০৩. যিনি তোমাকে গর্ভে ধরেছেন

তাঁকে প্রশ্ন করা হল, যিনি তোমাকে গর্ভে ধরেছেন, স্তন্যদান করে জীবন দিয়েছেন, তোমাকে জ্ঞানের আলো দেখিছেন সেই তিনি আর যিনি মাতৃজঠর থেকে নির্গত হওয়ামাত্র তোমার জন্য জায়গা দিয়েছেন, তার সংস্কৃতি তার সংস্কার রক্তে মিশিয়ে দিয়েছেন এই তিনি-কাকে তুমি আপন বলে গ্রহণ করবে? তিনি বলরেন, দুজনকেই। কারণ একজনের সঙ্গে নাড়ির বাধন ছিন্ন হওয়ামাত্রই আর-একজনের সঙ্গে নাড়ির বাঁধন যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ছিন্ন না হলে যে যুক্ত হত না। তাই দুজনেই আমার আপন।

তাকে বলা হল, যদি একজনকে ত্যাগ করতে বলা হয় তবে কাকে ত্যাগ করবে? তিনি বললেন, এই মাটির তো তারও জননী। তাই এর জন্য জীবন দিয়ে তিনিই ধন্য হবেন। সে ত্যাগ মানে আরও বড় করে পাওয়া, সে-ত্যাগের আগেই আমার আনন্দ।

সমস্ত ক্লাস চুপচাপ, নতুন স্যার একটু থামলেন, তারপর উদগ্রীব-হয়ে-থাকা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই মায়ের পায়ে যখন লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল ইংরেজরা তখন তার এমন কত দামাল ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুঃখিনী মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাতে। একবারে না পারলে বলেছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। এই মা দেশমাতৃকা। তোমরা নতুন ভারতবর্ষের নাগরিক। আজ আমাদের মায়ের পায়ে বেড়ি নেইকো, অনেক রক্তের বিনিময়ে তিনি আজ মুক্ত, কিন্তু এতদিনের শোষণে তিনি আজ রিক্তা, মলিন, শীর্ণা। তোমাদের ওপর দায়িত্ব তার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনবার। নাহলে তোমরা যাদের উত্তরাধিকারী তাদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না ভাই। ব্যস, আজ এই পর্যন্ত। টেবিলের ওপর থেকে ডাস্টার বই তুলে নিয়ে স্যার ক্লাসরুম থেকে সোজা-মাথায় বেরিয়ে গেলেন। তার খদ্দরের পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ বুঝতে পারেনি ওর সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। এইসব কথা এই স্কুলের নতুন স্যার আসার আগে কেউ বলেনি। ব্যাপারটা ভাবলেই কেমন হয়ে যায় মনটা। নতুন স্যার বলেছেন, শিবাজীও একজন স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধা ছিলেন। শিবাজীর কথা শুনলে মনের মধ্যে কিছু হয় না, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু যখন বলেন গিভ মি ব্লাড তখন হৃৎপিণ্ড দপদপ করে। এই ব্লাড শব্দটা উচ্চারণ করার সময় নতুন স্যার এমন জোর দিয়ে বলেন অনিমেষ চট করে সেই ছবিটা দেখতে পায়, নিজের আঙুলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ কান্না পেয়ে যায়।

নতুন স্যার থাকেন হোস্টেলে। ওদের স্কুলের সামনে বিরাট মাঠ পেরিয়ে হোস্টেল। কদিনের মধ্যে অনিমেষের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল নতুন স্যারের। ওদের স্কুলের অন্যান্য টিচার দীর্ঘদিন ধরে পড়াচ্ছেন। ওঁরা নতুন স্যারের সঙ্গে ছাত্রদের এই মেলামেশা ঠিক পছন্দ করেন না। একমাত্র ড্রিল স্যার বরেনবাবুর সঙ্গে নতুন স্যারের বন্ধুত্ব আছে। ওঁরা দুজন এক ঘরে থাকেন।

অনিমেষের পড়ার চাপ পড়েছে বলে সরিৎশেখর ভোরে আর ওকে বেড়াতে যেতে বলেন না। কিন্তু এইটুকু ছেলের মধ্যে যে চাঞ্চল্য ছটফটানি থাকার কথা অনিমেষের মধ্যে তা নেই। সারাদিনই যখনই বাড়িতে থাকে তখনই মুখ গুঁজে বই পড়ে। বই পড়ার এই নেশাটা ওর মধ্যে ঢুকিয়েছিল প্রিয়তোষ। ঢুকিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে সে। সরিৎশেখরের জীবনে আর-একটি আঘাত এই ছোট ছেলে। দিনরাত বাড়ির বাইরে পড়ে থাকত, কখন যেত কখন আসত হেমলতা ছাড়া কেউ টের পেত না। রাগারাগি করতে করতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন সরিৎশেখর। চাকরিবাকরি করে না, তার কোনো সাহায্য হচ্ছে না, এ-ছাড়া এই ছেলের বিরুদ্ধে ওঁর অভিযোগ করার অন্য কারণ নেই। অনি তখন সবে স্কুলে ভরতি হয়েছে। বাড়ি এলে অনির সঙ্গে আড্ডা হত খুব। স্বর্গহেড়ায় ওর যেআকর্ষণের আভাস তিনি হেমলতার কাছে পেয়েছেন সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু ও যে আর স্বৰ্গছেঁড়ায় যায় না, জোর করেও তাকে স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠাতে পারেননি সেকথাও তো সত্যি।

তারপর সেই দিনটা এল। তিন দিন বাড়ি আসেনি প্রিয়তোষ। সরিৎশেখর এখানে-সেখানে ওকে খুঁজেছেন। যে-কজন ওর সমবয়সি-ছেলেকে ওর সঙ্গে ঘুরতে দেখেছেন তারাও ওর হাদিস দিতে পারেনি। বিরক্ত চিন্তিত সরিৎশেখর ঠিক করেছিলেন প্রিয়তোষ এলে পাকাপাকি কথা বলে নেবেন ভদ্রভাবে সে বাড়িতে থাকতে পারবে কি না।

তখন ওঁরা নতুন বাড়িতে উঠে এসেছেন। ছোট বাড়িটায় পুরনো জিনিসপত্রের গুদাম করে রাখা হয়েছে। মাঝখানে বড় ঘরটায় সরিৎশেখর একা শোন, লাগোয় ঘরটায় হেমলতা। বাইরের দিকের ঘরটায় প্রিয়তোষ এবং অনিমেষ থাকত। অনিমেষকে সে বছরই প্রথম স্কুলে ভরতি করা হয়েছে, খুব কড়া স্কুল। এ-জেলার মধ্যে এই স্কুলের নামডাক সবচেয়ে বেশি। সরিৎশেখর নিজে গিয়ে ওকে ক্লাসে বসিয়ে এসেছেন। ভেবেছিলেন ক্লাসে ঢুকে ছেলেটা নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করবে। কিন্তু অনি ওঁর চলে আসার সময় খুব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ছেলেটার। সেই জন্ম থেকে তিনি ওকে দেখছেন, ওর নাড়িনক্ষত্র জানা, কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর ছেলেটা রাতারাতি পালটে যাচ্ছে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে চুপচাপ ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। প্রিয়তোষ ওর। দিদিকে বলেছে রাতদুপুরে অনি নাকি জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে কথা বলেব না। হেমলতাকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন সরিৎশেখর এটাই চাইছিলেন।

মাধুরী বেঁচে থাকতে কাকার সঙ্গে অনির খুব একটা ভাব ছিল না। বরং কারণে–অকারণে প্রিয়তোষ ওর উপর অত্যাচার করত। অনির কান দুটো প্রিয়তোষের আঙুলের বাইরে থাকার জন্য তখন প্রাণপণ চেষ্টা করত। মা মরে যাবার পর প্রিয়তোষের ব্যবহার একদম পালটে গেল।

নতুন স্যার তখন সদ্য স্কুলে এসেছেন। ওঁর কথাবার্তা, হাসি অনিমেষের খুব ভালো লাগছে। মাঝে-মাঝে যখন খুব শক্ত কথা বলেন তখন অনিমেষরা বুঝতে পারে না। কিন্তু যখন দেশের গল্প করতে করতে নতুন স্যার জানতে পারলেন অনির মা নেই, অনি দেখল, ক্লাসের সমস্ত মুখগুলো ওর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। যেন মা নেই ব্যাপারটা কেউ ভাবতে পারছে না। নতুন স্যার ওকে দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। যেন মা নেই ব্যাপারটা কেউ ভাবতে পারছে না। নতুন স্যার ওকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, মা নেই বোলো না। আমাদের তো দুটো মা, একজন চলে গেলেন ঈশ্বরের কাছে, কিন্তু আর-এক মা তো রয়েছেন। তুমি তার কথা ভাববে, দেখবে আর খারাপ লাগবে না। বঙ্কিমচন্দ্র বলে একজন বিরাট সাহিত্যিক ছিলেন, তিনি এই দেশকে মা বলেছিলেন, বলেছিলেন বন্দেমাতরম।

প্রিয়তোষ সেই রাত্রে বাড়িতে ছিল। অনেক রাত জেগে কাকাকে বইপত্র পড়তে দেখত অনিমেষ। নিজের খাটে শুয়ে শুয়ে প্রিয়ভোষকে নতুন দিদিমণি যখন বন্দেমাতরম শব্দটা ওদের উচ্চারণ করেছিলেন তখন শব্দটার মানেটা ও ধরতে পারেনি। নতুন স্যার ওকে সে-রহস্য থেকে মুক্ত করেছেন। সব শুনে প্রিয়তোষ বলল, শালা কংগ্রেসি!

এই প্রথম অনিমেষ কাকাকে গালাগাল দিতে শুনল। স্বৰ্গছেঁড়ায় বাজারের রাস্তায় অনেক মদেসিয়া মাতালকে এই শব্দটা ব্যবহার করতে শুনেছে ও। মাধুরীর শ্রাদ্ধের সময় নদীয়া থেকে অনির মামামরা এসেছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন ওঁরা হলেন মহীতোষের শালা। রেগে গেলে এই সম্বোধনটাকে কেন লোকে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে বুঝতে পারে না অনিমেষ। আবার মদেসিয়াদের মুখে শুনতে যতটা-না খারাপ লাগত এই মুহূর্তে কাকার মুখে খুব বিচ্ছিরি লাগল। কংগ্রেসি শব্দটা ও খবরের কাগজ থেকে জেনে গিয়েছিল। যেমন মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসি, জওহরলাল নেহরু কংগ্রেসি। দেশের জন্য যারা কাজ করে তারা কংগ্রেসি, তাদের মাথায় একটা সাদা টুপি থাকে। নতুন স্যারের মাথায় সাদা টুপি নেই, তা হলে তিনি কংগ্রেসি, তাদের মাথায় একটা সাদা টুপি থাকে। নতুন স্যারের মাথায় সাদা টুপি নেই, তা হলে তিনি কংগ্রেসি হবেন কী করে? আর যারা দেশের জন্য কাজ করে, দেশমায়ের জন্য জীবন দান করে তারা শালা হবে কেন? কিন্তু কাকার সঙ্গে তর্ক করা বা কাকার মুখেমুখে কথা বলতে সাহস পেল না অনিমেষ। কথা বলার সময় কাকার মুখ-চোখ দেখেছিল ও, ভীষণ রাগী দেখাচ্ছিল তখন। কিন্তু কাকার কথা মেনে নিতে পারেনি, নতুন স্যারকে গালাগালি দিয়েছে বলে কাকার ওপর ওর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। সেদিন মাঝরাতে অনির ঘুম ভেঙে গেলে দেখল কাকা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা বই ওর মাথায় তলার চাপা পড়ে দুমড়ে যাচ্ছে। হারিকেনের আলোটা কমানো হয়নি। অনেক রাত অবধি আলে জ্বেলে রাখলে দাদু রাগ করেন, কেরোসিন তেল নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু অনি উঠে আলো নেবাল না, কাকাকে ডাকল না। দাদু যদি এখন এখানে আসে বেশ হয়। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল ও। একটা-দুটো করে তারা গুনতে গুনতে আস্তে-আসতে সেগুলো মায়ের মুখ হয়ে গেল। অনি স্থির হয়ে অনেকক্ষণ মাকে দেখল, তারপর নিজের মনে বলল, মা, যারা দেশকে ভালোবাসতে বলে তারা কি খারাপ?

(না সোনা, কক্ষনো না।)

তাহলে কাকা কেন নতুন স্যারকে গালাগালি দিল?

(কাকা রেগে গেছে তাই।)

আমি যদি দেশকে ভালোবাসি তুমি খুশি হবে তো?

(আমি তো তা-ই চাই সোনা।)

মা, তোমার জন্য বড় কষ্ট হয় গো কথাটা বলতেই অনির চোখ উপচে জল বেরিয়ে এল সেই জলের আড়াল ভেদ করে আনি আর কিছুই দেখতে পেল না। অনি লক্ষ করেছে যখনই সে মায়ের সঙ্গে কথা বলে, কষ্টের কথা বলে, তখনই চোখ জুড়ে নেমে আসে আর সেই সুযোগে মা পালিয়ে যায়। চোখ মুছে আর খুঁজে পায় না সে।

কদিন কাকা বাড়িতে আসেনি। দাদু অনেক খুঁজেও ছোট কাকার খবর পাচ্ছেন না। জলাইগুড়িতে হঠাৎ একটা মিছিল বেরিয়েছে। অনি দেখেনি, কিন্তু ক্লাসে বন্ধুদের কাছে শুনেছে সেটা নাকি কংগেসিদের মিছিল নয়, তারা কংগ্রেসিদের গালাগালি দিচ্ছিল। পুলিশ নাকি খুব লাঠির বাড়ি মেরেছে। গোলমাল হবার ভয়ে সুর কদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময় খবরের কাগজ পড়ে সরিৎশেখর খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। বাড়িতে খুব শক্ত ইংরেজি কাগজ রাখতে আরম্ভ করলেন তিনি, ওতে নাকি অনেক বেশি খবর থাকে।

কদিন বাদে অনেক রাত্রে দরজায় টকটক শব্দ হতে অনিমেষের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কাকা না থাকলেও এক ওত ও। হেমলতা আপত্তি করতে ও বহিল ওর ভয় করবে না। পিসিমার বাবা দাদুর ঘর থেকে জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না। এনে ও দেখল পাশের জানলার নিচে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ও চোখ বন্ধ করতে যালি, হঠাৎচাপা গলায় নিজের নাম শুনতে পেয়ে বুঝল, কাকা এসেছে। চট করে উঠ গিয়ে দরজা খুলতে কাকা মূখে আঙুল দিয়ে ইশারা করে ওকে চুপ। করতে বলল, তারপর ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। অনিমেষ দেখল এই কয়দিনে কাকার চেহারা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছে। পাজামা আর শার্ট খুব ময়লা, গালরতি হোট ঘোট দাড়ি গজিয়েছে, স্নানটান হয়নি বোঝা যায়। ঘরে এসে কাকা প্রথমে হারিকেনটা বাড়িয়ে দিল, তারপর ওর খাটের তলা থেকে একটা টিনের সুটকেস টেনে বের করল। তালা খুলে ফেলতে দেখল, সামান্য কয়েকটা জামাকাপড় ছাড়া অনেকগুলো বই আর পত্রিকায় সেটা ভরতি। কাকা ওর সঙ্গে কথা বলছে না, একমনে বইগুলো উলটেপালটে দেখছে। তারপর অনেকক্ষণ দেখেশুনে কতগুলো বই আর পত্রিকা আলাদা করে বেঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে গিয়ে কী ভেবে আবার বান্ডিলের ওপরের পত্রিকাটার ওপর বড় বড় করে লেখা আছে-মার্কসবাদী। কাকা খুব ফিসফিস করে বলল, অনি, কেউ যদি আমার খোঁজে এখানে আসে তা হরে তাকে কক্ষনো বলবি না যে আমি এসে বইগুলো নিয়ে গেছি। বুঝলি?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, তারপর বলল, তুমি কেন চলে যাচ্ছ?

কাকা বলল, ওদের পুলিশ আমাদের ধরে জেলখানায় নিয়ে যেতে চাইছে। আমাদের পার্টিকে ভ্যান করে দিয়েছে ওরা। মুখে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলবে, অথচ কাউকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে না।

অবাক হয়ে অনি বলল, কারা?

