার চালাতে লাগলেন। ওই তো এলিয়টগঞ্জ ব্রিজ। ক্যাপ্টেন হায়দার তার যোদ্ধাদের নিয়ে এটা ভেঙে দিয়েছিলেন। সেটা দেখা যাচ্ছে। দাউদকান্দি। সাবধান বদরুল। এখানে কিন্তু রেডিও টাওয়ার আছে। অল্পের জন্য টাওয়ার এড়াতে পারলেন তারা। সামনে আসল বিপদ। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর দিয়ে তাদের পথে পড়ছে ৩৩০০০ কেভিএ বৈদ্যুতিক তার। তারা কি এটার নিচ দিয়ে যাবেন, নাকি ওপর দিয়ে। বদরুল, বলো কী করব। ওপর দিয়ে না নিচ দিয়ে।
নিচ দিয়ে স্যার।
ইয়েস নিচ দিয়ে। শীতলক্ষ্যার পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছ?
ইয়েস স্যার।
কুয়াশা নাই, এইটা ভালো।
ইয়েস স্যার।
ওই দেখো আমাদের টার্গেট। গোদনাইল তেলের ডিপো।
স্যার। আমি রকেট চার্জ করছি স্যার।
ওকে। আমি সোজা এই স্পিডেই যাব। ইউ ডু ইয়োর জব।
রকেট ছোঁড়ায় পেশাদারি দক্ষতা আছে বদরুলের। দুটো রকেট ছুড়লেন। তেলের পাম্প দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
বদরুল, শাবাশ। কিন্তু আগুন তো দাউদাউ করে হেলিকপ্টার পর্যন্ত উঠছে। আপনি বামে টার্ন করতে থাকুন স্যার।
ঘুরে আবার এলেন তারা লক্ষ্যের কাছে। বদরুল এবার ছয় জোড়া রকেট একবারে চার্জ করলেন।
আগুনের শিখা আকাশ পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে। তারা আবারও গতিমুখ বদলালেন। তারপর ফিরতে লাগলেন তেলিয়াপাড়ার মুখে। এবার আর কোনো চিন্তা নেই। রকেট নেমে গেছে। তেল অনেক কমে গেছে। হেলিকপ্টার এখন হালকা। কাজেই হেলিকপ্টার উড়তে আর কোনো সমস্যা হবে না।
তারা তেলিয়াপাড়ার কাছে এসেছেন।
সুলতান মাহমুদ বললেন, লিফলেটগুলো ছুঁড়েছ?
গানার বলল, ভুইলা গেছিলাম স্যার।
চলো আবার লিফলেট ছুঁড়তে যাই।
গানার বলল, তেল শেষ হয়ে গেছে স্যার।
সুলতান হাসলেন। বললেন, আমরা এখন তেলিয়াপাড়ায় ল্যান্ড করছি।
ভোর হচ্ছে। এখন আমাদের আর ল্যান্ড করতে কোনো অসুবিধা হবে না।
তারা পাহাড়ের ওপরে নেমে গেলেন।
হেলিকপ্টারের স্টার্ট বন্ধ করা হলো।
পাখির ডাক শোনা যেতে লাগল পাহাড়ি গাছগুলো থেকে। ভোরের সূর্য তখন কুয়াশা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে।
অটার বিমান নিয়ে কমলপুর থেকে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং ক্যাপ্টেন আকরাম চলেছেন চট্টগ্রাম অভিমুখে। তাঁদের সঙ্গেও একজন গানার। রাত ১১টা ৪০-এ উড়তে শুরু করে মাটি থেকে মাত্র ১০০ ফুট ওপর দিয়ে তাঁরা চলতে শুরু করেন, যাতে শত্রুবাহিনী রাডারে ধরা না পড়েন। বিদ্যুতের তার, টাওয়ার, ময়নামতি পাহাড়ের বিপদ এড়িয়ে ঘন কুয়াশা পাড়ি দিয়ে তারা দুই ঘণ্টায় চট্টগ্রামের লক্ষ্যবস্তুর কাছে যান। বিমানের তেলের ডিপোতে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করলেন। তখন বাজে ১টা ১০ মিনিট। তেলের ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ আর আগুন দেখে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারল যে এটা তাদের নিজেদের প্লেন নয়, শত্রুবিমান, তখন তারা একযোগে কামান দাগা শুরু করল। দুই বৈমানিক দেখতে পেলেন পেছনে আগুনের বাণ উড়ছে। দুই ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে ৩টা ১০-এ তাঁরা শিলচরের কাছে কুম্ভীপুরে নিরাপদে ফিরে এলেন। দেখতে পেলেন, এই ডিসেম্বরের শীতে আকাশের নিচু তাপমাত্রায় থাকা সত্ত্বেও তারা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছেন।
৮৭
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। লায়ালপুর জেলের ভেতরের আদালতকক্ষ। শেখ মুজিবকে হাজির করা হয়েছে। তিনি শুধু একবার বললেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আদালতে?