কাকা থেমে গেল প্রথমটা, তারপর হেসে বলল, ঐ বন্দেমাতরম পার্টি, কংগ্রেসিরা। তুই এখন বুঝবি না, বড় হলে যখন জানবি তখন আমার কথা বুঝতে পারবি।

অনিমেষ বলল, কিন্তু নতুন স্যার বলেছেন কংগ্রেসিরা দেশসেবক।

ঘৃণায় মুখটা বেঁকে গেল যেন, কাকা বলল, দেশসেবা? একে দেশসেবা বলে? ভিক্ষে করার নাম দেশসেবা! ইংরেজদের পা ধরে ভিক্ষে করে রাত্রের অন্ধকারে চোরের মত হাতে ক্ষমতা নিয়ে দেশসেবা হচ্ছে। আমরা বলেছি এ আজাদি ঝুটা হ্যায়। আমরা এইরকম স্বাধীনতা চাই না যে-স্বাধীনতা শোষণের হাত শক্ত করে। তাই ওরা আমাদের গলা টিপতে চায়। ওদের হাতে পুলিশ আছে, বন্দুক আছে, কিন্তু আমাদের শরীরে রক্ত আছে-যাক, এসব কথা এখন তুই বুঝবি না।

আমাদের শরীরে রক্ত আছে। কথাটা শুনেই অনি নিজের আঙুলের দিকে তাকাল, তারপর ওর মনে পড়ল, গিভ মি ব্লাড, আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। সুভাষচন্দ্র বসুর দুইরকম ছবি দেখেছে ও। একটা ছবিতে সাদা টুপি মাথায় আর একটা ছবিতে মিলিটারি জামা টুপিতে একটি হাত সামনের দিকে বাড়ানো। সুভাষচন্দ্র বসু কি কংগ্রেসি ছিলেন না। ও কাকার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে ফেলল, তোমরা কি সুভাষচন্দ্র বসুর লোক হয়েছ।

অবাক হয়ে গেল প্রিয়তোষ, তারপর বলল, না, আমরা কমিউনিস্ট। আমরা চাই দেশে গরিব বড়লোক থাকবে না, সবাই সমান, তা হলেই আমরা স্বাধীন হব। আমি যাচ্ছি অনি, তুই কাউকে বলিস না আমি এসেছিলাম। আর মনে রাখিস এ আজাদি ঝুটা হ্যায়।

খুব সন্তর্পণে যেমন এসেছিল তেমনি বেরিয়ে গেল প্রিয়তোষ। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনিমেষ। কাকা যেসব কথা বলে গেল তার মানে কী? আমরা কি স্বাধীন হইনি! নতুন স্যারের কথার সঙ্গে কাকার কথার কোনও মিল নেই কেন? নতুন স্যার বলেছেন, স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমরাই আমাদের রাজা। ইংরেজরা যে শোষণ করে দেশকে নিঃস্ব করে গেছে এখন আমাদের তার শ্রী ফিরিয়ে আনতে হবে। আর কাকা বলে গেল এ-স্বাধীনতা মিথ্যে, তবে কি আমরা এখনও পরাধীন? কিছুই ঠাওর করতে পারল না অনিমেষ। সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ও দেখল, কাকা তাড়াতাড়িতে বইপত্র নিয়ে যাবার সময় ভুল করে সুটকেস বন্ধ করেনি। পায়ে পায়ে অনিমেষ সুটকেসটার কাছে এল। দুটো ধুতি, পাজামা, দুটো শার্ট রয়ে গেছে সুটকেসে। জামাকাপড় তুলতেই তলায় একটা পুরনো খবরের কাগজ। অনিমেষ দেখল, কাগজ জুড়ে একটা মানুষের ছবি, যার মাথাটা দেখা যাচ্ছে না। কৌতূহলী হয়ে কাগজটা তুলতে ও দেখল কাগজটা কাটা, ছবির মুখ নেই। একটা নীল কাগজ সুটকেসের তলায় সেঁটে থাকতে দেখল সে। কাগজটা বের করে আবার সবকিছু ঠিকঠাক রেখে সুটকেসের খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিল ও।

নীল কাগজটা খুলতেই সুন্দর করে লেখা কয়েকটা লাইন দেখতে পেল অনিমেষ। গোটা-গোটা করে লেখা, কোনো সম্বোধন নেই। লেখার শেষে নামটা পড়ে অবাক হয়ে গেল ও। তপুপিসি লিখেছে? কাকে লিখেছে তা হলে শ্রীচরণেষু বা পূজনীয় নেই কেন? তপুপিসি তো কাকার চেয়ে অনেক ছোট। গুদামবাবুর বাড়িটার কথা মনে পড়ল। তপুপিসি কুচবিহারে পড়ত। চিঠিটা পড়া শুরু করল অনিমেষ। পৃথিবীতে চিরকাল মেয়েরাই ঠকবে এটাই নিয়ম, আমার বেলায় তার ব্যতিক্রম হবে কেন? আমি খুব সাধারণ মেয়ে, আমি সুন্দরী নই। তোমার ওপর জোর করব সে-অধিকার আমার কোথায়? এখানে যখন ছিলে তখন তোমায় কিছুটা বুঝতাম। শহরে যাওয়ার পর তুমি কী দ্রুত পালটে গেলে। তোমার রাজনীতিই এখন সব, আমি কেউ নই। হঠাৎ মনে হল, তুমি তো আমাকে কোনোদিন কথা দাওনি, তোমাকে দোষ দিই কী করে! তুমি তো যৌবনের ধর্ম পালন করেছিলে। কী বোকা আমি! তাই তুমি যত ইচ্ছা রাজনীতি করো, আমি দায় তুলে নিলাম।–তপু।

তপুপিসি কেন এই চিঠি লিখেছে বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। কিন্তু তপুপিসি খুব দুঃখ পেয়েছে, কাকা রাজনীতি করে বলে তপূপিসির খুব কষ্ট হয়েছে। রাজনীতি করা মানে কী? এই যে কাকা। বাড়িতে থাকে না আজকাল, উশকোখুশকো হয়ে ঘুরে বেড়ায় চোরের মতো একে কি রাজনীতি বলে? এসব করলে কি আর তপুপিসির সঙ্গে ভাব রাখা যায় না? কিন্তু তপুপিসি কেন লিখেছে আমি সুন্দরী নই। সারা স্বৰ্গছেঁড়ায় তপুপিসির চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তো কেই নেই, এক সীতা ছাড়া। কিন্তু সীতা তো ছোট্ট। বড় হলে নাকি চেহারা পালটে যায়। বড় হবার পর সীতদা তপুপিসির মতো সুন্দরী নাও হতে পারে। এমন সময় অনিমেষ শুনতে পেল একটি গাড়ি খুব জোরে এসে শব্দ করে বাড়ির সামনে থামল। তিন-চারটে গলায় কথাবার্তা জুতোর শব্দ চারধারে ছড়িয়ে পড়তে ও জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। প্রথমে বুঝতে-না-বুঝতে দরজার প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ উঠল। আওয়াজটা ওর ঘরের দরজায়, দ্রুতহাতে কে শব্দ করছে, দরজা ভেঙে ফেলা যোগাড়। অনি কী করবে বুঝতে পারছিল না, এমন সময় সরিৎশেখরের গলা শুনতে পেল ও। শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে চিৎকার করছেন, কে কে? শব্দটা থেমে গেল আচমকা, একটা বাজখাই গলায় কেউ বলে উঠল, দরজা খুলুন, পুলিশ।

পুলিশ! অনিমেষ বুঝতে পারছিল না সে কী করবে। পুলিশ তাদের বাড়িতে আসবে কেন? ছেলেবেলা থেকে পুলিশ দেখলে ওর কেমন ভয় করে। সরিৎশেখরের চাচানি বন্ধ হয়ে গেল আচমকা। অনিমেষ শুনল দাদু উঠে তার নাম ধরে ডাকছেন। সে দখল তার গলা শুকিয়ে গেছে, দাদুর ডাকে সাড়া দিতে পারছে না। বিদ্যাসগরি চটিতে শব্দ করতে করতে ভেতরের দরজা খুলে দাদু এঘরে এলেন। ঘরের মধ্যিখানে আলো জ্বালিয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাদু খুব অবাক হলেন, কী হল, তুমি ঘুমোওনি?

ঘাড় নেড়ে অনিমেষ বলল, পুলিশ।

সরিৎশেখর বললেন, আমি দেখছি, তুমি পিসিমার কাছে যাও।

কথাটা শুনে অনিমেষ ভেতরের ঘরে ঢুতে থমকে দাঁড়াল। ঘরটা অন্ধকার, একদিকে পিসিমার ঘরে, অন্যদিকে দাদুর ঘরে যাবার দরজা। অনিমেষ শুনতে পেল পিসিমা বিড়বিড় করে জয় গুরু জয় গুরু বলে যাচ্ছেন। অনিমেষ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকিমেরে দেখল দাদু দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে কয়েকজন পুলিশ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। প্রথমে যে এল তার হাতে রিভলভার দেখল। অনিমেষ। পুলিশরা ঘরে ঢুকে পড়তেই সরিৎশেখর ধমকে উঠলেন, কী ব্যাপার, এত রাত্রে আমার বাড়িতে আপনারা কেন এসেছেন, কী চান?

রিভলভার-হাতে পুলিশটা বলল, আপনার ছেলে কোথায়?

সরিৎশেখর অবাক হলেন, ছেলেও, আমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই!

পুলিশটা বলল, ন্যাকামো করবেন না, আপনার ছোট ছেলে প্রিয়তোষের কথা জিজ্ঞাসা করছি।

সরিৎশেখর ঘাড় নাড়লেন, জানি না।

চিবিয়ে চিবিয়ে লোকটা বলল, জানেন না! এই বাড়ি সার্চ করো।

কথাটা বলতেই অন্য পুলিশগুলো রিভলভার বের করে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে জিনিসপত্র উলটেপালটে দেখতে লাগল। সরিৎশেখর দুহাত তুলে তাদের থামাতে গেলেন, আরে কী করছেন কী। আপনারা? আমি কালই ডি সি-র সঙ্গে কথা বলব। আমাকে আপনারা অপমান করতে পারেন না। কী করেছে আমার ছেলে?

প্রথম লোকটি বলল, বাপ হয়ে জানেন না ছেলে কমিউনিস্ট হয়েছে। দেশ উদ্ধার করেছেন সব। সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। ওর নামে ওয়ারেন্ট আছে। কাজে বাধা দেবেন না, ওর বইপত্র আমরা দেখব। ও বাড়িতে এসেছে এ-খবর আমরা পেয়েছি।

সরিৎশেখর বললেন, আজ কদিন সে বাড়িতে নেই। আমি বলছি সে বাড়িতে নেই। কিন্তু সে কমিউনিস্ট হল কবে?

লোকটি বলল, এই তো, বাপ হয়েছেন অথচ ছেলের খবর রাখেন না!

সরিৎশেখর রেগে গিয়ে চিষ্কার করে উঠলেন, মুখ সামলে কথা বলবেন। জানেন সারাজীবন আমি কংগ্রেসকে সাহায্য করছি। দরকার হলে এই জেলার মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করবেন। আপনি কি ভাবছেন এখনও ব্রিটিশ আমল রয়েছে যে এইসব কথা বলবেন?

পুলিশ বলল, মশাই, আমল বদলায় আপনাদের কাছে আমরা হুকুমের চাকর। আমাদের কাছে ব্রিটিশরাও যা এই কংগ্রেসিরাও তা, হুকুম তামিল করব। সবাই আমাদের সাহেব। যান, বেশি বকাবেন না, আমাদের সার্চ করতে দিন।

অসহায়ের মতো সরিৎশেখর ধপ করে অনিমেষের খাটে বসে পড়লেন। অনিমেষ শুনল, দাদু বিড়বিড় করছেন, প্রিয় কমিউনিস্ট হয়েছে, কমিউনিস্ট। ততক্ষণে পুলিশগুলো ঘর তছনছ করে ফেলেছে। অনির বইপত্র ছ্যকার, কাকার, সুটকেসটা খালি হয়ে ঢং করে মাটিতে পড়ল। একটা লোক বলল, এ-ঘরে কিছু নেই স্যার।

প্রথম পুলিশ বলল, পালাবে কোথায় বাড়ি ঘেরাও করা আছে। অন্য ঘর দ্যাখো। পুলিশগুলোকে এদিকে আসতে দেখে অনিমেষ দৌড়ে পিসিমার ঘরে চলে এল। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল হাতের মুঠোয় পুপিসির চিঠিটা রয়ে গেছে। এই চিঠিটা পেলে পুলিশরা নিশ্চয়ই কাকার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে! তপূপিসি তো লিখেছে কাকা রাজনীতি করে। অনিমেষের মনে হল, রাজনীতি করা মানে কমিউনিস্ট হওয়া। চিঠিটা লুকিয়ে ফেলা দরকার। কী করবে কোথায় রাখবে বুঝতে না পেরে সে চিঠিটাকে পেটের কাছে প্যান্টের ভাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেঞ্জিটা টেনে দিল। দিতেই সে দেখল হেমলতা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ঘরের এককোণে ঠাকুরের ছবির তলায়। একটা ডিমবাতি জ্বলছে। হেলমতা নিজের বিছানার ওপর বাবু হয়ে বসে আছেন। চোখাচোখি টর্চ জেলে ঘরে ঢুকে পড়ল। একজন ওদের মুখে টর্চ ফেলতে হেমলতা বললেন, চোখে আয়ে ফেলবেন না, কী চাই আপনাদের?

একটা লোক খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলল, রাতদুপুরে জেগে বসে আছেন যে, প্রিয়তোষ কোথায়?

হেমলতা সজোরে উত্তর দিলেন, রাতদুপুরে বাড়িতে ডাকাত পড়লে কেউ নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয় না। আমার ভাই বাড়িতে নেই।

লোকগুলো তন্নতন্ন করে ঘরের জিনিসপত্র ঘাটছিল। হেমলতা উঠে দাঁড়ালেন, খবরদার, আমার ঠাকুরের গায়ে কেউ হাত দেবেন না।

যে-লোকটা সেদিকে এগিয়েছিল সে হেমলতার মূর্তি দেখে থমকে গেল। পেছন থেকে একজন বলল, ছেড়ে দে, ঠাকুর-দেবতার সঙ্গে কমিউনিস্ট পত্রিকা থাকে না।

হঠাৎ একটা লোক অনিমেষের দিকে এগিয়ে এল গটগট করে, ওহে খোকাবাবু, তোমার নাম কী?

অনিমেষ কোনোরকমে বলল, অনিমেষ।

লোকটি চিবুক ধরতে অনিমেষের হাত পেটের কাছে চলে গেল সড়াৎ করে, এই যে মিঃ মেষ, প্রিয়বাবু তোমার কে হয় বলো তো?

কাকা। মুখ উঁচু করে ধরে থাকায় অনিমেষের ঘাড়ে লাগছিল।

কাকা! গুড। একটু আগে সে এখানে এসেছিল আমরা জানি, তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

অনিমেষ কোনদিন মিথ্যে কথা বলেনি। মা বলেছেন, কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। অনি এখন কী করবে? সত্যি কথা বললে কি কাকার খারাপ হবে? কাকা তো চলে গিয়েছে এখান থেকে এই বাড়িতে কাকাকে খুঁজে পাবে না ওরা। তা হলে? সত্যি কথাটা বলে দেবে? লোকটা তখনও ওর মুখ এমন জোরে উঁচু করে রেখেছে যে ঘাড় টানটান করছে। লোকটা ধমকে উঠল, কী হল?

অনিমেষ ফিসফিসিয়ে বলল, আঃ!

লোকটি বলল, কী? না বলে অনিমেষের মুখটা ছেড়ে দিল, শালা বাড়িসুদ্ধ লোক ট্রেইন্ড হয়ে রয়েছে। বুঝলে মিত্তির, এই বাচ্চাটা যখন বড় হবে তখন এই প্রিয়তোষদের চেয়ে থাইজেন্ড টাইমস ফেরোসাস হবে। ওইসব থিওরিটিকাল কমিউনিস্টগুলো তখন পাত্তাই পাবে না। শালা এইটুকুনি বাচ্চাও কেমন ট্রেইন্ড লায়ার। কথাগুলো বলে লোকগুলো অন্য ঘরে চলে গেল।

পাথরের মতো বসে ছিল অনিমেষ। হঠাৎ ওর খেয়াল হল পুলিশটা ওকে লায়ার বলল। লায়ার মানে মিথুক। কখনো না, ও মিথুক নয়। ও কিছুই বলেনি, পুলিশটা নিজে নিজে মনে করে নিয়েছে। ও দৌড়ে পুলিশটাকে কাছে যেতে উঠে পড়তেই হেমলতা ওকে চট করে ধরে ফেললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

অনিমেষ ছটফট করছিল, ওরা আমাকে লায়ার বলে গালাগালি দিল। আমি কক্ষনো মিথ্যে বলি। মা তা হলে রাগ করবে। বলো আমি কি মিথ্যক।

দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিলেন হেমলতা, কাকু কি এসেছিল?

ঘাড় নাড়ল অনি, যা, এসে বইপত্র নিয়ে গেছে।

হেমলতা জিজ্ঞাসা করেন, কী বই?

অনি বলল, জানি না। তবে একটা বই-এর নাম মার্কসবাদী। আমাকে ছাড়ো, আমি ওদের সত্যি কথা বলে দিয়ে আসি, আমি লায়ার নই। মা বলে গেছে সত্যি বলতে।

হেমলতা কেঁদে ফেললেন, অনি বাবা, যুধিষ্ঠিরও একসময় মিথ্যে বলেছিলেন। কিন্তু তুমি তো বলনি, ওরা তোমার কথা ভুল বুঝেছে। আমার কাছে বসে তুমি মনে মনে মাকে ডাকো, দেখবে তিনি একটুও রাগ করেননি।

সমস্ত বাড়ি তছনছ করে পুলিশের গাড়ি শব্দ করে ফিরে গেল। ওরা চলে গেলে বাড়িটা আচমকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল যেন। কোথাও কোনো শব্দ নেই, পিসিমার পাশে অনি গা-ঘেঁষে বসে, সরিৎশেখরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তিস্তার একগাদা শেয়াল নিজেদের মধ্যে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। এই রাত্রে, এখন, জলপাইগুড়ি শহরটা চুপচাপ ঘুমিয়ে। অনিমেষ প্রিয়তোষের কথা ভাবছিল, কাকা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে নেই। কাকাকে খুঁজতে পুলিশটা চারধারে ছুটে বেড়াচ্ছে। কাকা তো কাউকে হত্যা করেনি, কিন্তু পুলিশগুলোর মুখ দেখে মনে হল সেইরকম খারাপ কিছু কাকা করেছে। এখন কাকা কোথায়? কাকা কেন স্বৰ্গছেঁড়ায় পালিয়ে যাচ্ছে না। স্বৰ্গছেঁড়ায় কোনোদিন পুলিশ যায় না, কাকা সেটা ভুলে গেল কী করে!

এমন সময় শব্দ করে বাইরে দরজাটা বন্ধ হল। বিদ্যাসাগরি চটির আওয়াজটা এ-ঘরের দরজায় এসে থামল! অনি তাকিয়ে দেখল দাদুর চোখে চশমা নেই, কেমন রোগা লাগছে মুখটা। অদ্ভুত শূন্য গলায় সরিৎশেখর বললেন, বুঝলে হেম, এই শুরু হল, আমাকে আরও যে কত দেখে যেতে হবে!

হেমলতা খুব ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

চিৎকার করে উঠলেন সরিৎশেখর, তোমার ভাই কমিউনিস্ট হয়েছে, আমার গুষ্টির পিণ্ডি হয়েছে।

হেমলতা বললেন কমিউনিস্টা সে আবার কী?

সরিৎশেখর বললেন, দেশ উদ্ধার করছেন, আমরা যে এতদিন পর স্বাধীনতা পেলাম তাতে বাবুদের মন উঠছে না, সারা দেশ তাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। মেরে হাড় ভেঙে দেবে জওহরলাল। আমি এসব বরদাস্ত করব না, একটা মাতাল লম্পটকে তাড়িয়েছি, এটাও যেন কোনোদিন বাড়িতে না ঢোকে। এই ছেলের জন্য এত রাত্রে আমাকে হেনস্তা হতে হল!

হেমলতা বললেন, প্রিয় আবার কবে ওসব দলে ভিড়ল!

সরিৎশেখর খেঁকিয়ে উঠলেন, তোমারই তো দোষ, নিজের ভাই কী করছে খেয়াল রাখতে পার।

হেমলতা উত্তেজিত হরেন, আমার ভাই, কিন্তু আপনার তো ছেলে।

সরিৎশেখর একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে বলে চললেন, তখন যদি গুদামবাবুর মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতাম তা হলে আর এই দুর্ভোগ হত না। তুমিই তো তখন খ্যাঁক খ্যাঁক করেছিল।

হেমলতা কোনো জবাব দিলেন না। প্রিয়তোষের ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না ঠিক। কিন্তু গুদামবাবুর মেয়ে তপুকে বাড়ির বউ হিসেবে মাধুরীর পাশে তিনি ভাবতেই পারেন না।

এমন সময় সরিৎশেখর অনিমেষের দিকে তাকালেন, তুমি এত রাত্রে জেগে ছিলে কেন?

অনিমেষ ভয়ে-ভয়ে দাদুর দিকে তাকাল। রাগলে দাদুকে ভয়ংকর দেখায়। কী বলবে ভাবতে-না-ভাবতেই সরিৎশেখর ধমকে উঠলেন, কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দাও না কেন? ভাগ্যিস হেমলতা একটা হাত ওর পিঠের ওপর ছিল নইলে সে কেঁদে ফেলত। সরিৎশেখর এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, প্রিয়তোষ কি এসেছিল। চট করে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, যা। প্রথম থেকেই এইরকম একটা সন্দেহ করেছিল সরিৎশেখর, কিন্তু নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে এখন হতবাক হয়ে গেলেন। পুলিশ অফিসারটা যখন ধমকাচ্ছিল তখন অনিমেষ একথা স্বীকার করেনি তো! ঐটুকু শিশু! সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, আমাকে ডাকনি কেন?

বিড়বিড় করে অনিমেষ বলল, আমাকে শব্দ করতে মানা করেছিল কাকা। আমার মন-খারাপ লাগছিল।

কেন।

কাকার শরীর খুব খারপ হয়ে গেছে, জামাকাপড় ময়লা।

হুম্‌। কী করল সে?

বইপত্র নিয়ে চলে গেল।

কী বই?

অনেক বই। একটার নাম মার্কসবাদী।

ও! সর্বনাশ তা হলে অনেক ভেতরে গেছে। কী বলল?

আমি সব কথা বুঝিনি, শুধু একটা কতা মনে আছে-এ আজাদি ঝুটা হ্যায়।

ছাই হ্যায়! চিষ্কার করে উঠলেন সরিৎশেখর, সব জেনে বসে আছে, আজাদির তোরা কী বুঝিস রে। নেতাজিকে গালাগালি দিস, রবীন্দ্রনাথকে গালাগালি দিস, ক্ষুদিরাম বাঘা যতীন-এঁদের কথা ভুলে যাস-ননসেন্স ; হঠাৎ অনির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এসব একদম বাজে কথা, তুমি কান দিও না।

নিজের ঘরের দিকে যেতে-যেতে তার মনে পড়ল ঐ বালকটি আঠারো বছর বয়সে জেলে যাবে। বুকের ভিতর দুরমুশ শুরু হয়ে গেল ওর-কী জানি–আজ রাত্রে তার বীজবপন হয়ে গেল কি না। ওর দিকে নজর রাকতে হবে, ওকে নিজের মতো করে গড়তে হবে।

ঘাড় ঘুরিয়ে সরিৎশেখর দেখলেন পায়েপায়ে অনিমেষ তার দিকে এগেিয় আসছে। ওর হাঁটার ধরন দেখে খুব অবাক হলেন সরিৎশেখর। খুব শান্ত গলায় নাতিকে ডাকলেন তিনি, কছি বলবে? ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। তারপর সরিৎশেখরের একদম কাছে এসে পেটের ওপর প্যান্টের ভাজ থেকে সেই নীল চিঠিটা বের করে দাদুকে দিল। অবাক হয়ে চিঠিটা নিয়ে নিজের ঘরে গেলেন সরিৎশেখর, টেবিলের ওপর রাখা চমশাটা তুলে সেটা পড়লেন। অনেকক্ষণ বাদে ডাক এল অনিমেষে, তুমি এটা কোথায় পেলে?

কাকার সুটকেসে।

পড়েছ?

মাথা নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ।

চোখ বন্ধ করলেন সরিৎশেখর, কিছু বুঝেছ।

ভয়ে-ভয়ে অনি ঘাড় নাড়ল, না।

যাও। শুয়ে পড়ে। প্রিয়তোষ যদি আসে আমাকে না বলে দরজা খুলবে না।

চলে যেতে-যেতে অনিমেষ দেখল দাদু আলমারির ভেতর চিঠিটা রেখে দিয়ে তালা বন্ধ করছেন।

হঠাৎ অনির মনটা তপুপিসির জন্য কেমন করে উঠল।

স্কুলের প্রথম বছরে অনিমেষের স্বৰ্গছেঁড়ায় যাওয়া হয়নি। মহীতোষ ওখানে অত বড় কোয়ার্টারে একা আছেন ঝড়িকে নিয়ে। সে-ই রান্নাবান্না করে সংসার সামলায়। গরমের ছুটিতে বা পূজার সময় সরিৎশেখর ভেবেছিলেন নাতিকে পাঠাবেন, কিন্তু মহীতোষই আপত্তি করেছেন। ওখানে গেলে মাধুরীর কথা বারবার মনে হবে অনিমেষের। হেমলতার হয়েছে মুশকিল, হাজার দোষ করলেও ভাইপোকে বকামারা চলবে না, সরিৎশেখরের হুকুম। মহীতোষ দুদিন ছুটি থাকলেই শহরে চলে আসেন, কিন্তু ছেলের সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও মিশতে পারেন না ঠিকমতো। কোথায় যেন আটকে যায়। ঐটুকুনি ছেলে একা একা শোয়, একা একা বাগানে ঘোরে, কী গভীর দেখায়। পড়াশুনায় রেজাল্ট ভালোই হচ্ছে। হেডমাস্টারমশাই সরিৎশেখরকে বলেছেন, হি ইজ একসেপনাল, অত্যন্ত লাজুক। জলপাইগুড়ি শহরে কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপারে আর তেমন হইচই হচ্ছে না। কংগ্রেসের মিছিল বেরুচ্ছে ঘনঘন। প্রিয়তোষের খবর পাওয়া যায়নি আর। মহীতোষের এক ক্লাসমেট জলপাইগুড়ি থানায় পোস্টেড হয়ে এল, সেও কোনো খবর দিতে পারল না। পরিষ আসামে এক কাঠের ঠিকাদারের কাছে সামান্য মাইনেতে কাজ করছে এ-খবর মহীতোষ পেয়েছেন। যে খবর এনেছে সে পরিতোষের বউকে নাকি দেখেছে। খবরটা বাবাকে জানাতে পারেননি মহীতোষ। বড়দার কথা শুনলেই বাবার মেজাজ চড়ে যায়।

 

হেমলতা জলপাইগুড়িতে আসার পর হঠাৎ যেন বুড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই অম্বল হচ্ছে আজকাল, কিছু খেলে হজম হয় না ঠিক। সব কাজ শেষ করে খেতে-খেতে চারটে বেজে যায়। সেই সময় অনিমেষ আসে। পিসিমার আলোচালের ভাত নিরামিষ তরকারি দিয়ে খেতে ও খুব ভালোবাসে। সরিৎশেখরের সন্দেহ অনিমেষের সঙ্গে খাবার জন্যেই হেমলতার চারটের আগে খেতে বসা হয় না। অনেক বকাঝকা করেছেন, কোনো কাজ হয়নি। নিজের হাতে রান্না সেরে সরিৎশেখরকে খাইয়ে সমস্ত বাড়ি ঝেড়েমুছে বাসন মেজে তবে নিজের নিরামিষ রান্না রু করবেন হেমলতা। একটু পিটপিটে স্বভাব আগেও ছিল, সরিৎশেখর লক্ষ করেছেন ইদানীং সেটা আরও বেড়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা জল ঘেঁটে ঘেঁটে দুপায়ের আঙুলের ফাঁকে সাদা হাজা বেরিয়ে গেছে, অনিমেষের মুখে সরিৎশেখর সদ্য সেটা জানতে পারলেন। বিকেলে যখন ওরা মুখোমুখি খেতে বসে সে-দৃশ্য বেশ মজার। পিড়িতে বাবু হয়ে বসে অনিমেষ, হেমলতা অত বড় ছেলেটাকে ভাত, তারকারি মেখে গোল্লা পাকিয়ে দিয়ে নিজে মাটিতে উবু হয়ে বসে খাওয়া শুরু করেন। প্রায় একই সংলাপ দিয়ে খাওয়া শুরু হয় রোজ, সরিৎশেখর চুরি করে শুনেছেন। অনিমেষ বলে, মাকে তুমি ফ্রক পরা দেখেছ?

হেমলতা খেতে-খেতে বলেন, পনেরো বছরের মেয়ে ফ্রক পরবে কী! তবে বিয়ের আগের দিনও নাকি রান্নাঘরে ঢোকেনি। তোর দাদু যখন দেখতে গিয়েছিল তখন ওর বাবা খুব ভুজুং দিয়েছিল-এই রাঁধতে পারে সেই রাঁধতে পারে।

তারপর?

তারপর আর কী! বিয়ের পর আমি বেঁধে দিতাম আর তোর দাদু জানত মাধুরী বেঁধেছে। তবে খুব চটপট শিখেছিল।

মা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল, না?

মুখটা খুব মিষ্টি ছিল তবে ভীষণ মোটা। হাতটাতগুলো কী, এক হাতে ধরা যায় না! মাথায় চুল ছিল বটে, হাঁটুর নিচ অবধি নেমে আসত। দুহাতে চুল বাঁধতে হিমশিম খেতে হত। একদিন রাগ করে অনেকটা কেটে দিলাম।

মা মোট ছিল? অনিমেষের গলায় বিস্ময়।

হুঁ। বাবার তো ঐরকম পছন্দ ছিল। আমার প্রথম মার নাকি পাহাড়ের মতো শরীর ছিল। বিয়ের পর আমরা তোর মাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা করতাম। তারপর তুই হতে কেমন রোগা-রোগা হয়ে গেল।

তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ দুজনে কথা না বলে খেয়ে যায়। বিকেলের অনির এই ভাত খাওয়াটা একদম পছন্দ করেন না সরিৎশেখর। কিন্তু মেয়ের জন্য কিছু বলতেও পারেন না। অনেক কিছু এখন মেনে নিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। সরিৎশেখর বুঝতে পারছেন তাঁর পুঁজি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এতদিন চা-বাগানের চাকরিতে মাইনে ছাড়া বাড়িতে কোনো উপার্জন করেননি। বিলাসিতা ছিল না তাই জমানো টাকার বেশির ভাগ দিয়ে এই বাড়িটা তৈরি করার পর হাতে যা আছে তাতে মাত্র কয়েক বছর চলতে পারে। এখনও তার স্বাস্থ্য ভালো, ইচ্ছে করলে এই শহরে কোনো দেশি চা-বাগানের হেড অফিসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু আর গোলামি করতে প্রবৃত্তি হয় না। চা-বাগানের ইতিহাসে এতদিন পেনশনের ব্যাপারটাই ছিল না। রিটায়ার করার পর অনেক লেখালেখি করে কলকাতা থেকে তার জন্য পঁচাত্তর টাকার একটা মাসিক পেনশনের অনুমতি আনিয়েছেন। সরিৎশেখরের ধারণা তাঁর চিঠির চেয়ে ম্যাকফার্সনের সুপারিশ বেমি কাজ করেছে। মেমসাহেব এখনও প্রতি মাসে তাকে চিঠি লেখেন ডিয়ার বাবু বলে। স্বৰ্গছেঁড়ার জন্য কষ্ট হয় তার, সরিৎশেখরকে তিনি ভোলননি-এইসব। টানা-টানা হাতের লেখা। অনিমেষকে সে-চিঠি পড়ান সরিৎশেখর। খামের ওপর ডাকঘরের ছাপ থেকে দেশটাকে বাতির কাছ উপস্থিত করতে চেষ্টা করেন। মিসেস ম্যাকফার্সন লিখেছিলেন তোমার গ্রান্ডসন যখন এখানে ব্যারিস্টারি পড়তে আসবে তখন সব খরচ আমার। সরিৎশেখর অনিমেষকে বিলেতে পাঠাবেন বলে যখন ঘোষণা করেন তখন সময়ের হিসাব তার হারিয়ে যায়। পেনশন পাবার পর চলে যাচ্ছে একরকম। তিনটে তো প্রাণী, এতবড় বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। মহীতোষ তাকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিলেন প্রতি মাসে, রাজি হননি তিনি। বলেছিলেন তা হলে ছেলেকে হোস্টেলে রাখে। আর কথা বাড়াননি মহীতোষ। টাকার দরকার হলে বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন সরিৎশেখর। এটা তার একধরনের আনন্দ। কেউ ভাড়া চাইতে চলে তাকে মুখের ওপর না, বলে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে বলেন, বুঝলে হেম, এই যে বাড়িটা দেখছ-এই হল আমার আসল ছেলে, শেষ বয়সে এই আমাকে দেখবে।

এখন প্রতি বছর তিস্তায় ফ্লাড আসে। যেমনভাবে নিয়ম মেনে বর্ষা আসে শীত আসে তেমনি বন্যার জল শহরে ঢুকে পড়ে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর জল আর জিনিসপত্র নষ্ট করার সযোগ পায় না। শুধু প্রতি বছর সরিৎশেখরের বাগানের ওপর পলিমাটির স্তরটা বেড়ে যায়। এখন নদী দেখলে সরিৎশেখর বুঝতে পারেন দুএকদিনের মধ্যে বন্যা হবে কি না। এমনকি তিস্তা যখন খটখটে শুকনো, সাদা বালির চলে হাজার হাজার কাশগাছ বাতাসে মাথা দোলায়, যখন ওপারের বার্নিশঘাট অবধি জলের রেখা দেখা যায় না, ভাঙা ট্যাক্সিগুলো সারাদিন বিকট শব্দ করে তিস্তার বুকে ছুটে বেড়ায়, সেইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে বোমা ফাটার শব্দ ওঠে তিস্তার বুকে আর সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি ভিজে গেছে। বিকেল নাগাদ ভুস করে জল উঠে স্রোত বইতে শুরু করবে। চোখের উপর এই শহরটার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখের উপর অনিকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। পড়াশুনায় ভালো ছেলে, পড়ার কথা কখনো বলতে হয় না।

এখন প্রতি বছর তিস্তায় ফ্লাড আসে। যেমনভাবে নিয়ম মেনে বর্ষা আসে শীত আসে তেমনি বন্যা জল শহরে ঢুকে পড়ে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর জল আর জিনিসপত্র নষ্ট করার সুযোগ পায় না। শুধু প্রতি বছর সরিৎশেখরের বাগানের ওপর পলিমাটির স্তরটা বেড়ে যায়। এখন নদী দেখলে সরিৎশেখর বুঝতে পারেন দুএকদিনের মধ্যে বন্যা হবে কি না। এমনকি তিস্তা যখন খটখটে শুকনো, সাদা বালির চরে হাজার হাজার কাশগাছ বাতাসে মাথা দোলায়, যখন ওপারের বার্নিশঘাট অবধি জলের রেখা দেখা যায় না, ভাঙা ট্যাক্সিগুলো সারাদিন বিকট শব্দ করে তিস্তার বুকে ছুটে বেড়ায়, সেইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে বোমা ফাটার শতো শব্দ ওঠে তিস্তার বুকে আর সরিৎশেখর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হয়ে যান কাল ভোরে বেড়াতে গিয়ে দেখতে পাবেন তিস্তার শুকনো বালি রাতারাতি ভিজে গেছে। বিকেল নাগাদ ভুস করে জল উঠে স্রোত বইতে শুরু করবে। চোখের উপর এই শহরটার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখের উপর অনিকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছেন। পড়াশুনায় ভালো ছেলেটা, পড়ার কথা কখনো বলতে হয় না। আজ অবধি কারোর কাছ থেকে কোনোরকম নালিশ শুনতে হয়নি ওর বিরুদ্ধে। কিন্তু ভীষণ লাজুক অথবা গতর হয়ে থাকে ছেলেটা। এই বয়সে ওরকম মানায় না। জোর করে বিকেলে স্কুলের মাঠ পাঠালে ওকে, খেলাধুলা না করলে শরীর ঠিক থাকবে কী করে! ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে ওর শরীর, এই সময় ব্যায়াম দরকার।

অনিমেষ শুনেছিল দাদু সেকালে ফাষ্ট ক্লাস অবধি পড়েছিলেন। কলেজে যাননি কোনোদিন। কিন্তু এত ভালো ইংরেজি বুঝিয়ে দিতে পারেন যে ওদের স্কুলের রজনীবাবু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একবার প্রতিশব্দ লিখতে বলেছিলেন রজনীবাবু। অনিমেষ বাড়িতে এসে দাদুকে জিজ্ঞাসা করতে একটা শব্দের পাঁচটা প্রতিশব্দ পেয়ে গেল। রজনীবাবুর মুখ দেকে ক্লাসে বসে পরদিন অনিমেষ বুঝতে পেরেছিল তিনি নিজেও অতগুলো জানতেন না। ছোট ডিকশনারিতে অতগুলো না পেয়ে রজনীবাবু ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোত্থেকে ও এসব লিখেছে। অনিষের মুখ থেকে শুনে রজনীবাবু বিকেলে এসে দাদুর সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছিলেন। ম্যাকফার্সন সাহেব দাদুকে একটা ডিকশনারি দিয়েছিলেন যার ওজন প্রায় দশ সের হবে, অনিমেষ দুহাতে কোনোক্রমে এখন সেটাকে তুলতে পারে। রজনীবাবু মাঝে-মাঝে এসে সেটা দেখে যান।

শেষ পর্যন্ত কিছুই চোপে রাখা গেল না। সরিৎশেখর যতই আড়াল করুন মহীতোষের বিয়ের আঁচ এ-বাড়িতে লাগতে আরম্ভ করল। মহীতোষ নিজে আসছেন না বটে, কিন্তু তার হবু স্বত্তবাড়ির লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলতে সরিৎশেখরের কাছে না এসে পারছেন না। সরিৎশেখর সকালে বাজারে গিয়ে একগাদা মিষ্টি নিয়ে আসেন, কখন কে আসে বলা যায় না। হেমলতা তা দিয়ে অতিথি আপ্যয়ন করেন। মেয়ের বাড়ি থেকে যারা আসেন তারা অনিকে দেখে একটু অস্বস্তির মধ্যে থাকেন সেটা অনি বেশ টের পায়। দাদু পিসিমা ওকে মুখে কিছু না বললেও ও যে ব্যাপার জেনে গেছে সেটা বুঝতে পেরে গেছেন। অনির ধারণা ছিল বিয়ে হলে খুব ধুমধাম হয়, অনেক আত্মীয়স্বজন আসে, কিন্তু ওদের বাড়িতে কেউ এল না। শুধু এক বিকেলে সাধুচরণ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে সরিৎশেখরের কাছে এলেন। ওদের সাজগোজ দেখে কেমন সন্দেহ হল অনিমেষের, পা টিপে ও দাদুর ঘরের জানলার কাছে এসে কান পাতল। সাধুচরণ বলেছিলেন, সব ঠিকঠাক আছে, এবার আপনাকে যেতে হয়।

সরিৎশেখর বললেন, সন্ধে-সন্ধে বিয়েটা হয়ে যাবে আশা করি, আমি আবার আটটার মধ্যে শুয়ে পড়ি।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, যা, সন্ধেবেলাতেই বিয়ে;, আপনি খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন।

সরিৎশেখর বললেন, খাওয়াদাওয়া না বেয়াই মশাই, আমি তো খেতে পারব না। আমাকে এঅনুরোধ করবেন না।

বৃদ্ধ বললেন, সে কী? তা কখনো হয়?