জি হুজুর। পেয়াদারা বলল।
শেখ মুজিব হাসলেন।
হাসছেন কেন স্যার?
এই আদালতে নেবার মানে কী? বিচারকেরা আগে থেকেই জানে, তারা কী রায় দেবে। এটা ইয়াহিয়া খান আগে থেকেই ঠিক করে তারপর এই আদালত বসিয়েছে। গতকাল তারা তাড়াহুড়া করে বলেছে, উভয় পক্ষের আমেন্ট শেষ করুন। আমাদের হাতে সময় নাই। হাতে সময় না থাকলে বিচার করার দরকার পড়ে না। আমার যদি জেল হতো, তাহলে তো তাড়াহুড়া করতে হতো না। এর একটাই মানে তারা আমাকে খুন করতে চায়। খুন করার জন্য আমাকে আদালতে নেবার দরকার কী?
মুজিবকে কাঠগড়ায় তোলা হলো। বিচারকেরা এসে বসলেন। পাঁচজন বসার কথা। একজন আসেননি। যিনি আসেননি, তিনিই ছিলেন এই ট্রাইব্যুনালের একমাত্র বেসামরিক বিচারক।
প্রধান বিচারক বললেন, আমাদের একজন মাননীয় বিচারক আসতে পারেননি। তাঁর পিতার মৃত্যু হয়েছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
প্রধান বিচারক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বললেন, আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক গৃহীত সাক্ষ্য উপস্থাপিত হয়েছে। সাক্ষীদের হাজির করা হয়েছে এবং উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরা তাঁদের জেরা করেছেন। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে এই আদালত এই রায় সর্বসম্মতিক্রমে দিচ্ছেন যে আসামির বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সামরিক আইনের বিধি বলে আসামি শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হলো। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সামরিক আইনের বিধি বলে এই রায়ের বিশ্লেষণ কিংবা সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই, সুযোগও নেই। এই রায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমোদনসাপেক্ষ। আদালত সমাপ্ত হলো।
শেখ মুজিব পরে জানতে পারবেন যে ৩ ডিসেম্বরে ইয়াহিয়া খান বিচারকদের ডেকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে গিয়েছিলেন। আর ৪ ডিসেম্বরেই রায় ঘোষণা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রায় কী হবে, তা-ও তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন।
ব্রোহি মাথা নিচু করে চলে গেলেন।
শেখ মুজিবকে আবারও নির্জন সেলে এনে রাখা হলো।
শেখ মুজিব ফিরে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বিকেলে তার হাঁটার সময় তিনি যথারীতি হাঁটলেন।
তারপর অজু করে তিনি মাগরিবের নামাজ পড়লেন। শীতকালটা গরমকালের চেয়ে বেশ সহনীয়। তিনি কোরআন শরিফ থেকে খানিকক্ষণ পাঠ করলেন। তারপর তিনি আপনমনে বলতে লাগলেন, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, আমি একবার মরি, দুইবার মরি না। যদি আমাকে মারতে হয় মারো। শুধু আমার একটা অনুরোধ আছে, আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ো।
৮৮
ব্যাঙ্গমা বলল, বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, কোটি মানুষের শরণার্থী হওয়া, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাইগা যাওয়া, চীন রাশিয়ার এর সাথে যুক্ত হওয়া–এই সবকিছুর পিছনে আছিল মাত্র দুইটা মানুষ।
ব্যাঙ্গমি বলল, নিক্সন আর কিসিঞ্জার। .
ব্যাঙ্গমা বলল, আরও নির্দিষ্ট কইরা ভাবলে মাত্র একজন মানুষ। নিক্সন।
ব্যাঙ্গমি বলল, দ্যাশে দ্যাশে যুদ্ধ লাগে। সমাজে-রাষ্ট্রে কত বিপ্লব হয়। এই সবের অর্থনৈতিক কারণ, সাংস্কৃতিক কারণ, ঐতিহাসিক কারণ–পুঁজি, রাষ্ট্রের লাভ, ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ–কত কিছু দিয়াই তো জ্ঞানী মানুষেরা ব্যাখ্যা করে। কিন্তু এর বাইরে যে একটা কারণ থাকতে পারে, যার নাম ব্যক্তিমানুষের মন–এটার কথা কেউ সাধারণত কয় না।
ব্যাঙ্গমা বলল, ঠিক কইছ। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়া খানের লগে এক ব্যাখ্যার অতীত প্রেমের বন্ধনে জড়ায়া আছিলেন। আর ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না। এইটা যে কত বড় ফ্যাক্টর হইয়া দাঁড়াইছিল!
ব্যাঙ্গমি বলল, আর পাকিস্তানের জন্মের লগে লগে তার উপরে একটা জন্ম-অভিশাপ ভর করছিল। আমেরিকা কইছিল, এই নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের লগে আমাদের দোস্তি করতে হইব। রণকৌশলগতভাবে জায়গাটা ভীষণ ইম্পরট্যান্ট। সেই যে আমেরিকার প্রেমের আসর পড়ল পাকিস্তানের উপরে, ২৪ বছরে সংবিধান দিতে পারল না, একটা ইলেকশন হইল, তার ফল মিলিটারি ভুট্টো পশ্চিমারা মাইনা নিতে পারল না। খালি ১৯৭১-এ নয়, এর পরেও কোনো দিনও পাকিস্তান মিলিটারি, জঙ্গি, মৌলবাদের হাত থাইকা বাইরাইতে পারব না।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, আসো আমরা নিক্সন আর কিসিঞ্জারের কর্মকাণ্ড ফলো করতে থাকি।
নিক্সন গেছেন ফ্লোরিডা। বেড়াইতে। মিয়ামি সৈকতে খালি গা হইয়া রোদ পোহাইবেন, চামড়ার রং বাদামি করবেন, এই হলো উদ্দেশ্য। সেইখানে, সমুদ্রের দিকে মুখ কইরা বইসা, বিয়ারের ক্যান সামনে রাইখা, উড়ন্ত গাঙচিলের পাখায় রোদের ঝলক দেখতে দেখতে নিক্সন খেইপা উঠেন।
আমার কিছু ভালো লাগে না। আমার কিছু ভালো লাগে না। আমার বাথরুম পাচ্ছে। আমার মনের ওপরে অসহ্য চাপ। নিক্সন বিড়বিড় করেন। তারপর তিনি বলেন, ওই মিয়া ফোন লাগাও।
কোথায় ফোন লাগাব স্যার।
কিসিঞ্জাররে ধরায়া দেও।
হ্যালো।
হেনরি, আমি তো অসুস্থ হয়ে পড়ছি। একেবারে অসুস্থ।
কেন? শরীরটা খারাপ?
মন খারাপ। মেজাজ খারাপ। আমি অসুস্থ। যখনই আমি আমার পেয়ারের পাকিস্তানের কথা ভাবি, হেনরি, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ইন্ডিয়া কী দশা করে ফেলল পাকিস্তানের। আমরা কি ওই কুকুরিকে সাবধান করে দিইনি? দিয়েছি। তারপরও তার এত বড় সাহস! হেনরি তুমি একটা কিছু করো।
আচ্ছা আমি দেখছি। আমি ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের মিটিং ডাকছি। আমরা অবশ্যই একটা কিছু করব।
কিসিঞ্জার কী কী করা যায়, ভাবছেন। কাগজপত্র তৈরি করছেন। একটু পরে আবার ফোন।
হেনরি?