সরিৎশেখর বললেন, হয়। আমার বাড়িতে আমার নাতি আছে যাকে আমরা এই বিয়ের কথা জানাইনি। তাকে বাদ দিয়ে কোনো আনন্দ-উৎসবে আহার করতে অক্ষম।

বৃদ্ধ বললেন, কিন্তু তাকে তো আপনি নিজেই নিয়ে যেতে চাননি।

সরিৎশেখর বললেন, ঠিকই। ঐ অনুষ্ঠানে ওর উপস্থিতি কি কারো ভালো লাগবে। তা ছাড়া একজনকে যখন এনেছিলাম তখন অনেক আমোদ-আহ্লাদ করেছি, তবু তাকে কি রাখতে পারলাম। ওসব কথা যাক। পাত্রের পিতা হিসেবে আমার কর্তব্যটুকু করতে দিন, এর বেশি কিছু বলবেন না।

অনি শুনল দাদু গলা চড়িয়ে ডাকছেন, হেম, হেম। রান্নাঘর থেকে সাড়া দিতে-দিতে পিসিমা এ ঘরের দরজা অবধি এসে থেমে গেলেন, কী বলছেন?

আমি চললাম, সেই হারটা দাও তো!

ঐ তো, আপনার ড্রয়ারের মধ্যে আছে। কিন্তু আপনি জামাকাপড় পালটালেন না? এরকম ময়লা পাঞ্জাবি পরে লোকে বাজারে যায়, বরকর্তা হয়ে যায় নাকি!

অনি ড্রয়ার খোলার আওয়াজ পেল। তারপর শুনল দাদু বলছেন, আমি আটটার মধ্যে ফিরে আসব। অনিকে বোললা ও যেন আমার জন্য অপেক্ষা করে, একসঙ্গে পাব।

পায়ের শব্দ পেতেই অনি দ্রুত সরে এল। আড়ালে দাঁড়িয়ে ও দেখল সাধুচরণ আর সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দাদু বাইরে বেরিয়ে এলেন। পিসিমার গলায় দুর্গা দুর্গা শুনতে পেল সে। সাধুচরণ ও সেই ভদ্রলোকের পাশে দাদুকে একদম মানাচ্ছে না। লংক্লথের ময়লা পাঞ্জাবি, হাঁটুর নিচ অবধি ধুতি, লাঠি-হাতে দাদু ওঁদের সঙ্গে হেঁটে গলির বাঁক পেরিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে পিসিমা ডাকলেন, অনি, অনিবাবা!

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ সোজা হয়ে দাঁড়াল। দাদু কোথায় যাচ্ছেন সেটা বুঝতে পেরে ওর অসম্ভব কৌতূহল হতে লাগল। চট করে এপাশ-ওপাশ দেখে নিয়ে বারান্দায় ছেড়ে-রাখা চটিজোড়া এক হাতে তুলে ও লাফ দিয়ে ভেতরের বাগানে নেমে পড়ল।

বাড়ির পেছন দিয়ে দৌড়ে ও যখন গলির মুখে এসে দাঁড়াল ততক্ষণে সরিৎশেখররা টাউন ক্লাব ছাড়িয়ে গেছেন। দূর তেকে তাদের দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্তমনে হাঁটতে লাগল ও। এখন প্রায় শেষুবিকেল। টাউন ক্লাবের মাঠে ফুটবল খেলা চলছে। রাস্তাটায় লোকজন বেশি, নিরাপদ দূরত্বে অনিমেষ হাঁটছিল। সাধুরচণ একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে কী বলতে সরিৎশেখর ঘাড় নাড়ালেন। অনিমেষ জানে দাদু রিকশায় উঠবেন না। শরীর ঠিক থাকলে দাদকে রিকশায় ওঠানো সহজ নয়। অবশ্য এখন যদি দাদু রিকশায় উঠতেন তা হরে অনিমেষ কিছুতেই আর নাগল পেত না। রিকশায় না-ওঠার জন্য সময় সময় ওর দাদুর ওপর খুব রাগ হত, কিন্তু একন এই মুহূর্তে ওর খুব ভালো লাগল। দাদুর সঙ্গে হেঁটে তাল রাখতে পারছেন না সাধুচরণ। সঙ্গের ভদ্রলোকটি প্রায় দৌড়াচ্ছেন। বড় বড় পা ফেলে চলেছেন। সরিৎশেখর লাঠি দুলিয়ে। সাধুচরণকে ও কোনোদিন দাদু বলতে পারল না। এর জন্য অবশ্য হেমলতা অনেকটা যে কষ্ট দেয়, সে-মেয়ে মরে গেলে তো কষ্ট পাবেই না-এটা তো জানা কথা, কিন্তু তা বলে। পাঁচজনকে বলে বেড়াবে, অর্ধমুক্তি হল আমার। বাকি অর্ধেকটা যেন স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। হেমলতা কোনোদিন ওকে কাকা জ্যাঠা বলতে পারেননি। সেটাই শুধু করেছিল অনি। সামনাসামনি কিছু বলত না, কিন্তু আড়াল হলেও পিসিমার মতো নাম ধরে বলা অভ্যাস করে ফেলল।

ঝোলনা পুল পার হয়ে করলা নদীর ধার ওঁদের থানার দিকে যেতে দেখে অনি দূরত্বটা বাড়িয়ে, দিল। এখানে রাস্তাটা অনেকখানি সোজা, চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালে ও ধরা পড়ে যাবে। নিচে করলা নদীর জল কচুরিপানায় একদম ঢাকা পড়ে আছে। এখনও সন্ধে হয়নি। দাদুদের ওপর চোখ রেখে পুলের মাঝামাঝি এসে নতুন স্যারের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। পুলের তারের জালে হেলান দিয়ে নতুন স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁকে দেখে নতুন স্যার হাসলেন, কোথায় যাচ্ছ অনিমেষ?

কী বলবে বুঝতে না পেরে অনি বলল, বেড়াতে।

ও, তোমাদের এই নদীকে আমার খুব ভালো লাগে, জান। কেমন চুপচাপ বয়ে চলে যায়। অথ এর নাম কেন একটা তেতো ফলের নামে রাখল বলো তো? নতুন স্যার বললেন।

অনি দেখছিল দাদুরা খুব দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছেন। কিছু বলা দরকার তাই বলল, কমলা খেলে তো রক্ত পরিষ্কার হয়।

গুড! খুব খুশি হলেন নতুন স্যার, এই নদী শহরের দুষিত রক্ত পরিষ্কার করছে। এককালে এসব জায়গায় দেবী চৌধুরানী নৌকো নিয়ে বেড়াতেন। ইংরেজদের সঙ্গে ওর খুব যুদ্ধ হয়েছিল। তিস্তার পাড়ে এখনও নাকি একটা কালীমন্দির আছে যেটা শুনেছি ওরই প্রতিষ্ঠিত। তুমি দেবী চৌধুরানীর নাম শুনেছ?

অনি ঘাড় নাড়ল, না।

নতুন স্যার বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে পরে একদিন ওর কথা বলব। আজ বরং তোমাকে একটা বই দিই। এটা চিরকাল তোমার কাছে রেখে দেবে। অনি দেখল নতুন স্যার তার কাধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। বইটার মলাটে পাগড়ি পরা একজন মানুষের মুখ যাকে দেখলে মারোয়াড়ি দোকানদার বলে মনে হয়। আর ওপরে লেখা রয়েছে আনন্দমঠ, নিচে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নতুন স্যার বললেন, ইনি হলেন আমাদের সাহিত্যম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। আর এই বল হল ভারতের স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বন্দেমাতরমের উত্স। এই বই না পড়লে দেশকে জানা যাবে না, আমাদের ইতিহাসকে জানা যাবে না।

বইটা থেকে মুখ তুলে অনি দেখল থানার রাস্তায় দাদুদের কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। করল? ওপর আবছায়া সন্ধ্যার অন্ধকার কোন ফাঁকে চুইয়ে নেমে এসেছে। হঠাৎ কোনো কথা না বলে বই বগলে করে ও দৌগতে লাগল। নতুন স্যার অবাক হয়ে ওকে কিছু বললেন, কিন্তু সেটা শোনার জন্য সে দাঁড়াল না।

রাস্তাটা বাঁধানো নয়, একরাশ ধুলো উড়িয়ে ও থানার পাশে এসে দাঁড়াতেই ঢং ঢং করে পেটাঘড়িতে শব্দ হতে লাগল। এখান থেকে রাস্তা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। কোন রাস্তা দিয়ে দাদু গিয়েছেন কী করে বোঝা যাবে? হঠাৎ খেয়াল হল সেদিন দাদু হোটেলের কথা বলছিলেন। থানার

ওপাশে কী-একটা হোটেলের সাইনবোর্ড দেখেছিল ও একদিন। সেদিনই পা চালাল অনি।

এখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় তেমন আলো নেই। দুই-একটা রিকশা ছাড়া লোকজন কম যাওয়া-আসা করছে। থানার সামনে দুটো সিপাই বন্দুক ঘাড়ে করে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একা সন্ধেবেলায় এইদিকে কখনো আসেনি ও। আনন্দমঠটা দুহাতে চেপে ধরে সামনে দিয়ে হেঁটে এল অনি। সামনেই একটা বিরাট বটগাছ, তার তলায় ভুজাওয়ালা দোকান। অনি গাছের তলায় চলে এল। এদিকে আলো নেই একদম, শুধু ভূজাওয়ালার দোকানের সামনে একটা গ্যাস পাইপ জ্বলছে। সেই আবহায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনি দেখল বেশকিছু লোক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। একটা কালো রঙের গাড়ির সামনের সিটে দাদু বসে আছেন। দাঁড়িয়ে-থাকা লোকগুলোর মধ্যে সাধুচরণ ছাড়া স্বৰ্গছেঁড়ার মনোজ হালদার, মালবাবুকে দেখতে পেল ও। একটু বাদেই অনি অবাক হয়ে দেখল কয়েকজন তোক মহীতোষকে দুপাশে ধরে হোটেলের সিড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে। বাবাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এখন। এক হাতে টোপর, ধুতি কুঁচিয়ে ফুলের মতো অন্য হাতে ধরা, কপালে চন্দনের ফোঁটা, পাঞ্জাবিটা কেমন চকচকে করছে আলোয়। বাবা এসে গাড়ির পিছনে উঠে বসলেন। সাধুচরণ আর সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক মালবাবুকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা কিন্তু হুশ করে চলে যেতে পারল না। কারণ গাড়ির সামনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোকজন হেঁটে যেতে লাগল পথ চিনিয়ে। সিটির দাঁড়িয়ে অনি গাড়িটাকে প্রায় ওর সামনে দিয়ে যেতে দেখল! দাদু গম্ভীরবে বসে আছেন। বাবা হেসে মালবাবুকে কী বলছেন। মুখ ফেরালেই ওরা ওকে দেখে ফেলতে পারতেন। দেখতে পেলে কি বাবা ওকে বকতেন? হঠাৎ ওর মনে পড়ল বাবার এইরকম পোশাক পরা একটা ছবি স্বৰ্গছেঁড়ার বাড়িতে মায়ের অ্যালবামে আছে। মা বলতেন, বিয়ের ছবি! আনন্দমঠ জড়িয়ে ধরে অনি চুপচাপ গাড়ি খানিক পেছনে হাঁটতে লাগল।

গলির মুখটায় বেশ ভিড়, গাড়ি ঢুকল না। তিন-চারটে গোরামনে মেয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে এসে বাবাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল, তারপর ভিড়টা সিনেমা হলে ঢোকার মতো গলির ভেতর চলে গেল। এখন চারিদিকে বেশ অন্ধকার। এ-রাস্তায় আলো নেই, শুধু বিয়েবাড়ি বলে গুলির মুখে একটা হ্যাজাক ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনির খুব কৌতূহল হচ্ছিল ভিতরে গিয়ে দেখতে বোনে। হচ্ছে। বাবা যখন মাকে বিয়ে করতে গিয়েছিল তখনও কি এইরকম ভিড় হয়েছিল? এইরকম আলো দিয়ে মায়েদের বাড়ি সাজানো হয়ছিল। মা বেঁচে থাকলে বাবা আর বিয়ে করতে পারত না এটা বুঝতে পাবে অনি। কিন্তু এখন, এই একটু আগে বাবাকে যখন মেয়েরা গাড়ি তেকে নামিয়ে নিয়ে গেল তখন তো একদম মনে হল না বাবার মনে কষ্ট আছে। বউ মরে গেলে যদি আবার বিয়ে করা যায় তো পিসিমা কেন বিয়ে করেনি? পিসিমা তো আবার শাড়ি পরে মাছ খেতে পারত। আজন্ম-দেখা পিসিমার চেহারাটায় ও মনেমনে শাড়ি সিঁদুর পরিয়ে হেসে ফেলল, দ্যৎ পিসিমাকে একদম মানায় না। ঠিক ওই সময় ও শুনতে পেল কে যেন ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করছে, কী চাই খোন কা? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?

অনিমেষ কী বলবে মনেমনে তৈরি করতে-না-করতে লোকটা এসে দাঁড়াল সামনে, নেমন্তন্ন খেতে এসেছ তো এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে যাও।

লোকটা ওর পিঠে হাত রেখে বলছে, ভেতরে যাও। এখন তো বেশ সহজে যেতে পারে। কিন্তু বাবা,-দাদু-অনিমেষ এক পা এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল।

কী হল, দাঁড়ালে কেন? যাও। লোকটা কথাটা শেষ করতেই ওর মনে হল এবার একছুটে পালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু ততক্ষণে একটা সন্দেহ এসে গেছে লোকটার মনে, তোমার নাম কী? কোন বাড়িতে থাকা

আমি এখানে থাকি না। অনিমেষ বলল।

কোন পাড়ায় থাক? কার সঙ্গে এসেছ?

আমি নেমন্তন্ন খেতে আসিনি। অনিমেষ প্রায় কেঁদে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটার চেহারা পালটে গেল, তা হলে এখানে দুরমুর করছিস কেন? চুরিচামারির ধান্দা, অ্যাঁ? যা ভাগ। অনিমেষ দেখল লোকটা চড় মরার ভঙ্গিতে একটা হাত উগড়ে তুলেছে। নিজেকে বাঁচাবার জন্য সরে যেতে না-যেতেই লোকটা খপ করে ওর হাত ধরল, তোর হতে এটা কী! বাই! কোত্থেকে মেরেছ বাবা! প্রায় ছোঁ মেরে বইটা কেড়ে নিয়ে লোকটা বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে উচ্চারণ করল, আনন্দমঠ, অ্যাঁ? ধান্দাটা কী?

আমার বইটি দিন। অনিমেষ কোনোরকমে বলল।

অ্যাই চোপ। যা পালা এখান থেকে। লোকটা তেড়ে উঠতে পেছন থেকে আর-একটা গলা শোনা গেল, কী হয়েছে শ্যামসুন্দর? চেঁচাচ্ছে কেন?

আরে এই ছোকরা তখন থেকে ঘুরঘুর করছে, এ-পাড়ায় কোনোদিন দেখিনি। লোকটা মুখ ফিরিয়ে বলল।

খুব সাবধান। আজকাল চোর-ডাকাতের দল এইসব বাচ্চা ছেলেকে পাঠিয়ে খবরাখবর নেয়। অনিমেষ দেখল একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে আসছেন।

হঠাৎ মাথা-গরম হয়ে গেল ওর। শ্যামাসুন্দর নামে লোকটা কিছু বোঝার আগেই ও ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত থেকে আনন্দমঠটা ছিনিয়ে নিল। এত জোরে লাফিয়ে উঠেছিল অনিমেষ ও শ্যামসুন্দর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ঘুরে মাটিতে পড়ে গিয়ে ওরে বাপরে বাপ বলে চিৎকার করে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরতে গেল। বেটাল হয়ে অনিমেষ মাটিতে পড়তে পড়তে কোনোরকমে শ্যামসুন্দরের মুখে একটা পেনালটি শট কষিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অনিমেষকে ছেড়ে দিয়ে নিজের মুখ দুহাতে চেপে ডাকাত ডাকাত বলে শ্যামসুন্দর চাঁচাচ্ছে আর সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক হঠাৎ গলা ফাটিয়ে একটা বিকট শব্দ তুলতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে গলির ভিতরে অনেকগুলো গলায় হইহই আওয়াজ উঠল। অনিমেষ দেখল পিলপিল করে লোকজন বেরিয়ে আসছে গলি দিয়ে। আর দাঁড়াল না অনিমেষ, এক হাতে বইটা সামলে প্রাণপণে ছুটতে লাগল সামনের রাস্তা ধরে। কেউ পালিয়ে গেছে এটা বুঝতে না পেরে একটা অজানা অন্ধকার গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। এতদূর দৌড়ে এসে ওর হাঁপ ধরে যাচ্ছিল, মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে ও বুঝতে পারছিল আর পালাতে পারবে না। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ কিছু–একটায় পা জড়িয়ে ও ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল। ওর মনে হল ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা। ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, একটা অসহ্য যন্ত্রণা পাক খেয়ে উঠেছে পা বেয়ে। চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে ও টের পেল পেছনে কোনো পায়ের শব্দ নেই। কোনো গলা ভেসে আসছে না। তা হলে কি ওরা আর পেছন পেছন আসছিল না? ও কি বোকার মতো ভয়ের চোটে দৌড়ে যাচ্ছিল। একটু একটু করে সাহস ফিরে আসতে শরীর ঠাণ্ডা হল, বুকের ভিতর ধুকধুকুনিটা কমে এল। অনিমেষ উঠে বসে নিজের বুড়ো আঙুলে হাত দিতেই আঙুলগুলো চটচটে হয়ে গেল। গরম ঘন বস্তুটি যে রক্ত তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না। আঙুলের চটচটে অনুভূতিটা হঠাৎ ওকে কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলল। একা এই অন্ধকারে মাটিতে বসে মাধুরীর মুখটা দেখতে পেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল অনিমেষ।

পায়ের গোড়ালির উপর ভর করে কয়েক পা হেঁটে আসতে ও একসঙ্গে অনেকগুলো আলো দেখতে পেল। আললাগুলো খুব উজ্জ্বল নয়, পরপর লাইন কিছুটা দূরে চলে গেছে। কাছাকাছি অনেকগুলো গলা শুনতে পেল সে। বেশির ভাগ গলাই মেয়েলি, কেউ হাসছে, কেউ গান গাইছে। এইরকম গলায় কোনো মেয়েকে ও হাসতে শোনেনি কোনোদিন। ওকে দেখে মেয়েগুলো মুখের কাছে আলো তুলে ধরল। অবাক চোখে অনিমেষ দেখল পরপর অনেকগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সার দিয়ে। কেমন সব সাদা-সাদা মুখ আর তাতে পড়েছে লণ্ঠন, কুপির আলো। যেন নিজেদের মুখ অনিকে দেখানোর জন্য ওরা আলোগুলো তুলেছে। একটা মেয়েলি গলায় চিৎকার উঠল, এ যে দেখি, কেষ্টঠাকুর, নাড় গোপাল, ননী খাবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?

সঙ্গে সঙ্গে আলোগুলো নিচে নেমে এল, ওমা, এ যে দেখছি পুঁচকে ছেলে! আমি ভাবলাম নাগর এল বুঝি।

খিলখিল করে হেসে উঠল একজন, এগুলো হল ক্ষুদে শয়তান, বুঝলে দিদি! একটু সুড়সুড়ি উঠেছে কি এসে হাজির।

ঝ্যাঁটা মার, ঝ্যাঁটা মার।

আঃ থামো তো, রাম না বলতেই রামায়ণ গাইছ। অনিমেষ দেখলে একটা লম্বামতন মেয়ে লণ্ঠন-হাতে ওর দিকে এগিয়ে এল, এই ছোঁড়া, এখানে এসেছিস কেন?

আমি আর আসব না। অনিমেষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ল, কান ধরে বলতে বল রে!

মেয়েটি এক হাত কোমরে রেখে অন্য হাতে হারিকেন ধরে আবার বলল, কিন্তু এসেছিস কেন? জানিস না এ-মহল্লার নাম বেগুনটুনি, এখানে আসতে নেই! নাকি জেনেশুনে এসেছিস?

ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, তারপর বলল, আসতে নেই কেন?

মেয়েটি কী বরতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর একটু নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন স্কুলে পড়?

হঠাৎ তুই থেকে তুমিতে উঠে গেলে অনিমেষের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল, জেলা স্কুলে।

বলতে বলতে ও যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেলল। মেয়েটি বলল, কী হয়েছে, অ্যায়সা করছ কেন?

অনিমেষ পা-টা তুলে ধরতেই মেয়েটি মুখে হাতচাপা দিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল, ওমা, এ যে দেখছি রক্তগঙ্গা ছুটছে, ক্যায়সা হল?

অনিমেষ দেখল আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে মুখ বাড়িয়ে ওর পা দেখছে। একজন বলল, ছেড়ে দে, এই সন্ধেবেলায় আর ঝামেলা বাড়াস না।

কে-একজন জড়ানো গলায় গান গাইতে গাইতে এদিকে আসছে দেখে সবাই হৈ হৈ করে আবার বাতি নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথম মেয়েটি সেদিকে একবার দেখে একটু ইতস্তত করে এক হাত অনিমেষের পিঠের ওপর রেখে বলল, তুমি আস্তে-আস্তে আমার কামরায় উঠে এসো তো!

একটু এগোলেই সার-দেওয়া মাটির ঘর দেখতে পেল অনিমেষ। তারই একটায় মেয়েটি ওকে নিয়ে ঢুকল। ঘরের মধ্যে লণ্ঠনটা রেখে মেয়েটি ওকে বসতে বলল। আসবার বলতে একটা তক্তাপোশ, আর ওপর বিছানা করা। দুটো বালিশ, কোনো পাশবালিশ নেই। দেওয়ালে একটা ভাঙা আয়না ঝোলানো, একদিকে দড়িতে কিছু জামাকাপড় এলোমেলোভাবে টাঙানো। ওকে বসতে বলে মেয়েটি তক্তাপোশের তলা থেকে একটা টিনের সুটকেস টেনে বের করে তা থেকে অনেকটা পাড় ছিঁড়ে নিয়ে এসে বলল, দেখি, গোড় বাড়াও! ওর খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল মেয়েটি পা ধরায়, কিন্তু হঠাৎ ওর মনে হল মেয়েটি খুব ভালো। এত ভালো যে তার কাছে আসতে নেই কেন? তপুপিসির চেয়ে বেশি বড় হবে না মেয়েটি, কিন্তু সাজগোজ একদম অন্যরকম। এরা কারা? এই যে এত মেয়ে একসঙ্গে রয়েছে, সন্ধেবেলায় আলো নিয়ে ঘুরছে কী জন্যে? এটা কি কোনো হোস্টেল? ওদের স্কুলে যেমন ছেলেদের বোর্ডিং আছে তেমন কিছু কিন্তু মেয়েরা এত চেঁচিয়ে হাসবে কেন? ওর মনে পড়ে গেল হেমলতা ওকে যে অপ্সরাদের গল্প বলেছিলেন তারাও তো এইরকম হাসি গান নিয়ে থাকে, দরকার হলে ভগবানদের সভায় গিয়ে নেচে আসে। এরা কি নাচ জানে? দ্যুৎ অপ্সরারা দারুণ সুন্দরী হয়, এরা তো কেমন কালোকালো। হঠাৎ ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে চাপ লাগাতেই অনিমেষের নজর পায়ের দিকে চলে এল। ও দেখল ওর পায়ের ওপর ইয়া লম্বা একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গেছে। ওদের ডিল স্যার খুব সুন্দর করে ব্যান্ডেজ বাঁধার যে-কায়দাটা ওদের শিখিয়ে দিয়েছেন এই মেয়েটা নিশ্চয়ই সেটা জানে না।

কি, আর দরদ লাগছে। মেয়েটি গিট বেঁধে ওর পা কোল থেকে নামিয়ে দিল। ঘাড় নেড়ে না বলে অনিমেষ উঠে দাঁড়াতেই ওর মনে হল কী-একটা যেন ওর কাছে নেই। কী নেই বুঝতে না পেরে ও নিজের হাতের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল অনিমেষ। ও যখন দৌড়ে এই গলির মুখে আসে তখনও বইটা তার হাতে ধরা ছিল হাতজোড়া হয়েছিল বলে একটুও লকোতে পারেনি। তা হলে নিশ্চয়ই অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে ও যখন আছড়ে পড়েছিল তখন বইটা ছিটকে গিয়েছে। গোড়ালির ওপর ভর করে ও প্রায় দৌড়ে বাইরে আসছিল কিছু না বলে। মেয়েটি চট করে ওর হাত ধরে বলল, চলতে পারবে তো?

দ্রুত ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, হ্যাঁ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল। মেয়েটি খুব অবাক হচ্ছিল ওর এইরকম পরিবর্তনে, লণ্ঠন-হাতে পেছন পেছন খানিকটা এসে চেঁচিয়ে বলল, আরে শোনো, সামালকে যাও। ততক্ষণে অনিমেষ অনেকটা দূর চলে গেছে। কিন্তু গলিটার মধ্যে এত অন্ধকার কেন যে-জায়গাটায় ও আছাড় খেয়ে পড়েছিল সে-জায়গাট যে ছাই বোঝা যাচ্ছে না। কোথায়। পা দিয়ে রাস্তাটা হাঁটকে দেখতে লাগল ও অন্ধের মতন। নতুন স্যার বলেছেন, এই বই না পড়লে দেশকে জানা যাবে না, আমাদের ইতিহাস জানা যাবে না। এই অন্ধকারে অনিমেষ কোথাও বইটার অস্তিত্ব খুঁজে পেল না একা একা। ঠিক এই সময় অন্ধকার কুঁড়ে একটা চিৎকার উড়ে এল, গলাটা ক্যানকেনে, কে রে এখানে ঘুরঘুর করে, ট্যাকখালির জমিদারের পো নাকি, বাপের বাসিবিয়ে দেখার বড় সাদ, না রে, যা বোরো এখান হতে। চারপাশে তাকিয়ে অনিমেষ কাউকে দেখতে পেল না। এই অন্ধকার গলিতে কাউকে দেখা অসম্ভব। অথচ ওর মনে হচ্ছে এই কথাগুলো যে বলল সে যেন স্পষ্ট তাকে দেখতে পাচ্ছে। কেমন শিরশির করতে লাগল ওর। এখান থেকে একদৌড়ে ও বড় রাস্তায় চলে যেতে পারে। কিন্তু বইটা? ধীরে ধীরে ও পেছনদিকে তাকাল। একটা আলো পেলে হত, কেউ যদি একটা আলো দিত ওকে!

গোড়ালিতে ভর করে ও আবার ফিরে এল। ওকে দেখে একজন শিস দিয়ে উঠল, আ গিয়া মেরা জান-খিলাও দো খিলি পান। আর-একজন বলে উঠল, হায় কপাল, এ-ছেঁড়ার দেখছি জোয়ার এসেছে, তুই যত ওকে ঘরে ফেরত পাঠাবি, কবুতরী, ও তত এখানে ঘুরঘুর করবে দ্যাখ।

অনিমেষ দেখল সেই মেয়েটি লণ্ঠন-হাতে দ্রুত ওর দিকে এগিয়ে এল। তা হলে এর নাম কবুতরী? বেশ সুন্দর নাম তো। ওর কাছে এসে কবুতরী বলল, ফিন চলে এলে, ঘর যাও। এখন ওর কথার মধ্যে বেশ একটা ব্যাজ টের পেল অনিমেষ। সেই নরম ভাবটা নেই। মুখ ঘুরিয়ে ও আবার গলিটার দিকে তাকাল-একদম ঘুটঘুট করছে। ওর কাছে আলো চাইলে কি খুব রেগে যাবে? কবুতরী সেটা লক্ষ করে বলল, ডর লাগছে নাকি? আসতে ডর নেই, যেতে ডর! চল, আমি যাচ্ছি। ফির কভি এখানে আসবি না। লণ্ঠনটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে অনিমেষকে টানতে টানতে কবুতরী হাঁটতে লাগল। কয়েক পা এগোতেই বাঁদিকের রকে চোখ যেতে চমকে উঠল অনিমেষ। একটা বুড়ি শুকনো মুখ ফোকলা দাঁতে হাসছে। তার চোখ দুটো খুব বড়, সমস্ত চামড়া ঝুলছে। দুটো শুকনো পায়ের ফাঁকে মুণ্ডুটা ঝোলানো যেন, উবু হয়ে বসে আছে। বোধহয় কেউ সরিয়ে না দিলে নড়তে পারে না। হারিকেনের আলো ওর মুখ তেকে সরে যাবার আগেই ক্যানকেনে গলায় বেড়িয়ে এল মুখ থেকে, ক্যারে, বিয়ে দেখলি? অ্যাঁ?

বুকের ভিতর হিম হয়ে যায় আচমকা। হাঁটতে হাঁটতে কতরী বলল, ডরো মৎ। ও বহুৎ ভালো বুড়ি আছে, আমাদের দেখ ভাল করে। হোঁচট খাওয়ার জা; টায় এসে অনিমেষ দাঁড়িয়ে পড়ল। লণ্ঠনের আলো গলির ভিতর নাচতে নাচতে যাচ্ছে, ব্যাকুল চোখে ও চারধারে খুঁজতে লাগল। সব জায়গায় আলো যাচ্ছে না, বইটা কত দূরে যেতে পারে? কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল কবুতরী, কী হল, খাড়া হয়ে গেলে কেন? আর ঠিক তখনই ও. দেখতে পেল রাস্তার পাশে নর্দমার গায়ে নরম পাকের ভিতর বর্শার মতো গেঁথে আছে বইটা। একছুটে অনিমেষ বইটাকে তুলে নিল। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা কাদা-মাখা জল গড়িয়ে পড়ল নিচে, তলার দিকটা কাদায় ভিজে কালো হয়ে গিয়েছে। নতুন স্যার কী বলবেন ওকে হাত দিয়ে মলাটের কাদা মুছতে গিয়ে কাগজটা আরও কালো-কালো হয়ে গেল। আলোটা বেড়ে গেলে ও দেখল কবুতর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কী টুড়ছ? কার কিতাব?

অনিমেষ বলল, আমার। পড়ে গিয়েছিল এখানে। কাদা লেগে গেছে।

লণ্ঠনটা নামিয়ে রেখে কবুতরী হঠাৎ বইটা টেনে নিল। উবু হয়ে বসে মলাটের ওপর পাগড়ি মাথায় বঙ্কিমচন্দ্রের ছবিটা খানিকক্ষণ দেখে জিজ্ঞাসা করল, নাম কী এই কিতাবের?

অনিমেষ বলল, আনন্দমঠ। বইটা খুলে পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে কবুতরী বলল, জাদা নষ্ট হয়নি। শেষ পাতায় কিছুটা কাদা ছিল, আঙুল দিয়ে সেটাকে মুছতে খানিকটা দাগ হয়ে গেল। বইটা ফেরত দিয়ে কবুতরী জিজ্ঞাসা করল, এখন সাফ করলে আরও খারাপ পড়ে ফেলল-বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গেল।

লাইনটার মানে ও কিছুতেই বুঝতে পারল না।

দাদুর সঙ্গে চলে আসার পর আর স্বৰ্গছেঁড়ায় যায়নি অনিমেষ। মহীতোষ এর মধ্যে অনেকবার এসেছেন জলপাইগুড়িতে। প্রত্যেকবারই স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন, রাত্রে থাকেননি কখনো, বেলায়বেলায় চলে গিয়েছেন।

হেমলতা বলেছিলেন, মা না বলতে পারিস তুই, নতুন মা বলে ডাকিস, অনি। আমিও তা-ই বলতাম। হাজার হোক মা তো! ওরা এলো ধারেকাছে থাকত না অনি। প্রথমদিকে কেমন একটা অস্বস্তি, পরে লজ্জা-লজ্জা করত। অথচ ওরা আসবেন ছুটির দিন দেখে যখন অনিকে বাড়িতে থাকতেই হয়। মহীতোষ বাড়ি এসে বেশির ভাগ সময় তার বাবার সঙ্গেই গল্প করেন, চা-বাগানের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নেন। সেই সময় তার স্ত্রী রান্নাঘরে হেমলতার পাশে গিয়ে বসে থাকে। মেয়েটির বয়স অল্প এবং হেমলতা প্রথম আলাপেই বুঝে গিয়েছিলেন, মেয়েটির স্বভাবের সঙ্গে মাধুরীর যথেষ্ট মিল আছে। চিবুকের আদলটায় তো মাধুরী বসানো, সেইরকমই হাবভাব। তবে মাধুরী একটু ফরসা ছিল এই যা। প্রথম কদিন তো একদম কথাই বলেনি। হেমলতা তিনরার জিজ্ঞাসা করলে একবার উত্তর পান। সে-সময় কী কারণে মহীতোষ এদিকে এসেছিলেন, হেমলতা তাকে ডেকে বললেন, ও মহী, তোর বউ-এর বোধহয় আমাকে পছন্দ হয়নি, আমার সঙ্গে একদম কথা বলে না।

মহীতোষ উত্তর দেননি কিছু, চুপচাপ চলে গিয়েছিলেন ঘর থেকে। তার চলে যাওয়া বুঝতে পেরে খুব আস্তে অথচ দ্রুত নতুন বউ বলে উঠেছিল, আমার ভয় করে।

ভয়! ভয় কেন? অবাক হয়েছিলেন হেমলতা।

মাথা নিচু করে নতুন বউ বলেছিল, আমি যদি দিদির মতো না হই!

ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে জল হয়ে গেলেন হেমলতা। মহীতোষের বিয়ে করাটা উনি একদম পছন্দ করেননি সেটা সবাই জানে। নতুন বউ এলে একটা দূরত্ব রেখে গেছেন এই কয়দিন, কখনো অনিকে বলেননি কাছে আসতে। এক সেই প্রথমদিন ওঁরা যখন জোড়ে এলেন, বউ এসে তাঁকে প্রণাম করল, কানে দুল দিয়ে আশীবাদ করলেন যখন তখন সরিৎশেখর অনিকে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। ছেলেটা। আগাগোড়া মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে ওঁদের প্রণাম করে চলে গেল। শ্বশুর সামনে তখন নতুন বউ একমাথা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে। এখন এই মেয়েটার কথা শুনে বুকটা কেমন করে উঠল হেমলতার। মাধুরী মুখটা ভাবতে গিয়ে কাঁপুনি এল শরীরে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে ললেন, তোমার নামটা আমার একদম ভালো লাগে না বাপু, আমি তোমাকে কিন্তু মাধুরী বলে ডাকব।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে ওঁর দিকে তাকিয়েছিল নতুন বউ। হেমলতা দেখেছিলেন দুটো বড় বড় চোখ ওঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে হেমলতা দেখলেন একটু একটু করে জল গড়িয়ে এসে চোখের কোনায় জমা হচ্ছে। খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছেন বুঝতে পেরে গেছেন ততক্ষণে। সরিৎশেখর চিরকাল তাকে বকাবকি করেছেন পেট-আলগা বলে, মনে যা আসে মুখে তা না বললে স্বস্তি পান না হেমলতা। এই মেয়েটাকে মাধুরী বলে ডাকলে মনটা শান্ত হবে। ভেবেই কথাটা বলেছিলেন।

খপ করে নতুন বউ-এর হাতটা ধরলেন হেমলতা, রাগ করলি ভাই, আমি তোকে সত্যি বলছি, দুঃখ দিতে চাইনি।

নতুন বউ-এর তখন গলা ধরে গেছে, আপনি আমাকে যা-খুশি ডাকুন।

হেমলতা বললেন, দেখি তোর একটা পরীক্ষা নিই। কাল রাত্রে পায়েস করেছিলাম। অনির জন্য একবাটি সরপাতা হয়ে আছে। ওটা নিয়ে ছেলেটাকে খাইয়ে আয় দেখি। বেলা হয়ে গেল।

কথার নেশায় হেমলতা কখন টপ করে যে তুইতে নেমে এসেছেন নিজেই বুঝতে পারেননি। বয়সে ছোট কাউকে যদি ভালো লেগে যায় তাহলে তাকে তুই না বললে একদম সুখ হয় না তার।

ঘরের কোনায় মিটসেফের ভিতর পায়েসের বাটিগুলো চাপা দেওয়া আছে। আগের সন্ধেবেলায় রাধা পায়েস এক-একটা বাটিতে ঢেলে রেখে দেন হেমলতা। নাড়াচাড়া না হওয়ায় বাটিগুলোতে পায়ে জমে গিয়ে পুরু সর পড়ে যায়। সরিৎশেখরের ভালোবাসার জিনিসের মধ্যে এখন এই একটা জিনিস টিমটিম করে বেঁচে রয়েছে। ভালো দুধ পাওয়া যায় না এখানে, স্বৰ্গছেঁড়ায় যখন পায়েস রান্না হত সাত বাড়ির লোক টের পেত। কালানোনিয়া চালের গন্ধে চারধার ম-ম করত। সরিৎশেখর নিজেই এক জামবাটি পায়েস দুবেলা খেতেন! দাদুর এই শখটা পেয়েছে নাতি, পায়েস খেতে বড় ভালোবাসে ছেলেটা।

আজ মহীতোষরা আসবেন বলে প্রত্যেকের জন্য আলাদা বাটিতে পায়েস বেঁধে রেখেছেন হেমলতা। সকালে দেখেছেন সেগুলো জমে গিয়েছে বেশ। বিভিন্ন সাইজের বাটি আছে মিটসেফে। নতুন বউ উঠে দাঁড়ালে তিনি মিটসেফটা ওকে দেখিয়ে দিলেন। বুক-সমান মিটসেফের দরজা খুলে নতুন বউ সেদিকে তাকাতেই হেমলতা আড়চোখে দেখতে লাগলেন। অনির মন অল্পে ভরে না, ছোট বাটিতে পায়েস দিলে ঠ্যাচামেচি করবেই। নতুন বউ কোনো বাটিটা তোলে দেখছিলেন তিনি, মন বোঝা যাবে। দেওয়ার হাতটা টের পাওয়া যাবে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে, মনে মনে খুশি হলেন হেমলতা। বড় তিনটে বাটির একটাকে বের করে আনল নতুন বউ, ছোট দুটোতে হাত ছোঁয়াল না। যাক, অনিটার কখনো কষ্ট হবে না। চামচটাও মনে করে নিল!