ইয়েস প্রেসিডেন্ট।
তুমি কী করছ? পাকিস্তানের ব্যাপারে তুমি কী করছ? তুমি তো জানো আমরা পাকিস্তানের পক্ষে। তুমি একটা কিছু করো। শক্ত কিছু করো।
অবশ্যই।
কিসিঞ্জার খেতে বসেছেন। দুপুরের লাঞ্চে তিনি আজ খাবেন একটা স্যান্ডউইচ, সঙ্গে একটুখানি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। আর কালো কফি।
আবারও ফোন।
হ্যালো হেনরি।
ইয়েস, প্রেসিডেন্ট।
তুমি কি বুঝছ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তুমি এই বাস্টার্ড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে কী করছ আমাকে জানাও।
বিকেলে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের মিটিং বসল। কিসিঞ্জার বললেন, প্রেসিডেন্ট অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁর হুকুম আমরা যেন পাকিস্তানের পক্ষে থাকি। কী করা উচিত বলুন।
সবাই মাথা চুলকাতে লাগল। কী করা উচিত? আমরা জাতিসংঘে যেতে পারি।
রাইট।
আমরা বলতে পারি, ইন্ডিয়া নগ্ন আগ্রাসন চালাচ্ছে। এটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান তাদের সৈন্য নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে আনবে।
গ্রেট আইডিয়া। পাকিস্তান ইন্ডিয়ার ভেতরে ঢুকতে পারে নাই। কাজেই এ কথা বলার অর্থই হলো আমরা পাকিস্তানের পক্ষে।
কিসিঞ্জার ফোন করলেন প্রেসিডেন্টকে। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর শীতকাতর দিবসে।
হ্যালো, ইয়াহিয়া খান ফোন করেছিলেন। তিনি বলছেন আমরা তাকে ইরানের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারি কি না।
নিক্সন বললেন, আমার বন্ধু ইয়াহিয়া আমাকে দুদিন আগে কল করেছিল। বলেছে, আমি যেন ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিই। আর মনে। করিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সেন্টো চুক্তি আছে। যার মাধ্যমে আমরা তাদের অস্ত্র দিতে বাধ্য।
কিসিঞ্জার বললেন, না। তাদের সঙ্গে আমাদের এই চুক্তি নেই। এটা বরং ভারতের সঙ্গে আমাদের হয়েছিল চীন যুদ্ধের সময়। তো ইরানের মাধ্যমে অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কী করা যায়?
নিক্সন তখন একটা পেনসিল তুলে নিয়ে পিঠের বেকায়দা জায়গায় চুলকাতে চুলকাতে বললেন, রোদ আমার সহ্য হয় না হেনরি। স্কিনে অ্যালার্জি হয়। আচ্ছা ইরান, দেখো না কী করতে পারো।
আমার মনে হয় আমরা ইরানকে বলতে পারি অস্ত্র দাও। তবে ইরান বলে যে সেই অস্ত্র আমাদের পূরণ করে দিতে হবে।
তা দেব।
জর্ডানও জানতে চায় ইয়াহিয়াকে তারা আমাদের প্লেন দেবে কি না।
দিতে বলো। তবে যদি এই খবর ফাঁস হয়, আমরা জাস্ট অস্বীকার করব।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ জাতিসংঘে আমেরিকার স্থায়ী প্রতিনিধি। তিনি জাতিসংঘে প্রস্তাব আনলেন। এখনই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যার যার সৈন্য নিজ দেশে ফেরত আনতে হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক। তিনি হাতে তুললেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটা নথি, যেটা আলোচনার শুরুতেই সবার হাতে হাতে দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যা নিয়ে, সেই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা তো আমাদের শুনতে হবে। তিনি জাতিসংঘের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। আমরা ডাকলেই তিনি আসতে পারেন।
পাকিস্তান তীব্র বিরোধিতা করল। চীন বলল, এটা অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে, কাজেই জাতিসংঘের নীতিবিরোধী।
ইয়াকফ মালিক আইন দেখালেন, নিরাপত্তা পরিষদ মনে করলে তৃতীয় কাউকে ডেকে তার কথা শুনতে পারে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তর্কবিতর্ক চলতে লাগল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বলল, আমাদের প্রস্তাব হলো, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ফয়সালা দরকার।
চীন নতুন এসেছে নিরাপত্তা পরিষদে। তারা বলল, ভারতের এই নগ্ন আগ্রাসনের প্রতিবাদে…
আমেরিকার প্রস্তাব সমর্থন করল ১১ সদস্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে দিল। রাশিয়ার প্রস্তাব সমর্থন করল শুধু পোল্যান্ড। চীনেরটা কেউই করল না…
ব্রিটেন আর ফ্রান্স ভোটদানে বিরত রইল।
এই সব বিতর্ক চলতে থাকুক। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পথে চলছেন। তিনি চাচ্ছেন জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করার আগেই ঢাকার পতন ঘটাতে।
৮৯
৪ ডিসেম্বরে সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন আহমদ চলে গিয়েছিলেন দিল্লি। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা চিঠি দিয়ে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর হাতে। তাতে তারা বলেছিলেন :
ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, সম্মানের সঙ্গে জানাচ্ছি যে ৩ ডিসেম্বর আপনার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সরাসরি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের যেকোনো সেক্টরে অথবা ফ্রন্টে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অব্যাহত লড়াই জোরদার করতে প্রস্তুত রয়েছে। আমরা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি তাহলে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যাপ্তি লাভ করবে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা আপনার কাছে পুনরায় অনুরোধ করছি, ভারত সরকার অবিলম্বে আমাদের দেশ ও সরকারকে স্বীকৃতি দান করুন। আমাদের আন্তরিক আশা যে আমাদের যৌথ প্রতিরোধের ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হীন পরিকল্পনা ও জঘন্য ইচ্ছা ব্যর্থ হতে বাধ্য হবে এবং আমরা সফল হব।
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আপনাদের ন্যায়নিষ্ঠ সংগ্রামের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি।
৫ ডিসেম্বর সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন দিল্লি থেকে ফিরে এলেন কলকাতায়।
৬ ডিসেম্বর সোমবার সকালবেলা।
ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দিচ্ছেন পার্লামেন্টে। তিনি বললেন, আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ সরকারের বারবার অনুরোধে যথেষ্ট বিবেচনার পর ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
মাননীয় সদস্যরা জেনে সুখী হবেন যে বাংলাদেশ সরকার তাদের রাষ্ট্রীয় নীতির মৌলিক আদর্শ ঘোষণা করেছে। আর সেসব হচ্ছে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা…তাদের ঘোষিত আদর্শের সঙ্গে ভারতের আদর্শের মিল রয়েছে। একসঙ্গে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আমরা সৎ প্রতিবেশী হয়ে বাস করার এমন এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরব যাতে এ অঞ্চলে শান্তি, শৃঙ্খলা ও প্রগতি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই একযোগে টেবিল চাপড়াতে লাগল। হর্ষধ্বনি উঠল পার্লামেন্টে। এই রকম ঐকমত্য ভারতের পার্লামেন্টে নজিরবিহীন।
পার্লামেন্টে উপস্থিত ছিলেন দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ পক্ষে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রদূতের কাজ করে যাচ্ছিলেন। পার্লামেন্টে লোকজন তাকে বিপুলভাবে ফুলের মালা দিতে লাগল। তিনি বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, আপনি শুধু ভারতের নেত্রী নন, আপনি বিশ্বেরও একজন নেত্রী। তার বক্তৃতা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হলো।
খবর ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎবেগে। কলকাতা থিয়েটার রোডের কর্মীরা হর্ষধ্বনি দিয়ে আঙিনায় বেরিয়ে এলেন। জনসংযোগ বিভাগের কর্মী আলী তারেক বাংলাদেশ সরকারের অফিস ভবনের সামনে লাল-সবুজ-হলুদ পতাকা। উড়িয়ে দিলেন। ডিসেম্বরের উত্তুরে হাওয়ায় সেই পতাকা উড়তে লাগল গর্বভরে।
অফিসে ছিলেন মুক্তিবাহিনী প্রধান ওসমানী। আর ছিলেন তাঁর এডিসি শেখ কামাল। ফারুক আজিজ খান তাদের দুজনকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন। জানালেন। অফিসের ফটোগ্রাফার সেই ফুল দেবার ছবিও তুলে ফেললেন। চটপট। শেখ কামালও ওসমানীর হাতে ফুল তুলে দিলেন। মিষ্টি বিতরণ চলল অফিসে।
.
তাজউদ্দীন অফিসে এলেন বিকেলে। কালো রঙের অ্যাম্বাসেডর গাড়ি তাঁকে নিয়ে এসে অফিসের আঙিনায় থামল। পেছনে আরেকটা গাড়িতে নিরাপত্তাকর্মীরা। তাজউদ্দীন গাড়ি থেকে নামলেন। সবুজ রঙের সাফারি পরনে তার। তাঁর পাশে উৎফুল্ল সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সবাই দৌড়ে গেল তাঁদের কাছে। তাঁদের বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হলো। স্লোগান উঠল : জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় ইন্দিরা গান্ধী।
সংবাদকর্মীরা এলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ আপনার মনের অবস্থা কী?
তাজউদ্দীন বললেন, আমার আবার প্রতিক্রিয়া কী? একটা নতুন শিশুর জন্ম হলো। অথচ শিশুটির জনক শত্রুদের কারাগারে বন্দী। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতির কথা বারবার স্মরণ করছি। নবজাতকের কান্না শুনে তার পিতা যেমন খুশি হন, বঙ্গবন্ধু উপস্থিত থাকলে তো তিনি তেমনি খুশি হতে পারতেন।
তাজউদ্দীন কেঁদে ফেললেন।
.