হেমলতা বললেন, বড় বাড়িতে রয়েছে ও, তুই গিয়ে ভালো করে আলাপ করে পায়েস খাইয়ে আয়। এক পা হেঁটে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল নতুন বউ। কিছু-একটা বলব-বলব করে যেন বলতে পারছিল না। সেটা বুঝতে পেরেই যেন হেমলতা বললেন, কী হল, আরে বাবা নিজের ছেলের কাছে যাচ্ছিস, লজ্জা কিসের! অনি বড় ভালো ছেলে, মনটা খুব নরম। নে যা, আমি আর বকবক করতে পারছি না, উনুন কামাই যাচ্ছে।

ভেতরের বারান্দায় সরিৎশেখর মহীতোষের সঙ্গে বসেছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন বউকে দেখলেন সরিৎশেখর। একমাথা ঘোমটা, আঁচলের তলায় কিছু-একটা ঢেকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে আসছে। ওকে দেখলেই চট করে মাধুরীর কথা মনে পড়ে যায়। মাধুরীও ঘোমটা দিত তবে এতটা নয়। সে-মেয়েকে পছন্দ করে এনেছিলেন তিনি, তার পছন্দের জিনিস বেশিদিন টেকে না। ছেলের দিকে তাকালেন, মহীতোষও বউকে দেখছে। একটুও গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, মেয়েটাকে ওর বাপের কাছে নিয়ে যাও না কেন? প্রত্যেকবারেই দেখতে পাই এখানে এসেই ফিরে যাচ্ছ।

হঠাৎ-এ ধরনের কথার জন্য তৈরি ছিলেন না মহীতোষ। কিছু-একটা নিয়ে স্ত্রীকে ওদিকে যেতে দেখে অবাক হয়েছিলেন তিনি। এই প্রথম এ-বাড়িতে ওকে দিয়ে কোনো কাজ করাচ্ছে দিদি। কিন্তু কার যাচ্ছে। ওখানে তো অনি থাকে। ছেলের সঙ্গে এখ ভালো করে কথা হয় না তার, কেমন অস্বস্তি হয়। স্ত্রীকে অনির কাছে যেতে দেখে হঠাৎ খুব আরাম বোধ হচ্ছিল। এই সময় বাবার প্রশ্নটা কানে কী বলবেন বুঝতে না পেরে কান চুলকে বললেন, যেতে চায় না ও।

ভ্রূ কুঁচকালেন সরিৎশেখর, সে কী! না না, এ ঠিক কথা নয়। তোমারই উদ্যোগী হওয়া উচিত, এক শহরে বাড়ি, তার মা-বাবা কী ভাবছেন বলো তো!

সরিৎশেখর নিজে কখনো ছেলের শ্বশুবাড়িতে যান না, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও যেতে পারেন না। মহীর বিয়ের রাত্রে বাড়ি ফিরে তার যে-অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে-কথা কাউকে বলা হয়নি, এমনকি হেমলতাকেও নয়। নাতির মুখের দিকে চেয়ে সেদিন তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

নতুন বউ এদিকটায় কখনো আসেনি। বিরাট বারান্দা পেরিয়ে সার-দেওয়া ঘরগুলোর কোনটায় অনিমেষ আছে বুঝে উঠতে সময় লাগল তার। দরজাটা ভেজানো ছিল। হঠাৎ তার মনের হল শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, হাতে কোনো সাড় নেই। এ-বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিনও এরকম মনে হয়নি। এতবড় একটা ছেলে যার তাকে বিয়ে করতে কখনোই ইচ্ছে হয়নি তার, তবু বিয়েটা হলে গেল। আর বিয়ের পর ইস্তক অহরহ যার নাম শুনছে ও, সে হল এই ছেলে। মহীতোষের কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছে ছেলের মন জয় করতে মহীতোষ স্ত্রীকে যেন পরোক্ষভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু সেটা কী করে হয়! আজ অবধি জেনেশুনে কোনো মন জয় করার চেষ্টা ওকে করতে হয়নি। সেটা কী করে করতে হবে মহীতোষ তাকে শিখিয়ে দেননি কিন্তু। ভেজানো দরজাটা ঠেলল নতুন বউ।

বাবা এবং নতুন মা এসেছেন জানতে পেরে অনি চুপচাপ করে বসে ছিল। পিসিমার নির্দেশমতো ও মনে মনে নতুন মা শব্দটাকে অনেকখানি রপ্ত করে নিয়েছে, কিন্তু ব্যবহার করেনি। দূর থেকে কয়েকবার নতুন মাকে ও দেখেছে। এর আগে ওরা যখন এসেছেন তখন দুপুরের খাওয়ার সময় বাবা আর দাদুর পাশে বসে খেতে খেতে মাথা নিচু করে আড়চোখে দেখেছে, একটা রঙিন শাড়ি রান্নাঘরের দরজার অনেকটা আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খাওয়ার সময় বসে খাতাটা অত্যন্ত খারাপ লাগে অনির। বাবা যেন না বললে নয় এরকম দুএকটা প্রশ্ন করেন। কত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে পারবে সেই চেষ্টা চালিয়ে যায় অনি। পিসিমা পরিবেশন করে বলে স্বস্তি পায় ও। এতদিন যা মনে হয়নি আজ ওঁরা যখন রিকশা থেকে নামলেন তখন অনি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমে টিনের বালতিতে ওর জামাকাপড় জলে ভিজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে আসছিল পড়তে, এমন সময় রিকশা বাড়ির সামনে এসে। থামে। মহীতোষ রিকশাগুলোকে পয়সা দিচ্ছিলেন যখন তখন নতুন মা রিকশা থেকে নেমে ঘোমটা ঠিক করে বাড়ির দিকে তাকাল। তার তাকানোর ভঙ্গিটা অনিকে কেমন চমকে দিল। ওর মনে যেটুকু আছে, মাধুরী এইরকমভাবে তাকাতেন। একছুটে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল অনি, কেউ ওকে লক্ষ করেনি।

কালকের পড়া হয়ে গিয়েছিল। খুব একটা আটকে না গেলে ও পড়া বুঝতে সরিৎশেখরের কাছে যায় না। এমনিতে দাদু খুব ভালো কিন্তু পড়াতে গেলেই চট করে এমন রেগে যান যে অনিকে অবশ্যই চড়-চাপড় খেতে হয়। সে-সময় ওঁর চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়। একটা সাধারণ ইংরেজি শব্দ অনি কেন বুঝতে পারছে না এই সমস্যাট এত প্রবল হয়ে ওঠে যে সেটা সমাধান করতে প্রহার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সামনের বছর থেকে মাস্টার রাখবেন মহীতোষ, সরিৎশেখরকে এরকম বলতে শুনেছে ও। পিসিমাকে অনি বলেছে যদি মাস্টার রাখতেই হয় তা হলে নতুন স্যারকে যেন রাখা হয়।

অনি দেখল দরজাটা খুলে গেল, এক হাতে বাটি নিয়ে নতুন মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতে মুখ নিচু করল অনি। এ–ঘরে কেন এসেছে নতুন মা? ও তো কাউকে বিরক্ত করতে যায়নি। যেন কিছুই দেখেনি এইরকম ভঙ্গি করে অনি সামনে খুলে-রাখা একটা বই-এর দিকে চেয়ে থাকল।

পায়েসটা খেয়ে নাও। বড়দের মতন নয়, একদম ওদের মতো গলায় কথাটা শুনতে পেল অনি। অবাক হয়ে তাকাল ও। পায়েস খেতে ওর খুব ভালো লাগে কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি রান্নাঘরের বাইরে ভাতের সকড়ি এ-বাড়িতে কাউকে আনতে দেখেনি। পিসিমা এ-ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। জামাকাপড় না ছেড়ে পায়খানায় গেলে চিৎকার করে পাড়ামাত করে দেন। পায়েস শোয়ার ঘরে বসে কেতে দেবেন, এ একেবারেই অবিশ্বাস্য। হয় পিসিমা জানেন না, নতুন মা না বলে নিয়ে এসেছে। উলটো ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না অনিমেষের। খুব আস্তে ও বলল, আমি শোবার ঘরে পায়েস খাই না।

থতমত হয়ে গেল নতুন বউ। কথাটা ওর একদম খেয়াল হয়নি, আসার সময় দিদিও বলে দেয়নি। এইটুকুনি ছেলে যে এতটা বিচক্ষণের মতো কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি সে, শুনে লজ্জা এবং অস্বস্তি হল। মাথায় বেশ লম্বা ছেলেটা, গড়ন অবিকল মহীতোষের মত। মুখটা খুব মিষ্টি, চিবুকের কাছে এমন একটা ভাঁজ আছে যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। এই ছেলে, এত বড় ছেলের মা হতে হবে, বরং দিদি হতে পারলে ও সবচেয়ে খুশি হত।

চেষ্টা করে হাসল নতুন বউ, তারপর ঘরটা দেখতে দেখতে অনির পাশে এসে দাঁড়াল, ঠিক বলেছ, আমার ছাই মাথার ঠিক নেই। যেই শুনলাম তুমি পায়েস খেতে ভালোবাস নিয়ে চলে এলাম। একবারও মনে হল না যে এটা রান্নাঘর না, এখানে সকড়ি চলে না। তা এসেছি যখন তখন এক কাজ করা যাক, আমি হাতে ধরে থাকি তুমি চামচ দিয়ে তুলে তুলে খাও। পায়েসে গাঁথা চামচসুদ্ধ বাটিটা আনির সামনে ধরল নতুন বউ। সেদিকে তাকিয়ে অনির জিভে জল প্রায় এসে গেল, কী পুরু সর পড়েছে। কিন্তু কেউ বাটি ধরে থাকবে আর তা থেকে ও খাবে এরকম কোনোদিন হয়নি। হঠাৎ ও নতুন বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বাঙাল, না?

হকচকিয়ে গেল নতুন বউ, মানে?

পায়েসের দিকে তাকিয়ে অনি বলল, পিসিমা বলেন, বাঙালরা সকড়ি-কড়ি মানে না!

খিলখিল করে হেসে ফেলল নতুন বউ। হাসির দমকে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম সে বিয়ের আগের মতো হাসতে পারছে। অনির খুব মজা লাগছিল। নতুন মা একদম তপুপিসির মতো করছে। কোনোরকমে হাসির দমক সামলে নতুন বউ বলল, ঘটি ঘটি ঘটি, বাঙাল চললে চটি। তার পরেই হঠাৎ গলার স্বর পালটে প্রশ্ন করল, তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ, না?

মাথা নিচু করল অনি। সেই রাত্রে বাড়িতে ফিরে বারান্দায় দাঁড়ানো সরিৎশেখরকে সে রেগেমেগে যেসব কথা বলেছিল তা কি বাবা জানেন?বাবা জানলেই নতুন বউ জানবে। পিসিমা তো কোনোদিন অনির সঙ্গে ও-বাপরে কথা বলেননি। কিন্তু অনি জানে পিসিমা সব শুনেছিলেন আবার কেউ-এর দিকে ও পূর্ণচোখে তাকাল। শরীর দেখে খুব বড় বলে একদম মনে হয় না। একটুও ভারিকি দেখাচ্ছে না, কিন্তু এখন যেভাবে ঠোঁট টিপে হাসছে চট করে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। অনি বলল, আমি তোমাকে চিনি না, খামোকা রাগ করতে যাব কেন?

এক হাতে পায়েসের বাটিটা তখনও ধরা, অন্য হাত অনির চেয়ারের পেছনে রাখল নতুন বউ, আমাকে তুমি কী বলে ডাকবে?

একটু ভেবে অনি বলল, তুমি বলো।

তোমাকে কেউ বলে দেয়নি?

হুঁ বলেছে। পিসিমা বলেছে নতুন মা বলতে।

খুব ফিসফিস করে শব্দটা উচ্চারিত হতে শুনল অনি।

তোমার নতুন মা বলে ডাকতে ভালো লাগবে তো?

অনির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কথাবার্তাগুলো এমনভাবে হচ্ছে যে, অন্য একটা অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল সে।

অনি, আমাকে তুমি ছোটমা বলে ডাকবে? আমি তো চিরকাল নতুন থাকতে পারব না!

ঘাড় নাড়ল অনি। নতুন মার চেয়ে ছোটমা অনেক ভালো। মায়ের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন ছোটমা বলা।

তাহলে এই পায়েসটা খেয়ে ফ্যালো। চামচটা এগিয়ে দিল ছোটমা।

হেসে ফেলল অনিমেষ, যদি না খাই?

কপট নিশ্বাস ফেলল ছোটমা, কী আর করা যাবে। ভাবব আমার কপাল এইরকম। তোমাকে তো আর বকতে পারব না।

কেন? মায়েরা তো বকে।

ঘাড় নাড়ল অনি, ওর খুব মজা লাগছিল।

বন্ধু হলে কিন্তু সব কথা শুনতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়। আমার আজ অবধি একটাও বন্ধু ছিল। তুমি আমার বন্ধু হলে।

হাত বাড়িয়ে চামচটা ধরল সে, পুরু সরের চাদর কেটে এক চামচ পায়েস তুলে মুখে পুরতে পুরতে জিজ্ঞাসা করল, তুমি পেয়েছ?

একগাল হেসে ছোটমা বলল, কেন?

পিসিমা দারুণ পায়েস রাঁধে, খেয়ে দেখো। নিশ্চিত বিশ্বাসে বলল অনি, মাও এত ভালো পারত না।

নতুন বউ-এর সঙ্গে অনির ভাব হয়ে গিয়েছে জানতে পেরে মহীতোষ সবচেয়ে খুশি হলেন। হেমলতার মনটা ব্যবহারে বোঝা যায়, নতুন বউ-এর ওপর তার টেনে বেড়ে গেছে। সরিৎশেখরকে চট করে বোঝা মুশকিল। হেমলতা দুপুরে খাওয়ার সময় পাখার হাওয়া করতে করতে অনেকবার নতুন বউ-এর সঙ্গে অনির ভাবের কথা তুলেছেন। সরিৎশেখর হা-না করেননি। চিরকালেই আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তার একটা আড়াল-রাখা সম্পর্ক আছে, মনে কী হচ্ছে বোঝা যায় না। মহীতোষের বিয়ের রাত থেকে এ-ব্যাপারে একটা কথাও তার মুখ থেকে বের হয়নি।

এবার মহীতোষরা ফিরে যাবার পর বেশ কিছুদিন আসতে পারলেন না। চা-পাতা তোলা হচ্ছে। এখন ফ্যাক্টরিতে দিনরাত মেশিন চলছে। রবিবারেও সময়-অসময়ে ডাক পড়ে। এখন স্বৰ্গছেঁড়া ছেড়ে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর অনির স্কুল এখন ছুটি। কিন্তু নতুন স্যার ওদের প্রত্যেকদিন স্কুলে যেতে বলেছেন। রোজ দুটো থেকে স্কুলের মাঠে মহড়া হচ্ছে। ছাব্বিশে জানুয়ারি আসছে। নতুন স্যার বলেছেন, আমরা জন্মেছি পনেরোই আগস্ট আর আমাদের অন্নপ্রাশন হবে ছাব্বিশে জানুয়ারি।

ঠিক এই সময় এক অনি সেজেগুঁজে বেরুচ্ছে, ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে গেল। শীতের এই দুপুরে পশ্চিমে সূর্য চলে গেলে সরিৎশেখর পেছন-বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে শুয়ে থাকেন রোদে গা। ড়ুবিয়ে। ডাকপিয়ন ওঁর হাতে চিঠিটা দিয়ে গেল। খামের উপর ঠিকানা পড়ে তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, দাদুভাই তোমার চিঠি।

ভেতরের কলতলায় বাসন মাজছিলেন হেমলতা। এখনও মান হয়নি তার, জল লেগে পায়ের হাজা জ্বলছে, বারবার চিৎকার শুনে হাত থামিয়ে বললেন, ওমা, অনিকে আবার কে চিঠি দিল!

ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল অনিমেষ। আজ অবধি তাকে কেউ চিঠি দেয়নি। চিঠি দেবার মতো বন্ধু তার কেউ নেই।

অবশ্য ওর ঠিকানা স্কুলের অনেকের কাছে আছে। স্কুল বন্ধ হবার সময় যারা বাইরে যায় তারা পছন্দমতো ছেলের ঠিকানা নিয়ে যায়। কিন্তু কোনোবার চিঠি দেয়নি কেউ তাকে। বিশু আর বাপী যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। ওরা কোনোদিন তাকে চিঠি দেয়নি। বেশ একটা উত্তেজনা বুকের ভেতর নিয়ে অনিমেষ বারান্দায় দাদুর কাছে গেল। ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন সরিৎশেখর, এক হাত ওপরদিকে ভোলা, তাতে একটা মোটা নীল খাম ধরা। খামটা নিয়ে একছুটে ভিতরে চলে এল ও এদিক-ওদিক চেয়ে সোজা বাগানে নেমে গেল। সুপারিগাছে বসে একজোড়া ঘুঘু সামনে ডেকে যাচ্ছে। পেয়ারাতলায় এসে খামটা খুলতেই মিষ্টি একটা গন্ধ বেরুত। মার একটা খুব বড় সেন্টের শিশি ছিল। এই চিঠি যে লিখেছে সেও কি সেই সেন্ট মাখে! খামের ওপর লেখাটা দেখল ও। গোটা-গোটা মুক্তোর মতো অক্ষরে তার নাম লেখা দাদুর কোর অফে। নীল আকাশের চেয়ে নীল খামটা সন্তর্পণে খুলতেই ভাঁজ করা কাগজ হাতে উঠে এল। চিঠি বুক চিরে চারটে ভজের রেখা চারদিকে চলে গিয়েছে। চিঠির তলায় চোখ রাখল অনি, আমার স্নেহাশিস জানিও। ইতি, আশীর্বদিকা, তোমার ছোটমা। উত্তেজনাটা হঠাৎ কমে এল অনির। জানা হয়ে গেলে কোনোকিছু আশীবাদিকা, তোমার ছোটমা। উত্তেজনাটা হঠাৎ কমে এল অনির। জানা হয়ে গেলে কোনোকিছু নতুন থাকে না। উত্তেজনার জায়গায় কৌতূহল এসে জুড়ে বসল। চিঠিটা পড়ল সে, স্নেহের অনি। এই পত্র পাইয়া নিশ্চয়ই খুব অবাক হইয়াছ। এখানে আসিয়া শুধু তোমার কথা মনে পড়িতেছে। তুমি নিশ্চয় জান এই সময় তোমার পিতার চাকরিতে ছুটি থাকে না, তাই আমাদের জলপাইগুড়ি যাওয়া হইতেছে না। তাই বলি কি, তোমার যখন পাশের পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে তখন আমার নিকট চলিয়া আসিও। এখন তো আমরা বন্ধু, বন্ধুর নিকট বন্ধু আসিবে না?

তোমাকে লইয়া আমি নদীর ধারে বেড়াইব। শুনিয়াছি নদী বন্ধ হইবে, উহা কী জিনিস আমি জানি না। কুলগাছে প্রচুর কুল ধরিয়াছে। তুমি জানিয়া খুশি হইবে কালীগাই-এর একটি নাতনি হইয়াছে। রং সাদা বলিয়া নাম রাখিয়াছি ধবলি। বাড়িতে এখন এত দুধ হইতেছে যে খাইবার লোক নাই। তুমি আসলে আমি তোমাকে যত ইচ্ছা পায়েস খাওয়াইব। জানি দিদির মতো ভালো হইবে না।

গতকাল এখানকার স্কুলের ভবানী মাস্টার আমাদের বাড়িতে আসিয়াছিলেন। তোমাদের স্কুল এই বৎসর হইতে নতুন বাড়িতে উঠিয়া যাইতেছে। ভবানী মাস্টারের ইচ্ছা তুমি অবশ্যই আগামী ছাব্বিশে জানুয়ারি এখানে থাক। কারণ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রথম পতাকা তুমি উত্তোলন করিয়াছিলে। ছাব্বিশে জানুয়ারিতেও সেই কাজটি তোমাকে দিয়া তিনি করাইতে চান। শুনিলাম এই বৎসরই তিনি অবসর লইয়া দেশে যাইবেন।

তোমার পিতা পরে পত্র দিতেছেন, দিদিকে বলিও। গুরুজনদের আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম দিলাম। তুমি আমার স্নেহাশিস জানিও। ইতি, আশীর্বাদিকা, তোমার ছোটমা।

পুনশ্চ।। এ-জীবনে আমি কাহাকেও দুঃখ দিই নাই। অনি, তুমি কি আমাকে দুঃখ দিবে?

চিঠিটা পড়ে অনিমেষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন সেই ঘুঘু দুটোই শুধু নয়, একরাশ পাখি সমস্ত বাগান জুড়ে তারস্বরে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছ। চোখের সামনে স্বর্গহেঁড়ার গাছপালা মাঠ নদী যেন একছুটে চলে এল। সেই কাঁঠালগাছের ঝুপড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাল চিংড়িগুলো কিংবা সবুজ লালচের মতো বিছানো চা-গাছের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসা কুয়াশার দঙ্গল একটা নিশ্বাস হয়ে অনিমেষের বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।

ভবানী মাস্টার চলে যাবেন! একটা কথা মনে রাখবা বাবা, নিজের কাছে সৎ থাকলে জীবনে কোনো দুঃখই থাকে না। একটু ঘাম-জড়ানো নস্যির গন্ধ যেন বাতাসে ভেসে এল। স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবার যে ইচ্ছেটা মাধুরী চলে যাওয়ার পর একদম চলে গিয়েছিল সেটা হঠাৎ ঝুপঝুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মায়ের কথাটা ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা শীতল ছোঁয়া লাগল অনির। স্বৰ্গছেঁড়ায় গেলে সবাইকে দেখতে পাবে ও, শুধু মা নেই। তার জায়গায় ছোটমা সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিয়ের পর হেমলতা রাগ করে বলেছিলেন, দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? মা হল মা, সত্য সৎমাই। আচ্ছা, সত্য বলে কেন? সৎ মানে তো ভালো, ভালো মা-রা আবার খারাপ হবে কী করে! কিন্তু ছোটমাকে তো মায়ের মতো মনেই হয় না, বরং দিদির মতো নিজের মনে হয়। সত্যরা নাকি খুব অত্যাচার কার। ছোটমাকে দেখে, এই চিঠি পড়ে, কেউ সে কথা বললে অনি তাকে মিথ্যক বলবে। এখানে। ছোটমাকে তার ভালো লেগেছে, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ায় গেলে মাকে মনে পড়বেই, তখন ছোটমাকে–। অনির মনের হল বাবাকে যদি সে জিজ্ঞাসা করতে পার, মাকে ভুলে গেছে কি না। কিন্তু তবু স্বৰ্গছেঁড়ায়। যাবার জন্যে বুকের মধ্যে যে–ছটফটানি শুরু হয়ে গেছে সেটা যাচ্ছে না। নতুন স্যার বলেছিলেন, মা নেই কে বলল? জন্মভূমিই তো আমাদের মা। বন্দেমাতরম্। শব্দটা উচ্চাণ করলেই শরীর গরম হয়ে ওঠে। তখন আর কারও মুখ মনে পড়ে না ওর। পেয়রাগাছের তলায় পায়চারি করতে করতে ও নিচগলায় আবৃত্তি করতে লাগল, আমরা অন্য মা জানি না-জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই-আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়সীমরণ শীতলা, শস্যশ্যামলা-। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল অনি। একদৃষ্টে ও মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পেয়ারাগাছের তলায় ছোট ছোট ঘাসের ফাঁকে কালো মাটি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই মাটিটাকে চেনা যাচ্ছে না আর। সেই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে চলে আসার দিন ও কুমালে করে লুকিয়ে একমুঠো মাটি এনে পেয়ারাগাছের তলায় রেখে দিয়েছিল। যখনই মন-খারাপ করত তখনই এসে মাটিটাকে দেখত, মাটিটা দেখা মানে স্বৰ্গছেঁড়াকে দেখা। তারপর একসময় ভুলে গিয়েছিল সেই মাটির কথা। এতদিন ধরে কত বৃষ্টি গেল, প্রতি বছরের বা গেল। এখন আর কাউকে আলাদা করে চেনা যাবে না। মাটিদের চেহারা কেমন এক হয়ে যায়। মামাদের মা নাই, বাপ নাই, আমাদের জন্মভূমি আছে। চিঠিটা পকেটে রাখতে অনি ঠিক করল এখন ও স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবে না।

এবারও অনি ভালো রেজাল্ট করে নতুন ক্লাসে উঠল। তবে প্রথম তিনজনের মধ্যে ও জায়গা পাচ্ছে না, সরিৎশেখর ওর প্রগ্রেস রিপোর্ট দেখেছেন, অঙ্কে ও খুব কম নম্বর পাচ্ছে। মহীতোষ চাইছেন, স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাইকে বাড়িতে শিক্ষক হিসেবে রাখতে, কিন্তু অনির এক গোঁ-নতুন স্যার ছাড়া ও কারও কাছে পড়বে না। সরিৎশেখর নতুন স্যার নিশীথ সেনের সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছেন। ভদ্রলোক বাংলার শিক্ষক, টিউশনি করেন না, তা ছাড়া ইদানীং জলপাইগুড়ির একটি দলের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগের কথা সবাই জানে। নিজে সারাজীবন কংগ্রেসকে সমর্থন করেছেন সরিৎশেখর, কিন্তু সেট দূর থেকে। জলপাইগুড়িতে আসার পর সকাল-বিকাল বাইরে বেরিয়ে স্থানীয় নেতাদের যে চেহারা দেখেছেন তাতে এখানকার পলিটিকস ঠিক কী জিনিস তিনি বুঝতে পারছেন না। এই সেদিন বাজারে যাবার সময় দিনবাজার পোস্টঅফিসের সামনে দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি দেখা, দুজনেই খদ্দর পরেছেন, একজনের মাথায় গান্ধীটুপি। টুপিহীন লোকটিকে যেন কোথায় দেখেছেন একথা মনে হতে ওরা এসে তার সঙ্গে আলাপ করলেন। টুপি-পরা লোকটি বললেন, নমস্কার, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।

সরিৎশেখর বললেন, আমার কাছে?

হ্যাঁ। আপনি তো স্বৰ্গছেঁড়া টি-এস্টেটের বড়বাবু?

একদিন ছিলাম।

আপনি আমাকে চেনেন না। আমি বনবিহারী সেন, মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনের সময় কংগ্রেসের হয়ে আপনার কাছেই দাবি জানাতে যেতাম, হা হা হ্যাঁ। প্রাণ খুলে হাঁসলেন ভদ্রলোক।

দাবি কেন বলছেন, কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া আমাদের কর্তব্য। সরিৎশেখর খুব সৎ গলায় বললেন।

ভালো ভালো। কিন্তু জানেন, এত কষ্টে স্বাধীনতা এনে দিলাম তবু দেশের লোকজন আমাদের প্রাপ্য সম্মানটা দিতে চায় না। আচ্ছা, আপনার একটি ছেলে শুনেছি কমিউনিস্ট, কী নাম যেন

বনবিহারীবাবু পাশের লোকটির দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, প্রিয়তোষ।

বনবিহারীবাবু ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ, সে ফিরেছে। পুলিশ কিন্তু ওয়ারেন্ট উইথড্র করে নিয়েছে। আসলে আমরা কারও সঙ্গে শক্তভাবে থাকতে চাই না। ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

সরিৎশেখর বললেন, এ-ছেলের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে উষ্ণু গলায় বনবিহারীবাবু চিৎকার করে উঠলেন, এই তো, এই যে আদর্শের কথা বললেন সমস্ত দেশবাসীর তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আপনার মতো লোকই তো এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। হ্যাঁ, আপনার কাছে কেন যাচ্ছিলাম, বলি।

পাশের লোকটি বললেন, এসব কথা ওঁর বাড়িতে গিয়ে বললে হত না?

বনবিহারীবাবু ঘাড় নাড়লেন, আরে না না হল ধর, ইনি হরেন আমাদের ঘরের লোক, এর সঙ্গে অত ভদ্রতা না করলেও চলবে। হ্যাঁ, সরিৎবাবু, আপনি তো জানেন ছাব্বিশে জানুয়ারি আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস। তা এই দিনটিকে সার্থক করে তোলার জন্য আমরা একটা বিরাট পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। চাঁদমারির মাঠে ঐতিহাসিক জমায়েত হবে, কলকাতা থেকে নেতারা আসবেন, কিন্তু আমাদের স্থানীয় অফিসে বসে এতবড় ব্যাপারটা অর্গানাইজ করা যাবে না। আমাদের ইচ্ছা আপনার বিরাট বাড়িটা তো পড়েই আছে, ওটা আমরা সাময়িকভাবে অফিস হিসেবে ব্যবহার করি। আপনি কী বলেন?

থতমত হয়ে গেলেন সরিৎশেখর, কিন্তু আমার বাড়ি তো খুব বড় নয়। তা ছাড়া, বাড়ি ভাড়ার কথা–।

আমি জানি আপনি ভাড়া দেবেন না, আর সেটা দিয়ে আপনাকে অপমান করব না। আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। প্রকৃত দেশসেবী হিসেবে এটা আপনার কাছে নিশ্চয়ই আশা করতে পারি। বনবিহারীবাবু রুমালে নাক মুছলেন।

মুহূর্তেই সরিৎশেখর চিন্তা করে নিলেন। পার্টি অফিস করতে দিলে বাড়িটার হাল কয়েক দিনেই যা হবে অনুমান করা শক্ত নয়। এত সাধের তৈরি বাড়িতে পাঁচ ভূতে আড্ডা জমাবে, প্রাণ ধরে সহ্য। করতে পারবেন না তিনি। হোক সেটা কংগ্রেসের অফিস, এ-ব্যাপারে তাঁর কোনো দুর্বলতা নেই। এবাড়ি তার ছেলের মতো, অসময়ে দেখবে, তাকে বকে যেতে দিতে পারেন না তিনি। বনবিহারীবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না আমি অ্যাকটিভ পলিটিকস্ কোনোদিন করতাম না। তবে দূর থেকে কংগ্রেসকে সমর্থন করে এসেছি। আমার ভূমিকা আজও একই। আপনাদের এই প্রজাতন্ত্র দিবসের কর্মযজ্ঞে দূর থেকে সমর্থন জানিয়ে যাব। আচ্ছা, নমস্কার–।

সরিৎশেখরকে হাঁটতে দেখে বনবিহারীবাবু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন প্রথমটা, তারপর কোনোরকমে বললেন, কিন্তু আমি যে নিশীথের কাছে শুনেছিলাম–

ঘুরে দাঁড়ালেন সরিৎশেখর, কে নিশীথ?

জিলা স্কুলের চিটার নিশীথ সেন।

কী বলেছে সে?

নিশীথ বলল, আপনারা কংগ্রেসের সাপোর্টার। আপনার এক নাতি যে জেলা স্কুলে পড়ে, সে নিশীথের কংগ্রেসিজমের প্রচণ্ড ভক্ত। নিশীথ তাকে গড়েপিঠে তৈরি করছে, তারও ই আপনার বাড়িতেই কংগ্রেস অফিস হোক। আমি কি তা ভুল রিপোর্টেড হলধর? তুমি তো সেই সাপ্লাইয়ারের কাজ করা থেকে সরিত্বাবুকে চেনা সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত বনবিহাববাবু প্রশ্নটা কলেন।

এতক্ষণে টুপিহীন লোকটিকে চিনতে পারলেন সরিৎশেখর। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের একজন ফায়ারউড সাপ্লায়ারের হয়ে এই লোকটি মাঝে-মাঝে অফিসে যেত। মাল না দিয়েও সাপ্লাই হয়েছে বলে চেষ্টা করার জন্য সাপ্লায়ারে কন্ট্রাক্ট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সরিৎশেখর তখন শুনেছিলেন এই লোকটিই নাকি সেজন্য দায়ী। হলধর বলল, নিশীথ তো মিথ্যে কথা বলবে না আপনাকে।

সরিৎশেখর হাসলেন, আমার নাতিকে আমার চেয়ে সেই ভদ্রলোক দেখছি বেশি চিনে গেছেন। ভালো ভালো। আচ্ছা চলি। আর দাঁড়ালেন না তিনি।

বাজার থেকে ফিরে সরিৎশেখর সোজা অনির ঘরে এলেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসে অনি, সরিৎশেখর ঘর দেখে খুশি হলেন। নিজের জামাকাপড় ও নিজেই কাছে, হেমলতা ইস্ত্রি করে দেন। কিন্তু বই-এর টেবিল দেখে বিরক্ত হলেন সরিৎশেখর, সব স্তুপ হয়ে পড়ে আছে। পড়ার টেবিলে বসে অনি তখন ছবি আঁকছিল, দাদুকে দেখে সেটা চাপা দিল। সচরাচর এই ঘরে সরিৎশেখর আসেন না, দরকারে অনিই তার কাছে যায়।

সরিৎশেখর বললেন, নতুন বইগুলোর এই অবস্থা কেন, সাজিয়ে রাখতে পার না? বুকলিস্ট পাবার পর সদ্য কেনা হয়েছে বইগুলো। ওর ওপর একটা পুরনো বই দেখে হাতে তুলে নিলেন সরিৎশেখর, বঙ্কিমবাবুর আনন্দমঠ। পাতা উলটে দেখলেন, বেশির ভাগ জায়গায় লাল পেন্সিলে আন্ডারলাইন করা আছে। নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি, এই বই কোথায় পেলে?

অনি বলল, নতুন স্যারের কাছ থেকে এনেছি।

পড়েছ?

ঘাড় নাড়ল অনি, যা, আমার অনেকটা মুখস্থ হয়ে গেছে। ধরবে?

কেন মুখস্থ করলে?

প্রশ্নটা যেন আশা করেনি অনি, একটু থেমে বলল, আমার ভালো লাগে।

নাতির দিকে ভালো করে তাকারেন সরিৎশেখর। হঠাৎ ওঁর মনে হল অনি আর সেই ছোটটি নেই। জলপড়া গাছের মতো হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে অনেকখানি উঠে এসেছে। প্রতিদিন দেখতে দেখতে এই বড়-হয়ে-ওঠা ব্যাপারটা তিনি টের পাননি। এমনকি গলার স্বর পর্যন্ত পালটে যাচ্ছে ওর।

সরিৎশেখর বললেন, নতুন স্যার তোমাকে কী বলেছেন একটু শুনি।

অনি দাদুর দিকে তাকাল, কী কথা?