রাতের বেলা ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডের বাড়িতে সবাই রেডিও শুনছেন। রেনু মাথার চুল আঁচড়াচ্ছেন। হাসিনার চুল বেঁধে দিলেন রেহানা। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। বাসনকোসন ধুয়ে সবাই এখন রেডিও শোনার জন্যই তৈরি। প্রথমে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। তারপর বিবিসি। তারপর আকাশবাণী।
আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
খবরের শেষে সংবাদ পরিক্রমা। লিখেছেন প্রণবেশ সেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধু আজ এই শুভক্ষণে আমাদের মাঝে নেই, এই বেদনা কোথায় রাখি! বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন!
তার এই কান্না সঞ্চারিত হলো ১৮ নম্বরের বাড়িতে। কাঁদতে লাগলেন হাসিনা, কাঁদতে লাগলেন রেহানা। রাসেল চোখের পানি ফেলে গোপনে। রেনু শক্ত হয়ে রইলেন।
খোকা বললেন, চল হাসিনা। আমাদের এই বাড়ির মিলিটারিগুলোকে বের করে দিই। আমাদের দেশ স্বাধীন দেশ। ওরা দখলদার। ভারত এই দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা বিশ্ব দেবে। চল।
রেনু বললেন, স্বামী গেছে। দুই ছেলে গেছে যুদ্ধে। ভাগনে-ভাতিজারা গেছে। খোকা তুই আর পাগলামো করিস না। শান্ত হয়ে থাক। আর কটা দিন দেখ। আর দশ দিনের মধ্যেই দেখিস এরা ভেগে যাবে।
ব্যাঙ্গমা বলে, বেগম মুজিবের কথা ঠিক হইছিল। দশ দিন পর ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি মিলিটারি আত্মসমর্পণ করছিল।
ব্যাঙ্গমি মাথা নাড়ে।
.
৭ ডিসেম্বর ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা পি এন ব্যানার্জি এসেছেন মুজিবনগরে। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে চলে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিব ফারুক বসে ছিলেন সিঁড়িতে। সেখান থেকে আকাশ দেখা যায়। আকাশ ঝকঝক করছে। অসম্ভব নীল আর রোদ ঝলমল আজকের আকাশটা। ব্যানার্জি চলে যাওয়ার পর তাজউদ্দীন বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে। ফারুককে বললেন, এই চিঠিটা পড়েন। সুন্দর চিঠি।
ফারুকের সঙ্গে রিডিং গ্লাস নেই। তাজউদ্দীন তাঁর নিজের চশমাটা দিয়ে বললেন, এটা লাগিয়ে পড়ুন।
ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের উদ্দেশে ইংরেজিতে লিখেছেন :
৪ ডিসেম্বরে মাননীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি যে বার্তা আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তাতে আমার সহকর্মীবৃন্দ ও আমি খুবই অভিভূত হয়েছি। চিঠি পাওয়ার পর আপনাদের সাফল্যজনক নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানসংক্রান্ত আপনাদের অনুরোধ ভারত সরকার পুনর্বিবেচনা করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার আপনাদের। স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আজ সকালে আমি পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে একটা বিবৃতি দিয়েছি। তার অনুলিপি এর সঙ্গে পাঠালাম।
বাংলাদেশের জনসাধারণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালযাপন করেছে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আপনাদের যুবসমাজ নিঃস্বার্থভাবে আত্মাহুতির মাধ্যমে এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। ভারতের জনসাধারণও একই মূল্যবোধকে রক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ। আমাদের মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এই অধ্যবসায় ও আত্মদান আমাদের দুই দেশের জনসাধারণের মধ্যে বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করবে। পথ যতই দীর্ঘ হোক না কেন এবং ভবিষ্যতে আমাদের জনসাধারণের যত ত্যাগ করতে হোক না কেন, বিজয়ের মালা আমরা বরণ করবই। এ উপলক্ষে আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং আপনার সহকর্মী ও বাংলাদেশের বীর জনতাকে আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আমি আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করছি।
ইন্দিরা গান্ধী।
ফারুক বললেন, সত্যিই খুব সুন্দর চিঠি।
চ্যাটার্জিবাবু সিল আর প্যাড ফেরত দিয়ে গেছেন। সেটা নিয়ে ফারুক গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বললেন, এটা একটা ঐতিহাসিক জিনিস। আপনি এই সিল আর প্যাড রেখে দিন। স্মারক হিসেবে এটা আপনার সংগ্রহেই থাকা উচিত। অফিসের কাজ সারিয়ে নেওয়ার জন্য আমি নতুন সিল-প্যাড বানিয়ে নিয়েছি।