সরিৎশেখর বললেন, এই দেশের কথা, কংগ্রেসের কথা।

অনি হাসল, নতুন স্যার আমাকে খুব ভালোবাসেন দাদু। বলেন, তোমার মতো সিরিয়াস ছেলে এই স্কুলে আর কেউ নেই।

সরিৎশেখর বললেন, আচ্ছা! খুব ভালো।

অনি যেন উজ্জীবিত হল কথাটা শুনে, পরিশ্রম, আত্মদান আর ইতিহাস ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে না। আমাদের এই দেশ স্বাধীন হয়েছে একমাত্র কংগ্রেসের ওইসব গুণ চিল বলে। তা ছাড়া যে-কোনো জাতির যদি উপযুক্ত নেতা না থাকে সে-জাতি দেশ শাসন করতে পারে না। আমাদের পণ্ডিত নেহরু হলেন সেইরকম এক নেতা।

চোখ বন্ধ করলেন সরিৎশেখর। কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। এখন রাস্তাঘাটে যেসব ছেলেকে দেখেন তাদের থেকে অনি আলাদা। কিন্তু ওর নিশীথ সেন এইসব ব্যাপার ওর মাথায় ঢুকিয়ে ভালো করছে না খারাপ কমছে বোঝা যাচ্ছে না।

তুমি কি নতুন স্যারকে বলেছ যে, এই বাড়িতে কংগ্রেস অফিস হলে আমার আপত্তি হবে না? গীর গলায় প্রশ্নটা করলেন তিনি।

দাদুর গলার স্বর শুনে অনি চট করে মাথাটা নিচু করে ফেলল। নতুন স্যার যখন বলেছিলেন, ছাব্বিশে জানুয়ারি প্রিপারেশনের জন্য বড় বাড়ি চাই তখন ও এই কথাটা বলেছিল। তাদের বাড়িতে কংগ্রেস অফিস হরে বড় বড় নেতা এখানে আসবেন, তাদের দেখতে পাবে অনি-এটা ভাবতেই কেমন লাগছিল। খুব সন্তর্পণ মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ।

সরিৎশেখর এতটা আশা করেননি। তাঁর খুব বিশ্বাস ছিল নিশীথ সেন নিয়ে বানিয়ে কথাটা বলছে। হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল ওর, গলা চড়িয়ে বললেন, কিসে আমার আপত্তি আছে আর কিসে নেই-একথা তুমি জানলে কী করে?

দাদুর গলা সমস্ত ঘরে গমগম করছে এখন। খুব অবাক হয়ে অনি দাদুর দিকে তাকাল। এইরকম মুখ নিয়ে দাদ কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলেননি। অসহায় ভঙ্গিতে ও বলল, কিন্তু তুমি তো কংগ্রেসি। দেশবন্ধু, সুভাষ বোস, মহাত্মা গান্ধীর কথা তুমি তো বলতে। তাই আমি ভাবলাম

হঠাৎ হাত বাড়িয়ে নাতির কান ধরলেন সরিৎশেখর। উত্তেজনায় তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপছিল, ভীষণ পেকে গেছ তুমি। আমি কংগ্রেসি তোমাকে কখনো বলেছি। মহাত্মা গান্ধী একসময় কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুভাষ বোসকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এসব খবর নতুন স্যার বলেছে টকটকে লাল কানটাকে এবার ছেড়ে দিরেন সরিৎশেখর, মানুষের ইতিহাস দিয়ে মানুষকে বিচার করি না। আমি, একটা মানুষ কীরকর্ম সেটা তার বর্তমান দেখেই বোঝা যায়। স্বাধীনতার আগে আমরা যা ছিলাম, এই তো তিন বছর চলে গেল প্রায়, কতটুকু এগিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস দেশটাকে? শেষের কথাটা নাতিকে ধমকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

কানের ব্যথায় এবং সহসা দাদুর এই নতুন চেহারাটা দেখতে পেয়ে অনি কেঁদে ফেলল এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল, নতুন স্যার বলেছেন রাতারাতি দেশ তৈরি যায় না।

পঁচিশ বছরেও পারবে না। সব নিজের পকেট ভরার ধান্ধায় রয়েছে, দেশটা উচ্ছনে গেলে ওদের লাভ! সে-কংগ্রেস আর এই কংগ্রেস এক নয়। আটচল্লিশ সালের তিরিশে জানুয়ারি গান্ধীজির সঙ্গে সে-কংগ্রেস মরে গেছে। এতক্ষণে সরিৎশেখরের খেয়াল হল একটি নাবালকের কাছে এসব কী বলে যাচ্ছেন! বিদ্যাসাগরি চটিতে শব্দ করে বেরিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। ঘুরে নাতির দিকে তাকালেন। অনি এখন কাঁদছে না, হাঁ করে দাদুর দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল সরিৎশেখরের। জীবনে এই প্রথম তিনি অনির গায়ে হাত দিলেন। তার সারাজীবনে অনেক কঠোর কাজ তিনি করেছেন, কিন্তু এই নীতির ব্যাপারে তার মনের ভেতর যে-দুর্বলতা ওর জন্মমুহূর্ত থেকে এসেছিল তাকে সরাতে পারেননি কখনো। কিন্তু আজ যখন শুনলেন কে এক নিশীথ সেন ওকে গড়েপিটে তৈরি করছে তখন থেকে বুকের মধ্যে অভূত একটা ঈর্ষা বোধ করতে শুরু করেছেন তিনি। ছোট ছেলেরটা কখন তার অজান্তে রাজনীতির মধ্যে ঝাঁপিয়ে এখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর। ভবিষ্যৎ কী তিনি জানেন না। সে-রাজনীতি ব্যক্তিগতভাবে তিনি অপছন্দ করেন। কিন্তু সেটাও তাকে খুব বড় আঘাত দেয়নি। সহ্য হয়ে গেছে একসময়। এখন এই ছোট্ট কাদার তালটাকে যদি কেউ রাজনীতির আগুনে সেঁকে, তা হলে সহ্য করতে কষ্ট হবে বইকী।

অনির কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। আস্তে করে দুহাতে মুখটা ধরলেন, দাদু, তুমি তো এখন অনেক চোট, এসব কথা তোমার ভাববার সময় নয়। এখন তোমার কর্তব্য অধ্যয়ন করা। নিজের দেশের ইতিহাস পড়ে দেশকে প্রথমে জান, তারপর বড় হয়ে নিজের চোখে তার সঙ্গে দেশকে মিলিয়ে নিয়ে তবে স্থির করবে এসব করবে কি না।

অনি দাদুর এই পরিবর্তনে খুব খুশি হতে পারছিল না। সামনের দিকে মুখ তুলে সে বলল, কিন্তু নতুন স্যার বলেন, আমাদের কোনো ইতিহাস নেই। যা আছে তা ইংরেজদের লেখা।

সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সরিৎশেখর। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, শোনো, আমি চাই তুমি এসবের মধ্যে থাক। দাদুভাই, একটা কথা চিরকাল মনে রেখো, নিজে উপযুক্ত না হলে কোনো জিনিস গ্রহণ করা যায় না। আমি চাই তুমি ফার্স্ট ডিভিশন স্কুল থেকে বেরুবে। তার আগে তোমাক এসব কথা বলতে যেন না শুনি। আর হ্যাঁ, ওই নতুন স্যারের সঙ্গে বেশি মেলামেশা না। করলেই ভালো। সামনের মাস থেকে তোমাদের অঙ্কের মাস্টার বাড়িতে পড়াতে আসবেন।

হনহন করে বেরিয়ে যেতে-যেতে সরিৎশেখরের নিজেরই মনে হল, তিনি বৃথা এই শব্দগুলো ব্যবহার করলেন। বঙ্কিমাবাবু ঠিকই বলেছেন, এ যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবে কে? কিন্তু সেই তরঙ্গটাকে এরা দশ বছর বয়সেই চাপিয়ে দিল যে।

বন্দেমাতরম্ জেলা স্কুলের বিরাট মাঠ জুড়ে চিৎকারটা উঠে সমস্ত আকাশ ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় সাড়ে চারশ ছেলে তিনটে লাইনে ভাগে ভাগে মাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। প্রথম দিকে স্কাউটরা, পরে সমস্ত স্কুল। একটু আগে হেডমাস্টারমশাই ছাব্বিশে জানুয়ারির পতাকাটা তুললেন। লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে অনির মনে পড়ছিল স্বৰ্গছেঁড়ার কথা। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট পতাকা তোলার সময় তার কী অবস্থাটাই না হয়েছিল। প্রত্যেকটা ক্লাসের ছেলেদের সামনে একজন করে লিডার দাঁড়িয়ে। নতুন স্যার অনিকে ওর ক্লাসের লিডার ঠিক করেছেন। এই নিয়ে রিহার্সালের সময় থেকে মণ্টু ওর পেছনে লেগে আছে, নেহাত নতুন স্যারের জন্য কিছু বলতে পারছে না। আজকেও একটু আগে লাইনের দাঁড়িয়ে নেতাজির পিয়াজি বলে খেপাচ্ছিল। যেহেতু সে লিডার তাই মুখটা সামনে ফেরানো, ফলে মটুকে কিছু বলতে পারছে না। বন্দেমাতরম্ ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ওর গায়ে সেই কাঁটাটা আবার ফিরে এল। এমনকি দাদু যে অনেক গম্ভীরমুখে আজকের মিছিলে যেতে পারমিশন দিয়েছেন-সেকথাটা ভুলে গিয়েছিল। আজকাল দাদু যেন কেমন হয়ে গিয়েছেন।

হেডমাস্টারমশাই-এর বক্তৃতার পর নতুন স্যার মঞ্চে উঠলেন, এবার আমরা সবাই সুশৃখলভাবে মার্চ করে চাঁদামারির মাঠে যাব। তোমরা জান নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে বিশিষ্ট নেতারা সব সেখানে এসেছেন। তা ছাড়া সরকারের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত আছেন। আমরা স্কুলের তরফ থেকে সেই ঐতিহাসিক জমায়েতে যোগ দিয়ে পবিত্র কর্তব্য পালন করব।

স্কুলের সমস্ত মাস্টারমশাই এমনকি ওদের পাগল ড্রইং-স্যার অবধি সামনে হাঁটতে লাগলেন। সাড়ে চারশো ছেলে ভাগে ভাগে মাঠ ছেড়ে রাস্তায় নামল মার্চ করতে করতে। অনি একবার দেখতে পেল ক্লাস টেনের অরুণদার হাতে বিরাট জাতীয় পতাকাটা উড়ছে। অত বড় পতাকা নিয়ে অনি কখনোই সোজা হয়ে হাঁটতে পারত না। অরুণদাকে খুব হিংসে হচ্ছিল ওর।

রাস্তায় পড়তেই গান শুরু হল। চল-চল-চল, উধ্ব গগনে বাজে মাদল। তালে তালে, এতদিনের রিহার্সাল মনে রেখে যখন সবাই গাইতে গাইতে পা ফেলছে তখন মানুষজন অবাক হয়ে ওদের দেখতে লাগল। টাউন ক্লাব মাঠের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ও দেখল রাস্তার দুপাশে ভিড়ের মধ্যে সরিৎশেখর দাঁড়িয়ে আছেন লাঠি-হাতে। হঠাৎ দাদুকে ভীষণ বুড়ো বলে মনে হল ওর। চোখচোখি হতে দাদু মাথা নেড়ে হাসলেন। তখন দ্বিতীয় গানের মাঝামাঝি জায়গায় এসে গিয়েছে। অনি দাদুর দিকে চেয়ে লাইনটা সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইল সপ্তকোটিকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে দ্বিসপ্তকোটিভুজৈধৃত-করকরলে অবলা কেন মা এত বলে।

করলা নদীর কাঠের পুলটা পেরিয়ে পোস্টঅফিসের সামনে দিয়ে ওদের মিছিলটা এঁকেবেঁকে গাইতে গাইতে এগোতেই ওরা দেখতে পেল এফ. ডি. আই. থেকে ছেলেরা বেরুচ্ছে। এফ. ডি. আই-এর সঙ্গে জেলা স্কুলের চিরকালের প্রতিদ্বন্দিতা, খেলাধুলায় ওদের কাছে হেরে গেলেও পড়াশুনায় জেলা স্কুল ওদের থেকে এগিয়ে থাকে প্রতিবার। এফ. ডি. আই-এর ছেলেদের দেখে চিকারটা যেন হঠাত্ব বেড়ে গেল। হঠাৎ মণ্ট চেঁচিয়ে বলল, অনিমেষ, ওদের রাস্তা ছাড়িস না, আমরা আড়ে বেরিয়ে যাব। ওদের রাস্তা জুড়ে চলতে দেখে অসহায় হয়ে এফ. ডি. আই.-এর ছেলেরা অপেক্ষা করতে লাগল।

চাঁদমারির মাঠে তিলধারণের জায়গা নেই। সামনের দিকে ওরা যেতে পারল না। স্কাউট ড্রিল-স্যারের সঙ্গে অন্যদিকে চলে গেল। পুলিশ, স্কাউট, গার্লস গাইড পতাকাকে অভিবাদন জানাল। চাঁদমারি গায়ে বিরাট মঞ্চ তৈরি হয়েছে। মণ্টু বলল, চল সামনে যাই, এখান থেকে কিছুই দেখতে পাব না। ভিড় ঠেলে সামনে যাওয়া সোজা কথা নয়, অনির মাঝে-মাঝে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ভিড়ের চাপে। শেষ পর্যন্ত ওরা একদম মঞ্চের সামনে যখন এসে দাঁড়াল তখন সমস্ত শরীর এই শেষ-জানুয়ারি সকালেও প্রায় ঘেমে উঠেছে। অনি দেখল বিরাট মঞ্চের ওপর নেতারা বসে আছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন বিরাট লোক, যার ছবি প্রায়ই কাগজে বের হয়, অনি তাকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পাশেই পুলিশ ব্যান্ডে ধনধান্যেপুষ্পেভরা বাজছে। মণ্টু বলল, আমি এরকম কখনো দেখিনি।

অনি হাসল, কী করে দেখবি, প্রজাতন্ত্র দিবস তো এর আগে আসেনি।

একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। প্রথমে পায়ে পায়ে বিরাট পুলিশবাহিনী:মার্চ করে এসে পতাকাকে স্যালুট করে গেল। পেছনের ব্যান্ডের তালে তালে ওদের পা পড়ছিল। স্কাউট আর গার্লস গাউডদের যবার সময় মাঝে-মাঝে হাসি শোনা যাচ্ছে জনতার মধ্যে থেকে। একটি মোটা মেয়ে ঠিক সোজা বিরাট ব্যক্তিটি কপালে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন তখন থেকে। অনি বুঝতে পারছিল ওঁর হাত ব্যথা করছে। এর পরেই বন্দে-এ-এ মাতরম্ ধ্বনি দিতে দিতে কংগ্রেসের ফ্ল্যাগ নিয়ে নেতারা এগিয়ে এলেন অভিবাদন জানাতে। সেই চিৎকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জনতার মধ্যে কেউ-কেউ বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিল। অনির সমস্ত শরীর এখন অদ্ভুত উত্তেজনা তিরতির করে ওঠানামা করছে। আর সেই সময় ঘটে গেল ব্যাপারটা।

কংগ্রেসের লোকজন যখন প্রায় মঞ্চের সামনে এসে পড়েছেন ঠিক তখনই আট-নটি যুবক দৌড়ে জনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে মঞ্চের কাছাকাছি চলে গেল। ওদের হোটার ভঙ্গিতে এমন একটা তৎপরতা ছিল যে জনতা এমনকি মার্চ-করে-আসা কংগ্রেসিরাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনি শুনল ওরা পাগলের মতো হাত নেড়ে চিষ্কার করছে, ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। এ আজাদি-ঝুটা হ্যায়। প্রথম কথাটার মানে অনি বুঝতে পারছিল না। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের ওপর শোরগোল পড়ে গেল। হঠাৎই অজস্র পুলিশ এসে ওদের ঘিরে ফেলল। ওরা তখনও সামনে চেঁচিয়ে যাচ্ছে-ইনকিলাব জিন্দাবাদ। অনি বিস্ময়ে ওদের দেখছিল। পুলিশ লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু ওরা যাচ্ছে না কিছুতেই। ঠিক সেই সময় কংগ্রেসিরাও ধ্বনি তুলল-বন্দেমাতরম্। এদেরও গলার জোর যেন হঠাৎ বেড়ে গেল, ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। তার পরই অনির সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ও দেখল নির্দয়ভাবে পুলিশের লাঠি লোকগলোর ওপর পড়ছে। যন্ত্রণায় চিষ্কার করতে করতে ওরা মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আর সেই জটলা থেকে একপাটি জুতোশা করে তীরের মতো আকাশে উঠে মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো পেছনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। মঞ্চের সবাই এসে তাকে ঘিলে ধরেছেন। একজন লোক, বোধহয় ডাক্তার, ব্যাগ হাতে ছুটে এলেন।

এতক্ষণে পুলিশ ওদের সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। একটা বড় গাড়িতে ওদের তুলে পুলিশরা শহরে চলে গেল।

এখন একটা থিতনো ভাব চারধারে। কেউ কোনো কথা বলছে না। জনতার কেউ-কেউ উসখুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে। অবস্থা স্বাভাবিক করতে থেমে-দাঁড়ানো কংগ্রেসিরা আবার বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিতে দিতে চলে গেলেন। মঞ্চের ওপর তখনও সবাই ওই নেতাকে নিয়ে ব্যস্ত কংগ্রেসিদের এই যাওয়াটায় কারও মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হল না।

মণ্টু বলল, চল, আমরা পালিয়ে যাই।

অনিমেষ বলল, কেন?

মণ্টু চাপা গলায় বলল, মারামারি হতে পারে। বলে ছু দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওদের ক্লাসের কয়েকজন ওর পেছন ধরল। অনি দৌড়তে গিয়ে হঠাৎ কী মনে হতে না দৌড়ে হাঁটতে লাগল জনতার মধ্যে দিয়ে। আসবার সময় মানুষ–ঠাসা হয়ে ছিল মাঠটা, এখন কেমন ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে গেছে, হাঁটতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ মানে কী? অনি হাটহাঁটতে ভাবছিল। এই ধ্বনি এর আগে শোনননি সে। কথাটা কি বাংলা নতুন স্যার বলেন, ইংরেজ পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেও কংগ্রেসি বন্দেমাতরম্ ধ্বনি ছাড়েনি। এরাও তো আজ পুলিশে মার খেয়েও ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলেছে। কেন? এখন তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ওরা তবে কী বলতে চায়? কেন ওরা মারকেও ভয় করে না? হঠাই ওর ছোটকাকা প্রিয়তোষের কথা মনে পড়ে গেল। এই লোকগুলো কি ছোটকাকার দলের? ছোটকাকা কোথায় চলে গেছে। পিসিমা বলতেন পুলিশের ভয়ে প্রিয় আসে না। কেন পুলিশকে ভয় করবে? এখন তো সবাই বন্দেমাতরমের পুলিশ। অনির বকের মধ্যে আজকের মার-খাওয়া ছেলেগুলোর জন্যে একটু মমতা জমছিল। কেন কংগ্রেসিরা পুলিশদের নিষেধ করল না মারতে? ওরা তো প্রথমে কোনো অন্যায় করেনি, পরে অবশ্য জুতো ছুড়েছিল। ইনকিলাব জিন্দাবাদের মানেটা জানবার জন্য অনি নতুন স্যারকে খুঁজতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *